সূরা আনআমঃ ১১তম রুকু (৯১-৯৪)আয়াত সমূহ

 সূরা আনআমঃ ১১তম রুকু (৯১-৯৪)আয়াত সমূহ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৬:৯১ وَ مَا قَدَرُوا اللّٰهَ حَقَّ قَدۡرِهٖۤ اِذۡ قَالُوۡا مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ عَلٰی بَشَرٍ مِّنۡ شَیۡءٍ ؕ قُلۡ مَنۡ اَنۡزَلَ الۡکِتٰبَ الَّذِیۡ جَآءَ بِهٖ مُوۡسٰی نُوۡرًا وَّ هُدًی لِّلنَّاسِ تَجۡعَلُوۡنَهٗ قَرَاطِیۡسَ تُبۡدُوۡنَهَا وَ تُخۡفُوۡنَ کَثِیۡرًا ۚ وَ عُلِّمۡتُمۡ مَّا لَمۡ تَعۡلَمُوۡۤا اَنۡتُمۡ وَ لَاۤ اٰبَآؤُکُمۡ ؕ قُلِ اللّٰهُ ۙ ثُمَّ ذَرۡهُمۡ فِیۡ خَوۡضِهِمۡ یَلۡعَبُوۡنَ ﴿۹۱﴾

৯১. আর তারা আল্লাহকে তাঁর যথার্থ মর্যাদা দেয়নি, যখন তারা বলে, আল্লাহ্‌ কোন মানুষের উপর কিছুই নাযিল করেননি। বলুন, কে নাযিল করেছে মূসার আনীত কিতাব যা মানুষের জন্য আলো ও হিদায়াতস্বরূপ, যা তোমরা বিভিন্ন পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে কিছু প্রকাশ কর ও অনেকাংশ গোপন রাখ এবং যা তোমাদের পিতৃপুরুষগণ ও তোমরা জানতে না তাও তোমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছিল? বলুন, ‘আল্লাহই’; অতঃপর তাদেরকে তাদের অযাচিত সমালোচনার উপর ছেড়ে দিন, তারা খেলা করতে থাকুক।

আগের ধারাবাহিক বর্ণনা ও পরবর্তী জওয়াবী ভাষন থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এটি ছিল ইহুদীদের উক্তি৷ যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাবী ছিল, আমি নবী এবং আমার কাছে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবে কুরাইশ কাফের সম্প্রদায় এবং আরবের অন্যান্য মুশরিকরা এ দাবীর যথার্থতা অসুন্ধান করার জন্য ইহুদী ও খৃষ্টানদের কাছে যেতো এবং তাদেরকে জিজ্ঞেস করতো, তোমরাও তো নবী-রসূলদের মানো, বলো সত্যিই কি এ ব্যক্তির কাছে আল্লাহর কালাম নাযিল হয়েছে৷ এর জওয়াবে তারা যা বলতো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কট্টর বিরোধী পক্ষ বিভিন্ন জায়গায় সে কথাগুলো বলে বলে লোকদেরকে বিভ্রান্ত ও উত্তেজিত করতো৷ তাই ইসলাম বিরোধীরা ইহুদীদের যে উক্তিটিকে প্রমাণ হিসেবে খাড়া করেছিল সেটি এখানে উদ্ধৃত করে তার জওয়াব দেয়া হচ্ছে৷

এ আয়াতে ঐসব লোকের জবাব দেয়া হয়েছে, যারা বলেছিল, আল্লাহ তা’আলা কোন মানুষের প্রতি কখনো কোন গ্রন্থ নাযিলই করেননি, গ্রন্থ ও রাসূলদের ব্যাপারটি মূলতঃ ভিত্তিহীন। কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এটি মূর্তিপূজারী কুরাইশদের উক্তি। [ইবন কাসীর]। ইবন জারীর তাবারী এ মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [তাবারী] কেননা, তারা কোন গ্রন্থ ও নবীর প্রবক্তা কোন কালেই ছিল না।

যদি আয়াতে বর্ণিত লোকেরা ইয়াহুদী হয়, তবে এতে আল্লাহ্ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলেছেন, যারা এমন বাজে কথা বলেছে, তারা যথোপযুক্তভাবে আল্লাহ্ তা’আলাকে চিনে নি। নতুবা এরূপ ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি তাদের মুখ থেকে বেরই হত না। যারা সর্বাবস্থায় আসমানী গ্রন্থকে অস্বীকার করে, আপনি তাদেরকে বলে দিন, আল্লাহ তা’আলা কোন মানুষের কাছে যদি গ্রন্থ প্রেরণ না-ই করে থাকেন, তবে যে তাওরাত তোমরা স্বীকার কর, সে তাওরাত কে নাযিল করেছে? তাওরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিচয় ও গুণাবলী সম্পর্কিত কিছু আয়াত ছিল। ইয়াহুদীরা সেগুলো তাওরাত থেকে উধাও করে দিয়েছিল। [তাবারী, বাগভী, মুয়াসসার]

মূলতঃ নবুঅত ও রিসালাতের যে অস্বীকৃতি রয়েছে তা তাদের এমন কথা, যার ভিত্তি হল হঠকারিতা, জেদ এবং শত্রুতার উপর। অর্থাৎ, এই আয়াতের তফসীরে মুফাসসিরদের রয়েছে তিনটি মত। প্রথমতঃ সম্পূর্ণ আয়াতকেই ইয়াহুদী সম্পর্কীয় বলা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সম্পূর্ণ আয়াতকে মুশরিক সম্পর্কীয় বলা হয়েছে এবং তৃতীয়তঃ আয়াতের শুরুর অংশকে মুশরিক সম্পর্কীয় এবং تَجْعَلُوْنَهُ থেকে অবশিষ্ট অংশটুকু ইয়াহুদী সম্পর্কীয় বলা হয়েছে। আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন, {أَكَانَ لِلنَّاسِ عَجَبًا أَنْ أَوْحَيْنَا إِلَى رَجُلٍ مِنْهُمْ أَنْ أَنْذِرِ النَّاسَ} ‘‘মানুষের কাছে কি আশ্চর্য লাগছে যে, আমি অহী পাঠিয়েছি তাদের মধ্য থেকে একজনের কাছে, যেন সে মানুষকে সতর্ক করে?’’ (সূরা ইউনুস ২)

তিনি আরো বলেন, {وَمَا مَنَعَ النَّاسَ أَنْ يُؤْمِنُوا إِذْ جَاءَهُمُ الْهُدَى إِلَّا أَنْ قَالُوا أَبَعَثَ اللهُ بَشَرًا رَسُولًا} ‘‘মানুষের কাছে হিদায়াত এসে যাওয়ার পরও তাদের এই উক্তিই কি তাদেরকে ঈমান আনা থেকে বিরত রাখে যে, আল্লাহ একজন মানুষকে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন?’’ (সূরা ইসরা’ ৯৪)

“আর যারা আমাদের নিদর্শনসমূহে মিথ্যারোপ করেছে, অচিরেই আমরা তাদেরকে এমনভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাব যে, তারা জানতেও পারবে না। আর আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি; নিশ্চয় আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। আরাফ-৮২-৮৩

আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ পাক জালিমকে অবকাশ দিতে থাকেন। ঢিল দিতে থাকেন। কিন্তু এরপর যখন পাকড়াও করেন তখন আর ছাড়েন না। এরপর রাসূলে করিম সা: এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন- ‘এমনই হয় তোমার রবের পাকড়াও, যখন তিনি জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন, ওদের জুলুমে লিপ্ত অবস্থায়’ (বুখারি-৪৬৮৬)।

আল্লাহ্‌ বলেন, যারা অনুসরণ করে রাসূলের, উম্মী নবীর, যার উল্লেখ তারা তাদের কাছে তাওরাত ও ইঞ্জলে লিপিবদ্ধ পায়। [সূরা আল-আরাফঃ ১৫৭]

“যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আগত স্পষ্ট প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ওর সঙ্গে তাঁর পক্ষ হতে এক সাক্ষীও বিদ্যমান, আর ওর পূর্বে (সাক্ষী) ছিল আদর্শ ও করুণা স্বরূপ মূসার গ্রন্থ; (সে কি তার মত যে অনুরূপ নয়)? এমন লোকেরাই এ (কুরআন)-এর প্রতি বিশ্বাস রাখে। আর সমস্ত দলের মধ্য হতে যে ব্যক্তি এই (কুরআন) অমান্য করবে, তার প্রতিশ্রুত স্থান হবে দোযখ। অতএব তুমি এ (কুরআন) সম্পর্কে সন্দেহে পড়ো না। নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে এটা সত্য (গ্রন্থ); কিন্তু অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে না। হুদঃ১৭

 

৬:৯২ وَ هٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ مُبٰرَکٌ مُّصَدِّقُ الَّذِیۡ بَیۡنَ یَدَیۡهِ وَ لِتُنۡذِرَ اُمَّ الۡقُرٰی وَ مَنۡ حَوۡلَهَا ؕ وَ الَّذِیۡنَ یُؤۡمِنُوۡنَ بِالۡاٰخِرَۃِ یُؤۡمِنُوۡنَ بِهٖ وَ هُمۡ عَلٰی صَلَاتِهِمۡ یُحَافِظُوۡنَ ﴿

৯২. আর এটি বরকতময় কিতাব, যা আমরা নাযিল করেছি, যা তার আগের সব কিতাবের সত্যায়নকারী এবং যা দ্বারা আপনি মক্কা ও তার চারপাশের মানুষদেরকে সতর্ক করেন। আর যারা আখেরাতের উপর ঈমান রাখে, তারা এটাতেও ঈমান রাখে এবং তারা তাদের সালাতের হিফাযত করে।

মানুষের ওপর আল্লাহর কালাম নাযিল হতে পারে এবং কার্যত হয়েছেও এরি স্বপক্ষে দেয়া হয়েছে প্রথম যুক্তিটি৷

তাওরাত আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল- একথা যেমন তারা স্বীকার করে, তেমনিভাবে এ কুরআনও আমি নাযিল করেছি। কুরআনের সত্যতার জন্য তাদের পক্ষ থেকে এ সাক্ষ্যই যথেষ্ট যে, কুরআন, তাওরাত ও ইঞ্জলে নাযিলকৃত সব বিষয়বস্তুর সত্যায়ন করে। মক্কা মুআযযামাকে কুরআনুল কারীম ‘উম্মুল কুরা’ বলেছে। অর্থাৎ বস্তিসমূহের মূল। এর কারণ এই যে, ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী এখান থেকেই পৃথিবী সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল। তাছাড়া এ স্থানটিই সারা বিশ্বের কেবল এবং মুখ ফেরানোর কেন্দ্রবিন্দু। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর]

এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর যে কালামটি নাযিল হয়েছে সেটি আল্লাহরই কালাম, এর স্বপক্ষে দেয়া হচ্ছে এ দ্বিতীয় যুক্তিটি৷ এ সত্যটি প্রমাণ করার জন্য সাক্ষ হিসেবে চারটি কথা পেশ করা হয়েছে৷

এক: এ কিতাবটি বড়ই কল্যাণ ও বরকতপূর্ণ৷ অর্থাৎ মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নের জন্য এর মধ্যে সর্বোত্তম মূলনীতি পেশ করা হয়েছে৷ এখানে নির্ভুল ও সঠিক আকীদা-বিশ্বাসের শিক্ষা দেয়া হয়েছে সৎকাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, উন্নত নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলী সৃষ্টির উপদেশ দেয়া হয়েছে, পাক-পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনের পথ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং অন্যদিকে মূর্খতা, অজ্ঞতা, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণ মনতা, জুলুম চরিত্রহীনতা, অশ্লীলতা ও অন্যান্য যেসব অসৎকর্ম তোমরা পবিত্র আসমানী কিতাবসমূহে স্তুপীকৃত করে রেখেছো সেগুলো থেকে এ কিতাবটিকে মুক্ত রাখা হয়েছে৷

وَ هٰذَا کِتٰبٌ اَنۡزَلۡنٰهُ مُبٰرَکٌ فَاتَّبِعُوۡهُ وَ اتَّقُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ

আর এ কিতাব, যা আমরা নাযিল করেছি- বরকতময়। কাজেই তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।আন’আমঃ ১৫৫

আর অবশ্যই আমরা তাদের নিকট নিয়ে এসেছি এমন এক কিতাব, যা আমরা জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশদ ব্যাখ্যা করেছি। আর যা মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ। আরাফঃ ৫২

দুই: এর আগে আল্লাহর পক্ষ থেকে যেসব হেদায়াতনামা এসেছিল এ কিতাব সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে অন্য কোন হেদায়াত পেশ করে না বরং সেগুলোয় যা কিছু পেশ করা হয়েছিল তার সত্যতা প্রমাণ করে এবং তার প্রতি সমর্থন যোগায়৷

وَ اَنۡزَلۡنَاۤ اِلَیۡکَ الۡکِتٰبَ بِالۡحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیۡنَ یَدَیۡهِ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ مُهَیۡمِنًا عَلَ

আর আমরা আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি ইতোপূর্বেকার কিতাবসমূহের সত্যতা প্রতিপন্নকারী ও সেগুলোর তদারককারীরূপে। মায়েদাঃ ৪৮

আর এ কুরআন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রচনা হওয়া সম্ভব নয়। বরং এর আগে যা নাযিল হয়েছে এটা তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ ব্যাখ্যা। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটা সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে। ইউনুসঃ ৩৭

তাদের বৃত্তান্তে অবশ্যই বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আছে শিক্ষা। এটা কোন বানানো রচনা নয় বরং এটা আগের গ্রন্থে যা আছে তার সত্যায়ন ও সব কিছুর বিশদ বিবরণ, আর যারা ঈমান আনে এমন সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমত। ইউসুফঃ ১১১

তিন: প্রত্যেক যুগে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে উদ্দেশ্য কিতাব নাযিল করা হয়েছে এ কিতাবটিও সে একই উদ্দেশ্য নাযিল করা হয়েছে৷ অর্থাৎ মানুষকে গালতির নিঁদ থেকে জাগিয়ে সতর্ক করা এবং বিপথগামী লোকদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করাই এর উদ্দেশ্য৷

“আর আমরা তো আপনাকে কেবল সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” [সূরা সাবা: ২৮] আরও এসেছে, “কত বরকতময় তিনি! যিনি তার বান্দার উপর ফুরকান নাযিল করেছেন, সৃষ্টিকুলের জন্য সতর্ককারী হতে।” [সূরা আল-ফুরকান: ১]।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক নবীকেই তার (যুগ) উপযোগী মু’জিযা প্রদান করা হয়েছে। সে অনুসারে মানুষ তার উপর ঈমান এনেছে। আর নিশ্চয়ই আমাকে অহী দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহ তা’আলা আমার উপর নাযিল করেছেন। অতএব, আমি আশা করছি যে, কিয়ামতের দিন আমার অনুগামী তাদের থেকে বেশী হবে। [বুখারীঃ ৪৯৮১]

চার: মানব সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা দুনিয়া পূজারী ও প্রবৃত্তি লালসার দাসত্বে জীবন উৎসর্গকারী, এ কিতাব তাদেরকে দাওয়াত দিয়ে সমবেত করেনি বরং নিজের চারদিকে এমন সব লোককে সমবেত করেছে যাদের দৃষ্টি দুনিয়ার সংকীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে আরো আগে চলে যায়৷ তারপর এ কিতাবের দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে তাদের জীবনে যে বিপ্লব আসে তার সবচেয়ে সুস্পষ্ট আলামত হচ্ছে এই যে, তারা নিজেদের আল্লাহ প্রীতির কারণে সমগ্র মানব জাতির মধ্যে বিশিষ্টতা অর্জন করে৷ কোন মিথ্যাচারী ব্যক্তি যে কিতাব রচনা করেছেন এবং নিজের রচনাকে আল্লাহর রচনা বলে চালিয়ে দেবার চরম ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে তার সে কিতাব কি এহেন বৈশিষ্ট ও সুফলের অধীকারী হতে পারে৷

৯৩ وَ مَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنِ افۡتَرٰی عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا اَوۡ قَالَ اُوۡحِیَ اِلَیَّ وَ لَمۡ یُوۡحَ اِلَیۡهِ شَیۡءٌ وَّ مَنۡ قَالَ سَاُنۡزِلُ مِثۡلَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ ؕ وَ لَوۡ تَرٰۤی اِذِ الظّٰلِمُوۡنَ فِیۡ غَمَرٰتِ الۡمَوۡتِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ بَاسِطُوۡۤا اَیۡدِیۡهِمۡ ۚ اَخۡرِجُوۡۤا اَنۡفُسَکُمۡ ؕ اَلۡیَوۡمَ تُجۡزَوۡنَ عَذَابَ الۡهُوۡنِ بِمَا کُنۡتُمۡ تَقُوۡلُوۡنَ عَلَی اللّٰهِ غَیۡرَ الۡحَقِّ وَ کُنۡتُمۡ عَنۡ اٰیٰتِهٖ تَسۡتَکۡبِرُوۡنَ ﴿

৯৩. আর তার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রটনা করে, কিংবা বলে, আমার কাছে ওহী হয়, অথচ তার প্রতি কিছুই ওহী করা হয় না এবং যে বলে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন আমিও তার মত নাযিল করব? আর যদি আপনি দেখতে পেতেন, যখন যালিমরা মৃত্যু যন্ত্রনায় থাকবে এবং ফিরিশতাগণ হাত বাড়িয়ে বলবে, তোমাদের প্রাণ বের কর। আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হবে, কারণ তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তার আয়াতসমূহ সম্পর্কে অহংকার করতে।

‘যালেম’ বলতে প্রত্যেক যালেমকে বুঝানো হয়েছে এবং এর মধ্যে আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকারকারী ও নবুঅতের মিথ্যা দাবীদারগণ সর্বপ্রথম শামিল থাকবে। غَمَرَاتٌ থেকে মৃত্যু-যন্ত্রণাকে বুঝানো হয়েছে। ‘ফিরিশতাগণ হাত বাড়িয়ে’ অর্থাৎ, জান কবয করার জন্য। اليَوْمَ (আজ) অর্থাৎ, জান কবয করার দিন। আর এই দিন হল আযাব শুরু হওয়ার সময়; যার প্রথম স্থান হল কবর। আর এ থেকে এ কথাও সুসাব্যস্ত হয়ে যায় যে, কবরের আযাব সত্য। তা না হলে হাত বাড়ানো এবং প্রাণ বের করে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার সাথে এ কথা বলার কোন অর্থ থাকে না যে, আজ তোমাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে। স্মরণ থাকে যে, কবর বলতে উদ্দেশ্য বারযাখী জীবন। অর্থাৎ, ইহজগতের জীবনের পর এবং পরজগতের জীবনের (কিয়ামত ঘটার) পূর্বে এটা একটি মধ্যজগতের জীবন। যার সময়কাল হল, মানুষের মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত। এটাকে বলা হয় বারযাখী জীবন। চাহে তাকে কোন হিংস্র পশু খেয়ে নিক অথবা তার লাশ সামুদ্রিক তরঙ্গ-কবলিত হোক কিংবা জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হোক বা কবরে দাফন করা হোক। মরণের পর এ হল বারযাখী জীবন, যেখানে আযাব দেওয়ার শক্তি মহান আল্লাহর আছে।

যেদিন তারা ফিরিশতাদেরকে দেখতে পাবে সেদিন অপরাধীদের জন্য কোন সুসংবাদ থাকবে না এবং তারা বলবে, রক্ষা কর, রক্ষা কর। ফুরকানঃ২২

মহান আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ –

﴿فَكَيْفَ إِذَا تَوَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ﴾

সে সময় কি অবস্থা হবে যখন ফেরেশতারা তাদের রূহ কবজ করবে এবং তাদের মুখ ও ফিটের ওপর আঘাত করতে করতে নিয়ে যাবে এসব হওয়ার কারণ হচ্ছে,

﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ﴾

তারা এমন পন্থার অনুসরণ করেছে যা আল্লাহর অসন্তুষ্টি উৎপাদন করে এবং তাঁর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণ করা পছন্দ করেনি৷ এ কারণে তিনি তাদের সব কাজ-কর্ম নষ্ট করে দিয়েছেন  (সূরা মুহাম্মদঃ২৭-২৮ আয়াত)

তিনি বলেনঃ “আর যদি তুমি দেখ! যখন ফেরেশতারা কাফেরদের প্রান হরন করে এবং প্রহার করে তাঁদের মুখেও তাদের পশ্চাদদেশে,আর বলে তোমরা দহন যন্ত্রনা ভোগ কর।” এ হচ্ছে সেই অপকর্মের প্রতিফল যা তোমরা আগেই করে রেখে এসেছো৷ নয়তো আল্লাহ তার বান্দাদের ওপর জুলুমকারী নন৷(সূরা আনফালঃ ৫০-৫১ আয়াত)

রাসুল (স.) বলেনঃ”কাফির (জাহান্নামি র) এর আত্মা মালাকুল মাউত বলবেন-হে অপবিএ আত্মা তোমার প্রভুর অসন্তষ্টি ও ক্রোধের দিকে বেরিয়ে এসো। অতঃপর তিনি তার রুহ টেনে বের করবেন এমন ভাবে যেমন বাঁকা ধারওয়ালা লোহার শিক কাঠি পশমের মধ্যে থেকে টেনে ছিড়ে বের করে আনা হয়।   (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

তিনি বলেনঃ”যখন জানাযা (খাটিয়া য়) রাখা হয় এবং পুরুষ লোকেরা তা তাদের কাঁধে তুলে নেয়,সে পূন্যবান না (যালেম ও কাফের) হলে সে আপন পরিজনকে বলতে থাকে হায় আফসোস! এটা নিয়ে তোমরা কোথায় যাচ্ছ? মানুষ জাতি ব্যতীত সবাই তার চিৎকার শুনতে পায়। মানুষ যদি তা শুনতে পেত তবে অবশ্যই অজ্ঞান হয়ে যেত।”  (সহীহ বুখারী)

আল্লাহ সম্বন্ধে অন্যায় বা অসত্য বলার মধ্যে কিতাব অবতীর্ণ হওয়া ও রসূল প্রেরণের কথা অস্বীকার এবং নবী হওয়ার মিথ্যা দাবী করার কথাও শামিল আছে। নবুঅত ও রিসালাতের অস্বীকার এবং তা মেনে নেওয়ার ব্যাপারে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার ব্যাপারটাও অনুরূপ। এই উভয় কারণের ভিত্তিতে তাদেরকে অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে।

৬:৯৪ وَ لَقَدۡ جِئۡتُمُوۡنَا فُرَادٰی کَمَا خَلَقۡنٰکُمۡ اَوَّلَ مَرَّۃٍ وَّ تَرَکۡتُمۡ مَّا خَوَّلۡنٰکُمۡ وَرَآءَ ظُهُوۡرِکُمۡ ۚ وَ مَا نَرٰی مَعَکُمۡ شُفَعَآءَکُمُ الَّذِیۡنَ زَعَمۡتُمۡ اَنَّهُمۡ فِیۡکُمۡ شُرَکٰٓؤُا ؕ لَقَدۡ تَّقَطَّعَ بَیۡنَکُمۡ وَ ضَلَّ عَنۡکُمۡ مَّا کُنۡتُمۡ تَزۡعُمُوۡنَ ﴿۹

৯৪. আর অবশ্যই তোমরা আমাদের কাছে নিঃসঙ্গ অবস্থায় এসেছ, যেমন আমরা প্রথম বার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম; আর আমরা তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম তা তোমরা তোমাদের পিছনে ফেলে এসেছ। আর তোমরা যাদেরকে তোমাদের ব্যাপারে (আল্লাহর সাথে) শরীক মনে করতে, তোমাদের সে সুপারিশকারিদেরকেও আমরা তোমাদের সাথে দেখছি না। তোমাদের মধ্যকার সম্পর্ক অবশ্যই ছিন্ন হয়েছে এবং তোমরা যা ধারণা করেছিলে তাও তোমাদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে।

فُرَادَى হল فَرْدٌ এর বহুবচন। যেমন, سُكَارَى হল سَكْرَانٌ এর এবং كُسَالَى হল كَسْلاَنٌ এর বহুবচন। অর্থাৎ, তোমরা পৃথক পৃথকভাবে একজন একজন করে আমার কাছে আসবে। তোমাদের সাথে না থাকবে মাল, না সন্তান-সন্ততি আর না সেই উপাস্যগুলো, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর শরীক এবং নিজেদের সাহায্যকারী মনে করেছিলে। অর্থাৎ, এগুলোর মধ্য থেকে কোন জিনিসই তোমাদের কোন উপকারে আসার ক্ষমতা রাখবে না। পরের আয়াতগুলোতে এ কথাগুলোরই আরো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

মৃত্যু নিয়ে কেউ যদি ঠাণ্ডা মাথায় বসে গভীরভাবে চিন্তা করে: মৃত্যুর পরে তার কী হবে? সে কোথায় যাবে? সে কি সত্যিই আল্লাহকে বোঝাতে পারবে কেন সে জীবনটা এভাবে পার করেছে? —এগুলো নিয়ে কেউ যদি একটু মনোযোগ দিয়ে, ধিরস্থিরভাবে বসে কিছুক্ষণ চিন্তা করে, তাহলে তার জীবন সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা বদলে যেতে বাধ্য। আজকাল আমরা জীবন শৃঙ্খলায় এত বেশি জড়িয়ে পড়েছি যে, সেগুলো থেকে নিজেকে বের করে এনে, চুপচাপ কিছুক্ষণ একাকী বসে নিজের মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। যদিও বা মাঝে মধ্যে চিন্তা করতে বসি, তখন চিন্তা হয়: আমার স্বামী/স্ত্রীকে কে দেখবে? আমার সন্তানদের কী হবে? আমার বাড়ি, গাড়ি, জমি, ব্যাংকের টাকার ভাগবাটোয়ারা কীভাবে হবে? আমার ব্যবসা কে চালাবে? — নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই। মৃত্যুর পরে আখিরাতে আমার নিজের কী অবস্থা হবে, সেটা নিয়ে চিন্তা না করে,  বরং চিন্তা করি মৃত্যুর পরে দুনিয়াতে বাকি সবার কী অবস্থা হবে।

কুর‘আনে আমাদেরকে শত বার মৃত্যু এবং আখিরাতে নিজের কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। কারণ কেউ যখন মনোযোগ দিয়ে তা ভেবে দেখবে, পরিকল্পনা করবে, তখন সে দেখবে যে, সে জীবনে বহু দায়িত্ব নিয়েছে, বহু কাজে জড়িয়ে পরেছে, বহু দুশ্চিন্তা ঘাড়ে নিয়েছে, যেগুলো আসলে তার আসল ভবিষ্যতের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। সেগুলো তার কোনোই কাজে লাগবে না। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে ভুল লক্ষ্য থাকার কারণে আজকে সেগুলোই তাকে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত রেখেছে, সবচেয়ে বেশি সমস্যায় জর্জরিত করে ফেলেছে।

আর স্মরণ করুন, যেদিন আমরা তাদের সবাইকে একত্র করব, তারপর যারা শির্ক করেছে তাদেরকে বলব, যাদেরকে তোমরা আমার শরীক মনে করতে, তারা কোথায়? আন’আমঃ২২

আর যেদিন আমরা তাদের সবাইকে একত্র করে যারা মুশরিক তাদেরকে বলব, তোমরা এবং তোমরা যাদেরকে শরীক করেছিলে তারা নিজ নিজ স্থানে অবস্থান কর; অতঃপর আমরা তাদেরকে পরস্পর থেকে পৃথক করে দেব এবং তারা যাদেরকে শরীক করেছিল তারা বলবে, তোমরা তো আমাদের ইবাদত করতে না। ইউনুসঃ২৮

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমরা মানুষদের উপরে একটি উঁচু জায়গায় থাকব। তখন প্রত্যেক জাতিকে তাদের দেব-দেবীসহ ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ডাকা হবে। তারপর আমাদের মহান রব আসবেন এবং বলবেন, তোমরা কিসের অপেক্ষায় আছ? তখন তারা বলবে, আমরা আমাদের মহান রবের অপেক্ষায় আছি। তখন তিনি বলবেন, আমি তোমাদের রব। তারা বলবে, আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখব। তখন তিনি তাদের জন্য তাজাল্লি দিবেন এমতাবস্থায় যে, তিনি হাসছেন। আর তখন মুমিন ও মুনাফিক প্রত্যেককে নুর দিবেন। যার উপরে অন্ধকার চাপা থাকবে।

তারপর তারা তার অনুসরণ করবে পুল-সিরাতের দিকে। তাদের সাথে মুনাফিকরাও থাকবে। সে পুল-সিরাতে থাকবে লোহার হুক ও বশি। এগুলো যাকে ইচ্ছা পাকড়াও করবে। তারপর মুনাফিকদের নুর নিভিয়ে দেয়া হবে। আর মুমিনরা নাজাত পাবে। তখন প্রথম দল যারা নাজাত পাবে তাদের চেহারা হবে চৌদ্দ তারিখের রাত্রির চাঁদের মত। সত্তর হাজার লোক, তাদের কোন হিসাব হবে না। তারপর যারা তাদের কাছাকাছি হবে তারা হবে আকাশের সবচেয়ে উজ্জল তারকাটির মত। তারপর অন্যরা। শেষ পর্যন্ত শাফা’আত আপতিত হবে। ফলে তারা শাফা’আত করবে, এমনকি যে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, যার অন্তরে যব পরিমাণ তা থাকবে তাকেও বের করা হবে। তাকে জান্নাতের আঙ্গিনায় রাখা হবে। আর জান্নাতিরা তাদের গায়ে পানি ফেলতে থাকবে, ফলে তারা বন্যার উদ্ভিদ যেভাবে উৎপন্ন হয় সেভাবে উদগত হবে। আর তাদের পোড়া চলে যাবে। তারপর তারা আল্লাহর কাছে চাইবে, শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য থাকবে দুনিয়া ও তার মত দশগুণ। [মুসনাদে আহমাদ ৩/৩৪৫–৩৪৬]

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন