সূরা আন নিসাঃ ১৬তম রুকু(১০৫-১১২)আয়াত
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
এই রুকুর আয়াত সমূহের নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট হলো-
সূরা আন-নিসার ১০৫ থেকে ১১৩ নং আয়াত এক বিশেষ ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত। ঘটনাটি হচ্ছে, হিজরতের প্রাথমিক যুগে সাধারণ মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তাদের সাধারণ খাদ্য ছিল যবের আটা কিংবা খেজুর কিংবা গমের আটা। এগুলো প্রায়ই মদীনায় পাওয়া যেতো না। সিরিয়া থেকে কোন চালান এলে কেউ কেউ তা সংগ্রহ করে রাখত।
রিফা’আ ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এ ধরনের কিছু গমের আটা সংগ্রহ করে একটি বস্তায় রেখে দিয়েছিলেন। এ বস্তার মধ্যে কিছু অস্ত্র-শস্ত্রও রেখে একটি ছোট কক্ষে সংরক্ষিত রেখেছিলেন। মদীনাতে তখন বনু উবাইরাক গোত্রের বিশর, বশীর ও মুবাশশির নামীয় তিন লোক বিশেষ কারণে খ্যাতি লাভ করেছিল। তন্মধ্যে বশীর ছিল প্রকৃতই মুনাফিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নামে বদনামী করে কবিতা রচনা করে অন্যের নামে চালিয়ে দিত। সেই বশীর সিধ কেটে রিফা’আ ইবন যায়েদের সে বস্তা বের করে নেয়। সকালে রিফা’আ রাদিয়াল্লাহু আনহু ব্যাপারটি তার ভ্রাতুষ্পপুত্র কাতাদার কাছে বিবৃত করলেন। বনু উবায়রাক বললো, সম্ভবত এটা লবীদ ইবন সাহলের কীর্তি।
লবীদ ইবন সাহল তা শুনে অত্যন্ত ক্রোধাম্বিত হলেন এবং তরবার কোষমুক্ত করে বললেন, আমার উপর অপবাদ চাপানো হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পন্থায় কাতাদা ও রিফা’আ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার প্রবল ধারণা জন্মেছিল যে, এটি বনী উবাইরাকের কীর্তি। তখন কাতাদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে চুরির ঘটনা এবং তদন্তক্রমে বনু উবাইরাকের প্রতি প্রবল ধারণার কথা আলোচনা করলেন। বনু উবায়রাক সংবাদ পেয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে রিফা’আ ও কাতাদার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল যে, শরীআতসম্মত প্রমাণ ছাড়াই তারা আমাদের নামে চুরির অপবাদ আরোপ করছে। আপনি তাদেরকে বারণ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই করলেন। কিন্তু বেশীদিন অতিবাহিত না হতেই এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। যার মাধ্যমে সমস্ত ঘটনা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে তুলে ধরা হয়।
প্রথমে আয়াতে বলা হয়েছে, আমরা তো আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করতে পারেন এবং বিশ্বাসঘাতকদের অর্থাৎ বনী উবাইরাক এর সমর্থনে তর্ক করবেন না। আর আপনি ধারণার বশবর্তী হয়ে সাহাবী কাতাদা ইবন নুমানকে যা বলা হয়েছে সে জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী হোন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আল্লাহ বিশ্বাস ভংগকারী পাপীকে পছন্দ করেন না। তারা মানুষ থেকে গোপন করতে চায় কিন্তু আল্লাহর থেকে গোপন করে না, অথচ তিনি তাদের সংগেই আছেন রাতে যখন তারা, তিনি যা পছন্দ করেন না- এমন বিষয়ে পরামর্শ করে এবং তারা যা করে তা সর্বতোভাবে আল্লাহর জানা রয়েছে।
দেখ, তোমরাই ইহ জীবনে তাদের পক্ষে বিতর্ক করছ; কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে কে তাদের পক্ষে বিতর্ক করবে অথবা কে তাদের উকিল হবে? কেউ কোন মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি যুলুম করে পরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহকে সে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে। অর্থাৎ যদি তারা ক্ষমা প্রার্থী হতো তবে আল্লাহ অবশ্যই তাদের ক্ষমা করে দিতেন। আর কেউ পাপ কাজ করলে সে ওটা তার নিজের ক্ষতির জন্যই করে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। কেউ কোন দোষ বা পাপ করে পরে ওটা কোন নির্দোষ ব্যক্তি অর্থাৎ লবীদ ইবন সাহলের প্রতি আরোপ করলে সে তো মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।
তারপর আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলকে উদ্দেশ্য করে নাযিল করলেন, আপনার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না থাকলে তাদের একদল আপনাকে পথভ্রষ্ট করতে বদ্ধপরিকর ছিল। কিন্তু তারা নিজেদের ছাড়া আর কাউকেও পথভ্রষ্ট করে না এবং আপনার কোনই ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ আপনার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না তা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন, আপনার প্রতি আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে। এ আয়াতসমূহ নাযিল হলে মূল ঘটনা স্পষ্ট হয়ে গেল। বনু উবাইরাকের কাছ থেকে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রিফা’আর কাছে তা ফেরৎ দিলেন। তিনি সে সমুদয় আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলেন
এদিক বিশর মুনাফেকী অবস্থা ধরা পড়ে যাওয়ার কারণে মক্কায় সুলাফা বিনতে সাদ ইবন সুমাইয়া নামীয় এক মহিলার কাছে গিয়ে সরাসরি মুর্তাদ হয়ে গেল। তখন ১১৫ নং আয়াত নাযিল হলো, যাতে হক প্রকাশিত হওয়ার পরে রাসূলের বিরুদ্ধাচারণের কারণে কঠিন শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। [তিরমিযী: ৩০৩৬; মুস্তাদরাকে হাকিম ৪/৩৮৫] ঘটনা যাই হোক, কুরআনের সাধারণ পদ্ধতি অনুযায়ী এ ব্যাপারে প্রদত্ত নির্দেশাবলী এ ঘটনার সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত নয়; বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতে আগমনকারী মুসলিমদের জন্য ব্যাপক। এছাড়া এসব নির্দেশের মধ্যে অনেক মৌলিক ও শাখাগত মাসআলাও রয়েছে।
(২) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি দিনে সত্তর বারেরও অধিক আল্লাহর নিকট ইস্তেগফার এবং তাওবা করে থাকি। [বুখারীঃ ৬৩০৭]
এই (১০৪ থেকে ১১৩ পর্যন্ত) আয়াতগুলোর শানে নুযুল সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আনসারদের যাফার গোত্রের ত্বো’মা অথবা বাশীর ইবনে উবাইরিক নামক এক ব্যক্তি অপর এক আনসারীর বর্ম চুরি করে নেয়। যখন এই চুরির চর্চা হতে লাগল এবং যখন সে অনুভব করল যে, তার চুরির কথা ফাঁস হয়ে যাবে, তখন সে (চুরিকৃত) বর্মটা এক ইয়াহুদীর বাড়িতে ফেলে দিয়ে যাফার গোত্রের কিছু লোককে সাথে নিয়ে রসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হল। সকলে মিলে বলল যে, বর্মটা অমুক ইয়াহুদী চুরি করেছিল। সেই ইয়াহুদীও নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ইবনে উবাইরিক বর্ম চুরি করে আমার বাড়িতে ফেলে দিয়েছিল। যাফার গোত্রের লোকেরা (ত্বো’মা অথবা বাশীর প্রভৃতি) প্রথম থেকেই সতর্ক ছিল। তারা নবী করীম (সাঃ)-কে বুঝাতে চেষ্টা করছিল যে, চোর ইয়াহুদীই; ত্বো’মার উপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। নবী করীম (সাঃ) তাদের চমৎকার ও চতুরতাপূর্ণ কথাবার্তায় প্রভাবান্বিত হয়ে পড়েন এবং আনসারীকে চুরির অপবাদ থেকে মুক্ত ঘোষণা করে ইয়াহুদীকে চুরির অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত করতে যাবেন, ঠিক এই সময়ই মহান আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করেন। এ থেকে যে বিষয়গুলো জানা গেল তা হল, প্রথমতঃ নবী করীম (সাঃ) একজন মানুষ বিধায় তিনি ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি গায়েব তথা অদৃশ্যের জ্ঞান রাখতেন না। গায়বের খবর জানলে তিনি সত্বর তাদের প্রকৃত ব্যাপার জেনে নিতেন। তৃতীয়তঃ মহান আল্লাহ স্বীয় পয়গম্বরের হিফাযত করেন। তাই কখনোও যদি প্রকৃত ব্যাপার গুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণে নবীর দ্বারা (সত্যের) বিপরীত কিছু হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছত, সঙ্গে সঙ্গেই মহান আল্লাহ সে ব্যাপারে নবীকে সতর্ক করে তাঁর সংশোধন করে দিতেন। আর এটাই হল নবীদের নিষ্পাপ হওয়ার দাবী। এ এমন এক উচ্চ মর্যাদা যা আম্বিয়া ব্যতীত আর কেউ লাভ করতে পারে না।
৪:১০৫ اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ لِتَحۡکُمَ بَیۡنَ النَّاسِ بِمَاۤ اَرٰىکَ اللّٰهُ ؕ وَ لَا تَکُنۡ لِّلۡخَآئِنِیۡنَ خَصِیۡمًا
আমরা তো আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করতে পারেন। আর আপনি বিশ্বাসভঙ্গকারীদের সমর্থনে তর্ক করবেন না
৪:১০৬ وَّ اسۡتَغۡفِرِ اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا
এবং আল্লাহর কাছে তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর, নিশ্চয় আল্লাহ চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
কোন তদন্ত না করে খিয়ানতকারীদের যেহেতু তুমি সমর্থন করেছ, তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উভয় দলের মধ্যে কোন এক পক্ষের সত্যতার ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চয়তা না হওয়া পর্যন্ত তার সমর্থন করা এবং তার হয়ে ওকালতি বা প্রতিনিধিত্ব করা বৈধ নয়। এ ছাড়াও যদি কোন দল ধোঁকা ও প্রতারণামূলকভাবে এবং নিজেদের বাকপটুতা দ্বারা আদালত অথবা বিচারকের কাছ থেকে নিজেদের স্বপক্ষে বিচার করিয়ে নেয়, আর তারা যদি তার অধিকারী না হয়, তাহলে আল্লাহর নিকট এ বিচারের কোন মূল্য নেই। এই কথাটাকে নবী করীম (সাঃ) একটি হাদীসে এইভাবে বর্ণনা করেছেন, “সাবধান! আমি তো একজন মানুষই। আমি আমার শোনা কথার আলোকে ফায়সালা করি। হতে পারে কোন মানুষ তার দলীল-প্রমাণ পেশ করার ব্যাপারে বড়ই দক্ষ ও হুঁশিয়ার হবে। আর আমি তার পটুতাপূর্ণ কথায় প্রভাবিত হয়ে তারই পক্ষে ফায়সালা করে দেব, অথচ সে সত্যাশ্রয়ী নয়। এইভাবে আমি অন্যের অধিকার তাকে দিয়ে দেব। তার মনে রাখা দরকার যে, এটা হবে আগুনের টুকরা। এখন তার ইচ্ছা হলে তা গ্রহণ করুক অথবা বর্জন করুক।” (বুখারী ২৪৫৮, মুসলিম ৭১৮৫নং)
