সূরা আন নিসাঃ ২০তম রুকু(১৩৫-১৪১)আয়াত
৪:১৩৫ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ بِالۡقِسۡطِ شُهَدَآءَ لِلّٰهِ وَ لَوۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ اَوِ الۡوَالِدَیۡنِ وَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ ۚ اِنۡ یَّکُنۡ غَنِیًّا اَوۡ فَقِیۡرًا فَاللّٰهُ اَوۡلٰی بِهِمَا ۟ فَلَا تَتَّبِعُوا الۡهَوٰۤی اَنۡ تَعۡدِلُوۡا ۚ وَ اِنۡ تَلۡوٗۤا اَوۡ تُعۡرِضُوۡا فَاِنَّ اللّٰهَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا
হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ্ উভয়েরই ঘনিষ্টতর। কাজেই তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হইয়ো না। যদি তোমরা বক্রতা কথা বল বা পাশ কাটিয়ে যাও তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।
এ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হ’ল মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করা। মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার না থাকলে মানুষ পশুর মত হয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বে মানব রচিত আইন ইনছাফ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা আদেশ করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁর মনোনীত রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন তাঁর বিধানকে বাস্তবায়নের জন্য।
সুবিচার বাধাগ্রস্থ দুই দিক দিয়ে-
১। কারো প্রতি অধিক ভালোবাসা
২। কার প্রতি ঘৃনা
এই আয়াতে মহান আল্লাহ ঈমানদারকে সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করার এবং ন্যায় অনুযায়ী সাক্ষ্য দেওয়ার প্রতি তাকীদ করছেন, যদিও তার কারণে তাকে অথবা তার পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনদেরকে ক্ষতির শিকার হতে হয় তবুও। কেননা, সব কিছুর উপর সত্যের থাকে কর্তৃত্ব ও প্রাধান্য
কোন ধনবানের ধন এবং কোন দরিদ্রের দরিদ্রতার ভয় যেন তোমাদেরকে সত্য কথা বলার পথে বাধা না দেয়। বরং আল্লাহ এদের তুলনায় তোমাদের অনেক কাছে এবং তাঁর সন্তুষ্টি সবার ঊর্ধ্বে।
এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে,
وَأُمِرْتُ لِأَعْدِلَ بَيْنَكُمُ ‘তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি’ (শূরা ৪২/১৫)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ النَّاسِ أَن تَحْكُمُواْ بِالْعَدْلِ ‘তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচার কার্য পরিচালনা করবে তখন তা ন্যায় পরায়ণতার সাথে করবে (নিসা ৪/৫৮)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ كُوْنُوْا قَوَّامِيْنَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُواْ اللهَ إِنَّ اللهَ خَبِيْرٌ بِمَا تَعْمَلُوْنَ
‘হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। সুবিচার করবে, এটা তাক্বওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন’ (মায়েদা ৫/৮)।
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে,
وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُواْ وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى
‘যখন তোমরা কথা বলবে তখন ন্যায় কথাই বলবে, তোমার নিকট আত্মীয় হলেও (আন‘আম ৬/১৫২)।
تَلْوُوْا শব্দটি لَي ধাতু থেকে গঠিত, যার অর্থ পরিবর্তন করা এবং জেনে-শুনে মিথ্যা বলা। অর্থাৎ, পরিবর্তন-পরিবর্ধন এবং পাশ কাটিয়ে যাওয়া বলতে (সত্য) সাক্ষ্য গোপন করা ও তা পরিত্যাগ করা। এই দু’টি জিনিস থেকেও বাধা প্রদান করা হয়েছে। এই আয়াতে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে এবং এর জন্য যা যা প্রয়োজন তার প্রতি যত্ন নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমনঃ-
* সর্বাবস্থায় সুবিচার প্রতিষ্ঠা কর, তা থেকে পাশ কাটিয়ে যেয়ো না এবং কোন তিরস্কারকারীর তিরস্কার অথবা অন্য কোন চাপ বা প্রবর্তনা যেন এ পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। বরং এর প্রতিষ্ঠার জন্য তোমরা একে অপরের সাহায্যকারী হও।
* তোমাদের কেবল লক্ষ্য হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। যেহেতু এ রকম হলে পরিবর্তন, হেরফের এবং গোপন করা থেকে তোমরা বিরত থাকবে। ফলে তোমাদের বিচার-ফায়সালা ন্যায়-নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।
* ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষতি যদি তোমার অথবা তোমার পিতা-মাতার কিংবা তোমার আত্মীয়-স্বজনের উপর আসে, তবুও তুমি কোন পরোয়া না করে নিজের ও তাদের স্বার্থ রক্ষার তুলনায় সুবিচারের দাবীসমূহকে অধিক গুরুত্ব দাও।
* ধনের কারণে কোন ধনীর খাতির করো না এবং কোন দরিদ্রের প্রতি দরিদ্রতার ফলে মায়া প্রদর্শন করবে না। কেননা, আল্লাহই জানেন তাদের উভয়ের কল্যাণ কিসে আছে?
* সুবিচার কায়েম করার পথে প্রবৃত্তি, পক্ষপাতিত্ব এবং শত্রুতা যেন বাধা না হয়, বরং এ সব কিছুকে পরিহার করে বাধাহীন সুবিচার করো।
যে সমাজে এই সুবিচারের যত্ন নেওয়া হবে, সে সমাজ হবে নিরাপত্তা ও শান্তির আধার এবং আল্লাহর পক্ষ হতে সেখানে অজস্র রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হবে।
সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এ বিষয়টিকে খুব ভালোভাবেই হৃদয়ঙ্গম করে নিয়েছিলেন। সুতরাং আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রাঃ) সম্পর্কে এসেছে যে, রসূল (সাঃ) তাঁকে খায়বারের ইয়াহুদীদের নিকট পাঠালেন, সেখানকার ফলসমূহ ও ফসলাদি অনুমান করে দেখে আসার জন্য। ইয়াহুদীরা তাঁকে ঘুষ পেশ করল; যাতে তিনি তাদের ব্যাপারে একটু শিথিলতা প্রদর্শন করেন। তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তাঁর পক্ষ হতে প্রতিনিধি হয়ে এসেছি যিনি দুনিয়ায় আমার কাছে সব থেকে বেশী প্রিয়তম এবং তোমরা আমার নিকট সর্বাধিক অপ্রিয়। কিন্তু স্বীয় প্রিয়তমের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং তোমাদের প্রতি আমার শত্রুতা আমাকে তোমাদের ব্যাপারে সুবিচার না করার উপর উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না।’ এ কথা শুনে তারা বলল, ‘এই সুবিচারের কারণেই আসমান ও যমীনের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা সুপ্রতিষ্ঠিত রয়েছে।’ (ইবনে কাসীর)
ইরশাদ হয়েছে—-
(আমি তাকে বললাম) “ হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য সহকারে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করো এবং প্রবৃত্তির কামনার অনুসরণ করো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপরথগামী করবে৷ যারা আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হয় অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি, যেহেতু তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে৷সূরা সাদঃ২৬
ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বিচারকের আচরণ যেমন হওয়া উচিত :
(ক) মোকদ্দমার বিবরণ শান্ত মেযাজে ও গভীর মনোনিবেশের সাথে শ্রবণ করা।
(খ) বাদী ও বিবাদীকে সম্মুখে বসানো।
(গ) বাদী ও বিবাদী কোন পক্ষের সাথে পক্ষপাতমূলক আচরণ না করা, যাতে অন্য পক্ষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
(ঘ) সাক্ষীগণের সাথে এমন আচরণ না করা, যাতে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যথার্থ সাক্ষ্য প্রদানে অক্ষম হয়ে পড়ে।
(ঙ) বাদী-বিবাদী কোন পক্ষকে ভীত-সন্ত্রস্ত না করা।
(চ) প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে কোন পক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত অথবা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কিংবা অন্যের আকাঙ্ক্ষা মোতাবেক মোকদ্দমার রায় প্রদান না করা।
(ছ) মোকদ্দমার রায় ঘোষণার পূর্ব পর্যন্ত তা একান্তভাবে গোপন রাখা।
(জ) আদালতের বিচারকার্যের আগে সংশ্লিষ্ট কার্য ব্যতীত অন্য কোন কাজ না করা।
(ঝ) কর্কশ ভাষী, নিষ্ঠুর বা উৎপীড়ক না হওয়া।
(ঞ) ক্রোধান্বিত, ক্ষুধার্ত ও ঘুম জড়িত, তন্দ্রাচ্ছন্ন অথবা ব্যক্তিগত কারণে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিচারকার্য পরিচালনা না করা।
(ট) যতক্ষণ পর্যন্ত শান্ত মনে ও নিবিষ্টচিত্তে বিচারকার্য পরিচালনা করা সম্ভব, ততক্ষণ বিচারকার্য পরিচালনা করা এবং বিরক্তি বা শ্রান্তিবোধ হ’লে বিচারকার্য মুলতবী করা।
(ঠ) স্বীয় আত্মীয়-স্বজন পরস্পরের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের করলে তাড়াহুড়া না করে তাদের মধ্যে সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করা।
(ড) ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত না হওয়া।
(ঢ) বাদী-বিবাদী কারো নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ না করা।
(ণ) আত্মীয় ব্যতীত কারো নিকট হ’তে কোন উপহার-উপঢৌকন গ্রহণ না করা।
