সুরা বাকারাঃ ২৭তম রুকু (২১৭-২২১)আয়াত

 সুরা বাকারাঃ ২৭তম রুকু (২১৭-২২১)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:২১৭ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الشَّهۡرِ الۡحَرَامِ قِتَالٍ فِیۡهِ ؕ قُلۡ قِتَالٌ فِیۡهِ کَبِیۡرٌ ؕ وَ صَدٌّ عَنۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ کُفۡرٌۢ بِهٖ وَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ٭ وَ اِخۡرَاجُ اَهۡلِهٖ مِنۡهُ اَکۡبَرُ عِنۡدَ اللّٰهِ ۚ وَ الۡفِتۡنَۃُ اَکۡبَرُ مِنَ الۡقَتۡلِ ؕ وَ لَا یَزَالُوۡنَ یُقَاتِلُوۡنَکُمۡ حَتّٰی یَرُدُّوۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِکُمۡ اِنِ اسۡتَطَاعُوۡا ؕ وَ مَنۡ یَّرۡتَدِدۡ مِنۡکُمۡ عَنۡ دِیۡنِهٖ فَیَمُتۡ وَ هُوَ کَافِرٌ فَاُولٰٓئِکَ حَبِطَتۡ اَعۡمَالُهُمۡ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ

২১৭. পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞেস করে বলুন, এতে যুদ্ধ করা কঠিন অপরাধ। কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা দান করা, আল্লাহ্‌র সাথে কুফরী করা, মসজিদুল হারামে বাধা দেয়া ও এর বাসিন্দাকে এ থেকে বহিস্কার করা আল্লাহ্‌র নিকট তারচেয়েও বেশী অপরাধ। আর ফিতনা হত্যার চেয়েও গুরুতর অপরাধ। আর তারা সবসময় তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে, যে পর্যন্ত তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরিয়ে না দেয়, যদি তারা সক্ষম হয়। আর তোমাদের মধ্য থেকে যে কেউ নিজের দ্বীন থেকে ফিরে যাবে এবং কাফের হয়ে মারা যাবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের আমলসমূহ নিস্ফল হয়ে যাবে। আর এরাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।

এ বিষয়টি একটি ঘটনার সাথে সম্পর্কিত৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাসে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী ‘নাখ্‌লা’ নাম স্থানে আটজনের একটি বাহিনী পাঠান৷ কুরাইশদের গতিবিধি ও তাদের সংকল্প সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করার দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করেন৷ যুদ্ধ করার কোন অনুমতি তাদেরকে দেননি৷ কিন্তু পথে তারা কুরাইশদের একটি ছোট বাণিজ্যিক কাফেলার মুখোমুখি হয়৷ কাফেলার ওপর আক্রমণ চালিয়ে তারা একজনকে হত্যা করে এবং বাদবাকি সবাইকে গ্রেফতার করে অর্থ ও পণ্য সম্ভারসহ তাদেরকে মদীনায় নিয়ে আসে৷ তাদের এ পদক্ষেপটি এমন এক সময় গৃহীত হয় যখন রজব শেষ হয়ে শাবান মাস শুরু হয়ে গিয়েছিল৷ তাদের এ আক্রমণটি রজব মাসে (অর্থাৎ হারাম মাসে) সংঘটিত হয়েছিল কি না বা ব্যাপারটি সম্পর্কে সন্দেহ জাগে৷ কিন্তু কুরাইশরাও পর্দান্তরালে তাদের সাথে যোগসাজশকারী ইহুদী ও মদীনার মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরুদ্দে প্রচারণা চালাবার জন্য এ ঘটনাটির কথা চারদিকে ব্যাপকভাবে ছড়াতে থাকে৷ তারা কঠিন আপত্তি জানিয়ে অপ্রচার করতে থাকে হাঁ, এরা বড়ই আল্লাওয়ালা হয়েছে৷ অথচ হারাম মাসেও রক্তপাত করতে কুন্ঠিত হয় না৷ এ আয়াতে তাদের এ আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে৷ জবার আর নির্যাস হচ্ছেঃ হারাম মাসে লড়াই করা নিসন্দেহে বড়ই গর্হিত কাজ৷ কিন্তু এর বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করা তাদের জন্য শোভা পায় না, যারা শুধুমাত্র এক আল্লাহর ওপর ঈমান আনার কারণে তেরো বছর ধরে তাদের অসংখ্য ভাইয়ের ওপর যুলুম নির্যাতন চালিয়ে এসেছে৷ তাদেরকে এমনভাবে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করেছে যে, তারা স্বদেশ ভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে৷ তারপর এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি৷ তাদের ঐ ভাইদের মসজিদে হারামে যাবার পথও বন্ধ করে দিয়েছে৷ অথচ মসজিদে হারাম কারোর নিজস্ব সম্পত্তি নয়৷ গত দু’হাজার বছর থেকে কোন দিন কাউকে এ ঘরের যিয়ারতে বাধা দেয়া হয়নি৷ কাজেই এ ধরনের কলংকিত চরিত্রের অধিকারী জালেমরা কোন্‌ মুখে সামান্য একটি সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে এত বড় হৈচৈ করে বেড়াচ্ছে এবং আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করে চলছে? অথচ এ সংঘর্ষে নবীর অনুমতি ছাড়াই সবকিছু ঘটেছে৷ এ ঘটনাটিকে বড় জোর এভাবে বলা যেতে পারে, একট ইসলামী জামায়াতের কয়েকজন লোক একটি দায়িত্বহীন কাজ করে বসেছে৷

এ প্রসংগে একথা মনে রাখা দরকার যে, এ তথ্য সংগ্রহাক বাহিনীটি বন্দী ও গনীমাতের মাল নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খিদমতে হাযির হবার সাথে সাথেই তিনি বলেন, আমি তো তোমাদের যুদ্ধ করার অনুমতি দেইনি৷ তাছাড়া তারা যে গনীমাতের মাল এনেছিল তা থেকে তিন বাইতুল মালের অংশ নিতেও অস্বীকৃতি জানান৷ তাদের এ লুন্ঠন অবৈধ ছিল, এটি তারই প্রমাণ৷ সাধারণ মুসলমানরাও এ পদক্ষেপের কারণে এর সাথে সংশ্লিষ্ট নিজেদের লোকদেরকে কাঠোরভাবে তিরস্কার করে৷ মদীনার একটি লোকও তাদের এ কাজের প্রশংসা করেনি৷

সততা ও সৎপ্রবণতার ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মুসলমানদের কোন কোন সরলমনা ব্যক্তি মক্কার কাফের ও ইহুদিদের উপরোল্লিখিত অভিযোগে প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন৷ এই আয়াতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে যে,তোমাদের এসব কথায় তোমাদের ও তাদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে যাবে, একথা মনে করো না৷ তারা বোঝাপড়ার জন্য অভিযোগ করছে না৷ তারা তো আসলে কাঁদা ছুঁড়তে চায়৷ তোমরা কেন এই দীনের প্রতি ঈমান এনেছো এবং কেন দুনিয়াবাসীর সামনে এর দাওয়াত পেশ করে চলেছো- একথা তাদের মনে কাঁটার মতো বিঁধছে৷ কাজেই যতদিন তারা নিজেদের কুফরীর ওপর অটল রয়েছে এবং তোমরাও এই দীন ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকেছো ততিদন তোমাদের ও তাদের মধ্যে কোন প্রকার বোঝাপড়া ও সমঝোতা হতে পারে না৷ আর এই ধরনের শত্রুদেরকে তোমরা মামুলি শত্রু মনে করো না যারা তোমাদের অর্থ-সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতে চায় তারা অপেক্ষাকৃত ছোট পর্যায়ের শত্রু৷ কিন্তু যারা তোমাদেরকে আল্লাহর সত্য দীন থেকে ফিরিয়ে নিতে চাই তারাই তোমাদের নিকৃষ্টতম শত্রু৷ কারণ প্রথম শত্রুটি তোমাদের বৈষয়িক ক্ষতি করতে চাই কিন্তু দ্বিতীয় শত্রুটি চায় তোমাদেরকে আখেরাতের চিরন্তন আযাবের মধ্যে ঠেলে দিতে এবং এ জন্য সে তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷

মুরতাদ সে ব্যক্তি, যে ইসলাম থেকে কুফরীর দিকে ফিরে গেছে, চাই তা কথায় হোক, বিশ্বাসে হোক বা কাজে হোক। এ আয়াতের শেষে মুসলিম হওয়ার পর তা ত্যাগ করা বা মুরতাদ হয়ে যাওয়ার হুকুম বলা হয়েছে। “তাদের আমল দুনিয়া ও আখেরাতে বরবাদ হয়ে গেছে”। এ বরবাদ হয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে যে, পার্থিব জীবনে তাদের স্ত্রী তাদের বিবাহ বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যদি তার কোন নিকটআত্মীয়ের মৃত্যু হয়, তাহলে সে ঐ ব্যক্তির উত্তরাধিকার বা মীরাসের অংশ থেকে বঞ্চিত হয়, ইসলামে থাকাকালীন সালাত-সাওম যত কিছু করেছে সব বাতিল হয়ে যায়, মৃত্যুর পর তার জানাযা পড়া হয় না এবং মুসলিমদের কবরস্থানে তাকে দাফনও করা হবে না। আর আখেরাতে বরবাদ হওয়ার অর্থ হচ্ছে ইবাদাতের সওয়াব না পাওয়া এবং চিরকালের জন্য জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া।                                                  হাদীসে আছে, ‘‘যে তার দ্বীন পরিবর্তন করে ফেলেছে, তাকে হত্যা করে দাও।’’ (বুখারী ৩০১৭নং)                                             মোটকথা, মুরতাদের অবস্থা কাফেরদের অবস্থা অপেক্ষাও নিকৃষ্টতর। এজন্য কাফেরদের থেকে জিযিয়া গ্রহণ করা যায়, কিন্তু পুনরায় ইসলাম গ্রহণ না করলে মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কেননা, মুরতাদের কার্যকলাপের দরুন সরাসরিভাবে ইসলামের অবমাননা করা হবে। কাজেই তারা সরকার অবমাননার শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

২:২১৮ اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ الَّذِیۡنَ هَاجَرُوۡا وَ جٰهَدُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ۙ اُولٰٓئِکَ یَرۡجُوۡنَ رَحۡمَتَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

২১৮. নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে। আর আল্লাহ ক্ষমাপরায়ণ, পরম দয়ালু।

জিহাদ অর্থ হচ্ছে,কোন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে নিজের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া৷ এটি নিছক যুদ্ধের সমার্থক কোন শব্দ নয়৷ যুদ্দের জন্য আরবীতে ‘কিতাল’ (রক্তপাত) শব্দ ব্যবহার করা হয়৷ জিহাদের অর্থ তার চাইতে ব্যাপক৷ সব রকমের প্রচেষ্টা ও সাধনা এর অন্তরভূক্ত৷ মুজাহিদ এমন এক ব্যক্তিকে বলা হয়, যে সর্বক্ষন নিজের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সাধনে নিমগ্ন, যার মস্তিস্ক সবসময় ঐ উদ্দেশ্য প্রচারণায় নিয়োজিত৷ মুজাহিদের হাত, পা ও শরীরের প্রতিটি অংগ প্রত্যংগ জিহাদের উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য সারাক্ষন প্রচেষ্টা, সাধনা ও পরিশ্রম করে চলছে৷ জিহাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য সে নিজের সম্ভাব্য সমস্ত উপায়-উপকরণ নিয়োগ করে, পূর্ণ শক্তি দিয়ে এই পথের সমস্ত বাধার মোকাবিলা করে, এমনকি শেষ পর্যন্ত যখন প্রাণ উৎসর্গ করার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন নির্দ্বিধায় এগিয়ে যায়৷ এর নাম ‘জিহাদ’ আর আল্লাহর পথে জিহাদ হচ্ছেঃ এ সবকিছু একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করতে হবে৷ এই দুনিয়ায় একমাত্র আল্লাহর দীন তথা আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান প্রতিষ্ঠিত হবে এবং আল্লাহর বানী ও বিধান দুনিয়ায়া সমস্ত মতবাদ, চিন্তা ও বিধানের ওপর বিজয় লাভ করবে৷ মুজাহিদের সামনে এ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য ও লক্ষ থাকবে না৷

শর’য়ী পরিভাষায় – কাফের, সীমালংঘনকারী অথবা মুরতাদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের যুদ্ধের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকে জিহাদ বলে। কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য বর্ণনায় জিহাদের অসাধারণ ফযিলতের কথা বিধৃত হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন জিহাদকে একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, মারে ও মরে। তাওরাত, ইনজীল ও কুরআনে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি রয়েছে। নিজ প্রতিজ্ঞা পালনে আল্লাহর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কে আছে? তোমরা যে সওদা করেছ সে সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং ওটাই তো মহাসাফল্য।” [সূরা আত-তাওবাঃ ১১১]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদকে ইসলামের সর্বোচ্চ শিখর হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেনঃ ‘সকল কিছুর মূল হলো ইসলাম। যার খুঁটি হলো সালাত এবং সর্বোচ্চ শিখর জিহাদ। [তিরমিযীঃ ২৬১৬] জিহাদের তুলনা অন্য কিছু দ্বারা হয় না।               আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে এমন একটি আমলের কথা বলে দিন যা জিহাদের পরিপূরক হতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেনঃ ‘আমি পাইনি। [বুখারীঃ ২৮১৮]                                                                                                            এছাড়া আল্লাহর পথে যারা জিহাদ করবে, তাদেরও অসংখ্য মর্যাদার কথা ঘোষিত রয়েছে কুরআন ও হাদীসে। যেমন, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ “আর আল্লাহর পথে যারা নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না”। [সূরা আল বাকারাহঃ ১৫৪]                                                                                                                             অপর হাদীসে এসেছে, জিহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণকারীরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-এর সম্মানীত মেহমান। মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, ‘শহীদদের ছয়টি মর্যাদা রয়েছে – (১) রক্তের প্রথম ফোটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই তাকে মাফ করে দেয়া হয়। (২) জান্নাতে তার অবস্থানস্থল দেখিয়ে দেয়া হয়। (৩) কবরের আযাব থেকে মুক্ত থাকবে এবং মহা শংকার দিনে শংকামুক্ত থাকবে। (৪) তাকে ঈমানের অলংকার পরানো হবে। (৫) জান্নাতের হুর তাকে বিয়ে করানো হবে। (৬) তার নিকটাত্মীয়দের থেকে সত্তর জনের জন্য সুপারিশ করার সুযোগ দেয়া হবে। [বুখারীঃ ২৭৯০]

আলোচ্য আয়াত দ্বারা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক মুসলিমের উপর সব সময়ই জিহাদ ফরয। তবে কুরআনের কোন কোন আয়াত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসের বর্ণনাতে বোঝা যায় যে, জিহাদের এ ফরয, ফরযে-“আইনরূপে প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয সাব্যস্ত হয় না, বরং এটা ফরযে কেফায়া। যদি মুসলিমদের কোন দল তা আদায় করে, তবে সমস্ত মুসলিমই এ দায়িত্ব থেকে রেহাই পায়। তবে যদি কোন দেশে বা কোন যুগে কোন দলই জিহাদের ফরয আদায় না করে, তবে ঐ দেশের বা ঐ যুগের সমস্ত মুসলিমই ফরয থেকে বিমুখতার দায়ে পাপী হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “আমাকে প্রেরণের পর থেকে কেয়ামত পর্যন্ত জিহাদ চলতে থাকবে, আমার উম্মতের সর্বশেষ দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে। [আবু দাউদঃ ২৫৩২]

কুরআনের অন্য এক আয়াতে এরশাদ হয়েছেঃ “আল্লাহ্ তা’আলা জান ও মালের দ্বারা জিহাদকারীগণকে জিহাদ বর্জনকারীদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন এবং উভয়কে পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন”। [সূরা আন-নিসাঃ ৯৫] সুতরাং যেসব ব্যক্তি কোন অসুবিধার জন্যে বা অন্য কোন দ্বীনী খেদমতে নিয়োজিত থাকার কারণে জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে পারে নি, তাদেরকে আল্লাহ তা’আলা পুরস্কার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, জিহাদ যদি ফরযে-আইন হতো, তবে তা বর্জনকারীদের সুফল দানের কথা বলা হত না।

তাছাড়া হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিহাদে অংশ গ্রহণ করার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, তোমার পিতা-মাতা কি বেঁচে আছেন? উত্তরে সে বলল, জি, বেঁচে আছেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উপদেশ দিলেনঃ তুমি পিতা-মাতার খেদমত করেই জিহাদের সওয়াব হাসিল কর। [মুসলিমঃ ২৫৪৯] এতেও বোঝা যায় যে, জিহাদ ফরযে-কেফায়া। যখন মুসলিমদের একটি দল ফরয আদায় করে, তখন অন্যান্য মুসলিম অন্য খেদমতে নিয়োজিত হতে পারে। তবে যদি মুসলিমদের নেতা প্রয়োজনে সবাইকে জিহাদে অংশ গ্রহণ করার আহবান করেন, তখন জিহাদ ফরযে-আইনে পরিণত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমের এরশাদ হয়েছেঃ “হে মুমিনগণ! তোমাদের কি হয়েছে যে, যখন তোমাদেরকে বলা হয়, তোমরা আল্লাহর পথে বেরিয়ে যাও, তখনই তোমরা ভারাক্রান্ত হয়ে যমীনে ঝুঁকে পড়”। [সূরা আত-তাওবাঃ ৩৮] এ আয়াতে আল্লাহর পথে বেরিয়ে পড়ার সার্বজনীন নির্দেশ ব্যক্ত হয়েছে।

এমনিভাবে আল্লাহ না করুন, যদি কোন ইসলামী দেশ অমুসলিম দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং সে দেশের লোকের পক্ষে এ আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব না হয়, তবে পাশ্ববর্তী মুসলিম দেশবাসীর উপরও সে ফরয আপতিত হয়। তারাও যদি প্রতিহত করতে না পারে, তবে এর নিকটবর্তী মুসলিম দেশের উপর, এমনি সারা বিশ্বের প্রতিটি মুসলিমের উপর এ ফরয পরিব্যপ্ত হয় এবং ফরযে-আইন হয়ে যায়। কুরআনের আলোচ্য আয়াতসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, জিহাদ স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণভাবে ফরযে-কেফায়া। আর যতক্ষণ পর্যন্ত জিহাদ ফরযে-কেফায়া পর্যায়ে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তানদের পক্ষে পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত জিহাদে অংশ গ্রহণ করা জায়েয নয়। কিংবা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির পক্ষে ঋণ পরিশোধ করার পূর্ব পর্যন্ত এ ফরযে কেফায়াতে অংশ গ্রহণ করা জায়েয নয়। আর যখন এ জিহাদ প্রয়োজনের তাকীদে ফরযে-আইনে পরিণত হয়, তখন পিতা-মাতা, স্বামী বা স্ত্রী ঋণদাতা কারোরই অনুমতির অপেক্ষা রাখে না।

২:২১৯ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِؕ قُلۡ فِیۡهِمَاۤ اِثۡمٌ کَبِیۡرٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ ۫ وَ اِثۡمُهُمَاۤ اَکۡبَرُ مِنۡ نَّفۡعِهِمَا ؕ وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ مَا ذَا یُنۡفِقُوۡنَ ۬ؕ قُلِ الۡعَفۡوَؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَکُمُ الۡاٰیٰتِ لَعَلَّکُمۡ تَتَفَکَّرُوۡنَ ﴿

