সূরা আন নিসাঃ ১৩ম রুকু(৯২-৯৬)আয়াত
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
৪:৯২ وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ اَنۡ یَّقۡتُلَ مُؤۡمِنًا اِلَّا خَطَـًٔا ۚ وَ مَنۡ قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَـًٔا فَتَحۡرِیۡرُ رَقَبَۃٍ مُّؤۡمِنَۃٍ وَّ دِیَۃٌ مُّسَلَّمَۃٌ اِلٰۤی اَهۡلِهٖۤ اِلَّاۤ اَنۡ یَّصَّدَّقُوۡا ؕ فَاِنۡ کَانَ مِنۡ قَوۡمٍ عَدُوٍّ لَّکُمۡ وَ هُوَ مُؤۡمِنٌ فَتَحۡرِیۡرُ رَقَبَۃٍ مُّؤۡمِنَۃٍ ؕ وَ اِنۡ کَانَ مِنۡ قَوۡمٍۭ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَهُمۡ مِّیۡثَاقٌ فَدِیَۃٌ مُّسَلَّمَۃٌ اِلٰۤی اَهۡلِهٖ وَ تَحۡرِیۡرُ رَقَبَۃٍ مُّؤۡمِنَۃٍ ۚ فَمَنۡ لَّمۡ یَجِدۡ فَصِیَامُ شَهۡرَیۡنِ مُتَتَابِعَیۡنِ ۫ تَوۡبَۃً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ عَلِیۡمًا حَکِیۡمًا
৯২. কোন মুমিনকে হত্যা করা কোন মুমিনের কাজ নয়, তবে ভুলবশত করলে সেটা স্বতন্ত্র; এবং কেউ কোন মুমিনকে ভুলবশত হত্যা করলে এক দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা কর্তব্য, যদি না তারা ক্ষমা করে। যদি সে তোমাদের শক্র পক্ষের লোক হয় এবং মুমিন হয় তবে এক মুমিন দাস মুক্ত করা কর্তব্য। আর যদি সে এমন সম্প্রদায়ভুক্ত হয় যাদের সাথে তোমরা অংগীকারাবদ্ধ তবে তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় এবং মুমিন দাস মুক্ত করা কর্তব্য। আর যে সঙ্গতিহীন(আর যে ব্যক্তি কোন গোলাম পাবে না) সে একাদিক্রমে দু’ মাস সিয়াম পালন করবে। তাওবাহর জন্য এগুলো আল্লাহর ব্যবস্থা এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
হত্যা সর্বমোট আট প্রকার। কেননা, নিহত ব্যক্তি
১। হয়তো মুসলিম, কিংবা ২। যিম্মী, অথবা.৩। চুক্তিবদ্ধ ও অভয়প্রাপ্ত, নতুবা ৪। দারুল হারবের কাফের হবে। এ চার অবস্থার কোন না কোন একটি হবেই।
হত্যাকারী দু’প্রকারঃ হয় ইচ্ছাকৃত, না হয় ভুলবশতঃ।
অতএব, মোট প্রকার হল আটটিঃ (এক) মুসলিমকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (দুই) মুসলিমকে ভুলবশতঃ হত্যা, (তিন) যিম্মীকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (চার) যিম্মীকে ভুলবশতঃ হত্যা, (পাঁচ) চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত হত্যা, (ছয়) চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে ভুলবশতঃ হত্যা (সাত) হারবী কাফেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা এবং (আট) হারবী কাফেরকে ভুলবশতঃ হত্যা।
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য হত্যার ব্যাপারে কিসাসের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে ৷ স্বাধীন ব্যক্তি হত্যা করে থাকলে তার বদলায় ঐ স্বাধীন ব্যক্তিকেই হত্যা করা হবে , দাস হত্যাকারী হলে ঐ দাসকেই হত্যা করা হবে, আর নারী এই অপরাধ সংঘটিত করলে সেই নারীকে হত্যা করেই এর কিসাস নেয়া হবে ৷ তবে কোন হত্যাকারীর সাথে তার ভাই যদি কিছু কোমল ব্যবহার করতে প্রস্তুত হয়, তাহলে প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী রক্তপণ দানের ব্যবস্থা হওয়া উচিত এবং সততার সঙ্গে রক্তপণ আদায় করা হত্যাকারীর জন্য অপরিহার্য ৷ এটা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দন্ড হ্রাস ও অনুগ্রহ ৷ এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ৷ [সূরা আল-বাকারাহ ১৭৮]
‘কিসাস’ হচ্ছে রক্তপাতের বদলা বা প্রতিশোধ৷ অর্থাৎ হত্যাকারীর সাথে এমন ব্যবহার করা যেমন সে নিহত ব্যক্তির সাথে করেছে৷ কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, হত্যাকারী যেভাবে নিহত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে ঠিক সেভাবে তাকেও হত্যা করতে হবে৷ বরং এর অর্থ হচ্ছে, সে একজনকে হত্যা করেছে, তাকেও হত্যা করা হবে৷
হে বুদ্ধি – বিবেক সম্পন্ন লোকেরা ! তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যে জীবন রয়েছে ৷ আশা করা যায়, তোমরা এই আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার ব্যাপারে সতর্ক হবে ৷ সূরা বাকারাঃ ১৭৯
ওপরে যেসব মুনাফিক মুসলমানদেরকে হত্যা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে এখানে তাদের কথা বলা হয়নি৷ বরং এখানে এমন মুসলমানদের কথা বলা হয়েছে যারা দারুল ইসলামের অধিবাসী অথবা দারুল হারব বা দারুল কুফরে অবস্থান করলেও ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রুদের তৎপরতায় তাদের অংশগ্রহনের কোন প্রমাণ নেই৷ সে সময় এমন বহু লোকও ছিল যারা ইসলাম গ্রহণ করার পর নিজেদের যথার্থ অক্ষমতার কারণে ইসলামের শত্রু গোত্রদের মধ্যে অবস্থান করছিল৷ অনেক সময় এমন দুঘটনার ঘটে যেতো, মুসলমানরা কোন ইসলাম দুশমন গোত্রের ওপর আক্রমণ চালাতো এবং সেখানে তাদের অজ্ঞতাবশত তাদের হাতে কোন মুসলমান মারা যেতো৷ তাই মহান আল্লাহর এখানে ভুলবশত মুসলমানের হাতে কোন মুসলমানের নিহত হবার বিষয় সম্পর্কিত বিধান বর্ণনা করেছেন৷
. যেহেতু নিহত ব্যক্তি একজন মু’মিন, তাই একজন মু’মিন গোলামকে মুক্ত করে দেয়াই তাকে হত্যা করার কাফ্ফারা গণ্য করা হয়েছে৷
১ম প্রকারঃ (মুসলিমকে ইচ্ছাকৃত হত্যা)
প্রথম প্রকারের পার্থিব বিধান হচ্ছে, কিসাস ওয়াজিব হওয়া।
হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য হত্যার ব্যাপারে কিসাসের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে ৷ স্বাধীন ব্যক্তি হত্যা করে থাকলে তার বদলায় ঐ স্বাধীন ব্যক্তিকেই হত্যা করা হবে , দাস হত্যাকারী হলে ঐ দাসকেই হত্যা করা হবে, আর নারী এই অপরাধ সংঘটিত করলে সেই নারীকে হত্যা করেই এর কিসাস নেয়া হবে ৷ তবে কোন হত্যাকারীর সাথে তার ভাই যদি কিছু কোমল ব্যবহার করতে প্রস্তুত হয়, তাহলে প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী রক্তপণ দানের ব্যবস্থা হওয়া উচিত এবং সততার সঙ্গে রক্তপণ আদায় করা হত্যাকারীর জন্য অপরিহার্য ৷ এটা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দন্ড হ্রাস ও অনুগ্রহ ৷ এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ৷ [সূরা আল-বাকারাহ ১৭৮]
আর আখেরাতে এর পরিণতি সূরা আন-নিসা এর ৯৩ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।
আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।
২য় প্রকার (ভুলবশতঃ মুমিনকে হত্যা)
দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ ভুলবশতঃ মুমিনকে হত্যার বর্ণনা আলোচ্য সূরা আন-নিসার ৯২ নং আয়াতে এসেছে। অর্থাৎ দিয়াত দিতে হবে।
এক দাস মুক্ত করা এবং তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় করা কর্তব্য, যদি না তারা ক্ষমা করে। যদি সে তোমাদের শক্র পক্ষের লোক হয় এবং মুমিন হয় তবে এক মুমিন দাস মুক্ত করা কর্তব্য। আর যদি সে এমন সম্প্রদায়ভুক্ত হয় যাদের সাথে তোমরা অংগীকারাবদ্ধ তবে তার পরিজনবর্গকে রক্তপণ আদায় এবং মুমিন দাস মুক্ত করা কর্তব্য। আর যে সঙ্গতিহীন সে একাদিক্ৰমে দু’ মাস সিয়াম পালন করবে। তাওবাহর জন্য এগুলো আল্লাহর ব্যবস্থা এবং আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।
তৃতীয় প্রকার অর্থাৎ যিম্মীকে ইচ্ছাকৃত হত্যার হুকুম কি তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
চতুর্থ প্রকার অর্থাৎ যিম্মীকে ভুলবশতঃ হত্যার শাস্তি
সূরা আন-নিসার ৯২ নং আয়াতের শেষে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সেটারও দিয়াত দিতে হবে।
পঞ্চম প্রকার অর্থাৎ চুক্তিবদ্ধ কাফেরকে ইচ্ছাকৃত হত্যা।
এর হুকুম সূরা আন-নিসার ৯০ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। মূলতঃ তাদের এবং যিম্মীদের হুকুম একই। কেননা, ৯০ নং আয়াতে উল্লেখিত مِيثَاقٌ তথা চুক্তি অস্থায়ী ও স্থায়ী উভয় প্রকারই হতে পারে। অতএব, যিম্মী ও অভয়প্রাপ্ত কাফের এর অন্তর্ভুক্ত।
৬ষ্ঠ প্রকার চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে ভুলবশতঃ হত্যা
সপ্তম ও অষ্টম প্রকারের বিধান (হারবী কাফেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা এবং হারবী কাফেরকে ভুলবশতঃ হত্যা।
স্বয়ং জিহাদ আইনসিদ্ধ হওয়ার মাসআলা থেকে জানা গেছে। কেননা, জিহাদে দারুল হারবের কাফেরদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবেই হত্যা করা হয়। অতএব, ভুলবশতঃ হত্যার বৈধতা আরো সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হবে।
কিসাস ও দিয়াতের বিধান সংশ্লিষ্টতার দিক থেকে হত্যা কয়েক প্রকারঃ
নিহত ব্যক্তির রক্তের বিনিময় স্বরূপ যে জিনিস তার (নিহতের) উত্তরাধিকারীদেরকে দেওয়া হয়, তাকে ‘দিয়াত(রক্তপণ) বলা হয়।
প্রথম প্রকার عَمَدٌ অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত হত্যা। এমন অস্ত্র দ্বারা, যা দ্বারা হত্যা করা যায়। এ ধরনের হত্যার শাস্তি হচ্ছে কিসাস।
দ্বিতীয় প্রকার شِبْهِ عَمدٍ অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত হত্যার সাথে যা সাদৃশ্যপূর্ণ। এর সংজ্ঞা এইঃ ইচ্ছা করেই হত্যা করা, কিন্তু এমন অস্ত্র দ্বারা নয়, যা দ্বারা অঙ্গচ্ছেদ হতে পারে।
তৃতীয় প্রকার خطأ অর্থাৎ ভুলবশতঃ হত্যা। ইচ্ছা ও ধারণায় ভুল হওয়া। যেমন দূর থেকে মানুষকে শিকার জন্তু কিংবা দারুল-হারবের কাফের মনে করে লক্ষ্য স্থির করতঃ গুলী করে ফেলা কিংবা লক্ষ্যচ্যুতি ঘটা। যেমন, জন্তুকে লক্ষ্য করেই তীর অথবা গুলী ছোড়া; কিন্তু তা কোন মানুষের গায়ে লেগে যাওয়া। এগুলো সব ভুলবশতঃ হত্যার অন্তর্ভুক্ত। এখানে ভুল বলে ‘ইচ্ছা নয়’ বোঝানো হয়েছে।
অতএব, দ্বিতীয় ও তৃতীয় উভয় প্রকার হত্যাই এর অন্তর্ভুক্ত। উভয় প্রকারের মধ্যে গোনাহ ও রক্ত-বিনিময় বিভিন্ন রকম।
দ্বিতীয় প্রকারের রক্ত-বিনিময় হচ্ছে একশ’ উট। উটগুলো চার প্রকারের হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রকারে পাঁচটি করে উট থাকবে।
তৃতীয় প্রকারের রক্ত-বিনিময়ও একশ উট। কিন্তু উটগুলো হবে পাঁচ প্রকারের। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রকারে বিশটি করে উট থাকবে।
তবে রক্ত-বিনিময় মুদ্রার মাধ্যমে দিলে উভয় প্রকারে দশ হাজার দিরহাম অথবা এক হাজার দীনার দিতে হবে। ইচ্ছার কারণে দ্বিতীয় প্রকারের গোনাহ বেশী এবং তৃতীয় প্রকারের গোনাহ কম।
অর্থাৎ শুধু অসাবধানতার গোনাহ হবে। কাফফারা অর্থাৎ ক্রীতদাস মুক্ত করা কিংবা রোযা রাখা স্বয়ং হত্যাকারীর করণীয় এবং রক্ত-বিনিময় হত্যাকারীর স্বজনদের যিম্মায় ওয়াজিব। শরীআতের পরিভাষায় তাদেরকে ‘আকেলাহ’ বলা হয়। এখানে প্রশ্ন করা উচিত হবে না যে, হত্যাকারীর অপরাধের বোঝা তার স্বজনদের উপর কেন চাপানো হয়? তারা তো নিরপরাধ। এর কারণ এই যে, হত্যাকারীর স্বজনরাও দোষী। তারা তাকে এ ধরণের উচ্ছৃংখল কাজ-কর্মে বাধা দেয়নি। রক্ত-বিনিময়ের ভয়ে ভবিষ্যতে তারা তার দেখাশোনা করতে ক্রটি করবে না। এর বাইরে অন্য এক প্রকার হত্যা রয়েছে। যাকে