সুরা বাকারাঃ ১৭তম রুকু (১৪২-১৪৭)আয়াত
২য় পারা শুরু
أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
২:১৪২ سَیَقُوۡلُ السُّفَهَآءُ مِنَ النَّاسِ مَا وَلّٰىهُمۡ عَنۡ قِبۡلَتِهِمُ الَّتِیۡ کَانُوۡا عَلَیۡهَا ؕ قُلۡ لِّلّٰهِ الۡمَشۡرِقُ وَ الۡمَغۡرِبُ ؕ یَهۡدِیۡ مَنۡ یَّشَآءُ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسۡتَقِیۡمٍ
মানুষের মধ্য হতে নির্বোধরা অচিরেই বলবে যে, এ যাবত তারা যে কেবলা অনুসরণ করে আসছিল তা থেকে কিসে তাদেরকে ফিরালো? বলুন, পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথের হিদায়াত করেন।
ক্বিবলা (আরবি: قبلة, “দিক”), এছাড়াও কেবলা হিসাবে বর্ণান্তরিত, একটি দিক যার সম্মুখীন হয়ে মুসলিমরা নামাজের সময় প্রার্থনা করেন। এটি মক্কায় অবস্থিত কাবার দিক হিসাবে স্থিরীকৃত। অধিকাংশ মসজিদে মিহরাবের মাধ্যমে কাবাঘরের দিক নির্দেশ করা হয়।
যখন রসূল (সাঃ) হিজরত করে মক্কা থেকে মদীনায় যান, তখন প্রায় ১৬-১৭ মাস পর্যন্ত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়েন। তবে তাঁর ইচ্ছা এটাই হত যে, কাবা শরীফের দিকে মুখ করে নামায পড়া হোক যা ইবরাহীম (আঃ)-এর ক্বিবলা।
মসজিদুল আকসা হচ্ছে ইসলামের প্রথম কিবলা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরত করার পর প্রথম ১৬ মাস মসজিদুল আকসার দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেন। পরবর্তীতে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে মুসলমানদের কিবলা মক্কার দিকে পরিবর্তিত হয়। হিজরি দ্বিতীয় সনের শাবান মাসের মাঝামাঝি সময়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: কিছু সাহাবায়ে কিরামসহ মদিনার অদূরে মসজিদে বনু সালামায় জোহর মতান্তরে আসর নামাজ আদায় করেন। দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাকাতের মাঝামাঝি সময়ে মহান আল্লাহর নির্দেশে মহানবী সা: ও সাহাবায়ে কিরাম চার রাকাতবিশিষ্ট নামাজের বাকি দুই রাকাত মক্কায় অবস্থিত পবিত্র কাবা শরিফের দিকে ফিরে আদায় করেছিলেন বলে ইসলামের ইতিহাসে মসজিদটি (মসজিদে বনু সালামা) মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। বায়তুল মুকাদ্দাস হচ্ছে মক্কা ও মদিনার পর তৃতীয় পবিত্র স্থান। মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা: মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববী ও বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি। এ সম্পর্কে মহানবী সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো মসজিদে বিশেষ সওয়াবের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ করো না। ওই তিনটি মসজিদ হলোÑ মসজিদুল হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদুল আকসা’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)।
দ্বিতীয় হিজরিতে মদিনা মুনাওয়ারার বনি সালামা অঞ্চলের খালিদ বিন ওয়ালিদ সড়কসংলগ্ন এ মসজিদটি সর্বপ্রথম রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) নির্মাণ করেন। অতঃপর ১০০ হিজরিতে কিংবদন্তি ন্যায়পরায়ণ শাসক, দ্বিতীয় ওমর নামে খ্যাত খলিফা হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.) ‘মসজিদে কিবলাতাইন’ পুনর্নির্মাণ করেন।
ইবনুল কাইয়ুম থেকে বর্ণনা-
“তিনি জিবরীল (আঃ) কে বলেছিলেন- আমার আশা, আল্লাহ্ তা‘আলা যেন আমার চেহারা ইহুদীদের কিবলা হতে ফিরিয়ে দেন। জিবরীল বললেন- আমি তো আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র। আপনি আপনার রবের কাছে প্রার্থনা করুন এবং তাঁর কাছেই বিষয়টি বলুন। তিনি কিবলা পরিবর্তনের আশায় আকাশের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলেন। আর এর জন্য তিনি দু’আও করতেন এবং বারবার আসমানের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন”।
শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ ক্বিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দিলেন। তা দেখে ইয়াহুদী ও মুনাফিকরা হাঙ্গামা শুরু করে দিল। অথচ নামায আল্লাহর এক ইবাদত। আর ইবাদতে আবেদ (ইবাদতকারী)-কে যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়, সেইভাবে সে করতে বাধ্য। কাজেই যে দিকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন, সে দিকে ফিরে যাওয়া তাঁর জন্য জরুরী ছিল। তাছাড়া যে আল্লাহর ইবাদত করা হয়, পূর্ব ও পশ্চিম সব দিকই তাঁর; অতএব দিকের কোন গুরুত্ব নেই। প্রত্যেক দিকেই আল্লাহর ইবাদত হতে পারে। কেবল শর্ত হল, সেই দিকটা নির্বাচন করার নির্দেশ যেন আল্লাহ দিয়ে থাকেন। ক্বিবলা পরিবর্তনের এ নির্দেশ আসরের সময় এসেছিল। ফলে (সর্বপ্রথম) আসরের নামায কাবা শরীফের দিকে মুখ করে পড়া হয়েছে। তাফসীরে আহসানুল বায়ান
এটি হচ্ছে নির্বোধদের অভিযোগের প্রথম জবাব ৷ তাদের চিন্তার পরিসর ছিল সংকীর্ণ ৷ তাদের দৃষ্টি ছিল সীমাবদ্ধ ৷ স্থান ও দিক তাদের কাছে ছিল গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ৷ তাদের ধারণা ছিল আল্লাহ কোন বিশেষ দিকে সীমাবদ্ধ ৷ তাই সর্বপ্রথম তাদের এই মূর্খতাপ্রসূত অভিযোগের জবাবে বলা হয়েছে , পূর্ব ও পশ্চিম সবই আল্লাহর দিক ৷ কোন বিশেষ দিককে কিব্লায় পরিণত করার অর্থ এ নয় যে,আল্লাহ সেই দিকে আছেন৷ আল্লাহ যাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন তারা এ ধরনের সংকীর্ণ দৃষ্টির ও সংকীর্ণ মতবাদের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে এবং তাদের জন্য বিশ্বজনীন সত্য উপলব্ধির দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায় ৷
২:১৪৩ وَ کَذٰلِکَ جَعَلۡنٰکُمۡ اُمَّۃً وَّسَطًا لِّتَکُوۡنُوۡا شُهَدَآءَ عَلَی النَّاسِ وَ یَکُوۡنَ الرَّسُوۡلُ عَلَیۡکُمۡ شَهِیۡدًا ؕ وَ مَا جَعَلۡنَا الۡقِبۡلَۃَ الَّتِیۡ کُنۡتَ عَلَیۡهَاۤ اِلَّا لِنَعۡلَمَ مَنۡ یَّتَّبِعُ الرَّسُوۡلَ مِمَّنۡ یَّنۡقَلِبُ عَلٰی عَقِبَیۡهِ ؕ وَ اِنۡ کَانَتۡ لَکَبِیۡرَۃً اِلَّا عَلَی الَّذِیۡنَ هَدَی اللّٰهُ ؕ وَ مَا کَانَ اللّٰهُ لِیُضِیۡعَ اِیۡمَانَکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوۡفٌ رَّحِیۡمٌ
আর এভাবে আমরা তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর স্বাক্ষী হও এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারেন। আর আপনি এ যাবত যে কিবলা অনুসরণ করছিলেন সেটাকে আমরা এ উদ্দেশ্যে কেবলায় পরিণত করেছিলাম যাতে প্রকাশ করে দিতে পারি কে রাসূলের অনুসরণ করে এবং কে পিছনে ফিরে যায়? আল্লাহ্ যাদেরকে হিদায়াত করেছেন তারা ছাড়া অন্যদের উপর এটা নিশ্চিত কঠিন। আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমানকে ব্যর্থ করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, পরম দয়ালু।
এটি হচ্ছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মাতের নেতৃত্বের ঘোষণাবানী৷ ‘এভাবেই’শব্দটি সাহায্যে দু’দিকে ইংগিত করা হয়েছে ৷
এক: আল্লাহর পথপ্রদর্শনের দিকে ইংগিত করা হয়েছে৷ যার ফলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুগত্যকারীরা সত্য-সরল পথের সন্ধান পেয়েছে এবং তারা উন্নতি করতে করতে এমন একটি মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে যেখানে তাদেরকে ‘মধ্যপন্থী উম্মাত’ গণ্য করা হয়েছে ৷
দুই: এ সাথে কিব্লাহ পরিবর্তনের দিকেও ইংগিত করা হয়েছে ৷ অর্থাৎ নির্বোধরা একদিক থেকে আর একদিকে মুখ ফিরানো মনে করছে ৷ অথচ বাইতুল মাকদিস থেকে কা’বার দিকে মুখ ফিরানোর অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ বনী ইসরাঈলকে বিশ্ববাসীর নেতৃত্ব পদ থেকে যথানিয়মে হটিয়ে উম্মাতে মুহাম্মাদীয়াকে সে পদে বসিয়ে দিলেন ৷
وسط শব্দের অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট বিষয়।
আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম عدل শব্দ দ্বারা وسط এর ব্যাখ্যা করেছেন। [বুখারী: ৭৩৪৯] এর অর্থ সর্বোৎকৃষ্ট। আবার وسط অর্থ হয় মধ্যবর্তী, মধ্যপন্থী। সে হিসাবে এ আয়াতে মুসলিম সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠত্ব ও সম্মানের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, এ সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করা হয়েছে।
আমারদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত হিসেবে আল্লাহ পাঠিয়েছেন। এই আয়াতে বর্ণিত ‘ওয়াসাতান’ শব্দের অর্থ হচ্ছে– যথাযথ ভারসাম্যপূর্ণতা, বাড়াবাড়ি ও শৈথিল্য প্রদর্শনের মাঝামাঝি অবস্থান, মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ইত্যাদি। নিছক রাজনৈতিক অর্থে মধ্যপন্থা নয়, বরং ওয়াসাতিয়ার আলোকে মধ্যপন্থা। এর পেছনে যথার্থ কারণ রয়েছে। তাহলো আমরা যাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের কাছে সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়াই, যেভাবে মহানবী (সা.) আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের নিকট সাক্ষ্য হিসেবে প্রেরিত। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার।
মধ্যমপন্থী উম্মত’ শব্দটি অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক তাৎপর্যের অধিকারী। এর অর্থ হচ্ছে- এমন একটি উৎকৃষ্ট ও উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন দল, যারা নিজেরা ইনসাফ, ন্যায়-নিষ্ঠা ও ভারসাম্যের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দুনিয়ার জাতিদের মধ্যে যারা কেন্দ্রীয় আসন লাভের যোগ্যতা রাখে, সত্য ও সততার ভিত্তিতে সবার সাথে যাদের সম্পর্ক সমান এবং কারো সাথে যাদের কোনো অবৈধ ও অন্যায় সম্পর্ক নেই। মুসলিম সম্প্রদায়কে মধ্যপন্থী, ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায় বলে অভিহিত করে বলা হয়েছে যে, মানবীয় মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
سددوا وقاربوا واغدوا وروحوا وشيء من الدلجة والقصد، القصد تبلغوا
তোমরা আমলে মধ্যপন্থা অবলম্বন কর, বাড়াবাড়ি করো না। সকাল-সন্ধ্যায় (ইবাদতের জন্য) বের হয়ে পড় এবং রাতের কিছু অংশেও। তোমরা অবশ্যই পরিমিতি রক্ষা করো। তাহলে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৪৬৩)
বিখ্যাত তাবেঈ মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর পুত্রকে লক্ষ করে বলেছিলেন, বাছা! পুণ্য হচ্ছে দুই পাপের মাঝখানে অর্থাৎ শৈথিল্য ও বাড়াবাড়ির মাঝখানে। সবকিছুর মধ্যাবস্থাই সেরা। সেই গতি অতি মন্দ, যার তীব্রতা বাহনকে ধ্বংস করে (উয়ূনুল আখবার, খ. ১,
মধ্যম জাতি হিসেবে মুসলমানদের বৈশিষ্ট্যের কথা আল্লাহ তায়ালা আল কুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন-
‘রহমানের (প্রকৃত) বান্দাহ তারা- যারা ভূপৃষ্ঠে নম্রতার সাথে চলাফেরা করে, আর জাহেল লোকেরা তাদের সাথে কথা বলতে এলে বলে দেয় যে, তোমাদের সালাম।
যারা নিজেদের রবের নিকট সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকে রাত এবং যারা এই বলে দোয়া করে যে, হে আমাদের রব, জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করো। জাহান্নামের আজাব তো প্রাণান্তকর লেগে থাকে। নিশ্চয়ই বিশ্রামস্থল এবং বাসস্থান হিসেবে তা অত্যন্ত জঘন্য এবং যারা খরচের বেলায় বেহুদা খরচ কিংবা কার্পণ্য করে না; বরং দু’সীমার মাঝামাঝি মধ্যম নীতির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে’ (সূরা ফুরকান- ৬৩-৬৭)।
‘তোমার চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর খাটো করো (সূরা লোকমান-১৯)।
লোকদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না, আর গর্বভরে জমিনে হাঁটাচলা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো আত্ম-অহঙ্কারী, দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না’ (সূরা লোকমান- ১৮)।
সুতরাং মুসলমান কখনো গোঁড়ামি ও চরমপন্থা অথবা অতি উদার নীতি কখনো গ্রহণ করতে পারে না। তাই মধ্যমপন্থী জাতি হিসেবে আমাদের কথা ও কাজে গোঁড়ামি ও চরমপন্থা ও অতি উদারতাকেও পরিহার করতে হবে এবং ন্যায় ও ইনসাফের জন্য অগ্রসর হতে হবে।
আলাহ তায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোনো দলের শত্রুতা তোমাদের যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয়, যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো। এটি আল্লাহভীতির সাথে বেশি সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ তার খবর রাখেন’ (সূরা মায়েদা-৮)।
আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপ্স মধ্যপন্থি সম্পর্কে বলেছেন-
এই মধ্যপন্থী বা ন্যায়পরায়ণ জাতির ধারণাটি আমরা কুরআনের সর্বত্র দেখতে পাই: যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে ন্যায়বিচারের আদেশ দেন; যখন ধর্মের ক্ষেত্রে চরমপন্থা বর্জনের, ব্যয়ের ক্ষেত্রে বাহুল্য বর্জনের কিংবা জীবনের কোন ক্ষেত্রে সীমা লংঘন করা থেকে বিরত থাকার আদেশ দেন।
নিজের হাত গলায় বেঁধে রেখো না এবং তাকে একেবারে খোলাও ছেড়ে দিয়ো না, তাহলে তুমি নিন্দিত ও অক্ষম হয়ে যাবে৷ বনী ইসরাইল:২৯
হে নবী ! এদেরকে বলে দাও, আল্লাহ বা রহমান যে নামেই ডাকো না কেন, তাঁর জন্য সবই ভালো নাম৷ আর নিজের নামায খুব বেশী উচ্চ কণ্ঠেও পড়বে না, বেশী ক্ষীণ কণ্ঠেও না, বরং এ দুয়ের মাঝামাঝি মধ্যম পর্যায়ের কণ্ঠস্বর অবলম্বন করবে৷ বনী ইসরাইল:১১০
তাই মুসলিম উম্মাহর পথকে অন্যান্যদের থেকে পার্থক্য করা যায়। এই পথ ডানে বা বামে ঝুঁকে পড়েনা, কোন চরম অবস্থানে চলে যায়না।
ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বালুতে একটি সরলরেখা টানলেন এবং এর ডানে ও বামেও রেখা টানলেন। তিনি প্রথম রেখার দিকে নির্দেশ করে বললেন, এটি তাঁর পথ, সরল পথ। ডানের ও বামের পথ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। ডান ও বামের পথের প্রতিটির মাথায় অবস্থিত শয়তান, লোকদের সেসব পথের দিকে ডাকে।
এই যে পথ বেছে নেওয়া হলো যাতে কোন বাড়াবাড়ি নেই, তা এই উম্মাহর জন্য বিশিষ্ট। বিশিষ্ট এই জন্য যে, ইসলামের বাণী সর্ম্পকে যারা জানতে চায়, তাদের জন্য এখনও তা সংরক্ষিত অবস্থায় আছে। এজন্য একে বিশিষ্ট বলা হয়নি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা কেবল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই এই পথে চলতে আদশে করেছিলেন, এই পথে মানুষকে ডাকতে বলেছিলেন; প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সকল নবীই এ পথের প্রতি আহবান করেছেন। কিন্তু তাদের (পূর্ববর্তী নবীদের) বাণীর বিকৃতির কারণে, বর্তমানে কেবল চরমপন্থাই অবশিষ্ট রয়েছে যেমন ইহুদী ও খ্রীস্টান ধর্ম।
মূসা ও ঈসা (আ) যে মধ্যপথ শিখিয়ে গেছেন, তা এখন বিলুপ্ত হয়েছে। তাই শুধুমাত্র এই শেষ উম্মতই মধ্যপথ অবলম্বন করে রয়েছে। খ্রীস্টানরা বিশ্বাস করে ঈসা (আ.) ঈশ্বর। তারা ঈসাকে (আ.) স্বর্গীয় মর্যাদায় উন্নীত করেছে, তাঁকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছে। ইহুদীরা তাকে অবৈধ সন্তানের কাতারে নামিয়েছে। এই দুটোই চরম অবস্থান। ইসলামই ঈসার (আ.) প্রকৃত পরিচয় রক্ষা করেছে – তিনি আল্লাহর একজন মহান নবী, কুমারী মাতা থেকে তাঁর জন্ম, তিনি ঈশ্বর নন, তাঁর কোন ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিলনা। সন্দেহাতীতভাবে এই শিক্ষাই তিনি দিয়েছিলেন। অন্যরা এর পরিবর্তন করে বিকৃতিতে পৌঁছে গেছে।
তাদের অন্যান্য বিশ্বাসের বেলাও এরকম দেখা যায়। ফেরেশতাদের ক্ষেত্রে খ্রীস্টানরা জিব্রাইলকে (আ.) আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছে, তাকে তারা বলে ”পবিত্র আত্মা”। অপরদিকে ইহুদীরা কিছু ফেরেশতাকে শয়তানের পর্যায়ে অবনমিত করেছে। তাদের মতে শয়তানরা অধঃপতিত ফেরেশতা, যারা আল্লাহকে অমান্য করেছিল। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ফেরেশতারা আল্লাহকে অমান্য করেনা, আবার তাদের কোন ধরনের ঐশ্বরিক ক্ষমতাও নেই।
কুরআন বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্নভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা বর্ণনা করেছে। বলা হয়েছে,
আর আমরা যাদের সৃষ্টি করেছি তাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় রয়েছে, যারা সৎপথ প্রদর্শন করে এবং সে অনুযায়ী ন্যায়বিচার করে। [সূরা আল-আরাফ: ১৮১]
এতে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ও চারিত্রিক ভারসাম্য আলোচিত হয়েছে যে, তারা ব্যক্তিগত স্বার্থ ও কামনা-বাসনা বিসর্জন দিয়ে আসমানী গ্রন্থের নির্দেশ অনুযায়ী নিজেরাও চলে এবং অন্যদেরকেও চালাবার চেষ্টা করে। কোন ব্যাপারে কলহ-বিবাধ সৃষ্টি হলে তার মীমাংসাও তারা গ্রন্থের সাহায্যেই করে, যাতে কোন ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের স্বার্থপরতার কোন আশংকা নেই।
অন্য সূরায় মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মিক ভারসাম্য এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
তোমরাই সে কাজের আদেশ করবে, মন্দকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর ঈমান রাখবে। [সূরা আলে-ইমরান: ১১০]
অর্থাৎ মুসলিমরা যেমন সব নবীর শ্রেষ্ঠতম নবীপ্রাপ্ত হয়েছে, সব গ্রন্থের সর্বাধিক পরিব্যপ্ত ও পূর্ণতর গ্রন্থ লাভ করেছে, তেমনি সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সুস্থ মেজাজ এবং ভারসাম্যও সর্বাধিক পরিমাণে প্রাপ্ত হয়েছে।
ফলে তারাই সকল সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় সাব্যস্ত হয়েছে। তাদের সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তত্ত্ব-রহস্যের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। ঈমান, আমল ও আল্লাহ ভীতির সমস্ত শাখাপ্রশাখা ত্যাগের বদৌলতে সজীব ও সতেজ হয়ে উঠবে। তারা কোন বিশেষ দেশ ও ভৌগলিক সীমার বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে না। তাদের কর্মক্ষেত্র হবে সমগ্র বিশ্ব এবং জীবনের সকল শাখায় পরিব্যপ্ত। তাদের অস্তিত্বই অন্যের হিতাকাংখা ও তাদেরকে জান্নাতের দ্বারে উপনীত করার কাজে নিবেদিত। এ সম্প্রদায়টি গণমানুষের হিতাকাংখা ও উপকারের নিমিত্তই সৃষ্ট। তাদের অভীষ্ট কর্তব্য ও জাতীয় পরিচয় এই যে, তারা মানুষকে সৎকাজের দিকে পথ দেখাবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকেও মুসলিম জাতি এক ভারসাম্যপূর্ণ সম্প্রদায়। তাদের মধ্যে রয়েছে, ঈমানের ভারসাম্য। পূর্ববতী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা নবীগণকে আল্লাহর পুত্ৰ মনে করে তাদের উপাসনা ও আরাধনা করতে শুরু করেছে। যেমন,
এক আয়াতে রয়েছেঃ ইয়াহুদীরা বলেছে, ওযায়ের আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলেছে, মসীহ আল্লাহর পুত্র। [সূরা আত-তাওবাহঃ ৩০]
অপরদিকে এসব সম্প্রদায়েরই অনেকে নবীর উপর্যুপরি মু’জিযা দেখা সত্বেও তাদের নবী যখন তাদেরকে কোন ন্যায়যুদ্ধে আহবান করেছেন, তখন তারা পরিস্কার বলে দিয়েছে, আপনি এবং আপনার পালনকর্তাই যান এবং শক্রদের সাথে যুদ্ধ করুন। আমরা এখানেই বসে থাকব সূরা আল-মায়েদাহ: ২৪]
আবার কোথাও নবীগণকে স্বয়ং তাদের অনুসারীদেরই হাতে নির্যাতিত হতে দেখা গেছে। পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা তা নয়। তারা একদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এমন আনুগত্য ও ভালবাসা পোষণ করে যে, এর সামনে জান-মাল, সন্তান-সন্ততি, ইজ্জত-আব্রু সবকিছু বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। অপরদিকে রাসূলকে রাসূল এবং আল্লাহকে আল্লাহই মনে করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা আল্লাহর দাস ও রাসূল বলেই বিশ্বাস করে এবং মুখে প্রকাশ করে। তার প্রশংসা এবং গুণগান করতে গিয়েও তারা একটা সীমার ভেতর থাকে।
তাছাড়া মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে, কর্ম ও ইবাদাতের ভারসাম্য। পূর্ববর্তী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা শরীআতের বিধি-বিধানগুলোকে কানাকড়ির বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়, ঘুষ-উৎকোচ নিয়ে আসমানী গ্রন্থকে পরিবর্তন করে অথবা মিথ্যা ফতোয়া দেয়, বাহানা ও অপকৌশলের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পরিবর্তন করে এবং ইবাদাত থেকে গা বাঁচিয়ে চলে। অপরদিকে তাদের উপাসনালয়সমূহে এমন লোকও দেখা যায়, যারা সংসারধর্ম ত্যাগ করে বৈরাগ্য অবলম্বন করেছে। তারা আল্লাহ প্রদত্ত হালাল নেয়ামত থেকেও নিজেদের বঞ্চিত রাখে এবং কষ্ট সহ্য করাকেই সওয়াব ও ইবাদাত বলে মনে করে। পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায় একদিকে বৈরাগ্যকে মানবতার প্রতি যুলুম বলে মনে করে এবং অপরদিকে আল্লাহ ও রাসূলের বিধি-বিধানের জন্য জীবন বিসর্জন দিতেও কুন্ঠা বোধ করে না। অনুরূপভাবে তাদের মধ্যে রয়েছে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভারসাম্য।
পূর্ববর্তী উম্মতসমূহের মধ্যে একদিকে দেখা যায়, তারা মানবাধিকারের প্রতি পরোয়াও করেনি; ন্যায়-অন্যায়ের তো কোন কথাই নেই। মহিলাদের অধিকার দান করা তো দূরের কথা, তাদের জীবিত থাকার অনুমতি পর্যন্ত দেয়া হত না। কোথাও প্রচলিত ছিল শৈশবেই তাদের জীবন্ত সমাহিত করার প্রথা এবং কোথাও মৃত স্বামীর সাথে স্ত্রীকে দাহ করার প্রথা। অপরদিকে এমন নির্বোধ দয়াদ্রতারও প্রচলন ছিল যে, পোকামাকড় হত্যা করাকেও অবৈধ জ্ঞান করা হত। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীআত এসব ভারসাম্যহীনতার অবসান ঘটিয়েছে। তারা একদিকে মানুষের সামনে মানবাধিকারকে তুলে ধরেছে। শুধু শান্তি ও সন্ধির সময়ই নয়, যুদ্ধ ক্ষেত্রেও শক্রর অধিকার সংরক্ষণে সচেতনতা শিক্ষা দিয়েছে। অপরদিকে প্রত্যেক কাজের একটা সীমা নির্ধারণ করেছে, যা লংঘন করাকে অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। তদ্রুপভাবে তাদের মধ্যে রয়েছে, অর্থনৈতিক ভারসাম্য।
অর্থনীতিতে অপরাপর সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তর ভারসাম্যহীনতা পরিলক্ষিত হয়। একদিকে রয়েছে পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা। এতে হালাল-হারাম এবং অপরের সুখ-শান্তি ও দুঃখদুরাবস্থা থেকে চক্ষু বন্ধ করে অধিকতর ধন-সম্পদ সঞ্চয় করাকেই সর্ববৃহৎ মানবিক সাফল্য গণ্য করা হয়।
অপরদিকে রয়েছে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা। এতে ব্যক্তি মালিকানাকেই অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়। মুসলিম সম্প্রদায় ও তাদের শরীআত এক্ষেত্রেও ভারসাম্যপূর্ণ অভিনব অর্থ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে।
ইসলামী শরীআত একদিকে ধন-সম্পদকে জীবনের লক্ষ্য মনে করতে বারণ করেছে এবং সম্মান, ইজ্জত ও পদমর্যাদা লাভকে এর উপর নির্ভরশীল রাখেনি; অপরদিকে সম্পদ বন্টনের নিষ্কলুষ নীতিমালা প্রণয়ন করে দিয়েছে যাতে কোন মানুষ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপায়-উপকরণ থেকে বঞ্চিত না থাকে এবং কেউ সমগ্র সম্পদ কুক্ষিগত করে না বসে। এছাড়া সম্মিলিত মালিকানাভুক্ত বিষয়-সম্পত্তিকে যৌথ ও সাধারণ ওয়াকফের আওতায় রেখেছে। বিশেষ বস্তুর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে। হালাল মালের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছে এবং তা রাখার ও ব্যবহার করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছে।
এ উম্মাত হাশরের ময়দানে একটি স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে। সকল নবীর উম্মতরা তাদের হিদায়াত ও প্রচারকার্য অস্বীকার করে বলতে থাকবে, দুনিয়াতে আমাদের কাছে কোন আসমানী গ্রন্থ পৌছেনি এবং কোন নবীও আমাদের হেদায়াত করেননি। তখন মুসলিম সম্প্রদায় নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্যদাতা হিসেবে উপস্থিত হবে এবং সাক্ষ্য দেবে যে, নবীগণ সর্বযুগেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আনীত হিদায়াত তাদের কাছে পৌছে দিয়েছেন। একাধিক হাদীসে সংক্ষেপে ও সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা নূহ আলাইহিস সালাম-কে ডেকে বলবেন, হে নূহ আপনি কি আমার বাণী লোকদের কাছে পৌছিয়েছেন? তিনি বলবেন, হ্যাঁ।
তখন তার উম্মতকে জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তোমাদের কাছে কি তিনি কিছু পৌছিয়েছেন? তারা বলবে, আমাদের কাছে কোন সাবধানকারী আসেনি। তখন আল্লাহ বলবেনঃ হে নূহ আপনার পক্ষে কে সাক্ষ্য দেবে? তিনি বলবেন, মুহাম্মাদ ও তার উম্মত। তখন তারা সাক্ষ্য দেবে যে, নূহ আলাইহিস সালাম আল্লাহর বাণী লোকদের কাছে পৌছিয়েছেন। আর রাসূল তখন তোমাদের সত্যতার উপর সাক্ষ্য দেবেন। এটাই হলো আল্লাহর বাণীঃ “এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধ্যপন্থী জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা মানবজাতির উপর স্বাক্ষী হও এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হতে পারেন।” [বুখারীঃ ৪৪৮৭]
আয়াতে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা হচ্ছে, لِنَعْلَمَ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ‘যাতে আমরা জানতে পারি’। আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে কেউ কেউ এটা মনে করতে পারে যে, (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ বুঝি আগে জানতেন না, ঘটনা ঘটার পরে জানেন। মূলত: এ ধরনের বোঝার কোন অবকাশই ইসলামী শরীআতে নেই। কারণ, আল্লাহ তা’আলা আগে থেকেই সবকিছু জানেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাকে পরীক্ষার মাধ্যমে তার জানা বিষয়টি অনুসারে বান্দার কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দিয়ে বান্দার উপর তার প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে করে তার জানার উপর ন্যায় বরং বাস্তব ভিত্তিতে তিনি বান্দাকে সওয়াব বা শাস্তি দিতে পারেন। মূলত: এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা বান্দার পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।
যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “এটা এজন্যে যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের মনে যা আছে তা পরিশোধন করেন। আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত।” [সূরা আলে ইমরান ১৫৪]
এ আয়াতে পরীক্ষা করার কথা বলার মাধ্যমে এ কথাটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহ আগে থেকেই জানেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য পরীক্ষা করা। এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় আয়াতের শেষে ‘আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত এ কথা বলার মাধ্যমে। এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেলে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র যেমন,
তারপর আমি তাদেরকে উঠিয়েছি একথা জানার জন্য যে, তাদের দু দলের মধ্য থেকে কোন্টি তার অবস্থান কালের সঠিক হিসেব রাখতে পারে৷ সূরা আল-কাহাফ: ১২,
তাদের ওপর ইবলিসের কোন কর্তৃত্ব ছিল না৷ কিন্তু যা কিছু হয়েছে যে, আমি দেখতে চাচ্ছিলাম কে পরকাল মান্যকারী এবং কে সে ব্যাপারে সন্ধিহান৷ তোমার রব সব জিনিসের তত্ত্বাবাধায়ক৷ সাবা ২১
এ ব্যবহৃত لِنَعْلَمَ শব্দটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং কোন সন্দেহের উদ্রেক হবে না। [আদওয়াউল বায়ান]
এখানে ঈমান শব্দ দ্বারা ঈমানের প্রচলিত অর্থ নেয়া হলে আয়াতের মর্ম হবে এই যে, কেবলা পরিবর্তনের ফলে নির্বোধেরা মনে করতে থাকে যে, এরা দ্বীন ত্যাগ করেছে কিংবা এদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে। উত্তরে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ঈমান নষ্ট করবেন না। কাজেই তোমরা নির্বোধদের কথায় কর্ণপাত করো না। কোন কোন মনীষীদের উক্তিতে এখানে ঈমানের অর্থ করা হয়েছে সালাত। মৰ্মাৰ্থ এই যে, সাবেক কেবলা বায়তুল-মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে যেসব সালাত আদায় করা হয়েছে, আল্লাহ্ তা’আলা সেগুলো নষ্ট করবেন না; বরং তা শুদ্ধ ও মকবুল হয়েছে।
ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, কাবাকে কেবলা করার পর অনেকেই প্রশ্ন করে যে, যে সব মুসলিম ইতিমধ্যে ইন্তেকাল করেছেন, তারা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করে গেছেন- কাবার দিকে সালাত আদায় করার সুযোগ পাননি, তাদের কি হবে? এ প্রশ্নের প্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াত নাযিল হয় ৷ [বুখারীঃ ৪৪৮৬] এতে সালাতকে ঈমান শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে যে, ১. তাদের সব সালাতই শুদ্ধ ও গ্রহণীয়। তাদের ব্যাপারে কেবলা পরিবর্তনের কোন প্রতিক্রিয়া হবে না। ২. আমল ঈমানের অংগ ৷ ৩. সালাত ঈমানের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যে, সালাতকে বোঝানোর জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা ঈমান শব্দ ব্যবহার করেছেন।
২:১৪৪ قَدۡ نَرٰی تَقَلُّبَ وَجۡهِکَ فِی السَّمَآءِ ۚ فَلَنُوَلِّیَنَّکَ قِبۡلَۃً تَرۡضٰهَا ۪ فَوَلِّ وَجۡهَکَ شَطۡرَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ ؕ وَ حَیۡثُ مَا کُنۡتُمۡ فَوَلُّوۡا وُجُوۡهَکُمۡ شَطۡرَهٗ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ لَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ؕ وَ مَا اللّٰهُ بِغَافِلٍ عَمَّا یَعۡمَلُوۡنَ
অবশ্যই আমরা আকাশের দিকে আপনার বারবার তাকানো লক্ষ্য করি। সুতরাং অবশ্যই আমরা আপনাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব যা আপনি পছন্দ করেন। অতএব আপনি মসজিদুল হারামের দিকে চেহারা ফিরান। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন তোমাদের চেহারাসমূহকে এর দিকে ফিরাও এবং নিশ্চয় যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারা অবশ্যই জানে যে, এটা তাদের রব এর পক্ষ হতে হক। আর তারা যা করে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ গাফেল নন।
উল্লেখ করা যেতে পারে, বাইতুল মাকদিস মদীনা থেকে সোজা উত্তর দিকে ৷ আর কা’বা হচ্ছে দক্ষিণ দিকে ৷ আর নামাযের মধ্যে কিব্লাহ পরিবর্তন করার জন্য ইমামকে অবশ্যি মুকতাদিদের পেছন থেকে সামনের দিকে আসতে হয়েছে ৷ অন্যদিকে মুকতাদিদের কেবলমাত্র দিক পরিবর্তন করতে হয়নি বরং তাদেরও কিছু কিছু চলাফেরা করে লাইন ঠিকঠাক করতে হয়েছে ৷ কাজেই কোন কোন রেওয়ায়াতে এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনাও এসেছে ৷
এরপর মদীনা ও মদীনার আশেপাশে এ নির্দেশটি সাধারণভাবে ঘোষণা করে দেয়া হল। বারা ইবনে আযেব বলেন, এক জায়গায় ঘোষকের কথা এমন অবস্থায় পৌছল, যখন তারা রুকূ করছিল। নির্দেশ শোনার সাথে সাথেই সবাই সে অবস্থাতেই কাবার দিকে মুখ ফিরালো। আনাস ইবনে মালেক বলেন, এ খবরটি কুবায় পৌছল পরের দিন ফজরের সালাতের সময়। লোকেরা এক রাকাআত সালাত শেষ করেছিল, এমন সময় তাদের কানে আওয়াজ পৌছলঃ ‘সাবধান! কেবলা বদলে গেছে। এখন কাবার দিকে কেবলা নির্দিষ্ট হয়েছে। এ কথা শোনার সাথে সাথেই সমগ্র জামাআত কাবার দিকে মুখ ফিরালো। [অনুরূপ বর্ণনা, বুখারী ৪৪৮৬] ‘মসজিদুল হারাম’ অর্থ সম্মান ও মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ। এর অর্থ হচ্ছে এমন ইবাদতগৃহ, যার মধ্যস্থলে কা’বাগৃহ অবস্থিত।
(৪) হিজরতের পূর্বে মক্কা-মুকাররামায় যখন সালাত ফরয হয়, তখন কা’বাগৃহই সালাতের জন্য কেবল ছিল, না বায়তুল-মুকাদ্দাস ছিল – এ প্রশ্নে সাহাবী ও তাবয়ীগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুম বলেনঃ ইসলামের শুরু থেকেই কিবলা ছিল বায়তুল-মুকাদ্দাস। হিজরতের পরও ষোল/সতের মাস পর্যন্ত বায়তুল-মুকাদ্দাসই কেবলা ছিল। এরপর কাবাকে কেবলা করার নির্দেশ আসে। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় অবস্থানকালে হাজরে আসওয়াদ ও রোকনে-ইয়ামানীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেন যাতে কাবা ও বায়তুল-মুকাদ্দাস উভয়টিই সামনে থাকে। মদীনায় পৌছার পর এরূপ করা সম্ভব ছিল না।
তাই তার মনে কেবলা পরিবর্তনের বাসনা দানা বাঁধতে থাকে। অন্যান্য সাহাবী ও তাবেয়ীগণ বলেনঃ মক্কায় সালাত ফরয হওয়ার সময় কা’বা গৃহই ছিল মুসলিমদের প্রাথমিক কেবলা। কেননা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিমুস্ সালাম-এরও কেবলা তাই ছিল। মহানবী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় অবস্থানকালে কাবাগৃহের দিকে মুখ করেই সালাত আদায় করতেন। মদীনায় হিজরতের পর তার কেবলা বায়তুল-মুকাদ্দাস সাব্যস্ত হয়। তিনি মদীনায় ষোল/সতের মাস পর্যন্ত বায়তুল-মোকাদাসের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেন। এরপর প্রথম কেবল অর্থাৎ কাবাগৃহের দিকে মুখ করার নির্দেশ নাযিল হয়।
কিবলা পরিবর্তনের এই ঘটনায় বড় বড় অনেকগুলো হিকমত রয়েছে এবং এটি ছিল মুসলিম, মুশরিক, ইহুদী এবং মুনাফিক সকল সম্প্রদায়ের জন্যই পরীক্ষা। মুসলিমদের তো কোন সমস্যাই ছিলনা। আল্লাহর পক্ষ হতে হিদায়াত পাওয়ার কারণে তারা বললেন- আমরা ঈমান এনেছি, সব কিছুই আল্লাহর পক্ষ হতে। তাই আমরা শুনলাম এবং মেনে নিলাম। তাদের কাছে বিষয়টি তেমন বড় ছিলনা।
মুশরিকরা বলতে লাগল, সে যেমন আমাদের কিবলার (কাবার) দিকে ফেরত এসেছে তেমন অচিরেই আমাদের দ্বীনে ফেরত আসবে। আমাদের কিবলাকে সত্য মনে করেই সেদিকে ফিরে এসেছে। ইহুদীরা বলতে লাগল- সে তাঁর পূর্বের সকল নাবীদের কিবলার বিরোধীতা করছে।
মুনাফিকরা বলতে লাগল- জানিনা, এই লোক কোথায় যাচ্ছে? প্রথম কিবলা সঠিক হয়ে থাকলে সে একটি সত্য বিষয় পরিত্যাগ করেছে। আর দ্বিতীয়টি সঠিক হয়ে থাকলে প্রথমে সে বাতিলের উপর ছিল। এ ছাড়া মূর্খরা আরও অনেক কথাই বলেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন-
وَإنْ كَانَتْ لَكَبِيرَةً إِلا عَلَى الَّذِينَ هَدَى اللهُ
‘‘নিশ্চয়ই এটা (কিবলা পরিবর্তন) কঠিন বিষয়, কিন্তু তাদের জন্যে নয়, যাদেরকে আল্লাহ্ পথ প্রদর্শন করেছেন’’। (সূরা বাকারা-২:১৪৩)
নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে এটি মুমিন বান্দাদের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষাও ছিল। যাতে তিনি দেখে নেন কে রসূলের অনুসরণ করে এবং কে তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কিবলার বিষয়টি যেহেতু একটি বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই আল্লাহ্ তআলা কিবলা পরিবর্তনের পূর্বে ভূমিকা স্বরূপ নাসেখ-মানসুখ তথা শরীয়তের কোন বিষয়কে রহিত করার বিধি-বিধান বর্ণনা করেছেন। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা পূর্ণ ক্ষমতাবান। তিনি বলেছেন যে, কোন বিষয়কে মানসুখ (রহিত) করলে তার স্থলে আরও উত্তম হুকুম প্রদান করেন কিংবা অনুরূপ বিষয় স্থাপন করেন। এরপরই তিনি ঐ সমস্ত লোকদেরকে ধমক দিয়েছেন, যারা রসূল (ﷺ) এর হুকুমের বিরুদ্ধে হঠকারিতা প্রদর্শন করে এবং তাঁর হুকুমের সামনে মাথা নত করেনা।
অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ইহুদীদের পারস্পারিক মতভেদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, তাদের একদল অন্যদলকে দোষারোপ করে বলে থাকে যে, তোমরা সঠিক পথের উপর প্রতিষ্ঠিত নও। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে ইহুদী-খৃষ্টানদের অনুরূপ করতে এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা হতে সতর্ক করেছেন। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের কুফর ও শির্কের বিষয় উল্লেখ করেছেন। তারা বলে যে, আল্লাহর পুত্র সন্তান রয়েছে। তিনি এ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র এবং তাদের ধারণার অনেক উর্ধ্বে।
রসূল (ﷺ) যেখানেই থাকেন, যেখান থেকেই বের হন, সকল স্থানেই এবং সকল অবস্থাতেই তাঁকে কাবার দিকে মুখ ফিরানোর আদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা আরও সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা সঠিক পথের সন্ধান দেন। তিনিই তাদেরকে এই কিবলার দিকে হিদায়াত করেছেন। এটি মুসলিমদেরই কিবলা, তারাই এদিকে মুখ ফিরানোর হকদার। আর এটিই সর্বোত্তম কিবলা। মুসলিমগণ সর্বোত্তম জাতি। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য নির্বাচন করেছেন সর্বোত্তম রসূল, তাদেরকে দান করেছেন সর্বোত্তম কিতাব, তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন সর্বোত্তম যুগে, বিশেষ করে তাদেরকে দান করেছেন সর্বোত্তম শরীয়ত, ভূষিত করেছেন তাদেরকে সর্বোত্তম চরিত্রে, পাঠিয়েছেন তাদেরকে সুন্দরতম ভূখন্ডে, অধিষ্ঠিত করেছেন তাদেরকে জান্নাতের সর্বোত্তম স্থানে এবং কিয়ামতের দিন হাশরের মাঠে তাদের অবস্থানের জায়গা হবে সব চেয়ে উত্তম। তারা সে দিন দাঁড়াবে সুউচ্চ একটি টিলার উপর। অন্য লোকেরা দাঁড়াবে তাদের নীচে। সুতরাং আমি ঐ আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি, তিনি যাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমত প্রদান করেন এবং যাকে ইচ্ছা তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করেন। আর আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহ অত্যন্ত বিশাল।
২:১৪৫ وَ لَئِنۡ اَتَیۡتَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ بِکُلِّ اٰیَۃٍ مَّا تَبِعُوۡا قِبۡلَتَکَ ۚ وَ مَاۤ اَنۡتَ بِتَابِعٍ قِبۡلَتَهُمۡ ۚ وَ مَا بَعۡضُهُمۡ بِتَابِعٍ قِبۡلَۃَ بَعۡضٍ ؕ وَ لَئِنِ اتَّبَعۡتَ اَهۡوَآءَهُمۡ مِّنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَکَ مِنَ الۡعِلۡمِ ۙ اِنَّکَ اِذًا لَّمِنَ الظّٰلِمِیۡنَ
আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের কাছে সমস্ত দলীল নিয়ে আসেন, তবু তারা আপনার কিবলার অনুসরণ করবে না; এবং আপনিও তাদের কিবলার অনুসারী নন। আর তারাও পরস্পরের কিবলার অনুসারী নয়। আপনার নিকট সত্য-জ্ঞান আসার পরও যদি আপনি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করেন, তাহলে নিশ্চয় আপনি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
কারণ, ইয়াহুদীদের বিরোধিতা তো হিংসা ও বিদ্বেষের ভিত্তিতে। যার কারণে প্রমাণাদির কোন প্রভাব তাদের উপর পড়বে না। প্রভাব সৃষ্টি হওয়ার জন্য অন্তর পরিষ্কার হওয়া অত্যাবশ্যক।
কারণ, আপনি আল্লাহর অহীর অনুসারী। আল্লাহর নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আপনি তাদের ক্বিবলা গ্রহণ করতে পারেন না।
ইয়াহুদীদের ক্বিবলা হল, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পাথর (যার উপর গম্বুজ নির্মিত আছে)। আর খ্রিষ্টানদের ক্বিবলা হল, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের পূর্বদিক। আহলে-কিতাদের এই দু’টি দল যখন আপোসে একটি ক্বিবলার উপর ঐক্যবদ্ধ নয়, তখন তারা মুসলিমদের নিকট থেকে কিভাবে আশা করে যে, তারা (মুসলিমরা) এ ব্যাপারে তাদের সাথে একমত হবে?
এ রকম ধমক পূর্বেও দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য হল, উম্মতকে সতর্ক করা যে, কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও বিজাতি ও বিদআতীদের অনুকরণ করা যুলুম, সীমালংঘন ও ভ্রষ্টতা বৈ কিছুই নয়।
আর ইয়াহূদী ও নাসারারা আপনার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না, যতক্ষণ না আপনি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ করেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২০]
“তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি পুরোপুরি অনুসরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে এবং প্রতি গজে গজে। এমনকি তারা যদি ষাণ্ডার গর্তেও প্রবেশ করে থাকে, তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি ইয়াহূদী ও নাসারাদের কথা বলেছেন? জবাবে তিনি বললেন: তবে আর কার কথা বলছি”? হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. বর্ণনা করেছেন; ‘ফতহুল বারী’: ১৩/৩০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং- ২৬৬৯।
“যে ব্যক্তি কোনো জাতির অনুকরণ, অনুসরণ ও সামঞ্জস্য বিধান করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে” ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ: ২/৫০; আবু দাউদ রহ. বর্ণনা করেছে উৎকৃষ্ট সনদে, হাদীস নং-৪০৩১; আর আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, ‘সহীহ আল-জামে‘ আস-সাগীর’, হাদীস নং-৬০২৫।
“তোমরা সীমালঙ্ঘনকারীদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ো না, অন্যথায় অগ্নি তোমাদেরকে স্পর্শ করবে। আর এই অবস্থায় আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো বন্ধু থাকবে না এবং তোমরা সাহায্যও পাবে না”। সূরা হূদ, আয়াত; ১১৩
২:১৪৬ اَلَّذِیۡنَ اٰتَیۡنٰهُمُ الۡکِتٰبَ یَعۡرِفُوۡنَهٗ کَمَا یَعۡرِفُوۡنَ اَبۡنَآءَهُمۡ ؕ وَ اِنَّ فَرِیۡقًا مِّنۡهُمۡ لَیَکۡتُمُوۡنَ الۡحَقَّ وَ هُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ
আমরা যাদেরকে কিতাব দিয়েছি তারা তাকে সেরূপ জানে যেরূপ তারা নিজেদের সন্তানদেরকে চিনে। আর নিশ্চয় তাদের একদল জেনে-বুঝে সত্য গোপন করে থাকে।
এটি আরবের একটি প্রচলিত প্রবাদ ৷ যে জিনিসটিকে মানুষ নিশ্চিতভাবে জানে এবং যে সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ ও দ্বিধার অবকাশ থাকে না তাকে এভাবে বলা হয়ে থাকে যথা: সে এ জিনিসটিকে এমনভাবে চেনে যেমন চেনে নিজের সন্তানদেরকে ৷ অর্থাৎ নিজের ছেলে- মেয়েদেরকে চিহ্নিত করার ব্যাপারে যেমন তার মধ্যে কোন প্রকার জড়তা ও সংশয়ের অবকাশ থাকে না , ঠিক তেমনি সব রকম সন্দেহের উর্ধে উঠে নিশ্চতভাবেই সে এই জিনিসটিকে জানে ও চেনে ৷ ইহুদি ও খৃস্টান আলেমরা ভালোভাবেই এ সত্যটি জানতো যে, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কা’বা নির্মাণ করেছিলেন এবং বিপরীত পক্ষে এর ১৩ শত বছর পরে হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের হাতে বাইতুল মাকদিসের নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং তাঁর আমলে এটি কিব্লাহ হিসেবে গণ্য হয় ৷ এই ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাপারে তাদের মধ্যে সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ ছিল না ৷
এখানে আহলে-কিতাবের একটি দলের সত্যকে গোপন করার অপরাধ সাব্যস্ত করা হচ্ছে। কারণ, তাদের মধ্যে একটি দল আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-এর মত লোকেদেরও ছিল। যাঁরা স্বীয় সততা এবং অভ্যন্তরীণ নির্মলতার কারণে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হোন।
২:১৪৭ اَلۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّکَ فَلَا تَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡمُمۡتَرِیۡنَ
সত্য আপনার রব-এর কাছ থেকে পাঠানো। কাজেই আপনি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।
নবীর উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে যে বিধানই অবতীর্ণ হয়, তা অবশ্যই সত্য। সে ব্যাপারে সন্দেহ-সংশয়ের কোন অবকাশ নেই।
তাওরাত ও ইঞ্জিল গ্রন্থে শেষ নবীর বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। আর তাই আহলে কিতাবগণ নবী (সাঃ) কে চিনত কিন্তু বিদ্বেষ ও একগুঁয়েমীর কারণে তারা এই সত্যকে অন্যদের কাছে গোপন রাখত বা সত্যকে বিকৃত করত। অবশ্য আহলে কিতাব রাসূল (সা.) এর বৈশিষ্ট্য দেখে তার প্রতি ঈমান এনেছিল। এইসব শারীরিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্য পূর্ববর্তী গ্রন্থে এমনভাবে উল্লেখিত হয়েছিল যে, কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তারা নবী (সা.)কে নিজের সন্তানের মতই চিনত। শেষের এই আয়াতে যে বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে জোর দেয়া হয়েছে তা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নাজেল হয়েছে একমাত্র তাই সত্য। মানুষের বিরোধিতা এমনকি অধিকাংশ মানুষও যদি বিরোধিতা করে তাহলেও ঐশী নির্দেশের সত্যতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সন্দিহান হওয়া উচিত নয়।
সংগ্রহে—তাফসিরে যাকারিয়া,আহসানুল বায়ান,তাফহিমুল কুর’আন