সূরা আনআমঃ ৯ম রুকু (৭১-৮২)আয়াত সমূহ

 সূরা আনআমঃ ৯ম রুকু (৭১-৮২)আয়াত সমূহ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৬:৭১ قُلۡ اَنَدۡعُوۡا مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مَا لَا یَنۡفَعُنَا وَ لَا یَضُرُّنَا وَ نُرَدُّ عَلٰۤی اَعۡقَابِنَا بَعۡدَ اِذۡ هَدٰىنَا اللّٰهُ کَالَّذِی اسۡتَهۡوَتۡهُ الشَّیٰطِیۡنُ فِی الۡاَرۡضِ حَیۡرَانَ ۪ لَهٗۤ اَصۡحٰبٌ یَّدۡعُوۡنَهٗۤ اِلَی الۡهُدَی ائۡتِنَا ؕ قُلۡ اِنَّ هُدَی اللّٰهِ هُوَ الۡهُدٰی ؕ وَ اُمِرۡنَا لِنُسۡلِمَ لِرَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿ۙ

৭১. বলুন, আল্লাহ্‌ ছাড়া আমরা কি এমন কিছুকে ডাকব, যা আমাদের কোন উপকার কিংবা অপকার করতে পারে না? আর আল্লাহ্‌ আমাদেরকে হিদায়াত দেবার পর আমাদেরকে কি আগের অবস্থায় ফিরানো হবে সে ব্যক্তির মত, যাকে শয়তান যমীনে এমন শক্তভাবে পেয়ে বসেছে যে সে দিশেহারা? তার রয়েছে কিছু (ঈমানদার) সহচর, তারা তাকে হিদায়াতের প্রতি আহ্বান করে বলে, আমাদের কাছে আস?বলুন, আল্লাহ্‌র হিদায়াতই সঠিক হিদায়াত এবং আমরা আদিষ্ট হয়েছি সৃষ্টিকুলের রব-এর কাছে আত্মসমর্পণ করতে।

এখানে এমন লোকদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, যারা ঈমান আনার পর কুফরীর দিকে এবং তাওহীদের পর শিরকের দিকে ফিরে যায়। এদের দৃষ্টান্ত ঠিক এই রকম যে, এক ব্যক্তি তার সেই সাথীদের সাথছাড়া হয়ে যায়, যারা সোজা ও সঠিক পথে যাচ্ছিল। আর সঙ্গচ্যুত হয়ে এই ব্যক্তি বনে-জঙ্গলে চঞ্চল ও অস্থির অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। এদিকে তার সাথীরা তাকে ডাকে, কিন্তু চাঞ্চল্যের কারণে সে কিছুই শুনতে পায় না।  সে ঈমানদার বন্ধুদের এ আহবানে সাড়া দেয় না। [মুয়াস্‌সার] অথবা শয়তান জ্বিনদের কুহকে পড়ার কারণে সঠিক পথের দিকে ফিরে আসা তার পক্ষে সম্ভব হয় না।

এ আয়াত দ্বারা আরো জানা গেল যে, যারা আখেরাতের প্রতি অমনোযোগী হয়ে শুধু পার্থিব জীবন নিয়ে মগ্ন, তাদের সংসৰ্গও অপরের জন্য মারাত্মক। তাদের সংসর্গে উঠা-বসাকারীরাও পরিণামে তাদের অনুরূপ আযাবে পতিত হবে। পূর্ববর্তী তিনটি আয়াতের সারমর্ম মুসলিমদেরকে অশুভ পরিবেশ ও খারাপ সংসর্গ থেকে বাঁচিয়ে রাখা। এটি যে কোন মানুষের জন্যই বিষতুল্য। কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য উক্তি ছাড়াও চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, অসৎ সমাজ ও মন্দ পরিবেশই মানুষকে কুকর্ম ও অপরাধে লিপ্ত করে।

এ পরিবেশে জড়িয়ে পড়ার পর মানুষ প্রথমতঃ বিবেক ও মনের বিরুদ্ধে কুকর্মে লিপ্ত হয়। এরপর আস্তে আস্তে কুকর্ম যখন অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন মন্দের অনুভূতিও লোপ পায়, বরং মন্দকে ভাল এবং ভালকে মন্দ মনে করতে থাকে। যেমন এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যখন কোন ব্যক্তি প্রথমবার গোনাহ করে, তখন তার কলবে একটি কাল দাগ পড়ে। তারপর যখন তাওবা করে গোনাহের কাজ থেকে বিরত হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন তার কলব আবার পরিষ্কার হয়ে যায়।

কিন্তু যদি গোনাহ বাড়িয়ে দেয়, তখন একের পর এক কালো দাগ বাড়াতে থাকে। [কুরআনুল কারীমে (رَانَ) শব্দ দ্বারা এ অবস্থাকেই ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে,

৮৩:১৪ کَلَّا بَلۡ ٜ رَانَ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ مَّا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿

“কুকর্মের কারণে তাদের অন্তরে মরিচা পড়ে গেছে।” [সূরা আল-মুতাফ্‌ফিফীন: ১৪]

তারা এই কুরআন এবং আল্লাহর অহীর প্রতি ঈমান এই জন্য আনে না যে, গোনাহ করার দরুন তাদের অন্তরে পর্দা পড়ে গেছে এবং জং ধরে গেছে। رين গোনাহর সেই কালিমাকে বলা হয়, যা একাধারে পাপাচরণ করার কারণে অন্তরে ছেয়ে যায়। হাদীসে এসেছে যে, বান্দাহ যখন পাপ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো বিন্দু পড়ে যায়। যদি সে পাপ থেকে তওবা করে, তাহলে সেই কালো বিন্দু পরিষ্কার হয়ে যায়। আর তওবার পরিবর্তে যদি পাপের পর পাপ করেই যায়, তাহলে সেই কালো বিন্দুটি আরো বৃহৎ আকার ধারণ করে। এমনকি তা তার গোটা অন্তরে ছেয়ে যায়। এটাই হল সেই ‘রাইন’ যার কথা কুরআন মাজীদে এসেছে। (তিরমিযী সূরা মুতাফফিফীনের তফসীর পরিচ্ছেদ, ইবনে মাজাহ যুহদ অধ্যায় গোনাহ প্রসঙ্গ পরিচ্ছেদ, মুসনাদে আহমাদ ২/২৯৪ )

অর্থাৎ ভাল-মন্দ পার্থক্য করার যোগ্যতাই লোপ পেয়ে বসে। চিন্তা করলে বুঝা যায়, অধিকাংশ ভ্রান্ত পরিবেশ ও অসৎ সঙ্গই মানুষকে এ অবস্থায় পৌছায়। এ কারণেই অভিভাবকদের কর্তব্য ছেলে-সন্তানদেরকে এ ধরণের পরিবেশ থেকে বাচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করা।

আম্‌র ইবনে আউফ আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একবার আবূ উবাইদাহ ইবনে জারাহকে জিযিয়া (ট্যাক্স) আদায় করার জন্য বাহরাইন পাঠালেন। অতঃপর তিনি বাহরাইন থেকে (প্রচুর) মাল নিয়ে এলেন। আনসারগণ তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে ফজরের নামাযে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সঙ্গে শরীক হলেন। যখন তিনি নামায পড়ে (নিজ বাড়ি) ফিরে যেতে লাগলেন, তখন তারা তাঁর সামনে এলেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাদেরকে দেখে হেসে বললেন, “আমার মনে হয়, তোমরা আবূ উবাইদাহ বাহরাইন থেকে কিছু (মাল) নিয়ে এসেছে, তা শুনেছ।” তারা বলল, ‘জী হ্যা।’ তিনি বললেন, “সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং তোমরা সেই আশা রাখ, যা তোমাদেরকে আনন্দিত করবে। তবে আল্লাহর কসম! তোমাদের উপর দারিদ্র্য আসবে আমি এ আশংকা করছি না। বরং আশংকা করছি যে, তোমাদের পূর্ববতী উম্মতের ন্যায় তোমাদেরও পার্থিব জীবনে প্রশস্ততা আসবে। আর তাতে তোমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যেমন তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। অতঃপর তা তোমাদেরকে ধংস ক’রে দেবে, যেমন তাদেরকে ধংস ক’রে দিয়েছিল।” (বুখারী ৪০১৫, মুসলিম ২৯৬১নং)

মানুষ যার সাথে উঠা-বসা করবে, সে অবশ্যই তার দ্বারা কিছু না কিছু প্রভাবান্বিত হবে। আর সে জন্যই কারো কাছে বসার আগে জেনে নেওয়া উচিত, সে ভালো লোক কি না?

আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেন, ‘‘মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের অনুসারী হয়। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের দেখা উচিত যে, সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে. মুসনাদে আহমাদ আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা. হা/ ৭৯৬৮, আবূ দাঊদ ৪৮৩৩, তিরমিযী হা/২৩৭৮, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী ৯২৭

আল্লাহর রাসুল (ﷺ) বলেন,

مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالْجَلِيسِ السَّوْءِ كَمَثَلِ صَاحِبِ الْمِسْكِ وَكِيرِ الْحَدَّادِ لَا يَعْدَمُكَ مِنْ صَاحِبِ الْمِسْكِ إِمَّا تَشْتَرِيهِ أَوْ تَجِدُ رِيحَهُ وَكِيرُ الْحَدَّادِ يُحْرِقُ بَدَنَكَ أَوْ ثَوْبَكَ أَوْ تَجِدُ مِنْهُ رِيحًا خَبِيثَةً

‘‘সুসঙ্গী ও কুসঙ্গীর উপমা তো আতর-বিক্রেতা ও কামারের মত। আতর-বিক্রেতা (এর পাশে বসলে) হয় সে তোমার দেহে (বিনামূল্যে) আতর লাগিয়ে দেবে, না হয় তুমি তার নিকট থেকে তা ক্রয় করবে। তা না হলেও (অন্ততপক্ষে) তার নিকট থেকে এমনিই সুবাস পেতে থাকবে।

পক্ষান্তরে কামার (এর পাশে বসলে) হয় সে (তার আগুনের ফিনকি দ্বারা) তোমার কাপড় পুড়িয়ে ফেলবে, না হয় তার নিকট থেকে বিকট দুর্গন্ধ পাবে।বুখারী তাওহীদ পাবঃ হা/ ২১০১, মুসলিম আল-মাকতাবাতুশ-শামেলা হা/২৬২৮

উল্লেখ্য যে, ভালো লোকের সাথে উঠা-বসা করুন, ভালো হবেন, ভালো পাবেন। আর খারাপ লোককে প্রভাবান্বিত না করতে পারলে বর্জন করুন। নচেৎ খারাপ হয়ে যাবেন, খারাপ পাবেন। বিদআতীর মজলিসে বসবেন না। কারণ আপনার মর্মমূলেও বিদআত অনুপ্রবেশ করে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে সালাফদের কিছু বাণী উদ্ধৃত হলঃ

ফুযাইল বিন ইয়ায বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন বিদআতীর সাথে বসে, সে ব্যক্তি হতে সাবধান! যে ব্যক্তি কোন বিদআতীর সাথে বসে, তাকে কোন হিকমত (জ্ঞান) দান করা হয় না। আমি পছন্দ করি যে, আমার ও বিদআতীর মাঝে লোহার কেল্লা হোক। কোন বিদআতীর নিকট খাওয়া অপেক্ষা কোন ইয়াহুদী অথবা খৃষ্টানের নিকট খাওয়া আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়!’ লালকাঈ ৪/৬৩৮, ১১৪৯

(যুবক ও বন্ধুত্ব আবদুল হামীদ ফাইযী)——

অবশ্য এমন লোকও বহু আছে, যাদের চুন খেয়ে গাল তেঁতেছে, ফলে দই দেখেও ভয় পায়। অর্থাৎ, বন্ধুত্বের বাজারে ঠকে বা কাউকে ঠকতে দেখে একাকী থাকতে পছন্দ করে এবং মোটেই কোন মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। ফলে মাথা ব্যথা করলে তা সারার চেষ্টা না করে, মাথাটাই কেটে ফেলার ফায়সালা করে নেয়। অথচ মহানবী (সা.) বলেন, “যে মু’মিন মানুষের মাঝে মিশে তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে সেই মু’মিন ঐ মু’মিন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে লোকেদের সাথে মিশে না এবং তাদের কষ্টদানে ধৈর্যধারণ করে না।” (আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, সহীহুল জামে’ ৬৬৫১নং)

বন্ধুত্ব স্থাপন কর বন্ধুর তিনটি জিনিস পরীক্ষা করে। সে পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই তাকে বন্ধু বলে নির্বাচন কর, নচেৎ না।

১- প্রথমতঃ বন্ধুর জ্ঞান কত, তা বিচার কর। কারণ, জ্ঞানী বন্ধু এক নেয়ামত। যে নেয়ামত পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। যার নিকট সংকট মুহূর্তে বহু সুপরামর্শ পাওয়া যায়। যে স্পর্শকাতর সময়ে সঠিক পথনির্দেশ করে দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়। পড়াশোনার ক্ষেত্রে অধিক ফল লাভ করা সম্ভব হয়। এমন বন্ধুর বন্ধুত্বে ধোকাবাজির ভয় থাকে না, ভয় থাকে না কোথাও অপমানিত হওয়ার। কারণ, জ্ঞান হল আলো; চোখের আলো এবং মনেরও আলো। আর অলোর পথই ভালো। চাহে রাত্রি আসুক অথবা কাটা থাকুক পথে, নিশ্চিন্তে গন্তব্য হলের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়। আর এ জন্যই একজন বিজ্ঞ বন্ধু হল সবচেয়ে বড় নেয়ামত।

জ্ঞানীর সংস্পর্শে থাকলে হৃদয় আবাদ থাকে। জ্ঞানীর পরশে নিজেকেও জ্ঞানী করে তোলা যায়। তা না গেলেও জ্ঞানীর সাথে সম্পর্ক কায়েমে মানুষের সুনাম লাভ হয় -যদিও সে সুনামের যথার্থ অধিকারী নয়। আব্দুল্লাহ বিন ত্বাউস বলেন, একদা আমাকে আমার আব্বা বললেন, ‘বেটা! জ্ঞানীদের সাহচর্য গ্রহণ কর। তাদের প্রতি তোমাকে সম্পৃক্ত করা হবে – যদিও প্রকৃতপক্ষে তুমি তাদের দলভুক্ত নও (এবং নিজে তাদের মত জ্ঞানী না হও)। আর মুখদের সাহচর্য গ্রহণ করো না। কারণ, তাদের প্রতি তোমাকে সম্পৃক্ত করা হবে, যদিও আসলে তুমি তাদের দলভুক্ত নও (এবং তুমি নিজে মুখ না হও)। আর জেনে রেখো, প্রত্যেক জিনিসের একটা শেষ সীমা আছে। মানুষের বাসনার শেষ সীমা হল সুজ্ঞান লাভ। (অফিয়াতুল আ’ইয়ান ২/৫১১)।

২- বন্ধু দ্বীনদার কি না, তা দেখ। কারণ, দ্বীন হল মানুষের এমন সম্পদ, যা মানুষকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তোলে। দ্বীন দেয় জ্ঞান, মন ও দেহের খোরাক। দ্বীন হল সেই প্রতিষেধক মহৌষধ, যার ব্যবহার অন্তরের ব্যাধি দূর করে, দুর করে মনের কালিমা, প্রতিহত করে সকল অন্যায় ও অসৎ-আচরণকে। দ্বীন রক্ষা করে আল্লাহর গযব ও দোযখের আযাব থেকে।

যে ব্যক্তির দ্বীন নেই সে মৃত। বেদ্বীন মানুষের জীবনে কোন সুপরিকল্পিত আশা নেই। উদ্দেশ্যহীন জীবন-পথে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল নেই। তাই তার উপর কোন আস্থা নেই, নেই কোন ভরসা। বেদ্বীন মানুষ নিজেরই দুশমন। সুতরাং সে কিরূপে -বিশেষ করে দ্বীনদারের- দোস্ত হতে পারে? যে তার প্রতিপালককে ভালোবাসে না, সে কি তোমাকে ভালোবাসবে? তার ভালোবাসায় কি কোন ভরসা আছে? যে মহাপরাক্রমশালী বাদশা আল্লাহর ফরয আদায়ে গরয দেখায়, সে তোমার ভালোবাসার কর্জ কিভাবে আদায় করবে?

অতএব জেনে রেখো যে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। দ্বীনদার, পরহেযগার বন্ধুই তোমার বেহেস্তী পথের সঙ্গী। সেই তোমাকে সহায়তা করতে পারে মহাসাফল্যের জন্য। তাই তুমি দ্বীনদার বন্ধুই গ্রহণ কর। গরীব হলেও তাকেই তুমি অন্তরঙ্গ সাথী হিসাবে নির্বাচন কর। মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সা.)-কে সম্বোধন করে এই আদেশ করেন যে, “তুমি নিজেকে তাদের সংসর্গে রাখবে, যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে আহ্বান করে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য, আর পার্থিব জীবনের সুখ-সৌন্দর্য কামনা করে তাদের হতে তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিও না। পক্ষান্তরে তার অনুসরণ করো না, যার হৃদয়কে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করেছি, যে তার আপন খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে যায়।” (সূরা কাহফ ২৮ আয়াত)

আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “তুমি মু’মিন ব্যতীত আর কারো সাহচর্য গ্রহণ করো না এবং পরহেযগার মানুষ ছাড়া তোমার খাবার যেন অন্য কেউ না খায়।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে হিব্বান, হাকেম, সহীহুল জামে ৭৩৪১ নং)

৩- কারো সহিত বন্ধুত্ব গড়ার পুর্বে তার চরিত্র বিচার করে দেখো। কারণ, মানুষের জন্য সৎচরিত্রতা এক অমূল্য ধন৷ যার চরিত্র নেই, যে চরিত্রহীন, সে নিঃস্ব। সে মানুষ বাহ্যিকভাবে যতই সুন্দর ও সভ্য হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে সে অন্তঃসারশূন্য।

চরিত্রবান মানুষের এক প্রভাব আছে; যার মাধ্যমে সে অপরকে চরিত্রবান করতে পারে। তদনুরূপ দুশ্চরিত্রেরও প্রভাব কম নয়। সেও অপরকে চরিত্রহীন করতে অবশ্যই দ্বিধা করে । সুতরাং ওঠা-বসা করার সময় এ খেয়াল অবশ্যই রাখতে হবে, যাতে যুবকের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। মহান চরিত্রের উচ্চতম স্তরে অধিষ্ঠিত নবী (সা.) সৎ ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ পেশ করে বলেন, “সৎ ও অসৎ সঙ্গীর উদাহরণ হল আতর-ওয়ালা ও কামারের মত। আতর-ওয়ালা তোমাকে তার আতর উপহার দেবে, নতুবা তুমি তার নিকট থেকে আতর ক্রয় করবে, নচেৎ এমনিতেই তার নিকট থেকে সুবাস পাবে। আর কামার, হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে ফেলবে, হয় তুমি তার নিকট থেকে পাবে দুর্গন্ধ।” (বুখারী ২১০১, মুসলিম ২৬২৮ নং)

আতর-ওয়ালার পাশে বসে মন ও মগজকে যেমন আতরের সুবাসে তাজা করা যায়, তেমনি সৎ সঙ্গীর এমন সগুণাবলী আছে যে, তার মাধ্যমে নিজের জীবনকে সুন্দর ও আনন্দময় করা যায়। সৎ সঙ্গী তোমাকে এমন শিক্ষা দেবে, যা তোমার দ্বীন অথবা দুনিয়া অথবা উভয় ক্ষেত্রে যথার্থ কাজে আসবে। এমন উপদেশ ও পরামর্শ দেবে, যার মাধ্যমে তুমি তোমার জীবনে এবং মরণের পরেও উপকৃত হবে। এমন কাজের আদেশ করবে, যা করলে তোমার লাভ আছে এবং এমন কাজ হতে তোমাকে বিরত রাখবে, যে কাজে তোমার ক্ষতি ও নোকসান আছে। এমন বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব করার লাভ সুনিশ্চিত। যে বন্ধু তোমাকে গড়ে নেবে, তোমার ত্রুটি গোপন ও সংশোধন করবে, আল্লাহর আনুগত্যে সর্বদা উদ্বুদ্ধ করবে, পাপ কাজে বাধা দান করবে, তোমার ও তোমার ইজ্জত রক্ষা করবে এবং তার নেক দুআয় তুমি তোমার দুনিয়া ও আখেরাতে লাভবান হবে।

পক্ষান্তরে কামারের পাশে বসলে যেমন তার ধুয়া, কয়লা বা পুরনো লোহা পোড়ার দুর্গন্ধ, হাতুড়ী পেটার শব্দ এবং আগুনের ফিনকি ও আঙ্গার ইত্যাদি দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তেমনি অসৎ সঙ্গী ও দুরাচার বন্ধুর সংসর্গে থাকে বহুমুখী ক্ষতির আশঙ্কা ও নানাবিধ। অমঙ্গল ঘটার সংশয়। কারণ, এমন বন্ধু অসৎ কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে, সৎ কাজে বাধা দান করবে, তওবার কাজে অন্তরাল সৃষ্টি করবে, অর্থ ও স্বাস্থ্যের হানি ঘটাবে। বাড়ির ইজ্জত নষ্ট। করবে, এমন কি বন্ধুর সর্বস্ব লুটে যাওয়ার প্রয়াস চালাতে কুণ্ঠিত হবে না। অতএব হে যুবক বন্ধু! হুশিয়ার ও সচেতন থেকে এমন বন্ধুত্ব গড়া থেকে। আর হ্যাঁ, খেয়াল রেখো তোমার মান ও পজিশনের কথা।

অর্থাৎ, বন্ধুর মানে তুমি খাপ খাবে কি না তাও দেখে নিও। ইঁদুর-ওয়ালা হয়ে হাতি-ওয়ালার সাথে তোমার বন্ধুত্ব সাজে না। হাতি রাখার ঘর দিতে না পারলে তুমি তোমার বন্ধুর মন যোগাতে পারবে না, বিধায় তোমার সে বন্ধুত্ব টিকবে না। এমন উচ্চ মানের বন্ধুর বন্ধুত্ব গ্রহণের প্রয়াস চালায়ো না, যার গর্ব ও অহংকারে তুমি কষ্ট পাবে। তদনুরূপ এমন নিম্ন মানের বন্ধুর সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করো না, যার মূখতায় তোমার মন ব্যথিত হয় অথবা মান-ইজ্জত হারিয়ে যায়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ার পূর্বে ঠিক তেমনি করে ভেবে নিও, যেমন ভাব বিবাহ করার পূর্বে। বন্ধু ও স্ত্রীর অনেকটা দিক প্রায় একই। অবশ্য বন্ধু পাল্টানো যায়, কিন্তু স্ত্রী পাল্টানো গেলেও, তা মোটেই সহজ নয়। একবার জোড়া লেগে গেলে চিরদিন উপভোগ করতে হয় তার চরিত্র ও ব্যবহারের মধুরতা, নচেৎ বিষময় তিক্ততা।

অতএব ধোকা খাওয়ার পূর্বে বন্ধুকে পরখ করে নিও এবং তার বাহ্যিক আড়ম্বর ও সুশোভিত ব্যবহার তথা নতুন পরিচয়ের আচমকা-সুন্দর স্বভাব দেখে তাকে বন্ধু বলে লুফে নিও না। এক ব্যক্তি হযরত উমার (রাঃ)-কে কথা প্রসঙ্গে বলল, ‘অমুক লোকটা বড় খাটি লোক। তিনি বললেন, (তা তুমি কি করে জানলে? ওর সাথে কি কোন সময় সফর করেছ? লোকটি বলল, জী না।’ তিনি বললেন, ‘তোমার ও তার মাঝে কি কোন দিন তর্ক বা মতবিরোধ হয়েছিল? লোকটি বলল, জী না।’ তিনি বললেন, ‘ওর কাছে কি কোন দিন কিছু আমানত রেখেছিলে? লোকটি বলল, জী না। পরিশেষে তিনি বললেন, তাহলে ওর সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। আমার মনে হয় তুমি ওকে কেবল মসজিদে বসে মাথা হিলাতে দেখেছ।’ (উয়ুনুল আখবার ৩/ ১৫৮)

৬:৭২ وَ اَنۡ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اتَّقُوۡهُ ؕ وَ هُوَ الَّذِیۡۤ اِلَیۡهِ تُحۡشَرُوۡنَ ﴿

৭২. এবং সালাত কায়েম করতে ও তার তাকওয়া অবলম্বন করতে। আর তিনিই, যাঁর কাছে তোমাদেরকে সমবেত করা হবে।

وَأَنْ أَقِيْمُوْا এর সংযোগ হল لِنُسْلِمَ এর সাথে। অর্থাৎ, আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আমরা যেন বিশ্বের প্রতিপালকের অনুগত হয়ে যাই। আর আমরা যেন নামায কায়েম করি এবং তাঁকে ভয় করি। আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার পর সবচেয়ে বড় নির্দেশ নামায প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশই দেওয়া হয়েছে। এতে নামাযের গুরুত্ব সুস্পষ্ট হয়ে যায়। আর এর পর রয়েছে আল্লাহভীরুতার নির্দেশ। কারণ, নামাযের প্রতি যত্নবান হওয়া আল্লাহভীরুতা ও নম্রতা ব্যতীত সম্ভব নয়। তিনি বলেন, {وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ} বিনীতগণ ব্যতীত আর সকলের নিকট নিশ্চিতভাবে এ কঠিন। (সূরা বাক্বারাহ ৪৫)

৬:৭৩ وَ هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ بِالۡحَقِّ ؕ وَ یَوۡمَ یَقُوۡلُ کُنۡ فَیَکُوۡنُ ۬ؕ قَوۡلُهُ الۡحَقُّ ؕ وَ لَهُ الۡمُلۡکُ یَوۡمَ یُنۡفَخُ فِی الصُّوۡرِ ؕ عٰلِمُ الۡغَیۡبِ وَ الشَّهَادَۃِ ؕ وَ هُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡخَبِیۡرُ

৭৩. তিনিই যথাযথভাবে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। আর যেদিন তিনি বলবেন, ‘হও’, তখনই তা হয়ে যাবে। তার কথাই সত্য। যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে সেদিনের কর্তৃত্ব তো তারই। গায়েব ও উপস্থিত বিষয়ে তিনি পরিজ্ঞাত। আর তিনি প্রজ্ঞাময়, সবিশেষ অবহিত।

অর্থাৎ, তিনি যথা উদ্দেশ্যে ও মহান লক্ষ্যে তা সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ, এগুলোকে অনর্থক-লাভহীন (খেল-তামাশার জন্য) সৃষ্টি করেননি। বরং এক বিশেষ উদ্দেশ্যে বিশ্বজাহান সৃষ্টি করেছেন। আর তা হল, সেই আল্লাহকে স্মরণ এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন।

কুরআনের বিভিন্ন স্থানে একথা বর্ণনা করা হয়েছে যে, আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীকে যথাযথভাবে বা হকের সাথে সৃষ্টি করেছেন৷ এ বাণীটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবহ৷

এর একটি অর্থ হচ্ছে, পৃথিবী ও আকাশসমূহের সৃষ্টি নিছক খেলাচ্ছলে সাধিত হয়নি৷ এটি ঈশ্বরের বা ভগবানের লীলা নয়৷ এটি কোন শিশুর হাতের খেলনাও নয়৷ নিছক মন ভুলাবার জন্য কিছুক্ষন খেলার পর শিশু অকস্মাত একে ভেঙ্গে চুরে শেষ করে ফেলে দেবে এমনও নয়৷ আসলে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ কাজ৷ অত্যন্ত গভীর ও সূক্ষ্ম জ্ঞানের ভিত্তিতে এ কাজটি করা হয়েছে৷ এর মধ্যে নিহিত রয়েছে একটি বিরাট উদ্দেশ্য৷ এর একটি পর্যায় অতিক্রান্ত হবার পর এ পর্যায়ে যে সমস্ত কাজ হয়েছে তার হিসেবে নেয়া এবং এই পর্যায়ের কাজের ফলাফলের ওপর পরবর্তী পর্যায়ের বুনিয়াদ রাখা স্রষ্টার জন্য একান্ত অপরিহার্য৷ এ কথাটিকেই অন্যান্য জায়গায় এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: “হে আমাদের রব! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি করোনি”৷

“আমি আকাশ ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝখানে যা কিছু আছে সেগুলোকে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি”৷

অন্যত্র বলা হয়েছে:

“তোমরা কি ভেবেছো, আমি তোমাদেরকে এমনি অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে আমার দিকে ফিরিয়ে আনা হবে না”৷

দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে: আল্লাহ তাআলা বিশ্ব-জাহানের গোটা ব্যবস্থা ও অবকাঠামোকে নিরেট ও নির্ভেজাল সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷ ন্যায়নীতি, সূক্ষ্মদর্শীতা ও বিচক্ষণতা এবং সততার বিধান এর প্রতিটি জিনিসের পেছনে ক্রিয়াশীল৷ বাতিল ও অসত্যের জন্য শেকড় গাড়া ও ফলপ্রসূ হবার কোন অবকাশই এ অবকাঠামোতে নেই৷ অবশ্য বাতিলপন্থীরা যদি তাদের মিথ্যা, অন্যায় ও নিপীড়ণমূলক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে চায় তবে তাদেরকে সে জন্য চেষ্টা-সাধনা চালানোর কিছু সুযোগ আল্লাহর দিতেও পারেন-সেটা ভিন্ন কথা৷ কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে বাতিলের প্রতিটি বীজকে পৃথিবী উগরে ফেলে দেবে এবং শেষ হিসেব-নিকেশ প্রত্যেক বাতিলপন্থী দেখতে পাবে যে, এ নোংরা ও অবাঞ্ছিত বৃক্ষের চাষ করতে সে যত চেষ্টা চালিয়েছে, তার সবই বৃথা ও নিষ্ফল হয়ে গেছে৷

তৃতীয় অর্থ হচ্ছে: মহান আল্লাহ বিশ্ব-জাহানের এ সমগ্র ব্যবস্থাপনাটি হকের তথা নিরেট ও নির্ভেজাল সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং তাঁর নিজস্ব হক ও অধিকারের ভিত্তিতে তার ওপর শাসন কর্তৃত্ব চালাচ্ছেন৷ তাঁর হুকুম এ জন্য চলে যে, তিনিই তাঁর সৃষ্ট এ বিশ্ব-জাহানের ওপর রাজত্ব করার অধিকার রাখেন৷ আপাত দৃষ্টিতে যদি অন্যদের রাজত্বও এখানে চলতে দেখা যায় তাহলে তাতে প্রতারিত হয়ো না৷ প্রকৃতপক্ষে তাদের হুকুম চলে না,চলতে পারেও না৷ কারণ এ বিশ্ব-জাহানের কোন জিনিসের ওপর তাদের কর্তৃত্ব চালাবার কোন অধিকারই নেই৷

يَوْمَ তে জবর এসেছে وَاذْكُرُوا অথবা واتَّقُوا ঊহ্য ক্রিয়ার কারণে। অর্থাৎ, সেই দিনকে স্মরণ কর অথবা সেই দিনকে ভয় কর, যেদিন তাঁর كُنْ (হও) শব্দ দ্বারা তিনি যা চাইবেন, তা-ই হয়ে যাবে। এর দ্বারা যে কথাটির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা হল এই যে, হিসাব-কিতাবের এই কঠিন মুহূর্তগুলোও অতি সত্বর পার হয়ে যাবে। তবে কার জন্যে? ঈমানদারদের জন্যে। অন্যদেরকে তো এ দিনটা হাজার বছর অথবা পঞ্চাশ হাজার বছরের মত ভারী মনে হবে।

صُوْرٌ বলতে সেই শিঙ্গাকে বুঝানো হয়েছে, যার ব্যাপারে হাদীসে এসেছে যে, ইস্রাফীল ফিরিশতা (আঃ) সেটাকে মুখে নিয়ে মস্তক নত করে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁকে বলা হবে, তুমি তাতে ফুঁ দাও। (ইবনে কাসীর) আবূ দাউদ এবং তিরমিযীতে আছে যে, ‘‘সূর একটি বাঁশি, যাতে ফুঁ দেওয়া হবে। (হাদীস নং ৪৭৪২-৩২৪৪) কোন কোন উলামার মতে শিঙ্গা তিনবার ফুঁকা হবে। نَفْخَةُ الصَّعْق (যাতে সমস্ত মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে)। نَفْخَةُ الفَنَاء (যাতে সমস্ত মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে)। نَفْخَةُ الإِنْشَاء (যাতে সমস্ত মানুষ পুনর্জীবিত হয়ে যাবে)। আবার কোন কোন আলেম শেষোক্ত দু’টি ফুঁকের কথাই বলেছেন। আর আল্লাহই ভালো জানেন।

৬:৭৪ وَ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهِیۡمُ لِاَبِیۡهِ اٰزَرَ اَتَتَّخِذُ اَصۡنَامًا اٰلِهَۃً ۚ اِنِّیۡۤ اَرٰىکَ وَ قَوۡمَکَ فِیۡ ضَلٰلٍ مُّبِیۡنٍ ﴿

৭৪. আর স্মরণ করুন, যখন ইবরাহীম তার পিতা আযরকে বলেছিলেন, আপনি কি মূর্তিকে ইলাহরূপে গ্রহণ করেন? আমি তো আপনাকে ও আপনার সম্প্রদায়কে স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে দেখছি।

আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পক্ষ থেকে মুশরিকদেরকে সম্বোধন এবং প্রতিমাপূজা ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার আহবান বর্ণিত হয়েছিল। আলোচ্য আয়াতসমূহে একটি বিশেষ ভঙ্গিতে এ আহবানকেই সমর্থন দান করা হয়েছে। এ ভঙ্গি স্বভাবগতভাবেই আরবদের মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ছিলেন সমগ্র আরবের পিতামহ। তাই গোটা আরব তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সর্বদা একমত ছিল। আলোচ্য আয়াতসমূহে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর একটি তর্কযুদ্ধ উল্লেখ করা হয়েছে, যা তিনি প্রতিমাপূজা ও তারকাপূজার বিপক্ষে স্বীয় সম্প্রদায়ের সাথে করেছিলেন এবং সবাইকে একত্ববাদের শিক্ষা দান করেছিলেন। [নাযমুদ দুরার]

(২) এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পিতা আযরকে বললেন, আপনি স্বহস্তে নির্মিত স্বীয় উপাস্য স্থির করেছেন। আমি আপনাকে এবং আপনার গোটা সম্প্রদায়কে পথভ্রষ্টতায় পতিত দেখতে পাচ্ছি। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর পিতার নাম ‘আযর’ বলেই প্রসিদ্ধ। কোনও কোনও ইতিহাসবিদ তার নাম ‘তারেখ’ উল্লেখ করেছেন। তাদের মতে ‘আযর’ তার উপাধি। তবে কুরআনের বর্ণনাই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। [বাগভী]

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম নিজ গৃহ থেকে সত্য প্রচারের কাজ শুরু করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কেও অনুরূপ নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, “আর আপনি নিকট আত্মীয়দেরকে শাস্তির ভয় প্রদর্শন করুন”। সূরা আশ-শু’আরা: ২১৪] সে অনুযায়ী তিনি সর্বপ্রথম সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে সত্য প্রচারের জন্য পরিবারের সদস্যদেরকে একত্রিত করেন। [আর-রাহীকুল মাখতুম] এতে বুঝা যায় যে, পরিবারের কোন সম্মানিত যদি ভ্রান্ত পথে থাকে তবে তাকে বিশুদ্ধ পথে আহবান করা সম্মানের পরিপন্থী নয়, বরং সহানুভূতি ও শুভেচ্ছার দাবী তা-ই। আরো জানা গেল যে, সত্য প্রচার ও সংশোধনের কাজ নিকটআত্মীয়দের থেকে শুরু করা নবীগণের দাওয়াত পদ্ধতি।

এছাড়া আয়াতে ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম স্বীয় পরিবার ও সম্প্রদায়কে নিজের দিকে সম্বন্ধ করার পরিবর্তে পিতাকে বলেনঃ আপনার সম্প্রদায় পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়েছে। মুশরিক স্বজনদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহর পথে যে মহান ত্যাগ স্বীকার করেন, এ উক্তিতে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। তিনি স্বীয় কর্মের মাধ্যমে বলে দিলেন যে, ইসলামের সম্পর্ক দ্বারাই মুসলিম জাতীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়। বংশগত ও দেশগত জাতীয়তা যদি মুসলিম জাতীয়তার পরিপন্থী হয়, তবে মুসলিম জাতীয়তার বিপরীতে সব জাতীয়তাই বর্জনীয়। কুরআনুল কারীম ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর এ ঘটনা উল্লেখ করে ভবিষ্যৎ উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছে, যেন তারা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে।

বলা হয়েছে, “ইবরাহীম ও তার সঙ্গীরা যা করেছিলেন, তা উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য উত্তম আদর্শ ও অনুকরণযোগ্য। তারা স্বীয় বংশগত ও দেশগত স্বজনদেরকে পরিস্কার বলে দিয়েছিলেন যে, আমরা তোমাদের ও তোমাদের ভ্রান্ত উপাস্যদের থেকে মুক্ত। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিহিংসা ও শক্ৰতার প্রাচীর ততদিন অবস্থিত থাকবে, যতদিন তোমরা এক আল্লাহর ইবাদতে সমবেত না হও।” [সূরা আল-মুমতাহিনাহঃ ৪]

৬:৭৫ وَ کَذٰلِکَ نُرِیۡۤ اِبۡرٰهِیۡمَ مَلَکُوۡتَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لِیَکُوۡنَ مِنَ الۡمُوۡقِنِیۡنَ ﴿

৭৫. এভাবে আমরা ইবরাহীমকে আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব দেখাই, যাতে তিনি নিশ্চিত বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হন।

‘মালাকূত’ শব্দের অর্থ নিয়ে কয়েকটি মত রয়েছে। ইকরামা বলেন, এর অর্থ আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব ও মালিকানা বা কর্তৃত্ব। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এর অর্থ, আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি। মুজাহিদ বলেন, এর অর্থ, আসমান ও যমীনের নিদর্শনাবলী। [তাবারী] অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদাত করা হয়, তাদের অসারতার কথা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নিকট স্পষ্ট হওয়ার পর আল্লাহ তা’আলা তাকে আসমান ও যমীনের রাজত্ব, নিদর্শনাবলী ও বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্রপুঞ্জের পরিচালন ব্যবস্থা দেখান। [তাবারী]

৬:৭৬ فَلَمَّا جَنَّ عَلَیۡهِ الَّیۡلُ رَاٰ کَوۡکَبًا ۚ قَالَ هٰذَا رَبِّیۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَفَلَ قَالَ لَاۤ اُحِبُّ الۡاٰفِلِیۡنَ

৭৬. তারপর রাত যখন তাকে আচ্ছন্ন করল তখন তিনি তারকা দেখে বললেন, এ আমার রব। তারপর যখন সেটা অস্তমিত হল তখন তিনি বললেন, যা অস্তমিত হয় তা আমি পছন্দ করি না।

৬:৭৭ فَلَمَّا رَاَ الۡقَمَرَ بَازِغًا قَالَ هٰذَا رَبِّیۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَفَلَ قَالَ لَئِنۡ لَّمۡ یَهۡدِنِیۡ رَبِّیۡ لَاَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡقَوۡمِ الضَّآلِّیۡنَ

৭৭. তঃপর যখন তিনি চাঁদকে সমুজ্জ্বলরূপে উঠতে দেখলে তখন বললেন, ‘এটা আমার রব। যখন সেটাও অস্তমিত হল তখন বললেন, আমাকে আমার রব হিদায়াত না করলে আমি অবশ্যই পথভ্রষ্টদের শামিল হব।

৬:৭৮ فَلَمَّا رَاَ الشَّمۡسَ بَازِغَۃً قَالَ هٰذَا رَبِّیۡ هٰذَاۤ اَکۡبَرُ ۚ فَلَمَّاۤ اَفَلَتۡ قَالَ یٰقَوۡمِ اِنِّیۡ بَرِیۡٓءٌ مِّمَّا تُشۡرِکُوۡنَ

৭৮. অতঃপর যখন তিনি সূর্যকে দীপ্তিমানরূপে উঠতে দেখলেন তখন বললেন, এটা আমার রব, এটা সবচেয়ে বড়। যখন এটাও অস্তমিত হল, তখন তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর তার সাথে আমার কোন সংশ্ৰব নেই।

নবুওয়াতের দায়িত্বে সমাসীন হবার আগে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যে প্রাথমিক চিন্তাধারার সাহায্যে মহাসত্যে পৌছে গিয়েছিলেন এখানে তার অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে৷ এখানে বলা হয়েছে, সুস্থ মস্তিষ্ক, নির্ভুল চিন্তা ও স্বচ্ছল দৃষ্টিশক্তির অধিকারী এক ব্যক্তি যখন এমন এক পরিবেশে চোখ মেললেন যেখানে চারদিকে মিলকের ছড়াছড়ি, কোথাও থেকে তাওহীদের শিক্ষা লাভ করার মতো অবস্থা তাঁর নেই, তখন তিনি কিভাবে বিশ্ব প্রকৃতির নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণ এবং সেগুলোর মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তা থেকে সঠিক ও নির্ভুল যুক্তি-প্রমাণ সংগ্রহের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যে উপনীত হতে সক্ষম হলেন৷ ইতিপূর্বে ইবরাহীমের জাতির যে অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে তার ওপর একটু চোখ বুলালেই জানা যায় যে, ছোট বেলায় জ্ঞান হবার পর হযরত ইবরাহীম দেখেন তাঁর চারদিকে চন্দ্র, সুর্য ও তারকারাজির পূজার ধুম চলছে৷ তাই সত্যি এদের কেউ রব কিনা-এই প্রশ্নটি থেকে হযরত ইবরাহীমের সত্য অনুসন্ধানের সূচনা হওয়াই স্বাভাবিক ছিল৷ এ কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি নিয়ে তিনি চিন্তা-ভাবনা করেন৷ অবশেষে নিজের জাতির সমস্ত রবকে একটি অমোঘ বিধানের আওতায় বন্দী দাসানুদাসের মতো আবর্তন করতে দেখে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যাদের রব হওয়ার দাবী করা হয় তাদের কারোর মধ্যে রব হবার যোগ্যতার লেশমাত্রও নেই৷ বর মাত্র একজনই, যিনি এদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর বন্দেগী করতে সবাইকে বাধ্য করেছেন৷

