সূরা আন নিসাঃ ১১তম রুকু(৭৭-৮৭)আয়াত

 সূরা আন নিসাঃ ১১তম রুকু(৭৭-৮৭)আয়াত

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

৪:৭৭ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ قِیۡلَ لَهُمۡ کُفُّوۡۤا اَیۡدِیَکُمۡ وَ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّکٰوۃَ ۚ فَلَمَّا کُتِبَ عَلَیۡهِمُ الۡقِتَالُ اِذَا فَرِیۡقٌ مِّنۡهُمۡ یَخۡشَوۡنَ النَّاسَ کَخَشۡیَۃِ اللّٰهِ اَوۡ اَشَدَّ خَشۡیَۃً ۚ وَ قَالُوۡا رَبَّنَا لِمَ کَتَبۡتَ عَلَیۡنَا الۡقِتَالَ ۚ لَوۡ لَاۤ اَخَّرۡتَنَاۤ اِلٰۤی اَجَلٍ قَرِیۡبٍ ؕ قُلۡ مَتَاعُ الدُّنۡیَا قَلِیۡلٌ ۚ وَ الۡاٰخِرَۃُ خَیۡرٌ لِّمَنِ اتَّقٰی ۟ وَ لَا تُظۡلَمُوۡنَ فَتِیۡلًا ﴿

. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে বলা হয়েছিল, তোমরা তোমাদের হস্ত সংবরণ কর, সালাত কায়েম কর এবং যাকাত দাও? অতঃপর যখন তাদেরকে যুদ্ধের বিধান দেয়া হল তখন তাদের একদল মানুষকে ভয় করছিল আল্লাহকে ভয় করার মত অথবা তারচেয়েও বেশী এবং বলল, “হে আমাদের রব! আমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান কেন দিলেন? আমাদেরকে কিছু দিনের অবকাশ কেন দিলেন না?” বলুন, ‘পার্থিব ভোগ সামান্যএবং যে তাকওয়া অবলম্বন করে তার জন্য আখেরাতই উত্তম। আর তোমাদের প্রতি সামান্য পরিমাণও যুলুম করা হবে না।

আয়াতটির তিনটি অর্থ হয়৷ এই তিনটি অর্থই তাদের নিজস্ব পরিসরে যথার্থ ও নির্ভুলঃ

এর একটি অর্থ হচ্ছে,

প্রথমে লোকেরা নিজেরাই যুদ্ধ করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিল৷ বারবার বলতোঃ আমাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে৷ নিপীড়ন নির্যাতন চালানো হচ্ছে৷ মারপিট করা হচ্ছে ৷ গালি গালাজ করা হচ্ছে৷ আমরা আর কতদিন সবর করবো? আমাদের মোকাবিলা করার অনুমতি দেয়া হোক৷ সে সময় তাদেরকে বলা হতো, সবর করো এবং নামায ও যাকাতের মাধ্যমে নিজেদের সংশোধন করতে থাকো৷ তখন এই সবর ও সহিঞ্চুতা অবলম্বন করার হুকুম পালন করা তাদের জন্য বড়ই কষ্টকর হতো৷ কিন্তু এখন লড়াই করার হুকুম দেবার পর সেই লড়াইয়ের দাবীদারদের একটি দল শত্রুদের সংখ্যা ও যুদ্ধের বিপদ দেখে আতংকিত হয়ে পড়েছিল ৷

আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আব্দুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তার কয়েকজন সাথী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা যখন মুশরিক ছিলাম তখন আমরা সম্মানিত ছিলাম। কিন্তু যখন ঈমান আনলাম তখন আমাদেরকে অসম্মানিত হতে হচ্ছে। একথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ ‘আমি ক্ষমা করতে নির্দেশিত হয়েছি, সুতরাং তোমরা যুদ্ধ করো না। তারপর যখন আল্লাহ তাকে মদীনায় হিজরত করালেন এবং যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হল তখন তাদের কেউ কেউ যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকল। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন। [নাসায়ী: ৩০৮৬; মুস্তাদরাকে হাকিমঃ ২/৬৭, ৩০৬]

দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, যতদিন নামায, রোযা এবং এই ধরনের নির্ঝনঝাট ও ঝুঁকিহীন কাজের হুকুম ছিল এবং যুদ্ধ করে প্রাণ দান করার প্রশ্ন সামনে আসেনি ততদিন এরা খাঁটি দীনদার ও ঈমানদার ছিল৷ কিন্তু এখন সত্যের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার কাজ শুরু হতেই এরা ভীত ও আতংকিত হয়ে পড়েছে৷

এর তৃতীয় অর্থটি হচ্ছে, প্রথমে তো লুটপাট করার ও নিজের স্বার্থোদ্ধারের লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য তাদের তরবারী সবসময় কোষমুক্ত থাকতো এবং রাতদিন যুদ্ধ-বিগ্রহই ছিল তাদের কাজ৷ সে সময় তাদেরকে রক্তপাত থেকে বিরত রাখার জন্য নামায ও যাকাতের মাধ্যমে নফসের সংশোধন করার হুকুম দেয়া হয়েছিল৷ আর এখন আল্লাহর জন্য তলোয়ার ওঠাবার হুকুম দেবার পর দেখা যাচ্ছে, যারা স্বার্থোদ্ধারের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সিংহ ছিল আল্লাহর জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তারা হয়ে গেছে বুজদিল কাপুরুষ৷ নফ্‌স ও শয়তানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে হাতে ইতিপূর্বে তরবারী ঝল্‌সে উঠেছিল, আল্লাহর পথে তরবারী চালাবার প্রশ্নে সে হাত নিস্তেজ হয়ে পড়েছে৷

সুদ্দী বলেন, তারা কিছুদিনের অবকাশ’ বলে মৃত্যু পর্যন্ত সময় চাচ্ছিল। অর্থাৎ তারা যেন বলছে যে, তাদের মৃত্যু হয়ে গেলে তারপর এ আয়াত নাযিল হওয়ার দরকার ছিল। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

এ তিনটি অর্থই বিভিন্ন ধরনের লোকদের আচরণের সাথে খাপ খেয়ে যায়৷ এখানে আয়াতের মধ্যে এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা একই সাথে এই তিনটি অর্থই প্রকাশ করতে সক্ষম৷

আয়াতে দুনিয়ার নেয়ামতের তুলনায় আখেরাতের নেয়ামতসমূহকে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার কয়েকটি কারণ রয়েছে:

ক) দুনিয়ার নেয়ামত অল্প এবং আখেরাতের নেয়ামত অধিক।

খ) দুনিয়ার নেয়ামত ক্ষণস্থায়ী এবং আখেরাতের নেয়ামত অনন্ত-অফুরন্ত।

গ) দুনিয়ার নেয়ামতসমূহের সাথে নানা রকম অস্থিরতাও রয়েছে, কিন্তু আখেরাতের নেয়ামত এ সমস্ত জঞ্জালমুক্ত।

ঘ) দুনিয়ার নেয়ামত লাভ অনিশ্চিত, কিন্তু আখেরাতের নেয়ামত প্রত্যেক মুত্তাকী ব্যক্তির জন্য একান্ত নিশ্চিত। [তাফসীরে কাবীর]

আল্লাহ তাআলা বলেন-

بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْحَیٰوةَ الدُّنْیَاؗ  وَ الْاٰخِرَةُ خَیْرٌ وَّ اَبْقٰی.

না, তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী। -সূরা আ‘লা (৮৭) : ১৬-১৭

یَعْلَمُوْنَ ظَاهِرًا مِّنَ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا  وَ هُمْ عَنِ الْاٰخِرَةِ هُمْ غٰفِلُوْنَ .

তারা দুনিয়ার বাহ্যিক দিক খুব ভাল জানে। কিন্তু আখেরাতের ব্যাপারে গাফেল। -সূরা রূম (৩০) : ৭

দুনিয়ার জীবন ধোকায় পূর্ণ সাময়িক ভোগ-বিলাসের বস্তু ছাড়া আর কিছুইনা।”

সুরা আলে-ইমরানঃ ১৮৫।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) একদিন উমার (রাঃ) এর ছেলে আব্দুল্লাহ (রাঃ) এর কাধের উপর হাত রেখে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন,

“তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস করো, যেনো তুমি এই দুনিয়াতে একজন মুসাফির বা পথিক। ”[সহীহ বুখারীঃ ৬৪১৬]

“তোমরা জেনে রাখ যে, দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া কৌতুক, শোভা-সৌন্দর্য, তোমাদের পারস্পরিক গর্ব-অহংকার এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে আধিক্যের প্রতিযোগিতা মাত্র। এর উপমা হলো বৃষ্টির মতো, যার উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে আনন্দ দেয়, তারপর তা শুকিয়ে যায়, তখন তুমি তা হলুদ বর্ণের দেখতে পাও, তারপর তা খড়-কুটায় পরিণত হয়। আর আখিরাতে আছে কঠিন আযাব এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর দুনিয়ার জীবনটা তো ধোঁকার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।” [সূরা আল-হাদীদ, আয়াত: ২০]

আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল বস্তু থেকে এবং দুর্বলতার পর তিনি শক্তি দান করেন। আর শক্তির পর তিনি আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান”। [সূরা আর-রূম, আয়াত: ৫৪]

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দৃষ্টান্ত ও উপমা দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে, দুনিয়ার জীবনের অবস্থা ও পরিণতি কী হবে এবং তাদের গন্তব্য কোথায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে আরও জানিয়ে দেন, দুনিয়ার জীবন কখনোই চিরস্থায়ী নয়, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, দুনিয়ার জীবন নিঃসন্দেহে শেষ ও ধ্বংস হয়ে যাবে এবং আখিরাতের জীবন চিরস্থায়ী যার শুরু আছে শেষ নাই। আখিরাতের জীবনে মানুষ অনন্ত অসীম কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং আখিরাতের অফুরন্ত, অসংখ্য, অগণিত ও চিরস্থায়ী নি‘আমতসমূহের প্রতি অগ্রসর হতে তাগিদ ও নির্দেশ দেন।

“আর আপনি তাদের জন্য পেশ করুন দুনিয়ার জীবনের উপমা: তা পানির মতো, যা আমি আসমান থেকে বর্ষণ করেছি। অতঃপর তার সাথে মিশ্রিত হয় জমিনের উদ্ভিদ। ফলে তা পরিণত হয় এমন শুকনো গুঁড়ায়, বাতাস যাকে উড়িয়ে নেয়। আর আল্লাহ সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান”। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ৪৫]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى

‘আর তুমি তোমার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করো না ঐ সবের প্রতি, যা আমরা তাদের বিভিন্ন শ্রেণীর লোককে ভোগ্য বস্ত্তরূপে দান করেছি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য স্বরূপ। যাতে আমরা এর মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করতে পারি। বস্ত্ততঃ তোমার প্রতিপালকের দেওয়া (আখেরাতের) রিযিক অধিক উত্তম ও অধিকতর স্থায়ী’ (ত্বোয়াহা ২০/১৩১)।

মুসতাওরিদ হ’তে বির্ণত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, দুনিয়ার জীবন দৃষ্টান্ত আখেরাতের জীবনের তুলনায় এমন, যেমন তোমাদের কেউ অকুল সমুদ্রে একটি আংগুল রাখল, তারপর তা তুলে ফেলল, তখন তার আংগুলের সাথে যতটুকু পানি উঠে আসে দুনিয়ার জীবনও আখেরাতের তুলনায় তার মত। সে যেন চিন্তা করে দেখে সমুদ্রের পানির তুলনায় তার আংগুলের সাথে উঠে আসা পানির পরিমাণ কতটুকু’।ইবনু মাজাহ হা/৪১০৮; হাকেম হা/৬৫১০, সনদ ছহীহ।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের গরীবী ও অভাব-অনটনের ভয় করি না, বরং ভয় করি পৃথিবীটা তোমাদের জন্য সম্প্রসারিত করা হবে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য যেভাবে করা হয়েছিল। তারপর তোমরা পৃথিবীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে যাবে, যেভাবে তারা অনুরক্ত হয়েছিল। ফলে পৃথিবী তোমাদেরকে বিনাশ করে দিবে, যেভাবে তাদেরকে বিনাশ করেছিল’।বুখারী হা/৩১৫৮; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬১।

কাতাদা ইবন নু‘মান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন তখন তিনি তাকে দুনিয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখেন যেমন তোমরা তোমাদের রোগীকে পানি থেকে বাঁচিয়ে রাখ’।তিরমিযী হা/২০৩৬; মিশকাত হা/৫২৫০; ছহীহুত তারগীব হা/৩১৮০।

দুনিয়ার মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ

দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বতের কারণে সমাজে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। মারামারি কাটাকাটি ইত্যাদির মুল কারণ, হলো দুনিয়ার মহব্বত। বর্তমান সমাজে আমরা দেখতে পাই ভাই ভাইয়ে সাথে, পিতা পুত্রের সাথে এবং পাড়া প্রতিবেশীর সাথে দুনিয়াকে কেন্দ্র করে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই আছে। অনেক সময় তা শুধু ঝগড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা হত্যা জেল-যুলুম ইত্যাদিতে রূপ নেয়। মোটকথা দুনিয়ার মহব্বত হলো সব গুনাহ পাপাচার ও অপরাধের মূল। নিম্নে এ বিষয়ের কিছু প্রতিক্রিয়া আলোচনা করা হলো। আশা করি আপনারা উপকৃত হবেন।

১. মানুষকে দুনিয়ার মধ্যে ডুবে থাকতে বাধ্য করা

দুনিয়ার মহব্বত মানুষকে গুনাহে লিপ্ত থাকতে বাধ্য করে। তারা দুনিয়া লাভ করার উদ্দেশ্যে হালাল হারাম ন্যায় অন্যায় কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করে না। যেখানেই দুনিয়া লাভ দেখে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। আব্দুল্লাহ ইবন হারেস ‌ইবন নওফল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদিন উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন,

»لا يزال الناس مختلفة أعناقهم في طلب الدنيا«

“মানুষ সব সময় দুনিয়ার অনুসন্ধানে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। সহীহ মুসলিম,  ২৮৯৫।

 

২. আখিরাতের নাম বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন করা

বর্তমান সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা দীন দ্বারা দুনিয়া কামাই করে। দীনকে দুনিয়ার সামান্য লাভের বিনিময় বিক্রি করে দেয়। দীনের নামে ইসলামের নামে বিভিন্ন ধরনের কু-কর্ম বিদ‘আত শির্ক করে দুনিয়া উপার্জন করছে। তারা দুনিয়ার সামান্য লাভের জন্য দীনকে নষ্ট করছে।

মুতাররফ রহ. বলেন: “দুনিয়ার প্রতি সর্বনিকৃষ্ট চাহিদা হলো, আখিরাতের নাম বিক্রি করে দুনিয়া অর্জন করা. বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩০।

ফুজাইল ইবন আয়াজ রহ. বলেন, “দীনের মাধ্যমে দুনিয়া উপার্জনের তুলনায় ডোল তবলা বাজিয়ে দুনিয়া উপার্জন করা আমার নিকট বেশি প্রিয় বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩১।

জুনাইদ রহ. বলেন, “আমি ছুররি রহ. কে যারা দীনের দ্বারা যে দুনিয়া কামাই করে তাদের দুর্নাম করতে শুনেছি। তিনি বলতেন, “অপবিত্র কাজ হলো, একজন বান্দা তার দীন দ্বারা তার জীবিকা উপার্জন করা”।

মালেক ইবন আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, “মালিকের উস্তাদ রবিয়া আর-রাঈ বলতেন, হে মালেক! হতভাগা কমবখত কে? উত্তরে তিনি বলেন, আমি বললাম, যে দীন দ্বারা জীবিকা উপার্জন করে। তারপর সে আবার জিজ্ঞাসা করল, কে তার চেয়ে আরও নিকৃষ্ট কমবখত? সে উত্তরে বলল, যে অন্যের দুনিয়াকে সুন্দর করে নিজের দীনকে বাদ দিয়ে। সে বললেন, আমার উত্তর শুনে আমার উস্তাদ খুব খুশি হলেন এবং আমাকে সাবাস দিলেন” বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩২।

আব্দুল্লাহ ইবন মুবারককে জিজ্ঞাসা করা হলো, প্রকৃত মানুষ কে? উত্তরে সে বলল, আলিমগণ। তারপর জিজ্ঞাসা করা হলো, বাদশাহ কারা? উত্তরে সে বলল, আবেদগণ। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কমবখত কারা? উত্তরে সে বলল, যারা দীনের দ্বারা দুনিয়া কামাই করে. বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান ৬৯৩৩।

৩. খাওয়া-দাওয়া পোশাক-আশাক ইত্যাদিতে সীমাতিরিক্ত অপচয় করা

মুয়াজ ইবন জাবাল থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে ইয়ামনের দিকে পাঠান, তখন তিনি তাকে উপদেশ দিয়ে বলেন,

«إيَّاكَ وَالتَّنَعُّمَ فَإنَ عِبَادَ اللهِ لَيْسُوا بالمتَنَعِّمِينَ»

“তোমরা ভোগ-বিলাস ও অপচয় করা হতে সতর্ক থাক। কারণ, মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের বান্দারা কখনোই ভোগ-বিলাস ও অপচয় করেন না. আহমদ, হাদীস নং ৬১৬০০।

৪. ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান ও ক্ষমতার লোভ:

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন,

﴿تِلۡكَ ٱلدَّارُ ٱلۡأٓخِرَةُ نَجۡعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوّٗا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَلَا فَسَادٗاۚ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِينَ ٨٣﴾ [القصص: 83]

“এই হচ্ছে আখিরাতের নিবাস, যা আমরা তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা জমিনে ঔদ্ধত্য দেখাতে চায় না এবং ফাসাদও চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য।” [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৩]

কা‘ব ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مَا ذِئْبَانِ جَائعَانِ أُرْسِلا فِي غَنم بأفْسَدَ لهَا مِنْ حِرْصِ المَرْءِ عَلَى المَالِ وَالَّشَرفِ لدِِينهِِ»

“দু’টি ক্ষুধার্ত বাঘকে কোনো ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া, ছাগলের পালের জন্য ততটা ক্ষতিকর নয়, যতটা ক্ষতিকর হয় একজন মানুষের দীনের জন্য, যখন তার মধ্যে ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান ও ক্ষমতার লোভ থাকে”তিরমিযী, হাদীস নং ২৩৭২। ইমাম তিরমিযি হাদীসটিকে সহীহ ও হাসান বলেন আখ্যায়িত করেন।

 দুনিয়ার মহব্বতের কারণসমূহ

সব কিছুর পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। কারণ, জানা থাকলে তা হাসিল করা কিংবা তা থেকে বিরত থাকা সহজ হয়। দুনিয়ার মহব্বতের অনেকগুলো কারণ আছে। আমরা এখানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি আলোচনা করব।

১. দুনিয়ার সৌন্দর্য ও বাহ্যিক চাকচিক্য

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন,

“সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা। আর স্থায়ী সৎকাজ তোমার রবের নিকট প্রতিদানে উত্তম এবং প্রত্যাশাতেও উত্তম।” [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ৪৬]

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দুনিয়া খুব সুন্দর, উপভোগ্য, সজ্জিত ও আনন্দদায়ক। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তোমাদের দুনিয়াতে তার প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তিনি দেখেন তোমরা কেমন আমল কর। তোমরা দুনিয়া বিষয়ে সতর্ক থাক, আর নারীদের বিষয়ে সতর্ক থাক। কারণ, বনী ইসরাঈলের মধ্যে সর্বপ্রথম ফিতনা সংঘটিত হয় নারীদের নিয়ে”. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৪২।

২. মানবাত্মা ও অন্তর দুনিয়ার দিকে অধিক ঝুঁকে পড়া

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন,

“মানুষের জন্য সুশোভিত করা হয়েছে প্রবৃত্তির ভালবাসা- নারী, সন্তানাদি, রাশি রাশি সোনা-রূপা, চি‎হ্নত ঘোড়া, গবাদি পশু ও শস্যক্ষেত। এগুলো দুনিয়ার জীবনের ভোগসামগ্রী। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম প্রত্যাবর্তনস্থল।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৪]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন,

«قَلْبُ الشَّيْخِ شَاٌّب عَلى حُبِّ اثْنَتَيْنِ، حُبِّ اْلعْيشِ وَالمَالِ»

“বৃদ্ধ মানুষের অন্তর দু’টি জিনিসের মহব্বতে যুবক। দুনিয়ার মহব্বত ও ধন-সম্পদের মহব্বত”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৪৬।

অপর এক বর্ণনায় বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“আদম সন্তান বুড়ো হয়, তবে তার দু’টি জিনিস জোয়ান হতে থাকে। এক. ধন-সম্পদের লোভ, দুই. দুনিয়ার জীবনের লোভ”।

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরও বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“যদি আদম সন্তানের ধন-সম্পদের দু’টি উপত্যকা থাকে, তখন সে আরও একটি উপত্যকা তালাশ করবে। আর আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া কোনো কিছু দ্বারাই পুরো করা যাবে না। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করবেন যাকে তিনি ক্ষমা করার ইচ্ছা করেন”।

“যদি আদম সন্তানের উপত্যকা থাকে, তখন সে আরও একটি স্বর্ণ-মুদ্রার উপত্যকা চাইবে। আর আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া কোনো কিছু দ্বারাই পুরো করা যাবে না। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ক্ষমা করবেন যাকে তিনি ক্ষমা করার ইচ্ছা করেন”।

৩. বর্তমানকে প্রাধান্য দেওয়া প্রতীক্ষিত ভবিষ্যতের ওপর

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿بَلۡ تُؤۡثِرُونَ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا ١٦ وَٱلۡأٓخِرَةُ خَيۡرٞ وَأَبۡقَىٰٓ ١٧﴾ [الأعلى: 17]

“বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ। অথচ আখিরাত সর্বোত্তম ও স্থায়ী।” [সূরা আল-আ‘লা, আয়াত: ১৭]

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, বরং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের নিকট প্রেরণ করেন তার রাসূলগণ, নাযিল করেন কিতাবসমূহ। তাদের নিকট আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বার্তা পাঠান এবং সুস্পষ্ট বর্ণনা করেন, কোনো কাজে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের সন্তুষ্টি আর কোনো কাজে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের অসন্তুষ্টি। মানুষ যদি তাদের প্রবৃত্তির পূজা ও মানবিক চাহিদা থেকে বের হয়ে, মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের হুকুমের আনুগত্য করে তবে আল্লাহ তাদের জান্নাতে চিরস্থায়ী নি‘আমতের প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরও অধিকাংশ জ্ঞানীদের জ্ঞান এ দুনিয়া খতম হওয়ার পর, নগদ, উপস্থিত ও চাক্ষুষের ওপর প্রতীক্ষার পরবর্তী ভবিষ্যৎকে প্রাধান্য দিতে রাজি হয় না। তারা বলে নগদ পন্য যা আমার কব্জায় রয়েছে, তা কীভাবে সুদীর্ঘ কালের জন্য বাকী বিক্রি করবো? যা পৃথিবীর ধ্বংস ও দুনিয়ার নিঃশেষ হওয়ার পর লাভ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ লোকের অবস্থা দেখে মনে হয়, তারা বলে, তুমি এখন যা দেখছ, তা গ্রহণ কর, আর যা শুনছ তা ছাড়। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকে তাওফিক দেয়, সেই আখিরাতের মূল্য বুঝতে পারে এবং ঈমানের শক্তি ও জ্ঞান দ্বারা আখিরাতের স্থায়িত্ব ও রহস্য সম্পর্কে জানতে পারে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যারা আনুগত্য করে তাদের জন্য যে সব নি‘আমত আর যারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নাফরমানী করে তাদের জন্য যেসব আযাব নির্ধারণ করেছেন তা তারা বুঝেন। তারা দুনিয়ার বাস্তবতা, পরিবর্তন, অল্প সময়ে নিঃশেষ হওয়া, দুনিয়ার গাদ্দারী ও অত্যাচার, অনাচার সবই দেখতে পান। তারা জানেন, দুনিয়া হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেমন বর্ণনা করেছেন, খেলাধুলা, ক্রীড়া, কৌতুক ও ধন-সম্পদ ও ছেলে সন্তান নিয়ে প্রতিযোগিতা। আর ধন-সম্পদ নিয়ে বাড়াবাড়ি ও অহংকার। আর দুনিয়া হলো, বৃষ্টির দ্বারা উৎপন্ন ফসলের মত যা একজন কৃষককে খুশি করে ও আনন্দ দেয়। অতঃপর তুমি দেখতে পাবে, উৎপাদিত ফসলগুলো শুকিয়ে হলুদ বর্ণের হয়ে গেছে। অথচ এসব ফসল একটু আগেও তরতাজা ও সবুজ বর্ণের ছিল। তারপর এ ফসলগুলো খড়-কুটো ও ধুলায় পরিণত হয়।

আমাদের ও ছেলে সন্তানদের সৃষ্টি এ জগতেই। ফলে আমরা এ ছাড়া কিছুই বুঝি না এবং এর বাইরে কোনো কিছু বুঝতে রাজি না। আমাদের অভ্যাস আমাদের বিচারক আর আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের বাদশাহ। আমাদের জ্ঞানের ওপর ইন্দ্রসমূহ ক্ষমতাশীল ও রাজা। নফসের চাহিদা ও দাবি অনুযায়ী চলে আমাদের জীবন।

মোটকথা, দুনিয়ার মহব্বত ও দুনিয়াকে আখিরাতের ওপর প্রাধান্য দেওয়া দুই কারণে হয়ে থাকে।

প্রথম কারণ: দীন ও ঈমান ধ্বংস হওয়া।

দ্বিতীয় কারণ: জ্ঞান-বুদ্ধি নষ্ট হওয়া।

দুনিয়ার মহব্বতের পরিণতি

দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বত থাকার কারণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। দুনিয়া মানুষের জন্য অনিবার্য ও জরুরি, কিন্তু তার অর্থ এ নয় যে, এ দুনিয়াই হবে একজন মানুষের শেষ প্রান্তর ও জীবনের সবকিছু। দুনিয়া হলো একজন মানুষের জন্য আখিরাতের ক্ষেত ও সেতুবন্ধন স্বরূপ। একজন মানুষের শেষ প্রান্তর ও গন্তব্য হলো, আখিরাতের জীবন ও মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন। দুনিয়াতে তার যাবতীয় কাজ ও আমল হবে তার আসল গন্তব্য ও শেষ ঠিকানার জন্য। দুনিয়া তার আসল গন্তব্য বা শেষ ঠিকানা নয়। এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের দুনিয়ার প্রতি অধিক মনোযোগী হতে বা ঝুঁকে পড়তে নিষেধ করেন এবং দুনিয়ার মোহে পড়ে আমরা যাতে ধোঁকায় না পড়ি এ জন্য তিনি আমাদের সতর্ক করেন। দুনিয়ার প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়াতে নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। তা চাই নগদে হোক অথবা পরবর্তীতে হোক। নিম্নে কয়েকটি ক্ষতি ও পরিণতির কথা আলোচনা করা হলো।

এক. দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের চাবিকাঠি

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “দুনিয়াতে আখিরাতের জন্য প্রস্তুতির চাবি হলো, আশাকে খাট করা বা অধিক আশা করা হতে বিরত থাকা। আর যাবতীয় সব কল্যাণের চাবি হলো, আখিরাতের আকাঙ্ক্ষা করা ও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি বেশি বেশি ধাবিত হওয়া। আর সমস্ত অনিষ্টের চাবি হলো, দুনিয়ার প্রতি অধিক মহব্বত ও লম্বা আশা।

দুই. দুনিয়ার মহব্বত মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের সাথে কুফুরী করা ও তার নাফরমানীর কারণ

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“মানুষ ঈমানদার অবস্থায় সকাল উদযাপন করে, আর বিকালে সে কাফির আবার ঈমানের অবস্থায় বিকাল অতিবাহিত করে কিন্তু সকালে সে ঈমান হারা হয়ে যায়। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের জন্য সে তার দীনকে বিক্রি করে দেয়”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৮।

যে ঈমান আনার পর আল্লাহর সাথে  কুফুরী করেছে এবং যারা তাদের অন্তর  কুফুরী দ্বারা উন্মুক্ত করেছে, তাদের ওপরই আল্লাহর ক্রোধ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা আযাব। ঐ ব্যক্তি ছাড়া যাকে বাধ্য করা হয় (কুফুরী করতে) অথচ তার অন্তর থাকে ঈমানে পরিতৃপ্ত। এটা এজন্য যে, তারা আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনকে পছন্দ করেছে। আর নিশ্চয় আল্লাহ কাফির কাওমকে হিদায়াত করেন না। এরাই তারা, যাদের অন্তরসমূহ, শ্রবণ সমূহ ও দৃষ্টিসমূহের ওপর আল্লাহ মোহর করে দিয়েছেন এবং তারাই হচ্ছে গাফেল। সন্দেহ নেই, তারাই আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত”। [সূরা নাহাল, আয়াত: ১০৬ -১০৯]

তিন. আখিরাতের শাস্তির পূর্বে দুনিয়াতেই শাস্তির সম্মুখীন হওয়া

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “দুনিয়ার মহব্বতকারী তার দুনিয়া দ্বারা সমস্ত মানুষের চেয়ে অধিক শাস্তি ভোগ করবে। সে তার জীবনের তিনটি স্তরে সর্বাধিক বেশি আযাবের সম্মুখীন হবে।

দুনিয়াতে তার শাস্তি হলো, ধন-সম্পদ অর্জন করার জন্য চেষ্টা করা ও এর জন্য দুনিয়াদারদের সাথে ঝগড়া-বিবাদ করা ইত্যাদির কষ্ট।

আর আলমে বরযখেও সে অধিক কষ্ট পাবে। সেখানে সে দুনিয়া হারানোর কষ্টে ও বেদনা অনুভব করবে এবং আফসোস করতে থাকবে। যখন সে বুঝতে পারবে যে, তার মধ্যে ও তার সম্পদের মাঝে চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদ ঘটেছে আর কখনোই তার সাথে এবং তার সম্পদের সাথে দেখা হবে না এবং দুনিয়ার বিনিময়ে এখানে আর কোনো বন্ধু সে পাবে না যা তার সমপর্যায়ের হবে, তখন তার কষ্টের আর অন্ত থাকবে না।

আর লোকটি কবরেও অনেক আযাবের অধিকারী হবে। ধন-সম্পদ হারানো চিন্তা, আফসোস, পেরেশানি তার আত্মায় এমনভাবে আঘাত করতে থাকবে যেমনটি সাপ, বিচ্ছু ও পোকা-মাকড় তার দেহে আঘাত করতে থাকে”।

“অতএব, তোমাকে যেন মুগ্ধ না করে তাদের ধন-সম্পদ এবং সন্তানাদি, আল্লাহ এর দ্বারা কেবল তাদের আযাব দিতে চান দুনিয়ার জীবনে এবং তাদের জান বের হবে কাফির অবস্থায়।” [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৫৫]

চার. অন্তর আখিরাতের প্রতি অমনোযোগী হওয়া ও নেক আমলে ত্রুটি করা

দুনিয়াদারদের অন্তর আখিরাত বিমুখ হয়ে থাকে। ফলে তারা কোনো নেক আমল করতে চায় না, তারা সব সময় তাদের লক্ষ্য দুনিয়া কামাই করাতে ব্যস্ত থাকে। তাদের সব ধরনের চেষ্টা, কষ্ট-ক্লেশ ও পরিশ্রম দুনিয়া কামাইর জন্যই ব্যয় হয়ে থাকে। ফলে তারা আখিরাত থেকে বঞ্চিত হয়।

আবু মুসা আশয়ারী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«مْن أَحبَّ دنْيَاهُ أَضَرَّ بِآخِرَتِهِ، وَمَن أََحبَّ آخِرَتَهُ أَضَر بدُِنْيَاهُ، فَآثرُِوا مَا يَبْقَى عَلى مَا يَفْنىَ»

“যে ব্যক্তি দুনিয়া লাভ করতে বেশি পছন্দ করে, সে তার আখিরাত লাভ করতে গিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, আর যে ব্যক্তি আখিরাতকে অর্জন করতে মহব্বত করে, তাকে অবশ্যই দুনিয়া অর্জন করতে লোকসান দিতে হবে। সুতরাং তোমরা যা চিরস্থায়ী তার অর্জনকে ক্ষণস্থায়ী বস্তুর অর্জনের ওপর প্রাধান্য দাও”।  শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বাণী-:

﴿قُتِلَ ٱلۡخَرَّٰصُونَ ١٠ ٱلَّذِينَ هُمۡ فِي غَمۡرَةٖ سَاهُونَ ١١﴾ [الذاريات: 10,11]

“মিথ্যাচারীরা ধ্বংস হোক! যারা সন্দেহ-সংশয়ে নিপতিত, উদাসীন”। [সুরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ১০, ১১]

“আর ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না, যার অন্তরকে আমরা আমাদের যিকির থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং যার কর্ম বিনষ্ট হয়েছে।” [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ২৮]

সহীহ বুখারী ও হাদীসের আরও অন্যান্য কিতাবে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“অর্থের গোলাম ধ্বংস হোক, ধ্বংস হোক সম্পদের গোলাম, ধ্বংস হোক পোশাকের গোলাম, ধ্বংস হোক জামা-‎কাপড়ের গোলাম। ধ্বংস হোক, ধ্বংসেই নিমজ্জিত থাকুক সে। যখন দুনিয়ার মুসীবতে পতিত হয়, তা যেন হটানো না ‎হয়। তাকে যখন দুনিয়া দেওয়া হয় তখন সে খুশি হয়, আর যখন তাকে দুনিয়া দেওয়া হয় না তখন সে অসন্তুষ্ট হয়”।

পাঁচ. অন্তরে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের মহব্বত সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধক হয় ও বিঘ্ন ঘটায়

ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “যখন অনেক বড় বড় ও শক্তিশালী উপাস্য (দিরহাম, দিনার, কু-প্রবৃত্তি ও নফস) যেগুলো অন্তরকে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের মহ্ববত ও তার ইবাদত থেকে বিরত রাখে তা অন্তরের ওপর কর্তৃত্ব করে, তখন সে অন্তরে কীভাবে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের মহব্বত থাকতে পারে। কারণ, এসবের মহব্বত অন্তরে থাকার দ্বারা মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের মহব্বত তার প্রতিবন্ধক হয়

ছয়. মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের যিকিরে অন্তর স্বাদ-আস্বাদন না করা

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “অন্তরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের যিকিরের জন্য। এ কারণেই সিরিয়ার পূর্বসূরি জ্ঞানীদের থেকে একজন জ্ঞানী (আমার জানা মতে তার নাম সুলাইমান আল খাওয়ায রহ.) তিনি বলেন, যিকির অন্তরের জন্য দেহের জন্য খাদ্যের মতো। দেহ যখন অসুস্থ হয়, তখন সে যেমন খাওয়ারের মজা পায় না অনুরূপভাবে যে অন্তরে দুনিয়ার মহব্বত থাকে সে অন্তর আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের যিকিরের মজা পায় না। মাজমুয়ুল ফাতওয়া ৯/৩১৬।

সাত. সর্বদা দুশ্চিন্তা অভাব অনটন ও মতবিরোধ

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

“যে ব্যক্তির জীবনে দুনিয়া অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ওপর বিশৃঙ্খলা চাপিয়ে দেন। আর দরিদ্রতা ও অভাব তার চোখের সামনে তুলে ধরেন। সে যতই চেষ্টা করুক না কেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার ভাগ্যে যতটুকু দুনিয়া লিপিবদ্ধ করেছেন তার বাহিরে সে দুনিয়া হাসিল করতে পারবে না। আর যে ব্যক্তির জীবনে আখিরাত অর্জন করাই তার বড় টার্গেট বা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার অন্তরকে অভাব মুক্ত করে দেন। তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার সম্পদকে সহজ করে দেন। আর দুনিয়া তার নিকট অপমান অপদস্থ হয়ে আসতে থাকে”। তিরমিযী, হাদীস নং ২৪৬৫। আল্লামা আলবানি হাদীসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।

আট. দুনিয়ার মহব্বত মানুষকে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের যিকির থেকে বিরত রাখে

নয়. একজন দুনিয়াদারের জন্য দুনিয়াই হলো, তার শেষ গন্তব্য

“যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবন ও তার জৌলুস কামনা করে, আমি সেখানে তাদেরকে তাদের আমলের ফল পুরোপুরি দিয়ে দিই এবং সেখানে তাদেরকে কম দেওয়া হবে না। এরাই তারা, আখিরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া আর কিছুই নেই এবং তারা সেখানে যা করে তা বরবাদ হয়ে যাবে আর তারা যা করত, তা সম্পূর্ণ বাতিল”। [সূরা হুদ, আয়াত: ১৫, ১৬] আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,

﴿مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ ٢٠﴾ [الشورى: 20]

“যে আখিরাতের ফসল কামনা করে, আমরা তার জন্য তার ফসলে প্রবৃদ্ধি দান করি, আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিই এবং আখিরাতে তার জন্য কোনো অংশই থাকবে না”। [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২০]

দশ: বান্দার আমল নষ্ট হয় এবং সাওয়াব ও বিনিময় থেকে বঞ্চিত হয়

গার. হঠকারিতা

দুনিয়ার মহব্বতের কারণে একজন মানুষের মধ্যে হঠকারীতা সৃষ্টি হয়। ফলে সে আর কাউকে মানতে চায়না এমনকি আল্লাহর আদেশ নিষেধও তার নিকট গুরুত্বহীন হয়ে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন,

﴿كَلَّآ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَيَطۡغَىٰٓ ٦ أَن رَّءَاهُ ٱسۡتَغۡنَىٰٓ ٧﴾ [العلق: 6-7]

“কখনো নয়, নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ”। [সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ৬-৭] আল্লামা ইবন কাসীর রহ. বলেন, “ইবন আবী হাতেম রহ. বলেন, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেন যায়েদ ইবন ইসমাইল তিনি বলেন, আমাকে হাদীস বর্ণনা করেন, জাফর ইবন আওন… আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

“দুই লোভী ব্যক্তি কখনো পরিতৃপ্তি লাভ করে না। এক হলো, জ্ঞানী-লোক দ্বিতীয় হলো, দুনিয়াদার। তারা উভয় কখনো সমান হয় না। জ্ঞানী লোক তার জ্ঞানের কারণে মহান আল্লাহ রাব্বুল  আলামীনের সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পায়। আর দুনিয়াদার তার দুনিয়ার কারণে হৎকারীতা ও সীমালঙ্ঘন বৃদ্ধি পায়।” তারপর আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু

كَلَّآ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَيَطۡغَىٰٓ ٦ أَن رَّءَاهُ ٱسۡتَغۡنَىٰٓ﴾ ﴿

“কখনো নয়, নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ”। আয়াত তিলাওয়াত করেন, কখনো নয়, নিশ্চয় মানুষ সীমালঙ্ঘন করে থাকে। কেননা সে নিজকে মনে করে স্বয়ংসম্পূর্ণ। [সূরা আল-‘আলাক, আয়াত: ৬-৭] আর অপর লোকের বিষয়ে বলেন, এ হাদীসটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে মারফু‘ সনদে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«منهومان لا يشبعان طالب علم وطالب دنيا»

“দুই লোভী তাদের লোভ কখনোই শেষ হয় না।

এক- ইলম পিপাসী, দুই- দুনিয়া লোভী”।

বার. দীন বিক্রি করে দুনিয়া ক্রয় করা

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«بَادِرُوا باِلأعْمَالِ فتَنًا كَقِطَعِ اللَّيْلِ المُظْلِمِ، يْصبحُِ الرَّجُل مُؤمًنا وَيُمْسِي كَافرًا، وَيمْسِي مُؤْمِناً وَيُصْبحُِ كَافرا، يَبيِعُ دِينَهُ بعَرَضٍ مِنَ الدُّنْيَا»

“অমবস্যার রাতের মতো অন্ধকার ফিতনা তোমাদের ঘ্রাস করার পূর্বে তোমরা নেক আমলসমূহ করার জন্য প্রতিযোগিতা কর। কারণ, তখন একজন লোক দিনের শুরুতে মুমিন থাকবে আর দিনের শেষে সে কাফির হয়ে যাবে। আর দিনের শেষে সে মুমিন থাকবে আবার দিনের শুরুতে সে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামান্য সম্পদের বিনিময় সে তার দীনকে বিক্রি করে দেবে”

তের. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে না জেনে কথা বলা এবং দীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার করা

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “মহা মূল্যবান বাণী: যে সব আহলে ইলমগণ, দুনিয়াকে আখিরাতের ওপর প্রাধান্য দেয় ও মহব্বত করে, সে অবশ্যই ফতওয়া বা কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সম্পর্কে না হক কথা বলবে। কারণ, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবজাতির জন্য যে বিধান নাযিল করেছেন তা অনেক সময় মানুষের মতের পরিপন্থী হয়ে থাকে। বিশেষ করে যারা দুনিয়াদার, নেতৃত্বের লোভী ও কু-প্রবৃত্তির পূঁজারী। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য কখনোই হকের বিরুদ্ধাচরণ বা বিরোধিতা করা ছাড়া হাসিল হয় না। যখন কোনো আলিম বা জ্ঞানী নেতৃত্ব-লোভী ও প্রবৃত্তির পূজারী হয়, তখন সে তার উদ্দেশ্যে সত্যের বিরোধিতা করা ছাড়া সফল হতে পারে না। বিশেষ করে যখন তার মধ্যে সন্দেহ, সংশয় তৈরি হয়, তখন তার সন্দেহ ও কু-প্রবৃত্তি তার নফসের চাহিদাকে আরও উসকিয়ে দেয়। তখন তার থেকে সত্য সুস্পষ্ট বা তার মধ্যে কোনো প্রকার আবরণ না থাকা স্বত্বেও আত্মগোপন করে এবং সত্যের বিরোধিতা করতে সে কোনো প্রকার কুণ্ঠাবোধ করে না। আর সে বলে আমার জন্য তাওবার পথ খোলা আছে, আমি মৃত্যুর আগে তাওবা করে নেব মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। এদের মত লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমে বলেন,

“তাদের পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কু-প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। তবে তারা নয় যারা তাওবা করেছে, ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে; তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি কোনো যুলুম করা হবে না।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৬-৬০]

চৌদ্দ. ভালো কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে বারণ করা ছেড়ে দেয় এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রাস্তায় জিহাদ করা ছেড়ে দেয়

“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কী হলো, যখন তোমাদের বলা হয়, আল্লাহর রাস্তায় (যুদ্ধে) বের হও, তখন তোমরা যমীনের প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়? তবে কি তোমরা আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে সন্তুষ্ট হলে? অথচ দুনিয়ার জীবনের ভোগ-সামগ্রী আখিরাতের তুলনায় একেবারেই নগণ্য”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৮]

দ্বীন ও দুনিয়ার মধ্যে ব্যালেন্স সবচেয়ে সুন্দরভাবে করেছিলেন সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম। তাঁদের জন্যও একাজটা খুব একটা সহজ ছিল না। মদীনাতে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর দারসে বসার জন্য সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম স্পেশাল রুটিন বানাতেন। দুজন সাহাবী মিলে ঠিক করে নিতেন, একজন সকালে দারসে বসবেন আর কাজ করবেন বিকেলে। আরেকজন সকালে কাজ করবেন আর বিকেলের দারসে থাকবেন। এভাবে যার যেটা মিস হবে অপর জনের কাছ থেকে তিনি সেটা জেনে নেবেন।

অধিকাংশ সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম তেমন একটা ধনী ছিলেন না। তবু দ্বীনের জন্য তাঁরা নিজেদের অফিস আওয়ার বদলে নিতেন। নিজেদের ডেইলি রুটিন পালটে ফেলতেন। যে সময়টুকু কাজ করলে উপার্জন বাড়ানো যেতো, নিজের পরিবারের স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং উঁচু করা যেতো, তাঁরা সেটা ব্যয় করতেন দ্বীনের জন্যে। এটা ছিল সাধারন রুটিন। যখন প্রয়োজন দেখা দিত তখন এটাও পালটে যেতো পুরোপুরি। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর পক্ষ থেকে কোন নির্দেশ আসলে অন্য সব কাজ ছেড়ে সেটাতেই মনোযোগী হতেন তাঁরা। রাসূলুল্লাহ যখন কোন জিহাদের অভিযানে বের হবার নির্দেশ দিতেন, তখন বাকি সবকিছুকে স্ট্যান্ডবাই রেখে বেরিয়ে পড়তেন সাহাবীগণ। রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ওয়া আজমাইন।

৪:৭৮ اَیۡنَ مَا تَکُوۡنُوۡا یُدۡرِکۡکُّمُ الۡمَوۡتُ وَ لَوۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ بُرُوۡجٍ مُّشَیَّدَۃٍ ؕ وَ اِنۡ تُصِبۡهُمۡ حَسَنَۃٌ یَّقُوۡلُوۡا هٰذِهٖ مِنۡ عِنۡدِ اللّٰهِ ۚ وَ اِنۡ تُصِبۡهُمۡ سَیِّئَۃٌ یَّقُوۡلُوۡا هٰذِهٖ مِنۡ عِنۡدِکَ ؕ قُلۡ کُلٌّ مِّنۡ عِنۡدِ اللّٰهِ ؕ فَمَالِ هٰۤؤُلَآءِ الۡقَوۡمِ لَا یَکَادُوۡنَ یَفۡقَهُوۡنَ حَدِیۡثًا

তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই, এমনকি সুউচ্চ সুদৃঢ় অবস্থান করলেও। যদি তাদের কোন কল্যাণ হয় তবে তারা বলে, “এটা আল্লাহর কাছ থেকে।” আর যদি তাদের কোন অকল্যাণ হয় তবে তারা বলে, “এটা আপনার কাছ থেকে। বলুন, সবকিছুই আল্লাহর কাছ থেকে। এ সম্প্রদায়ের কি হল যে, এরা একেবারেই কোন কথা বুঝে না!

৪:৭৯ مَاۤ اَصَابَکَ مِنۡ حَسَنَۃٍ فَمِنَ اللّٰهِ ۫ وَ مَاۤ اَصَابَکَ مِنۡ سَیِّئَۃٍ فَمِنۡ نَّفۡسِکَ ؕ وَ اَرۡسَلۡنٰکَ لِلنَّاسِ رَسُوۡلًا ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ شَهِیۡدًا

যাকিছু কল্যাণ আপনার হয় তা আল্লাহর কাছ থেকে এবং যাকিছু অকল্যাণ আপনার হয় তা আপনার নিজের কারণেএবং আপনাকে আমরা মানুষের জন্য রাসূলরূপে পাঠিয়েছি; আর সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট

এখান থেকে পুনরায় মুনাফিকদের আলোচনা শুরু হচ্ছে। পূর্ববর্তী উম্মতের অস্বীকারকারীদের মত এরাও বলল যে, কল্যাণ (সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ভাল ফলনের ফসলাদি এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য ইত্যাদি) আল্লাহর পক্ষ হতে এবং অকল্যাণ (অনাবৃষ্টি এবং ধন-সম্পদের হ্রাস ইত্যাদি) হে মুহাম্মাদ! এগুলো তোমার পক্ষ হতে। অর্থাৎ, তোমার দ্বীন অবলম্বন করার ফল স্বরূপ এ বিপদ এসেছে। যেমন মূসা (আঃ) এবং ফিরআউন ও তার লোক-জনদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন, ‘‘যখন তাদের কোন কল্যাণ হত, তখন তারা বলত, ‘এতো আমাদের প্রাপ্য।’ আর যখন কোন অকল্যাণ হত, তখন তা মূসা ও তার সঙ্গীদেরকে অশুভ কারণরূপে মনে করত।’’ (আ’রাফঃ ১৩১) (অর্থাৎ –নাঊযু বিল্লাহ– এ সব তাঁদের কুলক্ষণের কুফল মনে করে।)

অর্থাৎ, কল্যাণ-অকল্যাণ উভয়ই আল্লাহর পক্ষ হতে। কিন্তু এরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধির স্বল্পতা এবং মূর্খতা ও যুলুম-অত্যাচারের আধিক্যের কারণে তা বোঝে না।

আয়াতে বলা হয়েছে যে, সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। কিন্তু এর পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে যে, ভাল কাজ হলে তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর মন্দ কাজ হলে তা বান্দার পক্ষ থেকে।

এর কারণ হলো আল্লাহর ইচ্ছা দু’প্রকার,

(১) সৃষ্টিগত সাধারণ ইচ্ছা, যার সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকা বাধ্যতামূলক নয়।

(২) শরীআতগত বিশেষ ইচ্ছা, যার সাথে সন্তুষ্ট থাকা অবশ্য জরুরী।

আলোচ্য এ আয়াতে আল্লাহর সাধারণ ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টিতে আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কিছুই হয় না। কিন্তু খারাপ কিছুর ব্যাপারে আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকে না। তিনি শুধু ভাল কাজেই সন্তুষ্ট হন। খারাপ পরিণতি বান্দার কর্মকাণ্ডের ফল। বান্দা যখন খারাপ কাজ করে তখন আল্লাহ তা হতে দেন যদিও তাতে তিনি সন্তুষ্ট হন না। এর বিপরীতে বান্দা যখন ভাল কাজ করেন তখন আল্লাহ তা’আলা তা হতে দেয়ার পাশাপাশি তাতে সন্তুষ্টও হন। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে খারাপ পরিণতির দায়-দায়িত্ব কেবল বান্দার দিকেই সম্পর্কযুক্ত করা যাবে, আল্লাহ্‌র দিকে সম্পর্কযুক্ত করা জায়েয নেই। [মাজমু ফাতাওয়া ইবন তাইমিয়্যাহ]

আয়াতে ‘হাসানাহ’-এর দ্বারা নেয়ামতকে বোঝানো হয়েছে। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, মানুষ যে সমস্ত নেয়ামত লাভ করে তা তাদের প্রাপ্য নয়, বরং একান্ত আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহেই প্রাপ্ত হয়। মানুষ যত ইবাদাত-বন্দেগীই করুক না কেন, তাতে সে কোন নেয়ামত লাভের অধিকারী হতে পারে না। কারণ, ইবাদাত করার যে সামর্থ্য, তাও আল্লাহর পক্ষ থেকেই লাভ হয় তদুপরি আল্লাহ তা’আলার অসংখ্য নেয়ামত তো রয়েছেই। এ সমস্ত নেয়ামত সীমিত ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে কেমন করে সম্ভব? বিশেষ করে আমাদের ইবাদাত-বন্দেগী যদি আল্লাহ্ তা’আলার শান মোতাবেক না হয়? অতএব, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলার রহমত ব্যতীত কোন একটি লোকও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হল, আপনিও কি যেতে পারবেন না? তিনি বললেন, না আমিও না। [বুখারীঃ ৫৩৪৯, মুসলিমঃ ২৮১৬]

বিপদাপদ যদিও আল্লাহ তা’আলাই সৃষ্টি করেন, কিন্তু তার কারণ হয় মানুষের কৃত অসৎকর্ম। মানুষটি যদি কাফের হয়ে থাকে, তবে তার উপর আপতিত বিপদাপদ তার জন্য সে সমস্ত আযাবের একটা সামান্য নমুনা হয়ে থাকে যা আখেরাতে তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে। বস্তুতঃ আখেরাতের আযাব এর চাইতেও বহুগুণ বেশী। আর যদি লোকটি ঈমানদার হয়, তবে তার উপর আপতিত বিপদাপদ হয় তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত, যা আখেরাতে তার মুক্তির কারণ। অথবা তার জন্য পদমর্যাদা বৃদ্ধির সোপান। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন মুসলিমের উপর যে বিপদই আপতিত হোক না কেন, এর দ্বারা আল্লাহ তা’আলা তার গোনাহের কাফফারা করে দেন। এমনকি যে কাটাটি পায়ে ফোটে তাও। [বুখারীঃ ৫৩২৪, মুসলিমঃ ২৫৭২]

অন্যত্র বলেছেন, [وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ] ‘‘তোমাদের যেসব বিপদ-আপদ আপতিত হয়, তা তোমাদের কর্মেরই ফল এবং তিনি তোমাদের অনেক গুনাহ ক্ষমা করে দেন।’’ (শূরাঃ ৩০)

 

৪:৮০ مَنۡ یُّطِعِ الرَّسُوۡلَ فَقَدۡ اَطَاعَ اللّٰهَ ۚ وَ مَنۡ تَوَلّٰی فَمَاۤ اَرۡسَلۡنٰکَ عَلَیۡهِمۡ حَفِیۡظًا ﴿ؕ

৮০. কেউ রাসূলের আনুগত্য করলে সে তো আল্লাহরই আনুগত্য করল আর কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে আপনাকে তো আমরা তাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠাই নি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের সকল লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু যে অস্বীকার করেছে (সে জান্নাতবাসী হতে পারবে না)। জিজ্ঞাসা করা হলঃ কে অস্বীকার করেছে, হে রাসূল! উত্তরে বললেনঃ যে আমার অনুসরণ করল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অনুসরণ করল না, সে অস্বীকার করল। [বুখারীঃ ৭২৮০]

‘বল! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। আর তোমরা তাঁর আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে, রাসূলের কর্তব্য হচ্ছে শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া’ (নূর ২৪/৫৪)।

রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা এবং তাঁর অনুসরণে ছালাত প্রতিষ্ঠা করা ও যাকাত দেওয়ার মধ্যেই মানব জীবনে শান্তি ফিরে আসবে। মহান আল্লাহ বলেন, وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ- ‘তোমরা ছালাত ক্বায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হ’তে পার’ (নূর ২৪/৫৬)।

মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَلاَ تُبْطِلُوْا أَعْمَالَكُمْ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য কর, আর (তা না করে) তোমাদের আমল সমূহ বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ-  ‘আর এটাই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করো না। অন্যথা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে দিবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।

অপর বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে আমার আনুগত্য করল সে অবশ্যই আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্য হলো সে আল্লাহর অবাধ্য হল। অনুরূপভাবে যে ক্ষমতাসীনের আনুগত্য করল সে আমার আনুগত্য করল। আর যে ক্ষমতাসীনের অবাধ্য হলো সে আমার নাফরমানী করলো। ইমাম বা শাসক তো ঢালস্বরূপ, যার পিছনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করা যায় এবং যার দ্বারা বাঁচা যায়। যদি ইমাম বা শাসক আল্লাহর তাকওয়ার নির্দেশ দেন এবং ইনসাফ করেন তা হলে সেটা তার জন্য সওয়াবের কাজ হবে। আর যদি অন্য কিছু করেন তবে সেটা তার উপরই বর্তাবে। [বুখারীঃ ২৯৫৭, মুসলিমঃ ১৮৩৫]

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের অন্তর্গত ‘ঊলুল আমর’ তথা আদেশ দাতাগণের। অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে ম­তবিরোধ দেখা দেয়, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক। এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর সমাধান’ (নিসা ৪/৫৯)।

তারা নিজেরাই নিজেদের কাজের জন্য দায়ী৷ তাদের কাজের জন্য তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না৷ তোমাকে কেবল এতকুটু কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যে, তুমি আল্লাহর নির্দেশ ও বিধানসমূহ তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে৷ এ কাজটি তুমি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছো৷ এখন তাদের হাত ধরে জবরদস্তি সত্য-সরল পথে পরিচালিত করা তোমরা কাজ নয়৷ তোমর মাধ্যমে যে হিদায়াত পৌঁছানো হচ্ছে তারা যদি তার অনুসরণ না করে, তাহলে তার কোন দায়-দায়িত্ব তোমার ওপর থাকবে না৷ তারা কেন নাফরমানি করেছিল, এর জবাবদিহি করার জন্য তোমাকে পাকড়াও করা হবে না৷

‘আর সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং বিশ্বাসীগণের বিপরীত পথের অনুগামী হয়, তবে সে যাতে অভিনিবিষ্ট আমি তাকে তাতেই প্রত্যাবর্তিত করব ও তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব এবং এটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (নিসা ৪/১১৫)।

৪:৮১ وَ یَقُوۡلُوۡنَ طَاعَۃٌ ۫ فَاِذَا بَرَزُوۡا مِنۡ عِنۡدِکَ بَیَّتَ طَآئِفَۃٌ مِّنۡهُمۡ غَیۡرَ الَّذِیۡ تَقُوۡلُ ؕ وَ اللّٰهُ یَکۡتُبُ مَا یُبَیِّتُوۡنَ ۚ فَاَعۡرِضۡ عَنۡهُمۡ وَ تَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَکِیۡلًا ﴿

আর তারা বলে, ‘আনুগত্য করি’, তারপর যখন তারা আপনার কাছ থেকে চলে যায় তখন রাতে তাদের একদল যা বলে তার বিপরীত পরামর্শ করে। তারা যা রাতে পরামর্শ করে আল্লাহ তা লিপিবদ্ধ করে রাখেন। কাজেই আপনি তাদেরকে উপেক্ষা করুন এবং আল্লাহর প্রতি ভরসা করুন; আর কাজ উদ্ধারের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট

মুনাফিকরা যখন আপনার নিকট আসে, তখন বলে যে, আমরা আপনার নির্দেশ কবুল করে নিয়েছি। কিন্তু যখন তারা নাফরমানী করার উদ্দেশ্যে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বড় কষ্ট হয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেদায়াত দান করছেন যে, এসব বিষয়ে আপনি কোন পরোয়া করবেন না। আপনি আপনার যাবতীয় কাজ আল্লাহর উপর ভরসা করে চালিয়ে যেতে থাকুন। কারণ, আপনার জন্য তিনিই যথেষ্ট। এতে প্রতীয়মান হয় যে, যারা মানুষকে হেদায়াতের জন্য দাওয়াত দেবে তাদেরকে নানারকম জটিলতা অতিক্রম করতেই হবে। মানুষ তাদের প্রতি নানারকম উল্টা-সিধা অপবাদ আরোপ করবে। বন্ধুরূপী বহু শত্রুও থাকবে। এসব সত্বেও সে সংকল্প ও দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজের কাজে নিয়োজিত থাকা উচিত। যদি তার লক্ষ্য ও কর্মপন্থা সঠিক হয়, তবে ইনশাআল্লাহ তারা কৃতকার্য হবেই।

যারা আল্লাহ ও রাসূলের অনুসারী তথা কুরআন-হাদীছ মেনে চলবে না, ক্বিয়ামতের দিন তারা আফসোস করবে এবং তাদেরকে যারা বিভ্রান্ত করেছিল, সেসব অনুসৃত লোকদের দ্বিগুণ শাস্তি কামনা করবে। মহান আল্লাহর বাণী, يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُوْلُوْنَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُوْلاً، وَقَالُوْا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّوْنَا السَّبِيْلاً، رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا-  ‘যে দিন তাদের মুখমন্ডল অগ্নিতে উলটপালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম! তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন এবং তাদেরকে দিন মহা অভিশাপ’ (আহযাব ৩৩/৬৬-৬৮)।

মুমিনদের উক্তি তো এই, যখন তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেবার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলবে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম, আর তারাই সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হ’তে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১-৫২)।

কুরআন-সুন্নাহর অনুসারীদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে।

হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ غَرِيبًا فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءِ

‘ইসলাম শুরু হয়েছিল গুটিকতক লোকের মাধ্যমে, আবার সেই অবস্থা প্রাপ্ত হবে। অতএব সুসংবাদ সেই অল্প সংখ্যক লোকদের জন্য (যারা কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করে)। মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৯।

ইমামগণও মানুষকে কুরআন হাদীছ আকড়ে ধরার জন্য বলেছেন। যেমন ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন,

‘আমি যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসূল (ছাঃ)-এর কথার (সুন্নাহ) বিরোধী কোন কথা বলে থাকি, তাহ’লে আমার কথাকে ছুড়ে ফেলে দিও। মাজমূউর রাসায়েল আল-মুনীরিয়া, ১/২৫-২৬।

তিনি আরো বলেন, إذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।ইবনু আবেদীন, রদ্দুল মুহতার ১/১৬৭।

ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন,

السنة سفينة نوح من ركبها نجا، ومن تخلف عنها غرق،  ‘সুন্নাত হ’ল নূহ (আঃ)-এর নৌকা সদৃশ। যে তাতে আরোহণ করবে সে পরিত্রাণ পাবে। আর যে তা থেকে পিছে অবস্থান করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে’। মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়া, ৪/১৩৭।

তিনি আরো বলেন, আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি ভুল করি, আবার ঠিকও করি। অতএব আমার সিদ্ধান্তগুলো তোমরা যাচাই কর। যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে হবে সেগুলো গ্রহণ কর। আর যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর প্রতিকূলে হবে তা প্রত্যাখ্যান কর’। শাওকানী, আল-কওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিল ইজতেহাদি ওয়াত তাকলীদ, পৃঃ ১৬; ইবনু হাযম, আল-আহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬/৫৯-৬০, সনদ হাসান।

ইমাম শাফঈ (রহঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কথার উপর অন্য কারো কথা চলবে না, এর উপর সকল মানুষ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এরপর বলেন, আমার কথা যখন কোন ছহীহ হাদীছের বিরোধী হবে তখন আমার কথাকে দেয়ালে ছুড়ে ফেল এবং ছহীহ হাদীছের উপর আমল কর।

ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ৪/২৩৩; মাজমূউর রাসায়েল আল-মুনীরিয়া, ১/২৭।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, আশ্চর্য লাগে ঐ সকল সম্প্রদায়কে যারা ছহীহ হাদীছ ও (হাদীছের) ছহীহ সনদ জানার পরেও (মানুষকে) ছুফিয়ান ও অন্যান্য (ইমামদের) রায় গ্রহণ করার জন্য ডাকে এবং সে রায়ের দিকেই যেতে বলে। এরূপ করা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ। একাজের পরিণতি ভয়াবহ। ইবনুন নাজ্জার, শারহুল কাওকাবুল মুনীর ৪/৫৯০।

আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর কঠিন শাস্তি (নূর ২৪/৬৩)।

রাসূল (ছাঃ) মানুষের মুক্তির জন্য দু’টি জিনিস রেখে গেছেন। তিনি বলেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি; যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্ত্তকে মযবূতভাবে ধরে থাকবে, ততদিন (তোমরা) পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বস্ত্ত হ’ল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’। মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬, সনদ হাসান

৪:৮২ اَفَلَا یَتَدَبَّرُوۡنَ الۡقُرۡاٰنَ ؕ وَ لَوۡ کَانَ مِنۡ عِنۡدِ غَیۡرِ اللّٰهِ لَوَجَدُوۡا فِیۡهِ اخۡتِلَافًا کَثِیۡرًا

তবে কি তারা কুরআনকে গভীরভাবে অনুধাবন করে না? যদি তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট হতে আসত, তবে তারা এতে অনেক অসঙ্গতি পেত

মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকদের যে আচরণ সম্পর্কে ওপরের আয়াতগুলোতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে তার প্রধান ও আসল কারণ ছিল এই যে, কুরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হবার ব্যাপারে তাদের মনে সন্দেহ ছিল৷ তারা একথা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, সত্যি সত্যিই রসূলের ওপর অহী নাযিল হয় এবং এই যে হিদায়াতগুলো আসছে, এগুলো সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে আসছে৷ তাই তাদের মুনাফেকী আচরণের নিন্দা করার পর এখন বলা হচ্ছে, তারা কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনাই করে না৷ কেননা এই গ্রন্থ নিজেই সাক্ষী দিচ্ছে যে, এটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো বাণী হতেই পারে না৷ কোন মানুষের ক্ষমতা নেই বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ দিতে থাকবে এবং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত ভাষণ একটি সুসামঞ্জস্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও এক বর্ণের মোতির মালায় পরিণত হবে৷ এর কোন অংশ অন্য অংশের সাথে সংঘর্ষশীল হবে না৷ এর মধ্যে মত পরিবর্তনের কোথাও কোন নাম নিশানাও পাওয়া যাবে না৷ ভাষণদাতার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানসিক অবস্থার কোন প্রতিফলনও সেখানে দেখা যাবে না৷ এই ভাষণের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করার কোন প্রশ্নই কখনো উত্থাপিত হবে না৷ এই ধরনের ভাষণ দেয়া কোন মানুষের জন্য কোন কালেই সম্ভবপর নয়৷

পবিত্র কুরআনে কোন একটি বিষয়েও অসংগতি নেই। অতএব, এটা একান্তভাবেই আল্লাহর কালাম। মানুষের কালামে এমন অপূর্ব সামঞ্জস্য হতেই পারে না। এর কোথাও না আছে ভাষালঙ্কারের কোন ক্রটি, না আছে তাওহীদ, কুফর, কিংবা হালাল-হারামের বিবরণে কোন স্ববিরোধিতা ও পার্থক্য। তাছাড়া গায়েবী বিষয়সমূহের মাঝেও এমন কোন সংবাদ নেই, যা প্রকৃত বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তদুপরি না আছে কুরআনের ধারাবাহিকতার কোন পার্থক্য যে, একটি হবে অলঙ্কারপূর্ণ আরেকটি হবে অলঙ্কারহীন। প্রত্যেক মানুষের ভাষা-বিবৃতি ও রচনা-সংকলনে পরিবেশের কমবেশী প্রভাব অবশ্যই থাকে – আনন্দের সময় তা এক ধরণের হয়, আবার বিষাদে হয় অন্যরকম। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয় এক রকম, আবার অশান্তিপূর্ণ পরিবেশে হয় অন্য রকম। কিন্তু কুরআন এ ধরণের যাবতীয় ক্রটি, পার্থক্য ও স্ববিরোধিতা থেকে পবিত্র ও উর্ধ্বে। আর এটাই হলো কালামে-ইলাহী হওয়ার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

কুরআন থেকে হিদায়াত পাওয়ার জন্য এ ব্যাপারে চিন্তা ও গবেষণা করার তাকীদ করা হচ্ছে এবং এর (কুরআনের) সত্যতা জানার মানদন্ডও বলে দেওয়া হচ্ছে। যদি এটা কোন মানুষ রচিত গ্রন্থ হত (যা কাফেররা মনে করে), তাহলে তার বিষয়-বস্তুসমূহে এবং তাতে বর্ণিত ঘটনাদির মধ্যে বড়ই পরস্পর-বিরোধিতা দেখা যেত। কারণ,

প্রথমতঃ এটা কোন ক্ষুদ্র পুস্তিকা নয়, এটা এমন এক বিশাল ও বিস্তৃত গ্রন্থ; যার প্রতিটি অংশ চমৎকারিত্বে এবং সাহিত্য-শব্দালংকারে পরিপূর্ণ। অথচ মানুষের রচিত কোন বড় গ্রন্থে ভাষার মান এবং সাহিত্যময় চমৎকারিত্ব বজায় থাকে না।

দ্বিতীয়তঃ এতে অতীত জাতির এমন ঘটনাবলীও বর্ণিত হয়েছে, যা অদৃশ্য বিষয়ে মহাজ্ঞানী আল্লাহ ব্যতীত কেউ বর্ণনা করতে পারে না।

তৃতীয়তঃ এই ঘটনাবলীর মধ্যে না পারস্পরিক কোন বিরোধ আছে, আর না এ সবের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর কোন অংশ কুরআনের কোন মূল বিষয়ের পরিপন্থী। অথচ কোন মানুষ অতীত ঘটনাবলী বর্ণনা করলে, তার ধারাবাহিকতার শৃঙ্খল ছিন্ন হয়ে যায় এবং তার বিশদ বর্ণনার মধ্যে বড়ই স্ববিরোধিতা সৃষ্টি হয়। কুরআন কারীমের সমূহ এই মানবিক দোষ থেকে মুক্ত হওয়ার স্পষ্ট অর্থ এই যে, অবশ্যই এটা আল্লাহর কালাম, যা তিনি ফিরিশতার মাধ্যমে তাঁর শেষ নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করেছেন।

 

এটা হল কিছু দুর্বল ও দ্রুততাপ্রিয় মুসলিমের স্বভাব। তাদের সংশোধনের উদ্দেশ্যে আলোচ্য আয়াতের অবতারণা। الأمن শান্তির খবর বলতে মুসলিমদের সফলতা এবং শত্রু-ধ্বংসের ও পরাজয়ের খবরকে বুঝানো হয়েছে। (যা শুনে শান্তি ও স্বস্তির ঝড় বয়ে যায় এবং যার ফলে প্রয়োজনাতীত স্বনির্ভরশীলতার সৃষ্টি হয়; যা ক্ষতির কারণও হতে পারে) আর الخَوف ভয়ের সংবাদ বলতে মুসলিমদের পরাজয় এবং তাদের হত্যা ও ধ্বংসের খবরকে বুঝানো হয়েছে। (যাতে মুসলিমদের মাঝে দুঃখ, বেদনা ও আফসোস ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের মনোবল দমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।) তাই তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, এই ধরনের খবর শুনে; তাতে তা শান্তির (জয়ের) হোক অথবা ভয়ের (পরাজয়ের) হোক তা সাধারণের মাঝে প্রচার না করে রসূল (সাঃ)-এর নিকট পৌঁছে দাও কিংবা জ্ঞানী ও তত্ত্বানুসন্ধানীদের কাছে পৌঁছে দাও; যাতে তাঁরা দেখেন যে খবর সঠিক, না বেঠিক?

এ সময় সারা দেশে জরুরী অবস্থা বিরাজ করছিল৷ তাই চারদিকে নানান ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল৷ কখনো ভিত্তিহীন অতিরঞ্জিত আশংকার খবর এসে পৌঁছতো৷ এর ফলে হঠাৎ মদীনা ও তার আশেপাশে ভীতি চড়িয়ে পড়তো ৷ কখনো ধূর্ত শত্রু কোন যথার্থ বিপদকে গোপন করার জন্য সন্তোষজনক খবর পাঠাতো এবং তা শুনে সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্ত ও গাফেল হয়ে পড়তো৷ এই গুজব ছড়াবার ব্যাপারে নিছক হাংগামাবাজ লোকেরা বড়ই উৎসাহ বোধ করতো৷ তাদের কাছে ইসলাম ও জাহেলীয়াতের এই সংঘাত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না৷ এই ধরনের দায়িত্বহীন গুজব রটানোর পরিণতি কত সূদুর প্রসারী হতে পারে সে সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না৷ তাদের কানে কোন কথা পড়লেই হলো, তারা তাই নিয়ে জায়গায় ফুঁকে দিতে থাকতো৷ এই আয়াত এই ধরনের লোকদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে এবং তাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়ে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকার এবং কোন কিছু শুনলে তা সংগে সংগেই দায়িত্বশীলদের কানে পৌঁছিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ নীরবতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷

এ আয়াত দ্বারা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, কোন শ্রুত কথা যাচাই, অনুসন্ধান ব্যতিরেকে বর্ণনা করা উচিত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কোন লোকের পক্ষে মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোন রকম যাচাই না করেই সমস্ত শ্রুত কথা প্রচার করে। [মুসলিম: ৫] অপর এক হাদীসে তিনি বলেছেনঃ “যে লোক এমন কোন কথা বর্ণনা করে, যার ব্যাপারে সে জানে যে, সেটি মিথ্যা, তাহলে সে দু’জন মিথ্যাবাদীর একজন মিথ্যাবাদী।” [তিরমিযী: ২৬৬২ ইবন মাজাহ ৩৮; মুসনাদে আহমাদ ৪/২৫৫]

(২) আয়াতের দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও দলীলপ্রমাণের মাধ্যমে হুকুম-আহকাম উদ্ভাবনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তার কারণ, আয়াতে দু’রকম লোকের নিকট প্রত্যাবর্তন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের একজন হলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং অপরজন হচ্ছেন, ‘উলুল আমর’। অতঃপর বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী তাদেরকে জানাত, তবে তাদের মধ্যে যারা তথ্য অনুসন্ধান করে তারা সেটার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত’। আর এই নির্দেশটি অত্যন্ত ব্যাপক। রাসূল ও আলেম সমাজ এর আওতাভুক্ত।

(৩) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কুরআন তার একাংশ অপরাংশ দ্বারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য নাযিল হয়নি, বরং এর একাংশ অপরাংশের সত্যতা নিরূপন করে। সুতরাং তোমরা এর মধ্যে যা বুঝতে পার তার উপর আমল কর আর যা বুঝতে পারবে না সেটা যারা বুঝে তাদের হাতে ছেড়ে দাও। [ইবন মাজাহঃ ৮৫, মুসনাদে আহমাদ ২/১৮১]

এ আয়াতের প্রথম বাক্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “আপনি একাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ুন; কেউ আপনার সাথে থাক বা নাই থাক।” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বাক্যে এ কথাও বলা হয়েছে যে, অন্যান্য মুসলিমদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দানের কাজটিও পরিহার করবেন না। এভাবে উৎসাহদানের পরেও যদি তারা যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ না হয়, তবে আপনার দায়িত্ব পালিত হয়ে গেল; তাদের কর্মের জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে না। এতদসঙ্গে একা যুদ্ধ করতে গিয়ে যেসব বিপদাশংকা দেখা দিতে পারে, তার প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে- “আশা করা যায় আল্লাহ কাফেরদের যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং তাদেরকে ভীত ও পরাজিত করে দেবেন। আর আপনাকে একাই জয়ী করবেন” অতঃপর এই বিজয় প্রসঙ্গে প্রমাণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, আপনার প্রতি যখন আল্লাহ তা’আলার সমর্থন রয়েছে, যার সমর শক্তি কাফেরদের শক্তি অপেক্ষা অসংখ্যগুণ বেশী, তখন আপনার বিজয়ই অবশ্যম্ভাবী। তারপর এই সুদৃঢ় প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় শাস্তির কঠোরতা বর্ণনা করা হয়েছে। এ শাস্তি কিয়ামতের দিনেই হোক, কিংবা পার্থিব জীবনেই হোক, যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেমন আমার শক্তি অপরাজেয়, তেমনি শাস্তি দানের ক্ষেত্রেও আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।

(২) কিসে উদ্বুদ্ধ করা হবে, তা এ আয়াতে বলা হয় নি। অন্য আয়াতে এসেছে, আর আপনি মুমিনদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করুন। [সূরা আল-আনফাল: ৬৫]

 

এ আয়াতের প্রথম বাক্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, “আপনি একাই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ুন; কেউ আপনার সাথে থাক বা নাই থাক।” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বাক্যে এ কথাও বলা হয়েছে যে, অন্যান্য মুসলিমদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহ দানের কাজটিও পরিহার করবেন না। এভাবে উৎসাহদানের পরেও যদি তারা যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ না হয়, তবে আপনার দায়িত্ব পালিত হয়ে গেল; তাদের কর্মের জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে না। এতদসঙ্গে একা যুদ্ধ করতে গিয়ে যেসব বিপদাশংকা দেখা দিতে পারে, তার প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে- “আশা করা যায় আল্লাহ কাফেরদের যুদ্ধ বন্ধ করে দেবেন এবং তাদেরকে ভীত ও পরাজিত করে দেবেন। আর আপনাকে একাই জয়ী করবেন” অতঃপর এই বিজয় প্রসঙ্গে প্রমাণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, আপনার প্রতি যখন আল্লাহ তা’আলার সমর্থন রয়েছে, যার সমর শক্তি কাফেরদের শক্তি অপেক্ষা অসংখ্যগুণ বেশী, তখন আপনার বিজয়ই অবশ্যম্ভাবী। তারপর এই সুদৃঢ় প্রতিরোধ ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে স্বীয় শাস্তির কঠোরতা বর্ণনা করা হয়েছে। এ শাস্তি কিয়ামতের দিনেই হোক, কিংবা পার্থিব জীবনেই হোক, যুদ্ধের ক্ষেত্রে যেমন আমার শক্তি অপরাজেয়, তেমনি শাস্তি দানের ক্ষেত্রেও আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।

কিসে উদ্বুদ্ধ করা হবে, তা এ আয়াতে বলা হয় নি। অন্য আয়াতে এসেছে, আর আপনি মুমিনদেরকে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করুন। সূরা আল-আনফাল: ৬৫

৪:৮৫ مَنۡ یَّشۡفَعۡ شَفَاعَۃً حَسَنَۃً یَّکُنۡ لَّهٗ نَصِیۡبٌ مِّنۡهَا ۚ وَ مَنۡ یَّشۡفَعۡ شَفَاعَۃً سَیِّئَۃً یَّکُنۡ لَّهٗ کِفۡلٌ مِّنۡهَا ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ مُّقِیۡتًا

কেউ কোন ভাল কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে এবং কেউ কোন মন্দ কাজের সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর নজর রাখেন।

এ আয়াতে শাফা’আত অর্থাৎ সুপারিশকে ভাল ও মন্দ দু’ভাগে বিভক্ত করার পর এর স্বরূপ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক সুপারিশ যেমন মন্দ নয়, তেমনি প্রত্যেক সুপারিশ ভালোও নয়। আরো বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি ভালো সুপারিশ করবে, সে সওয়াবের অংশ পাবে এবং যে ব্যক্তি মন্দ সুপারিশ করবে, সে আযাবের অংশ পাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি কারো বৈধ অধিকার ও বৈধ কাজের জন্য বৈধ পন্থায় সুপারিশ করবে, সেও সওয়াবের অংশ পাবে।

তেমনিভাবে যে ব্যক্তি কোন অবৈধ কাজের জন্য অথবা অবৈধ পন্থায় সুপারিশ করবে, সে আযাবের অংশ পাবে। অংশ পাওয়ার অর্থ এই যে, যার কাছে সুপারিশ করা হয়, সে যখন এই উৎপীড়িতের কিংবা বঞ্চিতের কার্যোদ্ধার করে দেবে তখন কার্যোদ্ধারকারী ব্যক্তি যেমন সওয়াব পাবে, তেমনি সুপারিশকারীও সওয়াব পাবে। এমনিভাবে কোন অবৈধ কাজের সুপারিশকারীও গোনাহগার হবে। তবে সুপারিশকারীর সওয়াব কিংবা আযাব তার সুপারিশ কার্যকরী ও সফল হওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়; বরং সর্বাবস্থায় সে নিজ অংশ পাবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে ব্যক্তি কোন সৎকাজে অপরকে উদ্বুদ্ধ করে, সেও ততটুকু সওয়াব পায়, যতটুকু সৎকর্মী পায়।” [মুসলিমঃ ১৮৯৩]

এতে জানা গেল যে, সৎকাজে কাউকে উদ্ভুদ্ধ করা যেমন একটি সৎকাজ তেমনি অসৎ ও পাপ কাজে কাউকে উদ্ভুদ্ধ করা কিংবা সহযোগিতা প্রদান করা সমান গোনাহ। এ সবই হচ্ছে দুনিয়ার সুপারিশের বিষয়। আখেরাতের সুপারিশের আলোচনা অন্যত্র করা হয়েছে।

(২) আভিধানিক দিক দিয়ে مُقِيْتٌ শব্দের অর্থ তিনটিঃ

(১) শক্তিশালী, সংরক্ষক ও ক্ষমতাবান, (২) উপস্থিত ও দর্শক এবং (৩) রুযী বন্টনকারী। উল্লেখিত বাক্যে তিনটি অর্থই প্রযোজ্য।

প্রথম অর্থের দিক দিয়ে বাক্যের অর্থ হবে- আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। যে কাজ করে এবং যে সুপারিশ করে তাদেরকে প্রতিদান কিংবা শাস্তিদান তার পক্ষে কঠিন নয়।

দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে বাক্যের অর্থ হবে- আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক বস্তুর পরিদর্শক। কে কোন নিয়তে সুপারিশ করে; আল্লাহর ওয়াস্তে মুসলিম ভাইয়ের সাহায্যার্থে করে, না ঘুষ হিসেবে তার কাছ থেকে কোন মতলব হাসিলের উদ্দেশ্যে করে, তিনি সে সবই জানেন।

তৃতীয় অর্থের দিক দিয়ে বাক্যের মর্ম হবে রিযিক ও রুযী বন্টনের কাজে আল্লাহ স্বয়ং যিম্মাদার।

যার জন্য যতটুকু লিখে দিয়েছেন, সে ততটুকু অবশ্যই পাবে। কারো সুপারিশে তিনি প্রভাবিত হবেন না; বরং যাকে যতটুকু ইচ্ছা দেবেন। তবে সুপারিশকারী ব্যক্তি মাঝখান থেকে সওয়াব পেয়ে যাবে। কেননা, এটা হচ্ছে দুর্বলের সাহায্য।

হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘আল্লাহ তা’আলা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য অব্যাহত রাখেন, যতক্ষণ সে কোন মুসলিম ভাইয়ের সাহায্যে ব্যাপৃত থাকে। তোমরা সুপারিশ কর, সওয়াব পাবে। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় পয়গম্বরের মাধ্যমে যে ফয়সালা করেন তাতে সন্তুষ্ট থাক। [মুসলিমঃ ২৬২৭]

এ কারণেই কুরআনুল কারীমের ভাষায় ইঙ্গিত রয়েছে যে, সুপারিশের সওয়াব ও আযাব সুপারিশ সফল হওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সুপারিশ করলেই সর্বাবস্থায় সওয়াব অথবা আযাব হবে। আপনি ভাল সুপারিশ করলেই সওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবেন এবং মন্দ সুপারিশ করলেই আযাবের যোগ্য হয়ে পড়বেন -আপনার সুপারিশ কার্যকরী হোক বা না হোক। তবে অন্যের কাছে সুপারিশ করেই সুপারিশকারী যেন ক্ষান্ত হয়ে যায়, তা গ্রহণ করতে বাধ্য করবে না। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মুক্ত করা বাদী বারীরা দাসী অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার পর তার স্বামী মুগীছের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যান।

মুগীছ বারীরার ভালবাসায় পাগলপারা হয়ে পড়লে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুগীছকে গ্রহণ করার জন্য বারীরার কাছে সুপারিশ করেন। বারীরা বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এটি আপনার নির্দেশ হলে শিরোধার্য, পক্ষান্তরে সুপারিশ হলে আমার মন তাতে সম্মত নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ নির্দেশ নয়, সুপারিশই। বারীরা জানতেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নীতির বাইরে অসন্তুষ্ট হবেন না। তাই পরিস্কার ভাষায় বললেনঃ তাহলে আমি এ সুপারিশ গ্রহণ করবো না। [বুখারীঃ ৪৯৭৯]

৪:৮৬ وَ اِذَا حُیِّیۡتُمۡ بِتَحِیَّۃٍ فَحَیُّوۡا بِاَحۡسَنَ مِنۡهَاۤ اَوۡ رُدُّوۡهَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ حَسِیۡبًا

. আর তোমাদেরকে যখন অভিবাদন করা হয় তখন তোমরাও তার চেয়ে উত্তম প্রত্যাভিবাদন করবে অথবা সেটারই অনুরূপ করবে; নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর হিসেব গ্রহণকারী।

এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সালাম ও তার জবাবের আদব বর্ণনা করেছেন। মূলত: ‘আস-সালাম’ শব্দটি আল্লাহ্ তা’আলার উত্তম নামসমূহের অন্যতম। যার অর্থ শান্তি ও নিরাপত্তার আধার। বান্দা যখন এ কথা বলে তখন সে তার ভাইয়ের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও হেফাযত কামনা করে। সে হিসেবে আস-সালামু আলাইকুম এর অর্থ, আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের সংরক্ষক।

সালামের উৎপত্তি সম্পর্কে রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তা’আলা যখন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করেন তখন তার উচ্চতা ছিল ষাট হাত। আল্লাহ তা’আলা তাকে সৃষ্টি করে বললেন, যাও, ফেরেশতাদের অবস্থানরত দলকে সালাম করো এবং মন দিয়ে শুনবে, তারা তোমার সালামের কি জবাব দেয়।

এটাই হবে তোমার এবং তোমার সন্তানদের সালাম। সুতরাং আদম ‘আলাইহিস সালাম গিয়ে বললেনঃ আসসালামু আলাইকুম। ফেরেশতাগণ জবাব দিলেন- ওয়া আলাইকুমুসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। ফেরেশতাগণ ওয়া রাহমাতুল্লাহ বৃদ্ধি করলেন। তারপর যারা জন্নাতে যাবে তারা প্রত্যেকেই আদম ‘আলাইহিস সালাম-এর আকৃতি বিশিষ্ট হবে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের উচ্চতা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েই আসছে। [বুখারীঃ ৬২২৭]

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক লোক এসে বললেন, আসসালামু আলাইকুম, রাসূল তার সালামের জবাব দিলেন। তারপর লোকটি বসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ দশ। তারপর আরেকজন এসে বললঃ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালামের জবাব দিয়ে বললেনঃ বিশ। তারপর আরও একজন এসে বললেনঃ আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সালামের জবাব দিয়ে বললেনঃ ত্রিশ। [আবু দাউদঃ ৫১৯৫, তিরমিযীঃ ২৬৮৯]

এখানে এটা জানা আবশ্যক যে, ইসলামী অভিবাদন অন্যান্য জাতির অভিবাদন থেকে উত্তম। জগতের প্রত্যেক সভ্য জাতির মধ্যে পারস্পারিক দেখা-সাক্ষাতের সময় ভালবাসা ও সম্প্রীতি প্রকাশার্থে কোন কোন বাক্য আদান-প্রদান করার প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু তুলনা করলে দেখা যাবে যে, ইসলামী সালাম যতটুকু ব্যাপক অর্থবোধক, অন্য কোন জাতির অভিবাদন ততটুকু নয়। কেননা, এতে শুধু ভালবাসাই প্রকাশ করা হয় না, বরং সাথে সাথে ভালবাসার যথার্থ হকও আদায় করা হয়। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে দো’আ করা হয় যে, আল্লাহ আপনাকে সর্ববিধ বিপদাপদ থেকে নিরাপদে রাখুন। এতে এ বিষয়েরও অভিব্যক্তি রয়েছে যে, আমরা ও তোমরা- সবাই আল্লাহ তা’আলার মুখাপেক্ষী। তার অনুমতি ছাড়া আমরা একে অপরের উপকার করতে পারি না।

এ অর্থের দিক দিয়ে বাক্যটি একাধারে একটি ইবাদাত এবং মুসলিম ভাইকে আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়ার উপায়ও বটে। মোট কথা এই যে, ইসলামী সালামে বিরাট অর্থগত ব্যাপ্তি রয়েছে। যথা,

(১) এটি আল্লাহর একটি নাম। তাছাড়া এতে রয়েছে আল্লাহ তা’আলার যিকর,

(২) আল্লাহর কথা মনে করিয়ে দেয়া,

(৩) মুসলিম ভাইয়ের প্রতি ভালবাসা ও সম্প্রীতি প্রকাশ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা ঈমান না আনা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না পরস্পরকে ভালবাসবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের ঈমান পূর্ণ হবে না। আমি কি তোমাদেরকে একটা বিষয় শিক্ষা দিব, যা করলে তোমরা পরস্পরকে ভালবাসবে? তোমরা তোমাদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও।” [মুসলিমঃ ৫৪]

(৪) মুসলিম ভাইয়ের জন্য সর্বোত্তম দোআ এবং

(৫) মুসলিম ভাইয়ের সাথে এ চুক্তি যে, আমার হাত ও মুখ দ্বারা আপনার কোন কষ্ট হবে না। সহীহ হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ সে-ই প্রকৃত মুসলিম। [বুখারী ১৫: মুসলিম: ৪১]

অমুসলিমরা কেউ যদি মুসলিমদেরকে সালাম দেয় তবে তার উত্তরে ‘ওয়া আলাইকুম’ পর্যন্ত বলতে হবে। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। যদি সে ভালো উদ্দেশ্যে বলে থাকে, তবে ভালো পাবে, আর যদি খারাপ উদ্দেশ্যে বলে, তবে এটা তার জন্য বদ দোআর কাজ করবে।

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইয়াহুদীরা যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়, তখন তোমরা প্রত্তোত্তরে ‘ওয়া আলাইকুম’ বা তোমাদের উপরও অনুরূপ হোক এ কথাটি বলবে, কেননা তারা তোমাদের মৃত্যুর দো’আ করে থাকে। [বুখারী: ৬২৫৭; মুসলিম: ২১৬৪]

তাছাড়া সালাম যেহেতু মুসলিমদের একান্ত নিজস্ব ব্যাপার, সেহেতু অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য তা প্রয়োগ করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদেরকে সালাম দিও না; যদি তাদের কারো সাথে তোমাদের সাক্ষাৎ হয়, তবে তাকে সংকীর্ণ পথে চলে যেতে বাধ্য করবে। [মুসলিম: ২১৬৭]

প্রশ্নঃ অমুসলিমদের সালাম দেয়া যাবে কি ?

======================

উত্তরঃ কোন অমুসলিম যদি সালাম দেয় তাহ’লে তার উত্তরে শুধুমাত্র ‘ওয়া‘আলাইকা’ অথবা ‘ওয়া‘আলাইকুম’ বলতে হবে কিন্তু তাদের সালাম দেয়া যাবে না। (বুখারী ‘কিতাবুল ইসতিযান’ হা/৬২৫৭ , ‘কিতাবুল ইসতিতাবাতুল মুরতাদ্দীন’ হা/৬৯২৮ ; মুসলিম হা/২১৬৪ ; সহীহ আবু দাউদ হা/৫২০৬ ; সহীহ ইবনু মাজাহ হা/৩৬৯৭)।

 

হিন্দুদের বা কোন অমুসলিমকে ‘সালাম’ দেওয়া যাবে না। মুসলমান পরস্পরকে সালাম দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হ’তে তার উপরে শান্তি বর্ষণের দো‘আ করেন। হিন্দুগণ ঈমানদার নন বিধায় তাদেরকে ইসলামী তরীকায় সালাম দেওয়া যাবে না বা ইসলামী আক্বীদা বিরোধী কোন শব্দ, বাক্য বা ইঙ্গিত করা যাবে না। যেমন ‘নমষ্কার’ করা অর্থ ‘আমি আপনার প্রতি মাথা ঝুঁকালাম। আপনি কবুল করুন’।

‘নমস্কার’ শব্দটি এসেছে মূল সংস্কৃত শব্দ ‘নমঃ’থেকে যার আভিধানিক অর্থ সম্মানজ্ঞাপনপূরবক অবনত হওয়া। আদাবও বলা উচিত না কারন আদাব আরবি শব্দ। এটার অর্থ সালাম।

অনুরূপভাবে ‘নমস্তে’ বলা যাবে না। যার অর্থ ‘আমি আপনার প্রতি মাথা ঝুঁকালাম’। একইভাবে কারুপ্রতি সম্মানার্থে মাথা হেঁট করা কিংবা পিঠ ঝুঁকানো যাবে না’

(বিস্তারিত দ্র: যাদুল মা‘আদ ২/৩৮৮; মাজমূ‘আ ফাতাওয়া উছায়মীন ৩/৩৩;

আল-মওসূ‘আতুল ফিক্বহিইয়াহ ২৫/১৬৮ প্রভৃতি)।

অর্থাৎ মানুষ এবং ইসলামী অধিকার; যথা সালাম ও সালামের জবাব ইত্যাদি সবই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ্ তা’আলা এগুলোরও হিসাব নেবেন।

বিদায়ের সময় সালাম-মুসাফাহা করা কি সুন্নতের খেলাফ?

কোনো কোনে মানুষের ধারণা, বিদায়ের সময় সালাম-মুসাফাহা করা সুন্নতের খেলাফ। তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। হাদীস শরীফে বিদায়ের সময় সালাম-মুসাফাহা করার কথা প্রমাণিত আছে।

সাক্ষাতের সময় যেমন সালাম দেয়া সুন্নত, তেমনি বিদায়ের সময়ও সালাম দিয়ে বিদায় নেওয়া সুন্নত। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কেউ কোনো মজলিসে পৌঁছবে তখন সালাম দিবে। যদি বসতে চায় বসে পড়বে। এরপর যখন মজলিস ত্যাগ করবে তখনও সালাম দিবে। কারণ প্রথম সালাম দ্বিতীয় সালাম অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থাৎ উভয়টির গুরুত্ব সমান। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭০৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২০৮

আরেকটি বর্ণনায় এভাবে এসেছে, নবীজী একটি মজলিসে ছিলেন, এক ব্যক্তি পাশ দিয়ে অতিক্রমের সময় বলল,  আস সালামু আলাইকুম। নবীজী বললেন, দশ নেকি।… এক ব্যক্তি সালাম দেয়া ছাড়া উঠে গেল। তখন নবীজী বললেন, সে মনে হয় ভুলে গেছে। যখন তোমাদের কেউ কোনো মজলিসে পৌঁছবে তখন সালাম দিবে। যদি উক্ত মজলিসে বসতে চায় বসবে। এরপর যখন মজলিস থেকে উঠে যাবে (বিদায় নিবে) তখনও সালাম দিবে। কারণ প্রথম সালাম দ্বিতীয় সালাম অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ নয়। অর্থাৎ উভয়টির গুরুত্ব সমান। -আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৯৮৬

তেমনি বিদায়ের সময় মুসাফাহা করাও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কাযাআ রাহ. বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর নিকট ছিলাম। যখন সেখান থেকে ফিরে আসবো তখন তিনি আমাকে বললেন, থামো, আমি তোমাকে সেভাবে বিদায় দিবো যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বিদায় দিয়েছেন। তখন তিনি আমার হাত ধরে মুসাফাহা করলেন এরপর বললেন,

أَسْتَوْدِعُ اللهَ دَيْنَكَ، وَأَمَانَتَكَ، وَخَوَاتِيمَ عَمَلِكَ.

আসতাওদিউল্লাহা দ্বি-নাকা, ওয়া আমানাতাকা, ওয়া আখিরা আমালিকা।’

অর্থ : তোমার দ্বিন, ঈমান ও সর্বশেষ আমলের ব্যাপারে আমি আল্লাহ তাআলাকে আমানতদার নিযুক্ত করলাম।

-আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ী, হাদীস  ১০২৭০

আর নিম্নোক্ত হাদীসও প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাউকে বিদায় দিতেন তখন তার হাত ধরতেন। অতপর ঐ ব্যক্তি হাত টেনে না নেওয়া পর্যন্ত তিনি তার হাত ছাড়তেন না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৪২; ইমদাদুল ফাতাওয়া ৪/৪৯১

আসতাওদিউল্লাহা দ্বি-নাকা, ওয়া আমানাতাকা, ওয়া আখিরা আমালিকা।’

অর্থ : ‘তোমার দ্বিন, ঈমান ও সর্বশেষ আমলের ব্যাপারে আমি আল্লাহ তাআলাকে আমানতদার নিযুক্ত করলাম।

সুতরাং বিদায়ের সময় সালাম-মুসাফাহাকে সুন্নতের খেলাফ বলার কোনো অবকাশ নেই।

 

 

 

 

 

 

৪:৮৭ اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ لَیَجۡمَعَنَّکُمۡ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ لَا رَیۡبَ فِیۡهِ ؕ وَ مَنۡ اَصۡدَقُ مِنَ اللّٰهِ حَدِیۡثًا

আল্লাহ, তিনি ছাড়া অন্য কোন প্রকৃত ইলাহ নেই; অবশ্যই তিনি তোমাদেরকে কেয়ামতের দিন একত্র করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই(১) আর আল্লাহ্‌র চেয়ে বেশী সত্যবাদী কে?

(১) আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। তাকেই উপাস্য মনে কর এবং যে কাজই কর, তার ইবাদাতের নিয়তে কর। তিনি কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে একত্রিত করবেন। এতে কোন সন্দেহ নেই। ঐ দিন সবাইকে প্রতিদান দেবেন। কিয়ামতের ওয়াদা, প্রতিদান ও শাস্তির সওয়াব সব সত্য।

কেননা এ সংবাদ আল্লাহর দেয়া। আল্লাহর চাইতে কার কথা সত্য হতে পারে? তিনি নিজে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি আরও ঘোষণা করছেন যে, তিনি সবাইকে কিয়ামতের দিন একত্রিত করবেন। সুতরাং এ তাওহীদ ও আখেরাতের ব্যাপারে কারও মনে কোন প্রকার সন্দেহ থাকা উচিত হবে না।

তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহীমুল কুর’আন