সুরা বাকারাঃ ২০তম রুকু (১৬৪-১৬৭)আয়াত

সুরা বাকারাঃ ২০তম রুকু (১৬৪-১৬৭)আয়াত

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ 

২:১৬৪ اِنَّ فِیۡ خَلۡقِ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ وَ اخۡتِلَافِ الَّیۡلِ وَ النَّهَارِ وَ الۡفُلۡکِ الَّتِیۡ تَجۡرِیۡ فِی الۡبَحۡرِ بِمَا یَنۡفَعُ النَّاسَ وَ مَاۤ اَنۡزَلَ اللّٰهُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ مَّآءٍ فَاَحۡیَا بِهِ الۡاَرۡضَ بَعۡدَ مَوۡتِهَا وَ بَثَّ فِیۡهَا مِنۡ کُلِّ دَآبَّۃٍ ۪ وَّ تَصۡرِیۡفِ الرِّیٰحِ وَ السَّحَابِ الۡمُسَخَّرِ بَیۡنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّعۡقِلُوۡنَ

১৬৪. নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, মানুষের উপকারী দ্রব্যবাহী চলমান সামুদ্রিক জাহাজে এবং আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের মূধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠকে তার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকল প্রকার বিচরণশীল প্রাণী এবং বায়ুর দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে বিবেকবান কওমের জন্য নিদর্শনসমূহ রয়েছে।

এই রুকুর আয়াত সমূহ রুকাইয়্যা হিসেবে পাঠ করা হয়, খুবই শক্তিশালী আয়াত সমূহ।

. অর্থাৎ বিশ্ব-জাহানের এই যে বিশাল কারখানা মানুষের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত সক্রিয়, মানুষ যদি তাকে নিছক নির্বোধ জন্তু-জানোয়ারের দৃষ্টিতে না দেখে বুদ্ধি-বিবেকের সাহায্যে বিচার বিশ্লেষণ করে তার সূক্ষ্ম ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সকল প্রকার হঠধর্মিতা পরিহার করে পক্ষপাতহীনভাবে মুক্ত মনে চিন্তা করে তাহলে চতুর্দিকে যেসব নিদর্শন সে প্রত্যক্ষ করছে সেগুলো তাকে এই সিদ্ধান্তে পৌছে দেয়ার জন্য যথেষ্ট যে,বিশ্ব-জাহানের সমগ্র ব্যবস্থাপনা একজন অসীম ক্ষমতাধর জ্ঞানবান সত্তার বিধানের অনুগত ৷ সমস্ত ক্ষমতা-কর্তৃত্ব সেই একক সত্তার হাতে কেন্দ্রীভূত ৷ এই ব্যবস্থাপনায় অন্য কারোর স্বাধীন হস্তক্ষেপের বা অংশীদারীত্বের সামান্যতম অবকাশই নেই ৷ কাজেই প্রকৃতপক্ষে সমগ্র সৃষ্টিজগতের তিনিই একমাত্র প্রভু, ইলাহ ও আল্লাহ ৷ তাঁর ছাড়া আর কোন সত্তার কোন বিষয়ে সামান্যতম ক্ষমতাও নেই ৷ কাজেই খোদায়ী কর্তৃত্ব ও উপাস্য হবার ব্যাপারে আল্লাহর সাথে আর কারোর কোন অংশ নেই ৷

(১) আসমান ও যমীনের সৃষ্টি কিভাবে নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত, তা এ আয়াতে ব্যাখ্যা করে বলা হয় নি। অন্যত্র তা স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যেমন

“তারা কি তাদের উপরে অবস্থিত আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না, আমরা কিভাবে তা নির্মাণ করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি এবং তাতে কোন ফাটলও নেই? আর আমরা বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদগত করেছি নয়ন প্রীতিকর সর্বপ্রকার উদ্ভিদ, আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।” [সূরা কাফ: ৬-৮]

আর আসমান সম্পর্কে বলেছেন “যিনি সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে সাত আসমান। রহমানের সৃষ্টিতে আপনি কোন খুঁত দেখতে পাবেন না; আপনি আবার তাকিয়ে দেখুন, কোন ক্রটি দেখতে পান কি?

তারপর আপনি দ্বিতীয়বার দৃষ্টি ফেরান, সে দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে আপনার দিকে ফিরে আসবে। আমরা নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করেছি প্রদীপমালা দ্বারা এবং সেগুলোকে করেছি শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের উপকরণ এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জ্বলন্ত আগুনের শাস্তি [সূরা আল-মুলক ৩-৫]

যে ব্যক্তি আসমানের দিকে তাকাবে, আসমানের নিপুণ সৃষ্টি, আসমানের অপার সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য এবং এর অনুমেয় উচ্চতা ও বিশালতার প্রতি লক্ষ্য করবে, সে তার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার অসীম শক্তি ও ক্ষমতাই দেখতে পাবে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন:

أَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاءُ بَنَاهَا. رَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوَّاهَا

‘তোমাদেরকে সৃষ্টি করা অধিক কঠিন, না আসমান সৃষ্টি? তিনি তা বানিয়েছেন। তিনি তার ছাদকে উচ্চ করেছেন এবং তাকে সুসম্পন্ন করেছেন। সূরা আন-নাযিয়াত : ২৭-২৮।আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন :

وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ

এখানে أيدٍ শব্দটি يَدٌ এর জমা নয়। বরং এর অর্থ ক্ষমতা ও শক্তি।

আর আসমান আমরা তা নির্মাণ করেছি আমাদের ক্ষমতা বলে এবং আমরা নিশ্চয়ই মহাসম্প্রসারণকারী। সূরা আয-যারিয়াত: ৪৭।

তারপর যমীন সম্পর্কে বলেছেন, “তিনিই তো তোমাদের জন্য যমীনকে সুগম করে দিয়েছেন; অতএব তোমরা এর দিক-দিগন্তে বিচরণ কর এবং তার দেয়া রিযক থেকে তোমরা আহার কর; আর পুনরুত্থান তো তারই কাছে।” [সূরা আল-মুলক: ১৫]

আর যে যমীন তথা ভূপৃষ্ঠের দিকে তাকাবে, সে দেখতে পাবে কীভাবে আল্লাহ তা`আলা একে সুগম করেছেন, এর মধ্যে আমাদের জন্য রাস্তা বানিয়েছেন, এর উপরিভাগে দৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, এতে বরকত দিয়েছেন, এতে সমভাবে খাদ্য নিরূপণ করে দিয়েছেন এবং বান্দাদের জন্য এসব আহরণ করা সহজ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ مِنْ فَوْقِهَا وَبَارَكَ فِيهَا وَقَدَّرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءً لِلسَّائِلِينَ

‘আর তার উপরিভাগে তিনি দৃঢ় পর্বতমালা স্থাপন করেছেন এবং তাতে বরকত দিয়েছেন, আর তাতে চারদিনে প্রার্থীদের জন্য সমভাবে খাদ্য নিরূপণ করে দিয়েছেন। সূরা ফুসসিলাত : ১০।

বান্দারা যাতে রিযক অন্বেষণ করতে পারে তাই আল্লাহ তা‘আলা যমীনকে সমতল বানিয়েছেন। বান্দারা যমীনে চাষাবাদ করে, যমীন থেকে পানি বের করে তা পান করে তৃপ্ত হয়। আল্লাহ তা‘আলা যমীনকে স্থির করেছেন, তাঁর নির্দেশ ছাড়া তা নড়ে না বা কম্পিত হয় না। আল্লাহ তা‘আলা, তাই ইরশাদ করেন :

وَفِي الْأَرْضِ آَيَاتٌ لِلْمُوقِنِينَ

‘সুনিশ্চিত বিশ্বাসীদের জন্য যমীনে অনেক নিদর্শন রয়েছে. সূরা আয-যারিয়াত : ২০।

আল্লাহ তা‘আলার আরেক নিদর্শন তাঁর গড়া আসমান-যমীনের অসংখ্য জীব। আসমানে অসংখ্য অগণিত ফেরেশতা রয়েছেন, যার সঠিক সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা`আলাই জানেন। যমীনে আল্লাহ তা‘আলা যে কত জাতের ও কত প্রজাতির জীব সৃষ্টি করেছেন, তিনি ছাড়া তা কেউ জানে না। আর এগুলোর সংখ্যা যে কত তাও কল্পনার অতীত। এসব জীব আবার নানা প্রজাতির, নানা রঙের এবং নানা ধরনের। এর মধ্যে কিছু আছে যা আমাদের জন্য উপকারী। এর দ্বারা আল্লাহর নিয়ামতের পূর্ণতা উপলব্ধি করা যায়। আবার কিছু আছে মানুষের জন্য ক্ষতিকর, এর দ্বারা মানুষের নিজের জীবনের মূল্য এবং আল্লাহর সৃষ্টির সামনে তার দুর্বলতার অনুভূতি হাসিল হয়। এসব সৃষ্টির প্রত্যেকেই কিন্তু আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাগুণ বর্ণনা করে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন :

تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَوَاتُ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيمًا غَفُورًا.

‘সাত আসমান ও যমীন এবং এগুলোর মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছু তাঁর তাসবীহ পাঠ করে এবং এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রসংশায় তাসবীহ পাঠ করে না; কিন্তু তাদের তাসবীহ তোমরা বুঝ না। নিশ্চয় তিনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ। সূরা বনী ইসরাঈল : ৪৪।

পৃথিবীতে আমাদের দেখা না-দেখা এবং জানা –নাজানা যত প্রাণী আছে সকল প্রাণীর রিযকও আল্লাহ তা‘আলা দিয়ে থাকেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُبِينٍ

‘আর যমীনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিযকের দায়িত্ব আল্লাহরই এবং তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। সব কিছু আছে স্পষ্ট কিতাবে। সূরা হূদ: ৬

আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে তো অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।    সূরা রুমঃ ২২

(২) রাত দিনের পরিবর্তন কিভাবে নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত, তা এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয় নি। অন্য আয়াতে তা ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে। যেমন,

“বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ্‌ যদি রাতকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ্‌ ছাড়া এমন কোন ইলাহ আছে, যে তোমাদেরকে আলো এনে দিতে পারে? তবুও কি তোমরা কর্ণপাত করবে না? বলুন, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ যদি দিনকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, আল্লাহ ছাড়া এমন কোন ইলাহ আছে, যে তোমাদের জন্য রাতের আবির্ভাব ঘটাবে যাতে বিশ্রাম করতে পার? তবুও কি তোমরা ভেবে দেখবে না?” [সূরা আল-কাসাস: ৭১, ৭২]

আল্লাহ তা`আলা ইরশাদ করেন :

فَالِقُ الْإِصْبَاحِ وَجَعَلَ اللَّيْلَ سَكَنًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ حُسْبَانًا ذَلِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ

‘(তিনি) প্রভাত উদ্ভাসিতকারী। তিনি বানিয়েছেন রাতকে প্রশান্তি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে সময় নিরূপক। এটা সর্বজ্ঞ পরাক্রমশালীর নির্ধারণ.’ সূরা আনআম : ৯৬।

(৩) এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সামুদ্রিক জাহাজের মাধ্যমে এক দেশের মালামাল অন্য দেশে আমদানী-রফতানী করার মাঝেও মানুষের এত বিপুল কল্যাণ নিহিত রয়েছে যা গণনাও করা যায় না। আর এ উপকারিতার ভিত্তিতেই যুগে যুগে, দেশে দেশে নতুন নতুন বাণিজ্যপন্থা উদ্ভাবিত হয়েছে। এমনিভাবে আকাশ থেকে এভাবে পানিকে বিন্দু বিন্দু করে বর্ষণ করা, যাতে কোন কিছুর ক্ষতিসাধিত না হয়। যদি এ পানি প্লাবনের আকারে আসত, তাহলে কোন মানুষ, জীব-জন্তু কিংবা অন্যান্য জিনিসপত্র কিছুই থাকত না।

অতঃপর পানি বর্ষণের পর ভূ-পৃষ্ঠে তাকে সংরক্ষণ করা মানুষের সাধ্যের আওতায় ছিল না। যদি তাদেরকে বলা হত, তোমাদের সবাই নিজ নিজ প্রয়োজনমত ছ’মাসের প্রয়োজনীয় পানি সংরক্ষণ করে রাখ, তাহলে তারা পৃথক পৃথকভাবে কি সে ব্যবস্থা করতে পারত? আর কোনক্রমে রেখে দিলেও সেগুলো পচন অথবা বিনষ্ট হওয়ার হাত থেকে কেমন করে রক্ষা করত? কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই সে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কুরআনে বলা হয়েছেঃ

“আমি পানিকে ভূমিতে ধারণ করিয়েছি, যদিও বৃষ্টির পানি পড়ার পর তাকে প্রবাহিত করেই নিঃশেষ করে দেয়ার ক্ষমতা আমার ছিল”। [সূরা আল-মুমিনুন: ১৮]

কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা পানিকে বিশ্ববাসী মানুষ ও জীব-জন্তুর জন্য কোথাও উন্মুক্ত খাদ-খন্দে সংরক্ষিত করেছেন, আবার কোথাও ভূমিতে বিস্তৃত বিভিন্ন স্তরের মাধ্যমে ভূমির অভ্যন্তরে সংরক্ষণ করেছেন। তারপর এমন এক ফল্গুধারা সমগ্র জমীনে বিছিয়ে দিয়েছেন যা পতিত কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে করে নিতে পারে। আবার এ পানিরই একটা অংশকে জমাট বাধা সাগর বানিয়ে তুষার আকারে পাহাড়ের চূড়ায় চাপিয়ে দিয়েছেন যা পতিত কিংবা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একান্ত সংরক্ষিত; অথচ ধীরে ধীরে গলে প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারার মাধ্যমে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সারকথা, উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলার পরিপূর্ণ ক্ষমতার কয়েকটি বিকাশস্থলের বর্ণনার মাধ্যমে তাওহীদ বা একত্ববাদই প্রমাণ করা হয়েছে।

(৪) এ আয়াতে আল্লাহ তা’আলার প্রকৃত একত্ববাদ সম্পর্কে বাস্তব লক্ষণ ও প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা জ্ঞানী-নিজ্ঞান নির্বিশেষে যে কেউই বুঝতে পারে। আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের চিরাচরিত বিবর্তন তারই ক্ষমতার পরিপূর্ণতা ও একত্ববাদের প্রকৃত প্রমাণ। অনুরূপভাবে পানির উপর নৌকা ও জাহাজ তথা জলযানসমূহের চলাচলও একটি বিরাট প্রমাণ। পানিকে আল্লাহ্ তা’আলা এমন এক তরল পদার্থ করে সৃষ্টি করেছেন যে, একান্ত তরল ও প্রবাহমান হওয়া সত্বেও তার পিঠের উপর লক্ষ লক্ষ মণ ওজনবিশিষ্ট বিশালাকায় জাহাজ বিরাট ওজনের চাপ নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলাচল করে।

তদুপরি এগুলোকে গতিশীল করে তোলার জন্য বাতাসের গতি ও নিতান্ত রহস্যপূর্ণভাবে সে গতির পরিবর্তন করতে থাকা প্রভৃতি বিষয়ও এদিকেই ইঙ্গিত করে যে, এগুলোর সৃষ্টি ও পরিচালনার পিছনে এক মহাজ্ঞানী ও মহা বিজ্ঞ সত্তা বিদ্যমান। পানীয় পদার্থগুলো তরল না হলে যেমন এ কাজটি সম্ভব হত না, তেমনি বাতাসের মাঝে গতি সৃষ্টি না হলেও জাহাজ চলতে পারত না; এগুলোর পক্ষে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করাও সম্ভব হত না। মহান আল্লাহ বলেন,

“তিনি ইচ্ছে করলে বায়ুকে স্তব্ধ করে দিতে পারেন; ফলে নৌযানসমূহ নিশ্চল হয়ে পড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠে। নিশ্চয়ই এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে প্রত্যেক চরম ধৈর্যশীল ও একান্ত কৃতজ্ঞ ব্যক্তির জন্য।” [সূরা আশ-শুরা ৩৩]  তাফসীরে জাকারিয়া

আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদেরকে প্রদর্শন করান বিদ্যুৎ ভয় ও আশার সঞ্চারকরূপে এবং আসমান থেকে পানি নাযিল করেন। অতঃপর তা দিয়ে যমীনকে পুনর্জীবিত করেন সেটার মৃত্যুর পর; নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা অনুধাবন করে। সূরা রুমঃ ২৪

সংক্ষেপে বলা যায়— এই আয়াতটি বহুল অর্থবিশিষ্ট। কারণ, বিশ্বজাহানের সৃষ্টি এবং তার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কীয় সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে একত্রে উল্লিখিত হয়েছে, যা অন্য কোন আয়াতে নেই।

(ক) আসমান ও যমীনের সৃষ্টিঃ যার ব্যাপকতা ও বিশালতা বর্ণনার মুখাপেক্ষী নয়।

(খ) রাত ও দিনের একের পর এক আসা। দিনকে উজ্জ্বল এবং রাতকে অন্ধকার করাঃ যাতে জীবিকার জন্য কাজকর্মও যেন হয় এবং আরামও যেন করা যেতে পারে। আবার রাত বড় ও দিন ছোট হওয়া। অনুরূপ এর বিপরীত দিন বড় ও রাত ছোট হওয়া।

(গ) সমুদ্রে নৌকা ও পানিজাহাজের চলাচলঃ যার সাহায্যে ব্যবসার সফরও হয় এবং জীবিকা নির্বাহের টন টন পণ্যসামগ্রী এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছানো হয়।

(ঘ) বৃষ্টিঃ যা যমীনের উর্বরতা ও শ্যামলতার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।

(ঙ) বিভিন্ন প্রকারের পশু-সৃষ্টিঃ যা বহন, চাষাবাদ এবং যুদ্ধেও কাজে আসে। এমন কি মানুষের খাদ্যের একটা বড় পরিমাণ প্রয়োজন এদের দিয়ে পূরণ হয়।

(চ) সব রকমের হাওয়া প্রবাহিতকরণঃ ঠান্ডা ও গরম, উপকারী ও অপকারী। পূর্ব ও পশ্চিমমুখী, আবার উত্তর ও দক্ষিণমুখী; মানুষের জীবন এবং তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী।

(ছ) মেঘের সৃষ্টিঃ যার দ্বারা মহান আল্লাহ যেখানে চান, সেখানেই বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এই যাবতীয় বিষয়াদি কি মহান আল্লাহর মহাশক্তি ও তাঁর একত্বকে প্রমাণ করে না? অবশ্যই করে। এই সৃষ্টিসমূহ এবং তার নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় তাঁর কি কোন শরীক আছে? না, অবশ্যই না। তাহলে তাঁকে ছেড়ে অন্যকে উপাস্য এবং প্রয়োজন পূরণকারী মনে করা কি বুদ্ধিমানের কাজ?  তাফসীরে আহসানুল বায়ান

মহান রবের এই নিদর্শনের মূল উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। মহান আল্লাহ জানিয়েছেন—

আপনি অন্ধদেরকেও তাদের পথ ভ্রষ্টতা থেকে পথে আনতে পারবেন না। আপনি তো কেবল তাদেরকে শোনাতে পারবেন, যারা আমাদের নিদর্শনাবলীতে ঈমান আনে। অতঃপর তারাই আত্মসমর্পণকারী। সূরা নমলঃ ৮১

অচিরেই আমি এদেরকে সর্বত্র আমার নিদর্শনসমূহ দেখাবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও ৷ যাতে এদের কাছে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ কুরআন যথার্থ সত্য এটাই কি যথেষ্টে নয় যে, তোমার রব প্রতিটি জিনিস দেখছেন ? হামীম আস সাজদাহঃ ৫৩

আর যারা আল্লাহর নিদর্শন ও তাঁর সাক্ষাত অস্বীকার করে, তারাই আমার অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়েছে। আর তাদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। সূরা আনকাবুতঃ২৩

২:১৬৫ وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّتَّخِذُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اَنۡدَادًا یُّحِبُّوۡنَهُمۡ کَحُبِّ اللّٰهِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَشَدُّ حُبًّا لِّلّٰهِ ؕوَ لَوۡ یَرَی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡۤا اِذۡ یَرَوۡنَ الۡعَذَابَ ۙ اَنَّ الۡقُوَّۃَ لِلّٰهِ جَمِیۡعًا ۙ وَّ اَنَّ اللّٰهَ شَدِیۡدُ الۡعَذَابِ

১৬৫. আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তারা তাদেরকে ভালবাসে আল্লাহ্‌র ভালবাসার মতই; পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাসে। আর যারা যুলুম করেছে যদি তারা আযাব দেখতে পেত, (তবে তারা নিশ্চিত হত যে,) সমস্ত শক্তি আল্লাহরই। আর নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।

[তাওয়াক্কুল, ভয় ও আশার মতই একটি ইবাদত ‘ভালবাসা’ (الحب والمحبة)। ভালবাসার ক্ষেত্রেও উপরের জাগতিক ও ঈমানী দুটি পর্যায় আছে। জাগতিক ভালবাসা ইবাদত নয়, তবে জাগতিক ভালবাসা যদি আল্লাহর বিধান পালনের বিপরীতে দাঁড়ায় তবে তা পাপ। পিতামাতা, সন্তান, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক, উপকারী মানুষ ও অন্যান্য বিভিন্ন মানুষকে মানুষ জাগতিকভাবে ভালবাসে। এরূপ ভালবাসার উৎস জাগতিক সম্পর্ক, মেলামেশা, দেখাশুনা ইত্যাদি।

ঈমানী ভালবাসার তিনটি দিক রয়েছে: (১) আল্লাহকে ভালবাসা (حب الله), (২) আল্লাহর জন্য ভালবাসা (الحب لله) এবং (৩) আল্লাহর সাথে ভালবাসা (الحب مع الله)। আল্লাকে ভালবাসা হয় কেবলমাত্র তাঁরই জন্য আর কারো জন্য নয়। আর এ ভালবাসার সাথে থাকে গভীর অলৌকিক ভয়, আশা ও অসহায়ত্বের ও ভক্তির প্রকাশ। এরূপ ভালবাসাই ইবাদত। আল্লাহর জন্য ভালবাসতে হয় যাদেরকে আল্লাহ ভালবাসতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর আল্লাহর সাথে ভালবাসা হলো শিরক। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর জন্য নয়, বরং তার নিজের কারণে ভালবাসা বা অলৌকিক ভক্তি, ভয় ও অসহায়ত্বের সাথে ভালবাসা শিরক। মহান আল্লাহ বলেন

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ

‘মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে, কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তম। সূরা  বাকারা: ১৬৫।

মুশরিকগণ দাবি করত যে, তারা তাদের উপাস্যদেরকে ভালবাসত ‘আল্লাহর প্রিয়’ হওয়ার কারণে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের হৃদয়ে এ সকল উপাস্যের প্রেমই ছিল মূল। এদের মর্যাদায়, প্রশংসায় কিছু বললে তারা খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠত। পক্ষান্তরে একমাত্র আল্লাহর মর্যাদা, প্রশংসা ও গুণকীর্তন করলে তারা বিরক্ত হতো। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِالآَخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

‘একমাত্র আল্লাহর কথা বলা হলে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে যারা তাদের উল্লেখ করা হয়ে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।সূরা যুমার: ৪৫।]

ড আব্দুল্লাহ জাহাংগির লেখা

[বান্দার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার যে ভয়-ভীতি বিদ্যমান থাকে সেটার সাথে তার ভালোবাসা মিশ্রিত হওয়া চাই। কেননা শুধু ভয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা খারেজীদের দীনের মূল বিষয়।

সুতরাং ভালোবাসা হলো ইসলামের মূল বিষয়। এটিই ইসলামের কেন্দ্র বিন্দু। অতএব আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসার পূর্ণতা অনুপাতেই তার দীন পরিপূর্ণ হয়ে থাকে এবং ভালোবাসার ঘাটতি অনুযায়ীই মানুষের তাওহীদ ত্রুটিযুক্ত হয়।

ভালোবাসা বলতে এখানে ইবাদতের ভালোবাসা উদ্দেশ্য, যা নত হওয়া, বিনয়ী হওয়া এবং পরিপূর্ণ আনুগত্যের দাবি করার সাথে সাথে স্বীয় প্রিয়পাত্রকে অন্যের উপর প্রাধান্য দেয়ারও দাবি জানায়। এ ভালোবাসাটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য খালেস বা নির্দিষ্ট হওয়া চাই। এতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা জায়েয নয়। কেননা ভালোবাসা দু’প্রকার।

(ক) একক ও খাস ভালোবাসা: এটি হচ্ছে ইবাদতের ভালোবাসা, যা পরিপূর্ণরূপে নত হওয়া এবং পরিপূর্ণরূপে মাহবুবের অনুগত থাকার দাবি করে। এ শ্রেণীর ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্দিষ্ট।

(খ) সাধারণ ও যৌথ ভালোবাসা: এটি তিন প্রকার। প্রথমটি হচ্ছে স্বভাবগত ও সৃষ্টিগত ভালোবাসা। যেমন খাবারের প্রতি ক্ষুধার্ত লোকের ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মায়া-মমতার ভালোবাসা। যেমন সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা। তৃতীয়টি হচ্ছে, পরিচিতি ও সাহচর্যের ভালোবাসা। যেমন এক অংশীদার অন্য অংশীদারকে এবং এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে ভালোবাসে।

এ তিন প্রকার ভালোবাসার মধ্যে সম্মান প্রদর্শন করা ও নত হওয়া আবশ্যক নয় এবং এর জন্য কাউকে পাকড়াও করা হবে না। তা ছাড়া এটি খাস ভালোবাসার সাথে সাংঘর্ষিকও নয়। সেগুলো কারো মধ্যে থাকলে শিরকও হয় না। কিন্তু খাস বা একক ভালোবাসাকে এগুলোর উপর অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। একক ও খাস ভালোবাসা দ্বারা ইবাদতের ভালোবাসা উদ্দেশ্য। এ ভালোবাসার কথা নিম্নের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ (বাকারাঃ১৬৫) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে আল্লাহর ভালোবাসার মতই ভালোবাসবে, সে ঐ ব্যক্তির মতো হবে, যে ভালোবাসা ও তা’যীমের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যদেরকে তার শরীক হিসাবে গ্রহণ করেছে।

ইমাম ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে মুশরিকদের দুনিয়ার অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং আখিরাতে তাদের যে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি রয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। কেননা তারা আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করেছে। তারা তাদের সাথে ঐরূপ ভালোবাসা পোষণ করে, যেরূপ ভালোবাসা আল্লাহর সাথে হওয়া উচিত। অর্থাৎ তারা ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে তাদেরকে আল্লাহর সমান করে ফেলে।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ এর উপরোক্ত কথাকে সমর্থন করেছেন। ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে তারা যে তাদের মাবুদদেরকে আল্লাহর সমান করে ফেলতো, সে কথা আল্লাহ তা‘আলা তার নিম্নের বাণীতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

﴿تَاللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ إِذْ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘আল্লাহর কসম আমরা তো স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালকের সমকক্ষ গণ্য করতাম’’। (সূরা শুআরা: ৯৭-৯৮)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন

﴿ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ﴾

অতঃপর কাফেররা অন্যদেরকে তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে। সূরা আনআম:১

আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ ‘‘যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী’’।

অর্থাৎ মুশরিকরা আল্লাহকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, মুমিনগণ তাকে তাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। অথবা মুশরিকরা তাদের শরীকদেরকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলাকে তারচেয়ে বহুগুণ বেশি ভালোবাসে। সুতরাং আয়াতটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি কোনো কিছুর প্রতি ঐরূপ ভালোবাসা পোষণ করে, যেরূপ ভালোবাসা আল্লাহর জন্য হওয়া বাঞ্চনীয় সে সেটাকে ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলো।

শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি কোনো শরীক গ্রহণ করলো এবং সেটাকে আল্লাহর ভালোবাসার সমান ভালোবাসলো, এ ক্ষেত্রে সে আল্লাহ সাথে বড় শির্কে লিপ্ত হলো।

আমাদের কথাও শাইখের কথার কাছাকাছি। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ইবাদতের যে ভালোবাসা পোষণ করা আবশ্যক, তাকে ঐসব ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দেয়া উচিত, যা ইবাদতের ভালোবাসা নয়। সেগুলো হচ্ছে সাধারণ ভালোবাসা যেমন পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক ভালোবাসা, ধন-সম্পদের ভালোবাসা ইত্যাদি। যারা এসব কিছুর ভালোবাসাকে আল্লাহর ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দিবে, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কঠিন শাস্তির ধমক দিয়েছেন।] শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান লেখা

উল্লিখিত সুস্পষ্ট দলীলাদি ও অকাট্য প্রমাণাদি সত্ত্বেও বহু মানুষ এমনও রয়েছে, যারা এককভাবে আল্লাহর ইবাদত না করে তাঁর সাথে অন্যদেরকে তাঁর শরীক স্থাপন করে থাকে। তাদের সাথে ঐরূপ ভালবাসা পোষণ করে, যেরূপ ভালবাসা আল্লাহর সাথে হওয়া উচিত। আর এটা যে কেবল মহানবী (সাঃ)-এর আগমনের সময়ই ছিল তা নয়, বরং শিরকের এই প্রচলন বর্তমানেও ব্যাপক। বর্তমানে ইসলামের দাবীদারদের মধ্যেও এ রোগ সংক্রমণ করেছে। তারা গায়রুল্লাহ, পীর, ফকীর এবং মাজারের গদিনশীনদেরকে কেবল নিজেদের (বিপদে) আশ্রয়স্থল, (মুক্তির) আধার, প্রয়োজনপূরণের ক্বিবলা বানিয়ে রেখেছে যে তা নয়, বরং তারা তাদেরকে আল্লাহর থেকেও বেশী ভালবাসা দান করেছে! তাওহীদের দর্স ও নসীহত তাদেরকেও ঐরূপ অপছন্দ লাগে, যেরূপ মক্কার মুশরিকদেরকে লাগত। কুরআনের এক আয়াতে মহান আল্লাহ তাদের সে চিত্র তুলে ধরে বলেন,

{وَإِذَا ذُكِرَ اللهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ}

‘‘যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, ‘আল্লাহ এক’ –একথা বলা হলে তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং তিনি ছাড়া অন্য (উপাস্য)-দের উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়। (সূরা যুমার ৪৫ আয়াত) اشمَأزَّت মানে হৃদয় সংকীর্ণ হওয়া।

তবে ঈমানদাররা মুশরিকদের বিপরীত, তাদের ভালোবাসা মহান আল্লাহরই সাথে সর্বাধিক হয়। কেননা, মুশরিকরা যখন সমুদ্রে ইত্যাদিতে বিপদে ফেঁসে যায়, তখন তারা নিজেদের উপাস্য ভুলে গিয়ে কেবল মহান আল্লাহকেই ডাকে।

{فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ} (العنكبوت: ৬৫) {وَإِذَا غَشِيَهُمْ مَوْجٌ كَالظُّلَلِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ} (لقمان: ৩২) {وَظَنُّوا أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ} (يونس:২২)

এই আয়াতগুলোর সারমর্ম হল, মুশরিকরা কঠিন বিপদের সময় সাহায্যের জন্য কেবল আল্লাহকেই ডাকত।  তাফসীরে আহসানুল বায়ান

কুরআন ও হাদীসের পর্যালোচনায় আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের একাধিক নিদর্শনপাওয়া যায়।

রাসূল সা বলেছেন-

তিনটি জিনিস যার মধ্যে পাওয়া যাবে সে প্রকৃত ঈমানের স্বাদ পেয়েছে। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল অন্য সবকিছু থেকে তার কাছে প্রিয় হবে। সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কোন ব্যক্তিকে ভালবাসে। আল্লাহ তাকে কুফরী থেকে মুক্তি দেয়ার পর পুনর্বার কুফরীতে ফিরে যাওয়া আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতোই অপছন্দ করে। (-বোখারী, মুসলিম, নাসায়ী।)

এ আয়াতে তাদের ব্যাপারে সতর্কবাণী আরোপ করা হয়েছে যারা ইবাদাত ও সম্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভালবাসার মত আর কাউকে ভালবাসবে।

«রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমল হচ্ছে আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসা এবং আল্লাহর জন্য কারো সাথে শত্রুতা করা।» (আহমদ)

আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন-{বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান-যাকে তোমরা পছন্দ কর-আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর রাহে জেহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত।} [সূরা: আত-তাওবাহ : ২৪]

এ আয়াতে তাদের প্রতি কঠিন সতর্কবাণী রয়েছে যারা উক্ত আট শ্রেণীর প্রতি আল্লাহ থেকে বেশী মুহাব্বত পোষণ করেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- «তোমরা কেউ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সন্তান, পিতা ও অন্যদের চেয়ে আমাকে অধিক ভাল না বাসবে।» (-ইবনে মাজাহ।)

৫- ঈমানদারদের ভালবাসার পরিবর্তে মুশরিকদের বন্ধুরূপে গ্রহণ ও তাদেরকে ভালবাসা মূলত: আল্লাহর প্রতি ভালবাসার সংগে সাংঘর্ষিক বিষয়। সুতরাং আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ঈমানের মস্তবড় মূলনীতি। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-

{মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোন কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে।} [সূরা: আলে-ইমরান: ২৮।]

আল্লাহ তা’আলা মুমিন বান্দাদেরকে কাফেরদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন এবং এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, যে ব্যক্তি এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর বন্ধুত্ব থাকবে না। সুতরাং আল্লাহর বন্ধুদের ভালবাসা ও শত্রুদের ভালবাসা ভিন্ন ও বিপরীত দুটি বিষয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন: {তবে যদি তোমরা তাদের পক্ষ থেকে কোন অনিষ্টের আশঙ্কা কর, তবে তাদের সাথে সাবধানতার সাথে থাকবে।}

[সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ২৮।]

কাফেরদের সাথে কেবল ঐ সকল লোকদেরকে বন্ধুত্বের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যারা কাফেরদের অনিষ্টের শিকার হওয়ার আশংকাবোধ করে। শুধু এ ক্ষেত্রেই তাদের সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা যাবে। তখন তাদের সাথে বাহ্যিকভাবে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ করা যাবে তবে অন্তর ঈমানের প্রতি অবিচল থাকবে এবং কাফেরদের কুফরের প্রতি ঘৃণা থাকবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন:{যার উপর জবরদস্তি করা হয় এবং তার অন্তর বিশ্বাসে অটল থাকে সে ব্যতীত।}[সূরা: আন-নাহল, আয়াত: ১০৬]

যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পার্থিব জীবন ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মধ্যে একটিকে গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেয়া হয় তখন তিনি বলেন: «বরং পরম বন্ধুর সান্নিধ্য।» (-আহমদ।)

সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর মুহাব্বত ও তাঁর সাথে সাক্ষাতকে প্রাধান্য দেন এবং আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়াকে দুনিয়ার মোহ ও ভোগের উপর প্রাধান্য দেন।

আল্লাহর প্রতি ভালবাসার নিদর্শন হলো অধিক পরিমাণে তাঁকে স্মরণ করা এবং তাঁর সাক্ষাতের প্রতি উদগ্রীব হওয়া। কেউ কোন বস্তুকে ভালবাসলে তার স্মরণ এবং সাক্ষাতের চেয়ে প্রিয় তার কাছে আর কি থাকতে পারে?

আল্লাহ তাআলার প্রতি বান্দার ভালোবাসা সত্য হওয়ার আলামত সম্পর্কে তিনি বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি তার দীন থেকে ফিরে যায়, তাহলে আল্লাহ আরো এমন বহু লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হবে, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি সেটা দান করেন। বস্তুত আল্লাহ প্রাচুর্যময় এবং সর্ব বিষয়ে অবগত’’। (সূরা আল মায়িদা: ৫৪)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ভালোবাসার চারটি আলামত উল্লেখ করেছেন।

প্রথম আলামত: যারা আল্লাহকে ভালোবাসে তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও দয়ালু হবে। তারা তাদের মুমিন ভাইদের প্রতি কোমল হবে, তাদের উপর দয়া করবে এবং তাদের প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শন করবে। আতা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, পিতা যেমন পুত্রের প্রতি স্নেহশীল হয়, তারা মুমিনদের প্রতিও অনুরূপ হবে।

দ্বিতীয় আলামত: তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর হবে। অর্থাৎ তারা কাফেরদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করবে এবং তারা নিজেদেরকে কাফেরদের উর্ধ্বে মনে করবে। তারা কোনোভাবেই কাফেরদের প্রতি নতি স্বীকার করবে না এবং তাদের কাছে দুর্বলতাও দেখাবে না।

তৃতীয় আলামত: তারা জান-মাল, হাতের শক্তি ও জবান দিয়ে আল্লাহর পথে ও আল্লাহর দীনকে শক্তিশালী করা এবং শত্রুদের মূলোৎপাটন করার জন্য যে কোনো উপায়ে জিহাদ করবে।

চতুর্থ আলামত: তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করতে গিয়ে এবং সত্যের বিজয় আনতে গিয়ে জান-মাল খরচ করার পথে কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। সত্যের সাহায্যার্থে তারা নিজেদের জান-মাল খরচ করার সময় মানুষের তিরস্কার ও দোষারোপ তাদের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। কেননা তারা যে দীনের উপর রয়েছে, তা সত্য হওয়ার ব্যাপারে তাদের পরিপূর্ণ প্রত্যয় রয়েছে এবং তাদের ঈমান ও ইয়াকীন খুবই শক্তিশালী। নিন্দুকের নিন্দার কারণে যদি ভালোবাসা পোষণকারীর ভালোবাসায় ভাটা পড়ে অতঃপর সে যদি তার হাবীবের সাহায্য করতে দুর্বলতা দেখায়, তাহলে সে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা পোষণকারী নয়। [শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান]

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার দশটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

(১) গভীর মনোযোগ সহকারে কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করা এবং কুরআনের অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করা।

(২) ফরয সালাত শেষে নফল সালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল করার চেষ্টা করা।

(৩) জবান, অন্তর ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের মাধ্যমে সবসময় ও সকল অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার যিকির করা।

(৪) বান্দা যা ভালোবাসে এবং আল্লাহ যা ভালোবাসেন, -এ দু’টি ভালোবাসা সাংঘর্ষিক হলে আল্লাহর ভালোবাসাকেই প্রাধান্য দেয়া।

(৫) আল্লাহর অতি সুন্দর নামসমূহ, তার সুউচ্চ গুনাবলীসমূহ এবং সেটার কামালিয়াত, বড়ত্ব, মর্যাদা ও প্রশংসনীয় ফলাফল নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা।

(৬) আল্লাহ তা‘আলার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নিয়ামতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবষেণা করা এবং বান্দাদের উপর তার দয়া, অনুগ্রহ ও নিয়ামতগুলো গভীর দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করা।

(৭) মন-প্রাণ উজাড় করে আল্লাহর সামনে কাকুতি-মিনতি করা এবং নিজের সকল প্রয়োজন আল্লাহর কাছে তুলে ধরা।

(৮) রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে যখন দুনিয়ার আসমানে নুযুলে এলাহীর সময় হয় তখন নির্জনে আল্লাহ তা‘আলার নিকট কান্না-কাটি করা, দু‘আ করা এবং কুরআন তেলওয়াত করা। ক্ষমা প্রার্থনা ও তাওবার মাধ্যমে শেষ রাতের আমলের সমাপ্তি করা।

(৯) আল্লাহর প্রিয় বান্দা-সৎলোকদের সাথে উঠা-বসা করা এবং তাদের উপদেশ-নছীহত ও কথা-বার্তা থেকে উপকৃত হওয়া।

(১০) আল্লাহর মাঝে ও বান্দার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক জিনিস থেকে দূরে থাকা।

রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই এই দোয়া করতেন: ‘হে আল্লাহ! আপনার ভালোবাসা চাই, আপনার ভালোবাসার জনের ভালোবাসা চাই; আর সে আমল করার তৌফিক চাই, যে আমল করলে আপনার ভালোবাসা লাভ করা যায়।’ (মুআত্তা ইমাম মালিক)

২:১৬৬ اِذۡ تَبَرَّاَ الَّذِیۡنَ اتُّبِعُوۡا مِنَ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡا وَ رَاَوُا الۡعَذَابَ وَ تَقَطَّعَتۡ بِهِمُ الۡاَسۡبَابُ

১৬৬. যখন যাদের অনুসরণ করা হয়েছে তারা, যারা অনুসরণ করেছে তাদের থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেবে এবং তারা শাস্তি দেখতে পাবে। আর তাদের পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে,

২:১৬৭ وَ قَالَ الَّذِیۡنَ اتَّبَعُوۡا لَوۡ اَنَّ لَنَا کَرَّۃً فَنَتَبَرَّاَ مِنۡهُمۡ کَمَا تَبَرَّءُوۡا مِنَّا ؕ کَذٰلِکَ یُرِیۡهِمُ اللّٰهُ اَعۡمَالَهُمۡ حَسَرٰتٍ عَلَیۡهِمۡ ؕ وَ مَا هُمۡ بِخٰرِجِیۡنَ مِنَ النَّارِ

১৬৭.আর যারা অনুসরণ করেছিল তারা বলবে, ‘হায়! যদি একবার আমাদের ফিরে যাওয়ার সুযোগ হতো তবে আমরাও তাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম যেমন তারা আমাদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে’(১)। এভাবে আল্লাহ তাদের কার্যাবলী তাদেরকে দেখাবেন, তাদের জন্য আক্ষেপস্বরূপ(২)। আর তারা কখনো আগুন থেকে বহির্গমণকারী নয়।

(১) এ আয়াতে জাহান্নামবাসীদের মধ্যে নেতারা ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে যে সমস্ত ঝগড়া-বিবাদ হবে সেটার কিছু কথোপকথন ও তাদের অনুতাপের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অন্যান্য স্থানে এ বিষয়টি আরও বেশী করে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে,

“আর যারা কুফরী করেছে তারা বলে, “আমরা এ কুরআনে কখনো বিশ্বাস করব না, এর পূর্ববতী কিতাবসমূহেও নয়। হায়! আপনি যদি দেখতেন যালিমদেরকে যখন তাদের রবের সামনে দাঁড় করানো হবে তখন তারা পরস্পর বাদ-প্রবিবাদ করতে থাকবে, যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, তোমরা না থাকলে আমরা অবশ্যই মুমিন হতাম।

যারা ক্ষমতাদর্পী ছিল তারা, যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তাদের বলবে, ‘তোমাদের কাছে সৎপথের দিশা আসার পর আমরা কি তোমাদেরকে তা থেকে নিবৃত্ত করেছিলাম? বরং তোমরাই ছিলে অপরাধী। যাদেরকে দুর্বল মনে করা হত তারা ক্ষমতাদর্পীদেরকে বলবে, প্রকৃত পক্ষে তোমরাই তো দিনরাত চক্রান্তে লিপ্ত ছিলে, যখন তোমরা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলে যেন আমরা আল্লাহর সাথে কুফর করি এবং তার জন্য সমকক্ষ (শির্ক) স্থাপন করি। আর যখন তারা শাস্তি দেখতে পাবে তখন তারা অনুতাপ গোপন রাখবে এবং যারা কুফরী করেছে আমরা তাদের গলায় শৃংখল পরাব। তাদেরকে তারা যা করত তারই প্রতিফল দেয়া হবে।” [সূরা সাবা: ৩১-৩৩]

(২) আবুল আলীয়াহ বলেন, তাদের খারাপ আমলসমূহ কিয়ামতের দিন তাদের জন্য আফসোস ও পরিতাপের কারণ হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “সেদিন প্রত্যেকেই জান্নাতে তাদের ঘর এবং জাহান্নামে তাদের ঘরের দিকে তাকাবে। সেদিন হচ্ছে আফসোসের দিন। তিনি বলেন, জাহান্নামীরা জান্নাতে তাদের জন্য নির্দিষ্ট ঘরের দিকে তাকাবে তারপর তাদের বলা হবে, হায় যদি তোমরা এর জন্য আমল করতে। তখন তাদেরকে আফসোস পেয়ে বসবে। আর জান্নাতীরা জাহান্নামে তাদের জন্য নির্দিষ্ট তাদের ঘরের দিকে তাকাবে, তখন তাদের বলা হবে, যদি আল্লাহ তোমাদের উপর তার দয়া না করতেন তবে তো তোমরা সেখানকার অধিবাসীই হতে।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ৪/৪৯৬-৪৯৭]তাফসীরে জাকারিয়া

সাতটি বিষয়ে মানুষ আফসোস করবে। পবিত্র কোরআন সেগুলোর বর্ণনা দিয়েছে :

১. নিজেদের কৃতকর্মের ফিরিস্তি দেখে আফসোস করে করে বলবে,

হায়! আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম! এরশাদ হচ্ছে : ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম; সেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে এবং অবিশ্বাসী বলবে, হায় আফসোস! যদি আমি মাটি হয়ে যেতাম।’ (সুরা নাবা : ৩০)।

২. জাহান্নামকে তাদের সামনে উপস্থিত করা হবে। তখন নেক আমল অগ্রে না পাঠানোর জন্য আফসোস করবে।

‘আর সেদিন জাহান্নামকে উপস্থিত করা হবে; ওই দিন মানুষ স্মরণ করবে। কিন্তু সেই স্মরণ তা কী উপকারে আসবে? সে বলবে, হায়! আমি যদি আগে আমার এ জীবনের জন্য কিছু পাঠাতাম! সেদিন আল্লাহর আজাবের মতো আজাব কেউ দিতে পারবে না।’ (সুরা ফাজর, ২৩-২৪-২৫)

অর্থাৎ সেদিন জাহান্নামকে আনা হবে বা সামনে উপস্থিত করা হবে। হাদিসে এসেছে, ‘জাহান্নামকে ফেরেশতারা টেনে নিয়ে আসবে, সেদিন জাহান্নামের ৭০ হাজার লাগাম হবে, প্রতি লাগামে ৭০ হাজার ফেরেশতা থাকবে।’ (মুসলিম : ২৮৪২)।

৩. বাম হাতে আমলনামা পেয়ে আফসোস করবে। মরে যেতে চাইবে। কিন্তু আর মৃত্যু নেই।

‘কিন্তু যার আমলনামা তার বাম হাতে দেওয়া হবে, সে বলবে, হায়! আমাকে যদি দেওয়াই না হতো আমার আমলনামা; আর আমি যদি না জানতাম আমার হিসাব! হায়! আমার মৃত্যুই যদি আমার শেষ হতো! আমার ধন-সম্পদ আমার কোনো উপকারেই এলো না। (সুরা হাক্কা : ২৫-২৮)।

৪. মানুষ খারাপ বন্ধু গ্রহণ করার কারণে জাহান্নামি হবে। তখন দুই হাতে কামড়াতে থাকবে আর আফসোস করবে,

আমি নবী-রাসুল ও তাঁদের প্রতিনিধিদের কথা কেন শুনলাম না! কেন অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ করলাম! ‘জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের দুহাত দংশন করতে করতে বলবে, হায়! আমি যদি রাসুলের সঙ্গে কোনো পথ অবলম্বন করতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার! আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে তো সে পথভ্রষ্ট করেছিল, আমার কাছে উপদেশ পৌঁছার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।’ (সুরা ফুরকান : ২৭-২৯)।

৫. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অনুসরণ না করার কারণে মানুষ আফসোস করবে। দুনিয়ায় মনে করেছে এসব দিয়ে কোনো লাভ হবে না। কিন্তু সেখানে বাস্তবতা প্রকাশিত হওয়ার পর আফসোস করতে থাকবে।

‘যেদিন তাদের মুখম-ল আগুনে উলটপালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম আর রাসুলকে মানতাম! তারা আরও বলবে, হে আমাদের রব! আমরা আমাদের নেতা ও বড়লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল; হে আমাদের রব! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং তাদের বেশি করে অভিশম্পাত করুন।’ (সুরা আহজাব : ৬৬-৬৮)

৬. জান্নাতিদের দেখে জাহান্নামিরা আফসোস করে বলবে, আমরা তাদের সঙ্গে থাকলে তাদের মতো ঈমান ও আমল করলে তো আজকে আমরাও তাদের মতো সফল হতাম। জাহান্নামে যেতে হতো না।

এরশাদ হচ্ছে : ‘আর যদি তোমাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ হয়, তাহলে সে অবশ্যই বলবে, হায়! যদি আমি তাদের সঙ্গে থাকতাম, তাহলে আমিও বিরাট সাফল্য লাভ করতাম।’ (সুরা নিসা : ৭৩)।

তাফসিরিবিদ মুজাহিদ (রহ.) বলেন, এ আয়াত ও পূর্ববর্তী আয়াতে যাদেরকে বলা হয়েছে, তারা হচ্ছে মোনাফেক।

৭. জাহান্নামের পাশে তাদের নিয়ে গেলে মোমিন না হওয়ার আফসোস করবে। আবার দুনিয়ায় ফিরে আসতে চাইবে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে : ‘তুমি যদি দেখতে পেতে যখন তাদের দোজখের পাশে দাঁড় করানো হবে এবং তারা বলবে, হায়! যদি আমাদের পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন ঘটত, তাহলে আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিদর্শনকে মিথ্যা বলতাম না এবং আমরা বিশ্বাসীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা আনআম : ২৭)।

এ আয়াতে অবিশ্বাসী ও অপরাধীদের অবস্থা বর্ণনা হয়েছে, আখেরাতে যখন তাদের জাহান্নামের কিনারায় দাঁড় করানো হবে এবং তারা কল্পনাতীত ভয়াবহ শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে, তখন তারা আফসোস করে বলবে, আমাদের পুনরায় দুনিয়াতে প্রেরণ করা হলে আমরা প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি ও নির্দেশাবলিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতাম না; বরং এগুলো বিশ্বাস করে ঈমানদারদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেতাম।

দুনিয়ায় ভুল করলে শোধরানোর সুযোগ থাকে। তওবা করা যায়। যত মারাত্মক ও বড় গোনাহই হোক না কেন, আল্লাহ তায়ালার কাছে খাঁটি দিলে তওবা করলে তিনি ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু হাশরের ময়দানে আফসোস করলে কোনো লাভ হবে না। অনেকে বলবে, হে আল্লাহ! আমাদের আবার দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিন; আমরা আপনার হুকুম মতো চলব। কিন্তু কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।

তাদের কথা পবিত্র কোরআনের ভাষায় দেখুন : ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এ থেকে আমাদের উদ্ধার করো; আমরা যদি পুনরায় তা করি, তবে আমরা জালেম গণ্য হব। আল্লাহ বলবেন, তোমরা ধিক্কৃত অবস্থায় এখানেই পড়ে থাক এবং আমার সঙ্গে কোনো কথা বলো না।’ (সুরা মুমিনুন : ১০৭-১০৮)।

সংগ্রহে—তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন