সুরা বাকারাঃ ৩৭তম রুকু (২৬৭-২৭৩)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:২৬৭ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡفِقُوۡا مِنۡ طَیِّبٰتِ مَا کَسَبۡتُمۡ وَ مِمَّاۤ اَخۡرَجۡنَا لَکُمۡ مِّنَ الۡاَرۡضِ ۪ وَ لَا تَیَمَّمُوا الۡخَبِیۡثَ مِنۡهُ تُنۡفِقُوۡنَ وَ لَسۡتُمۡ بِاٰخِذِیۡهِ اِلَّاۤ اَنۡ تُغۡمِضُوۡا فِیۡهِ ؕ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ غَنِیٌّ حَمِیۡدٌ
২৬৭. হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমরা যা যমীন থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদন করি তা থেকে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর; এবং নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্প করো না, অথচ তোমরা তা গ্রহণ করবে না, যদি না তোমরা চোখ বন্ধ করে থাক। আর জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।
এখানে প্রথমেই হালাল (তাইয়্যেব বা পবিত্র) আয় করা ও তা থেকে ব্যয় করার কথা এসেছে।
যিনি নিজের উৎকৃষ্ট গুণাবলীর অধিকারী তিনি কখনো নিকৃষ্ট গুণের অধিকারীদের পছন্দ করতে পারেন না, একথা সবাই জানে৷ মহান আল্লাহ নিজেই পরম দাতা এবং সর্বক্ষন নিজের সৃষ্টির ওপর দান-দাক্ষিন্যের ধারা প্রবাহিত করেছেন৷ কাজেই তাঁর পক্ষে কেমন করে সংকীর্ণ দৃষ্টি, স্বল্প সাহস ও নিম্নমানের নৈতিক চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী লোকদেরকে ভালোবাসা সম্ভব ?
ইরশাদ হয়েছে–
﴿لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ۚ وَمَا تُنفِقُوا مِن شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ﴾
৯২) তোমরা নকী অর্জন করতে পারো না যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলো ( আল্লাহর পথে) ব্যয় করো৷ আর তোমরা যা ব্যয় করবে আল্লাহ তা থেকে বেখবর থাকবেন না৷আলে ইমরানঃ ৯২
أَخْرَجْنَا শব্দ দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ওশরী জমিতে (যে জমিনের উৎপন্ন শষ্যের এক-দশমাংশ ইসলামী বিধান অনুযায়ী সরকারী তহবিলে জমা দিতে হয়) যে ফসল উৎপন্ন হয়, তার এক-দশমাংশ দান করা ওয়াজিব। ‘ওশর’ ও ‘খারাজ’ ইসলামী শরীআতের দুটি পারিভাষিক শব্দ। এ দুয়ের মধ্যে একটি বিষয় অভিন্ন। উভয়টিই ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভূমির উপর আরোপিত কর। পার্থক্য এই যে, ‘ওশর’ শুধু কর নয়, এতে আর্থিক ইবাদাতের দিকটিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ; যেমন- যাকাত। এ কারণেই ওশরকে যাকাতুল-আরদ বা ‘ভূমির যাকাত’ও বলা হয়। পক্ষান্তরে খারাজ শুধু করকে বোঝায়। এতে ইবাদাতের কোন দিক নেই। মুসলিমরা ইবাদাতের যোগ্য ও অনুসারী।
তাই তাদের কাছ থেকে ভূমির উৎপন্ন ফসলের যে অংশ নেয়া হয়, তাকে ‘ওশর’ বলা হয়। অমুসলিমরা ইবাদাতের যোগ্য নয়। তাই তাদের ভূমির উপর যে কর ধাৰ্য্য করা হয়, তাকে ‘খারাজ’ বলা হয়। যাকাত ও ওশরের মধ্যে আরও পার্থক্য এই যে, স্বর্ণ, রৌপ্য ও পণ্য সামগ্রীর উপর বছরান্তে যাকাত ওয়াজিব হয়, কিন্তু ওশর জমিতে উৎপাদনের সাথে সাথেই ওশর ওয়াজিব হয়ে যায়। দ্বিতীয় পার্থক্য এই যে, জমিনে ফসল উৎপন্ন না হলে ওশর দিতে হয় না। কিন্তু পণ্য দ্রব্যে ও স্বর্ণ-রৌপ্যে মুনাফা না হলেও বছরান্তে যাকাত ফরয হবে।
হাদীসে এসেছে, ‘‘আল্লাহ পবিত্র। তাই তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই কবুল করেন। এর দ্বিতীয় অর্থ হল, খারাপ ও অতি নিম্নমানের জিনিস। নষ্ট হয়ে যাওয়া খারাপ জিনিসও যেন আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় না করা হয়।
আর {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} আয়াতের দাবীও তা-ই। এই আয়াত নাযিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, মদীনার কোন কোন আনসার সাহাবী খারাপ হয়ে যাওয়া নিম্নমানের খেজুরগুলো সাদাকা স্বরূপ মসজিদে দিয়ে যেতেন। যার ফলে এই আয়াত নাযিল হয়। (ফাতহুল ক্বাদীরঃ তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ ইত্যাদি)
প্রথম আয়াতে বলা হয়েছেঃ যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে, অর্থাৎ হজ, জিহাদ কিংবা ফকীর, মিসকীন, বিধবা ও ইয়াতীমদের জন্য কিংবা সাহায্যের নিয়্যতে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অর্থ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত হল যেমন, কেউ গমের একটি দানা সরস জমিতে বপন করল। এ দানা থেকে একটি চারা গাছ উৎপন্ন হল, যাতে গমের সাতটি শীষ এবং প্রত্যেকটি শীষে একশ’ করে দানা থাকে। অতএব, এর ফল দাঁড়ালো এই যে, একটি দানা থেকে সাতশ দানা অর্জিত হয়ে গেল। উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর পথে ব্যয় করার সওয়াব এক থেকে শুরু করে সাতশ পর্যন্ত পৌছে। এক পয়সা ব্যয় করলে সাতশ’ পয়সার সওয়াব অর্জিত হতে পারে। সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসসমূহে বর্ণিত আছে, একটি সৎকর্মের সওয়াব দশগুণ পাওয়া যায় এবং তা সাতশ গুণে পৌছে। [দেখুন, বুখারী ৪১, মুসলিম: ১২৮]
আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এ বিষয়বস্তুটি সংক্ষিপ্ত ও পরিস্কার ভাষায় বর্ণনা করার পরিবর্তে গম-বীজের দৃষ্টান্ত আকারে বর্ণনা করেছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কৃষক গমের এক দানা থেকে সাতশ দানা তখনই পেতে পারে, যখন দানাটি হবে উৎকৃষ্ট। কৃষকও কৃষি বিষয়ে পুরোপুরি ওয়াকেফহাল হবে এবং জমিও হবে সরস। কেননা, এ তিনটি বিষয়ের যেকোন একটি বিষয়ে অভাব হলেও হয় দানা বেকার হয়ে যাবে অর্থাৎ একটি দানাও উৎপন্ন হবে না, কিংবা এক দানা থেকে সাতশ দানার মত ফলনশীল হবে না। এমনিভাবে সাধারণ সৎকর্ম এবং বিশেষ করে আল্লাহর পথে কৃত ব্যয় গ্রহণীয় ও অধিক সওয়াব পাওয়ার জন্য তিনটি শর্ত রয়েছেঃ
পবিত্র ও হালাল ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা। হাদীসে আছে, আল্লাহ তা’আলা পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া কোন কিছুই গ্রহণ করেন না। [মুসলিম: ১০১৫]
যে ব্যয় করবে তাকেও সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত ও সৎ হতে হবে। কোন খারাপ নিয়্যতে কিংবা নাম-জশ অর্জনের উদ্দেশ্যে যে ব্যয় করে, সে ঐ অজ্ঞ কৃষকের মত, যে বীজকে অনুর্বর মাটিতে বপন করে, ফলে তা নষ্ট হয়ে যায়।
যার জন্য ব্যয় করবে, তাকেও সদকার যোগ্য হতে হবে। অযোগ্য ব্যক্তির জন্য ব্যয় করলে সদকা ব্যর্থ হবে। এভাবে বর্ণিত দৃষ্টান্ত দ্বারা আল্লাহর পথে ব্যয় করার ফযীলতও জানা গেল এবং সাথে সাথে তিনটি শর্তও জানা গেল যে, হালাল ধন-সম্পদ ব্যয় করতে হবে, ব্যয় করার রীতিও সুন্নাত অনুযায়ী হতে হবে এবং যোগ্য ব্যক্তির জন্য ব্যয় করতে হবে। শুধু পকেট থেকে বের করে দিয়ে দিলেই এ ফযীলত অর্জিত হবে না।
২:২৬৮ اَلشَّیۡطٰنُ یَعِدُکُمُ الۡفَقۡرَ وَ یَاۡمُرُکُمۡ بِالۡفَحۡشَآءِ ۚ وَ اللّٰهُ یَعِدُکُمۡ مَّغۡفِرَۃً مِّنۡهُ وَ فَضۡلًا ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
২৬৮. শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং অশ্লীলতার নির্দেশ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী-প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
আল্লাহ যখন শয়তানকে জান্নাত থেকে বের করে দেন তখন শয়তান চারটি বিষয়ের আবেদন করে। তা হলো–
১. আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত জীবন লাভ। আল্লাহ তার এ প্রার্থনা কবুল করেন। আল্লাহর বাণী, ‘ইবলিস বলল, আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত সুযোগ দিন, আল্লাহ তাআলা বললেন, তুমি সুযোগপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : আরাফ : ১৫)
২. আমার জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এ আবেদনও কবুল করা হয়।
৩. আমাকে মানুষের দৃষ্টিশক্তির অন্তরাল হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এটিও কবুল করা হয়।
৪. আমি যেন মানবদেহের শিরা-উপশিরায় চলাচল করতে পারি। এ দোয়াও কবুল করা হয়।
মহানবী (সা.) বলেন, ‘অবশ্যই শয়তান আদমসন্তানের শিরা-উপশিরায় বিচরণ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৮৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২১৭৪)
পবিত্র কোরআনের ৪ স্থানে আল্লাহ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। এসব স্থানে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
১. শয়তান মানুষের শত্রু : শয়তান মানুষের শত্রু, সে মানুষের অনিষ্ট চায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা আনআম : ১৪২)
২. শয়তান অসৎ জীবনের পথ দেখায় : মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি, পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কোরো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা: ১৬৮)
৩. আল্লাহর আনুগত্যে বাধা দেয় : শয়তান মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য করতে এবং তাঁর কাছে সর্বাত্মক আত্মসমর্পণ করতে নিষেধ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা সর্বাত্মকভাবে ইসলামে প্রবেশ কোরো এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ২০৮)
৪. শয়তান অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয় : পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কোরো না। কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে, শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।’ (সুরা নুর: ২১)
যখন কারো মনে এ ধারণা জন্মে যে, দান-সদকা করলে ফকীর হয়ে যাবে, বিশেষতঃ আল্লাহ তা’আলার তাকীদ শুনেও স্বীয় ধন-সম্পদ ব্যয় করার সাহস না হয় এবং আল্লাহর ওয়াদা থেকে মুখ ফিরিয়ে শয়তানী ওয়াদার দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন বুঝে নেয়া উচিত যে, এ প্ররোচনা শয়তানের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে যদি মনে ধারণা জন্মে যে, দান-সদকা করলে গোনাহ মাফ হবে এবং ধন-সম্পত্তিও বৃদ্ধি পাবে ও বরকত হবে, তখন মনে করতে হবে, এ বিষয়টি আল্লাহর পক্ষ থেকে। এমতাবস্থায় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আল্লাহর ভাণ্ডারে কোন কিছুর অভাব নেই। তিনি সবার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং নিয়্যত ও কর্ম সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত।
আমরা যখন আল্লাহর تعالى পথে দান করতে যাই, তখন আমাদের মনে নানা ধরনের চিন্তা আসা শুরু হয়ে যায়, “বাড়ি ভাড়া দেওয়ার টাকা থাকবে? ছেলে মেয়েদের পড়ার খরচ দিতে পারবো? ঈদের শপিং করতে পারবো?” অথচ যখন শপিং মল বা রেস্টুরেন্টে যাই, আমরাই তখন দেদারসে টাকা উড়াতে থাকি। তখন আমাদের মাথায় বাড়ি-ভাড়া, সন্তানের ভবিষ্যৎ-এর কথা মাথায় আসে না। যে লোক মসজিদের দান বাক্সে একশ টাকা দিবে না দশ টাকা দিবে এই নিয়ে নিজের মধ্যে যুদ্ধ করতে থাকে, সেই মানুষই সিনেমা, টিভি, রংবেরঙের পানীয়, দামি খাবার, ব্রান্ড কাপড়, বিদেশে বেড়াতে যাওয়া — এসবের জন্য দুহাতে টাকা খরচ করতে একটুও বাধে না।
আমরা যখন যাকাত দেওয়ার সময় হিসেব করে দেখি কত যাকাত দিতে হবে, তখন ভাবি, “এত্ত গুলো টাকা দিয়ে দিতে হবে! এত টাকা যাকাত দিয়ে কী হবে? মানুষের অভাবের তো কোনো শেষ নেই। যত দিবো, তত চাইবে।” — যাকাতের পরিমাণ দেখে আমাদের আফসোস শুরু হয়ে যায়, অথচ ভেবে দেখি না যে, এটা হচ্ছে আমাদের সম্পত্তির মাত্র ২.৫%অংশ, খুবই নগণ্য পরিমাণ। বাকি বিশাল ৯৭.৫% অংশ সম্পত্তি আমাদের জমা হয়ে আছে। যাকাত দেওয়ার সময় আমাদের শুধু আফসোস হয় যে, কতগুলো টাকা বের হয়ে গেলো। সেই টাকা না দিলে কত কিছু কিনতে পারতাম, কত কিছু করতে পারতাম। অথচ চিন্তা করে দেখি না যে, আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এত সম্পত্তি দিয়েছেন যে, তার এক নগণ্য অংশও আমাদের কাছে এত বেশি মনে হচ্ছে —
আল-বাক্বারাহ’র এই আয়াতে আল্লাহ تعالى বিশেষভাবে বলছেন যে, শয়তান আমাদেরকে ٱلْفَحْشَآء ফাহশা’ এর দিকে ডাকবে। ফাহশা’ হচ্ছে যে কোনো লজ্জাহীন, অশ্লীল এবং অনৈতিক কাজ, যেমন, বিপরিত লিঙ্গের (বা সমলিঙ্গের) অবৈধ কারো সাথে করা যাবতীয় অশ্লীল কাজ।[১১][১৬] ফেইসবুকে বিপরীত লিঙ্গের দিকে পশুর মত কামুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা। হিন্দি, ইংরেজি মুভি দেখা, যেখানে নারী পুরুষদের অশ্লীলভাবে দেখানো হয়। পরকীয়া এবং অশ্লীল আবেদনে ভরা হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা গান শোনা। সবশেষে একেবারেই পশুর থেকেও অধম হয়ে গিয়ে পর্ণ দেখা, সমকামিতা, ব্যভিচারে জড়িয়ে পড়া —এই সব কিছু ফাহশা’র মধ্যে পড়ে।
শয়তান জানে যে, আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে বিপরীত (বা সম) লিঙ্গের প্রতি কামনা। তাই এই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর জন্য ওরা কোটি কোটি ডলারের বিশাল মুভি, মিউজিক, পর্ণ বাণিজ্য সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা যেন প্রতিক্ষণে ফাহশা’র কোনো না কোনো হাতছানি দেখতে পাই, সেজন্য ওরা খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টিভি, রেডিও, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, রাস্তায় বিলবোর্ড —সব দখল করে রেখেছে। বিংশ শতাব্দীতে যোগাযোগের যত আধুনিক প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে, তার বেশিরভাগই আজকাল ওরা ব্যবহার করছে ফাহশা’র মধ্যে আমাদের বুঁদ করে রাখার জন্য।
ফাহশা’র একটি বৈশিষ্ট্য হলো: আমরা প্রথম যখন খারাপ কিছু দেখি, তখন চোখে খুব লাগে। কিন্তু যখন বার বার দেখতে থাকি, তখন আস্তে আস্তে চোখ সয়ে আসে। একসময় সেটা আর খারাপ লাগে না। একারণেই মিডিয়াতে ফাহশা’কে ধীরে ধীরে নোংরা থেকে নোংরাতর করা হয়। দেশে যখন কেব্ল টিভি প্রথম এসেছিল, আমরা তখন পাশ্চাত্যের অশালীন পোশাক, আচার-আচরণ দেখে বিরাট ধাক্কা খেয়েছিলাম। একসময় তা আমাদের সহ্য হয়ে গেল। আমরা ভাবতাম ওরা নষ্ট হয়ে গেছে, আমরা এখনও ভালো আছি। তারপর একসময় আমরা ওদের অনুকরণ করে নষ্ট হয়ে গেলাম। প্রথম দিকে যখন দেখতাম আমাদের কিছু ছেলে-মেয়ে পাশ্চাত্যের নকল করছে, তখন ধাক্কা লাগতো। একসময় সেটাও গা সওয়া হয়ে গেলো। আজকাল রেস্টুরেন্ট, ক্লাব, ইউনিভারসিটি, কনসার্টে গেলে, বা টিভিতে সাবান, শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন দেখলে বোঝা যায় না এটা বাংলাদেশ, নাকি নষ্ট সংস্কৃতিতে ধ্বসে যাওয়া পাশ্চাত্যের কোনো দেশ। এভাবেই ফাহশা’ মানুষকে ধীরে ধীরে বেহায়া বানিয়ে দেয়।
অভাবের সাথে ফাহশা‘র সম্পর্ক কি?
শয়তান যখন মানুষকে অভাবের ভয় দেখিয়ে দান করা থেকে দূরে রাখতে পারে, তখন সে মানুষের উপর জিতে যায়। চারিদিকে এত অভাব, এত মানুষের কষ্ট, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এত সুযোগ, আল্লাহর تعالى পথে খরচ করার এত ব্যবস্থা —এগুলো সব দেখেও মানুষ যখন প্রতিটা দিন শয়তানের কথা শুনে চোখ-কান বন্ধ করে রাখতে পারে, সে তখন তার বিবেকের চাবি শয়তানের হাতে দিয়ে দেয়। একবার শয়তান যখন কারও বিবেককে অন্ধ করে দিতে পারে, তখন সে তাকে দিয়ে সহজেই অশ্লীল কাজ করিয়ে নিতে পারে। আল্লাহর تعالى পথে দান করা থেকে আটকানো হচ্ছে মানুষের বিবেকের উপর জয়ী হয়ে যাওয়ায় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। শয়তান যখন এভাবে বিবেকের নিয়ন্ত্রণ দখল করে নিতে পারে, তখন সে মানুষকে দিয়ে অতি সহজে অশ্লীল কাজ করাতে পারে।
সুতরাং আল্লাহর تعالى পথে খরচ করা হচ্ছে আমাদের জন্য এক মানসিক যুদ্ধ। আমরা যখন এই যুদ্ধে জয়ী হই, তখন শয়তানের কুমন্ত্রণার হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য আরও শক্তিশালী হই। এভাবে আমাদের ঈমানের জোর বাড়ে, আমরা নিজেদেরকে অশ্লীল কাজ থেকে তত বেশি দূরে রাখতে পারি। যারা নিজেদেরকে অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখতে পারছেন না, তাদের আসল সমস্যা হচ্ছে তাদের বিবেকের আসনে আর তিনি বসে নেই, বসে আসে শয়তান। সুতরাং প্রথমে নিজের ভেতরে যুদ্ধ করে আগে সেই শয়তানকে দূর করতে হবে। আর এর জন্য এক মোক্ষম উপায় হচ্ছে আল্লাহর تعالى পথে খরচ করা, যত কষ্টই হোক না কেন, যত দুশ্চিন্তাই আসুক না কেন, যতই ভয় লাগুক না কেন।
একইসাথে শয়তান অভাবের ভয় দেখিয়ে আমাদেরকে দিয়ে নোংরা কাজ করায়। যেমন, ইন্টার্ভিউ দিতে যাওয়ার সময় হিজাব ছেড়ে বা দাঁড়ি কেটে যাওয়া, কারণ যদি চাকরি না মেলে? চাকরি হারানোর ভয়ে অফিসে কখনও হিজাব না পড়া, বা দাঁড়ি বড় না করা, এমনকি বসের সাথে রেন্সটুরেন্টে, পার্টিতে গিয়ে আপত্তিকর কাজেও অংশ নেওয়া। প্রমোশন হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে উপরের তলার নোংরা কাজের খবর জেনেও চেপে যাওয়া। —এভাবে শয়তান আমাদেরকে অভাবে ভয় দেখিয়ে অশ্লীল কাজ করাতে থাকে।
শয়তান কখনও আপনাকে এসে বলবে না, “আমি শয়তান। আমি তোমাকে জাহান্নামে পুড়াতে চাই। আসো আমরা ইয়ে করি।” ইবলিস এবং অন্যান্য জিন শয়তানরা মানুষের কাছে অদৃশ্য প্রাণী। তারা বিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে ‘প্যারালাল ইউনিভার্স’ বা ‘অন্য ডাইমেনশন’-এ থাকে, যেখান থেকে তারা ঠিকই আমাদেরকে দেখতে পায়, কিন্তু আমরা তাদেরকে দেখতে পাই না, বা কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্র দিয়ে সনাক্ত করতে পারি না।
সে এবং তার অনুসারিরা তোমাদেরকে তাদের জায়গা থেকে দেখতে পায়, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। [আল-আরাফ :২৭]
শয়তান মানুষের অবচেতন মনে কুচিন্তা বা কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দেয়। আমরা সাবধানে লক্ষ্য করলেও বুঝতে পারবো না: আমাদের মনের গভীরে যে চিন্তাগুলো চলছে, তার কোনটা আমি, আর কোনটা শয়তান। সূরা আন-নাস-এ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলেছেন, কীভাবে শয়তান কাজ করে—
(আমি আশ্রয় চাই) তার অনিষ্ট থেকে, যে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কুমন্ত্রণা দেয়। যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে। জ্বিনের মধ্য থেকে এবং মানুষের মধ্য থেকে। [আন-নাস :৪-৬]
এই আয়াতে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, শয়তান শুধুই জ্বিন নয়। ইবলিস এবং তার উদ্দেশকে বাস্তবায়ন করতে যে সব মানুষ সাহায্য করে, তারাও শয়তান।
শয়তান এমন কৌশলে আমাদের মনে কু-চিন্তা, অসুস্থ কামনা ঢুকিয়ে দেয় যে, আমরা মনে করবো: সেগুলো আসলে আমাদের নিজেদেরই চিন্তা-ভাবনা, আবেগ এবং অনুভুতি। যেহেতু আমরা সবসময় শয়তানের ব্যাপারে সাবধান থাকি না, তাই কখন যে শয়তান আমাদের মধ্যে তার কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিয়ে, আমাদেরকে দিয়ে তার কাজ করানো শুরু করে দেয়, তা আমরা ভুলে যাই। একারণেই আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সাবধান করেছেন—
যারা আল্লাহর প্রতি সচেতন থাকে, যখনি তাদের মনে শয়তান কোনো কু-চিন্তা দেয়, তারা সাথে সাথে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তখনি তারা পরিস্কার দেখতে পায় আসলে কী ঘটছে। [আল-আ’রাফ :২০১]
আল্লাহ تعالى আমাদেরকে একটা চমৎকার ফর্মুলা শিখিয়ে দিয়েছেন: কীভাবে শয়তানকে প্রতিহত করতে হবে। যখনি অনুভব করা শুরু করবেন যে, আপনি যেই কাজটা করছেন, তা করা ঠিক হচ্ছে না, সাথে সাথে আল্লাহর تعالى কথা মনে করুন। মনে মনে বুঝে বলুন, “আউ’যু বিল্লা-হি মিনাশ শাইত-নির রজীম” – “আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই বিতাড়িত শয়তান থেকে”। দ্রুত কোনো কু’রআনের আয়াত মনে করার চেষ্টা করুন, যেটা আপনার পরিস্থিতির সাথে মিলে যায়। যেমন: আপনি কারও প্রতি দুর্বলতা অনুভব করছেন, এমন দিকে তাকাচ্ছেন যেদিকে আপনার তাকানোর কথা না, সাথে সাথে নিজেকে মনে করিয়ে দিন—
বিশ্বাসী পুরুষদেরকে বলো যেন, তারা তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গকে সাবধানে রক্ষা করে, এটা তাদের জন্যই বেশি কল্যাণকর। আল্লাহ খুব ভালো করে জানেন তোমরা কী করো। বিশ্বাসী নারীদেরকে বলো, যেন তারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের গোপন অঙ্গকে সাবধানে রক্ষা করে … [নুর ২৪:৩০]
তবে দরকারের সময় জরুরি কোনো আয়াত মনে করাটা খুব কঠিন, যদি না আমরা নিয়মিত কিছু জরুরি আয়াত ঝালিয়ে না নেই। এজন্য নিয়মিত কু’রআন পড়াটা জরুরি। আর সবচেয়ে বেশি দরকার কু’রআন বুঝে পড়া। বুঝে কুর’আন না পড়লে আমরা কোনোদিন জানবো না: আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কত পদ্ধতি শিখিয়েছেন, কত ব্যাপারে সাবধান করেছেন।
এক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সম্পদের প্রতি মানুষের মোহ।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে মানুষের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা অধিক অর্থ সম্পদের মালিক হতে চায়। এই প্রসংগে তিনি বলেন: الهكم التكاثر حتي زرتم المقابر- كلا سوف تعملون- التكاثر ১-৩ তোমাদেরকে অধিক অধিক অর্থ সম্পদ সঞ্চিত করার চিন্তা ভাবনা চরমভাবে নিমগ্ন করে রেখেছে। কবরে পা দেয়া পর্যন্ত এ চিন্তায় তোমরা বিভোর থাক। কখন নয় অতি শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে- আত-তাকাসুর ১-৩।
ইবন কাসীর বলেন, উপরিউল্লেখিত আয়াতের মর্মার্থ এই যে ধন সম্পদের প্রাচুর্য অথবা ধন সম্পদ, সন্তান সন্তুতি বংশ গোত্রের বড়াই তোমাদেরকে গাফেল ও উদাসীন করে রাখে। নিজেদের পরিণতি ও পরকালের হিসাব নিকাশের কোন চিন্তা তোমরা করোনা এবং এমনি অবস্থায় তোমাদের মৃত্যু এসে যায়। আর মৃত্যুর পর তোমরা আযাবে নিপতিত হও।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন শিখখীর বলেন, আমি একদিন রাসুলে কারীম (সা) এর নিকট পৌঁছে দেখলাম, তিনি الهكم التكاثر তেলাওয়াত করে বলছিলেন: মানুষ বলে, আমার ধন আমার ধন, অথচ তোমার অংশ তো ততটুকুই যতটুকু তুমি খেয়ে শেষ করে ফেল অথবা পরিধান করে ছিন্ন করে দাও অথবা সদকা করে সন্মুখে পাঠিয়ে দাও। এছাড়া যা আছে তা তোমার হাত থেকে চলে যাবে। তুমি অপরের জন্য তা ছেড়ে যাবে- ইবন কাসীর। মানুষের অর্থ লোভ সম্পর্কে হযরত আনাস (রা) একটি হাদীস বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসুলে কারীম (সা) বলেন, আদম সন্তানের যদি স্বর্ণে পরিপূর্ণ একটি উপত্যকা থাকে , তবে সে ( তাতেই সন্তুষ্ট হবেনা; বরং) দুটি উপত্যকার কামনা করবে। তার মুখ তো ( কবরের ) মাটি ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা ভর্তি করা সম্ভব নয়। যে আল্লাহর দিকে রজু করে আল্লাহ তার তাওবা কবুল করেন- বুখারী।
এই প্রসংগে আল্লাহ ইরশাদ করেন:
زين للناس حب الشهوات من النساء والبنين والقناطير المقنطرة من الذهب والفضة والخيل المسومة والانعام والحرث – ذلك متاع الحيوة الدنيا والله عنده حسن الماب- قل اونبئكم بخير من ذلكم للذين اتقوا عند ربهم جنت تجري من تختها الانهر خلدين فيها وازواج مطهرة و رضوان من الله والله بصيربالعباد- ال عمران ১৪-১৫
মানবকূলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তান-সন্তুতি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিিহ্নত অশ্ব, গবদি পশুরাজি এবং ক্ষেত খামারের মত আকর্ষনীয় বস্তুসামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্তুসামগ্রী। বলুন আমি কি তোমাদেরকে এসবের চাইতও উত্তম বিষয়ের সন্ধান বলবো? যারা পরহেযগার, আল্লাহর নিকট তাদের জন্য রয়েছে বেহেশত, যার তলদেশে প্রস্রবন প্রবাহিত- তারা সেখানে থাকবে চিরকাল। আর রয়েছে পরিচ্ছন্ন সংগীগণ এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সুদৃষ্টি রাখবেন- আল ইমরান ১৪-১৫।
উল্লেখিত আয়াত দ্বয়ে দুনিয়ার কয়েকটি কাম্যবস্তুর কথা উল্লেখ আছে যার প্রতি আকর্ষন মানুষের জন্য স্বাভাবিক করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রমনী, সন্তান সন্তুতি ও ধন সম্পদের কথা বলা হয়েছে। মানুষ অনেক সময় এসবের মোহে আখেরাতের কথা ভুলে যায়; ধন সম্পদ হলেও এসবের মোহে তা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে পারেনা।
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করতে না পারার তৃতীয় কারণ হচ্ছে কৃপনতা। কৃপণতার পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
هَا أَنتُمْ هَٰؤُلَاءِ تُدْعَوْنَ لِتُنفِقُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَمِنكُم مَّن يَبْخَلُ ۖ وَمَن يَبْخَلْ فَإِنَّمَا يَبْخَلُ عَن نَّفْسِهِ ۚ وَاللَّهُ الْغَنِيُّ وَأَنتُمُ الْفُقَرَاءُ ۚ وَإِن تَتَوَلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُونُوا أَمْثَالَكُم﴾
তোমরাতো এমন লোক যাদেরকে আল্লাহর পথে খরচের জন্য আহবান জানানো হচ্ছে অতপর তোমাদের মধ্য থেকে কিছু লোক কৃপণতা করছে। যারা কৃপনতার আশ্রয় নিবে তার পরিণামে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন। অথচ তোমরাই তাঁর মুখাপেক্ষী। যদি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন কর, তাহলে আল্লাহর কিছু যায় আসেনা। তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য কোন সম্প্রদায়কে একাজের দায়িত্ব দিবেন; অতপর তারা তোমাদের মত হবেনা – সূরা মুহাম্মদ ৩৮। কুরআনের অন্যত্র কৃপনদের সম্পর্কে ইরশাদ করেন:
الذين يبخلون ويامرون الناس بالبخل و من يتول فان الله هوالغني الحميد- الحديد ২
যারা কৃপনতা করে এবং মানুষকে কৃপনতার প্রতি উৎসাহ দেয়, যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জানা উচিৎ যে আল্লাহ অভাবমুক্ত , প্রশংসিত- সূরা আল-হাদীদ ২৪।
আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং প্রাচুর্যের নিশ্চয়তা দেন
আল্লাহ تعالى আমাদেরকে কথা দিয়েছেন যে, যদি আমরা তাঁর পথে দান করি, তাহলে তিনি আমাদেরকে فضل অর্থাৎ প্রাচুর্য দেবেন। ফাদল এই দুনিয়াতেও দেবেন, আখিরাতেও দেবেন। আল্লাহ تعالى দুটোই আমাদেরকে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন। অনেকের কাছে মনে হয়, আখিরাত সেই কবে আসবে, কিছু পাবো কি পাবো না তার ঠিক নেই, তাই দুনিয়াতে ঝুঁকি নিয়ে দান করার দরকার নেই। তাদের জন্য সুখবর। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে শুধু আখিরাতে দেবেন বলেননি, দুনিয়াতেও দেবেন বলে কথা দিয়েছেন।
আল্লাহর تعالى বাণী আজকাল আমাদের কাছে মূল্যহীন। আল্লাহ تعالى যখন বলেন যে, তিনি আমাদেরকে গ্যারান্টি দিয়েছেন যে, তিনি আমাদেরকে অনেক দেবেন, যদি কিনা আমরা তাঁর পথে খরচ করি, তাঁর এই গ্যারান্টি শুনেও আমাদের সন্দেহ যায় না। যদি না পাই? যদি আরও গরিব হয়ে যাই? যদি দান করে কোনো লাভ না হয়? — এই সব সন্দেহের মধ্যে ঘুরতেই থাকি। আজকাল মুসলিমদের কাছে কোনো ধনী দেশের প্রেসিডেন্টের আশ্বাসের বাণীর অনেক দাম আছে। যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মুসলিমদের নিয়ে ভালো কিছু বলে, তাদেরকে কোনো ব্যাপারে সমর্থন করে, তখন মুসলিমরা সে কী খুশি! শান্তিতে তাদের বুক ভরে যায়। অথচ আল্লাহ تعالى যখন কুর‘আনে বলেন যে, তিনি অবশ্যই বিশ্বাসীদের এবং সবরকারীদের পাশে আছেন —তখন আমাদের কিছু যায় আসে না। আজকাল আমাদের কাছে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দেওয়া কথার দাম, আল্লাহর تعالى দেওয়া আস্থার থেকে বেশি দামি হয়ে গেছে।
যার হাতে সমস্ত সম্পদ, যিনি সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, যিনি যে কোনো সময় মানুষের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারেন, যে কোনো ধনী ব্যক্তিকে পথে বসিয়ে দিতে পারেন, পথের ফকিরকে রাতারাতি ধনকুবের বানিয়ে দিতে পারেন, সেই মহাশক্তিশালী প্রভু আমাদেরকে কথা দিয়েছেন যে, আমরা যদি তাঁর পথে খরচ করি, তাহলে তিনি আমাদেরকে অনেক দেবেন। এরপরেও যদি কেউ আল্লাহর تعالى পথে খরচ করতে হাজার অজুহাত দাঁড় করায়, তাহলে তার থেকে সাবধান থাকতে হবে। শয়তান তার উপর দখল নিয়ে নিয়েছে।
কিছু মানুষ আছে যাদের উপর শয়তান পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। এধরনের মানুষের চিন্তা-ভাবনা, কাজকর্ম, অনুভুতি, আবেগ– সবকিছুই শয়তানের দখলে চলে গেছে। এরা কথা বললে খারাপ কথা বলে, যা শুনলে মানুষ কষ্ট পায়, বিভ্রান্ত হয়ে যায়, মানুষে মানুষে সমস্যা তৈরি হয়। এদের কাজগুলো বেশিরভাগই হারাম কাজ। যেমন: টিভি দেখলে এরা দেখে তারকাদের সাক্ষাতকার, মিউজিক শো, ড্যান্স কম্পিটিশন, নানা ধরণের অসুস্থ সিরিয়াল। মুভি দেখলে দেখে সব মারামারি, খুনাখুনি, বিকৃত হরোর মুভি, না হয় হারাম প্রেম-ভালবাসা, পরকীয়ার মুভি। খবরের কাগজে এরা সব হারাম খবর পড়ে: কে কবে কাকে কী গালি দিলো, কোন তারকাকে নিয়ে কী স্ক্যান্ডাল চলছে, কোন পাতায় কোন মডেলের ছবি আছে। কম্পিউটারে বসলে এরা চুরি করা সফটওয়্যার ব্যবহার করে। ইন্টারনেটে গেলে এরা বেশিরভাগ সময় পর্ণ, সিনেমা, সিরিয়াল; না হয় ফেইসবুকে পরকীয়া, অবৈধ মেলামেশা, ডেটিং সাইটে মিথ্যা যোগ্যতা দিয়ে অন্যদেরকে পটানোর চেষ্টা করে। মোবাইল ফোনে বন্ধু-বান্ধবের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গীবত, এর কথা ওকে লাগানো, গোপন খবর ফাঁস করে দেওয়া ইত্যাদি।
এভাবে এরা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠার পর থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত যত ধরণের শয়তানী কাজ করা যায়, তার সবই করে। এরা তাদের মস্তিস্কের নিয়ন্ত্রণ শয়তানের হাতে দিয়ে দিয়েছে। তাদের অন্তরের ভেতরে চালকের আসনে আর তার বিবেক বসে নেই। বসে আছে শয়তান। এদের সম্পর্কে আল্লাহ تعالى বলেছেন—
শয়তান এদের উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। এরা শয়তানের দল। সাবধান! এই শয়তানের দল একদিন ধ্বংস হয়ে যাবেই। [মুজাদিলা ৫৮:১৯]
এই ধরণের মানুষদের সম্পর্কে সাবধান। আল্লাহ تعالى এদেরকে শয়তানের দল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এরা আর সাধারণ মানুষ নেই। আল্লাহর দৃষ্টিতে এরা মানুষরূপী শয়তান। সে আপনার বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলে-মেয়ে যেই হোক না কেন। সাবধানে থাকবেন, যেন তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে, বা তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে, আপনি আল্লাহকে تعالى সন্তুষ্ট রাখার কথা ভুলে না যান, আল্লাহর تعالى বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু না করেন।
আপনাকে সবসময় মনে রাখতে হবে, আপনি পৃথিবীতে এসেছেন আল্লাহকে تعالى খুশি রেখে নিজের ভালো দ্বারা পরকালের পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য। আল্লাহর تعالى বিনিময়ে অন্যদেরকে খুশি রাখার জন্য নয়। তাই কখনও আপনার নষ্ট হয়ে যাওয়া স্বামী বা স্ত্রীর জন্য নিজের জীবন শেষ করে দিবেন না। কখনও বাবা-মার অন্যায়ের সমর্থনে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে শেষ করবেন না। মানুষরূপী শয়তান বসের হয়ে জঘন্য কাজ করে নিজের উপরে আল্লাহর تعالى আক্রমণ ডেকে আনবেন না। এদের কাছ থেকে সসন্মানে, সুকৌশলে সরে আসুন, কারণ আল্লাহ تعالى আমাদেরকে সাবধান করেছেন –
তুমি এমন কাউকে পাবে না, যারা সত্যিই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ এবং শেষ বিচার দিনে বিশ্বাস করে, কিন্তু একই সাথে তাদেরকেও ভালবাসে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যায়। যদিও কিনা তারা তাদেরই বাবা, ছেলে, ভাই বা নিজেদের কোনো দল বা জাতির কেউ হয়। [মুজাদিলা ৫৮:২২]
https://quranerkotha.com/baqarah-268/
২:২৬৯ یُّؤۡتِی الۡحِکۡمَۃَ مَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّؤۡتَ الۡحِکۡمَۃَ فَقَدۡ اُوۡتِیَ خَیۡرًا کَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یَذَّکَّرُ اِلَّاۤ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ
২৬৯. তিনি যাকে ইচ্ছে হেকমত দান করেন। আর যাকে হেকমত প্রদান করা হয় তাকে তো প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়; এবং বিবেকসম্পন্নগণই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।
حِكمَة ‘হিকমত’এর অর্থ কেউ করেছেন, জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রজ্ঞা। কেউ করেছেন, সঠিক মত বা সিদ্ধান্ত, কুরআনের ‘নাসেখ-মানসুখ’ এর জ্ঞান এবং বিচার শক্তি। আবার কারো নিকট ‘হিকমত’ হল, কেবল সুন্নাতের জ্ঞান অথবা কিতাব ও সুন্নাতের জ্ঞান। অথবা উপরোক্ত সব অর্থই ‘হিকমত’-এর আওতাভুক্ত। সহীহ বুখারী ও মুসলিম ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, ‘‘দুই ব্যক্তির প্রতি ঈর্ষা করা বৈধ। এক ব্যক্তি হল সেই, যাকে আল্লাহ সম্পদ দান করেছেন এবং সে তা সৎপথে ব্যয় করে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হল সে, যাকে আল্লাহ হিকমত দান করেছেন যার দ্বারা সে বিচার-ফয়সালা করে এবং মানুষদেরকেও তা শিক্ষা দেয়।’’ (বুখারী, অধ্যায়ঃ ইলম, মুসলিম, অধ্যায়ঃ সালাতুল মুসাফেরীন)
হেকমত’ শব্দটি কুরআনুল কারীমে বার বার ব্যবহৃত হয়েছে। প্রত্যেক জায়গায় এর ব্যাখ্যায় বিভিন্ন অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো প্রায় কাছাকাছি উক্তি। হেকমতের আসল অর্থ প্রত্যেক বস্তুকে যথাস্থানে স্থাপন করা। এর পূর্ণত্ব শুধুমাত্র নবুওয়াতের মাধ্যমেই সাধিত হতে পারে। তাই এখানে হেকমত বলতে নবুওয়াতকে বোঝানো হয়েছে। রাগেব ইস্পাহানী বলেনঃ হেকমত শব্দটি আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা হলে এর অর্থ হবে সমগ্র বিষয়াদির পূর্ণ জ্ঞান এবং নিখুঁত আবিস্কার। অন্যের জন্য এ শব্দটি ব্যবহার করা হলে এর অর্থ হয় সৃষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান এবং তদানুযায়ী কর্ম। এ অর্থটিই বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। কোথাও এর অর্থ নেয়া হয়েছে কুরআন, কোথাও হাদীস, কোথাও বিশুদ্ধ জ্ঞান, কোথাও সৎকর্ম, কোথাও সত্যকথা, কোথাও সুস্থ বুদ্ধি, কোথাও দ্বীনের বোধ, কোথাও মতামতের নির্ভুলতা এবং কোথাও আল্লাহর ভয়। কেননা, আল্লাহর ভয়ই প্রকৃত হেকমত। আয়াতে হেকমতের ব্যাখ্যা সাহাবী ও তাবে-তাবেয়ীগণ কর্তৃক হাদীস ও সুন্নাহ বলে বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন যে, আলোচ্য আয়াতে উপরোল্লেখিত সবগুলো অর্থই বোঝানো হয়েছে। [বাহরে মুহীত]
২:২৭০ وَ مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ مِّنۡ نَّفَقَۃٍ اَوۡ نَذَرۡتُمۡ مِّنۡ نَّذۡرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ یَعۡلَمُهٗ ؕ وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ اَنۡصَارٍ
২৭০. আর যা কিছু তোমরা ব্যয় কর অথবা যা কিছু তোমরা মানত কর নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা জানেন। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।
‘যা কিছু তোমরা ব্যয় কর’ বলতে সর্বপ্রকার ব্যয়ই অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে; যে ব্যয়ে সব শর্তের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে এবং যে ব্যয়ে সবগুলোর কিংবা কতকগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়নি। উদাহরণতঃ আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয়নি বরং গোনাহর কাজে ব্যয় করা হয়েছে, কিংবা লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করা হয়েছে, অথবা ব্যয় করে অনুগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে কিংবা হালাল ও উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করা হয়নি ইত্যাদি, সর্বপ্রকার ব্যয়ই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
মানত কাকে বলে?
আমরা বাংলাতে বলি মানত । আরবিতে বলা হয় نذر (নযর) বহুবচনে নুযুর। মানত বা নযরের আভিধানিক অর্থ হল, নিজের দায়িত্বে নেয়া। যা নিজের দায়িত্ব নয় তা অপরিহার্য করে নেয়া।
শরয়ি পরিভাষায় মানত বলা হয়: নিজের উপর এমন কিছু ওয়াজিব (আবশ্যিক) করে নেয়া যা আসলে ওয়াজিব ছিল না। সেটা শর্তযুক্তও হতে পারে আবার শর্ত মুক্তও হতে পারে।
‘মানত’ শব্দের ব্যাপকতায় সর্বপ্রকার মানতই এসে গেছে। মানত বলতে বুঝায় কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোন কাজ করার শর্ত করা। যেমন, যদি আমার সন্তান হয় তাহলে আমি হজ করব বা যদি আমার ব্যবসায় সাফল্য আসে তবে আমি এত টাকা দান করব ইত্যাদি। মূলতঃ মানত পূরণ করা ইবাদাত। কিন্তু মানত করা ইবাদাত নয়। মানত করার ব্যাপারে শরীআত কাউকে উৎসাহ দেয়নি। বরং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মানত কারো জন্য ভাল কিছু নিয়ে আসে না বরং মানত কৃপণের সম্পদ থেকে কিছু বের করে। [বুখারীঃ ৬৬০৮, ৬৬৯২ ৬৬৯৩]
মানতের হুকুম- ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত না মুস্তাহাব?
আসলে মানত করা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে সব সময় উম্মতদের নিরুৎসাহিত করেছেন। বিষয়টি আমরা অনেকেই জানি না। বরং মনে করি মানত করা খুব সওয়াবের কাজ। আসলে এটি কোনো সওয়াবের কাজ নয়। বরং মাকরূহ। অধিকাংশ ইমাম ও ফেকাহবিদের অভিমত এটাই। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। তবে যদি কেউ মানত করে ফেলে তাহলে তাকে তা পালন করতেই হবে। তবে এক্ষেত্রে কিছু শর্তাবলী ও নিয়ম-নীতি আছে। খানিক পর আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করব।
মানত করা নিষেধ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। হাদীসে এসেছে : আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন আমাদের মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কিছুকে ফেরাতে পারে না। তবে মানতের মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৫) ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘মানত কোনো কিছুকে আগেও করে না, পিছেও করে না। বরং এর দ্বারা কেবল কৃপণ ব্যক্তি থেকে বের করা হয়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৬, সহিহ সুনান নাসায়ি)
ইবনু উমার রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। আর বলেছেন: মানত কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। এটা শুধু কৃপণ ব্যক্তি থেকে মাল খসায়।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৭, আহমাদ) আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘তোমরা মানত করবে না। কেননা মানত তাকদীরের কোনো কিছু-কে ফেরাতে পারে না। এটা শুধু কৃপণ থেকে সম্পদ খসায়।‘ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম, হাদীস নং ৪৩২৯, সহিহ সুনান তিরমিজি, সহিহ সুনান নাসায়ি) সাহবি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘যেই বস্তু মহান আল্লাহ আদম সন্তানের জন্য নির্ধারণ করেননি মানত সেটি তার নিকটবর্তী করে না। বরং তাকদীরে যা আছে মানত সেটাই নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয় যা সে খরচ করতে চায়নি।‘ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৩৩১)
উদ্ধৃত হাদীসগুলো থেকে আমরা জানতে পারলাম-
এক. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানত করতে নিষেধ করেছেন। অতএব মানত করা ঠিক নয়। আমরা অনেকে বিপদ-আপদে পতিত হলে মানত করে থাকি। আর মনে করি এটা সওয়াবের কাজ। আল্লাহ খুশী হবেন। কিন্তু আসলে তা সওয়াবের কাজ নয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করতে নিষেধ করেছেন তাতে আল্লাহ খুশী হবেন না। এবং এতে কোনো সওয়াবও হয় না। তাই আমাদের উচিত হবে কোনো অবস্থায় মানত না করা। অবশ্য মানত করে ফেললে তা পালন করতেই হবে কারণ মানত করলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
দুই. মানত করার মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তির সম্পদ বের করা হয়। এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝিয়েছেন, মানত করা একটি অনর্থক কাজ। সাধারণত কৃপণ স্বভাবের লোকেরা মানত করে থাকে। তারা সুস্থ ও নিরাপদ থাকা কালে দান-সদকা করে না। কিন্তু বিপদে পড়লে আল্লাহর পথে খরচ বা দান সদকা করার বড় বড় মানত করে।
তিন. তাকদীরে যা লেখা আছে তা হবেই। মানত করার মাধ্যমে তাকদীরের লেখা পরিবর্তন করা যায় না। তাকদীরের প্রতি যাদের যথাযথ ঈমান নেই সাধারণত তারাই মানত করে থাকে।
চার. মানত করা হোক বা না হোক। ফলাফল একই হবে। তাকদীরে যা লেখা আছে সেটাই আসবে অবধারিতভাবে।
পাঁচ. আলোচিত সবগুলো হাদীসই মানত না করার জন্য মুসলিমদের-কে নিরোৎসাহিত ও নিষেধ করেছে। বলেছে, এটি কোনো ফল বয়ে আনে না বরং শুধু কৃপণের সম্পদ খরচ করায়। এ সকল বিষয় জানার পর কোনো মুসলিমের পক্ষে কোনো প্রকার মানত করা উচিত নয় । সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, যে কাজটি করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন, আমরা সেটাকে সুন্নাত মনে করি। বহু আলেম-ওলামাকে বলতে শুনা যায়: আপনি ওখানে মানত করেন, তাহলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, বিপদ দূর হয়ে যাবে। অনেক খানকাহ ও দরবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের দরবারে বা খানকায় মানত করার জন্য মুসলিম জনগণকে উৎসাহিত করে থাকে। দরাজ গলায় বলে, আমাদের এই মাদরাসায় বা এই খানকায় মানত করে কেহ বিফল হয়নি। এমনটি যারা করেন তারা নিজেরাও এ বিষয়ে বিভ্রান্ত। সাথে সাথে অন্যদেরও বিভ্রান্ত করে থাকেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে হিফাজত করুন! দীনে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন!
ছয়. হাদীসগুলো পাঠ করে কেউ বলতে পারেন, এ সকল হাদীসে আর্থিক বিষয়াদি তথা ব্যয় ও দান- সদকা করার মানত করা থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। অতএব কেউ যদি নামাজ, রোজা, হজ, উমরা কিংবা কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত বিষয়ক মানত করে তবে দোষের কিছু হবে না। আমরা বলব, কথাটি ঠিক নয়। কেননা হাদীসের অর্থ ব্যাপক। তখনকার মানুষ সাধারণত খরচ বা দান-সদকা করার মানত করত। তাই এটাকে সামনে আনা হয়েছে। তাছাড়া আর্থিক মানতের মাঝে বহুবিদ উপকার নিহিত রয়েছে। মানতকারী ছাড়াও অন্য লোকেরা দান-সদাকা গ্রহণ করে উপকৃত হয়। তা সত্ত্বেও এটা যদি নিষিদ্ধ হয় তাহলে যে মানতে এমন বহুমাত্রিক উপকার নেই, তা অনুমোদিত হবার প্রশ্নই আসে না। তাই নামাজ, রোজা, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি নফল ইবাদতের মানত করাও ঠিক নয়
মানত করলে তা আদায় করতে হবে
মানত করা জায়েয নয়। কিন্তু কেউ যদি কোনো ভাল কাজ করার মানত করে তাহলে তাকে তা পালন করতে হবে। যাকে আমরা বলি মানত পুরা করা। মানত পুরা করা ওয়াজিব। না করলে গুনাহ হবে। মানত পুরা করা একটি ইবাদত। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: “তারা যেন তাদের মানতসমূহ পূরণ করে।” [সূরা আল হজ, আয়াত ২৯] আল্লাহ আরো বলেন: “তোমরা যা কিছু ব্যয় কর অথবা যে কোনো মানত কর তা অবশ্যই আল্লাহ জানেন।” [সূরা বাকারা, আয়াত ২৭০] আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীল ঈমানদারদের প্রশংসায় বলেন: “তারা মানত পূরণ করে।” [সূরা আল-ইনসান, আয়াত ৭]
এ সকল আয়াত থেকে স্পষ্টত প্রতিভাত হয়
এক. মানত করলে তা পূরণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা মানত পূরণ করতে হুকুম করেছেন।
দুই. এ সকল আয়াতের কোথাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানত করতে আদেশ করেননি বা উৎসাহ দেননি। অন্য কোনো আয়াতেও দিয়েছেন এমনটি পাওয়া যায় না।
তিন. মানত পূরণ করা সৎকর্মশীল ঈমানদারদের একটি গুণ হিসাবে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন। তাই মানত পূরণ করলে সওয়াব অর্জিত হবে, প্রতিদান পাওয়া যাবে
চার. মানুষ মানত করলে, কিংবা কোনো খরচ করলে আল্লাহ তা ভালভাবেই জানেন। তাই মানত পূরণ না করে কোনো উপায় নেই।
পাঁচ. মানত পূরণ করা যখন একটি ইবাদত, তখন তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে করতে হবে। মানত পূরণ করা সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার মানত করে সে যেন (তা পূরণ করে) তাঁর আনুগত্য করে । আর যে অবাধ্যতার কোনো বিষয়ে মানত করে সে যেন তাঁর অবাধ্যতা না করে। (সহিহ বুখারি, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, নাসায়ি) আমরা এই হাদীস থেকে জানতে পারলাম, ভাল কাজের মানত করলে শর্ত পূরণ হলে সেই মানত পূরণ করতে হয়। তাছাড়া এতে আমরা মানতের প্রকার সম্পর্কেও ইঙ্গিত পেলাম। যা নিম্নে আলোচিত হল।
যে মানত আদায় করা যাবে না:
উপরোক্ত হাদীস থেকে আমরা যেসব বিষয় জানতে পারলাম
মানত দুই প্রকার।
(ক) মানতের বিষয় হবে শরিয়ত অনুমোদিত ভাল কাজ। যেমন কেউ বলল, যদি আমি সুস্থ হই তাহলে তিনটি রোজা রাখব। এখানে মানতের বিষয়টি শরিয়ত অনুমোদিত একটি ইবাদত ও আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের বিষয়। শর্ত পূরণ হলে এ মানত আদায় করতে হবে।
(খ) শরিয়ত নিষিদ্ধ-মন্দ ও আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজ করার মানত। যেমন কেউ বলল, আজ যদি অমুক দল খেলায় জিতে যায় তাহলে আমি তোমাদেরকে মদ পান করাব। এ মানত পূরণ করা মোটেই জায়েয নয়। মানতের শর্ত পূরণ হোক বা না হোক। কারণ এতে আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতা বিদ্যমান।
মানত করে যদি তা পূর্ণ করতে না পারে:
কোনো ব্যক্তি বড় একটি মানত করল। যেমন বলল, এ কাজটি অর্জিত হলো আমি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দশ লক্ষ টাকা দিয়ে একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেব। কাজটি অর্জিত হল, কিন্তু দেখা গেল, এত টাকা দিয়ে তার মসজিদ নির্মাণের সামর্থ্য নেই। হয়ত মানত করার সময়ও সামর্থ্য ছিল না। তখন সে কি করবে? তখন সে ব্যক্তি কসম ভাঙ্গার কাফফারার হিসাবে মানতের কাফফারা আদায় করবে।
সহিহ মুসলিমে উকবা ইবনে আমের রা. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, মানতের কাফফরা হল কসম ভঙ্গের কাফফারার মত।
কিন্তু যে কোনো মানত পূর্ণ না করলে কি কাফফারা দিতে হয়?
অর্থাৎ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি এমন মানত করল যা পূর্ণ করার সামর্থ্য তার নেই, সে কসমের কাফফারা আদায় করবে। হাদীসটি আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন। আর হাফেজ ইবনে হাজার রহ. বুলুগুল মারাম কিতাবে এর সূত্রকে বিশুদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন। শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. তার ৩৩/৪৯ নং ফতোয়ায় বলেছেন: যখন কোনো ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে থেকে মানত করে তখন তা পূর্ণ করতেই হয়। কিন্তু যদি পূর্ণ করতে অক্ষম হয়ে যায় তাহলে কসম ভঙ্গের কাফফারা আদায় করবে। পূর্ববর্তী অধিকাংশ আলেম-উলামার অভিমত এটাই।
কসম ভঙ্গের কাফফরা,
দশজন অভাবী মানুষকে খাদ্য বা পোশাক দান করা কিংবা একটি দাস মুক্ত করে দেয়া। নিজেদের নিয়মিত খাবারের মধ্যম ধরনের খাবার দশ জনের প্রত্যেককে দিতে হবে। প্রতি জনের খাদ্যের পরিমাণ হবে কমপক্ষে অর্ধ সা অর্থাৎ কাছাকাছি দেড় কেজি। যদি সে এ তিন পদ্ধতির কোনো একটি দিয়ে কাফফারা আদায় করতে না পারে তাহলে তিন দিন রোজা পালন করবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: “আল্লাহ তোমাদেরকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অর্থহীন কসমের ব্যাপারে, কিন্তু যে কসম তোমরা দৃঢ়ভাবে কর সে কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও করেন। সুতরাং এর কাফফারা হল দশ জন মিসকীনকে খাবার দান করা, মধ্যম ধরনের খাবার, যা তোমরা স্বীয় পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদের বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস মুক্ত করা। অতঃপর যে সামর্থ্য রাখে না তবে তিন দিন সিয়াম পালন করা। এটা তোমাদের কসমের কাফ্ফারা, যদি তোমরা কসম কর, আর তোমরা তোমাদের কসম হেফাযত কর। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা করেন যাতে তোমরা শোকর আদায় কর।” [সূরা মায়েদা, আয়াত ৮৯]
তবে মনে রাখতে হবে, যে মানত পূরণ জায়েয নয় তা পালন না করার কারণে কাফফারা দিতে হয় না। কোনো কোনো ইমাম বলেছেন যে মানত নির্দিষ্ট করা হয়নি তারও কাফফারা দিতে হবে। যেমন কেউ বলল, আমি মানত করলাম বা আমার উপরে মানত আছে। কিন্তু কি মানত করল বা তার দায়িত্বে কি মানত আছে তা নির্দিষ্ট করল না। তাহলে তাকে মানত পূর্ণ না করে কসম ভঙ্গের কাফফারা দিতে হবে। তাদের দলীল হল: তিরমিজি ও ইবনে মাজা উদ্ধৃত, সাহাবি উকবা ইবনে আমের রা. -এর হাদীসে এসেছে, যখন মানত নির্ধারণ করা হয় না তখন তার কাফফারা হল, কসম ভঙ্গের কাফফারা। আবু দাউদ এ রকম একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন ইবনে আব্বাস রা. থেকে। তবে এ মাসআলাটিতে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধিকাংশ ফিকাহবিদের মত হল, যদি কেউ মানত করল কিন্তু নির্ধারণ করল না, তাহলে তার সামনে দু’টো অবকাশ থাকে। সে ইচ্ছা করলে মানত পূর্ণ করতে পারে আবার কাফফারাও দিতে পারে। আর যদি -মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়েছে কিন্তু সামর্থ্য নেই- এমনটি হয়, তাহলে কসম ভঙ্গের কাফফারার মত কাফফারা দেবে। এ মাসআলাটি সর্বসম্মত। ফিকাহবিদদের একটি দল বলেছেন, যে কোনো মানত, গুনাহের কাজের হোক বা অসমর্থ কাজের হোক তা আদায় না করে কাফফারা দিতে হবে। তাদের মতে কোনো মানত বৃথা যাবে না। হয়ত পূর্ণ করতে হবে। পূর্ণ করতে না পারলে কাফফারা দিতে হবে।
২:২৭১ اِنۡ تُبۡدُوا الصَّدَقٰتِ فَنِعِمَّا هِیَ ۚ وَ اِنۡ تُخۡفُوۡهَا وَ تُؤۡتُوۡهَا الۡفُقَرَآءَ فَهُوَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ ؕ وَ یُکَفِّرُ عَنۡکُمۡ مِّنۡ سَیِّاٰتِکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ
২৭১. তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর তবে তা ভাল; আর যদি গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্থকে দাও তা তোমাদের জন্য আরো ভাল; এবং এতে তিনি তোমাদের জন্য কিছু পাপ মোচন করবেন। আর তোমরা যে আমল কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্মক অবহিত
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সাধারণ অবস্থায় গোপনে সাদাকা করাই উত্তম। তবে সাদাকা করার প্রতি মানুষকে উৎসাহ দানের প্রতি লক্ষ্য করে প্রকাশ্যেও তা করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে যে সর্বাগ্রে অগ্রসর হবে তার যদি লোক দেখানো উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে সে যে বিশেষ ফযীলত লাভ করবে সে কথাও বহু হাদীস দ্বারা পরিষ্কারভাবে জানা যায়। এই ধরনের কিছু বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া অন্যান্য অবস্থায় চুপিসারে সাদাকা-খয়রাত করাই শ্রেয়। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, যারা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া লাভ করবে, তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর লোক হবে তারা, যারা এমন গোপনীয়তা রক্ষা করে দান করেছে যে, তাদের ডান হাত কি ব্যয় করেছে, তা বাম হাতও জানতে পারেনি। কোন কোন আলেমের নিকট গোপনে সাদাকা করার যে ফযীলত তা কেবল নফল সাদাকার মধ্যে সীমিত। তাঁদের মতে যাকাত আদায় প্রকাশ্যে করাই উত্তম। কিন্তু কুরআনের ব্যাপক নির্দেশ নফল ও ফরয উভয় সাদাকাকেই শামিল করে। (ইবনে কাসীর) অনুরূপ হাদীসের ব্যাপকার্থবোধক শব্দও এ কথার সমর্থন করে।
অর্থাৎ লুকিয়ে সৎকাজ করলে মানুষের আত্মা ও নৈতিক বৃত্তির অনবরত সংশোধন হয়ে থাকে৷ তার সৎগুণাবলী বিকাশ লাভ করতে থাকে তার দোষ, ত্রুটি ও অসৎবৃত্তিগুলো ধীরে ধীরে নির্মুল হতে থাকে৷ এই জিনিসটি তাকে আল্লাহর এমন প্রিয়ভাজন করে তোলে,যার ফলে তার আমলনামায় যে সামান্য কিছু গোনাহ লেখা থাকে, তার এই সৎগুণাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করে মহান আল্লাহ সেগুলো মাফ করে দেন৷
২:২৭২ لَیۡسَ عَلَیۡکَ هُدٰىهُمۡ وَ لٰکِنَّ اللّٰهَ یَهۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَلِاَنۡفُسِکُمۡ ؕ وَ مَا تُنۡفِقُوۡنَ اِلَّا ابۡتِغَآءَ وَجۡهِ اللّٰهِ ؕ وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یُّوَفَّ اِلَیۡکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لَا تُظۡلَمُوۡنَ
২৭২ তাদের হিদায়াত দানের দায়িত্ব আপনার নয়; বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছে হিদায়াত দেন। আর যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় কর তা তোমাদের নিজেদের জন্য আর তোমরা তো শুধু আল্লাহ্কে চেয়েই (তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই) ব্যয় করে থাক। আর তোমরা উত্তম কোন কিছু ব্যয় করে থাকলে তার পুরস্কার তোমাদেরকে পুরোপুরিভাবেই দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।
প্রথমদিকে মুসলমানরা নিজেদের অমুসলিম আত্মীয়-স্বজন ও সাধারণ অমুসলিম দরিদ্র ও অভাবীদের সাহায্য করার ব্যাপারে ইতস্তত করতো ৷ তারা মনে করছিল কেবলমাত্র মুসলিম অভাবী ও দরিদ্রদের সাহায্য করলেই তা আল্লাহর পথে সাহায্য হিসেবে গণ্য হবে৷ এই আয়াতে তাদের এই ভূল ধারণার অপনোদন করা হয়েছে৷ এখানে আল্লাহর বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, এসব লোকের মনে হিদায়াতের মর্মবানী সুদৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল করে দেয়া তোমরা দায়িত্বের অন্তরভূক্ত নয়৷ তোমার দায়িত্ব হচ্ছে কেবল এদের কাছে হককথা পৌঁছিয়ে দেয়া৷ হককথা পৌঁছিয়ে দিয়েই তুমি দায়িত্বমুক্ত হয়ে গেছো৷ এখন তাদের অন্তরদৃষ্টি দান করা বা না করা আল্লাহর ইখতিয়ারভূক্ত৷ আর তোমরা নিছক তাদের হিদায়াত গ্রহণ না করার কারণে পার্থিব অর্থ-সম্পদ দিয়ে তাদের অভাব মোচনের ব্যাপারে ইতস্তত করো না কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে তোমরা যে কোন অভাবী লোকের সাহায্য করো না কেন, আল্লাহ তার প্রতিদান অবশ্যি তোমাদের দেবেন৷
২:২৭৩ لِلۡفُقَرَآءِ الَّذِیۡنَ اُحۡصِرُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ لَا یَسۡتَطِیۡعُوۡنَ ضَرۡبًا فِی الۡاَرۡضِ ۫ یَحۡسَبُهُمُ الۡجَاهِلُ اَغۡنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِ ۚ تَعۡرِفُهُمۡ بِسِیۡمٰهُمۡ ۚ لَا یَسۡـَٔلُوۡنَ النَّاسَ اِلۡحَافًا ؕ وَ مَا تُنۡفِقُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِیۡمٌ
২৭৩. এগুলো অভাবগ্রস্থ লোকদের প্রাপ্য; যারা আল্লাহ্র পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, দেশময় ঘুরাফিরা করতে পারে না; আত্মসম্মানবোধ না চাওয়ার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে; আপনি তাদের লক্ষন দেখে চিনতে পারবেন। তারা মানুষের কাছে নাছোড় হয়ে চায় না। আর যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ্ সে ব্যাপারে সবিশেষ জ্ঞানী।
এখানে যেসব লোকের কথা বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে এমন একদল লোক যারা আল্লাহার দীনের খেদমতে নিজেদেরকে কায়মনোবাক্যে সাবর্ক্ষণিকভাবে উৎসর্গ করে দিয়েছিল৷ তাদের সমস্ত সময় এই দীনি খেদমতে ব্যয় করার কারণে নিজেদের পেট পালার জন্য কিছু কাজকাম করার সুযোগ তাদের ছিল না৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবীদের এটি স্বতন্ত্র দল ছিল৷ ইতিহাসে তাঁরা ‘আসহাবে সুফ্ফা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন৷ এরা ছিলেন তিন চারশো লোকের একটি দল৷ নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে দিয়ে এরা মদীনায় চলে এসেছিলেন৷ সর্বক্ষন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির থাকতেন৷ তাঁর সাথে সাথে থাকতেন৷ তিনি যখন যাকে যেখানে কোন কাজে বা অভিযানে প্রয়োজন তাদের মধ্যে থেকে নিয়ে পাঠিয়ে দিতেন৷ মদীনার বাইরে কোন কাজ না থাকলে তারা মদীনায় অবস্থান করে দীনী ইল্ম হাসীল করতেন এবং অন্যদেরকে তার তালিম দিতেন৷ যেহেতু তাঁরা ছিলেন সার্বক্ষনিক কমী এবং নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার মতো ব্যক্তিগত উপকরণও তাঁদের ছিল না, তাই মহান আল্লাহ সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টি তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে বিশেষ করে তাদেরকে সাহায্য করাকে আল্লাহ পথে ব্যয়ের সবোর্ত্তম খাত বলে উল্লেখ করেছেন৷
আব্বাস ইবন মুহাম্মাদ দূরী (রহঃ) ….. ফাযালা ইবন উবায়দ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন লোকদের নিয়ে সালাতে দাঁড়াতেন তখন কিছু লোক ক্ষুধার তীব্র জ্বালায় দাঁড়ানো থেকে সালাতের মাঝেই নীচে পড়ে যেতেন। এরা ছিলেন, ’সুফফার’ সদস্য।* এমনকি তাদের এই অবস্থা দেখে মরুবাসীারবরা বলতঃ এরা পাগল নাকি!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত (নামায) শেষ করে এদের দিকে ফিরতেন। বলতেনঃ তোমরা যদি জানতে আল্লাহর কাছে তোমাদের জন্য কি নেয়ামত আছে তাহলে তোমরা আরো ক্ষুধার্ত থাকতে আরো অভাবী থাকতে ভালবাসতে। ফায়ালা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি ঐ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গেই ছিলাম। সহীহ, তা’লিকুর রাগীব ৪/১২০, তিরমিজী হাদিস নম্বরঃ ২৩৬৮ [আল মাদানী প্রকাশনী]
(আবু ঈসা বলেন) হাদীসটি হাসান-সহীহ।
এ থেকে সেই মুহাজিরদের বুঝানো হয়েছে যাঁরা মক্কা ত্যাগ করে আসেন এবং আল্লাহর পথে এসে প্রত্যেক জিনিস থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সব কিছুই তাঁদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণকারী ছাত্র-ছাত্রী এবং আলেমরাও এরই আওতায় পড়তে পারে।
অর্থাৎ, ঈমানদারদের গুণ হল, অভাব-অনটন সত্ত্বেও তারা চাওয়া ও ভিক্ষা করা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করে এবং নাছোড় বান্দা হয়ে চাওয়া থেকে বিরত থাকে।
কেউ কেউ إلحاف এর অর্থ করেছেন, মোটেই না চাওয়া। কেননা, তাদের প্রথম গুণ বলা হয়েছে যে, তারা যাচ্ঞা করে না। (ফাতহুল ক্বাদীর) আর কেউ কেউ বলেছেন, তারা চাওয়াতে বারবার আবেদন ও কাকুতি-মিনতি করে না এবং অপ্রয়োজনীয় জিনিস লোকের কাছে প্রার্থনা করে না। কারণ, إلحاف হল, প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও (স্বভাবগত কারণে) মানুষের কাছে চাওয়া। এই অর্থের সমর্থন সেই হাদীসসমূহ দ্বারাও হয়ে যায় যাতে বলা হয়েছে, ‘‘মিসকীন তো সে নয়, যে একটি-দু’টি খেজুরের জন্য অথবা এক-দু’ লুকমা খাবারের জন্য দ্বারে দ্বারে গিয়ে চেয়ে বেড়ায়, বরং আসল মিসকীন তো সেই, যে (অভাব সত্ত্বেও) চাওয়া থেকে বেঁচে থাকে।’ অতঃপর নবী করীম (সাঃ) প্রমাণস্বরূপ
{لاَ يَسْئَلُوْنَ النَّاسَ إلْحَافًا} আয়াতটি পাঠ করেন। (সহীহ বুখারী ১৪৭৬নং)
এই জন্য পেশাদার ভিক্ষুকের পরিবর্তে মুহাজির, দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণকারী ছাত্র-ছাত্রী, উলামা এবং চাইতে পারে না অথবা চাইতে লজ্জাবোধ করে এমন গুপ্ত অভাবীদের খোঁজ করে তাদের সহযোগিতা করা উচিত। কারণ, অন্যের সামনে হাতপাতা মানুষের আত্মসম্মান পরিপন্থী ও মর্যাদাহানিকর কর্ম। তাছাড়া হাদীসে এসেছে যে, যার কাছে তার প্রয়োজনের যথেষ্ট সামগ্রী থাকা সত্ত্বেও মানুষের কাছে ভিক্ষা চায়, কিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডল ক্ষত-বিক্ষত হবে। (সুনানে আরবাআহ) আর বুখারী ও মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে যে, ‘‘যে ব্যক্তি সব সময় মানুষের কাছে চায়, কিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডলে গোশত থাকবে না।’’ (বুখারী ১৪৭৫, মুসলিম ১০৪০নং)
সংগ্রহে-
তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন,আহসানুল বায়ান