সূরা আন নিসাঃ ১৪তম রুকু(৯৭-১০০)

 

 সূরা আন নিসাঃ ১৪তম রুকু(৯৭-১০০)

৪:৯৭ اِنَّ الَّذِیۡنَ تَوَفّٰهُمُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ ظَالِمِیۡۤ اَنۡفُسِهِمۡ قَالُوۡا فِیۡمَ کُنۡتُمۡ ؕ قَالُوۡا کُنَّا مُسۡتَضۡعَفِیۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ قَالُوۡۤا اَلَمۡ تَکُنۡ اَرۡضُ اللّٰهِ وَاسِعَۃً فَتُهَاجِرُوۡا فِیۡهَا ؕ فَاُولٰٓئِکَ مَاۡوٰىهُمۡ جَهَنَّمُ ؕ وَ سَآءَتۡ مَصِیۡرًا

৯৭. তাদের প্রাণগ্রহণের সময় ফিরিশতাগণ বলে, তোমরা কি অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম: তারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি এমন প্রশস্ত ছিল না যেখানে তোমরা হিজরত করতে? এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম, আর তা কত মন্দ আবাস!

এখানে এমন লোকদের কথা বলা হয়েছে যারা ইসলাম গ্রহণ করার পরও কোন প্রকার বাধ্যবাধকতা ও অক্ষমতা ছাড়াই এখনো পর্যন্ত নিজেদের কাফের গোত্রের সাথে অবস্থান করছিল ৷ তারা আধা মুসলমানের ও আধা কাফেরের জীবন যাপন করেই সন্তুষ্টি ছিল৷ অথচ ইতিমধ্যে একটি দারুল ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল৷ সেখানে হিজরাত করে নিজেদের দীন ও আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলামী জীবন যাপন করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে উঠেছিল৷ এটিই ছিল নিজেদের ওপর তাদের জুলুম৷ কেননা পূর্ণাংগ ইসলামী জীবন যাপনের মোকাবিলায় এই আধা কুফরী ও আধা ইসলামী জীবনে যে জিনিসটি তাদেরকে সন্তুষ্টি ও নিশ্চিন্ত করে তুলেছিল সেটি যথার্থই কোন অক্ষমতা ছিল না৷ বরং সেটি ছিল নিছক আত্মবিলাসিতা এবং নিজেদের পরিবার, সহায়-সম্পত্তি, অর্থ-সম্পদ ও পার্থিব স্বার্থপ্রীতি ৷ নিজেদের দীনের ওপর তারা এগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

আয়াত নাযিল হওয়ার কারণের দিক দিয়ে এখানে ‘আরয’(দুনিয়া) বলতে মক্কা ও তার পার্শ্বস্থ অঞ্চলকে বুঝানো হয়েছে এবং এর পরের ‘আরয’(দুনিয়া) বলতে মদীনাকে বুঝানো হয়েছে। তবে নির্দেশের দিক দিয়ে সাধারণ। অর্থাৎ, প্রথম ‘আরয’ (দুনিয়া) বলতে কাফেরদের দুনিয়া বা দেশ যেখানে ইসলাম অনুযায়ী আমল করা কঠিন হয় এবং ‘আরযুল্লাহ’ (আল্লাহর দুনিয়া) বলতে এমন সব জায়গা বা দেশ, যেখানে মানুষ আল্লাহর দ্বীনের উপর আমল করার উদ্দেশ্যে হিজরত করে যায়।

(১) হিজরত সম্পর্কিত আয়াতসমূহে তিন রকমের বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়েছে।

(এক) হিজরতের ফযীলত, (দুই) হিজরতের কারনে দুনিয়া ও আখেরাতের বরকত ও (তিন) সামর্থ্য থাকা সত্বেও দারুল-কুফর থেকে হিজরত না করার কারণে শাস্তিবাণী।

হিজরতের ফযীলতঃ

এ বিষয়ে সূরা বাকারার এক আয়াতে রয়েছে-

(إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أُولَٰئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَتَ اللَّهِ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ)

অর্থাৎ যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহ তা’আলারঅনুগ্রহ-প্রার্থী আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, করুণাময় [সূরা আল-বাকারাহঃ ২১৮] অনুরূপভাবে আছে-

(الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ)

অর্থাৎ যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে মাল ও জান দ্বারা জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহ্‌র কাছে বিরাট পদমর্যাদার অধিকারী এবং তারাই সফলকাম”। [সূরা আত-তাওবাহঃ ২০]

অন্যত্র এসেছে: (وَمَنْ يَخْرُجْ مِنْ بَيْتِهِ مُهَاجِرًا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ يُدْرِكْهُ الْمَوْتُ فَقَدْ وَقَعَ أَجْرُهُ عَلَى اللَّهِ)

যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও রাসূলের নিয়তে নিজ গৃহ থেকে বেরিয়ে পথেই মৃত্যুবরণ করে তার সওয়াব আল্লাহর যিম্মায় সাব্যস্ত হয়ে যায়”। [সূরা আন-নিসাঃ ১০০]

মোটকথা, উপরোক্ত তিনটি আয়াতে দারুল-কুফর থেকে হিজরতে উৎসাহ দান এবং এর বিরাট ফযীলত সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে।

এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ হিজরত পূর্বকৃত সব গোনাহকে নিঃশেষ করে দেয়। [মুসলিম: ১২১; সহীহ ইবন খুযাইমাহ ২৫১৫]

হিজরতের বরকতঃ

হিজরতের বরকত সম্পর্কে সূরা নাহলের ৪১-৪২ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ

“যারা আল্লাহর জন্য হিজরত করে নির্যাতিত হওয়ার পর, আমি তাদেরকে দুনিয়াতে উত্তম ঠিকানা দান করবো এবং আখেরাতের বিরাট সওয়াব তো রয়েছেই, হায় ! যে মজলুমরা সবর করেছে এবং যারা নিজেদের রবের ওপর ভরসা করে কাজ করছে তারা যদি জানতো (কেমন চমৎকার পরিণাম তাদের জন্য অপেক্ষা করছে)৷নহলঃ ৪১-৪২

যদি তারা বুঝে সূরা নিসার উল্লেখিত চার আয়াতে বলা হয়েছেঃ

যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে হিজরাত করবে, সে পৃথিবীতে আশ্রয়লাভের জন্য অনেক জায়গা এবং সময় অতিবাহিত করার জন্য বিরাট অবকাশ পাবে৷ আর যে ব্যক্তি নিজের গৃহ থেকে আল্লাহ ও রসূলের দিকে হিজরাত করার জন্য বের হবে তারপর পথেই তার মৃত্যু হবে, তার প্রতিদান দেয়া আল্লাহর জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে৷ আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়। সূরা নিসাঃ১০০

আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কিছু মুসলিম কাফেরদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাসত্বেও অংশগ্রহণ করত। এতে করে কাফেরদের পাল্লা ভারী হত। কিন্তু যুদ্ধের সময় কোন কোন তীর এসে তাদেরকে হত্যা করত। তখন আল্লাহ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করে তাদেরকে এ অবস্থায় থাকা থেকে নিষেধ করেছেন ৷ [বুখারীঃ ৪৫৯৬, ৭০৮৫]

৪:৯৮ اِلَّا الۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الۡوِلۡدَانِ لَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ حِیۡلَۃً وَّ لَا یَهۡتَدُوۡنَ سَبِیۡلًا ﴿ۙ

৯৮. যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন পথও পায় না।

এখানে হিজরতের নির্দেশ থেকে সেই সব পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদেরকে স্বতন্ত্র করা হচ্ছে, যারা ছিল হিজরতের উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত এবং পথের ব্যাপারে অজ্ঞ। শিশুরা যদিও শরীয়তের বিধি-বিধানের ভার থেকে মুক্ত, তবুও এখানে তাদের উল্লেখ করা হয়েছে হিজরতের গুরুত্বকে আরো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরার জন্য অথবা এখানে শিশু বলতে সাবালকত্বের কাছাকাছি কিশোরদের বুঝানো হয়েছে।

৪:৯৯ فَاُولٰٓئِکَ عَسَی اللّٰهُ اَنۡ یَّعۡفُوَ عَنۡهُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ عَفُوًّا غَفُوۡرًا

৯৯. আল্লাহ অচিরেই তাদের পাপ মোচন করবেন, কারণ আল্লাহ পাপ মোচনকারী, ক্ষমাশীল।

৪:১০০ وَ مَنۡ یُّهَاجِرۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ یَجِدۡ فِی الۡاَرۡضِ مُرٰغَمًا کَثِیۡرًا وَّ سَعَۃً ؕ وَ مَنۡ یَّخۡرُجۡ مِنۡۢ بَیۡتِهٖ مُهَاجِرًا اِلَی اللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ ثُمَّ یُدۡرِکۡهُ الۡمَوۡتُ فَقَدۡ وَقَعَ اَجۡرُهٗ عَلَی اللّٰهِ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا

১০০. আর কেউ আল্লাহর পথে হিজরত করলে সে দুনিয়ায় বহু আশ্রয়স্থল এবং প্রাচুর্য লাভ করবে। আর কেউ আল্লাহ ও রাসূলের উদ্দেশ্যে নিজ ঘর থেকে মুহাজির হয়ে বের হবার পর তার মৃত্যু ঘটলে তার পুরস্কারের ভার আল্লাহ্‌র উপর; আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।এই আয়াতে হিজরতের প্রতি প্রেরণা এবং মুশরিকদের থেকে পৃথকভাবে বসবাস করার শিক্ষা রয়েছে।

مُرَاغَمًا এর অর্থ স্থান, বাসস্থান অথবা আশ্রয়স্থল। আর سَعَةٌ এর অর্থ রুযীর প্রাচুর্য অথবা স্থান ও পৃথিবী ও দেশসমূহের প্রশস্ততা।

এখানে নেক-নিয়ত অনুযায়ী নেকী ও প্রতিদান পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে, যদিও কেউ মৃত্যু হয়ে যাওয়ার কারণে নেক আমলকে পূর্ণ করতে না পারে। যেমন, অতীত উম্মতের মধ্য থেকে এমন এক ব্যক্তির ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, যে ১০০ জন মানুষ খুন করেছিল। অতঃপর তওবা করার জন্য পুণ্যবানদের একটি গ্রামে যাচ্ছিল। পথিমধ্যেই তার মৃত্যু হয়ে যায়। মহান আল্লাহ পুণ্যবানদের গ্রামকে অন্য গ্রামের তুলনায় নিকটতর করে দিলেন। যার ফলে রহমতের ফিরিশতাগণ তাকে তাঁদের সাথে নিয়ে গেলেন। (বুখারী ৩৪৭০, মুসলিম ২৬৭৭নং)

অনুরূপ যে ব্যক্তি হিজরতের নিয়তে ঘর থেকে বের হল, তার যদি পথিমধ্যেই মৃত্যু এসে যায়, সে আল্লাহর পক্ষ হতে হিজরতের সওয়াব অবশ্যই পাবে, যদিও সে হিজরতের কাজ সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়নি।

নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, (إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ) আমলসমূহ নির্ভর করে নিয়তের উপর। (وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِىءٍمَا نَوَى) আর মানুষ তা-ই পায়, যার সে নিয়ত করে। যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্যই হবে। আর যে দুনিয়া অর্জনের জন্য অথবা কোন মহিলাকে বিবাহ করার জন্য হিজরত করবে, তার হিজরত তারই জন্য হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছে। (বুখারী ১, মুসলিম ১৯০৭নং)

এটি একটি এমন ব্যাপক বিধান, যা দ্বীনের প্রত্যেক বিষয়কেই শামিল। অর্থাৎ, কাজ করার সময় যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ উদ্দেশ্য হয়, তবে তা গ্রহণীয় হবে, অন্যথা তা প্রত্যাখ্যাত হবে।

(আবদুল হামীদ ফাইযী )হিজরত করা ওয়াজেব কখন?

মুসলিম যখন নিজের দ্বীন প্রকাশ করতে, দ্বীনের প্রতীক সমূহ প্রতিষ্ঠা করতে বাধাপ্রাপ্ত হবে, নামাজ কায়েম করতে, জুমাআহ ও জামায়াত কায়েম করতে, যাকাত, রোজা ও হজ্জ পালন করতে অক্ষম হবে, তখন হিজরত ওয়াজেব হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

“যারা নিজেদের উপর অবিচার করে, তাদের প্রাণ হরণের সময় ফিরিশতাগণ বলে, ‘তোমরা কি অবস্থায় ছিলে?’ তাঁরা বলে, ‘দুনিয়ায় আমরা অসহায় ছিলাম।’ তাঁরা বলে, ‘তোমরা নিজ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে বসবাস করতে পারতে, আল্লাহর দুনিয়া কি এমন প্রশস্ত ছিল না?’ এদেরই আবাসস্থল জাহান্নাম। আর তা কত নিকৃষ্ট আবাস! (নিসাঃ ৯৭)  সুতরাং যে পরিবেশে মুসলিম তার ইসলাম প্রকাশ করতে বাধা গ্রস্ত হয়, সে পরিবেশে বসবাস করা বৈধ নয়। সে পরিবেশ ছেড়ে এমন পরিবেশে হিজরত করে যাওয়া তার জন্য ওয়াজেব, যেখানে সে নিজের ইমান ইসলাম ও তার প্রতীকসমূহ প্রকাশ করতে সক্ষম হবে।

আপন অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে করণীয় তিন কাজ(মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম)

কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تُطِعِ الْكٰفِرِیْنَ وَ الْمُنٰفِقِیْنَ وَ دَعْ اَذٰىهُمْ وَ تَوَكَّلْ عَلَی اللهِ  وَ كَفٰی بِاللهِ وَكِیْلًا.

কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না এবং তাদের পক্ষ থেকে যে কষ্ট-ক্লেশ তোমাকে দেওয়া হয়, তা অগ্রাহ্য কর এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখ। কর্মবিধায়করূপে আল্লাহই যথেষ্ট। – সূরা আহযাব (৩৩) : ৪৮

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা তিনটি হুকুম দিয়েছেন। ক. কাফের ও মুনাফিকদের কথায় চলো না; খ. তাদের দেওয়া কষ্ট-ক্লেশ উপেক্ষা কর এবং গ. আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখ।

কিয়ামত পর্যন্ত আপন আপন অবস্থান অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে এর প্রতিটি হুকুম অতি গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক। এর প্রতি শৈথিল্য ও অমনোযোগের পরিণাম হয় অতি অশুভ। আজ সারা বিশ্বে মুসলিম জাতির ব্যক্তিজীবন অব্যবস্থিত, সমাজজীবন বিপর্যস্ত এবং তাদের রাষ্ট্রসমূহ বহুমুখী আগ্রাসনে ক্ষত-বিক্ষত। এর একমাত্র কারণ এ হুকুমসমূহ পালনে আমাদের উদাসীনতা ও ব্যর্থতা। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, আমরা এগুলো মেনে চলার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও যত্নবান নই। আজ তারই খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। এর থেকে নিস্তার পেতে চাইলে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো দরকার। আর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দরকার এ হুকুমগুলোর পুনর্পাঠ। প্রয়োজন আন্তরিকতার সাথে এর অনুসরণ শুরু করে দেওয়া এবং তা এখনই।

কাফের দেশে বসবাস সম্পর্কে ইসলামের বিধান(সংগৃহিত)

ইসলামের বিপক্ষে যুদ্ধরত কুফফারদের দেশগুলোতে বসবাস ও সেসব ভূমি থেকে হিজরত প্রসঙ্গে সরল কিছু কথা-

মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ ٱلَّذِينَ تَوَفَّىٰهُمُ ٱلْمَلَٰٓئِكَةُ ظَالِمِىٓ أَنفُسِهِمْ قَالُوا۟ فِيمَ كُنتُمْۖ قَالُوا۟ كُنَّا مُسْتَضْعَفِينَ فِى ٱلْأَرْضِۚ قَالُوٓا۟ أَلَمْ تَكُنْ أَرْضُ ٱللَّهِ وَٰسِعَةً فَتُهَاجِرُوا۟ فِيهَاۚ فَأُو۟لَٰٓئِكَ مَأْوَىٰهُمْ جَهَنَّمُۖ وَسَآءَتْ مَصِيرًا

‘নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা যমীনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল।’ (সূরা নিসা ৯৭)

“রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে যেসব মুসলিম মুশরিকদের সঙ্গে ছিল এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল, মাঝে মাঝে এমনও হত যে, তাদের কেউ কেউ মুসলিমদেরই তীরের আঘাতে নিহত হতো বা তাদেরকে হত্যা করা হত। তখন আল্লাহ তা‘আলা –

(إِنَّ الَّذِيْنَ تَوَفّٰهُمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ ظَالِمِيْٓ أَنْفُسِهِمْ)

আয়াতটি অবতীর্ণ করেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫৯৬)

এ আয়াতে যারা সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হিজরত করে না তাদেরকে তিরস্কারের সাথে কঠিন শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সুতরাং কাফিরদের দেশ থেকে হিজরত করা ফরয, যেখানে ইসলামের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী আমল করা যায় না এবং যেখানে থাকলে কুফরীর দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।” (ফাতহুল মাজীদ, সূরা আন নিসা ৪/৯৭)

“আয়াত থেকে প্রথমতঃ জানা যায় যে, অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামের কোন কোন আমল (ত্যাগ করা) কুফরী পর্যায়ে পৌঁছে যায় অথবা (পালন করলে) ইসলাম গণ্য হয়। যেমন, এই সময়ে হিজরত করাই ইসলাম গণ্য হয়েছে এবং তা ত্যাগ করা প্রায় কুফরীর আওতাভুক্ত গণ্য করা হয়েছে।

দ্বিতীয়তঃ জানা যায় যে, এমন কাফের দেশ থেকে হিজরত করা ফরয, যেখানে ইসলামের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী আমল করা কঠিন হয় এবং যেখানে থাকা কুফরী ও কাফেরদের উৎসাহ লাভের কারণ হয়।” (আহসানুল বায়ান, সূরা আন নিসা ৪/৯৭)

“বদরের যুদ্ধে যখন তারা (মুসলিমরা) মুশরিকদের সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয় তখন মুসলিমদের হাতে তাদের কয়েকজন লোক মারা যায়। ফলে মুসলিমরা অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বলেঃ ‘আফসোস! এরা তো আমাদের ভাই ছিল, অথচ এরা আমাদেরই হাতে মারা গেল। তারা তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। সে সময় এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। হযরত ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি কুরাইশের ঐ লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় যারা ইসলামের কালেমা পাঠ করেছিল এবং মক্কাতেই ছিল।

আয়াতের হুকুম হচ্ছে সাধারণ। প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্যেই এ হুকুম প্রযোজ্য- যে হিজরত করতে সক্ষম অথচ মুশরিকদের মধ্যে পড়ে থাকে এবং দ্বীনের উপর দৃঢ় থাকে না। সে আল্লাহ তা’আলার নিকট অত্যাচারী। এ আয়াতের ভাব হিসেবে এবং মুসলমানদের ইজমা হিসেবেও সে হারাম কার্যে লিপ্ত হওয়ার দোষে দোষী। এ আয়াতে হিজরত করা ছেড়ে দেয়াকে অত্যাচার বলা হয়েছে। এ প্রকারের লোকদেরকে তাদের মৃত্যুর সময় ফেরেশতাগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমরা এখানে পড়ে রয়েছে কেন? কেন তোমরা হিজরত করনি? তারা উত্তর দেয়,“আমরা নিজেদের শহর ছেড়ে অন্য কোন শহরে চলে যেতে সক্ষম হইনি।” তাদের এ কথার উত্তরে ফেরেশতাগণ বলেন-“আল্লাহ তাআলার পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না?’ (ইবনে কাসীর, সূরা আন নিসা ৪/৯৭)

‘কোনো ব্যক্তির যদি স্বীয় মুসলিম দেশে জান ও মালের নিরাপত্তা থাকে তথা কোনোরূপ অপরাধ ব্যতীত গ্রেপ্তারি বা জেলে যেতে না হয়, কিংবা তার মালামাল ক্রোক করা না হয়, এবং এতটুকু জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা থাকে, যতটুকু দ্বারা সে নিজ শহরের স্টাটাস অনুযায়ী চলতে পারে। তবে শুধুমাত্র জীবনসামগ্রীর আরো উন্নতি, আরো স্বচ্ছলতা-স্বাচ্ছন্দ, দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতার উদ্দেশ্যে কোনো অমুসলিম দেশে যেতে চায়, এসব উদ্দেশ্যে সেখানে যাওয়া নাজায়েজ। কেননা, এক্ষেত্রে ইহকালীন পরকালীন কোনো প্রয়োজন ছাড়া সেখানকার অশ্লীলতা বেহায়াপনায় নিজেকে নিজে ফেলে দেয়া হচ্ছে। আর বিনা প্রয়োজনে নিজের দ্বীন-ধর্ম, আখলাক-চরিত্র ইত্যাদিকে এক ঝুকির মধ্যে ফেলে দেয়া কোনো অবস্থাতেই সঠিক হতে পারে না।’ এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতা হলো- ‘যারাই শুধুমাত্র সুখী, সমৃদ্ধি, ভোগ-বিলাসিতার উদ্দেশ্যে কোনো অমুসলিম দেশে বসবাস করছে, তাদের ধর্মীয় চেতনা একেবারে দুর্বল হয়ে যায়। এধরনের লোকেরা কুফরী পরিবেশে থেকে সেখানকার কালচারে উজ্জীবিত হয়ে যায়।’ [মূলঃ মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী (হাফিঃ), প্রবন্ধঃ ‘অমুসলিম দেশে বসবাস’]

এসমস্থ কারণে পবিত্র হাদীস শরীফে অত্যন্ত প্রয়োজন ব্যতীত, অমুসলিমদের সাথে বসবাস করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন-

জারীর আল-বাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

«أَنَا بَرِيءٌ مِنْ كُلِّ مُسْلِمٍ يُقِيمُ بَيْنَ الْمُشْرِكِينَ»

‘আমি ঐসব মুসলিমের উপর অসন্তুষ্ট ও রুষ্ট যারা মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করে।’ (বুলুগুল মারাম ১২৬৪, মান: সহিহ)

সামুরাহ ইবনু জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

“‏مَنْ جَامَعَ الْمُشْرِكَ وَسَكَنَ مَعَهُ فَإِنَّهُ مِثْلُهُ”‏

‘কেউ কোন মুশরিকের সাহচর্যে থাকলে এবং তাদের সাথে বসবাস করলে সে তাদেরই মত।’ (আবু দাউদ ২৭৮৭, মান: সহিহ)

জারীর ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,

“‏أَنَا بَرِيءٌ مِنْ كُلِّ مُسْلِمٍ يُقِيمُ بَيْنَ أَظْهُرِ الْمُشْرِكِينَ”‏ ‏.‏ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلِمَ قَالَ ‏”‏لاَ تَرَايَا نَارَاهُمَا‏”‏ ‏.‏

‘মুশ্‌রিকদের সাথে যে সকল মুসলমান বসবাস করে আমি তাদের দায়িত্ব হতে মুক্ত। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! তা কেন? তিনি বললেনঃ ইসলামের অগ্নি এবং কুফরীর অগ্নি উভয়টি এক সাথে থাকতে পারেনা। কোনটি মুসলমানের আগুন, কোনটি অমুসলিমের আগুন তোমরা তা পার্থক্য করতে পারবেনা।’ (জামে’ আত-তিরমিজি ১৬০৪, মান: সহিহ)

আল্লামা খাত্ত্বাবী (রহ.) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর তিরমিজির বর্ণনার এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, “একেক জনে এর ব্যাখ্যা একেক রকম করেছে। কারো কারো নিকট এর ব্যাখ্যা হলো, মুসলিম এবং অমুসলিম বিধানের দিক থেকে এক হতে পারেনা বরং উভয়ের আহকাম ভিন্ন। কেউ কেউ বলেন, এই হাদীসের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলা দারুল ইসলাম এবং দারুল কুফরকে পৃথক পৃথক করে দিয়েছেন। সুতরাং কোনো মুসলমানের জন্য অমুসলিমদের দেশে বসবাস করা জায়েয নেই। কেননা, অমুসলিমরা যখন আগুন জ্বালাবে, সেসময় যেসব মুসলমান তাদের সাথে থাকবে, মনে হবে তারাও অমুসলিমদের অন্তর্ভূক্ত। ওলামায়ে কিরামের ব্যাখ্যা দ্বারা একথাও প্রতীয়মান হয় যে, কোনো মুসলমান ব্যবসার উদ্দেশ্যেও যদি অমুসলিমদের দেশে গমন করে, তাহলে তার জন্য সেখানে বিনা প্রয়োজনে বেশি দিন বসবাস করা মাকরূহ। (মা‘আলিমুস সুনান লিল খাত্ত্বাবী ঃ ৩/৪৩৭)

সামুরা ইবনু জুনদাব (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

“لَا تُسَاكِنُوا الْمُشْرِكِينَ وَلَا تُجَامِعُوهُمْ فَمَنْ سَاكَنَهُمْ أَوْ جَامَعَهُمْ فَهُوَ مِثْلُهُمْ”

‘মুশরিকদের সাথে তোমরা একত্রে বসবাস কর না, তাদের সংসর্গেও যেও না। যে মানুষ তাদের সাথে বসবাস করবে অথবা তাদের সংসর্গে থাকবে সে তাদের অনুরূপ বলে বিবেচিত হবে।’ (জামে’ আত-তিরমিজি ১৬০৫, মান: নির্ণীত নয়)

কাফেরদের দেশের লোকদের জন্য: ‘আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত পালনে বাধাপ্রাপ্ত হলে হিজরত করা ওয়াজিব। হিজরত করা ওয়াজিব হলে তা বর্জন করা কবীরা গুনাহ। তবে শরীয়তসম্মত ওযর থাকলে ভিন্ন কথা।’ (ফাতহুল মাজীদ, সূরা আন নিসা ৪/৯৭)

কাফের ভূমি থেকে হিজরত করতে অপারগ প্রসঙ্গে,

إِلاَّ الْمُسْتَضْعَفِينَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاء وَالْوِلْدَانِ لاَ يَسْتَطِيعُونَ حِيلَةً وَلاَ يَهْتَدُونَ سَبِيلاً

‘তবে যেসব অসহায় পুরুষ, নারী ও শিশু কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না’ (নিসা ৯৮) — অর্থাৎ উপরে উল্লিখিত শাস্তির আওতাধীন তারা নয় যারা- দুর্বল অসহায় নারী পুরুষ ও শিশু। যারা কোন উপায় অবলম্বন করতে পারে না এবং কোন পথও খুঁজে পায় না, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা যাদের অক্ষমতা কবুল করেন আমার মাতা তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৫৯৭)” (ফাতহুল মাজীদ, সূরা আন নিসা ৪/৯৭)

ইসলামের সাথে যুদ্ধরত কাফির দেশসমূহে টুইন টাওয়ার হামলার মতো হামলার আশঙ্কায় সেখানে মুসলিমদের অবস্থান করার প্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য –

অমুসলিম দেশে ৯/১১ এর মত হামলার মাসালা হল- ‘যদি হামলা করা জরুরী হয়ে পরে, কাফিররা যদি ঐ স্থানে থাকা মুসলিমদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে আর কুফফারদের দল থেকে যদি মুসলিমদের আলাদা করা সম্ভব না হয়, তবে ইমামদের বক্তব্য অনুসারে তাদেরসহ কুফফারদের উপড়ে হামলা করা বৈধ। পরকালে তারা যার যার নিয়ত অনুযায়ী উঠবে। মুসলিমরা সেখানে অবস্থান করে বলে জিহাদ বন্ধ রাখা হবে না। জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি যে অন্যান্য বিষয়গুলোর চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ । যে সকল বিষয় জিহাদকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার ঝুঁকির সম্মুখীন করে তার সবকিছুই রহিত হয়ে যাবে। মুসলিম উম্মতের বিপক্ষে কাফেরদের সুবিধার জন্য শরিয়তের দলীল ব্যাবহার কারার কোন সুযোগ নেই।’ (দেখুনঃ ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়াহ, ২৮/৫৩৭ ও ২০/৫২, আল হাশিয়া আলা আর রাওধ, ৪/২৭১, আল হিদায়া (ইফাঃ), অধ্যায়ঃ জিহাদ, ২/৪৩২, ও এই বিষয়ে শাইখ আব্দুর রহমান রহিঃ এর বিস্তারিত ফতোয়া)

একটি বিষয় চিন্তা করুন — ‘সেসব মুসলিম দের কি ঐ সমস্থ জায়গায় থাকার কথা?’ ‘তার দ্বীন যে ভূমিতে হুমকির মুখে সেখানে বসবাস করা কি তাদের জন্য জায়েজ?’ ‘তাদের কি হিজরত করা উচিত নয়?’ — সত্যিটা হচ্ছে তারা দ্বীন সম্পর্কে উদাসীন। ‘জায়েজ নাকি নাজায়েজ’ এতে তাদের কিছু যায় আসে না।’

একটি হাদিস দেখুন- আবুল আসওয়াদ মুহাম্মাদ ইবনু ‘আবদুর রহমান (রহ.) থেকে বর্ণিত,

عَبْدُ اللهِ بْنُ يَزِيْدَ الْمُقْرِئُ حَدَّثَنَا حَيْوَةُ وَغَيْرُهُ قَالَا حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ أَبُو الْأَسْوَدِ قَالَ قُطِعَ عَلَى أَهْلِ الْمَدِيْنَةِ بَعْثٌ فَاكْتُتِبْتُ فِيْهِ فَلَقِيْتُ عِكْرِمَةَ مَوْلَى ابْنِ عَبَّاسٍ فَأَخْبَرْتُهُ فَنَهَانِيْ عَنْ ذَلِكَ أَشَدَّ النَّهْيِ ثُمَّ قَالَ أَخْبَرَنِي ابْنُ عَبَّاسٍ أَنَّ نَاسًا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ كَانُوْا مَعَ الْمُشْرِكِيْنَ يُكَثِّرُوْنَ سَوَادَ الْمُشْرِكِيْنَ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَأْتِي السَّهْمُ فَيُرْمَى بِهِ فَيُصِيْبُ أَحَدَهُمْ فَيَقْتُلُهُ أَوْ يُضْرَبُ فَيُقْتَلُ فَأَنْزَلَ اللهُ : {إِنَّ الَّذِيْنَ تَوَفّٰهُمُ الْمَلٰٓئِكَةُ ظَالِمِيْٓ أَنْفُسِهِمْ}الآيَةَ رَوَاهُ اللَّيْثُ عَنْ أَبِي الْأَسْوَدِ.

“রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে যেসব মুসলিম মুশরিকদের সঙ্গে ছিল এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল, মাঝে মাঝে এমনও হত যে, তাদের কেউ কেউ মুসলিমদেরই তীরের আঘাতে নিহত হতো বা তাদেরকে হত্যা করা হত। তখন আল্লাহ তা‘আলা — … إِنَّ الَّذِيْنَ تَوَفّٰهُمُ الْمَلٰ۬ئِكَةُ ظَالِمِيْٓ أَنْفُسِهِمْ ‘নিশ্চয় যারা নিজদের প্রতি যুলমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে’? তারা বলে, ‘আমরা যমীনে দুর্বল ছিলাম’। ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে’? সুতরাং ওরাই তারা যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল। (সূরা নিসা ৯৭) আয়াতটি অবতীর্ণ করেন।” (সহীহ বুখারী ৪৫৯৬, মান সহিহ)

হাদিসে এসেছে- জারীর আল-বাজালী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,

«أَنَا بَرِيءٌ مِنْ كُلِّ مُسْلِمٍ يُقِيمُ بَيْنَ الْمُشْرِكِينَ»

‘আমি ঐসব মুসলিমের উপর অসন্তুষ্ট ও রুষ্ট যারা মুশরিকদের মধ্যে অবস্থান করে।’ (বুলুগুল মারাম ১২৬৪, মান: সহিহ, এ বিষয়ে আরো দেখুন- জামে’ আত-তিরমিজি ১৬০৪, মান: সহিহ, আবু দাউদ ২৭৮৭, মান: সহিহ)

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সাবেক সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, আশ-শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] প্রদত্ত ফাতওয়া—

প্রশ্ন: অমুসলিমদের দেশে বসবাসের বিধান কী?

উত্তর: অমুসলিম-কাফিরদের দেশে বসবাস করা মুসলিমের দ্বীন, চরিত্র, চলাফেরা ও শিষ্টাচারের জন্য খুবই বিপজ্জনক। আমরা নিজেরা এবং আমরা ছাড়া আরও অনেকেই এটা প্রত্যক্ষ করেছি যে, যারা সেখানে বসবাসের জন্য গিয়েছে, তাদের অনেকেই বিপথগামী হয়েছে, ফলে তারা সেখানে যা নিয়ে গিয়েছিল, তার বিপরীত জিনিস নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেছে। তারা সেখান থেকে পাপাচারী হয়ে এসেছে। এমনকি তাদের কেউ কেউ নিজের দ্বীন পরিত্যাগ করে সকল ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস (নাস্তিকতা) নিয়ে ফিরে এসেছে। আল-‘ইয়াযু বিল্লাহ (আল্লাহ’র কাছে এ থেকে পানাহ চাই)।

এক পর্যায়ে তারা নিরেট অবিশ্বাসের দিকে চলে যায় এবং ধর্ম ও পূর্ববর্তী-পরবর্তী ধর্মপালনকারীদের দিয়ে ঠাট্টাবিদ্রুপ শুরু করে। তাই সকলের জন্য এ থেকে সতর্ক থাকা এবং এ জাতীয় ধ্বংসাত্মক বিষয়ে নিপাতিত হওয়া থেকে নিরোধকারী শর্ত আরোপ করা বাঞ্ছনীয়।

কাফির রাষ্ট্রে বসবাসের জন্য অবশ্যই দুটো প্রধান শর্ত পূরণ হতে হবে। যথা:

প্রথম শর্ত: বসবাসকারীকে স্বীয় দ্বীনের ব্যাপারে আশঙ্কামুক্ত হতে হবে। অর্থাৎ তার এমন ‘ইলম, ঈমান ও প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকতে হবে, যা তাকে দ্বীনের ওপর অটল থাকার মতো এবং বক্রতা ও বিপথগামিতা থেকে বেঁচে থাকার মতো আত্মবিশ্বাসের জোগান দেয়। আর কাফিরদের প্রতি তার অন্তরে শত্রুতা ও বিদ্বেষ থাকতে হবে। অনুরূপভাবে কাফিরদের সাথে মিত্রতা ও তাদের প্রতি ভালোবাসা থেকে তাকে দূরে থাকতে হবে। কেননা তাদের সাথে মিত্রতা স্থাপন করা এবং তাদেরকে ভালোবাসা ঈমানের পরিপন্থি।

মহান আল্লাহ বলেছেন, لَا تَجِدُ قَوْمًا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ يُوَادُّونَ مَنْ حَادَّ اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَوْ كَانُوا آبَاءَهُمْ أَوْ أَبْنَاءَهُمْ أَوْ إِخْوَانَهُمْ أَوْ عَشِيرَتَهُمْ

“তুমি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী এমন কোনো জাতিকে পাবে না, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বিরোধীদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে; যদিও তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র, অথবা ভাই, কিংবা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী হয়।” [সূরাহ মুজাদালাহ: ২২]

মহান আল্লাহ আরও বলেছেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَىٰ أَوْلِيَاءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ ۚ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ. فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰ أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ ۚ فَعَسَى اللَّهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَىٰ مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ

“হে মু’মিনগণ, ইহুদি-খ্রিষ্টানদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে অবশ্যই তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হিদায়াত দেন না। সুতরাং তুমি দেখতে পাবে, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে, তারা কাফিরদের মধ্যে (বন্ধুত্বের জন্য) ছুটছে। তারা বলে, ‘আমরা আশঙ্কা করছি যে, কোনো বিপদ আমাদেরকে আক্রান্ত করবে।’ অতঃপর হতে পারে আল্লাহ দান করবেন বিজয় কিংবা তাঁর পক্ষ থেকে এমন কিছু, যার ফলে তারা তাদের অন্তরে যা লুকিয়ে রেখেছে, তাতে লজ্জিত হবে।” [সূরাহ মা’ইদাহ: ৫১-৫২]

নাবী ﷺ বলেছেন, الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ “মানুষ যাকে ভালোবাসে, সে (পরকালে) তার সাথেই থাকবে।” [সাহীহ বুখারী, হা/৬১৬৯; সাহীহ মুসলিম, হা/২৬৪০

আল্লাহ’র শত্রুদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা মুসলিমের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ। কেননা তাদেরকে ভালোবাসলে তাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করা এবং তাদের অনুসরণ করা, কিংবা কমপক্ষে তাদের কর্মের বিরোধিতা না করা—জরুরি হয়ে যায়। একারণে নাবী ﷺ বলেছেন, “মানুষ যাকে ভালোবাসে, সে (পরকালে) তার সাথেই থাকবে।”

দ্বিতীয় শর্ত: নিজের দ্বীনকে প্রকাশ করার মতো সক্ষমতা থাকতে হবে। অর্থাৎ, বসবাসকারী ব্যক্তি কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ইসলামের নিদর্শনাবলি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন। নামাজ, জুমু‘আহ ও জামা‘আত—যদি তার সাথে জামা‘আতে নামাজ ও জুমু‘আহ প্রতিষ্ঠা করার মতো কেউ থেকে থাকেন—প্রতিষ্ঠা করতে বাধাগ্রস্ত হবেন না। অনুরূপভাবে জাকাত, রোজা, হজ ও অন্যান্য শার‘ঈ নিদর্শন প্রতিষ্ঠা করতে বাধাগ্রস্ত হবেন না। যদি এসব কাজ করার সক্ষমতা না থাকে, তাহলে তখন হিজরত ওয়াজিব হয়ে যাওয়ার কারণে সেখানে বসবাস করা জায়েজ হবে না।

ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) “মুগনী” গ্রন্থের ৮ম খণ্ডের ৪৫৭ পৃষ্ঠায় হিজরতের ব্যাপারে মানুষের প্রকারভেদ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, “যার ওপর হিজরত করা ফরজ: যে ব্যক্তির হিজরত করার মতো সক্ষমতা আছে, আর তার জন্য স্বীয় দ্বীনকে প্রকাশ করা এবং কাফিরদের মধ্যে বাস করে দ্বীনের ওয়াজিব বিষয়াদি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না, সে ব্যক্তির ওপর হিজরত করা ওয়াজিব। যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় যারা নিজেদের প্রতি জুলুমকারী, ফেরেশতারা তাদের জান কবজ করার সময় বলে, ‘তোমরা কী অবস্থায় ছিলে?’ তারা বলে, ‘আমরা জমিনে দুর্বল ছিলাম।’ ফেরেশতারা বলে, ‘আল্লাহর জমিন কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করতে?’ সুতরাং ওরাই তারা, যাদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম। আর তা মন্দ প্রত্যাবর্তনস্থল।” (সূরাহ নিসা: ৯৭) এটা হলো কঠিন হুঁশিয়ারি, যা হিজরতের আবশ্যকিয়তা প্রমাণ করে। কেননা দ্বীনের আবশ্যকীয় বিষয় পালন করা প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব। হিজরত একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব; এটি এমন একটি বিধান, যা আবশ্যকীয় কর্মাবলিকে পূর্ণতা দান করে। আর যা ব্যতিরেকে ওয়াজিব কাজ পূর্ণ হয় না, সেটাও ওয়াজিব।” [উদ্ধৃতি সমাপ্ত]

উল্লিখিত প্রধান শর্ত দুটি পূরণ হওয়ার পর কাফির রাষ্ট্রে বসবাস করার বিষয়টিকে কয়েক প্রকারে বিভক্ত করা যায়। যথা:

প্রথম প্রকার: ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত এবং ইসলামের প্রতি উৎসাহ প্রদানের জন্য বসবাস করা। এটি এক প্রকার জিহাদ।

সক্ষম ব্যক্তির ওপর এ কাজ করা ফরজে কিফায়াহ (যে ফরজ কতিপয় আদায় করলে বাকিদের ওপর থেকে তা আদায় না করার পাপ ঝরে যায় – অনুবাদক)। তবে শর্ত হলো—দা‘ওয়াত বাস্তবায়িত হতে হবে এবং দা‘ওয়াত প্রদান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকা যাবে না। কেননা ইসলামের দিকে দা‘ওয়াত দেওয়া দ্বীনের আবশ্যকীয় বিধিবিধানের অন্তর্ভুক্ত। আর এটিই রাসূলগণের পথ। নাবী ﷺ সর্ব জায়গা ও সর্ব সময়ে ইসলামের তাবলীগ (প্রচার) করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ﷺ বলেছেন, بَلِّغُوْا عَنِّى وَلَوْ اَيَةً “আমার পক্ষ হতে (মানুষের কাছে) একটি বাক্য হলেও পৌঁছিয়ে দাও।” [সাহীহ বুখারী, হা/৩৪৬১]

দ্বিতীয় প্রকার: কাফিরদের অবস্থা পর্যালোচনা করার জন‍্য এবং তারা যে ভ্রান্ত ‘আক্বীদাহ, বাতিল ইবাদত, নষ্ট চরিত্র ও নৈরাজ্যপূর্ণ চলাফেরার ওপর রয়েছে—তা জানার জন্য সেখানে অবস্থান করা। যাতে করে মানুষকে তাদের মাধ্যমে ধোঁকাগ্রস্ত হওয়া থেকে সতর্ক করা যায়, আর যারা তাদেরকে ভালো মনে করে, তাদের কাছে ওদের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করা যায়। এ ধরনের বসবাসও জিহাদের অন্তর্ভুক্ত।

যেহেতু এর মাধ্যমে কুফর ও কাফিরদের থেকে সতর্ক করা হয়, যা ইসলাম ও তার আদর্শের প্রতি উৎসাহপ্রদানের মতো বিষয়কে ধারণ করে। কেননা কুফরির অনিষ্টতাই ইসলামের সঠিকতার প্রমাণ। তাইতো বলা হয়, “বস্তুর প্রকৃতত্ব তার বিপরীত বিষয়ের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়।”

কিন্তু এক্ষেত্রেও একটি অবশ্য পালনীয় শর্ত আছে। আর তা হলো—ওই কাজের ভালো ফলের চেয়ে বড়ো কোনো ক্ষতির আনয়ন ব্যতিরেকেই উক্ত কাজের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হতে হবে। যদি উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত না হয়, তথা কাফিররা যে মতাদর্শের ওপর রয়েছে তা প্রচার করতে এবং তা থেকে সতর্ক করতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে সেখানে অবস্থান করার কোনো ফায়দা নেই। আবার যদি উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হওয়ার সাথে সাথে তার চেয়ে বড়ো কোনো ক্ষতি অর্জিত হয়, তাহলে উক্ত কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। যেমন: কাফিররা প্রচারকারী ব‍্যক্তির কাজের মোকাবেলায় ইসলামকে এবং ইসলামের রাসূল ও ইমামগণকে গালিগালাজ করা শুরু করল (তাহলে উক্ত কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক)।

যেহেতু মহান আল্লাহ বলেছেন, وَلَا تَسُبُّوا الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ فَيَسُبُّوا اللَّهَ عَدْوًا بِغَيْرِ عِلْمٍ ۗ كَذَٰلِكَ زَيَّنَّا لِكُلِّ أُمَّةٍ عَمَلَهُمْ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّهِمْ مَرْجِعُهُمْ فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ “আর তোমরা তাদেরকে গালি দিয়ো না, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা আহ্বান করে, ফলে তারা বিদ্বেষ ও অজ্ঞতাবশত গালি দিবে আল্লাহকে। এভাবেই আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য তাদের কর্মকে শোভিত করেছি। তারপর তাদের রবের কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দিবেন।” [সূরাহ আন‘আম: ১০৮]

এই প্রকারটি কাফির রাষ্ট্রে মুসলিমদের গুপ্তচর হিসেবে অবস্থান করার মতো। যাতে সে জানতে পারে যে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে তারা কী গুপ্ত ষড়যন্ত্র করছে, ফলে তাদের থেকে মুসলিমরা সতর্ক থাকতে পারে। যেমন নাবী ﷺ খন্দক যুদ্ধে হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) কে মুশরিকদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, তাদের খবর জানার জন্য।

তৃতীয় প্রকার: মুসলিম রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এবং কাফির রাষ্ট্রের সাথে মুসলিম রাষ্ট্রের সম্পর্ক বজায় রাখতে সেখানে বসবাস করা। যেমন: দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ।

এক্ষেত্রে যে কাজের জন্য এখানে অবস্থান করতে হচ্ছে, সে কাজের বিধান যা, এখানে বসবাসের বিধানও তা। উদাহরণস্বরূপ কোনো কালচারাল অ্যাটাশে ছাত্রদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার জন্য এবং তাদেরকে ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামে বর্ণিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শিষ্টাচার পালন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার জন্য সেখানে বসবাস করছেন। তাঁর সেখানে বসবাস করার ফলে অর্জিত হয় বিরাট কল্যাণ এবং নিশ্চিহ্ন হয় বড়ো ধরনের অকল্যাণ।

চতুর্থ প্রকার: কোনো বিশেষ বৈধ কাজের জন্য বসবাস করা। যেমন: ব্যবসা, চিকিৎসা প্রভৃতি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুযায়ী বসবাস করা জায়েজ। ‘আলিমগণ (রাহিমাহুল্লাহ) ব্যবসা করার জন্য কাফির রাষ্ট্রে প্রবেশ করা বৈধ—বলে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন এবং তাঁরা বিষয়টি কিছু সাহাবী (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম) থেকেও বর্ণনা করেছেন।

পঞ্চম প্রকার: পড়াশোনার জন্য বসবাস করা। এটি পূর্বোক্ত—প্রয়োজন অনুযায়ী বসবাস করা বৈধ—প্রকারটির‌ই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এটি বসবাসকারীর দ্বীন ও আখলাকের জন‍্য পূর্বোক্ত বিষয়ের চেয়েও বিপজ্জনক ও ভয়াবহ। কেননা এতে ছাত্র নিজের নিচু মর্যাদা এবং তার শিক্ষকদের উঁচু মর্যাদা অনুভব করে। ফলে সে তাদেরকে শ্রদ্ধা করে এবং তাদের মতাদর্শ ও লাইফ স্টাইলে পরিতুষ্ট হয়। এক পর্যায়ে সে তাদের অনুকরণ শুরু করে। আল্লাহ যাকে হেফাজত করতে চান, সে ছাড়া কেউ এ থেকে বাঁচতে পারে না; আর তাদের (বেঁচে যাওয়া ছাত্রদের) সংখ্যা খুবই নগন্য।

এতদ্ব্যতীত ছাত্র স্বীয় শিক্ষকের কাছে নিজের প্রয়োজন অনুভব করে, যা তাকে (কাফির) শিক্ষকের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা এবং শিক্ষকের ভ্রষ্ট মতাদর্শের ব্যাপারে তাঁর মোসাহেবি করার দিকে ঠেলে দেয়। এছাড়াও ছাত্র যে ছাত্রাবাসে থাকে, সেখানে তার সহপাঠীরাও থাকে। তাদের মধ্য থেকে সে কতিপয়কে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে ভালোবাসে এবং তাদের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে। এই প্রকার বসবাসের ভয়াবহতার কারণে এক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কে থাকা ওয়াজিব। তাই এক্ষেত্রে প্রধান শর্ত দুটোর পাশাপাশি আরও কিছু শর্ত যুক্ত হয়। যথা:

১ম শর্ত: ছাত্রকে বিবেকগত পক্বতার দিক থেকে উঁচু স্তরের হতে হবে, যার মাধমে সে কল্যাণকারী ও অকল্যাণকারীকে আলাদা করতে পারবে এবং অদূর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা করতে পারবে। পক্ষান্তরে কমবয়সী এবং কম বুদ্ধিসম্পন্ন ছাত্রদেরকে কাফির রাষ্ট্রে পাঠানো তাদের দ্বীন, চরিত্র ও শিষ্টাচারের জন্য খুবই বিপজ্জনক। এরপর এটা তাদের জাতির লোকের জন্যও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন তারা নিজেদের জাতির কাছে ফিরে যায় এবং তাদের মধ্যে ওই বিষ উৎক্ষেপণ করে, যা সে ওই কাফিরদের নিকট থেকে পান করে এসেছে। যেমনটি ইতঃপূর্বে ঘটেছে এবং বাস্তবতাও এর সাক্ষ্য দিচ্ছে। ওই সকল ছাত্রদের অনেকেই যা নিয়ে সেখানে গিয়েছিল, তার বিপরীত বিষয় নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেছে। তারা তাদের ধার্মিকতা, চরিত্র ও শিষ্টাচারের ক্ষেত্রে বিপথগামী হিসেবে ফিরে এসেছে। আর এসব ক্ষেত্রে তারা নিজেরা এবং তাদের সমাজ অর্জন করেছে ভয়াবহ অনিষ্ট, যা এখন সুবিদিত বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। তাদেরকে সেখানে পড়তে পাঠানো মূলত হিংস্র কুকুরের কাছে ভেড়ী বা দুম্বী পেশ করার নামান্তর।

২য় শর্ত: ছাত্রের এমন শারঈ ‘ইলম থাকতে হবে, যার দ্বারা সে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং হক দিয়ে বাতিলকে প্রতিহত করতে পারে। যাতে করে কাফিররা যে বাতিল মতাদর্শের ওপর আছে, সে তার দ্বারা ধোঁকাগ্রস্ত হয়ে ওই মতাদর্শকে হক মনে করে না বসে, অথবা তা তার কাছে গোলমেলে হয়ে না যায়, কিংবা তা প্রতিহত করতে ব্যর্থ না হয়। অন্যথায় সে দিশেহারা হয়ে যাবে, কিংবা বাতিলের অনুসরণ করতে শুরু করবে। হাদীসে বর্ণিত দু‘আয় বলা হয়েছে, اللهم أرني الحق حقاً وارزقني اتباعه، وأرني الباطل باطلاً وارزقني اجتنابه، ولا تجعله ملتبساً علي فأضل “হে আল্লাহ, আপনি আমার কাছে হককে হক হিসেবেই দেখান এবং আমাকে তা অনুসরণ করার সামর্থ্য দিন। আপনি আমার কাছে বাতিলকে বাতিল হিসেবেই দেখান এবং আমাকে তা বর্জন করার সামর্থ্য দিন। আর আপনি বাতিলকে আমার ওপর গোলমেলে করে তুলিয়েন না, যার দরুন আমি পথভ্রষ্ট হয়ে যাই!”

৩য় শর্ত: ছাত্রের এমন ধার্মিকতা থাকতে হবে, যা তাকে হেফাজত করবে এবং যার মাধ্যমে সে কুফর ও পাপাচারিতা থেকে বেঁচে থাকতে পারবে। ধর্মপালনে দুর্বল ব্যক্তির জন্য ওখানে বসবাস করা নিরাপদ নয়, তবে আল্লাহ যাকে নিরাপদ রাখতে চান তার কথা স্বতন্ত্র। কেননা ওখানে প্রতিরোধকারী দুর্বল, আর আক্রমণকারী শক্তিশালী। ওখানে কুফর ও পাপাচারিতার অসংখ্য শক্তিশালী মাধ্যম রয়েছে। যখন এসব মাধ্যম কোনো দুর্বল প্রতিরোধকারীর সম্মুখে এসে পড়ে, তখন সেগুলো তাদের কাজ করে চলে যায়।

৪র্থ শর্ত: সে যে বিদ্যা অর্জনের জন্য সেখানে বসবাস করছে, সেই বিদ্যার প্রয়োজন থাকতে হবে। যেমন ওই বিদ্যা অর্জনের মধ্যে মুসলিমদের কল্যাণ নিহিত থাকা এবং উক্ত বিদ্যার অস্তিত্ব মুসলিমদের দেশে না থাকা। কিন্তু তা যদি অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হয়, কিংবা সেই বিদ্যার অস্তিত্ব মুসলিম দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে থাকে, তাহলে উক্ত বিদ‍্যা অর্জনের জন্য কাফির রাষ্ট্রে বসবাস করা জায়েজ নয়। যেহেতু সেখানে বসবাসের মধ্যে রয়েছে দ্বীন ও আখলাকের ক্ষতি এবং কোনো ফায়দা ছাড়াই বিপুল পরিমাণ সম্পদের অপচয়।

ষষ্ঠ প্রকার: (স্থায়ীভাবে) বসবাসের জন্য অবস্থান করা। এটি পূর্বের প্রকারগুলোর চেয়ে বিপজ্জনক ও ভয়াবহ। কেননা এতে অনেক ক্ষতি রয়েছে। যেমন: কাফিরদের সাথে পূর্ণরূপে সংমিশ্রিত হওয়া, এবং তার এই উপলব্ধি হওয়া যে, সে একজন নাগরিক, যে কি না দেশ যা দাবি করে—তথা ভালোবাসা, মিত্রতা প্রভৃতি—তা মেনে চলে। এছাড়াও এতে রয়েছে কাফিরদের দল ভারি করার মতো ক্ষতিকর বিষয়। এরকম ব্যক্তি নিজের পরিবারকে কাফিরদের মধ্যে লালনপালন করে। ফলে তার পরিবারের সদস্যরা কাফিরদের চরিত্র ও সংস্কৃতির অনেক বিষয় গ্রহণ করে এবং কখনো কখনো ‘আক্বীদাহ ও ইবাদতের ক্ষেত্রে তাদের অনুকরণও করে!

একারণে হাদীসে এসেছে, নাবী ﷺ বলেছেন, مَنْ جَامَعَ الْمُشْرِكَ وَسَكَنَ مَعَهُ فَإِنَّهُ مِثْلُهُ “যে ব্যক্তি কোনো মুশরিকের সাহচর্যে থাকে এবং তার সাথে বসবাস করে, সে মূলত তারই মতো।” [আবূ দাঊদ, হা/২৭৮৭; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

এই হাদীস যদিও দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে, তথাপি এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। আর তা হলো—একত্রে বসবাস একই রকম হওয়ার দিকে আহ্বান করে।

ক্বাইস বিন আবূ হাযিম থেকে বর্ণিত, তিনি জারীর বিন ‘আব্দুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নাবী ﷺ বলেছেন, أَنَا بَرِيءٌ مِنْ كُلِّ مُسْلِمٍ يُقِيمُ بَيْنَ أَظْهُرِ الْمُشْرِكِينَ. قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ لِمَ؟ قَالَ: لَا تَرَاءَى نَارَاهُمَا

“আমি ওই সকল মুসলিম থেকে দায়মুক্ত, যারা মুশরিকদের মধ্যে বসবাস করে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহ’র রাসূল, এরূপ কেন?’ তিনি বললেন, ‘যাতে করে তাদের দুজনের আগুনকে এক দৃষ্টিতে দেখা না যায়’।” [আবূ দাঊদ, হা/২৬৪৫; তিরমিযী, হা/১৬০৪; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: আলবানী)]

অধিকাংশ রাবি (বর্ণনাকারী) হাদীসটিকে ক্বাইস বিন আবূ হাযিম কর্তৃক নাবী ﷺ থেকে মুরসাল সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, “আমি মুহাম্মাদকে—অর্থাৎ ইমাম বুখারীকে—বলতে শুনেছি, সঠিক কথা হলো নাবী ﷺ থেকে ক্বাইসের বর্ণিত হাদীসটি মুরসাল।”

তাহলে কীভাবে একজন মু’মিনের অন্তর কাফিরদের দেশে বসবাস করার প্রতি সম্মত হতে পারে? অথচ সেসব দেশে কুফরের নিদর্শনাবলি প্রকাশমান, সেসব দেশে শাসন করা হয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আইন ব্যতীত অন্য আইন দিয়ে! আর সে তার দু চোখ দিয়ে এসব দেখে, দু কান দিয়ে এসব শোনে, এবং তাতে সম্মত হয়। এমনকি সে ওই সকল দেশের দিকে নিজেকে সম্পৃক্ত করে। সেসব দেশে সে স্বীয় পরিবার ও সন্তানসন্ততি নিয়ে বসবাস করে এবং সেসব দেশে শান্তি খুঁজে পায়, যেমনভাবে মুসলিমদের দেশে থেকে প্রশান্তি লাভ করা হয়। অথচ সেখানে বসবাস করা তার নিজের জন্য এবং তার পরিবারপরিজন ও সন্তানসন্ততির দ্বীন ও আখলাকের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

কাফিরদের দেশে বসবাসের বিধানের আলোচনায় আমরা এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছি। আমরা আল্লাহ’র কাছে প্রার্থনা করি, যেন উক্ত সিদ্ধান্ত হক ও সঠিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

তথ্যসূত্র:   ইমাম ‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ), মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৫-৩০; দারুল ওয়াত্বান, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪১৩ (সর্বশেষ প্রকাশ)।

অনুবাদক: মুহাম্মাদ ‘আব্দুল্লাহ মৃধা

প্রশ্ন: অমুসলিমদের দেশে বসবাসের বিধান কী?

অমুসলিমদের দেশে বসবাসের বিধান