সূরা আন নিসাঃ ১০ম রুকু(৭১-৭৬)আয়াত

১২। সূরা আন নিসাঃ ১০ম রুকু(৭১-৭৬)আয়াত

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

 

৪:৭১ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا خُذُوۡا حِذۡرَکُمۡ فَانۡفِرُوۡا ثُبَاتٍ اَوِ انۡفِرُوۡا جَمِیۡعًا

৭১. হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের সতর্কতা অবলম্বন কর; তারপর হয় দলে দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হও অথবা একসঙ্গে অগ্রসর হও।

উল্লেখ্য এ ভাষণটি এমন এক সময় নাযিল হয়েছিল যখন ওহোদ যুদ্ধের পরাজয়ের পর মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার গোত্রগুলোর সাহস বেড়ে গিয়েছিল এবং বিপদ আপদ চতুর্দিক থেকে মুসলমানদেরকে ঘিরে ফেলেছিল৷ সে সময় প্রায় প্রতিদিনই নানান ধরনের দুঃসংবাদ আসতো৷ উমুক গোত্র বিরূপ হয়ে গেছে৷ মুসলমানদের সাথে এক নাগাড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল৷ তাদের প্রচারকদেরকে দীন প্রচারের উদ্দেশ্যে দাওয়াত দিয়ে ধোঁকা দিয়ে হত্যা করা হতো৷ মদীনার বাইরে তাদের জানমালের কোন নিরাপত্তা ছিল না৷ এ অবস্থায় এসব বিপদের ঢেউয়ের আঘাতে যাতে ইসলামের তরী ডুবে না যায় সেজন্য মুসলমানদের পক্ষ থেকে একটি জোরদার প্রচেষ্টা ও জীবন উৎসর্গকারী সংগ্রাম পরিচালনার প্রয়োজন ছিল৷

আয়াতের প্রথমাংশে জিহাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং আয়াতের দ্বিতীয় অংশে জিহাদে অংশ গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বেশকিছু শিক্ষা রয়েছে –

(১) কোন ব্যাপারে বাহ্যিক উপকরণ অবলম্বন করা তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতার পরিপন্থী নয়। (

২) অস্ত্র সংগ্রহের নির্দেশ দেয়া হলেও এমন প্রতিশ্রুতি কিন্তু দেয়া হয়নি যে, এ অস্ত্রের কারণে তোমরা নিশ্চিতভাবেই নিরাপদ হতে পারবে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, বাহ্যিক উপকরণ অবলম্বন করাটা মূলতঃ মানসিক স্বস্তি লাভের জন্যই হয়ে থাকে।

(৩) এ আয়াতে প্রথমে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ অতঃপর জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সুশৃংখল নিয়ম বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যখন জিহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে, তখন একা একা বাহির হবেনা, বরং ছোট ছোট দলে বাহির হবে কিংবা (সম্মিলিত) বড় সৈন্যদল নিয়ে বাহির হবে। তার কারণ, একা একা যুদ্ধ করতে গেলে ক্ষতির আশংকা রয়েছে। শক্ররা এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মোটেই শৈথিল্য করে না।

৪:৭২ وَ اِنَّ مِنۡکُمۡ لَمَنۡ لَّیُبَطِّئَنَّ ۚ فَاِنۡ اَصَابَتۡکُمۡ مُّصِیۡبَۃٌ قَالَ قَدۡ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیَّ اِذۡ لَمۡ اَکُنۡ مَّعَهُمۡ شَهِیۡدًا

৭২. আর নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে, যে গড়িমসি করবেই। অতঃপর তোমাদের কোন মুসীবত হলে সে বলবে, তাদের সঙ্গে না থাকায় আল্লাহ্ আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন।

এখানে মুনাফিকদের কথা বলা হচ্ছে। ‘পিছনে থাকবেই’-এর অর্থ, জিহাদে না গিয়ে পিছনে থেকে যাবেই।

অথবা যুদ্ধে গেলেও পিছনের লাইনে থাকে,যেনো আঘাত না আসে।

এর এক অর্থ এও হতে পারে যে, নিজে তো গড়িমসি করেই এমন কি অন্যদেরকে ও হিম্মতহারা করে দেয়, তাদের বুকে ভয় ঢুকিয়ে দেয় এবং জিহাদ বন্ধ করার জন্য এমন ধরনের কথা বলতে থাকে যার ফলে তারা নিজেদের জায়গায় চুপচাপ বসে থাকে৷

৪:৭৩ وَ لَئِنۡ اَصَابَکُمۡ فَضۡلٌ مِّنَ اللّٰهِ لَیَقُوۡلَنَّ کَاَنۡ لَّمۡ تَکُنۡۢ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَهٗ مَوَدَّۃٌ یّٰلَیۡتَنِیۡ کُنۡتُ مَعَهُمۡ فَاَفُوۡزَ فَوۡزًا عَظِیۡمًا

৭৩. আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হলে, যেন তোমাদের ও তার মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই এমনভাবে বলবেই, ‘হায়! যদি তাদের সাথে থাকতাম তবে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম।

মুজাহিদ বলেন, এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে যাদেরকে বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে মুনাফিক। যারা সাহাবাদের সাথে মিশে থাকত। [আত-তাফসীরুস সহীহ] যুদ্ধের ঘোষণা শোনার সথে সাথেই তাদের মধ্যে গড়িমসি শুরু হত। এরপর যদি মুসলিমদের কোন বিপদ হতো, তখন তারা বলত যে, তাদের সাথে না থাকাটা আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ অবস্থায় তারা খুশীও প্রকাশ করত। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মঙ্গল হলে তা তাদেরকে কষ্ট দেয় আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা তাতে আনন্দিত হয়। [সূরা আলে-ইমরান: ১২০]

“আপনার মংগল হলে তা ওদেরকে কষ্ট দেয় এবং আপনার বিপদ ঘটলে ওরা বলে, ‘আমরা তো আগেই আমাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলাম এবং ওরা উৎফুল্ল চিত্তে সরে পড়ে।” [আত-তাওবাহ: ৫০] পক্ষান্তরে যখন মুসলিমদের কোন বিজয়ের কথা শুনত, তখন তারা বোল পাল্টিয়ে ফেলত যাতে করে যুদ্ধলন্দ সম্পদে ভাগ বসাতে পারে। যদিও মুসলিমদের বিজয় তাদের মনের জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। [আদওয়াউল বায়ান]

৪:৭৪ فَلۡیُقَاتِلۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ الَّذِیۡنَ یَشۡرُوۡنَ الۡحَیٰوۃَ الدُّنۡیَا بِالۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ مَنۡ یُّقَاتِلۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ فَیُقۡتَلۡ اَوۡ یَغۡلِبۡ فَسَوۡفَ نُؤۡتِیۡهِ اَجۡرًا عَظِیۡمًا

৭৪. কাজেই যারা আখেরাতের বিনিময়ে পার্থিব জীবন বিক্রয় করে তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করুক। আর কেউ আল্লাহর পথে যুদ্ধ করলে সে নিহত হোক বা বিজয়ী হোক আমরা তো তাকে মহাপুরস্কার প্রদান করব।

 

شَرَى يَشْرِي ক্রয়-বিক্রয় উভয় অর্থেই ব্যবহার হয়। যদি এর অর্থ করা হয় বিক্রয় করা, তাহলে فَلْيُقَاتِلْ ‘ফে’ল’ বা ক্রিয়াপদের ‘ফায়েল’ বা কর্তৃপদ হবে [الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ] আর যদি অর্থ করা হয় ক্রয় করা, তাহলে الَّذِيْنَ হবে মাফউল বা কর্মপদ এবং فَلْيُقَاتِلْ ক্রিয়ার কর্তৃপদ المُؤْمِنُ النَّافِر (জিহাদের পথে যাত্রাকারী মু’মিন) ঊহ্য থাকবে। মু’মিনের তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা উচিত, যারা পরকালের বিনিময়ে পার্থিব জীবনকে ক্রয় করে। অর্থাৎ, যারা দুনিয়ার সামান্য মালের বিনিময়ে দ্বীনকে বিক্রি করে দিয়েছে। এ থেকে মুনাফিক এবং কাফেরদেরকে বুঝানো হয়েছে। (ইবনে কাসীর এই অর্থই বর্ণনা করেছেন।)

অর্থাৎ আল্লাহর পথে লড়াই করা দুনিয়ার লাভ ও দুনিয়ার স্বার্থ পূজারী লোকদের কাজ নয়৷ এটা এমন এক ধরনের লোকের কাজ যারা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে এবং নিজেদের পার্থিব প্রাচুর্য ও সমৃদ্ধির সমস্ত সম্ভাবনা ও সব ধরনের পার্থিব স্বার্থ একমাত্র আল্লাহর জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত হয়ে যায়৷ তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়, তাদের রব যেন তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং এই দুনিয়ায় তাদের ত্যাগ কুরবানী বিফল হয়ে গেলেও আখেরাতেও যেন বিফল না যায়৷

উদাহরন—

সারিইয়া বি’রে মাঊনা(سرية بئر معونة) : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। নাজদের নেতা আবু বারা ‘আমের বিন মালেকের আমন্ত্রণক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদবাসীদের কুরআন পড়ানোর জন্য ও দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য মুনযির বিন ‘আমের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৭০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন। যাদের সকলে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ক্বারী ও বিজ্ঞ আলেম। যারা দিনের বেলায় কাঠ কুড়াতেন এবং রাত্রি জেগে নফল ছালাত আদায় করতেন। তাঁরা মাঊনা নামক কূয়ার নিকটে অবতরণ করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর পত্র নিয়ে হারাম বিন মিলহান গোত্রনেতা ‘আমের বিন তুফায়েল-এর নিকটে গমন করেন। কিন্তু সে পত্রের প্রতি দৃকপাত না করে একজনকে ইঙ্গিত দেয় তাকে হত্যা করার জন্য। ফলে হত্যাকারী তাকে পিছন দিক থেকে বর্শা বিদ্ধ করে। এ সময় রক্ত দেখে হারাম বিন মিলহান বলে ওঠেন,اللهُ أكْبَرُ، فُزْتُ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ ‘আল্লাহু আকবর! কা‘বার রবের কসম! আমি সফল হয়েছি’। অতঃপর ‘আমের বিন তুফায়েলের আবেদনক্রমে বনু সুলাইমের তিনটি গোত্র উছাইয়া, রে‘ল ও যাকওয়ান(عُصَيَّة، رِعْل، ذَكْوَان) চতুর্দিক হ’তে তাদের উপরে আক্রমণ চালায় এবং সবাইকে হত্যা করে। একমাত্র ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী রক্ষা পান মুযার গোত্রের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে। এতদ্ব্যতীত বনু নাজ্জারের কা‘ব বিন যায়েদ জীবিত ছিলেন। তাঁকে নিহতদের মধ্য থেকে যখমী অবস্থায় উঠিয়ে আনা হয়। পরে তিনি ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধের সময় একটি অজ্ঞাত তীরের আঘাতে শহীদ হন।

এসময় জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে খবর দিয়ে বললেন, প্রেরিত দলটি তাদের রবের সাথে মিলিত হয়েছে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করেছেন। এ ঘটনার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের বিরুদ্ধে ৪০ দিন অন্য বর্ণনায় এক মাস যাবত কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।

হারাম বিন মিলহানের মৃত্যুকালীন শেষ বাক্যটি হত্যাকারী জাববার বিন সালমা(عُصَيَّة، رِعْل، ذَكْوَان) এর অন্তরে এমনভাবে দাগ কাটে যে, পরে তিনি ইসলাম কবুল করেন’ (ইবনু হিশাম ২/১৮৬)।

৪:৭৫ وَ مَا لَکُمۡ لَا تُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ الۡمُسۡتَضۡعَفِیۡنَ مِنَ الرِّجَالِ وَ النِّسَآءِ وَ الۡوِلۡدَانِ الَّذِیۡنَ یَقُوۡلُوۡنَ رَبَّنَاۤ اَخۡرِجۡنَا مِنۡ هٰذِهِ الۡقَرۡیَۃِ الظَّالِمِ اَهۡلُهَا ۚ وَ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ وَلِیًّا ۚۙ وَّ اجۡعَلۡ لَّنَا مِنۡ لَّدُنۡکَ نَصِیۡرًا

৭৫. আর তোমাদের কি হল যে, তোমরা যুদ্ধ করবে না আল্লাহর পথে এবং অসহায় নরনারী এবং শিশুদের জন্য, যারা বলে, হে আমাদের রব! এ জনপদ-যার অধিবাসী যালিম, তা-থেকে আমাদেরকে বের করুন; আর আমাদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কাউকে অভিভাবক করুন এবং আপনার পক্ষ থেকে কাউকে আমাদের সহায় করুন।

মক্কা নগরীতে এমন কিছু দুর্বল মুসলিম রয়ে গিয়েছিলেন, যারা দৈহিক দুর্বলতা এবং আর্থিক দৈন্যের কারণে হিজরত করতে পারছিলেন না। পরে কাফেররাও তাদেরকে হিজরত করতে বাধাদান করেছিল এবং বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে আরম্ভ করেছিল, যাতে তারা ইসলাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। যেমন ইবন আব্বাস ও তার মাতা, সালামা ইবন হিশাম, ওলীদ ইবন ওলীদ, আবু জান্দাল ইবন সাহল প্রমূখ। এসব সাহাবী নিজেদের ঈমানী বলিষ্ঠতার দরুন কাফেরদের অসহনীয় উৎপীড়ন সহ্য করেও ঈমানের উপর স্থির থাকেন। অবশ্য তারা এসব অত্যাচার উৎপীড়ন থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য বরাবরই আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দো’আ করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা তাদের সে প্রার্থনা মঞ্জুর করে নেন এবং মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেন যাতে তারা জিহাদের মাধ্যমে সেই নিপীড়িতদেরকে কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আমি ও আমার মা অসহায়দের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। [বুখারী ৪৫৮৭]

এ আয়াতে মুমিনরা আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে দুটি বিষয়ে দোআ করেছিলেন।

একটি হলো এই যে, আমাদিগকে এই (মক্কা) নগরী থেকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করুন এবং

দ্বিতীয়টি হলো, আমাদের জন্য কোন সহায় বা সাহায্যকারী পাঠান।

আল্লাহ তাদের দুটি প্রার্থনাই কবুল করে নিয়েছিলেন। তা এভাবে যে, কিছু লোককে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, যাতে তাদের প্রথম প্রার্থনাটি পূরণ হয়েছিল। অবশ্য কোন কোন লোক সেখানেই রয়ে যান এবং বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আত্তাব ইবন উসায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে সেসব লোকের মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। অতঃপর তিনি এসব উৎপীড়িতদেরকে অত্যাচারীদের উৎপীড়ন-অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন। আর এভাবেই পূর্ণ হয় তাদের দ্বিতীয় প্রার্থনাটি। আয়াতে বলা হয়েছে যে, জিহাদের নির্দেশ দানের পিছনে একটি কারণ ছিল সে সমস্ত অসহায় দুর্বল নারী-পুরুষের প্রার্থনা। মুসলিমগণকে জিহাদ করার নির্দেশ দানের মাধ্যমে সে প্রার্থনা মঞ্জুরীর কথাই ঘোষণা করা হয়েছে।

অলী শব্দের বহুবচন হলো আউলিয়া। যার আভিধানিক অর্থ হল, নিকটবর্তী। এর পরিপ্রেক্ষিতে আওলিয়াউল্লাহর অর্থ হবে, ঐ সকল নেক ও খাঁটি মু’মিন ব্যক্তিগণ, যাঁরা আল্লাহর আনুগত্য করে এবং তাঁর অবাধ্যতা থেকে দূরে থেকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। এই জন্য সূরা ইউনুসের ২টি আয়াতে আল্লাহ তাআলা নিজেই  তাঁদের প্রশংসা করেছেন, ‘‘তারা হচ্ছে সেই লোক যারা বিশ্বাস করেছে (ঈমান এনেছে) এবং সাবধানতা (পরহেযগারি) অবলম্বন করে থাকে।’’ আর ঈমান ও পরহেযগারি বা তাকওয়াই হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মূল ভিত্তি এবং একমাত্র উপায়। এই হিসাবে সকল মুত্তাকী মু’মিনই হচ্ছে আল্লাহর ওলী (বন্ধু)

ইরশাদ হয়েছে–

اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰهِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ

﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ

জেনে রাখা আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।” [সূরা ইউনুসঃ ৬২–৬৩]

যদি আল্লাহর অলী বলতে ঈমানদার ও মুত্তাকীদের বুঝায় তাহলে বান্দার ঈমান ও তাকওয়া অনুসারে আল্লাহর কাছে তার বেলায়াত তথা বন্ধুত্ব নির্ধারিত হবে। সুতরাং যার ঈমান ও তাকওয়া সবচেয়ে বেশী পূর্ণ, তার বেলায়াত তথা আল্লাহর বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশী হবে। ফলে মানুষের মধ্যে তাদের ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে আল্লাহর বেলায়াতের মধ্যেও তারতম্য হবে।

আল্লাহর অলীদের সম্পর্কে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ

১. আল্লাহর নবীরা তার সর্বশ্রেষ্ঠ অলী হিসাবে স্বীকৃত। নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন তার রাসূলগণ। রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাসূলগণ তথা নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর সমস্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাসূলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেনঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।

২.  আল্লাহর অলীগণ দুশ্রেণীতে বিভক্তঃ প্রথম শ্রেণীঃ যারা অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্ত। দ্বিতীয় শ্রেণীঃ যারা ডান ও মধ্যম পন্থী। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তাদের উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ “যখন যা ঘটা অবশ্যম্ভাবী (কিয়ামত) তা ঘটবে, তখন তার সংঘটনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কেউ থাকবে না। তা কাউকে নীচ করবে, কাউকে সমুন্নত করবে। যখন প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে যমীন। পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়বে। ফলে তা উৎক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পর্যবসিত হবে। এবং তোমরা বিভক্ত হয়ে পড়বে তিন শ্রেনীতে- ডান দিকের দল; ডান দিকের দলের কি মর্যাদা! আর বাম দিকের দল; বাম দিকের দলের কি অসম্মান। আর অগ্রবর্তীগণই তো অগ্রবর্তী। তারাই নৈকট্যপ্রাপ্ত- নেয়ামত পূর্ণ জান্নাতে। [সূরা আল-ওয়াকি’আহঃ ১–১২]

দু’দল জান্নাতের, তারা হলেনঃ ডানদিকের দল এবং অগ্রবর্তী ও নৈকট্যপ্রাপ্তগণ। তাদেরকে আবার এ সূরা আল ওয়াকি’আরই শেষে আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করে বলেছেন, “তারপর যদি সে নৈকট্যপ্রাপ্তদের একজন হয় তবে তার জন্য রয়েছে আরাম, উত্তম জীবনোপকরণ ও নেয়ামত পূর্ণ জান্নাত। আর যদি সে ডান দিকের একজন হয় তবে তোমার জন্য সালাম ও শান্তি; কারণ সে ডানপন্থীদের মধ্যে”। [সূরা আল-ওয়াকি’আহঃ ৮৮–৯১]

অনুরূপভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অলীদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিখ্যাত হাদীসে বলেনঃ “মহান আল্লাহ বলেনঃ যে ব্যক্তি আমার কোন অলীর সাথে শক্রতা পোষণ করে আমি তার সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দিলাম। আমার বান্দার উপর যা আমি ফরয করেছি তা ছাড়া আমার কাছে অন্য কোন প্রিয় বস্তু নেই যার মাধ্যমে সে আমার নৈকট্য লাভ করতে পারে। আমার বান্দা আমার কাছে নফল কাজসমূহ দ্বারা নৈকট্য অর্জন করতেই থাকে, শেষ পর্যন্ত আমি তাকে ভালবাসি। তারপর যখন আমি তাকে ভালবাসি তখন আমি তার শ্রবণশক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে শুনে, তার দৃষ্টি শক্তি হয়ে যাই যার দ্বারা সে দেখে, তার হাত হয়ে যাই যার দ্বারা সে ধারণ করে আর তার পা হয়ে যাই যার দ্বারা সে চলে। তখন আমার কাছে কিছু চাইলে আমি তাকে তা অবশ্যই দেব, আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে অবশ্যই উদ্ধার করব।” [বুখারী: ৬৫০২]

এর মর্ম হলো এই যে, তার কোন গতি-স্থিতি ও অন্য যে কোন কাজ আলাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে হয় না। বস্তুতঃ এই বিশেষ ওলীত্ব বা নৈকট্যের স্তর অগণিত ও অশেষ। এর সর্বোচ্চ স্তর নবী-রাসূলগণের প্রাপ্য। কারণ, প্রত্যেক নবীরই ওলী হওয়া অপরিহার্য। আর এর সর্বোচ্চ স্তর হলো সাইয়্যেদুল আম্বীয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর। এর পর প্রত্যেক ঈমানদার তার ঈমানের শক্তি ও স্তরের বৃদ্ধি-ঘাটতি অনুসারে বেলায়েতের অধিকারী হবে। সুতরাং নেককার লোকেরা হলোঃ ডান দিকের দল, যারা আল্লাহর কাছে ফরয আদায়ের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ করে। তারা আল্লাহ তাদের উপর যা ফরয করেছেন তা আদায় করে, আর যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করে। তারা নফল কাজে রত হয় না। কিন্তু যারা অগ্রবর্তী নৈকট্যপ্রাপ্ত দল তারা আল্লাহর কাছে ফরয আদায়ের পর নফলের মাধ্যমে নৈকট্য লাভে রত হয়।

৩. এখানে আরও একটি বিষয় জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর অলীগণ অন্যান্য মানুষদের থেকে প্রকাশ্যে কোন পোষাক বা বেশ-ভূষা দ্বারা বিশেষভাবে পরিচিত হন না। বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের মধ্যে প্রকাশ্য বিদ’আতকারী ও অন্যায়কারী ছাড়া সর্বস্তরে আল্লাহর অলীগণের অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাদের অস্তিত্ব রয়েছে কুরআনের ধারক-বাহকদের মাঝে, জ্ঞানী-আলেমদের মাঝে, জিহাদকারী ও তরবারী-ধারকদের মাঝে, ব্যবসায়ী, কারিগর ও কৃষকের মাঝে।

৪. আল্লাহর অলীগণের মধ্যে নবী-রাসূলগণ ছাড়া আর কেউ নিষ্পাপ নন, তাছাড়া কোন অলীই গায়েব জানেনা, সৃষ্টি বা রিযক প্রদানে তাদের কোন প্রভাবও নেই। তারা নিজেদেরকে সম্মান করতে অথবা কোন ধন-সম্পদ তাদের উদ্দেশ্যে ব্যয় করতে মানুষদেরকে আহবান করেন না। যদি কেউ এমন কিছু করে তাহলে সে আল্লাহর অলী হতে পারে না, বরং মিথ্যাবাদী, অপবাদ আরোপকারী, শয়তানের আলী হিসাবে বিবেচিত হবে।

৫. আল্লাহর অলী হওয়ার জন্য একটিই উপায় রয়েছে, আর তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রঙে রঞ্জিত হওয়া, তার সুন্নাতের হুবহু অনুসরণ করা। যারা এ ধরনের অনুসরণ করতে পেরেছেন তাদের মর্যাদাই আলাদা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “আল্লাহর এমন কিছু বান্দা রয়েছে যাদেরকে শহীদরাও ঈর্ষা করবে। বলা হলোঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? হয়ত তাদের আমরা ভালবাসবো। রাসূল বললেনঃ “তারা কোন সম্পদ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক ব্যতীতই একে অপরকে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবেসেছে। নূরের মিম্বরের উপর তাদের চেহারা হবে নূরের। মানুষ যখন ভীত হয় তখন তারা ভীত হয় না। মানুষ যখন পেরেশান ও অস্থির হয় তখন তারা অস্থির হয় না।” তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করলেন। [ইবনে হিব্বানঃ ৫৭৩, আবু দাউদঃ ৩৫২৭]

অন্য বর্ণনায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “বিভিন্ন দিক থেকে মানুষ আসবে এবং বিভিন্ন গোত্র থেকে মানুষ এসে জড়ো হবে, যাদের মাঝে কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকবে না। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একে অপরকে ভালবেসেছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যুদ্ধে স্থাপন করবেন, তারপর তাদেরকে সেগুলোতে বসাবেন। তাদের বৈশিষ্ট হলো মানুষ যখন ভীত হয় তখন তারা ভীত হয় না, মানুষ যখন পেরেশান হয় তখন তারা পেরেশান হয় না। তারা আল্লাহর অলী, তাদের কোন ভয় ও পেরেশানী কিছুই থাকবে না। [মুসনাদে আহমাদ ৫/৩৪৩]।

[উসুলুল ঈমান ফী দাওয়িল কিতাবি ওয়াস সুন্নাহ, বাদশাহ ফাহাদ কুরআন প্রিন্টিং প্রেস থেকে মুদ্রিত, পৃ. ২৮২–২৮৬ (বাংলা সংস্করণ)]

অলি দুই প্রকার

১ / আল্লাহর অলি

২ / শয়তানের অলি

৪:৭৬ اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۚ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ الطَّاغُوۡتِ فَقَاتِلُوۡۤا اَوۡلِیَآءَ الشَّیۡطٰنِ ۚ اِنَّ کَیۡدَ الشَّیۡطٰنِ کَانَ ضَعِیۡفًا

৭৬. যারা মুমিন তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, আর যারা কাফের তারা তাগূতের পথে যুদ্ধ করে। কাজেই তোমরা শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; শয়তানের কৌশল অবশ্যই দুর্বল।

আয়াতে বলা হয়েছে যে, যারা মুমিন বা ঈমানদার তারা জিহাদ করে আল্লাহর পথে। আর যারা কাফের তারা যুদ্ধ করে শয়তানের পথে। সুতরাং পরিপূর্ণ কোন মুমিন ব্যক্তি যখন যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়, তখন তার সামনেই এ উদ্দেশ্য বিদ্যমান থাকে যে, আমি আল্লাহর পথেই এ কাজ করছি। তার নির্দেশ ও নিষেধকে বাস্তবায়নই আমার জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু এর বিপরীতে যারা কাফের তাদের বাসনা থাকে কুফরের প্রচলন, কুফরের বিজয় এবং পৈচাশিক শক্তির শাসন প্রতিষ্ঠা করা, যাতে করে বিশ্বময় কুফরী ও শির্কী বিস্তার লাভ করতে পারে। আর কুফরী ও শির্কী যেহেতু শয়তানের পথ, সুতরাং কাফেররা শয়তানের কাজেই সাহায্য করে থাকে।

(২) আয়াতে বলা হয়েছে যে, শয়তানের চক্রান্ত ও কলাকৌশল হয় দুর্বল। ফলে তা মুমিনের সামান্যতমও ক্ষতি করতে পারে না। অতএব মুসলিমগণকে শয়তানের বন্ধুবৰ্গ অর্থাৎ কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে কোন রকম দ্বিধা করা উচিত নয়। তার কারণ, তাদের সাহায্যকারী হলেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। পক্ষান্তরে শয়তানের কলাকৌশল কাফেরদের কিছুই মঙ্গল সাধন করবে না। এ আয়াতে শয়তানের কলাকৌশলকে যে দুর্বল বলে অভিহিত করা হয়েছে, সেজন্য আয়াতের মাধ্যমেই দু’টি শর্তের বিষয়ও প্রতীয়মান হয়।

(এক) যে লোকের বিরুদ্ধে শয়তান কলাকৌশল অবলম্বন করবে, তাকে মুসলিম হতে হবে এবং (দুই) সে যে কাজে নিয়োজিত থাকবে, তা একান্তভাবেই আল্লাহর জন্য হতে হবে; কোন পার্থিব বস্তুর আকাঙ্খা কিংবা আত্মস্বার্থ প্রণোদিত হবে না। এ দু’টি শর্তের যেকোন একটির অবর্তমানে শয়তানের কলাকৌশল দুর্বল হয়ে পড়া অবশ্যম্ভাবী নয়।

শয়তানের অলী কারা ?

তারা হল আল্লাহর বিরোদিতা কারী তারা কুর’আন ও সুন্না অনুসরন করা জরুরী মনে করেনা , এবং বিদ’আত ও নাফসানিয়াত অনুযায়ী চলে । আল্লাহ ছাড়া গায়রুল্লাহর নিকট দু’আ করে আর যত অলী আওলিয়ার নামে কিচ্ছা কাহিনী বয়ান করে ।

আল্লাহ তা’আলা বলেন ,

যে ব্যক্তি রহমানের স্মরণ থেকে গাফিল থাকে আমি তার ওপর এক শয়তান চাপিয়ে দেই, সে তার বন্ধু হয়ে যায়৷, এ শয়তানরা এসব লোকদেরকে সঠিক পথে আসতে বাধা দেয়, কিন্তু এরা মনে করে আমরা ঠিক পথেই চলছি৷  (যুখরুফঃ৩৬-৩৭ )

এরাই হচ্ছে শয়তানের অলী যাদের তোমরা অলী মনেকর ।

আল্লাহ  বলেন, আশ-শুআরা ২২১/২২২)

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ

হে লোকেরা! আমি তোমাদের জানাবো শয়তানরা কার উপর অবতীর্ণ হয় ?তারা তো প্রত্যেক জালিয়াত বদকারের উপর অবতীর্ণ হয়৷ শোনা কথা কানে ঢুকিয়ে দেয় এবং এর বেশির ভাগই হয় মিথ্যা৷ আশ-শুআরা ২২১-২২৩)

এখানে গণৎকার , জ্যোতিষী , ভবিষ্যত বক্তা ,”আমলকারী” ভন্ড পীর ,ইত্যাদি লোক , যারা ভবিষ্যতের খবর জানে বলে ভণ্ড প্রতারকের অভিনয় করে

এর দু’টি অর্থ হতে পারে৷ একটি হচ্ছে , শয়তানরা কিছু শুনেটুনে নিয়ে নিজেদের চেলাদেরকে জানিয়ে দেয় এবং তাতে সামান্যতম সত্যের সাথে বিপুল পরিমাণ মিথ্যার মিশ্রণ ঘটায় ৷ দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে (,ভন্ড পীর) যারা আল্লাহর অলি বলে দাবি করে তারা ! মির্থুক-প্রতারক গণৎকাররা শয়তানের কাছ থেকে কিছু শুনে নেয় এবং তারপর তার সাথে নিজের পক্ষ থেকে অনেকটা মিথ্যা মিশিয়ে মানুষের কানে ফুঁকে দিতে থাকে৷ একটি হাদীসে এর আলোচনা এসেছে৷ হাদীসটি বুখারী শরীফে আয়েশার (রা) বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছে৷ তাতে আয়েশা (রা) বলেনঃ কোন কোন লোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গণকদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে৷ জবাবে তিনি বলেন ,ওসব কিছুই নয়৷ তারা বলে , হে আল্লাহর রসূল ! কখনো কখনো তারা তো আবার ঠিক সত্যি কথাই বলে দেয়৷ রসূলুল্লাহ (সা) বলেন, সত্যি কথাটা কখনো কখনো জিনেরা নিয়ে আসে এবং তাদের বন্ধুদের কানে ফুঁকে দেয় তারপর তারা তার সাথে নানা রকম মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি কাহিনী তৈরী করে৷

জান্নাত ও জাহান্নামের ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে যেটুকু কলা হয়েছে, তা ব্যতীত অন্য কোন খবর জানার কোন উপায় নেই। কারণ এগুলো গায়েবী বিষয়। আল্লাহ্ তাআলা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে আমাদেরকে যেটুকু বলেছেন, আমরা শুধু সেটুকুই জানি। সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি এর অতিরিক্ত কিছু দাবী করে, তাহলে সে মিথ্যাবাদী। তা বিশ্বাস করা সুস্পষ্ট শির্ক। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

হে নবী! আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধু একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদাতা ঈমানদারদের জন্য। (সূরা আ’রাফঃ ১৮৮) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

قُلْ لَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ

আপনি বলুন: আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহ্র ভাণ্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় অবগতও নই। (সূরা আনআমঃ ৫০)

عَالِمُ الْغَيْبِ فَلَا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ

“তিনি (আল্লা) গায়েব সম্পর্কে অবগত। তিনি গায়েবের বিষয় কারও কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তাঁর মনোনীত কোন রসূল ব্যতীত। (সূরা জিনঃ ২৬-২৭)

আর কবি দের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা বলেই দিয়েছেন,

আর কবিরা! তাদের পেছনে চলে পথভ্রান্ত যারা৷,

أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ তুমি কি দেখ না তারা উপতক্যায় উপত্যকায় উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়। শুয়ারাঃ ২২৪-২২৫

কাজেই হে মুহাম্মদ! আল্লাহর সাথে অন্য কোন মাবুদকে ডেকো না, নয়তো তুমিও শাস্তি লাভকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে৷শুয়ারাঃ২১৩

﴿وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ﴾

‘‘আর যারা আমার উদ্দেশে কষ্ট সহ্য (জিহাদ) করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ নেককারদের সাথে আছেন। (সূরা আল ‘আন্কাবূত ২৯ : ৬৯)

﴿فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُمْ بِه جِهَادًا كَبِيرًا﴾

‘‘অতএব আপনি কাফিরদের আনুগত্য করবেন না এবং তাদের সঙ্গে কুরআনের সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম (জিহাদ) চালিয়ে যান। (সূরা আল ফুরকান ২৫ : ৫২)

 

ওহোদ পরবর্তী যুদ্ধসমূহ (السرايا والغزوات بعد أحد)

https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=15&chapter=5489

২১. গাযওয়া হামরাউল আসাদ(غزوة حمراء الأسد) : ৩য় হিজরীর ৮ই শাওয়াল রবিবার। আবু সুফিয়ানের বাহিনী পুনরায় মদীনা আক্রমণ করতে পারে, এই আশংকায় রাসূল (ছাঃ) ওহোদ যুদ্ধের পরদিনই তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং মদীনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মক্কার দিকে ১২ কি. মি. দূরে হামরাউল আসাদে পৌঁছেন। তিনি সেখানে তিনদিন অবস্থান শেষে মদীনায় ফিরে আসেন। (বিস্তারিত ৩৫৪ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।

২২. সারিইয়া আবু সালামাহ(سرية أبي سلمة) : ৪র্থ হিজরীর ১লা মুহাররম। ত্বালহা ও সালামা বিন খুওয়াইলিদ নামক কুখ্যাত ডাকাত দু’ভাই বনু আসাদ গোত্রকে মদীনা আক্রমণের প্ররোচনা দিচ্ছে মর্মে খবর পৌঁছলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বীয় দুধভাই আবু সালামাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে মুহাজির ও আনছারদের ১৫০ জনের একটি সেনাদল প্রেরণ করেন। বনু আসাদের প্রস্ত্ততি গ্রহণের পূর্বেই তাদের ‘ক্বাত্বান’ (قَطَن) নামক ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণের ফলে তারা হতচকিত হয়ে পালিয়ে যায়। মুসলিম বাহিনী তাদের ফেলে যাওয়া উট ও বকরীর পাল ও গণীমতের মাল নিয়ে ফিরে আসে। এই যুদ্ধ থেকে ফিরে কিছু দিনের মধ্যে আবু সালামা মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তার বিধবা স্ত্রী উম্মে সালামা রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে বিবাহিতা হন। আবু সালামা ইতিপূর্বে ওহোদের যুদ্ধে যখমী হয়েছিলেন’। ইবনু সা‘দ ২/৩৮; যাদুল মা‘আদ ৩/২১৮; আল-বিদায়াহ ৪/৬১; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৮০১; আর-রাহীক্ব ২৯০-৯১ পৃঃ; বর্ণনাটি যঈফ (তা‘লীক্ব পৃঃ ১৫৭)।

২৩. সারিইয়া আব্দুল্লাহ বিন উনাইস(سرية عبد الله بن أنيس): ৪র্থ হিজরীর ৫ই মুহাররম সোমবার। মুসলমানদের উপরে হামলার জন্য নাখলা অথবা উরানাহ নামক স্থানে খালেদ বিন সুফিয়ান বিন নুবাইহ আল-হুযালী সৈন্য সংগ্রহ করছে মর্মে বলে সংবাদ পেয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আব্দুল্লাহ বিন উনাইস আল-জুহানী আনছারীকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। তিনি তাকে হত্যা করে মদীনায় ফিরে আসেন এবং রাসূল (ছাঃ)-কে তার নিহত হওয়ার সংবাদ প্রদান করেন।

ইবনু সা‘দ ২/৩৯; ইবনু হিশাম ২/৬১৯-২০। বর্ণনাটি যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২০২৫)।

২৪. সারিইয়া বি’রে মাঊনা(سرية بئر معونة) : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। নাজদের নেতা আবু বারা ‘আমের বিন মালেকের আমন্ত্রণক্রমে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদবাসীদের কুরআন পড়ানোর জন্য ও দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য মুনযির বিন ‘আমের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৭০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন। যাদের সকলে ছিলেন শীর্ষস্থানীয় ক্বারী ও বিজ্ঞ আলেম। যারা দিনের বেলায় কাঠ কুড়াতেন এবং রাত্রি জেগে নফল ছালাত আদায় করতেন। তাঁরা মাঊনা নামক কূয়ার নিকটে অবতরণ করেন। অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর পত্র নিয়ে হারাম বিন মিলহান গোত্রনেতা ‘আমের বিন তুফায়েল-এর নিকটে গমন করেন। কিন্তু সে পত্রের প্রতি দৃকপাত না করে একজনকে ইঙ্গিত দেয় তাকে হত্যা করার জন্য। ফলে হত্যাকারী তাকে পিছন দিক থেকে বর্শা বিদ্ধ করে। এ সময় রক্ত দেখে হারাম বিন মিলহান বলে ওঠেন,اللهُ أكْبَرُ، فُزْتُ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ ‘আল্লাহু আকবর! কা‘বার রবের কসম! আমি সফল হয়েছি’। অতঃপর ‘আমের বিন তুফায়েলের আবেদনক্রমে বনু সুলাইমের তিনটি গোত্র উছাইয়া, রে‘ল ও যাকওয়ান(عُصَيَّة، رِعْل، ذَكْوَان) চতুর্দিক হ’তে তাদের উপরে আক্রমণ চালায় এবং সবাইকে হত্যা করে। একমাত্র ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী রক্ষা পান মুযার গোত্রের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে। এতদ্ব্যতীত বনু নাজ্জারের কা‘ব বিন যায়েদ জীবিত ছিলেন। তাঁকে নিহতদের মধ্য থেকে যখমী অবস্থায় উঠিয়ে আনা হয়। পরে তিনি ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধের সময় একটি অজ্ঞাত তীরের আঘাতে শহীদ হন। আল-ইছাবাহ, কা‘ব বিন যায়েদ ক্রমিক ৭৪১৭; যাদুল মা‘আদ ৩/২২২; ইবনু সা‘দ ২/৩৯-৪০।

এসময় জিব্রীল (আঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে খবর দিয়ে বললেন, প্রেরিত দলটি তাদের রবের সাথে মিলিত হয়েছে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাদেরকে সন্তুষ্ট করেছেন। এ ঘটনার পর রাসূল (ছাঃ) তাদের বিরুদ্ধে ৪০ দিন অন্য বর্ণনায় এক মাস যাবত কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।

হারাম বিন মিলহানের মৃত্যুকালীন শেষ বাক্যটি হত্যাকারী জাববার বিন সালমা(عُصَيَّة، رِعْل، ذَكْوَان) এর অন্তরে এমনভাবে দাগ কাটে যে, পরে তিনি ইসলাম কবুল করেন’ (ইবনু হিশাম ২/১৮৬)।

২৫. সারিইয়া রাজী‘(سرية رجيع) : ৪র্থ হিজরীর ছফর মাস। কুরায়েশরা ষড়যন্ত্র করে ‘আযাল ও ক্বাররাহ(عَضَلٌ وَالْقَارَّةُ) গোত্রের সাতজন লোককে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে পাঠায়। তারা গিয়ে আরয করে যে, আমাদের গোত্রের মধ্যে ইসলামের কিছু চর্চা রয়েছে। এক্ষণে তাদেরকে দ্বীন শিক্ষাদানের জন্য ও কুরআন পড়ানোর জন্য কয়েকজন উঁচু মর্তবার ছাহাবীকে পাঠালে আমরা উপকৃত হ’তাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সরল বিশ্বাসে তাদের গোত্রে ‘আছেম বিন ছাবিত (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ৬জন মুহাজির ও ৪জন আনছারসহ ১০ জনের একটি মুবাল্লিগ দল প্রেরণ করেন।অন্য বর্ণনায় এসেছে, মারছাদ বিন আবী মারছাদ আল-গানাভী-র নেতৃত্বে (ইবনু হিশাম ২/১৬৯)।

‘আছেম হযরত ওমরের শ্বশুর ছিলেন এবং ‘আছেম বিন ওমরের নানা ছিলেন। তারা রাবেগ ও জেদ্দার মধ্যবর্তী রাজী‘ নামক ঝর্ণার নিকটে পৌঁছলে পূর্ব পরিকল্পনা মতে হুযায়েল গোত্রের শাখা বনু লেহিয়ানের ১০০ তীরন্দায তাদের উপর হামলা করে। যুদ্ধে ‘আছেম সহ ৮জন শহীদ হন এবং দু’জনকে তারা মক্কায় নিয়ে বিক্রি করে দেয়। তারা হ’লেন হযরত খোবায়েব বিন ‘আদী ও যায়েদ বিন দাছেনাহ(زيد بن الدَّثِنَةِ)।

সেখানে ওক্ববা বিন হারেছ বিন ‘আমের খোবায়েবকে এবং ছাফওয়ান বিন উমাইয়া বিন খালাফ যায়েদকে হত্যা করে বদর যুদ্ধে তাদের স্ব স্ব পিতৃহত্যার বদলা নেয়। শূলে চড়ার আগে খোবায়েব দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করেন এবং বলেন, আমি ভীত হয়েছি, এই অপবাদ তোমরা না দিলে আমি দীর্ঘক্ষণ ছালাত আদায় করতাম। তিনিই প্রথম এই সুন্নাতের সূচনা করেন। অতঃপর কাফেরদের বদ দো‘আ করেন এবং মর্মন্তুদ কবিতা বলেন, যা ছহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন হাদীছ ও জীবনী গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। খোবায়েবের সেই বিখ্যাত দো‘আটি ছিল নিম্নরূপ- اللَّهُمَّ أَحْصِهِمْ عَدَدًا وَاقْتُلْهُمْ بَدَدًا وَلاَ تُبْقِ مِنْهُمْ أَحَدًا ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে এক এক করে গুণে রাখ। তাদেরকে এক এক করে হত্যা কর এবং এদের একজনকেও অবশিষ্ট রেখো না’। অতঃপর তাঁর পঠিত সাত বা দশ লাইন কবিতার বিশেষ দু’টি লাইন ছিল নিম্নরূপ-

وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا + عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ فِي اللهِ مَصْرَعِي

وَذَلِكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ + يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ

‘আমি যখন মুসলিম হিসাবে নিহত হই তখন আমি কোন পরোয়া করি না যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমাকে কোন্ পার্শ্বে শোয়ানো হচ্ছে’। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আমার মৃত্যু হচ্ছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমার খন্ডিত টুকরা সমূহে বরকত দান করতে পারেন’।ইবনু হিশাম ২/১৭৬; বুখারী হা/৩০৪৫, ৩৯৮৯।

যায়েদ বিন দাছেনাকে হত্যার পূর্বে আবু সুফিয়ান তাকে বললেন, তুমি কি এটাতে খুশী হবে যে, তোমার স্থলে আমরা মুহাম্মাদকে হত্যা করি এবং তুমি তোমার পরিবার সহ বেঁচে থাক? তিনি বলেন,لاَ وَاللهِ الْعَظِيمِ مَا أُحِبُّ أَنْ يَفْدِيَنِي بِشَوْكَةٍ يُشَاكَهَا فِي قَدَمِهِ ‘কখনোই না। মহান আল্লাহর কসম! আমি চাই না যে, আমার স্থলে তাঁর পায়ে একটি কাঁটারও আঘাত লাগুক’। একথা শুনে বিস্মিত আবু সুফিয়ান বললেন,مَا رَأَيْتُ مِنَ النَّاسِ أَحَدًا يُحِبُّ أَحَدًا كَحُبِّ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا ‘মুহাম্মাদের সাথীরা মুহাম্মাদকে যেরূপ ভালোবাসে সেরূপ কাউকে আমি দেখিনি’। হারাম এলাকা থেকে বের করে ৬ কি. মি. উত্তরে ‘তানঈম’ নামক স্থানে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার গোলাম নিসতাস ইবনুদ দাছেনাকে হত্যা করে। অতঃপর একইদিনে খোবায়েবকে সেখানে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয় (আল-বিদায়াহ ৪/৬৫-৬৬)।

বীরে মা‘উনার মর্মান্তিক হত্যাকান্ডে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ছাহাবী ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী প্রহরীদের লুকিয়ে অতীব চতুরতার সাথে খোবায়েবের লাশ এনে সসম্মানে দাফন করেন (আল-বিদায়াহ ৪/৬৬)। অন্যদিকে দলনেতা ‘আছেম-এর লাশ আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা লোক পাঠান। কিন্তু আল্লাহ তার লাশের হেফাযতের জন্য এক ঝাঁক ভীমরুল প্রেরণ করেন। ফলে মুশরিকরা তার লাশের নিকটে যেতে পারেনি। কেননা ‘আছেম আল্লাহর নিকটে অঙ্গীকার দিয়েছিলেন,لاَ يَمَسَّهُ مُشْرِكٌ، وَلاَ يَمَسَّ مُشْرِكًا أَبَدًا فِي حَيَاتِهِ ‘যেন কোন মুশরিক তাকে স্পর্শ না করে এবং তিনিও কোন মুশরিককে তাঁর জীবদ্দশায় কখনো স্পর্শ না করেন’। পরে হযরত ওমর (রাঃ) বলেন,مَنَعَهُ اللهُ بَعْدَ وَفَاتِهِ، كَمَا امْتَنَعَ مِنْهُ فِي حَيَاتِهِ ‘আল্লাহ তাঁকে মুশরিকের স্পর্শ থেকে মৃত্যুর পরেও হেফাযত করেছেন, যেমন তাকে জীবিত অবস্থায় হেফাযত করেছিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/১৭১)।

খোবায়েবকে হত্যার জন্য খরীদ করেন হুজায়ের বিন আবু ইহাব তামীমী, যিনি বদর যুদ্ধে নিহত হারেছ বিন ‘আমের-এর সহোদর ভাই ছিলেন। তার দাসী, যিনি পরে মুসলমান হন, তিনি বলেন যে, খোবায়েব আমার বাড়ীতে আটক ছিল। একদিন আমি তাকে বড় এক থোকা আঙ্গুর খেতে দেখি। অথচ তখন মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না। তিনি বলেন, হত্যার সময় উপস্থিত হ’লে তিনি আমাকে বলেন, আমার জন্য একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিন, যাতে হত্যার পূর্বে আমি ক্ষৌরকর্ম করে পবিত্রতা অর্জন করতে পারি। তখন আমি আমার বাচ্চাকে দিয়ে তাঁকে একটা ক্ষুর পাঠিয়ে দিলাম। পরক্ষণে আমি বলে উঠলাম, হায়! আমি এটা কি করলাম? আল্লাহর কসম! লোকটি নিজের হত্যার বদলে আমার বাচ্চাকে হত্যা করবে। অতঃপর যখন সে বাচ্চার হাত থেকে ক্ষুরটি নিল, তখন বলল, তোমার জীবনের কসম! তোমার মা যেন আমার বিশ্বাসঘাতকতার ভয় না করেন, যখন তিনি তোমাকে এই ক্ষুরসহ আমার কাছে পাঠিয়েছেন। অতঃপর সে বাচ্চাকে ছেড়ে দিল’ (ইবনু হিশাম ২/১৭২)।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, কুরায়েশরা খোবায়েবকে হারেছ বিন ‘আমেরের বাড়ীতে কয়েকদিন বন্দী রাখে। এ সময় তাকে কোন খাদ্য বা পানীয় দেওয়া হয়নি। একদিন হঠাৎ হারেছ-এর ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটি ধারালো ছুরি নিয়ে খেলতে খেলতে তার কাছে চলে আসে। তিনি তাকে আদর করে কোলে বসান। এ দৃশ্য দেখে বাচ্চার মা চিৎকার করে ওঠেন। তখন খোবায়েব বলেন, মুসলমান কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। মৃত্যুর পূর্বে খোবায়েবের শেষ বাক্য ছিল-اللَّهمَّ إنَّا قَدْ بَلَّغْنَا رِسَالَةَ رَسُولِكَ، فَبَلِّغْهُ الْغَدَاةَ مَا يُصْنَعُ بِنَا ‘হে আল্লাহ, আমরা তোমার রাসূলের রিসালাত পৌঁছে দিয়েছি। এক্ষণে তুমি তাঁকে আমাদের সাথে যা করা হচ্ছে, সে খবরটি পৌঁছে দাও’।

ওমর (রাঃ)-এর গবর্ণর সাঈদ বিন ‘আমের (রাঃ) যিনি খোবায়েবের হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, তিনি উক্ত মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণ করে মাঝে-মধ্যে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যেতেন। তিনি বলতেন, খোবায়েবের নিহত হবার দৃশ্য স্মরণ হ’লে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। আল্লাহর পথে কতবড় ধৈর্যশীল তিনি ছিলেন যে, একবার উহ্ পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। বন্দী অবস্থায় তাঁকে থোকা থোকা আঙ্গুর খেতে দেখা গেছে। অথচ ঐসময় মক্কায় কোন আঙ্গুর ছিল না’ (ইবনু হিশাম ২/১৭২)।

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে পরপর দু’টি হৃদয় বিদারক ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দারুণভাবে ব্যথিত হন। অতঃপর তিনি বনু লেহিয়ান, রে‘ল ও যাকওয়ান এবং উছাইয়া গোত্র সমূহের বিরুদ্ধে এক মাস যাবত পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে বদ দো‘আ করে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করেন।বুখারী হা/৪৫৬০; মুসলিম হা/৬৭৫; আবুদাঊদ হা/১৪৪২; নাসাঈ হা/১০৭৩; মিশকাত হা/১২৮৮-৯১ ‘বিতর’ অধ্যায়, ‘কুনূত’ অনুচ্ছেদ।

২৬. সারিইয়া ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী(سرية عمرو بن أمية الضمري) : ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বি’রে মাঊনার মর্মান্তিক ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র ছাহাবী ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী বি’রে মাঊনা হ’তে মদীনায় ফেরার পথে ক্বারক্বারা নামক বিশ্রাম স্থলে পৌঁছে বনু কেলাব গোত্রের দু’ব্যক্তিকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। এর মাধ্যমে তিনি সাথীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উক্ত গোত্রের সঙ্গে যে রাসূল (ছাঃ)-এর সন্ধিচুক্তি ছিল, তা তিনি জানতেন না। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে বিনিময় স্বরূপ রক্তমূল্য প্রদান করেন। কিন্তু এই ঘটনা পরবর্তীতে বনু নাযীর যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইবনু হিশাম ২/১৮৬; আর-রাহীক্ব ২৯৪ পৃঃ।

 

[2]. ইবনু সা‘দ ২/৩৯; ইবনু হিশাম ২/৬১৯-২০। বর্ণনাটি যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২০২৫)।

এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, আব্দুল্লাহ বিন উনাইস (রাঃ) ১৮ দিন পর মদীনায় ফিরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে খালেদের কাটা মাথা এনে রাখেন। এসময় রাসূল (ছাঃ) তাকে একটি লাঠি হাদিয়া দেন এবং বলেন, এটি ক্বিয়ামতের দিন তোমার ও আমার মাঝে নিদর্শন হবে। আব্দুল্লাহ উক্ত লাঠিটি আমৃত্যু সাথে রাখেন এবং অছিয়ত করেন যে, এটি আমার কাফনের সাথে দিয়ে দিয়ো। অতঃপর উক্ত লাঠি সহ তাকে দাফন করা হয় (আর-রাহীক্ব ২৯১ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬২০; যাদুল মা‘আদ ৩/২১৮)। বর্ণনাটি যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২০২৬)। ১৮ দিন পর মাথা নিয়ে আসার কথা ইবনু হিশামে নেই। যাদুল মা‘আদে আব্দুল মুমিন বিন খালাফ (মৃ. ৭০৫ হি.)-এর বরাতে লেখা হয়েছে। কিন্তু মুবারকপুরী এটি সরাসরি লিখেছেন। যা একেবারেই ভিত্তিহীন।