সূরা আনআমঃ ৩য় রুকু (২১-৩০)আয়াত সমূহ
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
৬:২১ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا اَوۡ کَذَّبَ بِاٰیٰتِهٖ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الظّٰلِمُوۡنَ
২১. যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে বা তার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে, তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? নিশ্চয় যালিমরা সাফল্য লাভ করতে পারে না।
অর্থাৎ এ মর্মে দাবী করে যে, প্রভুত্বের ব্যাপারে আরো অনেক সত্তা আল্লাহর সাথে শরীক৷ তাদের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার গুণাবলী এবং তারা মানুষের সামনে তাদের বন্দেগী লাভ করার জন্য নিজেদেরকে উপস্থাপন করার যোগ্যতা রাখে৷ তাছাড়া আল্লাহ অমুক সত্তাকে নিজের বিশেষ নিকটতম হিসেবে গণ্য করেছেন এবং তিনিই এ হুকুম দিয়েছেন অথবা কমপক্ষে তাদের সাথে ইলাহসুলভ গুণাবলী সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে সম্মত রয়েছেন এবং আল্লাহর সাথে বান্দার যে ধরনের আচার-আচরণ করা উচিত তাদের সাথেও সে ধরনের আচরণ করতে হবে-কারোর এ জাতীয় কথা বলাও আল্লাহর প্রতি এক ধরনের মিথ্যা দোষারোপ৷
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেছে তার ওপর আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার আবাস জাহান্নাম ৷ আর এ ধরনের জালেমদের কোন সাহায্যকারী নেই৷ ৫ঃ৭২ মায়েদাঃ৭২
হে মুহাম্মাদ ! … এরা তোমাকে মিথ্যা বলে না বরং এ জালেমরা আসলে আল্লাহর আয়াতকেই অস্বীকার করছে৷ ৬ঃ৩৩ আন’আমঃ৩৩
আর সে ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে হবে যে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ রটায় অথবা বলে আমার কাছে অহী এসেছে অথচ তার ওপর কোন অহী নাযিল করা হয়নি অথবা যে আল্লাহর নাযিল করা জিনিসের মোকাবিলায় বলে, আমিও এমন জিনিস নাযিল করে দেখিয়ে দেবো ? ৬ঃ৯৩
আর কে তার চেয়ে বড় জালেম, যাকে তার রবের আয়াত শুনিয়ে উপদেশ দেয়ার পর সে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং সেই খারাপ পরিণতির কথা ভুলে যায় যার সাজ-সরঞ্জাম সে নিজের জন্য নিজের হাতে তৈরি করেছে ? 18:57 কাহফঃ৫৭
১৬. আল্লাহর নিদর্শনাবলী বলতে এমন সব নিদর্শন বুঝানো হয়েছে যেগুলো মানুষের নিজের সত্তার মধ্যে এবং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের মধ্যে ছড়িয়ে রয়েছে, নবী-রসূলগনের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে যেগুলোর প্রকাশ ঘটেছে এবং যেগুলো আসমানী কিতাবসমূহের মধ্যে পেশ করা হয়েছে৷ এ সমস্ত নিদর্শন একটি মাত্র সত্যের প্রতিই মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে৷ সে সত্যটি হচ্ছে, এ সৃষ্টিজগতের বুকে যা কিছু অস্তিত্বমান তার মধ্যে বিধাতা ও মনিব মাত্র একজনই এবং বাকি সবাই প্রজা ও বান্দা৷ এখন যে ব্যক্তি এ সমস্ত নিদর্শনের মোকাবিলায় প্রকৃত ও যথার্থ সাক্ষ-প্রমাণ ছাড়াই, কোন জ্ঞান, প্রত্যক্ষ দর্শন ও কোন প্রকার অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই নিছক আন্দাজ-অনুমান বা পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণের ভিত্তিতে অন্যদের সাথে উপাস্য ও পূজনীয় হবার গুণাবলী সংযুক্ত করে এবং আল্লাহ যেসব অধিকার এককভাবে লাভ করেন, তাদেরকে সেগুলোর যোগ্য গণ্য করে, তাদের চেয়ে বড় জালেম আর কেউ হতে পারে না৷ তারা সুস্পষ্ট ও জাজ্জ্বল্যমান সত্যের প্রতি অবিচার ও জুলুম করছে৷ তারা নিজেদের নফসের ওপর জুলুম করছে৷ তারা এ ভ্রান্ত মতাদর্শের ভিত্তিতে বিশ্ব-জাহানের যেসব জিনিসের সাথে সম্পর্ক ও সংযোগ স্থাপন করে এবং তাদেরকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে তাদের প্রত্যেকের সাথে জুলুম করছে৷
৬:২২ وَ یَوۡمَ نَحۡشُرُهُمۡ جَمِیۡعًا ثُمَّ نَقُوۡلُ لِلَّذِیۡنَ اَشۡرَکُوۡۤا اَیۡنَ شُرَکَآؤُکُمُ الَّذِیۡنَ کُنۡتُمۡ تَزۡعُمُوۡنَ
২২. আর স্মরণ করুন, যেদিন আমরা তাদের সবাইকে একত্র করব, তারপর যারা শির্ক করেছে তাদেরকে বলব, যাদেরকে তোমরা আমার শরীক মনে করতে, তারা কোথায়?
৬:২৩ ثُمَّ لَمۡ تَکُنۡ فِتۡنَتُهُمۡ اِلَّاۤ اَنۡ قَالُوۡا وَ اللّٰهِ رَبِّنَا مَا کُنَّا مُشۡرِکِیۡنَ
২৩. তারপর তাদের এ ছাড়া বলার অন্য কোন অজুহাত থাকবে না, আমাদের রব আল্লাহর শপথ! আমরা তো মুশরিকই ছিলাম না।
এখানে একটি সর্ববৃহৎ পরীক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে যা হাশরের ময়দানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর সামনে অনুষ্ঠিত হবে। বলা হয়েছে ঐ দিনটিও স্মরণ যোগ্য, যেদিন আমরা সবাইকে অর্থাৎ মুশরিক ও তাদের তৈরী করা উপাস্যসমূহকে একত্রিত করব। অতঃপর আমরা তাদেরকে প্রশ্ন করব যে, তোমরা যেসব উপাস্যকে আমার অংশীদার, স্বীয় স্বীয় অভাব পূরণকারী ও বিপদ বিদূরণকারী মনে করতে, আজ তারা কোথায়? তারা তোমাদের সাহায্য করে না কেন? হাশরের মাঠে একত্রিত সবাই তখন তারা সে সব উপাস্যদের থেকে নিজদেরকে বিমুক্ত ঘোষণা করবে এবং বলবে, আল্লাহর শপথ আমরা তো মুশরিকই ছিলাম না। এভাবে তারা বাতিল ও মিথ্যা কথা বলবে এবং ওযর-আপত্তি পেশ করতে চেষ্টা করবে। [তাবারী, কুরতুবী, মুয়াসসার, আইসারুত তাফসীর]
এ আয়াতে তাদের উত্তরকে فِتْنَةُ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এ শব্দটি কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
পরীক্ষার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তখন আয়াতের অর্থ হবে, তাদের পরীক্ষায় তারা উপরোক্ত উত্তর দিবে।
এ অর্থে তাদের পরীক্ষার উত্তরকেই পরীক্ষা বলা হয়েছে।
আবার শব্দটির অন্য অর্থ হতে পারে, তাদের ফিতনার শাস্তি। তখন ফিতনা অর্থ কুফর ও শির্ক। অর্থাৎ তাদের কুফর ও শির্কের শাস্তি তাই হবে যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। কাতাদা বলেন, এখানে ফিতনা বলে তাদের ওযর আপত্তি পেশ করাকে বোঝানো হয়েছে। [কুরতুবী]
তাছাড়া ফিতনা শব্দটি কারো প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এ অর্থের উদ্দেশ্য এই যে, এরা পৃথিবীতে এসব মূর্তি ও স্বহস্ত নির্মিত উপাস্যদের প্রতি আসক্ত ছিল, স্বীয় অর্থ-সম্পদ এদের জন্যই উৎসর্গ করত। কিন্তু আজ সব ভালবাসা ও আসক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং এ ছাড়া তাদের মুখে কোন উত্তর যোগাচ্ছে না। কাজেই তাদের থেকে নির্লিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন হওয়ারই দাবী করে বসল। [বাগভী]
তাদের উত্তরে একটি বিস্ময়কর বিষয় এই যে, কেয়ামতের ভয়াবহ ও লোমহর্ষক দৃশ্যাবলী এবং রাব্বুল আলামীন-এর শক্তি-সামর্থ্যের অভাবনীয় ঘটনাবলী দেখার পর তারা কোন সাহসে রাব্বুল আলামীন-এর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নির্জলা মিথ্যা বলবে! তাও এমন বলিষ্ঠ চিত্তে যে, আল্লাহর মহান সত্তার কসম খেয়ে বলবে যে, আমরা মুশরিক ছিলাম না। অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এর উত্তরে বলেনঃ তাদের এ উক্তি বিবেক-বুদ্ধি ও পরিণামদর্শিতার উপর ভিত্তিশীল নয়, বরং ভয়ের আতিশয্যে হতবুদ্ধিতার আবেশে মুখে যা এসেছে, তাই বলেছে।
কিন্তু হাশরের সাধারণ ঘটনাবলী ও অবস্থা চিন্তা করলে এ কথাও বলা যায় যে, আল্লাহ্ তাআলা তাদের পূর্ণ অবস্থা দৃষ্টির সামনে আনার জন্য এ শক্তিও দিয়েছেন যে, তারা পৃথিবীর মত অবাধ ও মুক্ত পরিবেশে যা ইচ্ছা বলুক- যাতে কুফর ও শির্কের সাথে সাথে তাদের এ দোষটিও হাশরবাসীদের জানা হয়ে যায় যে, তারা মিথ্যা ভাষণে অদ্বিতীয় পটু, এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও তারা মিথ্যা বলতে দ্বিধা করে না। কুরআনুল কারীমের অপর আয়াতে বলা হয়েছে যে,
তুমি কি তাদের দেখনি যারা এমন এক গোষ্ঠীকে বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে যারা আল্লাহর গযবে নিপতিত৷ তারা তোমাদেরও নয়, তাদেরও নয়৷ তারা জেনে ও বুঝে মিথ্যা বিষয় কসম করে। আল্লাহ তাদের জন্য কঠিন শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন৷ তারা যা করেছে তা অত্যন্ত মন্দ কাজ৷ তারা নিজেদের কসমকে ঢাল বানিয়ে রেখেছে৷ এর আড়ালে থেকে তারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বাধা দেয়৷ এ কারণে তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাকর আযাব৷ আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের অর্থ-সম্পদ যেমন কাজে আসবে না, তেমনি সন্তান-সন্তুতিও কোন কাজে আসবে না৷ তারা দোযখের উপযুক্ত, সেখানেই তারা চিরদিন থাকবে৷ যেদিন আল্লাহ তাদের সবাইকে জীবিত করে উঠাবেন সেদিন তাঁর সামনেও তারা ঠিক সেভাবে কসম করবে যেমন তোমাদের সামনে কসম করে থাকে এবং মনে করবে এভাবে তাদের কিছু কাজ অন্তত হবে৷ ভাল করে জেরে রাখো, তারা যারপর নাই মিথ্যাবাদী৷ শয়তান তাদের ওপর চেপে বসেছে এবং তাদের অন্তর থেকে আল্লাহর স্মরণ মুছে দিয়েছে৷ তারা শয়তানের দলভুক্ত লোক৷ সাবধান! শয়তানের দলভুক্ত লোকেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে৷ সূরা আল-মুজাদালাহ ১৪-১৯
সূরা ইয়াসীনে বলা হয়েছেঃ “আমি আজ এদের মুখে মোহর মেরে দেব, এদের হাত কথা বলবে আমার সাথে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে এদের কৃতকর্মের।” [ইয়াসীনঃ ৬৫]
অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(وَلَا يَكْتُمُونَ اللَّهَ حَدِيثًا) অর্থাৎ “আর তারা আল্লাহ হতে কোন কথাই গোপন করতে পারবে না।” [সূরা আন-নিসাঃ ৪২] আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা-এর মতে এর অর্থ এই যে, প্রথমে তারা খুব মিথ্যা বলবে এবং মিথ্যা শপথ করবে, কিন্তু স্বয়ং তাদের হস্ত-পদ যখন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, তখন কেউ ভুল কথা বলতে সাহসী হবে না। মহা বিচারপতির আদালতে সম্পূর্ণ মুক্ত পরিবেশে আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দেয়া হবে। পৃথিবীতে যেভাবে সে মিথ্যা বলত, তখনো তার মিথ্যা বলার এ ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া হবে না। কেননা, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তার মিথ্যার আবরণ স্বয়ং তার হস্তপদের সাক্ষ্য দ্বারা উন্মোচিত করে দেবেন। ফলে তারা কোন কিছুই গোপন করতে সমর্থ হবে না। [তাবারী; কুরতুবী; ইবন কাসীর]
মৃত্যুর পর কবরে মুনকীর-নকীর ফিরিশতাদ্বয়ের সামনে প্রথম পরীক্ষা হবে। এ পরীক্ষা সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছেঃ মুনকীর-নকীর যখন কাফেরকে জিজ্ঞেস করবে, مَنْ رَبُّكَ، وَمَا دِينُكَ، وَمَنْ نَبِيُّكَ অর্থাৎ তোমার রব কে, তোমার দ্বীন কি? তোমার নবী কে? কাফের বলবেঃ هٰاهْ هٰاهْ لاٰ أدرِي অর্থাৎ হায়! হায়!! আমি কিছুই জানি না! এর বিপরীতে মুমিন বলবে, আমার রব আল্লাহ, আমার দ্বীন ইসলাম এবং আমার নবী মুহাম্মাদ। [আবু দাউদ: ৪৭৫৩] এতে বুঝা যায় যে, এ পরীক্ষায় কেউ মিথ্যা বলার ধৃষ্টতা দেখাতে পারবে না। নতুবা কাফেরও মুমিনের ন্যায় উত্তর দিতে পারতো।
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তা’আলা বান্দার সাথে হাশরের মাঠের সাক্ষাতে বলবেন, হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মানিত করিনি?
তোমাকে নেতা বানাইনি? তোমাকে বিয়ে-শাদী দেইনি? তোমার জন্য ঘোড়া উট করায়ত্ত্ব করে দেইনি? তোমাকে নেতৃত্ব দিতে ও আরামে ঘুরতে ফিরতে দেইনি। তখন সে বলবে, হ্যাঁ, তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি কি বিশ্বাস করতে যে, আমার সাথে তোমার সাক্ষাত হবে? সে বলবে, না। তখন তিনি বলবেন, আজ আমি তোমাকে ছেড়ে যাব যেমন তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে।
তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তির সাথে অনুরূপ করবেন, সেও তা বলবে আর আল্লাহ্ তা’আলাও তদ্রুপ উত্তর করবেন। তারপর তৃতীয় ব্যক্তিকে অনুরূপ বলবেন, সে বলবে, হে রব! আমি আপনার উপর, আপনার কিতাবের উপর ও আপনার রাসূলের উপর ঈমান এনেছিলাম, সালাত ও রোযা আদায় করেছিলাম, দান করেছিলাম এবং যত পারে প্রশংসা করবে। তখন তাকে বলা হবে এখানে তাহলে (অপেক্ষা কর)। তারপর তাকে বলা হবে, এখন তোমার উপর সাক্ষ্য উত্থাপন করা হবে। সে তখন তার মনে চিন্তা করবে, সেটা আবার কে যে আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে? তখন তার মুখে মোহর মেরে দেয়া হবে, আর তার উরু, মাংস ও অস্থিকে কথা বলতে নির্দেশ দেয়া হবে, ফলে তার উরু, মাংস ও অস্থি তার আমল সম্পর্কে বলবে … [মুসলিম: ২৯৬৮]
কোন কোন মুফাসসিরের মতে, যারা মিথ্যা কসম খেয়ে মিথ্যা শির্ককে অস্বীকার করবে, তারা হলো সেসব লোক, যারা কোন সৃষ্টজীবকে খোলাখুলি আল্লাহ কিংবা আল্লাহর প্রতিনিধি না বলেও আল্লাহর সব ক্ষমতা সৃষ্টজীবে বন্টন করে দিয়েছিল। তারা নিজেদেরকে মুশরিক মনে করতো না। তাই হাশরের ময়দানেও কসম খেয়ে বলবে যে, তারা মুশরিক ছিল না। [ফাতহুল কাদীর] কিন্তু কসম খাওয়া সত্বেও আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন।
৬:২৪ اُنۡظُرۡ کَیۡفَ کَذَبُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ وَ ضَلَّ عَنۡهُمۡ مَّا کَانُوۡا یَفۡتَرُوۡنَ
২৪. দেখুন, তারা নিজেদের প্রতি কিরূপ মিথ্যাচার করে এবং যে মিথ্যা তারা রটনা করত তা কিভাবে তাদের থেকে উধাও হয়ে গেল।
হাশরের ভয়াবহ ময়দানে মুশরিকদেরকে যা ইচ্ছা বলার স্বাধীনতা দানের মধ্যে সম্ভবতঃ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মিথ্যা বলার অভ্যাস এমন খারাপ অভ্যাস যা পরিত্যাগ করা অতি কঠিন। সুতরাং যারা দুনিয়াতে মিথ্যা কসম খেত, তারা এখানেও তা থেকে বিরত থাকতে পারেনি। ফলে সমগ্র সৃষ্ট জগতের সামনে তারা লাঞ্ছিত হয়েছে। এ কারণেই কুরআন ও হাদীসে মিথ্যা বলার নিন্দা জোরালো ভাষায় করা হয়েছে। কুরআনের স্থানে স্থানে মিথ্যাবাদীদের প্রতি অভিসম্পাত বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। কেননা, মিথ্যা পাপাচারের দোসর। মিথ্যা ও পাপাচার উভয়ই জাহান্নামে যাবে। [ইবনে হিব্বান: ৫৭৩৪]
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ যে কাজের দরুন মানুষ জাহান্নামে যাবে, তা কি? তিনি বললেনঃ সে কাজ হচ্ছে মিথ্যা। [মুসনাদে আহমাদ: ২/১৭৬]
অনুরূপভাবে, মে’রাজের রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, এক ব্যক্তির চোয়াল চিরে দেয়া হচ্ছে। তার সাথে এ কার্যধারা কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তিনি জিবরীল আলাইহিস সালাম-কে জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘এ ব্যক্তি কে? জিবরীল বললেনঃ ‘এ হলো মিথ্যাবাদী’। [বুখারী ১৩৮৬; মুসনাদে আহমাদ: ৫/১৪]
৬:২৫ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ یَّسۡتَمِعُ اِلَیۡکَ ۚ وَ جَعَلۡنَا عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ اَکِنَّۃً اَنۡ یَّفۡقَهُوۡهُ وَ فِیۡۤ اٰذَانِهِمۡ وَقۡرًا ؕ وَ اِنۡ یَّرَوۡا کُلَّ اٰیَۃٍ لَّا یُؤۡمِنُوۡا بِهَا ؕ حَتّٰۤی اِذَا جَآءُوۡکَ یُجَادِلُوۡنَکَ یَقُوۡلُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اِنۡ هٰذَاۤ اِلَّاۤ اَسَاطِیۡرُ الۡاَوَّلِیۡنَ
২৫. আর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক আপনার প্রতি কান পেতে শুনে, কিন্তু আমরা তাদের অন্তরের উপর আবরণ করে দিয়েছি যেন তারা তা উপলব্ধি করতে না পারে; আর আমরা তাদের কানে বধিরতা তৈরী করেছি। আর যদি সমস্ত আয়াতও তারা প্রত্যক্ষ করে তবুও তারা তাতে ঈমান আনবে না। এমনকি তারা যখন আপনার কাছে উপস্থিত হয়, তখন তারা আপনার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়, যারা কুফরী করেছে তারা বলে, এটাতো আগেকার দিনের উপকথা ছাড়া আর কিছু নয়।
মুজাহিদ বলেন, এখানে কুরাইশদের কথা বলা হচ্ছে, তারাই কান পেতে শুনত। [আত-তাফসীরুস সহীহ] কাতাদাহ বলেন, মুশরিকরা তাদের কান দিয়ে শুনত কিন্তু সেটা তারা বুঝতো না। তারা জন্তু-জানোয়ারদের মতো, যারা কেবল হাকডাকই শুনতে পায়। তাদেরকে কি বলা হচ্ছে সেটা জানে না। [তাফসীর আবদির রাযযাক] ইরশাদ হয়েছে—
(আজ তারা দুনিয়ার জীবন নিয়ে মত্ত হয়ে আছে৷) আর যেদিন আল্লাহ তাদেরকে একত্র করবেন সেদিন৷ (এদুনিয়ার জীবন তাদের কাছে এমন ঠেকাবে) যেন মনে হবে তারা পরস্পরের মধ্যে পরিচয় লাভের উদ্দেশ্য নিছক একদণ্ডের জন্য অবস্থান করেছিল (সে সময় নিশ্চিতভাবে জানা যাবে) প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকে মিথ্যা বলেছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা মোটেই সঠিক পথে ছিল না৷ইউনুসঃ ৪৫
৬:২৬ وَ هُمۡ یَنۡهَوۡنَ عَنۡهُ وَ یَنۡـَٔوۡنَ عَنۡهُ ۚ وَ اِنۡ یُّهۡلِکُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡفُسَهُمۡ وَ مَا یَشۡعُرُوۡنَ
২৬. আর তারা অন্যকে এগুলো শুনা থেকে বিরত রাখে এবং নিজেরাও এগুলো শুনা থেকে দুরে থাকে। আর তারা নিজেরাই শুধু নিজেদেরকে ধ্বংস করে, অথচ তারা উপলব্ধি করে না।
মধ্য রাত। চারিদিক নিরব, নিস্তব্ধ। নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের তিনপাশে তিনজন আড়ি পেতে আছেন। মক্কার কাফিরদের দুই নেতা- আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান। তাদের সাথে আছেন আরেকজন, তার নাম আখনাস ইবন শুরায়ক। মজার ব্যাপার হলো, সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে এসেছেন, কেউ জানতো না অপর পাশে আরেকজন আছে।
এই মধ্য রাতে তারা তাদের চিরশত্রুর ঘরে জড়ো হয়েছে কেনো? তাকে হত্যা করতে? না। তারা বরং এমন একটা কাজ করতে জড়ো হয়েছে, দিনের বেলা যেই কাজটিকে তারাই ‘নিষিদ্ধ’ করেছে।
তারা জড়ো হয় নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুললিত কন্ঠের কুরআন তেলাওয়াত শুনতে! সারারাত কুরআন তেলাওয়াত শুনে ভোরবেলা বাসায় ফেরার জন্য সবাই রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে একজন আরেকজনের সাথে “আরে, তুমি এখানে?”
“আমারও তো একই প্রশ্ন, তুমি এখানে কী করো?”
সবাই বুঝতে পারলো যে, সবাই-ই একই উদ্দেশ্যে মাঝরাতে তাদের চিরশত্রুর বাড়িতে জড়ো হয়েছে। একজন আরেকজনকে তিরস্কার করে বললো, “আমরা এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনছি, এটা প্রচার হয়ে গেলে তো লোকেরা আমাদেরকে খারাপ ভাববে!” সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আর এভাবে আসবে না।
কিন্তু, কুরআনের টান তাদেরকে বিছানায় থাকতে দিলো না। আবারো মধ্যরাতে তারা জড়ো হলো নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরের পাশে। সবাই ভেবেছিলো, ‘আমি আসছি, এটা হয়তো কেউ জানবে না’। ভোরবেলা বাড়ি ফেরার সময় আবারো তিনজনের দেখা। আবারো আগেরদিনের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।
তৃতীতবারের মতো সবাই সবার কাছে ধরা খেলো। কিন্তু, আজকে তারা শক্ত সিদ্ধান্ত নিলো। এরকম করলে চলবে না। মক্কার কাফিররা, অর্থাৎ তাদের কর্মীরা যদি শুনে যায় যে, দিনে নেতা যা নিষেধ করেন, রাতে সেটাই তিনি উপভোগ করেন, তাহলে তো তাদের আর মান-সম্মান থাকবে না।
দাহহাক, কাতাদাহ, মুহাম্মদ ইবনে হানফিয়া রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমূখ মুফাসসিরগণের মতে এ আয়াত মক্কার কাফেরদের সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। তারা কুরআন শুনতে ও অনুসরণ করতে লোকদেরকে বারণ করত এবং নিজেরাও তা থেকে দূরে সরে থাকত। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, এ আয়াত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চাচা আবু তালেব সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, তিনি তাকে কাফেরদের উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করতেন, কিন্তু কুরআনে বিশ্বাস করতেন না। এমতাবস্থায় عنه শব্দের সর্বনামটির অর্থ কুরআনের পরিবর্তে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হবেন। [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/৩১৫]
৬:২৭ وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذۡ وُقِفُوۡا عَلَی النَّارِ فَقَالُوۡا یٰلَیۡتَنَا نُرَدُّ وَ لَا نُکَذِّبَ بِاٰیٰتِ رَبِّنَا وَ نَکُوۡنَ مِنَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ
২৭. আপনি যদি দেখতে পেতেন যখন তাদেরকে আগুনের উপর দাঁড় করানো হবে তখন তারা বলবে, ‘হায়! যদি আমাদেরকে ফেরত পাঠানো হত, আর আমরা আমাদের রবের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ না করতাম এবং আমরা মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।
ইসলামের তিনটি মৌলনীতি রয়েছে- (১) একত্ববাদ (২) রেসালাত ও (৩) আখেরাতে বিশ্বাস। [তাফসীর মানার: ৯/৩৯] অবশিষ্ট সমস্ত বিশ্বাস এ তিনটিরই অধীন। এ তিন মূলনীতি মানুষকে স্বীয় স্বরূপ ও জীবনের লক্ষ্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এগুলোর মধ্যে আখেরাত ও আখেরাতের প্রতিদান ও শাস্তির বিশ্বাস কার্যতঃ এমন একটি বিশ্বাস, যা মানুষের প্রত্যেক কাজের গতি একটি বিশেষ দিকে ঘুরিয়ে দেয়। এ কারণেই কুরআনুল কারীমের সব বিষয়বস্তু এ তিনটির মধ্যেই চক্রাকারে আবর্তিত হয়। আলোচ্য আয়াতসমূহে বিশেষভাবে আখেরাতের প্রশ্ন ও উত্তর, কঠোর শাস্তি, অশেষ সওয়াব এবং ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার স্বরূপ বৰ্ণিত হয়েছে।
(২) এ আয়াতে অবিশ্বাসী, অপরাধীদের অবস্থা বর্ণনা করে বলা হয়েছে, আখেরাতে যখন তাদেরকে জাহান্নামের কিনারায় দাঁড় করানো হবে এবং তারা কল্পনাতীত ভয়াবহ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন তারা আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে বলবে, আফসোস, আমাদেরকে পুনরায় দুনিয়াতে প্রেরণ করা হলে আমরা রব-এর প্রেরিত নিদর্শনাবলী ও নির্দেশাবলীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম না, বরং এগুলো বিশ্বাস করে ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম। [মুয়াসসার]
কিন্তু সেখান থেকে পুনরায় ফিরে আসা সম্ভব হবে না। কাজেই তারা তাদের এই আশা পূরণ করতে পারবে না। কাফেরদের এই ধরনের আশার কথা কুরআন বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছে।
{رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْهَا فَإِنْ عُدْنَا فَإِنَّا ظَالِمُونَ* قَالَ اخْسَأُوا فِيهَا وَلا تُكَلِّمُونِ}
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! এ থেকে আমাদেরকে উদ্ধার কর; আমরা যদি পুনরায় তা করি, তবে আমরা (বড়ই) যালেম গণ্য হব। আল্লাহ বলবেন, তোমরা ধিক্কৃত অবস্থায় এখানেই পড়ে থাক এবং আমার সাথে কোন কথা বলো না। (সূরা মু’মিনূন ১০৭-১০৮)
{رَبَّنَا أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوقِنُونَ}
‘‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা দেখলাম ও শুনলাম। এখন আমাদেরকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিন, আমরা সৎকর্ম করব। আমরা দৃঢ় বিশ্বাসী হয়ে গেছি। (সূরা সাজদাহ ১২)
যারা দুনিয়ায় আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতায় জীবন কাটিয়েছে, তারা সেদিন চরম ব্যর্থ হবে। সেদিন অনুতাপ করে তারা নিজেদেরকেই দোষারোপ করতে থাকবে। আর বলবে, (তরজমা) ‘হায় আফসোস! যদি এমন না করতাম!’
আখেরাতে বিফল জাহান্নামীরা কীভাবে আফসোস করবে, তা বিশদভাবে আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলে দিয়েছেন।
অপরাধীদের আমলনামা উপস্থিত করা হলে, তারা তা দেখে চমকে উঠবে এবং আফসোস করতে থাকবে,
কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَ وُضِعَ الْكِتٰبُ فَتَرَی الْمُجْرِمِیْنَ مُشْفِقِیْنَ مِمَّا فِیْهِ وَ یَقُوْلُوْنَ یٰوَیْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا یُغَادِرُ صَغِیْرَةً وَّ لَا كَبِیْرَةً اِلَّاۤ اَحْصٰىهَا وَ وَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا وَ لَا یَظْلِمُ رَبُّكَ اَحَدًا.
‘আমলনামা’ সামনে রেখে দেওয়া হবে। তখন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে, তাতে যা (লেখা) আছে, তার কারণে তারা আতঙ্কিত এবং তারা বলছে, হায়! আমাদের দুর্ভোগ! এটা কেমন কিতাব, যা আমাদের ছোট-বড় যত কর্ম আছে, সবই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে রেখেছে। তারা তাদের সমস্ত কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি কোনো জুলুম করবেন না। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ৪৯
আমলনামা উপস্থিত করা হলে তারা দেখবে দুনিয়াতে ছোট-বড় যা কিছু করেছে, সব সেখানে লেখা রয়েছে। ইহজীবনে যে গুনাহকে তুচ্ছ ভেবে উদাসীন থেকেছে। আমলনামায় তা দেখে হতভম্ব হয়ে যাবে, হায় হায়! এ কী! কোনো কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি!
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَمَّا مَنْ اُوْتِیَ كِتٰبَهٗ بِشِمَالِهٖ فَیَقُوْلُ یٰلَیْتَنِیْ لَمْ اُوْتَ كِتٰبِیَهْ وَ لَمْ اَدْرِ مَا حِسَابِیَهْ یٰلَیْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِیَةَ مَاۤ اَغْنٰی عَنِّیْ مَالِیَهْ هَلَكَ عَنِّیْ سُلْطٰنِیَهْ.
সেই ব্যক্তি, যার আমলনামা দেওয়া হবে তার বাম হাতে; সে বলবে, আহা! আমাকে যদি আমলনামা দেওয়াই না হত! আর আমি জানতেই না পারতাম, আমার হিসাব কী? আহা! মৃত্যুতেই যদি আমার সব শেষ হয়ে যেত! আমার অর্থ-সম্পদ আমার কোনো কাজে আসল না! আমার সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেল। -সূরা আলহাক্কাহ (৬৯) : ২৫-২৯
অপরাধীদের বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে, তারা আমলনামা গ্রহণ করতে চাইবে না। বলবে, হায়! যদি আমলনামা না দেওয়া হত! পৃথিবীতে যে মৃত্যু থেকে বাঁচতে সর্বস্ব ত্যাগ করতেও পিছপা হত না, সেই মৃত্যুই তখন বড় কামনার বিষয় হবে। জাগতিক ধন-সম্পদ বিত্ত-বৈভব ও ক্ষমতা সেদিন কোনো কাজে আসবে না।
শয়তানের অনুসরণে যারা জীবন কাটায়। শয়তানের দোসর হয়ে নিজেও আল্লাহ-রাসূলকে ভুলে থাকে, মুমিনদেরকেও দ্বীনের পথে বাঁধা দান ও পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে। কিয়ামতের দিন যখন তারা এর ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখবে, তখন শয়তান থেকে যোজন যোজন দূরত্ব কামনা করবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
حَتّٰۤی اِذَا جَآءَنَا قَالَ یٰلَیْتَ بَیْنِیْ وَ بَیْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَیْنِ فَبِئْسَ الْقَرِیْنُ.
পরিশেষে এরূপ ব্যক্তি যখন আমার কাছে আসবে তখন (সে তার সঙ্গী শয়তানকে) বলবে, আহা! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত। কেননা তুমি বড় মন্দ সঙ্গী ছিলে। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩৮
ইরশাদ হয়েছে وَ هُمْ یَصْطَرِخُوْنَ فِیْهَا رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَیْرَ الَّذِیْ كُنَّا نَعْمَلُ.
তারা তাতে আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে মুক্তি দান করুন; আমরা আগে যে কাজ করতাম তা ছেড়ে ভালো কাজ করব। -সূরা ফাতির (৩৫) : ৩৭
৬:২৮ بَلۡ بَدَا لَهُمۡ مَّا کَانُوۡا یُخۡفُوۡنَ مِنۡ قَبۡلُ ؕ وَ لَوۡ رُدُّوۡا لَعَادُوۡا لِمَا نُهُوۡا عَنۡهُ وَ اِنَّهُمۡ لَکٰذِبُوۡنَ
২৮. বরং আগে তারা যা গোপন করত তা এখন তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। আর তাদের আবার (দুনিয়ায়) ফেরৎ পাঠানো হলেও তাদেরকে যা করতে নিষেধ করা হয়েছিল আবার তারা তাই করত এবং নিশ্চয়ই তারা মিথ্যাবাদী।
بَلْ যেটা إِضْرَاب (অর্থাৎ, পূর্বের কথাকে প্রত্যাহার করার) জন্য আসে। এ বাক্যের কয়েকটি ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে। (ক) তাদের সেই কুফরী, বিরুদ্ধাচরণ এবং মিথ্যাজ্ঞান প্রকাশিত হয়ে যাবে, যা ইতিপূর্বে তারা দুনিয়াতে অথবা আখেরাতে গোপন করত। অর্থাৎ, যেটাকে অস্বীকার করত। যেমন, সেখানে প্রথম পর্যায়ে বলবে, مَا كُنَّا مُشْرِكِيْنَ ‘‘আমরা তো মুশরিকই ছিলাম না।’’ (খ) অথবা রসূল (সাঃ) এবং কুরআনে কারীমের যে সত্যতার জ্ঞান তাদের অন্তরে ছিল, কিন্তু তা তাদের অনুসারীদের নিকট গোপন করত, সেখানে প্রকাশিত হয়ে যাবে। (গ) কিংবা মুনাফেকদের সেই মুনাফেকী সেখানে প্রকাশিত হয়ে যাবে, যা তারা দুনিয়াতে ঈমানদারদের নিকট গোপন করত। (তাফসীর ইবনে কাসীর)
[2] অর্থাৎ, পুনরায় দুনিয়াতে আসার ইচ্ছা ঈমান আনার জন্য নয়, বরং কেবল সেই আযাব থেকে বাঁচার জন্য, যা কিয়ামতের দিন প্রকাশ হয়ে যাবে এবং যা তারা প্রত্যক্ষ দেখেও নেবে। তাছাড়া দুনিয়াতে যদি এদেরকে পুনরায় পাঠানোও যায়, তবুও তারা তা-ই করবে, যা পূর্বে করেছে।
৬:২৯ وَ قَالُوۡۤا اِنۡ هِیَ اِلَّا حَیَاتُنَا الدُّنۡیَا وَ مَا نَحۡنُ بِمَبۡعُوۡثِیۡنَ
২৯. আর তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই একমাত্র জীবন এবং আমাদেরকে পুনরুত্থিতও করা হবে না।
অর্থাৎ যদি তারা দুনিয়াতে পুনঃ প্রেরিত হয়, তবে সেখানে পৌছে একথাই বলবে যে, আমরা এ পার্থিব জীবন ছাড়া অন্য কোন জীবন মানি না; এ জীবনই একমাত্র জীবন। আমাদেরকে পুনরায় জীবিত করা হবে না। [ইবন কাসীর] মোটকথাঃ কাফের ও পাপীরা হাশরের ময়দানে প্রাণ রক্ষার্থে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নানা ধরণের কথাবার্তা বলবে। কখনো মিথ্যা কসম খাবে, কখনো দুনিয়ায় পুনঃ প্রেরিত হওয়ার আকাঙ্খা করবে। এতে ফুটে উঠল যে, পার্থিব জীবন অনেক বড় নেয়ামত এবং অত্যন্ত মূল্যবান বিষয়। যদি তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়। তাই ইসলামে আত্মহত্যা হারাম এবং মৃত্যুর জন্য দো’আ ও মৃত্যু কামনা করা নিষিদ্ধ। কারণ এতে আল্লাহ তা’আলার একটি বিরাট নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
সারকথা এই যে, দুনিয়াতে যে বস্তুটি প্রত্যেকেই প্রাপ্ত হয়েছে এবং যা সর্বাধিক মূল্যবান ও প্রিয়, তা হচ্ছে মানুষের জীবন। এ কথাও সবার জানা যে, মানুষের জীবনের একটা সীমাবদ্ধ গণ্ডি রয়েছে কিন্তু তার সঠিক সীমা কারো জানা নেই যে, তা সত্তর বছর হবে, না সত্তর ঘন্টা হবে, না একটি শ্বাস ছাড়ারও সময় পাওয়া যাবে না। সুতরাং দুনিয়ার জীবনকে আখেরাতের জন্য সঠিকভাবে কাজে লাগানো উচিত।
৬:৩০ وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذۡ وُقِفُوۡا عَلٰی رَبِّهِمۡ ؕ قَالَ اَلَیۡسَ هٰذَا بِالۡحَقِّ ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ رَبِّنَا ؕ قَالَ فَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَکۡفُرُوۡنَ ﴿
৩০. আর আপনি যদি দেখতে পেতেন, যখন তাদেরকে তাদের রব-এর সম্মুখে দাঁড় করান হবে; তিনি বলবেন, এটা কি প্রকৃত সত্য নয়? তারা বলবে, আমাদের রব-এর শপথ! নিশ্চয়ই সত্য। তিনি বলবেন, তবে তোমরা যে কুফরী করতে তার জন্য তোমরা এখন শাস্তি ভোগ কর।
অর্থাৎ, স্বচক্ষে দর্শন করার পর তো তারা স্বীকার করবেই যে, আখেরাতের জীবন বাস্তব ও সত্য। তবে সেখানে এই স্বীকারোক্তির কোন লাভ হবে না এবং মহান আল্লাহ বলবেন, “এখন তোমরা তোমাদের কুফরীর কারণে আযাবের স্বাদ গ্রহণ কর।”
অসৎ সঙ্গীর পাল্লায় পড়ে আল্লাহ তাআলার বিধান ভুলে যায়। আল্লাহর হুকুম মানতে অবহেলা করে। বন্ধুর মন রক্ষার্থে আল্লাহ যা করতে আদেশ করেছেন, তা করে না। যা করতে নিষেধ করেছেন, তা-ই করে। আখেরাতে তারাই এদের মনস্তাপ ও সর্বনাশের কারণ হবে। সেদিন কোনো বন্ধুত্ব থাকবে না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন-
وَ یَوْمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی یَدَیْهِ یَقُوْلُ یٰلَیْتَنِی اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِیْلًا یٰوَیْلَتٰی لَیْتَنِیْ لَمْ اَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِیْلًا لَقَدْ اَضَلَّنِیْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ اِذْ جَآءَنِیْ وَ كَانَ الشَّیْطٰنُ لِلْاِنْسَانِ خَذُوْلًا.
যেদিন জালেম ব্যক্তি (মনস্তাপে) নিজের হাত কামড়াবে এবং বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে পথ ধরতাম! হায় আমার দুর্ভোগ! আমি যদি অমুক ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে তো উপদেশ এসে গিয়েছিল, কিন্তু সে (ওই বন্ধু) আমাকে তা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আর শয়তান তো (এমনই চরিত্রের; সময়কালে সে) মানুষকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ২৭-২৯।
আল্লাহ তাআলা আখেরাতে ইহজীবনের ভালো-মন্দ কাজের প্রতিদান দেবেন। যারা পার্থিব জীবনে আল্লাহ তাআলার বিধান মেনে জীবন কাটিয়েছে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জান্নাতসহ আরও অনেক নিআমত দান করবেন। কুরআন কারীমের ভাষায় তারাই সফলকাম। জান্নাতে তারা নিআমত উপভোগ করতে করতে বলবে, (তরজমা) ‘আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আমরা তা সত্য পেয়েছি।’ -সূরা আরাফ (৭) : ৪৪
অন্যদিকে যারা দুনিয়ায় আল্লাহ ও রাসূলের অবাধ্যতায় জীবন কাটিয়েছে, তারা সেদিন চরম ব্যর্থ হবে। সেদিন অনুতাপ করে তারা নিজেদেরকেই দোষারোপ করতে থাকবে। আর বলবে, (তরজমা) ‘হায় আফসোস! যদি এমন না করতাম!’
আখেরাতে বিফল জাহান্নামীরা কীভাবে আফসোস করবে, তা বিশদভাবে আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে বলে দিয়েছেন।
অপরাধীদের আমলনামা উপস্থিত করা হলে, তারা তা দেখে চমকে উঠবে এবং আফসোস করতে থাকবে,
কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-
وَ وُضِعَ الْكِتٰبُ فَتَرَی الْمُجْرِمِیْنَ مُشْفِقِیْنَ مِمَّا فِیْهِ وَ یَقُوْلُوْنَ یٰوَیْلَتَنَا مَالِ هٰذَا الْكِتٰبِ لَا یُغَادِرُ صَغِیْرَةً وَّ لَا كَبِیْرَةً اِلَّاۤ اَحْصٰىهَا وَ وَجَدُوْا مَا عَمِلُوْا حَاضِرًا وَ لَا یَظْلِمُ رَبُّكَ اَحَدًا.
‘আমলনামা’ সামনে রেখে দেওয়া হবে। তখন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে, তাতে যা (লেখা) আছে, তার কারণে তারা আতঙ্কিত এবং তারা বলছে, হায়! আমাদের দুর্ভোগ! এটা কেমন কিতাব, যা আমাদের ছোট-বড় যত কর্ম আছে, সবই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে রেখেছে। তারা তাদের সমস্ত কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি কোনো জুলুম করবেন না। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ৪৯
আমলনামা উপস্থিত করা হলে তারা দেখবে দুনিয়াতে ছোট-বড় যা কিছু করেছে, সব সেখানে লেখা রয়েছে। ইহজীবনে যে গুনাহকে তুচ্ছ ভেবে উদাসীন থেকেছে। আমলনামায় তা দেখে হতভম্ব হয়ে যাবে, হায় হায়! এ কী! কোনো কিছুই বাদ দেওয়া হয়নি!
আরও ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَمَّا مَنْ اُوْتِیَ كِتٰبَهٗ بِشِمَالِهٖ فَیَقُوْلُ یٰلَیْتَنِیْ لَمْ اُوْتَ كِتٰبِیَهْ وَ لَمْ اَدْرِ مَا حِسَابِیَهْ یٰلَیْتَهَا كَانَتِ الْقَاضِیَةَ مَاۤ اَغْنٰی عَنِّیْ مَالِیَهْ هَلَكَ عَنِّیْ سُلْطٰنِیَهْ.
সেই ব্যক্তি, যার আমলনামা দেওয়া হবে তার বাম হাতে; সে বলবে, আহা! আমাকে যদি আমলনামা দেওয়াই না হত! আর আমি জানতেই না পারতাম, আমার হিসাব কী? আহা! মৃত্যুতেই যদি আমার সব শেষ হয়ে যেত! আমার অর্থ-সম্পদ আমার কোনো কাজে আসল না! আমার সব ক্ষমতা লুপ্ত হয়ে গেল। -সূরা আলহাক্কাহ (৬৯) : ২৫-২৯
অপরাধীদের বাম হাতে আমলনামা দেওয়া হবে, তারা আমলনামা গ্রহণ করতে চাইবে না। বলবে, হায়! যদি আমলনামা না দেওয়া হত! পৃথিবীতে যে মৃত্যু থেকে বাঁচতে সর্বস্ব ত্যাগ করতেও পিছপা হত না, সেই মৃত্যুই তখন বড় কামনার বিষয় হবে। জাগতিক ধন-সম্পদ বিত্ত-বৈভব ও ক্ষমতা সেদিন কোনো কাজে আসবে না।
শয়তানের অনুসরণে যারা জীবন কাটায়। শয়তানের দোসর হয়ে নিজেও আল্লাহ-রাসূলকে ভুলে থাকে, মুমিনদেরকেও দ্বীনের পথে বাঁধা দান ও পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করে। কিয়ামতের দিন যখন তারা এর ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখবে, তখন শয়তান থেকে যোজন যোজন দূরত্ব কামনা করবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
حَتّٰۤی اِذَا جَآءَنَا قَالَ یٰلَیْتَ بَیْنِیْ وَ بَیْنَكَ بُعْدَ الْمَشْرِقَیْنِ فَبِئْسَ الْقَرِیْنُ.
পরিশেষে এরূপ ব্যক্তি যখন আমার কাছে আসবে তখন (সে তার সঙ্গী শয়তানকে) বলবে, আহা! আমার ও তোমার মধ্যে যদি পূর্ব ও পশ্চিমের ব্যবধান থাকত। কেননা তুমি বড় মন্দ সঙ্গী ছিলে। -সূরা যুখরুফ (৪৩) : ৩৮
অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআনে বহুবার সতর্ক করে দিয়েছেন, শয়তান কিয়ামত পর্যন্ত মানুষকে পথভ্রষ্ট করার অঙ্গীকার করেছে। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। শয়তান দুনিয়াতে মানুষকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপথগামী করে রাখছে। আখেরাতে সে বলবে, আমি তো তোমাদেরকে জোর করিনি, আমি শুধু ডেকেছিলাম, তোমরা সাড়া দিয়েছো। কাজেই আমাকে দোষ না দিয়ে নিজেদেরকেই দোষারোপ কর। বস্তুত শয়তানের তখন তাদেরকে সাহায্য করার কোনো উপায়ও থাকবে না।
যারা অসৎ সঙ্গীর পাল্লায় পড়ে আল্লাহ তাআলার বিধান ভুলে যায়। আল্লাহর হুকুম মানতে অবহেলা করে। বন্ধুর মন রক্ষার্থে আল্লাহ যা করতে আদেশ করেছেন, তা করে না। যা করতে নিষেধ করেছেন, তা-ই করে। আখেরাতে তারাই এদের মনস্তাপ ও সর্বনাশের কারণ হবে। সেদিন কোনো বন্ধুত্ব থাকবে না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন-
وَ یَوْمَ یَعَضُّ الظَّالِمُ عَلٰی یَدَیْهِ یَقُوْلُ یٰلَیْتَنِی اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُوْلِ سَبِیْلًا یٰوَیْلَتٰی لَیْتَنِیْ لَمْ اَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِیْلًا لَقَدْ اَضَلَّنِیْ عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ اِذْ جَآءَنِیْ وَ كَانَ الشَّیْطٰنُ لِلْاِنْسَانِ خَذُوْلًا.
যেদিন জালেম ব্যক্তি (মনস্তাপে) নিজের হাত কামড়াবে এবং বলবে, হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে পথ ধরতাম! হায় আমার দুর্ভোগ! আমি যদি অমুক ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমার কাছে তো উপদেশ এসে গিয়েছিল, কিন্তু সে (ওই বন্ধু) আমাকে তা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আর শয়তান তো (এমনই চরিত্রের; সময়কালে সে) মানুষকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ২৭-২৯।
বন্ধুদেরকে দোষারোপ করার পাশাপাশি পৃথিবীতে যারা বিপথগামীতায় তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের প্রতি তারা ক্ষোভে ফেটে পড়বে। বলবে, (তরজমা) ‘আল্লাহ! আমরা আমাদের নেতাদের অনুসরণ করেছিলাম, তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। আল্লাহ! যারা আমাদেরকে বিপথগামী করেছে, আমাদেরকে আজ এমন শাস্তির সম্মুখীন করেছে, তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের প্রতি লানত করুন, মহা লানত। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৬৭-৬৮
অনুসৃতদেরকে তারা নিজেরাও শাস্তি দিতে চাইবে। বলবে, (তরজমা) ‘আল্লাহ! জীন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে, তাদেরকে দেখিয়ে দেন, আমরা তাদেরকে পায়ের নিচে পিষে লাঞ্ছিত করব।’ -সূরা হা-মীম সাজদা (৪১) ২৯
সেদিন তাদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং সদ্ভাব শেষ হয়ে যাবে। নিজেদের সর্বনাশের কারণে তারা পরস্পরের কঠোরতম শাস্তির আবেদন করবে।
রাসূলগণ যখন তাদেরকে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে দাওয়াত দিতেন তখন তারা বলত, ‘এসব পাগলের প্রলাপ, কাল্পনিক কথা।’ অথচ তাদেরই মাঝে বেড়ে ওঠা রাসূলের নিষ্কলুষতা তারা একবাক্যে স্বীকার করত। কিন্তু কবর, আখেরাত, জান্নাত, জাহান্নাম এসব যেন তাদের বিশ্বাসই হতে চায় না। নিজেদের অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত যুক্তিকে তাদের যুক্তিপূর্ণ কথা মনে হয় আর আসল যুক্তির কথাকে মনে করে রূপকথা। কিন্তু সেদিন বুঝতে পারবে, রাসূলের সঙ্গ ত্যাগ করে কী দুর্ভাগ্য টেনে এনেছে। প্রথমে যদিও তারা নিজেদের কর্মকা- অস্বীকার করে বলবে, আমরা শিরক করতাম না। কারণ একে তো তারা নিজেরাও বাঁচার বাহানা খুঁজবে। উপরন্তু তারা যাদের উপাসনা করত, তারাও অন্তর্হিত হয়ে যাবে। তারপর যখন আল্লাহ বলবেন, ‘দেখো! কীভাবে নিজেদের ব্যাপারে মিথ্যা বলছে।’ তখন নিজ মুখে অপরাধ স্বীকার করবে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, তারা বলবে-
رَبَّنَا غَلَبَتْ عَلَیْنَا شِقْوَتُنَا وَ كُنَّا قَوْمًا ضَآلِّیْنَ رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا مِنْهَا فَاِنْ عُدْنَا فَاِنَّا ظٰلِمُوْنَ.
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উপর আমাদের দুর্ভাগ্য ছেয়ে গিয়েছিল এবং আমরা ছিলাম বিপথগামী সম্প্রদায়। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এখান থেকে উদ্ধার করুন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা সেই কাজই করি, তবে অবশ্যই আমরা জালেম হব। -সূরা মুমিনূন (২৩) : ১০৬-১০৭
সেদিন তাদের বুঝে আসবে, পার্থিব জীবনে হঠকারিতা ও রাসূলের অবাধ্যতা করে তারা কেমন জুলুম করেছে, আর সেদিন তারা একেবারে ভালো মানুষ হয়ে যেতে চাইবে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ هُمْ یَصْطَرِخُوْنَ فِیْهَا رَبَّنَاۤ اَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَیْرَ الَّذِیْ كُنَّا نَعْمَلُ.
তারা তাতে আর্তনাদ করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে মুক্তি দান করুন; আমরা আগে যে কাজ করতাম তা ছেড়ে ভালো কাজ করব। -সূরা ফাতির (৩৫) : ৩৭
এভাবে তারা আরেকবার পৃথিবীতে ফিরে আসার সুযোগ চাইবে। বলবে, আল্লাহ! এবার আমাদের বুঝে এসেছে, এখন আর আমরা আগের মতো ভুল করব না। আপনার সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলব। এবার আমরা সত্যিকার মুমিন হয়ে যাব। আমাদেরকে শুধু আরেকবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিন।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের পর আর দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেবেন না। এজন্যই ইহজীবনে বারবার তিনি সতর্ক করছেন এবং মৃত্যুর পর কী ঘটবে তা আগেই বলে দিয়েছেন। সেদিন তিনি তাদের কোনো কথাই শুনবেন না।
যখন আক্ষেপ করে, অন্যকে দোষারোপ করে, আরেকটা সুযোগের আবেদন করে বা অন্য কোনোভাবেই পরিণতি এড়াতে পারবে না। তখন বলতে থাকবে-
لَوْ كُنَّا نَسْمَعُ اَوْ نَعْقِلُ مَا كُنَّا فِیْۤ اَصْحٰبِ السَّعِیْرِ.
আমরা যদি শুনতাম এবং বুদ্ধিকে কাজে লাগাতাম, তবে (আজ) আমরা জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম না। -সূরা মুল্ক (৬৭) : ১০
আরও বলবে-
یٰلَیْتَنِیْ قَدَّمْتُ لِحَیَاتِی.
হায়! আমি যদি আমার এই জীবনের জন্য অগ্রিম কিছু পাঠাতাম! -সূরা ফাজর (৮৯) : ২৪
সংগ্রহে-
তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন