সূরা আন নিসাঃ ১৭তম রুকু(১১৩-১১৫)আয়াত

সূরা আন নিসাঃ ১৭তম রুকু(১১৩-১১৫)আয়াত

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

৪:১১৩ وَ لَوۡ لَا فَضۡلُ اللّٰهِ عَلَیۡکَ وَ رَحۡمَتُهٗ لَهَمَّتۡ طَّآئِفَۃٌ مِّنۡهُمۡ اَنۡ یُّضِلُّوۡکَ ؕ وَ مَا یُضِلُّوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡفُسَهُمۡ وَ مَا یَضُرُّوۡنَکَ مِنۡ شَیۡءٍ ؕ وَ اَنۡزَلَ اللّٰهُ عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ عَلَّمَکَ مَا لَمۡ تَکُنۡ تَعۡلَمُ ؕ وَ کَانَ فَضۡلُ اللّٰهِ عَلَیۡکَ عَظِیۡمًا

আর আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তাদের একদল আপনাকে পথভ্রষ্ট করতে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু তারা নিজেদের ছাড়া আর কাউকেও পথভ্রষ্ট করে না এবং আপনার কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।

পূর্ব আয়াতের শানে নুযুলে যে ঘটনা ছিলো—

আনসারদের যাফার গোত্রের ত্বো’মা অথবা বাশীর ইবনে উবাইরিক নামক এক ব্যক্তি অপর এক আনসারীর বর্ম চুরি করে নেয়। যখন এই চুরির চর্চা হতে লাগল এবং যখন সে অনুভব করল যে, তার চুরির কথা ফাঁস হয়ে যাবে, তখন সে (চুরিকৃত) বর্মটা এক ইয়াহুদীর বাড়িতে ফেলে দিয়ে যাফার গোত্রের কিছু লোককে সাথে নিয়ে রসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হল। সকলে মিলে বলল যে, বর্মটা অমুক ইয়াহুদী চুরি করেছিল। সেই ইয়াহুদীও নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ইবনে উবাইরিক বর্ম চুরি করে আমার বাড়িতে ফেলে দিয়েছিল। যাফার গোত্রের লোকেরা (ত্বো’মা অথবা বাশীর প্রভৃতি) প্রথম থেকেই সতর্ক ছিল। তারা নবী করীম (সাঃ)-কে বুঝাতে চেষ্টা করছিল যে, চোর ইয়াহুদীই; ত্বো’মার উপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) তাদের চমৎকার ও চতুরতাপূর্ণ কথাবার্তায় প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েন এবং আনসারীকে চুরির অপবাদ থেকে মুক্ত ঘোষণা করে ইয়াহুদীকে চুরির অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করতে যাবেন, ঠিক এই সময়ই মহান আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন। এ থেকে যে বিষয়গুলো জানা গেল তা হল, প্রথমতঃ নবী করীম (সাঃ) একজন মানুষ বিধায় তিনি ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি গায়েব তথা অদৃশ্যের জ্ঞান রাখতেন না। গায়বের খবর জানলে তিনি সত্বর তাদের প্রকৃত ব্যাপার জেনে নিতেন। তৃতীয়তঃ মহান আল্লাহ স্বীয় পয়গম্বরের হিফাযত করেন। তাই কখনোও যদি প্রকৃত ব্যাপার গুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে নবীর দ্বারা (সত্যের) বিপরীত কিছু হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছত, সঙ্গে সঙ্গেই মহান আল্লাহ সে ব্যাপারে নবীকে সতর্ক করে তাঁর সংশোধন করে দিতেন। আর এটাই হল নবীদের নিষ্পাপ হওয়ার দাবী। এ এমন এক উচ্চ মর্যাদা যা আম্বিয়া ব্যতীত আর কেউ লাভ করতে পারে না।

এই আয়াতে সেই ঘটনায় যা হতে যাচ্ছিলো তা বলা হয়েছে,

অর্থাৎ যদি তারা মিথ্যা বিবরণী পেশ করে তোমার মনে ভুল ধারণা সৃষ্টিতে সক্ষমও হতো এবং নিজেদের পক্ষে প্রকৃত সত্য ও ইনসাফ বিরোধী ফায়সালা করিয়ে নিতে পারতো তাহলে তাতে প্রকৃত ক্ষতি তাদেরই হতো৷ তোমার কোন ক্ষতি হতো না৷ কারণ আল্লাহর কাছে তুমি নও, তারাই হতো অপরাধী৷ যে ব্যক্তি বিচারককে ধোঁকা দিয়ে নিজের পক্ষে সত্যের বিপরীত ফায়সালা করিয়ে নেয় সে আসলে নিজেকে এই ভুল ধারণার শিকার করে যে, এই ধরনের কলা-কৌশল অবলম্বন করার ফলে সত্য তার পক্ষে এসে গেছে৷ অথচ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দৃষ্টিতে সত্য যার দিকে মূলত তার দিকেই থেকে যায়৷ এ ক্ষেত্রে প্রতারিত বিচারপতির ফায়সালার কারণে আসল সত্যের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না

এখানে আল্লাহ তাআলার বিশেষ হিফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, যা তিনি কেবল নবীদের জন্য প্রয়োগ করেছেন। আর এটা ছিল তাঁর নবীদের উপর বিশেষ অনুগ্রহ ও দয়া স্বরূপ। طَائِفَةٌ (দল) বলতে সেই লোক, যারা বানী উবাইরিকের সমর্থনে রসূল (সাঃ)-এর নিকট তাদের নির্দোষ হওয়ার বার্তা পেশ করছিল। যার ভিত্তিতে আশঙ্কা ছিল যে, নবী করীম (সাঃ) তাকে চুরির অপবাদ থেকে মুক্ত ঘোষণা করবেন, যে প্রকৃতপক্ষে চোর ছিল।

এ হল দ্বিতীয় অনুগ্রহের কথা, যা কিতাব ও হিকমত (সুন্নাহ) অবতীর্ণ করে এবং জরুরী বিষয়ের জ্ঞান দান করে রসূল (সাঃ)-এর প্রতি করা হয়েছিল। যেমন তিনি অন্যত্র বলেছেন,

[وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلا الْأِيمَانُ]

অর্থাৎ, এভাবে আমি নিজ নির্দেশে তোমার প্রতি অহী (প্রত্যাদেশ) করেছি রূহ। তুমি তো জানতে না গ্রন্থ কি, ঈমান (বিশ্বাস) কি। (শূরাঃ ৫২)

[وَمَا كُنْتَ تَرْجُو أَنْ يُلْقَى إِلَيْكَ الْكِتَابُ إِلَّا رَحْمَةً مِنْ رَبِّكَ]

‘‘তুমি আশা করতে না যে, তোমার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হবে। এটা কেবল তোমার পালনকর্তার রহমত।’’ (ক্বাস্বাসঃ ৮৬)

এই সমস্ত আয়াত দ্বারা জানা গেল যে, মহান আল্লাহ রসূল (সাঃ)-এর উপর দয়া ও অনুগ্রহ করেছেন এবং তাঁকে কিতাব ও হিকমতও দান করেছেন। এ ছাড়াও আরো অনেক বিষয়ের জ্ঞান (আল্লাহর পক্ষ হতে) তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, যে ব্যাপারে তিনি অবহিত ছিলেন না। এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, তিনি গায়েব জানতেন না। কেননা, তিনি নিজেই যদি অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত হতেন, তাহলে অন্য কারো কাছে জ্ঞানার্জন করার প্রয়োজন হত না। যিনি অপরের থেকে জানতে পারেন, অহী অথবা অন্য কোন মাধ্যমে, তিনি অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাতা হতে পারেন না।

এ আয়াতে ‘কিতাব’-এর সাথে ‘হেকমত’ শব্দটি উল্লেখ করে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও শিক্ষার নাম যে হেকমত তাও আল্লাহ্ তা’আলারই নাযিলকৃত। পার্থক্য এই যে, সুন্নাহর শব্দাবলী আল্লাহর পক্ষ থেকে নয়। এ কারণেই তা কুরআনের অন্তর্ভুক্ত নয়। অবশ্য কুরআন ও সুন্নাহ উভয়টিরই তথ্যসমূহ আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত। তাই উভয়ের বাস্তবায়নই ওয়াজিব। সে জন্যই আলেমগণ বলেন, ওহী দুই প্রকারঃ

(১) مَتْلُوّ যা তিলাওয়াত করা হয় এবং (২) غَيْرُ مَتْلُوّ যা তিলাওয়াত করা হয় না।

প্রথম প্রকার ওহী কুরআনকে বলা হয়, যার অর্থ ও শব্দাবলী উভয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। দ্বিতীয় প্রকার ওহী হাদীস বা সুন্নাহ। এর শব্দাবলী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এবং মৰ্ম আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে।

তিনি আল্লাহর আয়াতসমূহ মানুষের সামনে আবৃত্তি করেছেন। মানুষকে পবিত্র করেছেন। তিন মানুষকে কিতাব শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে হিকমত শিক্ষা দিয়েছেন এবং মানুষ যা জানত না, তা শিক্ষা দিয়েছেন।

ইরশাদ হয়েছে—-

স্মরণ করো, যখন আল্লাহ নবীদের থেকে এই মর্মে অংগীকার নিয়েছিলেন, আজ আমি তোমাদের কিতাব ও হিকমত দান করেছি, কাল যদি অন্য একজন রসূল এই শিক্ষার সত্যতা ঘোষণা করে তোমাদের কাছে আসে, যা আগে থেকেই তোমাদের কাছে আছে, তাহলে তোমাদের তার প্রতি ঈমান আনতে হবে এবং তাকে সাহায্য করতে হবে ৷এই বক্তব্য উপস্থাপন করার পর আল্লাহ জিজ্ঞেস করেনঃ তোমরা কি একথার স্বীকৃতি দিচ্ছো এবং আমার পক্ষ থেকে অংগীকারের গুরুদায়িত্ব বহন করতে প্রস্তুত আছো ? তারা বললো, হ্যাঁ, আমরা স্বীকার করলাম ৷আলে ইমরানঃ৮১

হিকমাহ’ এক সারগর্ভ শব্দ। আলিমগণ এর বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর শব্দ, মর্ম ও প্রায়োগিক বিভিন্ন রূপ আলোচনা করেছেন। আরবী ভাষাবিদগণ বলেন, ح ك م ধাতুমূল المنع বা المنع للإصلاح (নিবৃত্ত করা বা ভালোর জন্য নিবৃত্ত করা) মর্ম ধারণ করে। এই মর্মসূত্রেই অন্যায় থেকে নিবৃত্ত করার অর্থে বিচারকে حُكْمٌ বলে এবং এই মর্ম হিসেবেই লাগামের লোহারদ-, যা পশুর মুখের ভিতরে থাকে একে حَكَمَةُ الدابة বলা হয়, কারণ তা সওয়ারিকে নিয়ন্ত্রণ করে সওয়ারের ইচ্ছার বিপরীতে চলা থেকে বিরত রাখে।

কুর’আনের কথা থেকে সংগ্রহঃ———-

হিকমাহ অর্থাৎ প্রজ্ঞা এসেছে ইহ্‌কাম احكم থেকে, যার অর্থ কথা বা কাজে পরিপূর্ণতা, পারফেকশন। তাফসির আল কুরতুবি।

প্রজ্ঞা হচ্ছে জ্ঞানকে সঠিকভাবে ব্যবহার। আমাদের অনেক জ্ঞান থাকতে পারে, কিন্তু যদি প্রজ্ঞা না থাকে, তাহলে সেই জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার হবে না। যেমন: আমরা অনেকেই জানি, আল্লাহ تعالى আমাদের ক্বদর/ভাগ্যের মালিক, তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ব্যাপারে কুর’আনের আয়াতগুলো আমরা পড়েছি, আমাদের জ্ঞান যথেষ্টই আছে। কিন্তু তারপরও আমরা বাচ্চার কপালে কালো টিপ দেই, যেন অশুভ চোখ না লাগে। স্বামীর নাম নেওয়া যাবে না, তাতে অমঙ্গল হয়।—এরকম শত শত ভুল ধারণায় আমরা বিশ্বাস করি, কারণ আমাদের জ্ঞান থাকলেও প্রজ্ঞা আসেনি। আমরা শিখিনি আমাদের জ্ঞান কীভাবে কাজে লাগাতে হয়।

আবার, আমরা অনেকেই জানি কুর‘আনে পরিষ্কার করে বলা আছে যে, নারীদের ‘খিমার’ (মাথা ঢেকে বুক পর্যন্ত কাপড় ছেড়ে দেওয়া) পড়তে হবে এবং এমন ঢিলেঢিলা কাপড় পড়তে হবে, যেন দেহের অবয়ব বোঝা না যায়। কিন্তু তারপরেও আমরা হিজাবকে এক ধরনের উগ্র ফ্যাশনে পরিণত করি। এগুলো হচ্ছে প্রজ্ঞার অভাব। জ্ঞান আছে, কিন্তু সেই জ্ঞানের আসল উদ্দেশ্য কী, সেটার বোঝার মত বোধ নেই।

আবার, অনেকে মনে করেন: নিজে কুর’আন পড়ে বুঝে চললেই হবে। কুর’আন কারও কাছ থেকে শেখার কিছু নেই। সাহাবীরা, তাদের অনুসারীরা কীভাবে কুর’আন বুঝে গেছেন, কীভাবে অনুসরণ করে গেছেন —এগুলো আমাদের জানার কোনো দরকার নেই। আজকের যুগ পাল্টে গেছে। আজকে আমাদেরকে নিজেদের কুর’আন পড়ে, বুঝে, নিজেদের সিদ্ধান্ত মতো জীবনযাপন করতে হবে।

ধরুন, একজন সিদ্ধান্ত নিল যে, সে বাজার থেকে সার্জারির উপর বেশ কিছু বই পড়ে নিজেই প্র্যাকটিস করে একজন সার্জন হয়ে যাবে। তার কোনো বড় সার্জনের কাছ থেকে শেখার কোনো দরকার নেই। সে নিজেই পারবে বই পড়ে অপারেশন করতে। সার্জারির উপর যথেষ্ট ভালো বই আছে, বিস্তারিত ছবি দেওয়া আছে, ইউটিউবে আজকাল সার্জারির ভিডিও পর্যন্ত পাওয়া যায়। এত কিছু থাকতে কেন আমাদেরকে কেনো সার্জনের কাছ থেকে সার্জারি করা শিখতে হবে?

একজন বড় সার্জন আমাদেরকে প্রজ্ঞা শেখাবেন। তিনি শেখাবেন কখন কোন পরিস্থিতিতে কী সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখন বইয়ের নিয়ম মানা যাবে, কখন নিয়ম এদিক-ওদিক করতে হবে। বইয়ের গদবাধা নিয়মের বাইরেও যে অনেক কিছু বিবেচনার আছে, সেগুলো তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শেখাবেন। সার্জারির আগে রোগীকে কী জানালে, কী না জানালে সার্জারি সফল হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে, তা শেখাবেন। সার্জারির পরে কী কী সতর্কতা নিলে ইনফেকশন কম হবে, তা শেখাবেন। এইসব প্রজ্ঞা বই পড়ে আসে না। এগুলো কারও কাছ থেকে শিখতে হয়, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে অর্জন করতে হয়।

একইভাবে ইসলামের শিক্ষা শুধু কিছু আয়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিটি আয়াতের পেছনে প্রজ্ঞা রয়েছে। কখন কোন প্রেক্ষাপটে কুর’আনের কোন আয়াত প্রযোজ্য, কখন কোন প্রেক্ষাপটে তা প্রযোজ্য নয় —এগুলো আমাদেরকে রাসুলের عليه السلام, তার অনুসারীদের এবং ফিকহ-এ অভিজ্ঞদের কাছ থেকে শিখতে হবে। না হলে আমরা কুর’আনের আয়াতের আক্ষরিক অনুবাদ করে, পরিস্থিতি বিবেচনা না করে, প্রজ্ঞা ব্যবহার না করে ঝাপিয়ে পড়ব নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে। যার ফলাফল হবে ভয়াবহ। ‘শুধু কুর‘আন’ নামে একদলের জন্ম হবে, যারা কুর‘আন ছাড়া আর কোনো ধর্মীয় বই মানবে না। একদল উগ্রপন্থী জিহাদির জন্ম হবে, যারা কুর‘আনের আয়াতের প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই, যে কোনো সময়ে, যে কোনো পরিস্থিতিতে জিহাদের আয়াতগুলোকে সশস্ত্র মারামারির আয়াত বানিয়ে ফেলবে।

একারণেই কুর‘আনে বলা হয়েছে যে, নবী-রসূলরা  শুধু আল্লাহর تعالى বাণীই শেখাবেন না, একইসাথে প্রজ্ঞা শেখাবেন, যেন আল্লাহর تعالى বাণীকে আমরা ঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারি।

ইবরাহীম আ এইভাবে দু’আ করেছিলেন-

ও আমাদের প্রভু, ওদের মধ্যে থেকে একজনকে রসূল হিসেবে গড়ে তুলুন, যে ওদেরকে আপানার আয়াত শোনাবে, তাদেরকে আপনার বিধি-বিধান এবং প্রজ্ঞা শেখাবে এবং তাদেরকে পবিত্র করবে। নিঃসন্দেহে আপনি সর্বোচ্চ ক্ষমতা-কর্তৃত্বের অধিকারী, পরম প্রজ্ঞাবান। [আল-বাক্বারাহ ১২৯]

যদি কুর‘আনের আয়াত শুনিয়ে, বিধি বিধান শেখালেই যথেষ্ট হতো, তাহলে প্রজ্ঞা শেখানোর কোনো দরকার ছিল না। কিন্তু আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে বলেছেন যে, রাসুল عليه السلام প্রজ্ঞা শেখাবেন এবং তাদেরকে পবিত্র করবেন। শুধু কুর‘আন ধরিয়ে দিয়েই বলবেন না যে, কুর‘আনই যথেষ্টও, আর কিছু জানার দরকার নেই। বিস্তারিত পড়ুন: কুর‘আনের কথা’র আল-বাক্বারাহ ১২৯-এর ব্যাখ্যা।

ইরশাদ হয়েছে, যেমন আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি, যে আমার আয়াত সমূহ তোমাদের নিকট আবৃত্তি করে, তোমাদের পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়। (সূরা বাকারাহ : আয়াত ১৫৯

يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا ۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّا أُولُو الْأَلْبَابِ

তিনি যাকে চান, তাকে প্রজ্ঞা দান করেন। আর যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়েছে, সে বিরাট কল্যাণ পেয়ে গেছে। আর চিন্তাশীল মানুষরা ছাড়া কেউ শিক্ষা নেবে না। [আল-বাক্বারাহ ২৬৯]

আল্লাহ আমাকে হিকমাহ না দিলে আমি কী করবো?

আয়াতে যেহেতু বলা হয়েছে যে, তিনি যাকে চান, তাকে প্রজ্ঞা দান করেন

— তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, যদি আল্লাহ تعالى আমাকে প্রজ্ঞা না দেন, তাহলে আমার কী দোষ?

এই আয়াতেই বলা হয়েছে যে, চিন্তাশীল মানুষরা অর্থাৎ أُولُو الْأَلْبَاب ছাড়া কেউ শিক্ষা নেবে না। আমাদেরকে প্রথমে আলবাব অর্থাৎ চিন্তাশীল মানুষদের একজন হতে হবে। চিন্তাশীল মানুষরা কারা?

নিশ্চয়ই আকাশগুলো এবং পৃথিবীর সৃষ্টিতে, এবং দিন ও রাতের আবর্তনে চিন্তাশীল মানুষদের জন্য বিরাট নিদর্শন রয়েছে। [আল-ইমরান ৩:১৯০]

তাদের কাহিনীতে চিন্তাশীল মানুষদের জন্য অনেক শেখার বিষয় রয়েছে। এগুলো কোনো মনগড়া কাহিনী নয়। বরং এটা তোমাদের কাছে যা আছে, তাকেই সমর্থন করে, এবং সবকিছুকে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করে। এটা বিশ্বাসীদের জন্য পথপ্রদর্শক এবং দয়া। [ইউসুফ ১২:১১১]

এটা এমন এক বই, যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি এক কল্যাণ হিসেবে, যেন এর আয়াতগুলো নিয়ে তারা গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে, এবং চিন্তাশীল মানুষেরা যেন এর থেকে শিক্ষা নিতে পারে। [সদ ৩৮:২৯]

সুতরাং চিন্তাশীল মানুষরা হচ্ছে তারাই, যারা গভীরভাবে চিন্তা করে আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে। এরা কোনো কিছু পড়লে, বা শুনলে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দেয় না। এদের মন পরিষ্কার। এদের মাথাভর্তি রাজনীতি, দুর্নীতি, খেলা, সিনেমা, তারকা, বিনোদনের খবর গিজগিজ করে না। এদের মাথায় সারাক্ষণ গানের সুর বাজতে থাকে না। এরা সৃষ্টিজগত নিয়ে চিন্তা করে, দিন-রাত কেন হয়, অর্থাৎ বিজ্ঞান নিয়ে তারা চিন্তা করে। এরা কুর‘আনে দেওয়া বিভিন্ন কাহিনীর মধ্যে শিক্ষণীয় কী আছে, তা বোঝার চেষ্টা করে। সেগুলো বুঝে তারা সে অনুযায়ী নিজেদেরকে পরিবর্তন করে।( বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর)

এরাই আল্লাহর تعالى অনুগ্রহে হিকমাহ অর্থাৎ প্রজ্ঞা পেতে পারে। আর যে একবার প্রজ্ঞা পেয়ে যায়, সে বিরাট কল্যাণ পেয়ে যায়। সে দুনিয়াতে সফল হয়, আর আখিরাতে তার জন্য অপেক্ষা করে অনন্ত সফলতা এবং শান্তি।

আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বিশেষভাবে আলবাব অর্থাৎ পরিষ্কার মনের, চিন্তাশীল মানুষদের কথা বলেছেন। আল্লাহ تعالى কুর‘আনে আরও বহু ধরনের মানুষের উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু প্রজ্ঞা পাওয়ার জন্য তিনি تعالى এই বিশেষ ধরনের মানুষদের বেছে নিয়েছেন। যেমন, তিনি বলতে পারতেন ذِى حِجر অর্থাৎ বুদ্ধিমান মানুষদের কথা, যাদের মস্তিষ্ক প্রখর। অথবা তিনি আক্বল বা বিবেক-বুদ্ধির মানুষদের কথা বলতে পারতেন, যারা বিবেক দিয়ে নিজেদের বুদ্ধিকে খারাপ কাজে ব্যবহার করা থেকে দূরে রাখতে চেষ্টা করে। অথবা তিনি হালিম বা সহনশীল মানুষ, যারা নিজেদেরকে সংযত রাখতে পারেন, রাগ দমন করে রাখতে পারেন, তাদের কথা বলতে পারতেন। অথবা তিনি أُوْلِى ٱلنُّهَىٰ  নুহা বা অত্যন্ত বুদ্ধিমান, যৌক্তিক, প্রখর উপলব্ধির মানুষদের কথা বলতে পারতেন, যাদের বোঝার ক্ষমতা গভীর, যারা অত্যন্ত অভিজ্ঞ।  কিন্তু এদের কথা না বলে তিনি আলবাব অর্থাৎ চিন্তাশীল মানুষদের কথা বলেছেন, যারা আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে।

হিকমাহ বা প্রজ্ঞা লাভ করা তাদের পক্ষেই সম্ভব, যারা গভীরভাবে চিন্তা করে কোনো কিছুর পেছনে আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন। এরাই বিরাট কল্যাণ লাভ করেন। আল্লাহ تعالى যখন কোনো কিছুকে বিরাট কল্যাণ বলেন, সেটা কত বড় ব্যাপার হতে পারে, তা আমাদের কল্পনার বাইরে। যেমন, তিনি কুর‘আন-এর মত এত বড় একটা ব্যাপারকেও শুধুই ‘কল্যাণ’ বলেছেন, ‘বিরাট কল্যাণ’ বলেননি। অথচ তিনি প্রজ্ঞাকে বিরাট কল্যাণ বলেছেন। যে এই বিরাট কল্যাণ পাবে, সে সবদিক থেকে সফল হয়ে যাবে। তাই আমাদের কাজ হবে মাথা ভর্তি আবর্জনা পরিষ্কার করে, গভীরভাবে সৃষ্টি জগত নিয়ে চিন্তা করা, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করা, প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেন ঘটে, কিভাবে ঘটে, এগুলোর পেছনে উদ্দেশ্য কী —এগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। আর কুর‘আনের আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। অনুবাদ দ্রুত না পড়ে, ধীরে সুস্থে পড়ে আয়াতগুলোকে নিয়ে চিন্তা করা। যত বেশি চিন্তা করবো, আমাদের চিন্তার গভীরতা তত বেশি বাড়বে। আমরা প্রজ্ঞা পাওয়ার জন্য তত বেশি যোগ্য হবো। আর একবার প্রজ্ঞা পেয়ে গেলেই আমাদের সফল হওয়ার নিশ্চয়তা অনেক বেড়ে যাবে। সংগৃহিত অংশ (https://quranerkotha.com/tag/%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE/)

 

৪:১১৪ لَا خَیۡرَ فِیۡ کَثِیۡرٍ مِّنۡ نَّجۡوٰىهُمۡ اِلَّا مَنۡ اَمَرَ بِصَدَقَۃٍ اَوۡ مَعۡرُوۡفٍ اَوۡ اِصۡلَاحٍۭ بَیۡنَ النَّاسِ ؕ وَ مَنۡ یَّفۡعَلۡ ذٰلِکَ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰهِ فَسَوۡفَ نُؤۡتِیۡـهِ اَجۡرًا عَظِیۡمًا

তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় সাদকাহ, সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের; আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের আশায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমরা মহা পুরস্কার দেব।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ঐ ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয় যে মানুষের মধ্যে ভাল কিছু ইশারা করে বা বলে শান্তি স্থাপন করে দেয়। [বুখারীঃ ২৬৯২, মুসলিমঃ ২৬০৫]

অন্য হাদীসে এসেছে, আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব না এমন কাজ যা সিয়াম, সালাত ও সদকা থেকেও উত্তম? তারা বললঃ অবশ্যই। রাসূল বললেনঃ মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়া। কেননা, মানুষের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হওয়া গর্দান কাটার সমান। [তিরমিযীঃ ২৫০৯]

نَجْوَى (গুপ্ত পরামর্শ) বলতে মুনাফিকদের সেই কথা-বার্তাকে বুঝানো হয়েছে, যা তারা আপোসে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অথবা একে অপরের বিরুদ্ধে বলাবলি করত।

সাদাকা-খয়রাত, সর্বপ্রকার ভাল কাজ এবং মানুষের মাঝে মীমাংসার জন্য গুপ্ত-পরামর্শ করা কল্যাণকর। বহু হাদীসেও এই কাজগুলোর ফযীলত ও গুরুত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে। কারণ, ইখলাস (আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের খাঁটি উদ্দেশ্য) না থাকলে বড় বড় আমলও কেবল নষ্টই হবে না, বরং আমলকারীর জন্য বিপদের কারণও হবে। نعوذ بالله من الرياء والنفاق

উল্লিখিত আমলগুলোর অনেক ফযীলতের কথা হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে। হালাল উপার্জন থেকে আল্লাহর রাস্তায় একটি খেজুর পরিমাণ সাদাকার নেকীও উহুদ পাহাড়ের সমান। (সহীহ মুসলিম, যাকাত অধ্যায়ঃ)

ভাল কথার প্রচারের নেকীও অনেক। অনুরূপ আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব এবং আপস-দ্বনেদ্ব লিপ্ত এমন মানুষদের মাঝে সদ্ভাব ও সন্ধি স্থাপন করে দেওয়ার ফযীলতও অনেক। একটি হাদীসে তো এ কাজকে নফল নামায, নফল রোযা এবং নফল সাদাকা-খয়রাত থেকেও উত্তম বলা হয়েছে।

মহানবী (সাঃ) বলেন, (أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِأَفْضَلَ مِنْ دَرَجَةِ الصِّيَامِ وَالصَّلَاةِ وَالصَّدَقَةِ؟ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: إِصْلَاحُ ذَاتِ الْبَيْنِ، وَفَسَادُ ذَاتِ الْبَيْنِ الحَالِقَةُ )

“আমি কি তোমাদেরকে রোযা, নামায ও সদকার মাহাত্ম্য অপেক্ষা অধিক মাহাত্ম্যের কথা বলে দিব না?” সকলে বলল, ‘অবশ্যই হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “আপোসে সদ্ভাব স্থাপন করা। আর আপোসের সদ্ভাব নষ্ট হওয়াই হল সর্বনাশী।” (আহমাদ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী)

এমন কি সন্ধিস্থাপনকারীদেরকে (প্রয়োজনবোধে) মিথ্যা বলার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। যাতে একজনকে অপরজনের নিকট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা বলার প্রয়োজন হলে সে ব্যাপারে যেন কোন দ্বিধা না করে। (لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِي يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ فَيَنْمِي خَيْرًا أَوْ يَقُولُ خَيْرًا ) “সে ব্যক্তি মিথ্যুক নয়, যে মানুষের মাঝে মীমাংসা করার জন্য ভাল কথার প্রচার করে অথবা ভাল কথা বলে বেড়ায়।” (বুখারী ২৬৯২-মুসলিম ২৬০৫)

৪:১১৫ وَ مَنۡ یُّشَاقِقِ الرَّسُوۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُ الۡهُدٰی وَ یَتَّبِعۡ غَیۡرَ سَبِیۡلِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصۡلِهٖ جَهَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا

আর কারো নিকট সৎ পথ প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছাড়া অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সে দিকেই তাকে আমরা ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করাব, আর তা কতই না মন্দ আবাস!

এ আয়াত থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা বের হয়।

এক. আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতাকারী জাহান্নামী।

দুই. কোন ব্যাপারে হক তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত প্রকাশিত হওয়ার পর সেটার বিরোধিতা করাও জাহান্নামীদের কাজ।

তিন. এ উম্মতের ইজমা বা কোন বিষয়ে ঐক্যমতে পৌছার পর সেটার বিরোধিতা করা অবৈধ। কারণ, তারা পথভ্রষ্টতায় একমত হবে না। মুমিনদের মত ও পথের বিপরীতে চলার কোন সুযোগ নেই।

হিদায়াতের পথ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর রসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা এবং মু’মিনদের পথ ত্যাগ করে অন্য পথের অনুসরণ করা ইসলাম থেকে খারিজ গণ্য হয় এবং এ ব্যাপারেই জাহান্নামের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاَ مُبِيْنًا

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ-

‘আর এটাই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করো না। অন্যথা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে দিবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।

‘অতএব তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও মুমিন হ’তে পারবে না, যে পর্যন্ত তোমাকে তাদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক হিসাবে মেনে না নিবে, তৎপর তুমি যে বিচার করবে তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করবে এবং ওটা শান্তভাবে পরিগ্রহণ না করবে’ (নিসা ৪/৬৫)।

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে, বিরুদ্ধাচরণ করলে জাহান্নামে যেতে হবে। যেমন হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى، قَالَ مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَى- ‘আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করবে (সে নয়)। তারা বললেন, কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই অস্বীকার করে’ (বুখারী হা/৭২৮০)।

আবূ মূসা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ‘আমার ও আমাকে আল্লাহ যা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হ’ল এমন যে, এক লোক কোন এক কওমের নিকট এসে বলল, হে কওম! আমি নিজের চোখে সেনাবাহিনীকে দেখে এসেছি। আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী। কাজেই তোমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা কর। কওমের কিছু লোক তার কথা মেনে নিল, সুতরাং রাতের প্রথম প্রহরে তারা সে জায়গা ছেড়ে রওনা হ’ল এবং একটি নিরাপদ জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। ফলে তারা রক্ষা পেল। তাদের মধ্যকার আর এক দল লোক তার কথা মিথ্যা মনে করল, ফলে তারা নিজেদের জায়গাতেই রয়ে গেল। সকাল বেলায় শত্রুবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করল ও তাদের ধ্বংস করে দিল এবং তাদের মূল উৎপাটিত করে দিল। এটা হ’ল তাদের উদাহরণ যারা আমার আনুগত্য করে এবং আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসরণ করে। আর যারা আমার কথা অমান্য করে তাদের দৃষ্টান্ত হ’ল, আমি যে সত্য (বাণী) নিয়ে এসেছি তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা

বুখারী হা/৭২৮৩

 

মু’মিনীন বলতে সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)-দের বুঝানো হয়েছে। যাঁরা হলেন সর্বপ্রথম ইসলামের অনুসারী এবং ইসলামী শিক্ষার পরিপূর্ণ নমুনা।

“তোমরা আমার সাহাবীগণকে সম্মান কর। কেননা তাঁহারা তোমাদের মধ্যকার উত্তম মানব”।(মুসনাদে আহমদ)

এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হওয়ার সময় তাঁরা ব্যতীত অন্য কোন মু’মিনীন বিদ্যমানও ছিলেন না যে তাঁরা লক্ষ্য হতে পারেন। কাজেই রসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা এবং সাহাবা (রাঃ)-দের পথ ত্যাগ করে অন্য পথের অনুসরণ করা দুটোই প্রকৃতপক্ষে একই জিনিসের নাম। এই জন্য সাহাবায়ে কেরামদের পথ থেকে বিচ্যুতিও কুফরী ও ভ্রষ্টতা। কোন কোন উলামা মু’মিনীনদের পথ বলতে উম্মতের ঐক্য (ইজমা বা সর্ববাদিসম্মতি)-কে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, উম্মতের কোন বিষয়ে ঐকমত্য প্রত্যাখ্যান করাও কুফরী। আর উম্মতের ঐকমত্যের অর্থ হল, কোন মসলায় উম্মতের সমস্ত আলেম ও ফিক্বাহবিদের ঐকমত্য প্রকাশ করা। অথবা কোন বিষয়ে সাহাবায়ে কেরামের ঐক্য হওয়া। উভয় অবস্থায়ই উম্মতের ঐক্য বলে গণ্য এবং এই উভয় ঐক্যের অথবা তার কোন একটির অস্বীকার করা হবে কুফরী। তবে সাহাবায়ে কেরামদের ঐকমত্য তো অনেক মসলায় পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এই প্রকারের ঐক্য তো লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু সাহাবায়ে কেরামদের ঐক্যের পর সমস্ত উম্মতের বহু বিষয়ে ঐকমত্যের দাবী করা হলেও বাস্তবে এ রকম মাসলা-মাসায়েলের সংখ্যা অনেক কম, যে ব্যাপারে উম্মতের সমস্ত উলামা ও ফুক্বাহা (ফিক্বাহ শাস্ত্রের পন্ডিতগণ) ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। স্বল্প সংখ্যায় হলেও যে ব্যাপারে উম্মতের ঐক্য হয়েছে তার অস্বীকৃতিও সাহাবায়ে কেরামদের ঐক্যের অস্বীকৃতির মতই কুফরী। কারণ, সহীহ হাদীসে এসেছে যে,

‘‘মহান আল্লাহ আমার উম্মতকে ভ্রষ্টতার উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না এবং জামাআতের উপর থাকে আল্লাহর হাত। (সহীহ তিরমিযী, আলবানী ১৭৫৯নং)

ওপরে উল্লেখিত মোকদ্দমায় আল্লাহর অহীর ভিত্তিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সেই বিশ্বাসঘাতকতা মুসলমানটির ওপর বিরুদ্ধে এবং নির্দোষ ইহুদীর পক্ষে ফায়সালা শুনিয়ে দিলেন তখন মুনাফিকটির ওপর জাহেলিয়াতের এমন প্রচণ্ড আক্রমণ হলো যার ফলে সে মদীনা ত্যাগ করে মক্কায় ইসলাম ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমনদের কাছে চলে গেলো এবং প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধীতা করতে লাগলো৷ এ আয়াতে তার এই আচরণের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে৷