সুরা বাকারাঃ ৪০তম রুকু (২৮৪-২৮৬)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:২৮৪ لِلّٰهِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ اِنۡ تُبۡدُوۡا مَا فِیۡۤ اَنۡفُسِکُمۡ اَوۡ تُخۡفُوۡهُ یُحَاسِبۡکُمۡ بِهِ اللّٰهُ ؕ فَیَغۡفِرُ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یُعَذِّبُ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
২৮৪. আল্লাহর জন্যই যা আছে আসমানসমূহে ও যা আছে যমীনে। তোমাদের মনে যা আছে তা প্রকাশ কর বা গোপন রাখ, আল্লাহ সেগুলোর হিসেব তোমাদের কাছ থেকে নিবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছে তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছে শাস্তি দিবেন।। আর আল্লাহ সব কিছুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।
হাদীসসমূহে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন এই আয়াত নাযিল হয়, তখন সাহাবায়ে কেরাম বড়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। তাঁরা রসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে আরজি পেশ করে বলেন, হে আল্লাহর রসূল! নামায-রোযা এবং যাকাত ও জিহাদ ইত্যাদি যে সমস্ত আমল করার নির্দেশ আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা আমরা করছি। কারণ, এ কাজগুলো আমাদের সামর্থ্যের বাইরে নয়। কিন্তু অন্তরে যেসব খেয়াল ও কুমন্ত্রণার সৃষ্টি হয় তার উপর তো আমাদের কোন এখতিয়ার নেই। সেগুলো তো মানুষের শক্তির বাইরের জিনিস। অথচ মহান আল্লাহ তারও হিসাব নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। নবী করীম (সাঃ) বললেন, ‘আপাতত তোমরা বল, আমরা শুনলাম ও মান্য করলাম।’
এরপর সাহাবাদের শোনার ও মানার উদ্দীপনা দেখে মহান আল্লাহ উক্ত আয়াতকে {لا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا} আয়াত দ্বারা মানসুখ (রহিত) করে দিলেন। (ইবনে কাসীর ও ফাতহুল ক্বাদীর) বুখারী-মুসলিম এবং অন্যান্য সুনান গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসটিও এর সমর্থন করে, ‘‘অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের অন্তরে উদীয়মান খেয়ালের কোন বিচার করবেন না, যে পর্যন্ত না তা কাজে পরিণত করবে অথবা মুখে উচ্চারণ করবে। (বুখারী ২৫২৮-মুসলিম ১২৭নং)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অন্তরে উদিত খেয়ালের কোন হিসাব হবে না। কেবল সেই খেয়ালের হিসাব হবে, যা কাজে পরিণত করা হবে। (উক্ত) আয়াতের ব্যাপারে ইমাম ইবনে জারীরের বিপরীত মন্তব্য রয়েছে। তাঁর খেয়াল হল, আয়াতকে রহিত করা হয়নি। কেননা, হিসাব হলেই যে শাস্তি হবে তা জরুরী নয়। অর্থাৎ, এটা জরুরী নয় যে, মহান আল্লাহ যারই হিসাব নিবেন, তাকেই শাস্তি দিবেন। বরং তিনি হিসাব তো প্রত্যেকেরই নিবেন, কিন্তু অনেক মানুষ এমনও থাকবে যাদের হিসাব নেওয়ার পর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। কিছু লোকের সাথে তো এমনও ব্যবহার করা হবে যে, তাদের একটি একটি পাপকে স্মরণ করিয়ে স্বীকারোক্তি নিয়ে বলবেন, দুনিয়ায় এই পাপগুলোকে আমি গোপন করে রেখেছিলাম। যাও, আজ এগুলোকে আমি মাফ করে দিলাম। (এই হাদীস সহীহ বুখারী ও মুসলিম ইত্যাদিতে বর্ণিত হয়েছে। ইবনে কাসীর) কোন কোন উলামা বলেছেন, এখানে ‘নাসখ’ (রহিত করণ) পারিভাষিক অর্থে বলা হয়নি, বরং কখনো কখনো ‘নাসখ’ ব্যবহার করা হয় কোন জিনিসকে আরো পরিষ্কারভাবে বিশ্লেষণ করে দেওয়ার অর্থে। তাই সাহাবাদের অন্তরে এই আয়াত থেকে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে দূর করে দেওয়া হল
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কেয়ামতের দিন মুমিনকে আল্লাহ্ তা’আলার নিকটবর্তী করা হবে এবং আল্লাহ তাকে এক এক করে সব গোনাহ স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করবেনঃ এ গোনাহটি কি তোমার জানা আছে? মুমিন স্বীকার করবে। আল্লাহ্ তাআলা বলবেনঃ আমি দুনিয়াতেও তোমার গোনাহ জনসমক্ষে প্রকাশ করিনি, আজও তা ক্ষমা করে দিলাম। অতঃপর নেক কাজের আমলনামা তার হাতে অর্পণ করা হবে। পক্ষান্তরে কাফের ও মুনাফেকদের পাপকাজসমূহ প্রকাশ্যে বর্ণনা করা হবে। [বুখারীঃ ২৪৪১, মুসলিমঃ ২৭৬৮]
{لاَ يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا} এই আয়াত এবং ‘‘অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের অন্তরের খেয়ালের বিচার করবেন না—।’’ এই হাদীস দ্বারা। এভাবে উভয় আয়াতের একটিকে ‘নাসিখ’ এবং অপরটি ‘মানসূখ’ ভাবার কোন প্রয়োজন হবে না।
এখানে ভাষণ সমাপ্ত করা হয়েছে৷ তাই দীনের মৌলিক শিক্ষাগুলোর বর্ণনার মাধ্যমে যেমন সূরার সূচনা করা হয়েছিল ঠিক তেমনি যে সমস্ত মৌলিক বিষয়ের ওপর দীনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত সূরার সমাপ্তি প্রসংগে সেগুলোও বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে৷ তুলনামুলক পাঠের জন্য সূরার প্রথম রুকূ’টি সামনে রাখলে বিষয়বস্তু বুঝতে বেশী সাহায্য করবে বলে মনে করি৷
. এটি হচ্ছে দীনের প্রথম বুনিয়াদ৷ আল্লাহ এই পৃথিবী ও আকাশসমূহের মালিক এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছু তাঁর একক মালিকানাধীন, প্রকৃতপক্ষে এই মৌলিক সত্যের ভিত্তিতেই মানুষের জন্য আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন কর্মপদ্ধতি বৈধ ও সঠিক হতে পারে না৷
. এই বাক্যটিতে আরো দু’টি কথা বলা হয়েছে৷ এক, প্রত্যেক ব্যক্তি এককভাবে আল্লাহর কাছে দায়ী হবে এবং এককভাবে তাকে জবাবাদিহি করতে হবে৷
দুই, পৃথিবী ও আকাশের যে একচ্ছত্র অধিপতির কাছে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে তিনি অদৃশ্য ও প্রকাশ্যের জ্ঞান রাখেন৷ এমনকি লোকদের গোপন সংকল্প এবং তাদের মনের সংগোপনে যেসব চিন্তা জাগে সেগুলোও তাঁর কাছে অপ্রকাশ নেই৷
২০:৬ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ وَ مَا بَیۡنَهُمَا وَ مَا تَحۡتَ الثَّرٰی
. যা আছে আসমানসমূহে ও যমীনে এবং এ দু’য়ের মধ্যবর্তী স্থানে ও ভূগর্ভে তা তাঁরই। ত্বাহাঃ ৬
. এটি আল্লাহর অবাধ ক্ষমতারই একটি বর্ণনা ৷ তাঁর ওপর কোন আইনের বাঁধন নেই ৷ কোন বিশেষ আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য তিনি বাধ্য নন৷ বরং তিনি সর্বময় ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী৷ শাস্তি দেয়ার ও মাফ করার পূর্ণ ইখতিয়ার তাঁর রয়েছে৷
আল্লাহ বলেন,
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ-
‘আমরা মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মনের মধ্যে যে কুচিন্তা আসে সেটাও আমরা জানি। আর তার গর্দানের মূল শিরা থেকেও আমরা তার নিকটবর্তী’ (ক্বাফ ৫০/১৬)।
اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۱۱۹
নিশ্চয় অন্তরে যা রয়েছে সে সম্পর্কে আল্লাহ সবিশেষ অবগত। আলে ইমরানঃ ১১৯
وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ ﴿۷﴾
আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে সবিশেষ অবগত। মায়েদাঃ ৭
৬৭:১৩ وَ اَسِرُّوۡا قَوۡلَکُمۡ اَوِ اجۡهَرُوۡا بِهٖ ؕ اِنَّهٗ عَلِیۡمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوۡرِ
আর তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তরসমূহে যা আছে তা সম্পর্কে সম্যক অবগত। মূলকঃ ১৩
-২০:৭ وَ اِنۡ تَجۡهَرۡ بِالۡقَوۡلِ فَاِنَّهٗ یَعۡلَمُ السِّرَّ وَ اَخۡفٰی
আর যদি আপনি উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন, তবে তিনি তো যা গোপন ও অতি গোপন সবই জানেন। ত্বাহাঃ৭
’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা সৎ-অসৎ চিহ্নিত করে রেখেছেন। যে ব্যক্তি সৎ কাজের সংকল্প করে, কিন্তু তা করেনি আল্লাহ তা’আলা তার জন্য একটি পূর্ণ নেকী লিখে নেন। আর যদি সৎ কাজের সংকল্প করার পর তা বাস্তবায়ন করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাকে এই একটি সৎ কাজের জন্য দশ গুণ হতে সাতশ’ গুণ, বরং বহুগুণ পর্যন্ত সৎ কাজ হিসেবে লিখে রাখেন। আর যে ব্যক্তি অসৎ কাজের সংকল্প করে, কিন্তু বাস্তবে তা না করে, আল্লাহ তা’আলা তার জন্য একে একটি পূর্ণ নেক কাজ হিসেবে লিখে নেন। আর যদি অসৎ কাজের সংকল্প করার পর তা বাস্তবে করে, তাহলে আল্লাহ এর জন্য তার একটি মাত্র গুনাহ লিখে রাখেন। (বুখারী, মুসলিম)সহীহ : বুখারী ৬৪৯১, মুসলিম ১৩১, আহমাদ ২৮২৭, শু‘আবূল ঈমান ৩২৮, সহীহ আত্ তারগীব ১৭।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রভূর সূত্রে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সৎকাজ ও পাপকাজের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং সেগুলোর বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছেন।
হাদীস শরীফে এসেছে, এক সাহাবী হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আল্লাহর রাসূল! অনেক সময় আমার মনে এমন সব কথা আসে, যা মুখে উচ্চারণ করার চেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়াও আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়। আমি কী করতে পারি? দেখুন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী জওয়াব দিলেন! তিনি বললেন-‘এটা তো খাঁটি ঈমানের আলামত।’ (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, বাবু বয়ানিল ওয়াসওয়াসা ফিল ঈমান)
আখেরাতে হিসাব সহজ করে নিবেন——-
এরপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে; অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে। আর সে তার পরিবার-পরিজনের কাছে আনন্দিত হয়ে ফিরে যাবে। (সুরা ইনশিকাক : আয়াত ৭-৯)
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন কোরআনের এ ঘোষণার এ বিষয়টি নবিজীর সামনে তুলে ধরলেন; তখন নবিজী কী বলেছেন? হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন কেয়ামতের দিন যারই হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বললাম, (এ কথা শুনে হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন) হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ কি বলেননি-فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِيْنِهِ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيْرًا
‘এরপর যার ‘আমলনামা’ তার ডান হাতে দেওয়া হবে; তার হিসাব সহজভাবেই নেওয়া হবে।’
এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ’তা কেবল পেশ করা মাত্র। কেয়ামতের দিন যার হিসাব খতিয়ে দেখা হবে তাকে অবশ্যই আজাব দেওয়া হবে।’ (বুখারি)
اللَّهُمَّ حَاسِبْنِي حِسَابَاً يَسِيرَاً
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা হাসিবনি হিসাবাই ইয়াসিরা।
‘অর্থ : ‘হে আল্লাহ! (কেয়ামতের দিন) আমার কাছ থেকে সহজ করে হিসাব নিও।’
মনে কুচিন্তা আসলে করনীয়—
﴿وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ ۚ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
২০০) যদি কখনো শয়তান তোমাকে উত্তেজিত করে তাহলে আল্লাহর আশ্রয় চাও৷ তিনি সবকিছু শোনেন এবং জানেন৷
﴿إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُم مُّبْصِرُونَ﴾
২০১) প্রকৃতপক্ষে যারা মুক্তাকী, তাদেরকে যদি কখনো শয়তানের প্রভাবে অসৎ চিন্তা স্পর্শও করে যায় তাহলে তারা তখনই সতর্ক হয়ে উঠে তারপর তারা নিজেদের সঠিক কর্মপদ্ধতি পরিষ্কার দেখতে পায়৷আরাফঃ ২০০-২০১
﴿وَقُل رَّبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ هَمَزَاتِ الشَّيَاطِينِ
﴿وَأَعُوذُ بِكَ رَبِّ أَن يَحْضُرُونِ﴾
৯৭) আর দোয়া করো, ‘‘হে আমার রব! আমি শয়তানদের উস্কানি থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷
৯৮) এমনকি হে ! পরওয়ারদিগার, সে আমার কাছে আসুক এ থেকেও তো আমি তোমার আশ্রয় চাই” ৷মুমিনুনঃ ৯৭-৯৮
ওয়া না’উযুবিল্লাহি মিন শুরুরি আনফুসিনা ওয়া মিন সায়্যি আতি আ’মালিনা।
আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি আমাদের অন্তরের অনিষ্ট থেকে ও আমাদের কাজের অনিষ্ট থেকে। (রাসূল সা এর খুতবাতুল হাজাহ)
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ কোন সময় তোমার অন্তরে আল্লাহ তাআলা ও ইসলাম সম্পর্কে শয়তানী কুমন্ত্রণা দেখা দিলে (هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ) আয়াতখানি আস্তে পাঠ করে নাও। [আবু দাউদ: ৫১১০]
২:২৮৫ اٰمَنَ الرَّسُوۡلُ بِمَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡهِ مِنۡ رَّبِّهٖ وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ؕ کُلٌّ اٰمَنَ بِاللّٰهِ وَ مَلٰٓئِکَتِهٖ وَ کُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ ۟ لَا نُفَرِّقُ بَیۡنَ اَحَدٍ مِّنۡ رُّسُلِهٖ ۟ وَ قَالُوۡا سَمِعۡنَا وَ اَطَعۡنَا ٭۫ غُفۡرَانَکَ رَبَّنَا وَ اِلَیۡکَ الۡمَصِیۡرُ
২৮৫. রাসূল তার প্রভুর পক্ষ থেকে যা তার কাছে নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছেন এবং মুমিনগণও। প্রত্যেকেই ঈমান এনেছে আল্লাহর উপর, তার ফেরেশতাগণ, তার কিতাবসমূহ এবং তার রাসূলগণের উপর। আমরা তাঁর রাসূলগনের কারও মধ্যে তারতম্য করি না। আর তারা বলেঃ আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। হে আমাদের রব। আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনার দিকেই প্রত্যাবর্তনস্থল।
এই আয়াতে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, যার উপর ঈমানদারদেরকে ঈমান আনতে বলা হয়েছে। এর পরের {لاَ يُكَلِّفُ اللهُ} আয়াতে আল্লাহর রহমত, তাঁর দয়া এবং তাঁর অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তিনি মানুষকে তার সাধ্যাতীত কোন কাজের ভার দেন না। হাদীসে এই শেষ দুটি আয়াতের অনেক ফযীলতের কথা এসেছে।
নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি সূরা বাক্বারার শেষের দু’টি আয়াত রাতে পড়ে নেয়, তার জন্য এই আয়াত দু’টিই যথেষ্ট হয়ে যায়।’’ (বুখারী, ইবনে কাসীর) অর্থাৎ, এই আমলের কারণে মহান আল্লাহ তার হেফাযত করবেন।
অপর একটি হাদীসে এসেছে, নবী করীম (সাঃ) মিরাজের রাতে যে তিনটি জিনিস পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল, সূরা বাক্বারার শেষের এই দু’টি আয়াত। (সহীহ মুসলিম)
সহীহ মুসলিম শরীফে রয়েছে যে, যখন রাসুলুল্লাহ (সঃ)-কে। মিরাজে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তিনি সপ্তম আকাশে অবস্থিত সিদরাতুল মুনতাহায় পৌছেন,যে জিনিস আকাশের দিকে উঠে যায় তা এই স্থান পর্যন্ত পৌছে থাকে ও এখান হতেই নিয়ে নেয়া হয় এবং যে জিনিস উপর থেকে নেমে আসে ওটাও এখন পর্যন্তই পৌছে থাকে। অতঃপর এখান হতেই নিয়ে নেয়া হয়।
ঐ স্থানটিকে সোনার ফড়িং ঢেকে রেখেছিল। তথায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে তিনটি জিনিস দেয়া হয়-(১) পাঁচ ওয়াক্ত নামায। (২) সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত এবং (৩) একত্ববাদীদের সমস্ত পাপের ক্ষমা। মুসনাদ -ই-আহমাদের মধ্যে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উকবা বিন আমির (রাঃ)-কে বলেনঃ সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করতে থাকবে।
অনেক বর্ণনায় এ কথাও এসেছে যে, এই সূরার শেষের আয়াত দু’টি রসূল (সাঃ)-কে আরশের নীচের একটি ভান্ডার থেকে দেওয়া হয় এবং এই আয়াত কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়, অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। (আহমদ, নাসায়ী, ত্বাবারানী, বায়হাক্বী, হাকেম এবং দারেমী ইত্যাদি।) মুআয (রাঃ) এই সূরা শেষ করে ‘আমীন’ বলতেন।’’ (ইবনে কাসীর)
বিশ্ব নবী (সাঃ) একদিন বললেন, “এই মাত্র আকাশের একটি দরজা খোলা হয়েছে
এর আগে কখনও এ দরজাটি খোলা হয়নি, এ দরজা দিয়ে একজন ফেরেশতা অবতরণ করছেন। এর আগে তিনি কখনও পৃথিবীতে অবতরণ করেননি। এ ফেরেশতা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে সালাম করে বলেন, সুসংবাদ গ্রহণ করুন আপাদমস্তক দুটি নূরের, যা আপনার আগে কোন নবীকে দেয়া হয়নি
১. ফাতেহাতুন কিতাব অর্থাৎ সুরা ফাতেহা এবং
২. সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত।
উভয় আয়াতে দোয়া আছে। আল্লাহর উসিলা করে,আপনি এসব দোয়ার যে অংশই পাঠ করবেন আল্লাহ আপনাকে অবশ্যই রহমত দান করবেন, (অর্থাত কবুল করা হবে)।সহীহ মুসলিম।
বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এই আয়াতে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মপদ্ধতির সংক্ষিপ্তসার বর্ণনা করা হয়েছে৷ এই সংক্ষিপ্তসার হচ্ছেঃ আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদেরকে ও তার কিতাবসমূহকে মেনে নেয়া,তাঁর রসূলদের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য সূচিত না করে (অর্থা কাউকে মেনে নেয়া আর কাউকে না মেনে নেয়া) তাঁদেরকে স্বীকার করে নেয়া এবং সবেশেষে আমাদের তাঁর সামনে হাজির হতে হবে এ বিষয়টি স্বীকার করে নেয়া৷ এ পাঁচটি বিষয় ইসলামের বুনিয়াদী আকীদার অন্তরভূক্ত৷ এই আকীদাগুলো মেনে নেয়ার পর একজন মুসলমানের জন্য নিম্নোক্ত কর্মপদ্ধিতই সঠিক হতে পারেঃ আল্লাহর পক্ষ থেকে যে নির্দেশগুলো আসবে সেগুলোকে সে মাথা পেতে গ্রহণ করে নেবে, সেগুলোর আনুগত্য করবে এবং নিজের ভালো কাজের জন্য অহংকার করে বেড়াবে না বরং আল্লাহর কাছে অবনত হতে ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকবে৷
’উমার ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি আমাদের নিকট আত্মপ্রকাশ করলেন। ধবধবে সাদা তাঁর পোশাক। চুল তাঁর কুচকুচে কালো। না ছিল তাঁর মধ্যে সফর করে আসার কোন চিহ্ন, আর না আমাদের কেউ তাকে চিনতে পেরেছেন। তিনি এসেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসে পড়লেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাঁটুর সাথে তাঁর হাঁটু মিলিয়ে দিলেন। তাঁর দু’হাত তাঁর দুই উরুর উপর রেখে বললেন, হে মুহাম্মাদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু বলুন, অর্থাৎ- ইসলাম কি? উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’ইসলাম হচ্ছে- তুমি সাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত আর কোন ইলাহ (উপাস্য) নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রসূল, সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) ক্বায়িম করবে, যাকাত আদায় করবে, রমাযান মাসের সিয়াম পালন করবে এবং বায়তুল্লাহর হাজ্জ (হজ/হজ্জ) করবে যদি সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে।’ আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন।’’ আমরা আশ্চর্যান্বিত হলাম একদিকে তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে (অজ্ঞের ন্যায়) প্রশ্ন করলেন, আবার অপরদিকে রসূলের বক্তব্যকে (বিজ্ঞের ন্যায়) সঠিক বলে সমর্থনও করলেন।
এরপর তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ’’আমাকে ঈমান সম্পর্কে কিছু বলুন।’’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তর দিলেন, ঈমান হচ্ছেঃ আল্লাহ তা’আলা, তাঁর মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ), তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রসূলগণ এবং পরকালকে সত্য বলে বিশ্বাস করা। এছাড়া তাক্বদীরের উপর, অর্থাৎ- জীবন ও জগতে কল্যাণ-অকল্যাণ যা কিছু ঘটছে, সবই আল্লাহর ইচ্ছায় হচ্ছে- এ কথার উপর বিশ্বাস করা। উত্তর শুনে আগন্তুক বললেন, ’’আপনি ঠিকই বলেছেন’’।
অতঃপর তিনি আবার বললেন, ’’আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।’’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ইহসান হচ্ছে, ’’তুমি এমনভাবে আল্লাহর ’ইবাদাত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছো। আর তুমি যদি তাকে না-ও দেখো, তিনি তোমাকে অবশ্যই দেখছেন’’।
আগন্তুক এবার বললেন, ’’আমাকে ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) সম্পর্কে বলুন।’’ উত্তরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’এ বিষয়ে যাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে তিনি প্রশ্নকারীর চাইতে অধিক কিছু জানেন না।’’ আগন্তুক বললেন, ’’তবে কিয়ামতের (কিয়ামতের) নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে বলুন।’’ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’কিয়ামতের (কিয়ামতের) নিদর্শন হলো, দাসী তাঁর আপন মুনীবকে প্রসব করবে, তুমি আরো দেখতে পাবে- নগ্নপায়ী বিবস্ত্র হতদরিদ্র মেষ চালকেরা বড় বড় দালান-কোঠা নিয়ে গর্ব ও অহংকার করবে।’’ ’উমার (রাঃ) বললেন, অতঃপর আগন্তুক চলে গেলে আমি কিছুক্ষণ সেখানেই অবস্থান করলাম। পরে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে বললেন, হে ’উমার! প্রশ্নকারী আগন্তুককে চিনতে পেরেছো?’’ আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, ’’ইনি হচ্ছেন জিবরীল (আঃ)। তিনি তোমাদেরকে তোমাদের দীন শিক্ষা দেবার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন’। (মুসলিম
সহীহ : মুসলিম ৮, আবূ দাঊদ ৪৬৯৫, নাসায়ী ৪৯৯০, সহীহ আত্ তারগীব ৩৫১, আহমাদ ৩৬৭।
মহান আল্লাহ বলেন,
قُولُواْ آمَنَّا بِاللهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالأسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ-
‘তোমরা বল, আমরা ঈমান রাখি আল্লাহর প্রতি এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং যা ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব এবং তাদের বংশধরের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল এবং মূসা ও ঈসা-কে যা প্রাদান করা হয়েছিল এবং অন্যান্য নবীগণকে তাদের প্রভু হ’তে যা দেয়া হয়েছিল। আমরা তাদের কারো মধ্যে পার্থক্য করি না এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৩৬)।
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا فَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُوْنَ ‘যারা বলে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ এবং এই বিশ্বাসে অবিচল থাকে, তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না’ (আহক্বাফ ৪৬/১৩)।
২:২৮৬ لَا یُکَلِّفُ اللّٰهُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَهَا ؕ لَهَا مَا کَسَبَتۡ وَ عَلَیۡهَا مَا اکۡتَسَبَتۡ ؕ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذۡنَاۤ اِنۡ نَّسِیۡنَاۤ اَوۡ اَخۡطَاۡنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تَحۡمِلۡ عَلَیۡنَاۤ اِصۡرًا کَمَا حَمَلۡتَهٗ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِنَا ۚ رَبَّنَا وَ لَا تُحَمِّلۡنَا مَا لَا طَاقَۃَ لَنَا بِهٖ ۚ وَ اعۡفُ عَنَّا ٝ وَ اغۡفِرۡ لَنَا ٝ وَ ارۡحَمۡنَا ٝ اَنۡتَ مَوۡلٰىنَا فَانۡصُرۡنَا عَلَی الۡقَوۡمِ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿
২৮৬. আল্লাহ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না যা তার সাধ্যাতীত। সে ভাল যা উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই, আর মন্দ যা কামাই করে তার প্রতিফল তার উপরই বার্তায়। হে আমাদের রব! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের উপর তেমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না যার সামর্থ আমাদের নেই। আর আপনি আমাদের পাপ মোচন করুন, আমাদের ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনিই আমাদের অভিভাবক। অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন।
আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদেরকে একটি বিশেষ দো’আ শিক্ষা দিয়েছেন। যাতে ভুল-ভ্রান্তিবশতঃ কোন কাজ হয়ে যাওয়ার পর ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং পূর্ববর্তী উম্মতদের মত শাস্তিও যেন এ উম্মতের উপর না আসে, তার জন্য বিশেষভাবে দো’আ করতে বলা হয়েছে।
. অর্থাৎ আল্লাহর কাছে মানুষের সামর্থ অনুযায়ী তার দায়িত্ব বিবেচিত হয়৷ মানুষ কোন কাজ করার ক্ষমতা রাখে না অথচ আল্লাহ তাকে সে কাজটি না করার জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, এমনটি কখনো হবে না৷ অথবা প্রকৃতপক্ষে কোন কাজ বা জিনিস থেকে দূরে থাকার সামর্থই মানুষের ছিল না, সে ক্ষেত্রে তাতে জড়িত হয়ে পড়ার জন্য আল্লাহর কাছে তাকে জবাবদিহি করতে হবে না ৷ কিন্তু এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, নিজের শক্তি-সামর্থ আছে কিনা, এ সম্পর্কে মানুষ নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না৷ প্রকৃতপক্ষে মানুষের কিসের শক্তি-সামর্থ ছিল আর কিসের ছিল না- এ সিদ্ধান্ত একমাত্র আল্লাহ গ্রহণ করতে পারেন৷
৩৩৯ . এটি আল্লাহ প্রদত্ত মানবিক ইখতিয়ার বিধির দ্বিতীয় মূলনীতি৷ প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে যে কাজ করেছে তার পুরস্কার পাবে৷ একজনের কাজের পুরস্কার অন্যজন পাবে, এটা কখনো সম্ভব নয়৷ অনুরূপভাবে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজে যে দোষ করেছে সে জন্য পাকড়াও হবে৷ একজন দোষ করবে আর অন্যজন পাকাড়ও হবে, এটা কখনো সম্ভব নয়৷ তবে এটা সম্ভব, এক ব্যক্তি কোন সৎকাজের ভিত্তি রাখলো এবং দুনিয়ায় হাজার বছর পর্যন্ত তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত থাকলো, এ ক্ষেত্রে এগুলো সব তার আমলনামায় লেখা হবে৷ আবার অন্য এক ব্যক্তি কোন খারাপ কাজের ভিত্তি রাখলো এবং শত শত বছর পর্যন্ত দুনিয়ায় তার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত থাকলো৷ এ অবস্থায় এ গুলোর গোনাহ ঐ প্রথম জালেমের আমলনামায় লেখা হবে৷ তবে এ ক্ষেত্রে ভালো বা মন্দ যা কিছু ফল হবে সবই হবে মানুষের প্রচেষ্টা ও সাধনার ফলশ্রুতি৷ মোটকথা যে ভালো বা মন্দ কাজে মানুষের নিজের ইচ্ছা, সংকল্প, প্রচেষ্টা ও সাধনার কোন অংশই নেই,তার শাস্তি বা পুরস্কার সে পাবে, এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয়৷ কর্মফল হস্তান্তর হওয়ার মতো জিনিস নয়৷
৩৪০ . অর্থাৎ আমাদের পূর্ববর্তীরা তোমার পথে চলতে গিয়ে যেসব পরীক্ষা, ভয়াবহ বিপদ, দুঃখ-দুর্দশা ও সংকটের সম্মুখীন হয়, তার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো৷ যদিও আল্লাহর রীতি হচ্ছে, যে ব্যক্তি সত্য ও ন্যায়ের অনুসরণ করার সংকল্প করেছে, তাকেই তিনি কঠিন পরীক্ষা ও সংকটের সাগরে নিক্ষেপ করেছেন এবং পরীক্ষার সম্মুখীন হলে মু’মিনের কাজই হচ্ছে,পূর্ণ ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে তার মোকাবিলা করা, তবুও মু’মিনকে আল্লাহর কাছে এই দোয়াই করতে হবে যে, তিনি যেন তার জন্য সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা সহজ করে দেন৷
৩৪১ . অর্থাৎ সমস্যা ও সংকটের এমন বোঝা আমাদের ওপর চাপাও, যা বহন করার ক্ষমতা আমাদের আছে৷ যে পরীক্ষায় পুরোপুরি উত্তীর্ণ হবার ক্ষমতা আমাদের আয়ত্বাধীন তেমনি পরীক্ষায় আমাদের নিক্ষেপ করো৷ আমাদের সহ্য ক্ষমতার বেশী দুঃখ-কষ্ট-বিপদ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ো না৷ তাহলে আমরা সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবো৷
. এই দোয়াটির পূর্ণ প্রাণসত্তা অনুধাবন করার জন্য এর নিম্নোক্ত প্রেক্ষাপটটি সামনে রাখতে হবে৷
হিজরতের প্রায় এক বছর আগে মি’রাজের সময় এ আয়াতটি নাযিল হয়েছিল ৷ তখন মক্কায় ইসলাম ও কুফরের লড়াই চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল৷ মুসলমানদের মাথায় বিপদ ও সংকটের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছিল ৷ কেবল মক্কাতেই নয়, আরব ভূ-খন্ডের কোথাও এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে কোন ব্যক্তি দীন ইসলাম গ্রহন করেছিল এবং তার জন্য আল্লাহর যমীনে, বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েনি৷ এ অবস্থায় মুসলমানদের আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হলো ৷ দানকারী নিজেই যখন চাওয়ার পদ্ধতি বাতলে দেন তখন তা পাওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায়৷ তাই এই দোয়া সেদিন মুসলমানদের জন্য অসাধারণ মানসিক নিশ্চন্ততার কারণ হয়৷ এ ছাড়াও এই দোয়ায় পরোক্ষভাবে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়, নিজেদের আবেগ অনুভূতিকে কখনো অসংগত ও অনুপযোগী ধারায় প্রবাহিত করো না বরং সেগুলোকে এই দোয়ার ছাঁচে ঢালাই করো ৷
একদিকে নিছক সত্যানুসারিতা ও সত্যের প্রতি সমর্থন দানের কারণে লোকদের ওপর যেসব হৃদয় বিদারক জুলুম নির্যাতন চালানো হচ্ছিল সেগুলো দেখুন এবং অন্যদিকে এই দোয়াগুলো দেখুন, যাতে শক্রদের বিরুদ্ধে সামান্য তিক্ততার নামগন্ধও নেই ৷ একদিকে এই সত্যানুসারীরা যেসব শারীরিক দুর্ভোগ ও আর্থিক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছিল সেগুলো দেখুন এবং অন্যদিকে এই দোয়াগুলো দেখুন, যাতে পার্থিব স্বার্থের সামান্য প্রত্যাশাও নেই,
একদিকে সত্যানুসারীদের চরম দুরবস্থা দেখুন এবং অন্যদিকে এই দোয়ায় উৎসারিত উন্নত ও পবিত্র আবেগ –উদ্দীপনা দেখুন ৷ এই তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই সে সময় ঈমানদারদের কোন্ ধরনের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অনুশীলন দেয়া হচ্ছিল, তা সঠিক ও নির্ভলভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হবে৷