সূরা আন’আমঃ ২য়রুকু  (১১-২০)আয়াত সমূহ

সূরা আন’আমঃ ২য়রুকু  (১১-২০)আয়াত সমূহ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৬:১১ قُلۡ سِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ ثُمَّ انۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُکَذِّبِیۡنَ

১১. বলুন, তোমরা যমীনে পরিভ্রমণ কর, তারপর দেখ, যারা মিথ্যারোপ করেছে তাদের পরিণাম কি হয়েছিল!

৬:১২ قُلۡ لِّمَنۡ مَّا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ قُلۡ لِّلّٰهِ ؕ کَتَبَ عَلٰی نَفۡسِهِ الرَّحۡمَۃَ ؕ لَیَجۡمَعَنَّکُمۡ اِلٰی یَوۡمِ الۡقِیٰمَۃِ لَا رَیۡبَ فِیۡهِ ؕ اَلَّذِیۡنَ خَسِرُوۡۤا اَنۡفُسَهُمۡ فَهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ

১২. বলুন, আসমানসমূহ ও যমীনে যা আছে তা কার? বলুন, আল্লাহরই, তিনি তার নিজের উপর দয়া করা লিখে নিয়েছেন। কিয়ামতের দিন তিনি তোমাদেরকে অবশ্যই একত্র করবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে তারা ঈমান আনবে না।

এ আয়াতে কাফেরদেরকে প্রশ্ন করা হয়েছেঃ নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল এবং এতদুভয়ে যা আছে, তার মালিক কে? অতঃপর আল্লাহ নিজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাচনিক উত্তর দিয়েছেনঃ সবার মালিক আল্লাহ। কাফেরদের উত্তরের অপেক্ষা করার পরিবর্তে নিজেই উত্তর দেয়ার কারণ এই যে, এ উত্তর কাফেরদের কাছেও স্বীকৃত। তারা যদিও শির্ক ও পৌত্তলিকতায় লিপ্ত ছিল, তথাপি ভূমণ্ডল, নভোমণ্ডল ও সবকিছুর মালিক আল্লাহ তা’আলাকেই মানতো অর্থাৎ তারা তাওহীদুর রবুবিয়াতের এ অংশে বিশ্বাসী ছিল। আর তারা যেহেতু তাওহীদের এ অংশে বিশ্বাস করছে, তাদের উচিত হবে তাওহীদের বাকী অংশ তাওহীদুল উলুহিয়ার স্বীকৃতি দেয়া এবং একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করা। [সা’দী; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

এই সূরার অন্যত্র এসেছে—

আর যারা আমাদের আয়াতসমূহে ঈমান আনে, তারা যখন আপনার কাছে আসে তখন তাদেরকে আপনি বলুন তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, তোমাদের রব তার নিজের উপর দয়া লিখে নিয়েছেন। তোমাদের মধ্যে কেউ অজ্ঞতাবশত যদি খারাপ কাজ করে, তারপর তওবা করে এবং সংশোধন করে, তবে নিশ্চয় তিনি (আল্লাহ) ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। আন’আমঃ ৫৪

আয়াতে দুটি শর্তাধীনে গোনাহগারদের সম্পর্কে ক্ষমা ও রহমতের ওয়াদা করা হয়েছে- (এক) তাওবা অর্থাৎ গোনাহর জন্য অনুতপ্ত হওয়া। হাদীসে বলা হয়েছে, অনুশোচনার নামই হলো তাওবা। [ইবন মাজাহঃ ৪২৫২ মুসনাদে আহমাদ: ১/৩৭৬] (দুই) ভবিষ্যতের জন্য আমল সংশোধন করা। কয়েকটি বিষয় এ আমল সংশোধনের অন্তর্ভুক্ত। ভবিষ্যতে এ পাপ কাজের নিকটবর্তী না হওয়ার সংকল্প করা ও সে বিষয়ে যত্নবান হওয়া এবং কৃত গোনাহর কারণে কারো অধিকার নষ্ট হয়ে থাকলে যথাসম্ভব তা পরিশোধ করা, তা আল্লাহর অধিকার হোক কিংবা বান্দার অধিকার। [সা’দী]

হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যখন মহান আল্লাহ সৃষ্টদের সৃষ্টি করলেন, তখন আরশে লিখে দিলেন, إِنَّ رَحْمَتِيْ تَغْلِبُ غَضَبِيْ ‘‘আমার দয়া আমার ক্রোধের উপরে বিজয়ী।’’ (বুখারীঃ তাওহীদ অধ্যায়, মুসলিমঃ তাওবা অধ্যায়) তবে এ দয়া ও রহমত কিয়ামতের দিন কেবল ঈমানদারদের জন্য হবে। আর কাফেরদের প্রতি প্রতিপালক চরম ক্রোধান্বিত হবেন। অর্থাৎ, দুনিয়াতে তো তাঁর রহমত অবশ্যই ব্যাপক; যার দ্বারা মু’মিন ও কাফের, সৎ ও অসৎ এবং বাধ্যজন ও অবাধ্যজন সকলেই উপকৃত হচ্ছে। মহান আল্লাহ কোন ব্যক্তিরই রুযী অবাধ্যতার কারণে বন্ধ করেন না। তবে তাঁর রহমতের এই ব্যাপকতা দুনিয়াতেই সীমাবদ্ধ। প্রতিফল ও প্রতিদানের স্থান আখেরাতে আল্লাহর সুবিচারক হওয়ার গুণের পূর্ণ বিকাশ ঘটবে, যার ফলে সেখানে ঈমানদাররা তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় লাভ করবে এবং কাফের ও ফাসেকরা জাহান্নামের চিরন্তন শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হবে।

এই জন্য কুরআনে বলা হয়েছে,

{وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُمْ بِآياتِنَا يُؤْمِنُونَ}

‘‘আমার দয়া প্রতিটি জিনিসের উপর পরিব্যাপ্ত। সুতরাং তা তাদের জন্য লিখে দেব যারা ভয় রাখে, যাকাত দেয় এবং যারা আমার আয়াতসমূহের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে।’’ (সূরা আ’রাফ ১৫৬)

সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যখন আল্লাহ তা’আলা যাবতীয় বস্তু সৃষ্টি করেন, তখন একটি ওয়াদাপত্র লিপিবদ্ধ করেন। এটি আল্লাহ্ তা’আলার কাছেই রয়েছে। এতে লিখিত আছেঃ আমার অনুগ্রহ আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে। [বুখারী: ৭৪০৪; মুসলিম: ২৭৫১]

এ বাক্যে إلى শব্দটি فى অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাতে মর্ম দাঁড়িয়েছে এই যে, আল্লাহ তা’আলা পূর্বের ও পরের সব মানুষকে কেয়ামতের দিন সমবেত করবেন কিংবা এখানে কবরে একত্রিত করা বুঝানো হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, কেয়ামত পর্যন্ত সব মানুষকে কবরে একত্রিত করতে থাকবেন এবং কেয়ামতের দিন সবাইকে জীবিত করবেন আর তোমাদেরকে তোমাদের কর্মকাণ্ডের শাস্তি প্রদান করবেন। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]

এতে ইঙ্গিত আছে যে, আয়াতের শুরুতে বর্ণিত আল্লাহ্ তা’আলার ব্যাপক অনুগ্রহ থেকে যদি কাফের ও মুশরিকরা বঞ্চিত হয়, তবে স্বীয় কৃতকর্মের কারণেই হবে। কারণ, তারা অনুগ্রহ লাভের উপায় অর্থাৎ ঈমান অবলম্বন করেনি। আল্লাহ্ তাআলা আখেরাত ও কিয়ামতের বাস্তবতার উপর অনেক দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, যাতে তা বাস্তব সত্যরূপে মানুষের কাছে প্রতিভাত হয়। কিন্তু তারা অস্বীকার ছাড়া কিছুই করেনি। তারা পুনরুত্থানকে অস্বীকার করেছে, ফলে তারা আল্লাহ্‌র অবাধ্যতায় নিপতিত হয়েছে এবং কুফরী করার মত দুঃসাহস দেখিয়েছে। এতে করে তারা তাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টিই বরবাদ করেছে। [সা’দী]

আর রহমান শব্দে  ৩টি অর্থ নিহিত-

১। চরম পরিমাণ এবং ধারণার বাইরে।

২। এখনই

৩। এটা অস্থায়ী।

الرَّحْمنُ عَلَّمَ الْقُرْآنَ ,“পরম করুণাময় আল্লাহ। শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন।”

(সূরা আর রাহমান: ১২)

মা তার সন্তানের উপর যতটুকু দয়ালু, আল্লাহ তার বান্দার উপর তদাপেক্ষা অধিক দয়ালু।”সহীহ বুখারী, ৭/৭৫

আর রাহীম অর্থ, অসীম দয়ালু এবং পরম অনুগ্রহশীল।

আর-রহীমের দুটো গুণ আছে।

১: এটা স্থায়ী ২: ঠিক এই মুহূর্তেই হতে হবে তা আবশ্যকীয় নয়।

إِنَّ اللَّـهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ “নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু।” (সূরা মুযাম্মিল: ২০)

أَنْتِ رَحْمَتِي أَرْحَمُ بِكِ مَنْ أَشَاءُ مِنْ عِبَادِي».

“তুমি আমার রহমত, তোমার মাধ্যমে আমি আমার বান্দাদের থেকে যাকে ইচ্ছা রহমত করব।”সহীহ বুখারী

যিনি ঈমানদারদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে বিশেষভাবে দয়া করেন। অর্থাৎ দুনিয়াতে তাদেরকে হকের পথ দেখান,হকের পথে প্রতিষ্ঠিত রাখেন,নেক কাজ করার শক্তি ও সামর্থ্য দান করেন,আখিরাতে তাদের হিসাব-নিকাশ সহজ করেন, পুলসিরাত পার করেন,জাহান্নামের শাস্তি থেকে হেফাজত করেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করান

إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفٞ رَّحِيمٞ١٤٣

“নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল, পরম দয়ালু।” [সূরা আল-বাকারা: ১৪৩]

وَأَمَّا ٱلَّذِينَ ٱبۡيَضَّتۡ وُجُوهُهُمۡ فَفِي رَحۡمَةِ ٱللَّهِۖ هُمۡ فِيهَا خَٰلِدُونَ١٠٧

“আর যাদের চেহারা সাদা হবে, তারা তো আল্লাহর রহমতে থাকবে। তারা সেখানে স্থায়ী হবে।” [সূরা আলে ইমরান: ১০৭]

৬:১৩ وَ لَهٗ مَا سَکَنَ فِی الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ ؕ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡعَلِیۡمُ

১৩. আর রাত ও দিনে যা কিছু স্থিত হয়, তা তারই এবং তিনি সবকিছু শুনেন, সবকিছু জানেন।

এখানে سُكُون অর্থ اِسْتَقَرَّ অবস্থান করা; অর্থাৎ পৃথিবীর দিবা-রাত্রিতে যা কিছু অবস্থিত আছে, তা সবই আল্লাহর। [তাবারী] অথবা এর অর্থ سُكُون وحَرْكَت এর সমষ্টি। অর্থাৎ مَا سَكَنَ ومَا تَحَرَّكَ (স্থাবর ও অস্থাবর) আয়াতে শুধু سُكُون উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা, এর বিপরীত حَرْكَت আপনা-আপনিই বুঝা যায়। অথবা سَكَنَ অর্থ যাবতীয় সৃষ্টি। অর্থাৎ যাবতীয় সৃষ্টির মালিকানা আল্লাহরই। [কুরতুবী]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণীঃ

(بِسْمِ اللَّهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ)

আমি শুরু করছি সেই আল্লাহর নামে, যার নামের সাথে পৃথিবী ও আকাশের কোন জিনিষ ক্ষতি সাধন করতে পারে না, এবং তিনিই سَمِيع (সর্বশ্রোতা) ও عَلِيم (সর্বজ্ঞ)’’।আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আদাব, ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ কিতাবুদ্ দুআ। হাকেম সহীহ বলেছেন, (১/৫১৪)।

৬:১৪ قُلۡ اَغَیۡرَ اللّٰهِ اَتَّخِذُ وَلِیًّا فَاطِرِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ هُوَ یُطۡعِمُ وَ لَا یُطۡعَمُ ؕ قُلۡ اِنِّیۡۤ اُمِرۡتُ اَنۡ اَکُوۡنَ اَوَّلَ مَنۡ اَسۡلَمَ وَ لَا تَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ

১৪. বলুন, ‘আমি কি আসমানসমূহ ও যমীনের স্রষ্টা আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করব? তিনিই খাবার দান করেন কিন্তু তাকে খাবার দেয়া হয় না। বলুন, নিশ্চয় আমি আদেশ পেয়েছি যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে যেন আমি প্রথম ব্যক্তি হই, আর (আমাকে আরও আদেশ করা হয়েছে) ‘আপনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা সমস্ত সৃষ্টিকুলের রিযিকের ব্যবস্থা করেন। তিনি পূর্ণ অমুখাপেক্ষী। তাঁর কোন রিযিকের প্রয়োজন পড়ে না। অন্য আয়াতেও আল্লাহ তা’আলা সেটা বলেছেন, আর আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এজন্যেই যে, তারা কেবল আমার ইবাদাত করবে। আমি তাদের কাছ থেকে জীবিকা চাই না এবং এটাও চাই না যে, তারা আমাকে খাওয়াবে, নিশ্চয় আল্লাহ, তিনিই তো রিযকদাতা, প্রবল শক্তিধর, পরাক্রমশালী। [সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬-৫৮] [আদওয়াউল বায়ান]

এর মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পরিহাস নিহিত রয়েছে৷ মুশরিকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে ইল্লাহ বানিয়েছে তারা সবাই নিজেদের এ বান্দাদেরকে জীবিকা দেবার পরিবর্তে বরং এদের থেকে জীবিকা লাভের মুখাপেক্ষী৷ কোন ফেরাউন তার বান্দাদের কাছ থেকে কর ও নযরানা না পেলে প্রভুত্বের দাপট দেখাতে পারে না৷ কোন কবরে সমাহিত ব্যক্তির পূজারীরা যদি তার কবরে জমকালো গম্বুজ তৈরী না করে দেয় তাহলে তার উপাস্য ও আরাধ্য হবার চমক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷ কোন দেবতার পূজারীরা তার মূর্তি বানিয়ে কোন মন্দিরে বা পূজা মণ্ডপে রেখে তাকে সুসজ্জিত ও সুশোভিত না করা পর্যন্ত সে দেবতার দেব মহিমা ও খোদায়ী কর্তৃত্ব ব্যক্ত হবার কোন পথ পায় না৷ এসব বানোয়াট ইলাহদের গোষ্ঠীই তাদের বান্দাদের মুখাপেক্ষী৷ একমাত্র সমগ্র বিশ্বজাহানের প্রকৃত একচ্ছত্র মালিক গৌরব তাঁর আপন শক্তি ও মহিমায় প্রতিষ্ঠিত, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বরং সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী৷

যে উম্মতের মধ্যে আমি প্রেরিত হয়েছি সে উম্মতের মধ্যে ইসলাম গ্রহণ করার ব্যাপারে প্রথম ব্যক্তি হই। এর অর্থ এ নয় যে, সমস্ত জাতির মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হবেন। কারণ, কুরআনের বহু আয়াতে এটা এসেছে যে, তার পূর্বেও নবীগণ ইসলামের উপর ছিলেন এবং অনেক উম্মতও ইসলামের উপর গত হয়েছেন। যেমন

আল্লাহ তা’আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,

﴿إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ ۖ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ

“স্মরণ করুন, যখন তার রব তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ করুন, তিনি বলেছিলেন, আমি সৃষ্টিকুলের রব-এর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৩১]।

فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ۖ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ﴾

আর ইউসুফ আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন, হে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা! দুনিয়ায় ও আখেরাতে আপনিই আমার অভিভাবক৷ “আপনি আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দিন এবং আমাকে সৎকর্মপরায়ণদের অন্তর্ভুক্ত করুন।” [সূরা ইউসুফঃ ১০১] [আদওয়াউল বায়ান]

(সূরা ইউনুস ৬২-৬৪)

১০:৬২ اَلَاۤ اِنَّ اَوۡلِیَآءَ اللّٰهِ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ

জেনে রাখা আল্লাহর বন্ধুদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।

১০:৬৩ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ

যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করত।

১০:৬৪ لَهُمُ الۡبُشۡرٰی فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ فِی الۡاٰخِرَۃِ ؕ لَا تَبۡدِیۡلَ لِکَلِمٰتِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَوۡزُ الۡعَظِیۡمُ ﴿ؕ۶۴﴾

তাদের জন্যই আছে সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে, আল্লাহর বাণীর কোন পরিবর্তন নেই; সেটাই মহাসাফল্য।

৬:১৫ قُلۡ اِنِّیۡۤ اَخَافُ اِنۡ عَصَیۡتُ رَبِّیۡ عَذَابَ یَوۡمٍ عَظِیۡمٍ ﴿

১৫. বলুন, আমি যদি আমার রব-এর অবাধ্যতা করি, তবে নিশ্চয় আমি ভয় করি মহাদিনের শাস্তির।

আয়াতে নির্দেশ অমান্য করার শাস্তি এক বিশেষ ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আদেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনি বলে দিন, মনে কর, যদি আমিও স্বীয় প্রতিপালকের নির্দেশ অমান্য করু, তবে আমারো কিয়ামতের শাস্তির ভয় রয়েছে। আল্লাহর নির্দেশের বিরোধিতা করলে যখন নবীগণের যিনি নেতা, তাকেও ক্ষমা করা যায় না, তখন অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য। যদি কেউ আল্লাহর অবাধ্য হয় আর সে অবাধ্যতা হয় শির্ক বা কুফরীর মাধ্যমে তাহলে তার রক্ষা নেই। সে স্থায়ীভাবে আল্লাহর ক্রোধে ও জাহান্নামে অবস্থান করবে। [সা’দী]

৬:১৬ مَنۡ یُّصۡرَفۡ عَنۡهُ یَوۡمَئِذٍ فَقَدۡ رَحِمَهٗ ؕ وَ ذٰلِکَ الۡفَوۡزُ الۡمُبِیۡنُ

১৬. সেদিন যার থেকে তা সরিয়ে নেয়া হবে, তার প্রতি তো তিনি দয়া করলেন এবং এটাই স্পষ্ট সফলতা

বলা হয়েছে, হাশর দিবসের শাস্তি অত্যন্ত লোমহর্ষক ও কঠোর হবে। কাতাদা বলেন, এখানে যা সরানোর কথা বলা হচ্ছে, তা হচ্ছে শাস্তি। কারো উপর থেকে এ শাস্তি সরে গেলে মনে করতে হবে যে, তার প্রতি আল্লাহর অশেষ করুণা হয়েছে। [তাফসীর আবদির রাযযাক]

অর্থাৎ এটিই বৃহৎ ও প্রকাশ্য সফলতা। [কুরতুবী] এখানে সফলতার অর্থ জান্নাতে প্রবেশ। কারণ, শাস্তি থেকে মুক্তি ও জান্নাতে প্রবেশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

যেমন অন্যত্র বলেছেন, {فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ} ‘‘সুতরাং যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে সফল হবে।’’ (সূরা আল-ইমরান ১৮৫) কারণ, সফলতা হলো অকল্যাণ থেকে বেঁচে যাওয়া এবং কল্যাণ অর্জন করার নাম। আর জান্নাত অপেক্ষা কল্যাণকর জিনিস আর কি হতে পারে?

ইসলামের দৃষ্টিতে পার্থিব জগতের সফলতা চূড়ান্ত সফলতা নয়, বরং পারলৌকিক জীবনের সার্থকতাই সর্বাপেক্ষা মহা সফলতা। দীর্ঘ পড়াশুনা ও বিরাট গবেষণার পর একজন ছাত্র জীবনে প্রতিষ্ঠা না পেলে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন, তার মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। নিজের নৈরাশ্যকে আপন করে পরিবার ও সমাজ থেকে আলাদা করে নেয়। তার বন্ধু-বান্ধবরা সরকারী চাকুরী পেয়ে প্রতিষ্ঠিত ও সফল হয়েছে, অথচ চাকুরী না পেলেও আত্মসম্মানের সাথে জীবন-যাপন করতে কোন অসুবিধা নেই। দুর্নীতির যাঁতাকলে অনেক মেধাবী ছাত্রের জীবন পিষ্ট। জালিয়াতির করাল গ্রাসে অনেক প্রতিভাবান জীবন নির্মম পরিহাসের শিকার। তেজদীপ্ত জ্ঞানের মাধ্যমে পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মুখে হাসি ফোঁটানোর তীব্র ইচছা দিন দিন নিস্প্রভ হয়ে পড়েছে। এমন ব্যর্থতার গ্লানি আমাদের জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়। সদা মনে রাখা উচিত চরম ব্যর্থতা অপেক্ষা করছে পরলোকে। এ জীবনের ব্যর্থতা ক্ষণিকের মাত্র। তথাপি প্রতিভার সাথে অর্থ-সম্পদের বোঝার দায়িত্ব আরও অনেক বেশী।

নবী করীম (সা) বলেন,‘নিশ্চয়ই দুনিয়া চার শ্রেণীর মানুষের জন্য।

১ম শ্রেণীর ব্যক্তি হ’লেন তিনি, আল্লাহ যাকে অর্থ ও জ্ঞান উভয়ই দান করেছেন। সে বিষয়ে তিনি তার রবকে ভয় করেন, তার সম্পদ তিনি তার আত্মীয়-পরিজনদের কাছে পৌঁছে দেন। আর সে ব্যাপারে তিনি আল্লাহর হক সম্পর্কে অবগত। তিনি সর্বোচচ স্তরের অধিকারী।

২য় শ্রেণীর ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ জ্ঞান দান করেছেন, কিন্তু অর্থ দান করেননি, তিনি সঠিক সংকল্পকারী। তিনি মনে মনে বলেন, যদি আমার অর্থ থাকতো তবে আমিও অমুক ব্যক্তির মতো (সৎ) কাজ করতাম। সেটা তার নিয়তের উপর নির্ভর করছে। ফলে তাদের দু’জনের নেকী সমান।

৩য় শ্রেণীর ব্যক্তি, যাকে আল্লাহ অর্থ দান করেছেন কিন্তু জ্ঞান দান করেননি। সে অজ্ঞতাবশত তার সম্পদ তছনছ করে। সম্পদের ক্ষেত্রে নিজ রবকে ভয় করে না। নিজ সম্পদ নিকটাত্মীয়দের পৌঁছে দেয় না এবং সম্পদে আল্লাহর হক জানে না। সে হচেছ সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্তরের অধিকারী।

৪র্থ শ্রেণীর ব্যক্তি, যাকে অর্থ ও জ্ঞান কিছুই দান করা হয়নি, অতঃপর সে বলে, যদি আমাকে অর্থ দান করা হ’ত, তবে আমি অমুক ব্যক্তির ন্যায় কাজ করতাম। বস্ত্তত এটা নির্ভর করছে তার নিয়তের উপর। ফলে তাদের দু’জনের পাপ সমান’তিরমিযী হা/২৩২৫; আহমাদ হা/১৮০৬০, সনদ হাসান।

অর্থাৎ এ জগতের সফলতা আখেরাতের জীবনের সফলতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং এ জগতে যেটা সুখ-শান্তির উৎস ভাবছি পরলোকে তাই দুঃখ-দুর্দশার কারণ হ’তে পারে। ডেকে আনতে পারে স্থায়ী ব্যর্থতার চরম অন্ধকার।

পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সফলতার অসংখ্য বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। পার্থিব জগতের সুখ-সমৃদ্ধি, আননদ-বিলাস, বিত্ত-বৈভবকে তুচছ বস্ত্ত হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ বলেন

,وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ وَمَنْ تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ،

‘তুমি তাদেরকে মন্দ কাজসমূহ থেকে রক্ষা কর। আর যাকে তুমি মন্দ কাজ সমূহ থেকে রক্ষা করলে তাকে তো তুমি ক্বিয়ামতের দিন অনুগ্রহ করলে। আর সেটাই হ’ল মহা সফলতা’ (গাফেরঃ৯)সূরা মুমিনঃ৯

আল্লাহ বলেন, وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَكَ مِنَ الْأُولَى، ‘নিশ্চয়ই পরকাল তোমার জন্য ইহকালের চাইতে কল্যাণকর’ (যোহা ৯৩/৪)।

 

৬:১৭ وَ اِنۡ یَّمۡسَسۡکَ اللّٰهُ بِضُرٍّ فَلَا کَاشِفَ لَهٗۤ اِلَّا هُوَ ؕ وَ اِنۡ یَّمۡسَسۡکَ بِخَیۡرٍ فَهُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

১৭. আর যদি আল্লাহ্‌ আপনাকে কোন দুর্দশা দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর যদি তিনি আপনাকে কোন কল্যাণ দ্বারা স্পর্শ করেন, তবে তিনি তো সব কিছুর উপর ক্ষমতাবানত।

এ আয়াতে ইসলামের একটি মৌলিক বিশ্বাস বর্ণিত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিটি লাভক্ষতির মালিক প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ তা’আলা। সত্যিকারভাবে কোন ব্যক্তি কারো সামান্য উপকারও করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না। আল্লাহ যদি কারও লাভ করতে চান তবে তা বন্ধ করার ক্ষমতা কারও নেই। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “আর আল্লাহ যদি আপনার মংগল চান তবে তার অনুগ্রহ প্রতিহত করার কেউ নেই। তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তার কাছে সেটা পৌছান।” [সূরা ইউনুস: ১০৭]

এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম বাগভী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন, ‘একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটে সওয়ার হয়ে আমাকে পিছনে বসিয়ে নিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেনঃ হে বৎস! আমি আরয করলামঃ আদেশ করুন, আমি হাযির আছি। তিনি বললেনঃ তুমি আল্লাহর বিধি-বিধানকে হেফাযত করবে, আল্লাহ তোমাকে হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর বিধি-বিধানকে হেফাযত করো তাহলে আল্লাহকে সাহায্যের সাথে তোমার সামনে পাবে। তুমি শান্তি ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আল্লাহকে স্মরণ রাখলে, বিপদের সময় তিনি তোমাকে স্মরণ রাখবেন। কোন কিছু চাইতে হলে তুমি আল্লাহর কাছেই চাও এবং সাহায্য চাইতে হলে আল্লাহর কাছেই চাও।

জগতে যা কিছু হবে, ভাগ্যের লেখনী তা লিখে ফেলেছে। সমগ্র সৃষ্টজীব সম্মিলিতভাবে তোমার কোন উপকার করতে চাইলে যা তোমার তাকদিরে লিখা নেই তারা কখনো তা করতে পারবে না। পক্ষান্তরে যদি তারা সবাই মিলে তোমার এমন কোন ক্ষতি করতে চায়, যা তোমার ভাগ্যে নেই, তবে কখনোই তারা তা করতে সক্ষম হবে না। যদি তুমি বিশ্বাস সহকারে ধৈর্যধারণের মাধ্যমে আমল করতে পার তবে অবশ্যই তা করো। সক্ষম না হলে ধৈর্য ধর। কেননা, তুমি যা অপছন্দ করো তার বিপক্ষে ধৈর্য ধারণ করায় অনেক মঙ্গল রয়েছে। মনে রাখবে, আল্লাহর সাহায্য ধৈর্যের সাথে জড়িত-কষ্টের সাথে সুখ এবং অভাবের সাথে স্বাচ্ছদ্য জড়িত। [মুসনাদে আহমাদ: ১/৩০৭]

৬:১৮ وَ هُوَ الۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهٖ ؕ وَ هُوَ الۡحَکِیۡمُ الۡخَبِیۡرُ

১৮. আর তিনিই আপন বান্দাদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণকারী, আর তিনি প্রজ্ঞাময়, সম্যক অবহিত।

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলাই সবার উপর পরাক্রান্ত ও শক্তিমান এবং সবাই তার ক্ষমতাধীন ও মুখাপেক্ষী। এ কারণেই দুনিয়ার জীবনে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন মহোত্তম ব্যক্তিগণও সব কাজে সাফল্য অর্জন করতে পারে না এবং তার সব মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয় না; তিনি নৈকট্যশীল রাসূলই হোন কিংবা রাজা বাদশাহ। আর তিনি যা আদেশ, নিষেধ, সাওয়াব, শাস্তি, সৃষ্টি বা নির্ধারণ যাই করেন তাই প্রজ্ঞাময়। তিনি গোপন যাবতীয় কিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত। এ সবকিছুই তার তাওহীদের প্রমাণ। [সা’দী]

৬:১৯ قُلۡ اَیُّ شَیۡءٍ اَکۡبَرُ شَهَادَۃً ؕ قُلِ اللّٰهُ ۟ۙ شَهِیۡدٌۢ بَیۡنِیۡ وَ بَیۡنَکُمۡ ۟ وَ اُوۡحِیَ اِلَیَّ هٰذَا الۡقُرۡاٰنُ لِاُنۡذِرَکُمۡ بِهٖ وَ مَنۡۢ بَلَغَ ؕ اَئِنَّکُمۡ لَتَشۡهَدُوۡنَ اَنَّ مَعَ اللّٰهِ اٰلِهَۃً اُخۡرٰی ؕ قُلۡ لَّاۤ اَشۡهَدُ ۚ قُلۡ اِنَّمَا هُوَ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ وَّ اِنَّنِیۡ بَرِیۡٓءٌ مِّمَّا تُشۡرِکُوۡنَ ﴿ۘ

১৯. বলুন, কোন জিনিস সবচেয়ে বড় সাক্ষী? বলুন, ‘আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষ্যদাতা। আর এ কুরআন আমার নিকট ওহী করা হয়েছে যেন তোমাদেরকে এবং যার নিকট পৌছবে তাদেরকে এ দ্বারা সতর্ক করতে পারি। তোমরা কি এ সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহও আছে? বলুন, ‘আমি সে সাক্ষ্য দেই না। বলুন, তিনি তো একমাত্র প্রকৃত ইলাহ এবং তোমরা যা শরীক কর তা থেকে আমি অবশ্যই বিমুক্ত।

অর্থাৎ কোন জিনিসের সাক্ষ্য সাক্ষী হিসেবে বড় বলে বিবেচিত? বলুন, আল্লাহ। তিনিই সবচেয়ে বড় সাক্ষী। তার সাক্ষ্যের মধ্যে কোন প্রকার ভুল-ত্রুটির সম্ভাবনা নেই। সুতরাং তিনিই আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষ্য যে, আমি রাসূল। [তাবারী, সা’দী]

অর্থাৎ এ মর্মে সাক্ষী যে, আমি তাঁর পক্ষ থেকে নিযুক্ত এবং যা কিছু বলছি তাঁরি নির্দেশ অনুসারে বলছি৷

কোন বিষয়ের সাক্ষ দেবার জন্য কেবল আন্দাজ-অনুমান যথেষ্ট নয়৷ বরং এ জন্য প্রত্যক্ষ ও সুনিশ্চিত জ্ঞান থাকা অপরিহার্য যেন সে এহেন নিশ্চিত জ্ঞানের ভিত্তিতে বলতে পারে যে, হ্যাঁ, ব্যাপারটি ঠিক এরূপই৷ কাজেই এখানে প্রশ্নের অর্থ হচ্ছে, সত্যিই কি তোমরা নির্ভুলভাবে একথা জানো যে, এ বিশাল সৃষ্টিজগতে আল্লাহ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন প্রভু আছে, যে, বন্দেগী ও পূজা-অর্চনা লাভের যোগ্য?

অর্থাৎ যদি তোমরা নির্ভুল ও নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়া নিছক মিথ্যা সাক্ষ দিতে চাও, তাহলে দিতে পারো কিন্তু আমি তো এ ধরনের সাক্ষ দিতে পারি না৷

এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক সেই ব্যক্তির জন্যই ভীতিপ্রদর্শনকারী যার কাছে এ কুরআনের আহবান পৌছেছে, সে যে-ই হোক না কেন। সুতরাং যার কাছেই এ আহবান পৌছবে সে তাতে ঈমান আনতে বাধ্য। যদি তা না করে তবে সে হবে জাহান্নামী। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত যে সর্বকাল ও সর্বজনব্যাপী তার প্রমাণ কুরআনের অন্য আয়াতেও এসেছে, “বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসূল।” [সূরা আল-আরাফ: ১৫৮]

আরও এসেছে, “আর আমরা তো আপনাকে কেবল সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” [সূরা সাবা: ২৮] আরও এসেছে, “কত বরকতময় তিনি! যিনি তার বান্দার উপর ফুরকান নাযিল করেছেন, সৃষ্টিকুলের জন্য সতর্ককারী হতে।” [সূরা আল-ফুরকান: ১]। আর যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনবে না, তাদের শাস্তি যে জাহান্নাম এ কথাও কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “অন্যান্য দলের যারা তাতে কুফর করে, আগুনই তাদের প্রতিশ্রুত স্থান।” [সূরা হুদ: ১৭] [আদওয়াউল বায়ান]

৬:২০ اَلَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰهُمُ الۡکِتٰبَ یَعۡرِفُوۡنَهٗ کَمَا یَعۡرِفُوۡنَ اَبۡنَآءَهُمۡ ۘ اَلَّذِیۡنَ خَسِرُوۡۤا اَنۡفُسَهُمۡ فَهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ

২০. আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাকে সেরূপ চিনে যেরূপ চিনে তাদের সন্তানদেরকে। যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে, তারাই ঈমান আনবে না।

يَعْرِفُوْنَهُ তে সর্বনাম (তাকে)এর লক্ষ্যস্থল হল রসূল (সাঃ)। অর্থাৎ, কিতাবধারীরা রসূল (সাঃ)-কে ঐভাবেই চিনত, যেভাবে তারা তাদের ছেলেদেরকে চিনত। কারণ, রসূল (সাঃ)-এর নিদর্শনাবলী ও তাঁর পরিচয় তাদের কিতাবগুলোতে বর্ণনা করা হয়েছিল এবং এই নিদর্শনাবলীর কারণে তারা তাঁর অপেক্ষাতেও ছিল। তাই এখন তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে না, তারা বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কেননা, তারা জানা সত্ত্বেও অস্বীকার করছে। فَإِنْ كُنْتَ لاََ تَدْرِيْ فَتِلْكَ مُصِيْبَة * وَإِنْ كُنْتَ تَدْرِيْ فَالْمُصِيْبَةُ أَعْظَمُ।

(যদি তোমার না জানা থাকে তবে এটা মুসীবত, কিন্তু যদি জানা থাকে তাহলে তো মুসীবত আরো বড়।)

তাফহিমুল কুর’আনে ব্যাখ্যায় এসেছে-

যারা আসমানী কিতাবসমূহের জ্ঞান রাখে, তারা সন্দেহাতীতভাবে এ সত্যটি জানে ও উপলব্ধি করে যে, আল্লাহ একক সত্তা এবং তাঁর প্রভুত্বের কর্তৃত্বে আর কেউ শরীক নয়৷ যেমন কারোর ছেলে অন্যান্য ছেলেদের ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে তাকে চিনে নেয়, ঠিক তেমনি যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান রাখে, সে ইলাহী কর্তৃত্ব ও উপাস্য হবার ব্যাপারে মানুষের অসংখ্য আকীদা, বিশ্বাস ও মতবাদের মধ্য থেকে কোন প্রকার সন্দেহ সংশয় ছাড়াই প্রকৃত সত্যটি সহজেই চিনে নেয়৷

সংগ্রহে-

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন