সূরা আনআমঃ ১৩তম রুকু (১০১-১১০)আয়াত সমূহ

 সূরা আনআমঃ ১৩তম রুকু (১০১-১১০)আয়াত সমূহ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৬:১০১ بَدِیۡعُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَنّٰی یَکُوۡنُ لَهٗ وَلَدٌ وَّ لَمۡ تَکُنۡ لَّهٗ صَاحِبَۃٌ ؕ وَ خَلَقَ کُلَّ شَیۡءٍ ۚ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿

১০১. তিনি আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, তার সন্তান হবে কিভাবে? তার তো কোন সঙ্গিনী নেই। আর তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক বস্তু সম্বন্ধে তিনি সবিশেষ অবগত।

যেমন আল্লাহ তাআলা এই সমস্ত জিনিসকে সৃষ্টি করার ব্যাপারে এক ও একক, তাঁর কোন শরীক নেই, অনুরূপ তিনিই এই যোগ্যতার দাবী রাখেন যে, একমাত্র কেবল তাঁরই ইবাদত করা হোক। তাঁর ইবাদতে অন্য কাউকে শরীক স্থির করা না হোক। কিন্তু মানুষ এই একক সত্তাকে বাদ দিয়ে জ্বিনদেরকে তাঁর শরীক বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তারাও আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট। মুশরিকরা তো মূর্তির অথবা কবরে সমাধিস্থ ব্যক্তিবর্গের পূজা করত। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে যে, তারা জ্বিনদেরকে আল্লাহর শরীক বানিয়ে রেখেছে। আসলে ব্যাপার হল, এখানে জ্বিনদের বলতে শয়তানদেরকে বুঝানো হয়েছে এবং শয়তানদের কথা অনুযায়ীই শিরক করা হয়, তাই প্রকৃতপক্ষে পূজা ও উপাসনা শয়তানেরই করা হয়। এই বিষয়টাকে কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন

﴿إِن يَدْعُونَ مِن دُونِهِ إِلَّا إِنَاثًا وَإِن يَدْعُونَ إِلَّا شَيْطَانًا مَّرِيدًا﴾

১১৭) এ ধরনের লোকেরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে দেবীর পূজা করে৷ তারা সেই বিদ্রোহী শয়তানের পূজা করে, সূরা নিসার ১১৭নং

শয়তানকে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে পূজা অর্চনা করে না বা তাকে সরাসরি আল্লাহর মর্যাদায় অভিসিক্ত করে না৷ এ অর্থে কেউ শয়তানকে মাবুদ বানায় না, একথা ঠিক৷ তবে নিজের প্রবৃত্তি, ইচ্ছা আশা-আকাংখা ও চিন্তা –ভাবনার লাগাম শয়তানের হাতে তুলে দিয়ে যেদিকে সে চালায় সেদিকে চলা এবং এমনভাবে চলা যেন সে শয়তানের বান্দা এবং শয়তান তার প্রভু—এটাইতো শয়তানকে মাবুদ বানাবার একটি পদ্ধতি ৷ এ থেকে জানা যায়, বিনা বাক্য ব্যয়ে, নির্দেশ মেনে চলা এবং অন্ধভাবে কারো হুকুম পালন করার নামই ‌‌‌‌‌’ইবাদত৷’ আর যে ব্যক্তি এভাবে কারো আনুগত্য করে সে আসলে তার ইবাদাত করে৷

﴿يَا أَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّيْطَانَ ۖ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلرَّحْمَٰنِ عَصِيًّا﴾

৪৪) আব্বাজান!আপনি শয়তানের বন্দেগী করবেন না৷ শয়তান তো করুণাময়ের অবাধ্য৷ সূরা মারয়্যামের ৪৪ নং

﴿أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَن لَّا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ ۖ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ﴾

৬০) হে আদম সন্তানেরা!আমি কি তোমাদের এ মর্মে হিদায়াত করিনি যে, শয়তানের বন্দেগী করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু  সূরা ইয়াসীনের ৬০ নং

৬:১০২ ذٰلِکُمُ اللّٰهُ رَبُّکُمۡ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۚ خَالِقُ کُلِّ شَیۡءٍ فَاعۡبُدُوۡهُ ۚ وَ هُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ وَّکِیۡلٌ ﴿

১০২. তিনিই তো আল্লাহ, তোমাদের রব; তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা; কাজেই তোমরা তাঁর ইবাদত কর; তিনি সবকিছুর তত্ত্বাবধায়ক।

৬:১০৩ لَا تُدۡرِکُهُ الۡاَبۡصَارُ ۫ وَ هُوَ یُدۡرِکُ الۡاَبۡصَارَ ۚ وَ هُوَ اللَّطِیۡفُ الۡخَبِیۡرُ ﴿

১০৩. দৃষ্টিসমূহ তাঁকে আয়ত্ব করতে পারে না, অথচ তিনি সকল দৃষ্টিকে আয়ত্ব করেন এবং তিনি সূক্ষ্মদশী, সম্যক অবহিত।

 

আলোচ্য আয়াতে أبصار শব্দটি بصر এর বহুবচন। এর অর্থ দৃষ্টি এবং দৃষ্টিশক্তি। إدراك শব্দের অর্থ পাওয়া, ধরা, বেষ্টন করা। [ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এস্থলে إدراك শব্দের অর্থ বেষ্টন করা বর্ণনা করেছেন। এতে আয়াতের অর্থ হয় এই যে, জীন, মানব, ফিরিশতা ও যাবতীয় জীব-জন্তুর দৃষ্টি একত্রিত হয়েও আল্লাহর সত্তাকে বেষ্টন করে দেখতে পারে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ তা’আলা সমগ্র সৃষ্টজীবের দৃষ্টিকে পূর্ণরূপে দেখেন এবং সবাইকে বেষ্টন করে দেখেন। এ সংক্ষিপ্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলার দুটি বিশেষ গুণ বর্ণিত হয়েছে। (এক) সমগ্র সৃষ্ট জগতে কারও দৃষ্টি বরং সবার দৃষ্টি একত্রিত হয়েও তাঁর সত্তাকে বেষ্টন করতে পারে না। (দুই) তার দৃষ্টি সমগ্র সৃষ্টিজগতকে পরিবেষ্টনকারী জগতের অণু-কণা পরিমাণ বস্তুও তার দৃষ্টির অন্তরালে নয়। সর্বাবস্থায় এ জ্ঞান এবং জ্ঞানগত পরিবেষ্টনও আল্লাহ তা’আলারই বৈশিষ্ট। তাকে ছাড়া কোন সৃষ্ট বস্তুর পক্ষে সমগ্র সৃষ্টজগত ও তার অণু-পরমাণুর এরূপ জ্ঞান লাভ কখনো হয়নি এবং হতে পারেও না। কেননা, এটা আল্লাহ্ তা’আলার বিশেষ গুণ।

মানুষ আল্লাহ্ তা’আলাকে দেখতে পাবে কিনা। এ মাসআলার দুটি দিক আছেঃ দুনিয়াতে তাঁকে কেউ দেখা সম্ভব কিনা? এ মাসআলারও দুটি দিক রয়েছে, একঃ তাকে স্বপ্নে দেখা। এ ধরণের দেখা সম্ভব বলেই অনেকে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা তাদের মতের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আল্লাহকে দেখার উপর বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করেন। দুই. দুনিয়াতে সরাসরি চোখ দ্বারা আল্লাহকে দেখা। দুনিয়াতে এ ধরণের দেখা কখনই সম্ভব নয়। এর দলীল হলোঃ মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহকে দেখতে চেয়ে বলেছিলেনঃ (رَبِّ أَرِنِي) “হে রব! আমাকে দেখা দিন”, তখন উত্তরে বলা হয়েছিলঃ (لَنْ تَرَانِي) আপনি আমাকে দেখতে পাবেন না। [সূরা আল-আরাফ: ১৪৩]

আল্লাহর নবী হয়েও যখন মূসা আলাইহিস সালাম এ উত্তর পেয়েছিলেন, তখন অন্য কোন জ্বিন ও মানুষের সাধ্য কি যে দুনিয়ার এ চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখবে! আখেরাতে ঈমানদারগণ আল্লাহ্ তা’আলাকে দেখতে পাবে। আখেরাতে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তা’আলার সাক্ষাত ঘটবে- হাশরে অবস্থানকালেও এবং জান্নাতে পৌছার পরও। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ও বিশ্বাস। এর সপক্ষে দলীল প্রমাণাদি অনেক, নীচে তার কিছু উল্লেখ করা হলোঃ

কুরআন থেকেঃ

আল্লাহর বাণীঃ (وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ ٭ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٌ) “সেদিন কিছু চেহারা হবে সজীব ও প্রফুল্ল। তারা স্বীয় রবকে দেখতে থাকবে। [সূরা আল-কিয়ামাহঃ ২২-২৩]

আল্লাহর বাণীঃ (لَهُمْ مَا يَشَاءُونَ فِيهَا وَلَدَيْنَا مَزِيدٌ) “তারা তাতে যা চাইবে তাই পাবে, আর আমাদের কাছে আছে আরো কিছু বাড়তি। [সূরা ক্বাফঃ ৩৫]। এ আয়াতের তাফসীরে আলী ও আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ বাড়তি বিষয় হলোঃ আল্লাহর চেহারার দিকে তাকানোর সৌভাগ্য’।

আল্লাহ্‌ তা’আলা কুরআনের অন্যত্র বলেছেনঃ (كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ) “কাফেররা সেদিন স্বীয় রব-এর সাক্ষাত থেকে বঞ্চিত থাকবে। [সূরা আল-মুতাফফেফীনঃ ১৫]। এর দ্বারা কাফের ও অবিশ্বাসীরা সেদিনও সাজা হিসেবে আল্লাহকে দেখার গৌরব থেকে বঞ্চিত থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ আয়াতের দ্বারা এটা স্পষ্ট হলো যে, যারা ঈমানদার তাদের এ শাস্তি হবে না। অর্থাৎ তারা আল্লাহকে দেখতে পাবে।

আল্লাহর বাণীঃ (لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ) “যারা সৎ কাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, তদুপরি তার উপর রয়েছে কিছু বাড়তি”। [সূরা ইউনুসঃ ২৬]। এ আয়াতের তাফসীরে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি আল্লাহকে দেখা বলে সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে। যার আলোচনা পরবর্তী বর্ণনায় হাদীস থেকে আসছে।

সহীহ হাদীস থেকেঃ

বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ঈমানদারদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলাকে দেখার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, সে সমস্ত হাদীস মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌছেছে। ইমাম দারকুতনী এ সংক্রান্ত বিশটির মত হাদীস বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম আবুল কাসেম লালাকা’য়ী ত্রিশটির মত হাদীস বর্ণনা করেছেন। নীচে এর কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করার পর আল্লাহ্ বলবেনঃ তোমরা যেসব নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছ, এগুলোর চাইতে বৃহৎ আরো কোন নেয়ামতের প্রয়োজন হলে বল, আমি তাও দেব। জান্নাতীরা নিবেদন করবেঃ ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং জান্নাতে স্থান দিয়েছেন। এর বেশী আমরা আর কি চাইব। তখন মধ্যবর্তী পর্দা সরিয়ে নেয়া হবে এবং সবার সাথে আল্লাহর সাক্ষাত হবে। এটিই হবে জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত’। [সহীহ মুসলিমঃ ১৮১] জান্নাতীদের জন্য আল্লাহর সাক্ষাতই হবে সর্ববৃহৎ নেয়ামত

অন্য এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক চন্দ্রালোকিত রাতে সাহাবীদের সমভিব্যাহারে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেনঃ তোমরা স্বীয় রবকে এ চাঁদের ন্যায় চাক্ষুষ দেখতে পাবে’৷ [বুখারীঃ ৫৫৪, ৭৪৩৫, ৭৪৩৭] বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, ইবন আবিল ইয আল-হানাফী, শারহুল আকীদাতিত তাহাভীয়্যা।

(৩) আরবী অভিধানে لطيف শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ঃ (এক) দয়ালু, (দুই) সূক্ষ্ম বস্তু যা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা বা জানা যায় না। خبير শব্দের অর্থ খবর রাখে। এখানে অর্থ হবে- তিনি খবর রাখেন। সমগ্র সৃষ্টিজগতের কণা পরিমাণ বস্তুও তার জ্ঞান ও খবরের বাইরে নয়। এখানে لطيف শব্দের অর্থ দয়ালু নেয়া হলে আলোচ্য বাক্যে এদিকে ইঙ্গিত হবে যে, তিনি যদিও আমাদের প্রত্যেক কথা ও কাজের খবর রাখেন এবং এজন্যে আমাদের গোনাহর কারণে আমাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন, কিন্তু যেহেতু তিনি দয়ালুও, তাই সব গোনাহর কারণেই পাকড়াও করেন না। [সিফাতুল্লাহিল ওয়ারিদা ফিল কিতাবি ওয়াসসুন্নাতি]

৬:১০৪ قَدۡ جَآءَکُمۡ بَصَآئِرُ مِنۡ رَّبِّکُمۡ ۚ فَمَنۡ اَبۡصَرَ فَلِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ عَمِیَ فَعَلَیۡهَا ؕ وَ مَاۤ اَنَا عَلَیۡکُمۡ بِحَفِیۡظٍ ﴿۱۰

১০৪. অবশ্যই তোমাদের রব-এর কাছ থেকে তোমাদের কাছে চাক্ষুষ প্রমাণাদি এসেছে। অতঃপর কেউ চক্ষুষ্মান হলে সেটা দ্বারা সে নিজেই লাভবান হবে, আর কেউ অন্ধ সাজলে তাতে সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর আমি তোমাদের উপর সংরক্ষক নই।

এ বাক্যটি আল্লাহর কালাম হলেও নবীর পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়েছে৷ কুরআন মজীদে বক্তার লক্ষ্য ও সম্বোধন বারবার পরিবর্ততিত হয়৷ কখনো নবীকে সম্বোধন করা হয়, কখনো মুমিনদেরকে, কখনো আহলি কিতাবদেরকে, কখনো কাফের ও মুশরিকদেরকে, কখনো কুরাইশদেরকে, কখনো আরববাসীদেরকে আবার কখনো সাধারণ মানুষকে সম্বোধন করা হয়৷ অথচ আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমগ্র মানব জাতীর হেদায়াত৷ অনুরূপভাবে সম্বোধনকারী ও বক্তাওবাবর পরিবর্তিত হয়৷ কোথাও বক্তা হন আল্লাহ নিজেই, কোথাও অহী বহনকারী ফেরেশতা,কোথাও ফেরেশতাদের দল, কোথাও নবী আবার ঈমানদাররা৷ অথচ এসব অবস্থায় সমস্ত কালামই একমাত্র আল্লাহরই কালাম হয়ে থাকে৷

“আমি তো তোমাদের পাহারাদার নই”-এ বাক্যের মানে হচ্ছে, তোমাদের কাছে আলো পৌছে দেয়াই শুধু আমার কাজ৷ তারপর চোখ খুলে দেখা বা না দেখা তোমাদের কাজ৷ যারা চোখ বন্ধ করে রেখেছে জোরপূর্বখ তাদের চোখ খুলো দেবো এবং যা কিছু তারা দেখছে না তা তাদেরকে দেখিয়ে ছাড়বো, এটা আমার দায়িত্ব নয়৷

এ আয়াতের بصائر শব্দটি بصيرة এর বহুবচন। এর অর্থ বুদ্ধি ও জ্ঞান। অর্থাৎ যে শক্তি দ্বারা মানুষ অতিন্দ্রীয় বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। আয়াতে بصائر বলে ঐসব যুক্তি-প্রমাণ ও উপায়াদিকে বোঝানো হয়েছে, যেগুলো দ্বারা মানুষ সত্য ও বাস্তব রূপকে জানতে পারে। আয়াতের অর্থ এই যে, আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে সত্য দর্শনের উপায়-উপকরণ পৌছে গেছে। [আল-মানার] অর্থাৎ কুরআন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও বিভিন্ন মু’জিযা আগমন করেছে। [ইবন কাসীর] তাছাড়া তোমরা রাসূলের চরিত্র, কাজকর্ম ও শিক্ষা প্রত্যক্ষ করছ।

এগুলোই হচ্ছে সত্য দর্শনের উপায়। অতএব, যে ব্যক্তি এসব উপায় ব্যবহার করে চক্ষুষ্মান হয়ে যায়, সে নিজেরই উপকার সাধন করে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এসব উপায় পরিত্যাগ করে সত্য সম্পর্কে অন্ধ হয়ে থাকে, সে নিজেরই ক্ষতি সাধন করে। [আল-মানার আইসারুত তাফসীর, মুয়াসসার]

অর্থাৎ মানুষকে জবরদস্তিমূলকভাবে অশোভনীয় কাজ থেকে বিরত রাখা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দায়িত্ব নয়, যেমন সংরক্ষকের দায়িত্ব হয়ে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশাবলী পৌছে দেয়া ও বুঝিয়ে দেয়া। এরপর স্বেচ্ছায় সেগুলো অনুসরণ করা না করা মানুষের দায়িত্ব। [সা’দী]

 

৬:১০৫ وَ کَذٰلِکَ نُصَرِّفُ الۡاٰیٰتِ وَ لِیَقُوۡلُوۡا دَرَسۡتَ وَ لِنُبَیِّنَهٗ لِقَوۡمٍ یَّعۡلَمُوۡنَ ﴿

১০৫. আর এভাবেই আমরা নানাভাবে আয়াতসমূহ বিবৃত করি এবং যাতে তারা বলে, আপনি পড়ে – নিয়েছেন, আর যাতে আমরা এটাক সুস্পষ্টভাবে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য বর্ণনা করি।

অর্থাৎ এভাবেই আমরা আমাদের আয়াতসমূহকে বিশদভাবে বর্ণনা করি, যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। [জালালাইন]

অর্থাৎ, আমি তাওহীদ এবং তার দলীলাদিকে এমনভাবে পরিষ্কার ভাষায় বিভিন্ন আকারে বর্ণনা করি যে, তা দেখে মুশরিকরা বলে, মুহাম্মাদ (সাঃ) কোথাও থেকে পড়ে এবং শিখে এসেছে।

এর মর্ম এই যে, হেদায়াতের সব সাজ-সরঞ্জাম, মু’জিযা, অনুপম প্রমাণাদি- যেমন, কুরআন- একজন নিরক্ষরের মুখ দিয়ে এমন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সত্য প্রকাশ করা, যা ব্যক্ত করতে জগতের সব দার্শনিক পর্যন্ত অক্ষম এবং এমন অলঙ্কারপূর্ণ কালাম উচ্চারিত হওয়া, যার সমতুল্য কালাম রচনা করার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সমস্ত জিন ও মানুষকে চ্যালেঞ্জ করার পরও সারা বিশ্ব অক্ষমতা প্রকাশ করেছে- সত্য দর্শনের এসব সরঞ্জাম দেখে যে কোন হটকারী অবিশ্বাসীরও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য নিদ্বিধায় মেনে নেয়া উচিত ছিল, কিন্তু যাদের অন্তরে বক্রতা বিদ্যমান ছিল, তারা বলতে থাকে, এসব জ্ঞান-বিজ্ঞান তুমি কারো কাছ থেকে অধ্যয়ন করে নিয়েছ। এটা ছিল কাফেরদের নিত্য-মন্তব্যের একটি। তারা এ ধরনের মন্তব্য করেই যাচ্ছিল।

অন্য আয়াতেও এটা বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ বলেন,

“আমরা অবশ্যই জানি যে, তারা বলে, তাকে তো শুধু একজন মানুষ শিক্ষা দেয়।” তারা যার প্রতি এটাকে সম্পর্কযুক্ত করার জন্য ঝুঁকছে তার ভাষা তো আরবী নয়; কিন্তু কুরআনের ভাষা স্পষ্ট আরবী ভাষা। [সূরা আন-নাহ্‌ল: ১০৩]

আল্লাহ আরও বলেন, “অতঃপর সে বলল, “এটা তো লোক পরম্পরায় প্রাপ্ত জাদু ভিন্ন আর কিছু নয়, ‘এ তো মানুষেরই কথা’। অচিরেই আমি তাকে দগ্ধ করব সাকার এ।” [আল-মুদ্দাসসির ২৪-২৬)

তিনি আরও বলেন, কাফেররা বলে, এটা মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়, সে এটা রটনা করেছে এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে। সুতরাং অবশ্যই কাফেররা যুলুম ও মিথ্যা নিয়ে এসেছে।” তারা আরও বলে, এগুলো তো সে কালের উপকথা, যা সে লিখিয়ে নিয়েছে; তারপর এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তার কাছে পাঠ করা হয়। “বলুন, এটা তিনিই নাযিল করেছেন যিনি আসমানসমূহ ও যমীনের সমুদয় রহস্য জানেন; নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [আল-ফুরকান: ৪-৬] [আদওয়াউল বায়ান]

এখানে এটা বলে কুরআন উদ্দেশ্য হতে পারে। [ফাতহুল কাদীর] অনুরূপভাবে পূর্বোক্ত আয়াতসমূহে যে হক প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে তাও হতে পারে। উদ্দেশ্য এই যে, আমাদের নানাভাবে বর্ণনা পদ্ধতি দ্বারা যারা জানে তারা হককে জানতে পারবে, সেটা গ্রহণ করতে পারবে, সে হকের অনুসরণ করতে পারবে। আর তারা হচ্ছে, মুমিনরা যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার উপর যা নাযিল হয়েছে সে সবের উপর ঈমান আনয়ন করেছিল। [মুয়াসসার]

অর্থাৎ সঠিক বুদ্ধিমান ও সুস্থ জ্ঞানীদের জন্য এ বর্ণনা উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। মোটকথা এই যে, হেদায়াতের সরঞ্জাম সবার সামনেই রাখা হয়েছে। কিন্তু কুটিল ব্যক্তিরা এর দ্বারা উপকৃত হয়নি। পক্ষান্তরে সুস্থ জ্ঞানী মনীষীরা এর মাধ্যমে সত্যের পথ প্রদর্শক হয়ে গেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলা হয়েছে, কে মানে আর কে মানে না- তা আপনার দেখার বিষয় নয়। আপনি স্বয়ং ঐ পথ অনুসরণ করুন, যা অনুসরণ করার জন্য আপনার রব-এর পক্ষ থেকে আপনার প্রতি ওহী আগমন করেছে। এর প্রধান বিষয় হচ্ছে এ বিশ্বাস যে, আল্লাহ ছাড়া উপাসনার যোগ্য আর কেউ নেই। এ ওহী প্রচারের নির্দেশও রয়েছে। এর উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে মুশরিকদের জন্য পরিতাপ করবেন না যে, তারা কেন গ্রহণ করল না।

 

এর কারণ এটাই ব্যক্ত করা হয়েছে যে, আল্লাহ যদি সৃষ্টিগতভাবে ইচ্ছা করতেন যে, সবাই মুসলিম হয়ে যাক, তবে কেউ শির্ক করতে পারতো না। কিন্তু তাদের দুষ্কৃতির কারণে তিনি ইচ্ছা করেননি, বরং তাদেরকে শাস্তি দিতেই চেয়েছেন। তাই শাস্তির সরঞ্জামও সরবরাহ করে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় আপনি তাদেরকে কিরূপে মুসলিম করতে পারেন? আপনি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন কেন, আমি আপনাকে তাদের সংরক্ষক নিযুক্ত করিনি এবং আপনি এসব কাজকর্মের কারণে তাদেরকে শাস্তি দেয়ার জন্য আমার পক্ষ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্তও নন। কাজেই তাদের কাজকর্মের ব্যাপারে আপনার উদ্বিগ্ন না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। [দেখুন, আল-মানার]

সূরা বাকারার তৃতীয় রুকূতে যে কথা বলা হয়েছে সে একই কথা এখানেও বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ মশা, মাকড়শা ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীট পতংগের উপমা শুনে এগুলোর মাধ্যমে যে মহাসত্য উদঘাটনা করা হয়েছে সত্য সন্ধানীরা তার নাগাল পেয়ে যায়৷ কিন্তু অস্বীকৃতি ও অবাধ্যতার রোগে যারা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে তারা বিদ্রুপের সূরে বলতে থাকে, আল্লাহর কালামে এ তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসগুলোর উল্লেখের কী প্রয়োজন হতে পারে! এ বিষয়বস্তুটিকে এখানে অন্য একভাবে বর্ণনা করা হয়েছে৷ এখানে একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহর এ কালামটি লোকদের জন্য একটি পরীক্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছে৷ ফলে এর মাধ্যমে খাঁটি ও অখাঁটি মানুষের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়ে যাচ্ছে৷ এক দল লোক এ কালামে শুনে বা পড়ে এর উদ্দশ্যে ও মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং এর মধ্য যেসব জ্ঞান ও উপদেশের কথা বলা হয়েছে তা থেকে লাভবান হয়৷ অন্যদিকে এগুলো শুনার পর আর একদল লোকের চিন্তা কালামের মূল বক্তব্যের দিকে না গিয়ে আর এক ভিন্নধর্মী অনুসন্ধারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে৷ তারা অনুসন্ধান করতে থাকে, এ নিরক্ষর ব্যক্তি এ ধরনের রচনা আনলো কোথা থেকে? আর যেহেতু বিরোধিতাসুলভ বিদ্বেষে তাদের অন্তর আগে থেকে আচ্ছন্ন থাকে, তাই একমাত্র আল্লাহর পক্ষে থেকে অবতীর্ণ হবার সম্ভাবনা বাদ দিয়ে বাকি সকল প্রকার সম্ভাবনাই তাদের মনে উঁকি দিতে থাকে৷ এগুলোকে তারা এমনভাবে বর্ণনা করতে থাকে যেন মনে হয় তারা এ কিতাবের উৎস সন্ধানে সফলকাম হয়ে গেছে৷

৬:১০৬ اِتَّبِعۡ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۚ وَ اَعۡرِضۡ عَنِ الۡمُشۡرِکِیۡنَ

১০৬. আপনার রব-এর কাছ থেকে আপনার প্রতি যা ওহী হয়েছে আপনি তারই অনুসরণ করুন, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই এবং মুশরিকদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন।

৬:১০৭ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰهُ مَاۤ اَشۡرَکُوۡا ؕ وَ مَا جَعَلۡنٰکَ عَلَیۡهِمۡ حَفِیۡظًا ۚ وَ مَاۤ اَنۡتَ عَلَیۡهِمۡ بِوَکِیۡلٍ ﴿۱۰

১০৭. আর আল্লাহ যদি ইচ্ছে করতেন তবে তারা শির্ক করত না। আর আমরা আপনাকে তাদের হিফাযতকারী বানাইনি এবং আপনি তাদের তত্ত্বাবধায়কও নন।

আল্লাহর ইচ্ছা এক জিনিস এবং তাঁর সন্তুষ্টি আর এক জিনিস। তাঁর সন্তুষ্টি তো তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করার মধ্যেই। তবে তিনি এর উপর মানুষকে বাধ্য করেননি। কেননা, বাধ্য করলে মানুষকে পরীক্ষা করা যেত না। পক্ষান্তরে আল্লাহর এখতিয়ারে তো এ কথা আছে যে, তিনি ইচ্ছা করলে কোন মানুষ শিরক করার কোন ক্ষমতাই রাখত না।

৩৫. আর যদি তাদের উপেক্ষা আপনার কাছে কষ্টকর হয় তবে পারলে ভূগর্ভে সুড়ঙ্গ বা আকাশে সিড়ি খোঁজ করুন এবং তাদের কাছে কোন নিদর্শন নিয়ে আসুন। আর আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করলে তাদের সবাইকে অবশ্যই সৎপথে একত্র করতেন। কাজেই আপনি মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। আনয়াম ৩৫

এর অর্থ হচ্ছে,তোমাকে আহবায়ক ও প্রচারকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, কোতায়ালের দায়িত্ব নয়৷ লোকদের সামনে এ আলোকবর্তিকাটি তুলে ধরা এবং সত্যের পূর্ণ প্রকাশের ব্যাপারে নিজের পক্ষ থেকে কোন প্রকার ত্রুটি না রাখাই কাজ এখন কেউ এ সত্যটি গ্রহণ না করতে চাইলে না করুক৷ লোকদেরকে সত্যপন্থী বানিয়েই ছাড়তে হবে, এ দায়িত্ব তোমাকে দেয়া হয়নি৷ তোমাদের নবুওয়াতের প্রভাবাধীন এলাকার মধ্যে মিথ্যার অনুসারী কোন এক ব্যক্তিও থাকতে পারবে না, একথাটিকে তোমার দায়িত্ব ও জবাবদিহির অন্তরভূক্ত করা হয়নি৷ কাজেই অন্ধদেরকে কিভাবে চক্ষুষ্মান করা যায় এবং যারা চোখ খুলে দেখতে চায় না তাদেরকে কিভাবে দেখানো যায়- এ চিন্তায় তুমি খামখা নিজের মন মস্তিস্ককে পেরেশান করো না৷ দুনিয়ায় একজনও বাতিলপন্থী থাকতে না দেয়াটাই যদি যথার্থই আল্লাহর উদ্দেশ্য হতো তাহলে এ কাজটি তোমাদের মাধ্যমে করাবার আল্লাহর কি প্রয়োজন ছিল? তার একটি মাত্র প্রাকৃতিক ইংগিতেই কি দুনিয়ার সমস্ত মানুষকে সত্যপন্থী করার জন্য যথেষ্ট ছিল না? কিন্তু সেখানে এটা আদতে উদ্দেশ্যের অন্তরভূক্তই নয়৷ সেখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে,মানুষের জন্য সত্য ও মিথ্যার মধ্য থেকে কোন একটিকে বাছাই করে নেবার স্বাধীনতা বজায় রাখা,তারপর সত্যের আলো তার সামনে তুলে ধরে উভয়ের মধ্য থেকে কোনটিকে সে গ্রহণ করে তা পরীক্ষা করা৷ কাজেই যে আলো তোমাকে দেখানো হয়েছে তার উজ্জ্বল আভায় তুমি নিজে সত্য-সরল পথে চলতে থাকো এবং অন্যদেরকে সে পথে চলার জন্য আহবান জানাও৷ এটিই হচ্ছে তোমার জন্য সঠিক কর্মপদ্ধতি৷ যারা এ দাওয়াত গ্রহণ করে তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরো এবং দুনিয়ার দৃষ্টিতে তারা যতই নগণ্য হোক না কেন তাদেরকে তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন করো না৷ আর যারা এ দাওয়াত গ্রহণ করেনি তাদের পেছনে লেগে থেকো না৷ তারা যে অশুভ পরিণামের দিকে নিজেরাই চলে যেতে চায় এবং যাবার জন্য অতি মাত্রায় উদগ্রীব, সেদিকে তাদেরকে যেতে চাও৷

 

৬:১০৮ وَ لَا تَسُبُّوا الَّذِیۡنَ یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ فَیَسُبُّوا اللّٰهَ عَدۡوًۢا بِغَیۡرِ عِلۡمٍ ؕ کَذٰلِکَ زَیَّنَّا لِکُلِّ اُمَّۃٍ عَمَلَهُمۡ ۪ ثُمَّ اِلٰی رَبِّهِمۡ مَّرۡجِعُهُمۡ فَیُنَبِّئُهُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿

১০৮. আর আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমলংঘন করে অজ্ঞানতাবশতঃ আল্লাহকেও গালি দেবে; এভাবে আমরা প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ শোভিত করেছি; তারপর তাদের রব-এর কাছেই তাদের প্রত্যাবর্তন। এরপর তিনি তাদেরকে তাদের করা কাজগুলো সম্বন্ধে জানিয়ে দেবেন।

আলোচ্য আয়াতটি একটি বিশেষ ঘটনা সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক মাসআলা নির্দেশিত হয়েছে যে, যে কাজ করা বৈধ নয়, সে কাজের কারণ ও উপায় হওয়াও বৈধ নয়। কুরাইশ সর্দাররা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ হয় তুমি আমাদের উপাস্য প্রতিমাদেরকে মন্দ বলা থেকে বিরত হও, না হয় আমরা তোমার প্রভুকে গালি দিবো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। [তাবারী] যাতে বলা হয়েছে, “আপনি ঐ প্রতিমাদেরকে মন্দ বলবেন না, যাদেরকে তারা উপাস্য বনিয়ে রেখেছে। তাহলে তারা আল্লাহকে মন্দ বলা শুরু করবে পথভ্রষ্টতা ও অজ্ঞতার কারণে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বভাবগত চরিত্রের কারণে শৈশবকালেও কোন মানুষকে বরং কোন জন্তুকেও কখনো গালি দেননি। সম্ভবত কোন সাহাবীর মুখ থেকে এমন কঠোর বাক্য বের হয়ে থাকতে পারে, যাকে মুশরিকরা গালি মনে করে নিয়েছে। [তাফসীরে বায়যাভী; আইসারুত তাফসীর]

 

কুরাইশ সর্দাররা এ ঘটনাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সামনে রেখে ঘোষণা করেছে যে, আপনি আমাদের প্রতিমাদেরকে গালি-গালাজ থেকে বিরত না হলে আমরা আপনার আল্লাহকেও গালি-গালাজ করব। এতে কুরআনের এ নির্দেশ নাযিল হয়েছে। এতে মুশরিকদের মিথ্যা উপাস্যদের সম্পর্কে কোন কঠোর বাক্য বলতে মুসলিমদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। এ ঘটনা ও এ সম্পর্কিত কুরআনী নির্দেশ একটি বিরাট জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং কতিপয় মৌলিক বিধান এ থেকে বের হয়ে এসেছে।

কোন পাপের কারণ হওয়া পাপঃ  উদাহরণতঃ একটি মূলনীতি এই বের হয়েছে যে, যে কাজ নিজ সত্তার দিক দিয়ে বৈধ; বরং কোন না কোন স্তরে প্রশংসনীয়ও, সে কাজ করলে যদি কোন ফ্যাসাদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে কিংবা তার ফলশ্রুতিতে মানুষ গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তবে সে কাজও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কেননা, মিথ্যা উপাস্য অর্থাৎ প্রতিমাদেরকে মন্দ বলা অবশ্যই বৈধ এবং ঈমানী মর্যাদাবোধের দিক দিয়ে দেখলে সম্ভবতঃ সওয়াব ও প্রশংসনীয়ও বটে, কিন্তু এর ফলশ্রুতিতে আশংকা দেখা দেয় যে, প্রতিমাপূজারীরা আল্লাহ তা’আলাকে মন্দ বলবে। অতএব, যে ব্যক্তি প্রতিমাদেরকে মন্দ বলবে, সে এ মন্দের কারণ হয়ে যাবে। তাই এ বৈধ কাজটিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। [কুরতুবী; রাযী]

নবী করীম (সাঃ)ও বলেছেন, ‘‘তোমরা কারো পিতা-মাতাকে গাল-মন্দ করো না, কেননা, এইভাবে তোমরা স্বয়ং নিজেদের পিতা-মাতাকে গাল-মন্দ করার কারণ হয়ে যাবে।’’ (মুসলিমঃ ঈমান অধ্যায়) ইমাম শাওকানী লিখেছেন যে, এই আয়াত হল মন্দের উপকরণসমূহ বন্ধ করার মূল নীতির উৎস। (ফাতহুল ক্বাদীর)

হাদীসে এর আরও একটি দৃষ্টান্ত রয়েছে। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেনঃ জাহেলিয়াত যুগে এক দুর্ঘটনায় কাবাগৃহ বিধ্বস্ত হয়ে গেলে কুরাইশরা তা পুননির্মাণ করে। এ পুননির্মাণে কয়েকটি বিষয় প্রাচীন ইবরাহিমী ভিত্তির খেলাফ হয়ে গেছে। প্রথমতঃ কাবার যে অংশকে ‘হাতীম’ বলা হয়, তাও কা’বাগৃহের অংশবিশেষ ছিল। কিন্তু পুননির্মাণে অর্থাভাবের কারণে সে অংশ বাদ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ কা’বাগৃহের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দু’টি দরজা ছিল। একটি প্রবেশের এবং অপরটি প্রস্থানের জন্য নির্দিষ্ট ছিল।

জাহেলিয়াত যুগের নির্মাতারা পশ্চিমের দরজা বন্ধ করে একটি মাত্র দরজা রেখেছে। এটিও ভূপৃষ্ঠ থেকে উচ্চে স্থাপন করেছে, যাতে কেউ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কা’বা গৃহে প্রবেশ করতে না পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেনঃ আমার আন্তরিক বাসনা এই যে, কা’বা গৃহের বর্তমান নিৰ্মাণ ভেঙ্গে দিয়ে সম্পূর্ণ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর নির্মাণের অনুরূপ করে দেই। কিন্তু আশংকা এই যে, তোমার সম্প্রদায় অর্থাৎ আরব জাতি নতুন মুসলিম হয়েছে। কা’বা গৃহ বিধ্বস্ত করলে তাদের মনে বিরূপ সন্দেহ দেখা দিতে পারে। তাই আমি আমার বাসনা মুলতবী রেখেছি। [এ ব্যাপারে দেখুন মুসলিমঃ ১৩৩৩]

এটা জানা কথা যে, কা’বা গৃহকে ইবরাহীমী ভিত্তির অনুরূপ নিৰ্মাণ করা একটি ইবাদাত ও সওয়াবের কাজ ছিল। কিন্তু জনগণের অজ্ঞতার কারণে এতে আশংকা আঁচ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। এ ঘটনা থেকেও এ মূলনীতিই জানা গেল যে, কোন বৈধ এমনকি সওয়াবের কাজেও যদি কোন অনিষ্ট অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, তবে সে বৈধ কাজও নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

 

কোন কোন মুফাসসির এখানে একটি আপত্তির বিষয় উল্লেখ করেছেন। তা এই যে, আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের উপর জিহাদ ফরয করেছেন। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হল এই যে, কোন মুসলিম কোন কাফেরকে হত্যা করলে কাফেররাও মুসলিমদেরকে হত্যা করবে। অথচ মুসলিমকে হত্যা করা হারাম। এখানে জিহাদ মুসলিম হত্যার কারণ হয়েছে। অতএব, উপরোক্ত মূলনীতি অনুযায়ী জিহাদও নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এমনিভাবে আমাদের প্রচারকার্য, কুরআন তিলাওয়াত, আযান ও সালাতের প্রতি অনেক কাফের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে। অতএব, আমরা কি তাদের ভ্রান্ত কর্মের দরুন নিজ ইবাদাত থেকেও হাত গুটিয়ে নেব? এর জবাব এই যে, একটি জরুরী শর্তের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের ফলে এ প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। শর্তটি এই যে, ফ্যাসাদ অবশ্যম্ভাবী হওয়ার কারণে যে বৈধ কাজটি নিষিদ্ধ করা হয়, তা ইসলামের উদ্দিষ্ট ও জরুরী কর্মসমূহের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া চাই।

যেমন মিথ্যা উপাসকদের মন্দ বলা। এর সাথে ইসলামের কোন উদ্দেশ্য সম্পর্কযুক্ত নয়। এমনিভাবে কা’বা গৃহের নির্মাণকে ইবরাহীমী ভিত্তির অনুরূপ করার উপরও ইসলামের কোন উদ্দেশ্য নির্ভরশীল নয়। তাই এগুলোর কারণে যখন কোন ধর্মীয় অনিষ্টের আশংকা দেখা দিয়েছে, তখন এগুলো পরিত্যক্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে যে কাজ স্বয়ং ইসলামের উদ্দেশ্য কিংবা কোন ইসলামী উদ্দেশ্য যার উপর নির্ভরশীল, যদি বিধর্মীদের ভ্রান্ত আচরণের কারণে তাতে কোন অনিষ্টও দেখা দেয়, তবু এ জাতীয় উদ্দেশ্যকে কোন অবস্থাতেই পরিত্যাগ করা হবে না। বরং এরূপ কাজ স্বস্থানে অব্যাহত রেখে যতদূর সম্ভব অনিষ্টের কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করা হবে।

৬:১০৯ وَ اَقۡسَمُوۡا بِاللّٰهِ جَهۡدَ اَیۡمَانِهِمۡ لَئِنۡ جَآءَتۡهُمۡ اٰیَۃٌ لَّیُؤۡمِنُنَّ بِهَا ؕ قُلۡ اِنَّمَا الۡاٰیٰتُ عِنۡدَ اللّٰهِ وَ مَا یُشۡعِرُکُمۡ ۙ اَنَّهَاۤ اِذَا جَآءَتۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ ﴿

১০৯. আর তারা আল্লাহর নামে কঠিন শপথ করে বলে, তাদের কাছে যদি কোন নিদর্শন আসত তবে অবশ্যই তারা এতে ঈমান আনত। বলুন, নিদর্শন তো আল্লাহর কাছেই। আর কিভাবে তোমাদের উপলব্ধিতে আসবে যে, যখন তা (নিদর্শন) এসে যাবে, তখন তারা ঈমান আনবে না?

এ আয়াতসমূহে বলা হয়েছে যে, তারা স্বীয় জিদ ও নতুন সংস্করণ রচনা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে বিশেষ বিশেষ ধরণের মু’জিযা দাবী করছে। কুরাইশ সর্দাররা দাবী উত্থাপন করেছে যে, আপনি যদি সাফা পাহাড়টি স্বর্ণে পরিণত হওয়ার মু’জিযা আমাদেরকে দেখাতে পারেন, তবে আমরা আপনার নবুয়ত মেনে নেব এবং মুসলিম হয়ে যাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আচ্ছা, শপথ কর! যদি এ মু’জিযা প্রকাশ পায়, তবে তোমরা মুসলিম হয়ে যাবে। তারা শপথ করল। তিনি আল্লাহর কাছে দুআ করার জন্য দাঁড়ালেন যে, এ পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে দিন। তৎক্ষণাৎ জিবরীল আলাইহিস সালাম ওহী নিয়ে এলেন যে, আপনি চাইলে আমি এক্ষুণি এ পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে দেব।

কিন্তু আল্লাহর আইন অনুযায়ী এর পরিণাম হবে এই যে, এরপরও বিশ্বাস স্থাপন না করলে ব্যাপক আযাব নাযিল করে সবাইকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। বিগত সম্প্রদায়সমূহের বেলায়ও তাই হয়েছে। তারা বিশেষ কোন মু’জিযা দাবী করার পর তা দেখানো হয়েছে। এরপরও যখন তারা বিশ্বাস স্থাপন করেনি, তখন তাদের উপর আল্লাহর গযব ও আযাব নাযিল হয়েছে। দয়ার সাগর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাফেরদের অভ্যাস ও হঠকারিতা সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন। তাই দয়াপরবশ হয়ে বললেনঃ এখন আমি এ মু’জিযার দু’আ করি না। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়। [তাবারী; সংক্ষিপ্তসার দেখুন আত-তাফসীরুস সহীহ]

কোন বড় মু’জিযা যা তাদের ইচ্ছার অনুবর্তী হবে। যেমন, মূসা (আঃ)-এর লাঠি, ঈসা (আঃ)-এর মৃতকে জীবিত করা, সামূদের উটনী ইত্যাদি।

এ আয়াতে তাদের উক্তির জবাব দেয়া হয়েছে যে, মু’জিযা ও নিদর্শন সবই আল্লাহর ইচ্ছাধীন। যেসব মু’জিযা ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোও তার পক্ষ থেকেই ছিল এবং যেসব মু’জিযা দাবী করা হচ্ছে, এগুলো প্রকাশ করতেও তিনি পূর্ণরূপে সক্ষম। কিন্তু বিবেক ও ইনসাফের দিক দিয়ে তাদের এরূপ দাবী করার কোন অধিকার নেই। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রিসালাতের দাবীদার এবং এ দাবীর পক্ষে অনেক যুক্তি-প্রমাণ ও সাক্ষ্য মু’জিযা আকারে উপস্থিত করেছেন। এখন এসব যুক্তি-প্রমাণ ও সাক্ষ্য খণ্ডন করার এবং ভ্রান্ত প্রমাণিত করার অধিকার প্রতিপক্ষের আছে। কিন্তু এসব সাক্ষ্য খণ্ডন না করে অন্য সাক্ষ্য দাবী করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এত নিদর্শন দেখার পরও যারা ঈমান আনেনি তারা আর ঈমান আনবে না। সুতরাং তাদের জন্য নতুন কোন মু’জিযা প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। [সা’দী]

৬:১১০ وَ نُقَلِّبُ اَفۡـِٕدَتَهُمۡ وَ اَبۡصَارَهُمۡ کَمَا لَمۡ یُؤۡمِنُوۡا بِهٖۤ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّ نَذَرُهُمۡ فِیۡ طُغۡیَانِهِمۡ یَعۡمَهُوۡنَ ﴿

১১০. আর তারা যেমন প্রথমবারে তাতে ঈমান আনেনি, তেমনি আমরাও তাদের অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ পাল্টে দেব এবং আমরা তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরপাক খাওয়া অবস্থায় ছেড়ে দেব।

অর্থাৎ আল্লাহ বলেন, এভাবেই আমরা তাদেরকে শাস্তি দেব। কারণ, তারা আল্লাহর দিকে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেয়নি। অথচ তাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে যে, এটা আল্লাহর আহবান ও তারই বাণী। সুতরাং তাদের অন্তর চিরন্তন পাল্টে যেতে থাকবে, ঈমান ও তাদের মাঝে বাধা এসে যাবে, তারা সঠিক পথে চলতে সক্ষম হবে না। এটা আল্লাহর ইনসাফেরই দাবী। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যারা তাদের নিজের উপর অপরাধ করে, তার অবারিত রহমত দর্শনের পরও তাতে অবগাহন না করে, সঠিক পথ দেখানোর পরও তাতে না চলে, তিনি তাদের থেকে সেটা গ্রহণ করার তাওফীক উঠিয়ে নেন। [সা’দী]

অর্থাৎ যে মানসিকতার কারণে প্রথমবার তার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত শুনে তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল সে একই মানসিকতা তাদের মধ্যে এখনো কাজ করছে৷ তাদের দৃষ্টিভংগীর মধ্যে এখনো কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি৷ যে বুদ্ধির প্যাঁচে পড়ে ও দৃষ্টির স্থুলতার শিকার হয়ে তারা সেদিন সত্যকে দেখতে ও বুঝতে পারেনি সে একই অবস্থা আজো তাদের ওপর চেপে বসে আছে৷

এখানে ঈমান না আনার কারনে যা শাস্তি বলা হয়েছে———

অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ পাল্টে দিবেন ইহজীবনে

তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের মত ঘুরপাক খাওয়া অবস্থায় ছেড়ে দিবেন।

ঈমান আনার কারণ ও না-আনার প্রতিবন্ধকতাগুলো কি কি?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক: ঈমান আনার কারণসমূহ অনেক। যেমন-

১। ইলম অর্জন করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: কিন্তু তাদের মধ্যে যারা জ্ঞানে মজবুত তারা ও মুমিনগণ আপনার প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে এবং আপনার আগে যা নাযিল করা হয়েছে তাতে ঈমান আনে।”[সূরা নিসা, আয়াত: ১৬২]

২। সত্যকে গ্রহণ করা, অহংকার না করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “এটা আখেরাতের সে আবাস যা আমরা নির্ধারিত করি তাদের জন্য যারা যমীনে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য।”[সূরা কাসাস, আয়াত: ৮৩]

৩। আল্লাহ্‌ তাআলার সৃষ্টিগত নিদর্শনগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে রাত ও দিনের পরিবর্তনে নিদর্শনাবলী রয়েছে বোধশক্তি সম্পন্ন লোকদের জন্য।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯০]

৪। মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীদের পরিণতি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “তারা কি যমীনে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারত।”[সূরা হাজ্জ, আয়াত: ৪৬]

৫। আল্লাহ্‌র পাঠানো কিতাব ও তাঁর শরয়ি নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “এক মুবারক কিতাব, এটা আমরা আপনার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসমূহে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং যাতে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিরা গ্রহণ করে উপদেশ।”[সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২৯]

৬। কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ না করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “সুতরাং আপনি আহ্বান করুন এবং দৃঢ় থাকুন, যেভাবে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন। আর আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করবেন না; এবং বলুন, আল্লাহ্‌ যে কিতাব নাযিল করেছেন আমি তাতে ঈমান এনেছি।”[সূরা শুরা, আয়াত: ১৫]

৭। ঈমানদারদের সঙ্গ গ্রহণ এবং কাফের ও পাপীদের সঙ্গ ত্যাগ: আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের দু’হাত দংশন করতে করতে বলবে, হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে কোন পথ অবলম্বন করতাম। হায়, দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে উপদেশ পৌঁছার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।”[সূরা ফুরক্বান, আয়াত: ২৭-২৯]

৮। সুস্থ-সরল বিবেককে কাজে লাগানো। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “আর তারা বলবে, ‘যদি আমরা শুনতাম অথবা বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করতাম, তাহলে আমরা জলন্ত আগুনের অধিবাসী হতাম না।”[সূরা মুলক, আয়াত: ১০]

৯। ভাল কাজ পছন্দ করা এবং কুফুরি ও পাপ কাজকে ঘৃণা করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “কিন্তু আল্লাহ্‌ তোমাদের কাছে ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং সেটাকে তোমাদের হৃদয়গ্রাহী করেছেন। আর কুফুরী, পাপাচার ও অবাধ্যতাকে করেছেন তোমাদের কাছে অপ্রিয়।”[সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৭]

১০। সব কারণের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আল্লাহ্‌ তাআলার ইচ্ছা ও বান্দার জন্য ভাল তাকদীর নির্ধারণ করে রাখা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “আর আল্লাহ্‌ শান্তির আবাসের দিকে আহ্বান করেন এবং যাকে ইচ্ছে সরল পথে পরিচালিত করেন।”[সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৫]

দুই:

ঈমান না-আনার প্রতিবন্ধকতাও অনেক। যেমন-

১। অজ্ঞতা এবং ঈমানী মহান শিক্ষা ও দিক নির্দেশনাগুলো না জানা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “বরং তারা যে বিষয়ের জ্ঞান আয়ত্ত করেনি তাতে মিথ্যারোপ করেছে, আর যার প্রকৃত পরিণতি এখনও তাদের কাছে আসেনি। এভাবেই তাদের পূর্ববর্তীরাও মিথ্যা আরোপ করেছিল, কাজেই দেখুন, যালিমদের পরিণাম কি হয়েছে।”! [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩৯] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, “কিন্তু, তাদের অধিকাংশই মূর্খ।”[সূরা আনআম, আয়াত: ১১১] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, “কিন্তু, তাদের অধিকাংশই জানে না।”[সূরা আনআম, আয়াত: ৩৭]

২। হিংসা ও বিদ্বেষ; যা হচ্ছে ইহুদীদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “কিতাবীদের অনেকেই চায়, যদি তারা তোমাদেরকে তোমাদের ঈমান আনার পর কাফেররূপে ফিরিয়ে নিতে পারত! সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরও তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে বিদ্বেষবশতঃ (তারা এটা করে থাকে।” [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১০৯]

৩। অহংকার। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “যমীনে যারা অন্যায়ভাবে অহংকার করে বেড়ায় আমার নিদর্শনসমূহ থেকে আমি তাদের অবশ্যই ফিরিয়ে রাখব। আর তারা প্রত্যেকটি নিদর্শন দেখলেও তাতে ঈমান আনবে না এবং তারা সৎপথ দেখলেও এটাকে পথ বলে গ্রহণ করবে না, কিন্তু তারা ভুল পথ দেখলে সেটাকে পথ হিসেবে গ্রহণ করবে। এটা এ জন্য যে, তারা আমাদের নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করেছে এবং সে সম্বন্ধে তারা ছিল গাফেল।”[সূরা আরাফ, আয়াত: ১৪৬]

৪। সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও সত্যকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “অতঃপর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনাকে তো আমরা এদের রক্ষক করে পাঠাইনি।”[সূরা শুরা, আয়াত: ৪৮] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, “পূর্বে যা ঘটেছে তার কিছু সংবাদ আমরা এভাবে আপনার নিকট বর্ণনা করি। আর আমরা আমাদের নিকট হতে আপনাকে দান করেছি যিকর। এটা থেকে যে বিমুখ হবে, অবশ্যই সে কিয়ামতের দিন মহাভার বহন করবে। সেটাতে তারা স্থায়ী হবে এবং কিয়ামতের দিন তাদের জন্য এ বোঝা হবে কত মন্দ!”[সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ৯৯-১০১] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, “অতএব আপনি তাকে উপেক্ষা করে চলুন যে, আমাদের স্মরণ থেকে বিমুখ হয় এবং কেবল দুনিয়ার জীবনই কামনা করে।”[সূরা নাজম, আয়াত: ২৯] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন: “আর যে রহমানের যিকির থেকে বিমুখ হয় আমরা তার জন্য নিয়োজিত করি এক শয়তান, অতঃপর সে হয় তার সহচর।”[সূরা যুখরুফ, আয়াত: ৩৬]

৫। ঈমানকে বুঝার পরে, দলিল জানার পরেও প্রত্যাখ্যান করা, গ্রহণ না করা। জানার পরেও হঠকারিতা করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাকে সেরূপ চিনে যেরূপ চিনে তাদের সন্তানদেরকে। যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছে, তারা ঈমান আনবে না।”[সূরা আনআম, আয়াত: ২০] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, “অতঃপর তারা যখন বাঁকা পথ অবলম্বন করল তখন আল্লাহ্‌ তাদের হৃদয়কে বাঁকা করে দিলেন। আর আল্লাহ্‌ ফাসিক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।”[সূরা সাফ্‌ফ, আয়াত: ৫] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, “এভাবেই ফিরিয়ে নেয়া হয় তাদেরকে যারা আল্লাহ্‌র নিদর্শনাবলীকে অস্বীকার করে।”[সূরা গাফের, আয়াত: ৬৩]

৬। বিলাসিতায় ডুবে থাকা, নেয়ামতের অপচয় করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “আর যারা কুফরী করেছে যেদিন তাদেরকে জাহান্নামের সামনে পেশ করা হবে (সেদিন তাদেরকে বলা হবে) ‘তোমরা তোমাদের দুনিয়ার জীবনেই যাবতীয় সুখ-সম্ভার নিয়ে গেছ এবং সেগুলো উপভোগও করেছে। সুতরাং আজ তোমাদেরকে দেয়া হবে অবমাননাকর শাস্তি; কারণ তোমরা যমীনে অন্যায়ভাবে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে এবং তোমরা নাফরমানী করতে।”[সূরা আহকাফ, আয়াত: ২০] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন, “ইতোপূর্বে তারা তো মগ্ন ছিল ভোগ-বিলাসে।”[সূরা ওয়াক্বিয়া, আয়াত: ৪৫]

৭। সত্যকে ও সত্য গ্রহণকারীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। আল্লাহ্‌ তাআলা নূহ আলাইহিস সালাম এর এর উম্মত সম্পর্কে বলেন, তারা বলল, ‘আমরা কি তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব অথচ তোমার অনুসরণ করছে নীচুজাতেরা।”[সূরা ওয়াক্বিয়া, আয়াত: ১১১]

৮। পাপ কাজ করা ও আল্লাহ্‌র আনুগত্য থেকে বেরিয়ে শয়তানের আনুগত্য করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, যারা অবাধ্য হয়েছে এভাবেই তাদের সম্পর্কে আপনার রবের বাণী সত্য প্রতিপন্ন হয়েছে যে, তারা ঈমান আনবে না।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৩৩]

৯। অন্তরের কাঠিন্যতা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “সুতরাং যখন আমাদের শাস্তি তাদের উপর আপতিত হল, তখন তারা কেন বিনীত হল না? কিন্তু তাদের হৃদয় নিষ্ঠুর হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল।”[সূরা আনআম, আয়াত: ৪৩]

১০। আল্লাহ্‌ যা নাযিল করেছেন সেটাকে অপছন্দ করা। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন, “আর যারা কুফরী করেছে তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংস এবং তিনি তাদের আমলসমূহ ব্যর্থ করে দিয়েছেন। এটা এজন্যে যে, আল্লাহ্‌ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই তিনি তাদের আমলসমূহ নিষ্ফল করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মদ, আয়াত: ৮-৯]

আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন। সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

 

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন