সুরা বাকারাঃ ৩২তম রুকু (২৪৩-২৪৮)আয়াত

 সুরা বাকারাঃ ৩২তম রুকু (২৪৩-২৪৮)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:২৪৩ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الَّذِیۡنَ خَرَجُوۡا مِنۡ دِیَارِهِمۡ وَ هُمۡ اُلُوۡفٌ حَذَرَ الۡمَوۡتِ ۪ فَقَالَ لَهُمُ اللّٰهُ مُوۡتُوۡا ۟ ثُمَّ اَحۡیَاهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَذُوۡ فَضۡلٍ عَلَی النَّاسِ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَشۡکُرُوۡنَ

২৪৩. আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যারা মৃত্যুভয়ে হাজারে হাজারে স্বীয় আবাসভূমি পরিত্যাগ করেছিল অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে বলেছিলেন, ‘তোমরা মরে যাও’। তারপর আল্লাহ তাদেরকে জীবিত করেছিলেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল; কিন্তু অধিকাং লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না

এখান থেকে আর একটি ধারাবাহিক ভাষণ শুরু হচ্ছে৷ এই ভাষণে মুসলমানদের আল্লাহর পথে জিহাদ ও অর্থ-সম্পদ দান করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে৷ যেসব দুর্বলতার কারণে বনী ইসরাঈলরা অবশেষে অবনতি ও পতনের শিকার হয় সেগুলো থেকে মুসলমানদের দূরে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ এখানে আলোচিত বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য এ বিষয়টি সামনে রাখতে হবে যে, মুসলমানরা সে সময় মক্কা থেকে বহিস্কৃত হয়েছিল, এক দেড় বছর থেকে তারা মদীনায় আশ্রয় নিয়েছিল৷ এবং কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরাই বারবার যুদ্ধ করার অনুমতি চাইছিল৷ কিন্তু যুদ্দের অনুমতি দেয়ার পর এখন তাদের মধ্যে কিছু লোক ইতস্তত করছিল, যেমন ২৬ রুকু’র শেষ অংশে বলা হয়েছে৷ তাই এখানে বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থেকে মুসলমানদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে৷

এ ঘটনা বিগত কোন জাতির। কোন সহীহ হাদীসে এর বিস্তারিত আলোচনা আসেনি। তফসীরের বর্ণনায় এটাকে বনী-ইস্রাঈলদের যুগের ঘটনা বলা হয়েছে এবং যে নবীর দু’আয় তাদেরকে মহান আল্লাহ পুনরায় জীবিত করেছিলেন, তাঁর নাম ‘হিযক্বীল’ বলা হয়েছে।

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, কোন এক শহরে ইসরাঈল-বংশধরের কিছু লোক বাস করত। তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। সেখানে এক মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হয়। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সে শহর ত্যাগ করে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক প্রশস্ত ময়দানে গিয়ে বসবাস করতে লাগল। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের কাছে দু’জন ফেরেশতা পাঠালেন তাদেরকে এবং দুনিয়ার অন্যান্য জাতিকে একথা অবগত করানোর জন্য যে, মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে গিয়ে কেউ রক্ষা পেতে পারে না। ফেরেশতা দু’জন ময়দানের দু’ধারে দাঁড়িয়ে এমন এক বিকট শব্দ করলেন যে, তাদের সবাই একসাথে মরে গেল। দীর্ঘকাল পর ইসরাঈল-বংশধরদের একজন নবী সেখান দিয়ে যাওয়ার পথে সেই বন্ধ জায়গায় বিক্ষিপ্ত অবস্থায় হাড়-গোড় পড়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলেন। তখন ওহীর মাধ্যমে তাকে মৃত লোকদের সমস্ত ঘটনা অবগত করানো হল। তখন তিনি দোআ করলেন এবং আল্লাহ তাদেরকে জীবিত করে দিলেন। [ইবনে কাসীর]

এ ঘটনাটি দুনিয়ার সমস্ত চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীকে সৃষ্টিবলয় সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দেয়। তদুপরি এটা কেয়ামত অস্বীকারকারীদের জন্য একটা অকাট্য প্রমাণ হওয়ার সাথে সাথে এ বাস্তব সত্য উপলব্ধি করার পক্ষেও বিশেষ সহায়ক যে, মৃত্যুর ভয়ে পালিয়ে থাকা তা জিহাদ হোক বা প্লেগ মহামারীই হোক, আল্লাহ এবং তার নির্ধারিত নিয়তি বা তাকদীরের প্রতি যারা বিশ্বাসী তাদের পক্ষে সমীচীন নয়। যার এ বিশ্বাস রয়েছে যে, মৃত্যুর একটা নির্ধারিত সময় রয়েছে, নির্ধারিত সময়ের এক মুহুর্ত পূর্বেও তা হবে না এবং এক মূহুর্ত পরেও তা আসবে না, তাদের পক্ষে এরূপ পলায়ন অর্থহীন এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টির কারণ।

এ আয়াত কয়েকটি বিষয়ের সমাধান করে দিয়েছে। প্রথমতঃ আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের উপর কোন তদবীর কার্যকর হতে পারে না। জিহাদ বা মহামারীর ভয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাচানো যায় না, আর মহামারীগ্রস্ত স্থানে অবস্থান করাও মৃত্যুর কারণ হতে পারে না। মৃত্যুর একটি সুনির্দিষ্ট সময় রয়েছে, যার কোন ব্যতিক্রম হওয়ার নয়। দ্বিতীয়তঃ কোনখানে কোন মহামারী কিংবা কোন মারাত্মক রোগ-ব্যাধি দেখা দিলে সেখান থেকে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়া বৈধও নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এরশাদ মোতাবেক অন্য এলাকার লোকের পক্ষেও মহামারীগ্রস্ত এলাকায় যাওয়া বৈধ নয়। হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘সে রোগের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের পূর্ববতী বিভিন্ন উম্মতের উপর আযাব নাযিল করেছেন। সুতরাং যখন তোমরা শুনবে যে, কোন শহরে প্লেগ প্রভৃতি মহামারী দেখা দিয়েছে, তখন সেখানে যেও না। আর যদি কোন এলাকাতে এ রোগ দেখা দেয় এবং তুমি সেখানেই থাক, তবে সেখান থেকে পলায়ন করবে না।‘ [বুখারী ৩৪৭৩, মুসলিম: ২২১৮]

ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, কোথাও যাওয়া মৃত্যুর কারণ হতে পারে না, আবার কোনখান থেকে পালিয়ে যাওয়াও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নয়’! এ মৌলিক বিশ্বাসের পাশাপাশি আলোচ্য নির্দেশটি নিঃসন্দেহে বিশেষ তাৎপর্যপূৰ্ণ।

প্রথমতঃ মহামারীগ্রস্ত এলাকার বাইরের লোককে আসতে নিষেধ করার একটি তাৎপর্য এই যে, এমনও হতে পারে যে, সেখানে গমন করার পর তার হায়াত শেষ হওয়ার দরুনই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে সে মৃত্যুবরণ করলঃ এতদসত্ত্বেও আক্রান্ত ব্যক্তির মনে এমন ধারণা হতে পারে যে, সেখানে না গেলে হয়ত সে মারা যেত না। তাছাড়া অন্যান্য লোকেরও হয়ত এ ধারণাই হবে যে, এখানে না এলে মৃত্যু হত না। অথচ যা ঘটেছে তা পূর্বেই নির্ধারিত ছিল। যেখানেই থাকত, তার মৃত্যু এ সময়েই হত! এ আদেশের মাধ্যমে মুসলিমদেরকে ঈমানের ব্যাপারে সন্দেহসংশয় থেকে রক্ষা করা হয়েছে। যাতে করে তারা কোন ভুল বোঝাবুঝির শিকার না হয়।

দ্বিতীয়তঃ এতে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন যে, যেখানে কষ্ট হওয়ার বা মৃত্যুর আশংকা থাকে, সেখানে যাওয়া উচিত নয়; বরং সাধ্যমত ঐসব বস্তু থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করা কর্তব্য, যা তার জন্য ধ্বংস বা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাছাড়া নিজের জানের হেফাযত করা প্রত্যেক মানুষের জন্য ওয়াজিব ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়মের চাহিদাও তাই যে, আল্লাহর দেয়া তাকদীরে পূর্ণ বিশ্বাস রেখে যথাসাধ্য সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। যেসব স্থানে প্রাণ নাশের আশংকা থাকে, সেসব স্থানে না যাওয়াও এক প্রকার সতর্কতামূলক তদবীর। এমনিভাবে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকদেরকে সে স্থান থেকে পলায়ন করতে নিষেধ করার মাঝেও বহু তাৎপর্য নিহিতঃ একটি হচ্ছে এই যে, যদি এ পলায়নের প্রথা চলতে থাকে, তবে সাধারণভাবে ও সমষ্টিগতভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা সক্ষম ও সবল তারা তো সহজেই পালাতে পারে, কিন্তু যারা দুর্বল তাদের কি অবস্থা হবে? আর যারা রোগাক্রান্ত, তাদের সেবা-শুশ্রুষা কিংবা মরে গেলে দাফন-কাফনেরই বা কি ব্যবস্থা হবে? দ্বিতীয়তঃ যারা সেখানে ছিল, তাদের মধ্যে হয়ত রোগের জীবাণু প্রবেশ করে থাকবে। এমতাবস্থায় তারা যদি বাড়ী-ঘর থেকে বের হয়ে থাকে, তবে তাদের দুঃখ-দুর্দশা আরও বেড়ে যাবে। কারণ প্রবাস জীবনে রোগাক্রান্ত হলে যে কি অবস্থা তা সবারই জানা।

তৃতীয়তঃ যদি তাদের মধ্যে রোগের জীবাণু ক্রিয়া করে থাকে, তবে তা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। আর যদি নিজের জায়গায় আল্লাহর উপর ভরসা করে পড়ে থাকে, তবে হয়ত নাজাত পেতে পারে। আর যদি এ রোগে মারা যাওয়াই তার ভাগ্যে থাকে, তবে ধৈর্য ও স্থিরতা অবলম্বনের বদলায় শহীদের মর্যাদা লাভ করবে। প্লেগ মহামারী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন, ‘এ রোগটি আসলে শাস্তিরূপে নাযিল হয়েছিল এবং যে জাতিকে শাস্তি দেয়া উদ্দেশ্য হত তাদের ভেতর পাঠানো হত। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা একে মুমিনদের জন্য রহমতে পরিবর্তিত করে দিয়েছেন। আল্লাহর যেসব বান্দা এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া সত্বেও নিজ এলাকায়ই ধৈর্য সহকারে বসবাস করে এবং এ বিশ্বাস রাখে যে, তার শুধু সে বিপদই হতে পারে, যা আল্লাহ তা’আলা তার জন্য লিখে রেখেছেন, তবে এমন ব্যক্তি শহীদের মত সওয়াব পাবে। [বুখারীঃ ৫৭৩৪] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীঃ প্লেগ শাহাদাত এবং প্লেগ আক্রান্ত ব্যক্তি শহীদ [বুখারীঃ ৫৭৩২] এর ব্যাখ্যাও তাই। [মাআরিফুল কুরআন থেকে সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত]

২:২৪৪ وَ قَاتِلُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

২৪৪. আর তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

২:২৪৫ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یُقۡرِضُ اللّٰهَ قَرۡضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗۤ اَضۡعَافًا کَثِیۡرَۃً ؕ وَ اللّٰهُ یَقۡبِضُ وَ یَبۡصُۜطُ ۪ وَ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ

২৪৫. কে সে, যে আল্লাহকে করযে হাসানা প্রদান করবে? তিনি তার জন্য তা বহুগুণ বৃদ্ধি করবেন। আর আল্লাহ সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করেন এবং তাঁর দিকেই তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তিত করা হবে।

‘করযে হাসানা’ এর শাব্দিক অনুবাদ হচ্ছে ”ভালো ঋণ”৷করজ বা কারদুন শব্দটি আরবি। অর্থ ঋণ, ধার বা কর্জ; আর হাসানা অর্থ উত্তম।

ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায়, সওয়াবের নিয়তে বিনা শর্তে কাউকে কোনো কিছু ঋণ দিলে তাকে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ বলে।

এমন ঋণ যা কেবলমাত্র সৎকর্ম অনুষ্ঠানের প্রেরণায় চালিত হয়ে নিস্বার্থভাবে কাউকে দেয়া হয়৷ অনুরূপভাবে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করলে আল্লাহ তাকে নিজের জন্য ঋণ বলে গণ্য করেন৷ এ ক্ষেত্রে তিনি কেবল আসলটি নয় বরং তার ওপর কয়েকগুণ বেশী দেয়ার ওয়াদা করেন৷ তবে এ জন্য শর্ত আরোপ করে বলেন যে, সেটি ‘করযে হাসানা’ অর্থাৎ এমন ঋণ হতে হবে আদায়ের পেছনে কোন হীন স্বার্থ বুদ্ধি থাকবে না বরং নিছক আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে এ ঋণ দিতে হবে এবং তা এমন কাজে ব্যয় করতে হবে যা আল্লাহ পছন্দ করেন৷

এটা আল্লাহ তা’আলার চরম উদারতা ও দানশীলতা যে, মানুষ যদি তাঁরই দেয়া সম্পদ তার পথে ব্যয় করে তাহলে তিনি তা নিজের জন্য ঋণ হিসেবে গ্ৰহণ করেন। অবশ্য শর্ত এই যে, তা “কর্জে হাসানা” (উত্তম ঋণ) হতে হবে। অর্থাৎ খাঁটি নিয়তে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য ছাড়াই তা দিতে হবে, তার মধ্যে কোন প্রকার প্রদর্শনীর মনোবৃত্তি, খ্যাতি ও নাম-ধামের আকাংখা থাকবে না, তা দিয়ে কাউকে খোটা দেয়া যাবে না, দাতা কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই দেবে এবং এছাড়া অন্য কারো প্রতিদান বা সন্তুষ্টি লক্ষ্য হবে না। এ ধরনের ঋণের জন্য আল্লাহর দুইটি প্রতিশ্রুতি আছে। একটি হচ্ছে, তিনি তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দেবেন। অপরটি হচ্ছে, এজন্য তিনি নিজের পক্ষ থেকে সর্বোত্তম পুরস্কারও দান করবেন। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অনেকেই এটাকে বাস্তবে রুপান্তরিত করেছিলেন। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]

قَرْضٌ حَسَنٌ (উত্তম ঋণ) প্রদান করার অর্থ আল্লাহর পথে এবং জিহাদে মাল ব্যয় করা। অর্থাৎ, জানের মত মালের কুরবানী দিতেও দ্বিধা করো না। রুযীর প্রসারণ ও সংকোচনের এখতিয়ার কেবল আল্লাহরই হাতে। তিনি উভয়েরই মাধ্যমে তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকেন; কখনো রুযী হ্রাস করে এবং কখনো তার প্রসার ঘটিয়ে। অতএব আল্লাহর পথে ব্যয় করলে কমে না, বরং মহান আল্লাহ এতে অনেক অনেক বৃদ্ধি দান করেন। কখনো বাহ্যিকভাবে, আবার কখনো অভ্যন্তরীণভাবে মালে বরকত দিয়ে। আর আখেরাতে যে বৃদ্ধি হবে তা অবশ্য অবশ্যই বিস্ময়কর হবে।

৫৭:১১ مَنۡ ذَا الَّذِیۡ یُقۡرِضُ اللّٰهَ قَرۡضًا حَسَنًا فَیُضٰعِفَهٗ لَهٗ وَ لَهٗۤ اَجۡرٌ کَرِیۡمٌ

এমন কে আছে যে আল্লাহকে দেবে উত্তম ঋণ? তাহলে তিনি বহু গুণে এটাকে বৃদ্ধি করবেন তার জন্য। আর তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার। হাদীদঃ ১১

আরেকটি বর্ননায় এসেছে— আয়াতের শানে নুযুল সম্পর্কে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি বর্ণনা ইমাম রাজী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘এ আয়াতটি (২ : ২৪৫) নাজিল হয়েছে হজরত আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে।

তিনি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার দু’টি বাগান আছে যদি তার একটি আমি আল্লাহর রাস্তায় দান করি তবে তার অনুরূপ বাগান জান্নাতে পাব?

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ’ পাবে; পুনরায় তিনি প্রিয়নবিকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার স্তীও কি ঐ বাগানে আমার সঙ্গে থাকতে পারবে? তিনি ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ’।

ঐ সাহাবি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আমার সন্তান-সন্ততিও কি আমার সঙ্গে থাকতে পারবে? তিনি ইরশাদ করলেন, ‘হ্যাঁ’ তখন তিনি তাঁর সর্বোত্তম বাগানটি আল্লাহর রাহে দান করলেন।

এ বাগানটির নাম ছিল ‘হোনায়না’

অতঃপর হজরত আবু দারদা ঘরে ফিরে গেলেন; যা ঐ বাগানেই অবস্থিত ছিল এবং বাগানের প্রবেশ দ্বারে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রীকে ডাক দিলেন এবং বিস্তারিত ঘটনা অবহিত করে বললেন, ‘তোমরা বেরিয়ে আস কেননা এই বাগান আমি জান্নাতের বিনিময়ে আল্লাহর রাস্তায় দান করেছি।

তাঁর স্ত্রী সন্তান-সন্ততির হাত ধরে বাগান থেকে রেব হয়ে আসলেন এবং বললেন, (স্ত্রী বললেন) আল্লাহ আপনার এ ব্যবসায় বরকত দান করুন।

করযে হাসানা : কিছু নির্দেশনা ( মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রাহমান)

মানুষের একার পক্ষে সবসময় সব প্রয়োজন পূরণ সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য করতে হয়। এই সাহায্যের নানা ধরন ও অনেক উপায় রয়েছে। একটি বড় উপায় ঋণ তথা করজ। বিভিন্ন কারণে মানুষ করজ নিয়ে থাকে। তার মধ্যে মূলতঃ দুটি কারণ বড়। ১. সাধারণ জীবন চলা তথা খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ইত্যাদির প্রয়োজনে করজ নেয়া। ২. ব্যবসা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ।

ঋণের ক্ষেত্রে সমাজে দু’টি অবস্থা লক্ষ করা যায়- সয়লাব ও সঙ্কট। অর্থাৎ সুদভিত্তিক ঋণের সয়লাব আর সুদবিহীন ঋণের সঙ্কট। একদিকে সামান্য প্রয়োজনেই ঋণগ্রহণ করে ফেলা হয়। বরং বিনা প্রয়োজনে ও গোনাহের কাজেও ঋণ নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ঋণের উপর ঋণগ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে সত্যিকারের ঋণ বিরল। কঠিন বিপদেও তা কদাচিৎই পাওয়া যায়। একটা সফল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে এটা বড় প্রতিবন্ধক।

করজে হাসানা তথা ঋণের আদান-প্রদানের ব্যাপারে ইসলামে আছে কল্যাণকর নির্দেশনা। যার নিখুঁত চর্চা ও যথার্থ প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। এখানে ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা উভয় শ্রেণির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু নির্দেশনা উল্লেখ করা হল।

ঋণগ্রহীতার দায়িত্ব 

এক. মানুষ মাত্রেরই অনেক প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনেরও রয়েছে বিভিন্ন স্তর এবং পূরণেরও নানা পথ। ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে বাস্তবিকই প্রয়োজন আছে কি না, থাকলে সেটা কোন্ পর্যায়ের, ঋণগ্রহণ ছাড়া অন্যভাবে পূরণ সম্ভব কি না এবং ঋণ গ্রহণ করলে সময়মত পরিশোধ করা যাবে কি না- এ বিষয়গুলো বিবেচনা করা অতি জরুরি। ক্ষেত্রবিশেষে মুরব্বীর সঙ্গে পরামর্শও করা যেতে পারে। বিশেষ প্রয়োজন এবং সময়মত পরিশোধের প্রবল ধারণা ছাড়া ঋণগ্রহণ জায়েয নয়। আর অপচয় ও অন্যায় কাজে ঋণ নেওয়া এবং ঋণকে জীবনের সাধারণ নিয়মে পরিণত করার তো প্রশ্নই আসে না।

ঋণ একটা বোঝা। ঋণগ্রস্ততা অনেক সময় দুশ্চিন্তা, অশান্তি ও অনৈতিকতার কারণ হয়। এজন্য বান্দার কর্তব্য, আল্লাহ তাআলার কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাওয়া এবং দুআ করা, তিনি যেন ঋণ ছাড়াই সব প্রয়োজন পূরণ করে দেন। রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  আল্লাহর কাছে ঋণ থেকে আশ্রয় চাইতেন। এ প্রসঙ্গে দু’টি হাদীস উল্লেখ করা যায়।

১. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে এ দুআ করতেন-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ المَسِيحِ الدَّجَّالِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِالمَحْيَا وَفِتْنَةِ المَمَاتِ، اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ المَأْثَمِ وَالمَغْرَمِ .

অর্থাৎ, ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আযাব থেকে আশ্রয় চাই। মাছীহ দাজ্জালের ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। জীবনের ফেতনা ও মৃত্যুর ফেতনা থেকে আশ্রয় চাই। ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে গোনাহ ও ঋণ থেকে আশ্রয় চাই।

কেউ (অন্য বর্ণনায় আছে বর্ণনাকারী নিজেই) জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি ঋণ থেকে এত বেশি আশ্রয় চান! তিনি বললেন, মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয় তখন কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৩২

২. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুআ করতেন-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الهَمِّ وَالحَزَنِ، وَالعَجْزِ وَالكَسَلِ، وَالجُبْنِ وَالبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ.

অর্থাৎ, ইয়া আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই দুঃখ-দুশ্চিন্তা থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, ভীরুতা ও কার্পণ্য থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাবল্য (-এর শিকার হওয়া) থেকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৬৯

ঋণ থেকে বাঁচার জন্য করণীয় :

১. বিশেষ প্রয়োজন এবং নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধের প্রবল ধারণা ছাড়া ঋণ না নেওয়ার দৃঢ় সংকল্প করা।

২. আয় ও ব্যয়ের মাঝে সমন্বয় করে চলা।

৩. নামডাক, কৃত্রিমতা ও রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা।

৪. যেসব কাজ জানমালে বরকতের পক্ষে সহায়ক তা গুরুত্বের সাথে করা। আর যেগুলো বরকত বিনষ্টকারী তা থেকে সযত্নে বেঁচে থাকা। একই সঙ্গে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআও করা।

দুইঃ  সময়মত পরিশোধের প্রাক নিয়ত রাখা এবং এর জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। আর আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করা। নিয়ত, দুআ ও সত্যিকার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে আল্লাহর সাহায্য সঙ্গে থাকে। তিনি পরিশোধ বা মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু ঋণ নেওয়ার সময়ই খারাপ নিয়ত রাখা বা ঋণ নিয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে পড়া খুবই অন্যায়। এতে শুধু আল্লাহর সাহায্যই হাতছাড়া হয় না, জানমালের বরকতও নষ্ট হয়ে যায়। হাদীসে এসেছে, যে মানুষের সম্পদ পরিশোধের নিয়তে (ঋণ) নেয়, আল্লাহ তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করে দেন। আর যে আত্মসাতের উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তা ধ্বংস করে দেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৮৭

তিন. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তো অবশ্যই, চেষ্টা করা, তার আগেই পরিশোধ করার। টালবাহানা, মিথ্যা কথা ও মিথ্যা ওয়াদার তো প্রশ্নই আসে না। এধরনের আচরণ তো যে কারো সাথেই না-জায়েয। আর যে বিপদে ঋণ দিয়ে অনুগ্রহ করেছে তার সাথে তো আরো ভয়াবহ। বস্তুত সামর্থ্য সত্ত্বেও এরূপ আচরণ খুবই অন্যায়। হাদীসে এসেছে, বিত্তবানের টালবাহানা জুলুম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪০০

চার. সময়মত পরিশোধ না করলে ঋণদাতা থেকে কখনো কষ্টদায়ক আচরণ প্রকাশিত হতে পারে। এক্ষেত্রে ছবর করা ও পাল্টা জবাব না দেওয়া কর্তব্য। ওজর থাকলে তাকে নম্রভাবে বুঝিয়ে বলা উচিত। একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক লোকের কাছ থেকে একটি উটনী ঋণ নিয়েছিলেন। সে তা চাইতে এসে কঠোর ব্যবহার করল। তখন উপস্থিত সাহাবীগণ তার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করতে চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদেরকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তাকে বলতে দাও। পাওনাদারের কিছু বলার আছে।’ এরপর তাঁদেরকে তাকে একটি উটনী কিনে দিতে বললেন। তাঁরা খুঁজে এসে বললেন, আমরা (এর সমকক্ষ উটনী পাইনি) এর চেয়ে উৎকৃষ্টই শুধু পেয়েছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটাই কিনে দাও। (জেনে রেখ) তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে, যে পরিশোধে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৯০

পাঁচ. ঋণ দেওয়ার জন্য দাতার শোকর আদায় করা, তার জন্য দুআ করা। এতে সে খুশি হবে এবং ঋণদানে উৎসাহ বোধ করবে। আবদুল্লাহ ইবনে আবী রাবিয়া রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুনাইনের যুদ্ধের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছ থেকে ত্রিশ বা চল্লিশ হাজার (দিরহাম?) ঋণ নিয়েছিলেন। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনি তা পরিশোধ করলেন এবং বললেন, আল্লাহ তোমার পরিবারে ও সম্পদে বরকত দান করুন। ঋণের বিনিময় তো হল পরিশোধ ও কৃতজ্ঞতা।

بَارَكَ اللَّهُ لَكَ فِي أَهْلِكَ وَمَالِكَ. -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৪১০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৬৮৩

ছয়. ঋণ বান্দার হক, যা পরিশোধ করতে হয় অথবা দাতা কর্তৃক মাফ  পেতে হয়। এছাড়া মুক্তির কোনো পথ নেই। আল্লাহ তাআলা তা মাফ করেন না। এজন্য তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করে নেওয়া উত্তম, মৃত্যুর আগে-আগে তো অবশ্যই। কিন্তু (আল্লাহ না করুন) তার আগেই যদি কারো মৃত্যুক্ষণ এসে যায়, তবে কাউকে অসিয়ত করে যাওয়া উচিত।

হাদীসে এসেছে, ঋণ ছাড়া শহীদের সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৮৬

সালামা ইবনুল আকওয়া রা. থেকে বর্ণিত, আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  মজলিশে ছিলাম। তখন একজন মায়্যিত উপস্থিত করা হল। লোকেরা তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? লোকেরা বলল, জ্বী না। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? তারা বলল, জ্বী না। তখন তিনি নামায পড়ালেন। তারপর আরেকজন মায়্যিত উপস্থিত করা হল। লোকেরা তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? বলা হল, জ্বী হাঁ। জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? লোকেরা বলল, তিন দিনার রেখে গিয়েছে। তখন তিনি নামায পড়ালেন। এরপর আরেকজন মায়্যিত আনা হল। লোকেরা তাঁকে নামায পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, সে কি কিছু রেখে গিয়েছে? তারা বলল, জ্বী না। জিজ্ঞাসা করলেন, তার উপর কি কোনো ঋণ আছে? বলা হল, তিন দিনার আছে। তিনি বললেন, তোমাদের সাথীর নামায তোমরাই পড়। এ কথা শুনে আবু কাতাদা রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি নামায পড়িয়ে দিন, তার ঋণ আমার জিম্মায়। তখন তিনি নামায পড়ালেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২২৮৯

ঋণদাতার দায়িত্ব

এক. বিশেষ প্রয়োজনে কেউ ঋণ চাইলে সামর্থ্য থাকলে এবং মুনাসিব মনে হলে তাকে ঋণ দেওয়া।

ঋণ দেওয়া মূলত মুখাপেক্ষীকে সাহায্য করা। এজন্য কুরআন-হাদীসে মুখাপেক্ষীকে সাহায্যের যে সওয়াব ও ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, তা এখানেও প্রযোজ্য। একারণে ঋণ দেওয়ার গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন নেই। শুধু একটি হাদীস উল্লেখ করছি।

আবু  হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করে না। তার সাহায্য ত্যাগ করে না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে থাকে,  আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে থাকেন। আর যে কোনো মুসলিমের একটি বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তার কিয়ামতের দিনের বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০

দুই. ঋণগ্রহীতা সময়মত পরিশোধের প্রবল ধারণার ভিত্তিতেই ঋণ নিবে। এবং এর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টাও করবে। কিন্তু কখনো এমন হতে পারে যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সে তা পরিশোধ করতে অক্ষম; বরং কখনো কখনো সম্পূর্ণ অক্ষমতারও আশঙ্কা থাকে, এক্ষেত্রে সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলে (বাস্তবতা বিবেচনা করে) সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে সুযোগ দেওয়া বা মাফ করে দেওয়া অনেক বড় সওয়াবের কাজ। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) এবং কোনো (দেনাদার) যদি অসচ্ছল হয়, তবে সচ্ছলতা লাভ পর্যন্ত তাকে অবকাশ দেওয়া উচিত। আর যদি সদাকাই করে দাও, তবে তোমাদের জন্য সেটা অধিকতর শ্রেষ্ঠ, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। -সূরা বাকারা (২) : ২৮০

এখানে মাফ করাকে ‘সদাকা’ বলা হয়েছে। এতে  সম্ভবত এ দিকে ইঙ্গিত করা উদ্দেশ্য যে, এই ক্ষমা সদাকা হিসেবে গণ্য হবে এবং অনেক সওয়াবের কারণ হবে।

হাদীসে এসেছে, তোমাদের পূর্ববর্তী এক লোকের হিসাব নেওয়া হলে তার কোনো নেক আমল পাওয়া যায়নি। তবে সে মানুষের সাথে লেনদেন করত এবং বিত্তবান ছিল। কর্মচারীদের প্রতি তার এ নির্দেশ ছিল যে, অক্ষমদের যেন তারা মাফ করে দেয়। আল্লাহ বললেন, মাফ করার সক্ষমতা তো ওর চেয়ে আমার বেশি। এরপর তিনি ফিরিশতাদেরকে আদেশ দেন তাকে মাফ করে দেওয়ার। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৬১

অন্য এক হাদীসে এসেছে, যে অক্ষমকে সুযোগ দেয়, আল্লাহ তাআলা তাকে কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়াতলে জায়গা দিবেন- যখন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ১৩০৬

আবদুল্লাহ ইবনে আবী কাতাদা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু কাতাদা রা. তার এক ঋণগ্রহীতাকে খুঁজলে সে আত্মগোপন করল। পরে তাকে পাওয়া গেল। তখন সে বলল, আমি অসচ্ছল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আল্লাহর কসম? সে বলল, আল্লাহর কসম (আমি অসচ্ছল)! আবু কাতাদা রা. বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যার পছন্দ যে আল্লাহ তাকে কিয়ামতের বিপদসমূহ থেকে মুক্তি দিন সে যেন অসচ্ছলকে সুযোগ দেয় অথবা মাফ করে দেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৬৩

তিন. সময়ের পরে  তো বটেই,  (ক্ষেত্রবিশেষে) আগেও পরিশোধ তলব করা  যাবে। তবে সর্বাবস্থায় নম্রতা ও ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া কর্তব্য। কঠোরতা, গালি-গালাজ, ঝগড়া-বিবাদ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকা উচিত। উত্তম চরিত্র মুমিনের বৈশিষ্ট্য, যার সর্বোত্তম ক্ষেত্র লেনদেন। হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর রহমত নাযিল করুন যে সহৃদয় যখন বেচে, যখন কিনে এবং যখন নিজের হক তলব করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০৭৬

অন্য এক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি হক তলব করে সে যেন পবিত্রতার সঙ্গে তলব করে…। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫০৮০

এখানে পবিত্রতা বলতে চারিত্রিক পবিত্রতা উদ্দেশ্য। সুতরাং চরিত্রকে কলুষিত করে এমন যেকোনো কথা ও কাজ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।

চার. ভোগ্য ঋণ হোক বা ব্যবসায়ী ঋণ, ঋণের বিনিময়ে মূলধনের অতিরিক্ত কোনোরূপ শর্তারোপ না করা কর্তব্য। এটা রিবা, যা সম্পূর্ণ হারাম। কেউ এরূপ করে ফেললে যথা নিয়মে তাওবা করে শুধু মূলধনই গ্রহণ করবে।

পাঁচ. খোটা বা অন্য কোনোভাবে ঋণগ্রহীতাকে কষ্ট না দেওয়া। সদকা, ঋণসহ যাবতীয় ঐচ্ছিক দান-অনুগ্রহের জন্য এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে আমলটির সওয়াব নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) হে মুমিনগণ! খোটা ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের সদাকাকে সেই ব্যক্তির মত নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এ রকম- যেমন এক মসৃণ পাথরের উপর মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং সেটিকে (পুনরায়) মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে তার কিছুই তাদের হস্তগত হয় না। আর আল্লাহ কাফেরদেরকে হেদায়েতে উপনীত করেন না। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৪

প্রশ্ন: সদকা ও কর্জে হাসানা এর অর্থ এবং এতদুয়ভয়ের মাঝে পার্থক্য কি?

উত্তর :

♦ সদকা ’শব্দের শাব্দিক অর্থ দান বা ডোনেশন।

আর ইসলামের পরিভাষায় সদকা বলতে বুঝায়, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অভাবীকে কোন কিছু প্রদান করা। যেমন; টাকা-পয়সা, খাদ্যদ্রব্য, কাপড়, গবাদী পশু ইত্যাদি।

♦ আর কর্জে হাসানা অর্থ: উত্তম ঋণ। কুরআনে বহু স্থানে এর কথা উল্লেখিত হয়েছে কিন্তু তা দ্বারা আমাদের সমাজে প্রচলিত একে অপরকে ঋণ বা ধার (loan/الدين) দেয়ার অর্থ বুঝায় না।

নিম্নে কুরআনুল কারিমে ‘কর্জে হাসানা’ এর ব্যবহার এবং তার প্রকৃত অর্থ তুলে ধরা হল:

আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমের একাধিক স্থানে ‘কর্জে হাসানা’ এর কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন:

✳ মহান আল্লাহ বলেন,

مَّن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّـهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ أَضْعَافًا كَثِيرَةً ۚ

“এমন কে আছে যে, আল্লাহকে করযে হাসানা (উত্তম ঋণ); অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন।” (সূরা বাকরা:২৪৫)

✳ তিনি আরও বলেন,

مَّن ذَا الَّذِي يُقْرِضُ اللَّـهَ قَرْضًا حَسَنًا فَيُضَاعِفَهُ لَهُ وَلَهُ أَجْرٌ كَرِيمٌ

“এমন কে আছে যে, আল্লাহকে করযে হাসানা (উত্তম ঋণ); অতঃপর আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ-বহুগুণ বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক পূরস্কার।” (সূরা আল হাদীদ:১১)

✳ তিনি আরও বলেন,

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَقْرِضُوا اللَّـهَ قَرْضًا حَسَنًا ۚ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنفُسِكُم مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِندَ اللَّـهِ هُوَ خَيْرًا وَأَعْظَمَ أَجْرًا ۚ

“তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে করযে হাসানা বা উত্তম ঋণ দাও। তোমরা নিজেদের জন্যে যা কিছু অগ্রে পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে উত্তম আকারে এবং পুরস্কার হিসেবে বর্ধিতরূপে পাবে।” (সূরা মুদ্দাসসির: ২০)

উক্ত আয়াতে কারীমা সমূহে উল্লেখিত আল্লাহকে কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ দেয়ার অর্থ, “আল্লাহর পথে খরচ করা।” (তাফসীর ইবনে কাসীর, তাফসীরে বিন সাদী ইত্যাদি)

ইবনে যায়েদ বলেন, “যাকাত দেয়া ছাড়াও নিজের অর্থ-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ করা। এ খরচ আল্লাহর পথে জিহাদ করা, আল্লাহর বান্দাদের সাহায্য করা, জনকল্যাণমূলক কাজ করা কিংবা অন্যান্য কল্যাণকর কাজেও হতে পারে।”

এভাবে অর্থ ব্যয় করলে আল্লাহ তাকে নিজের জন্য ঋণ বলে গণ্য করেন। তাই তিনি এক্ষেত্রে কেবল আসলটি নয় বরং তার ওপর কয়েকগুণ বেশী দেয়ার ওয়াদা করেছেন।

কোন কোন আলেমের মতে, কর্জে হাসানা দ্বারা যে কোন সৎকর্মকেই বুঝায়।

মোট কথা, কুরআনে বর্ণিত কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অর্থ-সম্পদ খরচ করা-যার পেছনে কোন ব্যক্তিগত বা দুনিয়াবী স্বার্থ জড়িত থাকবে না। বরং নিছক আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে তা এমন কাজে ব্যয় হবে যা তিনি পছন্দ করেন। অথবা অন্যান্য যে কোন সৎকর্ম যার প্রতিদান আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন আমল কারী কে অনেক বেশি পরিমাণে দান করবেন।  والله أعلم    উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।

আবু উমামা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

دَخَلَ رَجُلُ الْجَنّةَ فَرَاى عَلى بِابِهَا مَكْتُوْبًا الصَّدَقَةُ بِعَشَرِ اَمْثَالِهَا وَالْقَرَضُ بِثَمَانِيَةَ عَشَرَ

“এক ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করে দেখল, জান্নাতের দরজায় লেখা আছে: “দানের নেকি দশগুণ আর ঋণের নেকি ১৮ গুণ।” (সিলসিলা সাহীহা, হা/১৪৮১ এবং সহিহ তারগিব, হা/৯০০)।

উক্ত হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, দান ও ঋণ উভয়ের প্রতিদান জান্নাত। আর দান করার চেয়ে ঋণ প্রদানের সওয়াব অনেক বেশি।

তবে অন্য হাদিসে এসেছে, ইবনে মাসঊদ রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُقْرِضُ مُسْلِماً قَرْضاً مَرَّتَينِ، إِلاَّ كَانَ كَصَدَقَتِهَا مَرَّهً

‘‘কোন মুসলিম যদি অপর কোন মুসলিমকে দু বার ঋণ দেয়, তাহলে তা তাকে এক বার সদকা করার অনুরূপ (সওয়াব পাবে)।” [ইবনে মাজাহ, সনদ হাসান। উৎস: ইরওয়াউল গালীল, হা/১৩৮৯]

إِنَّ السَّلَفَ يَجْرِي مَجْرَى شَطرِ الصَّدَقَةِ

“নিশ্চয় ঋণ দেয়া অর্ধেক দানের স্থলাভিষিক্ত।” (মুসনাদে আহমদ, হা/৩৯১১, সহিহুল জামে লিশ শাইখ আলবানি, হা/১৬৪০)

এখানে দু ধরণের হাদিস দেখা যাচ্ছে। ১মটি বলা হয়েছে, দানে ১০গুণ আর ঋণে ১৮গুণ সওয়াব অর্থাৎ দানের চেয়ে ঋণে ৮গুণ সওয়াব বেশি কিন্তু পরের দুটি হাদিসে দেখা যাচ্ছে, ঋণের সওয়াব দানের সওয়াবের অর্ধেক। অর্থাৎ এখানে ঋণ দেয়ার চেয়ে দান করার সওয়াব বেশি বলা হচ্ছে। কেননা, আপনি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ একবার দান করে যে সওয়াব পাবেন তা পেতে হলে আপনাকে ঐ পরিমাণ অর্থ দু বার ঋণ দিতে হবে।

তাহলে বাহ্যত সওয়াবের পরিমাণের দিক থেকে দু প্রকার হাদিসকে সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে।

এ সাংর্ষিকতা সমাধানে ইমাম মুনাবী বলেন:

أن مرد ذلك يكون على حسب حالة المحتاج، فإن كان طالب القرض أحوج من طالب الصدقة كان ذلك أفضل، ويشترط للحصول على ثواب القرض إخلاص النية لله تعالى.

“সওয়াব প্রাপ্তির বিষয়টি নির্ভর করছে অভাবী ব্যক্তির অবস্থার উপরে। সুতরাং ঋণ প্রার্থী ব্যক্তি যদি সদকা প্রার্থী ব্যক্তির চেয়ে অধিক অভাবী হয় তাহলে তাকে ঋণ দেওয়া অধিক উত্তম। আর ঋণ দিয়ে সওয়াব পাওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে, ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ঋণ দেওয়া। [সুতরাং কেউ যদি কেউ যদি ঋণগ্রহীতাকে তার প্রতি অবদান দেখানো বা কেবল বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে ঋণ দেয় তাহলে সওয়াব পাবে না।]।

আল্লাহু আলাম।

▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬

উত্তর প্রদানে:

আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।

২:২৪৬ اَلَمۡ تَرَ اِلَی الۡمَلَاِ مِنۡۢ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ مِنۡۢ بَعۡدِ مُوۡسٰی ۘ اِذۡ قَالُوۡا لِنَبِیٍّ لَّهُمُ ابۡعَثۡ لَنَا مَلِکًا نُّقَاتِلۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ قَالَ هَلۡ عَسَیۡتُمۡ اِنۡ کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الۡقِتَالُ اَلَّا تُقَاتِلُوۡا ؕ قَالُوۡا وَ مَا لَنَاۤ اَلَّا نُقَاتِلَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ قَدۡ اُخۡرِجۡنَا مِنۡ دِیَارِنَا وَ اَبۡنَآئِنَا ؕ فَلَمَّا کُتِبَ عَلَیۡهِمُ الۡقِتَالُ تَوَلَّوۡا اِلَّا قَلِیۡلًا مِّنۡهُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌۢ بِالظّٰلِمِیۡنَ

২৪৬. আপনি কি মূসার পরবর্তী ইসরাঈল-বংশীয় নেতাদের দেখেননি? তারা যখন তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন রাজা নিযুক্ত কর যাতে আমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি’, তিনি বললেন, ‘এমন তো হবে না যে, তোমাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেয়া হলে তখন আর তোমরা যুদ্ধ করবে না? তারা বলল, আমরা যখন নিজেদের আবাসভূমি ও স্বীয় সন্তান-সন্ততি হতে বহিস্কৃত হয়েছি, তখন আল্লাহর পথে কেন যুদ্ধ করবো না’? অতঃপর যখন তাদের প্রতি যুদ্ধের বিধান দেয়া হলো তখন তাদের কিছু সংখ্যক ছাড়া সবাই পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল আর আল্লাহ যালিমদের সম্পর্কে সবিশেষ জ্ঞানী।

مَلأ কোন জাতির এমন সম্মানিত ও সমভ্রান্ত লোকদেরকে বলা হয়, যারা বিশেষ উপদেষ্টা ও নেতা হন। যাদেরকে দেখলে চোখ ও অন্তর প্রতাপে ভরে যায়। مَلأ এর আভিধানিক অর্থ ভরে যাওয়া। (আইসারুত্ তাফাসীর) যে নবীর কথা (আয়াতে) উল্লেখ হয়েছে, তার নাম ‘শামবীল’ বলা হয়। ইবনে কাসীর ও অন্যান্য মুফাসসিরগণ যে ঘটনা বর্ণনা করেছেন তার সার কথা হল, বানী-ইস্রাঈল মূসা (আঃ)-এর পর কিছুকাল পর্যন্ত সঠিক পথেই ছিল। তারপর তাদের মধ্যে বিমুখতা এল। দ্বীনে নতুন নতুন বিদআত আবিষ্কার করল। এমন কি মূর্তিপূজাও আরম্ভ করে দিল। নবীগণ তাদেরকে বাধা দিলেন, কিন্তু তারা অবাধ্যতা ও শিরক থেকে বিরত হল না। ফলে আল্লাহ তাদের শত্রুদেরকে তাদের উপর আধিপত্য দান করলেন। তারা ওদের অঞ্চল ওদের কাছ থেকে কেড়ে নিল এবং ওদের মধ্য থেকে বহু সংখ্যক মানুষকে বন্দী করল। তাদের মধ্যে নবী আগমনের ধারাবাহিকতাও বন্ধ হয়ে গেল। শেষে কিছু লোকের দু’আয় শামবীল নবী (আঃ) জন্ম লাভ করলেন। তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু করলেন। তারা নবীর কাছে দাবী পেশ করল যে, আমাদের জন্য একজন বাদশাহ নির্বাচিত করে দিন; আমরা তার নেতৃত্বে শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। নবী তাদের অতীত চরিত্রের আলোকে বললেন, তোমরা দাবী তো করছ, কিন্তু আমার অনুমান তোমরা তোমাদের কথার উপর অটল থাকবে না। সুতরাং সেই রকমই হল, যে রকম কুরআন বর্ণনা করেছে।

নবী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও রাজা নিযুক্ত করার দাবী পেশ করা, রাজতন্ত্র বৈধতার দলীল। কেননা, যদি রাজতন্ত্র বৈধ না হত, তাহলে মহান আল্লাহ তাদের দাবীকে প্রত্যাখ্যান করতেন। কিন্তু আল্লাহ তাদের দাবীকে প্রত্যাখ্যান করেননি, বরং ত্বালূতকে তাদের জন্য রাজা নিযুক্ত করে দিলেন; যাঁর কথা পরে আসছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, রাজা যদি লাগামহীন স্বেচ্ছাচারী না হয়ে আল্লাহর বিধি-বিধানের প্রতি যত্নবান এবং ন্যায়পরায়ণ হন, তাহলে তাঁর রাজত্ব কেবল বৈধই নয়, বরং কাম্য এবং বাঞ্ছনীয়ও। (অধিক জানার জন্য দ্রষ্টব্যঃ সূরা মায়েদা ২০নং আয়াতের টীকা)তাফসীরে আহসানুল বায়ান

২:২৪৭ وَ قَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ اِنَّ اللّٰهَ قَدۡ بَعَثَ لَکُمۡ طَالُوۡتَ مَلِکًا ؕ قَالُوۡۤا اَنّٰی یَکُوۡنُ لَهُ الۡمُلۡکُ عَلَیۡنَا وَ نَحۡنُ اَحَقُّ بِالۡمُلۡکِ مِنۡهُ وَ لَمۡ یُؤۡتَ سَعَۃً مِّنَ الۡمَالِ ؕ قَالَ اِنَّ اللّٰهَ اصۡطَفٰىهُ عَلَیۡکُمۡ وَ زَادَهٗ بَسۡطَۃً فِی الۡعِلۡمِ وَ الۡجِسۡمِ ؕ وَ اللّٰهُ یُؤۡتِیۡ مُلۡکَهٗ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ ﴿۲۴۷﴾

২৪৭. আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই তালুতকে তোমাদের রাজা করে পাঠিয়েছেন। তারা বলল, আমাদের উপর তার রাজত্ব কিভাবে বেশী হকদার এবং তাকে প্রচুর ঐশ্বর্যও দেয়া হয়নি!’ তিনি বললেন, আল্লাহ অবশ্যই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে স্বীয় রাজত্ব দান করেন। আর আল্লাহ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।

ত্বালূত সেই বংশের ছিলেন না, যে বংশ থেকে ধারাবাহিকতার সাথে বানী-ইস্রাঈলদের মধ্যে রাজাদের আগমন ঘটেছে। তিনি দরিদ্র ও সাধারণ একজন সৈনিক ছিলেন। তাই তারা অভিযোগ করল। নবী বললেন, এটা তো আমার নির্বাচন নয়, বরং মহান আল্লাহ তাঁকে নির্বাচন করেছেন। তাছাড়া নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব করার জন্য সম্পদের চেয়ে জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৈহিক শক্তির প্রয়োজন বেশী এবং এতে (জ্ঞান-বুদ্ধি ও দৈহিক শক্তিতে) তিনি তোমাদের সবার ঊর্ধ্বে। আর এই কারণেই মহান আল্লাহ তাঁকে এই পদের জন্য মনোনীত করে নিয়েছেন। তিনি বড়ই অনুগ্রহশীল। তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় দয়া ও অনুগ্রহদানে ধন্য করেন। তিনি সর্ব বিষয়ে অবগত। অর্থাৎ, তিনি জানেন যে, রাজত্ব পাওয়ার কে যোগ্য এবং কে অযোগ্য। (মনে হয় যখন তাদেরকে বলা হল যে, এই মনোনয়ন মহান আল্লাহ কর্তৃক, তখন তারা সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো কোন নিদর্শন কামনা করে, তাই পরের আয়াতে আরো একটি নিদর্শনের বর্ণনা এসেছে।)

২:২৪৮ وَ قَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ اِنَّ اٰیَۃَ مُلۡکِهٖۤ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ التَّابُوۡتُ فِیۡهِ سَکِیۡنَۃٌ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ بَقِیَّۃٌ مِّمَّا تَرَکَ اٰلُ مُوۡسٰی وَ اٰلُ هٰرُوۡنَ تَحۡمِلُهُ الۡمَلٰٓئِکَۃُ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیَۃً لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

২৪৮. আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিলেন, তার রাজত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের নিকট তাবূত আসবে যাতে তোমাদের রব-এর নিকট হতে প্রশান্তি এবং মুসা ও হারূন বংশীয়গণ যা পরিত্যাগ করেছে তার অবশিষ্টাংশ থাকবে; ফেরেশতাগণ তা বহন করে আনবে। তোমরা যদি মুমিন হও তবে নিশ্চয় তোমাদের জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।

সিন্দুক অর্থাৎ, তাবূত বা শবাধার। تابوت শব্দটি توب ধাতু থেকে গঠিত। যার অর্থ হল, প্রত্যাবর্তন করা। যেহেতু বানী-ইস্রাঈল বরকত অর্জনের জন্য এর প্রতি প্রত্যাবর্তন করত, তাই এর নাম তাবূত রাখা হয়। (ফাতহুল ক্বাদীর) এই সিন্দুকে মূসা এবং হারূন (আলাইহিমাসসালাম)-এর বরকতময় কিছু জিনিস ছিল। এই সিন্দুকও তাঁদের শত্রুরা তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। মহান আল্লাহ নিদর্শনস্বরূপ ফিরিশতাদের মাধ্যমে এই সিন্দুক ত্বালুতের দরজায় পৌঁছিয়ে দিলেন। তা দেখে বানী-ইস্রাঈল আনন্দিতও হল এবং মেনেও নিল যে, এটি ত্বালূতের রাজত্ব প্রমাণের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নিদর্শন। অনুরূপ মহান আল্লাহ এটিকে তাদের জন্য একটি অলৌকিক নিদর্শন এবং বিজয় লাভের ও তাদের মনের প্রশান্তির উপকরণ করেন। মনের প্রশান্তির অর্থই হচ্ছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর খাস বান্দাদের উপর এমন বিশেষ সাহায্যের অবতরণ, যার কারণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ময়দানে যখন বড় বড় সিংহের মত বীরদের অন্তর কেঁপে ওঠে, তখন ঈমানদারদের অন্তর শত্রুর ভয় থেকে শূন্য এবং বিজয় ও সফলতা অর্জনের আশায় পরিপূর্ণ থাকে।

এই কাহিনী থেকে জানা যায় যে, আম্বিয়া ও সালেহীনদের বরকতময় জিনিসের মধ্যে নিঃসন্দেহে আল্লাহর অনুমতিক্রমে গুরুত্ব ও উপকারিতা আছে। তবে শর্ত হল এই যে, তা সত্যপক্ষেই বরকতময় (এবং নবীদের ব্যবহূত) হতে হবে; যেমন উক্ত তাবূতে নিঃসন্দেহে মূসা ও হারূন আলাইহিমাস সালামের কিছু বরকতময় জিনিস রাখা ছিল। বলা বাহুল্য, মিথ্যা দাবীর ফলে কোন জিনিস বরকতময় হয়ে যায় না। যেমন বর্তমানে বরকতময় জিনিসের নামে কয়েক জায়গায় বিভিন্ন জিনিস রাখা আছে, অথচ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তার সত্যতার কোন প্রমাণ মিলে না। অনুরূপ মনগড়াভাবে কোন জিনিসকে বরকতময় বানিয়ে নিলে, তাও কোন উপকারে আসে না। যেমন কিছু লোক মহানবী (সাঃ)-এর বরকতময় জুতার মূর্তি বানিয়ে নিজের পাশে রাখে অথবা বাড়ির দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখে অথবা বিশেষ পদ্ধতিতে তা ব্যবহার করার মাধ্যমে নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ ও বিপদ দূর হবে বলে মনে করে থাকে। এইভাবে কবরে বুযুর্গদের নামে নিবেদিত নযর ও নিয়াযের জিনিসকে এবং তবরুকের খানাকে অনেকে বরকতময় মনে করে থাকে। অথচ এ হল গায়রুল্লাহর নামে নিবেদন ও অমূলক বিশ্বাস; যা শিরকের আওতাভুক্ত। এই শ্রেণীর খাবার খাওয়া নিঃসন্দেহে হারাম। কোন কোন কবরের গোসল দেওয়া হয় এবং তার পানিকে বরকতময় মনে করা হয়। অথচ কবরের গোসল দান কা’বাগৃহের গোসল দেওয়ার নকল; যা বৈধই নয়। পক্ষান্তরে গোসলে ব্যবহূত এ নোংরা পানি কিভাবে বরকতময় হতে পারে? বলাই বাহুল্য যে, এ শ্রেণীর অমূলক বিশ্বাস ও বরকত বা তবরুকের ধারণা ভ্রান্ত ও শিরক; ইসলামী শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই।

 

জালূত ও তালূতের কাহিনী এবং দাঊদের বীরত্ব

সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (মায়েদাহ ৫/২৩)।

কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, اذْهَبْ أَنتَ وَرَبُّكَ فَقَاتِلا إِنَّا هَاهُنَا قَاعِدُوْنَ-(المائدة ২৫)- ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)।

এতবড় বেআদবীর পরে মূসা (আঃ) তাদের ব্যাপারে নিরাশ হলেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দুভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।

জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে অতিবাহিত করার পর মূসার শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের চাপিয়ে দেন। বনু ইস্রাঈলরা আবার নিগৃহীত হ’তে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে যায়। এক সময় শ্যামুয়েল (شمويل) নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-

أَلَمْ تَرَ إِلَى الْمَلإِ مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ مِن بَعْدِ مُوسَى إِذْ قَالُوْا لِنَبِيٍّ لَّهُمُ ابْعَثْ لَنَا مَلِكاً نُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللهِ قَالَ هَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ أَلاَّ تُقَاتِلُوْا قَالُوْا وَمَا لَنَا أَلاَّ نُقَاتِلَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَقَدْ أُخْرِجْنَا مِنْ دِيَارِنَا وَأَبْنَآئِنَا فَلَمَّا كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقِتَالُ تَوَلَّوْا إِلاَّ قَلِيلاً مِّنْهُمْ وَاللهُ عَلِيمٌ بِالظَّالِمِيْنَ- (البقرة ২৪৬)-

‘তুমি কি মূসার পরে বনু ইস্রাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হ’তে! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হ’ল তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেমদের ভাল করেই জানেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৬)। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-

وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ اللهَ قَدْ بَعَثَ لَكُمْ طَالُوتَ مَلِكاً قَالُوْا أَنَّى يَكُونُ لَهُ الْمُلْكُ عَلَيْنَا وَنَحْنُ أَحَقُّ بِالْمُلْكِ مِنْهُ وَلَمْ يُؤْتَ سَعَةً مِّنَ الْمَالِ قَالَ إِنَّ اللهَ اصْطَفَاهُ عَلَيْكُمْ وَزَادَهُ بَسْطَةً فِي الْعِلْمِ وَالْجِسْمِ وَاللهُ يُؤْتِي مُلْكَهُ مَن يَّشَآءُ وَاللهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ- وَقَالَ لَهُمْ نِبِيُّهُمْ إِنَّ آيَةَ مُلْكِهِ أَن يَّأْتِيَكُمُ التَّابُوْتُ فِيْهِ سَكِيْنَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِّمَّا تَرَكَ آلُ مُوْسَى وَآلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلآئِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لَّكُمْ إِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِيْنَ-(البقرة ২৪৭-২৪৮)-

‘তাদের নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। জওয়াবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হ’লেন প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে তোমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ। এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ ২/২৪৭-২৪৮)।

বিষয়টি এই যে, বনু ইস্রাঈলগণের নিকটে একটা সিন্দুক ছিল। যার মধ্যে তাদের নবী মূসা, হারূণ ও তাঁদের পরিবারের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী ছিল। তারা এটাকে খুবই বরকতময় মনে করত এবং যুদ্ধকালে একে সম্মুখে রাখত। একবার আমালেক্বাদের সাথে যুদ্ধের সময় বনু ইস্রাঈলগণ পরাজিত হলে আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূত উক্ত সিন্দুকটি নিয়ে যায়। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন।

সিন্দুকটি তালূতের বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।

সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হ’লে তিনি কথিত মতে ৮০,০০০ হাজার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। ইবনু কাছীর এই সংখ্যায় সন্দেহ পোষণ করে বলেন, ক্ষুদ্রায়তন ফিলিস্তীন ভূমিতে এই বিশাল সেনাদলের সংকুলান হওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার। আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ২/৮;

অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ:

فَلَمَّا فَصَلَ طَالُوْتُ بِالْجُنُوْدِ قَالَ إِنَّ اللهَ مُبْتَلِيْكُمْ بِنَهَرٍ فَمَنْ شَرِبَ مِنْهُ فَلَيْسَ مِنِّي وَمَنْ لَّمْ يَطْعَمْهُ فَإِنَّهُ مِنِّيْ إِلاَّ مَنِ اغْتَرَفَ غُرْفَةً بِيَدِهِ فَشَرِبُوْا مِنْهُ إِلاَّ قَلِيلاً مِّنْهُمْ فَلَمَّا جَاوَزَهُ هُوَ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ قَالُوْا لاَ طَاقَةَ لَنَا الْيَوْمَ بِجَالُوْتَ وَجُنُوْدِهِ قَالَ الَّذِيْنَ يَظُنُّوْنَ أَنَّهُم مُّلاَقُو اللهِ: كَم مِّنْ فِئَةٍ قَلِيْلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيْرَةً بِإِذْنِ اللهِ وَاللهُ مَعَ الصَّابِرِيْنَ-(البقرة ২৪৯)-

‘অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হ’তে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক আঁজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হ’ল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হ’তেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৯)।

বস্ত্ততঃ নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্ত্তবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাঊদ। আল্লাহ বলেন,

وَلَمَّا بَرَزُوْا لِجَالُوْتَ وَجُنُوْدِهِ قَالُوْا رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْراً وَّثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِيْنَ-(البقرة ২৫০)-

‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হ’ল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ ২/২৫০)।

জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাঊদ নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন।

তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হ’লেন না। কিন্তু দাঊদ নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাঊদ ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাঊদ পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

فَهَزَمُوْهُمْ بِإِذْنِ اللهِ وَقَتَلَ دَاوُودُ جَالُوْتَ وَآتَاهُ اللهُ الْمُلْكَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَهُ مِمَّا يَشَآءُ وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الأَرْضُ وَلَـكِنَّ اللهَ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِيْنَ-(البقرة ২৫১)-

‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।

উপরোক্ত ঘটনায় আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, তালূত কর্তৃক পরীক্ষা গ্রহণের ফলে তাঁর আমলেই বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে দু’টি দলের সৃষ্টি হয়। একদল তালূতের অনুগত মুমিন। যারা নিজেদেরকে ‘বনূ ইস্রাঈল’ বলেই পরিচিত করে। অর্থ ‘আল্লাহর দাস’-এর বংশ। অপর দল ছিল মুনাফিক- যাদেরকে ‘ইয়াহুদী’ বলা হ’ত। প্রকৃত বনু ইস্রাঈলগণ ‘ইয়াহুদী’ নামকে ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আজও পৃথিবীতে তারা ঘৃণিত হয়েই আছে। অতদিন কিয়ামত হবেনা যতদিন না মুসলমানরা একে একে এদেরকে হত্যা করবেন। গাছ ও পাথর পর্যন্ত এদের পালিয়ে থাকা অবস্থান মুসলমানদের জানিয়ে দেবে। মুসলিম, মিশকাত হা/৫৪১৪ ‘ফিতান’ অধ্যায়, ১ অনুচ্ছেদ।

সংগ্রহ ও সহায়কঃ

তাফসিরে যাকারিয়া,তাফহিমুল কুর’আন,আহসানুল বায়ান, নবী কাহিনী