সুরা বাকারাঃ ২৩তম রুকু (১৮৩-১৮৮)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:১৮৩ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ
১৮৩. হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হল, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববতীদেরকে দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়ার অধিকারী হতে পারত
ঈমানদারদের সম্বোধন করে যে কাজটি নির্ধারন বা বাধ্যতামূলক যা ফরয বলে অভিহিত করা হয় তা কুতিবা শব্দটি দিয়ে বুঝানো হয়েছে। লিখিত হয়ে গেলে যেমন এটা জোরালো হয় তেমনি।
* صوم এর শব্দিক অর্থ বিরত থাকা। শরীআতের পরিভাষায় আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে পানাহার এবং স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকার নাম ‘সাওম’। তবে সুবহে সাদিক উদয় হওয়ার পূর্ব থেকে শুরু করে সূর্যস্ত পর্যন্ত সিয়ামের নিয়াতে একাধারে এভাবে বিরত থাকলেই তা সিয়াম বলে গণ্য হবে। সূর্যাস্তের এক মিনিট আগেও যদি কোন কিছু খেয়ে ফেলে, পান করে কিংবা সহবাস করে, তবে সিয়াম হবে না। অনুরূপ উপায়ে সবকিছু থেকে পূর্ণ দিবস বিরত থাকার পরও যদি সিয়ামের নিয়্যত না থাকে, তবে তাও সিয়াম পালন হবে না। সিয়াম ইসলামের মূল ভিত্তি বা আরকানের অন্যতম। সিয়ামের অপরিসীম ফযীলত রয়েছে।
* মুসলিমদের প্রতি সিয়াম ফরয হওয়ার নির্দেশটি একটি বিশেষ নযীর উল্লেখসহ দেয়া হয়েছে। নির্দেশের সাথে সাথে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, সিয়াম শুধুমাত্র তোমাদের প্রতিই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরয করা হয়েছিল। এর দ্বারা যেমন সিয়ামের বিশেষ গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে, তেমনি মুসলিমদের এ মর্মে একটি সান্ত্বনাও দেয়া হয়েছে যে, সিয়াম একটা কষ্টকর ইবাদাত সত্য, তবে তা শুধুমাত্র তোমাদের উপরই ফরয করা হয়নি, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলোর উপরও ফরয করা হয়েছিল। কেননা, সাধারণতঃ দেখা যায়, কোন একটা কষ্টকর কাজে অনেক লোক একই সাথে জড়িত হয়ে পড়লে তা অনেকটা স্বাভাবিক এবং সাধারণ বলে মনে হয়।
আয়াতের মধ্যে শুধু বলা হয়েছে যে, “সিয়াম যেমন মুসলিমদের উপর ফরয করা হয়েছে, তেমনি পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপরও ফরয করা হয়েছিল”; এ কথা দ্বারা এ তথ্য বুঝায় না যে, আগেকার উম্মতগণের সিয়াম সমগ্র শর্ত ও প্রকৃতির দিক দিয়ে মুসলিমদের উপর ফরযকৃত সিয়ামেরই অনুরূপ ছিল। যেমন, সিয়ামের সময়সীমা, সংখ্যা এবং কখন তা রাখা হবে, এসব ব্যাপারে আগেকার উম্মতদের সিয়ামের সাথে মুসলিমদের সিয়ামের পার্থক্য হতে পারে, বাস্তব ক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। বিভিন্ন সময়ে সিয়ামের সময়সীমা এবং সংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়েছে। [মা’আরিফুল কুরআন]
সাওমের যে মূল ফায়দা তা হলো তাকওয়া অর্জন। এ বাক্যে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাকওয়া শক্তি অর্জন করার ব্যাপারে সিয়ামের একটা বিশেষ ভূমিকা বিদ্যমান। কেননা, সিয়ামের মাধ্যমে প্রবৃত্তির তাড়না নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বিশেষ শক্তি অর্জিত হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে সেটাই তাকওয়ার ভিত্তি।
তাকওয়া অর্জনের জন্য রোযা ফরয
মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন বলেছেন:
মহান আল্লাহ ঈমানদারদের বলছেন রোযার উদ্দেশ্য সম্পর্কে। এখানে সবাই সেই উদ্দেশ্য লাভ করবে তা বলা হয় নাই, আল্লাহ বলছেন সম্ভবত লাভ করবে, আর সেটা হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। এই রোযা পূর্ববর্তীদের উপর ফরয ছিল। তবে ধরন ছিল অন্যরকম যেমন দু’দিন বা তিনদিন।
তাকওয়ার মূল ধাতুর অর্থ বাঁচা, মুক্তি বা নিষ্কৃতি।
তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ হল ভয় করা, পরহেযগারী, বিরত থাকা।
মূলত তাকওয়া শুধু আল্লাহভীতি নয় বরং আল্লাহ সম্পর্কে সেই রকম সচেতনতা( যা তাঁর আসমা ওয়াস সিফাতকে জানা বুঝা ও নিজ জীবনে প্রতিফলন করা)) রাখা, যার ফলে গুনাহ থেকে সরে থাকা ও কল্যান কাজে লিপ্ত থাকা যায়, মহান আল্লাহ যা আদেশ করেছেন এবং যে পদ্ধতিতে করতে বলেছেন তার অনুসরন(রাসুল সা এর আদর্শ) করা।
শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে আল্লাহ তা’লার সকল আদেশ মানা এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকার নাম তাকওয়া।
যে কোনো ধরনের বাঁচার নাম তাকওয়া নয়। ইসলাম বা আল-কুর’আনের আলোকে যেটা প্রকৃত মুক্তি, নিষ্কৃতি বা পরিত্রাণ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য সেই মুক্তি/নিষ্কৃতিই তাকওয়ার আওতায় পড়বে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
﴿فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَأَنفِقُوا خَيْرًا لِّأَنفُسِكُمْ ۗ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
কাজেই তোমাদের মধ্যে যতটা সম্ভব হয় আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আর শুন ও অনুসরণ কর এবং নিজের ধন-মাল ব্যয় কর, এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। যে লোক স্বীয় মনের সংকীর্ণতা ও কৃপনতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে তারাই সফলকাম হবে। সূরা আত তাগাবুন: ১৬
হে মানুষ! আমরাই তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রী হতে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদের মধ্যে জাতি ও ভাতৃগোষ্ঠী বানিয়ে দিয়েছি, যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত সে, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সব বিষয়ে অবহিত। সূরা আল হুজুরাত: ১৩
﴿وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَىٰ فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَىٰ﴾
আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফ্সকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিল তার ঠিকানা হবে জান্নাত। সূরা আন নাযিয়াত: ৩৫-৪১
আর তাই মহান আল্লাহ ঈমানদের সম্বোধন করে আহবান করেছেন:
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যথাযথভাবে আল্লাহকে ভয় করো। মুসলিম থাকা অবস্থায় ছাড়া যেন তোমাদের মৃত্যু না হয়। সূরা আলে ইমরান: ১০২
তাকওয়া মানুষের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার শক্তি জাগ্রত করে। আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَتَّقُوا اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ فُرۡقَانًا وَّ یُکَفِّرۡ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ
হে বিশ্বাসীগণ! যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহলে তিনি তোমাদেরকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যকারী শক্তি দেবেন, তোমাদের পাপ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অতিশয় অনুগ্রহশীল। সূরা আনফালঃ ২৯
”অর্থাৎ তাকওয়ার ফলে মানুষের বিবেক বুদ্ধি প্রখর হয় এবং সুষ্ঠ বিচার-বিবেচনা শক্তি জাগ্রত হয়। তাই সে সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ চিনতে এবং তা অনুধাবন করতে ভূল করে না। তার হাতে তাকওয়ার আলোকবর্তিকা থাকার ফলে জীবন পথের মন্দ দিকসমূহ সে স্পষ্টত দেখতে পায়। বিবেচনার শক্তির প্রখরতা ও বুদ্ধিদীপ্ততা তার মধ্যে এমনভাবে কাজ করে যে, তার কাছে তখন ইহ-পারলৌকিক যে কোন বিষয়ের কোনটি সঠিক আর কোনটি ভূল তা স্পষ্টতই ধরা পরে। ফলে সে কোন সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ইতস্তত, দুর্বলতা ও হীনমন্যতা ছাড়াই দিবালোকের মত সুস্পষ্ট ও সঠিক পথে চলতে সক্ষম হয়। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, “হে মু’মিনগণ ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর-তাকওয়া অর্জন কর এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি নিজ অনুগ্রহের দ্বিগুন প্রতিদান তোমাদেরকে দিবেন এবং তোমাদেরকে দিবেন জ্যোতি-আলো, যার সাহায্যে তোমরা পথ চলবে। সূরা হাদীদঃ২৮
অর্থাৎ তাকওয়া জীবনকে এমন এক সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করে, যা সকল প্রকার ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা, প্ররোচনা-প্রতারণা, প্রলভন-পদস্খলন থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখে। অন্ধকারাচ্ছন্ন গভীর সমুদ্রে কম্পাস বা দিক-দর্শন যন্ত্র যেমন সমুদ্রভিযাত্রীকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে, সমস্যা-সংকুল জীবন পথে তাকওয়াও তেমনি মানুষকে নির্ভূল পথের সন্ধান দেয়।
তাকওয়া একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। শিষ্টের লালন ও দুষ্টের দমন নীতির পরিচায়ক একটি শক্তি। ভালকে গ্রহণ করার তীব্র আগ্রহ এবং মন্দকে পরিহার করে চলার দৃঢ় মনোবলই হচ্ছে তাকওয়া। মানুষের সকল সৎগুণের সঞ্জীবনী শক্তি হচ্ছে তাকওয়া। এ ক্ষেত্রে তাকওয়ার অধিকারী ব্যক্তিদের ইতবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মকাণ্ডের বর্ণনা সম্বলিত নিম্নোক্ত আয়াতগুলো প্রণিধানযোগ্য। যেমন, “এ গ্রন্থ (আল কুরআন) পথ প্রদর্শণকারী পরহেযগারদের জন্য। পরহেযগার হচ্ছে তারা, যারা অদৃশ্য বিষয়ের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, নামায প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে; এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করে, সেসব বিষয়ের ওপর যা কিছু আপনার ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে, এবং যা কিছু আপনার পূর্ববর্তীদের ওপর অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং তারা আখিরাতের প্রতিও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে।” ২ : ২-৪।
সাওম কিভাবে তাকওয়া এনে দিবে?
মানুষের মাঝে ৩টি জিনিসের দাবী থাকে —
১। ক্ষুন্নিবৃত্তির দাবী (জীবন রক্ষার জন্য)
২। যৌন আবেগের দাবী
৩। শান্তি ও বিশ্রাম গ্রহণের দাবী
রোযা মানুষের আত্ম-সংযমের শক্তি সৃষ্টি করে, মানুষের খুদী বা আত্মজ্ঞান যখন দেহ ও অন্যান্য শক্তিসমূহকে পরিপুর্ণভাবে আয়ত্তাধীন করে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজের রুহের অধীন করে তখনই আত্মসংযম হয়। রোযার মাস আমাদের ট্রেনিং দেয় কিভাবে এই আত্মসংযম লাভ করা যায়।
- প্রত্যেক জিনিষের যাকাত বা পরিশুদ্ধি আছে। শরীরের পরিশুদ্ধি হচ্ছে রোযা। রোযা সবরের অর্ধেক। ইবনে মাজা
রাসূল সা. বলেছেন: মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন পাত্র ভর্তি করে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখার জন্য কয়েক গ্রাস খাবারই আদম সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তার চেয়েও যদি বেশী দরকার হয় তবে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে। আল জামে আত তিরমিযী: ২৩২১
জনৈক ব্যক্তি রাসূল সা.এর সামনে ঢেকুর (belching) তুলল। তিনি বলেন: আমাদের থেকে তোমার ঢেকুর বন্ধ কর। কেননা দুনিয়াতে যারা বেশী পরিতৃপ্ত হবে কিয়ামতের দিন তারাই সবচেয়ে বেশী ক্ষুধার্ত থাকবে।আল জামে আত তিরমিযী: ২৪২০
রাসূল সা. বলেছেন: মুসলমান একটি উদরপূর্ণ করে খায়। আর কাফের খায় সাতটি উদরপূর্ণ করে। সহীহ আল বুখারী: ৪৯৯৫
অলসতা দিয়ে শয়তান ইবাদাত থেকে দূরে রাখে। বেশী খাওয়া অলসতা আনার একটি কারন।
রাসূল সা. বলেছেন: তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে তার বিয়ে করা উচিত। কেননা বিয়ে চোখকে অবনতকারী ও গুপ্তাঙ্গের হেফাযতকারী। আর যে বিয়ে করতে সামর্থ নয় তার রোযা রাখা অবশ্য কর্তব্য। কেননা রোযা যৌন তাড়নাকে অবদমিত রাখে। সহীহ আল বুখারী: ১৭৭০
এখানে এই হাদীস থেকে বুঝা যায় রোযা মানুষের জৈবিক চাহিদাকে নিয়ন্ত্রন করে।
২:১৮৪ اَیَّامًا مَّعۡدُوۡدٰتٍ ؕ فَمَنۡ کَانَ مِنۡکُمۡ مَّرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ وَ عَلَی الَّذِیۡنَ یُطِیۡقُوۡنَهٗ فِدۡیَۃٌ طَعَامُ مِسۡکِیۡنٍ ؕ فَمَنۡ تَطَوَّعَ خَیۡرًا فَهُوَ خَیۡرٌ لَّهٗ ؕ وَ اَنۡ تَصُوۡمُوۡا خَیۡرٌ لَّکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
এগুলো গোনা কয়েক দিন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে। আর যাদের জন্য সিয়াম কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদইয়া- একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে তবে তা তার জন্য কল্যাণকর। আর সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণের যদি তোমরা জানতে।
বাক্যে উল্লেখিত রুগ্ন সে ব্যক্তিকে বুঝায়, সাওম রাখতে যার কঠিন কষ্ট হয় অথবা রোগ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।
( সফররত অবস্থায় সাওম না রাখা ব্যক্তির ইচ্ছা ও পছন্দের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সাহাবাগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরে যেতেন। তাদের কেউ সাওম রাখতেন আবার কেউ রাখতেন না। উভয় দলের কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে আপত্তি উঠাতেন না। [বুখারী: ১৯৪৭: মুসলিম: ১১১৬]
রুগ্ন বা মুসাফির ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় বা সফরে যে কয়টি সাওম রাখতে পারবে না, সেগুলো অন্য সময় হিসাব করে কাযা করা ওয়াজিব। এতে বলা উদ্দেশ্য ছিল যে, রোগজনিত কারণে বা সফরের অসুবিধায় পতিত হয়ে যে কয়টি সাওম ছাড়তে হয়েছে, সে কয়টি সাওম অন্য সময়ে পূরণ করে নেয়া তাদের উপর ফরয।
আয়াতের স্বাভাবিক অর্থ দাঁড়ায়, যেসব লোক রোগজনিত কারণে কিংবা সফরের দরুন নয়; বরং সাওম রাখার পূর্ণ সামর্থ থাকা সত্বেও সাওম রাখতে চায় না, তাদের জন্যও সাওম না রেখে সাওমের বদলায় ফিদইয়া দেয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সাথে সাথেই এতটুকু বলে দেয়া হয়েছে যে, সাওম রাখাই হবে তোমাদের জন্য কল্যাণকর।
উপরোক্ত নির্দেশটি ছিল ইসলামের প্রাথমিক যুগের, যখন লক্ষ্য ছিল ধীরে ধীরে লোকজনকে সাওমে অভ্যস্ত করে তোলা।
এরপর নাযিলকৃত আয়াত (فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ) এর দ্বারা প্রাথমিক এ নির্দেশ সুস্থ-সবল লোকদের ক্ষেত্রে রহিত করা হয়েছে। তবে যেসব লোক অতিরিক্ত বার্ধক্য জনিত কারণে সাওম রাখতে অপরাগ কিংবা দীর্ঘকাল রোগ ভোগের দরুন দূর্বল হয়ে পড়েছে, অথবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়েছে, সেসব লোকের বেলায় উপরোক্ত নির্দেশটি এখনো প্রযোজ্য রয়েছে।
সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সর্বসম্মত অভিমত তাই। সাহাবী সালামাহ ইবনুল আকওয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু- বলেন, যখন (وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ) শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আমাদেরকে এ মর্মে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল যে, যার ইচ্ছা হয় সে সাওম রাখতে পারে এবং যে সাওম রাখতে চায় না, সে ফিদইয়া দিয়ে দেবে। এরপর যখন পরবর্তী আয়াত (فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ) নাযিল হল, তখন ফিদইয়া দেয়ার ইখতিয়ার রহিত হয়ে সুস্থ-সমর্থ লোকদের উপর শুধুমাত্র সাওম রাখাই জরুরী সাব্যস্ত হয়ে গেল। [বুখারী ৪৫০৭, মুসলিম: ১১৪৫, আবু দাউদ: ২৩১৫, ২৩১৬ ও তিরমিযী: ৭৯৮]
২:১৮৫ شَهۡرُ رَمَضَانَ الَّذِیۡۤ اُنۡزِلَ فِیۡهِ الۡقُرۡاٰنُ هُدًی لِّلنَّاسِ وَ بَیِّنٰتٍ مِّنَ الۡهُدٰی وَ الۡفُرۡقَانِ ۚ فَمَنۡ شَهِدَ مِنۡکُمُ الشَّهۡرَ فَلۡیَصُمۡهُ ؕ وَ مَنۡ کَانَ مَرِیۡضًا اَوۡ عَلٰی سَفَرٍ فَعِدَّۃٌ مِّنۡ اَیَّامٍ اُخَرَ ؕ یُرِیۡدُ اللّٰهُ بِکُمُ الۡیُسۡرَ وَ لَا یُرِیۡدُ بِکُمُ الۡعُسۡرَ ۫ وَ لِتُکۡمِلُوا الۡعِدَّۃَ وَ لِتُکَبِّرُوا اللّٰهَ عَلٰی مَا هَدٰىکُمۡ وَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ
রমাদান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হিদায়তের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূর্ণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
রমযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার অর্থ এই নয় যে, কোন এক রমযানে পূর্ণ কুরআনকে নাযিল করে দেওয়া হয়েছে; বরং এর অর্থ এই যে, রমযানের কদরের রাতে ‘লাওহে মাহফূয’ থেকে নিকটের আসমানে পূর্ণ কুরআন একই সাথে অবতীর্ণ করা হয় এবং সেখানে ‘বায়তুল ইয্যাহ’তে রেখে দেওয়া হয়। ওখান থেকে ২৩ বছরের নবুঅতী জীবনে প্রয়োজনের তাকীদে এবং অবস্থা অনুপাতে কিছু কিছু করে অবতীর্ণ হতে থাকে। (ইবনে কাসীর) সুতরাং এ রকম বলা যে, কুরআন রমযান মাসে অথবা কদরের রাতে কিংবা পবিত্র বা বরকতময় রাতে অবতীর্ণ হয়েছে, সবই সঠিক। কারণ, ‘লাউহে মাহফূয’ থেকে তো রমযান মাসেই নাযিল করা হয়েছে। সূরা বুরুজে ইরশাদ হয়েছে–
﴿بَلْ هُوَ قُرْآنٌ مَّجِيدٌ﴾
২১) ( তোমার মিথ্যা আরোপ করায় এ কুরআনের কিছু আসে যায় না৷)
﴿فِي لَوْحٍ مَّحْفُوظٍ﴾
২২) বরং এ কুরআন উন্নত মর্যাদা সম্পন্ন , সংরক্ষিত ফলকে লিপিবদ্ধ৷
ইবনে মানযুর বলেন:لوح (লাওহ): “কাঠের প্রশস্ত যে কোন পৃষ্ঠকে লাওহ বলে।”
আযহারি বলেন: কাঠের পৃষ্ঠকে লাওহ বলা হয়। কাঁধের হাড়ের ওপর যদি কিছু লেখা হয় সেটাকেও লাওহ বলা হয়।যেটার উপর কিছু লেখা হয় সেটাই লাওহ। اللوح দ্বারা উদ্দেশ্য- اللوح المحفوظ (সুরক্ষিত ফলক)। যেমনটি আয়াতে কারীমাতে এসেছে فِي لَوْحٍ مَحْفُوظ (অর্থ- সুরক্ষিত ফলকে রয়েছে)। অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলার ইচ্ছাসমূহের সংরক্ষণাগার।
প্রত্যেক প্রশস্ত হাড্ডিকে লাওহ বলা হয়। শব্দটির বহুবচন হচ্ছে- ألواح আর ألاويح হচ্ছে-جمع الجمع (বহুবচনের বহুবচন)।
দুই: ইবনে কাছির (রহঃ) বলেন:فِي لَوْحٍ مَحْفُوظ (অর্থ-লাওহে মাহফুযে তথা সুরক্ষিত ফলকে রয়েছে): অর্থাৎ এটি উচ্চ পরিষদ কর্তৃক সংযোজন, বিয়োজন, বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে সংরক্ষিত।[তাফসিরে ইবনে কাছির (৪/৪৯৭, ৪৯৮]
তিন: ইবনুল কাইয়্যেম (রহঃ) বলেন:
আল্লাহ্র বাণী: مَحْفُوظ (সংরক্ষিত): অধিকাংশ ক্বারীগণ শব্দটিকে لوح শব্দের صفة হিসেবে جَرّ দিয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, শয়তানদের পক্ষে কুরআন নিয়ে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। কারণ কুরআন যে স্থানে রয়েছে সে স্থানটি শয়তান সেখানে পৌঁছা থেকে সংরক্ষিত। এবং কুরআন নিজেও সংরক্ষিত; কোন শয়তান এতে সংযোজন-বিয়োজন করার ক্ষমতা রাখে না।
তাইতো আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বাণীতে কুরআনকে সংরক্ষিত উল্লেখ করেছেন: “নিশ্চয় আমরা স্মরণিকাটি নাযিল করেছি। নিশ্চয় আমরা এর হেফাযতকারী”।[সূরা হিজর, আয়াত: ০৯] আর এ সূরাতে আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে কারীম যে স্থানে রয়েছে সে স্থানকেও সংরক্ষিত উল্লেখ করেছেন।
এভাবে আল্লাহ্ তাআলা কুরআন যে আধারে রয়েছে সে আধার সংরক্ষণ করেছেন এবং কুরআনকেও যাবতীয় সংযোজন, বিয়োজন ও পরিবর্তন থেকে হেফাযত করেছেন। কুরআনের শব্দাবলি যেভাবে হেফাযত করেছেন অনুরূপভাবে কুরআনের অর্থকেও বিকৃতি থেকে হেফাযত করেছেন। কুরআনের কল্যাণে এমন কিছু ব্যক্তিকে নিয়োজিত করেছেন যারা কোন প্রকার বাড়তি বা কমতি ছাড়া কুরআনের হরফগুলো মুখস্ত রাখে এবং এমন কিছু ব্যক্তি নিয়োজিত করেছেন যারা কুরআনের অর্থকে বিকৃতি ও পরিবর্তন থেকে হেফাযত করে।”[দেখুন: আত-তিবইয়ান ফি আকসামিল কুরআন, পৃষ্ঠা-৬২]
চার:কিছু কিছু তাফসিরে এসেছে যে, ‘লওহে মাহফুয’ হচ্ছে- ইস্রাফিলের কপালে; অথবা সবুজ রঙের মণি দিয়ে তৈরী এক প্রকার সৃষ্টি; কিংবা এ জাতীয় অন্যান্য ব্যাখ্যা— এসব বক্তব্য সাব্যস্ত নয়। এটি অদৃশ্যের বিষয়। যার কাছে ওহী আসত তিনি ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে গায়েব বা অদৃশ্যের ব্যাপারে কোন তথ্য গ্রহণ করা যাবে না। আল্লাহ্ই ভাল জানেন। সূত্র: শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
আল্লাহ তাআলা বলেন:
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ
“রমযান মাস হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।” (সূরা বাকারা: ১৮৫)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মাহে রামাযানকে কুরআন নাজিলের মাস হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
এর ব্যাখ্যায় মুফসসিরগণ বলেন, দুটি কারণে রামাযান মাসকে কুরআন নাযিলের মাস বলা হয়। যথা:
❖ ক. আল্লাহ তাআলা রামাযান মাসের কদরের রাতে ৭ম আসমানে অবস্থিত লাওহে মাহফুয থেকে শেষ আসমানে অবস্থিত বাইতুল ইযযতে পূরো কুরআন অবতীর্ণ করেন। তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন ঘটনা ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট আল কুরআন অবর্তীণ হয়।
❖ খ. রামাযান মাসের কদরের রাতে মক্কার হেরা পর্বতে অবস্থানকালীন সময়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর কুরআন নাযিলের সূচনা হয়। এ সময় নাযিল হয় সূরা আলাক এর ১ম ৫টি আয়াত। তারপর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে ক্রমান্বয়ে পূরো কুরআন নাজিল হয়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
আল্লাহু আলাম ▬▬▬▬▬▬▬▬আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব।
রামাদান কুর’আন নাযিলের মাস
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন, কোরআন পাওয়ার ফলে আমাদের আনন্দ করা প্রয়োজন।
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ
﴿قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ
হে মানুষ! তোমাদের কাছে তোমাদের মালিকের পক্ষ থেকে নসীহত (বিশিষ্ট কিতাব) এসেছে, মানুষের অন্তরে যে সব ব্যাধি রয়েছে, (এটা) তার প্রতিকার এবং মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত।
হে নবী, বলুন, মানুষের উচিত আল্লাহর এই অনুগ্রহ ও রহমতের কারণে আনন্দ প্রকাশ করা, কারণ এটা সেই সব জিনিষ হতে উত্তম তারা যা কিছু (জ্ঞান ও সম্পদ) জমা করেছে। সূরা ইউনুস: ৫৭-৫৮
কিন্তু আমরা কি সেইভাবে মনের মাঝে আনন্দ অনুভব করি এবং আমার মহান রবের কাছ থেকে পাওয়া উপদেশ যা আমার জীবনের জন্যই প্রয়োজন তা বুঝার জন্য কতটুকু উদ্যোগী হই?
আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
অতঃপর আমার নিকট থেকে যে জীবন বিধান তোমাদের নিকট পৌঁছুবে যারা আমার সেই বিধান মেনে চলবে তাদের জন্য কোন চিন্তা ও ভাবনার কোন কারণ থাকবে না। সূরা আল বাকারা: ৩৮
(এই) সেই (মহান) গ্রন্থ আল কুর’আন তাতে কোন সন্দেহ নেই, যারা আল্লাহ তা’লাকে ভয় করে, এই কিতাব তাদের জন্যই ভয় প্রদর্শক। সূরা আল বাকারা: ২
যে উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য এই নিয়ামতটি (কুর’আন) দান করা হয়েছিল তাকে পুর্ণ করার জন্য নিজেকে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত করা দরকার। কুর’আন আমাদেরকে এই উদ্দেশ্যে দান করা হয়েছে যে, আমরা এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তষ্টির পথ জেনে নিয়ে নিজেরা সেই পথে চলবো এবং অন্যদেরকেও সেই পথে চলার আহবান জানাবো। এভাবে নিজেদের তৈরী করার সর্বাত্মক মাধ্যম হচ্ছে রোযা। মহান আল্লাহ বলেছেন:
হা-মীম। এই সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, আমি এটি এক বরকত ও কল্যাণময় রাতে নাযিল করেছি। কারণ, আমি মানুষকে সতর্ক করতে চেয়েছিলাম। এটি ছিল সেই রাত – যাতে প্রত্যেকটি ব্যাপারের বিজ্ঞতাসূচক ফয়সালা আমাদের নির্দেশে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সূরা আদ দুখান: ১-৫
আমরা এটি (কুর’আন) কদরের রাতে নাযিল করেছি। তুমি কি জান ক্বদরের রাত কি? ক্বদরের রাত্রি হাজার মাস হতে উত্তম। ফেরেশতা ও রূহ এই রাত্রিতে তাদের আল্লাহর অনুমতিক্রমে সব হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হয়। সেই রাত্রি পুরোপরি শান্তি ও নিরাপত্তার – ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। সূরা আল ক্বদর: ১-৫
﴿كِتَابٌ أَنزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِّيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ
এটি এক বহু বরকতসম্পন্ন কিতাব যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যেন লোকেরা এর আয়াতগুলো সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে এবং জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন লোকেরা তা হতে সতর্কবাণী গ্রহণ করে।সূরা সা’দ: ২৯
তোমাদের কাছে আল্লাহর কাছ থেকে রৌশনী এসেছে, এমন একখানি সত্য প্রদর্শনকারী কিতাব যা দিয়ে আল্লাহ তা’লা তাঁর সন্তোষ সন্ধানকারী লোকদেরকে শান্তি ও নিরাপত্তার পথ বলে দেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং সঠিক পথে তাদেরকে পরিচালিত করেন।সূরা আল মায়িদা: ১৫-১৬
মহান আল্লাহর এই কথাগুলো অবশ্যই সত্য। আসলেই কেউ যখন কুর’আন নাযিলের ইতিহাস পড়ে দেখবেন এবং অতীতে যারা কুর’আন বিশ্বাস করেছিলেন তাদের ওপর কুর’আনের কি প্রভাব পড়েছিল সে সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করবেন, তখন যে কেউ অনুধাবন করবেন যে কুর’আনের উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত কথাগুলো তাঁদের জীবনে বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই সাহাবারা রা. বাস্তব ময়দানে থেকে কুর’আনকে উপলব্ধি করেছিলেন ও আমল করে দেখিয়ে গিয়েছেন। আজ আমরা প্রিয় নবী সা. এর মহব্বতের কথা বলে মীলাদ ও কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছি, কিন্তু নিজের জীবন চরিতকে মিলিয়ে দেখছি না সেই পরশ পাথরের সাথে। আজ নবীর সা. প্রতি কটাক্ষকারীদের ব্যাপারে যতটুকু অসহনীয়তা দেখিয়ে রাস্তায় নেমে আসি অথচ প্রতিনিয়ত নবীর সা. আদর্শের পরিপন্থী কাজ দেখেও নিরবে দুনিয়ার ভোগ বিলাসে নিমগ্ন রয়েছি বা নিজেই আদর্শহীনতায় লিপ্ত হচ্ছি। দুঃখ হলেও সত্য আজ আমাদের মাঝে কুর’আন আছে কিন্তু সাহাবাদের রা. মতো প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণকারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে। তাই আমাদের আজ এতো দুর্দশা।
- অনেকে কুর’আন পড়েন কিন্তু অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক দিকগুলো অবজ্ঞা করে গৌণ দিকগুলো প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
- অনেকে কুর’আনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সনাক্ত করতে ও বুঝতে ব্যর্থ হন ফলে কুর’আন পড়েন কিন্তু কুর’আন যা চায় তা সেখান থেকে গ্রহণ করতে পারেন না।
- সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি সহকারে কুর’আনের নিকটবর্তী হতে পারেন না ফলে এই কিতাব যা শিক্ষা দেয় এবং সেই শিক্ষা কিভাবে মানবকূলকে প্রভাবিত করতে পারে এই দুয়ের মাঝে যোগসূত্র করতে ব্যর্থ হন।
- অনেকে কুর’আনের যথাযথ ব্যাখ্যা না পড়ার কারণে সঠিক ও শুদ্ধ শিক্ষা লাভ করতে ব্যর্থ হন।
- মূলত কুর’আনকে বুঝার জন্য প্রয়োজন আরবী ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান। কুর’আনিক আরবী ব্যাকরন শিক্ষার সুযোগ করে নেয়া অতীব জরুরী। কুরআনের অলঙ্কার, ছন্দ ও তথ্যের উপস্থাপন এমন যে, সেটা বুঝতে হলে আরবী ভাষাতেই বুঝতে হবে।
আলজিরিয়া দখলের শতবর্ষ পূর্তিতে ফরাসী ঔপনিবেশিক গভর্ণর বলেছিলেন, যদি আমরা তাদের উপর বিজয়ী হতে চাই তবে তাদের মাঝ থেকে আরবী কুর’আন সরিয়ে ফেলা এবং তাদের জিহবা থেকে আরবী ভাষা সরিয়ে ফেলা এক অবশ্য করণীয় কর্তব্য।
মুসলিম জীবনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে কেবল কুর’আনকে সরিয়ে নিলেই অর্থাৎ জীবনের সকল কর্মকাণ্ড যে কুর’আনকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সেটার অবসান ঘটাতে পারলেই ইসলামের শত্রুদের মূখ্য কাজ সমাধা হবে।
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
আমরা এই কুর’আনকে উপদেশ গ্রহণের জন্য সহজ মাধ্যম বানিয়েছি। এ হতে উপদেশ গ্রহণের কেউ আছে কি? সূরা আল ক্বামার: ১৭
যে কুর’আন কষ্ট করে পড়ে তার জন্য দু’টি পুরষ্কার:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: কুর’আন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি (আখেরাতে) সম্মানিত নেককার লিপিকার ফেরেশতাদের সাথে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কুর’আন পড়ে এবং এটা তার পক্ষে খুবই কঠিন ও কষ্টকর, সে দু’টি পুরস্কার পাবে। সহীহ আল বুখারী, তিরমিযী: ২৮৩৯
যে কুর’আন বুঝে পড়তে সময় দেয় তার পুরষ্কার উত্তম:
রাসূল সা. বলেছেন: মহান রাব্বুল ইজ্জত বলেন, কোরআন (চর্চার ব্যস্ততা) যাকে আমার যিকির ও আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করতে বিরত রেখেছে আমি তাকে আমার কাছে যারা চায় তাদের চেয়ে অনেক উত্তম পুরস্কার দিব। সব কালামের উপর আল্লাহর কালামের মর্যাদা এত অধিক যত অধিক আল্লাহর মর্যাদা তাঁর সকল সৃষ্টির উপর। জামে আত তিরমিযী: ২৮৬১
আল্লাহ সুবহান বলেছেন: আর যে ব্যক্তি আমার যিকির (উপদেশমালা) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য হবে দুনিয়ায় সংকীর্ণ জীবন এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাবো অন্ধ করে। সে বলবে, “হে আমার রব! দুনিয়ায় তো আমি চক্ষুষ্মান ছিলাম কিন্তু এখানে আমাকে অন্ধ করে উঠালে কেন? আল্লাহ বলবেন, “হাঁ, এভাবেই তো আমার আয়াত যখন তোমার কাছে এসেছিল, তুমি তখন তাকে ভুলে গিয়েছিলে এবং সেভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হচ্ছে – এভাবেই আমি সীমালংঘনকারী এবং নিজের রবের আয়াত অমান্যকারীকে (দুনিয়ায়) প্রতিফল দিয়ে থাকি। আর আখেরাতের আযাব বেশী কঠিন এবং বেশীক্ষণ স্থায়ী। সূরা আত ত্বাহা: ১২৪-১২৭
যার অন্তরে কুর’আনের কিছুই নেই সে পরিত্যক্ত ঘরতুল্য। জামে আত তিরমিযী: ২৮৫০
তোমার মালিকের পক্ষ থেকে সত্য বাণী নিয়েই এই গ্রন্থ (আল কুর’আন) নাযিল করা হয়েছে, অতএব তুমি কখনো সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। ন্যায় ও ইনসাফের আলোকে তোমার মালিকের কথাগুলো পরিপূর্ণ এবং তাঁর এ কথার পরিবর্তন করার কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। সূরা আল আন’আম: ১১৪-১১৫
বুঝে পড়ার সাথে সাথে অত্যন্ত জরুরী বিষয় হচ্ছে কুর’আনকে নিজের মধ্যে আত্মীকরণ করা, কুর’আনের সাথে মন ও রূহের সম্পর্ক গভীর করা এবং লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলা।
আল কুর’আনে আল্লাহ বলেছেন:
প্রকৃত ঈমানদারতো তারাই যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে কেঁপে উঠে। আর আল্লাহর আয়াত যখন তাদের সামনে পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। তারা তাদের আল্লাহর উপর আস্থা এবং নির্ভরতা রাখে। সূরা আল আনফাল: ২
তাই কুর’আন তেলাওয়াতে, অধ্যয়নে আমাদের গোটা দেহ ও মন নিয়ে পুরোপুরিভাবে জড়িত হতে হবে। কেবলমাত্র এভাবেই আমরা আমাদের সত্ত্বাকে উন্নীত করতে পারি কুর’আনের কাংখিত স্তরে, যেখানে পৌঁছলে আমরা সত্যিকারের বিশ্বাসী হিসাবে অভিহিত হবো। মহান আল্লাহ বলেছেন:
আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি, তারা তা যথোপযুক্তভাবে পড়ে, তারা তার প্রতি নিষ্ঠা সহকারে ঈমান আনে। তার প্রতি যারা কুফরী করে মূ্লতঃ তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। সূরা আল বাকারা: ১২১
রমাদান বলতে কী বুঝায়?
উত্তর আলহামদু লিল্লাহ।.
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। রমাদান: আরবি বার মাসের একটি মাস। এ মাসটি ইসলাম ধর্মে সম্মানিত। অন্য মাসগুলোর তুলনায় এ মাসের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা রয়েছে। যেমন :
১. আল্লাহ তাআলা এ মাসে রোজা পালন করাকে ইসলামের চতুর্থ রুকন হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহতা‘আলা বলেন :
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْه) [ 2 البقرة : 185]
“রমাদান মাস এমন মাস যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে; মানবজাতির জন্য হিদায়েতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে। সুতরাং তোমাদের মাঝে যে ব্যক্তি এই মাস পাবে সে যেন রোজা পালন করে।”[সূরা আল-বাক্বারাহ : ১৮৫]
وثبت في الصحيحين البخاري ( 8 ) ، ومسلم ( 16 ) من حديث ابن عمر أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ” بني الإسلام على خمس شهادة أن لا إله إلا الله , وأن محمدا عبد الله ورسوله , وإقام الصلاة , وإيتاء الزكاة ، وصوم رمضان , وحج البيت” .
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম -এ ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ইসলাম পাঁচটি খুঁটির উপর নির্মিত।
(১) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ (উপাস্য) নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল (২) সালাত কায়েম (প্রতিষ্ঠা) করা (৩) যাকাত প্রদান করা (৪) রমজান মাসে রোজাপালনকরাএবং (৫) বায়তুল্লাহ শরিফেরহজ্জআদায় করা”।
২. আল্লাহ তাআলা এইমাসে কুরআন নাযিল করেছেন। যেমনটি তিনি ইতিপূর্বে উল্লেখিত আয়াতে বলেছেন:
(شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدىً لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ ) [ 2 البقرة : 185]
“রমজান মাস এমন মাস যে মাসেকুরআন নাযিল করা হয়েছে; মানবজাতির জন্য হিদায়েতের উৎস, হিদায়াত ও সত্য মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে। [ সূরা আল-বাক্বারা: ১৮৫]
তিনি আরও বলেছেন :
(إنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ)[ 97 القدر: 1]
“নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআনকে) লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি।” সূরা আল-ক্বাদ্র:১
৩. আল্লাহ তাআলা এ মাসে লাইলাতুল কদর বা ভাগ্য রজনী রেখেছেন।যে রাত্রি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
( إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ . وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ . لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ . تَنَزَّلُ الْمَلائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ . سَلامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ) [97 القدر: ١ – ٥]
নিশ্চয়ই আমি এটা (কুরআন) লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি। আপনি কি জানেন- লাইলাতুল কদরকি? লাইলাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এই রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরীল আলাইহিস সালাম) তাঁদের রবের অনুমতিক্রমে সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে অবতরণ করেন। ফজরের সূচনা পর্যন্ত শান্তিময়।”[ আল-ক্বদর :১-৫]
তিনি আরও বলেছেন :
( إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ ) [ 44 الدخان: 3]
“নিশ্চয়ই আমি এটা (কুরআন) এক মুবারকময় (বরকতময়) রাতে নাযিল করেছি।নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী।”[ আদ-দুখান : ৩]
আল্লাহতা‘আলা রমজান মাসকে লাইলাতুল কদর দিয়ে সম্মানিত করেছেন। আর এই বরকতময় রাতের মর্যাদা বর্ণনায় সূরাতুল কদর নাযিল করেছেন।এ ব্যাপারে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“তোমাদের কাছে রমজান উপস্থিত হয়েছে। এক বরকতময় মাস। আল্লাহ তোমাদের উপর এমাসে সিয়াম পালন করা ফরজ করেছেন। এমাসে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এমাসে অবাধ্য শয়তানদের শেকলবদ্ধ করা হয়। এ মাসে আল্লাহ এমন একটি রাত রেখেছেন যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হল সে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন নাসা’ঈ (২১০৬) ও ইমাম আহমাদ (৮৭৬৯) এবং শাইখ আলবানী ‘সহীহুততা্রগীব’ (৯৯৯) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন]
আর আবু হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতযে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের আশায় লাইলাতুল ক্দর বা ভাগ্য রজনীতে নামাজ আদায় করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (১৯১০) ও মুসলিম (৭৬০)]
৪. আল্লাহ তাআলা এই মাসে ঈমান সহকারে ও প্রতিদানের আশায় সিয়াম ও ক্বিয়াম পালন (রোজা ও নামাজ আদায়) করাকে গুনাহ মাফের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেমনটি সহীহ বুখারী (২০১৪) ও সহীহ মুসলিম (৭৬০) -এ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামবলেছেন:“যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমান সহকারে ও সওয়াবের আশায় রোজা পালন করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”এবং সহীহ বুখারী (২০০৮) ও সহীহ মুসলিম (১৭৪)-এ আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে আরও বর্ণিত হয়েছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমান সহকারে ও সওয়াবের আশায় নামায আদায় করবে তার অতীতের সব গুনাহমাফ করে দেয়া হবে।”
মুসলিমগণ এ ব্যাপারে ইজমা (ঐকমত্য) করেছেন যে, রমজান মাসে রাতের বেলা ক্বিয়াম পালন (নামায আদায় করা) সুন্নত। ইমাম নববী উল্লেখ করেছেন: “রমজান মাসে ক্বিয়াম করার অর্থ তারাবীর নামায আদায় করা। অর্থাৎ তারাবীর নামায আদায়ের মাধ্যমে ক্বিয়াম করার উদ্দেশ্য সাধিত হয়।”
৫.আল্লাহ তাআলা এই মাসে জান্নাতগুলোর দরজা খোলা রাখেন, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ রাখেন এবং শয়তানদেরকে শেকলবদ্ধ করেন। যেমনটি দুই সহীহ গ্রন্থ সহীহ বুখারী (১৮৯৮) ও সহীহ মুসলিম (১০৭৯)-এ আবু হুরায়রা (রাঃ) এর হাদিস হতে সাব্যস্ত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যখন রমজান আগমন করে তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শেকলবদ্ধ করা হয়।”
৬. এ মাসের প্রতিরাতে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে তাঁর বান্দাদের মুক্ত করেন। ইমাম আহমাদ (৫/২৫৬) আবু উমামাহ -এর হাদিস থেকে বর্ণনা করেছেন যে,নবী সাল্লাল্লাহু‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“প্রতিদিন ইফতারের সময় আল্লাহ কিছু বান্দাকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্ত করেন।”আল-মুনযিরী বলেছেন হাদিসটির সনদে কোন সমস্যা নেই। আলবানী‘সহীহুততারগীব’(৯৮৭) – গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন। বাযযার (কাশফ৯৬২) আবু সা’ঈদের হাদিস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনিবলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা রমজান মাসে প্রতি দিনে ও রাতে কিছু বান্দাকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তি দেন। আর নিশ্চয় একজন মুসলিমের প্রতি দিনে ও রাতে কবুল যোগ্য দুআ’ রয়েছে।”
৭. রমজান মাসে সিয়াম পালন পূর্ববর্তী রমজান থেকে কৃত গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয়; যদি কবিরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা হয়। যেমনটি প্রমাণিত হয়েছে ‘সহীহ মুসলিম’ (২৩৩)-এ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:“পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে অপর জুমা, এক রমজান থেকে অপর রমজান এদের মধ্যবর্তী গুনাহসমূহের জন্য কাফফারা হয়ে যায়; যদি কবিরা গুনাহ থেকে বিরত থাকা হয়।”
৮. এই মাসে সিয়াম পালন বছরের দশমাস সিয়াম পালন তুল্য। সহীহ মুসলিম (১১৬৪)-এআবু আইয়ূব আনসারীর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম পালন করল, এরপর শাওয়াল মাসেও ছয়দিন রোজা রাখল সে যেন সারা বছর রোজা পালন করল”।
ইমাম আহমাদ (২১৯০৬)বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:“যে ব্যক্তি রমজান মাসে সিয়াম পালন করল- রমজানের একমাস রোজা দশমাস রোজা রাখার সমতুল্য। আর ঈদুল ফিত্বরের পর (শাওয়াল মাসের) ছয় দিন রোজা রাখলেযেন গোটা বছরের রোজা হয়ে গেল।”
৯. এই মাসে যে ব্যক্তি ইমামের সাথে ইমাম যতক্ষণ নামায পড়েন ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামুল লাইল (তারাবী নামায) আদায় করবে সে ব্যক্তি সারা রাত নামায পড়ার সওয়াব পাবে।
দলিল হচ্ছে- আবু দাউদ (১৩৭০) ও অন্যান্য মুহাদ্দিস আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহুথেকে হাদিস বর্ণনা করেন তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ইমাম নামায শেষ করা পর্যন্ত ইমামের সাথে কিয়াম করবে তার জন্য সারারাত কিয়াম করার সওয়াব লেখা হবে।”আলবানী ‘সালাতুত তারাবী’ গ্রন্থ (পৃঃ ১৫) –এ হাদিসকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন।
১০. এই মাসে উমরা আদায় করা হজ্জ করার সমতুল্য। ইমামবুখারী (১৭৮২) ওমুসলিম (১২৫৬) ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন:রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক আনসারী মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন:“কিসে আপনাকে আমাদের সাথে হজ্জ করতে বাধা দিল?”মহিলা বললেন:“আমাদের পানি বহনকারী শুধু দুটো উট ছিল।”তাঁর স্বামী ও পুত্র একটি পানি বহনকারী উটে চড়ে হজ্জে গিয়েছিলেন।তিনি বললেন:“আর আমাদের পানি বহনের জন্যএকটি পানি বহনকারী উট রেখে গিয়েছেন।”তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:“তাহলে রমজান এলে আপনি উমরা আদায় করুন। কারণ এ মাসে উমরা করা হজ্জ করার সমতুল্য।” সহীহ মুসলিমের রেওয়ায়েতে আছে: “……আমার সাথে হজ্জ করার সমতুল্য।”
১১. এ মাসে ইতিকাফ করা সুন্নত। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমজানে ইতিকাফ করেছেন। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে আয়েশা রাদিয়াল্লাহুআনহা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রমজান মাসের শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করেছেন।[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (১৯২২) ও মুসলিম (১১৭২)]
১২. রমজান মাসে পারস্পারিক কুরআন তেলাওয়াত ও ব্যক্তিগতভাবে বেশি বেশি তেলাওয়াত করা তাগিদপূর্ণ মুস্তাহাব্ব।মুদারাসা বা পারস্পারিক তেলাওয়াত বলতে বুঝায় একজন তেলাওয়াত করা অন্যজন সেটা শুনা। আবার দ্বিতীয়জন তেলাওয়াত করা এবং প্রথমজন সেটা শুনা।এই পারস্পারিক তেলাওয়াত মুস্তাহাব্ব হওয়ার দলীল হলো:
أَنَّ جِبْرِيلَ كَانَ يَلْقَى النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ ” رواه البخاري ( 6 ) ومسلم ( 2308 )
“জিবরাইল (আঃ)রমজান মাসে প্রতি রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং পরস্পর কুরআন তেলাওয়াত করতেন।”[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী (৬) ও মুসলিম (২৩০৮)]
যে কোন সময় কুরআন তেলাওয়াত করা মুস্তাহাব। আর রমজানে এটি আরো বেশি তাগিদপূর্ণ মুস্তাহাব।
১৩. রমজান মাসে রোজাদারকে ইফতার খাওয়ানো মুস্তাহাব্ব।এর দলীল হচ্ছে-যায়েদ ইবনে খালিদ আল-জুহানী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم : ” مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا كَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ , غَيْرَ أَنَّهُ لا يَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَيْئًا ” رواه الترمذي (807) وابن ماجه ( 1746 ) وصححه الألباني في صحيح الترمذي (647).
“যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে সে ব্যক্তি রোজাদারের সমতুল্য সওয়াব পাবে।কিন্তু সেই রোজাদারের সওয়াবের কোন কমতি করা হবে না”।[হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম তিরমিযী (৮০৭) ও ইবনে মাজাহ (১৭৪৬)। শাইখ আলবানী ‘সহীহুত তিরমিযী’(৬৪৭) গ্রন্থে হাদিসটিকে সহীহ আখ্যায়িত করেছেন]দেখুন প্রশ্ন নং (12598)
আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন। সূত্র: ইসলাম জিজ্ঞাসা ও জবাব
রামাদান মাস কেন এতো সম্মানিত
রামাদান বিশেষ মাস বলে সম্মানিত লাভ যে কারণে তা হলো:
- নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী হওয়ার উপায়
- পথ নির্দেশিকা আল কুর’আন নাযিল
- তাকওয়া অর্জনের জন্য রোযা ফরয
- আত্মশুদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের মাস
- বিশেষ রজনী কদরের রাত – ভাগ্যরজনী এটাই।
- সারা বিশ্বে একই সময় এই ইবাদাত ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও ঐক্যের শিক্ষা দেয়
আর ‘লাইলাতুল কদর’ (কদরের রাত) ও ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ পবিত্র বা বরকতময় রাত একটাই রাত। অর্থাৎ, তা হল শবেকদর। আর শবেকদর রমযান মাসেই আসে। কারো কারো নিকট এর তাৎপর্য হল, রমযান মাসে কুরআন নাযিল আরম্ভ হয় এবং হিরা গুহায় প্রথম অহীও রমযান মাসেই আসে। তাই এইদিক দিয়ে কুরআন মাজীদ এবং রমযান মাসের পারস্পরিক সম্পর্ক অতি গভীর। আর এই জন্যই নবী করীম (সাঃ) এই পবিত্র মাসে জিবরীল (আঃ)-এর সাথে কুরআন পুনরাবৃত্তি করতেন এবং যে বছরে তাঁর মৃত্যু হয়, সে বছর তিনি (সাঃ) জিবরীলের সাথে দু’বার কুরআন পুনরাবৃত্তি করেন। রমযানের (২৩, ২৫, ২৭ এই) তিন রাত তিনি সাহাবাদেরকে নিয়ে জামাআতের সাথে নামাযও পড়েন। যাকে এখন তারাবীহর নামায বলা হয়। (সহীহ তিরমিযী ও সহীহ ইবনে মাজা আলবানী) এই তারাবীহর নামায বিতর সহ ১১ রাকআতই ছিল, যার বিশদ বর্ণনা জাবের (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে (কিয়ামুল্লাইল, মারওয়াযী ইত্যাদিতে) এবং আয়েশা (রাযীআল্লাহু আনহা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে (সহীহ বুখারীতে) বিদ্যমান রয়েছে। নবী করীম (সাঃ)-এর ২০ রাকআত তারাবীহ পড়ার কথা কোন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। তবে যেহেতু কোন কোন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) থেকে ১১ রাকআতের বেশী পড়া প্রমাণিত, সেহেতু কেবল নফলের নিয়তে ২০ রাকআত এবং তার থেকে কম ও বেশী পড়া যেতে পারে।
এই একটি মাত্র বাক্যে সাওম সম্পর্কিত বহু হুকুম-আহকাম ও মাসআলা-মাসায়েলের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। شَهِدَ শব্দটি شُهُوْدٌ থেকে গঠিত। এর অর্থ উপস্থিত ও বর্তমান থাকা। আরবী অভিধানে الشَّهر অর্থ মাস। এখানে অর্থ হলো রমাদান মাস। কাজেই বাক্যটির অর্থ দাঁড়াল এই যে, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রমাদান মাসে উপস্থিত থাকবে, অর্থাৎ বর্তমান থাকবে, তার উপর রমাদান মাসের সাওম রাখা কর্তব্য”। ইতঃপূর্বে সাওমের পরিবর্তে ফিদইয়া দেয়ার যে সাধারণ অনুমতি ছিল এ বাক্যের দ্বারা তা মনসুখ বা রহিত করে দিয়ে সাওম রাখাকেই ওয়াজিব বা অপরিহার্য কর্তব্য করে দেয়া হয়েছে। রমাদান মাসে উপস্থিত বা বর্তমান থাকার মর্ম হলো রমাদান মাসটিকে এমন অবস্থায় পাওয়া, যাতে সাওম রাখার সামর্থ্য থাকে।
আয়াতে রুগ্ন কিংবা মুসাফিরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে যে, সে তখন সাওম না রেখে বরং সুস্থ হওয়ার পর অথবা সফর শেষ হওয়ার পর ততদিনের সাওম কাযা করে নেবে, এ হুকুমটি যদিও পূর্ববর্তী আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছিল, কিন্তু এ আয়াতে যেহেতু সাওমের পরিবর্তে ফিদইয়া দেয়ার ঐচ্ছিকতাকে রহিত করে দেয়া হয়েছে, কাজেই সন্দেহ হতে পারে যে, হয়ত রুগ্ন কিংবা মুসাফিরের বেলায়ও হুকুমটি রহিত হয়ে গেছে। সুতরাং এখানে তার পুনরোল্লেখ করা হয়েছে। [মাআরিফুল কুরআন]
রমযানের রোযা না-রাখাকে বৈধকারী অজুহাতগুলো কি কি?
উত্তর
আলহামদু লিল্লাহ।.
নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য সহজীকরণ হচ্ছে, তিনি শুধুমাত্র তাদের উপর রোযা রাখা ফরয করেছেন যাদের রোযা রাখার সক্ষমতা আছে এবং শরিয়ত অনুমোদিত ওজরের ভিত্তিতে রোযা না-রাখাকেও বৈধ করেছেন। যেসব শরয়ি ওজরের কারণে রোযা না-রাখা বৈধ সেগুলো হচ্ছে:
এক: রোগ:
রোগ মানে হচ্ছে, এমন সব অবস্থা যার কারণে ব্যক্তি সুস্থতার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়।
ইবনে কুদামা বলেন: রোগের কারণে রোযা না-রাখা বৈধ হওয়া মর্মে আলেমগণের ইজমা সংঘটিত হয়েছে। দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: “আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ থাকবে অথবা সফরে থাকবে সে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূর্ণ করবে।”[সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫] সালামা বিন আকওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: যখন وَعَلَى الَّذِينَ يُطِيقُونَهُ فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ (অর্থ- আর যাদের জন্য সিয়াম কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদিয়া দেয়া তথা একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা।) শীর্ষক আয়াতটি নাযিল হয়, তখন আমাদেরকে এ মর্মে ইখতিয়ার দেয়া হয়েছিল যে, যার ইচ্ছা হয় সে রোযা রাখতে পারে, আর কেউ রোযা রাখতে না চাইলে সে ফিদিয়া দিবে। এরপর যখন পরবর্তী আয়াত: شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ (অর্থ- রমযান মাস, এতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের হেদায়াতের জন্য এবং হেদায়াতের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে এ মাস পাবে সে যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে। তবে তোমাদের কেউ অসুস্থ থাকলে বা সফরে থাকলে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূরণ করবে।) নাযিল হল, তখন ফিদিয়া দেয়ার ইখ্তিয়ার রহিত হয়ে সুস্থ-সক্ষম লোকদের ওপর শুধুমাত্র রোযা রাখা জরুরী সাব্যস্ত হয়ে যায়। এ আয়াত পূর্বের আয়াতটিকে রহিত করে দেয়। সুতরাং রোযা রাখার কারণে যে অসুস্থ ব্যক্তি তার রোগ বেড়ে যাওয়া, কিংবা আরোগ্য লাভ বিলম্বিত হওয়া কিংবা কোন অঙ্গহানি ঘটার আশংকা করে তার জন্য রোযা না-রাখা বৈধ। বরং রোযা না-রাখাই সুন্নত; রোযা রাখা মাকরূহ। কেননা কোন কোন ক্ষেত্রে রোযা রাখার পরিণতি মৃত্যুও হতে পারে। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। অতএব, জেনে রাখুন, রোগের কষ্ট ব্যক্তিকে রোযা না-রাখার বৈধতা দেয়। পক্ষান্তরে, সুস্থ ব্যক্তি যদি কষ্ট ও ক্লান্তি অনুভব করেন, তদুপরি তার জন্য রোযা ভাঙ্গা জায়েয নয়। অর্থাৎ যদি রোযা রাখার কারণে শুধু ক্লান্তির কষ্ট হয় সেক্ষেত্রে।
দুই: সফর:
যে সফরে রোযা না-রাখা বৈধ সে সফরের ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে:
ক. এমন দীর্ঘ সফর হওয়া, যে সফরে নামায কসর করা যায়।
খ. সফরকালীন সময়ের মধ্যে মুকীম হয়ে যাওয়ার সংকল্প না করা।
গ. এ সফর কোন গুনার কাজে না হওয়া। বরং জমহুর আলেমের নিকট স্বীকৃত কোন উদ্দেশ্য সফর করা। কেননা, রোযা না-রাখার অনুমতি একটি রুখসত (ছাড়) ও সহজীকরণ। তাই পাপে লিপ্ত ব্যক্তি এ সুযোগ পেতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ: কারো ভ্রমণের ভিত্তি যদি গুনার উপর হয়; যেমন- ডাকাতি করার জন্য সফর করা।
(কোন ক্ষেত্রে সফরের অনুমোদিত রুখসত (ছাড়) প্রযোজ্য হবে না)
সর্বসম্মতিক্রমে দুইটি কারণে সফর অবস্থার ছাড় প্রযোজ্য হবে না:
১। যদি মুসাফির তার নিজ দেশে ফেরত আসে ও নিজ এলাকায় প্রবেশ করে; যে এলাকায় সে স্থায়ীভাবে বসবাস করে।
২। যদি মুসাফির ব্যক্তি কোন স্থানে সাধারণভাবে স্থায়ীভাবে থাকার নিয়ত করে, কিংবা মুকীম সাব্যস্ত হয়ে যাওয়ার মত সময়কাল অবস্থান করার নিয়ত করেন এবং সে স্থানটি অবস্থান করার উপযুক্ত স্থান হয় তাহলে সেক্ষেত্রে তিনি মুকীম হয়ে যাবেন। তখন তিনি নামাযগুলো পরিপূর্ণ সংখ্যায় আদায় করবেন, রোযা রাখবেন; রোযা ছাড়বেন না; যেহেতু তার সফরের হুকুম শেষ হয়ে গেছে।
তিন: গর্ভধারণ ও দুধ পান করানো
ফিকাহ শাস্ত্রে বিশেষজ্ঞ আলেমগণ একমত যে, গর্ভবতী ও দুগ্ধ-দানকারিনী নারীর জন্য রমযানের রোযা না-রাখা বৈধ; এই শর্তে যে তারা নিজেদের কিংবা সন্তানের অসুস্থতার কিংবা রোগ বৃদ্ধির, কিংবা ক্ষতির কিংবা মৃত্যুর আশংকা করে। এই রুখসত বা ছাড়ের পক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী: “আর যে ব্যক্তি অসুস্থ থাকবে কিংবা সফরে থাকবে সে অন্য দিনগুলোতে এ সংখ্যা পূর্ণ করবে।” এখানে রোগ দ্বারা যে কোন রোগ উদ্দেশ্য নয়; কেননা যে রোগের কারণে রোযা রাখতে অসুবিধা হয় না সে রোগের কারণে রোযা ভাঙ্গার অবকাশ নেই। এখানে রোগ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে রোযা রাখলে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। রোগ দ্বারা এটাই উদ্দেশ্য। এখানে এ অর্থ পাওয়া গেছে। তাই এ বিষয়দ্বয় রোযা না-রাখার অবকাশের আওতায় পড়বে। আরেকটি দলিল হচ্ছে আনাস বিন মালিক আল-কা’বি (রাঃ) এর হাদিস: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ মুসাফিরের উপর থেকে রোযা ও অর্ধেক নামায মওকুফ করেছেন এবং গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনী নারীর উপর থেকে রোযা মওকুফ করেছেন। হাদিসের অন্য একটি রেওয়ায়েতে الحامل أو المرضع শব্দের পরিবর্তে الحبلى والمرضع শব্দদ্বয় এসেছে।
চার: বার্ধক্য ও জরাগ্রস্ততা
বার্ধক্য ও জরাগ্রস্ততা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করবে
জ্বরাগ্রস্ত বৃদ্ধ: যার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে কিংবা তিনি নিজে মৃত্যুর উপক্রম, প্রতিদিন ক্ষয় হতে হতে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এমন রুগ্ন ব্যক্তি যার সুস্থতার কোন আশা নেই; তার ব্যাপারে সবাই হতাশ।
এছাড়া বয়স্ক বৃদ্ধা।
উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের রোযা না-রাখার পক্ষে দলিল হচ্ছে আল্লাহ্র বাণী, “আর যাদের জন্য সিয়াম কষ্টসাধ্য তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদিয়া দেয়া তথা একজন মিসকীনকে খাদ্য দান করা।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৪] ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এ আয়াতে কারীমা রহিত হয়ে যায়নি। এ আয়াতে কারীমা (এর বিধান) বয়স্ক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার ক্ষেত্রে; যারা রোযা রাখতে পারেন না, তারা রোযার পরিবর্তে প্রতিদিন একজন মিসকীনকে খাদ্য দিবেন।
পাঁচ: ক্ষুধা ও তৃষ্ণার ফলে অস্বাভাবিক দুর্বলতা:
তীব্র ক্ষুধা কিংবা প্রচণ্ড তৃষ্ণা যাকে অস্বাভাবিক দুর্বল করে ফেলেছে; সেই ব্যক্তি তার জীবন বাঁচানোর পরিমাণ খাদ্য খাবে এবং সে দিনের অবশিষ্টাংশ উপবাস কাটাবে। আর এ রোযাটি কাযা পালন করবে।
ক্ষুধা ও তৃষ্ণার অস্বাভাবিক দুর্বলতার সাথে আলেমগণ শত্রুর সাথে সম্ভাব্য কিংবা সুনিশ্চিত মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুর্বল হয়ে পড়াকেও অন্তর্ভুক্ত করেছেন; যেমন শত্রুর দ্বারা অবরুদ্ধ হলে: যদি গাজী (যোদ্ধা) ব্যক্তি সুনিশ্চিতভাবে কিংবা প্রবল ধারণার ভিত্তিতে যুদ্ধের বিষয়টি জানেন যেহেতু তিনি শত্রুর মোকাবিলাতে রত রয়েছেন এবং রোযা রাখার কারণে শারীরিক দুর্বলতার আশংকা করেন; অথচ তিনি মুসাফির নন এমতাবস্থায় তার জন্য যুদ্ধের পূর্বে রোযা ভেঙ্গে ফেলা জায়েয আছে।
ছয়: জবরদস্তির শিকার:জবরদস্তি হচ্ছে: শাস্তির হুমকি দেওয়ার মাধ্যমে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে কোন কাজ করতে কিংবা না- করতে বাধ্য করা; যে ব্যাপারে সে ব্যক্তি নিজে থেকে রাজি নয়।
সূত্র: আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা, খণ্ড-৫, পৃষ্ঠা-৭৩
আল কুর’আনের পরিচয়ঃ
কুরআন শব্দটি এসেছে ‘কারাআ’ শব্দ থেকে। ‘কারাআ’ শব্দের অর্থ হলো পাঠ করা। কাজেই কুরআন শব্দের অর্থ হল ‘যাকে পাঠ করা হয়’।
কুরআন পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত ও প্রচারিত ইলাহী গ্রন্থ। আল্লাহ বলেন, وَكِتَابٍ مَسْطُوْرٍ، فِيْ رَقٍّ مَنْشُوْرٍ ‘কসম ঐ কেতাবের যা লিখিত হয়েছে’ ‘বিস্তৃত পত্রে’ (তূর ৫২/২-৩)। এখানে কুরআন মজীদের তিনটি বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে- ‘কিতাব’ (গ্রন্থ), ‘মাসতূর’ (লিখিত) এবং ‘মানশূর’ (বিস্তৃত)। বস্ত্ততঃ কুরআন সর্বাধিক উচ্চারিত ও বিস্তৃত গ্রন্থ এ কারণে যে, তা মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে। কুরআন প্রচারের জন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া অপরিহার্য নয়। যেকোন মুমিন কুরআন মুখস্থ করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে যতদিন পৃথিবীতে মুসলমান থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে কুরআন থাকবে ইনশাআল্লাহ।
সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ (المملوء بالصدق والعدل)
কুরআন এমনই একটি গ্রন্থ, যার প্রতিটি কথাই চূড়ান্ত সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। পরিস্থিতির কারণে যে সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلاً لاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর কালামের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১১৫)।
২:১৮৬ وَ اِذَا سَاَلَکَ عِبَادِیۡ عَنِّیۡ فَاِنِّیۡ قَرِیۡبٌ ؕ اُجِیۡبُ دَعۡوَۃَ الدَّاعِ اِذَا دَعَانِ ۙ فَلۡیَسۡتَجِیۡبُوۡا لِیۡ وَ لۡیُؤۡمِنُوۡا بِیۡ لَعَلَّهُمۡ یَرۡشُدُوۡنَ ﴿۱۸۶﴾
আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্পর্কে আপনাকে জিজ্ঞেস করে, (তখন বলে দিন যে) নিশ্চয় আমি অতি নিকটে। আহবানকারী যখন আমাকে আহবান করে আমি তার আহবানে সাড়া দেই। কাজেই তারাও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক, যাতে তারা সঠিক পথে চলতে পারে।
পূর্ববতী আয়াতগুলোতে রামাদানের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর একটি সুদীর্ঘ আয়াতে সাওম ও ইতিকাফের বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। এখানে মাঝখানে বর্তমান সংক্ষিপ্ত আয়াতটিকে বান্দাদের অবস্থার প্রতি মহান রব-এর অনুগ্রহ এবং তাদের প্রার্থনা শ্রবণ ও কবুল করার বিষয় আলোচনা করে নির্দেশ পালনে উৎসাহিত করা হচ্ছে। কারণ, সাওম সংক্রান্ত ইবাদাতে অবস্থাবিশেষে অব্যাহতি দান এবং বিভিন্ন সহজতা সত্বেও কিছু কষ্ট বিদ্যমান রয়েছে। এ কষ্টকে সহজ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, আমি আমার বান্দাদের সন্নিকটে রয়েছি, যখনই তারা আমার কাছে কোন বিষয়ে দো’আ করে, আমি তাদের সে দোআ কবুল করে নেই এবং তাদের বাসনা পূরণ করে দেই। এমতাবস্থায় আমার হুকুম-আহকাম মেনে চলা বান্দাদেরও একান্ত কর্তব্য। তাতে কিছুটা কষ্ট হলেও তা সহ্য করা উচিত।
ইমাম ইবনে কাসীর দো’আর প্রতি উৎসাহ দান সংক্রান্ত এই মধ্যবর্তী বাক্যটির তাৎপর্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, এ আয়াতের দ্বারা সাওম রাখার পর দোআ কবুল হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সে জন্যই সাওমের ইফতারের পর দোআর ব্যাপারে বিশেষ তৎপরতা অবলম্বন করা উচিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ “সিয়াম পালনকারীর দো’আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না অর্থাৎ কবুল হয়ে থাকে।” [ইবনে মাজাহ ১৭৫৩] সে জন্যই আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ইফতারের সময় পরিবার পরিজনকে ডাকতেন এবং দো’আ করতেন। [ইবনে কাসীর]
২:১৮৭ اُحِلَّ لَکُمۡ لَیۡلَۃَ الصِّیَامِ الرَّفَثُ اِلٰی نِسَآئِکُمۡ ؕ هُنَّ لِبَاسٌ لَّکُمۡ وَ اَنۡتُمۡ لِبَاسٌ لَّهُنَّ ؕ عَلِمَ اللّٰهُ اَنَّکُمۡ کُنۡتُمۡ تَخۡتَانُوۡنَ اَنۡفُسَکُمۡ فَتَابَ عَلَیۡکُمۡ وَ عَفَا عَنۡکُمۡ ۚ فَالۡـٰٔنَ بَاشِرُوۡهُنَّ وَ ابۡتَغُوۡا مَا کَتَبَ اللّٰهُ لَکُمۡ ۪ وَ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا حَتّٰی یَتَبَیَّنَ لَکُمُ الۡخَیۡطُ الۡاَبۡیَضُ مِنَ الۡخَیۡطِ الۡاَسۡوَدِ مِنَ الۡفَجۡرِ۪ ثُمَّ اَتِمُّوا الصِّیَامَ اِلَی الَّیۡلِ ۚ وَ لَا تُبَاشِرُوۡهُنَّ وَ اَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡکَ حُدُوۡدُ اللّٰهِ فَلَا تَقۡرَبُوۡهَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ اٰیٰتِهٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ یَتَّقُوۡنَ
সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের পোষাকস্বরুপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরুপ। আল্লাহ জানেন যে, তোমরা নিজদের সাথে খিয়নত কর ছিলে। সুতরাং তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদেরকে মার্জনা করেছেন। কাজেই এখন তোমরা তাদের সাথে সংগত হও এবং আল্লাহ যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা কর। আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাতের কালোরেখা থেকে উষার সাদা রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের নিকট প্রকাশ না হয়। তারপর রাতের আগমন পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর। আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাদের সাথে সংগত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর সীমারেখা। কাজেই এগুলোর নিকটবর্তী হয়ে না। এভাবে আল্লাহ তার আয়াতসমূহ মানুষদের জন্য সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন, যাতে তারা তাকওয়ার অধিকারী হতে পারে।
যে বিষয়টিকে এ আয়াত দ্বারা হালাল করা হয়েছে, তা ইতঃপূর্বে হারাম ছিল। বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, প্রথম যখন রমাদানের সাওম ফরয করা হয়েছিল, তখন ইফতারের পর থেকে শয্যগ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত খানা-পিনা ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। একবার শয্যাগ্রহণ করে ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই এ সবকিছু হারাম হয়ে যেত। কোন কোন সাহাবী এ ব্যাপারে অসুবিধায় পড়েন। কায়েস ইবনে সিরমাহ আনসারী নামক জনৈক সাহাবী একবার সমগ্র দিন কঠোর পরিশ্রম করে ইফতারের সময় ঘরে এসে দেখেন, ঘরে খাওয়ার মত কোন কিছুই নেই। স্ত্রী বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি কোথাও থেকে কিছু সংগ্রহ করে আনার চেষ্টা করি। স্ত্রী যখন কিছু খাদ্য সংগ্রহ করে ফিরে এলেন তখন সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইফতারের পর ঘুমিয়ে পড়ার দরুন খানা-পিনা তার জন্য হারাম হয়ে যায়। ফলে পরদিন তিনি এ অবস্থাতেই সাওম পালন করেন। কিন্তু দুপুর বেলায় শরীর দুর্বল হয়ে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যান। [বুখারী: ১৯১৫]
অনুরূপভাবে কোন কোন সাহাবী গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গার পর স্ত্রীদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হয়ে মানসিক কষ্টে পতিত হন। এসব ঘটনার পর এ আয়াত নাযিল হয়, যাতে পূর্ববর্তী হুকুম রহিত করে সূর্যাস্তের পর থেকে শুরু করে সুবহে-সাদিক উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সমগ্র রাতেই খানা-পিনা ও স্ত্রী সহবাস বৈধ করা হয়েছে। ঘুমাবার আগে কিংবা ঘুম থেকে উঠার পর সম্পর্কে কোন বাধ্যবাধকতাই এতে আর অবশিষ্ট রাখা হয়নি। এমনকি হাদীস অনুযায়ী শেষরাতে সেহরী খাওয়া সুন্নাত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে এ সম্পর্কিত নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে।
আয়াতে রাতের অন্ধকারকে কালো রেখা এবং ভোরের আলো ফোটাকে সাদা রেখার সাথে তুলনা করে সাওমের শুরু এবং খানা-পিনা হারাম হওয়ার সঠিক সময়টি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। অধিকন্তু এ সময়-সীমার মধ্যে কম-বেশী হওয়ার সম্ভাবনা যাতে না থাকে সে জন্য (حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ) শব্দটিও যোগ করে দেয়া হয়েছে। এতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, সন্দেহপ্রবণ লোকদের ন্যায় সুবহে-সাদিক দেখা দেয়ার আগেই খানা-পিনা হারাম মনে করো না অথবা এমন অসাবধানতাও অবলম্বন করো না যে, সুবহে-সাদিকের আলো ফোটার পরও খানা-পিনা করতে থাকবে। বরং খানা-পিনা এবং সাওমের মধ্যে সুবহে-সাদিকের উদয় সঠিকভাবে নির্ণয়ই হচ্ছে সীমারেখা। এ সীমারেখা উদয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খানা-পিনা বন্ধ করা জরুরী মনে করা যেমন জায়েয নয়, তেমনি সুবহে-সাদিক উদয় হওয়ার ব্যাপারে ইয়াকীন হয়ে যাওয়ার পর খানা-পিনা করাও হারাম এবং সাওম নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ, তা এক মিনিটের জন্য হলেও। সুবহে-সাদিক উদয় হওয়া সম্পর্কে ইয়াকীন হওয়া পর্যন্তই সেহরীর শেষ সময়। [মা’আরিফুল কুরআন]
ইতিকাফ-এর শাব্দিক অর্থ কোন এক স্থানে অবস্থান করা। কুরআন-সুন্নাহর পরিভাষায় কতগুলো বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একটা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্দিষ্ট মসজিদে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলা হয়। জামাআত হয় এমন যে কোন মসজিদেই ইতেকাফ হতে পারে। ইতিকাফের অবস্থায় খানা-পিনার হুকুম সাধারণত সাওম পালনকারীদের প্রতি প্রযোজ্য নির্দেশেরই অনুরূপ। তবে স্ত্রী সহবাসের ব্যাপারে এ অবস্থায় পৃথক নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে, ইতিকাফ অবস্থায় এটা রাতের বেলায়ও জায়েয নয়।
ইতিকাফের জন্য শর্ত হল, মসজিদ। মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ সহীহ নয়। এই শর্ত পুরুষ-মহিলা সবার জন্য প্রযোজ্য।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: أَن طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ
“তোমরা আমার গৃহকে তওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু-সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।” (সূরা বাকারা: ১২৫)
আল্লাহ আরও বলেন: وَلَا تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ
“আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না। ” (সূরা বাকরা:১৮৭)এ আয়াতগুলোতে মসজিদে ইতিকাফ করার কথা উল্লেখিত হয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,
أن النبي صلى الله عليه وسلم كان يعتكف العشر الأواخر من رمضان حتى توفاه الله، ثم اعتكف أزواجه من بعده
“রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রামযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন আর তাঁর ইন্তিকালের পরে তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।”
নারীদের জন্য তার ঘরকে মসজিদ বলা ঠিক নয়। কারণ, মসজিদে ঋতুবতি মহিলাদের দীর্ঘ সময় অবস্থান করা নিষেধ। ঘর যদি মসজিদ হত তাহলে সে ঘরে মহিলাদের অবস্থান করা বৈধ হত না। অনুরূপভাবে ঐ ঘর বিক্রয় করাও বৈধ হত না।
বি: দ্র:
মসজিদের মধ্যে মহিলাদের যদি নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে এবং তার ইতিকাফের কারণে যদি সন্তান প্রতিপালন, ঘর-সংসারের নিরাপত্তা এবং তার উপর অর্পিত অপরিহার্য কবর্ত্য পালনে ব্যাঘাত না ঘরে তবে স্বামী বা অভিভাবকের অনুমতি স্বাপেক্ষে ইতিকাফ করা বৈধ হবে। অন্যথায়, তার জন্য ইতিকাফ না করে বরং নিজ দায়িত্ব যাথাযথভাবে পালন, সংসার দেখা-শোনা, স্বামীর সেবা ইত্যাদিতেই অগণিত কল্যাণ নিহীত রয়েছে। তিনি কাজের ফাঁকে যথাসাধ্য দুয়া, তাসবীহ, কুরআন তিলাওয়াত, নফল সালাত ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের চেষ্টা করবেন। আল্লাহই তাওফীক দাতা।
➖➖➖➖➖➖➖➖
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, ksa
অর্থাৎ সাওমের মধ্যে খানা-পিনা এবং স্ত্রী সহবাস সম্পর্কিত যেসব নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, এগুলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা, এর ধারে-কাছেও যেও না। কেননা, কাছে গেলেই সীমালংঘনের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। একই কারণে সাওম অবস্থায় কুলি করতে বাড়াবাড়ি করা, যদ্দরুন গলার ভেতর পানি প্রবেশ করতে পারে; মুখের ভেতর কোন ঔষধ ব্যবহার করা, এসব ব্যাপার অসাবধানতা এবং শৈথিল্য প্রদর্শন আল্লাহর এ নির্দেশের পরিপন্থী। তাই সীমান্ত থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ ব্যবস্থা। কারণ, ঐ সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সীমান্ত রেখার মধ্যে পার্থক্য করা এবং তাদের কিনারে পৌছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ কথা নয়। এ ব্যাপারে সাবধান করে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “প্রত্যেক বাদশারই একটি সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে। আল্লাহর সে সংরক্ষিত এলাকা হল, তার নির্ধারিত হারাম বিষয়সমূহ। যে ব্যক্তি এর চারদিকে ঘুরে বেড়ায় সে উক্ত সংরক্ষিত এলাকার মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশং রয়েছে।” [মুসলিমঃ ২৬৮১]
আল্লাহর নিদর্শনঃ
আল্লাহ্ যথাযথভাবে আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন(১); এতে তো অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে মুমিনদের জন্য। আনকাবুতঃ৪৪
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে(১) রয়েছে যে, তিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর এখন তোমরা মানুষ, সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছ। সূরা রুমঃ২০
আপনি অন্ধদেরকেও তাদের পথ ভ্ৰষ্টতা থেকে পথে আনতে পারবেন না। আপনি তো কেবল তাদেরকে শোনাতে পারবেন, যারা আমাদের নিদর্শনাবলীতে ঈমান আনে। অতঃপর তারাই আত্মসমৰ্পণকারী। নমলঃ৮১
তিনি অন্যত্র বলেছেন,{سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ} অর্থাৎ, আমি ওদের জন্য আমার নিদর্শনাবলী বিশ্বজগতে ব্যক্ত করব এবং ওদের নিজেদের মধ্যেও; ফলে ওদের নিকট স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এ (কুরআন) সত্য। (হামীম আস সাজদাহ ৫৩ আয়াত)
যদি জীবিতকালে উক্ত নিদর্শনাবলী দেখেও তারা ঈমান আনয়ন না করে, তাহলে মৃত্যুর সময় অবশ্যই ওই সমস্ত নিদর্শন দেখে সত্য চিনে নেবে। কিন্তু সে সময়ের ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়।
২:১৮৮ وَ لَا تَاۡکُلُوۡۤا اَمۡوَالَکُمۡ بَیۡنَکُمۡ بِالۡبَاطِلِ وَ تُدۡلُوۡا بِهَاۤ اِلَی الۡحُکَّامِ لِتَاۡکُلُوۡا فَرِیۡقًا مِّنۡ اَمۡوَالِ النَّاسِ بِالۡاِثۡمِ وَ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۱۸۸﴾
আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে বুঝে অন্যায়ভাবে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে বিচারকদের কাছে পেশ করো না।
এ আয়াতটির এক অর্থ হচ্ছে, শাসকদেরকে উৎকোচ দিয়ে অবৈধভাবে লাভবান হবার চেষ্টা করো না।
এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা নিজেরাই যখন জানো এগুলো অন্যের সম্পদ, তখন শুধুমাত্র তার কাছে তার সম্পদের মালিকানার কোন প্রমাণ না থাকার কারণে অথবা একটু এদিক-সেদিক করে কোন প্রকারে প্যাঁচে ফেলে তাঁর সম্পদ তোমরা গ্রাস করতে পার বলে তার মামলা আদালতে নিয়ে যেয়ো না। কেননা, আদালত থেকে ঐ সম্পদের মালিকানা অধিকার লাভ করার পরও প্রকৃতপক্ষে তুমি তার বৈধ মালিক হতে পারবে না। আল্লাহর কাছে তো তা তোমার জন্য হারামই থাকবে।
ফাত্ওয়া নং- 65635
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তিদের সবার ক্ষেত্রে একই হুকুম প্রযোজ্য নয়। এ ব্যাপারে আমরা ‘আলিমগণের ভিন্ন মত ও তাদের বক্তব্য সমূহ কিছুটা বিস্তারিত আকারে (49008) নং প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করেছি
প্রশ্নে উল্লেখিত ব্যক্তিদের দুটি গ্রুপে ভাগ করা যেতে পারে :
১) কোনো শিশু যদি বালিগ হয়, কোনো কাফির যদি ইসলাম গ্রহণ করে, কোন পাগল যদি জ্ঞান ফিরে পায়- তবে তাঁদের সবার হুকুম এক, আর তা হল ‘উয্র (অজুহাত) চলে যাওয়ার সাথে সাথে দিনের বাকি অংশে সাওম ভঙ্গকারী সমস্ত কিছু হতে বিরত থাকা ওয়াজিব এবং এক্ষেত্রে তাদের সেই দিনের কাযা আদায় করা ওয়াজিব নয়।
২) অপরদিকে হায়েযপ্রাপ্ত নারী যদি পবিত্র হয়, মুসাফির ব্যক্তি স্বদেশে ফিরে আসে, অসুস্থ ব্যক্তি যদি আরোগ্য লাভ করে, এদের সবার হুকুম এক। এদের সাওম ভঙ্গকারী যাবতীয় বস্তু থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়, কারণ তারা বিরত থাকলেও কোনো উপকার পাবে না এবং তাদের উপর সেই দিনের কাযা আদায় করা ওয়াজিব।
প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রুপের মধ্যে পার্থক্য :
প্রথম গ্রুপের মধ্যে তাকলীফের (দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার) শর্ত রয়েছে আর তা হল বালিগ হওয়া, মুসলিম হওয়া ও ‘আক্বল (বুদ্ধি) সম্পন্ন হওয়া, তাই যদি তাঁদের ক্ষেত্রে শারী‘আতসম্মতভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত (মুকাল্লাফ) হওয়া প্রমাণিত হয়, তবে তাঁদের উপর সাওম ভঙ্গকারী সকল কিছু থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। এবং তাঁদের জন্য সেই দিনের কাযা আদায় করা আবশ্যক নয়। কারণ যখন তাদের সাওম ভঙ্গকারী সকল বস্তু হতে বিরত থাকা ওয়াজিব ছিল তখন তাঁরা তা থেকে বিরত থেকেছে এবং এর আগে তাঁরা সিয়ামের ব্যাপারে মুকাল্লাফ (শারীআতসম্মতভাবে দায়িত্ব) ছিল না।
অপর দিকে দ্বিতীয় গ্রুপটি সিয়াম এর ব্যাপারে শারী‘আত সম্মতভাবে দায়িত্বশীল ছিল। তাই তা পালন করা তাঁদের উপর ওয়াজিব ছিল, তবে শারী‘আত অনুমোদিত ‘উয্র (অজুহাত) থাকায় তাঁদের জন্য সাওম ভঙ্গ বৈধ হয়েছিল যেমন হায়েয, সফর, রোগ ইত্যাদি কারণে আল্লাহ্ তাঁদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন এবং তাঁদের জন্য সাওম ভঙ্গ বৈধ করেছেন। তাই তাঁদের ক্ষেত্রে সেই দিনের সম্মানীয় কর্তব্য পালনের দায়িত্ব চলে যায়।
তাঁদের ‘উয্রসমূহ (শারী‘আত অনুমোদিত অজুহাতসমূহ) রমযানে দিনের মাঝে দূরীভূত হলেও তারা সাওম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থেকে কোনো উপকার পাবে না এবং তাদের রমযানের পর সেই দিনের সাওম কাযা করতে হবে।
শাইখ মুহাম্মাদ ইব্ন সালিহ আল-‘উসাইমীন- রাহিমাহুমাল্লাহ- বলেছেন :
“যদি কোনো মুসাফির তার দেশে সাওম ভঙ্গরত অবস্থায় ফিরে আসে তবে তাঁর জন্য সাওম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়, সে দিনের বাকী অংশে খেতে ও পান করতে পারে কারণ তাঁর বিরত থাকায় কোনো উপকার হবে না। এটি এজন্য যে, তাঁকে সেই দিনের কাযা আদায় করতে হবে। এটিই সঠিক মত।
এটি ইমাম মালিক, ইমাম আশ-শাফি‘ঈ এর মত এবং ঈমাম আহমাদ – রাহিমাহুমাল্লাহ এর দুটি বর্ণনার একটি। তবে তাঁর প্রকাশ্যে আহার ও পান করা উচিৎ নয় ।”
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইব্ন ‘উসাইমীন (১৯/৫৮ নং প্রশ্ন)]
তিনি আরও বলেন :
“কোনো হায়েযপ্রাপ্ত নারী অথবা নিফাসপ্রাপ্ত নারী দিনের মাঝে পবিত্র হলে তাদের জন্য সাওম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব নয়, সে খেতে ও পান করতে পারে, কারণ তাঁর বিরত থাকায় কোনো উপকার হবে না। এটি এজন্য যে, তাঁকে সেই দিনের কাযা আদায় করতে হবে।
এটি ইমাম মালিক, ইমাম আশ-শাফি‘ঈ এর মত এবং ঈমাম আহমাদ এর দুটি বর্ণনার একটি।
ইবন মাস‘ঊদ -রাদ্বিআল্লাহু ‘আন্হু- থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন:
( من أكل أول النهار فليأكل آخره)
“যে দিনের প্রথম অংশে খেল সে যেন দিনের শেষ অংশেও খায়।”
‘অর্থাৎ যার জন্য দিনের প্রথম অংশে সাওম ভঙ্গ করা জায়েয তাঁর জন্য দিনের শেষ অংশেও সাওম ভঙ্গ করা বৈধ।’
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইব্ন ‘উসাইমীন (১৯/৫৯ নং প্রশ্ন)]
এই শাইখকে আরও প্রশ্ন করা হয়েছিল :
যে রমযানে দিনের বেলায় শারী‘আত অনুমোদিত ‘উয্রের কারণে সাওম ভঙ্গ করল, (সেই ‘উয্র চলে যাওয়ার পর) দিনের বাকি অংশে তার জন্য খাওয়া ও পান করা কি জায়েয হবে?
তিনি উত্তরে বলেন :
“তাঁর জন্য খাওয়া ও পান করা জায়েয; কারণ সে শারী‘আত অনুমোদিত ‘উয্রে (অজুহাতে) সাওম ভঙ্গ করেছে। সে যদি শারী‘আত সম্মত ‘উয্রের কারণে সাওম ভঙ্গ করে তবে তাঁর ক্ষেত্রে সেই দিনের সম্মানীয় কর্তব্য পালনের দায়িত্ব চলে যায়। ফলে সে খেতে ও পান করতে পারে।
এটি সেই ব্যক্তির অবস্থা থেকে ভিন্ন যে রমযানে দিনের বেলা কোন ‘উয্র (শরীয়ত অনুমোদিত অজুহাত) ছাড়া সাওম ভঙ্গ করে। এক্ষেত্রে আমরা বলব : যে তাঁর সাওম ভঙ্গকারী বিষয়বস্তু থেকে (দিনের বাকি অংশে) বিরত থাকা আবশ্যক। তাঁর ক্ষেত্রে সাওম কাযা করা আবশ্যক হবে।
এই দুটি মাসআলা এর পার্থক্যের দিকে সতর্কতার সাথে লক্ষ্য করা ওয়াজিব।”
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইব্ন ‘উসাইমীন (১৯/৬০ নং প্রশ্ন)]
তিনি আরও বলেন :
“সিয়াম সংক্রান্ত আমাদের গবেষণায় আমরা উল্লেখ করেছি যে কোন নারী যদি হায়েযপ্রাপ্ত হয় এবং রমযানে দিনের মাঝে পবিত্র হয় তবে সে দিনের বাকী অংশে পানাহার থেকে বিরত থাকবেন কি না এ ব্যাপারে ‘আলিমগণ ভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
আমরা বলব : ইমাম আহমাদ – রাহিমাহুমাল্লাহ – এর থেকে এ-ব্যাপারে দুটি বর্ণনা রয়েছে।
তার মাশহুর (সর্বজনবিদিত) মতটি হল- তাঁর সাওম ভঙ্গকারী যাবতীয় বস্তু থেকে দিনের বাকি অংশে বিরত থাকা ওয়াজিব। সে খাবে না, পানও করবে না।
দ্বিতীয়ত : তাঁর বিরত থাকা ওয়াজিব নয়, তাই তাঁর খাওয়া ও পান করা জায়েয।
আমরা বলব : দ্বিতীয় এই মতটি ইমাম মালিক ও ইমাম আশ-শাফি‘ঈ- রাহিমাহুমাল্লাহ- এর মত। এটি ইব্ন মাস‘ঊদ -রাদ্বিআল্লাহু ‘আনহ্- থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন :
( من أكل أول النهار فليأكل آخره)
“যে দিনের প্রথম অংশে খেল সে যেন দিনের শেষ অংশেও খায়।”
আমরা বলব ভিন্ন মত আছে এমন মাসআলাসমূহের ক্ষেত্রে জ্ঞান অন্বেষণকারী শিক্ষার্থীর কর্তব্য হল, দলীলসমূহ যাচাই করা এবং তাঁর কাছে যে মতটি বেশি শক্তিশালী বলে প্রতীয়মান হয় সেটি গ্রহণ করা এবং কারও ভিন্ন মতের ব্যাপারে পরোয়া না করা যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সাথে দলীল আছে, কারণ আমাদেরকে রাসূলদের অনুসরণ করতে আদেশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ তা’আলার বাণী
﴿ وَيَوۡمَ يُنَادِيهِمۡ فَيَقُولُ مَاذَآ أَجَبۡتُمُ ٱلۡمُرۡسَلِينَ ٦٥ ﴾ [القصص: ٦٥]
“আর সেই দিন যখন তাদের আহবান করা হবে এবং বলা হবে তোমরা রাসূলদের কি উত্তর দিয়েছিলে?” [আল-ক্বাসাস: ৬৫]
আর এই হাদীস দ্বারা দলীল দেয়া যা সহীহ বলে প্রমানিত হয়েছে যে, নবী সাল্লালাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনের মাঝে ‘আশুরা’ এর সিয়াম পালনের আদেশ করেছিলেন, তখন লোকেরা দিনের বাকি অংশে সাওম ভঙ্গকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকলেন।
আমরা বলব, এই হাদীস তাদের পক্ষে কোনো দলীল নয়; কারণ ‘আশুরা’ এর সাওমে ‘বাঁধা দানকারী বিষয় (যেমন হায়েয, নিফাস, কুফর ইত্যাদি) দূরীভূত হওয়ার’ কোনো ব্যাপার নেই। বরং এই ক্ষেত্রে ‘নতুন ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানোর’ ব্যাপারটি রয়েছে।
‘বাধাদানকারী বিষয় দূরীভূত হওয়া’ ও ‘নতুন ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানোর’ মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
‘নতুন ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানোর’ অর্থ হল সেই নির্দিষ্ট কারণ (যেমন ‘আশুরা’ এর দিন) উপস্থিতির আগে সেই হুকুমটি প্রতিষ্ঠিত হয় নি।
অপরদিকে ‘বাধাদানকারী বিষয় দূরীভূত হওয়ার’ অর্থ হল- সেই বাধাদানকারী বিষয়টি (যেমন হায়েয, নিফাস, কুফর ইত্যাদি)র উপস্থিতি সত্বেও এই হুকুমটি (যেমন সাওম পালন) প্রতিষ্ঠিত। যদি না এ ‘বাধাদানকারী বিষয়টি’ (যেমন হায়েয, নিফাস, কুফর) ইত্যাদি তা থেকে বাধা না হতো। আর বিধান প্রদানের কারণ (যেমন বিবেকবান হওয়া) তার সাথে এই বাধাদানকারী বিষয়টি (যেমন হায়েয হওয়া) এটি উপস্থিত থাকার অর্থ হল সেই কাজটি (সাওম পালন) এই ‘বাধাদানকারী বিষয়টির (যেমন হায়েয, নিফাস, কুফর) উপস্থিতির কারণে শুদ্ধ হবে না।
প্রশ্নকারীর উল্লেখিত মাসআলা এর মত আরেকটি উদাহরণ হল- দিনের মাঝে যদি কেউ ইসলাম গ্রহণ করে তবে তাঁর ক্ষেত্রে ‘নতুন করে ওয়াজিব দায়িত্ব’ বর্তায়।
এরকম আরেকটি উদাহরণ হল, কোনো শিশু দিনের মাঝে সাওম ভঙ্গকারী অবস্থায় বালিগ হলে তাঁর উপর ‘নতুন করে ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তায়। তাই যে দিনের মাঝে ইসলাম গ্রহণ করল আমরা তাঁকে বলব : আপনার জন্য (দিনের বাকি অংশে) সাওম ভঙ্গকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। তবে আপনার উপর কাযা আদায় করা ওয়াজিব নয়।
একই ভাবে দিনের মাঝে যে শিশু বালিগ হয়েছে, তাঁকে আমরা বলব : আপনার জন্য (দিনের বাকি অংশে) সাওম ভঙ্গকারী বিষয়বস্তু থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। তবে আপনার উপর কাযা আদায় করা ওয়াজিব নয়।
তবে একজন হায়েযপ্রাপ্ত নারীর ক্ষেত্রে হুকুমটি ভিন্ন হবে; যদি (দিনের মাঝে) সে পবিত্র হয়। ‘আলিমগণের মাঝে এ ব্যাপারে ইজমা’ (ঐকমত্য) রয়েছে যে তাঁর উপর সাওম কাযা করা ওয়াজিব। একজন হায়েযপ্রাপ্ত নারী দিনের মাঝে পবিত্র হয়ে দিনের বাকি অংশে সাওম ভঙ্গকারী বিষয়সমূহ থেকে বিরত থাকলে, এই বিরত থাকা যে তাঁর কোনো উপকারে আসবে না ও সাওম বলে গণ্য হবে না এবং তাঁকে যে সাওম কাযা করতে হবে- এ ব্যাপারে ‘আমিলগণ ইজমা’ (ঐকমত্য) পোষণ করেছেন।
এ থেকে ‘নতুন করে ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানো’ ও ‘বাধাদানকারী বিষয় দূরীভূত হওয়ার মধ্যে’ পার্থক্য জানা গেল।
সুতরাং একজন হায়েয প্রাপ্ত নারী পবিত্র হওয়ার মাস‘আলাটি ‘বাধাদানকারী বিষয় দূরীভূত হওয়া’ শীর্ষক শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত এবং কোনো শিশুর বালিগ হওয়া অথবা প্রশ্নকারীর উল্লেখিত ‘আশুরা’ দিনের সাওম ওয়াজিব হওয়া- রমযানের সিয়াম ফরয হওয়ার পূর্বে- নতুন করে ওয়াজিব দায়িত্ব বর্তানো’ শীর্ষক শিরোনামের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহই তাওফীক্ব দাতা।”
[মাজমূ‘ ফাত্ওয়া আশ-শাইখ ইব্ন ‘উসাইমীন (১৯/৬০ নং প্রশ্ন)]
Islam Q & A
সংগ্রহে
তাফসিরে যাকারিয়া, আহসানুল বায়ান, তাফহিমুল কুর’আন