সুরা বাকারাঃ ৩৫তম রুকু (২৫৮-২৬০)আয়াত

 সুরা বাকারাঃ ৩৫তম রুকু (২৫৮-২৬০)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:২৫৮ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡ حَآجَّ اِبۡرٰهٖمَ فِیۡ رَبِّهٖۤ اَنۡ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الۡمُلۡکَ ۘ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ رَبِّیَ الَّذِیۡ یُحۡیٖ وَ یُمِیۡتُ ۙ قَالَ اَنَا اُحۡیٖ وَ اُمِیۡتُ ؕ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ فَاِنَّ اللّٰهَ یَاۡتِیۡ بِالشَّمۡسِ مِنَ الۡمَشۡرِقِ فَاۡتِ بِهَا مِنَ الۡمَغۡرِبِ فَبُهِتَ الَّذِیۡ کَفَرَ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿

২৫৮. আপনি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখেননি, যে ইবরাহীমের সাথে তার রব সম্বন্ধে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল, যেহেতু আল্লাহ তাকে রাজত্ব দিয়েছিলেন। যখন ইবরাহীম বললেন, “আমার রব তিনিই যিনি জীবনদান করেন ও মৃত্যু ঘটান, সে বলল, আমিও তো জীবন দান করি ও মৃত্যু ঘটাই। ইবরাহীম বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদয় করান, তুমি সেটাকে পশ্চিম দিক থেকে উদয় করাও তো। তারপর যে কুফরী করেছিল সে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। আর আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না।

তাওহিদের কথা আয়াতুল কুরসী এরপর যারা এই তাওহীদ ধারন করে তার অবস্থা বলা হয়েছে, এখন উদাহরন হিসেবে ইবরাহীম আ এর কথা এসেছে ।

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) ছিলেন হযরত নূহ (আঃ)-এর সম্ভবত: এগারোতম অধঃস্তন পুরুষ। নূহ থেকে ইবরাহীম পর্যন্ত প্রায় ২০০০ বছরের ব্যবধান ছিল। হযরত ছালেহ (আঃ)-এর প্রায় ২০০ বছর পরে ইবরাহীমের আগমন ঘটে। ঈসা থেকে ব্যবধান ছিল ১৭০০ বছর অথবা প্রায় ২০০০ বছরের।

ইবরাহীম আ এর মাতৃভূমি ইরাকের বাদশাহ নমরুদ।

এখানে তখন কালেডীয় (كلدانى ) জাতি বসবাস করত। তাদেরই একচ্ছত্র সম্রাট ছিলেন নমরূদ। যিনি তৎকালীন পৃথিবীতে অত্যন্ত উদ্ধত ও অহংকারী সম্রাট ছিলেন। তিনি প্রায় চারশো বছর রাজত্ব করেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজে ‘উপাস্য’ হবার দাবী করেন। আল্লাহ তারই মন্ত্রী ও প্রধান পুরোহিত ‘আযর’-এর ঘরে বিশ্বনেতা ও বিশ্ব সংস্কারক নবী ইবরাহীমকে মুখ্যত: কালেডীয়দের প্রতি প্রেরণ করেন। ইবরাহীমের নিজ পরিবারের মধ্যে কেবল সহধর্মিনী ‘সারা’ ও ভ্রাতুষ্পুত্র ‘লূত’ মুসলমান হন।

মহান আল্লাহ কল্পনা করতে বলছেন সেই রোমহর্ষক ঘটনার কথা, যখন নবী ইব্রাহিম আ তখনকার প্রতাপশালী রাজা নমরুদ-এর দরবারে গিয়ে তার মুখের উপর তাকে রাব্ব বলে মানতে অস্বীকার করেছিলেন। রাজা নমরুদ নিজের বিশাল রাজত্ব এবং ক্ষমতায় এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে, সে নিজেকে ক্ষমতার মালিক এককভাবে বলে দাবি করতো। যেখানে এরকম একজন ফিরাউন টাইপের রাজা, তার মন্ত্রীসভা, দেহরক্ষী, লোকবল নিয়ে সভার একদিকে বসে আছে, আর অন্যদিকে প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন নবী ইব্রাহিম আ । তিনি একা সেই অহংকারী প্রতাপশালী রাজার সামনে দাঁড়িয়ে তার ভুল ধরিয়ে দিচ্ছেন, যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করছেন যে, রাজা যা দাবি করছে তা ভুল।

এটা এতটাই সাহসিকতার একটি ঘটনা যে, আল্লাহ কুর’আনে বলছেন, “তুমি কি ওকে দেখনি?” — অর্থাৎ একবার সেই দৃশ্যের কথা চিন্তা করো। আমাদের অবস্থান কোথায় একটু ভাবা প্রয়োজন!!!!

তারিক ইব্‌ন শিহাব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করলো, আর তখন তিনি তাঁর পদদ্বয় ঘোড়ার পাদানীতে রেখেছিলেন, কোন জিহাদ সর্বোত্তম? তিনি বললেনঃ অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা। সুনানে আন-নাসায়ী৪২০৯ হাদিসের মানঃ সহিহ হাদিস

আবু সাঈদ(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ তোমাদের কেউ যেন নিজেকে অপমানিত না করে। সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কেউ নিজেকে কিভাবে অপমানিত করতে পারে? তিনি বলেনঃ সে কোন বিষয়ে আল্লাহর বিধান অবহিত থাকা সত্ত্বেও তার পরিপন্থী কিছু হতে দেখেও সে সম্পর্কে কিছুই বললো না। কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তাকে বলবেনঃ অমুক অমুক ব্যাপারে কথা বলতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছিলো? সে বলবে, মানুষের ভয়। তখন আল্লাহ বলবেনঃ আমাকে তো তোমার ভয় করা উচিত ছিলো।[মুসনাদ আহমাদ ১১০৪৮, ১১৩০২, ১১৪৫৫, সুনান ইবন মাজাহ ৪০০৮]

নমরূদের সঙ্গে বিতর্ক ও অগ্নিপরীক্ষা : আরবীতে جِدَال (জিদাল) অর্থ হ’ল ঝগড়া, বিবাদ, তর্ক-বিতর্ক, কলহ ইত্যাদি। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে প্রতিহত করে নিজের কথা সত্য প্রমাণ করা। আবু ইয়ালা বলেন, বিতর্ক হ’ল পক্ষ-বিপক্ষ উভয়ের মাঝে কথার বিনিময় হওয়া এবং এর দ্বারা একে অপরের উপর বিজয়ী হওয়ার দৃঢ় ইচ্ছা থাকা’। কাযী আবু ইয়া‘লা, আল-ইদ্দাহ ফী উছূলিল ফিক্বহ ১/১৮৪ পৃ.।

আরবীতে বিতর্কের আরেকটি প্রতিশব্দ হ’ল مِرَاء (মিরা)। অনেকে বলেন, উভয় শব্দের অর্থ একই। তবে মিরা হ’ল নিন্দনীয় বিতর্ক। কারণ এটি হ’ল, হক প্রকাশ পাওয়ার পরও তা নিয়ে অনর্থক বিতর্ক করা। তবে ‘জিদাল’ এ রকম নয়। কখনও এটি ভাল অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পবিত্র কুরআনে ২৯ জায়গায় ‘জিদাল’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে’।ড. সাইয়েদ আলী খিযির, আল-হিওয়ার ফিস সীরাতিন নাবী, ১৮ পৃ.।

তন্মধ্যে মাত্র কয়েকটি জায়গা ব্যতীত বাকী জায়গায় মন্দ অর্থে এসেছে। মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ، ‘তোমরা কিতাবধারীদের সঙ্গে বিতর্ক করবে না উত্তম পন্থা ব্যতীত’ (আনকাবূত ২৯/৪৬)

বিতর্কের নানা কারণ রয়েছে। তনমধ্যে দু’টি কারণ উল্লেখযোগ্য। যেমন-

১. নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।

২. সত্যকে মিটিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। যেমন- মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا نُرْسِلُ الْمُرْسَلِينَ إِلَّا مُبَشِّرِيْنَ وَمُنْذِرِيْنَ وَيُجَادِلُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا بِالْبَاطِلِ لِيُدْحِضُوا بِهِ الْحَقَّ وَاتَّخَذُوا آيَاتِي وَمَا أُنْذِرُوا هُزُوًا ‘অথচ আমরা রাসূলগণকে প্রেরণ করে থাকি কেবল জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে। আর অবিশ্বাসীরা মিথ্যা দিয়ে ঝগড়া করে সত্যকে মিটিয়ে দেওয়ার জন্য এবং তারা আমার আয়াতসমূহকে ও যে শাস্তির ভয় তাদের দেখানো হয় সেগুলিকে ঠাট্টার বস্ত্তরূপে গ্রহণ করে’ (কাহাফ ১৮/৫৬)।

হিকমতের সাথে দাওয়াত দিবে। প্রজ্ঞাহীনকে হিকমতের সাথে আহ্বান করতে হবে। আল্লাহর পথে দাওয়াত শুরু করতে হবে হিকমতের সাথে, অতঃপর সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে, তারপরে জালিম ব্যতীত অন্যান্যদের সাথে উত্তম পন্থায় বিতর্ক করে। তাহলে চারটি স্তরে দাওয়াত দিতে হবে।

﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥ ﴾ [النحل: ١٢٥]

“তুমি তোমরা রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর এবং সুন্দরতম পন্থায় তাদের সাথে বিতর্ক কর। নিশ্চয় একমাত্র তোমার রবই জানেন কে তার পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং হিদায়াতপ্রাপ্তদের তিনি খুব ভাল করেই জানেন”। [সূরা: আন-নাহাল: ১২৫]

অন্যত্র আল্লাহ যখন মূসা (আঃ) এবং তাঁর ভাই হারূন (আঃ)-কে ফের‘আউনের কাছে প্রেরণ করেছিলেন, তখন তিনি তাঁদেরকে বলে দিয়েছিলেন, فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى، ‘অতঃপর তার সাথে নরমভাবে কথা বল। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৪)।

ইবরাহীম (আঃ) এটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করলেন। নমরূদ ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করায় সে উদ্ধত ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল এবং নিজেকে একমাত্র উপাস্য ভেবেছিল। তাই সে ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করল, বল তোমার উপাস্য কে? নমরূদ ভেবেছিল, ইবরাহীম তাকেই উপাস্য বলে স্বীকার করবে। কিন্তু নির্ভীক কণ্ঠে ইবরাহীম জবাব দিলেন,

رَبِّيَ الَّذِيْ يُحْيِـيْ وَيُمِيْتُ ‘আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি মানুষকে বাঁচান ও মারেন’।

মোটাবুদ্ধির নমরূদ বলল,  أَنَا أُحْيِـيْ وَأُمِيْتُ ‘আমিও বাঁচাই ও মারি’। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে খালাস দিয়ে মানুষকে বাঁচাতে পারি। আবার খালাসের আসামীকে মৃত্যুদন্ড দিতে পারি। এভাবে সে নিজেকেই মানুষের বাঁচা-মরার মালিক হিসাবে সাব্যস্ত করল।

ইবরাহীম তখন দ্বিতীয় যুক্তি পেশ করে বললেন, فَإِنَّ اللهَ يَأْتِيْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ  ‘আমার আল্লাহ সূর্যকে পূর্ব দিক থেকে উদিত করেন, আপনি তাকে পশ্চিম দিক হ’তে উদিত করুন’। فَبُهِتَ الَّذِيْ كَفَرَ ‘অতঃপর কাফের (নমরূদ) এতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো’ (বাক্বারাহঃ ২৫৮)।

নবী ইব্রাহিম আ যখন নমরুদকে বললেন যে, তিনি এমন একজনকে রব্ব মানেন, যিনি জীবন মৃত্যুর মালিক, তখন নমরুদ নিজেকে জীবন মৃত্যুর মালিক বলে দাবি করলো। নবী ইব্রাহিম আ তখন কিন্তু বলতে পারতেন, “কই? কাউকে জন্ম দিয়ে দেখাও দেখি?” কিন্তু তিনি সেটা না করে বরং অন্য একটা যুক্তি উপস্থাপন করলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি অন্য প্রশ্ন করলেন? কেন তিনি আগের যুক্তির ধারাবাহিকতা ধরে রেখে তর্ক করে গেলেন না?

নমরুদ যখন নিজেকে জন্ম মৃত্যুর মালিক বলে দাবি করলো, তখন সে জন্ম মৃত্যু দেওয়াকে নিজের মত বুঝে নিয়ে একজনকে মেরে ফেলে অবশ্যই নবী ইব্রাহিম আ জীবন মৃত্যুর মালিক বলতে এটা বোঝাননি। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করলেন যে, এভাবে তর্ক করে হবে না। নমরুদ তার তর্ককে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলার মত ভয়ংকর কাজ করতেও দ্বিধা বোধ করছে না। নমরুদ তর্ককে কুতর্কে পরিণত করছে। তখন তিনি এমন একটি যুক্তি উপস্থাপন করলেন, যা নিজের ইচ্ছেমত বুঝে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে। বিতর্ক করার সময় প্রতিপক্ষকে সুযোগ দেওয়া যাবে না, যেন সে নিজের ইচ্ছেমত তর্কের বিষয়কে তার সুবিধামত ঘুরিয়ে নিতে পারে। তর্ক করতে হবে এমন সব বিষয়ে, এমন সব যুক্তি দিয়ে, যা সবাই বুঝতে পারে কী বোঝাচ্ছে, এবং যা নিজের সুবিধামত ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব না। নমরুদ যা করেছিল, তাকে বলে Argumentum Ad Baculum — প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য জোর পূর্বক ক্ষমতা, হুমকি, ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়ে নিজের পছন্দ মত উপসংহারে পৌঁছে যাওয়া। এতে করে প্রতিপক্ষ ঘাবড়ে যায়, তার চিন্তার ধারা ভেঙ্গে যায়। আর সে ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারে না। এটা মানুষ তখনি কাজে লাগায়, যখন সে জানে তার কাছে জেতার মত যথেষ্ট প্রমাণ বা যুক্তি নেই। তখন সে ভয়ংকর কিছু একটা করে তর্কে জিতে জেতে চায়।

কওমের নেতারাই যেখানে পরাজয়কে মেনে নেয়নি, সেখানে দেশের একচ্ছত্র সম্রাট কেন পরাজয়কে মেনে  নিবেন। যথারীতি তিনিও অহংকারে ফেটে পড়লেন এবং ইবরাহীমকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার নির্দেশ  জারি করলেন। সাথে সাথে জনগণকে ধর্মের  দোহাই দিয়ে বললেন,

حَرِّقُوهُ وَانصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنتُمْ فَاعِلِيْنَ ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ ( সূরা আম্বিয়াঃ ৬৮)।

উল্লেখ্য যে, কুরআন কোথাও নমরূদের নাম উল্লেখ করেনি এবং সে যে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ উপাস্য’ দাবী করেছিল, এমন কথাও স্পষ্টভাবে বলেনি। তবে ‘আমিও বাঁচাতে  পারি ও মারতে পারি’ (সূরা বাক্বারাহঃ ২৫৮) তার এই কথার মধ্যে তার সর্বোচ্চ অহংকারী হবার এবং ইবরাহীমের ‘রব’-এর বিপরীতে নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করায় সে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ রব’ হিসাবে ধারণা করেছিল বলে প্রতীয়মান হয়। প্রধানত: ইস্রাঈলী বর্ণনাসমূহের উপরে ভিত্তি করেই ‘নমরূদ’-এর নাম ও তার রাজত্ব সম্পর্কে জানা যায়। কুরআন কেবল অতটুকুই বলেছে, যতটুকু মানব জাতির হেদায়াতের জন্য প্রয়োজন।

যুক্তিতর্কে হেরে গিয়ে নমরূদ ইবরাহীম (আঃ)-কে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুকুম দিল। অতঃপর তার জন্য বিরাটাকারের আয়োজন শুরু হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন,

وَأَرَادُوْا بِهِ كَيْداً فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَخْسَرِيْنَ، ‘তারা ইবরাহীমের বিরুদ্ধে মহা ফন্দি আঁটতে চাইল। অতঃপর আমরা তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৭০)।

মহান আল্লাহ বলেন, فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِينَ، ‘আমরা তাদেরকে পরাভূত করে দিলাম’ (সাফফাতঃ৯৮)।

অতঃপর ‘একটা ভিত নির্মাণ করা হ’ল এবং সেখানে বিরাট অগ্নিকুন্ড তৈরী করা হ’ল। তারপর সেখানে তাকে নিক্ষেপ করা হ’ল’ (সাফফাত ৩৭/৯৭)। ছহীহ বুখারীতে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপের সময় ইবরাহীম (আঃ) বলে ওঠেন, حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক। .বুখারী, হা/৪৫৬৩ তাফসীর অধ্যায়, সূরা আলে-ইমরান । একই প্রার্থনা শেষনবী মুহাম্মাদ (সা) করেছিলেন, ওহোদ যুদ্ধে আহত মুজাহিদগণ যখন শুনতে পান যে, আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে না গিয়ে পুনরায় ফিরে আসছে মদীনায় মুসলিম শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, তখন ‘হামরাউল আসাদে’ উপনীত তার পশ্চাদ্ধাবনকারী ৭০ জন আহত সাহাবীর ক্ষুদ্র দল রাসূলের সাথে সমস্বরে বলে উঠেছিল حَسْبُنَا اللّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيْلُ، ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি কতই না সুন্দর তত্ত্বাবধায়ক’ ঘটনাটি কুরআনেও বর্ণিত হয়েছে’। আলে ইমরানঃ১৭৩; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৮৬।

এভাবে পিতা ইবরাহীম ও পুত্র মুহাম্মাদের বিপদ মুহূর্তের বক্তব্যে শব্দে শব্দে মিল হয়ে যায়। তবে সার্বিক প্রচেষ্টার সাথেই কেবল উক্ত দোআ পাঠ করতে হবে। নইলে কেবল দো‘আ পড়ে নিষ্ক্রিয় বসে থাকলে চলবে না। যেমন ইবরাহীম (আঃ) সর্বোচ্চ পর্যায়ে দাওয়াত দিয়ে চূড়ান্ত বিপদের সময় এ দো‘আ করেছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) বিরোধী পক্ষের সেনাপতি আবু সুফিয়ানের পশ্চাদ্ধাবনের পরেই উক্ত দোআ পড়েছিলেন।

বস্ত্ততঃ এই কঠিন মুহূর্তের পরীক্ষায় জয়লাভ করার পুরস্কার স্বরূপ সাথে সাথে আল্লাহর নির্দেশ এল قُلْنَا يَا نَارُ كُونِيْ بَرْداً وَّسَلاَماً عَلَى إِبْرَاهِيمَ، ‘হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৯)। অতঃপর ইবরাহীম মুক্তি পেলেন।

অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইবরাহীম (আঃ) ফিরে আসেন এবং এভাবে আল্লাহ কাফিরদের সমস্ত কৌশল বরবাদ করে দেন। এরপর শুরু হ’ল জীবনের আরেক অধ্যায়।

পৃথিবীতে প্রথম ঔদ্ধত্য প্রদর্শনকারী ছিল নমরূদ। সে-ই আসমান অভিমুখে টাওয়ার নির্মাণ করেছিল। আল্লাহ তাকে শায়েস্তা করার জন্য একটি মশা পাঠান। সেটি তার নাকে প্রবেশ করে। মশার জ্বালা থেকে বাঁচার জন্য তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হত। তার রাজত্ব ছিল চারশত বছর। সে যেমন চারশত বছর পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিল তেমনি আল্লাহ তাকে চারশত বছর এই আযাবে রাখেন। অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৮৭৮)

আমি কারূন, ফিরাউন ও হামানকে ধ্বংস করেছিলাম। মূসা তাদের কাছে উজ্জ্বল নিদর্শন নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা ভূমিতে দম্ভ করল, তারা আমার শাস্তি এড়াতে পারেনি। তাদের প্রত্যেককেই আমি তার পাপের কারণে পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচন্ড ঝটিকা, কাউকে আঘাত করেছিল মহানাদ, কাউকে আমি ধসিয়ে দিয়েছিলাম ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের প্রতি কোন যুলুম করেননি; তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি যুলুম করেছিল। …আমি মানুষের কল্যাণার্থে এসব দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকি, কিন্তু জ্ঞানী ব্যক্তিরাই কেবল তা বুঝে। (আনকাবুত ২৯: ৩৯-৪০, ৪৩)

আখেরাতে যালেমের পরিণতি :

فلا تحسبن الله غافلا عما يعمل الظالمون إنما يؤخرهم ليوم تشخص فيه الأبصار، مهطعين مقنعي رؤوسهم لا يرتد إليهم طرفهم و أفئدتهم هواء…. وترى المجرمين يومئذ مقرنين في الأصفاد، سرابيلهم من قطران …

তুমি কিছুতেই মনে করো না যালিমরা যা-কিছু করছে আল্লাহ সে সম্পর্কে বেখবর। তিনি তো তাদেরকে সেই দিন পর্যস্ত অবকাশ দিচ্ছেন, যে দিন চক্ষুসমূহ থাকবে বিস্ফারিত। ভীত-বিহবল চিত্তে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা ছোটাছুটি করবে। নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে উদাস। …সেদিন তুমি অপরাধীদের দেখবে শৃঙ্খলিত অবস্থায়। তাদের জামা হবে আলকাতরার আর আগুন তাদের মুখমন্ডল আচ্ছন্ন করবে। … এটা এজন্য যে, আল্লাহ প্রত্যেকের কৃতকর্মের প্রতিফল দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণ করেন। এটা মানবজাতির জন্য এক বার্তা, যাতে এর দ্বারা তারা সতর্ক হয় এবং জানতে পারে যে, তিনি একমাত্র ইলাহ এবং যাতে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে।  (ইবরাহীম ১৪ : ৪২,৪৩, ৪৯-৫২)

وَقُلِ الْحَقُّ مِن رَّبِّكُمْ فَمَن شَاء فَلْيُؤْمِن وَمَن شَاء فَلْيَكْفُرْ إِنَّا أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَاراً أَحَاطَ بِهِمْ سُرَادِقُهَا وَإِن يَسْتَغِيثُوا يُغَاثُوا بِمَاء كَالْمُهْلِ يَشْوِي الْوُجُوهَ بِئْسَ الشَّرَابُ وَسَاءتْ مُرْتَفَقاً }الكهف

বলে দাও, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তো সত্য এসে গেছে। এখন যার ইচ্ছা ঈমান আনুক এবং যার ইচ্ছা কুফর অবলম্বন করুক। আমি যালেমদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করে রেখেছি, যার প্রাচীর তাদেরকে বেষ্টন করে রাখবে। তারা পানি চাইলে তাদেরকে তেলের তলানী সদৃশ পানি দেয়া হবে, যা তাদের চেহারা ঝলসে দেবে। কতই না মন্দ সে পানীয় এবং কতই না নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল! (কাহ্ফ ১৭: ২৯)

 

২:২৫৯ اَوۡ کَالَّذِیۡ مَرَّ عَلٰی قَرۡیَۃٍ وَّ هِیَ خَاوِیَۃٌ عَلٰی عُرُوۡشِهَا ۚ قَالَ اَنّٰی یُحۡیٖ هٰذِهِ اللّٰهُ بَعۡدَ مَوۡتِهَا ۚ فَاَمَاتَهُ اللّٰهُ مِائَۃَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهٗ ؕ قَالَ کَمۡ لَبِثۡتَ ؕ قَالَ لَبِثۡتُ یَوۡمًا اَوۡ بَعۡضَ یَوۡمٍ ؕ قَالَ بَلۡ لَّبِثۡتَ مِائَۃَ عَامٍ فَانۡظُرۡ اِلٰی طَعَامِکَ وَ شَرَابِکَ لَمۡ یَتَسَنَّهۡ ۚ وَ انۡظُرۡ اِلٰی حِمَارِکَ وَ لِنَجۡعَلَکَ اٰیَۃً لِّلنَّاسِ وَ انۡظُرۡ اِلَی الۡعِظَامِ کَیۡفَ نُنۡشِزُهَا ثُمَّ نَکۡسُوۡهَا لَحۡمًا ؕ فَلَمَّا تَبَیَّنَ لَهٗ ۙ قَالَ اَعۡلَمُ اَنَّ اللّٰهَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

২৫৯. অথবা সে ব্যক্তির মত, যে এমন এক জনপদ অতিক্রম করছিল যা তার ছাদের উপর থেকে বিধ্বস্ত ছিল। সে বলল, মৃত্যুর পর কিভাবে আল্লাহ্‌ একে জীবিত করবেন? তারপর আল্লাহ তাকে এক শত বছর মৃত রাখলেন। পরে তাকে পুনজীবিত করলেন। আল্লাহ্ বললেন, ‘তুমি কতকাল অবস্থান করলে?’ সে বলল, ‘একদিন বা একদিনেরও কিছু কম অবস্থান করেছি।‘ তিনি বললেন, বরং তুমি এক শত বছর অবস্থান করেছ। সুতরাং তুমি তোমার খাদ্যসামগ্রী ও পানীয় বস্তুর দিকে লক্ষ্য কর, সেগুলো অবিকৃত রয়েছে এবং লক্ষ্য কর তোমার গাধাটির দিকে। আর যাতে আমরা তোমাকে বানাবো মানুষের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। আর অস্থিগুলোর দিকে লক্ষ্য কর; কিভাবে সেগুলোকে সংযোজিত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই’। অতঃপর যখন তার নিকট স্পষ্ট হলো তখন সে বলল, ‘আমি জানি, নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’।

أَوْ كَالَّذِيْ এর সম্পর্ক হল পূর্বের ঘটনার সাথে। অর্থ হল, তুমি কি (পূর্বের ঘটনার ন্যায়) সেই ব্যক্তির কথা ভেবে দেখনি, যে এমন এক নগরে উপনীত হয়েছিল —। এই লোকটি কে ছিল? এ ব্যাপারে বহু উক্তি বর্ণিত হয়েছে। আর উযায়রের নাম সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কোন কোন সাহাবী ও তাবেয়ীর উক্তিও এ ব্যাপারে উদ্ধৃত হয়েছে। আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। পূর্বের (ইবরাহীম (আঃ) ও নমরূদের) ঘটনা ছিল মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণে এবং এই দ্বিতীয় ঘটনা হল মহান আল্লাহর মৃতকে জীবিত করার মহাশক্তির প্রমাণে। যে সত্তা এই লোকটিকে এবং তার গাধাকে একশ’ বছর পর জীবিত করেছেন, এমন কি তার খাদ্য-পানিও নষ্ট হতে দেননি, সেই মহান সত্তাই কিয়ামতের দিন মানবকুলকে পুনরায় জীবিত করবেন। যিনি একশ’ বছর পর জীবিত করতে পারেন, তাঁর জন্য হাজার বছর পর জীবিত করাও কোন কষ্টকর ব্যাপার নয়।

কথিত আছে যে, যখন উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছিল, তখন কিছুটা বেলা উঠে গিয়েছিল এবং যখন পুনরায় জীবিত হল, তখন সন্ধ্যা হতে কিছুটা বাকী ছিল। এ থেকে সে অনুমান করেছিল যে, আমি যদি গতকাল এসে থাকি, তাহলে এক দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে, আর যদি এটা আজকের ঘটনা হয়, তবে দিনের কিছু অংশ অতিবাহিত হয়েছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হল তার মৃত্যুর উপর একশ’ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে।

অর্থাৎ, বিশ্বাস তো আমার আগেও ছিল। এখন প্রত্যক্ষ দর্শন করে আমার প্রত্যয় ও জ্ঞানে আরো দৃঢ়তা এসেছে এবং তা বর্ধিত হয়েছে।

আয়াতে বর্ণিত উক্ত ব্যক্তি কে, তা নিয়ে মুফাসসিরগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী তিনি হলেন উযাইর (আ.)। আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.) তার তাফসীর গ্রন্থে লিখেন,

اخْتَلَفُوا فِي هَذَا الْمَارِّ مَنْ هُوَ، فَرَوَى ابْنُ أَبِي حَاتِمٍ، عَنْ عِصَامِ بْنِ رَوَّادٍ، عَنْ آدَمَ بْنِ أَبِي إِيَاسٍ، عَنْ إِسْرَائِيلَ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ، عَنْ نَاجِيَةَ بْنِ كَعْبٍ، عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، أَنَّهُ قَالَ: هُوَ عُزَيْرٌ. وَرَوَاهُ ابْنُ جَرِيرٍ عَنْ نَاجِيَةَ نَفْسِهِ، وَحَكَاهُ ابْنُ جَرِيرٍ وَابْنُ أَبِي حَاتِمٍ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ وَالْحَسَنِ وَقَتَادَةَ وَالسُّدِّيِّ وَسُلَيْمَانَ بْنِ بُرَيْدَةَ، وَهَذَا الْقَوْلُ هُوَ الْمَشْهُورُ

‘অতিক্রমকারী কে ছিলেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। আলী (রা.) বলেন, তিনি ছিলেন উযাইর (আ.)। ইবনে আব্বাস (রা.), হাসান বসরি ও কাতাদাহ (রহ.) থেকেও এমনটি বর্ণিত আছে। আর এ মতটিই প্রসিদ্ধ।’ [তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৫২৭]

উযাইর’( উযায়ের রুচি সম্পন্ন ব্যক্তি ﻋُﺰَﻳْﺮ)  বনী ইসরাইলের একজন নেককার ব্যক্তি। তিনি নবী কিনা- তা সাব্যস্ত হয়নি। যদিও প্রসিদ্ধ অভিমত হচ্ছে- তিনি নবী। ইবনে কাছীর ‘বিদায়া নিহায়া’ গ্রন্থে (২/২৮৯) এটাই ব্যক্ত করেছেন।

সুনানে আবু দাউদ গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমি জানি না-তুব্বা কি লানতপ্রাপ্ত; নাকি নয়। আমি জানি না- উযাইর কি নবী; না কি নবী নয়।” [আলবানি হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন]

শাইখ আব্বাদ বলেন:

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথা বলেছেন তাদের (তুব্বা সম্প্রদায়) অবস্থা জানার আগে। যেহেতু এ মর্মে রেওয়ায়েত এসেছে যে, তুব্বা সম্প্রদায় ইসলাম গ্রহণ করেছে। সুতরাং তারা লানতপ্রাপ্ত নয়। পক্ষান্তরে, উযাইর নবী কিনা এ ব্যাপারে কোন রেওয়ায়েত আসেনি।[শরহে আবু দাউদ (২৬/৪৬৮) থেকে সমাপ্ত

তবে তাঁর ক্ষেত্রে ‘আলাইহিস সালাম’ বলতে কোন সমস্যা নেই। যেহেতু তিনি নেককার মানুষ ছিলেন। তাঁর ঘটনা কুরআনে এসেছে। আলেমদের অনেকে তাঁকে নবী হিসেবে গণ্য করেছেন।

আরও জানতে 152887 নং প্রশ্নোত্তর দেখুন।

দুই:

আল্লাহ তাআলা বলেন: “অথবা সে ব্যক্তির মত, যে এমন এক জনপদ অতিক্রম করছিল যা তার ছাদের উপর থেকে বিধ্বস্ত ছিল। সে বলল, মৃত্যুর পর কিভাবে আল্লাহ একে পুনর্জীবিত করবেন? অতঃপর আল্লাহ তাকে একশ বছর মৃত অবস্থায় রাখলেন। তারপর তাকে পুনর্জীবিত করলেন। আল্লাহ বললেন, ‘তুমি কতকাল এভাবে ছিলে?’ সে বলল, একদিন বা একদিনেরও কিছু কম সময়। তিনি বললেন, বরং তুমি একশত বছর অবস্থান করেছ। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে সেগুলো অবিকৃত রয়েছে এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে। আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ, আমি কিভাবে সেগুলোকে সংযুক্ত করি এবং গোশত দ্বারা ঢেকে দেই। অতঃপর যখন তার নিকট স্পষ্ট হলো তখন সে বলে উঠল- ‘আমি জানি, নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান’।[সূরা বাকারা, আয়াত: ২৫৯]

প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী এই ব্যক্তি হচ্ছেন- উযাইর। ইবনে জারির ও ইবনে আবু হাতিম ইবনে আব্বাস, হাসান, কাতাদা, সুদ্দি ও সুলাইমান বিন বুরাইদা থেকে এ অভিমতটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে কাছির বলেন: এই উক্তিটি প্রসিদ্ধ।[তাফসিরে ইবনে কাছির (১/৬৮৭) থেকে সমাপ্ত]

এ সংক্রান্ত মতভেদ জানতে দেখুন ইবনুল জাওযি (১/২৩৩) এর ‘যাদুল মাসির’।

‘বুখতানাসসার’নামক ব্যক্তি উল্লেখিত গ্রামটিকে ধ্বংস করে ফেলার পর ও গ্রামবাসীকে হত্যা করার পর উযাইর সে গ্রাম দিয়ে -প্রসিদ্ধ মতে সেটি বাইতুল মুকাদ্দাস- অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। তখন সে গ্রামটি ছিল বিরান; তাতে কেউ ছিল না। এ গ্রামটি জনবহুল থাকার পর এখন এর যে অবস্থা তা নিয়ে তিনি ভাবতে ভাবতে বললেন: “মৃত্যুর (ধ্বংসের) পর কিভাবে আল্লাহ একে পুনর্জীবিত করবেন?” ধ্বংস ও বিরানতার ভয়াবহতা এবং পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসাকে দুরহ দেখে তিনি এ কথা বলেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: “অতঃপর আল্লাহ তাকে একশ বছর মৃত অবস্থায় রাখলেন।” এর মধ্যে শহরটি আবার পুনর্জীবিত হয়ে উঠেছে, লোকে লোকারণ্য হয়েছে, বনী ইসরাইলগণ এ শহরে ফিরে এসেছে। এরপর আল্লাহ যখন তাকে পুনর্জীবিত করলেন তখন সর্বপ্রথম তার চোখ দুইটিকে জীবিত করলেন যাতে করে সে আল্লাহর সৃজন ক্ষমতাকে দেখতে পায়, কিভাবে আল্লাহ তার দেহকে পুনর্জীবিত করেন। যখন তার গঠন পূর্ণ হল তখন আল্লাহ তাকে বললেন -অর্থাৎ ফেরেশতার মাধ্যমে- ‘তুমি কতকাল এভাবে ছিলে?’ সে বলল, একদিন বা একদিনেরও কিছু কম সময়। তাফসিরকারগণ বলেন: যেহেতু সে মারা গিয়েছিল দিনের প্রথমাংশে; আর তাকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে দিনের শেষাংশে। যখন সে দেখল এখনো সূর্য আছে সে ভেবেছে এটি সে দিনেরই সূর্য। তাই সে বলেছে: “একদিনেরও কিছু কম সময়”“তিনি বললেন, বরং তুমি একশত বছর অবস্থান করেছ। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে সেগুলো অবিকৃত রয়েছে”। বর্ণিত আছে তার সাথে আঙ্গুর, ত্বীন ফল ও শরবত ছিল। সে এগুলোকে যেমন রেখে মারা গিয়েছিল ঠিক তেমনি পেল। কোন পরিবর্তন হয়নি। শরবত নষ্ট হয়নি, আঙ্গুর পচেনি, ত্বীন গন্ধ হয়নি। “এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে”। অর্থাৎ তাকিয়ে দেখ তোমার চোখের সামনে আল্লাহ কিভাবে সেটিকে পুনর্জীবিত করেন। “আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি”। অর্থাৎ পুনর্জীবিত করার পক্ষে প্রমাণ বানাতে চেয়েছি। “হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ, আমি কিভাবে সেগুলোকে সংযুক্ত করি” অর্থাৎ একটি হাড্ডির সাথে অন্য হাড্ডিটি জুড়ে দেই। প্রত্যেকটি হাড্ডিকে স্ব স্থানে স্থাপন করে একটি ঘোড়ার কংকাল বানান; তাতে কোন গোশত ছিল না। এরপর এ হাড্ডির উপর গোশত, স্নায়ু, রগ ও চামড়া পরিয়ে দেন। এ সবকিছু করেছেন উযাইর এর চোখের সামনে। এভাবে যখন তার সামনে সবকিছু পরিষ্কার হলো তখন সে বলে উঠল- ‘আমি জানি, নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাবান’। অর্থাৎ এটি জানি। আমি তা সচক্ষে দেখেছি। আমার যামানার লোকদের মধ্যে আমি এ বিষয়ে সবচেয়ে ভাল জানি।[দেখুন: তাফসিরে ইবনে কাছির (১/৬৮৭-৬৮৯)]আরও জানতে দেখুন 12350 নং ও 132236 নং প্রশ্নোত্তর।

আল্লাহই ভাল জানেন।সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

২:২৬০ وَ اِذۡ قَالَ اِبۡرٰهٖمُ رَبِّ اَرِنِیۡ کَیۡفَ تُحۡیِ الۡمَوۡتٰی ؕ قَالَ اَوَ لَمۡ تُؤۡمِنۡ ؕ قَالَ بَلٰی وَ لٰکِنۡ لِّیَطۡمَئِنَّ قَلۡبِیۡ ؕ قَالَ فَخُذۡ اَرۡبَعَۃً مِّنَ الطَّیۡرِ فَصُرۡهُنَّ اِلَیۡکَ ثُمَّ اجۡعَلۡ عَلٰی کُلِّ جَبَلٍ مِّنۡهُنَّ جُزۡءًا ثُمَّ ادۡعُهُنَّ یَاۡتِیۡنَکَ سَعۡیًا ؕ وَ اعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰهَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ

২৬০. আর যখন ইবরাহীম বলল, “হে আমার রব! কিভাবে আপনি মৃতকে জীবিত করেন আমাকে দেখান, তিনি বললেন, তবে কি আপনি ঈমান আনেন নি? তিনি বললেন, অবশ্যই হ্যাঁ, কিন্তু আমার মন যাতে প্রশান্ত হয়! আল্লাহ্‌ বললেন, তবে চারটি পাখি নিন এবং তাদেরকে আপনার বশীভূত করুন। তারপর সেগুলোর টুকরো অংশ এক এক পাহাড়ে স্থাপন করুন। তারপর সেগুলোকে ডাকুন, সেগুলো আপনার নিকট দৌড়ে আসবে। আর জেনে রাখুন, নিশ্চয় আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহর বৃদ্ধ বয়সে সন্তান লাভের মাধ্যমে আল্লাহ যেভাবে তাদের ঈমান বর্ধিত ও মযবূত করেছিলেন। সম্ভবত: তাতে উৎসাহিত হয়ে ইবরাহীম (আঃ) একদিন আল্লাহর কাছে দাবী করে বসলেন, আপনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করেন, তা আমাকে একটু দেখান, যাতে হৃদয়ে প্রশান্তি আসে। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা অত্র আয়াতে।

আয়াতে বর্ণিত কাহিনীর সার-সংক্ষেপ হচ্ছে এই যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আল্লাহ্ তা’আলার কাছে আরয করলেনঃ আপনি কিভাবে মৃতকে পুনজীবিত করবেন, তা আমাকে প্রত্যক্ষ করান। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করলেনঃ ‘এরূপ আকাংখা ব্যক্ত করার কারণ কি? আমার সর্বময় ক্ষমতার প্রতি কি আপনার আস্থা নেই? ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজের আস্থা বিবৃত করে নিবেদন করলেনঃ আস্থা ও বিশ্বাস তো অবশ্যই আছে। কেননা, আপনার সর্বময় ক্ষমতার নিদর্শন সর্বদা, প্রতি মুহুর্তেই দেখতে পাচ্ছি এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই তার নিজের সত্তা থেকে শুরু করে এ বিশ্ব জাহানের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে এর প্রমাণ দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু মানব প্রকৃতির সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে যে, অন্তরের বিশ্বাস যতই দৃঢ় হোক, চোখে না দেখা পর্যন্ত অন্তরে পূর্ণ প্রশান্তি আসতে চায় না, প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগতে থাকে; এটা কি করে হবে, না জানি এর প্রক্রিয়াটা কেমন?

মনের মাঝে এ ধরনের প্রশ্ন উদয় হওয়ার ফলে পূর্ণ প্রশান্তি লাভ হতে চায় না। নানা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ কারণেই ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম এরূপ নিবেদন করেছিলেন, যাতে মৃত ব্যক্তিকে জীবিতকরণঃ সংক্রান্ত চিন্তা দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে পড়ে। অধিকন্তু মনে যাতে স্থিরতা আসে; নানা প্রশ্নের জাল যেন অন্তরে বাসা বাধতে না পারে এবং মনের দৃঢ়তা যাতে বজায় থাকে। আল্লাহ্ তা’আলা তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং বিষয়টি প্রত্যক্ষ করাবার জন্য একটি অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন, যাতে মুশরিকদের যাবতীয় সন্দেহ-সংশয়ও দূর হয়ে যায়।

এই ঘটনাটি ও পূর্বোক্ত ঘটনাটির অনেকে অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ কিন্তু আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামদের ব্যাপারে আল্লাহর যে নীতি রয়েছে,তা ভালোভাবে হৃদয়ংগম করতে সক্ষম হলে এ ব্যাপারে কোন প্রকার গোঁজামিল দেয়ার প্রয়োজনই দেখা দিতে পারে না৷ সাধারণ ঈমানদারদের এ জীবনে যে দায়িত্ব পালন করতে হবে সে জন্য নিছক ঈমান বিল গাইবই (না দেখে মেনে নেয়া) যথেষ্ট৷ কিন্তু নবীদের ওপর আল্লাহ যে, দায়িত্ব অর্পন করেছিলেন এবং যে নির্জলা সত্যগুলোর প্রতি দুনিয়াবাসীকে দাওয়াত দেয়ার জন্য তাঁর আদিষ্ট হয়েছিলেন সেগুলোকে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা তাঁদের জন্য অপরিহার্য ছিল৷ মানুষের সামনে সর্বশক্তি দিয়ে তাঁদের একথা বলার প্রয়োজন ছিল যে, তোমরা তো নিছক আন্দাজ অনুমান করে বলছো কিন্তু আমরা নিজেদের চর্মচক্ষে দেখা বিষয় তোমাদের বলছি৷ তোমাদের কাছে আন্দাজ, অনুমান, ধারণা,কল্পনা, কিন্তু আমাদের কাছে রয়েছে, দৃঢ় বিশ্বাসের জ্ঞানভাণ্ডার৷ তোমরা অন্ধ আর আমরা চক্ষুষ্মান৷ তাই নবীদের সামনে ফেরেশতারা আসতেন প্রকাশ্যে৷ তাঁদরকে পৃথিবী ও আকাশের ব্যবস্থাপনা দেখানো হয়েছে৷ জান্নাত ও জাহান্নাম তাদেরকে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করানো হয়েছে৷ মৃত্যর পরের জীবনের প্রদর্শণী করে তাঁদেরকে দেখানো হয়েছে৷ নবীগণ নবুওয়াতের গুরুদায়িত্ব লাভ করার অনেক আগেই ঈমান বিল গাইবের পর্যায় অতিক্রম করে থাকেন৷ নবী হবার পর তাঁদেরকে দান করা হয় ঈমান বিশ্ শাহাদাতের (চাক্ষুষ জ্ঞানলব্ধ বিশ্বাস) নিয়ামত৷ এ নিয়ামত একমাত্র নবীদের জন্য নির্দিষ্ট৷ ইরশাদ হয়েছে—

তারপর যে ব্যক্তি তার রবের পক্ষ থেকে একটি সুস্পষ্ট সাক্ষের অধিকারী ছিল,  এরপর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একজন সাক্ষীও (এ সাক্ষের সমর্তনে) এসে গেছে এবং পথপ্রদর্শকও অনুগ্রহ হিসেবে পূর্বে আগত মূসার কিতাবও বর্তমান ছিল (এ অবস্থায় সে ব্যক্তিও কি দুনিয়া পূজারীদের মতো তা অস্বীকার করতে পারে ?) এ ধরনের লোকেরা তো তার প্রতি ঈমান আনবেই,  আর মানব গোষ্ঠীর মধ্য থেকে যে-ই একে অস্বীকার করে তার জন্য যে জায়গার ওয়াদা করা হয়েছে তা হচ্ছে দোযখ৷ কাজেই হে নবী! তুমি এ জিনিসের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহে পড়ে যেয়ো না, এতো তোমার রবের পক্ষ থেকে পাঠানো সত্য৷ তবে বেশীর ভাগ লোক তা স্বীকার করে না৷ সূরা হুদঃ১৭

অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেই নিজের অস্তিত্ব, পৃথিবী ও আকাশের নির্মাণ এবং বিশ্ব-জাহানের শাসন-শৃংখলা বিধানের ক্ষেত্রে এ বিষয়ের সুস্পষ্ট সাক্ষলাভ করছিল যে, একমাত্র আল্লাহই এ দুনিয়ায় স্রষ্টা, মালিক ও প্রতিপালক এবং এ সাক্ষ দেখে যার মনে আগে থেকেই বিশ্বাস জন্মাচ্ছিল যে, এ জীবনের পরে আরো কোন জীবন অবশ্যি হওয়া উচিত যেখানে মানুষ আল্লাহর কাছে তার কাজের হিসাব দেবে এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য পুরস্কার ও শাস্তি লাভ করবে৷

অর্থাৎ কুরআন এসে এ প্রকৃতিগত ও বুদ্ধবৃত্তিক সাক্ষের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলো এবং তাকে জানালো তুমি বিশ্বপ্রকৃতিতে ও জীবন ক্ষেত্রে যার নিদর্শন ও পূর্বাভাস পেয়েছো প্রকৃতপক্ষে তাই সত্য৷

বক্তব্যের যে প্রাসংগিক ধারাবাহিকতা চলে এসেছে তার প্রেক্ষিতে এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে, যারা দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিকগুলো এবং তার আপাত চাকচিক্য মুগ্ধ হয়ে গেছে তাদের জন্য কুরআনের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করা সহজ৷ কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের অস্তিত্ব ও বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনায় আগে থেকেই তাওহীদ ও আখেরাতের স্পষ্ট সাক্ষ-প্রমাণ পেয়ে আসছিল তারপর কুরাআন এসে ঠিক সেই একই কথা বললো, যার সাক্ষ সে ইতিপূর্বে নিজের মধ্যে এবং বাইরেও পাচ্ছিল আর কুরআনের পূর্বে আগত আসমানী কিতাব থেকেও এর পক্ষে আরো সমর্থন পাওয়া গেলো, সে কেমন করে এসব শক্তিশালী সাক্ষ-প্রমাণের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে এ অস্বীকারকারীদের সুরে সুর মিলাতে পারে? এ উক্তি থেকে একথা পরিষ্কার জানা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআন নাযিলের পূর্বেই ঈমান বিল গাইব-এর মনযিল অতিক্রম করেছিলেন৷ সূরা আন’আম যেমন হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তিনি নবী হবার আগেই বিশ্ব-জগতের নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করে তাওহীদের তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেছিলেন, ঠিক তেমনি এ আয়াত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিচ্ছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে এ সত্যে উপনীত হয়েছিলেন৷ আর এর পর কুরআন এসে কেবল এর সত্যতা প্রমাণ এবং একে সুদৃঢ়ই করেনি বরং তাঁকে সরাসরি সত্যের প্রত্যক্ষ জ্ঞানও দান করেছে৷

প্রক্রিয়াটি ছিল এই যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে চারটি পাখি ধরে নিজের কাছে রেখে সেগুলোকে এমনভাবে লালন-পালন করতে নির্দেশ দেয়া হল, যাতে সেগুলো সম্পূর্ণরূপে পোষ মেনে যায় এবং ডাকামাত্রই হাতের কাছে চলে আসে। তদুপরি তিনি যেন সেগুলোকে ভালভাবে চিনতেও পারেন।

পরে নির্দেশ হল, পাখীগুলোকে জবাই করে এগুলোর হাড়-মাংস, পাখা ইত্যাদির সবগুলোকেই কিমায় পরিণত করুন, তারপর সেগুলোকে ভাল করে মিশিয়ে নিয়ে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে নিজের পছন্দমত কয়েকটি পাহাড়ে এক-একটি ভাগ রেখে দিন। তারপর এদেরকে ডাকুন। তখন এগুলো আল্লাহর কুদরতে জীবিত হয়ে উড়ে আপনার কাছে চলে আসবে। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তা-ই করলেন। অতঃপর এদের যখন ডাকলেন, সঙ্গে সঙ্গে হাড়ের সাথে হাড়, পাখার সাথে পাখা, গোশতের সাথে গোশত, রক্তের সাথে রক্ত মিলে পূর্বের রূপ ধারণ করল এবং তার কাছে উড়ে এসে উপস্থিত হল। [তাফসীরে কুরতুবী: ৪/৩১৪]

পরাক্রমশালী হওয়ার মধ্যে সর্বশক্তিমানতা বিধৃত হয়েছে; আর প্রজ্ঞাময় বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কোন বিশেষ হেকমতের কারণেই প্রত্যেককে মৃত্যুর পর পুনজীবন প্রত্যক্ষ করানো হয় না। নতুবা প্রত্যেককে এটা প্রত্যক্ষ করানো আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। সুতরাং প্রত্যক্ষ না করানোর মধ্যে ঈমান বিল-গায়েব বা গায়েবের উপর ঈমান স্থাপন করার বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন থাকে।

ইবরাহীমী জীবন থেকে প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হ’ল সর্বাবস্থায় আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ। যাকে বলা হয় ‘ইসলাম’। যেমন আল্লাহ বলেন,

إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ، وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيْمُ بَنِيْهِ وَيَعْقُوْبُ- (البقرة ১৩১-১৩২)-

‘স্মরণ কর যখন তাকে তার পালনকর্তা বললেন, তুমি আত্মসমর্পণ কর। তখন সে বলল, আমি আত্মসমর্পণ করলাম বিশ্ব চরাচরের প্রতিপালকের নিকট’। ‘এবং একই বিষয়ে সন্তানদেরকে অসিয়ত করে যান ইবরাহীম ও ইয়াকূব’ (বাক্বারাহঃ ১৩১-৩২)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, مَا كَانَ إِبْرَاهِيْمُ يَهُوْدِيًّا وَلاَ نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًا- (آل عمران ৬৭)-  ‘ইবরাহীম ইহুদী বা নাছারা ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠরূপে ‘মুসলিম’ বা আত্মসমর্পিত’ (আলে ইমরানঃ ৬৭)।