সুরা বাকারাঃ ৩৪তম রুকু (২৫৪-২৫৭)আয়াত

সুরা বাকারাঃ ৩৪তম রুকু (২৫৪-২৫৭)আয়াত

 

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:২৫৪ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَنۡفِقُوۡا مِمَّا رَزَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَ یَوۡمٌ لَّا بَیۡعٌ فِیۡهِ وَ لَا خُلَّۃٌ وَّ لَا شَفَاعَۃٌ ؕ وَ الۡکٰفِرُوۡنَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۲۵۴﴾

২৫৪. হে মুমিনগণ! আমরা যা তোমাদেরকে দিয়েছি তা থেকে তোমরা ব্যয় কর সেদিন আসার পূর্বে, যেদিন বেচা-কেনা, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না, আর কাফেররাই যালিম।

এখানে মুমিনদের সম্বোধন করে কয়েকটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রিযিকের যা দেয়া হয়েছে তা থেকে ব্যয় করার কথা।

﴿وَاعْلَمُوا أَنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ وَأَنَّ اللَّهَ عِندَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ﴾

এবং জেনে রেখো, তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্তুতি আসলে পরীক্ষার সামগ্রী ৷  আর আল্লাহর কাছে প্রতিদান দেবার জন্য অনেক কিছুই আছে৷  আনফালঃ২৮

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন

,لَوْ كَانَ لِى مِثْلُ أُحُدٍ ذَهَبًا، مَا يَسُرُّنِى أَنْ لاَ يَمُرَّ عَلَىَّ ثَلاَثٌ وَعِنْدِىْ مِنْهُ شَىْءٌ، إِلاَّ شَىْءٌ أُرْصِدُهُ لِدَيْنٍ،

‘যদি আমার নিকট ওহোদ পাহাড় সমান সোনা থাকত, তাহ’লে আমি এতে আনন্দিত হ’তাম যে, ঋণ পরিশোধের মত বাকী রেখে অবশিষ্ট সম্পদ তিনদিন অতিবাহিত না হ’তেই আল্লাহর পথে খরচ করে ফেলি’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৮৫৯।

আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন

,وَيْلٌ لِلْمُكْثِرِينَ إِلاَّ مَنْ قَالَ بِالْمَالِ هَكَذَا وَهَكَذَا وَهَكَذَا وَهَكَذَا أَرْبَعٌ عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ وَمِنْ قُدَّامِهِ وَمِنْ وَرَائِهِ.

‘দুর্ভোগ বিত্তবানদের জন্য। তবে তারা ব্যতীত যারা ধন-সম্পদ সম্পর্কে বলে, এইভাবে এইভাবে এইভাবে এইভাবে অর্থাৎ ডানে, বামে, সামনে ও পিছনে চারদিকে (ব্যয় কর)’। ইবনু মাজাহ হা/৪১২৯, সনদ হাসান; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৪১২।

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন—

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُلْهِكُمْ أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ عَن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ وَمَن يَفْعَلْ ذَٰلِكَ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ﴾

৯) হে  সেই সব লোক যারা ঈমান এসেছো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না দেয়৷ যারা এরূপ করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে৷

﴿وَأَنفِقُوا مِن مَّا رَزَقْنَاكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَ أَحَدَكُمُ الْمَوْتُ فَيَقُولَ رَبِّ لَوْلَا أَخَّرْتَنِي إِلَىٰ أَجَلٍ قَرِيبٍ فَأَصَّدَّقَ وَأَكُن مِّنَ الصَّالِحِينَ﴾

১০) আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় আসার পূর্বেই তা থেকে খরচ করো৷ সে সময় সে বলবে : হে আমার রব, তুমি আমাকে আরো কিছুটা অবকাশ দিলে না কেন ? তাহলে আমি দান করতাম এবং নেককার লোকদের মধ্যে শামিল হয়ে যেতাম৷ অথচ যখন কারো কাজের অবকাশ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার সময় এসে যায় তখন আল্লাহ

﴿وَلَن يُؤَخِّرَ اللَّهُ نَفْسًا إِذَا جَاءَ أَجَلُهَا ۚ وَاللَّهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ﴾

১১) তাকে আর কোন অবকাশ মোটেই দেন না৷ তোমরা যা কিছু কর সে বিষয়ে আল্লাহ পুরোপুরি অবহিত৷

সূরা মুনাফিকুনঃ৯-১১

“তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্হাপন কর এবং তিনি তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করেছেন তা থেকে ব্যয় কর। অতএব, তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস করে ও ব্যয় করে তাদের জন্য আছে মহা পুরুস্কার।” (সুরা হাদিদ আয়াতঃ ৭)

ইরশাদ হয়েছে–

হে ঈমানদারগণ! এ আহলে কিতাবদের অধিকাংশ আলেম ও দরবেশের অবস্থা হচ্ছে এই যে, তারা মানুষের ধন -সম্পদ অন্যায় পদ্ধতিতে খায়, এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে ৷  যারা সোনা রূপা জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে যন্ত্রনাময় আযাবের সুখবর দাও৷ একদিন আসবে যখন এ সোনা ও রূপাকে জাহান্নামের আগুণে উত্তপ্ত করা হবে, অতপর তারই সাহায্যে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে দাগ দেয়া হবে- এ সেই সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য জমা করেছিলে৷ নাও, এখন তোমাদের জমা করা সম্পদের স্বাদ গ্রহণ কর৷  সূরা তাওবাঃ ৩৪-৩৫

ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান এবং কাফের ও মুশরিকরা নিজেদের ইমাম অর্থাৎ, নবী, ওলী, বুযুর্গ এবং পীর-মুরশিদ ইত্যাদিদের ব্যাপারে এই বিশ্বাস রাখত যে, আল্লাহর উপর তাঁদের এত প্রভাব যে, তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিত্বের প্রতাপে তাঁদের অনুসারীদের ব্যাপারে যা চাইবেন আল্লাহর কাছ থেকে তা মানিয়ে নিতে পারবেন এবং মানিয়ে নিবেন। আর এটাকেই তারা শাফাআত বা সুপারিশ বলে। অর্থাৎ, প্রায় বর্তমানের অজ্ঞ মুসলিমদের মতই ছিল তাদের আকীদা ও বিশ্বাস। এদের (বর্তমানের অজ্ঞদের) কথা হল, আমাদের বুযুর্গরা আল্লাহর কাছে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিয়ে বসে যাবেন এবং ক্ষমা করিয়েই উঠবেন। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট এ রকম কোন সুপারিশের অস্তিত্বই নেই।

২:২৫৫ اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ اَلۡحَیُّ الۡقَیُّوۡمُ ۬ۚ لَا تَاۡخُذُهٗ سِنَۃٌ وَّ لَا نَوۡمٌ ؕ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یَشۡفَعُ عِنۡدَهٗۤ اِلَّا بِاِذۡنِهٖ ؕ یَعۡلَمُ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡهِمۡ وَ مَا خَلۡفَهُمۡ ۚ وَ لَا یُحِیۡطُوۡنَ بِشَیۡءٍ مِّنۡ عِلۡمِهٖۤ اِلَّا بِمَا شَآءَ ۚ وَسِعَ کُرۡسِیُّهُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ ۚ وَ لَا یَـُٔوۡدُهٗ حِفۡظُهُمَا ۚ وَ هُوَ الۡعَلِیُّ الۡعَظِیۡمُ

২৫৫. আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক। তাকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না, নিদ্ৰাও নয়। আসমানসমূহে যা রয়েছে ও যমীনে যা রয়েছে সবই তার কে সে, যে তার অনুমতি ব্যতীত তার কাছে সুপারিশ করবে? তাদের সামনে ও পিছনে যা কিছু আছে তা তিনি জানেন। আর যা তিনি ইচ্ছে করেন তা ছাড়া তার জ্ঞানের কোন কিছুকেই তারা পরিবেষ্টন করতে পারে না। তার কুরসী আসমানসমূহ ও যমীনকে পরিব্যাপ্ত করে আছে; আর এ দু’টোর রক্ষণাবেক্ষণ তার জন্য বোঝা হয় না)। আর তিনি সুউচ্চ সুমহা।

এই আয়াতটি হলো আয়াতুল কুরসী।

এই বরকতপূর্ণ আয়াতটির বড় মাহাত্ম্য এবং উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। কারণ মাহাত্ম্য, সম্মান এবং মর্যাদার বিবেচনায় কুরআন মাজীদের আয়াতসমূহের মধ্যে এটি সর্বমহান, সর্বোত্তম এবং সুউচ্চ আয়াত। এর চেয়ে সুমহান আয়াত কুরআনে আর নেই। হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াতটিকে সর্বোত্তম বলেছেন। ইমাম মুসলিম তাঁর স্বীয় সহীহ গ্রন্থে উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল তাঁকে বলেন,

«يَا أَبَا الْمُنْذِرِ أَتَدْرِي أَيُّ آيَةٍ مِنْ كِتَابِ اللهِ مَعَكَ أَعْظَمُ؟» قَالَ: قُلْتُ: ﴿ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡحَيُّ ٱلۡقَيُّومُ﴾ [البقرة: ٢٥٥]. قَالَ: فَضَرَبَ فِي صَدْرِي، وَقَالَ: «وَاللهِ لِيَهْنِكَ الْعِلْمُ أَبَا الْمُنْذِرِ»

“হে আবূল মুনযির! তোমার নিকট কিতাবুল্লাহর কোন আয়াতটি সর্বমহান? আমি বলি: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল বেশি জানেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় আবার সেই প্রশ্নটি করেন। তারপর আমি বলি: (আল্লাহু লা-ইলাহা ইল্লা হুয়াল্‌ হাইয়্যূল কাইয়্যূম…)। তারপর রাসূলুল্লাহ্ আমার বক্ষে হাতের থাবা মেরে বলেন, আল্লাহর কসম! “লি ইয়াহ্‌নিকাল্‌ ইলমা আবাল মুনযির”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮১০।

অর্থাৎ এই জ্ঞানের কারণে তোমাকে ধন্যবাদ! যা আল্লাহ তোমাকে দান করেছে, তোমার জন্য সহজ করেছে এবং তা দ্বারা তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মর্মে আল্লাহর কসম খেয়েছেন। বিষয়টির মর্যাদা এবং সম্মান প্রকাশার্থে।

(উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু ) তিনি হলেন “কারীদের প্রধান… রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবিত থাকাবস্থাতেই তিনি কুরআনকে একত্রিত করেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পেশ করেন এবং তাঁর থেকে বরকতপূর্ণ ইলম সংরক্ষণ করেন। তিনি রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ইলম ও আমলে প্রধান”।

এটি একটি এমন আয়াত যাতে তাওহীদের তিন প্রকারের সংক্ষিপ্ত পাঠ, উপকারী আলোচনা এবং ভালো বর্ণনা রয়েছে। তাওহীদের সাব্যস্ততা এবং বর্ণনা একত্রিত হয়েছে, যা এক সাথে অন্য কোনো আয়াতে একত্রিত হয় নি; বরং একাধিক আয়াতে পৃথক পৃথকভাবে এসেছে। শাইখ আব্দুর রহমান আস্‌-সাদী রহ. বলেন, “এই আয়াতে রয়েছে তাওহীদে উলুহিয়্যাহ, রুবুবিয়্যাহ, আসমা ওয়াস্‌ সিফাত এবং তাঁর বিশাল রাজত্ব, বিস্তৃত বাদশাহী, অনন্ত জ্ঞান, মহিমা, মর্যাদা, মহত্ব, অহঙ্কার এবং তামাম সৃষ্টির থেকে তিনি উর্ধ্বে থাকার বর্ণনা। এই আয়াতটি আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ এবং গুণাবলীর আকীদার সম্পর্কে মূল আয়াত। সমস্ত সুন্দর নাম এবং সুউচ্চ গুণাবলীকে এ আয়াত শামিল করে।” তাফসীরে সা‘দী পৃ. ১১০।

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “এটা জানা বিষয় যে, তাঁর সেই কালাম যাতে তিনি নিজের প্রশংসা করেন এবং নিজের গুণ ও একত্বতা বর্ণনা করেন, তা উত্তম সেই কালাম থেকে যা দ্বারা তিনি তাঁর শত্রুদের তিরস্কার করেন এবং তাদের মন্দ গুণের বর্ণনা করেন। এ কারণে সূরা ‘ইখলাস’ উত্তম, সূরা ‘তাব্বাত’ থেকে। সূরা ইখলাস কুরআনের এক-তৃতীয়াংশ, অন্য কোনো সূরা নয়। আর আয়াতুল্‌ কুরসী কুরআনের মহৎ আয়াত” । শেফাউল ‘আলীল ২/৭৪৪।

আয়াতুল কুরসীর মাহাত্ম্যের কারণে হাদীসে তা বেশি বেশি পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে, প্রতিদিন পঠিতব্য দো‘আর মধ্যে রাখতে বলা হয়েছে, যার প্রতি মুসলিম ব্যক্তি যত্নবান হবে এবং দিনে বারবার পড়বে:

১- হাদীসে প্রতি সালাত শেষে আয়াতুল কুরসী পড়তে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ইমাম নাসাঈ আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল বলেছেন: “যে ব্যক্তি প্রতি ফরয সালাত শেষে আয়াতুল কুরসী পড়ে, তার জান্নাতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ছাড়া কোনো কিছু বাধা হবে না।” সহীহ আল-জামে গ্রন্থে শাইখ আলবানী সহীহ বলেন। হাদীস নং ৬৪৬৪

২- ঘুমাবার সময় পাঠ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বিছানায় আশ্রয় নেওয়ার সময় তা পাঠ করবে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্যে এক রক্ষক নির্ধারণ করা হবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তার নিকটে আসবে না।

সহীহ বুখারীতে আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানের যাকাতের মাল হিফাযতে নিযুক্ত করেন। রাতে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি আসে এবং হাত ভরে ভরে যাকাতের খাদ্য দ্রব্য চুরি করে। আমি তাকে গ্রেফতার করি এবং বলি: আল্লাহর কসম! তোমাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পেশ করবো। সে বলে: আমি দরিদ্র আমার সন্তান-সন্ততি আছে। আমি খুব অভাবী। দুঃখ শুনে আমি তাকে ছেড়ে দেই। সকাল হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন, আবু হুরায়রা! গত রাতে তোমার বন্দী কী করেছিল? আমি উত্তরে বলি: হে আল্লাহর রাসূল! সে আমার কাছে দুঃখ-দুর্দশার কথা বলে, ছেলে পেলের কথা বলে। আমার মায়া চলে আসে, আমি তাকে ছেড়ে দেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। আমার বিশ্বাস হয়ে যায় যে, সে অবশ্যই আসবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় আসার কথা বললেন। আমি তাক লাগিয়ে থাকি। রাতে আবার হাত ভরে ভরে যাকাতের খাদ্য চুরি করে। আমি তাকে গ্রেফতার করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে পেশ করতে চাইলে সে বলে: ছেড়ে দাও ভাই! আমি দুঃখি মানুষ, বাড়িতে আমার সন্তান-সন্ততি আছে, আমি আর আসব না। কথা শুনে তার প্রতি আমার রহম হয়। আমি ছেড়ে দেই। সকালে আল্লাহর রাসূল বলেন, আবূ হুরায়রাহ তোমার কয়দীর খবর কী? আমি উত্তরে বলি: হে আল্লাহর রাসূল! সে তার দুঃখের কথা বলে, ছোট ছোট বাচ্চার কথা বলে, শুনে আমার রহম চলে আসে, আমি তাকে ছেড়ে দিয়েছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে তোমাকে মিথ্যা বলেছে এবং সে আবার আসবে। আমি তৃতীয়বার তার অপেক্ষায় থাকি। আবার চুরি। পাকড়াও করে বলি, এবার অবশ্যই রাসূলুল্লাহ’র নিকট পেশ করব। এটা শেষবার, তৃতীয়বার। তুমি বলো: আর আসবে না, কিন্তু আবার আস। সে বলে আমাকে ছেড়ে দাও। বিনিময়ে তোমাকে কিছু বাক্য শিক্ষা দিব। আল্লাহ তা দ্বারা তোমার উপকার করবেন। আমি বলি সেগুলো কী? সে বলে: যখন তুমি বিছানায় শুতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসী পড়বে। (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যূল কাইয়্যূম…) শেষ আয়াত পর্যন্ত। এ রকম করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বক্ষণের জন্য এক রক্ষক নির্ধারণ করা হবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটে আসবে না। এরপর আমি তাকে ছেড়ে দেই। সকালে আল্লাহ্‌র রাসূল আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেন: গত রাতে তোমার বন্দী কী করেছে? আমি বলি: সে আমাকে এমন কিছু কথা শিক্ষা দিতে চায় যার দ্বারা আল্লাহ আমার উপকার করবে। আমি তাকে ছেড়ে দেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেই কথাগুলো কী? আমি বলি: সে আমাকে বলে: ঘুমানোর উদ্দেশ্যে যখন বিছানায় যাবে তখন আয়াতুল কুরসী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়বে (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহ হুআল হাইয়্যূল কাইয়্যূম…) সে বলে: এরকম করলে, তোমার হিফাযতের উদ্দেশ্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে সর্বক্ষণের জন্য এক রক্ষক নির্ধারণ করা হবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার নিকটবর্তী হবে না। (বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবায়ে কেরাম কল্যাণের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন) সবকিছু শুনার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে আসলে মিথ্যুক কিন্তু তোমাকে সত্য বলেছে। আবু হুরায়রা! তুমি কি জান, তিন দিন ধরে তুমি কার সাথে কথোপকথন করছিলে? সে বলে: না। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সে ছিল শয়তান। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৩১১।

৩- সকালে সন্ধায় যিকির-আযকার করার সময় পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “তাঁর এক খেজুর রাখার থলি ছিল। ক্রমশ খেজুর কমতে থাকত। এক রাতে সে পাহারা দেয়। হঠাৎ যুবকের মতো যেন এক জন্তু! তিনি তাকে সালাম দেন। সে সালামের উত্তর দেয়। তিনি বলেন, তুমি কী? জিন্ন নাকি মানুষ? সে বলে: জিন্ন। উবাই রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তোমার হাত দেখি। সে তার হাত দেয়। তার হাত ছিল কুকুরের হাতের মতো আর চুল ছিল কুকুরের চুলের মতো। তিনি বলেন, এটা জিন্নের সুরত। সে (জন্তু) বলে: জিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী। তিনি বলেন, তোমার আসার কারণ কী? সে বলে: আমরা শুনেছি আপনি সাদকা পছন্দ করেন, তাই কিছু সদকার খাদ্যসামগ্রী নিতে এসেছি। সাহাবী বলেন, তোমাদের থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? সে বলে: সূরা বাকারার এই আয়াতটি (আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লাহ হুআল হাইয়্যূল কাইয়্যূম)। যে ব্যক্তি সন্ধায় এটি পড়বে, সকাল পর্যন্ত আমাদের থেকে পরিত্রাণ পাবে। আর যে ব্যক্তি সকালে এটি পড়বে, সন্ধা পর্যন্ত আমাদের থেকে নিরাপদে থাকবে। সকাল হলে তিনি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেন এবং ঘটনার খবর দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, খবীস সত্য বলেছে”। হাদীসটি নাসাঈ এবং ত্বাবারানী বর্ণনা করেছেন। শাইখ আলবানী সহীহুত তারগীবে সহীহ বলেন, ১/৪১৮।

পর্যন্ত আয়াতুল কুরসীর ফযীলত সংক্রান্ত মোট তিনটি হাদীস উল্লিখিত হয়েছে। এই হাদীসগুলো থেকে প্রতিদিন আটবার এই আয়াত পাঠ করার নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে সকাল-সন্ধ্যায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর ও শোওয়ার সময়।

আয়াতুল কুরসীর বিশেষ তাৎপর্যঃ

এ আয়াতে মহান রব আল্লাহ জাল্লা-শানুহুর একক অস্তিত্ব, তাওহীদ ও গুণাবলীর বর্ণনা এক অত্যাশ্চর্য ও অনুপম ভঙ্গিতে দেয়া হয়েছে, যাতে আল্লাহর অস্তিত্ববান হওয়া, জীবিত হওয়া, শ্রবণকারী হওয়া, দর্শক হওয়া, বাকশক্তিসম্পন্ন হওয়া, তার সত্তার অপরিহার্যতা, তার অসীম-অনন্ত কাল পর্যন্ত থাকা, সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা ও উদ্ভাবক হওয়া, যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া, সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া, এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের অধিকারী হওয়া যাতে তার অনুমতি ছাড়া তার সামনে কেউ কোন কথা বলতে না পারে, এমন পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যাতে সমগ্র বিশ্ব ও তার যাবতীয় বস্তুনিচয়কে সৃষ্টি করা এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং তাদের শৃংখলা বজায় রাখতে গিয়ে তাকে কোন ক্লান্তি বা পরিশ্রান্তির সম্মুখীন হতে হয় না এবং এমন ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যাতে কোন প্রকাশ্য কিংবা গোপন বস্তু কিংবা কোন অণু-পরমাণুর বিন্দু-বিসর্গও যাতে বাদ পড়তে না পারে। এই হচ্ছে আয়াতটির মোটামুটি ও সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু। আল্লামা ইবনে কাসীর বলেনঃ এ আয়াতটিতে দশটি বাক্য রয়েছে। প্রতিটি বাক্যের সাথেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা রয়েছে।

(২) প্রথম বাক্য (اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ) এতে আল্লাহ শব্দটি অস্তিত্ববাচক নাম। (لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ) সে সত্তারই বর্ণনা, যে সত্তা ইবাদাতের যোগ্য। মহান আল্লাহ ব্যতীত আর কোন সত্তা-ই ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য নয়। তিনিই একমাত্র হক মা’বুদ। আর সবই বাতিল উপাস্য।

এই বরকতপূর্ণ আয়াতটি চিরন্তন তাওহীদের বাক্য দ্বারা প্রারম্ভ করা হয়েছে (মহান আল্লাহ তিনিই যিনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই) এটি একটি মহান বাক্য, বরং সর্বাপেক্ষা মহান বাক্য।

এই কালেমার ফযীলত এবং ইসলামে এর গুরুত্ব, বর্ণনাকারীর বর্ণনা এবং জ্ঞানীদের জ্ঞানের উর্ধ্বে। বরং এর ফযীলত এবং গুরুত্ব এত বেশি যা, মানুষের মনে এবং অন্তরেও কখনো উদিত হয় নি। তবে মুসলিম ব্যক্তিকে এই স্থানে একটি বড় এবং মহৎ বিষয় জানা উচিৎ, যা এই বিষয়ের মগজ এবং আসল, তা হচ্ছে, এই কালেমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা আছে যা বুঝা জরুরী। কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আছে যা আয়ত্ব করা প্রয়োজন। জ্ঞানীদের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে যে, এই কালেমার মানে না বুঝে শুধু মুখে উচ্চারণে কোনো লাভ নেই, অনুরূপভাবে তার চাহিদা অনুযায়ী আমল না করাতেও কোনো উপকার নেই। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَا يَمۡلِكُ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِ ٱلشَّفَٰعَةَ﴾ [الزخرف: ٨٦]

“আল্লাহ ব্যতীত তারা যাদের আহ্বান (ইবাদত) করে, তারা সুপারিশের অধিকারী নয়।” [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]

আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্‌সিরগণ বলেন, অর্থাৎ কিন্তু যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য দেয়। মুখে যা বলে, অন্তরে তা বিশ্বাস করে (শুধু তাদের সাক্ষ্যই উপকারে আসবে)। কারণ, সাক্ষ্যর দাবী হচ্ছে, যার সাক্ষী দেওয়া হচ্ছে তার সম্বন্ধে জ্ঞান রাখা। অজানা বিষয়ে সাক্ষ্য হয় না। অনুরূপ সাক্ষ্যের দাবী হচ্ছে সত্যতা এবং এটির বাস্তবায়ন। বুঝা গেল, এই কালেমার সাথে আমল ও সত্যতার সাথে সাথে এর সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা জরুরী।

-জ্ঞানের দ্বারাই বান্দা খৃষ্টানদের রীতি-নীতি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে, যারা না জেনে আমল করে।

-আমলের মাধ্যমে মানুষ ইয়াহূদীদের চরিত্র থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে, যারা জানে তবে আমল করে না।

-জ্ঞানের দ্বারাই বান্দা মুনাফিকদের চরিত্র থেকে নাজাত পায়, যারা অন্তরে যা আছে, প্রকাশ করে তার বিপরীত।

এরপর বান্দা আল্লাহর সরল পথ অনুসারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। তাদের অন্তর্ভুক্ত হয় যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। যাদের প্রতি গযব বর্ষণ করেন নি এবং তারা পথভ্রষ্টও নয়।

সারকথা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কেবল তখনই গ্রহণযোগ্য ও লাভজনক হবে যে ব্যক্তি এ কালেমার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক অর্থের জ্ঞান রাখে এবং তা বিশ্বাস করে ও আমল করে।

-যে যবানে বলে এবং বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমল করে কিন্তু অন্তুরে বিশ্বাস করে না সে তো মুনাফিক।

– আর যে মুখে বলে কিন্তু তার বিপরীত আমল করে শির্ক করে সে তো মুশরিক।

-অনুরূপ যে মুখে বলেছে কিন্তু এর কোনো জরুরী বিষয় এবং দাবীসমূহের কোনো কিছু অস্বীকার করার কারণে ইসলাম থেকে মুরতাদ হয়ে গেছে, এ কালেমা তার কোনো লাভ দিবে না যদিও সে হাজার বার তা পাঠ করে।

– অনুরূপ যে তা মুখে বলে অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্যে কোনো প্রকার ইবাদত করে, তারও কোনো লাভ দিবে না। যেমন, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দো‘আ-প্রার্থনা করা, যবেহ করা, মান্নত করা, ফরিয়াদ করা, ভরসা করা, দুঃখ কষ্টের সময় প্রত্যাবর্তন করা, আশা-আকাংখা করা, ভয় করা এবং ভালোবাসা ইত্যাদি।

তাই যে ব্যক্তি ইবাদতের প্রকারসমূহের কোনো কিছু অন্যের জন্য করল, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করা যায় না, সে তো মহান আল্লাহর সাথে শরীক করল, যদিও সে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়ে থাকে। কারণ, এই কালেমা, তাওহীদ ও ইখলাসের যে দাবী রাখে সে অনুযায়ী সে আমল করল না, যা প্রকৃত পক্ষে এই মহান কালেমার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। তায়সীরুল আযীযিল হামীদ, পৃ. ৭৮।

কারণ, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’এর অর্থ হচ্ছে: কোনো সত্য উপাস্য নেই একজন ব্যতীত, তিনি হচ্ছেন এক আল্লাহ; যার কোনো অংশীদার নেই।’ ‘ইলাহ’ অভিধানিক অর্থে উপাস্যকে বলা হয়। আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো উপাস্য নেই। যেমন, আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [الانبياء: ٢٥]

“আপনার পূর্বে আমরা যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই দিয়েছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো (সত্য) উপাস্য নেই। সুতরাং আমারই ইবাদত কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]

﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ﴾ [النحل: ٣٦]

“অবশ্যই আমরা প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি যেন, তারা কেবল আল্লাহর ইবাদত করে এবং তাগুত বর্জন করে।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]

এ দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, ‘ইলাহ’ এর অর্থ মা‘বুদ (উপাস্য) এবং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ কেবল এক আল্লাহর জন্যই ইবাদত সুনিশ্চিত করা এবং তাগুতের ইবাদত থেকে বিরত থাকা।

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমায় দু’টি বিষয় পরিলক্ষিত। একটি না বাচক আর একটি হ্যাঁ বাচক।

না বাচক হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপাসনার অস্বীকার। তাই আল্লাহ ব্যতীত সবকিছু, ফিরিশতাবর্গ হোক বা নবীগণ, তারা উপাস্য নয়। তাদের কোনো উপাসনা হতে পারে না। এ ছাড়া অন্যরা তো আরও যোগ্য নয়।

আর হ্যাঁ বাচক হচ্ছে, শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যেই ইবাদত সুনিশ্চিতকরণ। বান্দা তিনি ছাড়া আর কারও শরণাপন্ন হবে না। … যেমন, দো‘আ-প্রার্থনা, কুরবানী এবং নযর-মান্নত ইত্যাদি।

কুরআনে কারীমে অনেক প্রমাণ আছে যা, তাওহীদের কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ প্রকাশ করে এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। তন্মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣﴾ [البقرة: ١٦٣]-

“এবং তোমাদের মা‘বুদ একমাত্র আল্লাহ; সেই সর্বপ্রদাতা করুণাময় ব্যতীত অন্য কোনো মা‘বুদ নেই।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৬৩] এবং তাঁর বাণী:

﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ﴾ [البينة: ٥]

“তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনগত্যে বিশুদ্ধ চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে।” [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫]

আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইয়াসীনে মুমিন বান্দার ঘটনা বর্ণনায় বলেন,

﴿وَمَا لِيَ لَآ أَعۡبُدُ ٱلَّذِي فَطَرَنِي وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٢ ءَأَتَّخِذُ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةً إِن يُرِدۡنِ ٱلرَّحۡمَٰنُ بِضُرّٖ لَّا تُغۡنِ عَنِّي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يُنقِذُونِ ٢٣ إِنِّيٓ إِذٗا لَّفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٢٤﴾ [يس: ٢٢، ٢٤]

“আমার কী হয়েছে যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার নিকট তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে আমি তাঁর ইবাদত করবো না? আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য মা‘বুদ গ্রহণ করবো? দয়াময় (আল্লাহ) আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না। এরূপ করলে আমি অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়বো।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ২২-২৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ١١ وَأُمِرۡتُ لِأَنۡ أَكُونَ أَوَّلَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٢ قُلۡ إِنِّيٓ أَخَافُ إِنۡ عَصَيۡتُ رَبِّي عَذَابَ يَوۡمٍ عَظِيمٖ ١٣ قُلِ ٱللَّهَ أَعۡبُدُ مُخۡلِصٗا لَّهُۥ دِينِي ١٤﴾ [الزمر: ١١، ١٤]

“বল: আমি আদিষ্ট হয়েছি, আল্লাহর আনুগত্য একনিষ্ট হয়ে তাঁর এবাদত করতে। আর আদিষ্ট হয়েছি, আমি যেন আত্মসমর্পণকারীদের অগ্রণী হই। বল: আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্য হই, তবে আমি ভয় করি মহা দিবসের শাস্তির। বল: আমি ইবাদত করি আল্লাহরই তাঁর প্রতি আমার আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১-১৪]

‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ শুধু একটি বিশেষ্য নয় যে, যার কোনো অর্থ নেই। আর না শুধু একটি বাক্য যার কোনো সত্যতা নেই। আর না একটি শব্দ যার কোনো মর্ম নেই। যেমন, অনেকের ধারণা। যারা বিশ্বাস করে যে এই কালেমার আসল রহস্য হচ্ছে শুধু মুখে বলা, অন্তরে কোনো প্রকার অর্থের বিশ্বাস ছাড়াই। কিংবা শুধু মুখে উচ্চারণ করা কোনো প্রকারের বুনিয়াদ বা ভিত্তি স্থাপন ছাড়াই। এটা কখনও এই মহান কালেমার মর্যাদা নয়।

বরং এটি একটি এমন বিশেষ্য যার আছে মহৎ অর্থ। একটি এমন শব্দ যার আছে উত্তম বিশ্লেষণ যা, সমস্ত বিশ্লেষণ হতে উৎকৃষ্ট। যার মূল কথা, আল্লাহ ব্যতীত সমস্ত কিছুর উপাসনা হতে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করা এবং এক আল্লাহর উপাসনার দিকে মনযোগ দেওয়া, বিনয়-নম্রতার সাথে, লোভ-লালসার সাথে, আশা-ভরসার সাথে এবং দো‘আ-প্রার্থনার সাথে। তাই ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়ালা কারো নিকট চাইবে না কিন্তু আল্লাহর কাছে, কারো কাছে ফরিয়াদ জানাবে না কিন্তু আল্লাহর দরবারে, ভরসা করবে না কারো ওপর, কিন্তু আল্লাহর প্রতি; আশা করবে না আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে, কুরবানী-নযরানা পেশ করবে না, কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। আর না সে ইবাদতের কোনো অংশ গায়রুল্লাহর জন্যে করবে। সে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর কাছে সেসব থেকে বিচ্ছেদের ঘোষণা জানাবে।

এটি অবগত হওয়ার পর জানা প্রয়োজন যে, আয়াতুল কুরসীতে তাওহীদের উজ্জ্বল দলীলসমূহ এবং স্পষ্ট প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, ইবাদতের হকদার কেবল তিনি। তিনি আল্লাহ একক, সকলের ওপর বিজয়ী। এই আয়াত উক্ত দলীলসমূহ পরস্পর ক্রমানুসারে একের পর এক এসেছে অত্যন্ত সুন্দর সাবলীলভাবে; যাতে তাওহীদের দলীলসমূহ ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে।

সংক্ষিপ্তাকারে এই প্রমাণাদির নিম্নে বর্ণনা দেওয়া হলো: ( আয়াতুল কুরসী ও তাওহীদের প্রমাণাদি–শাইখ আব্দুর রায্‌যাক ইবন আব্দুল মুহসিন আল-বদর, অনুবাদ: আবদুর রাকীব (মাদানী) সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া)

প্রথম প্রমাণ: ﴿ٱلۡحَيُّ﴾ (আল্‌ হাইউ) চিরঞ্জীব:

আল্লাহ তা‘আলাকে ইবাদতের ক্ষেত্রে এক জানার সম্পর্কে এটি স্পষ্ট প্রমাণ। তিনি পবিত্র চিরঞ্জীব হওয়ার গুণে গুণান্বিত, পূর্ণ জীবনের অধিকারী, অনাদি, যার ধ্বংস এবং পতন নেই, মন্দ এবং ত্রুটিমুক্ত, মহিমান্বিত, পবিত্র আমাদের রব্ব। এটি এমন জীবন যা আল্লাহর পূর্ণ গুণসমূহকে আবশ্যক করে। এ রকম গুণের অধিকারীই ইবাদত, রুকু এবং সাজদাহ পাওয়ার হকদার। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱلۡحَيِّ ٱلَّذِي لَا يَمُوتُ﴾ [الفرقان: ٥٨]

“তুমি নির্ভর কর তাঁর ওপর যিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৫৮]

আর যে জীবিত কিন্তু তার মৃত্যু আছে, কিংবা যে আসলেই মৃত কোনোভাবেই জীবিত নয়, কিংবা যা জড়পদার্থ যার জীবন নেই, এ রকম কোনো কিছুই কোনো প্রকারের ইবাদতের যোগ্য নয়। ইবাদতের যোগ্য তো তিনিই যিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই।

দ্বিতীয় প্রমাণ : ﴿ٱلۡقَيُّومُ﴾ (আল্‌ ক্কাইয়্যূম):

অর্থাৎ নিজে স্বয়ং স্বপ্রতিষ্ঠিত, তার সৃষ্টিকে প্রতিষ্ঠাকারী। এই নামের দিকেই প্রত্যাবর্তন করে মহান আল্লাহর সকল কার্যগত গুণাবলী। আর এটা আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ সকল সৃষ্টিকুল থেকে পূর্ণ অমুখাপেক্ষী। কারণ তিনি নিজেই নিজের ধারক এবং সৃষ্টি থেকে অমুখাপেক্ষী। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ أَنتُمُ ٱلۡفُقَرَآءُ إِلَى ٱللَّهِۖ وَٱللَّهُ هُوَ ٱلۡغَنِيُّ ٱلۡحَمِيدُ ١٥﴾ [فاطر: ١٥]

“হে মানবসকল! তোমরা তো আল্লাহর মুখাপেক্ষী, কিন্তু তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসার্হ।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ১৫]

অন্যত্র হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে,

«إِنَّكُمْ لَنْ تَبْلُغُوا نَفْعِي، فَتَنْفَعُونِي، وَلَنْ تَبْلُغُوا ضَرِّي فَتَضُرُّونِي».

“হে আমার বান্দারা! তোমরা কখনই আমার উপকার করার পর্যায়ে যেতে পারবে না যে আমার উপকার করবে, আবার আমার ক্ষতি করার পর্যায়েও যেতে পারবে না যে আমার ক্ষতি করবে”। সৃষ্টি থেকে আল্লাহ তা‘আলার অমুখাপেক্ষিতা সত্তাগত অমুখাপেক্ষিতা, কোনো বিষয়েই তিনি সৃষ্টির প্রয়োজন বোধ করেন না। সর্বক্ষেত্রে তিনি তাদের থেকে অমুখাপেক্ষী।

অনুরূপ এই নামটি আমাদের জানাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান এবং তাদের উপর রয়েছে তাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। তিনি তাঁর মহান ক্ষমতার মাধ্যমে তাদেরকে সুস্থির রাখছেন। সমস্ত সৃষ্টি তাঁর মুখাপেক্ষী। চোখের পলক পড়া বরাবরও তাঁর থেকে অমুখাপেক্ষী নয়। ‘আরশ, কুরসী, আকাশসমূহ, যমীন, পর্বতরাজি, গাছ-পালা, মানুষ এবং জীব-জন্তু সবই তাঁর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ বলেন,

﴿أَفَمَنۡ هُوَ قَآئِمٌ عَلَىٰ كُلِّ نَفۡسِۢ بِمَا كَسَبَتۡۗ وَجَعَلُواْ لِلَّهِ شُرَكَآءَ قُلۡ سَمُّوهُمۡ﴾ [الرعد: ٣٣]

“তবে কি প্রত্যেক মানুষ যা করে তার যিনি পর্যবেক্ষক, তিনি এদের অক্ষম উপাস্যগুলোর মতো? আর তারা তাঁর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করছে। বলুন, তোমরা সে সব (মনগড়া) অংশীদারের নাম বল” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ৩৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ يُمۡسِكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ أَن تَزُولَاۚ وَلَئِن زَالَتَآ إِنۡ أَمۡسَكَهُمَا مِنۡ أَحَدٖ مِّنۢ بَعۡدِهِۦٓۚ إِنَّهُۥ كَانَ حَلِيمًا غَفُورٗا ٤١﴾ [فاطر: ٤١]

“আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীকে সংরক্ষণ করেন যাতে ওরা স্থানচ্যুত না হয়, তারা স্থানচ্যুত হলে তিনি ব্যতীত কে তাদেরকে সংরক্ষণ করবে? তিনি অতি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ৪১]

তিনি আরো বলেন,

﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَن تَقُومَ ٱلسَّمَآءُ وَٱلۡأَرۡضُ بِأَمۡرِهِۦ﴾ [الروم: ٢٥]

“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও যমীনের স্থিত হওয়া।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২৫] এই অর্থের প্রচুর আয়াত বর্ণিত হয়েছে যে, অর্থ বহন করে যে, তিনিই সমগ্র সৃষ্টির এবং সমগ্র জাহানের পরিচালক এবং পরিকল্পনাকারী।

এ দ্বারা জানা যায় যে, মহান আল্লাহ সকল কার্যগত গুণাবলী, যেমন সৃষ্টি করা, রূযী দেওয়া, পুরস্কৃত করা, জীবিত করা, মৃত্যু দেওয়া ইত্যাদি সবই এ (ক্কাইয়ূম) নামের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। কারণ, এটির দাবী হচ্ছে এই যে, তিনিই তার সৃষ্টিকুলকে সুস্থির করেছেন, সৃষ্টি, আহার, জীবন, মৃত্যু এবং পরিচালনার দিক থেকে। যেমনিভাবে মহান আল্লাহর সকল সত্তাগত গুণাবলী, উদাহরণস্বরূপ: শ্রবণ, দর্শন, হাত, জ্ঞান প্রভৃতি তাঁর নাম ‘হাই’ (চিরঞ্জীব) এর দিকে প্রত্যাবর্তন করে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়: সমস্ত সুন্দর নামাবলীর উৎস এই দু’টি নাম (আল-হাই ও আল-ক্বাইয়ূম)। এ কারণে ইসলামী মনীষীদের একদল এই দু’টি নামকে ইসমে ‘আযম বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, যাকে মাধ্যম করে বা যার উসীলা দিয়ে দো‘আ করলে দো‘আ কবুল করা হয়, প্রার্থনা করলে প্রার্থনা গ্রহণ করা হয়। আর উভয়ের মর্যাদার কারণে এটি তাওহীদের প্রমাণাদি এবং দলীলাদির গুরুত্বে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাই যার শান-মর্যাদা এই যে, তিনি চিরঞ্জীব, মৃত্যুহীন, ধারক সৃষ্টির পরিচালক, কোনো কিছুই তাঁকে পরাস্ত করতে পারে না। আর না কোনো কিছু্র অস্তিত্ব হতে পারে তাঁর আদেশ ছাড়া। এ রকম গুণের অধিকারীই তো ইবাদতের যোগ্য। অন্য কেউ না। আর তিনি ব্যতীত অন্যের ইবাদত ভ্রষ্টতারই নামান্তর।

তৃতীয় প্রমাণ: ﴿لَا تَأۡخُذُهُۥ سِنَةٞ وَلَا نَوۡمٞۚ﴾ (তাঁকে না তন্দ্রা আর না ঘুম স্পর্শ করে):

তন্দ্রা বলা হয় ঘুমের পূর্বাবস্থার ঘুম ঘুম ভাবকে। আর ঘুম তো সবার জানা। আল্লাহ তা‘আলা উভয় থেকে পবিত্র, কারণ তিনি পূর্ণ জীবন এবং পূর্ণ রক্ষকের অধিকারী। পক্ষান্তরে মানুষ এবং অন্যান্য সৃষ্টি জীবিত তবে মরণশীল। তাদের জীবনে প্রয়োজন হয় আরাম-বিরামের। কারণ, তারা ক্লান্ত-ব্যথিত হয়। আর ঘুমের কারণেই হচ্ছে ক্লান্ত ও শ্রান্তবোধ করা। তাই মানুষ ক্লান্তির পর ঘুম নিলে আরাম এবং শান্তি পায়। বুঝা গেল, মানুষ তার দুর্বলতা এবং অক্ষমতার কারণে ঘুমের মুখাপেক্ষী। সে ঘুমায়, তন্দ্রা নেয়, ক্লান্ত হয়, শ্রান্ত হয় এবং অসুস্থ হয়। এ রকম যার অবস্থা তার জন্যে কিভাবে ইবাদত করা হবে?

এই তথ্য থেকে একটি নিয়ম স্পষ্ট হয় যে, কুরআনে আল্লাহর সত্তার ব্যাপারে যা কিছু অস্বীকার করা হয়, তা দ্বারা মহান আল্লাহর পূর্ণতা প্রমাণ হয়। এ স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘুম ও তন্দ্রা অস্বীকার করা হয়েছে, তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবন, তদারকি, ক্ষমতা এবং শক্তির কারণে। আর এ সবকিছুই ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁকে জরুরীভাবে একক করা ও জানার প্রমাণাদি। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

«إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَا يَنَامُ، وَلَا يَنْبَغِي لَهُ أَنْ يَنَامَ، يَخْفِضُ الْقِسْطَ وَيَرْفَعُهُ، يُرْفَعُ إِلَيْهِ عَمَلُ اللَّيْلِ قَبْلَ عَمَلِ النَّهَارِ، وَعَمَلُ النَّهَارِ قَبْلَ عَمَلِ اللَّيْلِ، حِجَابُهُ النُّورُ لَوْ كَشَفَهُ لَأَحْرَقَتْ سُبُحَاتُ وَجْهِهِ مَا انْتَهَى إِلَيْهِ بَصَرُهُ مِنْ خَلْقِهِ»

“আল্লাহ তা‘আলা ঘুমায় না, আর না ঘুম তাঁকে শোভা পায়। তিনি (নেকী-বদীর) পরিমাপ নীচু করেন এবং উঁচু করেন। রাতের আমল দিনের পূর্বে এবং দিনের আমল রাতের পূর্বে তাঁর নিকট উঠানো হয়। তাঁর পর্দা জ্যোতি, যদি তিনি তা উন্মুক্ত করে দেন, তাহলে তাঁর চেহারার আলো সমস্ত সৃষ্টিকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিবে”।সহীহ  মুসলিম, হাদীস নং ১৭৯।

তিনি সুমহান বরকতপূর্ন

চতুর্থ প্রমাণ: ﴿لَّهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۗ﴾ অর্থাৎ আকাশ ও যমীনে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক তিনি।

তিনি ব্যতীত আকাশ এবং যমীনের কোনো কিছুর কেউই মালিক নয়। অণু পরিমাণেরও মালিক নয়। যেমন, আল্লাহ বলেন,

﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱلَّذِينَ زَعَمۡتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَمۡلِكُونَ مِثۡقَالَ ذَرَّةٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا لَهُمۡ فِيهِمَا مِن شِرۡكٖ وَمَا لَهُۥ مِنۡهُم مِّن ظَهِيرٖ ٢٢﴾ [سبا: ٢٢]

“তুমি বল, তোমরা আহ্বান করা তাদেরকে, যাদেরকে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে মা‘বুদ মনে করতে। তারা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে অণু পরিমাণ কিছুর মালিক নয় এবং উভয়ের মধ্যে তাদের কোনো অংশও নেই এবং তাদের কেউ তার সহায়কও নয়।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২২]

অর্থাৎ অণু পরিমাণের মালিক নয়, না তো স্বতন্ত্রভাবে আর না অংশী হিসেবে। ইহজীবনে মানুষ ততটুকুরই মালিক যতটুকু আল্লাহ তাকে মালিক করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُلِ ٱللَّهُمَّ مَٰلِكَ ٱلۡمُلۡكِ تُؤۡتِي ٱلۡمُلۡكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ ٱلۡمُلۡكَ مِمَّن تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَآءُۖ بِيَدِكَ ٱلۡخَيۡرُۖ إِنَّكَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ٢٦﴾ [ال عمران: ٢٦]

“তুমি বল, হে রাজ্যাধিপতি আল্লাহ! আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যার নিকট হতে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন, যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন; আপনারই হাতে কল্যাণ, নিশ্চয় আপনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২৬]

অতঃপর মানুষ ইহজীবনে যা কিছুর মালিক তার পরিণাম দু’য়ের একটি। মৃত্যুকালে হয় তাকে সম্পদ ছেড়ে চলে যেতে হবে, আর না হলে সম্পদই তাকে ছেড়ে বসবে, দূর্যোগ, দূর্ঘটনা বা অনুরূপ কোনো কারণে। সেই বাগান মালীদের ন্যায় যারা প্রভাতে ফল আহরণের কসম খায় এবং ইনশাআল্লাহ বলে না। অতঃপর সেই রাতে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে দূর্যোগ হানা দেয়। ফলে বাগান পুরে ছাই হয়ে যায়। লক্ষ্য করুন! সন্ধাকালে দামী বাগানের মালিক আর প্রভাতকালে নিঃস্ব। তাই মনে রাখা দরকার, বান্দা যা কিছুর মালিক তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই। তিনি দানকারী, বঞ্চিতকারী, সঙ্কীর্ণকারী, প্রশস্তকারী, নিম্নকারী, উর্ধ্বকারী, সম্মানদাতা এবং লাঞ্ছিতকারী। আদেশ তাঁরই। রাজত্ব তাঁরই। তাই তিনিই ইবাদতের হকদার। কারণ, তার হাতে আছে দেওয়া, না দেওয়া, সম্মান এবং অপমান। তিনি ব্যতীত কেউই কোনো প্রকার ইবাদতের হকদার নয়। বরং তারা সৃষ্টি, তারা বাধ্য এবং তারা স্রষ্টার অধীনস্ত।

যে এই জগতের মালিক নয়। অণু পরিমাণেরও স্বতস্ত্রভাবে মালিক নয়। তাহলে তার উদ্দেশ্যে ইবাদতের হকদার তো তিনি যিনি এই জগতের মহিমান্বিত বাদশাহ, সম্মানিত স্রষ্টা, পরিচালক প্রভূ যার কোনো অংশী নেই।

পঞ্চম প্রমাণ: ﴿مَن ذَا ٱلَّذِي يَشۡفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذۡنِهِۦۚ﴾ (কে আছে যে, তাঁর সম্মুখে তাঁর অনুমতি ছাড়া সুপারিশ করবে?):

অর্থাৎ তার অনুমতি ব্যতীত কেউই সুপারিশ করতে পারবে না। কারণ, তিনি রাজা। আর তাঁর রাজত্বে তাঁর অনুমতি ব্যতীত কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না, কিছু করতেও পারে না।

﴿قُل لِّلَّهِ ٱلشَّفَٰعَةُ جَمِيعٗا﴾ [الزمر: ٤٤]

(বল! সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ইখতিয়ারে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৪৪] তাই এর আবেদন করা যাবে না তাঁর আদেশ ছাড়া। আর না এর দ্বারা ধন্য হওয়া যাবে তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া।

﴿وَلَا تَنفَعُ ٱلشَّفَٰعَةُ عِندَهُۥٓ إِلَّا لِمَنۡ أَذِنَ لَهُۥ﴾ [سبا: ٢٣]

“যাকে অনুমতি দেওয়া হয় সে ছাড়া আল্লাহর নিকট কারো সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না।” [সূরা সাবা, আয়াত: ২৩]

﴿وَكَم مِّن مَّلَكٖ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ لَا تُغۡنِي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡ‍ًٔا إِلَّا مِنۢ بَعۡدِ أَن يَأۡذَنَ ٱللَّهُ لِمَن يَشَآءُ وَيَرۡضَىٰٓ ٢٦﴾ [النجم: ٢٦]

“আকাশসমূহে কত ফিরিশতা রয়েছে! তাদের কোনো সুপারিশ ফলপ্রসু হবে না, যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি দেন।” [সূরা আন-নাজম, আয়াত: ২৬]                                                                   রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন মাকামে মাহমূদ নামক স্থানে সুাপারিশ করার মর্যাদা লাভ করবেন। তিনি নিজে আরম্ভ করবেন না যতক্ষণে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদেশ না হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হবে,

«ارْفَعْ رَأْسَكَ، قُلْ تُسْمَعْ، سَلْ تُعْطَهْ، اشْفَعْ تُشَفَّعْ»

“মাথা উঠাও এবং আবেদন কর, আবেদন গ্রহণ করা হবে। সুপারিশ কর, সুপারিশ কবুল করা হবে”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৩

অতঃপর জানা দরকার যে, সুপারিশকারীর সুপারিশ সবই লাভ করবে না, বরং তা কেবল মুওয়াহহিদ ও মুখলিসদের জন্য নির্দিষ্ট, মুশরিকদের তাতে কোনো অংশ নেই। সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ! مَنْ أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِكَ يَوْمَ القِيَامَةِ؟ فَقَالَ: «لَقَدْ ظَنَنْتُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ أَنْ لاَ يَسْأَلُنِي عَنْ هَذَا الحَدِيثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الحَدِيثِ، أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ»

“আমি আল্লাহর রাসূলকে জিজ্ঞাসা করি: হে আল্লাহর রাসূল! কিয়ামতের দিনে আপনার সুপারিশের কে বেশি সৌভাগ্যবান হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হে আবূ হুরায়রা! আমার মনে হচ্ছে, তোমার পূর্বে এ বিষয় সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করে নি, তুমিই প্রথম প্রশ্ন করেছ, যা হাদীসের প্রতি তোমার লিপ্সার পরিচয়। কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশের সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান সে, যে খাঁটি অন্তরে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে”।

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, ‘আবূ হুরায়রার হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী: «أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ القِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ» “আমার সুপারিশের সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান ব্যক্তি সে যে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়েছে” এটি তাওহীদের একটি রহস্য। আর তা হলো, সুপারিশ পাবে সে যে, শুধু আল্লাহর জন্যই ইবাদতকে মুক্ত করবে। যার তাওহীদ পূর্ণ হবে সেই শাফা‘আতের বেশি হকদার হবে। এমন নয় যে শির্ককারীও সুপারিশ লাভ করবে যেমন মুশরিকদের ধারণা”। তাহ্‌যীবুস্‌ সুনান ৭/১৩৪।

সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়য়া রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আরো বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,

«لِكُلِّ نَبِيٍّ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ، فَتَعَجَّلَ كُلُّ نَبِيٍّ دَعْوَتَهُ، وَإِنِّي اخْتَبَأْتُ دَعْوَتِي شَفَاعَةً لِأُمَّتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَهِيَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللهُ مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِي لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا»

“প্রত্যেক নবীর একটি গৃহীত দো‘আ আছে। প্রত্যেকেই তা অগ্রিম করেন। আর আমি আমার দো‘আকে কিয়ামতের দিনে সুপারিশস্বরূপ আমার উম্মতের জন্যে গোপন রেখেছি। আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো প্রকার শির্ক না করে মারা যাবে সে ইনশাআল্লাহ তা পাবে”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৯।

আল্লাহর প্রাপ্য অন্যকে দেওয়ার ব্যাপারে মুশরিকদের যে বিশ্বাস, এ প্রমাণে তা বাতিল করা হয়েছে। তাদের ধারণা, এ সকল (উপাস্য) সুপারিশকারী এবং মাধ্যমস্বরূপ। এরা তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। আল্লাহ বলেন,

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِ﴾ [يونس: ١٨]

“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন বস্তুসমূহেরও ইবাদত করে, যারা তাদের কোনো অপকারও করতে পারে না এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারে না, আর তারা বলে, এরা হচ্ছে আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী।” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮]

তারা আরো বলে:

﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣]

“আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই করি যে, এরা আমাদেরকে সুপারিশ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]

এ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই মৃত, পাথর, গাছ-পালা এবং অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে ইবাদত করা হয়। তাদের নিকট দো‘আ করা হয় এবং কুরবানী ও মান্নত করা হয়। প্রয়োজন পূরণ, বিপদ দুরীকরণ এবং বালা-মুসীবত থেকে পরিত্রানের প্রার্থনা করা হয়। তাদের বিশ্বাস, তারা তাদের আহ্বান শোনে, দো‘আ কবুল করে এবং চাহিদা পূরণ করে। এ সবই শির্ক ও ভ্রষ্টতা। প্রাচীন যুগে ও বর্তমানে সুপারিশের নামে তারা এর অনুশীলন করে আসছে। জানা দরকার, শাফা‘আতের তিনটি অধ্যায় আছে, যা ভ্রষ্ট দল জানে না, আর না হলে না জানার ভান করছে। তা হলো, আল্লাহর আদেশ ব্যতীত কোনো সুপারিশ হবে না। তারই জন্যে সুপারিশ হবে যার কর্ম ও কথার ওপর আল্লাহ সন্তুষ্ট। আর আল্লাহ সুবহানাহু তাওহীদবাদী না হলে কারও প্রতি সন্তুষ্ট হন না।

ষষ্ঠ প্রমাণ: ﴿يَعۡلَمُ مَا بَيۡنَ أَيۡدِيهِمۡ وَمَا خَلۡفَهُمۡۖ﴾ (তাদের সামনের ও পিছনের সবকিছুই তিনি জানেন।)

অর্থাৎ তাঁর জ্ঞান অতীত ও ভবিষ্যতের সবকিছুতে অন্তর্ভুক্ত। তাই তিনি জানেন যা অতীতে হয়েছে এবং যা ভবিষ্যতে হবে। তাঁর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। তিনি সবকিছুর বিস্তারিত হিসাবে রেখেছেন। আর কিভাবেই বা তাঁর জ্ঞান সব সৃষ্টিকে অন্তর্ভুক্ত করবে না! অথচ তিনি সৃষ্টিকর্তা।

﴿أَلَا يَعۡلَمُ مَنۡ خَلَقَ وَهُوَ ٱللَّطِيفُ ٱلۡخَبِيرُ ١٤﴾ [الملك: ١٤]

“যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি কি জানেন না? তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবগত।” [সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১৪]

সৃষ্টির সৃষ্টিকরণ এবং তাদের অস্তিত্বে আনয়নে এ কথার দলীল যে, তাঁর জ্ঞান এ সবকিছুতে অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖ وَمِنَ ٱلۡأَرۡضِ مِثۡلَهُنَّۖ يَتَنَزَّلُ ٱلۡأَمۡرُ بَيۡنَهُنَّ لِتَعۡلَمُوٓاْ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ وَأَنَّ ٱللَّهَ قَدۡ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عِلۡمَۢا ١٢ ﴾ [الطلاق: ١٢]

“আল্লাহ সপ্তাকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীও সেই পরিমাণে, এগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ; ফলে তোমরা বুঝতে পার যে, আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানে আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।” [সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১২]

সপ্তম এবং অষ্টম প্রমাণ: ﴿وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيۡءٖ مِّنۡ عِلۡمِهِۦٓ إِلَّا بِمَا شَآءَۚ﴾ (তাঁর জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন।):

এই বাণীতে সৃষ্টির অক্ষমতা এবং তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা ও সীমাবদ্ধতা বর্ণিত হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, তাদের খুবই সামান্য জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।

﴿وَمَآ أُوتِيتُم مِّنَ ٱلۡعِلۡمِ إِلَّا قَلِيلٗا﴾ [الاسراء: ٨٥]

“তামাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ৮৫]

সে তো প্রথম অবস্থায় মায়ের পেট থেকে বের হয়েছে এমন অবস্থায় যে, তারা কিছুই জানত না।

﴿ وَٱللَّهُ أَخۡرَجَكُم مِّنۢ بُطُونِ أُمَّهَٰتِكُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ شَيۡ‍ٔٗا﴾ [النحل: ٧٨]

“আর আল্লাহ তোমাদেরকে নির্গত করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমন অবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৭৮]

তাদের জ্ঞান দুর্বল ও ক্ষয়মুখী।

﴿وَمِنكُم مَّن يُرَدُّ إِلَىٰٓ أَرۡذَلِ ٱلۡعُمُرِ لِكَيۡ لَا يَعۡلَمَ بَعۡدَ عِلۡمٖ شَيۡ‍ًٔاۚ﴾ [النحل: ٧٠]

“তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ পৌঁছে যায় নিকৃষ্টতম বয়সে, ফলে যা কিছু তারা জানত সে সম্পর্কে তারা সজ্ঞান থাকবে না।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৭০]

এ জীবনে তারা সম্মুখীন হয় ভুল ও অক্ষমতার।

﴿وَلَقَدۡ عَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ ءَادَمَ مِن قَبۡلُ فَنَسِيَ وَلَمۡ نَجِدۡ لَهُۥ عَزۡمٗا ١١٥﴾ [طه: ١١٥]

“আমরা তো ইতোপূর্বে আদমের প্রতি নির্দেশ দান করেছিলাম, কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল; আমরা তাকে সংকল্পে দৃঢ় পাই নি”। [সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ১১৫]

তাদের কাছে যে জ্ঞানই এসেছে তা আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন বলেই তারা অর্জন করেছে।

﴿ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآ﴾ [البقرة: ٣٢]

“তারা বলেছিল আপনি পরম পবিত্র; আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তদ্ব্যতীত আমাদের কোনোই জ্ঞান নেই।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩২]

﴿ٱلَّذِي عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ ٤ عَلَّمَ ٱلۡإِنسَٰنَ مَا لَمۡ يَعۡلَمۡ ٥﴾ [العلق: ٤، ٥]

“যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।” [সূরা আল-‘আলাক্ক, আয়াত: ৪-৫]

﴿خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلۡبَيَانَ ٤﴾ [الرحمن: ٣، ٤]

“তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন বাক্‌ প্রণালী।” [সূরা আর-রহমান, আয়াত: ৩-৪

দো‘আয়ে মাসুরায় উল্লেখ হয়েছে:

«اللهم علمني ما ينفعني»

“হে আল্লাহ আমাকে শিক্ষা দাও তা, যা আমার জন্য লাভদায়ক”। তাই বান্দা জ্ঞানের কোনো অংশই অর্জন করতে পারে না, কেবল যখন আল্লাহ তাকে তাওফীক দেন এবং তার জন্য তা সহজ করেন তখনই সে তা অর্জন করতে পারে।

﴿إِلَّا بِمَا شَآءَ﴾ “কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন” এই বাণীতে তাওহীদের আর এক অন্য প্রমাণ বর্ণিত হয়েছে। সবকিছু আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার সাথে সম্পৃক্ত। তিনি যা চান তা হয় আর যা চান না তা হয় না। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ছাড়া কোনো শক্তি সামর্থ্য নেই।

নবম প্রমাণ: ﴿وَسِعَ كُرۡسِيُّهُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَۖ﴾ (তাঁর কুরসী (পাদানি) সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে):

যে আয়াতে ‘কুরসি’ শব্দটি আছে, সেটি হলো আয়াতুল কুরসি। ‘কুরসি’ শব্দের অর্থ আমাদের ভাষায় হলো ‘আসন’। তবে, আল্লাহ এটা বোঝাননি। এখানে ‘কুরসি’ মানে আল্লাহর পা রাখার জায়গা। এরচেয়ে বেশি ব্যাখ্যা আসেনি। এটার ধরন আল্লাহ ভালো জানেন। এটি আসন নাকি অন্য কিছু, সে ব্যাপারে আমরা জানি না। এর পরিচয় আল্লাহই ভালো জানেন। এরচেয়ে বেশি তথ্য আর কেউ দিতে পারবেন না

কুরসী আল্লাহ তা‘আলার বৃহৎ সৃষ্টির একটি। আল্লাহ সুবহানাহু এটির বর্ণনায় বলেন যে, আকাশ এবং যমীন পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। তার প্রশস্ততা, আকৃতির বড়ত্বতা এবং ক্ষেত্রের বিশালতার কারণে। ভূমণ্ডল এবং নভোমণ্ডলের তুলনা কুরসীর সাথে খুবই ক্ষীণ তুলনা। যেমন, কুরসীর তুলনা ‘আরশের সাথে দুর্বল তুলনা। আবূ যর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস এটি বিশ্লেষণ করে। তিনি বলেন,

«دَخَلْتُ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ ، فَرَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَحْدَهُ ، فَجَلَسْتُ إِلَيْهِ ، فَقُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، أَيُّ آيَةٍ نَزَلَتْ عَلَيْكَ أَفْضَلُ ؟ قَالَ :«آيَةُ الْكُرْسِيُّ، مَا السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ فِي الْكُرْسِيِّ إِلا كَحَلْقَةٍ فِي أَرْضٍ فَلاةٍ، وَفَضْلُ الْعَرْشِ عَلَى الْكُرْسِيِّ كَفَضْلِ تِلْكَ الْفَلاةِ عَلَى تِلْكَ الْحَلْقَةِ»

“আমি মসজিদে হারামে প্রবেশ করি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একাকি দেখে তার পাশে বসে পড়ি এবং জিজ্ঞাসা করি: হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি সর্বোত্তম কোন আয়াতটি অবতীর্ণ হয়? তিনি বলেন, “আয়াতুল কুরসী; কুরসীর তুলনায় আকাশ এবং যমীন, যেমন মরুভূমিতে পড়ে থাকা একটি বালা (আংটা)। আর আরশের শ্রেষ্ঠত্ব কুরসীর প্রতি যেমন মরুভূমির শ্রেষ্ঠত্ব সেই বালার প্রতি”। বায়হাকী, ২/৩০০-৩০১, শাইখ আলবানী সহীহ বলেন। সিলসিলা সহীহাহ, নং (১০৯)।

হাদীসটি এই আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের স্থানে বর্ণিত হয়েছে, যেন বান্দা এই সৃষ্টির বড়ত্ব সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তুলনা করতে সমর্থ্য হয় তার এবং আকাশ ও যমীনের মাঝে। তারপর তার ও আরশে আযীমের মাঝে তুলনায় এর ক্ষুদ্র হওয়া সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে।

এখানে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে, মরুভূমিতে পড়ে থাকা ছোট বালার স্থান মরুভুমির তুলনায় কতখানি। (খুবই নগন্য) অনুরূপ কুরসীর অবস্থা ‘আরশের তুলনায়। অতঃপর যমীন আসমানের স্থান কুরসীর তুলনায় সেরূপ নগণ্য।

যদি আপনি চিন্তা করেন এই যমীনের সম্পর্কে যাতে আপনি চলা-ফেরা করেন, বেষ্টনকারী পাহাড়ের তুলনায়। বলুন তো, সাধারণ যমীনের তুলনায় পাহাড়সমূহের স্থান কতখানি। তারপর সমগ্র যমীনের (যমীনের অভ্যন্তর স্তর সহ) তুলনায় তার অবস্থান। তারপর আকশসমূহের তুলনায় এটির স্থান। তারপর কুরসীর তুলনায় এটির স্থান, যে কুরসী আকাশ এবং যমীনকে পরিব্যপ্ত করে আছে। তারপর ‘আরশে আযীমের তুলনায় এটির অবস্থান। যেন আপনি অনুভব করতে পারেন বৃত্তের অতি ক্ষুদ্রতা, যাতে আপনি বসবাস করেন। যেন এ চিন্তার মাধ্যমে জানতে পারেন মহান আল্লাহর সৃষ্টির বড়ত্ব, যা স্রষ্টা ও আবিষ্কারকের মহত্ত্বের প্রমাণ। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:

«تفكروا في آلاء الله ولا تتفكروا في الله»

“তোমরা আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শণসমূহে চিন্তা কর, আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা কর না”। শারহুল্‌ ইতেকাদ, লাআল্কায়ী, ২/২১০, শাইখ আলবানী হাসান বলেছেন। সিলসিলা সহীহাহ, নং ১৭৮৮।

এটি বরকতপূর্ণ চিন্তা-ভাবনা যার দ্বারা বান্দা আবিষ্কারকের মহত্ত্বতা এবং স্রষ্টার পূর্ণতার সঠিক জ্ঞান পায়। জানতে পারে যে, তিনি আল্লাহ সুবহানুহু খুবই বড়, সুউচ্চ এবং সুমহান। এ কারনে কোনো কোনো পণ্ডিত বলেন, এ স্থানে কুরসীর বর্ণনা, আল্লাহর সুউচ্চতা এবং তাঁর মহত্ত্বতার বর্ণনার উদ্দেশ্যে ভূমিকাস্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে, যা আয়াতের শেষাংশে উল্লেখ হয়েছে।

মুসলিম ব্যক্তি যখন এই মহত্ত্ব উপলব্ধি করবে, তখন তার রবের সম্মুখে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করবে এবং যাবতীয় ইবদত তাঁর জন্যে করবে। দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে যে, তিনিই ইবাদতের যোগ্য। অন্য কেউ না। জানতে পারবে যে, প্রত্যেক মুশরিক তার রবের যথার্থ সম্মান করে না। যেমন, আল্লাহু তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٧﴾ [الزمر: ٦٧]

“তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না। কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুষ্টিতে এবং আকাশমণ্ডলী থাকবে ভাজকৃত তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্ধ্বে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৭] এবং তিনি বলেন,

﴿مَّا لَكُمۡ لَا تَرۡجُونَ لِلَّهِ وَقَارٗا ١٣ وَقَدۡ خَلَقَكُمۡ أَطۡوَارًا ١٤ أَلَمۡ تَرَوۡاْ كَيۡفَ خَلَقَ ٱللَّهُ سَبۡعَ سَمَٰوَٰتٖ طِبَاقٗا ١٥ وَجَعَلَ ٱلۡقَمَرَ فِيهِنَّ نُورٗا وَجَعَلَ ٱلشَّمۡسَ سِرَاجٗا ١٦ وَٱللَّهُ أَنۢبَتَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ نَبَاتٗا ١٧ ثُمَّ يُعِيدُكُمۡ فِيهَا وَيُخۡرِجُكُمۡ إِخۡرَاجٗا ١٨ وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ بِسَاطٗا ١٩ لِّتَسۡلُكُواْ مِنۡهَا سُبُلٗا فِجَاجٗا ٢٠﴾ [نوح: ١٣، ٢٠]

“তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে চাচ্ছ না? অথচ তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন পর্যায়ক্রমে, তোমরা লক্ষ্য কর নি? আল্লাহ কীভাবে সৃষ্টি করেছেন সপ্তস্তরে বিন্যস্ত আকাশমণ্ডলী এবং সেখানে চন্দ্রকে স্থাপন করেছেন আলোরূপে ও সূর্যকে স্থাপন করেছেন প্রদীপরূপে? তিনি তোমাদের উদ্ভুত করেছেন মাটি থেকে। অতঃপর তাতে তিনি তোমাদেরকে প্রত্ত্যাবৃত্ত করবেন ও পরে পুনরুত্থিত করবেন এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে ভূমিকে করেছেন বিস্তৃত, যাতে তোমরা চলাফেরা করতে পার প্রশস্ত পথে।” [সূরা নূহ, আয়াত: ১৩-২০]

জানি না কোথায় গুম হয়ে যায় এই সমস্ত মুশরিকদের বিবেক-বুদ্ধি! যখন তারা তাদের বিনয়-নম্রতা, অসহায়তা-অক্ষমতা, আশা-আকাঙ্খা, ভয়-ভীতি, ভালোবাসা এবং কামনা-বাসনা নিবেদন করে, দুর্বল-অক্ষম সৃষ্টির কাছে, যারা নিজের লাভ-লোকসানের মালিক নয় অপরের মালিক হওয়া তো দুরের কথা; আর বিনয়-নম্রতা নিবেদন করা ছেড়ে দেয় মহান আল্লাহ এবং মর্যাদাবান স্রষ্টার উদ্দেশ্যে। তারা যা বলে তা থেকে তিনি কত উর্ধ্বে। তিনি পবিত্র তা থেকে যাকে তারা তাঁর সাথে শরীক করে থাকে।

দশম প্রমাণ: ﴿ وَلَا يَ‍ُٔودُهُۥ حِفۡظُهُمَا﴾ (উভয়ের সংরক্ষণে তাঁকে বিব্রত হতে হয় না।):

এটিও আল্লাহর মাহাত্ম্য এবং তাঁর ক্ষমতা ও শক্তির পূর্ণতার বর্ণনা। আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি যে, কুরআনে না-সূচক কোনো কিছু শুধু না বলার জন্য ব্যবহৃত হয়না বরং তাতে আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতার প্রমাণ শামিল হয়। তাঁর বাণী: (وَلَا يَئُودُهُ) লা-ইয়াউদহু-অর্থাৎ তাঁকে চিন্তিত করে না, কাঠিন্যতায় ফেলে না এবং ক্লান্ত করে না। (হিফ্‌ যুহুমা)-উভয়ের সংরক্ষণ- অর্থাৎ আকাশ এবং যমীনের সংরক্ষণ। এতে তাঁর শক্তি ও ক্ষমতার পূর্ণতার প্রমাণ হয় এবং প্রমাণ হয় যে তিনি সংরক্ষক, আকশমণ্ডলী এবং যমীনের সংরক্ষণকারী। যেমন, আল্লাহ বলেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ يُمۡسِكُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ أَن تَزُولَاۚ وَلَئِن زَالَتَآ إِنۡ أَمۡسَكَهُمَا مِنۡ أَحَدٖ مِّنۢ بَعۡدِهِۦٓۚ إِنَّهُۥ كَانَ حَلِيمًا غَفُورٗا ٤١﴾ [فاطر: ٤١]“নিশ্চয় আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনকে ধরে রাখেন যাতে এগুলো স্থানচ্যুত না হয়। আর যদি এগুলো স্থানচ্যুত হয়, তাহলে তিনি ছাড়া আর কে আছে যে এগুলোকে ধরে রাখবে? নিশ্চয় তিনি পরম সহনশীল, অতিশয় ক্ষমাপরায়ণ”। [সূরা ফাতির, আয়াত: ৪১]

তিনি আরো বলেন,

﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَن تَقُومَ ٱلسَّمَآءُ وَٱلۡأَرۡضُ بِأَمۡرِهِۦۚ﴾ [الروم: ٢٥]

“তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তাঁরই আদেশে আকাশ ও পৃথিবীর স্থিতি।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২৫] এতেও আল্লাহর প্রতি সমস্ত সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ হয়। তাদের অবস্থান তাঁর নির্দেশে এবং তাদের সংরক্ষণ তাঁর ইচ্ছায়। তাঁর ক্ষমতায় তিনি তাদের ধারক। সৃষ্টির ওপর কর্তব্য হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে তাঁর জন্য ইবাদত করা, তাঁরই উদ্দেশ্যে আনুগত্য খাঁটি করা। শির্ক ও শরীক হতে তাঁকে মুক্তকরণের ব্যাপারে এটি একটি উজ্জ্বল প্রমাণ। দুর্বল সৃষ্টি এবং লাঞ্ছিত বান্দাকে কেমন করে তার প্রভূ ও স্রষ্টার সমতুল্য নির্ধারণ করা হতে পারে? কিভাবে সংরক্ষিত ব্যক্তি সংরক্ষকের সমতুল্য হতে পারে? সর্বক্ষেত্রে অভাবী, পদদলিত কেমন করে অভাবমুক্ত প্রসংশিতের সমকক্ষ হতে পারে। তাদের শির্ক থেকে তিনি উর্ধ্বে।

ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “এটা অজ্ঞতা এবং অত্যাচারের শেষ সীমা। কীভাবে মাটিকে মুনিবদের মুনিবের সাথে তুলনা করা হবে? কীভাবে দাসকে মালিকের মতো মনে করা হবে? কেমন করে দুর্বল, সত্তাগতভাবে অক্ষম, সত্তাগতভাবে অভাবী, সত্তাগতভাবে অস্তিত্বহীন হওয়াই যার আসল কথা, সে সত্তাগতভাবে অমুখাপেক্ষী, সত্তাগতভাবে সক্ষম, যার অমুখাপেক্ষিতা, ক্ষমতা, রাজত্ব, তাঁর সত্তার আবশ্যিক অংশ, তার সমকক্ষ হতে পারে? এর চেয়ে জঘন্য যুলুম আর কী হতে পারে? এর চেয়ে মারাত্মক কঠিন যুলুমপূর্ণ বিধান আর কী হতে পারে? যেখানে এমন সত্তাকে তার সৃষ্টির সমকক্ষ সাব্যস্ত করা হচ্ছে যার সমকক্ষ আসলে কেউ নেই। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ وَجَعَلَ ٱلظُّلُمَٰتِ وَٱلنُّورَۖ ثُمَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ بِرَبِّهِمۡ يَعۡدِلُونَ ١﴾ [الانعام: ١]

“সমস্ত প্রশংসাই আল্লাহর জন্য যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আলো ও অন্ধকার; তা সত্ত্বেও কাফিররা অপর জিনিসকে তাদের রবের সমকক্ষ নিরূপণ করছে।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১]

একাদশ এবং দ্বাদশ প্রমাণ: ﴿وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ﴾ (তিনি সুউচ্চ, মহীয়ান):

এ দু’টি তাওহীদের অন্যতম প্রমাণ। এগুলো প্রমাণ করছে যে, তিনি সুবহানাহুই ইবাদাতের হকদার, অন্য কেউ নয়। সমস্ত সৃষ্টির উপরে তাঁর উচ্চতা এবং তাঁর মাহাত্মের পূর্ণাঙ্গতা বর্ণনার মাধ্যমে এটি প্রকাশ করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী (وَهُوَ الْعَلِيُّ) এর মধ্যে বর্ণিত “আলিফ-লাম”টি ইস্তিগরাক তথা সম্পূর্ণবোধক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই এটি উচ্চতা বলতে যা বুঝায়, সেরকম সব অর্থকে শামিল করে। যেমন, সত্তাগত উচ্চতা, ক্ষমতাগত উচ্চতা এবং মর্যাদাগত উচ্চতা। (কবি বলেন),

وله العلو من الوجوه جميعها

ذاتًا وقهرًا مع علو الشان

অর্থ: তাঁর জন্য উচ্চতা সর্বক্ষেত্রে। অবস্থান ও সত্তাগত, ক্ষমতাসম্পর্কীয়, মর্যাদার উচ্চতাও বটে।

তাই তিনি তাঁর সত্তাসহ উঁচুতে রয়েছেন, সমস্ত সৃষ্টির উর্ধ্বে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ ٱسۡتَوَىٰ ٥﴾ [طه: ٥]

“দয়াময় (আল্লাহ) ‘আরশের উপর উঠেছেন।” [সূরা ত্ব-হা, আয়াত: ৫]

তিনি সার্বভৌমত্বের দিক দিয়েও সুউচ্চে। যেমন, আল্লাহ বলেন,

﴿وَهُوَ ٱلۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهِۦۚ﴾ [الانعام: ١٨]

“তিনিই তাঁর বান্দাদের ওপর একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৮]

তিনি তাঁর সম্মানের দিক দিয়েও সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী। যেমন, আল্লাহ বলেন,

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ﴾ [الزمر: ٦٧]

“তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না।’ [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৭]

এটি তাওহীদের প্রমাণাদির মধ্যে একটি বৃহৎ প্রমাণ এবং শির্কের খণ্ডন। এ কারণে আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেন,

﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ٦٢﴾ [الحج: ٦٢]

“এ জন্যেও যে, আল্লাহ, তিনিই সত্য এবং তারা তাঁর পরিবর্তে যাকে ডাকে এটা তো অসত্য এবং আল্লাহ- তিনিই তো সমুচ্চ, মহান।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৬২]

এবং তাঁর বাণী: (الْعَظِيم) এতে তাঁর মহত্বের প্রমাণ হয় এবং প্রমাণ হয় যে, তাঁর চেয়ে মহান আর কিছু নেই। আরও প্রমাণ হয় যে, মাখলুকের মর্যাদা, সে যত বড়ই হোক না কেন, তার অবস্থা এতই হীন যে তার সাথে মহান সৃষ্টিকর্তা এবং অস্তিত্বে আনয়নকারীর মহত্বের তুলনা করা যায় না।

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

«الْكِبْرِيَاءُ رِدَائِي، وَالْعَظَمَةُ إِزَارِي، فَمَنْ نَازَعَنِي وَاحِدًا مِنْهُمَا، قَذَفْتُهُ فِي النَّارِ»

“অহংকার আমার চাদর, বড়ত্ব আমার লুঙ্গি, যে ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে কোনো একটি নেওয়ার চেষ্টা করবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব”।আহমদ, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন। হাদীস নং ৫৪০।

এই নামের সাথে সম্পর্কিয় উপাসনাদির মধ্যে হচ্ছে বান্দা যেন তাঁর রবের সম্মান করে, তাঁর সামনে হীনতা অবলম্বন করে এবং তাঁর মহান সান্নিধ্যের উদ্দেশ্যে নম্রতা প্রকাশ করে। বিনয় নম্রতা এবং আনুগত্য কেবল তাঁরই জন্য করে। কিছু লোককে শয়তান ধোকা দিয়েছে তারা এই সত্যকে বদলে দিয়েছে এবং স্পষ্ট শির্কে নিমজ্জিত হয়েছে এবং শয়তানকে আল্লাহর সম্মানের আসনে বসিয়েছে। তারা বলছে: আল্লাহ তা‘আলা মহান মহিয়ান। তাঁর নৈকট্য, মধ্যস্থতাকারী, সুপারিশকারী, নিকটবর্তীকারী উপাস্য ছাড়া লাভ করা যেতে পারে না। আসলে কোনো বাতিলপন্থীই তার বাতিলের প্রচার-প্রসার ঘটাতে পারে না যতক্ষণ না সে বাতিলকে সত্যের মোড়কে পেশ করে।

আবদুর রহমান ইবন মাহদী রাহিমাহুল্লাহর কাছে জাহমিয়্যাহ সম্প্রদায়ের কথা বলা হলো যে, তারা আল্লাহ তা‘আলার গুণ সম্পর্কীয় হাদীসগুলোকে অস্বীকার করে এবং বলে: এই ধরনের গুণে গুণান্বিত হওয়া থেকে আল্লাহ তা‘আলা মহান। তখন তিনি বলেন, “এক সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছে সম্মানকে কেন্দ্র করে, তারা বলেছে: আল্লাহ তা‘আলা কিতাব অবতরণ করা কিংবা রাসূল প্রেরণ করা থেকে উর্ধ্বে। তারপর তিনি পড়েন:

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦٓ إِذۡ قَالُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٖ مِّن شَيۡءٖ﴾ [الانعام: ٩١]

“এই লোকেরা আল্লাহ তা‘আলার যথাযথ মর্যাদা উপলদ্ধি করে নি। যখন তারা বলেছে, আল্লাহ কোনো মানুষের ওপর কোনো কিছু অবতীর্ণ করেন নি।” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯১], তারপর তিনি (ইবনে মাহদী) বলেন, অগ্নিপুজকরা তো সম্মানকে কেন্দ্র করেই ধ্বংস হয়েছে। তারা বলে: আল্লাহ এটি থেকে মহান যে আমরা তাঁর ইবাদত করব বরং আমরা ইবাদত করব তার যে আমাদের চেয়ে আল্লাহর অধিকতর নিকটবর্তী। তাই তারা সূর্যের ইবাদত করে এবং সাজদাহ করে। তখন আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেন:

﴿وَٱلَّذِينَ ٱتَّخَذُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣]

“যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে (তারা বলে,) আমরা তো এদের পূজা এজন্যেই করি যে, এরা আমাদেরকে সুপারিশ করে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩] আল-হুজ্জাহ, তায়মী-১/৪৪০।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সম্বন্ধে এটা তাদের ভ্রান্ত ধারণা, যা তাদেরকে আল্লাহর সাথে শির্ক এবং অংশী স্থাপনে লিপ্ত করেছে। মধ্যস্থতাকারী ও সুপারিশকারী সাব্যস্ত করছে, তারা মনে করছে এ দ্বারা তারা রাব্বুল আলামীনের সম্মানই করছে। বস্তুত সত্যিই যদি তারা তাদের প্রভূ সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখত, তবে তারা তাঁর যথার্থ তাওহীদ সাব্যস্ত করতো।

যিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাবান, সবকিছু হতে অমুখাপেক্ষী, সবকিছুর ব্যাপারে সম্যক জ্ঞানী, পরম করুণাময় দয়ালু, যার দয়া সবকিছুকে শামিল করেছে। এ রকম গুণে গুণান্বিত সত্তা এবং তাঁর সৃষ্টির মাঝে মাধ্যম স্থাপন করা আসলে তাঁর রুবুবিয়্যাত (প্রভূত্ব) উলুহিয়্যাত (ইবাদত-সংক্রান্ত) এবং একত্ব সম্পর্কীয় ব্যাপারে তাঁর ক্ষমতা ছোট করা এবং তাঁর সম্পর্কে কু-ধারণা রাখা ছাড়া আর কি। এটি কখনও তিনি তাঁর বান্দাদের জন্যে বৈধ করেন নি। সুবিবেক এবং সু স্বভাবও এর বৈধতা অস্বীকার করে। আর এর জঘন্যতা সুবিবেকের কাছে অপরাপর সকল জঘন্যতার উপরে স্থান পায়।

এর বিশ্লেষণ এইরূপ: অবশ্যই উপাসনাকারী তাঁর উপাস্যকে সম্মান করে, উপাস্যের মর্যাদা দেয় এবং তাঁর জন্যে বিনয়-নম্রতা অবলম্বন করে। অন্যদিকে মহান রব আল্লাহ তা‘আলাই হচ্ছেন এককভাবে পূর্ণ সম্মান, মর্যাদা, ভালোবাসা এবং বিনয় পাওয়ার হকদার। এটা তাঁর একচ্ছত্র হক। তাই তাঁর হক অন্যকে দেওয়া অথবা তাঁর হকের মাঝে অন্যকে অংশীদার সাব্যস্ত করা জঘন্য যুলুম-অত্যাচার। বিশেষ করে তাঁর হকে শরীককৃত ব্যক্তি যদি তাঁর বান্দা এব দাস হয় তাহলে তা হবে আরো জঘন্য। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ضَرَبَ لَكُم مَّثَلٗا مِّنۡ أَنفُسِكُمۡۖ هَل لَّكُم مِّن مَّا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُم مِّن شُرَكَآءَ فِي مَا رَزَقۡنَٰكُمۡ فَأَنتُمۡ فِيهِ سَوَآءٞ تَخَافُونَهُمۡ كَخِيفَتِكُمۡ أَنفُسَكُمۡۚ كَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَعۡقِلُونَ ٢٨﴾ [الروم: ٢٨]

“আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন: তোমাদেরকে আমরা যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের কেউ কি তাতে অংশীদার? ফলে তোমরা কি তাদেরকে সেরূপ ভয় কর? এভাবেই আমরা বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শণাবলী বর্ণনা করি।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২৮] অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অপছন্দ করে যে, তার দাস তার সম্পদে অংশীদার হোক, তাহলে কীভাবে আমার দাসদের মধ্যে কাউকে আমার অংশীদার করে থাক, যে বিষয়ে আমি একক? আর সে বিষয়টি হচ্ছে, ইবাদত বা উপাসনা, যা আমি ব্যতীত অন্যের জন্যে কখনো সমীচীন নয়, আমি ছাড়া অন্যের জন্য অগ্রহণযোগ্য।

সুতরাং যে কেউ এমন ধারণা রাখবে, সে আমাকে যথোচিত মর্যাদা দিল না, যথাযথ সম্মান করল না, আমাকে একক মনে করলো না, যে বিষয়ে আমি একক কোনো সৃষ্টি নয়। সে ব্যক্তি যথাযথ আল্লাহর সম্মান করলো না যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্যের ইবাদত করলো। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٞ فَٱسۡتَمِعُواْ لَهُۥٓۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَن يَخۡلُقُواْ ذُبَابٗا وَلَوِ ٱجۡتَمَعُواْ لَهُۥۖ وَإِن يَسۡلُبۡهُمُ ٱلذُّبَابُ شَيۡ‍ٔٗا لَّا يَسۡتَنقِذُوهُ مِنۡهُۚ ضَعُفَ ٱلطَّالِبُ وَٱلۡمَطۡلُوبُ ٧٣ مَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦٓۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ ٧٤﴾ [الحج: ٧٣، ٧٤]

“হে লোকসকল! একটি উপমা দেওয়া হচ্ছে, মনোযোগসহ তা শ্রবণ কর; তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাকো তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এই উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্রিত হলেও পারবে না এবং মাছি যদি সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিকট থেকে, এটাও তারা এর নিকট থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। পূজারী ও দেবতা কতই না দুর্বল! (বস্তুত) তারা আল্লাহর যথোচিত মর্যাদা দেয় না; আল্লাহ নিশ্চয় ক্ষমতাবান, পরাক্রমশালী।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৭৩-৭৪]

তাই সে ব্যক্তি আল্লাহর যথাযথ সম্মান করলো না, যে ব্যক্তি তাঁর সাথে এমন কারো ইবাদত করলে যে অতি দুর্বল এবং অতি ছোট প্রাণী সৃষ্টি করতে অক্ষম এবং তার নিকট থেকে যদি মাছি কিছু ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাও উদ্ধার করতে অপারগ।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦ وَٱلۡأَرۡضُ جَمِيعٗا قَبۡضَتُهُۥ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَٱلسَّمَٰوَٰتُ مَطۡوِيَّٰتُۢ بِيَمِينِهِۦۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٧﴾ [الزمر: ٦٧]

“তারা আল্লাহর যথোচিত সম্মান করে না। কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মৃষ্টিতে এবং আকাশমণ্ডলী থাকবে ভাজকৃত তাঁর ডান হাতে। পবিত্র ও মহান তিনি, তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্ধ্বে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৬৭] যার এই মহিমা ও মহত্ব তাঁর সে যথাযথ সম্মান করে না, যে তাঁর ইবাদতে অন্য এমন কাউকে শরীক করে যার এতে কোনোই অংশ নেই, বরং সে সবচেয়ে দুর্বল ও অক্ষম। তাই সে ব্যক্তি শক্তিশালী ক্ষমতাবান আল্লাহর যথাযথ সম্মান করলো না, যে ব্যক্তি দুর্বল পদদলিতকে তাঁর সাথে শরীক করলো”। আল-জাওয়াব আল-কাফী ১৬২-১৬৪।

 

 

اللَّهُ لَآ إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ ۚ

১। আল্লা-হু লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যূল কাইয়্যূমু

আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ্ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক।

 

وَهُوَ الْعَلِىُّ الْعَظِيمُ

৯। ওয়া হুয়াল ‘আলিয়্যূল ‘আযীম

আর তিনি সুউচ্চ সুমহান।

لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ

২। লা তা’খুযুহু সিনাতুঁও ওয়ালা নাউম।

তাঁকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না, নিদ্রাও নয়।

 

وَلاَ يَؤُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ

৮। ওয়ালা ইয়াউদুহূ হিফযুহুমা

আর এ দুটোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর জন্য বোঝা হয় না।

 

لَّهُ مَا فِى السَّمٰوٰتِ وَمَا فِى الْأَرْضِ ۗ

৩। লাহূ মা-ফিসসামা-ওয়া-তি ওয়ামা ফিল আরদ্বি।

আসমানসমূহে যা রয়েছে ও যমীনে যা রয়েছে সবই তাঁর।

 

وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ ۖ

৭। ওয়াসি‘আ কুরসিয়্যুহুস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদ্ব।

তাঁর ‘কুরসী’ আসমানসমূহ ও যমীনকে পরিব্যাপ্ত করে আছে;

 

مَنْ ذَا الَّذِى يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِۦ ۚ

৪। মান যাল্লাযী ইয়াশফা‘উ ‘ইনদাহূ ইল্লা বিইযনিহী।

কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর কাছে সুপারিশ করবে?

 

وَلَا يُحِيطُونَ بِشَىْءٍ مِّنْ عِلْمِهِۦٓ إِلَّا بِمَا شَآءَ ۚ

৬। ওয়ালা ইয়ুহীতূনা বিশাইইম মিন্ ইলমিহী ইল্লা বিমা শাআ।

আর যা তিনি ইচ্ছে করেন তা ছাড়া তাঁর জ্ঞানের কোনো কিছুকেই তারা পরিবেষ্টন করতে পারে না।

 

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ

৫। ইয়া‘লামু মা বাইনা আইদীহিম ওয়ামা খালফাহুম।

তাদের সামনে ও পিছনে যা কিছু আছে তা তিনি জানেন।

মোট ৯টি বাক্য।

(৩) দ্বিতীয় বাক্য (الْحَيُّ الْقَيُّومُ) আরবী ভাষায় حَيٌّ অর্থ হচ্ছে জীবিত। আল্লাহর নামের মধ্য থেকে এ নামটি ব্যবহার করে বলে দিয়েছে যে, তিনি সর্বদা জীবিত; মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। قَيُّوم শব্দ কেয়াম থেকে উৎপন্ন, এটা ব্যুৎপত্তিগত আধিক্যের অর্থে ব্যবহৃত। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তিনি নিজে বিদ্যমান থেকে অন্যকেও বিদ্যমান রাখেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। কাইয়ূম আল্লাহর এমন এক বিশেষ গুণবাচক নাম যাতে কোন সৃষ্টি অংশীদার হতে পারে না। তার সত্তা স্থায়ীত্বের জন্য কারো মুখাপেক্ষী নয়। কেননা, যে নিজের স্থায়ীত্ব ও অস্তিত্বের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী, সে অন্যের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ কি করে করবে? সে জন্যই কোন মানুষকে কাইয়ূম বলা জায়েয নয়। যারা আবদুল কাইয়ূম নামকে বিকৃত করে শুধু কাইয়ুম বলে, তারা গোনাহগার হবে। অনুরূপভাবে, আল্লাহর এমন আরও কিছু নাম আছে, যেগুলো কোন বান্দাহর বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। যেমন, রাহমান, মান্নান, দাইয়্যান, ওয়াহহাব এ জাতীয় নামের ব্যাপারেও উপরোক্ত হুকুম প্রযোজ্য। আল্লাহর নামের মধ্যে (الْحَيُّ الْقَيُّومُ) অনেকের মতে ইসমে-আযম।

(৪) তৃতীয় বাক্য لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ আরবীতে سِنَةٌ শব্দের সীন-এর كسرة দ্বারা উচ্চারণ করলে এর অর্থ হয় তন্দ্রা বা নিদ্রার প্রাথমিক প্রভাব, نوم পূর্ণ নিদ্রাকে বলা হয়। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তা’আলা তন্দ্রা ও নিদ্রা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। পূর্ববর্তী বাক্যে ‘কাইয়ূম’ শব্দে মানুষকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, আসমান ও যমীনের যাবতীয় বস্তুর নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছেন আল্লাহ্‌ তা’আলা। সমস্ত সৃষ্টিরাজি তাঁর আশ্রয়েই বিদ্যমান। এতে করে হয়ত ধারণা হতে পারে যে, যে সত্তা এত বড় কার্য পরিচালনা করেছেন, তার কোন সময় ক্লান্তি আসতে পারে এবং কিছু সময় বিশ্রাম ও নিদ্রার জন্য থাকা দরকার। দ্বিতীয় বাক্য দ্বারা সীমিত জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে জানানো হয়েছে যে, আল্লাহকে নিজের বা অন্য কোন সৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করবে না, নিজের মত মনে করবে না। তিনি সমকক্ষতা ও সকল তুলনার উর্ধ্বে। তার পরিপূর্ণ ক্ষমতার পক্ষে এসব কাজ করা কঠিন নয়। আবার তার ক্লান্তিরও কোন কারণ নেই। আর তার সত্তা যাবতীয় ক্লান্তি, তন্দ্রা ও নিদ্রার প্রভাব থেকে মুক্ত ও পবিত্র।

(৫) চতুর্থ বাক্য (لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ) বাক্যের প্রারম্ভে ব্যবহৃত “লাম” অক্ষর মালিকানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আকাশ এবং যমীনে যা কিছু রয়েছে সে সবই আল্লাহর মালিকানাধীন। তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইচ্ছাশক্তির মালিক। যেভাবে ইচ্ছা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

(৬) পঞ্চম বাক্য (مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ) অর্থ হচ্ছে, এমন কে আছে যে, তার সামনে কারো সুপারিশ করতে পারে, তার অনুমতি ব্যতীত? এতে বুঝা যায় যে, যখন আল্লাহ্ তা’আলা যাবতীয় সৃষ্ট বস্তুর মালিক এবং কোন বস্তু তার চাইতে বড় নয়, তাই কেউ তার কোন কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকারী নয়। তিনি যা কিছু করেন, তাতে কারো আপত্তি করার অধিকার নেই। তবে এমন হতে পারত যে, কেউ কারো জন্য সুপারিশ করে, তাই এ বিষয়টিও স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে যে, এ ক্ষমতাও কারো নেই। তবে আল্লাহর কিছু খাস বান্দা আছেন, যারা তার অনুমতি সাপেক্ষে তা করতে পারবেন, অন্যথায় নয়। হাদীসে এরশাদ হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম আমি সুপারিশ করব। [মুসলিমঃ ১৯৩] একে ‘মাকামে-মাহমুদ’ বলা হয়, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য খাস। অন্য কারো জন্য নয়।

(৭) ষষ্ঠ বাক্য (يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা অগ্র-পশ্চাত যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনা সম্পর্কে অবগত। অগ্র-পশ্চাত বলতে এ অর্থও হতে পারে যে, তাদের জন্মের পূর্বের ও জন্মের পরের যাবতীয় অবস্থা ও ঘটনাবলী আল্লাহর জানা রয়েছে। আর এ অর্থও হতে পারে যে, অগ্র বলতে সে অবস্থা বোঝানো হয়েছে যা মানুষের জন্য প্রকাশ্য, আর পশ্চাত বলতে বোঝানো হয়েছে যা অপ্রকাশ্য। তাতে অর্থ হবে এই যে, কোন কোন বিষয় মানুষের জ্ঞানের আওতায় রয়েছে কিন্তু কোন কোন বিষয়ে তাদের জ্ঞান নেই। কিছু তাদের সামনে প্রকাশ্য আর কিছু গোপন। কিন্তু আল্লাহর ক্ষেত্রে সবই প্রকাশ্য। তার জ্ঞান সে সমস্ত বিষয়ের উপরই পরিব্যপ্ত। সুতরাং এ দুটিতে কোন বিরোধ নেই। আয়াতের ব্যাপকতায় উভয়দিকই বোঝানো হয়।

(৮) সপ্তম বাক্য (وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ) অর্থাৎ মানুষ ও সমগ্র সৃষ্টির জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের কোন একটি অংশবিশেষকেও পরিবেষ্টিত করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা যাকে যে পরিমাণ জ্ঞান দান করেন শুধু ততটুকুই সে পেতে পারে। এতে বলা হয়েছে যে, সমগ্র সৃষ্টির অণু-পরমাণুর ব্যাপক জ্ঞান আল্লাহর জ্ঞানের আওতাভুক্ত, এটা তার বৈশিষ্ট্য। মানুষ অথবা অন্য কোন সৃষ্টি এতে অংশীদার নয়।

(৯) অষ্টম বাক্য (وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ) অর্থাৎ তার কুরসী এত বড় যার মধ্যে সাত আকাশ ও যমীন পরিবেষ্টিত রয়েছে। হাদীসের বর্ণনা দ্বারা এতটুকু বোঝা যায় যে, আরশ ও কুরসী এত বড় যে, তা সমগ্র আকাশ ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। ইবনে কাসীর আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, কুরসী কি এবং কেমন? তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যার হাতে আমার প্রাণ তার কছম, কুরসীর সাথে সাত আসমানের তুলনা একটি বিরাট ময়দানে ফেলে দেয়া একটি আংটির মত। আর কুরসীর উপর আরশের শ্রেষ্ঠত্ব যেমন আংটির বিপরীতে বিরাট ময়দানের শ্রেষ্ঠত্ব। [ইবন হিব্বান: ৩৬১ বায়হাকী: ৪০৫]

(১০) নবম বাক্য (وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষে এ দুটি বৃহৎ সৃষ্টি, আসমান ও যমীনের হেফাজত করা কোন কঠিন কাজ বলে মনে হয় না। কারণ, এই অসাধারণ ও একক পরিপূর্ণ সত্তার পক্ষে এ কাজটি একান্তই সহজ ও অনায়াসসাধ্য।

(১১) দশম বাক্য (وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ) অর্থাৎ তিনি অতি উচ্চ ও অতি মহান। পূর্বের নয়টি বাক্যে আল্লাহর সত্তা ও গুণের পূর্ণতা বর্ণনা করা হয়েছে। তা দেখার এবং বোঝার পর প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলতে বাধ্য হবে যে, সকল শান-শওকত, বড়ত্ব ও মহত্ব এবং শক্তির একমাত্র মালিক আল্লাহ তা’আলা। এ দশটি বাক্যে আল্লাহর যাত ও সিফাতের পূর্ণ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

২৫৬ لَاۤ اِکۡرَاهَ فِی الدِّیۡنِ ۟ۙ قَدۡ تَّبَیَّنَ الرُّشۡدُ مِنَ الۡغَیِّ ۚ فَمَنۡ یَّکۡفُرۡ بِالطَّاغُوۡتِ وَ یُؤۡمِنۡۢ بِاللّٰهِ فَقَدِ اسۡتَمۡسَکَ بِالۡعُرۡوَۃِ الۡوُثۡقٰی ٭ لَا انۡفِصَامَ لَهَا ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

২৫৬. দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কেন জোর-জবরদস্তি নেই; সত্য পথ সুস্পষ্ট হয়েছে ভ্রান্ত পথ থেকে। অতএব, যে তাগুতকে অস্বীকার করবে ও আল্লাহর উপর ঈমান আনবে সে এমন এক দৃঢ়তর রজ্জু ধারন করল যা কখনো ভাঙ্গবে না। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।

আল্লাহ تعالى এখানে কঠিনভাবে বলেছেন لَا إِكْرَاهَ, কোনো ধরনের জোর জবরদস্থি করা যাবে না। এই আয়াতে শব্দটা হচ্ছে إِكْرَاه, যার অর্থ কোনো একটা ব্যাপার কেউ ঘৃণা করে, এবং তাকে সেটাই জোর করে করানো। বাইয়িনাহ এর কু’রআনের তাফসীর  মুহাম্মাদ মোহার আলি — A Word for Word Meaning of The Quran

একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, কেন জোর জবস্থি করে ধর্ম মানানো সম্ভব না। ধর্ম মানুষের অন্তরের ব্যাপার। মানুষকে জোর করে কোনো কিছু বিশ্বাস করানো যায় না। কারো সামনে তলোয়ার ধরে বললাম, “তিন দিন সময় দিলাম। এর মধ্যে মুসলিম হয়ে যাও। নাইলে…” — তাহলে সে মনে প্রাণে ইসলামে বিশ্বাস করে, তার যাবতীয় ভুল বিশ্বাস ভেঙ্গে ফেলবে না। সে বড়জোর একজন মুনাফিক হয়ে যাবে। একইসাথে কাউকে গিয়ে হুমকি দিলাম, “যদি কালকে থেকে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে না দেখি, তাহলে তোমাকে ধরে… ” — এই হুমকিতে সে হয়তো মসজিদে যাবে। কিন্তু সেটা আল্লাহর تعالى জন্য হবে না, হবে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে।

জোর করে ইসলাম গ্রহণ করানো ‘ইসলাম’ এবং ‘মুসলিম’ এই দুটো শব্দের সংজ্ঞারই পরিপন্থী। ‘মুসলিম’ শব্দের অর্থ: যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর تعالى ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করেছে। কাউকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার ইচ্ছাকে আল্লাহর تعالى কাছে সমর্পণ করানো যায় না —এটা স্ববিরোধী, অযৌক্তিক কথা। আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, আল্লাহ تعالى এই আয়াতে বলেননি যে, ইসলামে কোনো জোর জবস্থি নেই। বরং তিনি বলেছে,ধর্মে কোনো জরজবরদস্থি নেই। তাই অন্য ধর্মের লোকেরা যেন তাদের ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস, সংস্কৃতি জোর করে মুসলিমদের উপর চাপিয়ে না দেয়। তারা যেন মুসলিমদের শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারে বাঁধা না দেয়। যদি দেয়, সেটা ফিতনা হবে, এবং সেই ফিতনা দূর করতে মুসলিমরা সংগ্রাম করতে পারবে

কোন কোন লোক প্রশ্ন করে যে, আয়াতের দ্বারা বোঝা যায়, দ্বীনগ্রহণে কোন বল প্রয়োগ নেই। অথচ দ্বীন ইসলামে জিহাদ ও যুদ্ধের শিক্ষা দেয়া হয়েছে? একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে, এমন প্রশ্ন যথার্থ নয়। কারণ, ইসলামে জিহাদ ও যুদ্ধের শিক্ষা মানুষকে ঈমান আনয়নের ব্যাপারে বাধ্য করার জন্য দেয়া হয়নি। যদি তাই হত, তবে জিযিয়া করের বিনিময়ে কাফেরদেরকে নিজ দায়িত্বে আনার কোন প্রয়োজন ছিল না। ইসলামে জিহাদ ও যুদ্ধ ফেৎনা-ফাসাদ বন্ধ করার লক্ষ্যে করা হয়। কেননা, ফাসাদ আল্লাহর পছন্দনীয় নয়, অথচ কাফেররা ফাসাদের চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকে। তাই আল্লাহ্‌ তা’আলা এরশাদ করেছেন

(وَيَسْعَوْنَ فِي الْأَرْضِ فَسَادًا) “তারা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়ায়, কিন্তু আল্লাহ্‌ তা’আলা ফাসাদকারীদের পছন্দ করেন না”। [সূরা আল-মায়িদাহ ৬৪] এজন্য আল্লাহ্ তা’আলা জিহাদ এবং কেতালের মাধ্যমে এসব লোকের সৃষ্ট যাবতীয় অনাচার দূর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সে মতে জিহাদের মাধ্যমে অনাচারী যালেমদের হত্যা করা সাপ-বিচ্ছু ও অন্যান্য কষ্টদায়ক জীবজন্তু হত্যা করারই সমতুল্য।

ইসলাম জিহাদের ময়দানে স্ত্রীলোক, শিশু, বৃদ্ধ এবং অচল ব্যক্তিদের হত্যা করতে বিশেষভাবে নিষেধ করেছে। আর এমনিভাবে সে সমস্ত মানুষকেও হত্যা করা থেকে বিরত করেছে, যারা জিযিয়া কর দিয়ে আইন মান্য করতে আরম্ভ করেছে। ইসলামের এ কার্যপদ্ধতিতে বোঝা যায় যে, সে জিহাদ ও যুদ্ধের দ্বারা মানুষকে ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করে না, বরং এর দ্বারা দুনিয়া থেকে অন্যায় অনাচার দূর করে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আদেশ দিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, জিহাদ-যুদ্ধের নির্দেশ (لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ) আয়াতের পরিপন্থী নয়।

আবার কোন কোন নামধারী মুসলিম ইসলামের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাদেরকে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তারা “দ্বীন সম্পর্কে জোরজবরদস্তি নেই” এ অংশটুকু বলে। তারা জানে না যে, এ আয়াত দ্বারা যারা ইসলাম গ্রহণ করেনি শুধু তাদেরকে জোর করে ইসলামে আনা যাবে না বলা হয়েছে। কিন্তু হুকুম-আহকাম মানতে বাধ্য। সেখানে শুধু জোর-যবরদস্তি নয়, উপরন্তু শরীআত না মানার শাস্তিও ইসলামে নির্ধারিত। এমনকি তাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদেরকে দ্বীনের যাবতীয় আইন মানতে বাধ্য করানো অন্যান্য মুসলিমদের উপর ওয়াজিব। যেমনটি সিদ্দীকে আকবার আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত প্রাদানে অস্বীকারকারদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন।

একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হাদিস দক্ষ বক্তাদের প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায়। বাজারে প্রচলিত জিহাদি বইগুলোতে এই হাদিসটি থাকবেই

“আমি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি যতক্ষণ না তারা বলে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” সুতরাং যে ব্যাক্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর সাক্ষ্য দিবে তাঁর জান ও মাল-সম্পদ আমার থেকে নিরাপদ। তবে ইসলামের কোনো হক্‌ ব্যাতীত। আর তাঁর অন্তরের হিসাব আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত।” (বুখারী, মুসলিম)

এই হাদিসটি পড়লে মনে হবে, রাসুল عليه السلام বলছেন যে, তাকে পাঠানো হয়েছে সব অমুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য, যতক্ষণ না তারা কালেমা পড়ে সবাই মুসলিম হয়ে না যাচ্ছে। তার মানে আমাদেরকেও সব অমুসলিমদের আক্রমণ করতে হবে, যতক্ষণ না তারা কালেমা পড়ে মুসলিম না হচ্ছে। —এটা কত বড় বিভ্রান্তি দেখুন। এই হাদিসটি মূল হাদিসের অংশবিশেষ। মূল আরবি পড়লেই বিভ্রান্তিটি ধরা যাবে—

عَنْ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم قَالَ: “أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ، وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ؛ فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إلَّا بِحَقِّ الْإِسْلَامِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ تَعَالَى” .

[رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ]، [وَمُسْلِمٌ]

ইব্‌নু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত: আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আমি লোকদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য নির্দেশিত হয়েছি, যতক্ষন না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রসূল, আর সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। তারা যদি এগুলো করে, তবে আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মালের ব্যাপারে নিরাপত্তা লাভ করলো; অবশ্য ইসলামের বিধান অনুযায়ী যদি কোন কারণ থাকে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আর তাদের হিসাবের ভার আল্লাহর উপর অর্পিত।

এটি ইমাম নায়ায়ির ৪০ হাদিসের মধ্যে ৮ নম্বর হাদিস, সাহিহ বুখারির ২:১৮ । লক্ষ্য করে দেখুন, এই হাদিসের একটি অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে: “আর সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে” কারণ এই অংশটি থাকলে বিরাট সমস্যা। বহু মুসলিম আছে যারা সালাত ও যাকাত আদায় করে না। তার মানে আমাদেরকে আমাদের চারপাশের মুসলিমদের সাথেও যুদ্ধ করতে হবে, কারণ তারা অনেকেই সালাত প্রতিষ্ঠা করে না, যাকাতও আদায় করে না। তখন আর এই হাদিসটাকে শুধু অমুসলিমদের নামে চালিয়ে দেওয়া যাবে না।

এই হাদিসটি পড়লে প্রথমেই যেই প্রশ্ন আশা উচিত, সেটা হচ্ছে النَّاسَ বা ‘লোকরা’ কারা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলা হয়েছে? এরা কি সব অমুসলিম? বিখ্যাত হাদিস বিশারদরা কী বলেছেন দেখি—

ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, “সেই সব লোকদের নির্দেশ করে, যারা যুদ্ধ শুরু করেছে, যাদের সাথে যুদ্ধ করতে আল্লাহ تعالى আমাদের অনুমতি দিয়েছেন। এটি তাদের নির্দেশ করে না, যাদের সাথে আমাদের চুক্তি আছে, যাদের সাথে চুক্তি মানতে আল্লাহ تعالى আমাদের বলেছেন।” [মাজমু’ আল-ফাতাওয়া ১৯/২০] সৌদি আরবের প্রাক্তন প্রধান মুফতি শাইখ ইবন বা’য এর ফাতয়া অনুসারে এরা হচ্ছে সেই সব লোক, যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে, কিন্তু কাজে তারা ইসলামের মূল ভিত্তিগুলো অনুসরণ করে না, অর্থাৎ নামাজ প্রতিষ্ঠা করে না, যাকাত আদায় করে না। Alifta.net (2016). Fatwas of Ibn Baz .

ইবন হাজার আল-আস্কালানি তার সাহিহ বুখারির ব্যাখ্যায় ৫ বা ৬ ধরনের মানুষের কথা বলেছেন, যাদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে। অর্থাৎ কাদের সাথে যুদ্ধ করা যাবে, সেটা সুনির্দিষ্ট, ঢালাও ভাবে কোনো দেশের সব অমুসলিমরা নয়। 40hadithnawawi.com (2016). “Hadith 8 – The Sanctity of a Muslim”

একটি ইসলামি রাষ্ট্রে একজন কাফির-এর তার কুফরির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার অনুমতি রয়েছে। কিন্তু সে যদি একবার ইসলামে প্রবেশ করে যায়, তাহলে তাকে আবার ইসলাম ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না। যদি তা হয়, তাহলে আইন ও নিরাপত্তা নষ্ট হয়ে যাবে। দেখা যাবে, কেউ মুসলিম হয়ে কোনো পছন্দের মুসলিম নারীকে বিয়ে করে, তারপরে আবার নিজেকে অমুসলিম বলে ঘোষণা দিচ্ছে। একই সাথে ইসলামের বদনাম করার উদ্দেশ্যে অনেকে মুসলিম হয়ে আবার অমুসলিম হয়ে দেখিয়ে দেবে যে, ইসলাম আসলে সত্য ধর্ম নয়।

“কিন্তু ধর্ম তো মানুষের নিজের ব্যাপার। সে ইচ্ছা হলে বিশ্বাস করবে, ইচ্ছা না হলে ছেড়ে দেবে” — কিছু মানুষকে দেখা যায় এধরনের কথা বলতে। প্রথমে বুঝতে হবে, ধর্ম কোনো ফ্যাশন না, পছন্দ হলে করলাম, না হলে করলাম না। ইসলামকে ভুল ধর্ম মনে করে ছেড়ে দেওয়া অর্থ স্বীকার করা যে, মুহাম্মাদ عليه السلام একজন প্রতারক, ভণ্ড, যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেছেন। একইসাথে এটাও স্বীকার করা যে, কু’রআন একটা নকল বই, এটা আল্লাহর تعالى বাণী নয়। মুহাম্মাদ عليه السلام বা তার পরের মুসলিমরা এক বিরাট প্রতারণা করে কু’রআনকে আল্লাহ تعالى বাণী বলে হাজার বছর ধরে প্রচার করেছেন। এগুলো কোনো সহজ দাবি না যে, তা সহজে মেনে নেওয়া যায়।

আর যে ইসলামকে সঠিক জেনেও ইসলাম মানবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে একজন অপরাধী। সে আর আল্লাহকে تعالى মানে না, আল্লাহর تعالى বিধানকে মানে না। এবং যে আল্লাহকে تعالى একবার মেনে নিয়ে আবার তাঁকে تعالى অমান্য করে, তার দ্বারা যে কোনো অন্যায় করা সম্ভব। কারণ, সে আর জাহান্নামের শাস্তিকে মানে না, সে আল্লাহর تعالى আযাবকে আর ভয় পায় না। এই ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধীদের কাছ থেকে মুসলিমদেরকে রক্ষা করতে হবে।

একারণে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে মুরতাদ অর্থাৎ ইসলাম ত্যাগীদের বাঁধা দেওয়া মুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি। তাই যেমন মানবাধিকারের নামে হত্যা, চুরি, ধর্ষণের অপরাধের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না, ঠিক একইভাবে ইসলাম ত্যাগীদেরকেও ইসলামের আইন ভাঙ্গার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না। তাফসীর আহসানুল বায়ান — ইসলামিক সেন্টার, আল-মাজমাআহ, সউদি আরব

যেমন, কেউ সিদ্ধান্ত নিলো যে সে কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করবে। কিন্তু তারপরে সে আবার সেই দেশের নাগরিকত্ব অস্বীকার করলো, নাগরিকদের উপর প্রযোজ্য আইন মানবে না বলে দাবি করলো। তাহলে অবশ্যই তাকে শাস্তি দিতে হবে। একইভাবে মুসলিম হয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে ইসলামের নাগরিকত্ব গ্রহণ করা, আর মুরতাদ হচ্ছে ইসলামের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা, ইসলামের আইন অস্বীকার করা।

কেন ধর্ম মানতে কোনো জোরজবরদস্থি নেই, সেটাও আল্লাহ تعالى পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন—

সঠিক পথ ভুল পথ থেকে পরিষ্কারভাবে আলাদা হয়ে গেছে।

অন্য সব ধর্মের ভুলগুলো কোথায়, কেন ইসলাম একমাত্র সঠিক ধর্ম, সেটা আল্লাহ تعالى কু’রআনে বহু যুক্তি, উদাহরণ দিয়ে একদম পরিষ্কার করে দিয়েছেন। যাদের বিবেকবুদ্ধি আছে, তারা এগুলো নিয়ে নিরেপক্ষভাবে চিন্তা করলেই বুঝতে পারবে ইসলামের সত্যতা কোথায়। তাদেরকে কোনো ধরনের জোর করার প্রয়োজন পড়বে না। বরং মানুষকে কোনো কিছু মানতে কোনো ধরনের জোর করলেই তার ভেতরে এক ধরনের ঘৃণা জন্মে যায়। সেই ঘৃণা তখন তার নিরেপক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে অন্ধ করে দেয়। শুধু ঘৃণার কারণেই সে আর তখন সত্য মেনে নায় না।

ইসলাম ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। কু’রআনে পরিষ্কার বলা হয়েছে—

যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহলে পৃথিবীতে সবাই অবশ্যই বিশ্বাস করত। তাহলে তুমি কি মানুষকে জোর জবরদস্তি করবে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত? [ইউনুসঃ ৯৯]

وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ ۖ وَقُولُوا آمَنَّا بِالَّذِي أُنزِلَ إِلَيْنَا وَأُنزِلَ إِلَيْكُمْ وَإِلَٰهُنَا وَإِلَٰهُكُمْ وَاحِدٌ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ

আহলে কিতাবের মানুষদের সাথে সুন্দরভাবে ছাড়া যুক্তিতর্ক করবে না। তবে যারা অন্যায় করে, তাদের কথা আলাদা। বল, “আমরা বিশ্বাস করি যা আমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে, এবং যা তোমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে; আমাদের এবং তোমাদের উপাস্য প্রভু একই সত্তা, আমরা তাঁরই প্রতি নিজেদেরকে সমর্পণ করি।” [আল-আনকাবুতঃ ৪৬]

কোনো মুশরিক (মূর্তি পূজারি, যারা শিরক করে) যদি তোমাদের কাছ নিরাপত্তা চায়, তাহলে তাকে তা দেবে, যেন সে আল্লাহর বাণী শোনার সুযোগ পায়। তারপর তাকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে। আসলে তারা এমন একটা জাতি, যাদের জ্ঞান নেই। [আত-তাওবাহঃ ৬]

(২)

পবিত্র কোরআনে মোট আট স্থানে ‘তাগুত’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

তাগুত শব্দটি আরবী (তুগইয়ান) শব্দ থেকে উৎসারিত, যার অর্থ সীমালংঘন করা, বাড়াবাড়ি করা, স্বেচ্ছাচারিতা।

‘তাগূত’ শব্দটি আরবী ভাষায় সীমালংঘনকারী বা নির্ধারিত সীমা অতিক্রমকারী ব্যাক্তিকে বুঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইসলামী শরী’আতের পরিভাষায় তাগূত বলা হয়ে থাকে এমন প্রত্যেক ইবাদতকৃত বা অনুসৃত অথবা আনুগত্যকৃত সত্তাকে, যার ব্যাপারে ইবাদতকারী বা অনুসরণকারী অথবা আনুগত্যকারী তার বৈধ সীমা অতিক্রম করেছে আর ইবাদাতকৃত বা অনুসৃত অথবা আনুগত্যকৃত সত্তা তা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করে নিয়েছে বা সেদিকে আহবান করেছে। [ইবনুল কাইয়্যেম: ইলামুল মু’আক্কোয়ীন] সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি যে, তাগূত এমন বান্দাকে বলা হয়, যে বন্দেগী ও দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভূ ও ইলাহ হবার দাবীদার সাজে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজের বন্দেগী ও দাসত্বে নিযুক্ত করে।

তাগুত শব্দটির আভিধানিক অর্থ যে জেনে শুনে সীমা লঙ্ঘন করে। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহ تعالى ছাড়া যাদেরকেই অনুসরণ করা হয়, যারাই নিজেদেরকে অনুসরণ করতে বলে, আল্লাহর تعالى আইনের উপর নিজের আইন চাপিয়ে দেয়, আল্লাহর تعالى দাবি থেকে নিজেদের দাবিকে প্রাধান্য দেয়, তারাই তাগুত। তাগুত হচ্ছে যাবতীয় অপশক্তি, যা আমাদেরকে আল্লাহর تعالى অবাধ্যতার দিকে নিয়ে যায়।[

অধিকন্তু আরও বলা যায় যে, তাগুত শব্দ এসেছে “তাগা” যার অর্থ “সীমা লংঘন করা, আল্লাহ ছাড়া যা কিছুর উপাসনা করা হয় এবং যে এতে রাজি-খুশি থাকে, তাকে তাগুত বলা হয়।

সব সীমালংঘনই তাগুত নয়। যে সীমালংঘন আল্লাহর দাসত্ব থেকে সরিয়ে নেয় সেটাই তাগুত।

সূরা আনকবূতের প্রথম আয়াতেই আল্লাহ তাআলা বলেন –

মানুষ কি মনে করে যে আল্লাহর প্রতি ঈমন এনেছি বললেই তাদেরকে বিনা পরীক্ষায় ছেড়ে দেওয়া হবে?

ঈমানের পরীক্ষা আসে তাগূতের মাধ্যমে। তাগূতকে অমান্য করার সিদ্ধান্ত না থাকলে পরীক্ষায় অবশ্যই ফেল করবে।

আল্লাহর মোকাবেলায় বান্দার প্রভূত্বের দাবীদার সাজার এবং বিদ্রোহ করার তিনটি পর্যায় রয়েছে।

প্রথম পর্যায়ে বান্দা নীতিগতভাবে তার শাসন কর্তৃত্বকে সত্য বলে মেনে নেয়। কিন্তু কার্যত তার বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে। একে বলা হয় ‘ফাসেকী’।

দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে আল্লাহর শাসন-কর্তৃত্বকে নীতিগতভাবে মেনে না নিয়ে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করতে থাকে। একে বলা হয় কুফর ও শির্ক।

তৃতীয় পর্যায়ে সে মালিক ও প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার রাজ্যে এবং তার প্রজাদের মধ্যে নিজের হুকুম চালাতে থাকে। এ শেষ পর্যায়ে যে বান্দা পৌছে যায়, তাকেই বলা হয় তাগুত।

এ ধরণের তাগূত অনেক রয়েছে। কিন্তু প্রসিদ্ধ তাগুত ওলামায়ে কেরাম পাঁচ প্রকার উল্লেখ করেছেন।

(এক) শয়তান, সে হচ্ছে সকল প্রকার তাগূতের সর্দার। যেহেতু সে আল্লাহর বান্দাদেরকে আল্লাহর ইবাদাত থেকে বিরত রেখে তার ইবাদাতের দিকে আহবান করতে থাকে, সেহেতু সে বড় তাগুত।

আল্লাহ তাআলার এই বাণী,

أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِي آدَمَ أَن لَّا تَعْبُدُوا الشَّيْطَانَ ۖ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ

অর্থাৎ, হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করিনি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করো না। কারণ সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা ইয়াসীন-৬০ আয়াত)

(দুই) যে গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞান রয়েছে বলে দাবী করে বা অদৃশ্যের সংবাদ মানুষের সামনে পেশ করে থাকে। যেমন, গণক, জ্যোতিষী প্রমূখ।

মানুষের অন্তরের ভিতরে কি আছে তা বলতে পারে বলে দাবী করে। ভাগ্য বলে দিবো। বিভিন্ন রঙের পাথর দিয়ে ভাগ্য পরিবর্তন করে। ব্যক্তির হাতে দেখা যায় কয়েকটি আংটি, জিজ্ঞেস করলে বলবে  বলে অমুক বাবা, অমুক খাজা দিয়েছে কোনটা ব্যবসায় উন্নতি, জীবনে সফলতা ইত্যাদি।

অনেকে মুখে বলে থাকেন, তোর ভবিষ্যত অন্ধকার বা ভবিষ্যতে কিছুই করতে পারবি না, এই ধরনের কথা বলাটাও ঠিক নয়।

অথচ আল্লাহ বলেনঃ

“তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এ গুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানেনা। স্থলে ও জলে যা আছে, একমাত্র তিনিই জানেন। কোন পাতা ঝরে না, কিন্তু তিনি তা জানেন। কোন শস্য কণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুস্ক দ্রব্য পতিত হয় না, কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে”। সুরা আন-আমঃ ৫৯।

قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ

অর্থাৎ, বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর কেউই গায়েব (অদৃশ্যের) খবর জানে না।’ (সূরা নামল ৬৫ আয়াত)।

 (তিন) যে আল্লাহর বিধানে বিচার ফয়সালা না করে মানব রচিত বিধানে বিচার-ফয়সালা করাকে আল্লাহর বিধানের সমপর্যায়ের অথবা আল্লাহর বিধানের চেয়ে উত্তম মনে করে থাকে। অথবা আল্লাহর বিধানকে পরিবর্তন করে বা মানুষের জন্য হালাল-হারামের বিধান প্রবর্তন করাকে নিজের জন্য বৈধ মনে করে।

أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ

অর্থাৎ, ওদের কি এমন কতক অংশীদার আছে, যারা বিধান দেয় এমন দ্বীনের যার উপর আল্লাহ অনুমতি দেননি? (সূরা শুরা-২১ আয়াত)

وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

অর্থাৎ, এবং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই তো কাফের। (সূরা মায়েদাহ ৪৪ আয়াত)

 (চার) যার ইবাদাত করা হয় আর সে তাতে সন্তুষ্ট।

وَمَن يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَٰهٌ مِّن دُونِهِ فَذَٰلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ ۚ كَذَٰلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ

অর্থাৎ, ওদের মধ্যে যে বলবে, ‘তাঁর (আল্লাহর) পরিবর্তে আমিই মাবুদ তাকে আমি জাহান্নামের শাস্তি প্রদান করব। এভাবে আমি সীমালংঘনকারীদেরকে শাস্তি প্রদান করে থাকি। (সূরা আম্বিয়া ২৯ আয়াত)

(পাঁচ) যে মানুষদেরকে নিজের ইবাদাতের দিকে আহবান করে থাকে। উপরোক্ত আলোচনায় পাঁচ প্রকার তাগূতের পরিচয় তুলে ধরা হলেও তাগূত আরও অনেক রয়েছে। [কিতাবুত তাওহীদ]

সাধারনত এই ধরনের তাগুতী শক্তি প্রথমেই নিজেকে রব বলে কাজ শুরু করে না, মানুষের শুভাকাংখী হয়েই কাজ শুরু করে।সংস্কারক হয়েই কাজ করে, আস্তে আস্তে পদমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে। আস্তে আস্তে ব্যক্তির অন্তরে ভালোবাসা পদমর্যাদা অন্ধ ভক্তির জায়গাটা প্রস্তুত করে তারপর মহান রবের দাসত্ব থেকে সরিয়ে নেয়।

যেমন বিভিন্ন ফেরকার গ্রুপ।

কোন কোন ব্যক্তি বিভিন্নরুপ দরুদ/যিকির বানিয়ে অন্যকে আমল করতে বলে। কুর’আন সুন্নাহ উল্লেখিত দু’আ দরুদের দিকে যেতে মানা করে নিজের বানানোগুলো আমল করতে দাওয়া দেয়। আমি তোমার নেতা আমার কথাই মানতে হবে, কুর’আন হাদীসের কথা আরেকদিকে রাখো-এইভাবে কর্তৃত্ব খাটায়।

সূরা তওবার ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ

‘তারা তাদের ওলামা ও পীরদেরকে আল্লাহর বদলে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।

মহান আল্লাহ সুস্পষ্ট জানিয়েছেন-

এসব লোক কি আল্লাহর এমন কোন শরীকে বিশ্বাস করে যে এদের জন্য দীনের মত এমন একটি পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছে আল্লাহ যার অনুমোদন দেননি? যদি ফায়সালার বিষয়টি পূর্বেই মীমাংসিত হয়ে না থাকতো তাহলে তাদের বিবাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হতো৷এ জালেমদের জন্য নিশ্চিত কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে৷শূরাঃ২১

আল্লাহ তা’আলা বলেন-

– ‘সেদিন তাদের মুখমণ্ডল আগুনে উলটপালট করা হবে, তারা বলতে থাকবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ এবং (আল্লাহর) রাসূলের অনুসরণ করতাম। ‘তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। ‘হে আমাদের প্রতিপালক!তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে দাও মহাঅভিসম্পাত।[সূরা আহযাব : ৬৬-৬৮]

প্রতিটি ব্যক্তির নিজ দায়িত্ব হক ও বাতিল জানা, সচেতন থাকা আর তা না হলে দাজ্জালের ফিতনায় পড়ে যাবে। যতটুকু জ্ঞান থাকলে ইমান সঠিকভাবে রাখা আমল করা ও জীবন রবের পথে পরিচালিত করা যাবে ততটুকু জ্ঞান রাখা প্রত্যেকের দায়িত্ব।

কুর’আনের প্রথম নাযিল করা শব্দ হলো ইক্বরা, পড়ো। আর এই পড়ার কথা বলেই বলা হয়েছে যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর নামে। অর্থাৎ যত জ্ঞান অর্জন করা হোক না কেনো সকল কিছুর মাঝে এটাই প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে যে আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, আমরা তাঁরই সৃষ্ট।

এ ব্যাপারে নিম্নোক্ত নীতিমালার আলোকে আমরা সকল প্রকার তাগূতের পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হব।

(১) আল্লাহর রুবুবিয়্যত তথা প্রভূত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন বৈশিষ্ট্যের দাবী করা।

(২) আল্লাহর উলুহিয়াত বা আল্লাহর ইবাদাতকে নিজের জন্য সাব্যস্ত করা। এ হিসেবে আল্লাহর রুবুবিয়াতের বৈশিষ্ট্য যেমন, সর্বজ্ঞানী, সর্বশক্তিমান, জীবিতকরণ, মৃত্যুদান, বিপদাপদ থেকে উদ্ধারকরণ, হালাল-হারামের বিধান প্রবর্তন ইত্যাদিকে যে ব্যক্তি নিজের জন্য দাবী করবে সে তাগুত। অনুরূপভাবে আল্লাহকে ইবাদাত করার যত পদ্ধতি আছে যে ব্যক্তি সেগুলো তার নিজের জন্য চাইবে সেও তাগূত। এর আওতায় পড়বে ঐ সমস্ত লোকগুলো যারা নিজেদেরকে সিজদা করার জন্য মানুষকে আহবান করে। নিজেদের জন্য মানত, যবেহ, সালাত, সাওম, হজ ইত্যাদির আহবান জানায়।

তাগূতকে অস্বীকার করার অর্থ এই নয় যে, তাগূত নেই বলে বিশ্বাস পোষণ করা। বরং তাগুতকে অস্বীকার করা বলতে বুঝায় আল্লাহর ইবাদাত ছাড়া অন্য কারো জন্য ইবাদাত সাব্যস্ত না করা এবং এ বিশ্বাস করা যে আল্লাহর ইবাদাত ছাড়া সকল প্রকার ইবাদাতই বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। আর যারা আল্লাহর বৈশিষ্ট্যে কোন কিছু তাদের জন্য দাবী করে থাকে তাদেরকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং এ বিশ্বাস করা যে তাদের এ ধরণের কোন ক্ষমতা নেই।

ইসলামকে যারা সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে তারা যেহেতু ধ্বংস ও প্রবঞ্চনা থেকে নিরাপদ হয়ে যায়, সে জন্য তাদেরকে এমন লোকের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে কোন শক্ত দড়ির বেষ্টনকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করে পতন থেকে মুক্তি পায়। আর এমন দড়ি ছিঁড়ে পড়ার যেমন ভয় থাকে না, তেমনিভাবে ইসলামেও কোন রকম ধ্বংস কিংবা ক্ষতি নেই। তবে দড়িটি যদি কেউ ছিড়ে দেয় তা যেমন স্বতন্ত্র কথা, তেমনিভাবে কেউ যদি ইসলামকে বর্জন করে, তবে তাও স্বতন্ত্র ব্যাপার।

— ‘আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যে এ মর্মে রাসুল পাঠিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো ও তাগুত বর্জন করো…।(সুরা নাহল : ৩৬)।

— ‘বলে দাও, আমি কি তোমাদের এর চেয়েও নিকৃষ্ট পরিণামের সংবাদ দেব, যা আল্লাহর কাছে আছে? যাদের আল্লাহ লানত করেছেন ও যাদের ওপর তিনি ক্রোধান্বিত, আর যাদের মধ্য থেকে বাঁদর ও শূকর বানিয়েছেন এবং যারা তাগুতের উপাসনা করে। তারা মর্যাদার দিক থেকে নিকৃষ্টতর ও সরল পথ থেকে সর্বাধিক বিচ্যুত।’ (সুরা মায়েদা : ৬০)।

— ‘যারা তাগুতের উপাসনা বর্জন করে আল্লাহর অভিমুখী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ। কাজেই আমার বান্দাদের সুসংবাদ দাও।(সুরা যুমার: ১৭)।

— ‘তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ করোনি, যাদের কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছে, তারা প্রতিমা ও তাগুতের প্রতি ঈমান আনে। তারা কাফিরদের বলে, এদের পথ ঈমানদারদের চেয়ে প্রকৃষ্টতর।’ (সুরা নিসা : ৫১)।

–‘তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ করোনি, যারা দাবি করে যে তারা ঈমান এনেছে ওই বিষয়ে, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার আগে যা অবতীর্ণ হয়েছিল তার প্রতি। অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা (তাগুত) প্রত্যাখ্যান করার জন্য। কিন্তু শয়তান তাদের ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট করতে চায়। (সুরা নিসা: ৬০)।

— ‘যারা ঈমান আনে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরি করে তারা তাগুতের পথে লড়াই করে। সুতরাং তোমরা লড়াই করো শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে। নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল।(সুরা নিসা : ৭৬)

(তাগুত) সীমা অতিক্রম করা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে আমরা দেখে নিই কুর’আনের সেই আটটি আয়াত;

(১) নিশ্চয় হিদায়াত গোমরাহী হতে স্পষ্ট হয়ে গেছে, অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে অবশ্যই সে দৃঢ়তর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরলো যা কখনও ছিন্ন হবার নয় এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সুরা বাকারাহ ২,আয়াত ২৫৬)

(২) যারা তাগুতের উপাসনা বর্জন করে আল্লাহর অভিমুখী হয়, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ; কাজেই আমার বান্দাদেরকে সুসংবাদ দাও।(সুরা আজ জুমার ৩৯, আয়াত ১৭)

(৩) অবশ্যই আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি, এই কারণে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর আর তাগুতকে বর্জন কর। (সুরা আন্-নাহ্ল ১৬, আয়াত ৩৬)

(৪) তুমি বল, ‘আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়েও নিকৃষ্ট কিছুর সংবাদ দেব, যা আল্লাহর নিকট প্রতিদান হিসেবে আছে, যাকে আল্লাহ লা‘নত করেছেন এবং যার উপর তিনি ক্রোধান্বিত হয়েছেন? আর যাদের মধ্য থেকে বাঁদর ও শূকর বানিয়েছেন এবং তারা তাগুতের উপাসনা করেছে, তারা মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সরল পথ হতে সর্বাধিক বিচ্যুত’।(সুরা মায়িদাহ ৫, আয়াত ৬০)

(৫)যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক, তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর (নূরের) দিকে, আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত, তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়; এরাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী, তারা সেখানেই চিরকাল থাকবে। (সুরা বাকারাহ ২, আয়াত ২৫৭)

(৬) তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেয়া হয়েছে, তারা প্রতিমা ও তাগুতের (শয়তানের) প্রতি ঈমান আনে এবং যারা কুফরী করেছে তাদেরকে বলে, তারা মুমিনদের তুলনায় অধিক সঠিক পথপ্রাপ্ত। (সুরা নিসা ৪, আয়াত ৫১)

(৭)তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি যারা দাবী করে যে, নিশ্চয় তারা ঈমান এনেছে ঐ বিষয়ে, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছিল; তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায় অথচ তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা (তাগুতকে) প্রত্যাখ্যান করার জন্য কিন্তু শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট করে বহুদূরে নিয়ে যেতে চায়।(সুরা নিসা ৪, আয়াত ৬০)

(৮) যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে আর যারা কুফরী করেছে তারা তাগুতের পথে লড়াই করে সুতরাং তোমরা লড়াই কর শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে, নিশ্চয় শয়তানের চক্রান্ত দুর্বল। (সুরা নিসা ৪, আয়াত ৭৬)

আল কুরআন তাগুত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে যে মূলনীতি ঘোষণা করেছে –

১. ঈমান আনার অপরিহার্য শর্ত তাগুতকে অস্বীকার করা।

২. কুফরী পথের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক তাগুত।

৩. তাগুত আল্লাহর বান্দাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যায়।

৪. তাগুতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অমান্য করার আদেশ দেওয়া হয়েছে তথাপি মানুষ বিচার ফয়সালার জন্য তাগুতের কাছে যেতে চায়।

৫. তাগুতের পথ অবলম্বনকারীরা আল্লাহর নাযিলকৃত পদ্ধতির এবং রাসূলের নীতির দিকে আহ্বান জানালে ইতস্ততঃ করে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

৬. ঈমানদার লড়াই করে আল্লাহর পথে আর কাফের লড়াই করে তাগুতের পথে।

৭. তাগুত অবলম্বনকারীরা বলে তারা ঈমানদারদের থেকে অধিকতর সঠিক পথে রয়েছে।

৮. তাগুত অবলম্বনকারীদের প্রতি আল্লাহ লা’নত বর্ষণ করেছেন। তারা কোন সাহায্যকারী পাবে না।

৯.আল্লাহর দাসত্ব করা এবং তাগুত থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দেওয়ার জন্যই আল্লাহ রাসূল প্রেরণ করেছেন।

পবিত্র কোরআনের প্রসিদ্ধ আয়াত, ‘হে ইমানদারগণ আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যবরণ কর না। আর তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০২, ১০৩)।

 আলোচ্য আয়াতে মহান রাব্বুল আলামিন দুটি মূলনীতির আলোকপাত করেছেন।

এক. আল্লাহকে ভয় করা।

দুই. আল্লাহর রজ্জুকে মজবুত হস্তে আঁকড়ে ধরা। মৌলিকভাবে মুসলমানদের পূর্ণ শক্তি ও কামিয়াবির ভিত্তি এ দুটি জিনিসের ওপর নির্ভরশীল। যার ভিতরে এ দুটি মূলনীতির মজবুতি থাকবে সে তত তাড়াতাড়ি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারবে। তাফসিরে ইবনে কাসিরের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর রজ্জু বলতে পবিত্র কোরআনকে বুঝানো হয়েছে। আবার আল্লামা সুয়ূতী (রহ.) বলেন, আল্লাহর রজ্জু দ্বারা দীন-ইসলামকে বুঝানো হয়েছে। মোটকথা হাবলুন তথা আল্লাহর রজ্জু দ্বারা কোরআন বা দীন-ইসলাম যাই বুঝানো হোক। উভয়টি শুধু একতা, শৃঙ্খলা, মৈত্রী এবং দলবদ্ধভাবে থাকার শিক্ষাই দেয় না বরং তা অর্জন করতে হয় কীভাবে, তার ওপর অটল থাকতে হয় কীভাবে? তারও পদ্ধতি বাতলে দেয়।

পবিত্র কোরআনের অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ ۚ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ﴾

‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা বাকারা : ২০৮)। এ আয়াতে ‘সিলমুন’ এবং ‘কাফ্ফাহ’ শব্দ দুটি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লামা হাফেজ ইবনে কাছীর (র.) ‘সিলমুন’-এর অর্থ করেছেন ইসলাম ও শান্তি। আর ‘কাফ্ফাহ’-এর অর্থ করেছেন পরিপূর্ণরূপে ও সাধারণভাবে। জমহুরে সাহাবায়ে কেরামদের থেকেও এ অর্থের সাপোর্ট পাওয়া যায়। এখন আয়াতের অর্থ দাঁড়ালো— হে ইমানদারগণ! তোমরা ইসলামে তথা শান্তির ধর্মে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর। পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করা বলতে আমরা কি বুঝি? কোনো ব্যক্তি যদি আপন গৃহে প্রবেশ করে তখন সে পুরো বডি নিয়েই প্রবেশ করে। যদি সে শুধু পদযুগল প্রবেশ করায়, কিন্তু বাকি বডি প্রবেশ করাল না, তাহলে তাকে পূর্ণ প্রবেশকারী বলা হবে না। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা মুমিন ও মুসলমানদের উদ্দেশ করে বলছেন, তোমরা যখন শান্তির ধর্ম ইসলামে প্রবেশ করেছ, তখন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান মেনে চল। এমন যাতে না হয় নিজের সুবিধা মতো ইসলামের বিধি-বিধান মানলে, আর মন চায় না তো মানলে না। তা হবে না। ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করতে হলে, ইসলাম কি? ইসলাম কী শিক্ষা দেয়? ইসলামের মানশা কী? কোরআন ও হাদিস চর্চা করে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তখন দেখা যাবে ইসলাম সম্পর্কে যেসব ভ্রান্ত ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে তা সমূলে দূর হয়ে যাবে।

মুমিনরা এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস করে। তার রেজামন্দি হাসিলের জন্য দিবানিশি ইবাদতে মগ্ন থাকে। পারস্পরিক লেনদেন, আচার-আচরণ এবং স্বভাব-চরিত্র প্রকাশ করার মাধ্যমেও আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে।

হজরত রসুলে আরাবি (সা.) তার প্রিয় সাহাবি হজরত আনাস বিন মালেক (রা.)-কে বললেন, হে আনাস! তোমার পক্ষে যদি সম্ভব হয়, তুমি সকাল-সন্ধ্যা এমনভাবে অতিবাহিত করবে যে, তোমার অন্তরে কারও প্রতি কোনোরূপ বিদ্বেষ থাকবে না। তাহলে তুমি তাই কর (এটাই তোমার জন্য কল্যাণকর)। কারণ এমন ধারণা পোষণ করা আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে জিন্দা করে সে যেন আমাকেই ভালোবাসে। আর যে আমাকে ভালোবাসে সে পরকালে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে। (তিরমিজি : ২৬৭৮)। আমরা তো কেবল নামাজ ও রোজার সুন্নতকে ইবাদত মনে করি। এ ছাড়াও যে জীবন চলার প্রতিটি অঙ্গনে রসুল (সা.)-এর সুন্নত রয়ে গেছে সেদিকে একেবারেই খেয়াল নেই। ইসলামের বিধান হলো মানুষের জন্য মানুষ সব কাজে সহযোগিতা করবে। কাউকে কষ্ট দেবে না। কষ্টদায়ক বস্তু পথ থেকে সরিয়ে দেবে। আজকাল অনেক অনুষ্ঠানে কিংবা মসজিদে দেখা যায়, সামনে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে। অন্য সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে সামনের স্থান দখল করে। মসজিদে তার জুতার পানি টপ টপ করে মানুষের ওপর ও মসজিদে পড়তে থাকে। এদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার খেয়াল তো শুধু একটাই কীভাবে সামনে যেতে হবে। মসজিদে সামনের কাতারের ফজিলত পেতে হবে। তার এমন আচরণ দ্বারা সাধারণ মানুষের কষ্ট হয়। কেউ কষ্ট প্রকাশ করে আর কেউ তার দাপটের ভয়ে প্রকাশ করে

২:২৫৭ اَللّٰهُ وَلِیُّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۙ یُخۡرِجُهُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ۬ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَوۡلِیٰٓـُٔهُمُ الطَّاغُوۡتُ ۙ یُخۡرِجُوۡنَهُمۡ مِّنَ النُّوۡرِ اِلَی الظُّلُمٰتِ ؕ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ

২৫৭. আল্লাহ তাদের অভিভাবক যারা ঈমান আনে, তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা কুফরী করে তাগূত তাদের অভিভাবক, এরা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।

ওলি আরবি শব্দ যার অর্থ অভিভাবক বা মুরুব্বি, বন্ধু। আরবি ভাষায় “আউলিয়া” শব্দটি ওলির বহুবচন। ‘ওলি’ অর্থ বন্ধু, মিত্র বা অনুসারী। কখনো শব্দটির অর্থ হয় শাসক, অভিভাবক বা কর্তা। (তথ্যসূত্র- আরবি-বাংলা অভিধান, প্রকাশনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।

প্রসিদ্ধ আরবি-ইংরেজি অভিধান “আল-মাওয়ারিদ” অনুসারে ওলি শব্দের অর্থ- guardian, patron, friend, companion ইত্যাদি।

এখানে বলা হয়েছে যে, ইসলাম সর্বাপেক্ষা বড় নেয়ামত এবং কুফর সবচাইতে বড় দুর্ভাগ্য। এতদসঙ্গে কাফের বা বিরুদ্ধবাদীদের সাথে বন্ধুত্ব করার বিপদ সম্পর্কে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, এরা মানুষকে আলো থেকে অন্ধকারে টেনে নেয়।

অন্ধকার মানে মূর্খতা ও অজ্ঞতার অন্ধকার৷ যে অন্ধকারে পথ হারিয়ে মানুষের নিজের কল্যাণ ও সাফল্যের পথ থেকে দূরে সরে যায় এবং সত্যের বিরুদ্ধাচরণ করে নিজের সমস্ত শক্তি ও প্রচেষ্টাকে ভুল পথে পরিচালিত করে, সেই অন্ধকারের কথা এখানে বলা হয়েছে৷

আল্লাহ্ তা’আলা এখানে সংবাদ দিচ্ছেন যে, যারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে তাদেরকে তিনি শান্তির পথ প্রদর্শন করবেন এবং শিরক, কুফর ও সন্দেহের অন্ধকার থেকে বের করে সত্যের আলোর দিকে নিয়ে আসেন। পক্ষান্তরে শয়তানেরা কাফিরদের অভিভাবক। তারা তাদেরকে অজ্ঞতা, ভ্রষ্টতা ও কুফরীতে নিমজ্জিত রাখে এবং সত্যের আলো হতে দূরে সরিয়ে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে।

অন্য এক আয়াতে ইরশাদ করেছেন:

“তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও।” ( ৬: ১৫৩)

اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰهَ لَهٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مِنۡ وَّلِیٍّ وَّ لَا نَصِیۡرٍ

আপনি কি জানেন না যে, আসমান ও যমীনের সার্বভৌমত্ব একমাত্র আল্লাহর? আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবকও নেই, নেই সাহায্যকারীও। বাকারাঃ ১০৭

وَ اللّٰهُ اَعۡلَمُ بِاَعۡدَآئِکُمۡ ؕ وَ کَفٰی بِاللّٰهِ وَلِیًّا ٭۫ وَّ کَفٰی بِاللّٰهِ نَصِیۡرًا

বস্তুতঃ আল্লাহ তোমাদের শত্রুদেরকে ভালভাবে জানেন। আর অভিভাবক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট এবং সাহায্যকারী হিসাবেও আল্লাহই যথেষ্ট। নিসাঃ৪৫

৪৫:১৯ اِنَّهُمۡ لَنۡ یُّغۡنُوۡا عَنۡکَ مِنَ اللّٰهِ شَیۡئًا ؕ وَ اِنَّ الظّٰلِمِیۡنَ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ۚ وَ اللّٰهُ وَلِیُّ الۡمُتَّقِیۡنَ ﴿۱۹

নিশ্চয় তারা আল্লাহ্‌র মুকাবেলায় আপনার কোনই কাজে আসবে না; আর নিশ্চয় যালিমরা একে অন্যের বন্ধু; এবং আল্লাহ মুত্তাকীদের বন্ধু। জাসিয়াঃ ১৯

আল্লাহর অলী বা বন্ধু হলে কি লাভ—

‘জেনে রেখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য আছে সুসংবাদ দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহর বাণীর কোনো পরিবর্তন নেই; এটাই মহাসাফল্য। ’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৬৪)

‘কেউ আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং মুমিনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করলে, আল্লাহর দলই তো বিজয়ী হবে। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫৬)

যারা আল্লাহর ওলি বা বন্ধু। তাদের মর্যাদাও অনেক বেশি। হাদিসে কুদসিতে এসেছে-

‘যে ব্যক্তি আমার কোনো ওলির সাথে শত্রুতা করে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার নৈটক্য অর্জন বা ওলি হওয়ার জন্য বান্দা যত কাজ করে তন্মধ্যে সে কাজ আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি; যে কাজ আমি ফরজ করেছি। অর্থাৎ ফরজ কাজ পালন করাই আমার নৈকট্য অর্জনের জন্য সর্ব প্রথম ও সবচেয়ে প্রিয় কাজ।

এরপর বান্দা যখন সর্বদা নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আমার বেলায়েতের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালোবাসি। আর যখন আমি তাকে ভালোবাসি তখন আমি তার কানে পরিণত হই, যা দিয়ে সে শুনতে পায়; আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে দেখতে পায়; আমি তার হাত হয়ে যাই, যা দ্বারা সে ধরে বা আঘাত করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে হাঁটে।

সে যদি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করে তাহলে আমি অবশ্যই তাকে তা প্রদান করি। সে যদি আমার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে আমি অবশ্যই তাকে আশ্রয় প্রদান করি।’ (মুয়াত্তা মালেক)

নিশ্চয়ই তোমাদের ওলি হলেন আল্লাহ এবং তাঁর রসুল আর ঈমানদার লোকেরা- যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দিয়ে দেয়, এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত বাধ্যগত থাকে। যারা ওলি মানে আল্লাহকে এবং আল্লাহর রসুলকে আর ঈমানদার লোকদেরকে, তারাই আল্লাহর দল এবং আল্লাহর দলই থাকবে বিজয়ী। ( সূরা আল মায়িদা- আয়াত-৫৫/৫৬)

এ দুটি আয়াত থেকে জানা গেল, সকল মুমিনই আল্লাহর অলি/বন্ধু যারা সালাত কায়েম করে,যাকাত প্রদান করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং আল্লাহর অনুগত থাকে তারাই ওলি ”সকল মুমিনই আল্লাহ রহমানের অলি।” (ইমাম তাহাবী ”আল আকীদা” গ্রন্থ)

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন- “ওয়াল্লাহু ওয়ালীউল মু মিনীন” (অর্থ- আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক) (সূরা আলে ইমরান ৩ : ৬৮ ) “ওয়াল্লাহু ওয়ালীউল মুত্তাকীন “( অর্থ- আর আল্লাহ্ মুত্তাকীদের বন্ধু) (সূরা জাসিয়া ৪৫ : ১৯)।

আয়াতে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ তাআলা তাঁর আওলিয়া বা বন্ধুদের প্রসঙ্গে বলেছেন যে তার যারা বন্ধু তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। কারা তার সেই বন্ধু?

আল্লাহ তাআলা বলছেন যারা ঈমান আনবে এবং তাকওয়া অবলম্বন করবে তারাই হবে তাঁর বন্ধু। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন- “তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী।” (সূরা হুজুরাত ৪৯ : ১৩)

তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তিকে মুত্তাকী বলা হয়। সুতারং মুত্তাকী বা আমরা প্রচলিত ভাষায় যাকে বলি পরহেজগার সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে মর্যাদাসম্পন্ন। আবার এই মুত্তাকীদের মধ্যে যিনি অধিক মুত্তাকী তিনি আবার আল্লাহ তাআলার কাছে অধিক মর্যাদাসম্পন্ন। এই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিটিই আল্লাহর বন্ধু সে কথাটিই আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনুসের ৬৩নং এবং সূরা হুজুরাতের ১৩ নং আয়াতে বলেছেন।

নূর লাভের জন্য দু’আ———

اَللهُمَّ اجْعَلْ فِىْ قَلْبِىْ نُوْراً وَفِىْ لِسَانِىْ نُوْراً وَاجْعَلْ فِىْ سَمْعِىْ نُوْراً وَاجْعَلْ فِىْ بَصَرِىْ نُوْراً وَاجْعَلْ مِنْ خَلْفِىْ نُوْراً وَمِنْ أَمَامِىْ نُوْراً وَاجْعَلْ مِنْ فَوْقِىْ نُوْراً وَ مِنْ تَحْتِىْ نُوْراً اَللهُمَّ أَعْطَنِىْ نُوْراً

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাঝআল ফি ক্বালবি নুরাও ওয়া ফি লিসানি নুরাও ওয়াঝআল ফি সাময়ি নুরাও ওয়াঝআল ফি বাসারি নুরাও ওয়াঝআল মিন খালফি নুরাও ওয়া মিন আমামি নুরাও ওয়াঝআল মিন ফাউক্বি নুরাও ওয়া মিন তাহতি নুরা। আল্লাহুম্মা আঅত্বানি নুরা।’

অর্থ : হে আল্লাহ! আমার অন্তরে আলোর ব্যবস্থা করে দাও; আমার জিহ্বায় আলো দাও; আমার কানে আলো দাও; আমার চোখে আলো দাও; আমার পেছনে আলো দাও; আমার সামনে আলো দাও; আমার উপর থেকে আলো দাও; আমার নিচ থেকে আলো দাও। হে আল্লাহ! আমাকে আলো দান করো।’মুসলিম, মিশকাত ১১৯৫

ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি মাইমুনাহর নিকট রাত যাপন করি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাহ ওঠে প্রয়োজন পূরণ করলেন, তাপর দুইহাত ও চেহারা ধুইলেন। তারপর ঘুমালেন অতঃপর ঘুম থেকে উঠলেন। তার জন্য পানির পাত্রটি আনা হলো তিনি পাত্রের মুখ খুললেন। অতঃপর তিনি দুইটি ওযূর মাঝে মধ্যপন্থী ওযূ করলেন, যাতে বাড়ালেন না অথচ পরিপূর্ণ ওযূ করলেন। তিনি সালাত আদায় করলেন। আমি তাকে পর্যবেক্ষণ করছি দেখে ফেলবেন অপছন্দ করে গোপনীয়তা অবলম্বন করে উঠলাম। আমি ওযূ করলাম। তিনি সালাতে দাড়ালে আমিও তার বাম পাশে দাঁড়ালাম। তিনি আমার কান ধরে আমাকে তার ডান পাশে ঘুরিয়ে দিলেন। তারপর তের রাকা‘আত সালাত পূর্ণ করলেন। তারপর তিনি কাত হয়ে নাক ডেকে ঘুমালেন। তার অভ্যাস ছিল যখন ঘুমাতেন নাক ডাকতেন। তারপর বিলাল সালাতের ঘোষণা দিলে তিনি সালাত আদায় করেন তবে ওযূ করলেন না। তিনি দো‘আয় বলতেন, “হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে নূর (বা আলো) দান করুন, আমার চোখে নূর দান করুন, আমার শ্রবণশক্তিতে নূর দান করুন, আমার ডানে নূর দান করুন, আমার বামে নূর দান করুন, আমার উপরে নূর দান করুন, আমার নিচে নূর দান করুন, আমার সামনে নূর দান করুন, আমার পেছনে নূর দান করুন, আমার জন্য নূর দান করুন”।  সহীহ – মুত্তাফাকুন ‘আলাইহি (বুখারী ও মুসলিম)।

 

https://quranerkotha.com/baqarah-256-257/

সংগ্রহে– তাফসিরে জাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন, আহসানুল বায়ান