সুরা বাকারাঃ ১৮তম রুকু (১৪৮-১৫২)আয়াত
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:১৪৮ وَ لِکُلٍّ وِّجۡهَۃٌ هُوَ مُوَلِّیۡهَا فَاسۡتَبِقُوا الۡخَیۡرٰتِ ؕ اَیۡنَ مَا تَکُوۡنُوۡا یَاۡتِ بِکُمُ اللّٰهُ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿
আর প্রত্যেকের একটি দিক রয়েছে, যে দিকে সে চেহারা ফিরায়। অতএব তোমরা সৎকাজে প্রতিযোগিতা কর। তোমরা যেখানেই থাক না কেন আল্লাহ্ তোমাদের সবাইকে নিয়ে আসবেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
প্রত্যেক ধর্মাবলম্বিরা নিজেরদের পছন্দ মত ক্বিবলা বানিয়ে রেখেছে যেদিকে তারা মুখ করে থাকে।
এর দ্বিতীয় অর্থ হল, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বিরা নিজেদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পন্থা ও তরীকা বানিয়ে রেখেছে। যেমন, কুরআনের অন্য স্থানে এসেছে,
{لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَمِنْهَاجًا وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَجَعَلَكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَكِنْ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آتَاكُمْ}
তোমাদের প্রত্যেকের জন্য এক একটি শরীয়ত (আইন) ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদেরকে এক জাতি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদেরকে যা দিয়েছেন, তা দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য (তিনি তা করেননি)। (সূরা মাইদাহ ৪৮ আয়াত)
অর্থাৎ, মহান আল্লাহ হিদায়াত ও গুমরাহী উভয় পথকে পরিষ্কার করে দিয়ে মানুষকে দু’টি পথের মধ্যে কোন একটি নির্বাচন করার যে স্বাধীনতা দিয়েছেন এরই ফলে মানুষ ভিন্ন ভিন্ন এমন পথ ও মত অবলম্বন করেছে, যা একে অপরের বিপরীত। যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহলে সবাইকে একই পথের পথিক অর্থাৎ, সবাইকে হিদায়াতের পথে পরিচালিত করতে পারতেন। কিন্তু এটা স্বাধীনতা ছিনিয়ে না নিয়ে সম্ভব ছিল না। আর স্বাধীনতা দেওয়ার উদ্দেশ্য, পরীক্ষাকরণ। অতএব হে মুসলিমগণ! তোমরা সৎকাজে প্রতিযোগিতামূলকভাবে অগ্রসর হও! অর্থাৎ, নেকী ও সৎ পথে প্রতিষ্ঠিত থাকো। এটাই হল, আল্লাহর অহী এবং রসূল (সাঃ)-এর অনুসরণের পথ, যা থেকে অন্য ধর্মাবলম্বিরা বঞ্চিত।তাফসীরে আহসানুল বায়ান
ইসলামের বিরুদ্ধে কে, কী করছে, এই সব নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে, আমাদেরকে প্রতিযোগিতা করতে হবে- আমরা কে, কত বেশি ভালো কাজ করতে পারি। আল্লাহ প্রত্যেককে বিশেষ লক্ষ্য দিয়েছেন। আমাদেরকে সেই লক্ষ্য উপলব্ধি করে চেষ্টা করে যেতে হবে সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করার।
আমাদের কাজ হচ্ছে: আমাদের নিজেদের লক্ষ্য উপলব্ধি করা এবং সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা। ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করা। যে যত বেশি ভালো কাজ করবে, সে-ই জিতে যাবে। তাই যারা বুদ্ধিমান, তারা দুনিয়া নামের এই এই পরীক্ষা ক্ষেত্রে ভালো কাজে অন্যদের থেকে বেশি নাম্বারে এগিয়ে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাবে।
এই আয়াতে وِجْهَةٌ শব্দটির কয়েকটি অর্থ রয়েছে, যেমন ১) মুখ, ২) দিক, ৩) উদ্দেশ্য, লক্ষ্য। অনেকে এই আয়াতের অর্থ করেছেন যে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিজ নিজ কিবলা রয়েছে, আর মুসলিমদের কিবলা হচ্ছে কা’বা। আবার অনেকে এর অর্থ করেছেন: প্রত্যেকের নিজ নিজ লক্ষ্য রয়েছে, তাই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিযোগিতা করতে হবে। ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যাকে নামায পড়তে হবে তাকে অবশ্যি কোন না কোন দিকে মুখ ফেরাতে হবে ৷ কিন্তু যেদিকে মুখ ফেরানো হয় সেটা আসল জিনিস নয় , আসল জিনিস হচ্ছে সেই নেকী ও কল্যাণগুলো যেগুলো অর্জন করার জন্য নামায পড়া হয় ৷ কাজেই দিক ও স্থানের বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ে নেকী ও কল্যান অর্জনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে ৷
পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত কী অর্জন করে যেতে পারলাম, কয়টা লোককে ইসলামের পথে আনলাম, কয়টা মসজিদ বানালাম, কয়টা ইসলামিক ডিগ্রি পেলাম —সেটা লক্ষ্য নয়। আসল লক্ষ্য হলো: আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ভালো কাজ করতে কতটুকু চেষ্টা করেছি।
যারা ঈমান রাখে আল্লার প্রতি এবং শেষ দিবসের প্রতি। তারা আদেশ করে ভাল কাজের এবং নিষেধ করে মন্দ কাজে এবং তারা প্রতিযোগিতা করে নেক কাজে। তারাই নেককারদের মধ্যে সামিল (আলে ইমরান :১১৪)।
وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ﴾
তোমরা প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে ধাবমান হও তোমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে ক্ষমা এবং ঐ জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের ন্যায়, যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে মোত্তাকীদের জন্য (আলে ইমরান:১৩৩)।
কাজেই আমি তার দোয়া কবুল করেছিলাম এবং তাকে ইয়াহ্ইয়া দান করেছিলাম, আর তার স্ত্রীকে তার জন্য যোগ্য করে দিয়েছিলাম৷তারা সৎকাজে আপ্রাণ চেষ্টা করতো, আমাকে ডাকতো আশা ও ভীতি সহকারে এবং আমার সামনে ছিল অবনত হয়ে৷ (২১-সূরা আল আম্বিয়াঃ-৯০)
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اصْبِرُوا وَصَابِرُوا وَرَابِطُوا وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾
হে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং ধৈর্যধারণে প্রতিযোগিতা কর আর সদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাক। আর আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে (আলে ইমরান:২০০)।
তুমি তাদের মুখমন্ডলে দেখতে পাবে সুখ-শান্তির সজীবতা। তাদেরকে সীলমোহরকৃত বিশুদ্ধ শরাব পান করতে দেয়া হবে, যার সীলমোহর হবে কস্তুরীর, আর এরূপ বস্ত্তর জন্যই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত। আর তার মিশ্রণ হবে তাসনীমের, এমন এক ঝরনা, যা থেকে আল্লাহর সান্নিধ্যপ্রাপ্তরা পান করবে (সূত্রঃ আল্-ক্বোরআন ৮৩:২৪-২৮)।
ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে ছাদাক্বাহ করার নির্দেশ দেন। ঘটনাক্রমে সেদিন আমার কাছে মালও ছিল। আমি (মনে মনে) বললাম, আজ আমি আবুবকর (রাঃ)-এর অগ্রগামী হব। যদিও আমি কোনো দিন দানে তার অগ্রগামী হ’তে পারিনি। কাজেই আমি আমার অর্ধেক মাল নিয়ে উপস্থিত হ’লাম। রাসূল (ছাঃ) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পরিবারের জন্য কি অবশিষ্ট রেখে এসেছ? আমি বললাম, এর সমপরিমাণ। ওমর (রাঃ) বলেন, আর আবু বকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত মাল নিয়ে উপস্থিত হ’লেন। রাসূল (ছাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পরিবারের জন্য কি অবশিষ্ট রেখে এসেছ? তিনি বললেন, আল্লাহ আর তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, আমি কখনো কোনো বিষয়েই আপনাকে অতিক্রম করতে পারব না’।আবুদাউদ হা/১৬৭৮ ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘সমস্ত সম্পদ দানের অনুমতি সম্পর্কে’ অনুচ্ছেদ-৪১ ১ম খন্ড ৫২৬ পৃঃ; মিশকাত হা/৬০২১।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, অাঁধার রাতের মতো ফিৎনা আসার পূর্বেই তোমরা সৎ আমলের দিকে ধাবিত হও। সে সময় সকালে একজন মুমিন হ’লে বিকেলে কাফির হয়ে যাবে। বিকেলে মুমিন হ’লে সকালে কাফির হয়ে যাবে। দুনিয়ার সামগ্রীর বিনিময়ে সে তার দ্বীন বিক্রি করে বসবে’।মুসলিম হা/১৮৬, ২১৩; মিশকাত হা/৫৩৮৩।
২:১৪৯ وَ مِنۡ حَیۡثُ خَرَجۡتَ فَوَلِّ وَجۡهَکَ شَطۡرَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ وَ اِنَّهٗ لَلۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکَ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُوۡنَ
আর যেখান থেকেই আপনি বের হন না কেন মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফিরান। নিশ্চয় এটা আপনার রব-এর কাছ থেকে পাঠানো সত্য। আর তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফেল নন।
২:১৫০ وَ مِنۡ حَیۡثُ خَرَجۡتَ فَوَلِّ وَجۡهَکَ شَطۡرَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ وَ حَیۡثُ مَا کُنۡتُمۡ فَوَلُّوۡا وُجُوۡهَکُمۡ شَطۡرَهٗ ۙ لِئَلَّا یَکُوۡنَ لِلنَّاسِ عَلَیۡکُمۡ حُجَّۃٌ ٭ۙ اِلَّا الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مِنۡهُمۡ ٭ فَلَا تَخۡشَوۡهُمۡ وَ اخۡشَوۡنِیۡ ٭ وَ لِاُتِمَّ نِعۡمَتِیۡ عَلَیۡکُمۡ وَ لَعَلَّکُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ
আর আপনি যেখান থেকেই বের হন মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফিরান এবং তোমরা যেখানেই থাক না কেন এর দিকে তোমাদের চেহারা ফিরাও, যাতে তাদের মধ্যে যালিম ছাড়া অন্যদের তোমাদের বিরুদ্ধে বিতর্কের কিছু না থাকে। কাজেই তাদেরকে ভয় করো না এবং আমাকেই ভয় কর। আর যাতে আমি তোমাদের উপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করি এবং যাতে তোমরা হিদায়াত লাভ কর।
ক্বিবলার দিকে মুখ ফিরানোর নির্দেশের তিনবার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। হয় এর উপর তাকীদ ও এর গুরুত্ব বর্ণনা করার জন্য অথবা এই জন্য যে, এটা কোন বিধানকে রহিত ঘোষণা করার প্রথম পরীক্ষা ছিল। তাই মনের মধ্যেকার সন্দেহ-সংশয় ও খুঁতখুঁতে ভাবকে দূর করার জন্য জরুরী ছিল যে, তার বারবার পুনরাবৃত্তি করে মানুষের অন্তরে সুদৃঢ় করে দেওয়া হোক।
আবার এও হতে পারে যে, একাধিক কারণের জন্য এ রকম করা হয়েছে।
এক কারণ তো এই ছিল যে, নবী করীম (সাঃ)-এর এটা আন্তরিক ইচ্ছা ও আশা ছিল। তা বর্ণনা করার জন্য এ কথা বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বি ও দাওয়াতদাতার নিজস্ব পৃথক কেন্দ্র (ক্বিবলা) ছিল, তা বর্ণনা করে এ কথার পুনরাবৃত্তি হয়।
তৃতীয় কারণ, বিরোধীপক্ষের অভিযোগসমূহের খন্ডনের জন্য তৃতীয়বার তা পুনরুক্ত হয়। (ফাতহুল ক্বাদীর)
এখানে {ظَلَمُوْا} (সীমালংঘনকারী যালেম) থেকে বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আহলে-কিতাবদের মধ্যে যারা কট্টর বিদ্বেষী, তারা জানে যে, শেষ নবীর ক্বিবলা কাবাগৃহ হবে, তা সত্ত্বেও শুধুমাত্র শত্রুতাবশতঃ বলবে যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পরিবর্তে কাবাকে ক্বিবলা বানিয়ে মুহাম্মাদ শেষ পর্যন্ত স্বীয় বাপ-দাদার ধর্মের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। আবার কারো কাছে সীমালংঘনকারী বলে উদ্দেশ্য হল মক্কার মুশরিকগণ।
অর্থাৎ, যাতে আহলে-কিতাব বলতে না পারে যে, আমাদের কিতাবে তো ওদের ক্বিবলা কাবা শরীফ বলা হয়েছে, অথচ ওরা বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়ছে।
তাদেরকে ভয় করো না অর্থাৎ, মুশরিকদের কথার পরোয়া করো না। তারা বলেছিল যে, মুহাম্মাদ তো আমাদের ক্বিবলা গ্রহণ করে নিয়েছে, এবার অতি সত্বর দেখবে সে আমাদের দ্বীনও গ্রহণ করে নেবে। ‘আমাকেই ভয় কর’ অর্থাৎ, যে নির্দেশ আমি দিতে থাকব, তার উপর নির্ভয়ে আমল করতে থাকো।
ক্বিবলার পরিবর্তনকে অনুগ্রহ পরিপূর্ণতা ও পথপ্রাপ্তি বলে আখ্যায়িত করে এ কথা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে যে, অবশ্যই আল্লাহর নির্দেশের উপর আমল মানুষকে অনুগ্রহ, পুরস্কার ও সম্মানের অধিকারী বানায় এবং সে সুপথপ্রাপ্তি তথা হিদায়াতের তওফীক লাভ করে।তাফসীরে আহসানুল বায়ান
এখানে অনুগ্রহ বলতে নেতৃত্ব বুঝানো হয়েছে ৷ বনী ইসরাঈলদের থেকে কেড়ে নিয়ে এই নেতৃত্ব উম্মাতে মুসলিমাকে দেয়া হয়েছিল ৷ আল্লাহ প্রণীত বিধান অনুযায়ী একটি উম্মাতকে দুনিয়ার জাতিসমূহের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করা এবং মানবজাতিকে সৎকর্মশীলতা ও আল্লাহর ইবাদাতের পথে পরিচালিত করার দায়িত্বে তাকে নিয়োজিত করা ছিল তার সত্যানুসারিতার চরম পুরস্কার ৷ এই নেতৃত্বের দায়িত্বে যে উম্মাতকে দেয়া হয়েছে তার ওপর আসলে আল্লাহর অনুগ্রহ ও নিয়ামত পরিপূর্ণ করা হয়েছে ৷ আল্লাহ এখানে বলছেন, কিব্লাহ পরিবর্তনের এ নির্দেশটি আসলে এই পদে তোমাদের সমাসীন করার নিশানী ৷ কাজেই অকৃতজ্ঞতা ও নাফরমানীর প্রকাশ ঘটলে যাতে এ পদটি তোমাদের থেকে ছিনিয়ে না নেয়া হয় সে জন্যও তোমাদের আমার এই নির্দেশ মেনে চলা দরকার ৷ এটা মেনে চললে তোমাদের প্রতি এই নিয়ামত ও অনুগ্রহ পরিপূর্ণ করে দেয়া হবে ৷(তাফহিমুল কুর’আন)
২:১৫১ کَمَاۤ اَرۡسَلۡنَا فِیۡکُمۡ رَسُوۡلًا مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡا عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِنَا وَ یُزَکِّیۡکُمۡ وَ یُعَلِّمُکُمُ الۡکِتٰبَ وَ الۡحِکۡمَۃَ وَ یُعَلِّمُکُمۡ مَّا لَمۡ تَکُوۡنُوۡا تَعۡلَمُوۡنَ
যেমন আমরা তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে রাসূল পাঠিয়েছি যিনি তোমাদের কাছে আমাদের আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করেন, তোমাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেন। আর তা শিক্ষা দেন যা তোমরা জানতে না।
এ পর্যন্ত কেবলা পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনা চলে আসছিল। এখানে বিষয়টিকে এমন এক পর্যায়ে এনে সমাপ্ত করা হয়েছে, যাতে বিষয়টির ভূমিকায় কা’বা নির্মাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর দো’আর বিষয়টিও প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর বংশধরদের মধ্যে এক বিশেষ মর্যাদায় মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাব। এতে এ বিষয়েও ইংগিত করা হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আবির্ভাবে কা’বা নির্মাতার দো’আরও একটা প্রভাব রয়েছে। কাজেই তার কেবলা যদি কা’বা শরীফকে সাব্যস্ত করা হয়, তাহলে তাতে বিস্ময়ের কিংবা অস্বীকারের কিছু নেই।
২:১৫২ فَاذۡکُرُوۡنِیۡۤ اَذۡکُرۡکُمۡ وَ اشۡکُرُوۡا لِیۡ وَ لَا تَکۡفُرُوۡنِ
অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর; আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, আর কৃতঘ্ন হয়ো না।
যিকর আরবী শব্দ। এর বেশ কয়েকটি অর্থ হতে পারে-
(ক) মুখ থেকে যা উচ্চারণ করা হয়।
(খ) অন্তরে কোন কিছু স্মরণ করা।
(গ) কোন জিনিস সম্পর্কে সতর্ক করা।
শরী’ঈ পরিভাষায় যিকর হচ্ছে, বান্দা তার রবকে স্মরণ করা। হোক তা তার নাম নিয়ে, গুণ নিয়ে, তার কাজ নিয়ে, প্রশংসা করে, তার কিতাব তিলাওয়াত করে, তার একত্ববাদ ঘোষণা করে, তার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে অথবা তার কাছে কিছু চেয়ে।
যিকর দুই প্রকার। যথা – কওলী বা কথার মাধ্যমে যিকর ও আমলী বা কাজের মাধ্যমে যিকর।
প্রথম প্রকার যিকরের মধ্যে রয়েছে – কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর সুন্দর সুন্দর নাম ও সিফাতসমূহের আলোচনা ও স্মরণ, তার একত্ববাদ ঘোষণা ইত্যাদি।
আর দ্বিতীয় প্রকারে রয়েছে – ইলম অর্জন করা ও শিক্ষা দেয়া, আল্লাহর হুকুম-আহকাম ও আদেশ-নিষেধ মেনে চলা ইত্যাদি।
প্রথম প্রকার যিকরের মধ্যে কিছু যিকর আছে যা সময়, অবস্থা এবং সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, সকাল ও সন্ধ্যার যিকর, সালাতের পরের যিকর, খাওয়ার শুরু-শেষ, কাপড় পরিধান, মসজিদে প্রবেশ-বাহির ইত্যাদি সহ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ-কর্মের দোআ বা যিকরসমূহ।
যে সকল যিকর অবস্থা, সময় ও সংখ্যার সাথে সম্পৃক্ত সেগুলোর সংখ্যা, সময় অথবা অবস্থা কোনটিরই পরিবর্তন করা জায়েয নেই। যে সকল যিকর এ তিনটির সাথে সম্পৃক্ত নয় অর্থাৎ সাধারণ যিকর, সেগুলো সময়, সংখ্যা অথবা অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করাও জায়েয নেই। ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘মৌখিক যিকরের জন্য কোন নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হওয়া এবং নির্দিষ্ট শব্দ নির্ধারণ করা বিদ’আত’। [ইবনুল হুমাম, শরহে ফাতহুল কাদীরঃ ২/৭২]
যিকর এর ফযীলত অসংখ্য। তন্মধ্যে এটাও কম ফযীলত নয় যে, বান্দা যদি আল্লাহকে স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহও তাকে স্মরণ করেন।
আবু উসমান নাহদী রাহেমাহুল্লাহ বলেন, আমি সে সময়টির কথা জানি, যখন আল্লাহ তা’আলা আমাদিগকে স্মরণ করেন। উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি তা কেমন করে জানতে পারেন? বললেন, তা এজন্য যে, কুরআনুল কারীমের ওয়াদা অনুসারে যখন কোন মুমিন বান্দা আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ নিজেও তাকে স্মরণ করেন। কাজেই বিষয়টি জানা সবার জন্যই সহজ যে, আমরা যখন আল্লাহর স্মরণে আত্মনিয়োগ করব, আল্লাহ্ তা’আলাও আমাদের স্মরণ করবেন।
সাঈদ ইবনে যুবায়ের রাহিমাহুল্লাহ যিকরুল্লাহ’র তাফসীর প্রসঙ্গে বলেছেন যে, যিকরের অর্থই হচ্ছে আনুগত্য এবং নির্দেশ মান্য করা। তার বক্তব্য হচ্ছেঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করে না, সে আল্লাহর যিকরই করে না; প্রকাশ্যে যতবেশী সালাত এবং তাসবীহই সে পাঠ করুক না কেন। মূলত: যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্য করে অর্থাৎ তার হালাল ও হারাম সম্পর্কিত নির্দেশগুলোর অনুসরণ করে, সেই আল্লাহকে স্মরণ করে, যদি তার নফল সালাত ও সিয়াম কিছু কমও হয়। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশাবলীর বিরুদ্ধাচরণ করে সে সালাত-সিয়াম, তাসবীহ-তাহলীল প্রভৃতি বেশী করে করলেও প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহকে স্মরণ করে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ যে ব্যক্তি যিকর করে এবং যে ব্যক্তি যিকর করেনা তাদের উপমা হচ্ছে জীবিত ও মৃতের ন্যায়। [বুখারীঃ ২০৮]
অপর এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তোমাদেরকে কি এমন একটি উত্তম আমলের সংবাদ দেব যা তোমাদের মালিকের নিকট অধিকতর পবিত্র, তোমাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অধিকতর সহায়ক, স্বর্ণ ও রৌপ্য ব্যয় করা থেকেও তোমাদের জন্য উত্তম, শক্রর সাথে মোকাবেলা করে গর্দান দেয়া-নেয়া থেকে উত্তম? তারা বলল, হ্যাঁ অবশ্যই বলবেন। তিনি বললেন, যিকরুল্লাহ। [তিরমিযীঃ ৫/৪৫৯]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত এক হাদীসে-কুদসীতে আছে, আল্লাহ্ তাআলা বলেন, বান্দা যে পর্যন্ত আমাকে স্মরণ করতে থাকে বা আমার স্মরণে যে পর্যন্ত তার ঠোট নড়তে থাকে, সে পর্যন্ত আমি তার সাথে থাকি। [বুখারীঃ ৭৪০৫]
১৩:২৮ اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِکۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ
. যারা ঈমান আনে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের মন প্রশান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই মন প্রশান্ত হয়। সূরা আর রাদঃ ২৮
যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহর স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি, আপনি অত্যন্ত পবিত্র, অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন আলে ইমরানঃ ১৯১
অতঃপর যখন তোমরা সালাত সমাপ্ত করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে, অতঃপর যখন তোমরা নিরাপদ হবে তখন যথাযথ সালাত কায়েম করবে; নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। সূরা নিসাঃ১০৩
৭:২০৫ وَ اذۡکُرۡ رَّبَّکَ فِیۡ نَفۡسِکَ تَضَرُّعًا وَّ خِیۡفَۃً وَّ دُوۡنَ الۡجَهۡرِ مِنَ الۡقَوۡلِ بِالۡغُدُوِّ وَ الۡاٰصَالِ وَ لَا تَکُنۡ مِّنَ الۡغٰفِلِیۡنَ
আর আপনি আপনার রবকে নিজ মনে স্মরণ করুন সবিনয়ে, সশংকচিত্তে ও অনুচ্চস্বরে, সকালে ও সন্ধ্যায়। আর উদাসীনদের অন্তভুক্ত হবেন না।
২০:১২৪ وَ مَنۡ اَعۡرَضَ عَنۡ ذِکۡرِیۡ فَاِنَّ لَهٗ مَعِیۡشَۃً ضَنۡکًا وَّ نَحۡشُرُهٗ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ اَعۡمٰی
আর যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকবে, নিশ্চয় তার জীবন-যাপন হবে সংকুচিত এবং আমরা তাকে কিয়ামতের দিন জমায়েত করব অন্ধ অবস্থায়। সূরা ত্বহাঃ১২৪
অধিকাংশের নিকট এখানে কুরআন বোঝানো হয়েছে। সারমর্ম এই যে, যে ব্যক্তি কুরআনের বিধি-বিধান থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, কুরআনের নির্দেশের আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়; অন্যদের থেকে হিদায়াত গ্ৰহণ করে, তার পরিণাম এই যে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে। [ইবন কাসীর]
যিকরের ফযিলতঃ
- আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ (سَبَقَ الْمُفَرِّدُونَ) “নিঃসঙ্গ একাকী মানুষেরা এগিয়ে গেল। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল, মুফাররাদ বা একাকী মানুষেরা কারা?” তিনি বলেনঃ (الذَّاكِرُونَ اللَّهَ كَثِيرًا) আল্লাহর বেশি বেশি যিকরকারীগণ। সহীহ মুসলিম ৪/২০৬২, নং ২৬৭৬।
অন্য বর্ণনায় তিনি বলেনঃ (المُسْتَهْتَرُونَ بِذِكْرِ اللَّهِ يَضَعُ الذِّكْرُ عَنْهُمْ أَثْقَالَهُمْ فَيَأْتُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ خِفَافًا) “একাকী অগ্রগামীগণ হলেন ঐ সকল মানুষ, যারা আল্লাহর যিকরে মত্ত ও সর্বদা বেপরোয়াভাবে আল্লাহর যিকর করেন। যিকরের কারণে তাঁদের (গোনাহের) বোঝা হাল্কা হয়ে যাবে। এজন্য কিয়ামতের দিন তাঁরা হাল্কা হয়ে আল্লাহর দরবারে হাজির হবেন। তিরমিযী, ৩৫৯৬। তিরমিযী বলেন, হাদিসটি হাসান গারীব।
- মুআয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে আমার সর্বশেষ যে কথাটি হয়েছিল, যে কথাটি বলে আমি তাঁর থেকে শেষ বিদায় নিয়েছিলাম তা হলো, আমি প্রশ্ন করেছিলামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর নিকট সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে প্রিয়
আমল (কর্ম) কোনটি? তিনি বলেছিলেনঃ (أَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ أَنْ تَمُوتَ وَلِسَانُكَ رَطْبٌ مِنْ ذِكْرِ اللَّهِ) “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কর্ম যে, তুমি যখন মৃত্যু বরণ করবে তখনো তোমরা জিহ্বা আল্লাহর যিকরে আর্দ্র থাকবে।” বুখারী, খালকু আফ’আলিল ইবান ১/৭২, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/৯৯,
- আব্দুল্লাহ ইবনু বুসর (রাঃ) বলেন, একব্যক্তি বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইসলামের বিধানাবলী আমার জন্য বেশি হয়ে গিয়েছে। আমাকে এমন একটি আমল বলে দিন যা আমি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকব। তিনি বলেনঃ لا يزال لسانك رطبًا بذكر الله
“তোমার জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর যিকরে আর্দ্র থাকে।” সুনানে তিরমিযী, কিতাবুয দাওয়াত, নং ৩৩৭৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/৯৬, ইবনু মাজাহ ৩৭৯৩,
- আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ ৭ শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহ কিয়ামতের কঠিন দিনে তাঁর বিশেষ ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে এক শ্রেণীর মানুষঃ رَجُلٌ ذَكَرَ اللَّهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
“ঐ মানুষ যিনি একাকী আল্লাহর যিকর করেছেন আর তাঁর চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমেছে।” সহীহ বুখারী, কিতাবুল আযান, নং ৬৬০।
- আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ
مَنْ صَلَّى الْغَدَاةَ فِي جَمَاعَةٍ ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللَّهَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ … تَامَّةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ
“যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে আদায় করবে, এরপর বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকরে রত থাকবে। অতঃপর সে দুই রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে একটি হজ্ব ও একটি ওমরার সাওয়াব পাবে, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ (হজ্ব ও ওমরার সাওয়াব)। সুনানে তিরমিযী, কিতাবুল জুমু’আহ, নং ৫৮৬।
- মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললাম, আমাকে ওসীয়ত করুন। তিনি বললেনঃ
عليك بتقوى اللهِ ما استطَعْتَ واذْكُرِ اللهَ عندَ كُلِّ حَجَرٍ وشَجَرٍ وما عمِلْتَ من سوءٍ فأَحْدِثْ للهِ فيه توبةً السِّرُّ بالسِّرِّ والعَلانِيَةُ بالعَلانِيَةِ
“তুমি যথাসম্ভব আল্লাহকে ভয় করে (তাকওয়া আঁকড়ে ধরে) চলবে। প্রত্যেক পাথর ও গাছের নিকট আল্লাহর যিকর করবে। কোনো পাপ বা অন্যায় করলে নতুন করে আল্লাহর কাছে তাওবা করবে। গোপনের জন্য গোপনে ও প্রকাশ্যের জন্য প্রকাশ্যে।তাবারানী। সনদ হাসান। মাজমাউয যাওয়াইয়া ১০/৭৪
মুআয রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, “আল্লাহর আযাব থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে মানুষের কোন আমলই যিকরুল্লাহর সমান নয়।” যুন্নুন মিসর বলেনঃ ‘যে ব্যক্তি প্রকৃতই আল্লাহকে স্মরণ করে সে অন্যান্য সবকিছুই ভুলে যায়। এর বদলায় স্বয়ং আল্লাহ্ তা’আলাই সবদিক দিয়ে তাকে হেফাজত করেন এবং সবকিছুর বদলা তাকে দিয়ে দেন’।
অতএব এই অনুগ্রহ ও নিয়ামতের দরুন তোমরা আমার যিকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। অকৃতজ্ঞ হয়ে নিয়ামতকে অস্বীকার করো না। আর যিকর (স্মরণ) করার অর্থ হল, সদা-সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা। অর্থাৎ, ‘তাসবীহ’ (সুবহানাল্লাহ), ‘তাহলীল’ (লা ইলাহা ইল্লাল্লা-হ) এবং ‘তাকবীর’ (আল্লাহু আকবার) পাঠ করতে থাকো। আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার অর্থ হল, আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ও সামর্থ্যকে তাঁর (পক্ষ থেকেই আগত মনে করে তাঁরই সন্তুষ্টি ও) আনুগত্যের পথে ব্যয় করা। আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিকে তাঁর অবাধ্যতায় ব্যয় না করা। (এবং মুখে আল্লাহর প্রশংসার সাথে তা বয়ান করা।) এ রকম করলে আল্লাহর অকৃতজ্ঞ তথা নিয়ামতের কুফরী করা হয়। কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলে আরো অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ এবং অকৃতজ্ঞ হলে কঠিন শাস্তি পাওয়ার কথা এসেছে।
মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা কৃতজ্ঞ হলে তোমাদেরকে অবশ্যই অধিক দান করব, আর অকৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমার শাস্তি হবে কঠোর। (সূরা ইবরাহীম ৭ আয়াত)
কৃতজ্ঞ হওয়ার আহবানঃ
উবাইদ ইবনে উমাইর বলেনঃ আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললাম, রাসূলের সবচেয়ে আশ্চর্য কি কাজ আপনি দেখেছেন, তা আমাদেরকে জানান। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, হে আয়েশা, আমাকে আমার রবের ইবাদাত করতে দাও। আমি বললাম, হে রাসূল, আমি আপনার পাশে থাকতে ভালবাসি এবং যা আপনাকে খুশি করে তা করতে ভালবাসি। তারপর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করলেন এবং সালাত আদায়ে নিবিষ্ট হলেন ও কাঁদতে থাকলেন।
আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কাঁদছেন অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? এ রাতে আমার উপর একটি আয়াত নাযিল হয়েছে, যে ব্যক্তি তা তেলাওয়াত করল এবং চিন্তা-গবেষণা করল না, তার ধ্বংস অনিবার্য। তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। সহীহ [ইবনে হিব্বানঃ ৬২০]
তোমরা যারা বিশ্বাস করেছ, ভালো এবং পবিত্রগুলো গ্রহণ করো, যা আমি তোমাদেরকে সংস্থান হিসেবে দিয়েছি। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও, যদি তোমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করো। [আল-বাক্বারাহ ১৭২]
আল্লাহ যখন শয়তানকে তার সান্নিধ্য থেকে বের করে দিচ্ছিলেন, তখন শয়তান একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ শপথ করেছিল, যা থেকে তার মানুষকে ধ্বংস করার অন্যতম একটি প্রধান পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়—
(শয়তান বলল) “আমি মানুষের কাছে আসব ওদের সামনে থেকে, ওদের পেছন থেকে, ওদের ডান দিক থেকে এবং ওদের বাম দিক থেকে। আপনি দেখবেন ওরা বেশিরভাগই কৃতজ্ঞ না। [আল-আ’রাফ ৭:১৭]
কু’রআনে আল্লাহ প্রায় ৬০টি আয়াতে কৃতজ্ঞতার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন। এর মধ্যে একটি বিখ্যাত আয়াত হল—
মনে করে দেখো, তোমাদের প্রভু কথা দিয়েছিলেন, “যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও দিতেই থাকবো। কিন্তু যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও…, আমার শাস্তি বড়ই কঠিন। [ইব্রাহিম ১৪:৭]
সংগ্রহে—তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন