সূরা আন নিসাঃ ২১তম রুকু(১৪২-১৫২)আয়াত

 সূরা আন নিসাঃ ২১তম রুকু(১৪২-১৫২)আয়াত

 আউযুবিল্লাহি মিনাস শাইতোয়ানির রজিম

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

৪:১৪২ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ یُخٰدِعُوۡنَ اللّٰهَ وَ هُوَ خَادِعُهُمۡ ۚ وَ اِذَا قَامُوۡۤا اِلَی الصَّلٰوۃِ قَامُوۡا کُسَالٰی ۙ یُرَآءُوۡنَ النَّاسَ وَ لَا یَذۡکُرُوۡنَ اللّٰهَ اِلَّا قَلِیۡلًا ﴿۱۴۲﴾۫ۙ

নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করে বস্তুতঃ তিনি তাদেরকে ধোঁকায় ফেলেন। আর যখন তারা সালাতে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য এবং আল্লাহকে তারা অল্পই স্মরণ করে।

৪:১৪৩ مُّذَبۡذَبِیۡنَ بَیۡنَ ذٰلِکَ ٭ۖ لَاۤ اِلٰی هٰۤؤُلَآءِ وَ لَاۤ اِلٰی هٰۤؤُلَآءِ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰهُ فَلَنۡ تَجِدَ لَهٗ سَبِیۡلًا

দোটানায় দোদুল্যমান, না এদের দিকে, না ওদের দিকে! আর আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন আপনি তার জন্য কখনো কোন পথ পাবেন না।

মুনাফিকরা মুখে ইসলাম গ্রহণ করার মাধ্যমে মুসলমানদের হাত থেকে নিজেদের জান-মাল হেফাযত করতে পারে; সরাসরি  কাফির হ’লে যা তারা পারত না। আর এভাবে তারা আল্লাহকে ধোঁকা দিচ্ছে। কিন্তু এমনটি করতে গিয়ে তারা বরং আল্লাহর ধোঁকায় পড়ে যাচ্ছে। কেননা আল্লাহ তাদের মনের খবর ও তাদের কুফরী আক্বীদা সম্পর্কে সম্যক অবগত আছেন। তারপরও তিনি তাদের মুখে ঈমান যাহির করার জন্য তাদের জান-মালের উপর হস্তক্ষেপ বন্ধ রেখেছেন দুনিয়াতে ছাড় দেওয়ার মানসে। অবশেষে আখিরাতে যখন তারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন কুফর গোপন রাখার কারণে তিনি তাদের ঠিকই জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَمَا يَخْدَعُوْنَ إِلاَّ أَنفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُوْنَ-

‘তারা (মুখে ঈমানের দাবীদার মুনাফিকরা) আল্লাহ ও ঈমানদারদের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করতে চায়। বস্ত্ততঃ তারা নিজেদেরকেই ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারছে না’ (বাক্বারাহ ২/৯)।

মুনাফিকদের তাদের রব ও মুমিনদের সাথে ধোঁকাবাজি এই যে, তারা মুখে কালিমা উচ্চারণ এবং আল্লাহকে বিশ্বাসের কথা বলে। কিন্তু অন্তরে তারা আল্লাহর প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস লুকিয়ে রাখে। সরাসরি আললাহকে অস্বীকার করলে তার বিধান মৃত্যুদন্ড অথবা বন্দীত্ব। এই উভয় শাস্তি থেকে দুনিয়াতে নিজেদের বাঁচানোর জন্য তারা মুখে ঈমান যাহির করে এবং অন্তরে কুফর লুকিয়ে রেখে আল্লাহ ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসীদের ধোঁকা দিতে চেষ্টা করে। জামিউল বায়ান ১/২৭২।

আয়াতে মুনাফিকদের তিনটি খারাপ গুণ উল্লেখ করা হয়েছে।

এক. তারা তাদের সালাতে অলসতা করে।

দুই. তারা সালাতে প্রদর্শনেচ্ছা সহকারে দাঁড়ায়।

তিন. তারা খুব কমই আল্লাহর যিকর করে। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য আয়াতেও তাদের এ বদ স্বভাবসমূহের কথা উল্লেখিত হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-

তাদের দেয়া সম্পদ গৃহীত না হবার এ ছাড়া আর কোন কারন নেই যে, তারা আল্লাহ ও তার রসূলের সাথে কুফরী করেছে, নামাযের জন্য যখন আসে আড়মোড় ভাংতে ভাংতে আসে এবং আল্লাহর পথে খরচ করলে তা করে অনিচ্ছাকৃতভাবে ৷  সূরা আত-তাওবাহঃ ৫৪;

﴿فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ﴾

তারপর সেই নামাযীদের জন্য ধবংস ,

﴿الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ﴾

যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে গাফলতি করে

﴿الَّذِينَ هُمْ يُرَاءُونَ﴾

যারা লোক দেখানো কাজ করে সূরা আল-মাউন: ৪-৬।

তাছাড়া হাদীসেও মুনাফিকের এ সমস্ত চরিত্রের কথা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

ঐটি হচ্ছে মুনাফিকের সালাত। সে সূর্যের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর যখন সূর্য শয়তানের দু শিংয়ের মাঝখানে পৌছে (অর্থাৎ ডুবার কাছাকাছি পৌছে) তখন সে উঠে চারবার ঠোকর লাগায়। যাতে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই করে থাকে। [মুসলিম: ৬২২]

নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘‘এটা মুনাফিকের নামায, এটা মুনাফিকের নামায, এটা মুনাফিকের নামায। সে বসে বসে সূর্যের অপেক্ষা করতে থাকে। অবশেষে যখন সূর্য শয়তানের দু’টি শিঙের মধ্যবর্তী স্থানে (অস্ত যাওয়ার কাছাকাছি সময়ে) পৌঁছে, তখন (তড়িঘড়ি) উঠে চারটি ঠোকর মেরে নেয়। (সহীহ মুসলিম, মাসাজিদ অধ্যায়, মুঅত্তা, কুরআন অধ্যায়)

নবী করীম (সাঃ) বলেন, (إِنَّ أَثْقَلَ صَلَاةٍ عَلَى الْمُنَافِقِينَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ وَصَلَاةُ الْفَجْرِ )

অর্থাৎ, মুনাফিকদের উপর এশা এবং ফজরের নামায সব থেকে বেশী ভারী। (বুখারী, মুসলিম ৬৫১নং)

আর ছালাতে যে তারা অলসতাভরে দাঁড়ায় তার অর্থ হল, আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উপর যেসব আমল ফরয করেছেন, মুনাফিকরা তার কোনটাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়তে করে না। কারণ তারা পরকাল, পাপ-পুণ্য, শাস্তি ও পুরস্কার কোনটাতেই বিশ্বাস করে না। তারা কেবল জান বাঁচানোর তাকীদে কিছু বাহ্যিক আমল করে। মুমিনরা যাতে তাদের হত্যা না করে, তাদের অর্থ-সম্পদ ছিনিয়ে না নেয় সেই ভয়ে তারা এসব আমল করে। তাই ছালাতের মত একটি দৃশ্যমান ফরযে যখন তারা দাঁড়ায়, তখন আলস্যভরে দাঁড়ায়। যাতে মুমিনরা ছালাত আদায়কারী হিসাবে তাদের দেখতে পেয়ে তাদেরকে নিজেদের লোক বলে মনে করে। অথচ তারা তাদের লোক নয়। কেননা তারা ছালাতকে তাদের উপর ফরয বা আবশ্যিক বিষয় ভাবে না। তাই তারা আলস্যভরে ছালাতে দাঁড়ায়।

আল্লাহর বাণী- ‘তারা আল্লাহকে খুব অল্পই স্মরণ করে’ বাক্যটির উপর কেউ  হয়ত  প্রশ্ন করতে পারে  যে,  আল্লাহর যিকিরের ক্ষেত্রে ‘অল্প কিছু’ বলে কোন কথা আছে কি? তার উত্তরে বলা চলে, আয়াতের অর্থ আসলে তা নয়। এ কথার আসল অর্থ হচ্ছে- তারা আল্লাহকে লোক দেখানোর জন্য স্মরণ করে। এর দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য নিহত হওয়া, বন্দী হওয়া এবং ধন-সম্পদ খোয়ানোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। তাদের যিকির কোন বিশ্বাসীর যিকির নয়, যে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করে, একনিষ্ঠ মনে তার রুবূবিয়াতকে মেনে চলে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা একে ‘অল্প’ বলেছেন। কেননা এই যিকিরের লক্ষ্য আল্লাহ তা‘আলা নন, আল্লাহর নৈকট্য লাভের ইচ্ছাও তাতে নেই, আল্লাহর নিকট প্রতিদান লাভের প্রত্যাশাও এখানে নেই। তাই আমলকারী যতই কষ্ট করুক এবং যত বেশী যিকির করুক তা মরুভূমির মরীচিকা সদৃশ গণ্য হবে। যা দেখতে পানির মত, কিন্তু আসলে পানি নয়।ইবনু জারীর ত্বাবারী, জামিউল বায়ান ৫/৩২৯

মুমিনের সালাত কেমন হবে তা হাদীসের আলোকে জানা যায়-

হুজায়ফা রা. হতে বর্ণিত,

”আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে কোনো এক রাতে সালাত পড়েছি। লক্ষ্য করেছি, তিনি একটি একটি করে আয়াত পড়ছিলেন। যখন আল্লাহর প্রশংসামূলক কোনো আয়াত আসতো, আল্লাহর প্রশংসা করতেন। যখন প্রার্থনা করার আয়াত আসতো, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়ার আয়াত আসতো, আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতেন।” (সহিহ মুসলিম : ৭৭২)

হাদিসে জিবরীলে ইহসানের সংজ্ঞায় এসেছে,

أن تعبد الله كأنك تراه فإن لم تكن تراه فإنه يراك. (متفق عليه)

”আল্লাহর ইবাদত কর, তাকে দেখার মত করে। যদি তুমি তাকে না দেখ, সে তো অবশ্যই তোমাকে দেখে।” ( বোখারি মুসলিম

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, খুশুর সহায়ক দুটি জিনিস। প্রথমটি হল- নামাজি ব্যক্তির প্রতিটি কথা, কাজ, তেলাওয়াত, জিকির ও দোয়া গভীর মনোযোগ সহকারে আদায় করা। আল্লাহকে দেখে এসব আদায় করছি এরূপ নিয়ত ও ধ্যান করা। কারণ, নামাজি ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথপোকথন করে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ”তুমি সালাতে মৃত্যুর স্মরণ কর। কারণ, যে সালাতে মৃত্যুর স্মরণ করবে, তার সালাত অবশ্যই সুন্দর হবে। এবং সে ব্যক্তির ন্যায় সালাত পড়, যাকে দেখেই মনে হয়, সে সালাতে আছে। (সিলসিলাতুল সহিহাহ)

আবু আইউব রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপদেশ দিয়ে বলেন,

”যখন সালাতে দাড়াবে, মৃত্যুমুখী ব্যক্তির ন্যায় দাড়াবে। (আহমদ)

আমাদের নিজেদের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন যেন সালাতে এইরকম অবস্থা আসতে পারে। মহান আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে সুন্দর সালাত আদায়ের তাওফিক পাওয়ার।

 

১৪৩ আয়াতের মর্মার্থ হ’ল, মুনাফিকরা তাদের দ্বীন সম্পর্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তারা কোন বিশ্বাসেই স্থির হ’তে পারে না। না তারা মুমিনদের সাথে জাগ্রত জ্ঞানের উপর আছে, না কাফেরদের সাথে অজ্ঞতার উপর আছে। তারা বরং দুইয়ের মাঝে অস্থিরমতি হয়ে বিরাজ করছে। ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,

مَثَلُ الْمُنَافِقِ كَمَثَلِ الشَّاةِ الْعَائِرَةِ بَيْنَ الْغَنَمَيْنِ تَعِيرُ إِلَى هَذِهِ مَرَّةً وَإِلَى هَذِهِ مَرَّةً.

‘মুনাফিকের উদাহরণ দু’টো পাঁঠার মাঝে অবস্থিত একটি গরম হওয়া বকরির মত, একবার সে এটার কাছে যায়, আরেকবার সে অন্যটার কাছে যায়’। মুসলিম হা/২৭৮৪।

ইমাম নববী বলেছেন, اَلْعَائِرَةُ অর্থ হয়রান, দোদুল্যমান, যে বুঝে উঠতে পারছে না, দু’জনের কার কাছে সে যাবে। আর تَعِيْرُ শব্দের অর্থ, সে কার কাছে যাবে না যাবে তা নিয়ে দোটানায় পড়েছে। নববী, মুসলিম শারহু ১৭/১২৮।

কাফেরদের কাছে গিয়ে ওদের সাথে এবং মুসলিমদের কাছে এসে এদের সাথে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক থাকার কথা প্রকাশ করে। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে না তারা মুসলিমদের সাথে আছে, আর না কাফেরদের সাথে। বাহ্যিক তাদের মুসলিমদের সাথে থাকলে অভ্যন্তর থাকে কাফেরদের সাথে। আবার কোন কোন মুনাফিক তো ঈমান ও কুফরীর মধ্যে দোদুল্যমান অবস্থায় ঝুলতে থাকে

 

৪:১৪৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوا الۡکٰفِرِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَؕ اَتُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ عَلَیۡکُمۡ سُلۡطٰنًا مُّبِیۡنًا

হে মুমিনগণ! মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা কি নিজেদের উপর আল্লাহর প্রকাশ্য অভিযোগ কায়েম করতে চাও?

এই বিষয়টি আলে ইমরান সূরাতেও এসেছে–

মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহ্‌র কোন সম্পর্কে থাকবে না; তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আর আল্লাহ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন। আলে ইমরানঃ২৮

আউলিয়া ওলীর বহুবচন। আর ওলী এমন বন্ধুকে বলা হয়, যার সাথে থাকে আন্তরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক।

যেমন, মহান আল্লাহ নিজেকে ঈমানদারদের ওলী বলে ঘোষণা দিয়েছেন। [اَللهُ ولِيُّ الَّذِيْنَ آمَنُوا] ‘‘আল্লাহ হলেন ঈমানদারদের ওলী।’

ওলী বা অলী(ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.))

অলি (ولي) শব্দের অর্থ- বন্ধু, অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক, নৈকট্যশীল। অলির বহুবচন আওলিয়া ।

পরিচয়_

মুত্তাকি মুমিনরাই আল্লাহর আউলিয়া:

মহান আল্লাহ বলেন: أَلا إِنَّ أَولِياءَ اللَّـهِ لا خَوفٌ عَلَيهِم وَلا هُم يَحزَنونَ ﴿﴾الَّذينَ آمَنوا وَكانوا يَتَّقونَ

মনে রেখো যে, আল্লাহর অলীদের (বন্ধুদের) না কোন আশংকা আছে আর না তারা বিষণ্ণ হবে। তারা হচ্ছে সেই লোক, যারা ঈমান এনেছে এবং মুত্তাকী (সাবধানতা অবলম্বন করে থাকে)। (সূরা ১০ ইউনুস: ৬২-৬৩)

এই আয়াতের মাধ‌্যমে স্পষ্ট যে, সকল মুত্তাকী মু’মিনই হচ্ছে আল্লাহর অলী/ওলী (বন্ধু, এখানে নৈকট্যপ্রাপ্ত হিসেবেই ব্যবহৃত)।

‘ঈমান’ অর্থ তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাস- যে বিশ্বাস শিরক, কুফর ও বিদআত থেকে মুক্ত। ‘‘তাকওয়া’’ শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা করা। ফরয-ওয়াজিব পালন ও হারাম-পাপ বর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষার নাম-ই তাকওয়া। এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানছি যে, দুটি গুণের মধ্যে ওলীর পরিচয় সীমাবদ্ধ। ঈমান ও তাকওয়া।

এ দু’টি গুণ যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি বেলায়াতের পথে তত বেশি অগ্রসর ও আল্লাহর তত বেশি ওলী বা প্রিয় বলে বিবেচিত হবেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ওলীর বা বেলায়াতের পথের কর্মকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন: ফরয ও নফল। সকল ফরয পালনের পরে অনবরত বেশি বেশি নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যের পথে বেশি বেশি অগ্রসর হতে থাকে।

এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়া যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (৩২১হি) ইমাম আবু হানীফা, মুহাম্মাদ, আবু ইউসূফ (রাহ) ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা বর্ণনা করে বলেন:

 

اَلْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ أَوْلِيَاءُ الرَّحْمَنِ، وَأَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللهِ أَطْوَعُهُمْ وَأَتْبَعُهُمْ لِلْقُرْآنِ

‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর কাছে কারামত-প্রাপ্ত (ততবেশি ওলী বা ততবেশি সম্মানিত)।[আল-আকীদাহ – তাহাভী (শারহ সহ), পৃ: ৩৫৭-৩৬২]

তাহলে ওলী ও বেলায়েতের মানদন্ড হচ্ছে: ঈমান ও তাকওয়া: সকল ফরয কাজ আদায় এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যদি কোনো মুসলিম পরিপূর্ণ সুন্নাত অনুসারে সঠিক ঈমান সংরক্ষণ করেন, সকল প্রকারের হারাম ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করেন, তাঁর উপর ফরয যাবতীয় দায়িত্ব তিনি আদায় করেন এবং সর্বশেষে যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল ইবাদত আদায় করেন তিনিই আল্লাহর ওলী বা প্রিয় মানুষ। এ সকল বিষয়ে যিনি যতুটুকু অগ্রসর হবেন তিনি ততটুকু আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াত অর্জন করবেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ‘বেলায়াত’ কোনো পদ-পদবী নয় এবং ইসলামের ‘ওলী’ বলে কোনো বিশেষ পদ বা পর্যায় নেই। প্রত্যেক মুমিনই ওলী। যে যত বেশি ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করবেন তিনি তত বেশি ওলী।

পক্ষান্তরে কিছু মানুষের ধারণা যে, ওলী হতে হলে কারামত দেখানো জরুরী। অতঃপর তারা মনগড়া ওলীদের জন্য সত্য-মিথ্যা কিছু কারামতের কথা প্রচার করে থাকে। এ ধারণা ও কর্ম নেহাতই ভ্রান্ত। ওলী হওয়ার সাথে কারামতের না কোন সম্পর্ক আছে, আর না কারামত ওলী হওয়ার জন্য শর্ত। এটা স্বতন্ত্র ব্যাপার যে, যদি কোন ওলী দ্বারা কোন কারামত প্রকাশ হয়ে যায়, তবে তা আল্লাহর ইচ্ছা, তাতে সেই বুযুর্গের ইচ্ছা প্রবিষ্ট থাকে না। কিন্তু কোন মুত্তাকী মু’মিন এবং সুন্নতের অনুসারী দ্বারা কোন কারামত প্রকাশ হোক বা না হোক, তাঁর বিলায়াতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

কোনো বিদ’আতি, শরীয়াতের হুকুম তরককারী কি কখনো অলী হতে পারে? হে মুসলমান বিবেককে জিগ্যেস করুন।

অলী/ওলী হতে কি কারো হাতে বায়’আত হতে হয় এবং খেলাফত প্রাপ্ত হতে হয়?

সমাজে প্রচলিত পীর-মুরিদীর সিলসিলায় লাগলেও কুরআন ও হাদীসে বা সাহাবী/তাবেয়ীদের কাছ থেকে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।

এখন আমাদের মাঝে নবী নেই আর ওহীর দরজা বন্ধ। সুতরাং কে আল্লাহর কাছে অলী হিসেবে গণ্য বা কারা আল্লাহর নৈকটত্বপ্রাপ্ত বান্দাহ তা একমাত্র আল্লাহই জানেন এবং মৃত্যুর পরবর্তীতে সে ব্যক্তি জানতে পারবে (পরকালে সবার সামনে উন্মোচিত হবে।) কারো স্বপ্ন শরীয়াতের দলীল হতে পারে না। ইলহাম বা কাশফে যদি সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো তাহলে আক্বীদা ও ফিকহে এতো মতভেদ থাকতো না।

তাই-

অনর্থক কারো ধোঁকায় পড়ে, আজগুবি কল্পগাথায়, নানা বুজরুকিতে বা তেলেসমাতি দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। শরীয়াতের মাপকাঠি হলো দলীল (কুরআন ও সুন্নাহ)।

আল্লাহর মুমিনদের অলী:

আল্লাহ বলেন:

اللَّـهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُم مِّنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَـٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অলী (অভিভাবক)। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো দোযখের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে। (সূরা ২ বাকারা: ২৫৭)

এই আয়াতে স্পষ্ট যে, মুমিনদের অলী/অভিভাবক হলেন আল্লাহ আর কাফিরদের অভিভাবক হলো শয়তান!

সুতরাং কে আল্লাহর অলী বা কে শয়তানের অলী তা গভীরভাবে ভাবা দরকার!!

মনে রাখা দরকার-

কোনো বিদআ’তী, পেটপুজারী, মাজার-পুজারী, দুনিয়ামুখি কখনোই আল্লাহর অলি হতে পারে না, আল্লাহও তাদের অলি নয়!

আলোচ্য আয়াতের অর্থ হল, ঈমানদারদের পারস্পরিক ভালবাসা এবং বিশেষ সম্পর্ক থাকে। তারা আপোসে একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এখানে মহান আল্লাহ মু’মিনদেরকে কাফেরদের সাথে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব করতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। কারণ, কাফেররা আল্লাহর শত্রু এবং মু’মিনদেরও। সুতরাং তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করা কিভাবে বৈধ হতে পারে? আর এই কারণেই আল্লাহ তাআলা এই বিষয়টাকে কুরআনের আরো কয়েক স্থানে অতীব গুরুত্বের সাথে পেশ করেছেন। যাতে মু’মিনরা কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব এবং বিশেষ সম্পর্ক কায়েম করা থেকে বিরত থাকে।

অবশ্য (পার্থিব) প্রয়োজন ও সুবিধার দাবীতে তাদের সাথে সন্ধি ও চুক্তি হতে পারে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেনও। অনুরূপ যে কাফের মুসলিমদের সাথে শত্রুতা রাখে না, তার সাথে উত্তম ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার করা বৈধ। (এর বিস্তারিত আলোচনা সূরা মুমতাহিনায় আছে।) কারণ, এ সব কার্যকলাপ (বন্ধুত্ব ও ভালবাসা থেকে) ভিন্ন জিনিস।

এই অনুমতি সেই মুসলিমদের জন্য যারা কোন কাফের দেশে বসবাস করে। যদি কোন সময় তাদের (কাফেরদের) সাথে বন্ধুত্বের প্রকাশ করা ব্যতীত তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে মৌখিকভাবে বন্ধুত্বের প্রকাশ করতে পারবে। তাফসীরে আহসানুল বায়ান

‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে সে তাদেরই একজন গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ (সুরা মায়েদা : আয়াত ৫১)

আল্লাহ ওই সব লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেনে, যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের বাড়ি-ঘর, স্বদেশ থেকে বের করে দিয়েছে এবং তাদেরকে বের করার জন্য একে অপরকে সাহায্য করেছে। (তাদের ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম) আর তাদের সঙ্গে যারা বন্ধুত্ব করে তারাই তো জালেম বা অত্যাচারী।’ (সুরা মুমতাহিনা : আয়াত ৯)

“হে ঈমান-দারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। [সূরা তাওবাহ, আয়াত: ২৩]

“যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান আনে তুমি পাবে না এমন জাতিকে তাদেরকে পাবে না এমন লোকদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বন্ধু হিসাবে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করে, যদি সেই বিরুদ্ধবাদীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয় তবুও। এদের অন্তরে আল্লাহ ঈমান লিখে দিয়েছেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা তাদের শক্তিশালী করেছেন। তিনি তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতসমূহে যার নিচে দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এরা হল আল্লাহর দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহর দলই সফলকাম”। [সূরা মুজাদালাহ: ২২]

মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়। [সূরা ফাতহ, আয়াত: ২৯]

ইমাম আহমদ রহ. বলেন, আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«قلتُ لعمرَ رضى الله عنه لي كاتبٌ نصرانيٌ، قال: مالَكَ قاتلَكَ اللهُ ، أما سمعتَ قولَه تعالى ﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾ [ سورة المائدة:51]. ألا اتخذتَ حنيفاً ! قلتُ: يا أميرَ المؤمنينَ لي كتابتُه وله دينُه ، قال:لا أُكرمُهم إذ أهانَهم اللهُ ، ولا أُعزُهم إذ أَذلَهم اللهُ ، ولا أُدينهم وقد أقصاهم اللهُ»

অর্থ, একদিন আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলি, আমার একজন সচিব আছে, সে খৃষ্টান। এ কথা শুনে তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুন! তুমি খৃষ্টানকে কেন তোমার সচিব বানালে? তুমি কি আল্লাহ তা’আলার বাণী শুনোনি? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ﴾ [سورة المائدة:51].

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা ইয়াহুদি ও খৃষ্টানদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করো না। তারা নিজেরা পরস্পর বন্ধু”। [সূরা মায়েদাহ, আয়াত: ৫১] তুমি একজন খাটি মুসলিমকে কেন তোমার কাতেব বানালে না। তার কথা শুনে আমি বললাম, হে আমীরুল মুমীনিন! আমি তার থেকে কিতাবত আদায় করব, আর সে তার দ্বীন আদায় করবে। উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ যাদের অপমান করে আমি তাদের সম্মান করব না। আর আল্লাহ যাদের বে-ইজ্জত করে আমি তাদের ইজ্জত দেবো না এবং আমি তাদেরকে কাছে টানবো না, যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন।

মুসলিম নামধারী ব্যক্তিকে কাফির বলার সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয়: বন্ধুত্ব ও শত্রুতা। কাফিরের কুফরের প্রতি ঘৃণা এবং মুমিনের ঈমানের প্রতি প্রেম ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য ইসলামী আকীদার অন্যতম আলোচ্য বিষয় ‘আল-ওয়ালায়াতু ওয়াল বারাআত’ (الولاية والبراءة)। (الـوِلايَـة) বিলায়াত বা ওয়ালায়াত অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব। বারাআত (البراءة) অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কচ্ছিন্নতা, নির্দোষিতা বা অস্বীকৃতি।

কুরআন-হাদীসে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মুমিনকে ভালবাসতে, তাঁর সাথে বিলায়াত (বন্ধুত্ব) প্রতিষ্ঠা করতে, কাফিরকে অপছন্দ করতে ও তার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে। মহান আল্লাহ বলেন:

মহান আল্লাহ বলেন:

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘এবং মুমিন পুরুষগণ ও মুমিন নারীগণ একে অপরের বন্ধু-নিকটবর্তী বা ওলী। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। সূরা (৯) তাওবা: ৭১ আয়াত।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ

‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান গ্রহণ করেছে, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকু-রত। সূরা (৫) মায়িদা: ৫৫ আয়াত।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:

لا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً

‘‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ব্যতীত কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট হতে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর। আল-ইমরান: ২৮।

এভাবে কুরআনে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, মুমিনগণ পরস্পর ভাই, বন্ধু, অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা হৃদয়ের প্রিয়জন। পক্ষান্তরে কাফির কখনো মুমিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা হৃদয়ের প্রিয়জন হতে পারে না। অমুসলিমের সাথে মুসলিমের সামাজিক বা লৌকিক সুসম্পর্ক ও মানবিক সহযোগিতা থাকবে, তবে হৃদয়ের প্রেম থাকবে না।

 

এ বিষয়ে হাদীস শরীফেও বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ وَطَعْمَهُ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ فِى اللَّهِ وَأَنْ يُبْغِضَ فِى اللَّهِ وَأَنْ تُوقَدَ نَارٌ عَظِيمَةٌ فَيَقَعُ فِيهَا أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يُشْرِكَ بِاللَّهِ شَيْئًا

‘‘তিনটি বিষয় যার মধ্যে থাকবে সে এগুলো দ্বারা ঈমানের মিষ্টত্ব ও স্বাদ লাভ করবে: (১) মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) অন্য সকলের চেয়ে তার নিকট প্রিয়তর হবে, (২) সে আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা বা অপছন্দ করবে এবং (৩) বিশাল অগ্নিকুন্ড প্রজ্জ্বলিত করা হলে সে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়াকে সে আল্লাহর সাথে শিরক করা অপেক্ষা অধিক পছন্দ করবে।’’[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৮ (কিতাবুল ঈমান, বাবু খিসালিন মানিত্তাসাফা বিহিন্না ওয়াজাদা); নাসাঈ, আস-সুনান ৮/৯৪ (কিতাবুল ঈমান ও শারাইউহু, বাবু তা’মুল ঈমান)।

অন্য হাদীসে আবূ উমামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدْ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ

‘‘যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য প্রদান করে এবং আল্লাহর জন্য প্রদান থেকে বিরত থাকে সে ঈমান পরিপূর্ণ করেছে।আবূ দাউদ, আস-সুনান (শামিলা) ৪/৩৫৪ (কিতাবুস সুন্নাতি, বাবুদ দালীল আলা যিয়াদাতিল ঈমান..)। হাদীসটি সহীহ।

এ সকল আয়াত ও হাদীসের নির্দেশনা খুবই সুস্পষ্ট। মুমিন ঈমান ও ঈামনদারদেরকে ভালবাসবেন এবং কুফর ও কুফরে লিপ্ত মানুষদেরক ঘৃণা করবেন বা অপছন্দ করবেন। ঈমান ও ঈমানদারকে ভালবাসা এবং কুফর ও কাফিরকে ঘৃণা করা মূলত ‘‘ঈমান-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য এ বিষয় ‘‘ঈমান’’ ও ‘‘আকীদা’’ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। তবে ‘‘তাকফীর-এর একটি প্রচ্ছন্ন ও ভয়াবহ রূপ কাফিরদের বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াত বা হাদীসকে মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। এ ছিল খারিজী বিভ্রান্তির উৎস। তাদের বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন

إِنَّهُمْ انْطَلَقُوا إِلَى آيَاتٍ نَزَلَتْ فِي الْكُفَّارِ فَجَعَلُوهَا عَلَى الْمُؤْمِنِين

‘‘কাফিরদের বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতগুলোর কাছে যেয়ে সেগুলোকে তারা মুমিনদের উপর প্রয়োগ করে।বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৩৯ (কিতাবু ইসতিতাবাতিল মুরতাদ্দীন, বাবু কাতলিল খাওয়ারিজ)

বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বিষয়ক নির্দেশনাগুলোকে অনেক মুসলিম অন্য মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তারা পাপের কারণে, কর্মগত বা আকীদাগত মতভেদের কারণে ‘‘মুমিনগণকে ঘৃণা করেন, বিদ্বেষ করেন বা শত্রুতা করেন এবং এরূপ ঘৃণা-বিদ্বেষকে ‘‘দীন’’ ও ইবাদত বলে গণ্য করেন।

অনেক সময় মানবীয় দুর্বলতায় আমরা ভালবাসা বা ঘৃণায় আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়ি। ফলে এক্ষেত্রে ঈমানের নির্দেশনা অনুসারে সমন্বয় করতে পারি না। পাপ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাও ঈমানের দাবি। তবে মুমিনের মধ্যে পাপের পাশাপাশি ‘‘ঈমান’’ ও অন্যান্য ‘‘পুণ্য’’ বিদ্যমান। এগুলির জন্য মুমিনকে ভালবাসা ঈমানের দাবি। যেহেতু ঈমান মুমিনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম সেহেতু পাপে লিপ্ত মুমিনকে ঈমানের কারণে এ পরিমাণ ভালবাসতে হবে এবং অন্যান্য নেক আমলের মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তার পাপের প্রতি আপত্তি ও দূরত্বও থাকতে হবে। পাপের জন্য ঘৃণার কারণে ঈমানের অবমূল্যায়ন করা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক।

মুমিনের ঈমানের দাবি যে, তিনি ‘‘ঈমান’’-কে সর্বোচ্চ ভালবাসবেন ও মূল্যায়ন করবেন। এ ভালবাসা ও মূল্যায়নের দাবি এই যে, যে হৃদয়ে ঈমানের ন্যূনতম আভা বা ছোঁয়া বিদ্যমান সে হৃদয় ও হৃদয়ের অধিকারীর প্রতি তার অন্তরের প্রেম, গভীর ভালবাসা ও সর্বোচ্চ মূল্যায়ন থাকবে। এ ভালবাসার অর্থ মুমিনের অন্যায়কে সমর্থন করা নয়। ‘‘ঈমানদার’’ বা মুসলিম নামধারী ব্যক্তি যদি অন্যায়ে লিপ্ত হয় তবে তাকে অন্যায় থেকে নিষেধ করা ও ভাল কাজে আদেশ করা তার বন্ধুত্ব ও প্রেমেরই দাবি। তবে মুমিনের অন্যায়ের কারণে তার ‘‘ঈমান’’ মূল্যহীন হয়ে যায় না। কুরআনের নির্দেশনা এটিই।

পক্ষান্তরে ঈমানের ন্যূনতম দাবি যে, কুফরকে মুমিন সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করবে। যে হৃদয়ে ‘‘কুফর’’ বিদ্যমান সে হৃদয় ও হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিকে মুমিন কখনোই হৃদয়ের গভীরে ভালবাসতে পারে না। তাকে হৃদয়ের গভীরে ভালবাসার অর্থ তার ‘‘কুফর’’-কে স্বীকৃতি দেওয়া বা ‘‘কুফর’’-কে গুরুত্বহীন বলে গণ্য করা এবং কুফর-এর প্রতি হৃদয়ের আপত্তি অপসারিত হওয়া।

পাপ বা মতভেদের কারণে মুমিনকে ঢালাওভাবে ঘৃণা করা বা তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করা আর কোনো ভালকাজের কারণে কাফিরকে ভালবাসা ও তাকে হৃদয় দিয়ে প্রেম করা একই প্রকারের অপরাধ। উভয় ক্ষেত্রেই ‘‘ঈমান’’-এর অবমূল্যায়ন করা হয়। এরূপ ঘৃণা ও বিদ্বেষকে যতই আমরা ‘‘আল্লাহর জন্য ঘৃণা’’ বলে দাবি করি, মূলত তা আল্লাহর জন্য নয়, বরং নিজেদের মনমর্জি, দল, মত, নেতা, ইমাম, আমীর, পীর বা অন্য কিছুর জন্য। কারণ ভালবাসা ও শত্রুতা যদি আল্লাহর জন্য হয় তাহলে তা ঈমান, নেকআমল ও পাপের পরিমাণে সমন্বিত হবে।

মুমিনের অন্যতম পরিচয় ‘‘ঈমান’’-কে ভালবাসা ও ঈমানের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা। এজন্য সুনিশ্চিত পাপ বা মতভেদীয় ‘‘পাপ’’-এর কারণে মুমিনের প্রতি আপত্তি বা ঘৃণা থাকলেও সাথে সাথে তার মধ্যে বিদ্যমান ঈমান ও অন্যান্য নেক আমলের পরিমাণ ভালবাসা থাকতে হবে। এভাবে ‘‘বিলায়াত’’ ও ‘‘বারাআত’’ অর্থাৎ বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বা সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতা একত্রিত হবে। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাঁর ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’ গ্রন্থে কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন

‘‘আবূ মুকাতিল বলেন: ওয়ালায়াত ও বারাআত: বন্ধুত্ব ও সম্পর্কছিন্নতার ব্যাখ্যা আমাকে বলুন। একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি উভয় বিষয় একত্রিত হতে পারে? ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘ওয়ালায়াত’ অর্থ ভাল কাজের প্রতি সন্তুষ্টি এবং ‘বারাআত’ অর্থ খারাপ কাজের প্রতি অসন্তুষ্টি বা অপছন্দ। অনেক সময় একই মানুষের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় একত্রিত হয় এবং অনেক সময় একত্রিত হয় না। যে মুমিন ব্যক্তি পুণ্য ও পাপ উভয় কর্মই করছে তার পুণ্য কর্মের বিষয়ে তুমি তার সাথে একত্রিত হবে, ঐকমত্য পোষণ করবে এবং এজন্য তুমি তাকে ভালবাসবে। আর সে যে অন্যায় কর্ম করছে সে জন্য তুমি তার বিরোধিতা করবে, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং তা অপছন্দ করবে। এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বা সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি একত্রিত হবে, যে বিষয়ে তুমি প্রশ্ন করেছ। আর যার মধ্যে কুফর বিদ্যমান সে কোনো নেককর্মের মধ্যে নেই; তুমি তাকে ঘৃণা কর এবং সব বিষয়ে তার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। আর যাকে তুমি ভালবাসবে এবং তার কিছুই অপছন্দ করবে না সে ঐ মুমিন যে সকল নেক কর্ম করে এবং পাপ-অন্যায় বর্জন করে। এরূপ মুমিনের সবই তুমি ভালবাসবে এবং তার কিছুই অপছন্দ করবে না। ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩৮-৩৯।

এ হলো ভালবাসা ও সম্পর্কছিন্নতার বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি। এজন্যই আলী (রা), সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী ইমামগণ খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু কখনোই তাদেরকে কাফিরের মত ঘৃণা করেন নি। যদিও খারিজীগণ তাঁদেরকে কাফির বলে ঘৃণা করেছে, কিন্তু তাঁরা তা করেন নি। বরং তাদের সাথে আত্মীয়তা করেছেন, তাদের মধ্যে যারা সৎ ও সত্যপরায়ণ ছিলেন তাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং হাদীস, ফিকহ, তাফসীর ইত্যাদির বর্ণনায় তাদের উপর নির্ভর করেছেন।

বর্তমান মুসলিম বিশ্বে আমরা অনেকেই নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বা সুন্নাত ও ঐক্যের অনুসারী বলে দাবি করলেও বিদ‘আত ও বিভক্তির প্রতিই আমাদের আকর্ষণ বেশি। ঈমান, সালাত, যাকাত, সিয়াম, ইলম, কুরআন, তাকওয়া, আমল ইত্যাদির ভিত্তিতে আমরা মুসলিমদেরকে ভালবাসি না। বরং দলীয় মতামত ও পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদেরকে ভালবাসি। ধর্মীয় ক্ষুদ্রক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে আমরা বিভক্ত। আমার দল, গোষ্ঠীর নেতা বা গুরুর ‘‘অনুসারী’’ ব্যক্তি যদি ঈমান, আমল ও তাকওয়ায় অনেক পিছনেও থাকে তাহলেও সে আমার অতি প্রিয়জন। আর ভিন্ন দল, মত, নেতা বা গুরুর অনুসারী যদি ঈমান ও তাকওয়ার বিচারে অনেক ভালও হন তবুও তিনি আমার শত্রু বা অপছন্দিত।

আবার এরূপ বিভক্তিকে দীনের রূপ দেওয়ার জন্য আমরা অনেক তথাকথিত ‘‘আকীদা’’ বা ‘‘ইবাদত-পদ্ধতি’’ উদ্ভাবন করেছি, যে সকল আকীদা বা পদ্ধতির কথা কুরআন-হাদীসে সরাসরি নেই, ইমাম আযমসহ চার ইমাম বা তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণ লিখেন নি অথবা তা মুস্তাহাব পর্যায়ের কোনো কর্ম মাত্র। এ সকল বিষয়ের অজুহাতে আমরা মুত্তাকী ব্যক্তিকে ঘৃণা করি এবং ফাসিক ব্যক্তিকে ভালবাসি। সর্বাবস্থায় মুমিনের ঈমান, ফরয-ওয়াজিব দায়িত্ব পালন, হারাম-মাকরূহ বর্জন, ইলম, কুরআন ইত্যাদির চেয়ে ‘‘আমার মতের সাথে শতভাগ মিল থাকা’ বা ‘‘আমার পদ্ধতিতে ইবাদত পালন করা’-কেই আমার ভালবাসার মূলনীতি বানিয়েছি। এভাবে আমরা মূলত ‘‘আমার পছন্দের ভিত্তিতে ভালবাসছি’ কিন্তু একে আবার ‘‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা’ বলে আখ্যায়িত করছি।

মুসলিম উম্মাহর সকল বিভক্তি, ফিতনা ও অবক্ষয়ের অন্যতম উৎস ‘তাকফীর’। ইমাম আযমের সময়ে যেমন বিষয়টি অন্যতম ফিতনা ছিল, বর্তমানেও তা একইরূপ ফিতনা। রাজনৈতিক মতবাদ, মতভেদ, ধর্মীয় মতপার্থক্য ইত্যাদি কারণে কখনো বা মুসলিমদেরকে সরাসরি ‘‘কাফির’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ‘ইসলামের শত্রু, ‘‘কুরআনের শত্রু, ‘‘নবীর (ﷺ) শত্রু’’, ‘‘সুন্নাতের শত্রু’, ‘‘ওলী-আউলিয়ার শত্রু’, ‘‘কাফিরের চেয়েও খারাপ’, ‘‘কাফিরদের দালাল’ ইত্যাদি বলে প্রচ্ছন্ন ও কৌশলী তাকফীর করা হচ্ছে। এভাবে আমরা মুমিনকে কাফির বলার পাপে, বিদ্বেষের পাপে, দলাদলি ও বিভক্তির পাপে লিপ্ত হচ্ছি। সর্বোপরি জেনে বা না জেনে ইহূদী, খৃস্টান ও কাফিরগণ, যারা ইসলামের প্রকৃত শত্রু ও প্রকৃত কাফির তাদের স্বার্থরক্ষা ও ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র কার্যকর করার পরিবেশ তৈরি করছি। আমাদের উচিত, প্রত্যেকে নিজের মতে-পথে সুদৃঢ় থাকার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিমকে কাফির বলা থেকে বিরত থাকি, মত বা কর্মের সমালোচনা করলেও ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর প্রতি তাকফীর বা বিদ্বেষ প্রচার থেকে বিরত থাকি এবং সকল মুসলিমের হেদায়াত ও নাজাতের জন্য দুআ করি। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।

৪:১৪৫ اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ فِی الدَّرۡکِ الۡاَسۡفَلِ مِنَ النَّارِ ۚ وَ لَنۡ تَجِدَ لَهُمۡ نَصِیۡرًا

মুনাফিকরা তো জাহান্নামের নিম্নতমস্তরে থাকবে এবং তাদের জন্য আপনি কখনো কোন সহায় পাবেন না।

এ আয়াতে মুনাফিকদের স্থান নির্দেশ করে বলা হয়েছে যে, তারা জাহান্নামের সর্বনিম স্তরে থাকবে। জাহান্নামের সর্ব নিম্নস্তরকে هَاوِيَة (হাবিয়াহ) বলা হয়। أَعَاذَنَا اللهُ مِنْهَا উল্লিখিত মুনাফিক্বী স্বভাব ও আচার-আচরণ থেকে যেন আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেন!

অন্য স্থানে ফিরআউন ও তার অনুসারীদের জন্য কঠিন শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। “আগুন, তাদেরকে তাতে উপস্থিত করা হয় সকাল ও সন্ধ্যায় এবং যেদিন কিয়ামত ঘটবে সেদিন বলা হবে, ফিরআউন গোষ্ঠীকে নিক্ষেপ কর কঠোর শাস্তিতে।” [সূরা গাফির: ৪৬]

আবার অন্যত্র বনী ইসরাইলের মধ্যে যাদেরকে আকাশ থেকে দস্তরখানসহ খাবার দেয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে যারা কুফরী করবে তাদের জন্য এমন শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে শাস্তি আল্লাহ আর কাউকে দিবেন না।

“আল্লাহ বললেন, ‘আমিই তোমাদের কাছে ওটা পাঠাব; কিন্তু এর পর তোমাদের মধ্যে কেউ কুফরী করলে তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতের আর কাউকেও দেব না।” [সূরা আল-মায়িদাহ ১১৫] সুতরাং এটাই বলা চলে যে, সবচেয়ে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে এ তিন শ্রেণীর লোক। [আদওয়াউল বায়ান] এ আয়াতে বর্ণিত ‘দারকুল আসফাল’ বা নিম্নতম স্তর কি এ সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সেটা হবে বদ্ধ সিন্ধুক। [মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবাহঃ ১৩/১৫৪, নং ১৫৯৭২]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘দারকুল আসফাল’ হচ্ছে, এমন কিছু ঘর যেগুলোর দরজা বন্ধ করা আছে। আর সেগুলোকে উপর ও নিচ থেকে প্রজ্জলিত করা হবে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] ইবন আব্বাস বলেন, এর অর্থ, জাহান্নামের নীচে থাকবে। [তাবারী]

৪:১৪৬ اِلَّا الَّذِیۡنَ تَابُوۡا وَ اَصۡلَحُوۡا وَ اعۡتَصَمُوۡا بِاللّٰهِ وَ اَخۡلَصُوۡا دِیۡنَهُمۡ لِلّٰهِ فَاُولٰٓئِکَ مَعَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ؕ وَ سَوۡفَ یُؤۡتِ اللّٰهُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَجۡرًا عَظِیۡمًا

কিন্তু যারা তাওবাহ করে, নিজেদেরকে সংশোধন করে, আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের দ্বীনকে একনিষ্ট করে, তারা মুমিনদের সঙ্গে থাকবে এবং মুমিনদেরকে আল্লাহ অবশ্যই মহাপুরস্কার দেবেন।

অর্থাৎ, মুনাফিকদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি এই চারটি কর্মের প্রতি ঐকান্তিকতার সাথে যত্নবান হবে, সে জাহান্নামে যাওয়ার পরিবর্তে ঈমানদারদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

৪:১৪৭ مَا یَفۡعَلُ اللّٰهُ بِعَذَابِکُمۡ اِنۡ شَکَرۡتُمۡ وَ اٰمَنۡتُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ شَاکِرًا عَلِیۡمًا

তোমরা যদি শোকর-গুজার হও এবং ঈমান আন, তবে তোমাদের শাস্তি দিয়ে আল্লাহ কি করবেন? আর আল্লাহ (শোকরের) পুরস্কার দাতা সবজ্ঞ।

 

আয়াতে শোকর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর আসল অর্থ হচ্ছে নেয়ামতের স্বীকৃতি দেয়া ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা এবং অনুগৃহীত হওয়া। এ ক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ না হও এবং তার সাথে নিমকহারামী না কর; বরং যথার্থই তার প্রতি কৃতজ্ঞ ও শোকর আদায়কারী হও তাহলে আল্লাহ অনর্থক তোমাদের শাস্তি দেবেন না। মোটকথা: আল্লাহ তা’আলা ঈমানদার এবং শোকরগুজারকে শাস্তি দিবেন না। [তাবারী] কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনুগ্রহকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঠিক পদ্ধতি কি?

বস্তুতঃ হৃদয়ের সমগ্র অনুভূতি দিয়ে তার অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেয়া, মুখে এ অনুভূতির স্বীকারোক্তি করা এবং কার্যকলাপের মাধ্যমে অনুগৃহীত হওয়ার প্রমাণ পেশ করাই হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঠিক উপায়।

এ তিনটি কাজের সমবেত রূপই হচ্ছে শোকর। এ শোকরের দাবী হচ্ছে

প্রথমতঃ অনুগ্রহকে অনুগ্রহকারীর অবদান বলে স্বীকার করা। অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে অনুগ্রহকারীর সাথে আর কাউকে অংশীদার না করা।

দ্বিতীয়তঃ অনুগ্রহকারীর প্রতি ভালবাসা, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের অনুভূতি নিজের হৃদয়ে ভরপুর থাকা এবং অনুগ্রহকারীর বিরোধীদের প্রতি এ প্রসঙ্গে বিন্দুমাত্র ভালবাসা, আন্তরিকতা, আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার সম্পর্ক না থাকা।

তৃতীয়তঃ অনুগ্রহকারীর আনুগত্য করা, তার হুকুম মেনে চলা, তার নেয়ামতগুলোকে তার মর্জির বাইরে ব্যবহার না করা।

কুরআনের আয়াতে এখানে মূলত ‘শাকির’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর অনুবাদ করতে গিয়ে আমি ‘বড়ই পুরস্কারদানকারী’ শব্দ ব্যবহার করেছি৷ আল্লাহর তরফ থেকে যখন বান্দার প্রতি শোকর করার কথা বলা হয় তখন এর অর্থ হয় ‘কাজের স্বীকৃতি দেয়া বা কদর করা, মূল্য দান করা ও মর্যাদা দেয়া’৷

আর যখন বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহর প্রতি শোকর করার কথা বলা হয় তখন এর অর্থ হয়, নেয়ামতের স্বীকৃত দান বা অনুগৃহীত হবার কথা প্রকাশ করা৷ আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার শোকরিয়া আদায় করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ বান্দার কাজের যথার্থ মূল্যদান করার ব্যাপারে কুণ্ঠিত নন৷ বান্দা তাঁর পথে যে ধরনের যতটুক কাজ করে আল্লাহর তার কদর করেন, তার যথার্থ মূল্য দেন৷ বান্দার কোন প্রত্যেকটি কাজের তার প্রাপ্যের চাইতে অনেক বেশী প্রতিদান দেন৷ মানুষের অবস্থা হচ্ছে, মানুষ যা কিছু কাজ করে তার প্রকৃত মূল্যের চাইতে কম মূল্য দেয় আর যা কিছু করে না সে সম্পর্কে কঠোরভাবে পাকড়াও করে৷ বিপরীত পক্ষে আল্লাহর অবস্থা হচ্ছে,মানুষ যে কাজ করেনি সে ব্যপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত কোমল, উদার ও উপেক্ষার নীতি অবলম্বন করেন৷ আর যে কাজ সে করেছে তার মূল্য তার চাইতে অনেক বেশী দেন, যা তার প্রকৃতপক্ষে পাওয়া উচিত৷

৪:১৪৮ لَا یُحِبُّ اللّٰهُ الۡجَهۡرَ بِالسُّوۡٓءِ مِنَ الۡقَوۡلِ اِلَّا مَنۡ ظُلِمَ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ سَمِیۡعًا عَلِیۡمًا

মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার উপর যুলুম করা হয়েছে। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

এ আয়াতে দুনিয়া হতে জোর-যুলুমের অবসান ঘটানোর এক অপূর্ব বিধান পেশ করা হয়েছে। যার মধ্যে একদিকে ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা ও অপরাধ দমনের জন্য মযলুমকে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে তাকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আধিকার দিয়েছে।

অন্যদিকে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আবার যুলুম ও বাড়াবাড়ি করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যদি তোমরা প্রতিশোধ নিতে চাও, তবে তোমাদের উপর যে পরিমাণ যুলুম করা হয়েছে, তোমরা ঠিক ততটুকুই প্রতিশোধ নিতে পার [সূরা আন-নাহ্‌ল: ১২৬]

সাথে সাথে এ কথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, প্রতিশোধ গ্রহণ করার ক্ষমতা ও অধিকার থাকা সত্বেও যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং ক্ষমা করে দাও, তবে নিঃসন্দেহে তা তোমাদের জন্য অতি উত্তম। মোটকথাঃ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মযলুম ব্যক্তি যদি অত্যাচারীর অন্যায়-অত্যাচারের কাহিনী লোকদের কাছে প্রকাশ করে বা আদালতে অভিযোগ করে, তবে তা হারাম গীবতের আওতায় পড়বে না। কারণ যালিম নিজেই মযলুমকে অভিযোগ উত্থাপন করতে সুযোগ করে দিয়েছে, বরং বাধ্য করেছে।

কারো মধ্যে যদি কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়, তাহলে তার প্রকাশ্যে সমালোচনা না করার প্রতি শরীয়তে খুবই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, বরং তাকে নির্জনে বুঝাতে বলা হয়েছে। কিন্তু যদি ধর্মীয় কোন কল্যাণ থাকে, তাহলে প্রকাশ্যে সমালোচনা করায় কোন অসুবিধা নেই। এমনিভাবেই জনসমক্ষে প্রকাশ্যে কোন কুকর্ম করা নিতান্ত অপছন্দনীয়। একে তো কুকর্মে লিপ্ত হওয়াটাই নিষিদ্ধ, যদিও তা পর্দার অন্তরালে হয়, তার উপর সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ্যে করা অতিরিক্ত আর একটি অপরাধ। আর তার জন্য ঐ কুকর্মের অপরাধ দ্বিগুণ হতে পারে। উক্ত দুই ধরনের অপরাধের কথা এই আয়াতে উল্লিখিত হয়েছে। আর তাতে এটাও বলা হয়েছে যে, কারো কৃত বা অকৃত অপরাধের কারণে তাকে প্রকাশ্যে ভৎর্সনা করো না। অবশ্য যালেমের যুলুমের কথা জনসমক্ষে বর্ণনা করার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম। যালেমের যুলুমের কথা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করার মাঝে কয়েকটি মঙ্গল নিহিত আছে। যেমন, সম্ভবতঃ সে যুলুম করা থেকে বিরত হতে পারে অথবা সে আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করবে। দ্বিতীয়তঃ লোকে তার ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক থাকবে।

৪:১৪৯ اِنۡ تُبۡدُوۡا خَیۡرًا اَوۡ تُخۡفُوۡهُ اَوۡ تَعۡفُوۡا عَنۡ سُوۡٓءٍ فَاِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَفُوًّا قَدِیۡرًا

তোমরা সৎকাজ প্রকাশ্যে করলে বা গোপনে করলে কিংবা দোষ ক্ষমা করলে তবে আল্লাহও দোষ মোচনকারী, ক্ষমতাবান।

আল্লাহ তা’আলা একদিকে মযলুমকে তার প্রতি যুলুমের সমতুল্য প্রতিশোধ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছেন। অপরদিকে প্রতিশোধ গ্রহণ করার পরিবর্তে উন্নত চরিত্রের শিক্ষা ও ক্ষমার মনোভাব সৃষ্টি করার জন্য আখেরাতের উত্তম প্রতিদানের আশ্বাস শুনিয়ে ক্ষমা ও ত্যাগের আদর্শ গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করেছেন। এ আয়াতে মুখ্য উদ্দেশ্য কারো অন্যায়কে ক্ষমা করার আদর্শ শিক্ষা দেয়া। প্রকাশ্যে বা গোপনে নেক কাজ করার উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ক্ষমা করাও একটি বিশিষ্ট সৎকার্য।

যে ব্যক্তি অন্যের অপরাধ মার্জনা করবে, সে আল্লাহ তা’আলার ক্ষমা ও করুণার যোগ্য হবে। আয়াতের শেষে আল্লাহর দুটি গুণবাচক নাম উল্লেখ করে বলে দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা সর্বশক্তিমান, যাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দিতে পারেন এবং যখন ইচ্ছা প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারেন। তথাপি তিনি অতি ক্ষমাশীল। আর মানুষের শক্তি ও ক্ষমতা যখন সামান্য ও সীমাবদ্ধ, তাই ক্ষমা বা মার্জনার পথ অবলম্বন করা তার জন্য অধিক বাঞ্ছনীয়।

এ হচ্ছে অন্যায়-অত্যাচার প্রতিরোধ ও সামাজিক সংস্কার সাধনের ইসলামী মূলনীতি এবং অভিভাবকসুলভ সিদ্ধান্ত। একদিকে ন্যায়সঙ্গত প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার প্রদান করে ইনসাফ ও ন্যায়নীতিকে সমুন্নত রাখা হয়েছে, অপরদিকে উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে ক্ষমা বা মার্জনা করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। যার অনিবার্য ফলশ্রুতি সম্পর্কে কুরআনুল কারীমের অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছেঃ “তোমার ও অন্য যে ব্যক্তির মধ্যে দুশমনী ছিল, এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি আন্তরিক বন্ধু হয়ে যাবে।” [সূরা ফুসসিলাতঃ ৩৪]

আইন-আদালত বা প্রতিশোধ গ্রহণ করার মাধ্যমে যদিও অন্যায়-অত্যাচার প্রতিরোধ করা যায়, কিন্তু এর দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া অব্যাহত থাকে। যার ফলে পারস্পরিক বিবাদের সূত্রপাত হওয়ার আশংকা বিদ্যমান থাকে। কিন্তু কুরআনুল কারীম যে অপূর্ব নৈতিকতার আদর্শ শিক্ষা দিয়েছে, তার ফলে দীর্ঘকালের শক্রতাও গভীর বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হয়ে থাকে।

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘সাদকাহ দ্বারা সম্পদ কমে না এবং কোন বান্দার মধ্যে ক্ষমা প্রবণতার গুণের কারণে আল্লাহ তা’আলা কেবল তার মর্যাদাই বৃদ্ধি করেন। আর যে কেউ আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয়, আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেন। [মুসলিম: ২৫৮৮]

নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘আপোসের মধ্যে গালিগালাজ করে এমন দুই ব্যক্তি যা কিছু বলে পাপ সূচনাকারী ব্যক্তির উপরই বর্তায়; যদি না অত্যাচারিত ব্যক্তি (অর্থাৎ যাকে প্রথমে গালি দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিশোধে সেও গালি দিয়েছে সে) সীমালংঘন করে।’’ (মুসলিম ৪৫৮৭নং)

কিন্তু প্রতিশোধ গ্রহণের অনুমতির সাথে সাথে ক্ষমা প্রদর্শন করার প্রতি অধিক অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গরূপে ক্ষমতাবান, তা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমা করে দেন। এই জন্য তিনি বলেন, {وَجَزَاء سَيِّئَةٍ سَيِّئَةٌ مِّثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَأَصْلَحَ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ إِنَّهُُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ} অর্থাৎ, মন্দের প্রতিফল তো অনুরূপ মন্দই। কিন্তু যে ক্ষমা করে দেয় ও আপোস-নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট আছে। নিশ্চয় তিনি অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। (সূরা শূরা ৪০) আর হাদীসে মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘অপরাধ মার্জনা করার কারণে, আল্লাহ (মার্জনাকারীর) সম্মান ও ইজ্জত বাড়িয়ে দেন।’’ (মুসলিম)

৪:১৫০ اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّفَرِّقُوۡا بَیۡنَ اللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یَقُوۡلُوۡنَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٍ وَّ نَکۡفُرُ بِبَعۡضٍ ۙ وَّ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَّخِذُوۡا بَیۡنَ ذٰلِکَ سَبِیۡلًا

নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের সাথে কুফরী করে এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলগণের মধ্যে (ঈমানের ব্যাপারে) তারতম্য করতে চায় এবং বলে, ‘আমরা কতক-এর উপর ঈমান আনি এবং কতকের সাথে কুফরী করি’। আর তারা মাঝামাঝি একটা পথ অবলম্বন করতে চায়।

কাতাদা বলেন, এরা হচ্ছে, আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদ ও নাসারা সম্প্রদায়। কারণ, তাদের মধ্যে ইয়াহুদীরা তাওরাত ও মূসার উপর ঈমান আনে কিন্তু ইঞ্জীল ও ঈসার উপর ঈমান আনে না। আর নাসারারা ইঞ্জীল ও ঈসার উপর ঈমান আনে কিন্তু কুরআন ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর ঈমান আনে না। এভাবে এ দু’টি সম্প্রদায় ইয়াহুদী ও নাসারা হয়েছে। অথচ এ দুটি মতই বিদ’আত বা নব উদ্ভাবিত। যা আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। এভাবে তারা সমস্ত নবী-রাসূলদের মাধ্যমে আল্লাহ প্রদত্ত দ্বীন ইসলামকে পরিত্যাগ করেছে। [তাবারী]

৪:১৫১ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ حَقًّا ۚ وَ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا مُّهِیۡنًا

তারাই প্রকৃত কাফির। আর আমরা প্রস্তুত রেখেছি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।

পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত স্পষ্ট ঘোষণা ঐসব বিভ্রান্ত লোকদের হীনমন্যতা ও গোজামিলকেও ফাঁস করে দিয়েছে, যারা অন্যান্য ধর্মানুসারীদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজেদের দ্বীন ও দ্বীনী বিশ্বাসকে বিজাতির পদমূলে উৎসর্গ করতে ব্যগ্র। যারা কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট ফয়সালাকে উপেক্ষা করে অন্যান্য ধর্মানুসারীদেরকেও মুক্তি লাভ করবে বলে বুঝাতে চায়। অথচ তারা অধিকাংশ রাসূলকে অথবা অন্তত কোন কোন নবীকে অমান্য করে। যার ফলে তাদের কাফের ও জাহান্নামী হওয়ার কথা অত্র আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছে।

অমুসলিমদের প্রতি ইনসাফ, ন্যায়নীতি, সমবেদনা,সহানুভূতি, উদারতা ও ইহসান বা হিতকামনার দিক দিয়ে ইসলাম নজীরবিহীন। ইসলাম একদিকে মুসলিমদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও পরমসহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে যেমন উদার ও অবারিত দ্বার, অপরদিকে স্বীয় সীমারেখা সংরক্ষণের ব্যাপারে অতি সতর্ক, সজাগ ও কঠোর। ইসলাম অমুসলিমদের প্রতি উদারতার সাথে সাথে কুফর ও কু-প্রথার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলিম ও অমুসলিমরা দুটি পৃথক জাতি এবং মুসলিমদের জাতীয় প্রতীক ও স্বাতন্ত্র্য সযত্নে সংরক্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন। শুধু ইবাদাতের ক্ষেত্রেই স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখলে চলবে না, বরং সামাজিকতার ক্ষেত্রেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হবে। এ কথা কুরআন ও হাদীসে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।

কুরআনুল কারীম ও ইসলামের অভিমত যদি এই হতো যে, যে কোন ধর্মমতের সাহায্যে মুক্তি লাভ করা সম্ভব, তাহলে ইসলাম প্রচারের জন্য জীবন উৎসর্গ করার কোন প্রয়োজন ছিল না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খেলাফায়ে রাশেদীনের জিহাদ পরিচালনা করা এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত ও কুরআন নাযিল করারও কোন প্রয়োজন থাকতো না। পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় বলা হয়েছে, “নিশ্চয় যারা সত্যিকারভাবে ঈমান এনেছে (মুসলিম হয়েছে) এবং যারা ইয়াহুদী হয়েছে এবং নাসারা (খৃষ্টান) ও সাবেয়ীনদের মধ্যে যারা আল্লাহ তা’আলা প্রতি ও কেয়ামতের দিনের প্রতি ঈমান এনেছে আর সৎকাজ করেছে, তাদের পালনকর্তার সমীপে তাদের জন্য পূর্ণ প্রতিদান সংরক্ষিত রয়েছে। তাদের কোন শঙ্কা নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।” [সূরা আল-বাকারাহ: ৬২]

এ আয়াত থেকেও ভুল বোঝার কোন অবকাশ নেই। কেননা, কুরআনের পরিভাষায় আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমান শুধু তখনই গ্রহণযোগ্য ও ধর্তব্য হয় যখন তার সাথে নবী-রাসূল, ফিরিশতা ও আসমানী কিতাবের প্রতিও ঈমান আনা হয়। তাই তাদের প্রত্যেককে সাধারণ মুসলিমদের মত পুরোপুরি ঈমান আনতে হবে। আল্লাহ্ তা’আলার প্রতি ঈমানের পাশাপাশি নবী-রাসূলগণের প্রতিও ঈমান আনা অপরিহার্য।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে (চিনে রাখুন যে) তারা আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট। অতএব, আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহ তা’আলাই তাদের মোকাবেলায় যথেষ্ট এবং তিনি সবকিছু শোনেন ও জানেন।” [সূরা আল বাকারাহঃ ১৩৭]

সূরা আন-নিসার আলোচ্য আয়াতে আরো স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলার প্রেরিত কোন একজন নবীকেও যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে সে প্রকাশ্য কাফের, তার জন্য জাহান্নামের চিরস্থায়ী আযাব অবধারিত রাসূলের প্রতি ঈমান ছাড়া আল্লাহ তা’আলার প্রতি সত্যিকার ঈমান সাব্যস্ত হয় না। শেষ আয়াতে পুনরায় দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, আখেরাতের মুক্তি ও কামিয়াবী শুধু ঐসব লোকের জন্যই সংরক্ষিত যারা আল্লাহ তা’আলার প্রতি ঈমানের সাথে সাথে তার নবী ও রাসূলগণের প্রতি যথার্থ ঈমান রাখে। বস্তুত: কুরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা ও তাফসীর করে। কুরআনী তাফসীরের পরিপন্থী কোন তাফসীর বর্ণনা কারো জন্য জায়েয নয়।

৪:১৫২ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ وَ لَمۡ یُفَرِّقُوۡا بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡهُمۡ اُولٰٓئِکَ سَوۡفَ یُؤۡتِیۡهِمۡ اُجُوۡرَهُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا

আর যারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসূলগনের প্রতি ঈমান এনেছে এবং তাদের একের সাথে অপরের পার্থক্য করেনি, অচিরেই তাদেরকে তিনি তাদের প্রতিদান দেবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

এই আয়াতে ঈমানদারদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, তাঁরা সকল নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। যেমনটি মুসলিমরা কোন নবীকে অমান্য করে না।

কুরআন কারীমের উপরোক্ত স্পষ্ট ঘোষণায় ঐ সব বিভ্রান্ত লোকদের মতবাদ খন্ডন করা হয়েছে, যারা বলে, ‘সব ধর্ম সমান।’ যারা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজেদের ধর্মমত ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিজাতির পদমূলে ‘উৎসর্গ’ দিতে চায়। যারা কুরআনের স্পষ্ট বিধানকে উপেক্ষা করে অন্যান্য ধর্মানুসারীদেরকে বুঝাতে চায় যে, ইসলামই একমাত্র মুক্তির সনদ নয়, বরং অমুসলিমরাও তাদের নিজ নিজ ধর্মে-কর্মে স্থির থেকে পরকালে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে! অথচ কুরআনের এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপনের সাথে সাথে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরী। সুতরাং কেউ যদি শেষ রসূলের রিসালতকে অমান্য করে, তাহলে আল্লাহর উপর তার ঈমান গ্রহণযোগ্য হবে না। (আরো দেখুন সূরা বাক্বারার ৬২নং আয়াতের টীকা)

اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡهِ مِنۡ رَّبِّهٖ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ ۟ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡ رُّسُلِهٖ ۟ وَ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ٭۫ غُفۡرَانَکَ رَبَّنَا وَ اِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ

রাসূল তার প্রভুর পক্ষ থেকে যা তার কাছে নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ এবং তার রাসূলগণের উপর। আমরা তাঁর রাসূলগনের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলেঃ আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব। আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল।বাকারাঃ২৮৫

 

সহায়কঃ

তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বয়ান, তাফহিমুল কুর’আন