২১৯. লোকেরা আপনাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বলুন, দু’টোর মধ্যেই আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও; আর এ দু’টোর পাপ উপকারের চাইতে অনেক বড়। আর তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে কি তারা ব্যয় করবে? বলুন যা উদ্ধৃত। এভাবে আল্লাহ্‌ তার আয়াতসমূহ তোমাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তোমরা চিন্তা কর।

রাসূলুল্লাহ (সা) বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা ওমরের যবানে ও হৃদয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন (তিরমিযী হা/৩৬৮২, হাদীছ ছহীহ)। এক্ষণে ৬টি বিষয়ে ওমর (রাঃ)-এর প্রস্তাবের সমর্থনে কুরআনে আয়াত নাযিল হয়েছে, যা ছহীহ হাদীছ সমূহ দ্বারা প্রমাণিত। যেমন

  (১) বদর যুদ্ধের ৭০ জন বন্দীর ব্যাপারে ওমর (রাঃ)-এর পরামর্শ ছিল তাদেরকে হত্যা করা। পরে তাঁর মতের সমর্থনে আল্লাহ সূরা আনফালের ৬৭-৬৯ আয়াত নাযিল করেন (মুসলিম হা/১৭৬৩)।                               (২) মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (ছাঃ) যখন মাকামে ইবরাহীমের কাছে দাঁড়ালেন, তখন ওমর (রাঃ) তাঁকে বলেন, আমরা কি মাক্বামে ইবরাহীমকে ছালাতের স্থান বানিয়ে নিতে পারি না?… তখন সূরা বাক্বারার ১২৫ আয়াতটি নাযিল হয়।

(৩) একদা তিনি রাসূল (সা)-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার স্ত্রীগণের নিকট ভালো-মন্দ সব ধরনের লোক প্রবেশ করে। অতএব আপনি যদি তাদেরকে পর্দা করার নির্দেশ দিতেন!… এরপর উম্মাহাতুল মুমিনীনদের পর্দা ফরয করে সূরা আহযাবের ৫৩ আয়াতটি নাযিল হয়।                                                                                                                                                                                                                                                 (৪) হাফছার রা নিকটে রাসূল (সা)-এর মধু খাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্ত্রীগণের মাঝে পরস্পরে হিংসার ঘটনা ঘটলে তিনি তাদেরকে তালাক দেয়ার ধমকি দেন। অতঃপর তাঁর সমর্থনে সূরা তাহরীমের ৫ আয়াতটি নাযিল হয় (বুখারী হা/৪০২, মুসলিম হা/২৩৯৯, মিশকাত হা/৬০৪২)।                                                                                                                                                                                                                                                (৫) ওমর (রাঃ) মুনাফিক  নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের জানাযার ছালাতে বাধা দেওয়ার পরেও রাসূল (সা) তা আদায় করেন। তখন আল্লাহ ওমরের সমর্থনে সূরা তাওবার ৮৪ আয়াতটি নাযিল করেন এবং মুনাফিকদের জানাযায় অংশগ্রহণে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন (বুখারী হা/১৩৬৬, তিরমিযী হা/৩০৯৭)।                                                                                                                                                                                    (৬) ওমর (রাঃ)-এর আকাংখা মাফিক আল্লাহ তা‘আলা মদ নিষিদ্ধের আয়াত নাযিল করেন (আবুদাউদ হা/৩৬৭০; তিরমিযী হা/৫৫৪০; নাসাঈ হা/৩০৪৯)।

ইসলামের প্রথম যুগের জাহেলিয়াত আমলের সাধারণ রীতি-নীতির মধ্যে মদ্যপান স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরতের পরও মদীনাবাসীদের মধ্যে মদ্যপান ও জুয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষ এ দুটি বস্তুর শুধু বাহ্যিক উপকারিতার প্রতি লক্ষ্য করেই এতে মত্ত ছিল। কিন্তু এদের অন্তর্নিহিত অকল্যাণ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। তবে আল্লাহর নিয়ম হচ্ছে এই যে, প্রত্যেক জাতি ও প্রত্যেক অঞ্চলে কিছু বুদ্ধিমান ব্যক্তিও থাকেন যারা বিবেক-বুদ্ধিকে অভ্যাসের ঊর্ধ্বে স্থান দেন। যদি কোন অভ্যাস বুদ্ধি বা যুক্তির পরিপন্থী হয়, তবে সে অভ্যাসের ধারে-কাছেও তারা যান না। এ ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্থান ছিল সবচেয়ে ঊর্ধ্বে। কেননা, যেসব বস্তু কোন কালে হারাম হবে, এমন সব বস্তুর প্রতিও তার অন্তরে একটা সহজাত ঘৃণাবোধ ছিল। সাহাবীগণের মধ্যেও এমন কিছুসংখ্যক লোক ছিলেন, যারা হারাম ঘোষিত হওয়ার পূর্বেও মদ্যপান তো দূরের কথা, তা স্পর্শও করেননি। মদীনায় পৌছার পর কতিপয় সাহাবী এসব বিষয়ের অকল্যাণগুলো অনুভব করলেন।

এই পরিপ্রেক্ষিতে উমর, মুআয ইবনে জাবাল এবং কিছুসংখ্যক আনসার রাদিয়াল্লাহু আনহুম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেনঃ মদ ও জুয়া মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে ফেলে এবং ধন-সম্পদও ধ্বংস করে দেয়। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি? এ প্রশ্নের উত্তরেই আলোচ্য আয়াতটি নাযিল হয়। [আবু দাউদ: ৩৬৭০, তিরমিযী: ৩০৪৯, মুসনাদে আহমাদ: ১/৫৩]

এ হচ্ছে প্রথম আয়াত যা মুসলিমদেরকে মদ ও জুয়া থেকে দূরে রাখার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নাযিল হয়েছে। আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, মদ ও জুয়াতে যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিছু উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু দুটির মাধ্যমেই অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত হয়; যা এর উপকারিতার তুলনায় অনেক বড় ও ক্ষতিকর। পাপ অর্থে এখানে সেসব বিষয়ও বোঝানো হয়েছে, যা পাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, মদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দোষ হচ্ছে এই যে, এতে মানুষের সবচাইতে বড় গুণ, বুদ্ধি-বিবেচনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ, বুদ্ধি এমন একটি গুণ যা মানুষকে মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে৷ পক্ষান্তরে যখন তা থাকে না, তখন প্রতিটি মন্দ কাজের পথই সুগম হয়ে যায়। [মা’আরিফুল কুরআন]

এ আয়াতে পরিস্কারভাবে মদকে হারাম করা হয়নি, কিন্তু এর অনিষ্ট ও অকল্যাণের দিকগুলোকে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে, মদ্য পানের দরুন মানুষ অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। বলতে গেলে আয়াতটিতে মদ্যপান ত্যাগ করার জন্য এক প্রকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সুতরাং এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর কোন কোন সাহাবী এ পরামর্শ গ্রহণ করে তৎক্ষণাৎ মদ্যপান ত্যাগ করেছেন। আবার কেউ কেউ মনে করেছেন, এ আয়াতে মদকে তো হারাম করা হয়নি, বরং এটা দ্বীনের পক্ষে ক্ষতির কাজে ধাবিত করে বিধায় একে পাপের কারণ বলে স্থির করা হয়েছে, যাতে ফেত্নায় পড়তে না হয়, সে জন্য পূর্ব থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সূরার আন-নিসা এর ৪৩ নং আয়াতে মদপানের সময় সীমিত করা হয়। সবশেষে সূরা আল-মায়িদাহ এর ৯০ নং আয়াতের মাধ্যমে মদকে চিরতরে হারাম করা হয়। এ বিষয়ে আরও আলোচনা সূরা আল-মায়িদাহ এর ৯০ নং আয়াতে করা হবে।

আয়াতে উল্লেখিত ميسر শব্দটির অর্থ বন্টন করা, ياسر বলা হয় বন্টনকারীকে। জাহেলিয়াত আমলে নানা রকম জুয়ার প্রচলন ছিল। তন্মধ্যে এক প্রকার জুয়া ছিল এই যে, উট জবাই করে তার অংশ বন্টন করতে গিয়ে জুয়ার আশ্রয় নেয়া হত। কেউ একাধিক অংশ পেত আবার কেউ বঞ্চিত হত। বঞ্চিত ব্যক্তিকে উটের পূর্ণ মূল্য দিতে হত, আর গোশত দরিদ্রের মধ্যে বন্টন করা হত; নিজেরা ব্যবহার করত না। এ বিশেষ ধরনের জুয়ায় যেহেতু দরিদ্রের উপকার ছিল এবং খেলোয়াড়দের দানশীলতা প্রকাশ পেত, তাই এ খেলাতে গর্ববোধ করা হত। আর যারা এ খেলায় অংশগ্রহণ না করত, তাদেরকে কৃপণ ও হতভাগ্য বলে মনে করা হত। বন্টনের সাথে সম্পর্কের কারণেই এরূপ জুয়াকে ‘মাইসির’ বলা হত। [তাফসীরে কুরতুবী: ৩/৪৪২-৪৪৩]

সমস্ত সাহাবী ও তাবেয়ীগণ এ ব্যাপারে একমত যে, সব রকমের জুয়াই ‘মাইসির’ শব্দের অন্তর্ভুক্ত এবং হারাম। ইবনে কাসীর তার তাফসীরে এবং জাসসাস আহকামুল-কুরআনে লিখেছেন যে, মুফাসসিরে কুরআন ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, কাতাদাহ, মু’আবিয়া ইবনে সালেহ, আতা ও তাউস রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেছেনঃ সব রকমের জুয়াই ‘মাইসির’ এমনকি কাঠের গুটি এবং আখরোট দ্বারা বাচ্চাদের এ ধরনের খেলাও। ইবনে আব্বাস বলেছেনঃ লটারীও জুয়ারই অন্তর্ভুক্ত। জাসসাস ও ইবনে সিরীন বলেছেনঃ যে কাজে লটারীর ব্যবস্থা রয়েছে, তাও ‘মাইসির’ এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, লটারীর মাধ্যমে কেউ কেউ প্রচুর সম্পদ পেয়ে যায় অপরদিকে অনেকে কিছুই পায় না। আজকাল প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের লটারীর সাথে এর তুলনা করা যেতে পারে। এসবই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত ও হারাম। মোটকথা, ‘মাইসির’ ও কেমারের সঠিক সংজ্ঞা এই যে, যে ব্যাপারে কোন মালের মালিকানায় এমন সব শর্ত আরোপিত হয়, যাতে মালিক হওয়া না হওয়া উভয় সম্ভাবনাই সমান থাকে। আর এরই ফলে পূর্ণ লাভ কিংবা পূর্ণ লোকসান উভয় দিকই বজায় থাকবে। [ইবনে কাসীর]

ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন শব্দে কিমারের(জুয়ার) সংজ্ঞা দিয়েছেন। সাধারণত ফিকাহবিদদের মাঝে কিমারের যে সংজ্ঞাটি বেশি প্রসিদ্ধ, তা হলো।-‘‘উভয় পক্ষ থেকে মালিকানাকে সম্পদ এবং ঝুঁকির মাঝে ঝুলন্ত রাখা’’। জুয়ার সার্বাধিক সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন তাফসীরে মাআরিফুল

কুরআনের গ্রন্থকার হযরত মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ.-

তিনি বলেন,‘‘মাইসির এবং কিমারের সংজ্ঞা হলো, যে ব্যাপারে কোনো মালের মালিকানায় এমন সমুদয় শর্ত আরোপিত হয়, যাতে মালিক হওয়া না হওয়া উভয় সম্ভাবনাই সমানভাবে বিদ্যামান থাকে; আর এরই ফলে পূর্ণ লাভ কিংবা পূর্ণ লোকসান উভয় দিকেই বজায় থাকবে। (শামী-৫:৩৫৫ কিতাবুল হাযবী ওয়াল ইবাহা)

এ জন্য সহীহ হাদীসে দাবা ও ছক্কা-পাঞ্জা জাতীয় খেলাকেও হারাম বলা হয়েছে। কেননা, এসবেও অনেক ক্ষেত্রেই টাকা-পয়সার বাজী ধরা হয়ে থাকে। তাস খেলায় যদি টাকা-পয়সার হার-জিত শর্ত থাকে, তবে তাও এর অন্তর্ভুক্ত হবে। বারীদা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি ছক্কা-পাঞ্জা খেলে সে যেন শূকরের গোশত ও রক্তে স্বীয় হাত রঞ্জিত করে’। [মুসলিমঃ ২২৬০]

রাসুল (স:) ইরশাদ করেন –

‘যে ব্যক্তি অপরকে জুয়া খেলার প্রতি আহবান করবে, তার জন্য উচিত কিছু সদকা

করে দেয়া’’। (বুখারী শরীফ) উপরোক্ত হাদীসে রাসূল (স.) জুয়া পরিহার করার প্রতি এতো গুরুত্বারোপ করেছেন যে, শুধু জুয়াকেই হারাম করেননি; বরং জুয়ার ইচ্ছা প্রকাশকেও গুনাহ সাব্যস্ত করেছেন। যে ব্যক্তিঅপরকে জুয়ার প্রতি আহবান করবে,তাকে তার এই গুনাহ‘র’ প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে কিছু সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে মানব মস্তিষ্কের ভেন্ট্রোমিডিয়াল প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স, অর্বিটাল ফ্রন্টাল কর্টেক্স ও ইনসুলা অংশ এই জুয়া খেলার প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে যাঁরা নিয়মিত জুয়া খেলেন তাঁদের মস্তিষ্কের এই অংশগুলিতে অধিক তৎপরতা দেখা যায়। এ ছাড়া মস্তিষ্কে ডোপামাইন নামক এক প্রকার নিউরোট্রান্সমিটার থাকে, যা স্নায়ুসংবেদ পরিবহণ করে। পুরস্কারের প্রতি আসক্তির অনুভূতি তৈরি হয় এই উপাদানটির জন্যই। জুয়ায় আসক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, কোনও কিছু লাভ হওয়ার পর যখন মস্তিষ্কে ডোপামাইন ক্ষরিত হয় তখন তাঁদের উত্তেজনা তৈরির অনুপাত সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি হয়। ফলত তাঁরা সামান্য লাভেই অনেক বেশি উত্তেজিত হন ও পুনরায় আরও বেশি বাজি ধরতে উদ্যত হন।

বর্তমানে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয় তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে বিহেভিয়রাল কগনিটিভ থেরাপি।

প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা থাকে তাই খরচ কর। এতে বোঝা গেল যে, নফল সদাকার বেলায় নিজের প্রয়োজনে অতিরিক্ত যা থাকে তাই ব্যয় করতে হবে। নিজের সন্তানাদিকে কষ্টে ফেলে, তাদের অধিকার হতে বঞ্চিত করে সদাকা করার কোন বিধান নেই। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত, ঋণ পরিশোধ না করে তার পক্ষে নফল সদকা করাও আল্লাহর পছন্দ নয়।

যেসব মৌলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে আমাদের ইসলাম শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় আসীন, আদল ও ভারসাম্য তার অন্যতম। ইসলাম আমাদেরকে ঈমান-আমল থেকে শুরু করে সকল কর্ম ও আচরণে ভারসাম্য শেখায়। দানের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে খরচ না করে সব নিজের হাতে কুক্ষিগত করতে যেমন নিষেধ করা হয়েছে, তেমনি নিজের সকল অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে পরের দিন নিজেকেই হাত পাততে হচ্ছে বা পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে কষ্ট হচ্ছে- এমনটি ইসলাম পছন্দ করে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ لَا تَجْعَلْ یَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلٰی عُنُقِكَ وَ لَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا.

(কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সাথে বেঁধে রেখ না এবং তা সম্পূর্ণরূপে খুলে রেখ না, যদ্দরুন তোমাকে নিন্দাযোগে ও নিঃস্ব হয়ে বসে পড়তে হবে। -সূরা ইসরা (১৭) : ২৯

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় ও জান্নাতী বান্দাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে উল্লেখ করেছেন-

وَ الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَنْفَقُوْا لَمْ یُسْرِفُوْا وَ لَمْ یَقْتُرُوْا وَ كَانَ بَیْنَ ذٰلِكَ قَوَامًا.

আর ব্যয় করার সময় যারা না করে অপব্যয় এবং না করে কার্পণ্য; বরং তা হয় উভয়ের মাঝখানে ভারসাম্যমান। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৫৭

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,

إِن تُبْدُواْ الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِن تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاء فَهُوَ خَيْرٌ لُّكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنكُم مِّن سَيِّئَاتِكُمْ وَاللّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-সদকা কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি গোপনে ফকির-মিসকিনকে দান করে দাও, তবে আরো বেশি উত্তম। আর তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৭১)

গোপন-প্রকাশ্যে যে কোনোভাবে দান করা যায়। সকল দানেই সওয়াব রয়েছে।

বিদায় হজের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থান করছিলেন। সে সময় হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) অসুস্থ ছিলেন। প্রিয় নবী (সা.) তাকে দেখতে গেলেন। প্রচুর সম্পদের অধিকারী হজরত সাদ (রা.) তার সম্পদ সাদকা করার ইচ্ছা পোষণ করলেন। কী পরিমাণ সম্পদ দান-সাদকা করা যাবে? এ হাদিসে তা ফুটে উঠেছে।

সাহাবি হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ছিলেন প্রচুর সম্পদের অধিকারী। তার মৃত্যুর পর একমাত্র কন্যাসন্তান ছাড়া আর কোনো ওয়ারিস ছিল না।নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় সাহাবী হযরত সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রাযিয়াল্লাহু আনহু। দুনিয়াতে থাকতেই বিশেষভাবে যে দশজন সাহাবী জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ লাভ করেছিলেন হযরত সা‘দ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বিদায় হজে¦র সময় তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।  যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে দেখতে গেলেন, তখন তিনি বললেন-

ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আর বাঁচব না। আমার প্রচুর সম্পদ রয়েছে। অথচ আমার একটি মাত্র মেয়ে ছাড়া আমার ওয়ারিস হওয়ার মতো আর কেউ নেই। এ অবস্থায় আমি কি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ দান-সাদকা করতে পারি? রাসূলুল্লাহ (সা.)  বললেন, ‘না’। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তবে আমি কি অর্ধেক দান-সাদকা করে দিতে পারি? এবারও রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- ‘না’। তখন তিনি জানতে চাইলেন, তবে কি এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান-সাদকা করতে পারি? এবার রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- ‘এক-তৃতীয়াংশ সম্পদও তো অনেক।’

তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) যা বললেন, তা উম্মতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নসিহত। তাহলো-

إِنَّكَ أَنْ تَذَرَوَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَخَيْرٌمِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ وَلَسْتَ تُنْفِقُ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ بِهَا حَتّى اللّقْمَةَ تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ

‘সন্দেহ নেই, তোমার ওয়ারিসদের তুমি যদি এমন অভাবীরূপে রেখে যাও, যার ফলে তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এ অবস্থার তুলনায় তাদের তুমি সচ্ছলরূপে রেখে যাওয়া অনেক ভালো। আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় তুমি যা কিছুই ব্যয় করবে, তোমাকে এর প্রতিফলন দেয়া হবে। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লোকমাটি তুলে দাও; সে জন্যও তুমি পুরস্কার (প্রতিদান) পাবে।’ (বুখারি)

প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, কখন দান করা উত্তম? তিনি ইরশাদ করলেন-

أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ شَحِيحٌ، أَوْ صَحِيحٌ، تَأْمُلُ الْعَيْشَ، وَتَخْشَى الْفَقْرَ، وَلَا تُمْهِلْ حَتَّى إِذَا كَانَتْ بِالْحُلْقُومِ، قُلْتَ: لِفُلَانٍ كَذَا، وَلِفُلَانٍ كَذَا، وَقَدْ كَانَ.

যখন তুমি (অতি প্রয়োজন বা লোভের কারণে) মাত্রাতিরিক্ত মিতব্যয়ী বা হাড়কিপটে হও এবং সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশংকা কর, অথবা যখন তুমি সুস্থাবস্থায় দীর্ঘায়ুর প্রত্যাশা কর তখন সদকা করা। এত দেরি করো না যে, মৃত্যু এসে যায় আর তখন তুমি (ওসিয়ত করে) বলছ- আমার সম্পদগুলো অমুকের জন্য, অমুকের জন্য! অথচ (তুমি না বললেও) তা তাদের জন্য হয়েই আছে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৭৬৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৭০৬

ইসলামের দৃষ্টিতে দান করতে হয় নিজের প্রয়োজনে। দানের মাধ্যমে গ্রহীতার প্রতি অনুগ্রহ করা হচ্ছে- এমনটি নয় কখনো; বরং তার প্রাপ্য ও অধিকারটাই তাকে বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

وَ الَّذِیْنَ فِیْۤ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ مَّعْلُوْمٌ لِّلسَّآىِٕلِ وَ الْمَحْرُوْمِ.

আর যাদের সম্পদে নির্ধারিত ‘হক’ (অধিকার) রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের। -সূরা মাআরিজ (৭০) : ২৪-২৫

অর্থাৎ কুরআনে কারীমে একে তাদের ‘হক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

২:২২০ فِی الدُّنۡیَا وَ الۡاٰخِرَۃِ ؕ وَ یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡیَتٰمٰی ؕ قُلۡ اِصۡلَاحٌ لَّهُمۡ خَیۡرٌ ؕ وَ اِنۡ تُخَالِطُوۡهُمۡ فَاِخۡوَانُکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ الۡمُفۡسِدَ مِنَ الۡمُصۡلِحِ ؕ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰهُ لَاَعۡنَتَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ ﴿

২২০. দুনিয়া এবং আখেরাতের ব্যাপারে। আর লোকেরা আপনাকে ইয়াতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে; বলুন, তাদের জন্য সুব্যবস্থা করা উত্তম। তোমরা যদি তাদের সাথে একত্রে থাক তবে তারা তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ জানেন কে উপকারকারী এবং কে অনিষ্টকারী। আর আল্লাহ ইচ্ছে করলে এ বিষয়ে তোমাদেরকে অবশ্যই কষ্টে ফেলতে পারতেন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ প্রবল পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।

 

ইবনে আব্বাস বলেন, যখন “তোমরা উত্তম পদ্ধতি ব্যতীত ইয়াতিমের সম্পদের কাছেও যেও না” [সূরা আল-আনআমঃ ১৫২, আল-ইসরা: ৩৪] নাযিল হল তখন অনেকেই ইয়াতিমদের থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখে। ফলে ইয়াতিমরা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন এ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ তা’আলা ইয়াতিমদের সাথে কিভাবে চলতে হবে তা জানিয়ে দেন। [আবু দাউদ: ২৮৭১]

এতিমদের জন্য সুব্যবস্থা না করলে, তাদের দায়িত্ব না নিলে কী ভয়াবহ পরিণাম হয় তা আমরা আজকে খবরের কাগজ খুললেই দেখতে পাই। একদল অসাধু পশু এতিমদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের অঙ্গ বিক্রি করে পঙ্গু করে দেয়। আরেকদিকে অসাধু কিছু নেতা এতিমদের ধরে নিয়ে গিয়ে ট্রেনিং দিয়ে ক্যাডার, মস্তান, খুনি বানিয়ে ফেলে। আরেকদল অসাধু নেতা এতিমদের মগজ ধোলাই করে তাদেরকে ইসলামি সন্ত্রাসী শিখিয়ে কোপাকুপির জন্য ব্যবহার করে। যেই এতিমদেরকে আমাদের জনশক্তি বানানোর কথা, সেই এতিমরা হয়ে যায় জনশত্রু।

আল্লাহ تعالى আমাদেরকে এতিমদের সাথে إِصْلَاح ইসলাহ করতে বলেছেন। ইসলাহ অর্থ ভুল জিনিসকে ঠিক করা, ভেঙ্গে পড়া কিছুকে আবার জোড়া লাগানো, দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।[৫] যারা ইসলাহ করে, তারা হচ্ছেন মুসলিহুন مُصْلِحُونَ — আল্লাহর تعالى দৃষ্টিতে উঁচু পর্যায়ের সম্মানের অধিকারী, জান্নাতে যাওয়ার যোগ্য মানুষ।

প্রশ্ন: কুরআনে আল্লাহ তাআলা এতিম ও মিসকিনদেরকে খাদ্যদান এর কথা বলেছেন। প্রশ্ন হল, এতিম-মিসকিন কারা? তাদেরকে খাদ্য খাওয়ানোর মর্যাদা কতটুকু?

উত্তর: আল্লাহ তাআলা বলেন:   وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا

“তারা আল্লাহর ভালবাসায় অভাবগ্রস্ত, এতীম ও বন্দীকে খাবার দেয়।” (সূরা ইনসান/দাহর: ৮)                                                                                                                                                                                                              এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, জান্নাতবাসী লোকদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে, তারা অভাবী, অনাথ-এতিম শিশু ও বন্দিদেরকে খাবার দান করে (চাই সে মুসলিম হোক বা অমুসলিম হোক।)

▪ এতীম (অনাথ) বলা হয় ঐ শিশুকে, যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক অবস্থায় তার পিতাকে হারিয়েছে।

আপনি আপনার চারপাশে অনুসন্ধান করলে বা এতিমখানা/অরফেন সেন্টারগুলোতে খোঁজ নিলে অনেক এতিম শিশুর সন্ধান পাবেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিলবে অসংখ্য পিতৃহারা এতিম শিশু। কত অসহায় শিশু তাদের পিতৃ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে সমাজে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সহ্য করে বড় হচ্ছে। কত নারী স্বামী হারিয়ে তার এতিম সন্তানকে বুকে নিয়ে অমানবিক পরিস্থিতিতে জীবনের ঘানি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যাদের একটু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা প্রয়োজন। প্রয়োজন সঠিক শিক্ষার। এদের দায়িত্ব নেয়া অনেক মর্যাদাপূর্ণ কাজ, অনেক সওয়াবের কাজ। এ মর্মে কুরআন ও হাদিস পর্যাপ্ত বক্তব্য এসেছে।                                                                                                      আখিরাতে এতিম প্রতিপালনকারীদের মর্যাদা অপরিসীম। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضي الله عنه قَالَ :قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَافِلُ الْيَتِيمِ لَهُ أَوْ لِغَيْرِهِ أَنَا وَهُوَ كَهَاتَيْنِ فِي الْجَنَّةِ وَأَشَارَ مَالِكٌ بِالسَّبَّابَةِ وَالْوُسْطَى. رواه مسلم

আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আমি ও এতিম প্রতিপালনকারীর অবস্থান জান্নাতে এই দুই অঙ্গুলির ন্যায় পাশাপাশি হবে। চাই সেই এতিম তার নিজের হোক অথবা অন্যের। (বর্ণনাকারী) মালিক বিন আনাস রা. তর্জনী ও মধ্যমা অঙ্গুলি দ্বারা ইশারা করলেন। ( সহিহ মুসলিম) সুতরাং যে ব্যক্তি জান্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথী হতে চায় সে যেন এতিম শিশুদের দেখাশোনা ও প্রতিপালনের যত্নশীল হয়।                                                                                                                                                                                                                                                                          ▪ মিসকিন বলা ঐ সকল অভাবী লোকদেরকে যাদের উপার্জন তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। সব সময় অভাব-অনটনে ডুবে থাকে এবং আর্থিক সঙ্কটে বহু কষ্টে জীবন যাবন করে।                                                                       আর আমাদের সমাজে ফকির-মিসকিন তথা সহায়-সম্বলহীন দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত মানুষের অভাব নাই। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এদেরকে খাদ্য দান করা জান্নাত লাভের অন্যতম সহজ উপায়। আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি,

يَا أيُّهَا النَّاسُ أَفْشُوا السَّلاَمَ وَأطْعِمُوا الطَّعَامَ وَصِلُوا الأرْحَامَ وَصَلُّوا والنَّاسُ نِيَامٌ تَدْخُلُوا الجَنَّةَ بِسَلاَمرواه الترمذي وقالحديث حَسَنٌ صَحِيْحٌ

“হে লোকেরা, তোমরা সালাম সম্প্রসারণ কর, খাদ্য খাওয়াও, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ এবং মানুষ যখন (রাতে) ঘুমিয়ে থাকে, তখন তোমরা (তাহাজ্জুদের) নামায পড়। তাহলে তোমরা নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিযী ২৪৮৫, ইবনে মাজাহ ১৩৩৪, ৩২৫১, হাকিম ৪২৮৩, সহীহ তারগীব ৬১০ নং) আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন। আসুন আমরা এতিম ও মিসকিনদেরকে খাদ্যদান করি। আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল মাদানী

দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব

যদি তাদের সাথে একসাথে থাকো, তাহলে তারা তোমাদের ভাইবোন

আমাদের কারো উপর যদি দায়িত্ব পড়ে এতিমদের দেখাশুনা করার, তাহলে তাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম, থাকা, খাওয়া ইত্যাদি আমাদের পরিবারের সাথে একসাথে হলে, তাদেরকে আমাদের ভাইবোন হিসেবে দেখতে হবে। তারা উত্তরাধিকার হিসেবে যে সম্পত্তি নিয়ে আসবে, সেটা আমাদের সম্পত্তির সাথে মিশে যেতে পারে। বিশেষ করে এতিমদের খরচ যোগাতে তাদের নিজেদের সম্পত্তি ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে। তখন অনেক সময় কু’রআনে এতিমদের সম্পত্তির উপর অন্যায়ভাবে হাত না দেওয়া কঠিন নির্দেশগুলো পড়ে ভয় পেয়ে, অনেকেই এতিমদের আলাদা করে রাখেন। নিজের পরিবারের মধ্যে এতিমদেরকে আনতে চান না। এক্ষেত্রে আল্লাহ تعالى আমাদেরকে মধ্যমপস্থা নিতে বলেছেন। আল্লাহ تعالى আমাদেরকে বলছেন, তারা যদি আমাদের নিজেদের ভাইবোন হতো, তাহলে আমরা যা করতাম, সেটাই করবো। আল্লাহ تعالى জানেন কে ইচ্ছা করে খারাপ কাজ করে, আর কার ভুল হয়ে যায়।

{وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ۖ وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ ۖ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا ۖ وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَىٰ ۖ وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ}

“ আর তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের নিকটবর্তী হয়ো না, সুন্দর পন্থা ছাড়া। যতক্ষণ না সে পরিণত বয়সে উপনীত হয়, আর পরিমাপ ও ওযন ইনসাফের সাথে পরিপূর্ণ দেবে। আমি কাউকে তার সাধ্য ছাড়া দায়িত্ব অর্পণ করি না। আর যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ইনসাফ কর, যদিও সে আত্মীয় হয় এবং আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ কর। এগুলো তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।[ সুরা – আন’আম ০৬/১৫২ ]

  • এ আয়াতে যা বলা হয়েছে – এতীম সাবালক না হওয়া পর্যন্ত ইনসাফ ভিওিক উওম পন্থায় তার সম্পদ খরচ করা যাবে। কিন্তু! সাবালক হওয়ার সংঙ্গে সংঙ্গেই তার মাল তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। অবশ্য সে যদি নির্বোধ হয় বা এমন জ্ঞান না থাকে যাতে সে তার মাল সংরক্ষণ করতে পারবে না তাহলে আগের অবস্থান মাল ব্যবহার করতে পারবে।

– আল্লাহ্ তায়ালা অন্য আয়াতে বলেন

{وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُ ۚ وَأَوْفُوا بِالْعَهْدِ ۖ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْئُولًا}

“ আর তোমরা ইয়াতীমের সম্পদের কাছে যেয়ো না! সুন্দরতম পন্থা * ছাড়া, যতক্ষণ না সে বয়সের পূর্ণতায় উপনীত হয়। আর অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।( অর্থাৎ তার সম্পদ বৃদ্ধি, তার নিজের খরচ এবং দরিদ্র হলে বেতন গ্রহণ বৈধ। )” সুরা – ইসরাঃ৩৪

  • অর্থাৎ – ইয়াতিমের মাল ভোগ করার জন্য যাওয়া যাবে না ! তা সংরক্ষণের জন্য যেতে হবে। বালেগ হওয়া পর্যন্ত এটা করা যাবে। আল্লাহর হুকুম ও মানুষের পারস্পরিক প্রতিজ্ঞা সবই ওয়াদা (আহদ) এর অন্তর্গত। এগুলো ঠিকভাবে করতে হবে। এতীমের মাল ভক্ষণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

মহান আল্লাহ বলেছেন

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ أَمۡوَٰلَ ٱلۡيَتَٰمَىٰ ظُلۡمًا إِنَّمَا يَأۡكُلُونَ فِي بُطُونِهِمۡ نَارٗاۖ وَسَيَصۡلَوۡنَ سَعِيرٗا ١٠ ﴾ [النساء : ١٠]

অর্থাৎ নিশ্চয় যারা পিতৃহীন [এতীম]দের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে, তারা আসলে নিজেদের উদরে অগ্নি ভক্ষণ করে। আর অচিরেই তারা জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে।(সূরা নিসাঃ ১০ আয়াত)

– আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘তোমরা সাত প্রকার ধ্বংসাত্মক কর্ম থেকে দূরে থাক। লোকেরা বলল, ‘সেগুলো কি কি? হে আল্লাহর রাসূল!’ তিনি বললেন, • ‘‘আল্লাহর সাথে শিরক করা। • যাদু করা। • অন্যায়ভাবে এমন জীবন হত্যা করা, যাকে আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন। • সুদ খাওয়া। • এতীমের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করা।• ধর্মযুদ্ধ কালীন সময়ে [রণক্ষেত্র] থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করা।• সতী-সাধ্বী উদাসীনা মুমিন নারীদের চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক আরোপ করা।’’ (বুখারী ও মুসলিম) সহীহুল বুখারী ২৭৬৭, ২৭৬৬, ৫৭৬৪, ৬৮৫৭, মুসলিম ৮৯, নাসায়ী ৩৬৭১, আবূ দাউদ ২৮৭৪ রিয়াযুস স্বা লিহীন ১৬২২ হাদিসের মানঃ সহিহ.

– অনাথ-এতীম, কন্যা-সন্তান ও সমস্ত দুর্বল ও দরিদ্রের সঙ্গে নম্রতা, তাদের প্রতি দয়া ও তাদের সঙ্গে বিনম্র ব্যবহার করার গুরুত্ব।

– আবূ শুরাইহ্ খুওয়াইলিদ ইবনু ‘আমর খুযা‘য়ী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘হে আল্লাহ! আমি লোকদেরকে দুই শ্রেণীর দুর্বল মানুষের অধিকার সম্বন্ধে পাপাচারিতার ভীতিপ্রদর্শন করছি; এতীম ও নারী। (নাসায়ী, উত্তম সূত্রে)  ইবনু মাজাহ ৩৬৭৮, আহমাদ ৯৩৭৪ রিয়াযুস স্বা-লিহীন ২৭৫ হাদিসের মানঃ হাসান

আল্লাহ تعالى জানেন কে অনিষ্টকারী, আর কে উপকারী

আল্লাহ تعالى জানেন কে مُفْسِد মুফসিদ অর্থাৎ ফাসাদ করে, আর কে মুসলিহ অর্থাৎ ইসলাহ করে। ফাসাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ এবং কু’রআনে ৫০ বার এই শব্দটি বিভিন্ন রূপে পাবেন। এর অর্থ ব্যাপক[৫]—

১) দুর্নীতি, ক্ষয়ক্ষতি করা: যেমন, এতিমের সম্পত্তি নিজের নামে লিখে নেওয়া। অনেক সময় এতিমদেরকে ভয় দেখিয়ে, বা তাদেরকে না জানিয়ে তাদের সম্পত্তি দখল করা।

২) অপকার, অনিষ্ট করা: যেমন, এতিমের জমি আছে দেখে হিংসায় জ্বলে সেই জমি নষ্ট করে ফেলা।

৩) বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা সৃষ্টি: যেমন, কোনো এতিমখানার নামে ইসলামি সন্ত্রাসীর কালিমা লাগিয়ে সেই এতিমখানার পরিচালকদের জীবন কঠিন করে দেওয়া, এতিমদের জন্য ফান্ড বন্ধ করে দেওয়া।

৪) শারীরিক ক্ষতি করা: যেমন, এতিমদের মারধোর করা। এতিমখানায় এতিমদের উপর শারীরিক নির্যাতন করা। তাদের শারীরিক বিকৃতি করা। তাদের অঙ্গ বিক্রি করে দেওয়া।

এক কথায় ফাসাদ হলো, যে কোনো কাজের বা বস্তুর স্বাভাবিকতা নষ্ট করা। ফাসাদের ব্যাপারে আল্লাহর تعالى কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো, ফাসাদ যে সেক্টরে ঢুকে, সেটার স্বাভাবিকতা নষ্ট করে দেয়। শিক্ষাখাতে ফাসাদ ঢুকলে সেখান থেকে মুর্খরা ‘শিক্ষিতের’ তকমা লাগিয়ে বের হয়। বিচারখাতে ফাসাদ ঢুকলে ন্যায়বিচার ব্যহত হয়। নিরাপত্তাবাহিনীতে ফাসাদ ঢুকলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। মিডিয়ায় ফাসাদ ঢুকলে তা জনগণের মেধা-মননের প্রকৃতত্ব নষ্ট করে।

যারা এতিমদের সাথে ফাসাদে লিপ্ত, তারা সাবধান, কারণ—

যদি আল্লাহ تعالى ইচ্ছা করতেন, তাহলে তোমাদের অবস্থা কঠিন করে দিতে পারতেন

এই অংশটি ভয়ঙ্কর। আমরা যখন এতিমদেরকে দেখি, তখন নিজেদেরকে প্রশ্ন করা দরকার: আজকে যদি আমরা তাদের জায়গায় থাকতাম, তাহলে আমার জীবনটা কেমন হতো? আল্লাহ تعالى ইচ্ছা করলেই তাকে এতিম না বানিয়ে, আমাকে এতিম বানিয়ে দিতে পারতেন। তাকে পথে না বসিয়ে আমাকে পথে বসাতে পারতেন। সে যত অন্যায়, দুর্ব্যবহার সহ্য করে বড় হচ্ছে, যত কষ্ট সহ্য করছে, সেই কষ্টগুলো আমিও পেতে পারতাম। তখন আমার কেমন লাগতো? তখন আমি বাবা-মা’কে আর একটিবার দেখতে পাওয়া জন্য, আর একটিবার তাদের স্পর্শের জন্য কতটা হাহাকার করতাম? সারাদিন মানুষের কাছে কষ্ট পেয়ে আমার কি একটু ইচ্ছা করতো না কারো বুকে মাথা রেখে কিছুক্ষণ কাঁদি? আমার কী ইচ্ছা করতো না রাতে বিছানায় একা একা শুয়ে না থেকে, কাউকে জড়িয়ে ধরে একটু ঘুমাই? — আল্লাহ تعالى ইচ্ছা করলে আমার জীবনটাকেও কঠিন করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি করেননি। তার জন্য আমি তাঁকে কতটা কৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছি?

নিঃসন্দেহে তিনি সমস্ত ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের অধিকারী, পরম প্রজ্ঞাবান

এখানে আমরা আল্লাহর تعالى দুটো গুণের কথা জানবো— ১) ٱلْعَزِيز আল-আজিজ, ২) ٱلْحَكِيم আল-হাকিম।

১) ٱلْعَزِيز আল-আজিজ হচ্ছে যার ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দুটোই রয়েছে। কারও অনেক ক্ষমতা থাকতে পারে, কিন্তু তার যদি কোনো কর্তৃত্ব না থাকে, তাহলে সে তার ক্ষমতা কাজে লাগাতে পারবে না যেমন, পুলিশ বাহিনী। তাদের যথেষ্ট ক্ষমতা। কিন্তু তাদের কর্তৃত্ব খুবই কম। একারণে অনেকক্ষেত্রেই তারা কিছুই করতে পারে না।

আবার কারও অনেক কর্তৃত্ব থাকতে পারে, কিন্তু যদি ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সে তার কর্তৃত্ব খাঁটাতে পারবে না। যেমন, কোনো দেশের প্রেসিডেন্ট। তার যথেষ্ট কর্তৃত্ব। কিন্তু তার ক্ষমতা খুবই কম। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী তার বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে কাজ করে যান।

আল্লাহ تعالى হচ্ছেন আল-আজিজ: সমস্ত ক্ষমতা তাঁর এবং সেই ক্ষমতা যখন, যেভাবে খুশি ব্যবহার করার সমস্ত কর্তৃত্ব তাঁর হাতে। কেউ তাঁকে কিছুই বলতে পারে না। তিনি আজকে আপনাকে সকাল বেলা ভরপেট নাস্তা খেয়ে, সারাদিন সুস্থ হয়ে চলাফেরা করে, রাতে নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে দিতে পারেন। আবার কালকেই তিনি আপনাকে দুর্ঘটনায় পঙ্গু করে দিয়ে, হাসপাতালে আইসিইউ-তে রেখে, সারারাত ব্যাথায় চিৎকার করাতে পারেন। সমস্ত ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব তাঁর।

২) ٱلْحَكِيم হাকিম: পরম প্রজ্ঞাবান। আল্লাহ تعالى যখন আমাদের জীবনে কিছু করেন, তিনি তাঁর অসীম প্রজ্ঞা দিয়ে সেটা করেন। সেটা আমরা বুঝতে পারি, আর নাই পারি। হয়তো তিনি تعالى যখন কাউকে কাউকে পথে বসিয়ে দেন, তিনি تعالى সেটা করেন কারণ তিনি تعالى জানেন: যখন সে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে, তখন সে সম্পদের মূল্য বুঝবে, গরিবদের কষ্ট বুঝবে, অহংকার কম করবে, সবসময় শুধু নিজের এবং নিজের পরিবারের কথা না ভেবে আত্মীয়স্বজন, পাড়ার গরিবদের জন্য কিছু করবে।

হয়তো তিনি تعالى যখন কারও আপনজনকে নিয়ে যান, তিনি تعالى জানেন সেই আপনজনকে হারিয়ে সে মানসিকভাবে আরও শক্ত হবে, জীবনযুদ্ধ শক্ত হাতে মোকাবেলা করবে, নিজে জয়ী হবে, অন্যকে জয়ী হতে সাহায্য করবে।   আবার হয়তো তিনি تعالى যখন কাউকে কঠিন অসুখ দিয়ে বিছানায় ফেলে রাখেন, তিনি تعالى জানেন তার এই অসুখ তার পরিবারের মানুষগুলোকে একসাথে করে দেবে। পরিবারের সদস্যরা যে যার মতো দূরে সরে না গিয়ে, আরও কাছাকাছি হবে। একে অন্যকে সান্ত্বনা দেবে। একে অন্যের বিপদে পাশে থাকবে। তাদের বংশধরদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন আরও শক্ত হবে। অসুস্থ মানুষটাকে কেন্দ্র করে পরিবারের দুই-তিন প্রজন্ম একসাথে থাকবে। অসুস্থ মানুষটাকে দেখে তারা নিজেরা নিজেদের সুস্থতার মূল্য বুঝবে, আল্লাহর تعالى প্রতি আরও কৃতজ্ঞ হবে। এই কৃতজ্ঞতা বোধ তাদেরকে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা থেকে মুক্ত রাখবে।

আমরা আল্লাহর تعالى গভীর প্রজ্ঞা এবং পরিকল্পনা না বুঝে, অনেক সময় রেগে গিয়ে তাঁকে দোষ দিয়ে দেই। মনে করি, তিনি আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছেন। আমাদেরকে ভুলে গেছেন। আমাদেরকে কোনো কারণ ছাড়া কষ্টে রাখছেন। আমরা ভুলে যাই: তিনি আল-হাকিম, অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান। তাঁর প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে বিরাট কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি আমাদের জীবনে যা কিছুই করেন, তার সবকিছুই তাঁর মানবজাতিকে নিয়ে মহাপরিকল্পনার অংশ।

১ وَ لَا تَنۡکِحُوا الۡمُشۡرِکٰتِ حَتّٰی یُؤۡمِنَّ ؕ وَ لَاَمَۃٌ مُّؤۡمِنَۃٌ خَیۡرٌ مِّنۡ مُّشۡرِکَۃٍ وَّ لَوۡ اَعۡجَبَتۡکُمۡ ۚ وَ لَا تُنۡکِحُوا الۡمُشۡرِکِیۡنَ حَتّٰی یُؤۡمِنُوۡا ؕ وَ لَعَبۡدٌ مُّؤۡمِنٌ خَیۡرٌ مِّنۡ مُّشۡرِکٍ وَّ لَوۡ اَعۡجَبَکُمۡ ؕ اُولٰٓئِکَ یَدۡعُوۡنَ اِلَی النَّارِ ۚۖ وَ اللّٰهُ یَدۡعُوۡۤا اِلَی الۡجَنَّۃِ وَ الۡمَغۡفِرَۃِ بِاِذۡنِهٖ ۚ وَ یُبَیِّنُ اٰیٰتِهٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَتَذَکَّرُوۡنَ ﴿

২২১. আর মুশরিক নারীকে ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা বিয়ে করো না। মুশরিক নারী তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও অবশ্যই মুমিন কৃতদাসী তার চেয়ে উত্তম। ঈমান না আনা পর্যন্ত মুশরিক পুরুষদের সাথে তোমরা বিয়ে দিও না, মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও অবশ্যই মুমিন ক্রীতদাস তার চেয়ে উত্তম। তারা আগুনের দিকে আহবান করে। আর আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ ইচ্ছায় জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহবান করেন(৩)। আর তিনি মানুষের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তারা শিক্ষা নিতে পারে।

আয়াতে মুশরিক শব্দ দ্বারা সাধারণ অমুসলিমকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, কুরআনুল কারীমের অন্য এক আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, প্রকৃত কিতাবে বিশ্বাসী নারীরা এ আদেশের অন্তর্ভুক্ত নয়। বলা হয়েছে, “তোমাদের আগে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের সচ্চরিত্রা নারী তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো” [সূরা আল-মায়েদাহঃ ৫]।                                                                                                                                        তাই এখানে মুশরিক বলতে ঐ সব বিশেষ অমুসলিমকেই বোঝানো হয়েছে, যারা কোন নবী কিংবা আসমানী কিতাবে বিশ্বাস করে না। আহলে কিতাব ইয়াহুদী ও নাসারা নারীদের সাথে মুসলিম পুরুষদের সম্পর্কের অর্থ হচ্ছে এই যে, যদি তাদেরকে বিবাহ করা হয়, তবে বিবাহ ঠিক হবে এবং স্বামীর পরিচয়েই সন্তানদের বংশ সাব্যস্ত হবে। কিন্তু আল্লাহর কাছে এ বিবাহও পছন্দনীয় নয়।

মুসলিম বিবাহের জন্য দ্বীনদার ও সৎ স্ত্রীর অনুসন্ধান করবে, যাতে করে সে তার দ্বীনী ব্যাপারে সাহায্যকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে করে তাদের সন্তানদেরও দ্বীনদার হওয়ার সুযোগ মিলবে। যখন কোন দ্বীনহীন মুসলিম মেয়ের সাথে বিবাহ পছন্দ করা হয়নি, সে ক্ষেত্রে অমুসলিম মেয়ের সাথে কিভাবে বিবাহ পছন্দ করা হবে? এ কারণেই উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন খবর পেলেন যে, ইরাক ও শাম দেশের মুসলিমদের এমন কিছু স্ত্রী রয়েছে এবং দিন দিন তাদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তখন তিনি ফরমান জারি করলেন যে, তা হতে পারে না। তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হলো যে, এটা বৈবাহিক জীবন তথা দ্বীনী জীবনের জন্য যেমন অকল্যাণকর, তেমনি রাজনৈতিক দিক দিয়েও ক্ষতির কারণ। [তাফসীরে কুরতুবী: ৩/৪৫৬]

বর্তমান যুগের অমুসলিম আহলে কিতাব, ইয়াহুদী ও নাসারা এবং তাদের রাজনৈতিক ধোঁকা-প্রতারণা, বিশেষতঃ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিবাহ এবং মুসলিম সংসারে প্রবেশ করে তাদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করা এবং মুসলিমদের গোপন তথ্য জানার প্রচেষ্টা আজ স্বীকৃত সত্যে পরিণত হয়েছে। ইসলামের খলীফা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সুদূর প্রসারী দৃষ্টিশক্তি বৈবাহিক ব্যাপার সংক্রান্ত এ বিষয়টির সর্বনাশা দিক উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। বিশেষতঃ বর্তমানে পাশ্চাত্যের দেশসমূহে যারা ইয়াহুদী ও নাসারা নামে পরিচিত এবং আদম-শুমারীর খাতায় যাদেরকে দ্বীনী দিক থেকে ইয়াহুদী কিংবা নাসারা বলে লেখা হয়, যদি তাদের প্রকৃত দ্বীনের অনুসন্ধান করা যায়, তবে দেখা যাবে যে, নাসারা ও ইয়াহুদী মতের সাথে তাদের আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। তারা সম্পূর্ণভাবেই দ্বীন বর্জনকারী। তারা ঈসা আলাইহিস সালামকেও মানে না, তাওরাতকেও মানে না, এমনকি আল্লাহর অস্তিত্বও মানে না, আখেরাতও মানে না।

বলাবাহুল্য, বিবাহ হালাল হওয়ার কুরআনী আদেশ এমন সব ব্যক্তিদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে না। তাদের মেয়েদের সাথে বিবাহ সম্পূর্ণই হারাম। সূরা আল-মায়েদাহ এর আয়াতে যাদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়েছে, আজকালকার ইয়াহুদী-নাসারারা তার আওতায় পড়ে না। সে হিসেবে সাধারণ অমুসলিমদের মত তাদের মেয়েদের সাথেও বিবাহ করা হারাম। মানুষ অত্যন্ত ভুল করে যে, খোঁজ-খবর না নিয়েই পাশ্চাত্যের মেয়েদেরকে বিয়ে করে বসে। এমনিভাবে যে গিয়ে পৌছেছে, তার সাথে মুসলিম নারীর বিয়ে জায়েয নয়। আর যদি বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার আকীদা এমনি বিকৃত হয়ে পড়ে তবে তাদের বিয়ে ছিন্ন হয়ে যাবে। আজকাল অনেকেই নিজের দ্বীন সম্পর্কে অন্ধ ও অজ্ঞ এবং সামান্য কিছুটা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করেই স্বীয় দ্বীনের আকীদা নষ্ট করে বসে। কাজেই প্রথমে ছেলের আকীদা সম্পর্কে খোজ-খবর তারপর বিয়ে সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা দেয়া মেয়েদের অভিভাবকদের উপর ওয়াজিব। [মাআরিফুল কুরআন থেকে সংক্ষেপিত]

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কোন মুসলিম অমুসলিম মহিলাকে বিয়ে করতে পারে কিন্তু কোন অমুসলিমের সাথে কোন মুসলিম মহিলাকে বিয়ে দেয়া যাবে না। [তাবারী] যুহরী, কাতাদাহ বলেন, কোন অমুসলিম চাই সে ইয়াহুদী হোক বা নাসারা বা মুশরিক তার কাছে কোন মুসলিম মহিলাকে বিয়ে দেয়া যাবে না। [তাফসীরে আবদুর রাজ্জাক] এ ব্যাপারে উম্মতের ঐক্যমত রয়েছে।

আলোচ্য আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে যে, মুসলিম পুরুষের বিয়ে কাফের নারীর সাথে এবং কাফের পুরুষের বিয়ে মুসলিম নারীর সাথে হতে পারে না। কারণ, কাফের স্ত্রী-পুরুষ মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্ক পরস্পরের ভালবাসা, নির্ভরশীলতা এবং একাত্মতায় পরস্পরকে আকর্ষণ করে। তা ব্যতীত এ সম্পর্কে প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। আর মুশরিকদের সাথে এ জাতীয় সম্পর্কের ফলে ভালবাসা ও নির্ভরশীলতার অপরিহার্য পরিণাম দাঁড়ায় এই যে, তাদের অন্তরে কুফর ও শির্কের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় অথবা কুফর ও শির্কের প্রতি ঘৃণা তাদের অন্তর থেকে উঠে যায়। এর পরিণামে শেষ পর্যন্ত সেও কুফর ও শির্কে জড়িয়ে পড়ে; যার পরিণতি জাহান্নাম। এজন্যই বলা হয়েছে যে, এসব লোক জাহান্নামের দিকে আহবান করে। আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাত ও মাগফেরাতের দিকে আহবান করেন এবং পরিস্কারভাবে নিজের আদেশ বর্ণনা করেন, যাতে মানুষ উপদেশ মত চলে। [মাআরিফুল কুরআন]

মু’মিনদেরকে কেবল ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের পরস্পর বিবাহ দেওয়ার উপর তাকীদ করা হয়েছে এবং দ্বীনকে দৃষ্টিচ্যুত করে কেবল রূপ-সৌন্দর্যের ভিত্তিতে বিবাহ করাকে আখেরাতের জন্য বরবাদী সাব্যস্ত করা হয়েছে। যেমন

হাদীসে নবী করীম (সাঃ) বলেছেন যে, ‘‘চারটি জিনিসের ভিত্তিতে মহিলাদেরকে বিবাহ করা হয়; মাল, বংশ এবং সৌন্দর্য ও দ্বীনের ভিত্তিতে। তোমরা দ্বীনদার মহিলা নির্বাচন কর। (বুখারী ৫০৯০, মুসলিম ১৪৬৬নং) অনুরূপ তিনি পুণ্যময়ী সৎশীলা মহিলাকে দুনিয়ার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ গণ্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল পুণ্যময়ী নারী। (মুসলিম ১৪৬৭নং)

নারী ও পুরুষের মধ্যে বিয়েটা নিছক একটি যৌন সম্পর্ক মাত্র নয়৷ বরং এটি একটি গভীর তামাদ্দুনিক, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও মানসিক সম্পর্ক৷ ইরশাদ হয়েছে—–

তিনিই তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়। আরাফঃ১৮৯

৩০:২১ وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡهَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ

“আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রুম : আয়াত ২১)

مَوَدَّة এর অর্থ হল স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সুমধুর ভালবাসা যা সাধারণত পরিলক্ষিত হয়। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেরূপ ভালবাসা সৃষ্টি হয় অনুরূপ ভালবাসা পৃথিবীর অন্য কোন দুই ব্যক্তির মাঝে হয় না। আর رَحمَة (মায়া-মমতা) হল এই যে, স্বামী নিজ স্ত্রীকে সর্বপ্রকার সুখ-সুবিধা ও আরাম-আয়েশ দান করে থাকে। অনুরূপ স্ত্রীও নিজের সাধ্য ও ক্ষমতা অনুযায়ী স্বামীর সেবা করে থাকে। মহান আল্লাহ উভয়ের উপরেই সে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। বলা বাহুল্য, মানুষ এই শান্তি ও অগাধ প্রেম-ভালবাসা সেই দাম্পত্যের মাধ্যমেই লাভ করতে পারে যার সম্পর্কের ভিত্তি শরীয়তসম্মত বিবাহের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। পরন্তু ইসলাম একমাত্র বিবাহসূত্রের মাধ্যমেই সম্পৃক্ত দম্পতিকেই জোড়া বলে স্বীকার করে।

মু’মিন স্বামী বা স্ত্রীর প্রভাবে মুশরিক স্ত্রী বা স্বামী এবং তার পরিবার ও পরবর্তী বংশধররা ইসলামী আকীদা –বিশ্বাস ও জীবন ধারায় গভীরভাবে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত হয়ে যেতে পারে, সেখানে অন্যদিকে মুশরিক স্বামী বা স্ত্রীর ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা ও আচার-ব্যাবহারে কেবলমাত্র মু’মিন স্বামীর বা স্ত্রীরই নয় বরং তার সমগ্র পরিবার ও পরবর্তী বংশধরদেরও প্রভাবিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে৷ এই ধরনের দাম্পত্য জীবনের ফলশ্রুতিতে ইসলাম কুফর ও শিরকের এমন একটি মিশ্রিত জীবন ধারা সেই গৃহে ও পরিবারে লালিত হবার সম্ভাবনাই বেশী, যাকে অমুসলিমরা যতই পছন্দ করুক না কেন ইসলাম তাকে পছন্দ করতে এক মুহূর্তের জন্যও প্রস্তুত নয়৷

কোন খাঁটি ও সাচ্চা মু’মিন নিছক নিজের যৌন লালসা পরিতৃপ্তির জন্য কখনো নিজ গৃহে ও পরিবারে কাফেরী ও মুশিরকী চিন্তা-আচার-আচরণ লালিত হবার এবং নিজের অজ্ঞাতসারে নিজের জীবনের কোন ক্ষেত্রে কুফর ও শিরকে প্রভাবিত হয়ে যাবার বিপদ ডেকে আনতে পারে না৷ তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, কোন মু’মিন কোন মুশরিকের প্রেমে পড়ে গেছে তাহলেও তার ঈমানের দাবী হচ্ছে এই যে, সে নিজের পরিবার, বংশধর ও নিজের দীন, নৈতিকতা ও চরিত্রের স্বার্থৈ নিজের ব্যক্তিগত আবেগকে কুরবানী করে দেবে৷

সংগৃহিত

তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন

https://quranerkotha.com/baqarah-220/