সুরা বাকারাঃ ৩৬তম রুকু (২৬১-২৬৬)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:২৬১ مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ کَمَثَلِ حَبَّۃٍ اَنۡۢبَتَتۡ سَبۡعَ سَنَابِلَ فِیۡ کُلِّ سُنۡۢبُلَۃٍ مِّائَۃُ حَبَّۃٍ ؕ وَ اللّٰهُ یُضٰعِفُ لِمَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ
২৬১. যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশ শস্যদানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বহু গুণে বৃদ্ধি করে দেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।
২৬২ থেকে ২৮৩ পর্যন্ত মোট ২১টি আয়াত। এগুলোতে অর্থনীতি সংক্রান্ত বিশেষ নির্দেশ ও বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। এসব নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে বর্তমান বিশ্ব যেসব অর্থনৈতিক সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে সেগুলোর সমাধান আপনা-আপনিই বের হয়ে আসবে। আজ কোথাও পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং কোথাও এর জবাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তিত রয়েছে। এসব নীতির পারস্পরিক সংঘাতের ফলে গোটা বিশ্ব মারামারি, কাটাকাটি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের উত্তপ্ত লাভায় পরিপূর্ণ হয়ে অগ্নিগিরির রূপ ধারণ করেছে। এসব আয়াতে ইসলামী অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক বর্ণিত হয়েছে। এটি দু’ভাগে বিভক্ত,
এক. প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অভাবগ্রস্ত, দীন-দুঃখীদের জন্য ব্যয় করার শিক্ষা, যাকে সাদাকাহ বলা হয়।
দুই. সুদের লেন-দেনকে হারাম করে তা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ।
প্রথমে দান সাদাকাহর ফযীলত, সেদিকে উৎসাহ দান এবং সে সম্পর্কিত বিধানাবলী বর্ণিত হয়েছে সবশেষে সুদভিত্তিক কারবারের অবৈধতা, নিষেধাজ্ঞা এবং ঋণদানের বৈধ পস্থার বর্ণনা রয়েছে। [মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষেপিত]
আল্লাহর পথে ব্যয় করার ফযীলত। ‘আল্লাহর পথ’-এর উদ্দেশ্য যদি জিহাদ হয়, তাহলে তার অর্থ হবে জিহাদে ব্যয়কৃত টাকা-পয়সার এই নেকী পাওয়া যায়। আর যদি এর উদ্দেশ্য হয় সমস্ত কল্যাণের পথ, তবে এই ফযীলত হবে নফল সাদাকা-খয়রাতের। আর অন্যান্য নেকীসমূহ (একটি নেকীর প্রতিদান দশগুণ)এর আওতাভুক্ত হবে। (ফাতহুল ক্বাদীর) অর্থাৎ, সাদাকা-খয়রাতের সাধারণ প্রতিদান ও নেকী অন্যান্য কল্যাণকর কাজের চেয়ে বেশী। আর আল্লাহর পথে ব্যয় করার গুরুত্ব ও ফযীলত এত বেশী হওয়ার কারণ হল, যতক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধসামগ্রী ও অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবস্থা না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সৈন্যের পারদর্শিতাও শূন্যের কোটায় থাকবে। আর যুদ্ধসামগ্রী ও অস্ত্র-শস্ত্রের ব্যবস্থা টাকা-পয়সা ব্যতীত করা যেতে পারে না।
যে পরিমাণ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও গভীর আবেগ-উদ্দীপনা সহকারে মানুষ আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করবে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার প্রতিদানও তত বেশী ধার্য হবে৷ যে আল্লাহ একটি শস্যকণায় এত বিপুল পরিমাণ বরকত দান করেন যে,তা থেকে সাতশোটি শস্যকণা উৎপন্ন হতে পারে, তাঁর পক্ষে মানুষের দান-খয়রাতের মধ্যে এমনভাবে বৃদ্ধি ও ক্রমবৃদ্ধি দান করার যার ফলে এক টাকা ব্যয় করলে তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে এই বাস্তব সত্যটি বর্ণনা করার পর আল্লাহর দু’টি গুণাবলীর উল্লেখ করা হয়েছে৷
একটি গুণ হচ্ছে,তিনি মুক্ত হস্ত৷ তাঁর হাত সংকীর্ণ নয়৷ মানুষের কাজ প্রকৃতপক্ষে যতটুকু উন্নতি, বৃদ্ধি ও প্রতিদান লাভের যোগ্য, তা তিনি দিতে অক্ষম, এমনটি হতে পারে না৷
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তিনি সর্বজ্ঞ৷ অর্থাৎ তিনি কোন বিষয়ে বেখবর নন৷ যা কিছু মানুষ ব্যয় করে এবং যে মনোভাব, আবেগ ও প্রেরণা সহকারে ব্যয় করে, সে সম্পর্কে তিনি অনবহিত থাকবেন, ফলে মানুষ যথার্থ প্রতিদান লাভে বঞ্চিত হবে, এমনটিও হতে পারে না৷
২:২৬২ اَلَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ثُمَّ لَا یُتۡبِعُوۡنَ مَاۤ اَنۡفَقُوۡا مَنًّا وَّ لَاۤ اَذًی ۙ لَّهُمۡ اَجۡرُهُمۡ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ ۚ وَ لَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ
২৬২. যারা আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ ব্যয় করে তারপর যা ব্যয় করে তা বলে বেড়ায় না এবং কোন প্রকার কষ্টও দেয় না, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রব-এর নিকট। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করাকে কুরআনুল কারীম কোথাও إنْفَاق শব্দে, কোথাও إطْعَام শব্দে, কোথাও صَدَقَة শব্দে এবং কোথাও إيْتَاءُ الزَّكَاة শব্দে ব্যক্ত করেছে। কুরআনের এসব শব্দ এবং বিভিন্ন স্থানে এগুলোর ব্যবহারের প্রতি লক্ষ্য করলে জানা যায় যে, إنْفَاق – إطْعَام – صَدَقَة প্রভৃতি শব্দগুলো ব্যাপক অর্থবোধক এবং সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার দান-সদকা ও ব্যয়কেই বোঝায়; তা ফরয, ওয়াজিব কিংবা নফল, মুস্তাহাব যাই হোক। ফরয যাকাত বোঝাবার জন্য কুরআন একটি স্বতন্ত্র শব্দ إيْتَاءُ الزَّكَاة ব্যবহার করেছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এ বিশেষ সদকাটি আদায় করা ও ব্যয় করার মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এখানে বেশীর ভাগ إنْفَاق শব্দ এবং কোথাও صَدَقَة শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ এই যে, এখানে সাধারণ দান-সদকা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। [মা’আরিফুল কুরআন]
আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় বা দান করার উল্লিখিত ফযীলত কেবল সেই ব্যক্তিই লাভ করবে, যে স্বীয় সম্পদ দান করে অনুগ্রহ প্রকাশ করবে না এবং সে মুখ দিয়ে এমন কোন তুচ্ছ বাক্যও বের করবে না, যা কোন গরীব-অভাবীর সম্মানে আঘাত হানে এবং সে তাতে ব্যথা অনুভব করে। কেননা, এটা এত বড় অপরাধ যে, নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তিন শ্রেণীর মানুষের সাথে কথা বলবেন না। তাদের মধ্যে একজন হল, (দান করে) অনুগ্রহ প্রকাশকারী ব্যক্তি।’’ (মুসলিম ১০৬নং)
২:২৬৩ قَوۡلٌ مَّعۡرُوۡفٌ وَّ مَغۡفِرَۃٌ خَیۡرٌ مِّنۡ صَدَقَۃٍ یَّتۡبَعُهَاۤ اَذًی ؕ وَ اللّٰهُ غَنِیٌّ حَلِیۡمٌ
(২৬৩) যে দানের পশ্চাতে (যাচ্ঞাকারীকে) কষ্ট দেওয়া হয়, তার চেয়ে (তাকে) মিষ্টি কথা বলা এবং ক্ষমা করা উত্তম। আর আল্লাহ অভাবমুক্ত, পরম সহনশীল।
ভিক্ষুকের সাথে নম্রভাবে ও দয়ামাখা স্বরে কথা বলা অথবা দু’আ-বাক্য (আল্লাহ তাআ’লা তোমাকে ও আমাকে তাঁর অনুগ্রহ ও করুণা দানে ধন্য করুন! ইত্যাদি) দ্বারা তাকে উত্তর দেওয়াই হল ‘মিষ্টি বা উত্তম কথা’। আর ‘ক্ষমা করা’র অর্থ হল, ভিক্ষুকের অভাব-অনটন ও তার প্রয়োজনের কথা মানুষের সামনে প্রকাশ না করে তা গোপন করা। অনুরূপ ভিক্ষুকের মুখ দিয়ে যদি কোন অনুচিত কথা বেরিয়ে যায়, তা ক্ষমা করে দেওয়াও এর আওতাভুক্ত। অর্থাৎ, ভিক্ষুকের সাথে নম্রভাবে দয়ামাখা স্বরে কথা বলা, তাকে ক্ষমা করা এবং তার (ব্যাপার) গোপন করা সেই সাদাকার চেয়ে উত্তম, যে সাদাকা করার পর (যাকে সাদাকা দেওয়া হয়) তাকে মানুষের সামনে অপমানিত করে কষ্ট দেওয়া হয়। এই জন্যই হাদীসে বলা হয়েছে, ‘‘উত্তম কথা সাদাকার সমতুল্য।’’ (মুসলিম ১০০৯নং) অনুরূপ নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ‘‘তুমি কোনও নেকীর কাজকে তুচ্ছ ভেবো না, যদিও তা তোমার কোন ভায়ের সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ করার মাধ্যমে হয়।’’ (মুসলিম ২৬২৬নং)
২:২৬৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تُبۡطِلُوۡا صَدَقٰتِکُمۡ بِالۡمَنِّ وَ الۡاَذٰی ۙ کَالَّذِیۡ یُنۡفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤۡمِنُ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِؕ فَمَثَلُهٗ کَمَثَلِ صَفۡوَانٍ عَلَیۡهِ تُرَابٌ فَاَصَابَهٗ وَابِلٌ فَتَرَکَهٗ صَلۡدًا ؕ لَا یَقۡدِرُوۡنَ عَلٰی شَیۡءٍ مِّمَّا کَسَبُوۡا ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ
২৬৪. হে মুমিনগণ! দানের কথা বলে বেড়িয়ে এবং কষ্ট দিয়ে তোমরা তোমাদের দানকে ঐ ব্যক্তির ন্যায় নিস্ফল করো না যে নিজের সম্পদ লোক দেখানোর জন্য ব্যয় করে থাকে এবং আল্লাহ্ ও আখেরাতে ঈমান রাখে না। ফলে তার উপমা হলো এমন একটি মসৃণ পাথর, যার উপর কিছু মাটি থাকে, তারপর প্রবল বৃষ্টিপাত সেটাকে পরিস্কার করে রেখে দেয়। যা তারা উপার্জন করেছে তার কিছুই তারা তাদের কাজে লাগানোর ক্ষমতা রাখে না। আর আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।
এ আয়াতে সদকা কবুল হওয়ার দুটি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। (১) দান করে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে পারবে না এবং (২) গ্রহীতাকে ঘৃণিত মনে করা যাবে না। অর্থাৎ তার সাথে এমন কোন ব্যবহার করতে পারবে না, যাতে সে নিজেকে ঘৃণিত ও হেয় অনুভব করে কিংবা কষ্ট পায়।
এ উপমায় প্রবল বর্ষণ বলতে দান-সদকাকে এবং পাথরখণ্ড বলতে যে নিয়্যত ও প্রেরণার গলদসহ দান-সদকা করা হয়েছে, তাকে বুঝানো হয়েছে। মাটির আস্তর বলতে সৎকর্মের বাইরের কাঠামোটি বুঝানো হয়েছে, যার নীচে লুকিয়ে আছে নিয়্যতের গলদ। এ বিশ্লেষণের পর দৃষ্টান্তটি সহজেই বোধগম্য হতে পারে। বৃষ্টিপাতের ফলে মাটি স্বাভাবিকভাবেই সরস ও সতেজ হয় এবং তাতে চারা জন্মায়। কিন্তু যে মাটিতে সরসতা সৃষ্টি হয় তার পরিমাণ যদি হয় নামমাত্র এবং তা কেবল উপরিভাগেই লেপ্টে থাকে আর তার তলায় থাকে মসৃণ পাথর, তাহলে বৃষ্টির পানি এক্ষেত্রে তার জন্য লাভবান হওয়ার পরিবর্তে বরং ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়। অনুরূপভাবে দান-সদকা যদিও সৎকর্মকে বিকশিত করার ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু তা লাভজনক হবার জন্য সদুদ্দেশ্য, সৎসংকল্প ও সৎনিয়্যতের শর্ত আরোপিত হয়েছে। নিয়্যত সৎ না হলে যত অধিক পরিমাণেই দান করা হোক না কেন তা নিছক অর্থ ও সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
এখানে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ্ তা’আলা কৃতঘ্ন-কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন না। এর তাৎপর্য এই যে, আল্লাহ্ তা’আলার হিদায়াত ও আয়াত সব মানুষের জন্যই প্রেরিত হয়েছে। কিন্তু কাফেররা এসবের প্রতি ক্ৰক্ষেপ না করে বরং ঠাট্টাবিদ্রুপ করে। এর পরিণতিতে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে তাওফীক তথা সৎকাজের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে দেন। ফলে তারা কোন হেদায়াত কবুল করতে পারে না।
২:২৬৫ وَ مَثَلُ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ اَمۡوَالَهُمُ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰهِ وَ تَثۡبِیۡتًا مِّنۡ اَنۡفُسِهِمۡ کَمَثَلِ جَنَّۃٍۭ بِرَبۡوَۃٍ اَصَابَهَا وَابِلٌ فَاٰتَتۡ اُکُلَهَا ضِعۡفَیۡنِ ۚ فَاِنۡ لَّمۡ یُصِبۡهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ
(২৬৫) পক্ষান্তরে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং নিজের হৃদয়কে শক্তিশালী করার জন্য তাদের ধন দান করে, তাদের উপমা কোন উঁচু ভূমিতে অবস্থিত একটি বাগান, যাতে মুষলধারে বৃষ্টি হয়, ফলে তার ফল-মূল দ্বিগুণ জন্মে। যদি মুষলধারে বৃষ্টি নাও হয়, তবে হাল্কা বৃষ্টিই যথেষ্ট। বস্তুতঃ তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।
এটা সেই ঈমানদারদের দৃষ্টান্ত, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দান করে থাকে। তাদের দানকৃত সম্পদ সেই বাগানের মত, যা কোন উঁচু জায়গায় অবস্থিত, তাতে প্রবল বৃষ্টি হলে দ্বিগুণ ফসল দেয়। আর প্রবল বৃষ্টি না হলেও হাল্কা বর্ষণ এবং শিশিরও তার জন্য যথেষ্ট হয়। অনুরূপ তাদের সাদাকা-খয়রাত যতই কম হোক না কেন আল্লাহর নিকট তা কয়েক গুণ প্রতিদান ও নেকীর কারণ হবে। ‘জান্নাত’ বা বাগান এমন ভূমিকে বলা হয়, যাতে এত সংখ্যায় বৃক্ষাদি থাকে যে তা পুরো ভূমিকে ঢেকে নেয়। অথবা ‘জান্নাত’ এমন বাগান যার চতুর্দিক এমনভাবে ঘেরা-বেড়া থাকে যে, তার ফলে বাগান দৃষ্টিগোচর হয় না। جَنَّة জান্নাত শব্দটি جنّ ধাতু থেকে গঠিত, (যার অর্থ ঢাকা বা অদৃশ্য হওয়া)। এ জন্যই জ্বিন এমন সৃষ্টির নাম যা দেখা যায় না। পেটের শিশুকেও ‘জানীন’ বলা হয় কারণ তাও দেখা যায় না। পাগলামিকে ‘জুনুন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়, কারণ তার বুদ্ধির উপর পর্দা পড়ে যায়। আর জান্নাতকেও এই জন্যই জান্নাত বলা হয় যে তা রয়েছে দৃষ্টির অগোচরে। رَبوَة উঁচু ভূমিকে বলে। আর وَابِل অর্থ প্রবল বৃষ্টি।
২:২৬৬ اَیَوَدُّ اَحَدُکُمۡ اَنۡ تَکُوۡنَ لَهٗ جَنَّۃٌ مِّنۡ نَّخِیۡلٍ وَّ اَعۡنَابٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ۙ لَهٗ فِیۡهَا مِنۡ کُلِّ الثَّمَرٰتِ ۙ وَ اَصَابَهُ الۡکِبَرُ وَ لَهٗ ذُرِّیَّۃٌ ضُعَفَآءُ ۪ۖ فَاَصَابَهَاۤ اِعۡصَارٌ فِیۡهِ نَارٌ فَاحۡتَرَقَتۡ ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ تَتَفَکَّرُوۡنَ
২৬৬. তোমাদের কেউ কি চায় যে, তার খেজুর ও আঙ্গুরের একটি বাগান থাকবে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত থাকবে এবং যেটাতে তার জন্য সবরকমের ফলমূল থাকবে। আর সে এবং তার কিছু দুর্বল সন্তান-সন্ততি থাকবে, তারপর তার (এ বাগানের) উপর এক অগ্নিক্ষরা ঘূর্ণিঝড় আপতিত হয়ে তা জ্বলে যাবে? এভাবে আল্লাহ তাঁর আয়াতসমূহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-ভাবনা করতে পার।
এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ তোমাদের কেউ পছন্দ করবে কি যে, তার একটি আঙ্গুর ও খেজুরের বাগান হবে, বাগানের নীচ দিয়ে পানির নহরসমূহ প্রবাহিত হবে, বাগানে সব রকম ফল থাকবে, সে নিজে বৃদ্ধ হয়ে যাবে এবং তার দুর্বল ও শক্তিহীন ছেলেসন্তানও বর্তমান থাকবে, এমতাবস্থায় বাগানে দাবানল আঘাত হানবে এবং বাগানটি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? আল্লাহ্ তা’আলা এমনিভাবে তোমাদের জন্য নয়ীর বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর।
এ উদাহরণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত যোগ করা হয়েছে; অর্থাৎ সে বৃদ্ধ হয়ে গেল, তার সন্তান-সন্ততিও আছে এবং সন্তানগুলো অল্পবয়স্ক; ফলে দুর্বল ও শক্তিহীন। এসব শর্তের উদ্দেশ্য এই যে, যৌবনে কারো বাগান ও শষ্যক্ষেত্র জ্বলে গেলে সে পুনরায় বাগান করে নেয়ার আশা করতে পারে, কিংবা যার সন্তান-সন্ততি নেই এবং পুনরায় বাগান করে নেয়ার আশাও নেই, বাগান জ্বলে যাওয়ার পরও তার পক্ষে জীবিকার ব্যাপারে তেমন চিন্তিত হওয়ার কথা নয়। একটিমাত্র লোকের ভরণ-পোষণ, কষ্টে-সৃষ্টে হলেও চলে যায়।
পক্ষান্তরে যদি সন্তান-সন্ততিও থাকে এবং পিতার কাছে সহযোগিতা ও সাহায্য করার মত বলিষ্ঠ যুবক ও সৎ সন্তান-সন্ততি থাকে, তবুও বাগান ধ্বংস হওয়ার দরুন তেমন বেশী চিন্তা ও ব্যথার কারণ নেই। কেননা, সে সন্তান-সন্ততির চিন্তা থেকে মুক্ত। বরং সন্তানেরা তার বোঝাও বহন করতে সক্ষম। মোটকথা এ তিনটি শর্তেই মুখাপেক্ষিতার তীব্রতা বর্ণনা করার জন্য যোগ করা হয়েছে। অর্থাৎ সে অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে বাগান করল, বাগান তৈরী হয়ে ফলও দিতে লাগল, এমতাবস্থায় সে বৃদ্ধ হয়ে পড়ল। তার সন্তান-সন্ততিও বর্তমান এবং সন্তানগুলো অল্প বয়স্ক ও দুর্বল। এহেন মুহুর্তে যদি তৈরী-বাগান জ্বলে-পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে তীব্র আঘাত ও অপরিসীম কষ্টেরই কথা।
একদিন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাগণকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তোমরা কি জান এই আয়াতটি কি বিষয়ে নাযিল হয়েছে -“তোমাদের কেউ কি পছন্দ কর যে, তার একটি বাগান হবে”। [সূরা আল-বাকারাঃ ২৬৬] এ কথা শুনে তারা বললেনঃ আল্লাহই সবচাইতে ভাল জানেন। এ কথা শুনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু রেগে গিয়ে বললেনঃ বরং (পরিস্কার করে) জানি অথবা জানিনা বলুন। তখন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বললেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন! এ ব্যাপারে আমার মনে একটি কথা জাগতেছে। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ হে আমার ভাতিজা, বল, এবং তুমি তোমাকে ছোট মনে করো না।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বললেনঃ এখানে আল্লাহ আমলের একটি উদাহরণ পেশ করেছেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ কোন উদাহরণ? ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বললেনঃ শুধুমাত্র আমলের উদাহরণ (হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে)। এ কথা শুনে উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি আল্লাহর বিধি-নিষেধ মেনে আমল করছে; অতঃপর আল্লাহ তার নিকট শয়তানকে প্রেরণ করলেন। তখন শয়তানের নির্দেশে নাফরমানী করতে লাগল। এমনকি তার সমস্ত নেক আমলকে সে বরবাদ করে ফেলল। (বুখারীঃ ৪৫৩৮]
সূরা আলে ইমরানে ইরশাদ হয়েছে–(১১৬-১১৭ আয়াত)
﴿إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا لَن تُغْنِيَ عَنْهُمْ أَمْوَالُهُمْ وَلَا أَوْلَادُهُم مِّنَ اللَّهِ شَيْئًا ۖ وَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۚ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ﴾
১১৬) আর যারা কুফরীনীতি অবলম্বন করেছে, আল্লাহর মোকাবিলায় তাদের ধন-সম্পদ কোন কাজে লাগবে না এবং তাদের সন্তান –সন্ততিও ৷ তারা তো আগুনের মধ্যে প্রবেশ করবে এবং সেখানেই তারা থাকবে চিরকাল ৷
﴿مَثَلُ مَا يُنفِقُونَ فِي هَٰذِهِ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَثَلِ رِيحٍ فِيهَا صِرٌّ أَصَابَتْ حَرْثَ قَوْمٍ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ فَأَهْلَكَتْهُ ۚ وَمَا ظَلَمَهُمُ اللَّهُ وَلَٰكِنْ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ﴾
১১৭) তারা তাদের এই দুনিয়ার জীবনে যা কিছু ব্যয় করছে তার উপমা হচ্ছে এমন বাতাস যার মধ্যে আছে তূষার কণা৷ যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছে তাদের শস্যক্ষেতের ওপর দিয়ে এই বাতাস প্রবাহিত হয় এবং তাকে ধ্বংস করে দেয়৷ আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেননি৷ বরং প্রকৃতপক্ষে এরা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছে৷
সবগুলো আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করলে আল্লাহর পথে ব্যয় ও দান-সদকা গ্রহণীয় হওয়ার জন্য ছয়টি শর্ত জানা যাবে।
প্রথমতঃ যে ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা হয়, তা হালাল হতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ সুন্নাহ অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে।
তৃতীয়তঃ বিশুদ্ধ খাতে ব্যয় করতে হবে।
চতুর্থতঃ খয়রাত দিয়ে অনুগ্রহ প্রকাশ করা যাবে না।
পঞ্চমতঃ যাকে দান করা হবে,তার সাথে এমন ব্যবহার করা যাবে না, যাতে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়।
ষষ্টতঃ যা কিছু ব্যয় করা হবে, খাটি নিয়্যতের সাথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথেই করতে হবে – নাম-যশের জন্য নয়। অর্থাৎ ব্যয় করতে হবে ইখলাসের সাথে।
আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেনঃ
“সাত প্রকার কাজের সওয়াব মারা যাওয়ার পরও বান্দার কবরে পৌঁছতে থাকে। যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম শিক্ষা দেয়, নদী-নালায় পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করে, কুপ খনন করে, খেজুর গাছ রোপন করে, মসজিদ তৈরী করে, কুরআনের উত্তরাধিকারী রেখে যায় অথবা এমন সুসন্তান রেখে যায় যে তার মারা যাওয়ার পরও তার জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমার জন্য দুয়া করে।
আল্লামা আলবানী (রাহ:) কর্তৃক রচিত সহীহুত তারগীব ওয়াত্ তারহীব:৭৩
প্রথমত: ব্যক্তিগত উপকারিতা
১- আত্মার পরিশুদ্ধি।
ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন:
(خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم ) [التوبة:301]
{তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।} [ সূরা তাওবা:১০৩]
সাদাকা অন্তরের নিষ্ঠুরতার চিকিৎসা:
একদা এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট তার অন্তরের কঠোরতার অভিযোগ করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন: “ইয়াতীমের মাথায় হাত বুলাও এবং মিসকিনদের খাদ্য দান করো”। [আহমদ, নং (৭৫৬৬, হাসান স্বহীহ আল জামি নং ১৪১০]
২ – নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ; কেননা তাঁর একটি অবিচ্ছেদ্য গুণ ছিল দান-খয়রাত করা। আর তিনি এমন দান করতেন যারপর আর দারিদ্র্যের ভয় থাকত না। তিনি বিলাল রাযি. কে বলেছেন, ‘হে বিলাল তুমি সদকা করো, আরশের মালিক তোমার সম্পদ কমিয়ে দেবেন এ আশঙ্কা করোনা।’(বর্ণনায় বাযযার)
সাদাকা করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বৈশিষ্ট: ইবনে আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবচেয়ে বেশী দানশীল ছিলেন এবং তাঁর দানশীলতা আরও বৃদ্ধি পেত,যখন রামাযান মাসে ফেরেশতা জিবরীল তাঁর সাথে সাক্ষাত করত”। [বুখারী, নং (৬) মুসলিম]
৩। দান জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “একটুকরো খেজুর দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষা করো।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩২৮)
৪। দানকারী নগদ প্রতিদান পায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “প্রতিদিন আকাশ থেকে দুইজন ফেরেশতা নেমে আসেন। একজন বলেন, হে আল্লাহ ,(আজকের দিনের) দানকারীকে তার প্রতিদান দাও। আর অপরজন বলে হে আল্লাহ, কৃপণ লোককে শীঘ্রই ধংস করো।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩৫১)
৫। দান করলে, আল্লাহও দান করবেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “মহান আল্লাহ বলেছেন, হে আদম সন্তান! তুমি খরচ করো, তাহলে তোমার প্রতিও খরচ করা হবে।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৪৯৩৩)
‘তোমরা তোমাদের সম্পদ থেকে যা কিছু খরচ করে থাক তার যথার্থ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে। তোমাদের উপর কোনরূপ অবিচার করা হবে না।’ (বাকারা ২৭২)
৬। দান সর্বোত্তম আমল। “কোনো এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, ইসলামের কোন আমলটি সর্বেত্তম?তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন,কাউকে খাবার খাওয়ানো ও পরিচিত অপরিচিত সবাইকে সালাম দেয়া। ” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১১)
৭। দানকারীর হাত উত্তম হাত।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হে আদম সন্তান! তুমি যদি তোমার প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ খরচ করো তাহলে সেটা তোমার জন্য কল্যাণকর। আর যদি তা ধরে রাখো, তাহলে সেটা তোমার জন্য অনিষ্টকর। তোমার জন্য যে পরিমাণ সম্পদ যথেষ্ট তা ধরে রাখাতে তোমার জন্য কোনো তিরষ্কার নেই। আর দান শুরু করবে তোমার নিকটাত্মীয়দের থেকে। উপরের হাত নীচের হাতের চেয়ে উত্তম।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৪৩৫)
৮। দানে সম্পদ বাড়বেই বাড়বে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “সাদাকাহ করলে সম্পদ কমেনা।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৬৭৫৭)
হালাল রুজির সামান্য দানও বিরাট হয়ে যায়। যে ব্যক্তি তার হালাল উপর্জন থেকে একটি খেজুরের মূল্য পরিমাণ দান করে- বলা বাহুল্য মহান আল্লাহ হালাল বস্তু ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেননা। আল্লাহ তার সেই দান ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর সেই দানকে তার দানকারীর জন্য বৃদ্ধি করতে থাকেন। যেরুপ তোমাদের কেউ তার ঘোড়াকে লালন পালন করতে থাকে। অবশেষে তা একদিন পহাড় সমতূল্য হয়ে যায়।”(সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩২১)
৯। দানকারীকে গায়েবী সাহায্য করেন আল্লাহ তায়ালা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “একদা এক লোক পানিহীন এক প্রান্তর দিয়ে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সে মেঘ থেকে একটি আওয়াজ শুনতে পেল। ‘অমুক ব্যক্তির বাগানে পানি বর্ষণ করো’। এটা শুনে মেঘ খন্ডটি একদিকে এগিয়েয়ে গেল। এবং পাথরময় ভুখন্ডে পানি বর্ষণ করতে লাগলো। আর পানি ছোট ছোট নালাসমূহ থেকে বড় একটি নালার দিকে অগ্রসর হলো। এমনকি পুরো বাগানকে বেষ্টন করে ফেললো। লোকটি সেই পানির পিছনে পিছনে যেতে লাগলো। এমন সময় সে দেখতে পেল, এক ব্যক্তি তার বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার বেলচা দিয়ে এদিক সেদিক পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। সে ঐ ব্যক্তিকে বললো, হে আল্লাহর বান্দা আপনার নাম কী?সে বললো, আমার নাম অমুক। অর্থাৎ ঐ নামই বললো যা সে মেঘে থেকে শুনতে পেয়েছিল। বাগানের মালিক বললো, হে আল্লাহর বান্দা আমার নাম তুমি কেন জানতে চাইছো? যে মেঘ থেকে এ পানি বর্ষিত হয়েছে তা থেকে আমি তোমার নাম শুনতে পেয়েছিলাম। ঐ আওয়াজ ছিল এই যে ‘অমুকের বাগানে গিয়ে পানি বর্ষণ করো’। আপনার নামই তাতে বলা হয়েছিল। আচ্ছা আপনি এ বাগানে এমন কী আমল করেছেন? (যার কারণে মেঘ থেকে আপনার বলা হলো) সে বললো, আপনি যেহেতু জানতে চাচ্ছেন, তাহলে শুনুন। এ বাগান থেকে যা কিছু উৎপন্ন হয়, আমি তার তত্ত্বাবধান করি। উৎপাদিত দ্রব্যের এক তৃতীয়াংশ দান করে দেই। আরেক তৃতীযাংশ আমি ও আমার পরিবার খেয়ে থাকি। আর এক তৃতীয়াংশ পুণরায় এতে লাগিয়ে দেই “ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭৬৬৪)
প্রকৃতপক্ষে যা খরচ হয় তাই বাকি থাকে। একবার রাসুলুল্লাাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পরিবারে একটি বকরী জবাই করা হলো। (এবং তা থেকে মুসাফির মেহমানদের খাওয়ানো হলো) অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহ আনহাকে বললেন: বকরীর কতটুকু অংশ বাকি আছে? তিনি জবাবে বললেন, একটি বাহু ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (প্রকৃতপক্ষে) এর সবই অবশিষ্ট আছে শুধু এই বাহু ছাড়া।(তিরমিযি, হাদিস নং ২৪৭০ শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন হাদিসটি সহিহ
১০। মুমিনের ছায়া হবে তার দান সাদাকাহ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কিয়ামতের দিন মুমিনের ছায়া হবে তার দান সাদাকাহ।” (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং ১৮০৪৩ শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন হাদিসটি সহিহ)
অন্য হাদীসে সাত প্রকারের লোক আরশের ছায়াতলে স্থান পাবে বলে উল্লেখ হয়েছে, তন্মধ্যে এক ব্যক্তি সে যে, “গোপনে এমন ভাবে সাদাকা করে যে, তার ডান হাত যা খরচ করে তার বাম হাত জানতে পারে না। [বুখারী, (১৪২৩) মুসলিম(১০৩১)
১১। বেচা- কেনার ভুল থেকে সম্পদকে পবিত্র করা।
কায়েস ইবনে আবি গারাযা রযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমাদেরকে দালাল বলা হতো। একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের পাশ দিয়ে গেলেন এবং এর থেকেও উত্তম নামে আমাদেরকে সম্বোধন করলেন। তিনি বললেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, নিশ্চয় ব্যবসায় অহেতুক কথা ও কসম এসে যায়, অতঃপর তোমরা তা সদকা দ্বারা মিশ্রিত করো [অর্থাৎ তার কাফফরা প্রদান করো]’(বর্ণনায় আবু দাউদ)
১২। সাদাকা রোগ থেকে আরোগ্যে পাওয়ার কারণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:“সাদাকার মাধ্যমে রোগীদের চিকিৎসা
করো”। [স্বাহীহ আল জামি, শাইখ আলবানী হাসান বলেছেন]
১৩। মৃত্যুর পর সদকায়ে জারিয়ার দ্বারা মুসলমানের উপকার লাভ
আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন মানুষ মরে যায় তখন তার আমাল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিন প্রকার ব্যতীত: সদকায়ে জারিয়া অথবা এমন ইলম যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় অথবা সৎ সন্তান যে তার জন্য দুআ করে।’(বর্ণনায় মুসলিম)
১৪। সাদাকা আল্লাহর ভালবাসার কারণ:
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:“আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় সৎ কাজ হচ্ছে,
মুসলিম ব্যক্তিকে খুশী করা কিংবা তার কষ্ট দূর করা কিংবা তার ক্ষুধা নিবারণ করা কিংবা তার ঋণ পরিশোধ করা”। [স্বহীহুত তারগীব
ওয়াত্ তারহীব]
১৫। দুনিয়ার সমস্যা বা কঠিন বিষয় সহজ হয়ে যাবে
”যে ব্যক্তি কোন অভাবগ্রস্তের অভাব দূর করবে, আল্লাহ তার দু’নিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় সহজ করে দিবেন।” (মুসলিম)
আবু উমামাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“ভালো কাজ তথা সদকা-খয়রাত সদকাকারীকে সমূহ বিপদাপদ থেকে রক্ষা করে”। সহীহুত-তারগীবি ওয়াত-তারহীব, হাদীস নং ৮৮৯
পরিবারে খরচ করাও এক প্রকারের সাদাকাহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখন কোনো মুসলিম সওয়াবের আশায় তার পরিবারের প্রতি খরচ করে, তখন সেটাও সাদাকাহ হিসেবে গণ্য হয়।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৪৯৩২)
সাদাকা করার ক্ষেত্রে কিছু নীতিমালাঃ
কুরআন-হাদীসে। তাই ইসলামের অপরাপর আমলের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ আমলটির জন্যও রয়েছে অনন্য সাধারণ কিছু নির্দেশনা ও নীতিমালা। যদি দানের ক্ষেত্রে সেগুলো রক্ষা করা হয় তাহলে এর যথাযথ প্রতিদান পাওয়া যাবে।
এক. নিয়ত সহীহ হওয়া
সহীহ নিয়ত বিহীন কোনো আমলেরই আল্লাহর নিকট মূল্য নেই। নিয়ত যদি সঠিক না হয়, আল্লাহর নিকট সেই আমলের কোনো ধর্তব্য হয় না, এমনকি আমলগুলোর সওয়াব ও প্রতিদানও পাওয়া যায় না। এককথায় সকল আমলের শুদ্ধাশুদ্ধি এবং তার সওয়াব ও প্রতিদান নির্ভর করে নিয়তের উপর। হাদীসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ সহীহ বুখারীর প্রথম হাদীসই হল এই নিয়ত বিষয়ক। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى.
নিশ্চয়ই সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তা-ই পাবে, যার নিয়ত সে করবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৭
দান-খয়রাতের ব্যাপারেও একই কথা। দান করতে হয় আল্লাহর জন্য। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তবেই এই দান পরকালে বর্ধিত হয়ে দাতার হাতে ফিরে আসে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَثَلُ الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمُ ابْتِغَآءَ مَرْضَاتِ اللهِ وَ تَثْبِیْتًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍۭ بِرَبْوَةٍ اَصَابَهَا وَابِلٌ فَاٰتَتْ اُكُلَهَا ضِعْفَیْنِ فَاِنْ لَّمْ یُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ.
আর যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ এবং নিজেদের মধ্যে পরিপক্বতা আনয়নের জন্য, তাদের দৃষ্টান্ত এ রকম- যেমন কোনও টিলার উপর একটি বাগান রয়েছে, তার উপর প্রবল বৃষ্টিপাত হল, ফলে তা দ্বিগুণ ফল জন্মাল। যদি তাতে প্রবল বৃষ্টি নাও পড়ে, তবে হালকা বৃষ্টিও (তার জন্য যথেষ্ট)। আর তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ তা অতি উত্তমরূপে দেখেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৫
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা-ই তুমি খরচ করবে, তার প্রতিদান দেয়া হবে; এমনকি স্ত্রীর মুখে তুমি যে খাবারের লোকমা তুলে দাও! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬২৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪২৪৯
নিয়ত যদি সহীহ ও শুদ্ধ না হয় তখন হিতে বিপরীতও হয়ে যেতে পারে।
হাদীসে এসেছে, কিয়ামতের দিন সম্পদশালী ব্যক্তিকে আল্লাহর সামনে হাজির করে আল্লাহ তাকে যেসব নিআমতরাজি দান করেছেন, তার সামনে পেশ করা হবে। দেখে সে চিনে ফেলবে (হাঁ, এসব নিআমত দুনিয়াতে আমার কাছে ছিল।) তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, এগুলোতে তুমি কী আমল করেছ? সে বলবে-
مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَقَ فِيهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيهَا لَكَ.
যেসব খাতে দান করা আপনি পছন্দ করেন এমন প্রতিটি খাতেই আমি আপনার জন্য খরচ করেছি। তাকে ডেকে বলা হবে-
كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ، لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيلَ ثُمَّ أُمِرَ بِهِ، فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، حَتَّى أُلْقِيَ فِي النَّارِ.
তুমি মিথ্যা বলেছ! তুমি খরচ করেছ- যাতে তোমাকে দানবীর বলা হয়। তা বলা হয়ে গেছে। অতঃপর তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তাকে টেনে-হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮২৭৭
দুই. হালাল অর্থ থেকে দান করা
দান করতে হয় হালাল সম্পদ থেকে। অন্যথা এই দান কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْفِقُوْا مِنْ طَیِّبٰتِ مَا كَسَبْتُمْ وَ مِمَّاۤ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنَ الْاَرْضِ.
হে মুমিনগণ! তোমরা যা কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৭
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ، وَلاَ يَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ، وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ، كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوّهُ، حَتّى تَكُونَ مِثْلَ الجَبَلِ.
যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ দান করে, -আর আল্লাহ ‘হালাল’ ছাড়া গ্রহণ করেন না- আল্লাহ তা ডান হস্তে গ্রহণ করেন। অতঃপর তা লালন-পালন করে বড় করতে থাকেন। যেমন তোমরা ঘোড়ার বাচ্চা লালন-পালন কর। একপর্যায়ে এই ‘সামান্য দান’ পাহাড়সম হয়ে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪১০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৪
তিন. দান করা উচিত পছন্দের জিনিস থেকে
যা আমি দান করছি তা তো আসলে পরকালের জন্যই আল্লাহর হাতে রেখে দিচ্ছি। বীজের জন্য মানুষ ভালো ফসলটাই রেখে দেয়, যাতে নতুন করে বীজ বোনা যায়। কাজেই মুমিনেরও উচিত, হাতে থাকা সম্পদ থেকে উত্তমটাই আল্লাহর কাছে গচ্ছিত রাখা। নিজের পছন্দের জিনিসটি আল্লাহর পথে খরচ করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰی تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ.
তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু হতে (আল্লার জন্য) ব্যয় করবে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯২
চার. সাধ্য অনুযায়ী অল্প হলেও দান করা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য এক টুকরো খেজুর হলেও দান করতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ.
জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা করো, খেজুরের এক টুকরো (পরিমাণ সদকা করে) হলেও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪১৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৬
মালিক (রহঃ)-এর নিকট রেওয়ায়ত পৌছিয়াছে যে, জনৈক মিসকীন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট আসিয়া কিছু ভিক্ষা চাহিল। তাহার সম্মুখে তখন আঙ্গুর ছিল। আয়েশা (রাঃ) এক ব্যক্তিকে বলিলেন, একটি আঙ্গুর নিয়া ঐ মিসকীনকে দিয়া দাও। লোকটি আশ্চর্যবোধ করিতে লাগিল (মাত্র একটি আঙ্গুর দিতেছেন)। আয়েশা (রাঃ) লোকটির মনোভাব বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, তুমি আশ্চর্যবোধ করিতেছ? এই একটি আঙ্গুর কত অণু পরিমাণ হইবে বলিয়া তুমি মনে কর? মালিক ইবনু আনাস (রহঃ)- মুয়াত্তা মালিক
পাঁচ. দান করতে হয় কল্যাণ ও ন্যায়ের পথে
দান তো করব, কোথায় করব? হাঁ, ইসলাম আমাদের শেখায়- দান করতে হয় এমন খাতে, যেখানে দান করলে অর্থটা কোনো ভালো কাজে খরচ হয়। যার মাধ্যমে দ্বীন-শরীয়ত, ঈমান-আমল বা কোনো দ্বীনী বা মানবিক প্রয়োজন পূরণ হয়। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
নেকী ও আল্লাহভীতির সমস্ত কাজে সবার সাথে সহযোগীতা করো এবং গুনাহ ও সীমালংঘনের কাজে কাউকে সহযোগীতা করো না৷ আল্লাহকে ভয় করো৷ তাঁর শাস্তি বড়ই কঠোর৷ -সূরা মায়িদা (৫) : ২
ছয়. ভারসাম্য রক্ষা করে দান করা
যেসব মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের ইসলাম শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন, ইতিদাল ও ভারসাম্য তার অন্যতম। ইসলাম আমাদেরকে ঈমান-আমল থেকে শুরু করে সকল কর্ম ও আচরণে ভারসাম্য শেখায়
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا.
(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে। -সূরা ইসরা (১৭) : ২৯
অন্যত্র আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় ও জান্নাতী বান্দাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখ করেছেন-
وَ الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَنْفَقُوْا لَمْ یُسْرِفُوْا وَ لَمْ یَقْتُرُوْا وَ كَانَ بَیْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا.
আর ব্যয় করার সময় যারা না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৫৭
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু। দুনিয়াতে থাকতেই বিশেষভাবে যে দশজন সাহাবী জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ লাভ করেছিলেন হযরত সা‘দ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বিদায় হজে¦র সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মুমূর্ষু অবস্থা। নবীজী তার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তাকে দেখতে যান।
নবীজীকে কাছে পেয়ে হযরত সা‘দ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার শারীরিক অবস্থা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। আল্লাহ তাআলা আমাকে বেশ কিছু ধনসম্পদ দান করেছেন। আর সন্তান বলতে মাত্র একটি মেয়েই আমার। আমি চাচ্ছি, আমার সম্পদের তিন ভাগের দুই ভাগ দ্বীনের জন্য খরচ করব, আল্লাহর রাস্তায় সদকা করে দিব। অর্থাৎ পুরো সম্পদের এক ভাগ রেখে বাকি দুই ভাগই তিনি সদকা করে দেবেন। কিন্তু নবীজী এর অনুমতি দিলেন না।
অনুমতি না পেয়ে তিনি আরেকটু কম করে এজাযত চাইলেন। বললেন, তাহলে আমি অর্ধেক সম্পত্তি দান করার ওসিয়ত করি আর অর্ধেকটা রেখে দিই? নবীজী এরও অনুমতি দিলেন না।
এবার তিনি আরো কম করে অনুমতি চাইলেন। বললেন, তাহলে আমার মোট সম্পত্তির তিন ভাগের এক ভাগ দ্বীনের জন্য ওসিয়ত করে যাই আর মেয়ের জন্য দুই তৃতীয়াংশ রেখে যাই? নবীজী এখন কিছুটা সম্মত হলেন। বললেন-
وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ.
আচ্ছা, তিন ভাগের এক ভাগ দিতে চাও! ঠিক আছে, দিতে পার। কিন্তু তিন ভাগের এক ভাগও অনেক।
এরপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পদ ব্যয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন মুমিন কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবে, সেই নীতি সুস্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন। নবীজী বললেন-
إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ، وَلَسْتَ تُنْفِقُ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ بِهَا، حَتَّى اللُّقْمَةَ تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ.
তুমি তোমার সন্তান-সন্ততিকে দরিদ্র অবস্থায় রেখে যাবে আর তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এরচে’ অনেক উত্তম হচ্ছে তাদেরকে সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়া। আর তুমি যে খরচই কর না কেন, তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে তবে আল্লাহ তোমাকে সওয়াব দান করবেন। এমনকি একটি লোকমা, যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দাও। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪০৯)
সাত. দান গোপনে করতে পারলেই বেশি ভালো
দান করব এমন চুপে চুপে, যাতে কোনো ধরনের আত্মমুগ্ধতা বা আত্মপ্রচারের শিকার হতে না হয়। ডান হাত দান করবে তো বামহাতও যেন টের না পায়। হাদীসে এসেছে, সাত ধরনের ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন। তার মধ্যে অন্যতম হল-
وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ.
যে এমনভাবে দান করে যে, ডানহাতে দান করলে বামহাতও টের পায় না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪২৩
তবে হাঁ, কখনো গোপনে দান করার চেয়ে প্রকাশ্যে দানের মধ্যেও নিহিত থাকে অনেক কল্যাণ। যেমন দানের মাধ্যমে অন্যদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। এটাও যে দানের একটা গুরুত্বপূর্ণ খাত, সেদিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ইত্যাদি। প্রকাশ্যে দান করা মানেই মন্দ নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
اِنْ تُبْدُوا الصَّدَقٰتِ فَنِعِمَّا هِیَ وَ اِنْ تُخْفُوْهَا وَ تُؤْتُوْهَا الْفُقَرَآءَ فَهُوَ خَیْرٌ لَّكُمْ.
তোমরা দান-সদকা যদি প্রকাশ্যে দাও, সেও ভালো আর যদি তা গোপনে গরীবদেরকে দান কর তবে তা তোমাদের পক্ষে কতই না শ্রেয়! -সূরা বাকারা (২) : ২৭১
আট. প্রকৃত হকদারকে দান করা
দান করতে হয় নিজ দায়িত্বে অভাবীদেরকে খুঁজে খুঁজে।কুরআনে কারীমে কত চমৎকারভাবে তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে-
یَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِیَآءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِیْمٰىهُمْ لَا یَسْـَٔلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًا.
তারা যেহেতু অতি সংযমী হওয়ার কারণে কারো কাছে সওয়াল করে না, তাই অনবগত লোকে তাদেরকে বিত্তবান মনে করে। তোমরা তাদের চেহারার আলামত দ্বারা তাদেরকে (অর্থাৎ তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা) চিনতে পারবে। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৩
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَيْسَ المِسْكِينُ الَّذِي يَطُوفُ عَلَى النَّاسِ تَرُدُّهُ اللُّقْمَةُ وَاللُّقْمَتَانِ، وَالتَّمْرَةُ وَالتَّمْرَتَانِ، وَلَكِنِ المِسْكِينُ الَّذِي لاَ يَجِدُ غِنًى يُغْنِيهِ، وَلاَ يُفْطَنُ بِهِ، فَيُتَصَدَّقُ عَلَيْهِ وَلاَ يَقُومُ فَيَسْأَلُ النَّاسَ.
এক-দুই লোকমা খাবার বা এক-দুইটি খেজুরের জন্য যে মানুষের দ্বারে দ্বারে ধরনা দেয়- অভাবী তো সে নয়; প্রকৃত অভাবী হল, যার অভাব আছে, কিন্তু তাকে দেখে তার অভাব আঁচ করা যায় না; যার ভিত্তিতে মানুষ তাকে দান করবে। আবার চক্ষুলজ্জায় সে মানুষের দুয়ারে হাতও পাততে পারে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৭৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩৯
নয়. নিকটবর্তী লোকদের দান করা
দানের আরেকটি নিয়ম হল নিজের নিকটাত্মীয়দের আগে দান করা। এতে একদিকে যেমন সদাকার সওয়াব পাওয়া যায়, একইসাথে আত্মীয়তার হকও আদায় হয়ে যায়। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং একে দ্বিগুণ সওয়াব লাভের মাধ্যম বলেছেন। তিনি বলেছেন-
الصَّدَقَةُ عَلَى الْمِسْكِينِ صَدَقَةٌ، وَهِيَ عَلَى ذِي الرَّحِمِ ثِنْتَانِ: صَدَقَةٌ وَصِلَةٌ.
মিসকীনকে দান করলে কেবল দান করার সওয়াব লাভ হয়। আর আত্মীয়-স্বজনকে দান করলে দুটি সওয়াব- দান করার সওয়াব এবং আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৬৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬২৩৩
দশ. খোঁটা বা অন্য কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে দান-অনুদান নষ্ট করে দিব না
দান যাকেই করা হোক, দানের পরে খোঁটা দিতে নেই। অন্যথা সেটি পরকালে দানকারীর জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না। বানে ভেসে যাওয়া খড়-কুটোর মতো হারিয়ে যাবে। এককথায় ওই দানের মাধ্যমে সওয়াবের কোনো আশা করা যায় না। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی كَالَّذِیْ یُنْفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤْمِنُ بِاللهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ فَمَثَلُهٗ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَیْهِ تُرَابٌ فَاَصَابَهٗ وَابِلٌ فَتَرَكَهٗ صَلْدًا لَا یَقْدِرُوْنَ عَلٰی شَیْءٍ مِّمَّا كَسَبُوْا.
হে মুমিনগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে সেই ব্যক্তির মত নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এরকম- যেমন এক মসৃণ পাথরের উপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা (সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং) সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুমাত্র তারা হস্তগত করতে পারে না। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৪
দান বা পরোপকার করে যদি খোঁটা দেয়া হয়, সেটি আমলের মধ্যে ইখলাসশূন্যতা অথবা কিছুটা হলেও কমতির দিকে ইঙ্গিত বহন করে। কারণ খোঁটা তখনই আসে যখন দান বা পরোপকারের পিছনে লুকায়িত থাকে পার্থিব কোনো স্বার্থ বা প্রাপ্তির আশা। কিন্তু সেই আশার অনুরূপ যখন ফল পাওয়া গেল না, তখন সৃষ্টি হয় এক ধরনের হতাশা ও ক্ষোভ। আর সেখান থেকেই খোঁটা দেওয়া।
আরেকটি বিষয়, খোঁটা দেওয়া দ্বারা নিজের দান-সদকা বা পরোপকারের সওয়াবই নষ্ট হয়, কেবল তা নয়; এটি কঠিন পাপও বটে, যার দ্বারা উপকৃত ব্যক্তির অন্তরে আঘাত দেয়া হয়। হাদীসে প্রকৃত মুসলিম বলা হয়েছে, যার হাত ও মুখ থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে।
কাজেই দান করে খোঁটা দেওয়ার মত বোকামি কখনো করব না।
এগার. দান করব স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত হয়ে
কথায় আছে, ‘সদকায় বলা দূর।’ হাদীস শরীফেও এসেছে, নিশ্চয় সদাকা আল্লাহর ক্রোধকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। তাই বলে কি কেবল বিপদে যখন পড়ব তখনই দান-সদকা করব? না, ইসলামের শিক্ষা হল, দান কর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সবসময় সর্বাবস্থায়। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন-
الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ.
যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল (সর্বাবস্থায় আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে…। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৪
প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, কখন দান করা উত্তম? তিনি ইরশাদ করলেন-
أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ شَحِيحٌ، أَوْ صَحِيحٌ، تَأْمُلُ الْعَيْشَ، وَتَخْشَى الْفَقْرَ، وَلَا تُمْهِلْ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بِالْحُلْقُومِ، قُلْتَ: لِفُلَانٍ كَذَا، وَلِفُلَانٍ كَذَا، وَقَدْ كَانَ.
যখন তুমি (অতি প্রয়োজন বা লোভের কারণে) মাত্রাতিরিক্ত মিতব্যয়ী বা হাড়কিপটে হও এবং সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা কর, অথবা যখন তুমি সুস্থাবস্থায় দীর্ঘায়ুর প্রত্যাশা কর তখন সদকা করা। এত দেরি করো না যে, মৃত্যু এসে যায় আর তখন তুমি (ওসিয়ত করে) বলছ- আমার সম্পদগুলো অমুকের জন্য, অমুকের জন্য! অথচ (তুমি না বললেও) তা তাদের জন্য হয়েই আছে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৭৬৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৭০৬
বার. দান করতে হয় নিজের প্রয়োজনে নিজ দায়িত্বে
ইসলামের দৃষ্টিতে দান করতে হয় নিজের প্রয়োজনে। দানের মাধ্যমে গ্রহীতার প্রতি অনুগ্রহ করা হচ্ছে- এমনটি নয় কখনো; বরং তার প্রাপ্য ও অধিকারটাই তাকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وَ الَّذِیْنَ فِیْۤ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَّعْلُوْمٌ لِّلسَّآىِٕلِ وَ الْمَحْرُوْمِ.
আর যাদের সম্পদে নির্ধারিত ‘হক’ (অধিকার) রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের। -সূরা মাআরিজ (৭০) : ২৪-২৫
অর্থাৎ কুরআনে কারীমে একে তাদের ‘হক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে
সুতরাং দানকারীর মানসিকতা থাকবে, দান করছি নিজের প্রয়োজনে। গ্রহীতা ‘দান’টা গ্রহণ করে কেমন যেন আমার প্রতিই এক ধরনের করুণা করল! সংগৃহিত অংশঃ দান-অনুদান : যে বিষয়গুলো লক্ষ রাখা জরুরি(মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম)
কতটুকু সম্পদ থাকলে দান করবে?
সাহাবায়ে কেরাম নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করতেন-তারা কোন্ সম্পদ দান করবে? এ প্রশ্নটি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন-
وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ مَا ذَا یُنۡفِقُوۡنَ ۬ؕ قُلِ الۡعَفۡوَؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ تَتَفَکَّرُوۡنَ
লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘(আল্লাহর পথে) তারা কী খরচ করবে?’ বল, ‘যা উদ্বৃত্ত। এভাবে আল্লাহ তাঁর সকল নিদর্শন তোমাদের জন্য প্রকাশ করেন যাতে তোমরা চিন্তা কর। -সূরা বাকারা (২) : ২১৯
কথা সহজ-প্রথমে নিজের এবং নিজের পরিবারস্থ প্রতিপাল্য যারা তাদের হক আদায় করো। এরপর যদি কিছু সম্পদ হাতে থেকে যায়, সেখান থেকে দান করো অভাবী-অসহায়দের, শরীক থাকো কল্যাণকর কাজে। মনে রাখতে হবে-নফল ও ঐচ্ছিক এ দানের জন্যে কিছুতেই ফরয ও অবধারিত হক লঙ্ঘন করা যাবে না। ভারসাম্যের এ পথে যে দান, সেটাই সেরা দান।
কখন দান করবে?
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের আমি যা দিয়েছি তা থেকে দান করো সেই দিন আসার আগে, যেদিন কোনো রকম বেচাকেনা, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৫৪)
‘আমার ঈমানদার বান্দাহদের বলে দাও,তারা যেন নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে যেন খরচ করে,গোপনে অথবা প্রকাশ্যে, সেই দিন আসার আগেই যেদিন কোন কেনা বেচার সুযোগ থাকবে না, যেদিন কোন বন্ধুত্ব কাজে আসবে না। (ইবরাহীম ৩১)
সময় থাকতেই দান করতে হয়।
“একজন লোক এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললো, ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দান সওয়াবের দিক থেকে বড়? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যখন তুমি সুস্থ থাকো, সম্পদের প্রতি লোভ থাকে, তুমি দারিদ্রের ভয় করো এবং ধনী হওয়ার আশা রাখো, সেই সময়ের দান। সুতরাং তুমি দান করার জন্য মৃত্যু আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেনা। তখন তো তুমি বলবে এই সম্পদ অমুকের জন্য, এই সম্পদ অমুকের জন্য, অথচ তখন তো সম্পদ অমুকের হয়েই গেছে।” (সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ১৩৩০)
সংগ্রহে–
তাফসিরে যাকারিয়া,তাফহিমুল কুর’আন, আহসানুল বায়ান