(ত) কোন জানাযায় শরীক হ’লে এবং রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে গেলে তথায় বেশীক্ষণ অবস্থান না করা; রুগ্ন ব্যক্তি বাদী বা বিবাদী হ’লে তাদেরকে দেখতে না যাওয়া।
(থ) বাদী বা বিবাদীর কোন আহার্যের দাওয়াত গ্রহণ না করা।
(দ) একনিষ্ঠভাবে শরী‘আতের অনুসরণ করা।
(ধ) ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, যোগ্যতা ও সততার প্রতীক হওয়া, যাতে লোকেরা তার প্রতি আস্থাশীল হয়।
(ন) জনগণের সাথে সদ্ব্যবহার করা এবং নিজ কর্মচারীগণকেও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দেওয়া।
উল্লেখ্য, ওমর (রাঃ) আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-কে যে দীর্ঘ পত্র লেখেন, উপরোক্ত বক্তব্যগুলো তারই সারাংশ।
দারাকুৎনী হা/৪৫২৪; ইবনু তাইমিয়াহ, মিনহাজুস সুন্নাহ ৬/৩৭।
বিচারক তিন শ্রেণির, তার মধ্যে দুই শ্রেণি জাহান্নামী : হজরত বুরায়দা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : বিচারক তিন শ্রেণির, তার মধ্যে দুই শ্রেণির বিচারক জাহান্নামি এবং এক শ্রেণির বিচারক হবে জান্নাতি।
প্রথম প্রকার বিচারক তারা, যারা সত্যকে জানে এবং সত্যের সঙ্গেই বিচার ফায়সালা করে, তারা জান্নাতি।
দ্বিতীয় প্রকার সেসব বিচারক, যারা সত্যকে জানে কিন্তু তদানুযায়ী বিচার-ফায়সালা করে না বরং জুলুম করে, তারা জাহান্নামি।
তৃতীয় প্রকার সেসব বিচারক, যারা সত্যকে জানেও না এবং সে অজ্ঞতা নিয়েই মানুষের বিচার-ফায়সালা করে, তার জাহান্নামি। (আবু দাউদ)
ন্যায়বিচার এক প্রকার ইবাদত : রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এবং খোলাফায়ে রাশেদীন বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন এবং অন্য সাহাবাদেরও বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনুল হাম হানাফী (রহ.) বলেন, বিচারক নিয়োগ করা ফরজ এবং এ ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমা কায়েম হয়েছে। (বদরুদ্দীন কাশানী, বাদাই আস সানাই, সপ্তম খণ্ড)
বিচারক নিয়োগ সম্পর্কে কোরআন-হাদিস পর্যালোচনা পূর্বক ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞরা বিচারক হওয়ার আটটি শর্ত বর্ণনা করেছেন। তা হলো : ১. ঈমান ২. বয়ঃপ্রাপ্তি ৩. বুদ্ধি ৪. স্বাধীনতা ৫. পুরুষ হওয়া ৬. ন্যায়-নিষ্ঠা ও সততা ৭. ইসলামি আইনে পারদর্শিতা ৮. শারীরিক সুস্থতা।
ষষ্ঠ শর্ত সম্পর্কে তথা ন্যায়-নিষ্ঠা ও সততা সম্পর্কে ইসলামি আইন বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ হলো বেশির ভাগ ইমাম বলেন, ফাসেক ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা জায়েজ নেই এবং তার রায় কার্যকর হবে না। হানাফি ঈমামদের অভিমত হলো, ফাসেক ব্যক্তিকে বিচারক নিয়োগ করা নাজায়েজ। তবে তার রায় অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে। যদি তার ফায়সালা কোরআন সুন্নাহ ও ইজমার পরিপন্থী না হয়।
উল্লেখ্য, ফাসেক বলা হয় ওই ব্যক্তিকে যে কবিরা গুনাহ ও অশ্লীলতা হতে বিরত না থাকে এবং ফরজ-ওয়াজিবের তোয়াক্কা না করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বলতে বোঝায় নির্বাহী বিভাগের অযথা হস্তক্ষেপমুক্ত থাকা এবং স্বাধীনভাবে বিচার বিভাগ কাজ করতে পারা। তা ছাড়া ন্যায় প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
৪:১৩৬ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اٰمِنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ وَ الۡکِتٰبِ الَّذِیۡ نَزَّلَ عَلٰی رَسُوۡلِهٖ وَ الۡکِتٰبِ الَّذِیۡۤ اَنۡزَلَ مِنۡ قَبۡلُ ؕ وَ مَنۡ یَّکۡفُرۡ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا
হে মুমিনগণ! তোমরা ঈমান আন আল্লাহ্র প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি, এবং সে কিতাবের প্রতি যা আল্লাহ তার রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। আর সে গ্রন্থের প্রতিও যা তার পূর্বে তিনি নাযিল করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ, তার ফিরিশতাগণ, তার কিতাবসমূহ, তার রাসূলগণ ও শেষ দিবসের প্রতি কুফর করে সে সুদূর বিভ্রান্তিতে পতিত হলো
যারা পূর্বেই ঈমান এনেছে তাদেরকে আবার বলা, ‘তোমরা ইমান আনো’-কথাটা আপাত দৃষ্টিতে অদ্ভুত মনে হয়৷ কিন্তু আসলে এখানে ‘ঈমান’ শব্দটি দু’টি আলাদা আলাদা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷
ঈমান আনার একটি অর্থ হচ্ছে অস্বীকৃতির পরিবর্তে স্বীকৃতির পথ অবলম্বন করা৷ অস্বীকারকারীদের থেকে আলাদা হয়ে স্বীকৃতিদানকারীদের দলে শামিল হয়ে যাওয়া৷ এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে: কোন জিনিসকে সাচ্চা দিলে, সরল অন্ত:করণে এবং পূর্ণ দায়িত্ব সচেতনতা সহকারে মেনে নেয়া৷ নিজের চিন্তা, রুচি, পছন্দ , দৃষ্টিভংগী, মনোভাব, চাল-চলন এবং নিজের বন্ধুতা, শত্রুতা ও প্রচেষ্টা-সংগ্রামের সকল ক্ষেত্রকে সে যে আকীদার ওপর ঈমান এনেছে পুরোপুরি সেই অনুযায়ী ঢেলে সাজানো৷ প্রথম অর্থের দিক দিয়ে যেসব মুসলমান স্বীকারকারীদের অন্তরভূক্ত হয় এ আয়াতে তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে৷ তাদের কাছে দাবী করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় অর্থটির প্রেক্ষিতে তোমরা সাচ্চা মু’মিনে পরিণত হও৷
বিশ্বাসীদেরকে বিশ্বাস করা ও ঈমানদারদেরকে ঈমান আনার প্রতি তাকীদ করা, অর্জিত জিনিস অর্জন করার ব্যাপার নয়; বরং এই তাকীদের মাধ্যমে ঈমানকে পরিপূর্ণ করার এবং তার উপর সুদৃঢ় ও অবিচল থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন [اِهْدِنَا الصِّراطَ المُسْتَقِيْمَ] এর ভাবার্থ। (এ ছাড়া হাদীসে এসেছে যে, ঈমান পুরাতন হয় এবং তার নবায়নের জন্য দু’আ করতে হয়। সিলসিলাহ সহীহাহ ১৫৮৫নং)
রাসুল (সল্লাল্লহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
”কাপড় যেভাবে পুরানো হয়ে যায়,অন্তরের ঈমানও একইভাবে পুরানো হয়ে যায়। কাজেই তোমরা আল্লাহ্র কাছে তোমাদের অন্তরের ঈমান নবায়ন করে দেয়ার জন্য দু’আ কর।”
~[আল মুস্তাদরাক আল হাকীম,আত-ত্ববারানি মু’জামুল কাবীর,হাদিসটি সহীহ, সিলসিলাহ সহীহাহ,হাদিস#১৫৮৫]
اللَّهُمَّ جَدِّدِ الْإِيْمَانَ فِي قُلُوْبِنَا
আল্লাহুম্মা জাদ্দিদিল ঈমানা ফি কুলুবিনা
হে আল্লাহ, তুমি আমাদের হৃদয়ের ইমানকে নবায়ন করে দাও।
(তাবারানী,হাকেম, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৫৮৫ নং)
কুফরী করারও দু’টি অর্থ হয়৷ এর একটি অর্থ হচ্ছে,সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অস্বীকার করা৷
দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, মুখে মেনে নেয়া কিন্তু মনে মনে অস্বীকার করা৷ অথবা নিজের মনোভাবের মাধ্যমে একথা প্রমাণ করা যে, সে যে জিনিসটি মেনে নেয়ার দাবী করছে আসল সেটিকে মানে না৷ এখানে কুফরী শব্দটি এই দু’ইট অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে৷ ইসলামের এই বুনিয়াদী আকীদাগুলোর ব্যাপারে উপরোল্লিখিত দুই ধরনের কুফরীর মধ্য থেকে যে কোনটি অবলম্বন করা হবে তার ফল হবে কেবল হক থেকে দূরে সরে যাওয়া এবং বাতিলের পথে নিষ্ফল প্রয়াসে মাথা খুঁড়ে মরা৷ এ বিষয়টি সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করে দেয়াই এই আয়াতটির উদ্দেশ্য৷
৪:১৩৭ اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ثُمَّ کَفَرُوۡا ثُمَّ اٰمَنُوۡا ثُمَّ کَفَرُوۡا ثُمَّ ازۡدَادُوۡا کُفۡرًا لَّمۡ یَکُنِ اللّٰهُ لِیَغۡفِرَ لَهُمۡ وَ لَا لِیَهۡدِیَهُمۡ سَبِیۡلًا
নিশ্চয় যারা ঈমান আনে ও পরে কুফরী করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরী করে, তারপর তাদের কুফরী প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোন পথ দেখাবেন না
এখানে সেইসব লোকের কথা বলা হয়েছে যারা দ্বীনকে নিছক একটি হাল্কা প্রমোদ ও চিত্তবিনোদন হিসেবে গ্রহণ করে৷ যারা দ্বীনকে একটি খেলনা বানিয়ে নিজেদের কল্পনা ও কামনার রশি দিয়ে ইচ্ছেমতো তাকে ঘোরাতে থাকে তাদের কথাই এখানে আলোচিত হয়েছে৷ চিন্তার জগতে একটা আলোড়ন উঠলো আর অমনি মুসলমান হয়ে গেলো ৷ তারপর আর একটা আলোড়ন উঠলো আর অমনি কাফের হয়ে গেলো৷ অথবা যখন দেখা গেলো মুসলমান হয়ে গেলে বৈষয়িক স্বার্থ হাসিল করা যাবে তখন মুসলমান হয়ে গেলো৷ আবার যখন স্বার্থের খুঁটি ঘুরে গেলো তখন তার পদসেবা করার জন্য নির্দ্বিধায় সেদিকে চলে গেলো৷ এ ধরনের লোকদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত বা হিদায়াত কিছুই নেই৷
”তারপর নিজেদের কুফরীর মধ্যে তারা এগিয়ে যেতেই থাকলো”- এখানে একথা বলার অর্থ হচ্ছে: কোন ব্যক্তি কেবল কাফের হয়ে গিয়েই ক্ষান্ত হয় না৷ বরং এরপর সে অন্য লোকদেরকেও ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করে৷ ইসলামের বিরুদ্ধে গোপন চক্রান্ত করে এবং প্রকাশ্যে নানা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে৷ কুফরীরর শির উন্নত করার এবং তার মোকাবিলায় আল্লাহর দ্বীনের ঝাণ্ডা ধূলায় লুণ্ঠিত করার জন্য নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালায়৷ এটিকেই বলে কুফরীতে আরো উন্নতি হওয়া, কুফরী আরো বেড়ে যাওয়া এবং একটি অপরাধের পর আর একটি অপরাধ তারপর আর একটি অপরাধ-এভাবে অপরাধের ফিরিস্তি ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া৷ পরিণামে এ শাস্তিও নিছক কুফরী থেকে অনেক বেশী হতে হবে৷
কোন কোন মুফাসসির এ থেকে ইয়াহুদীদের বুঝিয়েছেন। তারা মূসা (আঃ)-এর উপর ঈমান এনেছিল, কিন্তু উযায়ের (আঃ)-কে অস্বীকার করেছিল। আবার উযায়ের (আঃ)-এর উপর ঈমান আনলে ঈসা (আঃ)-কে অস্বীকার করেছিল। এইভাবে তাদের কুফরী ও অবিশ্বাস বাড়তেই থাকল। এমনকি তারা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুঅতকেও অস্বীকার করে বসল। কেউ কেউ এ থেকে মুনাফিকদেরকে বুঝিয়েছেন। কেননা, তাদের কেবল লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের ক্ষতি সাধন করা। তাই তারা বারবার ভান করে নিজেদেরকে মুসলিম প্রকাশ করত। পরিশেষে তাদের কুফরী ও ভ্রষ্টতা এত বেড়ে গেল যে, তাদের হিদায়াত লাভের আশাই শেষ হয়ে গেল।
৪:১৩৮ بَشِّرِ الۡمُنٰفِقِیۡنَ بِاَنَّ لَهُمۡ عَذَابًا اَلِیۡمَۨا
মুনাফিকদেরকে শুভ সংবাদ দিন যে, তাদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে।
মুনাফিকীর পরিচয়- আভিধানিক অর্থে :
আরবী ভাষায় ن (নূন), ف (ফা) ও ق (ক্বাফ) বর্ণ তিনটি দ্বারা গঠিত শব্দের দু’টি উচ্চারণ রয়েছে- نَفَقَ ও نَفِقَ তন্মধ্যে একটির অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া, বিদূরিত হওয়া এবং অন্যটির অর্থ কোন জিনিস গোপন করা, উপেক্ষা করা। শব্দটি اَلنَّفَقُ থেকে নির্গত। এ শব্দটির অর্থ মাটির মধ্যস্থিত গর্ত বা সুড়ঙ্গ, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকা যায়। মুনাফিককে এজন্য মুনাফিক বলা হয়েছে যে, মুনাফিক তার কুফরী বিশ্বাসকে মনের মাঝে লুকিয়ে রাখে। যদিও মুনাফিকীর বিষয়টি আরবী ভাষায় সুবিদিত। তবুও আরবরা শব্দটিকে কোন বিশেষ অর্থে নির্দিষ্ট করেনি।
শরী‘আতের পরিভাষায় মুনাফিকী :
ভালকে প্রকাশ করা এবং মন্দকে গোপন রাখার নাম মুনাফিকী। ইবনু জুরাইজ বলেছেন, মুনাফিক সেই যার কথা তার কাজের, গোপনীয়তা প্রকাশ্যতার, ভেতর বাহিরের এবং বাহ্যিকতা অদৃশ্যমানতার বিপরীত।
মুনাফিকীর প্রকারভেদ :
মুনাফিকী বড় ও ছোট এই দু’ভাগে বিভক্ত। ইমাম ইবনু তায়মিয়া (রহঃ) বলেছেন, ‘কুফরের মতই মুনাফিকীর স্তর ভেদ আছে। এজন্য অনেক সময় বলা হয়, এমন কুফর যা ইসলাম থেকে বের করে দেয় এবং এমন কুফর যা ইসলাম থেকে বের করে না। অনুরূপ বড় মুনাফিকী (نفاق أكبر) ও ছোট মুনাফিকী (نفاق أصغر)। ইবনু তাইমিয়া, মাজমূউ ফাতাওয়া ৭/৫২৪।
১. বিশ্বাসগত মুনাফিকী (বড় মুনাফিকী) : যে মুনাফিক বাইরে নিজের ঈমান ও ইসলাম যাহির করে কিন্তু নিজের মনের মাঝে কুফরী লালন করে, সে আক্বীদাগত মুনাফিক। এ ধরনের মুনাফিক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ছিল। এদেরই নিন্দায় কুরআন নাযিল হয়েছে এবং এদেরকে কুরআন কাফির বলেও ঘোষণা দিয়েছে। কুরআনের বার্তা অনুযায়ী এরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে বসবাস করবে
২. আমল বা কর্মগত মুনাফিকী (ছোট মুনাফিকী) :
ধর্মীয় কাজগুলো লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়মমাফিক পালন না করা, তবে জনসমক্ষে সেগুলো যথাযথ পালন করার নাম আমল বা কর্মগত মুনাফিকী। এক্ষেত্রে কিন্তু আল্লাহর প্রতি ঈমান ও অন্যান্য আক্বীদা-বিশ্বাসে কোন ঘাটতি থাকবে না। ইবনু রজব বলেছেন, ছোট মুনাফিকী হ’ল আমলে মুনাফিকী। যখন মানুষ প্রকাশ্যে নেক আমল করে কিন্তু অপ্রকাশ্যে তার উল্টো কাজ করে তখন তা ছোট মুনাফিকী বলে গণ্য হয়।
আমলকেন্দ্রিক এই ছোট মুনাফিকী মূল ঈমান বিদ্যমান থাকা অবস্থায়ও মুসলিমের মনে বাসা বাধতে পারে। যদিও সেটা কবীরা বা বড় গুনাহ।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘দু’টি আচার কোন মুনাফিকের মধ্যে মেলে না- সদাচার ও দ্বীন সম্পর্কিত জ্ঞান’তিরমিযী হা/২৬৮৪, আলবানী এটিকে ছহীহ বলেছেন।
৪:১৩৯ الَّذِیۡنَ یَتَّخِذُوۡنَ الۡکٰفِرِیۡنَ اَوۡلِیَآءَ مِنۡ دُوۡنِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ؕ اَیَبۡتَغُوۡنَ عِنۡدَهُمُ الۡعِزَّۃَ فَاِنَّ الۡعِزَّۃَ لِلّٰهِ جَمِیۡعًا
মুমিনগণের পরিবর্তে যারা কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা কি ওদের কাছে ইযযত চায়? সমস্ত ইযযত তো আল্লাহরই।
এ আয়াতে কাফের ও মুশরিকদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য স্থাপন করাকে নিষিদ্ধ করে এ ধরণের আচরণে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। সাথে সাথে এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার উৎস ও মূল কারণ বর্ণনা করে একেও অযথা অবান্তর প্রতিপন্ন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছেঃ “তারা কি ওদের কাছে গিয়ে ইজ্জত-সম্মান লাভ করতে চায়? তবে ইজ্জত-সম্মানতো সম্পূর্ণভাবে আল্লাহরই মালিকানাধীন।” কাফের ও মুশরিকদের সাথে সৌহার্দ্য ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখা এবং অন্তরঙ্গ মেলা-মেশার প্রধান কারণ এই যে, তাদের বাহ্যিক মানমর্যাদা, শক্তি-সামর্থ্য, ধনবলে প্রভাবিত হয়ে হীনমন্যতার শিকার হয় এবং মনে করে যে, তাদের সাহায্য-সহযোগিতায় আমাদেরও মানমর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
আল্লাহ্ তাআলা তাদের ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করে বলেন যে, তারা এমন লোকদের সাহায্যে মর্যাদাবান হওয়ার আকাংখা করছে, যাদের নিজেদেরই সত্যিকারের কোন মর্যাদা নেই। তাছাড়া যে শক্তি ও বিজয়ের মধ্যে সত্যিকারের ইজ্জত ও সম্মান নিহিত, তা তো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই মালিকানাধীন। অন্য কারো মধ্যে যখন কোন ক্ষমতা বা সাফল্য পরিদৃষ্ট হয়, তা সবই আল্লাহ প্রদত্ত। অতএব, মানমর্যাদা দানকারী মালিককে অসন্তুষ্ট করে তার শত্রুদের থেকে ইজ্জত হাসিল করার অপচেষ্টা কত বড় বোকামী।
অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা এ ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, “আর ইজ্জত-সম্মান একমাত্র আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদারদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু মুনাফেকরা তা অবগত নয়।” [সূরা আল-মুনাফিকুন: ৮]
এখানে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনদের উল্লেখ করে বোঝানো হয়েছে যে, ইজ্জতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। তিনি যাকে ইচ্ছা আংশিক মর্যাদা দান করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও মুমিনগণ যেহেতু আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত অনুগত, পছন্দনীয় ও প্রিয়পাত্র, তাই তিনি তাদেরকে সম্মান দান করেন।
পক্ষান্তরে কাফের ও মুশরিকদের ভাগ্যে সত্যিকার কোন ইজ্জত নেই। অতএব, তাদের সাথে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক স্থাপন করে সম্মান অর্জন করা সুদূর পরাহত। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ যে ব্যক্তি বান্দাদের (মাখলুকের) মর্যাদাবান হওয়ার বাসনা করে আল্লাহ তা’আলা তাকে লাঞ্ছিত করেন। [বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান: ৭৪২১] সুতরাং আয়াতের মর্ম এই যে, কাফের, মুশরিক, পাপিষ্ঠ ও পথভ্রষ্টদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অর্জনের ব্যর্থ চেষ্টা করা অন্যায় ও অপরাধ।
مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعِزَّةَ فَلِلَّهِ الْعِزَّةُ جَمِيعًا ] অর্থাৎ, কেউ সম্মান চাইলে জেনে রেখো, সমস্ত সম্মান আল্লাহরই জন্য। (সূরা ফাত্বিরঃ ১০)
৪:১৪০ وَ قَدۡ نَزَّلَ عَلَیۡکُمۡ فِی الۡکِتٰبِ اَنۡ اِذَا سَمِعۡتُمۡ اٰیٰتِ اللّٰهِ یُکۡفَرُ بِهَا وَ یُسۡتَهۡزَاُ بِهَا فَلَا تَقۡعُدُوۡا مَعَهُمۡ حَتّٰی یَخُوۡضُوۡا فِیۡ حَدِیۡثٍ غَیۡرِهٖۤ ۫ۖ اِنَّکُمۡ اِذًا مِّثۡلُهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ جَامِعُ الۡمُنٰفِقِیۡنَ وَ الۡکٰفِرِیۡنَ فِیۡ جَهَنَّمَ جَمِیۡعَۨا
কিতাবে তোমাদের প্রতি তিনি তো নাযিল করেছেন যে, যখন তোমরা শুনবে, আল্লাহর আয়াত প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে এবং তা নিয়ে বিদ্রুপ করা হচ্ছে, তখন যে পর্যন্ত তারা অন্য প্রসঙ্গে লিপ্ত না হবে তোমরা তাদের সাথে বসো না, নয়তো তোমরাও তাদের মত হবে। মুনাফিক এবং কাফের সবাইকে আল্লাহ তো জাহান্নামে একত্র করবেন।
এ আয়াতের মর্ম এই যে, যদি কোন প্রভাবে কতিপয় লোক একত্রিত হয়ে আল্লাহ তা’আলার কোন আয়াত বা হুকুমকে অস্বীকার বা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে থাকে, তবে যতক্ষণ তারা এহেন গর্হিত ও অবাঞ্ছিত কাজে লিপ্ত থাকবে, ততক্ষণ তাদের মজলিশে বসা বা যোগদান করা মুসলিমদের জন্য হারাম।
বাতিলপন্থীদের মজলিশে উপস্থিত ও তার হুকুম কয়েক প্রকার।
প্রথমতঃ তাদের কুফরী চিন্তাধারার প্রতি সম্মতি ও সন্তুষ্টি সহকারে যোগদান করা। এটা মারাত্মক অপরাধ ও কুফরী।
দ্বিতীয়তঃ গর্হিত আলোচনা চলাকালে বিনা প্রয়োজনে অপছন্দ সহকারে উপবেশন করা। এটা অত্যন্ত অন্যায় ও ফাসেকী।
তৃতীয়তঃ পার্থিব প্রয়োজনবশতঃ বিরক্তি সহকারে বসা জায়েয।
চতুর্থতঃ জোর-জবরদস্তির কারণে বাধ্য হয়ে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে বসা ক্ষমার যোগ্য। পঞ্চমতঃ তাদের সৎপথে আনয়নের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হওয়া সওয়াবের কাজ।
আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, এমন মজলিশ যেখানে আল্লাহ্ তা’আলার আয়াত ও আহকামকে অস্বীকার, বিদ্রুপ বা বিকৃত করা হয়, সেখানে হৃষ্টচিত্তে উপবেশন করলে তোমরাও তাদের সমতুল্য ও তাদের গোনাহর অংশীদার হবে। অর্থাৎ আল্লাহ না করুন, তোমরা যদি তাদের কুফর কথা-বার্তা মনে প্রাণে পছন্দ কর, তাহলে বস্তুতঃ তোমরাও কাফের হয়ে যাবে। কেননা, কুফরী পছন্দ করাও কুফরী। আর যদি তাদের কথা-বার্তা পছন্দ না করা সত্বেও বিনা প্রয়োজনে তাদের সাথে উঠাবসা কর এমতাবস্থায় তাদের সমতুল্য হবার অর্থ হবে তারা যেভাবে শরীআতকে হেয় প্রতিপন্ন করা এবং ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষতি সাধন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে, ক্ষতি সাধন করছ।
‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন এমন দাওয়াতে শরীক না হয়, যেখানে মদ পরিবেশন করা হয়। (মুসনাদ আহমাদ ১/২০, ৩/৩৩৯) এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এমন সব মজলিস ও অনুষ্ঠানে শরীক হওয়া মহাপাপ, যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের বিধানের সাথে কথায় ও কাজের মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হয়। যেমন, বর্তমানে বহু নেতা, আধুনিক ও পাশ্চাত্য সভ্যতায় প্রভাবিত লোকদের মজলিসে সাধারণতঃ হয়ে থাকে।
অনুরূপ যা বিবাহ ও বার্ষিক বহু অনুষ্ঠানে ঘটে থাকে। [اِنَّكُمْ اِذًا مِّثْلَهُمْ] (তোমরাও তাদের মত হয়ে যাবে) কুরআনের এই ধমক ঈমানদারদের মধ্যে কম্পন সৃষ্টি করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, অবশ্য অন্তরে ঈমান থাকলে তবেই।
৪:১৪১ الَّذِیۡنَ یَتَرَبَّصُوۡنَ بِکُمۡ ۚ فَاِنۡ کَانَ لَکُمۡ فَتۡحٌ مِّنَ اللّٰهِ قَالُوۡۤا اَلَمۡ نَکُنۡ مَّعَکُمۡ ۫ۖ وَ اِنۡ کَانَ لِلۡکٰفِرِیۡنَ نَصِیۡبٌ ۙ قَالُوۡۤا اَلَمۡ نَسۡتَحۡوِذۡ عَلَیۡکُمۡ وَ نَمۡنَعۡکُمۡ مِّنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ ؕ فَاللّٰهُ یَحۡکُمُ بَیۡنَکُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ وَ لَنۡ یَّجۡعَلَ اللّٰهُ لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ سَبِیۡلًا
যারা তোমাদের অমঙ্গলের প্রতীক্ষায় থাকে, তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জয় হলে বলে, আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না। আর যদি কাফেরদের কিছু বিজয় হয়, তবে তারা বলে, আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে প্রবল ছিলাম না এবং আমরা কি তোমাদেরকে মুমিনদের হাত থেকে রক্ষা করিনি? আল্লাহ কেয়ামতের দিন তোমাদের মধ্যে বিচার মীমাংসা করবেন এবং আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না।
এটিই প্রত্যেক যুগের মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। মৌখিক স্বীকারোক্তি ও ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে নামমাত্র প্রবেশের মাধ্যমে মুসলিম হিসাবে যতটুকু স্বার্থ ভোগ করা যায় তা তারা ভোগ করে। আবার অন্যদিকে কাফের হিসাবে যে স্বার্থটুকু ভোগ করা সম্ভব তা ভোগ করার জন্য তারা কাফেরদের সাথে যোগ দেয়। তাদেরকে বলেঃ আমরা মোটেই গোড়া বা প্রতিক্রিয়াশীল অথবা মৌলবাদী-বিদ্বেষপরায়ণ মুসলিম নই। মুসলিমদের সাথে আমাদের নামের সম্পর্ক আছে কিন্তু আমাদের মানসিক ঝোঁক, আগ্রহ ও বিশ্বস্ততা রয়েছে তোমাদের প্রতি। চিন্তা-ভাবনা, আচার-ব্যবহার, রুচি-প্রকৃতি ইত্যাদি সবদিক দিয়ে তোমাদের সাথে আমাদের গভীর মিল। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরীর সংঘর্ষে আমরা তোমাদের পক্ষই অবলম্বন করব।
এ আয়াতের অর্থ এ নয় যে, দুনিয়াতে কোন কাফের ঈমানদারদের উপর বিজয়ী হবে না কারণ, এটার মূলকথা আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত। আয়াতের শুরুতেই কিয়ামতের দিন উল্লেখ করার মাধ্যমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এক লোক এসে বলল যে, এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না” অথচ কাফেররা মুমিনদের উপর বিজয়ী হচ্ছে। তখন আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আয়াতের প্রথমাংশের দিকে তাকাও। সেখানে বলা হয়েছে, কিয়ামতের দিন। সুতরাং কিয়ামতের দিন আল্লাহ কখনই মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জন্য কোন পথ রাখবেন না। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৩০৯; দ্বিয়া আল-মাকদেসী, আল-আহাদিসুল মুখতারাহ ২/৪০৬-৪০৭, হাদীস নং ৭৯৩]
তবে ইমামগণ এ আয়াত থেকে দুনিয়াতে এ মাসআলা নিয়েছেন যে, কোন কাফের কোন মুমিনের ওয়ারিশ হয় না। [আত-তা’লিকুল মুমাজ্জাদ আলা মুওয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ
বিজয় দান করবেন না। এর বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন,
(ক) মুসলিমদের এ জয় কিয়ামতের দিন লাভ হবে।
(খ) হুজ্জত ও প্রমাণাদির দিক দিয়ে কাফেররা মুসলিমদের উপর জয়লাভ করতে পারবে না।
(গ) কাফেরদের এমন বিজয় আসবে না, যাতে মুসলিমদের রাজ্য ও প্রতিপত্তি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তাদেরকে মুদ্রিত ভুল শব্দের মত বিশ্বের মানচিত্র থেকে মিটিয়ে দেওয়া হবে। একটি সহীহ হাদীস থেকেও এই অর্থের সমর্থন পাওয়া যায়।
(ঘ) যতদিন পর্যন্ত মুসলিমরা নিজেদের দ্বীন অনুযায়ী আমল করবে, বাতিলের প্রতি অসন্তুষ্ট থাকবে এবং অন্যায় কাজে বাধা দেবে, ততদিন পর্যন্ত কাফেররা তাদের উপর জয়লাভ করতে পারবে না। ইমাম ইবনুল আরাবী বলেন, ‘এটি সবার থেকে উত্তম অর্থ।’ কারণ, মহান আল্লাহ বলেন,[وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ] অর্থাৎ, যে বিপদই তোমাদের উপর আপতিত হয়, তা সবই তোমাদের কৃতকর্মের ফল। (সূরা শূরাঃ ৩০) (ফাতহুল ক্বাদীর) অর্থাৎ, মুসলিমদের পরাজয় তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিরই অনিবার্য কুফল।
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন