সূরা আন নিসাঃ ১২তম রুকু (৮৮-৯১)আয়াত
বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
৪:৮৮ فَمَا لَکُمۡ فِی الۡمُنٰفِقِیۡنَ فِئَتَیۡنِ وَ اللّٰهُ اَرۡکَسَهُمۡ بِمَا کَسَبُوۡا ؕ اَتُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ تَهۡدُوۡا مَنۡ اَضَلَّ اللّٰهُ ؕ وَ مَنۡ یُّضۡلِلِ اللّٰهُ فَلَنۡ تَجِدَ لَهٗ سَبِیۡلًا
৮৮. অতঃপর তোমাদের কি হল যে, তোমরা মুনাফেকদের ব্যাপারে দু’দল হয়ে গেলে? যখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের জন্য পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তোমরা কি তাকে সৎপথে পরিচালিত করতে চাও? আর আল্লাহ কাউকেও পথভ্রষ্ট করলে আপনি তার জন্য কখনো কোন পথ পাবেন না।
এখানে এমন সব মুনাফিক মুসলমানেদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা মক্কায় ও আরবের অন্যান্য এলাকায় ইসলাম গ্রহণ করেছিল কিন্তু হিজরাত করে দারুল ইসলামে না এসে যথারীতি নিজেদের কাফের গোত্রের মধ্যে অবস্থান করছিল৷ তাদের কাফের গোত্র ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব কাজ করতো তারাও তাদের সাথে কমবেশী এসব কাজে কার্যত অংশ নিতো৷ তাদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করা যায়, এ বিষয়টি মুসলমানদের জন্য আসলে অত্যন্ত জটিল ছিল৷
কেউ কেউ বলছিল, যাই হোক না কেন, তারা তো মুসলমান,কালেমা পড়ে, নামায পড়ে, রোযা রাখে, কুরআন তেলাওয়াত করে৷ তাদের সাথে কাফেরদের মতো ব্যবহার কেমন করে করা যেতে পারে? এই রুকূ’তে মহান আল্লাহ মুসলমানদের মতবিরোধের চূড়ান্ত মীমাংসা করে দিয়েছেন৷
এ প্রসংগে একটি কথা সুস্পষ্টভাবে বুঝে নিতে হবে৷ অন্যথায় কুরআনের কেবল এই জায়গায় নয় আরো বিভিন্ন জায়গায়, যেখানে হিজরাত না করার কারণে মুসলমানদেরকে মুনাফিকদের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে, সেখানে কুরআন মজীদের আসল বক্তব্য অনুধাবন করা সম্ভব হবে না৷ আসলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনা তাইয়েবায় হিজরাত করে আসেন এবং যখন আরব দেশে এমন একটি ছোট্ট ভূখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে একজন মু’মিন বান্দার জন্য তার দীন ও ঈমানেদের দাবী পুরন করা সম্ভবপর ছিল তখন যেখানে, যে এলাকায় ও যেসব গোত্রের মধ্যে ঈমানদারগণ কাফেরদের অধীনে ইসলামী জীবন যাপনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল, সেখান থেকে তাদের জন্য হিজরাত করার ও মদীনার দারুল ইসলামে চলে আসার সাধারণ হুকুমনামা জারী করে দেয়া হয়েছিল৷ সে সময় তাদের হিজরাত করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেবলমাত্র এজন্য হিজরাত করছিল না যে, তাদের নিজেদের ঘর-বাড়ি, আত্মীয়-স্বজন ও নিজেদের বৈষয়িক স্বাথ্য তাদের কাছে ইসলামের তুলনায় বেশী প্রিয় ছিল, তাদের সবাইকে মুনাফিক গণ্য করা হয়৷ আর যারা যথার্থই একেবারে অক্ষম ছিল তাদেরকে ‘মুসতাদআফীন’ (দুর্বল) গণ্য করা হয়৷ যেমন পরবর্তী ১৪ রুকূ’তে বলা হয়েছে৷
এখন একথা সুস্পষ্ট যে, দারুল কুফরে অবস্থানকারী কোন মুসলমানকে নিছক হিজরাত না করার কারণে মুনাফিক কেবলমাত্র তখনি বলা যেতে পারে যখন দারুল ইসলামদেরকে সেখানে বসবাস করার আহবান জানানো হবে অথবা কমপক্ষে তাদের জন্য দারুল ইসলামেদের দরজা উন্মুক্ত থাকবে৷ এ অবস্থায় অবশ্যি যেসব মুসলমান দারুল কুফরকে দারুল ইসলামে পরিণত করার জন্য প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম চালাবে না আবার অন্য দিকে সামর্থ থাকা সত্ত্বেও হিজরাতও করবে না তারা সবাই মুনাফিক বলে গণ্য হবে৷ কিন্তু দারুল ইসলামের পক্ষ থেকে যদি আমন্ত্রণই না জানানো হয় এবং মুহাজিরদের জন্য তাদের দরজা যদি উন্মুক্তই না থাকে, তাহলে এ অবস্থায় শুধুমাত্র হিজরাত না করলে কোন মুসলমান মুনাফিক হয়ে যাবে না৷ বরং এ অবস্থায় যখণ সে কোন মুনাফিক সুলভ কাজ করবে কেবলমাত্র তখনই মুনাফিক গণ্য হবে৷
যায়েদ ইবন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ওহুদের যুদ্ধে বের হলেন তখন তার সাথীদের মধ্য থেকে কিছু লোক ফিরে চলে আসলেন। তাদের ব্যাপারে সাহাবাগণ দ্বিমত পোষণ করলেন। কেউ বললেন হত্যা করব, কেউ বললেন হত্যা করব না। তখন এ আয়াত নাযিল হয় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ এই মদীনা নগরী কিছু মানুষকে দেশান্তর করে যেমনিভাবে আগুন দূর করে লোহার ময়লাকে। [বুখারীঃ ১৮৮৪, ৪০৫০, ৪৫৮৯, মুসলিমঃ ১৩৮৪, ২৭৭৬]
অর্থাৎ যে দ্বিমুখী নীতি, সুবিধাবাদিতা এবং আখেরাতের ওপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেবার কর্মনীতি তারা অবলম্বন করেছে, তার বদৌলতে আল্লাহ তাদেরকে আবার সেদিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন যেদিক থেকে তারা এসেছিল৷ তারা কুফরী থেকে বের হয়ে ইসলামের দিকে এগিয়ে এসেছিল ঠিকই কিন্তু এই এলাকায় এসে অবস্থান করার এবং একমূখী ও একাগ্র হবার প্রয়োজন ছিল, ঈমান ও ইসলামের স্বার্থের আথে সংঘর্ষশীল প্রতিটি স্বার্থ পরিহার করার প্রয়োজন ছিল এবং আখেরাতের ওপর এমন দৃঢ় বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল যার ভিত্তিতে মানুষ নিশ্চিন্তে নিজের দুনিয়ার স্বার্থ পরিহার করতে পারে৷ কিন্তু তা তারা অর্জন করতে পারেনি৷ তাই তারা যেদিক থেকে এসেছিল পেছন ফিরে আবার সেদিকেই চলে গেছে৷ কাজেই এখন তাদের ব্যাপারে মতবিরোধ করার আর কোন অবকাশ নেই৷
অন্য আয়াতেও আল্লাহ্ তা’আলা তা স্পষ্ট বলেছেন।
আল্লাহ বলেন, “আর আল্লাহ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান তার জন্য আল্লাহর কাছে আপনার কিছুই করার নেই। এরাই হচ্ছে তারা যাদের হৃদয়কে আল্লাহ বিশুদ্ধ করতে চান না; তাদের জন্য আছে দুনিয়ায় লাঞ্ছনা আর আখেরাতে রয়েছে তাদের জন্য মহাশাস্তি [সূরা আল-মায়িদাহ ৪১]
অন্য আয়াতে এসেছে, “আল্লাহ যাদেরকে বিপথগামী করেন তাদের কোন পথপ্রদর্শক নেই। [সূরা আল-আরাফ: ১৮৬]
মুনাফিকের পরিচয় সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তারা যখন ঈমানদার লোকদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন বলে আমরা ঈমান এনেছি। কিন্তু যখন নির্জনে তারা তাদের শয়তানদের সঙ্গে মিলিত হয় তখন তারা বলে, আসলে আমরা তোমাদের সঙ্গেই আছি, আর আমরা তাদের সঙ্গে ঠাট্টাই করি মাত্র। (সূরা বাক্বারাহ: আয়াত ১৪)
৪:৮৯ وَدُّوۡا لَوۡ تَکۡفُرُوۡنَ کَمَا کَفَرُوۡا فَتَکُوۡنُوۡنَ سَوَآءً فَلَا تَتَّخِذُوۡا مِنۡهُمۡ اَوۡلِیَآءَ حَتّٰی یُهَاجِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ فَاِنۡ تَوَلَّوۡا فَخُذُوۡهُمۡ وَ اقۡتُلُوۡهُمۡ حَیۡثُ وَجَدۡتُّمُوۡهُمۡ ۪ وَ لَا تَتَّخِذُوۡا مِنۡهُمۡ وَلِیًّا وَّ لَا نَصِیۡرًا
৮৯. তারা এটাই কামনা করে যে, তারা যেরূপ কুফরী করেছে তোমরাও সেরূপ কুফরী কর, যাতে তোমরা তাদের সমান হয়ে যাও। কাজেই আল্লাহর পথে হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের মধ্য থেকে কাউকেও বন্ধুরূপে গ্রহন করবে না। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদেরকে যেখানে পাবে গ্রেফতার করবে এবং হত্যা করবে আর তাদের মধ্য থেকে কাউকেও বন্ধু ও সহায়রূপে গ্রহণ করবে না।
মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফের জাতিদের সাথে যেসব মুনাফিক মুসলমান সম্পর্ক রাখে এবং ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ও শত্রুতামূলক কার্যকলাপে কার্যত অংশগ্রহণ করে, তাদের সম্পর্কে এই নিদের্শটি দেয়া হয়েছে৷
হিজরত দু’অর্থে ব্যবহৃত হয়-
(১) দ্বীনের খাতিরে দেশ ত্যাগ করা, যেমন সাহাবায়ে কেরাম স্বদেশ মক্কা ছেড়ে মদীনা ও আবিসিনিয়ায় চলে যান।
(২) পাপ কাজ বর্জন করা। তন্মধ্যে প্রথম প্রকার হিজরত হচ্ছে নিজের দ্বীনকে বাঁচানোর জন্য।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে কাফেরদের দেশ থেকে হিজরত করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয ছিল। এ কারণে যারা এ ফরয পরিত্যাগ করতো, তাদের সাথে আল্লাহ্ তাআলা মুসলিমদের মত ব্যবহার করতে নিষেধ করে দেন। হিজরত সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছেঃ যতদিন তাওবা কবুল হওয়ার সময় থাকবে, ততদিন হিজরত বাকী থাকবে। [আবু দাউদঃ ২৪৭৯]
এর দ্বারা বোঝা যায় যে, বর্তমানেও যদি কোন দেশে মুসলিমরা তাদের ঈমান টিকিয়ে রাখতে সামর্থ না হয়, তাদেরকে সেখান থেকে হিজরত করতে হবে ৷ পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকার হিজরত হচ্ছে, পাপকর্ম ত্যাগ করা। যেমন, এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘ঐ ব্যক্তি মুহাজির, যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয় বর্জন করে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৯৯] এ হিজরত সর্বাবস্থায় একজন মুমিনের কর্তব্য। এর জন্য দেশ ত্যাগের প্রয়োজন পড়ে না।
আল্লাহ বলেন, ‘হে নবি! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন এবং তাদের সম্পর্কে কঠোর নীতি অবলম্বন করুন। আর তাদের পরিণতির হচ্ছে জাহান্নাম এবং তা অত্যন্ত নিকৃষ্ট স্থান। (সূরা তাওবাহ: আয়াত ৭৩)
আল্লাহ আরো বলেন, নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে অবস্থান করবে। (সূরা নিসা: আয়াত ১৪৫)
৪:৯০ اِلَّا الَّذِیۡنَ یَصِلُوۡنَ اِلٰی قَوۡمٍۭ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَهُمۡ مِّیۡثَاقٌ اَوۡ جَآءُوۡکُمۡ حَصِرَتۡ صُدُوۡرُهُمۡ اَنۡ یُّقَاتِلُوۡکُمۡ اَوۡ یُقَاتِلُوۡا قَوۡمَهُمۡ ؕ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰهُ لَسَلَّطَهُمۡ عَلَیۡکُمۡ فَلَقٰتَلُوۡکُمۡ ۚ فَاِنِ اعۡتَزَلُوۡکُمۡ فَلَمۡ یُقَاتِلُوۡکُمۡ وَ اَلۡقَوۡا اِلَیۡکُمُ السَّلَمَ ۙ فَمَا جَعَلَ اللّٰهُ لَکُمۡ عَلَیۡهِمۡ سَبِیۡلًا ﴿۹۰﴾
৯০. কিন্তু তাদেরকে নয় যারা এমন এক সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয় যাদের সাথে তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ, অথবা যারা তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় আগমন করে যখন তাদের মন তোমাদের সাথে বা তাদের সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করতে সংকুচিত হয়। আল্লাহ যদি ইচ্ছে করতেন তবে তাদেরকে তোমাদের উপর ক্ষমতা দিতেন ফলে তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করত। কাজেই তারা যদি তোমাদের কাছ থেকে সরে দাঁড়ায়, তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট শান্তি প্রস্তাব করে তবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা অবলম্বনের পথ রাখেন নি।
এখানে আওতাভুক্ত না করার যে নির্দেশটি জারি করা হয়েছে তার সম্পর্ক ”তাদের মধ্য থেকে কাউকে নিজেদের বন্ধু ও সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করো না” বাক্যটির সাথে নয়৷ বরং এর সম্পর্ক হচ্ছে ”’ তাদেরকে যেখানেই পাও ধরো এবং হত্যা কারো” বাক্যটির সাথে৷ এর অর্থ হচ্ছে, যেসব মুনফিককে হত্যা করা ওয়াজিব, তারা যদি এমন কোন জাতির এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নেয় যাদের সাথে ইসলামী রাষ্ট্রের চুক্তি রয়েছে,তাহলে সেই রাষ্ট্রের সীমানায় প্রবেশ করে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা যাবে না৷ আর দারুল ইসলামের কোন মুসলমান কোন নিরপেক্ষ দেশের এলাকায় যদি এমন কোন মুনাফিককে পায় যাকে হত্যা করা ওয়াজিব এবং তাকে হত্যাও করে ফেলে, তাহলে এটাও কোনক্রমে বৈধ হবে না৷ এখানে আসলে মুনাফিকদের রক্তের প্রতি নয় বরং চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনই লক্ষ্য৷
যাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্য হতে দুই শ্রেণীর মানুষ এই নির্দেশ থেকে স্বতন্ত্র।
একঃ এমন লোক যার সম্পর্ক এমন জাতির সাথে আছে, যাদের সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি হয়ে আছে অথবা সে এমন লোক যে তাদের আশ্রয়ে আছে, যাদের সাথে তোমাদের সন্ধিচুক্তি হয়ে আছে।
দুইঃ এমন লোক যারা তোমাদের কাছে এমন অবস্থায় আসে যে, তাদের হৃদয় নিজেদের জাতির সাথে মিলে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অথবা তোমাদের সাথে মিলে নিজেদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে বড় সংকীর্ণতা বোধ করে। অর্থাৎ, না তোমাদের হয়ে যুদ্ধ করতে পছন্দ করে, না তোমাদের বিরুদ্ধে।
অর্থাৎ, তাদেরকে যুদ্ধ করা থেকে বিরত রাখাটা আল্লাহরই অনুগ্রহের ব্যাপার। তা না হলে যদি মহান আল্লাহ তাদের অন্তরে স্বীয় জাতির পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করার খেয়াল সৃষ্টি করে দিতেন, তাহলে তারাও তোমাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই যুদ্ধ করত। কাজেই সত্য-সত্যই যদি এরা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে, তাহলে তোমরাও তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করো না।
‘তোমাদের নিকট থেকে পৃথক হয়ে যায়, তোমাদের সাথে যুদ্ধ না করে এবং তোমাদের নিকট সন্ধি প্রার্থনা করে’ এ সবের অর্থ একই। তাকীদ এবং অধিক স্পষ্টভাবে বর্ণনার জন্য তিন ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে মুসলিম তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। কারণ, যে পূর্ব থেকেই যুদ্ধ হতে পৃথক এবং তাদের এই পৃথকতায় মুসলিমদের লাভও রয়েছে; আর এই জন্য মহান আল্লাহ এটাকে অনুগ্রহ ও দয়া স্বরূপ উল্লেখ করেছেন, সুতরাং তাদেরকে ঘাঁটানো এবং তাদের ব্যাপারে অসতর্কতা অবলম্বন করা তাদের মধ্যে বিরোধিতা এবং বিদ্রোহের প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারে; যা মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত তারা উল্লিখিত অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে না। এর দৃষ্টান্ত সেই গোষ্ঠীও বটে, যাদের সম্পর্ক ছিল বানী-হাশেমের সাথে। এরা বদর যুদ্ধে মুশরিকদের সাথ দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হলেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার তাদের কোনই ইচ্ছা ছিল না। যেমন, রসূল (সাঃ)-এর চাচা আব্বাস (রাঃ) প্রভৃতি ব্যক্তিবর্গ যাঁরা তখন পর্যন্তও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাই বাহ্যিকভাবে কাফেরদের তাঁবুতেই ছিলেন। আর এই জন্যই নবী করীম (সাঃ) আব্বাস (রাঃ)-কে হত্যা না করে কেবল বন্দী করেই ক্ষান্ত হন। سَلَمٌ (শান্তি) এখানে مُسَالَمَةٌ (শান্তিপ্রস্তাব) অর্থাৎ, সন্ধি করার অর্থে ব্যবহার হয়েছে।
৪:৯১ سَتَجِدُوۡنَ اٰخَرِیۡنَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّاۡمَنُوۡکُمۡ وَ یَاۡمَنُوۡا قَوۡمَهُمۡ ؕ کُلَّمَا رُدُّوۡۤا اِلَی الۡفِتۡنَۃِ اُرۡکِسُوۡا فِیۡهَا ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یَعۡتَزِلُوۡکُمۡ وَ یُلۡقُوۡۤا اِلَیۡکُمُ السَّلَمَ وَ یَکُفُّوۡۤا اَیۡدِیَهُمۡ فَخُذُوۡهُمۡ وَ اقۡتُلُوۡهُمۡ حَیۡثُ ثَقِفۡتُمُوۡهُمۡ ؕ وَ اُولٰٓئِکُمۡ جَعَلۡنَا لَکُمۡ عَلَیۡهِمۡ سُلۡطٰنًا مُّبِیۡنًا ﴿
৯১. তোমরা আরো কিছু লোক অবশ্যই পাবে যারা তোমাদের সাথে ও তাদের সম্প্রদায়ের সাথে শান্তি চাইবে। যখনই তাদেরকে ফিতনার দিকে মনোনিবেশ করানো হয় তখনই এ ব্যাপারে তারা তাদের আগের অবস্থায় ফিরে যায়। যদি তারা তোমাদের কাছ থেকে চলে না যায়, তোমাদের কাছে শান্তি প্রস্তাব না করে এবং তাদের হস্ত সংবরণ না করে তবে তাদেরকে যেখানেই পাবে গ্রেফতার করবে ও হত্যা করবে। আর আমরা তোমাদেরকে এদের বিরুদ্ধাচারণের স্পষ্ট অধিকার দিয়েছি।
উপরোক্ত ৮৮ থেকে ৯১ আয়াতসমূহে তিনটি দলের কথা বর্ণিত হয়েছে এবং তাদের সম্পর্কে দু’টি বিধান উল্লেখিত হয়েছে। এসব দলের ঘটনাবলী নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনাসমূহ থেকে জানা যাবে।
প্রথম বর্ণনাঃ তাফসীরকার মুজাহিদ বলেন, একবার কতিপয় মুশরিক মক্কা থেকে মদীনায় আগমন করে এবং প্রকাশ করে যে, তারা মুসলিম; হিজরত করে মদীনায় এসেছে। কিছুদিন পর তারা দ্বীনত্যাগী হয়ে যায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পণ্যদ্রব্য আনার অজুহাত পেশ করে পুনরায় মক্কা চলে যায়। এরপর তারা আর ফিরে আসেনি। এদের সম্পর্কে মুসলিমদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দেয়। কেউ কেউ বলল এরা কাফের, আর কেউ কেউ বলল এরা মুমিন। আল্লাহ্ তা’আলা ৮৮ ও ৮৯ নং আয়াতে এদের কাফের হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং এদেরকে হত্যা করার বিধান দিয়েছেন। [তাবারী] কাতাদা থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, এরা ছিল তিহামার একটি গোত্র, তারা রাসূলকে বলল যে, আমরা আপনার সাথে যুদ্ধ করব না, আমাদের কাওমের সাথেও যুদ্ধ করব না। তারা রাসূল ও তাদের কাওমের যুগপৎ নিরাপত্তা চাচ্ছিল। তাদের অবস্থা বুঝে আল্লাহ তা’আলা তা মানতে অস্বীকার করেন। [ইবন আবী হাতেম; আত-তাফসীরুস সহীহ]
দ্বিতীয় বর্ণনাঃ হাসান বসরী বর্ণনা করেন যে, বদর ও ওহুদ যুদ্ধের পর সুরাকা ইবন মালেক মুদলাজী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রার্থনা জানালো, আমাদের গোত্র বনী-মুদলাজের সাথে সন্ধি স্থাপন করুন। তিনি খালেদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সন্ধি সম্পন্ন করার জন্য সেখানে পাঠালেন। সন্ধির বিষয়বস্তু ছিল এইঃ আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করবো না। কুরাইশরা মুসলিম হয়ে গেলে আমরাও মুসলিম হয়ে যাবো। যেসব গোত্র আমাদের সাথে একতাবদ্ধ হবে, তারাও এ চুক্তিতে আমাদের অংশীদার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ নং আয়াত নাযিল হয়।
তৃতীয় বর্ণনাঃ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত আছে যে, ৯১ নং আয়াতে আসাদ ও গাতফান গোত্রদ্বয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। তারা মদীনায় এসে বাহ্যতঃ নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করতো এবং স্বগোত্রের কাছে বলতো আমরা তো বানর ও বিচ্ছদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তারাই আবার মুসলিমদের কাছে বলত, আমরা তোমাদের দ্বীনে আছি।
মোটকথা, এখানে তিন দল লোকের কথা উল্লেখিত হয়েছেঃ
এক. মুসলিম হওয়ার জন্য যে সময় হিজরত করা শর্ত সাব্যস্ত হয়, সে সময় সামর্থ্য থাকা সত্বেও যারা হিজরত না করে কিংবা হিজরত করার পর দারুল ইসলাম ত্যাগ করে দারুল হারবে চলে যায়।
দুই. যারা স্বয়ং মুসলিমদের সাথে ‘যুদ্ধ নয়’ চুক্তি করে কিংবা এরূপ চুক্তিকারীদের সাথে চুক্তি করে।
তিন. যারা সাময়িকভাবে বিপদ থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তিচুক্তি করে অতঃপর মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহবান জানানো হলে তাতে অংশগ্রহণ করে এবং চুক্তিতে কায়েম না থাকে।
প্রথম দল সাধারণ কাফেরদের মত। দ্বিতীয় দল হত্যা ও ধরপাকড়ের আওতা বহির্ভূত এবং তৃতীয় দল প্রথম দলের অনুরূপ শাস্তির যোগ্য। এসব আয়াতে মোট দুটি বিধান উল্লেখিত হয়েছে; অর্থাৎ সন্ধিচুক্তি না থাকা কালে যুদ্ধ এবং সন্ধিচুক্তি থাকাকালে যুদ্ধ নয়।
মুনাফিকদের বিষয়ে একজন ঈমানদারের অবস্থান কি হওয়া উচিত? অন্তর-বিধ্বংসী বিষয়সমূহ: নিফাক-শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
মুনাফিকদের সাথে কোনো প্রকার নমনীয়তা প্রদর্শন সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তাদের ক্ষতিকে কোনো ক্রমেই ছোট মনে করা যাবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের মুনাফিকদের তুলনায় বর্তমান যুগের মুনাফিকরা আরো অধিক ভয়ঙ্কর।
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামন রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«إن المنافقين اليوم شر منهم على عهد النبي صلى الله عليه وسلم كانوا يومئذ يسرون واليوم يجهرون»
“বর্তমান যুগের মুনাফিকরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের মুনাফিকদের তুলনায় আরো বেশি ভয়ঙ্কর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে তারা গোপনে কাজ করত, আর বর্তমানে তারা প্রকাশ্যে মুনাফেকি করে। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৭১১৩।
তাদের বিষয়ে একজন মুসলিমের অবস্থান:
১. মুনাফিকদের আনুগত্য করা হতে বিরত থাকা:
কখনোই মুনাফিকদের আনুগত্য করা যাবে না। কারণ, তারা কখনোই মুসলিমদের কল্যাণ চায় না তারা চায় ক্ষতি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ ٱتَّقِ ٱللَّهَ وَلَا تُطِعِ ٱلۡكَٰفِرِينَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمٗا﴾ [الأحزاب: 1
“হে নবী, আল্লাহকে ভয় কর এবং কাফির ও মুনাফিকদের আনুগত্য করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সম্যক জ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়।” [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ১]
আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা তাবারী রহ. আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ ٱتَّقِ ٱللَّهَ﴾ “হে নবী, আল্লাহকে ভয় কর” অর্থাৎ হে নবী! তুমি আল্লাহকে তার আনুগত্যের মাধ্যমে ভয় কর। তোমার জন্য যা করা কর্তব্য ও তোমার ওপর যা ফরয করা হয়েছে, তা আদায় কর এবং যে সব নিষিদ্ধ কাজ হতে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে, তা করা হতে বিরত থাক।
﴿لَا تُطِعِ ٱلۡكَٰفِرِينَ﴾ “আর তুমি কাফিরদের আনুগত্য করো না।” যারা তোমাকে বলে, তুমি তোমার আশপাশ থেকে দুর্বল, গরীব, মিসকিন ও অসহায় ঈমানদারদের সরিয়ে দাও। তাদের তুমি আনুগত্য করো না। وَٱلۡمُنَٰفِقِينَۚ আর তুমি মুনাফিকদের আনুগত্য করো না যারা তোমার নিকট এসে প্রকাশ করে যে, তারা ঈমানদার ও তোমার সহযোগী। বাস্তবে তারা ঈমানদার নয়, তারা কখনোই তোমাকে ও তোমার সাথীদেরকে বন্ধু বানাবে না। তুমি তাদের থেকে কোনো মতামত নিয়ো না এবং তাদের কোনো পরামর্শ গ্রহণ করো না। কারণ, তারা তোমার দুশমন ও আল্লাহর দীনের দুশমন।إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمٗا নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সম্যক জ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা তারা তাদের অন্তরে যা কিছু গোপন করে তা জানেন। আর তারা প্রকাশ্যে তোমার কল্যাণকামী হওয়ার দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ও জানেন। আল্লাহ তা‘আলা তোমার ও তোমার সাহাবীদের এবং দীনের যাবতীয় কর্মের আঞ্জাম দেওয়ার ক্ষেত্রে এবং সমগ্র মাখলুকের যাবতীয় পরিচালনায় তিনি সম্যক জ্ঞানী।জামেউল বায়ান ২০/২০২
২. মুনাফিকদের সাথে বিতর্ক করা থেকে বিরত থাকা, তাদের ধমক দেওয়া ও ভালো হওয়ার জন্য উপদেশ দেওয়া:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿بَشِّرِ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ بِأَنَّ لَهُمۡ عَذَابًا أَلِيمًا﴾ [النساء : 137
“তুমি মুনাফিকদের সুসংবাদ দাও যে, তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।” [সূরা আন-নিসা: ১৩৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُ ٱللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ فَأَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَعِظۡهُمۡ وَقُل لَّهُمۡ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَوۡلَۢا بَلِيغٗا﴾ [النساء: 63]
“ওরা হলো সেসব লোক, যাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ তা জানেন। সুতরাং তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও এবং তাদেরকে সদুপদেশ দাও। আর তাদেরকে তাদের নিজদের ব্যাপারে মর্মস্পর্শী কথা বল”। [সূরা আন-নিসা: ৬৩]
আয়াতের ব্যাখ্যা: হে মুহাম্মাদ! ঐ সব মুনাফিক যাদের বর্ণনা আমি তোমাকে দিয়েছি, তারা তোমার নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে আসা বাদ দিয়ে তাগুতের নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে যাওয়াতে তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা জানেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, يَعۡلَمُ ٱللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمۡ “তাদের অন্তরে কি আছে আল্লাহ তা জানেন” যদিও তারা শপথ করে বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ভালোই ছিল। আমরা কখনোই খারাপ চাইনি।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَأَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَعِظۡهُمۡ তুমি তাদের থেকে বিরত থাক। তাদের দৈহিক ও শারীরিক কোনো প্রকার শাস্তি দিও না। তবে তাদের ওপর নাযিল হওয়া আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে তাদের ভয় দেখিয়ে তাদের উপদেশ দাও। আর তাদের শাস্তি হলো, তারা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে যে সন্দেহ পোষণ করে তার কারণে তাদের ঘরে বাড়ীতে আযাব নাযিল হওয়া। আল্লাহ তার রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, وَقُل لَّهُمۡ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ قَوۡلَۢا بَلِيغٗا আর তুমি আল্লাহকে ভয় করতে এবং তার রাসূল তাদের আযাবের যে ওয়াদা ও হুমকি দিয়েছো তার প্রতি বিশ্বাস করতে বল। জামেউল বায়ান ৮/৫১৫।
৩. তাদের সাথে বিতর্ক না করা এবং তাদের থেকে আত্মরক্ষা করা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُجَٰدِلۡ عَنِ ٱلَّذِينَ يَخۡتَانُونَ أَنفُسَهُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ خَوَّانًا أَثِيما﴾ [النساء: 107]
“আর যারা নিজেদের খিয়ানত করে তুমি তাদের পক্ষে বিতর্ক করো না। নিশ্চয় আল্লাহ ভালবাসেন না তাকে, যে খিয়ানতকারী, পাপী।” [সূরা আন-নিসা: ১০৭]
“হে মুহাম্মাদ! তুমি বিতর্ক করো না তাদের পক্ষে যারা নিজেদের খিয়ানত করে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ঐ সব লোকদের পছন্দ করেন না যাদের গুণ হলো, মানুষের সম্পদে খিয়ানত করা এবং আল্লাহ তা‘আলা যে সব কাজ করতে নিষেধ করছে তা করা। জামে’উল বায়ান ৯/১৯০
৪. তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকা:
মুনাফিকদের কখনোই অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُواْ بِطَانَةٗ مِّن دُونِكُمۡ لَا يَأۡلُونَكُمۡ خَبَالٗا وَدُّواْ مَا عَنِتُّمۡ قَدۡ بَدَتِ ٱلۡبَغۡضَآءُ مِنۡ أَفۡوَٰهِهِمۡ وَمَا تُخۡفِي صُدُورُهُمۡ أَكۡبَرُۚ قَدۡ بَيَّنَّا لَكُمُ ٱلۡأٓيَٰتِۖ إِن كُنتُمۡ تَعۡقِلُونَ﴾ [آل عمران: 118]
“হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১১৮]
মুসলিমদের এক দল সম্পর্কে নাযিল হয়, যাদের সহযোগী ছিল ইয়াহুদী ও মুনাফিক। ইসলামের পূর্বে জাহিলিয়াতের যুগে তাদের সাথে যে সব কারণে বন্ধুত্ব ছিল, সে সব কারণে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিষেধ করেন এবং তাদের কোনো বিষয়ে উপদেশ দিতে নিষেধ করেন। জামেউল বায়ান ৭/১৪০।
৫. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং তাদের বিষয়ে কঠোর হওয়া:
মুনাফিকদের বিষয়ে কোনো প্রকার নমনীয়তা প্রদর্শন করা যাবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ وَٱغۡلُظۡ عَلَيۡهِمۡۚ وَمَأۡوَىٰهُمۡ جَهَنَّمُۖ وَبِئۡسَ ٱلۡمَصِيرُ﴾
“হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তাদের ওপর কঠোর হও, আর তাদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৭৩]
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা তার স্বীয় রাসূলকে নির্দেশ দেন যে, ﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ جَٰهِدِ ٱلۡكُفَّارَ﴾ হে নবী আপনি কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করেন তলোয়ার ও অস্ত্র নিয়ে।وَٱلۡمُنَٰفِقِينَ আর মুনাফিকদের সাথেও জিহাদ করুন। মুনাফিকদের সাথে জিহাদ করা অর্থ কি এ বিষয়ে, মুফাসসিরদের মধ্যে একাধিক মত আছে, তাদের সাথে জিহাদ হলো হাত ও মুখ দ্বারা। আর যা কিছু দ্বারা তাদের সাথে জিহাদ করা সম্ভব হয়। এটিই হলো, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদের মতামত। জামেউল বায়ান ১৪/৩৬০
৬. মুনাফিকদের নিকৃষ্ট বলে জানা এবং কখনো তাদের কাউকে নেতা না বানানো:
বুরাইদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا تَقُولُوا للِمُناَفقِِ سَّيدٌ، فَإنِّهُ إنِْ يَكُ سَّيدًا فَقَدْ أَسْخْطُتمْ ربَّكُمْ عَزَّ وَجَلَّ»
“তোমরা মুনাফিকদের কখনোই নেতা বলে সম্বোধন করো না। কারণ, যদি তোমরা তাদেরকে সরদার বল, তাহলে তোমরা তোমাদের রবকে অসন্তুষ্ট করলে ও কষ্ট দিলে।
৭. তারা মারা গেলে তাদের জানাজায় অংশ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকা:
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓۖ إِنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُواْ وَهُمۡ فَٰسِقُونَ﴾ [التوبة: 84]
“আর তাদের মধ্যে যে মারা গিয়েছে, তার ওপর তুমি জানাজা পড়বে না এবং তার কবরের ওপর দাঁড়াবে না। নিশ্চয় তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তারা ফাসিক অবস্থায় মারা গিয়েছে।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৮৪]
আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিন বলেন,
“আব্দুল্লাহ ইবন উবাই ইবন সুলুল মারা গেলে তার ছেলে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল! তুমি তোমার পরিধেয় কাপড়টি আমার নিকট দাও! তাতে আমি আমার পিতাকে কাফন দেবো। আর তুমি তার ওপর সালাতে জানাজা পড় এবং তার জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাও। তার প্রস্তাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মত হয়ে তাকে তার জামাটি দিয়ে দেয় এবং তাকে বলে, তুমি যখন কাফন থেকে ফারেগ হবে, তখন আমাকে খবর দেবে। তারপর যখন তারা কাফন থেকে ফারেগ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খবর দিল। খবর পেয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ওপর সালাতে জানাজা আদায়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে টেনে ধরে বলেন, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আল্লাহ তা‘আলা কি আপনাকে মুনাফিকদের ওপর সালাতে জানাজা পড়তে নিষেধ করে নি? তখন তিনি বলেন, আমি তাদের জন্য ক্ষমা চাই বা না চাই উভয়টি সমান। আর আমি যদি তাদের জন্য সত্তর বারও ক্ষমা চাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের কখনোই ক্ষমা করবে না। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন, ﴿وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓۖ إِنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ وَمَاتُواْ وَهُمۡ فَٰسِقُونَ﴾
আর তাদের মধ্যে যে মারা গিয়েছে, তার ওপর তুমি জানাযা পড়বে না এবং তার কবরের ওপর দাঁড়াবে না। নিশ্চয় তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং তারা ফাসিক অবস্থায় মারা গিয়েছে। তারপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ওপর সালাত আদায় করা ছেড়ে দেন। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৭৯৬।
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন