সূরা আন নিসাঃ ২৪তম রুকু(১৭২-১৭৬)আয়াত

 সূরা আন নিসাঃ ২৪তম রুকু(১৭২-১৭৬)আয়াত

আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতোয়ানির রজিম

৪:১৭২ لَنۡ یَّسۡتَنۡکِفَ الۡمَسِیۡحُ اَنۡ یَّکُوۡنَ عَبۡدًا لِّلّٰهِ وَ لَا الۡمَلٰٓئِکَۃُ الۡمُقَرَّبُوۡنَ ؕ وَ مَنۡ یَّسۡتَنۡکِفۡ عَنۡ عِبَادَتِهٖ وَ یَسۡتَکۡبِرۡ فَسَیَحۡشُرُهُمۡ اِلَیۡهِ جَمِیۡعًا

মসীহ আল্লাহ্‌র বান্দা হওয়াকে কখনো হেয় মনে করেন না, এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাগণও করে না। আর কেউ তাঁর ইবাদতকে হেয় জ্ঞান করলে এবং অহংকার করলে তিনি অচিরেই তাদের সবাইকে তাঁর কাছে একত্র করবেন।

ঈসা আলাইহিস সালাম স্বয়ং এবং আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভকারী ফিরিশতাগণ কখনো আল্লাহর বান্দারূপে পরিচিত হতে লজ্জা বা অপমান বোধ করেন না। কারণ, আল্লাহর দাসত্ব ও গোলামী করা, তার ইবাদাত-বন্দেগী করা, আদেশ-নিষেধ পালন করা অতি মর্যাদা, গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয়। ঈসা মসীহ আলাইহিস সালাম ও জিবরীল আলাইহিস সালাম প্রমূখ বিশিষ্ট ফিরিশতাগণ এ সম্পর্কে উত্তমরূপে অবহিত রয়েছেন। তাই এতে তাদের কোন লজ্জা নেই। আসলে আল্লাহ তা’আলা ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব বা গোলামী করাই লজ্জা বা অমর্যাদার কাজ। যেমন, নাসারারা ঈসা মসীহ ‘আলাইহিস সালাম-কে আল্লাহর পুত্র ও অন্যতম উপাস্য সাব্যস্ত করেছে এবং মুশরিকরা ফিরিশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা ও দেবী সাব্যস্ত করে তাদের মূর্তি তৈরী করে পূজা-আৰ্চনা শুরু করেছে। অতএব, তাদের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তি ও অপমান অবধারিত রয়েছে।

পক্ষান্তরে যারা সঠিকভাবে ঈমান আনবে এবং একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে বক্তি এ সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর সত্য কোন মা’বুদ নেই। তিনি এক এবং তার কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল আর ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল এবং সে কালেমা যা তিনি মারইয়াম আলাইহাস সালাম-এর মধ্যে পৌছিয়েছেন এবং তার পক্ষ থেকে রূহ বিশেষ। আর এও ঈমান আনে যে, জান্নাত সত্য ও জাহান্নাম সত্য। তার আমল যা-ই হোক না কেন, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। [বুখারীঃ ৩৪৩৫]

কিবিরের আভিধানিক অর্থ:

আল্লামা ইবন ফারেস রহ. বলেন, কিবির অর্থ: বড়ত্ব, বড়াই, অহংকার ইত্যাদি.

ইস্তেকবার শব্দটির অর্থ হলো, বড়ত্ব, দাম্ভিক ও অহমিকা. লিসানুল আরব ১২৫/৫০

ইসলামী পরিভাষায় কিবিরের সংজ্ঞা:

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই স্বীয় হাদীসে কিবিরের সংজ্ঞা বর্ণনা করেন।

আব্দুল্লাহ ইবন মাসুদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«لا يْدخُلُ الجَنةََّ مَنْ كَانَ فِي قَلْبهِِ مِثْقَالُ ذَرَّةٍ مِنْ كبِرٍ قَالَ رَجُلٌ: إِنَّ الرَّجُلَ يُحبُِّ أَنْ يَكُونَ ثَوْبُهُ حسَنًا، وَنْعُلُه حَسَنَةً. قَالَ: إِنَّ الله جَميِلٌ يُحبُ الجَمَالَ، الْكبِر بَطَرُ الحَقِّ، وَغَمْطُ الناَّسِ»

“যার অন্তরে একটি অণু পরিমাণ অহংকার থাকে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বললে, এক লোক দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোনো কোনো লোক এমন আছে, সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর তা‘আলা নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। (সুন্দুর কাপড় পরিধান করা অহংকার নয়) অহংকার হলো, সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট বলে জানা।সহীহ মুসলিম: ৯১।

এ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি অংশে অহংকারের সংজ্ঞা তুলে ধরেন।

হককে অস্বীকার করা, হককে কবুল না করে তার প্রতি অবজ্ঞা করা এবং হক কবুল করা হতে বিরত থাকা। বর্তমান সমাজে আমরা অধিকাংশ মানুষকে দেখতে পাই, যখন তাদের নিকট এমন কোনো লোক হকের দাওয়া নিয়ে আসে, যে বয়স বা সম্মানের দিক দিয়ে তার থেকে ছোট, তখন সে তার কথার প্রতি কোনো প্রকার গুরুত্ব দেয় না। আর তা যদি তাদের মতামত অথবা তারা যা নির্ধারণ ও যার ওপর তারা আমল করছে, তার পরিপন্থী হয়, তখন তারা তা অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করে।

আর অধিকাংশ মানুষের স্বভাব হলো, যে লোকটি তাদের নিকট দাওয়াত নিয়ে আসবে, তাকে ছোট মনে করবে এবং তার বিরোধিতায় অটল ও অবিচল থাকবে, যদিও কল্যাণ নিহিত থাকে সত্য ও হকের আনুগত্যের মধ্যে এবং তারা যে অন্যায়ের অপর অটুট রয়েছে, তাতে তাদের ক্ষতি ছাড়া কোনোই কল্যাণ না থাকে। আমাদের সমাজে এ ধরনের লোকের অভাব নেই। বিশেষ করে ছোট পরিসরে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটতে থাকে। যেমন, পরিবার, স্কুল মাদ্রাসায়, অফিস আদালত ও বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা নিত্যদিন ঘটে থাকে।

অহংকারীরা যে বিষয়টির আশংকা করে অপর থেকে সত্যকে গ্রহণ করে না, তা হলো, সে যদি অপর ব্যক্তি থেকে প্রমাণিত সত্যকে গ্রহণ করে, তাকে মানুষ সম্মান দেবে না, মানুষ অপর লোকটিকে সম্মান দেবে। তখন সম্মান অপরের হাতে চলে যাবে এবং সেই মানুষের সামনে বড় ও সম্মানী লোক হিসেবে বিবেচিত হবে, অহংকারীকে কেউ সম্মান করবে না। এ কারণেই সে কাউকে মেনে নিতে পারে না, সে মনে করে সত্যকে গ্রহণ করলে তার সম্মান নিয়ে টানাটানি হবে এবং মানুষ তার প্রতি আর আকৃষ্ট হবে না। মানুষ সে লোকটিকেই বড় মনে করবে এবং তাকেই মানবে। আর বাধ্য হয়ে অহংকারীকেও অপরের অনুসারী হতে হবে।

কিন্তু এ অহংকারী লোকটি যদি বুঝতে পারত, তার জন্য সত্যিকার ইজ্জত ও সম্মান হলো, হকের অনুসরণ ও আনুগত্য করার মধ্যে, বাতিলের মধ্যে ডুবে থাকাতে নয়, তা ছিল তার জন্য অধিক কল্যাণকর ও প্রশংসনীয়।

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট চিঠি লিখেন, তুমি গত কাল যে ফায়সালা দিয়েছিলে, তার মধ্যে তুমি চিন্তা ফিকির করে যখন সঠিক ও সত্য তার বিপরীতে পাও, তাহলে তা থেকে ফিরে আসাতে যেন তোমার নফস তোমাকে বাধা না দেয়। কারণ, সত্য চিরন্তন, সত্যের পথে ফিরে আসা বাতিলের মধ্যে সময় নষ্ট করার চেয়ে অনেক উত্তম। দারাকুতনী ২০৬/৪।

 

আব্দুর রহমান ইবন মাহদী রহ. বলেন, একদা আমরা একটি জানাযায় উপস্থিত হলাম, তাতে কাজী উবাইদুল্লাহ ইবনুল হাসান রহ. হাযির হলো। আমি তাকে একটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, সে ভুল উত্তর দেয়, আমি তাকে বললাম, আল্লাহ আপনাকে সংশোধন করে দিক, এ মাসআলার সঠিক উত্তর এভাবে…। তিনি কিছু সময় মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকলেন, তারপর মাথা উঠিয়ে বললেন, আমি আমার কথা থেকে ফিরে আসলাম, আমি লজ্জিত। সত্য গ্রহণ করে লেজ হওয়া আমার নিকট মিথ্যার মধ্যে থেকে মাথা হওয়ার চেয়ে অধিক উত্তম।

তারিখ বাগদাদ ৩০৭/১০। অন্তর বিধ্বংসী বিষয়সমূহ : অহংকার (মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ)

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, গুনাহের মৌলিক উপাদান তিনটি:

এক. অহংকার: অহংকারই অভিশপ্ত ইবলীশকে ধ্বংসে নিপতিত করে এবং করুণ পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।

দুই. লোভ: এ লোভই আদম ‘আলাইহিস সালামকে জান্নাত থেকে বের করে।

তিন. বিদ্বেষ: হিংসা-বিদ্বেষই আদম সন্তানদের একজনকে তার ভাইকে হত্যার প্রতি বাধ্য করে।

যে ব্যক্তি এ তিন অপরাধ থেকে মুক্ত থাকবে, সে যাবতীয় সব অন্যায় অপরাধ থেকে বেঁচে থাকবে। কুফুরীর উৎপত্তি অহংকার থেকে আর গুনাহের উৎপত্তি লোভ থেকে এবং অন্যায়, অনাচার ও জুলুমের উৎপত্তি হিংসা বিদ্বেষ থেকে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদের একটি সুস্পষ্ট ও বাস্তব দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, একজন মানুষকে কিসের ভিত্তিতে মূল্যায়ন ও অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং তাকে কিসের ভিত্তিতে অবমূল্যায়ন ও পিছনে ফেলে রাখা হবে। মানুষের মর্যাদা তার পোষাকে নয়, বরং মানুষের মর্যাদা, তার অন্তরনিহীত সততা, স্বচ্ছতা ও আল্লাহ-ভীতির ওপর নির্ভর করে। যার মধ্যে যতটুকু আল্লাহ-ভীতি থাকবে, সে তত বেশি সৎ ও উত্তম লোক হিসেবে বিবেচিত হবে।

“একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দিয়ে এক ব্যক্তি অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমবেত লোকদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে কি বল, তারা উত্তরে বলল, লোকটি যদি কাউকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার ডাকে সাড়া দেওয়া হয়, যদি কারো বিষয়ে সুপারিশ করে, তাহলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয়, আর যদি কোনো কথা বলে, তার কথা শোনা হয়। তাদের কথা শোনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুপ করে থাকেন। একটু পর অপর একজন দরিদ্র মুসলিম রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করে যাচ্ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে সাহাবীদের জিজ্ঞাসা করে বলেন, তোমরা এ লোকটি সম্পর্কে মতামত দাও! তারা বলল, যদি সে প্রস্তাব দেয়, তাহলে তার প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া হয় না, আর যদি সে কারো বিষয়ে সুপারিশ করে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না, আর যদি সে কোনো কথা বলে তার কথায় কান দেওয়া হয় না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ লোকটি যমিন ভরপুর যত কিছু আছে, তার সব কিছু হতে উত্তম।সহীহ বুখারী,৫০৯১।

যে সব অহংকারীকে তার অহংকার হকের অনুকরণ হতে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্ত

এক- ইবলিস:

অভিশপ্ত ইবলিসের কুফুরী করা ও আল্লাহর আদেশের অবাধ্য হওয়ার একমাত্র কারণ, তার অহংকার।

আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,

“তিনি বললেন, ‘স্মরণ কর, যখন তোমার রব ফিরিশতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমি মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করব। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তার মধ্যে আমার রূহ সঞ্চার করব, তখন তোমরা তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হয়ে যাও। ফলে ফিরিশতাগণ সকলেই সিজদাবনত হলো। ইবলীস ছাড়া, সে অহঙ্কার করল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ল। আল্লাহ বললেন, ‘হে ইবলীস, আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি তার প্রতি সাজদাবনত থেকে কিসে তোমাকে বাধা দিল? তুমি কি অহঙ্কার করলে, না তুমি অধিকতর উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন অগ্নি থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তিনি বললেন, তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। কেননা নিশ্চয় তুমি বিতাড়িত। আর নিশ্চয় বিচার দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার লা‘নত বলবৎ থাকবে। সে বলল, ‘হে আমার রব, আমাকে সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন যেদিন তারা পুনরুত্থিত হবে।’ তিনি বললেন, আচ্ছা তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হলে- ‘নির্ধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।’ সে বলল, ‘আপনার ইজ্জতের কসম! আমি তাদের সকলকেই বিপথগামী করে ছাড়ব।’ তাদের মধ্য থেকে আপনার একনিষ্ঠ বান্দারা ছাড়া। আল্লাহ বললেন, ‘এটি সত্য আর সত্য-ই আমি বলি’, তোমাকে দিয়ে এবং তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করত তাদের দিয়ে নিশ্চয় আমি জাহান্নাম পূর্ণ করব।’ বল, ‘এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না আর আমি ভানকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। সৃষ্টিকুলের জন্য এ তো উপদেশ ছাড়া আর কিছু নয়”। [সূরা সাদ, আয়াত: ৭১-৮৭]

দুই: ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা:

অনুরূপভাবে ফিরআউনের কুফুরী করার কারণ ছিল, তার অহংকার। আল্লাহ তা‘আলা তার বর্ণনা দিয়ে বলেন,

“আর ফির‘আউন বলল, ‘হে পারিষদবর্গ, আমি ছাড়া তোমাদের কোনো ইলাহ আছে বলে আমি জানি না। অতএব, হে হামান, আমার জন্য তুমি ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ তৈরী কর। যাতে আমি মূসার ইলাহকে দেখতে পাই। আর নিশ্চয় আমি মনে করি সে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত’। আর ফির‘আউন ও তার সেনাবাহিনী অন্যায়ভাবে যমীনে অহঙ্কার করেছিল এবং তারা মনে করেছিল যে, তাদেরকে আমার নিকট ফিরিয়ে আনা হবে না। অতঃপর আমরা তাকে ও তার সেনাবাহিনীকে পাকড়াও করলাম, তারপর তাদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করলাম। অতএব, দেখ যালিমদের পরিণাম কীরূপ হয়েছিল? আর আমরা তাদেরকে নেতা বানিয়েছিলাম, তারা জাহান্নামের দিকে আহ্বান করত এবং কিয়ামতের দিন তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এ যমীনে আমি তাদের পিছনে অভিসম্পাত লাগিয়ে দিয়েছি আর কয়ামতের দিন তারা হবে ঘৃণিতদের অন্তর্ভুক্ত”। [সূরা কাসাস, আয়াত: ৩৮-৪২]

তিন: সালেহ ‘আলাইহিস সালামের কাওম, সামুদ গোত্র:

সামুদ গোত্রের কুফুরীর কারণও একই। অর্থাৎ তাদের অহংকার। আল্লাহ তা’আলা বলেন,

﴿قَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِينَ ٱسۡتَكۡبَرُواْ مِن قَوۡمِهِۦ لِلَّذِينَ ٱسۡتُضۡعِفُواْ لِمَنۡ ءَامَنَ مِنۡهُمۡ أَتَعۡلَمُونَ أَنَّ صَٰلِحٗا مُّرۡسَلٞ مِّن رَّبِّهِۦۚ قَالُوٓاْ إِنَّا بِمَآ أُرۡسِلَ بِهِۦ مُؤۡمِنُونَ ٧٥ قَالَ ٱلَّذِينَ ٱسۡتَكۡبَرُوٓاْ إِنَّا بِٱلَّذِيٓ ءَامَنتُم بِهِۦ كَٰفِرُونَ﴾ [الأعراف: 75، 76[

“তার কাওমের অহঙ্কারী নেতৃবৃন্দ তাদের সেই মুমিনদেরকে বলল যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত, ‘তোমরা কি জান যে, সালিহ তার রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত’? তারা বলল, ‘নিশ্চয় সে যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছে, আমরা তাতে বিশ্বাসী’। যারা অহংকার করেছিল তারা বলল, ‘নিশ্চয় তোমরা যার প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তার প্রতি অস্বীকারকারী”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৭৫-৭৬]

চার: হূদ ‘আলাইহিস সালামের কাওম আদ সম্প্রদায়:

﴿فَأَمَّا عَادٞ فَٱسۡتَكۡبَرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَقَالُواْ مَنۡ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةًۖ أَوَ لَمۡ يَرَوۡاْ أَنَّ ٱللَّهَ ٱلَّذِي خَلَقَهُمۡ هُوَ أَشَدُّ مِنۡهُمۡ قُوَّةٗۖ وَكَانُواْ بِ‍َٔايَٰتِنَا يَجۡحَدُونَ ١٥ فَأَرۡسَلۡنَا عَلَيۡهِمۡ رِيحٗا صَرۡصَرٗا فِيٓ أَيَّامٖ نَّحِسَاتٖ لِّنُذِيقَهُمۡ عَذَابَ ٱلۡخِزۡيِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَعَذَابُ ٱلۡأٓخِرَةِ أَخۡزَىٰۖ وَهُمۡ لَا يُنصَرُونَ﴾ [فصلت: 15، 16]

“আর ‘আদ সম্প্রদায়, তারা যমীনে অযথা অহঙ্কার করত এবং বলত, ‘আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী কে আছে’? তবে কি তারা লক্ষ্য করে নি যে, নিশ্চয় আল্লাহ যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? আর তারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করত।

তারপর আমরা তাদের ওপর অশুভ দিনগুলোতে ঝঞ্ঝাবায়ু পাঠালাম যাতে তাদেরকে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনাদায়ক আযাব আস্বাদন করাতে পারি। আর আখিরাতের আযাব তো অধিকতর লাঞ্ছনাদায়ক এবং তাদেরকে সাহায্য করা হবে না।” [সূরা ফুসসলিাত, আয়াত: ১৫-১৬]

পাঁচ: শুয়াইব ‘আলাইহিস সালামের কাওম মাদায়েনের অধিবাসী:

আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন,

﴿قَالَ ٱلۡمَلَأُ ٱلَّذِينَ ٱسۡتَكۡبَرُواْ مِن قَوۡمِهِۦ لَنُخۡرِجَنَّكَ يَٰشُعَيۡبُ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مَعَكَ مِن قَرۡيَتِنَآ أَوۡ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَاۚ قَالَ أَوَلَوۡ كُنَّا كَٰرِهِينَ﴾ ]الأعراف: 88[

“তার কাওম থেকে যে নেতৃবৃন্দ অহঙ্কার করেছিল তারা বলল, ‘হে শু‘আইব, আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে অবশ্যই আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব অথবা তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসবে।’ সে বলল, ‘যদিও আমরা অপছন্দ করি তবুও?’ [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৮৮]

ছয়: নূহ ‘আলাইহিস সালামের কাওম:

﴿قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوۡتُ قَوۡمِي لَيۡلٗا وَنَهَارٗا ٥ فَلَمۡ يَزِدۡهُمۡ دُعَآءِيٓ إِلَّا فِرَارٗا ٦ وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوۡتُهُمۡ لِتَغۡفِرَ لَهُمۡ جَعَلُوٓاْ أَصَٰبِعَهُمۡ فِيٓ ءَاذَانِهِمۡ وَٱسۡتَغۡشَوۡاْ ثِيَابَهُمۡ وَأَصَرُّواْ وَٱسۡتَكۡبَرُواْ ٱسۡتِكۡبَارٗا ٧ ثُمَّ إِنِّي دَعَوۡتُهُمۡ جِهَارٗا ٨ ثُمَّ إِنِّيٓ أَعۡلَنتُ لَهُمۡ وَأَسۡرَرۡتُ لَهُمۡ إِسۡرَارٗا﴾ ]نوح: 5- 9[

“সে বলল, ‘হে আমার রব! আমি তো আমার কাওমকে রাত-দিন আহবান করেছি। ‘অতঃপর আমার আহ্বান কেবল তাদের পলায়নই বাড়িয়ে দিয়েছে’। ‘আর যখনই আমি তাদেরকে আহ্বান করেছি ‘যেন আপনি তাদেরকে ক্ষমা করেন’, তারা নিজদের কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছে, নিজদেরকে পোশাকে আবৃত করেছে, (অবাধ্যতায়) অনড় থেকেছে এবং দম্ভভরে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছে’। ‘তারপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে আহবান করেছি’। অতঃপর তাদেরকে আমি প্রকাশ্যে এবং অতি গোপনেও আহ্বান করেছি।” [সূরা নূহ, আয়াত: ৫-৯]

সাত. বনী ইসরাঈল:

“আর আমরা নিশ্চয় মূসাকে কিতাব দিয়েছি এবং তার পরে একের পর এক রাসূল প্রেরণ করেছি এবং মারইয়াম পুত্র ঈসাকে দিয়েছি সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ। আর তাকে শক্তিশালী করেছি ‘পবিত্র আত্মা’র মাধ্যমে। তবে কি তোমাদের নিকট যখনই কোনো রাসূল এমন কিছু নিয়ে এসেছে, যা তোমাদের মনঃপূত নয়, তখন তোমরা অহঙ্কার করেছ, অতঃপর (নবীদের) একদলকে তোমরা মিথ্যাবাদী বলেছ আর একদলকে হত্যা করেছ। আর তারা বলল, আমাদের অন্তরসমূহ আচ্ছাদিত; বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদেরকে লা‘নত করেছেন। অতঃপর তারা খুব কমই ঈমান আনে। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৮৭-৮৮]

আট. আরবের মুশরিকরা:

“আর তোমার পূর্বে যত নবী আমরা পাঠিয়েছি, তারা সবাই আহার করত এবং হাট-বাজারে চলাফেরা করত। আমি তোমাদের একজনকে অপরজনের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ করেছি। তোমরা কি ধৈর্যধারণ করবে? আর তোমার রব সর্বদ্রষ্টা। আর যারা আমার সাক্ষাৎ প্রত্যাশা করে না, তারা বলে, ‘আমাদের নিকট ফিরিশতা নাযিল হয় না কেন? অথবা আমরা আমাদের রবকে দেখতে পাই না কেন’? অবশ্যই তারা তো তাদের অন্তরে অহঙ্কার পোষণ করেছে এবং তারা গুরুতর সীমালংঘন করেছে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২০-২১]

৪:১৭৩ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ فَیُوَفِّیۡهِمۡ اُجُوۡرَهُمۡ وَ یَزِیۡدُهُمۡ مِّنۡ فَضۡلِهٖ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ اسۡتَنۡکَفُوۡا وَ اسۡتَکۡبَرُوۡا فَیُعَذِّبُهُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمًا ۬ۙ وَّ لَا یَجِدُوۡنَ لَهُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیۡرًا

অতঃপর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তিনি তাদেরকে পূর্ণ করে দিবেন তাদের পুরস্কার এবং নিজ অনুগ্রহে আরো বেশী দেবেন। আর যারা (আল্লাহ্‌র ইবাদত করা) হেয় জ্ঞান করেছে এবং অহংকার করেছে, তাদেরকে তিনি কষ্টদায়ক শাস্তি দেবেন। আর আল্লাহ্‌ ছাড়া তাদের জন্য তারা কোন অভিভাবক ও সহায় পাবে না।

উক্ত আয়াতে ‘বেশী দেওয়া’-এর ব্যাখ্যায় কতক উলামা বলেন, আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে সুপারিশ করার অনুমতি প্রদান করবেন এবং সুপারিশের অনুমতি পাওয়ার পর আল্লাহ যাদের ব্যাপারে অনুমতি দেবেন, তাঁরা শুধুমাত্র তাদের জন্যেই সুপারিশ করবেন। অর্থাৎ, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য থেকে বিরত থাকে এবং সে ব্যাপারে অস্বীকার ও অহংকার প্রদর্শন করে।

যেমন অন্যত্র বলেছেন, {إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ} অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা আল্লাহর ইবাদতে অস্বীকার ও অহংকার প্রদর্শন করে, তারা অচিরে লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে। (সূরা গাফির ৬০)

৪:১৭৪ یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ قَدۡ جَآءَکُمۡ بُرۡهَانٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکُمۡ نُوۡرًا مُّبِیۡنًا

হে লোকসকল! তোমাদের রবের কাছ থেকে তোমাদের কাছে প্রমাণ এসেছে এবং আমরা তোমাদের প্রতি স্পষ্ট জ্যোতি নাযিল করেছি।

বারাহা থেকে বুরহান যার অর্থ উজ্জ্বল,বিস্তৃত, আরেক ভাবে

برهان বলা হয় এমন অকাট্য ও স্পষ্ট প্রমাণকে যার পর আর কোন আপত্তি থাকার অবকাশ নেই এবং এমন অকাট্য প্রমাণ যার দ্বারা সন্দেহ নিরসন হয়

‘বুরহান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ অকাট্য দলীল-প্রমাণ। এ আয়াতে এর দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সত্তা ও মহান ব্যক্তিত্বকে বুঝানো হয়েছে।

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান ব্যক্তিত্বের জন্য ‘বুরহান’ শব্দ প্রয়োগ করার তাৎপর্য এই যে, তার বরকতময় সত্তা, অনুপম চরিত্র মাধুর্য, অপূর্ব মু’জিযাসমূহ, তার প্রতি বিস্ময়কর কিতাব আল-কুরআন নাযিল হওয়া ইত্যাদি তার রেসালাতের অকাট্য দলীল ও প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যার পরে আর কোন সাক্ষ্য প্রমাণের আবশ্যক হয় না। অতএব, তার মহান ব্যক্তিত্বই তার সত্যতার অকাট্য প্রমাণ।

আরেকভাবে অর্থ–

‘বুরহান’ কি?

لَوْلا أَن رَّآى بُرْهَانَ رَبِّهِ ‘যদি সে তার পালনকর্তার প্রমাণ না দেখত’ এ কথার মধ্যে কোন্ প্রমাণ ইউসুফকে দেখানো হয়েছিল, সেটা বলা হয়নি। তবে কুরআনে মানুষের তিনটি নফসের কথা বলা হয়েছে। (১) নফসে আম্মারাহ। যা মানুষকে অন্যায় কাজে প্ররোচিত করে (২) নফসে লাউয়ামাহ। যা মানুষকে ন্যায় কাজে উদ্বুদ্ধ করে ও অন্যায় কাজে বাধা দেয় এবং (৩) নফসে মুত্বমাইন্নাহ, যা মানুষকে ন্যায়ের উপর দৃঢ় রাখে, আর তাতে দেহমনে প্রশান্তি আসে। নবীগণের মধ্যে শেষের দু’টি নফস সর্বাধিক জোরালোভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। আর নফসে লাউয়ামাহ বা বিবেকের তীব্র কষাঘাতকেই এখানে ‘বুরহান’ বা ‘আল্লাহর প্রমাণ’ হিসাবে বলা হয়ে থাকতে পারে। যেমন হাদীছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উদাহরণ বর্ণনা করে তার মাথায় একজন আহবানকারীর কথা বলেছেন, যিনি সর্বদা মানুষকে ধমক দেন যখনই সে অন্যায়ের কল্পনা করে। তিনি বলেন, খবরদার! নিষিদ্ধ পর্দা উত্তোলন করো না। করলেই তুমি তাতে প্রবেশ করবে। এই ধমকদানকারীকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) واعظُ اللهِ في قلبِ كلِّ مؤمنٍ ‘প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ে আল্লাহর উপদেশদাতা’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’। রাযীন, আহমাদ, মিশকাত হা/১৯১ সনদ ছহীহ, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

ইউসুফের হৃদয়ে নিশ্চয়ই ঐ ধমকদাতা উপদেশ দানকারী মওজুদ ছিলেন যাকে (بُرْهَانَ رَبِّهِ) বা ‘আল্লাহর প্রমাণ’ বলা হয়েছে।

অতএব এখানে ‘বুরহান’ বা প্রমাণ বলতে যেনার মত জঘন্য অপকর্মের বিরুদ্ধে বিবেকের তীব্র কষাঘাতকেই বুঝানো হয়েছে। যা নবীগণের হৃদয়ে আল্লাহ প্রোথিত রাখেন। ইমাম জা‘ফর ছাদিক্ব বলেন, ‘বুরহান’ অর্থ নবুঅত, যাকে আল্লাহ নবীগণের হৃদয়ে গ্রথিত রাখেন। যা তার মধ্যে এবং আল্লাহর ক্রোধপূর্ণ কাজের মধ্যে প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। অতএব ‘বুরহান’ অর্থ নবুঅতের নিষ্পাপত্ব, যা ইউসুফকে উক্ত পাপ থেকে বিরত রাখে।

আয়াতে ‘নূর’ (জ্যোতি)র অর্থ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘কুরআন কারীম’ যা কুফর ও শিরকের অন্ধকারের মাঝে হিদায়াতের আলো এবং ভ্রষ্টতার ঘুরপাকে সরল ও সোজা পথ এবং আল্লাহর মজবুত ও শক্ত রজ্জু। সুতরাং এর প্রতি ঈমান আনয়নকারী আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতের হকদার হবে।

আলোচ্য আয়াতে نور (নূর) শব্দ দ্বারা কুরআন মাজীদকে বোঝানো হয়েছে।

যেমন, সূরা আল-মায়েদার ১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে, (قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ) অর্থাৎ তোমাদের কাছে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে এক উজ্জ্বল আলো তথা এক প্রকৃষ্ট কিতাব অর্থাৎ আল-কুরআন এসেছে।

আবার নুর অর্থ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আল-কুরআনও হতে পারে। তখন এর অর্থ হবে, হেদায়াতের নূর। যে আলোর ছোয়া লাগলে মানুষের হিদায়াত নসীব হয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবীয় দৈহিকতা থেকে মুক্ত শুধু নূর ছিলেন, যেমনটি কোন কোন ভ্ৰষ্ট সম্প্রদায় বিশ্বাস করে থাকে।

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا

وَدَاعِيًا إِلَى اللَّهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجًا مُّنِيرًا

হে নবী!  আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী বানিয়ে,

সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী করে আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারীরূপে ৮৪ এবং উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে৷  সূরা আহযাবঃ৪৫-৪৬

কুরআনের এসব আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আসমান থেকে নাযিলকৃত আল্লাহর সকল কিতাবই নূর। লক্ষণীয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যেরূপ ‘নুর’ শব্দের কর্তাবাচক শব্দ মুনীর বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে, অনুরূপ বিশেষণ আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের জন্য ব্যবহার করেছেন। যেমন, সূরা আলে ইমরান: ১৮৪।

﴿فَإِن كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ جَاءُوا بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ وَالْكِتَابِ الْمُنِيرِ﴾

এখন, হে মুহাম্মাদ ! যদি এরা তোমাদের মিথ্যা বলে থাকে, তাহলে তোমরা পূর্বে বহু রসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে৷ তারা স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, সহীফা ও আলোদানকারী কিতাব এনেছিলে৷আলে ইমরানঃ ১৮৪

এ থেকে বুঝা যায় যে, রাসূল, নাযিলকৃত অহী এবং সকল আসমানী কিতাব ‘নূর’; যা বান্দাদের প্রতি তাদের রবের পক্ষ থেকে আগমন করেছে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তাকেই হিদায়াত করেন, যে তার সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, অর্থাৎ তার মনোনীত দ্বীনের আলোকে চলে। কুরআনের অন্যত্র এ ঘোষণা এসেছে, যেমন;

﴿أَفَمَن شَرَحَ اللَّهُ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ فَهُوَ عَلَىٰ نُورٍ مِّن رَّبِّهِ ۚ فَوَيْلٌ لِّلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ أُولَٰئِكَ فِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ﴾

আল্লাহ তা’আলা যে ব্যক্তির বক্ষ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন  এবং যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত আলোতে চলছে  সেকি (সে ব্যক্তির মত হতে পারে যে এসব কথা থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি?) ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের অন্তর আল্লাহর উপদেশ বাণীতে আরো বেশী কঠোর হয়ে গিয়েছে৷ সে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে ডুবে আছে৷ যুমারঃ২২

যে ব্যক্তি প্রথমে মৃত ছিল, পরে আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তাকে এমন আলো দিয়েছি যার উজ্জ্বল আভায় সে মানুষের মধ্যে জীবন পথে চলতে পারে, সেকি এমন ব্যক্তির মতো হতে পারে, যে অন্ধকারের বুকে পড়ে আছে এবং কোনক্রমেই সেখানে বের হয় না ? সূরা আল-আনআমঃ ১২২।

এখানে মৃত্যু বলা হয়েছে অজ্ঞতা, মূর্খতা ও চেতনাবিহীন অবস্থাকে৷ আর জীবন বলতে জ্ঞান, উপলব্দি ও প্রকৃত সত্যকে চিনতে পারার অবস্থাকে বুঝানো হয়েছে৷ যে ব্যক্তির মধ্যে ভুল ও নির্ভুলের পার্থক্যবোধ নেই এবং যার সত্য-সরল পথের স্বরূপ জানা নেই, জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সে জীবন সম্পন্ন হলেও প্রকৃত সত্যের বিচারে সে মনুষ্য পদবাচ্য নয়৷ সে অবশ্যি জীবন্ত প্রাণী কিন্তু জীবন্তু মানুষ নয়৷ জীবন্ত মানুষ একমাত্র তাকেই বলা যাবে যে সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ও ভুল-নির্ভুলের চেতনা রাখে৷

অর্থাৎ যে মানুষটি মানিবক চেতনা লাভ করেছে এবং জ্ঞানের উজ্জ্বল আলোয় বাঁকা পথগুলোর মাঝখানে পড়ে থাকা সত্যের সোজা রাজপথটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, তার ব্যাপারে কেমন করে আশা করা যেতে পারে যে, সে এমনসব চেতনাবিহীন লোকদের মতো দুনিয়ায় জীবন যাপন করবে, যারা অজ্ঞতা ও মূর্খতার অন্ধকারে পথ হারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

অতএব এ নূর হচ্ছে অহীর নূর। এর মাধ্যমে বান্দা তার রবের ইবাদাত সম্পর্কে দিকনির্দেশনা লাভ করে। মানুষের সাথে সম্পর্কের নীতিমালা অর্জন করে। এ নুরই তার সঙ্গীতে পরিণত হয় এবং পথহারা অবস্থায় এ নুর দ্বারাই সে পথের সঠিক দিশা লাভ করে। মোদ্দাকথা নুর অর্থ অহী, এ অহী যেহেতু রাসূলের উপর নাযিল হয়েছে, তাই কখনো তাকে নূর হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে, কখনো কুরআনকে, কখনো তাওরাত ও ইঞ্জলকে। অতএব আয়াতের অর্থ হচ্ছে, তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী সম্বলিত রাসূল ও স্পষ্ট কিতাব আগমন করেছে

৪:১৭৫ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰهِ وَ اعۡتَصَمُوۡا بِهٖ فَسَیُدۡخِلُهُمۡ فِیۡ رَحۡمَۃٍ مِّنۡهُ وَ فَضۡلٍ ۙ وَّ یَهۡدِیۡهِمۡ اِلَیۡهِ صِرَاطًا مُّسۡتَقِیۡمًا

সুতরাং যারা আল্লাহতে ঈমান এনেছে এবং তাকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করেছে তাদেরকে তিনি অবশ্যই তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের মধ্যে দাখিল করবেন এবং তাদেরকে সরল পথে তার দিকে পরিচালিত করবেন।

মহান আল্লাহ কাদের দয়া ও অনুগ্রহের ভিতর অন্তর্ভূক্ত করবেন ও সরল পথে পরিচালিত করবেন সেটা এই আয়াত থেকে স্পষ্ট জানা যায়। যে কেউ মহান রবের প্রতি ঈমান আনবে ও তাঁর দেয়া পথে চলার সিদ্ধান্ত নিবে,এর উপর অটল থাকবে, কোন অবস্থাতেই এই পথ থেকে না সরার মতে অটল থাকবে, মহান আল্লাহ তাকেই পথ দেখাবেন ও অনুগ্রহ করবেন।

যিনি সসকল কিছুর মালিক তিনি যদি অনুগ্রহ করেন তাহলে আর কি কোন চিন্তা থাকার কারন থাকতে পারে? আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন।

وَ بَشِّرِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ بِاَنَّ لَهُمۡ مِّنَ اللّٰهِ فَضۡلًا کَبِیۡرًا

আর আপনি মুমিনদেরকে সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাঅনুগ্রহ। সূরা আহযাবঃ ৪৭

আপনি যালিমদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবেন তাদের কৃতকর্মের জন্য; অথচ তা আপতিত হবে তাদেরই উপর। আর যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে তারা থাকবে জান্নাতের উদ্যানসমূহে। তারা যা কিছু চাইবে তাদের রবের কাছে তাদের জন্য তা-ই থাকবে। এটাই তো মহা অনুগ্রহ। সূরা শুরাঃ২২

আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তিনি তাদের ডাকে সাড়া দেন এবং তাদের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বাড়িয়ে দেন; আর কাফিররা, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি।সূরা শুরাঃ২৬

وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُ

আর তোমরা সকলে আল্লাহ্‌র রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আলে ইমরানঃ১০৩

নিশ্চয় যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং সালাত কায়েম করে, আর আমরা তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করে এমন ব্যবসায়ের, যার ক্ষয় নেই। ফাতিরঃ২৯

বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। সূরা যুমারঃ ৫৩

رَبَّنَا لَا تُزِغۡ قُلُوۡبَنَا بَعۡدَ اِذۡ هَدَیۡتَنَا وَ هَبۡ لَنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ رَحۡمَۃً ۚ اِنَّکَ اَنۡتَ الۡوَهَّابُ

হে আমাদের রব সরল পথ দেয়ার পর আপনি আমাদের অন্তরসমূহকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করবেন না। আর আপনার কাছ থেকে আমাদেরকে করুণা দান করুন, নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা।আলে ইমরানঃ ৮

اِنَّهٗ کَانَ فَرِیۡقٌ مِّنۡ عِبَادِیۡ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاغۡفِرۡ لَنَا وَ ارۡحَمۡنَا وَ اَنۡتَ خَیۡرُ الرّٰحِمِیۡنَ

আমার বান্দাগণের মধ্যে একদল ছিল যারা বলত, হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি অতএব আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও দয়া করুন, আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু। সূরা মুমিনুনঃ১০৯

اَللّٰهُ وَلِیُّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۙ یُخۡرِجُهُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ۬ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَوۡلِیٰٓـُٔهُمُ الطَّاغُوۡتُ ۙ یُخۡرِجُوۡنَهُمۡ مِّنَ النُّوۡرِ اِلَی الظُّلُمٰتِ ؕ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ

আল্লাহ তাদের অভিভাবক যারা ঈমান আনে, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা কুফরী করে তাগূত তাদের অভিভাবক, এরা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে। বাকারাঃ ২৫৭

৪:১৭৬ یَسۡتَفۡتُوۡنَکَ ؕ قُلِ اللّٰهُ یُفۡتِیۡکُمۡ فِی الۡکَلٰلَۃِ ؕ اِنِ امۡرُؤٌا هَلَکَ لَیۡسَ لَهٗ وَلَدٌ وَّ لَهٗۤ اُخۡتٌ فَلَهَا نِصۡفُ مَا تَرَکَ ۚ وَ هُوَ یَرِثُهَاۤ اِنۡ لَّمۡ یَکُنۡ لَّهَا وَلَدٌ ؕ فَاِنۡ کَانَتَا اثۡنَتَیۡنِ فَلَهُمَا الثُّلُثٰنِ مِمَّا تَرَکَ ؕ وَ اِنۡ کَانُوۡۤا اِخۡوَۃً رِّجَالًا وَّ نِسَآءً فَلِلذَّکَرِ مِثۡلُ حَظِّ الۡاُنۡثَیَیۡنِ ؕ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمۡ اَنۡ تَضِلُّوۡا ؕ وَ اللّٰهُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿

লোকেরা আপনার কাছে ব্যবস্থা জানতে চায়। বলুন, পিতা-মাতাহীন নিঃসন্তান ব্যক্তি সম্বন্ধে তোমাদেরকে আল্লাহ ব্যবস্থা জানাচ্ছেন, কোন পুরুষ মারা গেলে সে যদি সন্তানহীন হয় এবং তার এক বোন থাকে তবে তার জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেক। আর সে (মহিলা) যদি সন্তানহীনা হয় তবে তার ভাই তার উত্তরাধিকারী হবে। অতঃপর যদি দুই বোন থাকে তবে তাদের জন্য তার পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দু’ভাগ। আর যদি ভাইবোন উভয়ে থাকে তবে এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের সমান। তোমরা পথভ্রষ্ট হবে এ আশংকায় আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে পরিষ্কারভাবে জানাচ্ছেন এবং আল্লাহ্‌ সবকিছু সম্পর্কে সবিশেষ অবগত।

এ সূরাটি নাযিল হওয়ার অনেক পরে এ আয়াতটি নাযিল হয়৷ কোন কোন হাদীসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এটি কুরআনের সর্বশেষ আয়াত৷ এ আয়াতটি নবম হিজরীতে নাযিল হয়৷ এর অনেক পূর্বে সূরা নিসা নাযিল হয়.

বারা ইবনে আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ সবশেষে নাযিলকৃত সূরা হল সূরা বারাআত (তাওবাহ)। আর সবশেষে নাযিলকৃত আয়াত হল এই আয়াত। [বুখারীঃ ৪৩৬৪, ৪৬০৫, ৪৬৫৬, মুসলিমঃ ১৬১৮]

জাবের ইবন আবদুল্লাহ বলেন, আমি অসুস্থ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে দেখতে আসলেন। তিনি অজু করে আমার উপর পানি ছিটিয়ে দিলে আমার হুশ আসে। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! মীরাস কারা পাবে? আমার তো ‘কালালাহ’ ছাড়া আর কোন ওয়ারিশ নেই। তখন ফারায়েযের আয়াত নাযিল হয়। [বুখারী: ১৯৪; মুসলিম: ১৬১৬]

মূল বাক্যে কালালা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ ‘কালালা’ শব্দের অর্থের ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে৷ কারো কারো মতো কালালা হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যার সন্তান নেই এবং যার বাপ-দাদাও বেঁচে নেই৷ আবার অন্যদের মতে যে ব্যক্তি নিছক নিসন্তান অবস্থায় মারা যায় তাকে কালালা বলা হয়৷ হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু শেষ সময় পর্যন্ত এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিলেন৷ কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু আনহুর মতে প্রথমোক্ত লোকটিকেই কালালা বলা হয়৷ সাধারণ ফকীহগণ তাঁর এই মত সমর্থন করেছেন৷ কুরআন থেকেও এই মতেরই সমর্থন পাওয়া যায়৷ কারণ কুরআন কালালার বোনকে পরিত্যক্ত সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক বানানো হয়েছে৷ অথচ কালার বাপ বেঁচে থাকলে বোন সম্পত্তির কিছুই পায় না৷

আল্লামা শানকীতী বলেন, এখানে এমন সব ভাই-বোনের মীরাসের কথা বলা হচ্ছে, যারা মৃতের সাথে বাবা-মা উভয়ের দিক থেকে অথবা শুধুমাত্র বাবার দিক থেকে শরীক। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার তার এক ভাষণে এ ব্যাখ্যাই করেছিলেন। কোন সাহাবা তার এই ব্যাখ্যার সাথে মতবিরোধ করেননি। ফলে এটি একটি ইজমা বা সর্বসম্মত মতে পরিণত হয়েছে। আয়াতে এক বোনের জন্য অর্ধেক। আর দুই বোনের জন্য দুই তৃতীয়াংশ ঘোষণা করা হয়েছে। যদি দুই এর অধিক বোন থাকে তবে তাদের ব্যাপারে এখানে কিছু বলা হয় নি। অন্য আয়াতে সেটাও বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে যে, বোনদের সর্বোচ্চ অংশ হচ্ছে, দুই তৃতীয়াংশ। তারা যত বেশীই হোক না কেন এ সীমা অতিক্রম করে যাবে না। বলা হয়েছে, অতঃপর যদি তারা দুই এর অধিক মহিলা হয়, তবে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশের মালিক হবে। [সূরা আন-নিসা ১১]

এখানে এমন সব ভাইবোনের মীরাসের কথা বলা হচ্ছে যারা মৃতের সাথে মা ও বাপ উভয় দিক দিয়ে অথবা শুধুমাত্র বাপের দিক দিয়ে শীরক৷ হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার তাঁর এক ভাষণে এই অর্থের ব্যাখ্যা করেছিলেন৷ কোন সাহাবা তাঁর এই ব্যাখ্যার সাথে মতবিরোধ করেননি৷ ফলে এটি একটি সর্বসম্মত মতে পরিণত হয়েছে৷

অর্থাৎ ভাই তার সমস্ত সম্পদের ওয়ারিশ হবে, যদি কোন নির্দিষ্ট অংশের অন্য কোন অধিকারী না থেকে থাকে৷ আর যদি নির্দিষ্ট অংশের অন্য কোন অধিকারী থাকে-যেমন স্বামী তাহলে প্রথমে তার অংশ আদায় করার পর অবশিষ্ট পরিত্যক্ত সম্পত্তি ভাই পাবে৷

এই বিধানই দুই-এর অধিক বোনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অর্থ এই দাঁড়াল যে, যদি ‘কালালাহ’ ব্যক্তির দুই অথবা দুই-এর অধিক বোন থাকে, তাহলে তারা সমস্ত মালের দুই তৃতীয়াংশের উত্তরাধিকারিণী হবে।

অর্থাৎ, ‘কালালাহ’ ব্যক্তির ওয়ারিসগণ যদি পুরুষ ও মহিলা উভয়ই হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ‘এক পুরুষের অংশ দুই নারীর অংশের সমান’ নিয়ম অনুযায়ী সম্পদ বণ্টন হবে। (যেমন ছেলে-মেয়ের ক্ষেত্রে হয়।)

সংগ্রহঃ

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন

 

সূরা আন নিসা সমাপ্ত-     আলহামদুলিল্লাহ। মহান আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করে আমল করার তাওফিক দান করুন ও কবুল করে নিন তাঁর অনুগত পছন্দনীয় দাস হিসেবে।