ইসলামী বিচার ব্যবস্থায় আইনের উৎস মূলতঃ তিনটি। (১) পবিত্র আল-কুরআন (২) ছহীহ হাদীছ ও (৩) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ইজতিহাদ বা গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত। মহান আল্লাহ বলেন,
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ-
‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেছি কিতাব ও মীযান। যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। এটা এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে না দেখে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী’ (হাদীদ ৫৭/২৫)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ يَقُصُّ الْحَقَّ وَهُوَ خَيْرُ الْفَاصِلِيْن
‘হুকুম দেওয়ার মালিক স্রেফ আল্লাহ। তিনি (তাঁর রাসূলের নিকট) সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ ফায়ছালাকারী’ (আন‘আম ৬/৫৭)।
ইসলামী বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি : ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিচার ব্যবস্থা পৃথিবীতে বিদ্যমান। শরী‘আতে যেকোন বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর সিদ্ধান্তকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করা ইসলামী বিচার ব্যবস্থার মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। যা নিম্নের দায়িত্বগুলো পালন করে থাকে।
১. সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা করা।
২. সমাজের সকল প্রকার ক্ষতিকর বিষয়গুলো প্রতিহত করা।
৩. সরকার ও জনগণের মধ্যে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি।
সহীহ বুখারীতে এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন, তিন শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা হাশর ময়দানে অভিযোগ উত্থাপন করবেন।
এক. ওই সব লোক যারা আল্লাহর সঙ্গে ওয়াদা দিয়ে গাদ্দারি করেছে।
দ্বিতীয়. যারা স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে মূল্য আত্মসাৎ করেছে।
তৃতীয়. যারা কোনো ব্যক্তিকে ভাড়ায় খাটিয়ে তার পারিশ্রমিক আদায় করে না। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২২৭০)
৪:১০৭ وَ لَا تُجَادِلۡ عَنِ الَّذِیۡنَ یَخۡتَانُوۡنَ اَنۡفُسَهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یُحِبُّ مَنۡ کَانَ خَوَّانًا اَثِیۡمًا
আর তুমি তাদের পক্ষে কথা বলো না, যারা নিজেদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক পাপিষ্ঠকে ভালবাসেন না।
যে ব্যক্তি অন্যের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে আসলে সবার আগে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের সাথে৷ কারণ মন ও মস্তিষ্কের শক্তিগুলো তার কাছে আমানত হিসেবে গচ্ছিত রাখা হয়েছে৷ সে সেগুলোকে অযথা ব্যবহার করে তাদেরকে বিশ্বাসঘাতকতা করার ক্ষেত্রে তার সাথে সহযোগীতা করতে বাধ্য করে৷ আর যে বিবেবকে আল্লাহ তার নৈতিক চরিত্রের পাহারাদার বানিয়েছিলেন তাকে এমনভাবে দাবিয়ে দেয় যার ফলে এই বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষেত্রে সে তাকে কোন বাধা দিতে পারে না৷ মানুষ তার নিজের মধ্যে অত্যাচারমূলক পদক্ষেপকে যখন এভাবে পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেয় তখনই বাইরে সে বিশ্বাসঘাতকতা ও পাপ কাজ করতে শুরু করে৷
এরশাদ হয়েছে,‘ হে ঈমানদারগণ! তোমরা (সর্বদাই) ন্যায় বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকো এবং আল্লাহ পাকের জন্যে সত্যের সাক্ষী হিসেবে নিজেকে পেশ করো, যদি এটি তোমার নিজের, তোমার নিজের পিতামাতার কিংবা নিজের নিকট আত্মীয় স্বজনের উপরও আসে, সে ব্যক্তি ধনী কিংবা গরীব, তাদের উভয়ের চাইতে মহান আল্লাহর অধিকার বেশী, অতত্রব আপনি কখনো ন্যায় বিচার করতে নিজের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করবেন না, যদি তোমরা পেঁচানো কথা কিংবা (সাক্ষ্য দেয়া থেকে) বিরত থাকো, তাহলে (জেনে রাখ), তোমরা যা কিছুই করো না কেন, আল্লাহ পাক তার যথার্থ সংবাদ রাখেন।’ (সূরা নিসা:১৩৫)।
এরশাদ হয়েছে,‘ হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা আল্লাহর জন্যে (সত্যও ) ন্যায়ের উপর সাক্ষী হয়ে অবিচলভাবে দাঁড়িয়ে থাকো, কোনো জাতির দুশমনি যেন তোমাদের এমনভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ন্যায় ও ইনসাফ করবে না।’ (সূরা মায়েদা: ৮)।
বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় কখনও কখনও ফায়সালা দানকারী কিংবা সাক্ষ্য দাতাকে প্ররোচিত হতে দেখা যায়। আল্লাাহ ইনসাফের সাথে বিবাদ মিমাংসাকারীকে ভালবাসেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ন্যায় নিষ্ঠদের ভালোবাসেন।’ (সূরা মায়েদা:৪২)।
ন্যায় সংগত ফায়সালা দেয়া একটি সৎকর্ম। এর ফজিলত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে,
‘মু’মিনরা তো (একে অপরের) ভাই বেরাদর, অতত্রব তোমাদের ভাইদের মাঝে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহ পাককে ভয় কর আশা করা যায় তোমাদের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করা হবে।’( সূরা হুজরাত:১০)।
হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূল (সা) এরশাদ করেছেন, সাত শ্রেণীর লোকদের আল্লাহ সেই কঠিন দিনে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তারা হচ্ছে: ১. ন্যায়বিচারক। ২. ঐ যুবক যে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত তথা তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্যের মধ্যে বড় হয়েছে। ৩.ঐ ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে জড়ানো। ৪. ঐ দু’ব্যক্তি যারা আল্লাহর জন্যে পরস্পরকে ভালোবাসে; আল্লাহর জন্যই তারা মিলিত হয় এবং আল্লাহর জন্যেই পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ৫. ঐ লোক যাকে অভিজাত বংশীয় কোনো সুন্দরী রমণী কুকর্মের জন্যে আহŸান করে। জওয়াবে সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। ৬. ঐ লোক যে গোপনে দান করে, এমনকি তার ডান হাত কি দান করল বাম হাত তা টেরও পায় না। ৭. ঐ লোক যে একাকী গোপনে আল্লাহকে শ্নরণ করে দুচোখের অশ্রæ ঝরায়। (বুখারী:৬৬০)।
বিশ্বাসঘাতক কিয়ামত দিবসে বিশেষ চিহ্ন নিয়ে উঠবে। ইবনে মাসউদ, ইবনে উমর ও আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তাঁরা বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের জন্য একটি করে (বিশেষ) পতাকা নির্দিষ্ট হবে। বলা হবে যে এটা অমুক ব্যক্তির (বিশ্বাসঘাতকতার) প্রতীক।’ (বুখারি, হাদিস : ৩১৮৬)
অন্য হাদিসে এসেছে, আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন প্রত্যেক বিশ্বাসঘাতকের পাছায় একটা পতাকা থাকবে, যাকে তার বিশ্বাসঘাতকতা অনুপাতে উঁচু করা হবে। জেনে রেখো! রাষ্ট্রনায়কের চেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক আর অন্য কেউ হতে পারে না (যদি রাষ্ট্রনায়ক বিশ্বাসঘাতক হয়)।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৭৩৮
৪:১০৮ یَّسۡتَخۡفُوۡنَ مِنَ النَّاسِ وَ لَا یَسۡتَخۡفُوۡنَ مِنَ اللّٰهِ وَ هُوَ مَعَهُمۡ اِذۡ یُبَیِّتُوۡنَ مَا لَا یَرۡضٰی مِنَ الۡقَوۡلِ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ بِمَا یَعۡمَلُوۡنَ مُحِیۡطًا
এরা মানুষকে লজ্জা করে (মানুষের দৃষ্টি থেকে গোপনীয়তা অবলম্বন করে), কিন্তু আল্লাহকে লজ্জা করে না (তাঁর দৃষ্টি থেকে গোপনীয়তা অবলম্বন করতে পারে না) অথচ তিনি তাদের সঙ্গে থাকেন, যখন রাত্রে তারা তাঁর (আল্লাহর) অপছন্দনীয় কথা নিয়ে পরামর্শ করে। আর তারা যা করে, তা সর্বতোভাবে আল্লাহর জ্ঞানায়ত্ত।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহকে লজ্জা কর সত্যিকারের লজ্জা। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা অবশ্যই আল্লাহকে লজ্জা করি- আলহামদুলিল্লাহ। তিনি বললেন, কথা সেটা নয়। বরং আল্লাহকে যথার্থভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, (১) তুমি তোমার মাথা ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর। (২) তুমি তোমার পেট ও যেগুলিকে সে জমা করে, তার হেফাযত কর। (৩) আর তোমার বারবার স্মরণ করা উচিৎ মৃত্যুকে ও তার পরে পচে-গলে যাওয়াকে। (৪) আর যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে, সে যেন পার্থিব বিলাসিতা পরিহার করে। যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজগুলি করে, সে ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে আল্লাহকে লজ্জা করে’। আহমাদ হা/৩৬৭১; তিরমিযী হা/২৪৫৮, মিশকাত হা/১৬০৮, সনদ হাসান ‘জানায়েয’ অধ্যায় ‘মৃত্যু কামনা’ অনুচ্ছেদ।
লজ্জা তিন প্রকার : নিজেকে লজ্জা, মানুষকে লজ্জা ও আল্লাহকে লজ্জা। প্রথম প্রকারের লজ্জা থেকে মানুষ বেপরওয়া। সে গোপনে ও একাকী যা ইচ্ছা তাই করে। অথচ সে জানেনা যে, অনেকগুলি অবিচ্ছেদ্য সাক্ষী সর্বদা তার সাথে রয়েছে। যাদেরকে বাদ দিয়ে সে কিছুই করতে পারে না। ঐ সাক্ষীগুলি হ’ল তার দেহচর্ম ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদি।
আল্লাহ বলেন,
الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ
‘আজ আমরা তাদের মুখে মোহর এঁটে দিব। আর তাদের হাত আমাদের সাথে কথা বলবে এবং তাদের পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দিবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৬৫)। তিনি আরও বলেন,
حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعُهُمْ وَأَبْصَارُهُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- وَقَالُوا لِجُلُودِهِمْ لِمَ شَهِدْتُمْ عَلَيْنَا قَالُوا أَنْطَقَنَا اللَّهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلَّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ- وَمَا كُنْتُمْ تَسْتَتِرُونَ أَنْ يَشْهَدَ عَلَيْكُمْ سَمْعُكُمْ وَلَا أَبْصَارُكُمْ وَلَا جُلُودُكُمْ وَلَكِنْ ظَنَنْتُمْ أَنَّ اللَّهَ لَا يَعْلَمُ كَثِيرًا مِمَّا تَعْمَلُونَ- وَذَلِكُمْ ظَنُّكُمُ الَّذِي ظَنَنْتُمْ بِرَبِّكُمْ أَرْدَاكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ مِنَ الْخَاسِرِينَ-
‘আল্লাহর শত্রুরা যখন জাহান্নামের কাছে পৌঁছবে, তখন তাদের কান, চোখ ও দেহচর্ম তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবে’। ‘তখন তারা তাদের দেহচর্মকে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা বলবে, যে আল্লাহ সবকিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন’। তোমাদের কান, চোখ ও তবক তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে না… এ ধারণা থেকেই তোমরা তাদের কাছে কোন কিছু গোপন করতে না। আর তোমরা মনে করতে যে তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না’। ‘অথচ তোমাদের প্রতিপালক সম্পর্কে তোমাদের এই ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছ’ (হামীম সাজদাহ ৪১/২০-২৩)।
গোপনে মন্দকর্ম করার সময় দ্বিতীয় সাক্ষী থাকেন ‘আল্লাহ’। যিনি তার গোপন ও প্রকাশ্য সব খবর রাখেন। অতএব কোন কাজ করার সময় নিজের অবিচ্ছেদ্য সাক্ষীগুলি থেকে যেমন সাবধান থাকতে হবে, তেমনি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ থেকে লজ্জিত হতে হবে।
সাঈদ বিন ইয়াযীদ আল-আযদী (রাঃ) বলেন, তিনি একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন, আপনি আমাকে উপদেশ দিন। তিনি বললেন, أُوْصِيْكَ بِتَقْوَى اللهِ، وَأَنْ تَسْتَحِيَ مِنَ اللهِ كَمَا تَسْتَحِي رَجُلاً صَالِحًا مِنْ قَوْمِكَ ‘আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি এই মর্মে যে, তুমি তাক্বওয়া অবলম্বন কর এবং আল্লাহকে লজ্জা কর, যেমন তুমি তোমার কওমের পুণ্যবান ব্যক্তিকে লজ্জা করে থাক’।ত্বাবারাণী কাবীর, বায়হাক্বী শু‘আব হা/৭৭৩৮; ছহীহাহ হা/৭৪১।
আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ-
‘আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মনের মধ্যে যে কুচিন্তা আসে সেটাও আমরা জানি। আর তার গর্দানের মূল শিরা থেকেও আমরা তার নিকটবর্তী’ (ক্বাফ ৫০/১৬)।
৪:১০৯ هٰۤاَنۡتُمۡ هٰۤؤُلَآءِ جٰدَلۡتُمۡ عَنۡهُمۡ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۟ فَمَنۡ یُّجَادِلُ اللّٰهَ عَنۡهُمۡ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اَمۡ مَّنۡ یَّکُوۡنُ عَلَیۡهِمۡ وَکِیۡلًا
দেখ, তোমরাই পার্থিব জীবনে তাদের স্বপক্ষে বিতর্ক করেছ; কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে কে তাদের স্বপক্ষে কথা বলবে অথবা কে তাদের উকিল হবে?
৪:১১০ وَ مَنۡ یَّعۡمَلۡ سُوۡٓءًا اَوۡ یَظۡلِمۡ نَفۡسَهٗ ثُمَّ یَسۡتَغۡفِرِ اللّٰهَ یَجِدِ اللّٰهَ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا
আর কেউ কোন মন্দ কাজ করে অথবা নিজের প্রতি যুলুম করে পরে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আল্লাহকে সে ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু পাবে।
এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, বান্দার হকের সাথে কিংবা আল্লাহর হকের সাথে সম্পর্কযুক্ত সব গোনাহই তাওবা ও ইস্তেগফারের দ্বারা মাফ হতে পারে। তবে তাওবা ও ইস্তেগফারের স্বরূপ জানা জরুরী। শুধু মুখে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতুবু ইলাইহি’ বলার নাম তাওবা ও ইস্তেগফার নয়। তাই আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে, গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তি যদি সে জন্য অনুতপ্ত না হয় এবং তা পরিত্যাগ না করে কিংবা ভবিষ্যতে পরিত্যাগ করতে সংকল্পবদ্ধ না হয়, তবে মুখে মুখে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলা তাওবার সাথে উপহাস বৈ কিছু নয়।
তাওবার জন্য মোটামুটি তিনটি বিষয় জরুরীঃ (১) অতীত গোনাহর জন্য অনুতপ্ত হওয়া, (২) উপস্থিত গোনাহ অবিলম্বে ত্যাগ করা এবং (৩) ভবিষ্যতে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে দৃঢ়সংকল্প হওয়া। তাছাড়া বান্দাহর হকের সাথে যেসব গোনাহর সম্পর্ক, সেগুলো বান্দাহর কাছ থেকেই মাফ করিয়ে নেয়া কিংবা হক পরিশোধ করে দেয়া তাওবার অন্যতম শর্ত।
তাওবা ও এস্তেগফার করা
জীবনের সকল অবস্থায় বেশী বেশী তাওবা ও ইস্তেগফার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে যখনই কোন অসুখ বা বিপদ এসে যায় বা ব্যক্তি জীবনে বা সামাজিক জীবনেও কোন কিছুর খুব বেশী প্রয়োজন, তখন আরো বেশী করে তাওবাহ ইস্তেগফার করা প্রয়োজন। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন-
আর তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অতঃপর তাওবা কর। সূরা হুদ : ৩
তিনি আরো বলেন:
হে ঈমানদারগন! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর, বিশুদ্ধ তাওবা। সূরা আত-তাহরীম : ৮
কুর’আনের শিক্ষা হলো প্রথমে ইস্তেগফার করতে হবে এরপর তাওবা করতে হবে এবং সেটা হতে হবে বিশুদ্ধ। অন্তরে অনুশোচনা নিয়ে একমাত্র মহান রবের কাছেই আত্মসমর্পন করে দিতে হবে নিজের নফসকে।
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুলুল্লাহ সা. -কে বলতে শুনেছি : আমি দিনের মধ্যে সত্তর বারেরও বেশী আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তেগফার) করি ও তাওবা করি। সহিহ বুখারি
হাদীসে সত্তর সংখ্যাটি আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সংখ্যা বুঝাতে নয়।
তওবা শব্দের আভিধানিক অর্থ – ফিরে আসা। ইস্তেগফার অর্থ ক্ষমা প্রার্থনা করা।
পরিভাষায় তওবা হল : যে সকল কথা ও কাজ মানুষকে আল্লাহর নৈকট্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা থেকে ফিরে এসে ঐ সকল কথা ও কাজে লেগে যাওয়া, যা দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় ও তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে বেঁচে থাকা যায়।
এক কথায় পাপ-কর্ম থেকে ফিরে এসে সৎকাজে প্রবৃত্ত হওয়া।
তওবাতুন নাসূহ বা পরিশুদ্ধ তওবা প্রতিটি গোনাহগারের উপর ফরয। পাপরাশিকে নেকীতে রূপান্তরিত হবার ওয়াদা এবং কল্যাণ ও বিজয়স্বরূপ জান্নাতে প্রবেশ করানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। উক্ত কথার উদ্দেশ্য এই যে, ব্যাপক তওবা সকল মুসলিমের জন্যই সাব্যস্ত। সকল গোনাহের জন্যও তওবা জরুরী -যেগুলো করতে আল্লাহ নিষেধ করেন, যেগুলো পরিহার ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে না।
পাপ বা অপরাধ দু ধরনের হয়ে থাকে :
১। যে সকল পাপ শুধুমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হক বা অধিকার সম্পর্কিত। যেমন শিরক করা, নামাজ আদায় না করা, মদ্যপান করা, সুদের লেনদেন করা ইত্যাদি।
২। যে সকল পাপ বা অপরাধ মানুষের অধিকার সম্পর্কিত। যে পাপ করলে কোন না কোন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন, জুলুম-অত্যাচার, চুরি-ডাকাতি, ঘুষ খাওয়া, অন্যায়ভাবে সম্পদ আত্নসাৎ ইত্যাদি।
প্রথম প্রকার পাপ থেকে আল্লাহর কাছে তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার সাথে পাঁচটি শর্তের উপস্থিতি জরুরী।
শর্ত পাঁচটি হল :
১। ইখলাস (অকপটতা),
২। পাপ কাজটি পরিহার করা।
৩। কৃত পাপটিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া।
৪। ভবিষ্যতে আর এ পাপ করব না বলে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।
৫। তওবা কবুল হওয়ার সময়সীমার মধ্যে তওবা করা।
অর্থাৎ তওবা করতে হবে মৃত্যু শুরু হওয়ার পূর্বে(মৃত্যুর ফেরেশতা দেখার পূর্বে) এবং পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় শুরু হওয়ার আগে। তিরমিযী: ৩৫৩৭, ইবনু মাজাহ: ৪২৫৩
দ্বিতীয় প্রকার পাপ থেকে তাওবা করার শর্ত হল মোট ছয়টি:
১। ইখলাস (অকপটতা),
২। পাপ কাজটি পরিহার করা।
৩। কৃত পাপটিতে লিপ্ত হওয়ার কারণে আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হওয়া।
৪। ভবিষ্যতে আর এ পাপ করব না বলে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা।
৫। পাপের কারণে যে মানুষটির অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে বা যে লোকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার পাওনা পরিশোধ করা বা যথাযথ ক্ষতিপুরণ দিয়ে তার সাথে মিটমাট করে নেয়া অথবা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে দাবী ছাড়িয়ে নেয়া।
৬। তওবা কবুল হওয়ার সময়সীমার মধ্যে তওবা করা।
শাইখ উছাইমীনের “লিকাউল বাব আল-মাফতুহ” ৫৩/৭৩
যে ব্যক্তি জীবনের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে তার তওবাও শুদ্ধ হবে। তার এ নিরাশার কারণ কোন রোগ হোক যেমন- ক্যান্সার। অথবা হত্যার শাস্তি তথা শিরোচ্ছেদের মুখোমুখি হওয়া এবং জল্লাদ তলোয়ার নিয়ে তার মাথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে হোক। অথবা বিবাহিত ব্যক্তির ব্যভিচারের শাস্তি তথা ‘পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড’ কার্যকর করার জন্য পাথর স্তূপ করার কারণে হোক। এদের সবার তওবা শুদ্ধ হবে। কেননা মৃত্যুর গড়গড়া শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা তওবা কবুল করেন। আল্লাহ তাআলার বাণী:
“অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশতঃ মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তওবা করে; এরাই হল সেসব লোক যাদের তওবা আল্লাহ কবুল করেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ।”( সূরা নিসা: ১৭)।
“অনতিবিলম্বে তওবা করে” এ কথার অর্থ হলো- মৃত্যুর আগে তওবা করে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“আর এমন লোকদের জন্য তওবা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে আমি এখন তওবা করছি।” (সূরা নিসা: ১৮)
আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তওবাহ সে পর্যন্ত কবুল করবেন, যে পর্যন্ত তার প্রাণ কণ্ঠাগত না হয়।তিরমিযী: ৩৫৩৭, ইবনু মাজাহ: ৪২৫৩
“কিন্তু যারা তাওবা করেছে, নিজেদের সংশোধন করেছে এবং বর্ণনা করেছে তারা হলো সেই লোক যাদের তাওবা আমি কবুল করবো এবং আমিই একমাত্র তাওবা কবুলকারী, দয়ালু।” (সূরা আল বাকারা: ১৬০)
এই উম্মতের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতসমূহের মধ্য থেকে একটি নেয়ামত এই যে, তিনি তওবার দরজা বন্ধ করেন নি। বরং জীবনের প্রতি মুহূর্তেই তওবার প্রতি মানুষকে উৎসাহ দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে অন্তর্দৃষ্টি দান করেছেন তাকে সর্বদা সন্দেহাতীতভাবে তাওবার প্রতি গুরুত্ববহ থাকতে আদেশ করেছেন।
তওবার প্রতি আল্লাহ্ তা‘আলার উৎসাহ প্রদানের জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, তিনি তওবাকারীর গোনাহগুলোকে নেকী দ্বারা রূপান্তর করে দেবেন। আল্লাহ বলেন:
“কিন্তু যারা তওবা করেছে এবং ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, এদের গোনাহগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা নেকী দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” সূরা আল-ফুরকান: ৬৯।
তওবার উপকারিতা
১. তওবা গুনাহ মুছে দেয়:
আল্লাহর রাসূল সা. বলেন:
“গোনাহ থেকে তওবাকারীর কোন গোনাহই থাকে না।” ইবন মাজাহ: ৪২৫০।
২. গুনাহকে নেকীতে রূপান্তরকারী :
আল্লাহ বলেন,
“কিন্তু যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও আমলে সালিহা করে, এদের সকল পাপরাশি নেকীতে রূপান্তর করে দেন আল্লাহ তা‘আলা। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” সূরা ফোরকান: ৬৯।
৩. তওবাকারীর হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন করে দেয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“বান্দা যখন কোন গোনাহর কাজ করে তখন তার অন্তরে এক ধরনের কালো দাগ পড়ে যায়। যদি ইস্তেগফার করে তাহলে এই দাগ দূরীভূত করে তার অন্তর সূচালু, ধারালো ও পরিশীলিত হবে। আর এই দাগের কথা কুরআনেই আছে, খবরদার! তাদের অন্তরে দাগ রয়েছে যা তারা কামাই করেছে।” জামে তিরমিযি: ৩৩৩৪।
৪. তওবা সুখী সুন্দর জীবনের সুসংবাদ দেয়
মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:
আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর, অনন্তর তারই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং তিনি অধিক আমলকারীকে বেশি করে দেবেন। সূরা হুদ: ৩
৫. তওবা রিযিক ও শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যম:
আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালামের ভাষায় বিধৃত করেন:
“তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র ধারায় বৃষ্টির নহর ছেড়ে দিবেন। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বাড়িয়ে দেবেন তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।” সূরা নূহ: ১০-১২
৬. তওবা দুনিয়া-আখিরাতের সফলতা অর্জনের মাধ্যম
“যারা তওবা করে, ঈমান আনে ও আমলে সালিহ করে, আশা করা যায় তারা সফলকাম হবে।” সূরা কাসাস-৬৭।
“পক্ষান্তরে যারা তওবা করবে, ঈমান আনবে ও আমলে সালিহ করবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, কোন প্রকার যুলম করা হবে না। সূরা মরিয়াম: ৬০।
৭। মহান আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের মাধ্যম
“মহান আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।”সূরা আল বাকারা: ২২২)
তাওবা করার নির্দেশনাঃ
অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যে কোন সময়ই নিজের গুনাহের ফলে অনুশোচনায় ব্যথিত হওয়া যে, নিজের উপর যুলুম করে ফেলেছেন, ভবিষ্যতে আর এই কাজ করবেন না ও মহান আল্লাহর আনুগত্যে অটল থাকবেন এই অংগীকার নিয়ে মহান আল্লাহর কাছেই ক্ষমা চাওয়া দিয়েই তাওবা করা হয়ে যায়।
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা রাত্রিবেলা তাঁর হস্ত প্রসারিত করেন যাতে দিবাভাগের গোনাহগুলোর তওবা কবুল করতে পারেন। ওদিকে দিনের বেলায় হস্ত প্রসারিত করেন যাতে রাতের গোনাহ তওবা গ্রহণ করতে পারেন। সহীহ মুসলিম: ২৭৪৭।
আমাদের সমাজে প্রচলিত মৌলভী ডেকে এনে তাওবা পড়ানোর পদ্ধতি সঠিক নয়। তাওবা নিজে নিজেই করবে আত্মোপলব্ধির সাথে। কেউ কাউকে তাওবা করে দিতে পারেন না। পূর্বে উল্লেখিত শর্তসমূহ মেনে চলে অনুতপ্ত হয়ে যে কোন সময়ই তাওবাতুন নাসূহা(উত্তম তাওবা) করতে পারেন।
তবে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বিশেষভাবে যে নফল সালাত আদায় করা হয়, তাকে ‘সালাতুত তাওবাহ’ বলা হয়।
আবুবকর রা. হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহসা.-কে বলতে শুনেছি যে, কোন লোক যদি গোনাহ করে। অতঃপর উঠে দাঁড়ায় ও পবিত্রতা অর্জন করে এবং দু’রাক‘আত সালাত আদায় করে। অতঃপর আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।
আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, হাদীছ হাসান; ফিক্বহুস সুন্নাহ ১/১৫৯;
উক্ত সালাত দুই বা চার রাক‘আত ফরয কিংবা নফল পূর্ণ ওযূ ও সুন্দর রুকূ-সিজদা সহকারে হ’তে হবে। আহমাদ হা/২৭৫৮৬; সহীহাহ হা/৩৩৯৮; সহীহ আত-তারগীব হা/২৩০।
আপনি বলে দিন, (আল্লাহ বলেন) হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর অত্যাচার করেছো, তোমরা আল্লাহ তায়ালার রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করবেন। নিশ্চয় তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু।” (সূরা আয্ যুমার: ৫৩)
তওবার জন্য নিম্নের দো‘আটি বিশেষভাবে সিজদায় ও শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানোর পূর্বে পাঠ করা যায়।
أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ-
আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহি।
‘আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি সেই আল্লাহর নিকটে যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্ব চরাচরের ধারক এবং তাঁর দিকেই আমি ফিরে যাচ্ছি বা তওবা করছি’। তিরমিযী, আবুদাঊদ, মিশকাত হা/২৩৫৩ ‘দোআ সমূহ’ অধ্যায়-৯।
সর্বোত্তম ইস্তেগফার হলো সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার—
اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنوبَ إِلاَّ أَنْتَ
আল্লা-হুম্মা আন্তা রাব্বি লা— ইলাহ ইল্লা আন্ত্, খালাক্ক্ তানি- ওয়া আনা- ‘আব্দুক্, ওয়া আনা- ‘আলা- আহদিকা ওয়া ওয়াঅ’দিকা মাসতাত্বোত্, আউ-যুবিকা মিন্ শার্ রি মা- সোনাত্, আবু-উলাকা বিনঅমাতিকা আলাই, ওয়া আবু-উ বিযাম্বি, ফাগফিরলি- ফাইন্নাহু লা- ইয়াগফিরুয্ যুনুবা ইল্লা আন্ত্
হে আল্লাহ! তুমি আমার রব, তুমি ছাড়া আর কোন (সত্য) উপাস্য নেই, তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার বান্দা, আমি তোমার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের উপর যথাসাধ্য প্রতিষ্ঠিত আছি, আমি যা করছি তাঁর অনিষ্ট হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, আমার উপর তোমার যে নি‘আমত রয়েছে আমি তা স্বীকার করছি, এবং আমি আমার অপরাধও স্বীকার করছি, তাই তুমি আমাকে ক্ষমা কর, নিশ্চয়ই তুমি ব্যতীত অন্য কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। (সহীহুল বুখারী)
হাদীসে আরো কিছু তাওবা ইস্তিগফারের উল্লেখ এসেছে, কয়েকটি তুলে ধরা হলো।
১। أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ
আস্তাগফিরুল্লা-হ;
আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
২। «أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ».
আস্তাগফিরুল্লাহ ওয়া আতূবু ইলাইহি।
“আমি আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর নিকটই তাওবা করছি”। (প্রতি দিন ১০০ বার) বুখারী ১১/১০১, নং ৬৩০৭;
৩। رَبِّ اغْفِرْلِيْ
রাব্ বিগ্ ফিরলি
হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা কর।
৪। اَللَّهُمَّ اغْفِرْلِيْ، وَارْحَمْنِيْ وَاهْدِنِيْ وَعَافِنِيْ وَارْزُقْنِيْ
আল্লা-হুম্মাগ্ ফিরলি-, ওয়ার্ হামনি- ওয়াহদিনি- ওয়া‘আ-ফিনি- ওয়ারযুক্বনি-
হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে দয়া কর, আমাকে হিদায়াত দাও, আমাকে নিরাপত্তা দাও, আমাকে জীবিকা দাও। (সহীহ মুসলিম)
৪:১১১ وَ مَنۡ یَّکۡسِبۡ اِثۡمًا فَاِنَّمَا یَکۡسِبُهٗ عَلٰی نَفۡسِهٖ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا
আর যে কেউ পাপ কাজ করে, সে তা দিয়ে নিজের ক্ষতি করে। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
এই বিষয়ের আর একটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, [وَلا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى] (الاسراء: 15) অর্থাৎ “কোন বোঝা বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবে না।” (বানী ইসরাঈলঃ ১৫)
অর্থাৎ, কিয়ামতে কেউ কারো দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। প্রত্যেক মানুষ তা-ই পাবে, যা সে কামিয়ে সাথে নিয়ে যাবে।
৪:১১২ وَ مَنۡ یَّکۡسِبۡ خَطِیۡٓىـَٔۃً اَوۡ اِثۡمًا ثُمَّ یَرۡمِ بِهٖ بَرِیۡٓــًٔا فَقَدِ احۡتَمَلَ بُهۡتَانًا وَّ اِثۡمًا مُّبِیۡنًا
যে কেউ কোন দোষ বা পাপ করে, অতঃপর তা কোন নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি আরোপ করে, সে মিথ্যা অপবাদ ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।
এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, যে লোক নিজে পাপ করে এবং অপর নিরপরাধ ব্যক্তিকে সেজন্য অভিযুক্ত করে, সে নিজ গোনাহকে দ্বিগুণ ও অত্যন্ত কঠোর করে দেয় এবং নির্মম শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়। একে তো নিজের আসল গোনাহর শাস্তি, দ্বিতীয়তঃ অপবাদের কঠোর শাস্তি।