যে ধরনের বাচনভংগী প্রয়োগের মাধ্যেম এ ঘটনটাটি বর্ণনা করা হয়েছে তাতে সাধারণ লোকদের মনে এক প্রকার সন্দেহ জাগে৷ বলা হয়েছে: যখন রাত হয়ে গেলো, সে একটি তারকা দেখলো আবার যখন তা ডুবে গেলো তখন একথা বললো৷ তারপর যখন চাঁদ দেখলো এবং পরে তা ডুবে গেলো তখন একথা বললো৷ এরপর সূর্য দেখলো এবং যখন তাও ডুবে গেলো তখন এ একথা বললো৷ ঘটনা বর্ণনার এ পদ্ধতি একজন সাধারণ পাঠকের মনে এ প্রশ্ন সৃষ্টি করে যে, ছোট বেলায় জ্ঞান চুক্ষু উন্মেলিত হবার পর থেকেই কি প্রতিদিন হযরত ইবরাহীম দিনের পরে রাত হতে দেখতেন না? তিনি কি প্রতিদিন সূর্য, চন্দ্র ও তারকাদের উদিত ও অস্তমিত হতে দেখতেন না? আর একথা তো সুস্পষ্ট যে, এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পরই করেছে৷ তাহলে এ ঘটনাটি এভাবে বলা হয়েছে কেন যে, রাত হলে এই দেখলেন এবং দিন হলে এই দেখলেন? যেন মনে হচ্ছে, এ বিশেষ ঘটনাটির আগে তাঁর এসব দেখার সুযোগ হয়নি৷ অথচ একথা মোটেই সত্য নয়৷ অনেকের কাছে এ সন্দেহের নিরসন ৷এমনই অসাধ্য মনে হয়েছে যে, তারা এর জবাব দেবার জন্য হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্ম ও প্রতিপালন সম্পর্কে একটি অস্বাভাবিক গল্প ফেঁদে বসা ছাড়া আর কোন উপায়ই দেখেননি৷ তাদের সেই গল্পে বলা হয়েছে: হযরত ইবরাহীমের জন্ম ও প্রতিপালন হয় একটি গূহার মধ্যে৷ সেখানে প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগে পর্যন্ত তাঁকে চন্দ্র, সূর্য, তারকার দর্শণ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়৷ অথচ কথা এখানে দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ ও পরিস্কার৷ একথা বোঝার জন্য এ ধরনের গল্প তৈরী করার কোন প্রয়োজন নেই৷ বিজ্ঞানী নিউটন সম্পর্কে বহুল প্রচলিত ঘটনা, তিনি একদিন একটি বাগানে গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখেন আকস্মাত তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, আপেলটি আকাশে না উঠে মাটিতে পড়লো কেন? এর ওপর চিন্তা-ভাবনা করতে করতে তিনি মধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কার করেন৷ প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঘটনাটির পূর্বে নিউটন কি কখনো কোন জিনিস ওপর থেকে নীচে পড়তে দেখেন নি? অবশ্যই দেখেছেন? বহুবার দেখেছেন ৷ তাহলে কি কারণে সেই একটি বিশেষ দিনে বিশেষ সময়ে আপেলটি মাটিতে পড়ার ঘটনা নিউটনের মনে এমন প্রশ্ন সৃষ্টি করে যা, ইতিপূর্বে প্রতিদিন শত শত বার এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেও তার মনে সৃষ্টি হয়নি? এর একমাত্র জওয়াব এই যে, চিন্তা-ভাবনাকারী ও অনুসন্ধানী মন সবসময় এক ধরনের পর্যবেক্ষন থেকে একইভাবে আলোড়িত হয় না৷ অনেক সময়ই এমন হতে দেখা গেছে, একটি জিনিস মানুষ ক্রমাগতভাবে দেখতে থাকে কিন্তু তার মনকে কোনভাবে নাড়া দেয় না৷ কিন্তু অন্য এক সময় সেই একই জিনিস দেখে তার মনে হঠাৎ একটি প্রশ্ন জাগে এবং তার ফলে তার চিন্তাশক্তিগুলো একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে৷ অথবা প্রথম থেকে কোন একটি বিষয়ের অনুসন্ধানে মনে খট্‌কা বা জটিলতার সৃষ্টি হয়৷ কিন্তু হঠাৎ একিদন প্রতিদিনকার বারবার দেখা একটি জিনিসের ওপর নজর পড়ার সাথে সাথেই জটিল গ্রন্থী উন্মোচনের সূত্র হাতে এসে যায় আর তারপর সবকিছু পানির মত তরল মনে হয়৷ হযরত ইবরাহীমের ঘটনাটিও এ ধরনের৷ রাত প্রতিদিন আসতো এবং চলেও যেতো৷ সুর্য, চন্দ্র, তারকা প্রতিদিন চোখের সামনে উদিত ও অস্তমিত হতো৷ কিন্তু সেটি ছিল একটি বিশেষ দিন যেদিন একটি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ হযরত ইবরাহীমের চিন্তা ও দৃষ্টিকে এমন একটি পথে পরিচালিত করে যার ফলে অবশেষে তিনি মহান আল্লাহর একত্বের (তাওহীদ) কেন্দ্রীয় সত্যে পৌছতে সক্ষম হন৷ হতে পারে হযরত ইবরাহীম (আ) প্রথম থেকে এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে আসছিলেন যে, যে বিশ্বাসের ভিত্তিতে তাঁর জাতির সমগ্র জীবন ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে তার মধ্যে কতটুকু সত্যতা আছে? আর এ অবস্থায় অকস্মাত আকাশের একটি নক্ষত্রের উদয়াস্ত তাঁর চিন্তার সমস্ত জট খুলে দিয়ে যায়৷ প্রকতৃ সত্য তাঁর সামনে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ আবার এইও হতে পারে, নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের ফলেই তাঁর মনে প্রথম চিন্তার উন্মেষ ঘটে৷

এ প্রসংগে আর একটি প্রশ্নও দেখা দেয়৷ সেটি হচ্ছে, হযরত ইবরাহীম (আ) যখন তারকা দেখে বলেন, এ আমার রব আবার যখন চাঁদ ও সূর্য দেখে তাদেরকেও নিজের রব বলে ঘোষণা দেন, সে সময় কি তিনি সাময়িকভাবে হলেও শিরকে লিপ্ত হননি? এর জওয়াব হচ্ছে, একজন সত্যসন্ধানী তাঁর সত্য অনুসন্ধানের পথে পরিভ্রমণকালে মাঝপথে যেসব মনযিলে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য থামে আসল গুরুত্ব সে মনযিনলগুলোর নয় বরং আসল গুরুত্ব হচ্ছে সে গন্তব্যের যে, দিকে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন এবং যেখানে গিয়ে তিনি অবস্থান করেন৷ মাঝখানের এ মনযিলগুলো অতিক্রম করা প্রত্যেক সত্যসন্ধানীর জন্য অপরিহার্য৷ সেখানে অবস্থান হয় অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে, অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখানে অবস্থান করা হয় না৷ মূলত এ অবস্থান হয় জিজ্ঞাসা সূচক ও প্রশ্নবোধক, সিদ্ধান্তমূলক নয়৷ অনুসন্ধানী যখন এ মনযিলগুলোর কোনটিতে অবস্থান করে বলেন, “ব্যাপারটি এমন” তখন একটি মূলত তার শেষ সিন্ধান্ত হয় না বরং তার একথা বলার উদ্দেশ্য হয়, জিজ্ঞাসা মূলক৷ অর্থাৎ “ব্যাপারটি কি এমন?” তারপর পরবর্তী অনুসন্ধানে এর নেতিবাচক জবাব পেয়ে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যান৷ তাই পথের মাঝখানে যেখানে যেখানে থামেন সেখানেই তিনি সাময়িকভাবে কুফরী বা শিরক করেন একথা সম্পূর্ণ ভুল৷ কাজেই হযরত ইবরাহীম আলাইহসি সালাম তাঁর সত্য অনুসন্ধানের পথে কোন প্রকার শিরকে লিপ্ত হননি৷

৬:৭৯ اِنِّیۡ وَجَّهۡتُ وَجۡهِیَ لِلَّذِیۡ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ حَنِیۡفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ

৭৯. আমি একনিষ্ঠভাবে তার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি যিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।

আমি তোমাদের এসব মুশরিকসুলভ ধারণা থেকে মুক্ত। তোমরা আল্লাহ তা’আলার সৃষ্ট জীবকেই আল্লাহর অংশীদার স্থির করেছ। অতঃপর এ স্বরূপ উদঘাটন করলেন যে, আমার ও তোমাদের পালনকর্তা এসব সৃষ্টবস্তুর মধ্যে কোনটিই হতে পারে না। এরা স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার্থে অন্যের মুখাপেক্ষী এবং প্রতি মুহুর্তে উত্থান-পতন, উদয়-অস্ত ইত্যাদি পরিবর্তনের আবর্তে নিপতিত। বরং সেই সত্তা আমাদের সবার রব, যিনি নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে সৃষ্ট সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আমি আমার চেহারা তোমাদের স্বনির্মিত প্রতিমা এবং পরিবর্তন ও প্রভাবের আবর্তে নিপতিত নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে ফিরিয়ে আল্লাহ ‘ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু’-এর দিকে করে নিয়েছি এবং আমি তোমাদের ন্যায় মুশরিক বা অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই।

এ বিতর্কে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নবীসুলভ প্রজ্ঞা ও উপদেশ প্রয়োগ করে এমন এক পন্থা অবলম্বন করলেন, যাতে প্রত্যেক সচেতন মানুষের মন ও মস্তিস্ক প্রভাবান্বিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সত্যকে উপলব্ধি করে ফেলে। মনে রাখতে হবে যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ তর্ক ছিল প্রতিপক্ষকে নিজের মত ও পথের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে। তিনি সম্পূর্ণ জেনে-বুঝেই প্রতিপক্ষের দাবী খণ্ডন করার জন্য এ প্রজ্ঞার আশ্রয় নিয়েছিলেন, যাতে তারা উপস্থিত সকল বস্তুর ইবাদতের অসারতা বুঝতে সক্ষম হয়। [দেখুন, সা’দী]

৬:৮০ وَ حَآجَّهٗ قَوۡمُهٗ ؕ قَالَ اَتُحَآجُّوۡٓنِّیۡ فِی اللّٰهِ وَ قَدۡ هَدٰىنِ ؕ وَ لَاۤ اَخَافُ مَا تُشۡرِکُوۡنَ بِهٖۤ اِلَّاۤ اَنۡ یَّشَآءَ رَبِّیۡ شَیۡئًا ؕ وَسِعَ رَبِّیۡ کُلَّ شَیۡءٍ عِلۡمًا ؕ اَفَلَا تَتَذَکَّرُوۡنَ

৮০. আর তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হল। তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছো? অথচ তিনি আমাকে হিদায়াত দিয়েছেন। আমার রব অন্য কোন ইচ্ছে না করলে তোমরা যাকে তাঁর শরীক কর তাকে আমি ভয় করি না, আমার রব জ্ঞান দ্বারা সবকিছু পরিব্যাপ্ত করে আছেন, তবে কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?

জাতিরা যখন তাওহীদের এ ওয়ায-নসীহত শুনলো যাতে তাদের বাতিল উপাস্যগুলোর খন্ডনও ছিল, তখন তারাও তাদের প্রমাণাদি পেশ করতে আরম্ভ করল। আর এ থেকে জানা যায় যে, মুশরিকরাও তাদের শিরকের উপর কোন কোন দলীল বানিয়ে রাখত। বর্তমানেও এ জিনিস লক্ষ্য করা যায়। শিরকীয় আকীদা পোষণকারী যত দল আছে, সকলেই তাদের জনতাকে সন্তুষ্ট করা ও রাখার জন্য এমন ‘অবলম্বন’ খুঁজে রেখেছে, যাকে তারা ‘দলীল’ মনে করে অথবা যার মাধ্যমে কমসে-কম মিথ্যার জালে বন্দী জনগণকে ঐ জালেই ফাঁসিয়ে রাখা সম্ভব হয়।

কুরআনের মূল আয়াতে ‘তাযাক্কুর’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে৷ এর সঠিক অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি গাফলতি ও ভুলে মধ্যে ডুবে ছিল তার হঠাৎ গাফলতি থেকে জেগে ওঠে যে, জিনিস থেকে গাফেল হয়ে ছিল তার স্মরণ করা৷ তাই “এরপরও কি তোমাদের চেতনার উদয় হবে না” হযরত ইবরাহীমের বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, তোমরা যা কিছু করছো তোমাদের আসল ও যথার্থ রব সে সম্পর্কে মোটেই অনবহিত নন৷ তিনি সব জিনিসের বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন৷ কাজেই এ সত্য অবগত হয়েও কি তোমরা সচেতন হবে না?

৬:৮১ وَ کَیۡفَ اَخَافُ مَاۤ اَشۡرَکۡتُمۡ وَ لَا تَخَافُوۡنَ اَنَّکُمۡ اَشۡرَکۡتُمۡ بِاللّٰهِ مَا لَمۡ یُنَزِّلۡ بِهٖ عَلَیۡکُمۡ سُلۡطٰنًا ؕ فَاَیُّ الۡفَرِیۡقَیۡنِ اَحَقُّ بِالۡاَمۡنِ ۚ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ

৮১. আর তোমরা যাকে আল্লাহর শরীক কর আমি তাকে কিরূপে ভয় করব? অথচ তোমরা ভয় করছ না যে, তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক করছ এমন কিছু, যার পক্ষে তিনি তোমাদের কাছে কোন প্রমাণ নাযিল করেন নি। কাজেই যদি তোমরা জান তবে বল, দু’ দলের মধ্যে কোন দল নিরাপত্তা লাভের বেশী হকদার।

অর্থাৎ, মু’মিন ও মুশরিকদের মধ্যে। মু’মিনদের কাছে তো তাওহীদের প্রচুর দলীল বিদ্যমান রয়েছে। পক্ষান্তরে মুশরিকদের কাছে আল্লাহর অবতীর্ণ করা কোন দলীল নেই। তাদের কাছে আছে কেবল বাতিল ধারণাসমূহ এবং (বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন) অপ্রাসঙ্গিক অপব্যাখ্যা। এ থেকেই অনুমান করা যেতে পারে যে, নিরাপত্তা ও মুক্তি পাওয়ার যোগ্য কারা হবে?

يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُم بُرْهَانٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَأَنزَلْنَا إِلَيْكُمْ نُورًا مُّبِينًا [٤:١٧٤]فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَاعْتَصَمُوا بِهِ فَسَيُدْخِلُهُمْ فِي رَحْمَةٍ مِّنْهُ وَفَضْلٍ وَيَهْدِيهِمْ إِلَيْهِ صِرَاطًا مُّسْتَقِيمًا [٤:١٧٥]-

হে মানুষ! তোমার প্রভুর পক্ষ হতে তোমাদের নিকট প্রমাণ এসেছে এবং আমি তোমাদের জন্য উজ্জ্বল আলো নাযিল করেছি যা তোমাদের সুস্পষ্ট পথ দেখায়। অতএব যারা আল্লাহর উপর ঈমান আনবে এবং তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করবে তিনি তাদেরকে নিজের দয়া ও অনুগ্রহের ছায়ায় আশ্রয় দিবেন এবং সঠিক পথে তাঁর দিকে পরিচালিত করবেন। (সূরা নিসাঃ ১৭৪-৫)

﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ﴾

৮২) আসলে তো নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা তাদেরই জন্য এবং সত্য-সরল পথে তারাই পরিচালিত যারা ঈমান এনেছে এবং যারা নিজেদের ঈমানকে জুলুমের সাথে মিশিয়ে ফেলেনি৷

এ সমগ্র ভাষনটি একথার সাক্ষ্য বহন করে যে, হযরত ইবরাহীমের জাতি পৃথিবী ও আকাশের স্রষ্টা মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না বরং তাদের আসল অপরাধ ছিল তারা আল্লাহর গুণাবলি এবং তার প্রভুত্বের অধিকারে অন্যদের শরীক করতো৷ প্রথম হযরত ইবরাহীম নিজেই বলছেনঃ তোমরা আল্লাহর সাথে অন্যদের শরীক করছো৷ দ্বিতীয়ত নিজের জাতিকে সম্বোধন করে আল্লাহর কথা বলা জন্য হযরত ইবরাহীম যে বর্ণনা পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন এ ধরনের পদ্ধতি একমাত্র এমন লোকদের জন্য অবলম্বিত হয় যারা আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করে না৷ কাজেই কুরআনের যেসব তাফসীরকার এখানে এবং কুরআনের অন্যান্য জায়গায় হযরত ইবরাহীম প্রসংগে কুরআনের বক্তব্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একথা বলেছেন যে, হযরত ইবরাহীমের জাতি আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকারকারী বা আল্লাহার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনবহিত ছিল এবং কেবমাত্র নিজেদের মাবুদদেরকেই ইলাহী ক্ষমতার পূর্ণাঙ্গ অধিকারী মনে করতো, তাদের বক্তব্য সঠিক নয়৷

শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা নিজেদের ঈমানকে জুলুমের সাথে মিশিয়ে ফেলেনি”৷ এর মধ্যে জুলুম শব্দটি থেকে কোন কোন সাহাবীর ভুল ধারণা হয়েছিল যে, বোধ হয় এর অর্থ গোনাহ, তাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লাম নিজেই এর ব্যাখ্যা করে বলেছেন: আসলে এখানে জুলুম মানে শিরক৷ কাজেই এ আয়াতের অর্থ দাঁড়ালো: যারা আল্লাহকে মেনে নেবে এবং নিজেদের এ মেনে নেবার মধ্যে কোন প্রকার মুশরিকী বিশ্বাস ও কর্মের অনুপ্রবেশ ঘটাবে না, নিরাপত্তা ও প্রশান্তি একমাত্র তারাই লাভ করবে এবং একমাত্র তারাই সত্য সরল পথে অধিষ্ঠিত থাকবে৷

এ প্রসঙ্গে আর একটি মজার কথা জানাও প্রয়োজন৷ এ ঘটনাটি হচ্ছে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মহান নবুওয়াতী জীবনের সূচনা বিন্দু৷ কিন্তু বাইবেলে এটি স্থান পেতে পারেনি৷ তবে তালমূদে এর উল্লেখ আছে৷ সেখানে এমন দু’টি কথা আছে, যা কুরআন থেকে ভিন্ন ৷ একটি হচ্ছে, সেখানে হযরত ইবরাহীমের সত্য অনুসন্ধানের সূচনা করা হয়েছে সূর্য থেকে এবং তারকা পর্যন্ত পৌছার পর তাকে আল্লাহতে পৌছিয়ে শেষ করা হয়েছে৷ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তালমূদের বর্ণনা মতে হযরত ইবরাহীম সূর্যকে “এ আমার রব” বলার সাথে সাথে তার বন্দনাও করে ফেলেন৷ আর এভাবে চাঁদকে “এ আমার রব” বলার পর তারও বন্দনা করেন৷

এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী বলা হচ্ছে- যুলুমের অর্থ শির্ক- সাধারণ গোনাহ নয়। কিন্তু ظلم শব্দটি نكرة ব্যবহার করায় আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী এর অর্থ ব্যাপক হয়ে গেছে। অর্থাৎ যাবতীয় শির্কই এর অন্তর্ভুক্ত। يَلْبِسُوا শব্দটি لَبْسٌ থেকে উদ্ভুত। এর অর্থ পরিধান করা কিংবা মিশ্রিত করা। আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, যে ব্যক্তি স্বীয় বিশ্বাসের সাথে কোন প্রকার শির্ক মিশ্রিত করে তার কোন নিরাপত্তা নেই। এ আয়াত দ্বারা বুঝা গেল যে, খোলাখুলিভাবে মুশরিক বা মূর্তিপূজারী হয়ে যাওয়াই শুধু শির্ক নয়, বরং সে ব্যক্তিও মুশরিক, যে কোন প্রতিমার পূজা করে না এবং ইসলামের কালেমা উচ্চারণ করে; কিন্তু কোন ফিরিশতা কিংবা রাসূল কিংবা ওলীকে আল্লাহর কোন কোন বিশেষ গুণে অংশীদার মনে করে বা আল্লাহকে যা দিয়ে ইবাদাত করা হয় তাদেরকে তেমন কিছু দিয়ে ইবাদাত করে।

সুতরাং জনসাধারণের মধ্যে যারা কোন পীর, জ্বিন, ওলী বা মাযার ইত্যাদিকে মনোবাঞ্ছা পূরণকারী বলে বিশ্বাস করে এবং কার্যতঃ মনে করে যে, আল্লাহর ক্ষমতা যেন তাদেরকে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই মুশরিক। তারা আল্লাহর রুবুবিয়াতে শির্ক করল। অনুরূপভাবে যারা কবরবাসী, ওলী, মাযার, জ্বিন ইত্যাদিকে আহ্বান করে, সিজদা করে, সাহায্য চায়, মান্নত করে, তাদের উদ্যেশ্যে যবেহ করে- তারা সবাই মুশরিক। তাদের নিরাপত্তা নেই। তারা আল্লাহর উলুহিয়াতে শির্ক করল এবং তাওবা না করে মারা গেলে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকবে।

অর্থাৎ শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও নিশ্চিত তারাই হতে পারে, যারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে, তারপর সে ঈমানের সাথে কোনরূপ যুলুমকে মিশ্রিত করেনি। হাদীসে আছে, এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম চমকে উঠেন এবং আরয করেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পাপের মাধ্যমে নিজের উপর যুলুম করেনি? এ আয়াতে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ হওয়ার জন্য বিশ্বাসের সাথে যুলুমকে মিশ্রিত না করার শর্ত বর্ণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের মুক্তির উপায় কি?

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হওনি। আয়াতে ‘যুলুম’ বলতে শির্ককে বোঝানো হয়েছে। দেখ, অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেন, (إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ) অর্থাৎ “নিশ্চিত শির্ক বিরাট যুলুম”। [বুখারীঃ ৪৬২৯, ৬৯১৮] কাজেই আয়াতের অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে, অতঃপর আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী এবং তার ইবাদাতে কাউকে অংশীদার স্থির না করে, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথ প্রাপ্ত।

আয়াতে এখানে ‘যুলম’ বলতে শিরককে বুঝানো হয়েছে। যেমন হাদীসে এসেছে যে, যখন এই আয়াত অবতীর্ণ হল, তখন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যুলুমের সাধারণ অর্থ (অবজ্ঞা, ত্রুটি, পাপ এবং অত্যাচার ইত্যাদি) মনে করে বড়ই অস্থির হয়ে পড়লেন এবং রসূল (সাঃ)-এর কাছে এসে বলতে লাগলেন, أَيُّنَا لَمْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ‘আমাদের মধ্যে এমন কেই বা আছে, যে যুলুম করেনি?’ তখন রসূল (সাঃ) বললেন, ‘‘এ থেকে উদ্দেশ্য সে যুলুম নয়, যেটা তোমরা মনে করছ, বরং এ থেকে উদ্দেশ্য শিরক। যেমন, লুকমান (আঃ) তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, {إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ} (لقمان: ১৩) ) ‘‘অবশ্যই শিরক হল বড় যুলুম।’’ (সহীহ বুখারীঃ তাফসীর সূরা আনআম)

সাহাবী উবাদা ইবনে সামেত (রা:) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল (স:) এরশাদ করেছেন,

من شهد أن لا اله إلا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده ورسوله وأن عيسى عبد الله ورسوله وكلمته ألقاها إلى مريم وروح منه، والجتة حق والنار حق أدخله الله الجنة على ما كان من العمل. (أخرجاه)

‘‘যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দান করল যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরিক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। তিনি তাঁর এমন এক কালিমা যা তিনি মরিয়াম (আঃ) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তিনি তাঁরই পক্ষ থেকে প্রেরিত রুহ বা আত্মা। জান্নাত সত্য জাহান্নাম সত্য। সে ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন, তার আমল যাই হোক না কেন। (বুখারি ও মুসলিম)

বিখ্যাত সাহাবী আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘আমি রাসূল (স:) কে এ কথা বলতে শুনেছি,

قال الله تعالى يابن آدم لو أتيتني بقراب الأرض خطايا ثم لقيتني لا تشرك بى شيئا لأتيتك بقرابها مغفرة. (ترمذي و حسنه)

‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘‘হে আদম সন্তান, তুমি দুনিয়া ভর্তি গুনাহ নিয়ে যদি আমার কাছে হাজির হও, আর আমার সাথে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করো, তাহলে আমি দুনিয়া পরিমাণ মাগফিরাত নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসবো। (তিরমিজী)

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন,

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِحَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴿النحل:120﴾

‘‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম পালনকারী একটি উম্মত বিশেষ। এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না।’’ (নাহলঃ১২০)

আমার সম্মুখে সমস্ত জাতিকে উপস্থাপন করা হলো। তখন আমি এমন একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে। এরপর আরো একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে মাত্র দু’জন লোক রয়েছে। আবার এমন একজন নবীকে দেখতে পেলাম যার সাথে কোন লোকই নেই। ঠিক এমন সময় আমার সামনে এক বিরাট জনগোষ্ঠী পেশ করা হলো। তখন আমি ভাবলাম, এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হলো এরা হচ্ছে মূসা (আঃ) এবং তাঁর জাতি।

এরপর আরো একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর দিকে আমি তাকালাম। তখন আমাকে বলা হলো, এরা আপনার উম্মত। এদের মধ্যে সত্তুর হাজার লোক রয়েছে যারা বিনা হিসেবে এবং বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। একথা বলে তিনি দরবার থেকে উঠে বাড়ীর অভ্যন্তরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা ঐ সব ভাগ্যবান লোকদের ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করে দিলো। কেউ বললো, তারা বোধ হয় রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সহচার্য লাভকারী ব্যক্তিবর্গ। আবার কেউ বললো, তারা বোধ হয় ইসলাম পরিবেশে অথবা মুসলিম মাতা-পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে আর আল্লাহর সাথে তারা কাউকে শরিক করেনি। তারা এ ধরনের আরো অনেক কথা বলাবলি করলো। অতঃপর রাসূল সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে উপস্থিত হলে বিষয়টি তাঁকে জানানো হলো। তখন তিনি বললেন,

هم الذين لا يسترقون ولا يتطيرون ولا يكتون وعلى ربهم يتوكلون

‘‘তারা হচ্ছে ঐ সব লোক যারা ঝাড়-ফুক করে না। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করে না। শরীরে সেক বা দাগ দেয় না। আর তাদের রবের উপর তারা ভরসা করে।’’ একথা শুনে ওয়াকাশা বিন মুহসিন দাড়িয়ে বললো, আপনি আমার জন্য দোয়া করুন যেন আল্লাহ তাআলা আমাকে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দলভূক্ত করে নেন। তিনি বললেন, আমি দোয়া করলাম, ‘‘তুমি তাদের দলভুক্ত’’। অতঃপর অন্য একজন লোক দাড়িয়ে বললো, আল্লাহর কাছে আমার জন্যও দোয়া করুন যেন তিনি আমাকেও তাদের দলভুক্ত করে নেন। তিনি বললেন, ‘‘তোমার পূর্বেই ওয়াকাশা সে সুযোগ নিয়ে গেছে।

ছোট শির্ক ও বড় শির্কের মধ্যে পার্থক্য

ছোট শির্ক ও বড় শিরকের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পার্থক্য রয়েছে যা নিম্নরূপ:

১. বড় শির্ক তাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে ইসলামের গন্ডী থেকেই সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়। ঠিক এরই বিপরীতে ছোট শির্ক এমন নয় বটে। তবে তা কবীরা গুনাহ্ তথা মহা পাপ অপেক্ষা আরো জঘন্যতম।

২. বড় শির্ক তাতে লিপ্ত ব্যক্তির সকল নেক আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। ঠিক এরই বিপরীতে ছোট শির্ক শুধু সে আমলকেই বিনষ্ট করে যে আমলে এ জাতীয় শির্কের সংমিশ্রণ রয়েছে। অন্য আমলকে নয়।

৩. বড় শির্ক তাতে লিপ্ত ব্যক্তির জান ও মাল তথা সার্বিক নিরাপত্তা বিনষ্ট করে দেয়। ঠিক এরই বিপরীতে ছোট শির্ক এমন নয়।

৪. বড় শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি চিরকালের জন্য জাহান্নামী হয়ে যায়। জান্নাত তার জন্য হারাম। তবে ছোট শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি এমন নয়। বরং সে কিছু দিনের জন্য জাহান্নামে গেলেও পরবর্তীতে তাকে জাহান্নাম থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়া হবে।

৫. বড় শির্কে লিপ্ত ব্যক্তির সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক রাখা যাবে না। বরং তার সাথে সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। যদিও সে নিকট আত্মীয় হোক না কেন। তবে ছোট শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি এমন নয়। বরং তার সাথে সম্পর্ক ততটুকুই রাখা যাবে যতটুকু তার ঈমান রয়েছে। তেমনিভাবে তার সাথে ততটুকুই সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে যতটুকু তার মধ্যে শির্ক রয়েছে।

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান ও তাফহিমুল কুর’আন