সুরা আলে ইমরান ১৮তম রুকু(১৭২-১৮০)আয়াত

১৮তম রুকু(১৭২-১৮০)

আউযুবিল্লাহি মিনাস শাইতোয়ানির রজীম,

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

 

৩:১৭২ اَلَّذِیۡنَ اسۡتَجَابُوۡا لِلّٰہِ وَ الرَّسُوۡلِ مِنۡۢ بَعۡدِ مَاۤ اَصَابَہُمُ الۡقَرۡحُ ؕۛ لِلَّذِیۡنَ اَحۡسَنُوۡا مِنۡہُمۡ وَ اتَّقَوۡا اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ

১৭২. যখম হওয়ার পর যারা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছে তাদের মধ্যে যারা সৎকাজ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলে তাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে।

উরওয়া ইবনে যুবাইর বলেনঃ আমাকে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, তোমার পিতা ও আমার পিতা ঐ সমস্ত সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, যারা যখমী হওয়ার পরে আল্লাহ এবং তার রাসূলের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। [বুখারীঃ ৪০৭৭] অর্থাৎ যুবাইর ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা।

যখন মুশরিকরা উহুদ যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করে, তখন পথিমধ্যে তাদের খেয়াল হয় যে, আমরা তো একটি সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করে দিলাম। পরাজয়ের কারণে মুসলিমদের মনোবল তো দমে গেছে এবং তারা এখন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সুতরাং এই সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের উচিত ছিল, মদীনার উপর পুরোদমে আক্রমণ করে বসা, যাতে মদীনা ভূমি থেকে ইসলাম সমূলে উচ্ছেদ হয়ে যেত। এদিকে মদীনায় পৌঁছে নবী করীম (সাঃ)ও তাদের (কাফেরদের) পুনরায় পাল্টা আক্রমণের আশঙ্কা বোধ করলেন। তাই তিনি সাহাবাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত করলেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যদিও নিজেদের নিহত ও আহতদের কারণে বড়ই মর্মাহত ও দুঃখিত ছিলেন, তবুও নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশ মত যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করলেন, কে আছে, যারা মুশরেকদের পশ্চাদ্ধাবন করবে? তখন সত্তর জন সাহাবী প্রস্তুত হলেন যাদের মধ্যে এমন লোকও ছিলেন যারা গত কালকের যুদ্ধে কঠিন ভাবে আহত হয়ে পড়েছিলেন এবং অন্যের সাহায্যে চলাফেরা করছিলেন। এরাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মুশরিকদের পশ্চাদ্ধাবনে রওয়ানা হলেন। [বুখারীঃ ৪০৭৭]

মুসলিমদের এই দল যখন মদীনা থেকে ৮ মাইল দূরে অবস্থিত ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে পৌঁছল, তখন মুশরিকরা ভয় পেয়ে গেল। কাজেই তাদের ইচ্ছার পরিবর্তন ঘটল এবং মদীনার উপর আক্রমণ করার পরিবর্তে মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করল। অতঃপর নবী করীম (সাঃ) এবং তাঁর সাথীরাও মদীনায় প্রত্যাগমন করলেন। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করার উদ্দীপনার উপর মুসলিমদের প্রশংসা করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণ হল, আবূ সুফিয়ানের ধমক ও হুমকি। সে হুমকি দিয়েছিল যে, আগামী বছর ‘বদর সুগরা’য় আমাদের ও তোমাদের মধ্যে মোকাবেলা হবে। (আবূ সুফিয়ান তখন পর্যন্ত ইসলাম গ্রহণ করেনি) তার এই হুমকির ভিত্তিতে মুসলিমরাও আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করার পূর্ণ উৎসাহ প্রদর্শন করে জিহাদে পুরো দমে অংশ গ্রহণ করার দৃঢ় সংকল্প করেন। (ফাতহুল ক্বাদীর ও ইবনে কাসীর থেকে সংগৃহীত সার-সংক্ষেপ। তবে শেষোক্ত কথাটি আলোচ্য বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়)

 

৩:১৭৩ اَلَّذِیۡنَ قَالَ لَہُمُ النَّاسُ اِنَّ النَّاسَ قَدۡ جَمَعُوۡا لَکُمۡ فَاخۡشَوۡہُمۡ فَزَادَہُمۡ اِیۡمَانًا ٭ۖ وَّ قَالُوۡا حَسۡبُنَا اللّٰہُ وَ نِعۡمَ الۡوَکِیۡلُ

১৭৩. এদেরকে লোকেরা বলেছিল, তোমাদের বিরুদ্ধে লোক জড়ো হয়েছে, কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় কর; কিন্তু এ কথা তাদের ঈমানকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তারা বলেছিল, ‘আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কত উত্তম কর্মবিধায়ক।

