সূরা আনআমঃ ১০ম রুকু (৮৩-৯০)আয়াত সমূহ

 

 সূরা আনআমঃ ১০ম রুকু (৮৩-৯০)আয়াত সমূহ

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

৬:৮৩ وَ تِلۡکَ حُجَّتُنَاۤ اٰتَیۡنٰهَاۤ اِبۡرٰهِیۡمَ عَلٰی قَوۡمِهٖ ؕ نَرۡفَعُ دَرَجٰتٍ مَّنۡ نَّشَآءُ ؕ اِنَّ رَبَّکَ حَکِیۡمٌ عَلِیۡمٌ

৮৩. আর এটাই আমাদের যুক্তি-প্রমাণ যা ইবরাহীমকে দিয়েছিলাম তাঁর জাতির মোকাবেলায়, যাকে ইচ্ছা আমরা মর্যাদায় উন্নীত করি। নিশ্চয়ই আপনার রব প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।

অর্থাৎ, আল্লাহর একত্ববাদের এমন যুক্তি ও দলীল, যার কোন উত্তর ইবরাহীম (আঃ)-এর জাতির কাছে ছিল না। আবার কারো নিকট তা ছিল এই উক্তি, তোমরা যাকে আল্লাহর অংশী কর, আমি তাকে কিরূপে ভয় করব? অথচ তোমরা ভয় কর না যে, তোমরা আল্লাহর সাথে এমন কিছুকে শরীক করে চলছ, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তোমাদের নিকট কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। সুতরাং যদি তোমরা জান (তাহলে বল,) দু’দলের মধ্যে কোন্ দলটি নিরাপত্তালাভের অধিকারী? মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-এর সে কথার সত্যায়ন করে বললেন, “যারা বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বিশ্বাস (ঈমান)-কে যুলুম (শিরক) দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদেরই জন্য এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত।”

﴿الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ﴾

আসলে তো নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্ততা তাদেরই জন্য এবং সত্য-সরল পথে তারাই পরিচালিত যারা ঈমান এনেছে এবং যারা নিজেদের ঈমানকে জুলুমের সাথে মিশিয়ে ফেলেনি৷ সূরা আনআমঃ ৮২

হজরত মুয়াজ ইববে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি বিশ্বনবির পেছনে ‘উফায়ের’ নামক গাধার উপর বসা ছিলাম। তখন তিনি বললেন-

‘হে মুয়াজ! তুমি কি জান বান্দার উপর আল্লাহর হক এবং আল্লাহর উপর বান্দার হক কী?

মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই বেশি জানেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

‘বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো- একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো- যে তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না তাকে শাস্তি না দেয়া।’

হজরত মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! এ ব্যাপারে মানুষকে সুসংবাদ প্রদান করি?

তিনি (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন- তাদের (এ) সুসংবাদ দিও না; কারণ তারা হাত-পা গুটিয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে কাজ-কর্ম ও ইবাদাত করা ছেড়ে বসে থাকবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)

জ্ঞান অর্জন করতে হবে। শুনলেই চলবে না।

কুরআনুল কারীমের আলোকে দ্বীনী ইলম শিক্ষার গুরুত্ব :

প্রথম ওহী ‘পড়ুন’

قا ل الله سبحا نه وتعا لى

* اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ-( سورة زمر –أية 01)

পড়ো তোমার প্রভূর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন ।

ইসলাম ধর্মের আগমনে পৃথিবীবাসী মানুষের জন্য জাগতিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার শিক্ষার দ্বার উম্মুক্ত হয়েছে। ইসলামের তথা, আল কুরআনের সর্বপ্রথম নাযিলকৃত বাণীটিই হচ্ছে- اقرأ অর্থাৎ, পড়ুন। এখান থেকে অনুধাবন করা যায়, ইসলাম বিশ্বমানবতার জন্য জ্ঞানের দ্বার কিভাবে উম্মুক্ত করে দিয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ ফরমান :

জ্ঞানী ও মূর্খ কখনো সমান হতে পারে না।

قا ل الله تبارك وتعا لى :

قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لا يعلمون ( الزمر 9- )

হে নবী আপনি বলে দিন, যে ব্যক্তি (কুরআন-সুন্নাহ তথা শরীয়াতের বিধান) জানে আর যে জানে না, তারা কি উভয়ে সমান গতে পারে? তার মানে কখনই সমান হতে পারে না।

যাদেরকে দ্বীন ইলমের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদেরকে বিশেষ মর্যাদা দান করা হয়েছে ঐসব লোকদের উপর, যারা তা জানে না।

قال الله سبحا نه وتعا لى :

*يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٌ (المجادلة-11)

তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের মধ্য থেকে যাদেরকে দ্বীন ইসলামের জ্ঞান দান করা হয়েছে, তাদেরকে বিশেস সন্মান বা মর্যাদা দান করা হয়েছে।

হযরত আনাস রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘প্রতিটি মুসলিম পুরুষের উপর দ্বীনী ইলম শিক্ষা গ্রহণ করা ফরজ।’

অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে– প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর উপর দ্বীনী ইলম শিক্ষা গ্রহণ করা ফরজ । ইবনে মাযাহ, হাদীস নং- ২২৪

মুয়াবিয়া রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান: ‘আল্লাহ তায়ালা যার জন্য বিশেষ কল্যাণ কামনা করেন, তাকে দ্বীনী জ্ঞান অর্জন ও বুঝার তাওফিক দান করেন।’ সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৭৩১২, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৩৭

তাবেয়ী কাছির ইবনু ক্বায়েছ রহমাতুল্লাহি আলাইহ বলেন: আমি দামেশকের মসজিদে বিশিষ্ট সাহাবী আবুদ্দারদাহ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু এর সাথে বসা ছিলাম, এমন সময় তার নিকট জনৈক ব্যক্তি এসে বল্লেন: হে আবুদ্দারদাহ! আমি সুদূর মদিনাতুর রাসূল থেকে আপনার নিকট শুধু একটি হাদীস শুনার জন্য এসেছি। আপনি নাকি উহা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করে থাকেন। তখন আবুদ্দারদাহ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু বল্লেন: হ্যা, আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে শুনেছি: তিনি বলেন; যে ব্যক্তি ইলম আন্বেষণ করার লক্ষ্যে কোন পথ অবলন্বন করে, আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে তাকে জন্নাতের পথ সমূহের মধ্য থেকে একটি পথে পৌছিয়ে দেন এবং ফেরেস্তাগণ ইলম অন্বেষণকারীদের সন্তুষ্টির জন্য তাদের নিজেদের পাখা বিছিয়ে দেন। এতদ্ব্যতীত যারা আলেম, তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীতে যারা আছেন , তারা সকলেই আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা ও দোওয়া করতে থাকেন। এমনকি পানির মধ্যে অবস্থিত মাছসমূহ তাদের জন্য দোওয়া করে থাকেন। আলেমের ফজিলাত সাধারণ আবেদের (ইবাদতকারী) উপর এমন, যেমন পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকারাজির উপর। আর আলিমগণ হচ্ছেন নাবীদের ওয়ারিশ। নাবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম ( টাকা-পয়সা ও ধনসম্পদ) রেখে যান না। তারা মিরাছ হিসেবে রেখে যান শুধু ইলম। সুতরাং যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করলো সে সৌভাগ্যের পূর্ণ অংশ গ্রহণ করলো। আহমদ, হাদীস নং ২১২০৭, তিরমিজি, ২৬৮২, ইবনু মাজাহ, ২২৩

হযরত আনাস রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের লক্ষ্যে নিজ বাড়ি থেকে বের হলো, সে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় রয়ে গেল।’ তিরমিজি, ২৬৪৭ এবং সুনানে দারেমি

মর্যাদা সম্মান দেয়ার মালিক আল্লাহইঃ

﴿قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَاءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَاءُ ۖ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

২৬) বলোঃ হে আল্লাহ ! বিশ্ব –জাহানের মালিক! তুমি যাকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা দান করো এবং যার থেকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নাও৷ যাকে চাও মর্যাদা ও ইজ্জত দান করো এবং যাকে চাও লাঞ্জিত ও হেয় করো৷ কল্যাণ তোমরা হাতেই নিহিত ৷ নিসন্দেহে তুমি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী ৷আলে ইমরানঃ২৬

যারা মুমিনদের পরিবর্তে অবিশ্বাসীদের বন্ধু রূপে গ্রহণ করেন, তারা কি ওদের কাছে সম্মান আশা করেন? না, সকল সম্মানের মালিক আল্লাহ। (সূরা আন-নিসা: আয়াত :১৩৯)

কেউ সম্মান চাইলে জেনে রেখ, সব সম্মান আল্লাহরই জন্য। (সূরা ফাতির ৩৫: ১০) তিনি আরও বলেন, ‘সম্মান তো আল্লাহ, তার রাসুল এবং মুমিনদের জন্যই। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।’ (সূরা মুনাফিকুন ৬৩: ৮

মর্যাদা বৃদ্ধির তিন আমল

তিন প্রকারের আমলের মাধ্যমে মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়ে থাকে: ১. মেহমান ও দরিদ্রদের খাবার খাওয়ানো। ২. সালামের ব্যাপক প্রসার ঘটানো এবং ৩. রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন নামাজে মশগুল হয়ে যাওয়া (আলমু’জামুল আওসাত্ব: ৬/৩৫১)।

সম্মান বাড়ানোর ইসলামী পন্থাসমূহ :

ক্ষমা করা : একটি উন্নতমানের গুণের নাম ক্ষমা করা। এর দ্বারা মানুষের মান-সম্মান ইজ্জত বহুগুণে বেড়ে যায়। এটি মূলত আল্লাহর গুণ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় মানুষকে দান করে, রাগ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানুষকে ক্ষমা করে থাকে আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’ (সূরা আলে ইমরান-১৩৪)।

আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘সদকা করলে সম্পদের ঘাটতি হয় না। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। আর কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিনীত হলে, তিনি তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন (মুসলিম-৬৪৮৬)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করুন। সৎ কাজের আদেশ দিন এবং মূর্খদের এড়িয়ে চলুন’ (সূরা আরাফ-১১৯)। ক্ষমাকারী আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হয়। আল্লাহ তার মান-সম্মান বাড়িয়ে দেন। ফলে মানুষও তাকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে শুরু করে।

দান করা : সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় মানুষকে দান করলেও আল্লøাহ মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। সূরা আলে ইমরানের ১৩৪ নম্বর আয়াত- ‘আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালোবাসেন’। সৎকর্মশীল মানেই সম্মানিত ব্যক্তি। যারা আল্লাহর পথে দান করেন, আল্লাহ তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।

রাগ নিয়ন্ত্রণ : যারা রাগ করেন না তারা সাধারণত ভদ্র। মানুষ তাদের সম্মান করেন। রাগ মানুষকে অভদ্র, উদ্ধত, বদমেজাজি ও অহঙ্কারী করে তোলে। ফলে সে অসম্মানিত ও অপমানিত হয়। অত্যধিক রাগ ও রাগহীনতার মাঝামাঝি পন্থার নাম বিনয় ও নম্রতা। এটি চরিত্রের ভূষণ ও সর্বোত্তম পন্থা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে চলে ও রাগান্বিত হয়ে ক্ষমা করে’ (সূরা আশ শুরা-৩৭)।

টোস্ট মাস্টার ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট জিসিকা লেবর সম্মান অর্জনের ১৫টি বিষয় উপস্থাপন করেছেন। সত্যিকার অর্থে এগুলো ইসলাম থেকেই ধার নেয়া। বিষয়গুলো নি¤œরূপ-

১. এমন কিছু করুন যা সত্যিই মানুষের কাজে লাগে; ২. কথা দিয়ে কথা রাখুন; ৩. দোষ না করলে দুঃখিত বলবেন না; ৪. ভুল করলে স্বীকার করুন এবং সংশোধন করুন; ৫. অন্যের সময় নষ্ট করবেন না; ৬. না জেনে মন্তব্য করবেন না, প্রয়োজনে চুপ থাকুন; ৭. অন্যের মতামতকে সম্মান জানান; ৮. অহঙ্কার করবেন না; ৯. অতি বিনয় পরিহার করুন; ১০. সৎ থাকুন; ১১. কথা ও কাজে মিল রাখুন; ১২. সব সময় নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করুন; ১৩. ইতিবাচক থাকুন ও অন্যদের অনুপ্রাণিত করুন; ১৪. আবেগের বদলে যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত নিন ও ১৫. সব সময় সত্যি কথা বলুন এবং সাহস প্রকাশ করুন।

إِنَّ رَبَّكَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ﴾

নিসন্দেহে তোমার রব সর্বজ্ঞ ও বিজ্ঞানময়৷”সূরা ইউসুফ-৬

৬:৮৪ وَ وَهَبۡنَا لَهٗۤ اِسۡحٰقَ وَ یَعۡقُوۡبَ ؕ کُلًّا هَدَیۡنَا ۚ وَ نُوۡحًا هَدَیۡنَا مِنۡ قَبۡلُ وَ مِنۡ ذُرِّیَّتِهٖ دَاوٗدَ وَ سُلَیۡمٰنَ وَ اَیُّوۡبَ وَ یُوۡسُفَ وَ مُوۡسٰی وَ هٰرُوۡنَ ؕ وَ کَذٰلِکَ نَجۡزِی الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿ۙ

৮৪. আর আমরা তাকে দান করেছিলাম ইসহাক ও ইয়া’কূব, এদের প্রত্যেককে হিদায়াত দিয়েছিলাম; পূর্বে নূহকেও আমরা হিদায়াত দিয়েছিলাম এবং তাঁর বংশধর দাউদ, সুলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও; আর এভাবেই মুহসিনদের পুরস্কৃত করি;

আমরা জানলাম ইবরাহীম আ এর জীবনের কথা, কিভাবে যুক্তি প্রমানের উপর দিয়ে রবের কথা বলেছেন।

মুসা আ ও ইসা আ এর অনুসারীরা যার যার চিন্তায় মনে করে তারাই একমাত্র ইবরাহীম আ এর অনুসারী।

এখানে আহলে কিতাবদের কথা বলার জন্যই এইভাবে ইবরাহীম আ এর সাথে ইসহাক আ ও তার ছেলে ইয়াকুব আ এর কথা তুলে ধরেছেন। এরপর বনী ইসরাইলের ধারা উল্লেখ হয়েছে।

আর দেখো ইবরাহীমের কাছে আমার ফেরেশতারা সুখবর নিয়ে পৌছলো৷ তারা বললো, তোমার প্রতি সালাম বর্ষিত হোক৷ ইবরাহীম জওয়াবে বললো, তোমাদের প্রতিও সালাম বর্ষিত হোক৷ তারপর কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই ইবরাহীম একটি কাবাব করা বাছুর (তাদের মেহমানদারীর জন্য) নিয়ে এলো৷ কিন্তু যখন দেখলো তাদের হাত আহারের দিকে এগুচ্ছে না তখন তাদরে প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়লো এবং তাদের ব্যাপারে মনে মনে ভীতি অনুভব করতে লাগলো৷ তারা বললো, “ভয় পাবেন না, আমাদের তো লূতের সম্প্রদায়ের কাছে পাঠানো হয়েছে৷” ইবরাহীমের স্ত্রীও দাঁড়িয়ে ছিল, সে একথা শুনে হেসে ফেললো৷ তারপর আমি তাকে ইসহাকের এবং ইসহাকের পরে ইয়াকুবের সুখবর দিলাম৷ সূরা হূদ ৬৯-৭১

বার্ধক্যে যখন তিনি সন্তান থেকে নিরাশ হয়ে গিয়েছিলেন। যেমন, সূরা হূদের ৭২-৭৩ নং আয়াতে আছে।

১১:৭২ قَالَتۡ یٰوَیۡلَتٰۤیءَ اَلِدُ وَ اَنَا عَجُوۡزٌ وَّ هٰذَا بَعۡلِیۡ شَیۡخًا ؕ اِنَّ هٰذَا لَشَیۡءٌ عَجِیۡبٌ

৭২. তিনি বললেন, হায়, কি আশ্চর্য! সন্তানের জননী হব আমি, যখন আমি বৃদ্ধা এবং এ আমার স্বামী বৃদ্ধ! এটা অবশ্যই এক অদ্ভুত ব্যাপার।

১১:৭৩ قَالُوۡۤا اَتَعۡجَبِیۡنَ مِنۡ اَمۡرِ اللّٰهِ رَحۡمَتُ اللّٰهِ وَ بَرَکٰتُهٗ عَلَیۡکُمۡ اَهۡلَ الۡبَیۡتِ ؕ اِنَّهٗ حَمِیۡدٌ مَّجِیۡدٌ

তারা বলল, আল্লাহর কাজে আপনি বিস্ময় বোধ করছেন? হে নবী পরিবার! আপনাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর অনুগ্রহ ও কল্যাণ। তিনি তো প্রশংসার যোগ্য ও অত্যন্ত সম্মানিত।

মুজাহিদ বলেন, তখন সারার বয়স ছিল ৯৯ বছর। আর ইবরাহীমের বয়স ছিল ১০০ বছর, সে হিসেবে ইবরাহীমের বয়স তার স্ত্রী অপেক্ষা ১ বছর বেশি। [বাগভী; কুরতুবী] ইবন ইসহাক বলেন, তার বয়স ১২০ বছর এবং তার স্ত্রীর ৯০ বছর। এতে আরও মতামত রয়েছে। [বাগভী; কুরতুবী]

অতঃপর পুত্রের সাথে সাথে এমন পৌত্র হওয়ারও সুসংবাদ দিলেন যিনি হবেন ইয়াকূব (আঃ)। আর এর (ইয়াক্বূবের) অর্থে এ কথাও শামিল আছে যে, তাঁর পশ্চাতে তাঁর সন্তানদের ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে। কারণ, এটা عَقَب (পশ্চাৎ) ধাতু থেকে গঠিত।

ذُرِّيَّتِهِ তে (তার) সর্বনামের ‘মারজা’ (পূর্বপদ) কোন কোন মুফাসসির নূহ (আঃ)-কে গণ্য করেছেন। কারণ, এটাই নিকটতম বিশেষ্য। অর্থাৎ, নূহ (আঃ)-এর সন্তানদের মধ্যে দাউদ (আঃ) এবং সুলাইমান (আঃ)-কে। আবার কেউ কেউ (সর্বনামের পূর্ববিশেষ্য) ইবরাহীম (আঃ)-কে গণ্য করেছেন। কারণ, সমস্ত আলোচনাটাই হচ্ছে তাঁর সম্বন্ধে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এই সমস্যা দেখা দেবে যে, (লক্ষ্য যদি ইবরাহীম (আঃ) হন) তাহলে ‘লূত (আঃ)’-এর নাম এই সূচীতে আসা উচিত ছিল না। কারণ, তিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর সন্তানদের আওতায় পড়েন না। তিনি হলেন তাঁর (ইবরাহীম (আঃ)-এর) ভাই ‘হারান ইবনে আ-যার’এর ছেলে। অর্থাৎ, ইবরাহীম (আঃ)-এর ভাইপো। আর ইবরাহীম (আঃ) লূত (আঃ)-এর পিতা নন, বরং চাচা। তবে হয়তো অধিকাংশের দিকে লক্ষ্য করে তাঁকেও ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর বা সন্তানদের মধ্যে গণ্য করে নেওয়া হয়েছে। এর আরো একটি দৃষ্টান্ত কুরআন মাজীদে আছে। যেখানে ইসমাঈল (আঃ)-কে ইয়াক্বূব (আঃ)-এর সন্তানদের পূর্বপুরুষ গণ্য করা হয়েছে। অথচ তিনি তাঁর চাচা ছিলেন। (দ্রষ্টব্যঃ সূরা বাক্বারা ১৩৩নং আয়াত)

৬:৮৫ وَ زَکَرِیَّا وَ یَحۡیٰی وَ عِیۡسٰی وَ اِلۡیَاسَ ؕ کُلٌّ مِّنَ الصّٰلِحِیۡنَ

৮৫. আর যাকারিয়্যা, ইয়াহয়া ঈসা এবং ইলইয়াসকেও (হিদায়াত দিয়েছিলাম)। এরা প্রত্যেকেই সৎকর্মপরায়ণ ছিলে;

ঈসা (আঃ)-এর উল্লেখ নূহ (আঃ) অথবা ইবরাহীম (আঃ)-এর সন্তানদের সাথে করা হয়েছে (অথচ তাঁর পিতা নেই), তা এই জন্য যে, মেয়েদের সন্তানরাও পুরুষদের সন্তানের মধ্যে শামিল হয়। যেমন, নবী করীম (আঃ) হাসান (রাঃ) (স্বীয় কন্যা ফাতিমা رَضِيَ اللهُ عَنْهَا এর ছেলে)-কে নিজের বেটা বলেছেন। ((إِنَّ ابْنِيْ هَذَا سَيِّدٌ ولَعلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيْمَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ)) (صحيح البخاري، كتاب الصلح) আরো বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, তাফসীর ইবনে কাসীর)

৬:৮৬ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ وَ الۡیَسَعَ وَ یُوۡنُسَ وَ لُوۡطًا ؕ وَ کُلًّا فَضَّلۡنَا عَلَی الۡعٰلَمِیۡنَ

৮৬. এবং ইসমা’ঈল, আল-ইয়াসা, ইউনুস ও লূতকেও (হিদায়াত দিয়েছিলাম) আর তাদের প্রত্যেককে আমরা শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম সৃষ্টিকুলের উপর।

৬:৮৭ وَ مِنۡ اٰبَآئِهِمۡ وَ ذُرِّیّٰتِهِمۡ وَ اِخۡوَانِهِمۡ ۚ وَ اجۡتَبَیۡنٰهُمۡ وَ هَدَیۡنٰهُمۡ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ

৮৭. এবং তাদের পিতৃপুরুষ, বংশধর ও ভাইদের কিছুসংখ্যককে। আর আমরা তাদেরকে মনোনীত করেছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করেছিলাম।

একত্রে ১৭ জন নবীর নাম এসেছে সূরা আন‘আম ৮৩ হ’তে ৮৬ আয়াতে।

বাকী নাম সমূহ এসেছে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে।

কেবলমাত্র ইউসুফ (আঃ)-এর কাহিনী সূরা ইউসুফে একত্রে বর্ণিত হয়েছে। বাকী নবীগণের কাহিনী কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে এসেছে। যেমন মূসা ও ফেরাঊনের ঘটনা কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৫টি স্থানে বর্ণিত হয়েছে। সেগুলিকে একত্রিত করে কাহিনীর রূপ দেওয়া রীতিমত কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

আল্লাহ বলেন, وَرُسُلاً قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلاً لَّمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ.

‘আমরা আপনার পূর্বে এমন বহু রাসূল পাঠিয়েছি, যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনিয়েছি এবং এমন বহু রাসূল পাঠিয়েছি, যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শুনাইনি…’ (নিসা ৪/১৬৪, মুমিন ৪০/৭৮)।

কুরআনে বর্ণিত ২৫ জন নবীর নাম:

আদম, নূহ, ইদরীস, হূদ, ছালেহ, ইবরাহীম, লূত্ব, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব, ইউসুফ, আইয়ূব, শু‘আয়েব, মূসা, হারূণ, ইউনুস, দাঊদ, সুলায়মান, ইলিয়াস, আল-ইয়াসা‘, যুল-কিফ্ল, যাকারিয়া, ইয়াহ্ইয়া, ঈসা (আঃ) ও মুহাম্মাদ (ছাঃ)। (ইবনু কাছীর, তাফসীর নিসা ২৬৪)

এঁদের মধ্যে ইবরাহীম-পূর্ব সকল নবী আদম ও নূহের বংশধর এবং ইবরাহীম-পরবর্তী সকল নবী ও রাসূল ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর।

উল্লেখ্য যে, সূরা তওবা ৩০ আয়াতে ওযায়ের-এর নাম, এলেও তিনি নবী ছিলেন না। বরং একজন সৎকর্মশীল ব্যক্তি ছিলেন। কুরতুবী বলেন, অত্যাচারী খৃষ্টান রাজা বুখতানছরের ভয়ে যখন ফিলিস্তীনের ইহুদীরা সবাই তওরাত মাটিতে পুঁতে ফেলে এবং তওরাত ভুলে যায়, তখন ওযায়ের তওরাত মুখস্ত করে সবাইকে শুনান। তাতে অনেকে এটাকে অলৌকিকভাবে তাকে ‘ইবনুল্লাহ’ বা আল্লাহর বেটা বলতে থাকে। ইবনু কাছীর ও সুদ্দী প্রমুখের বরাতে কাছাকাছি একইরূপ বর্ণনা করেছেন।

আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:

مَا أَدْرِيْ أعُزَيْرٌ نَبِيُّ هُوَ أَمْ لاَ

‘আমি জানি না যে, উযাইর নবী ছিলেন কি না। আবূ দাউদ, আস-সুনান ৪/২১৮; আযীম আবাদী, আউনুল মা’বুদ ১২/২৮০।

পৃথিবীতে আগত সকল নবীই মূলতঃ চারটি বংশধারা থেকে এসেছেন।

আল্লাহ বলেন,

إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى آدَمَ وَنُوحًا وَآلَ إِبْرَاهِيْمَ وَآلَ عِمْرَانَ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ، ذُرِّيَّةً بَعْضُهَا مِنْ بَعْضٍ.

‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ আদম, নূহ, আলে ইব্রাহীম ও আলে ইমরানকে নির্বাচিত করেছেন। যারা একে অপরের বংশধর ছিল …’ (আলে ইমরান ৩/৩৩-৩৪)।

এখানে আলে ইবরাহীম বলতে ইসমাঈল ও ইসহাক এবং আলে ইমরান বলতে মূসা ও তাঁর বংশধরগণকে বুঝানো হয়েছে।

ইবরাহীম-পুত্র ইসহাক তনয় ইয়াকূব-এর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ (অর্থ ‘আল্লাহর দাস’)। তাঁর পুত্র ‘লাভী’ থেকে ইমরান-পুত্র মূসা, দাঊদ ও ঈসা পর্যন্ত সবাই বনু ইস্রাঈলের নবী ছিলেন (আনকাবূত ২৯/২৭)।

ইবরাহীমের জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈলের বংশে জন্মগ্রহণ করেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। এজন্য ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-কে ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীগণের পিতা বলা হয়।

آباء (পিতৃগণ) বলতে মূল তথা পিতৃপুরুষগণ এবং ذريات বলতে শাখা-প্রশাখা তথা বংশধর ও সন্তান-সন্ততিদেরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, তাদের পিতৃপুরুষ, সন্তান-সন্ততি এবং ভাইদের মধ্য থেকেও আমি ‘ইজতিবা’ ও হিদায়াতের সম্মান দানে ধন্য করেছি। ‘ইজতিবা’র অর্থ হল, মনোনয়ন ও নির্বাচন করা এবং স্বীয় বিশিষ্ট বান্দাদের মধ্যে গণ্য করে নেওয়া ও তাদের সাথে মিলিয়ে নেওয়া। আর এটা جَبَيتُ الْماءَ فِي الْحَوْضِ (আমি হাওযে পানি জমা করে নিয়েছি) থেকে উদ্ভূত। অতএব, ‘ইজতিবা’র অর্থ হবে নিজের বিশিষ্ট বান্দাদের দলে শামিল করে নেওয়া। اصطِفاءٌ (মনোনীত ও নির্বাচন করা)ও এই অর্থেই ব্যবহূত। যার ‘মাফঊল’ (কর্মকারক) হল مصطفى মনোনীত ও নির্বাচিত। (ফাতহুল ক্বাদীর)

৬:৮৮ ذٰلِکَ هُدَی اللّٰهِ یَهۡدِیۡ بِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ مِنۡ عِبَادِهٖ ؕ وَ لَوۡ اَشۡرَکُوۡا لَحَبِطَ عَنۡهُمۡ مَّا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ ﴿

৮৮. এটা আল্লাহর হিদায়াত, স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছে তিনি এ দ্বারা হিদায়াত করেন। আর যদি তারা শির্ক করত তবে তাঁদের কৃতকর্ম নিস্ফল হত।

আলোচ্য আয়াতসমূহে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত দানসমূহ বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের একটি নিয়ম ব্যক্ত করা হয়েছে যে, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে প্রিয় বস্তু বিসর্জন দেয়, আল্লাহ তা’আলা তাকে দুনিয়াতেও তদপেক্ষা উত্তম বস্তু দান করেন।” [মুসনাদে আহমাদ: ৫/৩৬৩] অপরদিকে মক্কার মুশরিকদেরকে এসব অবস্থা শুনিয়ে বলা হয়েছে যে, দেখ, তোমাদের মান্যবর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার সমগ্র পরিবার এ কথাই বলে এসেছেন যে, আরাধনার যোগ্য একমাত্র সত্তা হচ্ছেন আল্লাহ্ তা’আলা। তার সাথে অন্যকে আরাধনায় শরীক করা কিংবা তার বিশেষ গুণে তার সমতুল্য মনে করা, তার ইবাদাতে অপর কাউকে শরীক করা শির্ক, কুফর ও পথভ্রষ্টতা। অতএব, তোমরা যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আদেশ অমান্য কর, তবে তোমরা আপন স্বীকৃত বিষয় অনুযায়ীও অভিযুক্ত।

১৮ জন নবীদের নাম উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলছেন, এই নবীরাও যদি শিরক করে বসত, তবে তাদেরও সমস্ত আমল নিষ্ফল ও বিনষ্ট হয়ে যেত। যেমন, অন্যত্র নবী করীম (সাঃ)-কে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা বলেন, {لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ} ‘‘ হে নবী! যদি তুমিও শিরক কর, তবে তোমার সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে যাবে।’’ (সূরা যুমার ৬৫) অথচ নবীদের দ্বারা শিরক সংঘটন হওয়া সম্ভবই নয়। আসলে উদ্দেশ্য হল উম্মতদেরকে শিরকের ভয়াবহতা এবং তার সর্বনাশী কুফল থেকে সতর্ক করা।

‘‘তুমি যাকে পছন্দ করো, তাকে হেদায়াত করতে পারবে না, তবে আল্লাহ্ তা‘আলাই যাকে ইচ্ছা হেদায়াতের পথে আনয়ন করেন। কে সৎপথে আসবে, সে সম্পর্কে তিনিই অধিক অবগত আছেন’’। (সূরা কাসাস: ৫৬)

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে হেদায়াতের মালিক নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে, তা হচ্ছে হেদায়াতের তাওফীক দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কেউ এ প্রকার হেদায়াতের মালিক নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ أَنْ تُؤْمِنَ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ

‘‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ ঈমান আনতে পারে না’’। (সূরা ইউনূস: ১০০) নূহ (আ.) তার পুত্রকে হেদায়াত করতে পারেননি, স্ত্রীকেও সৎ পথে আনতে পারেননি। ইবরাহীম খলীল (আ.) তার পিতাকে দ্বীনের পথে আনয়ন করার চেষ্টা করেও সফল হননি। লুত (আ.)এর ক্ষেত্রেও একই কথা। তার স্ত্রীকে সুপথে আনতে পারেননি। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম ও ইসহাক (আ.)এর ব্যাপারে বলেন,

وَبَارَكْنَا عَلَيْهِ وَعَلَى إِسْحَاقَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِهِمَا مُحْسِنٌ وَظَالِمٌ لِنَفْسِهِ مُبِينٌ

‘‘তাকে (ইবরাহীমকে) এবং ইসহাককে আমি বরকত দান করেছি। তাদের বংশধরদের মধ্যে কতক সৎকর্মী এবং কতক নিজেদের উপর স্পষ্ট যুলুমকারী। (সূরা সাফফাত: ১১৩)

আর নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে প্রকার হেদায়াত করতে সক্ষম বলে কুরআন সাক্ষ্য দিয়েছে, তা হচ্ছে হেদায়াতের পথ দেখানো। তিনি এবং সকল নাবী-রসূলই মানুষকে হেদায়াতের পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা সূরা শুরার ৫২ নং আয়াতে বলেন, وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ ‘‘নিশ্চয় আপনি সরল পথপ্রদর্শন করেন’’।

৬:৮৯ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰهُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحُکۡمَ وَ النُّبُوَّۃَ ۚ فَاِنۡ یَّکۡفُرۡ بِهَا هٰۤؤُلَآءِ فَقَدۡ وَکَّلۡنَا بِهَا قَوۡمًا لَّیۡسُوۡا بِهَا بِکٰفِرِیۡنَ

৮৯. এরাই তারা, যাদেরকে আমরা কিতাব, কর্তৃত্ব ও নবুওয়াত দান করেছি, অতঃপর যদি তারা এগুলোর সাথে কুফরী করে, তবে আমরা এমন এক সম্প্রদায়কে এগুলোর ভার দিয়েছি যারা এগুলোর সাথে কাফির নয়।

অর্থাৎ কিছুসংখ্যক সম্বোধিত ব্যক্তি যদি আপনার কথা অমান্য করে এবং পূর্ববর্তী সমস্ত নবীগণের নির্দেশ বর্ণনা করা সত্বেও অস্বীকারই করতে থাকে, তবে আপনি দুঃখিত হবেন না। কেননা, আপনার নবুওয়াত স্বীকার করার জন্য আমি একটি বিরাট জাতি স্থির করে রেখেছি। তারা অবিশ্বাস করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর আমলে বিদ্যমান মুহাজির ও আনসার এবং কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সমস্ত মুসলিম এ জাতির অন্তর্ভুক্ত। [আইসারুত তাফসীর] এ আয়াত তাদের সবার জন্য গর্বের সামগ্রী। কেননা, এ আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা প্রশংসার স্থলে তাদের উল্লেখ করেছেন।

৬:৯০ اُولٰٓئِکَ الَّذِیۡنَ هَدَی اللّٰهُ فَبِهُدٰىهُمُ اقۡتَدِهۡ ؕ قُلۡ لَّاۤ اَسۡـَٔلُکُمۡ عَلَیۡهِ اَجۡرًا ؕ اِنۡ هُوَ اِلَّا ذِکۡرٰی لِلۡعٰلَمِیۡنَ ﴿

৯০. এরাই তারা, যাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন, কাজেই আপনি তাদের পথের অনুসরণ করুন। বলুন, এর জন্য আমি তোমাদের কাছে পারিশ্রমিক চাই না, এ তো শুধু সৃষ্টিকুলের জন্য উপদেশ।

আলোচ্য আয়াতসমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সম্বোধন করে মক্কাবাসীদেরকে শোনানো হয়েছে যে, কোন জাতির পূর্বপুরুষরা শুধু পিতৃপুরুষ হওয়ার কারণেই অনুসরণীয় হতে পারে না যে, তাদের প্রত্যেকটি কথা ও কাজকে অনুসরণযোগ্য মনে করতে হবে। আরবদের সাধারণ ধারণা তাই ছিল। অনুসরণের ক্ষেত্রে প্রথমে দেখতে হবে যে, যার অনুসরণ করা হবে, সে নিজেও বিশুদ্ধ পথে আছে কি না। তাই নবীগণ আলাইহিমুস সালামদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, “এরা এমন লোক, যাদেরকে আল্লাহ সৎপথ প্রদর্শন করেছেন”। এরপর বলেছেন, “আপনিও তাদের হেদায়াত ও কর্মপন্থা অনুসরণ করুন”। এতে দুটি নির্দেশ রয়েছে-

(এক) আরববাসী ও সমগ্র উম্মতকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, পৈত্রিক অনুসরণের কুসংস্কার পরিত্যাগ কর এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সুপথপ্রাপ্ত নবী-রাসূলদের অনুসরণ কর।

(দুই) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আপনিও পূর্ববতী নবীগণের পন্থা অবলম্বন করুন।

এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বিশেষভাবে একটি ঘোষণা করতে বলা হয়েছে, যা পূর্ববর্তী নবীগণও করেছেন। ঘোষণাটি হচ্ছে, আমি তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করার জন্য যেসব নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি, তজ্জন্য তোমাদের কাছে কোন ফি বা পারিশ্রমিক চাই না। তোমরা এসব নির্দেশ মেনে নিলে আমার কোন লাভ নাই এবং না মানলে তাতেও কোন ক্ষতি নেই। এটি হচ্ছে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ ও শুভেচ্ছার বার্তা। বস্তুত: শিক্ষা ও প্রচারকার্যের জন্য কোনরূপ পারিশ্রমিক গ্রহণ না করা সব যুগে সব নবীর নিকট অভিন্ন রীতি ছিল। প্রচারকার্য কার্যকরী হওয়ার ব্যাপারে এর প্রভাব অনস্বীকার্য।

দ্বীনের কাজ করে পারিশ্রমিক নেয়া কি জায়েয?

মুমিনদের সব কাজই ধর্মীয়। তারপরও নির্দিষ্ট কিছু কাজ রয়েছে যেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিগণ পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারবেন। সেজন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বা কমিটি যথাযথ সম্মানীর ব্যবস্থা করবে। আবুবকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বেতন প্রদান করা হত (ছহীহ বুখারী, হা/২০৭০)। যেমন কাউকে কুরআন শিক্ষা দেয়া, মসজিদে আযান দেয়া বা ইমামতি করা এবং অন্যের নিকট দ্বীন প্রচার করা ইত্যাদি। শায়খ উছায়মীন (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, মসজিদের পরিচ্ছন্নকর্মী, ইমাম, মুয়াযযিন, কুরআনের শিক্ষকদের চুক্তি ছাড়া কোন ফান্ড থেকে বেতন দেয়াতে কোন সমস্যা নেই। যদি সরকার অথবা কোন বায়তুল মাল ফান্ড থেকে দেয়া হয় তাতেও সমস্যা নেই। কারণ যে ব্যক্তি এ দায়িত্ব পালন করবে জনগণের উচিত তার প্রয়োজন মেটানো (মুহাম্মাদ ছালেহ আল-উছায়মীন, নূরুন ‘আলাদ দারব, ৪৮/১৮২ পৃ.)। রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, إِنَّ أَحَقَّ مَا أَخَذْتُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا كِتَابُ اللَّهِ ‘যে সকল জিনিসের উপর তোমরা বিনিময় গ্রহণ করে থাক, তন্মধ্যে পারিশ্রমিক গ্রহণ করার সবচেয়ে বেশি হক রয়েছে আল্লাহর কিতাবের ক্ষেত্রে’ (ছহীহ বুখারী, হা/৫৭৩৭)।

তবে শর্ত বা চুক্তি করা উচিত নয়। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যে ব্যক্তি বলে আমি এত টাকা হলে ইমামতির চাকুরী করব, নয়লে করব না। তাহলে এমন ইমাম থেকে মুক্তি চাই। এমন ইমামের পেছনে কোন মুছল্লী কি ছালাত আদায় করবে? (মুহাম্মাদ বিন ইবরহীম, ইবাদতের দিকে ধাবিত হওয়ার আদব, পৃ. ১২৮)।

রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওছমান ইবনু আবিল ‘আছ (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে বললেন, أَنْتَ إِمَامُهُمْ وَاقْتَدِ بِأَضْعَفِهِمْ وَاتَّخِذْ مُؤَذِّنًا لَا يَأْخُذُ عَلَى أَذَانِهِ أَجْرًا ‘যাও তোমাকে তাদের ইমাম নিযুক্ত করা হল। তবে দুর্বল মুক্তাদীদের প্রতি খেয়াল রাখবে এবং এমন একজন মুয়াযযিন নিয়োগ করবে, যে তার আযানের বিনিময়ে পারিশ্রমিক গ্রহণ করবে না’ (আবূ দাঊদ, হা/৫৩১; নাসাঈ, হা/৬৭২; মিশকাত, হা/৬৬৮, সনদ ছহীহ)।

উক্ত হাদীছ উল্লেখ করে শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ঐ মুয়াযযিন উত্তম, যে আযানের বিনিময়ে কিছুই চায় না বা শর্ত করে না (শায়খ বিন বায, নূরুন ‘আলাদ দারাব, ‘আযান ও ইক্বামত’ অধ্যায়, ‘আযান দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করার বিধান’ অনুচ্ছেদ)। আল্লাহই অধিক জানেন।

রাসূল সাঃ কোরআনকে উপার্জনের পাথেয় হিসেবে গ্রহন করতে নিষেধ করেছেন।

১/রাসূল সা. বলেন- اقرءوا القران ولا تغلوا فيه ولا تجفوا عنه ولا تأكلوا به ولا تستكثروا به অর্থ- তোমরা কোরআন পাঠ কর।তবে তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেনা,তার থেকে দূরে সরে যাবেনা,তাকে অবলম্বন করে সম্পদ ভক্ষণ করবেনা, এবং তাকে অবলম্বন করে পার্থিব সম্পদ বাড়ানোর চেষ্টা করোনা।(আহমাদ,আল মুসনাদ,হা-নং-১৪৯৮১, ১৪৯৮৬ ২/ |

২/যে ব্যক্তি মানুষের কাছ থেকে রুটি-রুজি অর্জন করার উদ্দেশ্যে কোরআন পড়ে, সে কিয়ামাতের দিন এমন অবস্থায় উথিত হবে যে, তার চেহারার কেবল হাড়গোড়ই অবশিষ্ট থাকবে এবং তাতে গোশত থাকবে না। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা তাকে অপমানিত করবেন।(বায়হাকি,শুআবুল ইমান, হা.নং–২৫১৮)

কোরআন:-

আমার আয়াতের বিনিময়ে সামান্য মূল্যও তোমরা গ্রহণ করিও না। তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর। সূরা বাকারাঃ ৪১

হযরত নূহের অঙ্গিকার:-

হে আমার সম্প্রদায়! ইহার পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট। হুদঃ ২৯

হযরত হুদের অঙ্গিকার:-

হে আমার সপ্রদায়! আমি ইহার পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোন মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তারই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুঝতে চেষ্টা করবে না? হুদঃ ৫১

হযরত ছালেহ আ’ র অঙ্গিকার:-

আমি তোমাদের নিকট ইহার জন্য কোন পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। শুয়ারাঃ ১৪৫

হযরত লুতের আ অঙ্গিকার:-

ইহার জন্য আমি কোন মজুরী চাই না। আমার মজুরী জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। শুয়ারাঃ ১৬৪

হযরত শোয়াইবের আ অঙ্গিকার:-

আমি ইহার জন্য তোমাদের নিকট কোন মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। শুয়ারাঃ ১৮০

হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর অঙ্গিকার:-

এবং তুমি তাদের নিকট কোন মজুরি দাবি করিও না। ইহাতো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র। সূরা ইউসুফঃ১০৪

বল! আমি ইহার জন্য তোমাদের নিকট কোন পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভূক্ত নই। সূরা সাদঃ ৮৬

তাদেরকেই (নবিদেরকেই) আল্লাহ সৎ পথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! ইহার জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন মজুরি চাই না-। আনয়ামঃ ৯০

সংগ্রহে

তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন

https://www.youtube.com/watch?v=pEoF1B9wCFo