সুরা বাকারাঃ ৩৯তম রুকু (২৮২-২৮৩)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:২৮২ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا تَدَایَنۡتُمۡ بِدَیۡنٍ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی فَاکۡتُبُوۡهُ ؕ وَ لۡیَکۡتُبۡ بَّیۡنَکُمۡ کَاتِبٌۢ بِالۡعَدۡلِ ۪ وَ لَا یَاۡبَ کَاتِبٌ اَنۡ یَّکۡتُبَ کَمَا عَلَّمَهُ اللّٰهُ فَلۡیَکۡتُبۡ ۚ وَ لۡیُمۡلِلِ الَّذِیۡ عَلَیۡهِ الۡحَقُّ وَ لۡیَتَّقِ اللّٰهَ رَبَّهٗ وَ لَا یَبۡخَسۡ مِنۡهُ شَیۡئًا ؕ فَاِنۡ کَانَ الَّذِیۡ عَلَیۡهِ الۡحَقُّ سَفِیۡهًا اَوۡ ضَعِیۡفًا اَوۡ لَا یَسۡتَطِیۡعُ اَنۡ یُّمِلَّ هُوَ فَلۡیُمۡلِلۡ وَلِیُّهٗ بِالۡعَدۡلِ ؕ وَ اسۡتَشۡهِدُوۡا شَهِیۡدَیۡنِ مِنۡ رِّجَالِکُمۡ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یَکُوۡنَا رَجُلَیۡنِ فَرَجُلٌ وَّ امۡرَاَتٰنِ مِمَّنۡ تَرۡضَوۡنَ مِنَ الشُّهَدَآءِ اَنۡ تَضِلَّ اِحۡدٰىهُمَا فَتُذَکِّرَ اِحۡدٰىهُمَا الۡاُخۡرٰی ؕ وَ لَا یَاۡبَ الشُّهَدَآءُ اِذَا مَا دُعُوۡا ؕ وَ لَا تَسۡـَٔمُوۡۤا اَنۡ تَکۡتُبُوۡهُ صَغِیۡرًا اَوۡ کَبِیۡرًا اِلٰۤی اَجَلِهٖ ؕ ذٰلِکُمۡ اَقۡسَطُ عِنۡدَ اللّٰهِ وَ اَقۡوَمُ لِلشَّهَادَۃِ وَ اَدۡنٰۤی اَلَّا تَرۡتَابُوۡۤا اِلَّاۤ اَنۡ تَکُوۡنَ تِجَارَۃً حَاضِرَۃً تُدِیۡرُوۡنَهَا بَیۡنَکُمۡ فَلَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ اَلَّا تَکۡتُبُوۡهَا ؕ وَ اَشۡهِدُوۡۤا اِذَا تَبَایَعۡتُمۡ ۪ وَ لَا یُضَآرَّ کَاتِبٌ وَّ لَا شَهِیۡدٌ ۬ؕ وَ اِنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاِنَّهٗ فُسُوۡقٌۢ بِکُمۡ ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ ؕ وَ یُعَلِّمُکُمُ اللّٰهُ ؕ وَ اللّٰهُ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ
(২৮২) হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য পরস্পর ঋণ দেওয়া-নেওয়া কর, তখন তা লিখে নাও। আর তোমাদের মধ্যে কোন লেখক যেন ন্যায়ভাবে তা লিখে দেয় এবং আল্লাহ যেরূপ শিক্ষা দিয়েছেন –সেইরূপ লিখতে কোন লেখক যেন অস্বীকার না করে। অতএব তার লিখে দেওয়াই উচিত। আর ঋণগ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দিয়ে লিখিয়ে নেয় এবং সে যেন স্বীয় প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্র কম-বেশী না করে। অনন্তর ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ হয় কিংবা দুর্বল হয় অথবা নিজে লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে অক্ষম হয়, তাহলে তার অভিভাবক যেন ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লেখায়। আর তোমাদের মধ্যে দু’জন পুরুষকে (এই আদান-প্রদানের) সাক্ষী কর। যদি দু’জন পুরুষ না পাও, তাহলে সাক্ষীদের মধ্যে যাদেরকে তোমরা পছন্দ কর তাদের মধ্য হতে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলাকে সাক্ষী কর; যাতে মহিলাদ্বয়ের একজন ভুলে গেলে যেন অন্য জন তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আর যখন (সাক্ষ্য দিতে) ডাকা হয়, তখন যেন সাক্ষীরা অস্বীকার না করে। (ঋণ) ছোট হোক, বড় হোক, তোমরা মেয়াদসহ লিখতে কোনরূপ অলসতা করো না। এ লেখা আল্লাহর নিকট ন্যায্যতর ও সাক্ষ্য (প্রমাণের) জন্য দৃঢ়তর এবং তোমাদের মধ্যে সন্দেহ উদ্রেক না হওয়ার অধিক নিকটতর। কিন্তু তোমরা পরস্পরে ব্যবসায় যে নগদ আদান-প্রদান কর, তা না লিখলে কোন দোষ নেই। তোমরা যখন পরস্পর বেচা-কেনা কর, তখন সাক্ষী রাখ। আর কোন লেখক যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং না কোন সাক্ষী। যদি তোমরা তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত কর, তাহলে তা হবে তোমাদের পক্ষে পাপের বিষয়। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তোমাদেরকে শিক্ষা দেন। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে মহাজ্ঞান
যে সমাজে সূদী কার্যকলাপকে কঠোরভাবে নিষেধ করে সাদাকা-খয়রাত করার প্রতি তাকীদ করা হয়েছে, সেই সমাজে ঋণ করার প্রয়োজন পড়ে বেশী। কারণ সূদ তো হারাম এবং সব মানুষ সাদাকা-খয়রাত করার সামর্থ্য রাখে না। তাছাড়া সব লোক সাদাকা নিতে পছন্দও করে না। সুতরাং স্বীয় প্রয়োজন পূরণ করার জন্য উপায় এখন ঋণ আদান-প্রদান করা। আর এই কারণেই ঋণ দেওয়া যে বড় ফযীলতের কাজ, সে কথা বহু হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। তবে ঋণ যেহেতু অতীব প্রয়োজনীয় জিনিস, তাই এর প্রতি গুরুত্ব না দিলে অথবা এ ব্যাপারে অলসতা করলে, তা কলহ-বিবাদের কারণও হতে পারে। তাই এই আয়াতে –যাকে ‘আয়াতুদ দাইন’ বলা হয় এবং যেটা কুরআনের মধ্যে সব থেকে লম্বা আয়াত -তাতে মহান আল্লাহ ঋণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দান করেছেন। যাতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনটি কলহ-বিবাদের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই এ ব্যাপারে একটি নির্দেশ হল, মেয়াদ নির্দিষ্ট করে নাও। দ্বিতীয় নির্দেশ, এটা লিখে নাও এবং তৃতীয় নির্দেশ হল, এর উপর দু’জন মুসলিম পুরুষকে অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলাকে সাক্ষী বানিয়ে নাও।
আলোচ্য আয়াতসমূহে লেন-দেন সম্পর্কিত আইনের জরুরী মূলনীতি ব্যক্ত হয়েছে। যাকে চুক্তিনামাও বলা যেতে পারে। এরপর সাক্ষ্য-বিধির বিশেষ ধারা উল্লেখিত হয়েছে। আজকাল লেখালেখির যুগ। লেখাই মুখের কথার স্থলাভিষিক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি চৌদ্দ শ’ বছর পূর্বের দিকে তাকিয়ে দেখুন। তখন দুনিয়ার সব কাজকারবার ও ব্যবসা-বাণিজ্য মুখে মুখেই চলত। লেখালেখি এবং দলীল-দস্তাবেজের প্রথা প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম কুরআনুল কারীম এদিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বলা হয়েছে “তোমরা যখন পরস্পর নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ধার-কর্জের কারবার কর, তখন তা লিখে নাও”। এতে প্রথম নীতি এই যে, ধার-কর্জের লেনদেনে দলীল-দস্তাবেজ লিপিবদ্ধ করা উচিত – যাতে ভুল-ভ্রান্তি অথবা কোন পক্ষ থেকে অস্বীকৃতির কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তখন কাজে লাগে।
দ্বিতীয়তঃ ধার-কর্জের ব্যাপারে মেয়াদ অবশ্যই নির্দিষ্ট করতে হবে। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধার-কর্জের লেন-দেন জায়েয নয়। এতে কলহ-বিবাদের দ্বার উন্মুক্ত হয়। এ কারণেই ফেকাহবিদগণ বলেছেনঃ মেয়াদও এমন নির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে কোনরূপ অস্পষ্টতা না থাকে। মাস এবং দিন তারিখসহ নির্দিষ্ট করতে হবে। কোনরূপ অস্পষ্ট মেয়াদ, যেমন “ধান কাটার সময়”- এরূপ নির্ধাতির করা যাবে না। কেননা, আবহাওয়ার পরিবর্তনে ধান কাটার সময় আগে-পিছে হয়ে যেতে পারে। [মাআরিফুল কুরআন]
(২) অর্থাৎ এটা জরুরী যে, তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখবে। এতে একদিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, লেখক কোন এক পক্ষের লোক হতে পারবে না; বরং নিরপেক্ষ হতে হবে – যাতে কারো মনে সন্দেহ-সংশয় না থাকে। অপরদিকে লেখককে ন্যায়সঙ্গতভাবে লিখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যের ক্ষণস্থায়ী উপকার করে নিজের চিরস্থায়ী ক্ষতি করা তার পক্ষে উচিত হবে না। এরপর লেখককে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তাকে এ লেখার বিদ্যা দান করেছেন। এর কৃতজ্ঞতা এই যে, সে লিখতে অস্বীকার করবে না। [মা’আরিফুল কুরআন]
(৩) এরপর দলীল কোন পক্ষ থেকে লিখতে হবে সে সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ যার দায়িত্বে দেনা, সে লেখাবে। উদাহরণতঃ এক ব্যক্তি সওদা কিনে মূল্য বাকী রাখল। এখানে যার দায়িত্বে দেনা হচ্ছে, সে দলীলের বিষয়বস্তু লেখাবে। কেননা, এটা হবে তার পক্ষ থেকে স্বীকৃতি বা অঙ্গীকারপত্র।
(৪) লেন-দেনের ব্যাপারে দেনাদার ব্যক্তি কখনো নির্বোধ বা অক্ষম, বৃদ্ধ, অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক, মুক অথবা অন্য ভাষাভাষী হতে পারে। এ কারণে দলীলের বিষয়বস্তু বলে দেয়া তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। তাই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তার পক্ষ থেকে তার কোন অভিভাবক লেখাবে। পাগল ও নাবালেগের তো অভিভাবক থাকেই। তাদের সব কাজ-কারবার অভিভাবক দ্বারাই সম্পন্ন হয়। মুক ও অন্য ভাষাভাষীর অভিভাবকও এ কাজ সম্পন্ন করতে পারে। যদি তারা কাউকে উকিল নিযুক্ত করে, তাতেও চলবে। এখানে কুরআনুল কারীমের ‘ওলী’ শব্দটি উভয় অর্থই বোঝায়
(৫) এখানে বলা হয়েছে যে, দলীলের লেখাকেই যথেষ্ট মনে করবে না; বরং এতে সাক্ষ্যও রাখবে -যাতে কোন সময় পারস্পরিক কলহ দেখা দিলে আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য দ্বারা ফয়সালা হতে পারে। এ কারণেই ফেকাহবিদগণ বলেছেন যে, লেখা শরীআতসম্মত প্রমাণ নয়, তাই লেখার সমর্থনে শরীআতসম্মত সাক্ষ্য বিদ্যমান না থাকলে শুধু লেখার উপর ভিত্তি করে ফয়সালা করা যায় না। আজকালকার সাধারণ আদালতসমূহেও এ রীতিই প্রচলিত রয়েছে। লেখার মৌখিক সত্যায়ন ও তৎসমর্থনে সাক্ষ্য ব্যতীত কোন ফয়সালা করা হয় না। আয়াতে এরপর সাক্ষ্য-বিধির কতিপয় জরুরী নীতি বর্ণনা করা হয়েছে।
উদাহরণতঃ (১) সাক্ষী দু’জন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা হওয়া জরুরী। একা একজন পুরুষ অথবা শুধু দু’জন মহিলা সাধারণ লেন-দেনের সাক্ষ্যের জন্য যথেষ্ট নয়। অনুরূপভাবে (২) সাক্ষী মুসলিম হতে হবে। (مِنْ رِجَالِكُمْ) শব্দে এদিকেই নির্দেশ করা হয়েছে। (৩) সাক্ষী নির্ভরযোগ্য আদিল’ (বিশ্বস্ত) হতে হবে, যার কথার উপর আস্থা রাখা যায়। ফাসেক ও ফাজের (অর্থাৎ পাপাচারী) হলে চলবে না। (مِمَّنْ تَرْضَوْنَ مِنَ الشُّهَدَاءِ) বাক্যে এ নির্দেশ রয়েছে।
প্রশ্নঃ দুজন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান কেন ?
————————————————–
উত্তরঃ ডাঃ জাকির নায়েক
————————
দুজন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সমান এটা সব ক্ষেত্রে সঠিক নয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা সঠিক। আল-কোরআনের কমপক্ষে ৫ টি আয়াতে নারী-পুরুষ কারো উল্লেখ ব্যতীত সাক্ষ্যদান সংক্রান্ত আলোচোনা এসেছে। তার মধ্যে একটি মাত্র আয়াত এ বলা হয়েছে যে, একজন পুরষের সাক্ষ্য দুজন নারীর সমান। আর তা হলো ২নং সূরা আল-বাকারার ২৮২ নং আয়াত। এটা কোরানের দীর্ঘতম আয়াত। এতে অর্থৈনতিক লেনদেন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে,
“ও যারা ঈমান এনেছ! তোমরা যখন নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের লেনদেন কর, তখন তা লিখে রেখো; তোমাদের মধ্যে কোনো লোক যেন ন্য্যসংগতভাবে লিখে দেয়। লেখক যেন লিখতে অস্বীকার না করে, যেহেতু আল্লাহ তাকে লেখতে শিখিয়েছেন; সুতরাং সে যেন লিখে দেয়। আর ঋণগ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দেয় এবং তার প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করে আর তাতে যেন বিন্দুমাত্র কম না কড়ে। কিন্তু ঋণগ্রহীতা যদি নির্বোধ হয় অথবা দুর্বল হয় অথবা লেখার বিষয়বস্তু বলে দিতে না পারে, তবে যেন অভিভাবক লেখার বিষয়বস্তু ন্যায়সঙ্গতভাবে বলে দেয়। আর দু’জন সাক্ষী রাখবে তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে তবে যদি দু’জন পুরুষ না পাওয়া যায়, তবে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলা ঐ সাক্ষীদের মধ্য থেকে যাদের তোমরা পছন্দ কর; কারন তাদের একজন ভুল করলে অপরজন তা ঠিক করে দেবে”।
কুরআন মাজীদের উল্লেখিত আয়াতে অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে একটি লিখিত চুক্তি করার জন্য দু’ পক্ষকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং দু’জন সাক্ষী রাখার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। এতে সাক্ষী দু’জন পুরুষ হওয়াকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যদি দু’জন পুরুষ না পাওায়া যায়, তাহলে একজন পুরুষ ও দু’জন নারী সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।
ইসলামে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দু’জন পুরুষের সাক্ষ্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে কারন ইসলাম আশা করে যে, পুরুষরাই পরিবারের ভরণ পোষণের দায়-দায়িত্ব বহন করবে। যেহেতু অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব পুরুষরাই বহন করে থাকে। তাছারা অর্থনৈতিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে নারীদের তুলনায় পুরুষরাই অধিক দক্ষ। এটাই আশা করা হয়ে থাকে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলাকে সাক্ষী হিসাবে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। যাতে নারীদের একজন যদি ভুল করে অন্যজন তা স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।
কোরআনে এক্ষেত্রে “তাদিল্ল” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ তাল “পাকিয়ে ফেলা” বা “ভুল করা”।
অনেকে এ শব্দের ভুল অর্থ করে যে, এর অর্থ ভুলে যাওয়া। তাই একমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রেই একজন পুরষের সাক্ষীকে দু’জন নারীর সাক্ষীর সমতুল্য করা হয়েছে।
যা হোক ইসলামি আইনে কতেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, হত্যা মামলায় সাক্ষীদানের ক্ষেত্রেও নারীসুলভ দুর্বলতা প্রভাব ফেলতে পারে। নারীরা তাদের আবেগ প্রবণতার জন্য হত্যা মামলায় সংশয়িত হয়ে যেতে পারে। এজন্য ইসলামী আইনে হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দানের ক্ষেত্রে একজন পুরুষের সমান দু’জন নারী রায় দিয়েছেন। এছারা অন্য সকল মামলায় একজন পুরুষের সাক্ষ্য একজন নারীর সমান।
কোরআন মাজীদের যে সকল স্থানে পুরষ নারী – কোনটা উল্লেখ না করে সাক্ষ্য দানের বিষয় আলচিত হয়েছে তা নিন্মে উল্লেখ করা হোল…
উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে উইল প্রস্তত কালে দু’জন ন্যয়বান ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখা আবশ্যক।
৫নং সূরা আল-মায়িদার ১০৬নং আয়াতে বলা হয়েছে,
“তোমারা যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের মধ্যে যখন কোনো ব্যক্তির মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন তোমাদের অসিয়ত করার সময় তোমাদের মধ্যে থেকে দু’জন ন্যয়পরায়ণ লোককে সাক্ষী রাখবে। তোমরা সফরে থাকলে এবং তোমাদের মৃত্যু বিপদ, উপস্থিত হলে তোমাদের ছাড়া অন্য লোকদের মধ্য হতে দু’জন সাক্ষী মনোনীত করবে।”
আবার কোরআনের ৬৫নং সূরা তালাকের ২নং আয়াতে বলা হয়েছে,“আর যখন তাদের ইদ্দত পূরণের কাল আসন্ন হয় তোমরা হয় যথাবিধি তাদেরকে রেখে দিবে, না হয় তাদেরকে যথাবিধি পরিত্যাগ করবে এবং তোমাদের মধ্য হতে দু’জন ন্যায়পরায়ণ লোককে সাক্ষী রাখবে, আর তোমরা আল্লাহ্র জন্য সঠিক সাক্ষ্য দিবে, এ দ্বারা তোমাদের উপদেশ দেয়া হচ্ছে”।
যৌন অপরাধের সাক্ষী সম্বন্ধে আল-কোরআনের ২৪নং সূরা নূরের ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে,
“আর যারা কোনো সতী নারীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তারপরে চারজন সাক্ষী উপস্থিত করেনা তাদেরকে আশিটি বেত্রাঘাত করবে এবং কখনো তাদের সাক্ষ্য গ্রহন করবে না। এরাই প্রকৃত ফাসিক”।
কিছু ইসলামী বিশেষজ্ঞ আলিমদের মতে, একজন পুরুষের সাক্ষ্য দু’জন নারী লোকের সমান এবং এ বিধান সর্ব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অবশ্য এ মতামত সকলে সমর্থন করেনা। কারন কোরআনের ২৪নং সূরা নূরের ৬নং আয়াতে বলা হয়ছে একজন পুরুষের সাক্ষী একজন নারীর সমান। যেমন বলা হয়েছে,
“আর যারা নিজেদের স্ত্রীদের প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং নিজেরা ছাড়া তাদের আর কোনো সাক্ষী না থাকে, তখন সে আল্লাহার নামে চারবার কসম করে বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী”
ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞদের অনেকে এ ব্যপারে একমত পোষণ করেন যে, চাঁদ দেখার ব্যাপারে একজন মুসলিম নারীর সাক্ষ্যই যথেষ্ট। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি হলো রোযা। সেই রোযার ব্যপারে একজন নারীর সাক্ষ্যই মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে রমযানের চাঁদ দেখার ব্যপারে একজন সাক্ষী আর রমযানের শেষে ঈদের চাঁদ দেখার ব্যাপারে দু’জন সাক্ষী প্রয়োজন। আর এক্ষেত্রে সাক্ষীদের পুরুষ বা নারী হওয়ার ব্যাপারে কোনো শর্ত নেই।
তাই অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সাম্যের ব্যাপারে যে ইসলামিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, তা লিঙ্গ বৈষম্যের জন্যে নয়; বরং তা সমাজে নারী পুরুষের প্রকৃতি ও ভূমিকার পার্থক্যের কারণে।
প্রশ্ন : ইসলামে দুইজন নারীর সাক্ষ্যের সমান একজন পুরুষের সাক্ষ্য। ইসলামের দৃষ্টিতে কি তাহলে নারী ও পুরুষ সমমর্যাদার নয়?
পাশ্চাত্যের নারী-পুরুষ সমতার ধারণা ভুল। অতএব, এ ধারণা থেকে চিন্তা করলে ইসলামের সমতার দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা যাবে না। চিন্তাটি করতে হবে মানুষের স্রষ্টা ও বিধাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নীতি অনুযায়ী। ইসলামে নারী ও পুরুষের মর্যাদা অবশ্যই সমান। এমনকি নানা পর্যায়ে নারীর মর্যাদা পুরুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তবে মানবজীবনে কেবল মর্যাদা দিয়ে জীবনের সবকিছু চলে না। এখানে মর্যাদা, ক্ষমতা, অধিকার ও দায়িত্ব নিয়ে মানুষে ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়। নারীর মর্যাদা ক্ষমতা ও অধিকার পুরুষের চেয়ে বেশি। কিন্তু দায়িত্ব কম। আবার নারীর একটি দায়িত্ব আছে যা শত পুরুষের দায়িত্বের চেয়ে বড় ও ভারী। এর নাম মাতৃত্ব। এটি কোনো পুরুষ পালন করতে পারবে না। মর্যাদাও এমনই। নবী করিম সা. কে এক লোক প্রশ্ন করল, হযরত আমি কার সেবা করব, নবীজী উত্তরে বললেন, ‘তোমার মায়ের’। লোকটি আবার জিজ্ঞাসা করল, এরপর কার? হযরত জবাব দিলেন, ‘তোমার মায়ের’। লোকটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করল, হে রাসূল এরপর কার? প্রিয় নবী আবারো জবাব দিলেন, ‘তোমার মায়ের;। লোকটি ফের প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসূল এরপর কার? তখন চতুর্থবারের মতো জবাব দিতে গিয়ে নবী করিম সা. বললেন, ‘তোমার বাবার’ (আল হাদিস)। এ প্রশ্নোত্তরে নারীর মর্যাদা যে পুরুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি তা কি স্পষ্ট নয়? এরপর ধরা যাক, নারীর জীবন জীবিকার কথা। পৃথিবীর সব নারী ও তাদের শিশুরা পুরুষদের কাঁধেই আমানত হয়ে আছে। এটি আল্লাহর প্রাকৃতিক বিধান। শরিয়তও প্রকৃতি অনুযায়ীই তৈরি। এরপরও নারীর মালিকানা ও নিজ অঙ্গনে কর্তৃত্ব ইসলামে স্বীকৃত। তবে, নারীর মাতৃত্ব, নারীত্ব, সতিত্ব, ঈমান ও সম্মান রক্ষার্থে তাদের সেফটির ওপর জোর দিয়েছে। পুরুষের চালচলন, জীবিকার কঠোর বোঝা, কঠিন দৈহিক শ্রম, অনিরাপদ চলাচল ইত্যাদি থেকে নারীকে দূরে রেখেছে। এটি তার প্রতি অবহেলা নয়, বরং তার বিকল্পহীন দায়িত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্যই করেছে। কেননা, মানব শিশুর জন্ম, ধারণ-লালন, সংসারের পরিচালনা, পুরুষের শান্তিময় আশ্রয় সবই নারীর কাজ। এ হিসেবে নারীকে সুখি, নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট, পবিত্র ও সুরক্ষিত রাখা ইসলামের অভিপ্রায়। তবে, নারীর মাতৃত্বের প্রয়োজনেই প্রকৃতি তাকে যে বৈশিষ্ট্য, নিয়মিত অসুস্থতা, শারীরিক গঠন, স্বভাবগত মায়াময়তা ইত্যাদি দিয়েছে, সেসব অস্বীকার করে বা বিকৃত করে পুরুষের সঙ্গে নারীর নিঃশর্ত অংশগ্রহণ ইসলামসম্মত নয়। যে জন্য নারী-পুরুষে অবাধ মেলামেশা শরিয়তে হারাম। তবে, প্রয়োজনে শরিয়তের শর্ত পালন সাপেক্ষে, পর্দা, দৃষ্টি সংযম ইত্যাদি পালন করে আর্থ-সামাজিক লেনাদেনা বৈধও রেখেছে। কেবল ইসলামী উম্মাহর ইমারত (খেলাফতের প্রধান) ও মুসলিম জামাতের ইমামত (পুরুষের জামাতের ইমামতি) ছাড়া নারী অন্য সবকিছুতেই ভ‚মিকা রাখতে পারে। এটি নারীর প্রতি অবজ্ঞা নয়, বরং মাতৃত্বের বৈশিষ্ট্যের প্রতি পরম শ্রদ্ধা। তবে, অধিক স্নেহ, নম্রতা ও কোমলতা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভীরুতা, অমনোযোগিতা, পরিবেশ জ্ঞানের স্বল্পতা দরুণ বোধের সীমাবদ্ধতার জন্য (অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া) সাধারণত নারীরা সবসময় সব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মন-মানসিকতা ধরে রাখতে পারে না। তাই, গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্ষেত্রে তাদের সাক্ষ্য দু’জন মিলে একজনের সমান করা হয়েছে। তবে, এটিও আইনগত ক্ষেত্র ছাড়া জীবনের সব ক্ষেত্রে নয়। এটি উচ্চতর প্রজ্ঞাময় মহান সৃষ্টিকর্তার সিদ্ধান্ত। প্রকৃতির ওপর মানুষের যেমন হাত নেই, অভিযোগ নেই, ঠিক তেমনই শরিয়তের ওপরও মানুষের হাত নেই, অভিযোগ নেই, থাকতে পারে না। সুতরাং ইসলামের আলোয় যখন আপনি সব বিষয় দেখবেন, তখন মনে আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না। কারণ, ইসলাম মহান সৃষ্টিকর্তার বিধান। বান্দাদের সম্পর্কে তার চেয়ে ভালো আর কে জানে। কিসে তাদের মঙ্গল, তা তিনি ছাড়া আর কে বুঝবে।
সূত্র : জামেউল ফাতাওয়া, ইসলামী ফিক্হ ও ফাতাওয়া বিশ্বকোষ।উত্তর দিয়েছেন : আল্লামা মুফতি উবায়দুর রহমান খান নদভী
(৬) আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, যখন কোন ব্যাপারে কাউকে সাক্ষী করার জন্য ডাকা হয়, তখন সে যেন আসতে অস্বীকার না করে। কেননা, সাক্ষ্যই হচ্ছে সত্য প্রতিষ্ঠিত করার এবং বিবাদ মেটানোর উপায় ও পন্থা। কাজেই একে জরুরী জাতীয় কাজ মনে করে কষ্ট স্বীকার করবে। এরপর আবার লেন-দেনের দলীল লিপিবদ্ধ করার উপর জোর দিয়ে বলা হয়েছেঃ লেন-দেন ছোট কিংবা বড় হোক – সবই লিপিবদ্ধ করা দরকার। এ ব্যাপার বিরক্তিবোধ করা উচিত নয়। কেননা, লেন-দেন লিপিবদ্ধ করা সত্য প্রতিষ্ঠিত রাখতে, নির্ভুল সাক্ষ্য দিতে এবং সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকতে চমৎকাররূপে সহযোগীতা করে। যদি নগদ লেন-দেন হয় – বাকী না হয়, তবে তা লিপিবদ্ধ না করলেও ক্ষতি নেই। তবে এ ব্যাপারেও কমপক্ষে সাক্ষী রাখা বাঞ্ছনীয়। কেননা, উভয় পক্ষের মধ্যে কোন সময় মতবিরোধ দেখা দিতে পারে। উদাহরণতঃ বিক্রেতা মূল্যপ্রাপ্তি অস্বীকার করতে পারে কিংবা ক্রেতা বলতে পারে যে, সে ক্রীতবস্তু বুঝে পায়নি। এ মতবিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য কাজে লাগবে। [মা’আরিফুল কুরআন]
(৭) আয়াতের শুরুতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন লিখতে ও সাক্ষী দিতে অস্বীকার না করে। এমতাবস্থায় তাদেরকে হয়ত মানুষ বিরক্ত করে তুলতে পারত। তাই আয়াতের শেষ ভাগে বলা হয়েছে, (وَلَا يُضَارَّ كَاتِبٌ وَلَا شَهِيدٌ) অর্থাৎ কোন লেখক বা সাক্ষীকে যেন ক্ষতিগ্রস্ত করা না হয়। নিজের উপকারের জন্য যেন তাদের বিব্রত না করা হয়। এরপর বলা হয়েছে, (وَإِنْ تَفْعَلُوا فَإِنَّهُ فُسُوقٌ بِكُمْ) অর্থাৎ তোমরা যদি লেখক বা সাক্ষীকে বিব্রত কর, তবে এতে তোমাদের গোনাহ হবে। এতে বোঝা গেল যে, লেখক কিংবা সাক্ষীকে বিব্রত বা ক্ষতিগ্রস্ত করা হারাম। এ কারণেই ফকীহগণ বলেনঃ যদি লেখক লেখার পারিশ্রমিক দাবী করে কিংবা সাক্ষী যাতায়াত খরচ চায়, তবে এটা তাদের নায্য অধিকার। তা না দেয়াও তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিব্রত করার শামিল এবং অবৈধ। ইসলাম বিচার ব্যবস্থায় যেমন সাক্ষীকে সাক্ষ্যদানে বাধ্য করেছে এবং সাক্ষ্য গোপন করাকে কঠোর অপরাধ সাব্যস্ত করেছে, তেমনি এ ব্যবস্থাও করেছে, যাতে কেউ সাক্ষ্য দেয়া থেকে গা বাঁচাতে বাধ্য না হয়।
২:২৮৩ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ عَلٰی سَفَرٍ وَّ لَمۡ تَجِدُوۡا کَاتِبًا فَرِهٰنٌ مَّقۡبُوۡضَۃٌ ؕ فَاِنۡ اَمِنَ بَعۡضُکُمۡ بَعۡضًا فَلۡیُؤَدِّ الَّذِی اؤۡتُمِنَ اَمَانَتَهٗ وَ لۡیَتَّقِ اللّٰهَ رَبَّهٗ ؕ وَ لَا تَکۡتُمُوا الشَّهَادَۃَ ؕ وَ مَنۡ یَّکۡتُمۡهَا فَاِنَّهٗۤ اٰثِمٌ قَلۡبُهٗ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ عَلِیۡمٌ
২৮৩. আর যদি তোমরা সফরে থাক এবং কোন লেখক না পাও তবে হস্তান্তরকৃত বন্ধক রাখবে। অতঃপর তোমাদের একে অপরকে বিশ্বস্ত মনে করলে, যার কাছে আমানত রাখা হয়েছে সে যেন আমানত প্রত্যার্পণ করে এবং তার রব আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। আর যে কেউ তা গোপন করে অবশ্যই তার অন্তর পাপী। আর তোমরা যা কর আল্লাহ তা সবিশেষ অবগত।
যদি সফরে ঋণ লেনদেনের প্রয়োজন পড়ে এবং সেখানে লেখার লোক অথবা কাগজ-কলম ইত্যাদি না থাকে, তাহলে তার বিকল্প ব্যবস্থা হল, ঋণগ্রহীতা কোন জিনিস ঋণদাতার কাছে বন্ধক রাখবে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, বন্ধক রাখা শরীয়ত সম্মত একটি বৈধ জিনিস
এ আয়াত দ্বারা সফর অবস্থায় বন্ধক রাখা জায়েয প্রমাণিত হয়। অনুরূপভাবে মুকীম বা অবস্থানকালেও বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহণ করা জায়েয। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও মুকীম অবস্থায় বন্ধক দিয়ে ঋণ গ্রহণ করেছেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ইয়াহুদীর নিকট থেকে নির্দিষ্ট মেয়াদে (বাকী) কিছু খাদ্য সামগ্রী খরিদ করেন এবং ঐ সময়ের জন্য তিনি ইয়াহুদীর নিকট তার বর্ম বন্ধক রাখেন। [বুখারীঃ ২৫০৯]
এই বন্ধক রাখা জিনিসটি যদি এমন হয় যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়, তাহলে তার উপকারিতার অধিকারী হবে মালিক; ঋণদাতা নয়। অবশ্য বন্ধকে রাখা জিনিসে যদি ঋণদাতার কোন কিছু ব্যয় হয়, তবে সে তার খরচ নিতে পারবে। খরচ নিয়ে নেওয়ার পর অবশিষ্ট লাভ মালিককে দেওয়া জরুরী হবে।
অর্থাৎ, তোমাদের একে অপরের প্রতি যদি বিশ্বাস থাকে, তাহলে কিছু বন্ধক রাখা ছাড়াই ঋণের আদান-প্রদান করতে পার। (এখানে ‘আমানত’ অর্থ ঋণ।) আল্লাহকে ভয় করে তা (আমানত) সঠিকভাবে আদায় কর।
এ আয়াতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণিত হয়েছে। প্রথমতঃ বাকীর ব্যাপারে কেউ যদি বিশ্বস্ততার জন্য কোন বস্তু বন্ধক নিতে চায়, তাও করতে পারে। কিন্তু এতে مَقْبُوضَةٌ শব্দ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, বন্ধকী বস্তু দ্বারা উপকৃত হওয়া তার জন্য জায়েয নয়। সে শুধু ঋণ পরিশোধ হওয়া পর্যন্ত একে নিজের অধিকারে রাখবে। এর যাবতীয় মুনাফা আসল মালিকের প্রাপ্য। দ্বিতীয়তঃ যে ব্যক্তি কোন বিরোধ সম্পর্কে বিশুদ্ধ জ্ঞান রাখে, সে সাক্ষ্য গোপন করতে পারবে না। যদি সে গোপন করে, তবে তার অন্তর গোনাহগার হবে। ‘অন্তর গোনাহগার’ বলার কারণ এই যে, কেউ যেন একে শুধু মুখের গোনাহ মনে না করে। কেননা, অন্তর থেকেই প্রথমে ইচ্ছার সৃষ্টি হয়। তাই অন্তরের গোনাহ প্রথম। [মাআরিফুল কুরআন]
আমাদের দেশে জমিজমা চাষবাস ও এসংক্রান্ত অনেক ধরনের লেনদেন চলে। এগুলোর শরয়ি বিধানাবলিও ইসলামী ফিকাহ ও ফাতাওয়ার কিতাবগুলোয় উল্লেখ রয়েছে। আমরা এখানে বিশেষ কিছু মাসআলা নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
বর্গাচাষ : এটা হচ্ছে একজনের জমিতে অপরজন শ্রম দিয়ে চাষ করে উভয়ে পূর্বচুক্তি অনুসারে উৎপাদিত ফসল সমান অর্ধেক করে বা কমবেশি ভাগ করে নেবে। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনের প্রাসঙ্গিক অন্যান্য খরচ ও ব্যয়ভারের শরিয়তসম্মত তিনটি পদ্ধতির যেকোনো একটি গ্রহণ করা যেতে পারে।
১. জমি এবং বীজ একজন বহন করবে আর চাষাবাদের যাবতীয় খরচ দ্বিতীয় জন বহন করবে।
২. শুধু জমি একজনের আর চাষাবাদের জন্য যাবতীয় খরচ দ্বিতীয় জন আঞ্জাম দেবে।
৩. জমি এবং বীজসহ হালের জন্য গরু অথবা মেশিনের খরচ একজন বহন করবে আর দ্বিতীয় জন শুধু কাজ করবে।
এই তিনটি ছাড়া অন্য পদ্ধতি শরিয়তসম্মত নয়। (ফাতহুল কাদির : ৯/৪৭৬)
সাক্ষ্য গোপন করা কাবীরা গুনাহ। এই জন্যই এর কঠোর শাস্তির কথা কুরআনের এই আয়াতে এবং বহু হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। অনুরূপ সত্য সাক্ষ্য দেওয়ার ফযীলতও অনেক। এক হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘আমি কি তোমাদেরকে উত্তম সাক্ষীদাতার কথা বলে দিবো না? সে হল এমন লোক, যার কাছে সাক্ষী তলব করার পূর্বেই সে নিজেই সাক্ষী নিয়ে উপস্থিত হয়ে যায়।’’ (মুসলিম ১৭১৯নং) অপর এক বর্ণনায় নিকৃষ্টতম সাক্ষীদাতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘‘আমি কি তোমাদেরকে নিকৃষ্টতম সাক্ষীদাতাদের কথা বলে দিবো না? তারা এমন লোক, যাদের নিকট সাক্ষী চাওয়ার পূর্বেই তারা সাক্ষী দেয়।’’ (মুসলিম ২৫৩৫নং) অর্থাৎ, এরা মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে মহাপাপ সম্পাদন করে। আলোচ্য আয়াতে বিশেষ করে অন্তরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, গোপন করা অন্তরের কাজ। তাছাড়া অন্তর হল অন্য সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নেতা। এটা গোশতের এমন এক টুকরা যে, যদি এটা ঠিক থাকে, তাহলে সারা দেহ ঠিক থাকবে। আর যদি এর মধ্যে খারাবী আসে, তাহলে সমস্ত দেহ খারাবীর শিকার হয়ে পড়বে। (أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّهُ وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّهُ أَلاَ وَهِيَ الْقَلْبُ ) (অর্থাৎ, শোন! শরীরে এমন একটি গোশতের টুকরা আছে যে, যদি তা ঠিক থাকে, তাহলে সারা দেহ ঠিক থাকবে। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সারা দেহ নষ্ট হয়ে যাবে। শোন! তা হল, অন্তর।’’ (বুখারী ৫২নং)
মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়া আল্লাহর বান্দার অন্যতম গুণ। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ لاَ يَشْهَدُوْنَ الزُّوْرَ وَإِذَا مَرُّوْا بِاللَّغْوِ مَرُّوْا كِرَامًا، ‘যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয় তখন ভদ্রভাবে সে স্থান অতিক্রম করে’ (ফুরক্বান ২৫/৭২)।
আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া হ’ল, না জেনে কথা কথা বলার ন্যায় অপরাধ’। অনুরূপভাবে সাক্ষ্য গোপন করাও মিথ্যা সাক্ষীর মত। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَا تَكْتُمُوا الشَّهَادَةَ وَمَنْ يَّكْتُمْهَا فَإِنَّهُ آثِمٌ قَلْبُهُ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ عَلِيْمٌ، ‘আর তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে ব্যক্তি তা গোপন করে, তার হৃদয় পাপিষ্ঠ। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত’ (বাক্বারাহ ২/২৮৩)।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, شَهَادَةُ الزُّوْرِ مِنْ أَكْبَرِ الْكَبَائِرِ، وَكِتْمَانُهَا كَذَلِكَ، ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ও সাক্ষ্য গোপন করা সবচেয়ে বড় গুনাহ’
অনুরূপভাবে সাক্ষীর জন্যও ওয়াজিব হ’ল সত্য সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা সাক্ষ্য থেকে বেঁচে থাকা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হিসাবে, যদিও সেটি তোমাদের নিজেদের কিংবা তোমাদের পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে যায়। (বাদী-বিবাদী) ধনী হৌক বা গরীব হৌক (সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করো না)। কেননা তোমাদের চাইতে আল্লাহ তাদের অধিক শুভাকাঙ্ক্ষী। অতএব ন্যায়বিচারে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের সকল কর্ম সম্পর্কে অবহিত’ (নিসা ৪/১৩৫)।
সূরা মায়েদার ৮নং আয়াতে আল্লাহ তায়ারা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُونُواْ قَوَّامِينَ لِلّهِ شُهَدَاء بِالْقِسْطِ وَلاَ يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَآنُ قَوْمٍ عَلَى أَلاَّ تَعْدِلُواْ اعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَاتَّقُواْ اللّهَ إِنَّ اللّهَ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ
‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।’ (সূরা: মায়েদা, আয়াতে: ৮)
উত্তম সাক্ষ্য দাতার আলোচনায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ সর্বোত্তম সাক্ষ্যদাতা কে, আমি কি তা তোমাদেরকে অবহিত করবো? সে ওই সাক্ষ্যদাতা, যে তলব করার আগেই (নিজ দায়িত্ববোধ থেকে) সাক্ষ্য প্রদান করে।’ (সহীহ মুসলিম-৪৪৫৮)
সাক্ষ্যের জালিয়াতি ধরা পড়ার পরও সেই সাক্ষ্যের ভিত্তিতে রায় দেওয়া অনেক বড় অন্যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (সহীহ মুসলিম-১৮২৯)
অন্য হাদীসে এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বিচারকদের তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ জান্নাতে যাবে আর দুই ভাগ যাবে জাহান্নামে। জান্নাতে যাবে ওই সকল বিচারক যারা সত্য জেনে সে অনুযায়ী রায় দেন। বাকি দুই ভাগের প্রথম ভাগ হলো, যারা সত্য জেনেও ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হয়। আরেক দল হলো, ওই সকল বিচারক যারা আইন-কানুন না জেনে বিচার করে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৫৭৩)