সুরা বাকারাঃ ২৫তম রুকু (১৯৭-২১০)আয়াত

 সুরা বাকারাঃ ২৫তম রুকু (১৯৭-২১০)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ

২:১৯৭ اَلۡحَجُّ اَشۡهُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡهِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡهُ اللّٰهُ ؕؔ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ

১৯৭. হজ্ব হয় সুবিদিত মাসগুলোতে তারপর যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ্ব করা স্থির করে সে হজের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ করবে না। আর তোমরা উত্তম কাজ থেকে যা-ই কর আল্লাহ তা জানেন আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমরা আমারই তাকওয়া অবলম্বন কর।

হজ্জ একটি আরবি শব্দ এর আভিধানিক অর্থ হলো ইচ্ছা করা বা সংকল্প করা। ইসলামী পরিভাষায় হজ্জ বলা হয় নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কতিপয় এবাদত পালনের উদ্দেশ্যে বাইতুল্লাহ যিয়ারতের সংকল্প করা। হযরত ইব্রাহীম আ.কে আল্লাহতাআলা নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন,

আর লোকদেরকে হজ্জ করার জন্য প্রকাশ্যভাবে আহবান জানাও- তারা যেন তোমার কাছে আসে, পায়ে হেঁটে আসুক কিংবা দূরবর্তী স্থান থেকে কৃশ উটের পিঠে চড়ে আসুক। এখানে এসে তারা যেন দেখতে পায় তাদের জন্য দ্বীন দুনিয়ার কল্যানের কত সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর দেয়া জন্তুগুলোকে আল্লাহর নামে কুরবানী করবে, তা থেকে নিজেরাও খাবে এবং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদেরও খেতে দেবে। সূরা আল হজ্জ: ২৬-২৮

ইব্রাহীম আ.বলেছিলেন, হে আল্লাহ আমার এই ক্ষুদ্র আওয়াজ দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ কিভাবে শুনবে? উত্তরে আল্লাহ বলেছিলেন,তুমি ডাক দিয়ে দাও। আওয়াজ পৌছানোর দায়িত্ব আমার।

হজ্জ বান্দাহর উপর মহান আল্লাহর হক। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের উপর কাবা ঘরের হজ্জ ফরয করেছেন এবং এ হজ্জকে ইসলামের একটি স্তম্ভ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন:

মানুষের উপর আল্লাহর অধিকার রয়েছে যে, যার এই ঘর পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য আছে, সে যেন তার হজ্জ সম্পন্ন করে। আর যে এ নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি কিছুমাত্র মুখাপেক্ষী নন। সূরা আলে ইমরান: ৯৭

হজ্জে গমনকারী ব্যক্তি আল্লাহর মেহমান।

আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং হজ্জ ও উমরা পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান।আল্লাহ তাদের ডেকেছেন,তারা সে ডাকে সাড়া দিয়েছে। অতএব, তারা আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ তাই তাদের দিয়ে দিবেন।ইবনে মাজাহ:২৮৯৩

তিন ব্যক্তি আল্লাহর মেহমান। হাজী, উমরা পালনকারী ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী।নাসাঈ:২৬২৫

হজ্জ জিহাদতূল্য ইবাদাত।

আবু হুরায়রা রা.থেকে বর্ণিত,রাসূল স. বলেছেন, বয়স্ক,শিশু,দূর্বল ও নারীর জিহাদ হলো হজ্জ এবং উমরা পালন করা। নাসাঈ:২৬২৬

আয়িশাহ রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন,হে আল্লাহর রাসূল,মেয়েদের উপর কি জিহাদ ফরয!

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, মেয়েদের উপর এমন জিহাদ ফরয, যাতে লড়াই নেই-তা হচ্ছে হজ্জ ও উমরাহ পালন করা।আহমাদ:২৪৭৯৪ ও ইবনে মাজাহ

হজ্জ গুনাহমুক্ত করে।

আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি বলেন, নবী স. বলেছেন: “যে ব্যক্তি হজ্ব আদায় করেন, কিন্তু কোন পাপের কথা বা কাজ করেননি সে ব্যক্তি ঐদিনের মত হয়ে ফিরে আসবে যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।সহীহ বুখারী:১৫২১ ও সহীহ মুসলিম ১৩৫০

হজ্জের বিনিময় হবে জান্নাত। দারিদ্রতা দূর হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত,রাসূল স. বলেছেন, তোমরা হজ্জ ও উমরা পালন কর। কেননা হজ্জ ও উমরা উভয়টি দারিদ্র্য ও পাপরাশিকে দূরিভূত করে যেমনিভাবে হাপর স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহার মরিচা দূর করে দেয়। আর মাবরুর হজ্জের বদলা হলো জান্নাত। তিরমিযী:৮১০

হজ্জ রিযিকে বরকত এনে দেয়।

বুরাইদা রা. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন,তিনি বলেন,রাসূল স. বলেছেন, হজ্জে খরচ করা আল্লাহর পথে(জিহাদে) খরচ করার সমতূল্য সওয়াব।হজ্জে খরচকৃত সম্পদকে সাতশত গুন বাড়িয়ে এর প্রতিদান দেয়া হবে।আহমাদ:২২৪৯১ হাদীসটি সহিহ

জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভের ঘোষণা।

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. বলেন, আরাফার দিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের এত অধিক সংখ্যক জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন যা অন্য দিনে দেন না। তিনি এ দিনে বান্দাদের নিকটবর্তী হন ও তাদের নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করে বলেন, তোমরা কি বলতে পার আমার এ বান্দাগণ আমার কাছে কি চায় ? সহিহ মুসলিম: ১৩৪৮

হজ্জ আদায় না করার পরিণতি——

তাতে অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে, (যেমন) মাকামে ইবরাহীম। আর যে তাতে প্রবেশ করে সে নিরাপদ হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে যাদের সেখানে যাবার সামর্থ আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্জ করা তাদের উপর অবশ্য কর্তব্য। এবং কেউ (তা) প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন।সুরা আলে ইমরান: ৯৭

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তার মধ্যে দু’টি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে:

আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার জন্য পথের সম্বল এবং বাহন যার আছে সে যদি হজ্জ না করে, তবে এ অবস্থায় তার মৃত্যু ইহুদী ও নাসারার মৃত্যুর সমান বিবেচিত হবে। সহীহ জামে আত তিরমিযী

যার কোনো প্রকাশ্য অসুবিধা নেই, কোন যালেম বাদশাও যার পথ রোধ করেনি এবং যাকে কোন রোগ অসমর্থ করে রাখেনি – এতদসত্ত্বেও সে যদি হজ্জ না করেই মরে যায়, তবে সে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান হয়ে মরতে পারে।দারেমী,বায়হাকী,যাদে রাহ-৫২

উমরার ফরয বা রুকন ৩টি।

১। ইহরাম করা।

২। কাবাঘর তাওয়াফ করা।

৩। সাঈ করা

উমরার ওয়াজিব ২টি।

১।  মীকাত পার হওয়ার আগেই ইহরাম করা।

২। চুল কাটা বা মাথা মুণ্ডানো। মহিলাদের চুলের অগ্রভাগ কাটা।

হজ্জের ফরয বা রুকন ৩টি।

১। ইহরাম করা

২। আরাফাতে অবস্থান (৯ই যিলহজ্জ)

৩। তাওয়াফ করা (তাওয়াফে যিয়ারাহ বা ইফাদাহ)

হজ্জের ওয়াজিব ৯টি

১। ইহরাম করতে হবে মীকাত পার হয়ার আগেই।

২। সাফা মারওয়ার মাঝে সাঈ করা।

৩। আরাফাতে অবস্থান সূর্যাস্ত পর্যন্ত দীর্ঘায়ীত করা।

৪। মুযদালিফায় অবস্থান করা।

৫। মীনায় রাত্রি যাপন।

৬। জামরা সমূহে কঙ্কর নিক্ষেপ করা।

৭। হাদী (পশু) কুরবানী করা।

৮। চুল কাটা বা মাথা মুণ্ডানো। মহিলাদের চুলের অগ্রভাগ কাটা।

৯। বিদায়ী তাওয়াফ। ( হায়েয বা নেফাস শুরু হয়ে গেলে নারীদের অব্যাহতি দেয়া হয়েছে-বুখারী)

উল্লেখিত ওয়াজিবসমূহের মধ্যে কোন একটি যে কোন কারনেই ছুটে গেলেই বা বাদ পরে গেলে দম বা কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

দম বা কাফফারা আদায় করতে হয় যেভাবে—উমরা বা হজ্জের কোনো একটি ওয়াজিব ছুটে গেলে এর পরিবর্তে একটি খাসি,দুম্বা বা বকরি যবাই করে দিতে হয়।

এটি মিনায় বা মক্কায় দিতে হয়। এর গোশত শুধুমাত্র ফকির-মিসকীনরা খাবে, দমদাতা নিজে খাবে না।

অজানা ও অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটির জন্য দম দিতে হয় না, শুধুমাত্র ওয়াজিব তরক করলে দম দিতে হবে।

হজ্জের প্রধান সুন্নাত সমূহ

১। ইহরামের পূর্বে গোসল করা

২।পুরুষদের সাদা রঙের ইহরামের কাপড় পরিধান করা

৩।তালবিয়্যা পাঠ করা

৪।৮ই যিলহজ্জ দিবাগত রাত মিনায় অবস্থান করা

৫।ছোট ও মধ্যম জামারায় কংকর নিক্ষেপ করার পর দু’আ করা

৬।ইফরাদ হাজীদের তাওয়াফে কুদূম করা।

৭। তাওয়াফে কুদূমে ইযতেবা ও রমল করা

৮। সাফা-মারওয়ার সাঈর সময় সবুজ চিহ্নিত স্থানে পুরুষদের দৌড়ানো

৯।তাওয়াফ শেষ দুই রাকাত সালাত আদায় করা

সুন্নাত সমূহের কোন একটি ছুটে গেলে দম বা কাফফারা দিতে হবে না।

হজ্জের প্রকারভেদ—৩ প্রকার

১। তামাত্তু ২। কিরান। ৩। ইফরাদ

তামাত্তু হজ্জ—তামাত্তু শব্দের অর্থ হলো কিছু সময়ের জন্য সুযোগ সুবিধা ভোগ করা।

প্রথমত : ‘তামাত্তু’ হল হজ্জের সময় প্রথমে উমরা করে হালাল হয়ে ইহরামের কাপড় বদলিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা। এর কিছু দিন পর আবার মক্কা থেকেই ইহরাম বেধে হজ্জের আহকাম পালন করা।

দ্বিতীয়ত : ‘কিরান’ হল উমরা ও হজ্জের মাঝখানে হালাল না হওয়া এবং ইহরামের কাপড় না খোলা। একই ইহরামে আবার হজ্জ সম্পাদন করা।

তৃতীয়ত : ‘ইফরাদ’ হল উমরা করা ছাড়াই শুধুমাত্র হজ্জ করা।

মীকাত কি? কাবা শরীফ গমনকারীদেরকে কাবা হতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্বে থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়, যে স্থানগুলো নবীজির হাদীস দ্বারা নির্ধারিত আছে। ঐ জায়গাগুলোকে মীকাত বলা হয়। হারাম শরীফের চর্তুদিকেই মীকাত রয়েছে। ৫টি মীকাত।

১। মদ্বীনাবাসীদের জন্য যুল হুলাইফা ذو الحليفة

২। সিরিয়াবাসীদের জন্য আল-জুহফা الجحفة

৩। নজদবাসীদের জন্য কারনুল মানাযিল قرن المنازل

৪। ইয়ামানবাসীদের জন্য ইয়ালামলাম يلملم

৫। ইরাকবাসীদের জন্য যাতুইরক ذات عرق

বর্ণিত ৫ টি মীকাতের সীমানার ভিতরে যারা বসবাস করে যেমন জেদ্দা, বাহরা, তায়েফ, শরাইয় ও মক্কার মধ্যবর্তী এলাকার বাসিন্দাগণ বা চাকুরীরত বিদেশীরা কোথা থেকে ইহরাম বাঁধবে?

হজ্জের জন্য তারা তাদের নিজেদের ঘর থেকেই ইহরাম বাধবে। তাদেরকে মীকাতে যেতে হবে না।

মক্কাবাসীগণ কোথা থেকে ইহরাম বাঁধবে?

হজ্জের ইহরাম হলে নিজ নিজ ঘর থেকে, আর উমরার ইহরাম হলে মসজিদে তানয়ীমে যাবে অথবা হারামের হুদুদের (সীমানার) বাইরে যে কোন স্থানে গিয়ে বাঁধবে। মক্কায় চাকরীরত বিদেশীরাও তাই করবে।

ইহরাম শব্দের অর্থ হারাম বা নিষিদ্ধ করা। হজ্জ ও উমরাহকারী ব্যক্তিকে ইহরাম অবস্থা ধারন করতে হলে মীকাত থেকে বা মীকাত অতিক্রম করার পূর্বে কিছু কাজ ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

ইহরামের ৩টি শর্ত

১। মীকাত থেকে ইহরাম করা

২। পুরুষদের জন্য সেলাইবিহীন কাপড় পড়া

৩। তালবিয়্যা পড়া(ইহরাম শুরু করার পর পরই) তবে এ ব্যাপারে মতভেদ আছে,অনেকের মতে এটা সুন্নাত।

ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ

হজ ও উমরার কাজে প্রবেশের সাথে সাথে আপনার উপর অনেকগুলো কাজ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ফলে সে কাজগুলো আপনার জন্য হারাম হয়ে যায়। এগুলোকে বলা হয় ‘‘ইহরামের নিষিদ্ধকাজ’’।

আর তা হল : (ইহরামে প্রবেশের পর ব্যক্তিকে মুহরিম বলা হয়)

১। কেটে বা অন্য কোনভাবে চুল উপড়ে ফেলা এবং হাত বা পায়ের নখ কাটা। অবশ্য হাত দ্বারা মুহরিম ব্যক্তির মাথা চুলকানো জায়েয যদি তা প্রয়োজন হয়। এতে যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোন চুল পড়ে যায় অথবা মুহরিম ব্যক্তি তা ভুলে কিংবা হুকুম না জেনে করে ফেলে, তাহলে তার উপর কিছু ওয়াজিব হবে না।

২। ইহরামের পর কাপড়ে কিংবা শরীরে কিংবা অন্যত্র সুগন্ধি ব্যবহার করা। তবে ইহরামের আগে মাথায় ও দাঁড়িতে যে সুগন্ধি ব্যবহার করা হয়েছে তা ইহরামের পর বাকী থাকলেও কোন অসুবিধা নেই।

৩। মুহরিম ব্যক্তি স্ত্রী সঙ্গম করতে পারবে না, যৌন উত্তেজনার সাথে স্ত্রীকে স্পর্শও করবে না, স্ত্রীকে চুমু খাবে না এবং যৌন কামনার বশবর্তী হয়ে তার দিকে তাকানো যাবে না। মুহরিম ব্যক্তি মহিলাদের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে না এবং নিজের জন্য বা অন্য কারো জন্য বিয়ের আকদ করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে ইহরাম অবস্থায় থাকবে।

৪। মুহরিম ব্যক্তি হাত মোজা ব্যবহার করবে না।

৫। মুহরিম ব্যক্তির জন্য খরগোস ও কবুতর প্রভৃতির ন্যায় কোন স্থলজ শিকারী প্রাণীকে হত্যা করা অথবা পশ্চাদ্ধাবন করা কিংবা সে কাজে সাহায্য করা নিষিদ্ধ। মুহরিম ব্যক্তির জন্য সর্বাবস্থায় শিকার করা নিষিদ্ধ।

৬। সর্বাঙ্গে অথবা শরীরের কোন অঙ্গে জামা কিংবা পাজামা, গেঞ্জি, পাগড়ী, টুপী ও মোজার ন্যায় সেলাইকৃত কাপড় পরিধান করা পুরুষের জন্য হারাম।

মুহরিম ব্যক্তির জন্য সেন্ডেল, হাত ঘড়ি, আংটি, চশমা, কানে শোনার যন্ত্র, বেল্ট এবং টাকা-পয়সা ও কাগজপত্র হেফাযতের ব্যাগ ব্যবহার করা জায়েয।

৭। মুহরিম ব্যক্তি পুরুষ হলে মাথার সাথে লেগে থাকে এমন কিছু যেমন ইহরামের কাপড় বা পাগড়ী, রুমাল কিংবা টুপি দিয়ে মাথা ঢাকা হারাম।

তবে ছাতা, তাঁবু কিংবা গাড়ীর ছাদের ছায়ায় থাকলে অথবা মাথার উপর বোঝা বহন করলে কোন অসুবিধা নেই। মুহরিম ব্যক্তি যদি ভুলে কিংবা হুকুম না জেনে মাথা ঢেকে ফেলে তাহলে তার উপর ওয়াজিব হল যখনই স্মরণ হবে কিংবা হুকুম সম্পর্কে জানতে পারবে আবৃতকারী বস্ত্তটি সরিয়ে ফেলবে। আর এতে তার উপর কোন দম আসবে না।

৮। ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের হাত মোজা পরিধান করা নিষিদ্ধ ও নেকাব দিয়ে মুখ ঢাকা হারাম। নেকাব হলো দেখার জন্য দু‘চোখ খোলা রেখে যদ্বারা মুখমন্ডল আবৃত করা হয়। ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের জন্য এসবের কোনটাই বৈধ নয়। তাদের জন্য ওয়াজিব হলো তারা পুরুষদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় কিংবা পুরুষরা তাদের পাশদিয়ে যাওয়ার সময় শরীয়ত সম্মত ওড়না দিয়ে মুখ ঢাকা, যা মাথার উপরের দিক থেকে মুখের উপর ছেড়ে রাখবে।

৯। মুহরিম এবং মুহরিম নয় এমন ব্যক্তির জন্য হারাম শরীফের গাছ পালা এবং মানুষের চেষ্টা-চরিত্র ছাড়াই জন্মে এমন সবুজ তৃণলতা কাটা নিষিদ্ধ। হারাম শরীফের মধ্যে পড়ে থাকা জিনিস উঠিয়ে নেয়া যাবে না, অবশ্য মালিকের কাছে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে প্রচার করার জন্য তা উঠানো যাবে।

২:১৯৭ اَلۡحَجُّ اَشۡهُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡهِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡهُ اللّٰهُ ؕؔ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ

১৯৭. হজ্ব হয় সুবিদিত মাসগুলোতে তারপর যে কেউ এ মাসগুলোতে হজ্ব করা স্থির করে সে হজের সময় স্ত্রী-সম্ভোগ, অন্যায় আচরণ ও কলহ-বিবাদ করবে না। আর তোমরা উত্তম কাজ থেকে যা-ই কর আল্লাহ তা জানেন আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমরা আমারই তাকওয়া অবলম্বন কর।

মীকাত জামানিয়া (সময় সংক্রান্ত) ও মীকাত মাকানিয়া (স্থান সংক্রান্ত)

যারা হজ্ব অথবা উমরা করার নিয়্যতে এহরাম বাধে, তাদের উপর এর সকল অনুষ্ঠানক্রিয়াদি সম্পন্ন করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। এ দু’টির মধ্যে উমরার জন্য কোন সময় নির্ধারিত নেই। বছরের যে কোন সময় তা আদায় করা যায়। কিন্তু হজ্বের মাস এবং এর অনুষ্ঠানাদি আদায়ের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারিত রয়েছে। কাজেই এ আয়াতের শুরুতেই বলে দেয়া হয়েছে যে, হজ্বের ব্যাপারটি উমরার মত নয়। এর জন্য কয়েকটি মাস রয়েছে, সেগুলো প্রসিদ্ধ ও সুবিদিত। আর তা হচ্ছে শাওয়াল, যিলকদ ও জিলহজ্ব। হজ্বের মাস শাওয়াল হতে আরম্ভ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এর পূর্বে হজ্বের এহরাম বাধা জায়েয নয়।

*  رفث রাফাস একটি ব্যাপক শব্দ, যাতে স্ত্রী সহবাস ও তার আনুষাঙ্গিক কর্ম, স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা, এমনকি খোলাখুলিভাবে সহবাস সংক্রান্ত আলাপআলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত। এহরাম অবস্থায় এ সবই হারাম। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে কেউ এমনভাবে হজ্জ করবে যে, তাতে রাফাস, ফুসূক ও জিদাল তথা অশ্লীলতা, পাপ ও ঝগড়া ছিল না, সে তার হজ্জ থেকে সে দিনের ন্যায় ফিরে আসল যে দিন তাকে তার মা জন্ম দিয়েছিল।” [বুখারী: ১৫২১, মুসলিম: ১৩৫০]

*  فسوق ‘ফুসুক’ এর শাব্দিক অর্থ বের হওয়া। কুরআনের ভাষায় নির্দেশ লংঘন বা নাফরমানী করাকে ফুসুক বলা হয়। সাধারণ অর্থে যাবতীয় পাপকেই ফুসুক বলে। তাই অনেকে এস্থলে সাধারণ অর্থই নিয়েছেন। কিন্তু আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘ফুসুক’ শব্দের অর্থ করেছেন – সে সকল কাজ-কর্ম যা এহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ। স্থান অনুসারে এ ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত। কারণ সাধারণ পাপ এহরামের অবস্থাতেই শুধু নয়; বরং সবসময়ই নিষিদ্ধ।

আর الفسوق (পাপ) বলা হয় সবধরনের গুনার কাজকে। যেমন- পিতামাতার অবাধ্যতা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা, গীবত করা, চোগলখোরি করা ইত্যাদি। আবার ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজগুলোও ফুসুক বা পাপের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর এর الجدال অর্থ হচ্ছে- ঝগড়া-বিবাদ, অন্যায় বিতর্ক। হজ্জ বা উমরার ইহরাম অবস্থায় কারো জন্য অন্যায়ভাবে বিবাদ করা জায়েয নেই। তবে সত্যকে প্রকাশ করার জন্য উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা আল্লাহর আদেশের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন: “ডাক তোমার প্রতিপালকের দিকে হিকমত ও ওয়াজের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক কর উত্তম পন্থায়।” [সূরা নাহল, আয়াত: ১২৫] এই বিষয়গুলো (অর্থাৎ অশ্লীল কথা, গুনার কাজ, অন্যায় ঝগড়া)যদিও সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ কিন্তু হজ্জের মধ্যে এগুলোর নিষিদ্ধতা আরও জোরদার হয়। কেননা হজ্জের উদ্দেশ্য হচ্ছে- আল্লাহর প্রতি দীনতা, হীনতা প্রকাশ করা। তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে নৈকট্য হাছিল করা, পাপ থেকে পবিত্র থাকা। এভাবে আদায় করলে হজ্জটি মাবরুর হজ্জ হবে। আর মাবরুর হজ্জের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা প্রার্থনা করছি আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর যিকির, শুকর ও উত্তম ইবাদত করার সামর্থ্য দিন।আল্লাহই ভাল জানেন।

দেখুন: ফাতহুল বারী (৩/৩৮২), তাফসীরে সাদী (পৃষ্ঠা-১২৫), বিন বাযের ফতোয়াসমগ্র (১৭/১৪৪)।

যে সমস্ত বিষয় প্রকৃতপক্ষে নাজায়েয ও নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু এহরামের জন্য নিষেধ ও নাজায়েয, তা হচ্ছে ছয়টিঃ (১) স্ত্রী সহবাস ও এর আনুষাঙ্গিক যাবতীয় আচরণ; এমনকি খোলাখুলিভাবে সহবাস সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা। (২) স্থলভাগের জীব-জন্তু শিকার করা বা শিকারীকে বলে দেয়া। (৩) নখ বা চুল কাটা। (৪) সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যবহার। এ চারটি বিষয় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্যই এহরাম অবস্থায় হারাম বা নিষিদ্ধ। অবশিষ্ট দুটি বিষয় পুরুষের সাথে সম্পৃক্ত। (৫) সেলাই করা কাপড় পোষাকের মত করে পরিধান করা। (৬) মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা।

আলোচ্য ছয়টি বিষয়ের মধ্যে স্ত্রী সহবাস যদিও ফুসুক শব্দের অন্তর্ভুক্ত, তথাপি একে ‘রাফাস’ শব্দের দ্বারা স্বতন্ত্রভাবে এজন্যে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, এহরাম অবস্থায় এ কাজ থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এর কোন ক্ষতিপূরণ বা বদলা দেয়ার ব্যবস্থা নেই। কোন কোন অবস্থায় এটা এত মারাত্মক যে, এতে হজ্জই বাতিল হয়ে যায়। অবশ্য অন্যান্য কাজগুলোর কাফফারা বা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আরাফাতে অবস্থান শেষ হওয়ার পূর্বে স্ত্রী সহবাস করলে হজ্ব ফাসেদ হয়ে যাবে। গাভী বা উট দ্বারা এর কাফফারা দিয়েও পরের বছর পুনরায় হজ্ব করতেই হবে। এজন্যেই (فَلَا رَفَثَ) শব্দ ব্যবহার করে একে স্বতন্ত্রভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

*  جدال শব্দের অর্থ একে অপরকে পরাস্ত করার চেষ্টা করা। এ জন্যেই বড় রকমের বিবাদকে جدال বলা হয়। এ শব্দটিও অতি ব্যাপক। কেউ কেউ এস্থলে ফুসুক ও জিদাল শব্দদ্বয়কে সাধারণ অর্থে ব্যবহার করে এ অর্থ নিয়েছেন যে, ফুসুক ও জিদাল সর্বক্ষেত্রেই পাপ ও নিষিদ্ধ, কিন্তু এহরামের অবস্থায় এর পাপ গুরুতর। পবিত্র দিনসমূহে এবং পবিত্র স্থানে, যেখানে শুধুমাত্র আল্লাহর ইবাদাতের জন্য আগমন করা হয়েছে এবং ‘লাব্বাইকা লাব্বাইকা’ বলা হচ্ছে, এহরামের পোষাক তাদেরকে সবসময় এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, তোমরা এখন ইবাদাতে ব্যস্ত, এমতাবস্থায় ঝগড়া-বিবাদ ইত্যাদি অত্যন্ত অন্যায় ও চরমতম নাফরমানীর কাজ। [মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষেপিত]

*  ইহরামকালে নিষিদ্ধ বিষয়াদি বর্ণনা করার পর উল্লেখিত বাক্যে হিদায়াত করা হচ্ছে যে, হজ্জের পবিত্র সময় ও স্থানগুলোতে শুধু নিষিদ্ধ কাজ থেকেই বিরত থাকা যথেষ্ট নয়, বরং সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আল্লাহর যিকর ও ইবাদাত এবং সৎকাজে সদা আত্মনিয়োগ কর। তুমি যে কাজই কর না কেন, আল্লাহ্ তা’আলা জানেন। আর এতে তোমাদেরকে অতি উত্তম প্রতিদানও দেয়া হবে।

এ আয়াতে ঐ সমস্ত ব্যক্তির সংশোধনী পেশ করা হয়েছে যারা হজ ও উমরাহ করার জন্য নিঃস্ব অবস্থায় বেরিয়ে পড়ে। অথচ দাবী করে যে, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করছি। পক্ষান্তরে পথে ভিক্ষাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। নিজেও কষ্ট করে এবং অন্যকেও পেরেশান করে। তাদেরই উদ্দেশ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, হজের উদ্দেশ্যে সফর করার আগে প্রয়োজনীয় পাথেয় সাথে নেয়া বাঞ্ছনীয়, এটা তাওয়াক্কুলের অন্তরায় নয়। বরং আল্লাহর উপর ভরসা করার প্রকৃত অর্থই হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত আসবাব পত্র নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সংগ্রহ ও জমা করে নিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাওয়াক্কুলের এই ব্যাখ্যাই বর্ণিত হয়েছে।

  • অর্থাৎ আমার শাস্তি, আমার পাকড়াও, আমার লাঞ্ছনা থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখ। কেননা, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে চলে না, আমার নিষেধ থেকে দূরে থাকে না তাদের উপর আমার আযাব অবধারিত।

সতর্কতাঃ হাফেয ইবনুল ক্বাইয়্যেম লিখেছেন যে, রসূল (সাঃ)-এর কথা ও কাজ দ্বারা কেবল দু’প্রকারের উমরাহ প্রমাণিত, এক যা হজ্জে তামাত্তু’র সাথে করা যেতে পারে। আর দ্বিতীয় হল, এমন উমরাহ যা হজ্জের মাস ব্যতীত অন্য দিনে কেবল উমরাহ করার নিয়তে সফর করে করা হয়। এ ছাড়া হারাম সীমানার বাইরে গিয়ে (হারামের নিকটস্থ কোন স্থান থেকে) ইহরাম বেঁধে এসে (একই সফরে একাধিক) উমরা করা বিধেয় নয়। (অবশ্য তার ব্যাপার ভিন্ন, যে আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহার মত সমস্যায় পড়ে আগে উমরাহ না করতে পারবে।) (যাদুল মাআদ ২খন্ড নতুন ছাপা)

যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হলে হজ্জ বাতিল হয়ে যাবে।

## উযরবশত: একান্ত বাধ্য হয়ে যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মাথার চুল উঠায় বা কেটে ফেলে তাহলে ফিদইয়া দিতে হবে। উলামায়ে কিরামের কিয়াস অনুসারে মাথা ছাড়া অন্য অংশ থেকে চুল উঠালে বা কাটলে বা নখ কাটলেও ফিদইয়া দিতে হবে।

ফিদইয়া হলো— •  একটি ছাগল জবাই করে গোশত বিলিয়ে দেয়া অথবা

  • ৬জন মিসকিনকে (প্রত্যেককে ১কেজি ২০ গ্রাম পরিমান) একবেলা খাওয়াতে হবে অথবা
  • তিনদিন রোযা রাখতে হবে।

২:১৯৮ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ اَنۡ تَبۡتَغُوۡا فَضۡلًا مِّنۡ رَّبِّکُمۡ ؕ فَاِذَاۤ اَفَضۡتُمۡ مِّنۡ عَرَفٰتٍ فَاذۡکُرُوا اللّٰهَ عِنۡدَ الۡمَشۡعَرِ الۡحَرَامِ ۪ وَ اذۡکُرُوۡهُ کَمَا هَدٰىکُمۡ ۚ وَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مِّنۡ قَبۡلِهٖ لَمِنَ الضَّآلِّیۡنَ

১৯৮. তোমাদের রব-এর অনুগ্রহ সন্ধান করাতে তোমাদের কোন পাপ নেই। সুতরাং যখন তোমরা আরাফাত হতে ফিরে আসবে তখন মাশ’আরুল হারামের কাছে পৌছে আল্লাহকে স্মরণ করবে এবং তিনি যেভাবে শিক্ষা দিয়েছেন – ঠিক সেভাবে তাকে স্মরণ করবে। যদিও এর আগে তোমরা বিভ্রান্তদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে।

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, জাহেলিয়াতের যুগে ওকায, মাজান্নাহ ও যুল মাজায নামে তিনটি বাজার ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর হজ্জের সময় সাহাবীরা সেই বাজারগুলোতে ব্যবসা করা গুনাহ বলে মনে করতে থাকলে আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াত নাযিল করেন। অর্থাৎ হজের মৌসুমে সেসব স্থানগুলোতে ব্যবসা করা কোনো দোষের কাজ নয়। [বুখারী: ১৭৭০, ২০৯৮]

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহ্‌ তা’আলা জিবরীলকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কাছে প্রেরণ করে তাকে হজ্জ করান। তারা আরাফাতে পৌঁছলে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বললেন, عَرَفْتُ বা আমি চিনতে পেরেছি। কারণ, জিবরীল আলাইহিস সালাম ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে এর পূর্বেই সেখানে একবার নিয়ে এসেছিলেন। আর সে জন্যই সেটার নাম হয় আরাফাত। [ইবনে কাসীর]

আদুর রহমান ইবনে ইয়ামুর আদ-দীলী বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, হজ্জ হচ্ছে আরাফাত। তিনি এ কথা তিনবার বললেন। তারপর বললেন, যে ব্যক্তি সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পূর্বেই আরাফায় আসতে সক্ষম হবে সে হজ্জ পেল। আর মিনা হচ্ছে তিন দিন। সুতরাং যদি কেউ দুইদিনে তাড়াতাড়ি করলো তার কোন পাপ নেই এবং যে ব্যক্তি বিলম্ব করলো তারও কোনো পাপ নেই। [আবু দাউদ: ১৯৪৯, তিরমিযী: ৮৮৯, ইবনে মাজাহ: ৩০১৫, মুসনাদে আহমাদ: ৪/৩০৯, ৩১০]

আরাফায় পৌঁছে মসজিদে ‘নামিরা’র কাছে অবস্থান করা মুস্তাহাব অর্থাৎ উত্তম। সেখানে জায়গা না পেলে আরাফার সীমানার ভিতরে যে কোন স্থানে অবস্থান করতে পারেন। এতে কোন অসুবিধা নেই- (মুসলিম)। তবে পাশেই ‘উরানা’ নামের একটি উপত্যকা আছে। সেটি আরাফার চৌহদ্দির বাইরে। কাজেই সেখানে যাবেন না। ঐখানে অবস্থান করবেন না। মাশ’আরা অর্থ চিহ্ন, হারামের শেষ স্থান।

‘‘মাশআরুল হারাম’’ একটি পাহাড়ের নাম। এটি মুযদালিফায় অবস্থিত। এখানে একটি মসজিদও আছে। মাশ’আরুল হারাম বলে মুযদালিফা বোঝানো হয়েছে। কারণ, এ অংশ হারাম এলাকার ভিতরে। [ইবনে কাসীর]মুযদালিফায় অবস্থান সাদামাটা জীবন যাপন, গৃহহীনতা ও অভাবের প্রতীক। মুযদালিফা এলাকা হারামের সীমার ভিতরে অবস্থিত। আরাফার সীমানা শেষ হলেই মুযদালিফা শুরু হয় না। আরাফা থেকে ৬ কি.মি. অতিক্রম করার পর আসে মুযদালিফা। মুযদালিফার পর কিছু অংশ ওয়াদি আল-মুহাসসির উপত্যকা এলাকা তারপর মিনা সীমানা শুরু। ৯ইযিলহাজ্জ দিনে আরাফাত থেকে রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করবে এটা ওয়াজিব।

১০ই যিলহজ্জ দিনের ফজর অন্ধকার থাকতেই আউয়াল ওয়াক্তে পড়ে নেবেন। দুই রাকাত ফরজের সাথে দুই রাকাত সুন্নতও পড়বেন। এরপর ‘‘মাশআরুল হারাম’’-এর নিকটবর্তী কিবলামুখী দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে দোয়া-মুনাজাত করতে থাকবেন। এখানে আসতে না পারলে অসুবিধা নেই। মুযদালিফার যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে দোয়া করতে পারবেন।

এখানে ‘এর আগে’ বলে হেদায়াত আসার পূর্বে বা কুরআনের পূর্বে অথবা রাসূল সা আসার পূর্বে এ তিনটি অর্থই হতে পারে। অর্থগুলো পরস্পর কাছাকাছি। [ইবনে কাসীর]

২:১৯৯ ثُمَّ اَفِیۡضُوۡا مِنۡ حَیۡثُ اَفَاضَ النَّاسُ وَ اسۡتَغۡفِرُوا اللّٰهَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

১৯৯. তারপর অন্যান্য লোক যেখান থেকে ফিরে আসে তোমরাও সে স্থান থেকে ফিরে আসবে। আর আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সমস্ত আরাফাই অবস্থানের স্থান এবং উরনা উপত্যকা থেকে বের হয়ে যাও। আর মুযদালিফার সমস্ত জায়গাই অবস্থানস্থল এবং আর তোমরা ওয়াদী মুহাসসার থেকে প্রস্থান করো। আর মক্কার প্রতিটি অলিগলিই যবেহ করার জায়গা এবং আইয়ামে তাশরীকের প্রতিদিনই যবেহ করা যাবে। [মুসনাদে আহমাদ: ৪/৮২] অন্য হাদীসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, কুরাইশ ও তাদের মতানুসারীরা মুযদালিফায় অবস্থান করত এবং নিজেদেরকে ‘হুমুস’ নামে অভিহিত করতো। আর বাকী সব আরবরা আরাফায় অবস্থান করতো। অতঃপর যখন ইসলাম আসলো তখন আল্লাহ তাঁর নবীকে আরাফাতে যেতে, সেখানে অবস্থান করতে এবং সেখান থেকেই প্রস্থান করতে নির্দেশ দান করেন। এ জন্যই এ আয়াতে মানুষের সাথে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [বুখারী ৪৫২০, মুসলিম: ১২১৯]

মুযদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী একটি জায়গার নাম ওয়াদী মুহাসসার। এটা মুযদালিফার অংশ নয়। তাই এখানে অবস্থান করা যাবে না। এ মুহাসসার এলাকায় আবরাহা রাজার হাতির বাহিনীকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি কংকর নিক্ষেপ করে নাস্তানাবুদ করেছিল। ইতোপূর্বে এ কথাটি বলা হয়েছিল যে, বর্তমানে মুযদালিফার একাংশ মিনা হিসাবে ব্যবহার করা হয় হজযাত্রী সংকুলান না হওয়ার কারণে। তাই ঐ জায়গাটুকু মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হলেও যেহেতু মৌলিক অর্থে মিনায় পরিনত হয় নি, তাই ঐ অংশে তাবুতে রাত্রিযাপন করলে মুযদালিফার রাত্রিযাপন হয়ে যাবে। ওয়াদী মুহাসসারেও এখন অবশ্য তাবু বিছিয়ে মিনা হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় অবস্থানের ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তা‘আলা এ দিনে তোমাদের ওপর অনুকম্পা করেছেন, অতঃপর তিনি গুনাহগারদেরকে সৎকাজকারীদের কাছে সোপর্দ করেছেন। আর সৎকাজকারীরা যা চেয়েছে তা তিনি দিয়েছেন”।ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩০২৩

বৃদ্ধ ও দূর্বল পুরুষ-নারী, শিশু ও অসুস্থ ব্যক্তিগণ ওজর বা কারণ সাপেক্ষে মধ্যরাতের চাঁদ ডুবে যাওয়ার পর মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে পারেন। অসুস্থ্য ও দুর্বলদের সাহায্যার্থে তাদের সাথে অভিভাবকরাও যেতে পারবেন। ওজর ছাড়া মুযদালিফা ত্যাগ করে মিনায় যাওয়া ঠিক হবে না। চলে গেলে দম দিতে হবে। সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৫৬৪

২:২০০ فَاِذَا قَضَیۡتُمۡ مَّنَاسِکَکُمۡ فَاذۡکُرُوا اللّٰهَ کَذِکۡرِکُمۡ اٰبَآءَکُمۡ اَوۡ اَشَدَّ ذِکۡرًا ؕ فَمِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّقُوۡلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا وَ مَا لَهٗ فِی الۡاٰخِرَۃِ مِنۡ خَلَاقٍ

২০০. অতঃপর যখন তোমরা হজ্জের অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত করবে তখন আল্লাহকে এভাবে স্মরণ করবে। যেভাবে তোমরা তোমাদের পিতৃ পুরুষদের স্মরণ করে থাক, অথবা তার চেয়েও অধিক। মানুষের মধ্যে যারা বলে, “হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতেই দিন”। আখেরাতে তার জন্য কোনও অংশ নেই।

আতা রহিমাহুল্লাহ বলেন, এর অর্থ হলো, শিশুরা যেমন পিতা মাতাকে সব সময় স্মরণ করে, তোমরাও হজ শেষ করার পর আল্লাহ তা’আলাকে তেমনি স্মরণ কর। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, জাহেলিয়াতে হজের সময় একত্রে বসে পরস্পরে বলাবলি করত যে, আমার পিতা একজন অতিথিপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সাধারণের ভালো কাজ করে দিতেন। তিনি মানুষের দিয়াত বা রক্তপণ আদায় করে দিতেন। তাই আল্লাহ তা’আলা এখানে আল্লাহর যিকরকে তাদের পিতৃপুরুষের স্মরণের সাথে তুলনা করে বেশী বেশী করে যিকর করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। [ইবনে কাসীর]

আরবের লোক হজ্জ সমাপ্ত করে মিনায় মেলা বসাতো এবং পূর্বপুরুষদের কৃতিত্ব স্মরণ করত। মুসলিমদেরকে বলা হচ্ছে যে, ১০ই যুলহজ্জ কাঁকর মেরে, মাথা নেড়া করে এবং কাবার তাওয়াফ ও স্বাফা-মারওয়ার সাঈ করে হজ্জ সমাপ্ত করে নেওয়ার পর তোমরা যে তিনদিন মিনায় অবস্থান করবে, সে দিনগুলিতে সেখানে খুব বেশী বেশী আল্লাহর যিকর কর। যেমন, জাহেলী যুগে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করতে।

মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবসহ অধিকাংশ বিজ্ঞ উলামাদের মতে মিনায় রাত্রিযাপন ওয়াজিব। বিনা ওজরে এটি ছুটে গেলে দম দিতে হবে। তবে হানাফী মাযহাবে এটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। আর এ সুন্নাত ছুটে গেলে দম দেয়া লাগে না। ১০ ও ১১ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতগুলোতে মিনায় থাকা ওয়াজিব। ১২ই যিলহজ্জ তারিখে পাথর নিক্ষেপ শেষে সূর্যাস্তের আগে মিনা ত্যাগ করতে না পারলে ঐ তারিখের দিবাগত রাতেও মিনায় থাকা ওয়াজিব হয়ে যায়। রাতের কি পরিমাণ অংশ মিনায় কাটালে রাত্রি যাপনের ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে?

অর্ধেকের বেশী সময়।

২:২০১ وَ مِنۡهُمۡ مَّنۡ یَّقُوۡلُ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ حَسَنَۃً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ

২০১. আর তাদের মধ্যে যারা বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।

অর্থাৎ, ভাল কাজ করার তাওফীক দান কর। অর্থাৎ, ঈমানদাররা দুনিয়াতেও দুনিয়া চায় না, বরং নেকীর কাজের তাওফীক কামনা করে। নবী করীম (সাঃ) খুব বেশী বেশী এই দুআটি পড়তেন। তাওয়াফ করাকালীন অনেক লোকে প্রত্যেক চক্করে পৃথক পৃথক দুআ পড়ে থাকে, যা মনগড়া দু আ। এই দুআগুলোর পরিবর্তে তাওয়াফের সময় রুকনে ইয়ামানী এবং হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে ‘রাব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুনয়া হাসানাহ— পড়া সুন্নত।

আবদুল্লাহ ইবনে সায়েব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাবার দুই রুকনের মাঝখানে এ দোআ বলতে শুনেছি। [আবু দাউদ: ১৮৯২] আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই এ দো’আ করতেন। [বুখারী ৪৫২২, মুসলিম: ২৬৯০]

(প্রকাশ থাকে যে, আলোচ্য আয়াতে ‘ইহকালের কল্যাণ’-এর তাৎপর্যে একাধিক তফসীর বর্ণিত হয়েছে; যেমনঃ পুণ্যময়ী স্ত্রী, ইবাদত, ইলম ও ইবাদত, মাল-ধন, নিরাপত্তা, প্রশস্ত রুযী, নেয়ামত বা সম্পদ ইত্যাদি। সুতরাং এর অর্থ ব্যাপক রাখাই বাঞ্ছনীয়। পক্ষান্তরে পরকালের সাথে ইহকালের সুখ-শান্তি চাওয়াও দোষাবহ নয়। আসলে কিছু লোক কেবল ইহকালের সুখই কামনা করে; কিন্তু মুসলিম কামনা করে ইহ-পরকাল উভয়ের সুখ। -সম্পাদক)

এই দুয়ার মাঝে সকল কল্যান রয়েছে ও সকল ক্ষতি থেক্কে হেফাজতের চাওয়া রয়েছে। এই ধরনের দু’আ দু’আ জামে মানে বলা হয়,  আল্লাহুম্মা ইন্নি আসয়ালুকাল আফিয়াত

২:২০২ اُولٰٓئِکَ لَهُمۡ نَصِیۡبٌ مِّمَّا کَسَبُوۡا ؕ وَ اللّٰهُ سَرِیۡعُ الۡحِسَابِ

২০২. তারা যা অর্জন করেছে তার প্রাপ্য অংশ তাদেরই। আর আল্লাহ হিসেব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর।

২:২০৩ وَ اذۡکُرُوا اللّٰهَ فِیۡۤ اَیَّامٍ مَّعۡدُوۡدٰتٍ ؕ فَمَنۡ تَعَجَّلَ فِیۡ یَوۡمَیۡنِ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡهِ ۚ وَ مَنۡ تَاَخَّرَ فَلَاۤ اِثۡمَ عَلَیۡهِ ۙ لِمَنِ اتَّقٰی ؕ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّکُمۡ اِلَیۡهِ تُحۡشَرُوۡنَ

২০৩. আর তোমরা গোনা দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করবে। অতঃপর যদি কেউ তাড়াতাড়ি করে দুই দিনে চলে আসে তবে তার কোন পাপ নেই এবং যে ব্যক্তি বিলম্ব করে আসে তারও কোন পাপ নেই। এটা তার জন্য যে তাকওয়া অবলম্বন করে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ যে, তোমাদেরকে তাঁর নিকট সমবেত করা হবে।

নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন বলে তাশরীকের দিনগুলোকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, যুল-হজ্জের ১১, ১২ এবং ১৩ তারীখ। এই দিনগুলোতে আল্লাহর যিকর, অর্থাৎ, উচ্চৈঃস্বরে তকবীর পড়া সুন্নত। কেবল যে ফরয নামাযের পরই পড়া হবে তা নয়; বরং সব সময় এই তাকবীর ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, অলিল্লাহিল হামদ’ পড়া বাঞ্ছনীয়। কাঁকর মারার সময় প্রত্যেক কাঁকরের সাথে তাকবীর পড়া সুন্নত। (নায়লুল আওত্বার ৫/৮৬)

রম্ই জিমার (জামরাতে কাঁকর মারা) তিন দিন উত্তম। কিন্তু কেউ যদি কেবল দু’দিন (১১ ও ১২ই যুলহজ্জ) কাঁকর মেরে মিনা থেকে প্রত্যাগমন করে, তবে তারও অনুমতি আছে।

যে ব্যক্তির ইচ্ছা আছে ও সক্ষমতা আছে তার জন্য প্রতিবছর হজ্জ করা উত্তম? নাকি প্রতি তিন বছরে একবার হজ্জ করা উত্তম? নাকি প্রতি দুই বছরে একবার হজ্জ করা উত্তম?

উত্তর

আলহামদু লিল্লাহ।.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তাআলা সামর্থ্যবান মুকাল্লাফ (শরয়ি ভারপ্রাপ্ত) ব্যক্তির উপর জীবনে একবার হজ্জ আদায় করা ফরজ করেছেন। একবারের বেশি হজ্জ আদায় করলে সেটা নফল হজ্জ হিসেবে গণ্য হবে। এর মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে। শরয়ি দলিলে নফল হজ্জের কোন সংখ্যা নির্ধারণ সাব্যস্ত হয়নি। বরং এটি মুকাল্লাফ ব্যক্তির আর্থিক ও শারীরিক অবস্থার উপর এবং আশপাশের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গরীব-মিসকীনদের অবস্থার উপর নির্ভর করবে। অনুরূপভাবে ব্যক্তির জান ও মাল দিয়ে উম্মতের সার্বিক কল্যাণের কোন কোন খাতে সহযোগিতা করা যায় সেটার উপর নির্ভর করবে। উম্মতের মাঝে তার অবস্থান, তার হজ্জের সফর যাওয়া বা না-যাওয়ার সাথে উম্মতের কী ধরনের স্বার্থ বা কল্যাণ নিহিত আছে তার উপর নির্ভর করবে। এসব বিবেচনা করে অপেক্ষাকৃত যেটা কল্যাণকর ব্যক্তি সেটাকে প্রাধান্য দিবে। আল্লাহই উত্তম তাওফিকদাতা। আমাদের নবী মুহাম্মদ এর উপর আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি

সদস্য: শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আল-আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ বিন গুদয়ান, শাইখ আব্দুল্লাহ বিন কুউদ।

গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়াসমগ্র (১১/১৪)

সামর্থ্যবান হলে পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার আগে পুনরায় হজ্জ আদায় করা বাঞ্ছনীয়। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তাআলা বলেন: যে বান্দার শরীর সুস্থ আছে, আর্থিক সামর্থ্য আছে কিন্তু পাঁচ বছর গত হয়ে যাওয়ার পরও সে আমার উদ্দেশ্যে সফর করল না সে মাহরুম (বঞ্চিত)”।[সহিহ ইবনে হিব্বান (৯৬০), শাইখ আলবানী সবগুলো সনদ মিলিয়ে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন (সিলসিলা সহিহা ১৬৬২)]। আল্লাহই ভাল জানেন।

সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব

২:২০৪ وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یُّعۡجِبُکَ قَوۡلُهٗ فِی الۡحَیٰوۃِ الدُّنۡیَا وَ یُشۡهِدُ اللّٰهَ عَلٰی مَا فِیۡ قَلۡبِهٖ ۙ وَ هُوَ اَلَدُّ الۡخِصَامِ

২০৪. আর মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি আছে, পার্থিব জীবনে যার কথাবার্তা আপনাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। প্রকৃতপক্ষে সে ভীষণ কলহপ্রিয়।

আয়াতের এ অংশের তিনটি অর্থ হতে পারেঃ (১) পার্থিব জীবন সম্পর্কে যার কথাবার্তা আপনাকে চমৎকৃত করে। (২) পার্থিব জীবনে যাদের কথাবার্তা আপনাকে চমৎকৃত করে। এবং (৩) পার্থিব জীবনে আপনি চমৎকৃত হন তাদের কথাবার্তায়।

এই আয়াতের লক্ষ্য হল সেই সমস্ত মুনাফিক এবং অহংকারিগণ, যাদের মধ্যে কুরআনে উল্লিখিত নিকৃষ্ট স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে।

কোন কোন দুর্বল হাদীসের ভিত্তিতে বলা হয় যে, এই আয়াত একজন মুনাফিক আখনাস বিন শুরাইক সাক্বাফীর সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কিন্তু সঠিকতর কথা এই যে, এই আয়াতের লক্ষ্য হল সেই সমস্ত মুনাফিক এবং অহংকারিগণ, যাদের মধ্যে কুরআনে উল্লিখিত নিকৃষ্ট স্বভাবগুলো পাওয়া যাবে।

হে নবী, এ মুনাফিকরা যখন তোমার কাছে আসে তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল৷ আল্লাহ জানেন, তুমি অবশ্যই তাঁর রসূল৷ কিন্তু আল্লাহ সাক্ষ দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী৷ তারা নিজেদের শপথসমূহকে ঢাল বানিয়ে রেখেছে৷ এভাবে তারা নিজেরা আল্লাহর পথ থেকে বিরত থাকছে এবং অন্যদেরকেও বিরত রাখছে৷ এরা যা করছে তা কত মন্দ কাজ। সূরা মুনাফিকুনঃ১-২

তুমি যখন এদের প্রতি তাকিয়ে দেখ, তখন তাদের দেহাবয় তোমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়৷ আর যখন কথা বলে তখন তাদের কথা তোমার শুনতেই ইচ্ছা করে৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরা দেয়ালের গায়ে খাড়া করে রাখা কাঠের গুড়ির মত৷ যে কোন জোরদার আওয়াজকে এরা নিজেদের বিরুদ্ধে মনে করে৷ এরাই কট্টর দুশমন৷ এদের ব্যাপারে সাবধান থাক৷ এদের ওপর আল্লাহর গযব। এদেরকে উল্টো কোন্‌দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ? যখন তাদের বলা হয়, এসো আল্লাহর রসূল যাতে তোমাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন তখন তারা মাথা ঝাঁকুনি দেয় আর তুমি দেখবে যে, তারা অহমিকা ভরে আসতে বিরত থাকে৷ মুনাফিকুনঃ ৪-৫

এই আয়াতের তাফসিরে- হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই অত্যন্ত সুঠাম দেহী, সুস্থ, সুদর্শন ও বাকপটু ব্যক্তি ছিল ৷ তার সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকও তাই ছিল ৷ এরা সবাই ছিল মাদীনার নেতৃস্থানীয় লোক ৷ তারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে যখন আসতো তখন দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসতো এবং রসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা বলতো ৷ তাদের দেহাবয়ব ও চেহারা -আকৃতি দেখে আর কথাবার্তা শুনে কেউ কল্পনাও করতে পারতো না যে, সমাজের এসব সম্মানিত লোকেরা চরিত্রের দিক দিয়ে এত নীচ ও জঘন্য হতে পারে ৷

অর্থাৎ এরা যারা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে তারা মানুষ নয়, বরং কাঠের গুড়ি ৷ তাদেরকে কাষ্ঠখণ্ডের সাথে তুলনা করে বুঝানো হয়ে ছে যে, নৈতিক চরিত্র মানুষের মূল প্রাণসত্তা, সেই প্রাণসত্তাই তাদের মধ্যে নেই ৷ তারপর তাদেরকে দেয়ালগাত্রে হেলান দিয়ে খাড়া করা কাষ্ঠখন্ডের সাথে তুলনা করে এ কথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, তা একেবারেই অকেজো, অপদার্থ ৷ কেননা, কাঠ কেবল তখনই উপকারে আসে যদি তা ছাদে অথবা দরজায় বা আসবাব তৈরীর কাজে ব্যবহার করা হয় ৷ দেয়াল গাত্রে হেলান দিয়ে রাখা কাষ্ঠখন্ড কোন উপকারেই আসে না ৷

অর্থাৎ সে বলে, আল্লাহ সাক্ষী, আমি কেবলমাত্র শুভ কামনা করি৷ আমার নিজের কোন স্বার্থ নেই৷ শুধুমাত্র সত্য ও ন্যায়ের জন্য এবং মানুষের ভালো ও কল্যান সাধনের উদ্দেশ্য আমি কাজ করে যাচ্ছি৷এখানে কুরআনে ‘আলাদ্দুল খিসাম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর অর্থ হচ্ছে, এমন শত্রু যে সকল শত্রুর বড়৷ অর্থাৎ সত্যের বিরোধিতার ক্ষেত্রে সে সম্ভাব্য সব রকমের অস্ত্র ব্যবহার করে৷ মিথ্যা, জালিয়াতি, বেঈমানি, বিশ্বাসঘাতকতা এবং যে কোন ধরনের কপটতার অস্ত্র ব্যবহার করতে সে একটুও ইতস্তত করে না৷

২:২০৫ وَ اِذَا تَوَلّٰی سَعٰی فِی الۡاَرۡضِ لِیُفۡسِدَ فِیۡهَا وَ یُهۡلِکَ الۡحَرۡثَ وَ النَّسۡلَ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یُحِبُّ الۡفَسَادَ ﴿

২০৫. আর যখন সে প্রস্থান করে তখন সে যমীনে অশান্তি সৃষ্টি এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণী ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ ফাসাদ ভালবাসেন না।

‘ইয়া তাওয়াল্লা’ শব্দের দু’টি অর্থ হতে পারে৷ একটি অর্থ এখানে আয়াতের অনুবাদে অবলম্বন করা হয়েছে৷

এর দ্বিতীয় অর্থটি হচ্ছে, মজার মজার হৃদয় প্রলুব্ধকারীকথা বলে ‘যখন সে ফিরে আসে’ তখন এসব অপকর্ম করে৷

২:১১ وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُمۡ لَا تُفۡسِدُوۡا فِی الۡاَرۡضِ ۙ قَالُوۡۤا اِنَّمَا نَحۡنُ مُصۡلِحُوۡنَ

আর যখন তাদেরকে বলা হয়, তোমরা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করো না, তারা বলে, “আমরা তো কেবল সংশোধনকারী। বাকারাঃ১১

ফ্যাসাদ (فساد) শব্দটি আরবি। এর অর্থ নৈরাজ্য, উগ্রতা, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, অশান্তি,  উত্তরাধিকার, প্রভৃতি। ফাসাদ শব্দটি কুরআনের বহু জায়গায় ব্যবহার হয়েছে।

আবুল আলীয়া বলেন, ফাসাদ সৃষ্টি করো না অর্থাৎ যমীনে আল্লাহর অবাধ্য হয়ো না। মুনাফিকদের ফাসাদ সৃষ্টির অর্থই হচ্ছে, যমীনের বুকে আল্লাহর নাফরমানী ও অবাধ্যতা অবলম্বন। কেননা, যে কেউ যমীনে আল্লাহর অবাধ্য হবে, অথবা অবাধ্যতার নির্দেশ দিবে সে অবশ্যই যমীনের বুকে ফাসাদ সৃষ্টি করল। কারণ, আসমান ও যমীন একমাত্র আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত থাকে। [আত-তাফসীরুস সহীহ] যেহেতু মুমিনদেরকে মুনাফিকদের মৌখিক ঈমান ধোঁকায় ফেলে, অতএব নিফাকের ফাসাদ সুস্পষ্ট। কেননা, তারা প্রতারণামূলক চটকদার কথা বলে মুমিনদেরকে ভুলিয়ে রাখে এবং মুমিনদের অভ্যন্তরীন কথা নিয়ে কাফের বন্ধুদের বন্ধুত্ব রক্ষা করে। তারা এ ফাসাদকে মীমাংসা মনে করছে। তারা মনে করছে, আমরা মুমিন ও কফিরের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছি যেন উভয় দলের মধ্যে আপোস ও শান্তি বজায় রাখতে পারি। তারা মনে করছে, তারা মুমিন ও আহলে কিতাবদের মধ্যে আপোসরফা চালাচ্ছে। এর জবাবে আল্লাহ্ তা’আলা বলছেন যে, মনে রেখ তারা যেটাকে আপোস বা মীমাংসা মনে করছে সেটাই আসলে ফাসাদের মূল সূত্র। কিন্তু তারা তাদের অজ্ঞতার কারণে সেটাকে ফাসাদ হিসেবেই মনে করছে না। [ইবনে কাসীর] মূলত: মুনাফিকদের স্থায়ী কোন নীতি নেই। সুযোগ বুঝে তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুনাফিকের উদাহরণ হলো ঐ ছাগীর ন্যায় যা দু’ পাল পাঠা ছাগলের মাঝখানে অবস্থান করে। জৈবিক তাড়নায় সে উভয় পালের পাঠাদের কাছেই যাতায়াত করে। সে বুঝতে পারে না কার অনুসরণ করা দরকার।” [মুসলিম: ২৭৮৪]

মোটকথা: মুনাফিক ব্যক্তিত্বহীন। মহান আল্লাহ মুনাফিকদের এ চরিত্রের কথা ঘোষণা করে বলেন, “তারা দোটানায় দোদুল্যমান, না এদের দিকে, না ওদের দিকে!” (সূরা আন-নিসা ১৪৩]

কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, মুনাফিকের চরিত্র সম্পর্কে অনেকে বলে থাকেন যে, তাদের সবচেয়ে খারাপ চরিত্র হচ্ছে, তারা মুখে যা বলে অন্তরে তা অস্বীকার করে। আর কর্মকাণ্ডে তার বিপরীত করে। এক অবস্থায় সকালে উপনীত হয় তো অন্য অবস্থায় তার সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যা যে অবস্থায় হবে, সকাল হবে তার বিপরীত অবস্থায়। নৌকার মত নড়তে থাকে, যখনই কোন বাতাস জোরে প্রবাহিত হয়, সে বাতাসের সাথে নিজেকে প্রবাহিত করে। [আত-তাফসীরুস সহীহ]

মুনাফিকদের বিপরীতে মুমিনরা হলো ইসলাহ করে দেয় অর্থাৎ মিমাংসা করে।

নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালোবাসেন। মুমিনগণ পরস্পর ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু’ ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও।’ -সূরা হুজুরাত  : ১০

‘আমি কি তোমাদেরকে রোযা, নামায ও সদকার মর্তবা থেকেও উত্তম বিষয় সম্পর্কে বলব না? সাহাবীগণ আরয করলেন, আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন, ‘বিবাদরতদের মধ্যে মীমাংসা করা। আর জেনে রেখ, পরস্পর বিবাদই মানুষের দ্বীন মুড়িয়ে দেয়’। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯১৯

যে ব্যক্তি ন্যায়ের উপর থাকা সত্ত্বেও বিবাদ পরিহার করে, তার জন্য জান্নাতের মাঝে একটি ঘর তৈরি করা হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৯৩

উম্মে কুলসুম (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কল্যাণ লাভ করার উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি মিথ্যা কথার মাধ্যমে পরষ্পরবিরোধী দুই ব্যক্তির মধ্যে সন্ধি স্থাপন করে সে মিথ্যুক নয়। ’ (বুখারি, হাদিস : ২৬৯২, মুসলিম, হাদিস : ২৬০৫)

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন–

আর আল্লাহ যা তোমাকে দিয়েছেন তা দ্বারা আখেরাতের আবাস অনুসন্ধান কর এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না(১); তুমি অনুগ্রহ কর যেমন আল্লাহ্‌ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং যমীনের বুকে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ে না। নিশ্চয় আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে ভালবাসেন না। সূরা কাসাসঃ৭৭

এই ফাসাদ হয় পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যেও—-

যেমন অনেকেই স্বামী স্ত্রীর ভালো সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরাতে চায়(এমনকি কখনো কখনো মায়েরাও)

পিতা মাতার সাথে সন্তানের ভালো সম্পর্কের মাঝে ফাটল ধরাতে চায় (স্বামী বা স্ত্রীও)

জমি সংক্রান্ত বিষয়ে ভাই বোনদের মাঝে, অন্যদের সাথেও ভালো সম্পর্ক সহ্য না করতে পেরে ইত্যাদি

২:২০৬ وَ اِذَا قِیۡلَ لَهُ اتَّقِ اللّٰهَ اَخَذَتۡهُ الۡعِزَّۃُ بِالۡاِثۡمِ فَحَسۡبُهٗ جَهَنَّمُ ؕ وَ لَبِئۡسَ الۡمِهَادُ

২০৬. আর যখন তাকে বলা হয় ‘আল্লাহ্‌র তাকওয়া অবলম্বন কর, তখন তার আত্মাভিমান তাকে পাপাচারে লিপ্ত করে, কাজেই জাহান্নামই তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট বিশ্রামস্থল।

{أَخَذَتْهُ الْعِزَّةُ بِالْأِثْمِ} তার আত্মাভিমান তাকে অধিকতর পাপাচারে লিপ্ত করে। এখানে عِزَّة এর অর্থঃ গর্ব-অহঙ্কার, আত্মাভিমান।

‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা থেকে অহংকারবশে মুখ ফিরিয়ে থাকে, তাদের জন্য আকাশের দুয়ার সমূহ উন্মুক্ত করা হবে না এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ছুঁচের ছিদ্রপথে উষ্ট্র প্রবেশ করে। এভাবেই আমরা পাপীদের বদলা দিয়ে থাকি’ (আ‘রাফ ৭/৪০

‘অহংকার’ মানব স্বভাবের একটি নিকৃষ্ট অংশ। এর উপকারিতার চেয়ে অনিষ্টকারিতা বেশী। একে দমন করে সৎকর্মে লাগানোর মধ্যেই মানুষের কৃতিত্ব নির্ভর করে। মানুষের মধ্যে ষড়রিপু হ’ল কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। এর মধ্যে ‘মদ’ হ’ল দম্ভ, গর্ব, অহংকার। ‘মাৎসর্য’ হ’ল ঈর্ষা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা। প্রতিটি রিপুই মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্ট এবং প্রতিটির দক্ষ ব্যবহার কাম্য। যেমন টক-ঝাল-মিষ্টি-লবণ প্রতিটিই প্রয়োজন। কিন্তু অধিক ব্যবহারে প্রতিটিই ক্ষতিকর। জীবনের চলার পথে ষড়রিপু আমাদের সার্বক্ষণিক সাথী। যা মটর গাড়ীর মাথায় রাখা আগুনের বাক্সের মত। যাকে সর্বদা পাখা দিয়ে বাতাস করতে হয় এবং ড্রাইভার সর্বদা গিয়ার পরিবর্তনের মাধ্যমে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ী চালিয়ে থাকেন। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত উপরোক্ত ৬টি আগুনের মধ্যে ‘মদ’ বা অহংকার ও আত্মম্ভরিতা হ’ল অন্যতম প্রধান স্ফুলিঙ্গ। যা একবার জ্বলে উঠলে ও নিয়ন্ত্রণ হারালে পুরা মানবগাড়ীটাকে খাদে ফেলে ধ্বংস করে ছাড়ে।           অহংকারের আরবী নাম কিব্র (الْكِبْر)। যার অর্থ বড়ত্ব। অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করাই এর অন্তর্নিহিত অর্থ। এর পারিভাষিক অর্থ, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা।                                                                       রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ الْجَنَّةِ كُلُّ ضَعِيفٍ مُتَضَعِّفٍ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللهِ لَأَبَرَّهُ، أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِأَهْلِ النَّارِ كُلُّ عُتُلٍّ جَوَّاظٍ مُسْتَكْبِرٍ

‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল দুর্বল এবং যাদেরকে লোকেরা দুর্বল ভাবে। কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ তা অবশ্যই কবুল করেন। অতঃপর তিনি বলেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের বিষয়ে খবর দিব না? তারা হ’ল বাতিল কথার উপর ঝগড়াকারী, হঠকারী ও অহংকারী’। বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬ ‘ক্রোধ ও অহংকার’ অনুচ্ছেদ

অর্থাৎ হকপন্থী মুমিনগণ দুনিয়াবী দৃষ্টিতে দুর্বল হ’লেও আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে সবল। কেননা তাদের দো‘আ দ্রুত কবুল হয় এবং আল্লাহর গযবে অহংকারী ধ্বংস হয়।

২:২০৭ وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّشۡرِیۡ نَفۡسَهُ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ رَءُوۡفٌۢ بِالۡعِبَادِ

২০৭. আর মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য নিজেকে বিকিয়ে দেয়। আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল।

বিভিন্ন গ্রন্থে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াতটি সোহাইব রুমী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছিল। তিনি যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন, তখন পথিমধ্যে একদল কোরাইশ তাকে বাধা দিতে উদ্যত হলে তিনি সওয়ার থেকে নেমে দাঁড়ালেন এবং তার তুনীরে রক্ষিত সবগুলো তীর বের করে দেখালেন এবং কোরাইশদের লক্ষ্য করে বললেন, হে কোরাইশগণ! তোমরা জান, আমার তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তুনীরে একটি তীরও থাকবে, ততক্ষণ তোমরা আমার ধারে-কাছেও পৌছতে পারবে না। তীর শেষ হয়ে গেলে তলোয়ার চালাব।

যতক্ষণ আমার প্রাণ থাকবে, ততক্ষণ আমি তলোয়ার চালিয়ে যাব। তারপর তোমরা যা চাও করতে পারবে। আর যদি তোমরা দুনিয়ার স্বার্থ কামনা কর, তাহলে শোন, আমি তোমাদেরকে মক্কায় রক্ষিত আমার ধন-সম্পদের সন্ধান বলে দিচ্ছি, তোমরা তা নিয়ে নাও এবং আমার রাস্তা ছেড়ে দাও। তাতে কোরাইশদল রাযী হয়ে গেল এবং সোহাইব রুমী রাদিয়াল্লাহু আনহু নিরাপদে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হয়ে ঘটনা বর্ণনা করলেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’বার বললেন, সুহাইব লাভবান হয়েছে! সুহাইব লাভবান হয়েছে! [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৩/৩৯৮]

প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন৷তাওবাঃ১১১

আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে ঈমানের যে ব্যাপারটা স্থিরকৃত হয় তাকে কেনাবেচা বলে এখানে উল্লেখ করা হয়েছে৷ এর মানে হচ্ছে, ঈমান শুধুমাত্র একটা অতি প্রাকৃতিক আকীদা -বিশ্বাস নয়৷ বরং এটা একটি চুক্তি ৷ এ চুক্তির প্রেক্ষিতে বান্দা তার নিজের প্রাণ ও নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর হাতে বিক্রি করে দেয়৷ আর এর বিনিময়ে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ওয়াদা কবুল করে নেয় যে, মরার পর পরবর্তী জীবনে তিনি তাকে জান্নাত দান করবেন৷ এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু অনুধাবন করার জন্য সর্বপ্রথম কেনা -বেচার তাৎপর্য ও স্বরূপ কি তা ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে৷

কেনা -বেচার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করা যাকঃ

এক এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ মানুষকে দুটি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন৷

প্রথম পরীক্ষাটি হচ্ছে, তাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেবার পর সে মালিকাকে মালিক মনে করার এবং বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের পর্যায়ের নেমে না আসার মতো সৎ আচরণ করে কিনা৷

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নিজের প্রভু ও মালিক আল্লাহর কাছ থেকে আজ নগদ যে মূল্য পাওয়া যাচ্ছে না বরং মরার পর পরকালীন জীবনে যে মূল্য আদায় করার ওয়াদা তার পক্ষ থেকে করা হয়েছে তার বিনিময়ে নিজের আজকের স্বাধীনতা ও তার যাবতীয় স্বাদ বিক্রি করতে স্বেচ্ছায় ও সাগ্রহে রাজী হয়ে যাবার মত আস্থা তার প্রতি আছে কিনা৷

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সেই সত্তার কসম! যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يُحِبَّ لأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ، ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য তা-ই পসন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে’।বুখারী হা/১৩; মুসলিম হা/৪৫; মিশকাত হা/৪৯৬১।

অন্যত্র তিনি বলেন,وَأَحِبَّ لِلنَّاسِ مَا تُحِبُّ لِنَفْسِكَ تَكُنْ مُسْلِمًا، ‘তুমি নিজের জন্য যা পসন্দ কর, মানুষের জন্যও তা পসন্দ করবে, তাহ’লে পূর্ণ মুসলিম হ’তে পারবে’।তিরমিযী হা/২৩০৫; ইবনু মাজাহ হা/৪২১৭;

২:২০৮ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ادۡخُلُوۡا فِی السِّلۡمِ کَآفَّۃً ۪ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّهٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ

২০৮) হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।

“ইসলাম” শব্দটি তাফসীর ব্যাখ্যায় বর্ণনা পাওয়া যায় এই ভাবে যে, ইসলাম শব্দটি আরবি “সিলমুন” শব্দ হতে নির্গত সিলমুন শব্দ অর্থ শান্তি । মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর প্রেরিত নবী- রাসুল গনের নির্দেশিত আদেশ নিষেধ মোতাবেক শান্তি কায়েমে মানুষের শান্তির জীবন যাপন করার জীবনব্যবস্থাই হচ্ছে ইসলাম ।

এ আয়াতে ‘সিলমুন’ এবং ‘কাফফাহ’ শব্দ দুটি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লামা হাফেজ ইবনে কাছির (র.) ‘সিলমুন’-এর অর্থ করেছেন ইসলাম ও শান্তি। আর ‘কাফ্ফাহ’-এর অর্থ করেছেন পরিপূর্ণরূপে ও সাধারণভাবে। সাহাবায়ে কেরামদের থেকেও এ অর্থের সাপোর্ট পাওয়া যায়। এখন আয়াতের অর্থ দাঁড়ালো। হে ইমানদারগণ। তোমরা ইসলামে তথা শান্তির ধর্মে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ কর। পরিপূর্ণভাবে প্রবেশ করা বলতে আমরা কি বুঝি

ঈমানদারদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করে যাও। এমন করো না যে, যে নির্দেশগুলো তোমাদের স্বার্থ ও মনপসন্দ হবে, সেগুলোর উপর আমল করবে এবং অন্যান্য নির্দেশগুলো ত্যাগ করবে। অনুরূপ যে দ্বীন তোমরা ছেড়ে এসেছ, তার কথাও ইসলামে প্রবেশ করানোর অপচেষ্টা করো না; বরং কেবল ইসলামকেই পূর্ণরূপে বরণ করে নাও। এ আয়াতে দ্বীনের নামে বিদআতেরও খন্ডন করা হয়েছে এবং বর্তমানের ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীদের মতবাদও খন্ডন করা হয়েছে, যারা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়, বরং দ্বীনকে কেবল (ব্যক্তিগত) ইবাদত অর্থাৎ, মসজিদে সীমাবদ্ধ রেখে রাজনীতি এবং দেশের সংসদ থেকে তাকে নির্বাসন দিতে চায়। এইভাবে জনসাধারণকেও বুঝানো হচ্ছে, যারা প্রচলিত প্রথা ও লোকাচার এবং আঞ্চলিক সভ্যতা-সংস্কৃতিকে পছন্দ করে, কোন মতেই তারা এগুলোকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়; যেমন মৃত্যু ও বিবাহ-শাদীতে ব্যয়বহুল ও অপচয়মূলক এবং বিজাতীয় রীতিনীতি ইত্যাদির অনুকরণ করে থাকে, তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমরা সেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, যে ইসলাম পরিপন্থী কথা ও কর্মকে লোভনীয় ও শোভনীয় ভঙ্গীতে তোমাদের সামনে পেশ করে, যে মন্দের উপর খুব ভালোর লেবেল চড়ায় এবং বিদআতকেও নেকীর কাজ বলে বুঝায়, যাতে সর্বদা তোমরা তার পাতা জালে ফেঁসে থাকো।

আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করে তাদের জন্য ইসলামকেই একমাত্র দ্বীন হিসাবে মনোনীত করেছেন। তিনি বলেন           ,إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ  ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে একমাত্র মনোনীত দ্বীন হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯)

আয়াতটি অবতীর্ণ করেন, اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْنًا- ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নে‘মত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদা ৫/৩)

তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহ্কে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আহযাব ৩৩/২১)। তিনি অন্যত্র বলেন, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর, আর যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকেই ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর’ (হাশর ৫৯/৭)। মহান রব ইরশাদ করেছেন–

তাহলে কি তোমরা কিতাবের একটি অংশের ওপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশের সাথে কুফরী করছো? তারপর তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হবে এবং আখেরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে ? তোমাদের কর্মকান্ড থেকে আল্লাহ বেখবর নন৷বাকারাঃ৮৫

যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের সাথে কুফরী করে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে আমরা কাউকে মানবো ও কাউকে মানবো না আর কুফর ও ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়, তারা সবাই আসলে কট্টর কাফের ৷ আর এহেন কাফেরদের জন্য আমি এমন শাস্তি তৈরী করে রেখেছি, যা তাদেরকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করবে৷নিসাঃ১৫০-১৫১

,إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ-

‘শয়তান তো কেবল চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও ছালাত হ’তে তোমাদেরকে বিরত রাখতে। অতএব তোমরা নিবৃত্ত হবে কি?’ (মায়েদাহ ৫/৯১)।

,وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْزَغُ بَيْنَهُمْ إِنَّ الشَّيْطَانَ كَانَ لِلْإِنْسَانِ عَدُوًّا مُبِينًا- ‘

(হে নবী!) তুমি আমার বান্দাদের বল, তারা যেন (পরস্পরে) উত্তম কথা বলে। (কেননা) শয়তান সর্বদা তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উস্কানি দেয়। নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৫৩)

‘সে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দেয় ও মিথ্যা আশ্বাস দেয়। আর শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা প্রতারণা বৈ কিছু নয়’ (নিসা ৪/১২০)।

সে শুধুই তোমাদেরকে জঘন্য এবং অনৈতিক কাজ করতে বলে — আল-বাক্বারাহ ১৬৯

“হে আদম-সন্তানরা! (সাবধান!) শয়তান যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় যেমনিভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে, সে তাদের উভয়ের গোপনাঙ্গ দেখানোর জন্য তাদের পোশাক হরণ করেছে। সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে এমন স্থান থেকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদের দেখতে পাও না। নিশ্চয় যারা বিশ্বাস করে না আমরা শয়তানদেরকে তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি।” (আরাফ:২৭)

“হে মানুষ, নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে; আর বড় প্রতারক(শয়তান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারণা না করে। নিশ্চয় শয়তান তোমাদের শত্রু, অতএব তাকে শত্রু হিসেবে গণ্য কর। সে তার দলকে কেবল এজন্যই ডাকে যাতে তারা জ্বলন্ত আগুনের অধিবাসী হয়”। [সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ৫-৬]

শয়তান এদের উপরে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে এবং তাদেরকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। এরা শয়তানের দল। সাবধান! এই শয়তানের দল একদিন ধ্বংস হয়ে যাবেই। [মুজাদিলা ৫৮:১৯]

আপনি পাবেননা আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমানদার এমন কোন সম্প্রদায়, যারা ভালবাসে তাদেরকে যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে—হোক না এ বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই অথবা এদের জ্ঞাতি-গোত্র। এদের অন্তরে আল্লাহ লিখে দিয়েছেন ঈমান এবং তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে রূহ দ্বারা।(১) আর তিনি তাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে; আল্লাহ্‌ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। তারাই আল্লাহ্‌র দল। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ্‌র দলই সফলকাম। মুজাদিলা ৫৮:২২]

২:২০৯ فَاِنۡ زَلَلۡتُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡکُمُ الۡبَیِّنٰتُ فَاعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ

২০৯. অতঃপর তোমাদের কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি আসার পর যদি তোমাদের পদস্থলন ঘটে, তবে জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।

২:২১০ هَلۡ یَنۡظُرُوۡنَ اِلَّاۤ اَنۡ یَّاۡتِیَهُمُ اللّٰهُ فِیۡ ظُلَلٍ مِّنَ الۡغَمَامِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ قُضِیَ الۡاَمۡرُ ؕ وَ اِلَی اللّٰهِ تُرۡجَعُ الۡاُمُوۡرُ

২১০. তারা কি শুধু এর প্রতীক্ষায় রয়েছে যে, আল্লাহ ও ফেরেশতাগণ মেঘের ছায়ায় তাদের কাছে উপস্থিত হবেন? এবং সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যাবে। আর সমস্ত বিষয় আল্লাহর কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে।

এটা হয়তো কিয়ামতের দৃশ্য, যেমন কোন কোন তফসীরের বর্ণনায় এসেছে। (ইবনে কাসীর) অর্থাৎ, এরা কি কিয়ামত কায়েম হওয়ার অপেক্ষা করছে? অথবা এর অর্থ হল, মহান আল্লাহ ফিরিশতাসহ মেঘের আড়ালে তাদের সামনে এসে কোন চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেবেন, তবেই তারা ঈমান আনবে। কিন্তু এ রকম ঈমান ফলপ্রসূ হবে না। কাজেই ইসলাম গ্রহণ করার ব্যাপারে বিলম্ব না করে সত্বর তা স্বীকার করে নিয়ে নিজের পরকাল সুন্দর করে নাও।

তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে, কিয়ামত কবে ও কখন হবে? বলে দাও, একমাত্র আমার রবই এর জ্ঞান রাখেন৷ সঠিক সময়ে তিনিই তা প্রকাশ করবেন৷ আকাশ ও পৃথিবীতে তা হবে ভয়ংকর কঠিন সময়৷ সহসাই তা তোমাদের ওপর এসে পড়বে৷ তারা তোমার কাছে এ ব্যাপারে এমনভাবে জিজ্ঞেস করছে যেন তুমি তার সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছ? বলে দাও, একমাত্র আল্লাহরই এর জ্ঞান রাখেন৷ কিন্তু অধিকাংশ লোক এ সত্যটি জানে না৷   (সূরা আরাফঃ ১৮৭)

“আর শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা কবর থেকে তাদের রবের দিকে ছুটে আসবে। তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভোগ! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল থেকে উঠালো? (তাদেরকে বলা হবে) এটা তো তা যার ওয়াদা পরম করুনাময় করেছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন। তা ছিল শুধুই একটি বিকট আওয়াজ, ফলে তৎক্ষণাৎ তাদের সকলকে আমার সামনে উপস্থিত করা হবে। সুতরাং আজ কাউকেই কোনো যুলম করা হবে না এবং তোমরা যা আমল করছিলে শুধু তারই প্রতিদান তোমাদের দেওয়া হবে”। [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৫১-৫৪]

যখন মানুষ কবর থেকে উঠে দাড়াবে তাদের বলা হবে, তোমরা আসো তোমাদের প্রতিপালকের কাছে, আর থামো, তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তখন সকল মানুষ হতাশায় আতঙ্কিত হয়ে পড়বে। পরাক্রমশালী এক অদ্বিতীয় প্রভুর সামনে সকলে মাথা নত করে দিবে। তারা সেদিন এ আহবানে সাড়া দিতে দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করে দিবে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,“সেদিন তারা আহ্বানকারীর (ফিরিশতার) অনুসরণ করবে। এর কোনো এদিক সেদিক হবে না এবং পরম করুণাময়ের সামনে সকল আওয়াজ নিচু হয়ে যাবে। তাই মৃদু আওয়াজ ছাড়া তুমি কিছুই শুনতে পাবে না”। [সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১০৮] “অতএব তাদেরকে ছেড়ে দাও, তারা (বেহুদা কথায়) মত্ত থাকুক আর খেল-তামাশা করুক যতক্ষণ না তারা দেখা পায় সেদিনের, যার প্রতিশ্রুতি তাদেরকে দেওয়া হয়েছে। যেদিন দ্রুতবেগে তারা কবর থেকে বের হয়ে আসবে, যেন তারা কোনো লক্ষ্যের দিকে ছুটছে অবনত চোখে। লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে! এটিই সেদিন যার ওয়াদা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল”। [সূরা আল-মা‘আরিজ, আয়াত: ৪২-৪৪]

তারপর আল্লাহ তাদেরকে জিজ্ঞেস করবেন, বলো,পৃথিবীতে তোমরা কত বছর থাকলে?  তারা বলবে, ‘‘এক দিন বা দিনেরও কিছু অংশে আমরা সেখানে অবস্থান করেছিলাম, গণনাকারীদেরকে জিজ্ঞেস করে নিন৷ বলবেন, ‘‘অল্পক্ষণই অবস্থান করেছিলে,হায়!যদি তোমরা একথা সে সময় জানতে ৷ তোমরা কি মনে করেছিলে আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি   এবং তোমাদের কখনো আমার দিকে ফিরে আসতে হবে না? সূরা আল-মুমিনুন ১১২–১১৫

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,“কখনো নয়, যখন পৃথিবীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হবে পরিপূর্ণভাবে। আর তোমার রব ও ফিরিশতাগণ উপস্থিত হবেন সারিবদ্ধভাবে। আর সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে, সেদিন মানুষ স্মরণ করবে, কিন্তু সেই স্মরণ তার কী উপকারে আসবে? সে বলবে, হায়! যদি আমি কিছু আগে পাঠাতাম আমার এ জীবনের জন্য!” [সূরা আল-ফাজর, আয়াত: ২১-২৪]

সংগ্রহে—

তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন,আহসানুল বায়ান

https://www.youtube.com/watch?v=hQy31xcTOL0     (১৯৫-২০৩)

https://www.youtube.com/watch?v=FMqD2mkcPzg  (২০৪-২১০)