কোন কোন ফকীহ ভুলের পর্যায়ভুক্ত বলেছেন। যেমন, কেউ কূপ এমন স্থানে খনন করলো যে, একজন তাতে পড়ে মারা গেল। এর বিধান অবস্থাভেদে বিভিন্ন হয়ে থাকে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রক্ত বিনিময়ের পরিমাণ এক শত উট, দুই শত গরু বা দুই হাজার ছাগল নির্ধারণ করেছেন৷ কোন ব্যক্তি যদি রক্তমূল্য হিসেবে অন্য কিছু দিতে চায় তাহলে এই জিনিসগুলোর বিত্রুয়মূল্য ধরে তার পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে৷ যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে নগদ মুদ্রায় রক্তমূল্য দানকারীদের জন্য ৮ শত দীনার বা ৮ হাজার দিরহাম নির্ধারিত ছিল৷ হযরত উমর (রা) তাঁর শাসনমলে বলেনঃ উটের দাম এখন বেড়ে গেছে৷ কাজেই এখন স্বর্ণমুদ্রায় এক হাজার দীনার বা রৌপ্যমুদ্রায় ১২ হাজার দিরহাম রক্ত মূল্য হিসেবে আদায় করতে হবে৷ কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, রক্তমূল্যের এ পরিমাণটি জেনে বুঝে হত্যা করার জন্য নয় বরং ভুল বশত হত্যা করার জন্য নির্ধারিত হয়েছে৷
একঃ নিহত ব্যক্তি যদি দারুল ইসলামের অধিবাসী হয় তাহলে তার হত্যাকারীকে রক্তমূল্য দিতে হবে এবং আল্লাহর কাছে নিজের গোনাহমাফীর জন্য একজন গোলামকেও মুক্ত করে দিতে হবে৷
দুইঃ যদি নিহত ব্যক্তি দারুল হারবের বাসিন্দা হয় তাহলে হত্যাকারী কেবলমাত্র গোলাম মুক্ত করে দেবে৷ তাকে কোন রক্তমূল্য দিতে হবে না৷
তিনঃ যদি নিহত ব্যক্তি এমন কোন দারুল কুফরের বাসিন্দা হয় যার সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তি রয়েছে, তাহলে হত্যাকারী একজন গোলামকে মুক্ত করে দেবে এবং এ ছাড়াও রক্তমূল্যও দান করবে৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে রক্তমূল্যের পরিমাণ তাই হবে, যা সে চুক্তিবদ্ধ জাতির একজন অমুসলিম অধিবাসীকে হত্যা করলে চুক্তি অনুযায়ী দিতে হয়৷
কাফ্ফারার’ শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ”গোপন বস্তু” ৷ কোন সৎকাজকে গোনাহের কাফ্ফারা গণ্য করার অর্থ হচ্ছে এই যে, এই নেকীটি ঐ গোনাহের ওপর ছেয়ে যায় এবং তাকে ঢেকে ফেলে ৷ যেমন কোন দেয়ালের গায়ে দাগ লেগে গেলে চুনকাম করে দাগ মিটিয়ে দেয়া হয়৷
৪:৯৩ وَ مَنۡ یَّقۡتُلۡ مُؤۡمِنًا مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآؤُهٗ جَهَنَّمُ خٰلِدًا فِیۡهَا وَ غَضِبَ اللّٰهُ عَلَیۡهِ وَ لَعَنَهٗ وَ اَعَدَّ لَهٗ عَذَابًا عَظِیۡمًا
৯৩. আর কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ যখন সূরা আল-ফুরকানের এ আয়াত নাযিল হল “আর তারা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহকে ডাকে না। আল্লাহ যার হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে।” [আয়াতঃ ৬৮] তখন মক্কার মুশরিকরা বলতে লাগল, আমরা তো আল্লাহর হারাম করা আত্মাকে হত্যা করেছি, আল্লাহর সাথে অন্যান্য ইলাহকেও ডেকেছি এবং ব্যভিচারও করেছি। ফলে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করলেন “তারা নয়, যারা তাওবা করে, ঈমান আনে” সুতরাং এই আয়াতটুকু ঐ সমস্ত লোকদের জন্য যাদের কথা পূর্বে এসেছে।
কিন্তু সূরা আন-নিসার আয়াত “কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।” এখানে ঐ লোককে উদ্দেশ্য করা হয়েছে, যে ইসলামকে ভালভাবে জানল, শরীআতকে বুঝল, তারপর কোন মুমিনকে হত্যা করল- তার শাস্তি হবে জাহান্নাম। [বুখারীঃ ৩৮৫৫, ৪৭৬৪–৪৭৬৬, মুসলিমঃ ৩০২৩]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা আরো বলেনঃ এটি সর্বশেষ নাযিলকৃত আয়াতসমূহের অন্তর্ভুক্ত। একে কোন কিছু রহিত করেনি। [বুখারীঃ ৪৫৯০, মুসলিমঃ ৩০২৩] এতে বুঝা যায় যে, আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মত হল, যদি কেউ কোন মুমিনকে জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত হত্যা করে, তবে তার শাস্তি জাহান্নাম অবধারিত।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম বলেছেনঃ একজন মুমিন ব্যক্তি তার দ্বীনের ব্যাপারে মুক্তির সুযোগের মধ্যে থাকে যতক্ষন সে কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে হত্যা না করে। [বুখারীঃ ৬৮৬২]
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ তা’আলা মুমিনের হত্যাকারীর জন্য তাওবাহ কবুল করতে আমার নিকট অস্বীকার করেছেন। [আল-আহাদীসুল মুখতারাহঃ ৬/১৬৩, নং ২১৬৪] অন্য হাদীসে এসেছে, আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন দু মুসলিম তাদের অস্ত্র নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয় তখন হত্যাকারী ব্যক্তি ও হত্যাকৃত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামী।
আবু বাকরাহ বলেন, আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর ব্যাপারটা তো স্পষ্ট, কিন্তু হত্যাকৃত ব্যক্তির কি অপরাধ? তিনি জবাব দিলেন যে, সে তার সাথীকে হত্যা করার লালস করছিল। [বুখারীঃ ৬৮৭৫, মুসলিমঃ ২৮৮৮]
হাদীসে আরো এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন প্রথম বিচার অনুষ্ঠিত হবে মানুষের রক্তক্ষরণ তথা হত্যার ব্যাপারে। [বুখারীঃ ৬৮৬৪, মুসলিমঃ ১৬৭৮] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হত্যাকারী কিয়ামতের দিন এমনভাবে উপস্থিত হবে যে, হত্যাকৃত ব্যক্তি হত্যাকারীর মাথা ধরে রাখবে এবং বলবেঃ হে রব! আপনি একে প্রশ্ন করুন, কেন আমাকে হত্যা করেছে? [ইবন মাজাহঃ ২৬২১, মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৪০]
৪:৯৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا ضَرَبۡتُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ فَتَبَیَّنُوۡا وَ لَا تَقُوۡلُوۡا لِمَنۡ اَلۡقٰۤی اِلَیۡکُمُ السَّلٰمَ لَسۡتَ مُؤۡمِنًا ۚ تَبۡتَغُوۡنَ عَرَضَ الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا ۫ فَعِنۡدَ اللّٰهِ مَغَانِمُ کَثِیۡرَۃٌ ؕ کَذٰلِکَ کُنۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلُ فَمَنَّ اللّٰهُ عَلَیۡکُمۡ فَتَبَیَّنُوۡا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا
৯৪. হে মুমিনগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে যাত্রা করবে তখন যাচাই-বাছাই করে নেবে এবং কেউ তোমাদেরকে সালাম করলে ইহ জীবনের সম্পদের আশায় তাকে বলো না, তুমি মুমিন নও, কারণ আল্লাহর কাছে অনায়াসলভ্য সম্পদ প্রচুর রয়েছে। তোমরা তো আগে এরূপই ছিলো, তারপর আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন; কাজেই তোমরা যাচাই-বাছাই করে নেবে। নিশ্চয় তোমরা যা কর আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।
এ আয়াতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, কেউ মুসলিম বলে নিজেকে পরিচয় দিলে অনুসন্ধান ব্যতিরেকে তার উক্তিকে কপটতা মনে করা কোন মুসলিমের জন্যই বৈধ নয়। এ ব্যাপারে কোন কোন সাহাবী থেকে ভুল সংঘটিত হওয়ার কারণে আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত আছে যে, বনী-সুলাইমের এক ব্যক্তি একদিন ছাগলের পাল চরানো অবস্থায় একদল মুজাহিদ সাহাবীর সম্মুখে পতিত হয়। সে মুজাহিদ দলকে সালাম করল। তার পক্ষ থেকে এ বিষয়ের কার্যতঃ অভিব্যক্তি ছিল যে, সে একজন মুসলিম। কিন্তু মুজাহিদরা মনে করলো যে সে শুধু জীবন ও ছাগলের পাল রক্ষা করার জন্যই এ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।
এ সন্দেহে তারা লোকটিকে হত্যা করে তার ছাগলের পাল অধিকার করে নিলেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত করলেন। এ ঘটনার প্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়। এতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ইসলামী পদ্ধতিতে তোমাকে সালাম করে, তার সম্পর্কে এরূপ সন্দেহ করো না যে, সে প্রতারণাপূর্বক নিজেকে মুসলিম বলে প্রকাশ করেছে। তার অর্থ-সম্পদ যুদ্ধলব্ধ মাল মনে করে অধিকারে নিওনা। [মুস্তাদরাকে হাকেমঃ ২/২৩৫, মুসনাদে আহমাদঃ ১/২২৯, ২৭২, ৩২৪, তিরমিযীঃ ৩০৩০] আলোচ্য আয়াত সম্পর্কে এ দু’টি ঘটনা ছাড়া আরো দু’টি ঘটনা বর্ণিত রয়েছে, কিন্তু সুবিজ্ঞ তাফসীরবিদগণ বলেছেন, এসব রেওয়ায়েতের মাঝে কোন বিরোধ নেই। সমষ্টিগতভাবে কয়েকটি ঘটনাও আয়াতটি নাযিলের কারণ হতে পারে
(১) আয়াতের এ বাক্যে একটি সাধারণ নির্দেশ রয়েছে যে, মুসলিমরা কোন কাজ সত্যাসত্য যাচাই না করে শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে করবে না। বলা হচ্ছে- তোমরা যখন আল্লাহর পথে সফর কর, তখন সত্যাসত্য অনুসন্ধান করে সব কাজ করো। শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করলে প্রায়ই ভুল হয়ে যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিমরূপে পরিচয় দেয়, কালেমা পাঠ করে কিংবা অন্য কোন ইসলামী বৈশিষ্ট্য যথা আযান, সালাত ইত্যাদিতে যোগদান করে, তাকে মুসলিম মনে করা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। তার সাথে মুসলিমদের মতই ব্যবহার করতে হবে এবং সে আন্তরিকভাবে মুসলিম হয়েছে না কোন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণ করেছে, একথা প্রমাণ করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য ও স্মরণযোগ্য যে, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম বলে, কুরআন ও হাদীস অনুযায়ী তাকে কাফের বলা বা মনে করা বৈধ নয়।
এর সুস্পষ্ট অর্থ এই যে, কুফরের নিশ্চিত লক্ষণ, এরূপ কোন কথা বা কাজ যতক্ষণ তার দ্বারা সংঘটিত না হবে, ততক্ষণ তার ইসলামী স্বীকারোক্তিকে বিশুদ্ধ মনে করা হবে এবং তাকে মুসলিমই বলা হবে। তার সাথে মুসলিমের মতই ব্যবহার করা হবে এবং তার আন্তরিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করার অধিকার কারো থাকবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি ইসলাম ও ঈমান প্রকাশ করার সাথে সাথে কিছু কুফর কালেমাও উচ্চারণ করে, অথবা প্রতিমাকে প্রণাম করে কিংবা ইসলামের কোন অকাট্য ও স্বতঃসিদ্ধ নির্দেশ অস্বীকার করে কিংবা কাফেরদের কোন ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য অবলম্বন করে; যেমন গলায় পৈতা পরা ইত্যাদি, তাকে সন্দেহাতীতভাবে কুফর কাজকর্মের কারণে কাফের আখ্যা দেয়া হবে। তবে তাকে এ ব্যাপারে শরীআতের জ্ঞান দিতে হবে এবং তার যদি এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে, সে সন্দেহ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করতে হবে।
তারপরই কেবল তাকে কাফের বলা যাবে। নতুবা ইয়াহুদী ও খৃষ্টান সবাই নিজেকে মুমিন-মুসলিম বলতো। মুসায়লামা কাযযাব শুধু কালেমার স্বীকারোক্তিই নয়, ইসলামী বৈশিষ্ট্য যথা আযান, সালাত ইত্যাদিরও অনুগামী ছিল। আযানে ‘আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর সাথে ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’-ও উচ্চারণ করতো। কিন্তু সাথে সাথে সে নিজেকেও নবী-রাসূল ও ওহীর অধিকারী বলে দাবী করতো, যা কুরআন ও সুন্নাহর প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচরণ। এ কারণেই তাকে দ্বীনত্যাগী সাব্যস্ত করা হয় এবং সাহাবায়ে কেরামের ইজমা তথা সর্বসম্মতিক্রমে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করে তাকে হত্যা করা হয়। তবে শর্ত এই যে, ঐ লোকের কাজটি যে ঈমান বিরোধী, তা অকাট্য ও নিশ্চিত হতে হবে। আর তাকে সেটা জানাতে হবে এবং তার সন্দেহ থাকলে তা শরীআতের দৃষ্টিতে অপনোদন করতে হবে।
অর্থাৎ তোমাদেরও আগে এমন এক সময় ছিল যখন তোমরা কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলে। যুলুম নির্যাতনের ভয়ে ইসলামের কথা বাধ্য হয়ে গোপন রাখতে। ঈমানের মৌখিক অঙ্গীকার ছাড়া তোমাদের কাছে তার আর কোন প্রমাণ ছিল না। এখন আল্লাহর অনুগ্রহে তোমরা সামাজিক জীবন-যাপনের সুবিধা ভোগ করছ। কাফেরদের মুকাবেলায় ইসলামের ঝাণ্ডা বুলন্দ করার যোগ্যতা লাভ করেছ। কাজেই যেসব মুসলিম এখনো প্রথম অবস্থায় আছে তাদের ব্যাপারে কোমল ব্যবহার ও সুবিধা দানের নীতি অবলম্বন না করলে তোমাদেরকে যে অনুগ্রহ করা হয়েছে, তার প্রতি যথার্থ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হবে না।
৪:৯৫ لَا یَسۡتَوِی الۡقٰعِدُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ غَیۡرُ اُولِی الضَّرَرِ وَ الۡمُجٰهِدُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ بِاَمۡوَالِهِمۡ وَ اَنۡفُسِهِمۡ ؕ فَضَّلَ اللّٰهُ الۡمُجٰهِدِیۡنَ بِاَمۡوَالِهِمۡ وَ اَنۡفُسِهِمۡ عَلَی الۡقٰعِدِیۡنَ دَرَجَۃً ؕ وَ کُلًّا وَّعَدَ اللّٰهُ الۡحُسۡنٰی ؕ وَ فَضَّلَ اللّٰهُ الۡمُجٰهِدِیۡنَ عَلَی الۡقٰعِدِیۡنَ اَجۡرًا عَظِیۡمًا ﴿ۙ۹۵﴾
৯৫. মুমিনদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়। যারা স্বীয় ধন-প্ৰাণ দ্বারা জিহাদ করে আল্লাহ তাদেরকে, যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন; তাদের প্রত্যেকের জন্য আল্লাহ জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর যারা জিহাদ করে তাদেরকে আল্লাহ মহাপুরস্কারের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।
যখন এই আয়াত নাযিল হল যে, ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করে তারা এবং যারা বাড়ীতে অবস্থান করে তারা পরস্পর সমান নয়’, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রাঃ) (অন্ধ সাহাবী) প্রভৃতিরা অভিযোগ করলেন যে, আমরা তো অক্ষম, যার কারণে আমরা জিহাদে অংশ গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত। উদ্দেশ্য ছিল, ঘরে অবস্থান করার কারণে জিহাদে অংশ গ্রহণকারীদের সমান আমরা নেকী ও সওয়াব অর্জন করতে পারব না, অথচ আমাদের ঘরে অবস্থান স্বেচ্ছায় এবং জান বাঁচানোর জন্য নয়, বরং শরয়ী কারণেই। তাই মহান আল্লাহ [غَيْرُ اُولى الضَّرَرِ] (যারা অক্ষম নয়) কথাটি নাযিল করলেন। অর্থাৎ, যারা সঙ্গত ওজরের কারণে বাড়ীতে অবস্থান করে, তারাও মুজাহিদদের মত নেকীতে সমান সমান শরীক থাকবে। কারণ, (حَبَسَهُمُ العُذْرُ) ‘‘ওজরই তাদের পথে বাধা হয়েছে।’’ (সহীহ বুখারী, জিহাদ অধ্যায়ঃ)
) বারা ইবন আযেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যখন নাযিল হল “মুমিনদের মধ্যে যারা ঘরে বসে থাকে ও যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে তারা সমান নয়” তখন আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি তো অন্ধ। তখন নাযিল হল “যারা অক্ষম নয়”-এ অংশটুকু। [বুখারীঃ ২৮৩১, ৪৫৯৩, মুসলিমঃ ১৮৯৮]
(২) আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে আবু সাঈদ! যে আল্লাহকে রব হিসাবে মেনে সন্তুষ্ট, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসাবে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট তার জন্য জান্নাত অবধারিত। আবু সাঈদ এটা শুনে আশ্চর্য হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে আবার বলুন। রাসূল তাই করলেন। তারপর বললেনঃ “আরো কিছু কাজ রয়েছে, যার দ্বারা জান্নাতে বান্দার মর্যাদা উন্নত করা হয়, দু’স্তরের মাঝখানের দূরত্ব আসমান ও যমীনের মাঝখানের দূরত্বের মত। তিনি বললেন, সেটা কি? হে আল্লাহর রাসূল! রাসূল বললেনঃ আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ। [মুসলিমঃ ১৮৮৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘জান্নাতের একশত স্তর রয়েছে, দু’স্তরের মাঝখানের দূরত্ব শত বৎসরের। [তিরমিযীঃ ২৫২৯]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শত শত হাদীসে ‘জিহাদ’-কে শার‘ঈ অর্থে অর্থাৎ যুদ্ধ ও যুদ্ধের উপায়-উপকরণ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন : আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
مَثَلُ الْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ كَمَثَلِ الصَّائِمِ الْقَائِمِ الْقَانِتِ بِآيَاتِ اللّٰهِ لَا يَفْتُرُ مِنْ صِيَامٍ وَلَا صَلَاةٍ حَتّٰى يَرْجِعَ الْمُجَاهِدُ فِي سَبِيلِ اللّٰهِ تَعَالٰى.
আল্লাহর রাস্তায় মুজাহিদের তুলনা ওইরূপ সায়িম (রোযাদার), যে সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করে যাচ্ছে, যে তার সওম ও সালাত আদায়ে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি প্রকাশ করে না; (সে এরূপ সাওয়াব পেতেই থাকবে) যতক্ষণ না আল্লাহ তা’আলার রাস্তায় মুজাহিদ ফিরে আসে।(বুখারী হাঃ ২৭৮৭, মুসলিম হাঃ ৪৯৭৭)
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার পথে বের হয় তথা দায়িত্বগ্রহণ করে, এই মুজাহিদ আমার ও আমার রসূলের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাসের সত্যতা স্বীকারের তাকীদেই স্বীয় ঘর হতে আমার পথে বের হয়েছে, তাকে আমি অবশ্যই পরিপূর্ণ সাওয়াব দান করবো অথবা গনীমাতের মালসহ ঘরে ফিরিয়ে আনবো অথবা তাকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করাব। (বুখারী ও মুসলিম) সহীহ : সহীহুল বুখারী ৩৬, সহীহ মুসলিম ১৮৭৬।
৩৭৮৭-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তার রসূলের প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়িম করবে, রমাযানের সিয়াম পালন করবে, আল্লাহর পথে জিহাদ করবে বা স্বীয় জন্মভূমিতে অবস্থান করে- তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো আল্লাহর ওপর হক ও দায়িত্ব হয়ে যায়। অতঃপর লোকেরা (সহাবায়ে কিরাম) বললেন, আমরা কি জনগণের মাঝে এ সুসংবাদ জানিয়ে দিব না? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতে একশ’ মর্যাদা প্রস্তুত করে রেখেছে। প্রতি দু’ শ্রেণীর মর্যাদার মাঝে দূরত্বের পরিমাণ আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান। সুতরাং তোমরা যখন আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, তখন তার নিকট (জান্নাতুল) ফিরদাওস প্রার্থনা করবে। কেননা তা জান্নাতের মধ্যম ও সর্বোত্তম জান্নাত। তার উপরিভাগে আল্লাহর ‘আরশ এবং সেখান থেকে জান্নাতের ঝর্ণাসমূহ প্রবাহিত হয়। (বুখারী)সহীহ : সহীহুল বুখারী ২৭৯০, মুসনাদ আহমাদ ৮৪৭৪।
৪:৯৬ دَرَجٰتٍ مِّنۡهُ وَ مَغۡفِرَۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا
৯৬. এসব তার কাছ থেকে মর্যাদা, ক্ষমা ও দয়া; আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর,আন