যখন সাহাবায়ে কিরাম হামরাউল আসাদ নামক স্থানে গিয়ে পৌছালেন, তখন সেখানে নু’আইম ইবনে মাসউদের সাথে সাক্ষাত হল। সে সংবাদ দিল যে, আবু সুফিয়ান নিজের সাথে আরও সৈন্য সংগ্রহ করে পুনরায় মদীনা আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আহত-দুর্বল সাহাবায়ে কেরাম এই ভীতিজনক সংবাদ শুনে সমস্বরে বলে উঠলেন, আমরা তা জানি না ‘আল্লাহ আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম সাহায্যকারী’৷ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট, আর তিনিই আমাদের জন্য উত্তম যিম্মাদার’। এ কথাটি ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল তখন তিনি বলেছিলেন।

সহীহ বুখারী ইত্যাদি হাদীস গ্রন্থে এসেছে যে, যখন ইবরাহীম (আঃ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়, তখন তাঁর জবান দ্বারা এই (হাসবুনাল্লাহু অনি’মাল অকীল) শব্দই উচ্চারিত হয়েছিল। (ফাতহুল ক্বাদীর)

আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাই বলেছিলেন, যখন লোকজন তাকে এসে খবর দিলো যে, তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনাদল প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদেরকে ভয় করো। এ কথা শুনে তাদের ঈমান আরো মজবুত হলো, তারা বললঃ আল্লাহ্ই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আর আমাদের পক্ষ থেকে কাজের জন্য তিনিই উত্তম যিম্মাদার। [বুখারীঃ ৪৫৬৩]

৩:১৭৪ فَانۡقَلَبُوۡا بِنِعۡمَۃٍ مِّنَ اللّٰہِ وَ فَضۡلٍ لَّمۡ یَمۡسَسۡہُمۡ سُوۡٓءٌ ۙ وَّ اتَّبَعُوۡا رِضۡوَانَ اللّٰہِ ؕ وَ اللّٰہُ ذُوۡ فَضۡلٍ عَظِیۡمٍ

১৭৪. তারপর তারা আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহসহ ফিরে এসেছিল, কোন অনিষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেনি এবং আল্লাহ্‌ যাতে সন্তুষ্ট তারা তারই অনুসরণ করেছিল এবং আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।

এ আয়াতে সে সমস্ত সাহাবায়ে কেরামের জেহাদের জন্য রওয়ানা হওয়া এবং হাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওপক্কীরমিইল বলার উপকারিতা, ফলশ্রুতি ও বরকত বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে- “এরা আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ নিয়ে ফিরে এল। তাতে তাদের কোন রকম অনিষ্ট হলো না আর তারা হল আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত।” আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে তিনটি নেয়ামত প্রদান করলেন।

প্রথম নেয়ামত হলো এই যে, কাফেরদের মনে ভীতি সঞ্চার করে দিলেন, এতে তারা পালিয়ে গেল। ফলে তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে নিরাপদ রইলেন।

এ নেয়ামতকে আল্লাহ্ তা’আলা ‘নেয়ামত’ শব্দেই উল্লেখ করলেন।

দ্বিতীয় নেয়ামত এই যে, হামরাউল আসাদের বাজারে তাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সুযোগ হয়েছিল এবং তাতে তারা যে লাভবান হয়েছিলেন এবং কাফেরদের ফেলে যাওয়া গণীমতের মাল থেকে তারা যে লাভবান হয়েছিলেন তাকেই বলা হয়েছে ‘ফযল’।

তৃতীয় নেয়ামতটি হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ যা সমস্ত নেয়ামতের ঊর্ধ্বে এবং যা এই জেহাদে তাদেরকে বিশেষ ভঙ্গিতে দেয়া হয়েছে।

نِعْمَةٌ (নিয়ামত)এর অর্থ নিরাপত্তা ও শান্তি। আর فَضْلٌ (অনুগ্রহ)এর অর্থ সেই মুনাফা যা ‘বদর সুগরা’য় ব্যবসার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। নবী করীম (সাঃ) ‘বদর সুগরা’ হয়ে গমনকারী এক বাণিজ্য-কাফেলার নিকট থেকে পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে বিক্রি করেছিলেন, যা থেকে মুনাফা হয়েছিল এবং তা তিনি মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছিলেন। (ইবনে কাসীর)

৩:১৭৫ اِنَّمَا ذٰلِکُمُ الشَّیۡطٰنُ یُخَوِّفُ اَوۡلِیَآءَہٗ ۪ فَلَا تَخَافُوۡہُمۡ وَ خَافُوۡنِ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

১৭৫. সেতো শয়তান। সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়; কাজেই যদি তোমরা মুমিন হও তবে তাদেরকে ভয় করো না, আমাকেই ভয় কর।

এখানে ‘সে’ বলতে তাকে বোঝানো হয়েছে, যে ব্যক্তি মুমিনদের কাছে এসে বলেছিল যে, তোমাদের বিরুদ্ধে মানুষ জড়ো হয়েছে কাজেই তোমরা তাদের ভয় করো। তারা ছিল বনী আব্দুল কায়েসের কিছু লোক। [তাবারী]

যখন সে তোমাদের মধ্যে এই ধরনের ধারণায় পতিত করবে, তখন তোমরা কেবল আমারই উপর ভরসা রাখবে এবং আমার দিকেই প্রত্যাবর্তন করবে। আমিই তোমাদের জন্য যথেষ্ট হব এবং তোমাদের সাহায্য করব। যেমন অন্যত্র তিনি বলেছেন, [أَلَيْسَ اللهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ] ‘‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?’’ (সূরা যুমার ৩৬ আয়াত)

তিনি আরো বলেন, [كَتَبَ اللهُ لَاَغْلِبَنَّ اَنَا وَرُسُلِيْ] অর্থাৎ, আল্লাহ সিদ্ধান্ত করেছেন, আমি এবং আমার রসূলগণ অবশ্যই বিজয়ী হব। (সূরা মুজাদালাহ ২১) এ বিষয়ে এ ছাড়া আরো বহু আয়াত রয়েছে।

শয়তান মানুষকে বিভিন্নভাবেই ভয় দেখায়। এখানে একরকম, আরো যেভাবে ভয় দেখায় তা জানা যায় কুর’আন থেকে-

শয়তান তোমাদেরকে অভাবের ভয় দেখায়, আর তোমাদেরকে অশ্লীল কাজ করতে তাগাদা দেয়। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং প্রাচুর্যের নিশ্চয়তা দেন। আল্লাহ তো সবকিছু ঘিরে আছেন, তিনি সব জানেন। [আল-বাক্বারাহ ২৬৮]

সে এবং তার অনুসারিরা তোমাদেরকে তাদের জায়গা থেকে দেখতে পায়, কিন্তু তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। [আল-আ’রাফ ৭:২৭]

 আল্লামা ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ শয়তানের চক্রান্তের মধ্যে এটিও একটি চক্রান্ত যে, সে মুমিনদেরকে তার সেনাবাহিনী এবং বন্ধুদের মাধ্যমে ভয় দেখায়। যাতে মুমিনগণ শয়তানদের বিরুদ্ধে জিহাদ না করেন, সৎ কাজের আদেশ না দেন এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে বারণ না করেন। আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, এটিই শয়তানের চক্রান্ত এবং তার ভয় দেখানো। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শয়তানকে ভয় করতে নিষেধ করেছেন।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ সকল মুফাসসিরের নিকট আয়াতের অর্থ হচ্ছে, শয়তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে মুমিনদেরকে ভয় দেখায়।

আয়াতের অন্য একটি তাৎপর্য হচ্ছে, শয়তানের বন্ধুরা যদি ঈমান আনয়ন করে, তাহলে শয়তান তাদেরকে ভয় দেখায়।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَقَالُوا إِنْ نَتَّبِعِ الْهُدَى مَعَكَ نُتَخَطَّفْ مِنْ أَرْضِنَا‘‘

তারা বলে, যদি আমরা আপনার সাথে সুপথে আসি, তবে আমরা আমাদের দেশ থেকে উৎখাত হবো’’। (সূরা কাসাসঃ ৫৭) কতিপয় আলেম এ কথাই বলেছেন।

কাতাদাহ বলেনঃ শয়তান মানুষের অন্তরে তার বন্ধুদেরকে বড় করে দেখায়। যখনই বান্দার ঈমান মজবুত হয়, তখনই তার অন্তর থেকে শয়তানের বন্ধুদের ভয় দূর হয়ে যায়। আর যখনই ঈমান দুর্বল হয়, তখনই বান্দার অন্তরে শয়তানের বন্ধুদের ভয় প্রকট আকার ধারণ করে। অতএব আয়াতটি প্রমাণ করে যে, একমাত্র আল্লাহকে ভয় করা পরিপূর্ণ ঈমানের শর্তসমূহের অন্যতম। তাফসীর ও সীরাতের কিতাবসমূহ এই আয়াতের শানে নুযুল বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآَتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ

‘‘আল্লাহর মসজিদগুলোকে একমাত্র তারাই আবাদ করতে পারে, যারা আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেনা। অতএব, আশা করা যায়, তারা হেদায়াত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’। (সূরা তাওবাঃ ১৮)

ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিয়েছেন যে, কেবল ঐ সমস্ত লোকই মসজিদসমূহ আবাদ করে, যারা ঈমান রাখে আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি। অর্থাৎ যারা অন্তর দিয়ে ঈমান আনয়ন করে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে সৎকর্ম সম্পাদন করে। সেই সাথে শুধু আল্লাহকেই ভয় করে। সুতরাং জানা গেল যে, মসজিদ শুধু ঐ ঈমানের দ্বারাই আবাদ হবে, যার অধিকাংশ বিষয়ই হচ্ছে তাওহীদ। সেই সঙ্গে শির্ক-বিদআতের দোষমুক্ত খাঁটি সৎ আমলও করতে হবে। এ সমস্ত বিষয়ই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট ঈমানের অন্তর্ভূক্ত।

وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ‘‘আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেনা’’ঃ ইমাম ইবনে আতীয়া বলেনঃ এখানে ভয় বলতে আল্লাহর প্রতি সম্মান, আল্লাহর এবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর ভয় উদ্দেশ্য। কোনো সন্দেহ নেই যে, মানুষ পার্থিব জীবনের ক্ষতি ও বিপদাপদকে ভয় করে। তবে এ সকল ক্ষেত্রে বান্দার উচিত, সে কাযা ও কদর তথা তাকদীরের প্রতি ঈমান রেখেই পার্থিব জীবনের ক্ষতিকে ভয় করবে।

কিতাবুত তাওহীদের রচয়িতা শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের নাতী শাইখ হাসান বিন আব্দুর রাহমান (রঃ) বলেনঃ কল্যাণ ও অকল্যাণ আল্লাহর ইচ্ছা অনুপাতেই হয়ে থাকে। সুতরাং আল্লাহ যা চান, তাই হয়। তিনি যা চান না, তা হয়না।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ অন্তরের ভয় আল্লাহর এবাদতের অন্যতম প্রকার। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য তা পোষণ করা ঠিক নয়। আল্লাহর সামনে নত হওয়া, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা, আল্লাহর উপর ভরসা করা, আল্লাহর কাছেই আশা করা এবং এ প্রকারের অন্যসব বিষয় এবাদতে কালবীয়া অর্থাৎ অন্তরের এবাদতের অন্তর্ভূক্ত।

فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ ‘‘অতএব আশা করা যায় যে, তারা হেদায়াত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’ঃ ইবনে আবী তালহা আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস হতে বর্ণনা করেন যে, প্রকৃত পক্ষে এই লোকেরাই হেদায়াতপ্রাপ্ত। কুরআনে যত عَسَى (আশা করা যায়) অর্থের শব্দ আছে, তা আবশ্যক অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ অবশ্যই তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে।

 

 

আল্লাহ তাআলাকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করাঃ অর্থাৎ মানুষের সন্তুষ্টিকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর প্রাধান্য দেয়া। এটি ঐ ব্যক্তিই করতে পারে, যার অন্তরে আল্লাহর প্রতি সম্মান ও তাঁর ভয়ের এমন কোন অংশ নেই, যা তাকে তার প্রভু ও মালিক আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টির উপর মানুষের সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়া হতে বাধা দিতে পারে। আর আল্লাহ্ তাআলাই মানুষের অন্তরের মালিক ও তা পরিবর্তনকারী। এই দিক থেকে বলা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভালবাসা ও সন্তুষ্টির উপর মানুষের ভালোবাসা ও সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেয়, সে এক প্রকার শির্কেও লিপ্ত হয়। কেননা সে আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর সৃষ্টির সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং এমন বিষয় দিয়ে মাখলুকের নৈকট্য কামনা করেছে, যাতে আল্লাহ নারাজ হন। আল্লাহ যাকে হেফাজত করেন, সে ব্যতীত অন্য কেউ এ থেকে পরিত্রাণ পায়না।

তুমি যখন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে, তখন আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন, তোমার রিযিকের ব্যবস্থা করবেন এবং তোমার প্রয়োজন পূর্ণ করবেন। আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে বান্দাদেরকে সন্তুষ্ট করা বান্দাদেরকে ভয় করা কিংবা তাদের নিকট থেকে কিছু আশা করার কারণেই হয়ে থাকে। আর এটি দুর্বল ঈমানের পরিচয়।

হে মুমিন! আল্লাহর বান্দাদের কাছ থেকে যা পাওয়ার ধারণা করে থাক, তা যদি না পাও, তাহলে বুঝবে যে, এর কারণ আল্লাহ তাআলাই, তারা নয়। কেননা আল্লাহ যা চান, তাই হয়, তিনি যা চান না, তা কখনো হয়না। সুতরাং আল্লাহ তোমার জন্য নির্ধারণ না করার কারণে যা পাওনি, তার জন্য মানুষকে দোষারোপ করা তোমার ঈমানের দুর্বলতার পরিচয়।

সুতরাং হে মুমিন! তুমি মানুষকে ভয় করোনা এবং তাদের কাছে কিছুই চেয়োনা। আর তোমার ঈমান পরিপূর্ণ না হওয়ার কারণে কুপ্রবৃত্তির অনুসারী হয়ে মানুষকে দোষারোপও করোনা। লোকদের মধ্যে প্রশংসিত ঐ ব্যক্তি, যার প্রশংসা করেছেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং নিন্দিত ঐ ব্যক্তি, যার নিন্দা করেছেন আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল।

আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَأَرْضَى عَنْهُ النَّاسَ وَمَنِ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَسْخَطَ عَلَيْهِ النَّاسَ»

‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আললাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেন। ইমাম ইবনে হিববান তার সহীহ কিতাবে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ শারহুল আকীদাহ আল ওয়াসেতীয়াহ, হাদীছ নং- ৩০৪।

হাদীছে বর্ণিত التمس অর্থ হচ্ছে সে চায়, অনুসন্ধান করে, কামনা করে ইত্যাদি। শাইখুল ইসলাম বলেনঃ আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু উপরোক্ত হাদীছকে লিখে মুআবীয়া রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট পাঠিয়েছিলেন। অন্য বর্ণনায় আছে, তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মারফু সূত্রে বর্ণনা করেছেন। মারফু বর্ণনার শব্দগুলো ঠিক এ রকমঃ

«مَنْ أَرْضَى اللَّهَ بِسَخَطِ النَّاس كَفَاهُ مَؤُنَةَ النَّاسَ ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا»

‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনই উপকারে আসবেনা’’। আর মাউকুফ বর্ণনার শব্দগুলো হচ্ছে এ রকমঃ

«من أرضى الله بسخط الناس رضي الله عنه وأرضى عنه الناس ومن أرضى الناس بسخط الله عاد حامده من الناس له ذاما»

‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, মানুষের মধ্য হতে তার প্রশংসাকারীরাই তার নিন্দুকে পরিণত হয়।

এটি দ্বীনের বিরাট একটি শিক্ষা। কেননা যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য মানুষকে অসন্তুষ্ট করে, সে তার প্রভুকে ভয় করে এবং আল্লাহর সৎ বান্দা বলে গণ্য হয়। আল্লাহ তাআলা সৎ কর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন এবং আল্লাহই তাঁর বান্দাদের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (2) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ

‘‘আর যে আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ্ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক প্রদান করেন’’। (সূরা তালাকঃ ২-৩) কোনো সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলাই তাঁর বান্দাদের জন্য যথেষ্ট। যে ব্যক্তি মানুষকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে আল্লাহকে নারাজ করবে, বান্দারা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনো উপকারে আসবেনা। সে ঐ যালেমের মতই, যে কিয়ামতের দিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, হায় আফসোস। আমি যদি রাসূলের দেখানো পথ অবলম্বন করতাম, তাহলে কতই না ভাল হত।

 

৩:১৭৬ وَ لَا یَحۡزُنۡکَ الَّذِیۡنَ یُسَارِعُوۡنَ فِی الۡکُفۡرِ ۚ اِنَّہُمۡ لَنۡ یَّضُرُّوا اللّٰہَ شَیۡئًا ؕ یُرِیۡدُ اللّٰہُ اَلَّا یَجۡعَلَ لَہُمۡ حَظًّا فِی الۡاٰخِرَۃِ ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۷

১৭৬. যারা কুফরীতে দ্রুতগামী, তাদের আচরণ যেন আপনাকে দুঃখ না দেয়। তারা কখনো আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহ আখেরাতে তাদেরকে কোন অংশ দেবার ইচ্ছা করেন না। আর তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।

রসূল (সাঃ)-এর মধ্যে এই আশা চরমভাবে বিদ্যমান ছিল যে, সমস্ত মানুষ মুসলিম হয়ে যাক। আর এরই কারণে তাদের অস্বীকার করায় ও মিথ্যা ভাবায় তিনি বড়ই কষ্টবোধ করতেন। তাই মহান আল্লাহ এই আয়াতে তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন যে, তুমি কোন চিন্তা ও দুঃখ করবে না। এরা আল্লাহর কিছুই করতে পারবে না, তারা তো কেবল নিজেদের আখেরাত নষ্ট করছে

ক্ষেত্রে কেউ যেন এমন কোন সন্দেহ না করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা কাফেরদিগকে অবকাশ, দীর্ঘায়ু, স্বাস্থ্য-সামর্থ্য ও আরাম-আয়েশের উপকরণ এ জন্যই দিয়েছেন, যাতে তারা নিজেদের অপরাধ প্রবণতায় অধিকতর এগিয়ে যায়, তাহলে তো কাফেররা নির্দোষ। কারণ, আয়াতের উদ্দেশ্য হল এই যে, কাফেরদের সামান্য কয়েক দিনের এ অবকাশ ও ভোগ বিলাসে যেন মুসলিমরা পেরেশান না হয়। কেননা, কুফর ও পাপ সত্বেও তাদেরকে পার্থিব শক্তি-সামর্থ্য ও বৈভব দান করাটাও তাদের শাস্তিরই একটি পস্থা, যার অনুভূতি আজকে নয় এই পৃথিবী থেকে যাবার পরই হবে যে, তাদেরকে দেয়া পার্থিব ভোগ-বিলাসের যে উপকরণ তারা পাপকর্মে ব্যয় করেছে প্রকৃতপক্ষে সেসবই ছিল জাহান্নামের অঙ্গার। এ বিষয়টিই কতিপয় আয়াতে আল্লাহ এরশাদ করেছেন। বলা হয়েছে, “কাফেরদের ধন-সম্পদ এবং ভোগ-বিলাস তাদের জন্য গৌরবের বস্তু নয়; এগুলো আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে আযাবেরই একটি কিস্তি যা আখেরাতে তাদের আযাব বৃদ্ধির কারণ হবে।” [সূরা আত-তাওবাহ ৫৫]

 

৩:১৭৭ اِنَّ الَّذِیۡنَ اشۡتَرَوُا الۡکُفۡرَ بِالۡاِیۡمَانِ لَنۡ یَّضُرُّوا اللّٰہَ شَیۡئًا ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ

১৭৭. নিশ্চয় যারা ঈমানের বিনিময়ে কুফরী ক্রয় করেছে তারা কখনো আল্লাহ্‌র কোন ক্ষতি করতে পারবে না এবং তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে।

৩:১৭৮ وَ لَا یَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَنَّمَا نُمۡلِیۡ لَہُمۡ خَیۡرٌ لِّاَنۡفُسِہِمۡ ؕ اِنَّمَا نُمۡلِیۡ لَہُمۡ لِیَزۡدَادُوۡۤا اِثۡمًا ۚ وَ لَہُمۡ عَذَابٌ مُّہِیۡنٌ

১৭৮. কাফেরগণ যেন কিছুতেই মনে না করে যে, আমরা অবকাশ দেই তাদের মঙ্গলের জন্য: আমরা অবকাশ দিয়ে থাকি যাতে তাদের পাপ বৃদ্ধি পায়।(১) আর তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহর ‘হালীম’ নাম বা সীফতটি বহু আয়াতের শেষে আমরা দেখেছি। বস্তুতঃ আল্লাহর সব নাম গুলোই তার সীফত বা গুন। হালীম অর্থাৎ ঢিলা বা অবকাশ দান কারী। তিনি কোন বিষয়ে হঠাৎই পাকড়াও করেননা। অবকাশ বা ঢিল দিতে থাকেন। এখানে কাফেরদের সেই কথাটিই মনে করিয়ে দিয়ে বলছেন যেন তারা মনে না করে এটা তাদের জন্য কল্যানকর। তাদের ঢিল দেবার কারণ হল; তারা যাতে তাদের কাঙ্খীত পথে আরও এগিয়ে যেতে পারে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কেউ ইচ্ছা করলে সুপথে ফিরেও আসতে পারে। এর পরও যারা পাপের পথে রয়ে যাবে, আখেরাতে রয়েছে তাদের জন্য লাঞ্ছনা দায়ক শাস্তি।

এ আয়াতে কাফেরদেরকে কেন আল্লাহ তা’আলা তাদের পাপের কারণে শাস্তি না দিয়ে অবকাশ দিয়ে থাকেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, তাদের এ অবকাশ তাদের জন্য মঙ্গল বা সুখকর নয়। এটা তাদের গোনাহ আরও বর্ধিত করে তাদেরকে ভালভাবে পাকড়াও করার জন্য। অন্য আয়াতে অবশ্য বলা হয়েছে যে, তাদেরকে এ অবকাশ প্রদানের পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলা দুঃখ-কষ্ট দিয়ে আল্লাহর দিকে ফিরানোর সুযোগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারপরও যারা অবাধ্যতা অবলম্বন করে তাদেরকে তিনি শক্তহাতে পাকড়াও করেন। আল্লাহ বলেন, “আমি কোন জনপদে নবী পাঠালে সেখানকার অধিবাসীদেরকে অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট দ্বারা আক্রান্ত করি, যাতে তারা কাকুতি-মিনতি করে। তারপর আমরা অকল্যাণকে কল্যাণে পরিবর্তিত করি। অবশেষে তারা প্রাচুর্যের অধিকারী হয় এবং বলে, আমাদের পূর্বপুরুষরাও তো দুঃখ-সুখ ভোগ করেছে। তারপর হঠাৎ তাদেরকে আমরা পাকড়াও করি, কিন্তু তারা উপলব্ধি করতে পারে না” [সূরা আল-আরাফঃ ৯৪-৯৫]

আরও বলেন, “আপনার আগেও আমরা বহু জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি, তারপর তাদেরকে অর্থসংকট ও দুঃখ-কষ্ট দিয়ে পীড়িত করেছি, যাতে তারা বিনীত হয়। আমাদের শাস্তি তাদের উপর যখন আপতিত হল তখন তারা কেন বিনীত হল না? কিন্তু তাদের হৃদয় কঠিন হয়েছিল এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল। তাদেরকে যে উপদেশ দেয়া হয়েছিল তারা যখন তা ভুলে গেল তখন আমরা তাদের জন্য সবকিছুর দরজা খুলে দিলাম; অবশেষে তাদেরকে যা দেয়া হল যখন তারা তাতে উল্লাসিত হল তখন হঠাৎ তাদেরকে ধরলাম; ফলে তখনি তারা নিরাশ হল।” [সূরা আল-আনআমঃ ৪২-৪৪]

 

অন্য আয়াতে উল্লেখ করেছেন যে, এ অবকাশ প্রদান তার মজবুত কৌশলের অন্তর্গত। আল্লাহ বলেনঃ “আর যারা আমাদের নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে আমরা তাদেরকে এমনভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাই যে, তারা জানতেও পারবে না। আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি; আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ”। (সূরা আল-আরাফ, ১৮২-১৮৩]

আরও বলেন, “অতএব ছেড়ে দিন আমাকে এবং যারা এ বাণীতে মিথ্যারোপ করে তাদেরকে, আমরা তাদেরকে ক্রমে ক্রমে ধরব এমনভাবে যে, তারা জানতে পারবে না। আর আমি তাদেরকে সময় দিয়ে থাকি, নিশ্চয় আমার কৌশল অত্যন্ত বলিষ্ঠ [সূরা আল-কালাম: ৪৪-৪৫]

মহান আল্লাহ কুরআনের আরো কয়েকটি স্থানে উল্লেখ করেছেন। যেমন, [أَيَحْسَبُونَ أَنَّمَا نُمِدُّهُمْ بِهِ مِنْ مَالٍ وَبَنِينَ، نُسَارِعُ لَهُمْ فِي الْخَيْرَاتِ بَلْ لا يَشْعُرُونَ] ‘‘তারা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে সাহায্য স্বরূপ যে ধনৈশবর্য ও সন্তান-সন্ততি দান করি, তার দ্বারা তাদের জন্যে সর্বপ্রকার মঙ্গল তরান্বিত করছি? বরং তারা বুঝে না।’’ (সূরা মু’মিনূনঃ ৫৫-৫৬)

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলোঃ

প্রথমত : জীবনে পাপ করার স্বাধীনতাকে ভালো সুযোগ ভাবা উচিত নয়। এই সুযোগের কারণে বোকামী না করে বরং দেরী হবার আগেই কুফরী থেকে বিরত হওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত : জীবনে দীর্ঘায়ু হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বয়সকে অর্থাৎ সময়কে ভালোভাবে কাজে লাগানোই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম হোসাইন (আ.)’র পুত্র ইমাম সাজ্জাদ (আ.) তাঁর এক দোয়ায় বলেছেন- হে আল্লাহ! যদি আমার জীবন শয়তানের বিচরণ ক্ষেত্র হয়, তবে তা সংক্ষিপ্ত করে দাও।

তৃতীয়ত : কাফেরদের ভালো অবস্থা দেখেই তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা করা উচিত নয়, পরকালে তাদের শাস্তির বিষয়টি মনে রাখা উচিত।

চতুর্থত : কাফেরদের কর্তৃত্ব ও শাসন ক্ষমতাকে তাদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষণ মনে করে নীরব থাকা উচিত নয়। বরং তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।#

৩:১৭৯ مَا کَانَ اللّٰہُ لِیَذَرَ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ عَلٰی مَاۤ اَنۡتُمۡ عَلَیۡہِ حَتّٰی یَمِیۡزَ الۡخَبِیۡثَ مِنَ الطَّیِّبِ ؕ وَ مَا کَانَ اللّٰہُ لِیُطۡلِعَکُمۡ عَلَی الۡغَیۡبِ وَ لٰکِنَّ اللّٰہَ یَجۡتَبِیۡ مِنۡ رُّسُلِہٖ مَنۡ یَّشَآءُ ۪ فَاٰمِنُوۡا بِاللّٰہِ وَ رُسُلِہٖ ۚ وَ اِنۡ تُؤۡمِنُوۡا وَ تَتَّقُوۡا فَلَکُمۡ اَجۡرٌ عَظِیۡمٌ

১৭৯. অসৎকে সৎ থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ আল্লাহ্ মুমিনগণকে সে অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না অনুরূপভাবে গায়েব সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করা আল্লাহর নিয়ম নয়; তবে আল্লাহ তার রাসূলগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। কাজেই তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলগণের উপর ঈমান আন। তোমরা ঈমান আনলে ও তাকওয়া অবলম্বন করে চললে তোমাদের জন্য মহাপুরস্কার রয়েছে।

এই জন্যই মহান আল্লাহ পরীক্ষার কষ্টিপাথরে ঘষে নেন, যাতে তাঁর প্রকৃত বন্ধু কে তা পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তাঁর শত্রু লাঞ্ছিত হয়। আর ধৈর্যশীল মু’মিন মুনাফিক থেকে পৃথক হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ তাআলা উহুদের দিন ঈমানদারদেরকে পরীক্ষা করেছিলেন। সেদিন ঈমানদারগণ তাঁদের ঈমান, ধৈর্য, সুদৃঢ়তা এবং আনুগত্যের চরম উদ্দীপনার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পেশ করেছিলেন এবং মুনাফিকরা নিজেদেরকে মুনাফিক্বীর যে পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছিল, সে পর্দা উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল।

অর্থাৎ, মহান আল্লাহ যদি এইভাবে পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষদের অবস্থাসমূহ এবং তাদের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারসমূহকে প্রকাশ না করে দেন, তাহলে তোমাদের নিকট তো এমন কোন গায়বী জ্ঞান নেই, যার দ্বারা তোমাদের নিকট এই জিনিসগুলো প্রকাশ হয়ে যাবে এবং তোমরা জানতে পারবে যে, মুনাফিক কে এবং খাঁটি মু’মিন কে?

অবশ্য মহান আল্লাহ তাঁর মনোনীত রসূলগণের মধ্য থেকে যাঁকে চান, তাঁকে অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত করেন। ফলে তাঁদের নিকট মুনাফিকদের যাবতীয় অবস্থা এবং তাদের সমূহ চক্রান্তের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে যায়। অর্থাৎ, তা কখনো কখনো কোন কোন নবীর জন্য প্রকাশ করা হয়। সাধারণতঃ প্রত্যেক নবী (যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা না চান) মুনাফিকদের আভ্যন্তরিক মুনাফিক্বী এবং তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞই থাকেন।

(যেমন, সূরা তাওবার ১০১নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘আর কিছু কিছু তোমার আশে-পাশের মুনাফিক এবং কিছু লোক মদীনাবাসী কঠোর মুনাফিক্বীতে অনড়। তুমি তাদেরকে জান না, আমি তাদেরকে জানি।) এর অর্থ এও হতে পারে যে, আমি অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে কেবল আমার রসূলগণকেই অবহিত করি। কারণ, তাঁদের (নবুঅতী) পদের জন্য এটা জরুরী। এই আল্লাহর অহী এবং অদৃশ্য বিষয় দ্বারা তাঁরা মানুষদেরকে আল্লাহর প্রতি আহবান করেন এবং নিজেদেরকে আল্লাহর রসূল বলে সাব্যস্ত করেন।

এই বিষয়টাকে অন্যত্র এইভাবে বলা হয়েছে, [عَالِمُ الْغَيْبِ فَلا يُظْهِرُ عَلَى غَيْبِهِ أَحَدًا، إِلَّا مَنِ ارْتَضَى مِنْ رَسُولٍ] ‘‘তিনি অদৃশ্যের জ্ঞানী। পরন্তু তিনি অদৃশ্য বিষয় কারোও কাছে প্রকাশ করেন না। তাঁর মনোনীত রসূল ব্যতীত। (সূরা জিনঃ ২৬-২৭) প্রকাশ থাকে যে, অদৃশ্য বিষয় বলতে সেগুলোকে বোঝানো হয়েছে, যা রিসালাতের পদ এবং তার দায়িত্ব পালনের সাথে সম্পর্কিত। তা অতীত ঘটিত এবং ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত ঘটিতব্য বিষয়ের জ্ঞান নয়। যেমন, অনেক বাতিলপন্থী মনে করে ও করায় যে, আম্বিয়া (আলাইহিমুস্ সালাম) এবং তাদের কিছু ‘নিষ্পাপ’ ইমামরা নাকি অদৃশ্যের জ্ঞান রাখতেন।

৩:১৮০ وَ لَا یَحۡسَبَنَّ الَّذِیۡنَ یَبۡخَلُوۡنَ بِمَاۤ اٰتٰہُمُ اللّٰہُ مِنۡ فَضۡلِہٖ ہُوَ خَیۡرًا لَّہُمۡ ؕ بَلۡ ہُوَ شَرٌّ لَّہُمۡ ؕ سَیُطَوَّقُوۡنَ مَا بَخِلُوۡا بِہٖ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ وَ لِلّٰہِ مِیۡرَاثُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ اللّٰہُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ

১৮০. আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তাদের জন্য তা মঙ্গল, এমনটি যেন তারা কিছুতেই মনে না করে। বরং তা তাদের জন্য অমঙ্গল। যেটাতে তারা কৃপণতা করবে কেয়ামতের দিন সেটাই তাদের গলায় বেড়ী হবে।আসমান ও যমীনের সত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ্ তা বিশেষভাবে অবহিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত আদায় করেনি, তার সে ধন-সম্পদকে কেয়ামতের দিন একটি সাপের রূপ দেয়া হবে। যার মাথায় চুল থাকবে এবং চোখের উপর দুটি কালো দাগ থাকবে। সাপটিকে তার গলায় পেচিয়ে দেয়া হবে, সেটি তার মুখে দংশন করতে থাকবে এবং বলবেঃ আমি তোমার ধন-সম্পদ, আমি তোমার গচ্ছিত অর্থসম্পদ। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতটি পাঠ করেন। [বুখারীঃ ৪৫৬৫]

এই আয়াতে এমন কৃপণের কথা বলা হচ্ছে, যে আল্লাহর দেওয়া সম্পদ তাঁর রাস্তায় ব্যয় করে না। এমন কি সেই মালের ওয়াজেব যাকাতও আদায় করে না। সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে যে, ‘‘যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ধন-মাল দান করেছেন, কিন্তু সে ব্যক্তি তার সেই ধন-মালের যাকাত আদায় করে না, কিয়ামতের দিন তা (আযাবের) জন্য তার সমস্ত ধন-মালকে একটি মাথায় টাক পড়া (অতিরিক্ত বিষাক্ত) সাপের আকৃতি দান করা হবে; যার চোখের উপর দু’টি কালো দাগ থাকবে। সেই সাপকে বেড়ির মত তার গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর সে তার উভয় কশে ধারণ (দংশন) করে বলবে, ‘আমি তোমার মাল, আমি তোমার সেই সঞ্চিত ধনভান্ডার।’ (বুখারী ১৪০৩নং)