সুরা আলে ইমরান ১৪ তম রুকু (১৩০-১৪৩)

১৪দশ রুকু  (১৩০-১৪৩)

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُّضَاعَفَةً ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

১৩০. হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ খেয়ো না এবং আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

(১) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমর ইবনে আকইয়াশের জাহেলী যুগের কিছু সুদের কারবার ছিল সে তা উসুল করা জন্য ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত ছিল। তারপর যখন উহুদ যুদ্ধের দিন আসল, সে জিজ্ঞাসা করল, আমার চাচাত ভাই অমুক কোথায়? লোকেরা বলতঃ উহুদের প্রান্তরে, আবার জিজ্ঞাসা করতঃ অমুক কোথায়? তারা বলতঃ উহুদের প্রান্তরে, আবার জিজ্ঞাসা করলঃ অমুক কোথায়? লোকেরা বলতঃ সেও উহুদের প্রান্তরে। এতে সে তার যুদ্ধাস্ত্র পরে নিয়ে উহুদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়ে। মুসলিমগণ যখন তাকে দেখল তখন তারা বললঃ আমর! তুমি আমাদের থেকে দূরে থাক। কিন্তু সে জবাব দিল আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। তারপর সে যুদ্ধ করে আহত হলো, তাকে তার পরিবারের কাছে আহত অবস্থায় নিয়ে আসা হল।

সা’দ ইবনে মু’আয রাদিয়াল্লাহু আনহু এসে তার বোনকে বললেন তুমি তাকে জিজ্ঞাসা কর সে কি জাতিকে বাঁচানোর জন্য, নাকি তাদের ক্রোধে শরীক হওয়ার জন্য, নাকি আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করেছে? তখন আমর জবাবে বললঃ বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করেছি। তারপর তিনি মারা গেলেন। ফলে জান্নাতে প্রবেশ করলেন, অথচ আল্লাহর জন্য এক ওয়াক্ত সালাত পড়ারও সুযোগ তার হয়নি। [আবু দাউদঃ ২৫৩৭, ইসাবাঃ ২/৫২৬] হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আমি সর্বদা খুঁজে বেড়াতাম যে, আল্লাহ তা’আলা উহুদের ঘটনার মাঝখানে সুদের কথা কেন নিয়ে আসলেন, তারপর যখন এ ঘটনা পড়লাম তখন আমার কাছে এ আয়াতকে এখানে আনার যৌক্তিকতা স্পষ্ট হলো। [আল উজাবঃ ২/৭৫৩]

 

(২) আলোচ্য আয়াতে কয়েকগুণ বেশী অর্থাৎ চক্রবৃদ্ধি হারকে সুদ হারাম ও নিষিদ্ধ হওয়ার শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। অন্যান্য আয়াতে অত্যন্ত কঠোরভাবে সর্বাবস্থায় সুদ হারাম হওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। “আয়াতে চক্রবৃদ্ধি হারে” সুদ খাওয়া নিষেধ করার মধ্যে এদিকেও ইঙ্গিত হতে পারে যে, সুদ গ্রহণে অভ্যস্ত ব্যক্তি যদি চক্রবৃদ্ধি সুদ থেকে বেঁচেও থাকে, তবে সুদের উপার্জনকে যখন পুনরায় সুদে খাটাবে, তখন অবশ্যই দ্বিগুণের দ্বিগুণ হতে থাকবে- যদিও সুদখোরদের পরিভাষায় একে চক্রবৃদ্ধি সুদ বলা হবে না। সারকথা, সব সুদই পরিণামে দ্বিগুণের ওপর দ্বিগুন সুদ হয়ে থাকে।

 

সুতরাং আয়াতে সবরকম সুদকেই নিষিদ্ধ ও হারাম করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমরা ধ্বংসকারী সাতটি বিষয় হতে বেঁচে থাকবে, সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সে বিষয়গুলো কি কি? তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শির্ক করা, জাদু করা, যথার্থ কারণ ছাড়া আল্লাহ যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের মাল ভক্ষন করা, যুদ্ধ অবস্থায় জেহাদের ময়দান হতে পলায়ণ করা, পবিত্র মুসলিম নারীর উপর ব্যাভিচারের মিথ্যা অপবাদ দেয়া।” [বুখারীঃ ২৭৬৬]

 

৩:১৩১ وَ اتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡۤ اُعِدَّتۡ لِلۡکٰفِرِیۡنَ ﴿

১৩১. আর তোমরা সে আগুন থেকে বেঁচে থাক যা কাফেরদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের সবার সাথে আল্লাহ তা’আলা এমনভাবে কথা বলবেন যে, তার ও আল্লাহর মাঝে কোন অনুবাদকারী থাকবে না। তারপর প্রত্যেকে তার সামনে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পাবে না। অতঃপর সামনে তাকিয়ে দেখবে যে, জাহান্নাম তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসছে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন একটি খেজুরের অংশ বিশেষ দিয়ে হলেও জাহান্নাম থেকে নিজেকে বাঁচায়।” [বুখারী: ৬৫৩৯]

যারা কু’রআন কখনো পুরোটা একবারও অর্থ বুঝে পড়ে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখেননি, তারা এই ধরনের কথা বলেন। ইসলাম সম্পর্কে তারা নিজেদের ভেতরে একটা ধারণা করে নিয়েছেন। তাদের কাছে ইসলাম হচ্ছে: জীবনে যত খারাপ কাজ করেছি, তার জন্য কিছু সময় জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তারপর জান্নাতে গিয়ে পার্টি আর পার্টি। অনেকের মধ্যে একটা ধারণা আছে: যারা নামে মুসলিম (ঈমান না থাকলেও), তারা  সবাই জান্নাতে যাবেই। পাপের জন্য কয়েকটা দিন হয়ত জাহান্নামে শাস্তি পেতে হবে। তারপর জান্নাতে গিয়ে সব ভুলে যাবে। তাই এই দুনিয়ায় যে পাপ করছি, সেটা কোনো ব্যাপার না। একদিন না একদিন তো জান্নাতে যাবই। “হাজার হোক, আমার নাম আব্দুল্লাহ। আমার পাসপোর্টে ধর্ম লেখা আছে ‘ইসলাম’। আমি মুসলিম দেশে জন্মেছি! আমি জান্নাতে যাব না তো যাবে কে?

আর ওরা বলে, “আগুন আমাদেরকে মাত্র কয়েকটা দিনই স্পর্শ করবে।” বল, “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো অঙ্গীকার নিয়েছ, কারণ আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভাঙ্গেন না? নাকি তোমরা আল্লাহর সম্পর্কে না জেনেই কথা বল?” [আল-বাক্বারাহ ৮০]

সাইকোলজির ভাষায় এটা হচ্ছে এক ধরনের ‘কনফারমেশন বায়াস’।[১৭০] মানুষের ভেতরে একধরনের ঝোঁক বা প্রবণতা থাকে: সে যা বিশ্বাস করে সেটাকে সঠিক হিসেবে প্রমাণ করার। তার কাছে যখন কোনো তথ্য বা প্রমাণ আসে, সে সেটাকে এমনভাবে বুঝে নেয়, যা তার আগে থেকে ধরে রাখা বিশ্বাসকে সমর্থন করে। এমনকি তার কাছে যদি অপ্রাসঙ্গিক কোনো তথ্যও আসে, সে সেটাকে এমনভাবে গ্রহণ করে, যেন সেটা তারই বিশ্বাসকে সমর্থন করছে। তার বিশ্বাসের পক্ষের যুক্তিগুলো সে খুব ভালো করে শোনে, খুব ভালো করে মনে রাখে। কিন্তু তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধের যুক্তিগুলো তার এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন তাকে তার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে কিছু বললেও কোনো লাভ হয় না। সে ঘুরে ফিরে বিভিন্নভাবে নিজেকে নানাভাবে বোঝাতে থাকে, যেন সে তার বিশ্বাসে অটুট থাকতে পারে। এই কনফারমেশন বায়াস সবার ভেতরেই কম বেশি আছে।

এই ধরনের মানুষদের কনফারমেশন বায়াসকে আল্লাহ تعالى ভেঙ্গে দিচ্ছেন: “তোমরা কি আল্লাহর কাছ থেকে কোনো অঙ্গীকার নিয়েছ, কারণ আল্লাহ তার অঙ্গীকার ভাঙ্গেন না?”

কখনই না! যে একটিও বড় পাপ অর্জন করে এবং তার পাপের ধারাবাহিকতা তাকে ঘিরে রাখে — ওরাই হচ্ছে (জাহান্নামের) আগুনের সহযাত্রী। সেখানেই তারা অনন্তকাল [বা অনেক লম্বা সময়] থাকবে। [আল-বাক্বারাহ ৮১]

এই আয়াতে আল্লাহ تعالى এক বিশেষ প্রজাতির মানুষের কথা বলেছেন, যাদের অবাধ্যতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তিনি تعالى বলছেন: যারা ‘একটিও বড় পাপ’ করে। سَيِّئَةً — যা এসেছে سُوء থেকে, যার অর্থগুলো হলো: নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতিকারক কাজ, অশ্লীলতা, অপব্যবহার, অন্যায় সুবিধা নেওয়া।এটি হচ্ছে ঘৃণিত পাপ, বড় পাপ, যেমন মদ বা মাদকের প্রতি আসক্তি, ব্যভিচার, সুদ, হারাম ব্যবসা, অশ্লীলতা ইত্যাদি।

জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায় ইসলাম গ্রহণের সাথে ঈমান ও নেক আমল। ফরয পালন, পাপ বর্জন, তাক্বওয়া অর্জন ও দুআ। মহান আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন সে দুআঃ

رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

অর্থাৎ, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ইহকালে কল্যাণ দান কর এবং পরকালেও কল্যাণ দান কর। আর আমাদেরকে দোযখ-যন্ত্রণা থেকে রক্ষা কর।” (বাক্বারাহঃ ২০১)।

رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ ۖ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا (65) إِنَّهَا سَاءَتْ مُسْتَقَرًّا وَمُقَامًا

অর্থাৎ, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি নিবৃত্ত কর; জাহান্নামের শাস্তি তো নিশ্চিতভাবে ধ্বংসাত্মক; নিশ্চয় তা আশ্রয়স্থল ও বসতি হিসাবে অতীব নিকৃষ্ট!’ (ফুরক্বানঃ ৬৫-৬৬)

এ ছাড়া জাহান্নাম থেকে বাঁচার বহু উপায় হাদীসে বলা হয়েছে, যার কিছু নিম্নরূপঃ

এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে এমন আমল বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে এবং জাহান্নাম থেকে দুরে রাখবে। নবী (সাঃ) বললেন, “তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, তার সাথে কাউকে অংশীদার করবে না, নামায প্রতিষ্ঠা করবে, যাকাত দেবে এবং রক্ত সম্পর্ক বজায় রাখবে।” (বুখারী ও মুসলিম)।

“যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর রসূল, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেবেন।” (মুসলিম)।

“আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেবেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কামনায় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে।” (বুখারী ও মুসলিম)

“যে ব্যক্তি সুর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে (অর্থাৎ ফজরের ও আসরের নামায আদায় করবে, সে কখনো জাহান্নামে প্রবেশ করবে না।” (মুসলিম)।

“যে ব্যক্তি যোহরের ফরয নামাযের পুর্বে চার রাকআত ও পরে চার রাকআত সুন্নত পড়তে যত্নবান হবে, আল্লাহ তার উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দেবেন।” (আবু দাউদ, তিরিমিযী)।

“রোযা (জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার জন্য) ঢালস্বরূপ।” (বুখারী, মুসলিম)

“যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে (অর্থাৎ, জিহাদকালীন বা প্রভুর সন্তুষ্টি অর্জনকল্পে) একদিন রোযা রাখবে, আল্লাহ ঐ একদিন রোযার বিনিময়ে তার চেহারাকে জাহান্নাম হতে সত্তর বছর (পরিমাণ পথ) দূরে রাখবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)।

“সেই ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে; যতক্ষণ না দুধ স্তনে ফিরে না গেছে। (অর্থাৎ, দুধ স্তনে ফিরে যাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি তার জাহান্নামে প্রবেশ করাও অসম্ভব।) আর একই বান্দার উপর আল্লাহর পথের ধূলা ও জাহান্নামের পঁয়া একত্র জমা হবে। না।” (তিরমিযী, হাসান সহীহ)

“দুই প্রকার চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। আল্লাহর ভয়ে যে চক্ষু ক্রন্দন করে। আর যে চক্ষু আল্লাহর পথে প্রহরায় রত থাকে।” (তিরমিযী, হাসান)

“জাহান্নামের (আগুন) প্রত্যেক ঐ ব্যক্তির জন্য হারাম হবে, যে মানুষের নিকটবর্তী, নম্র, সহজ ও সরল।” (তিরমিযী, হাসান সূত্রে)।

“তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো; যদিও খেজুরের এক টুকরো সাদকাহ করে হয়। আর যে ব্যক্তি এরও সামর্থ্য রাখে না, সে যেন ভাল কথা বলে বাঁচে। যাকে এই কন্যা সন্তান দিয়ে কোন পরীক্ষায় ফেলা হয়, তারপর যদি সে তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করে, তাহলে এ কন্যারা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে অন্তরাল হবে।” (বুখারী, মুসলিম)।

“যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভায়ের সম্ভ্রম রক্ষা করবে, কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের আগুন থেকে তার চেহারাকে রক্ষা করবেন।” (তিরমিযী- হাসান)

“যে পছন্দ করে যে, তাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হোক এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হোক, তার মরণ যেন এমন অবস্থায় হয় যে, সে আল্লাহ ও তার রসুলের প্রতি ঈমান রাখে এবং অন্যের প্রতি এমন ব্যবহার দেখায়, যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে।” (মুসলিম)

 

৩:১৩২ وَ اَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَ الرَّسُوۡلَ لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ

১৩২. আর তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা কৃপা লাভ করতে পার।

আলোচ্য আয়াতে দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঃ

(এক) আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্যের সাথে রাসূলের আনুগত্যেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটা জানা কথা যে, রাসূলের আনুগত্য হুবহু আল্লাহর আনুগত্য বোঝায়। তারপরও এখানে রাসূলের আনুগত্যকে পৃথক করে বর্ণনা করার তাৎপর্য স্বয়ং আল্লাহ্ বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমাদের প্রতি করুণা করা হয়। এতে আল্লাহর করুণালাভের জন্যে আল্লাহ্ তা’আলার আনুগত্যকে যেমন অত্যাবশ্যকীয় ও অপরিহার্য করা হয়েছে, তেমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্যকেও জরুরী ও অপরিহার্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। শুধু এ আয়াতেই নয়, বরং সমগ্র কুরআনে বার বার এর পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে এবং যেখানেই আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ বর্ণিত হয়েছে, সেখানেই রাসূলের আনুগত্যকেও স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

কুরআন পাকের এই উপর্যুপরি ও অব্যাহত বাণী ইসলাম ও ঈমানের এ মূলনীতির প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে যে, ঈমানের প্রথম অংশ হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার তাওহীদ তথা অস্তিত্ব, প্রভুত্ব, নাম ও গুণ এবং ইবাদাত তথা দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করা এবং দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য করা।

(দুই) আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মকবুল ও নিষ্ঠাবান পরহেযগার বান্দার গুণাবলী ও লক্ষণাদি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য শুধু মৌখিক দাবীকে বলা হয় না, বরং গুণাবলী ও লক্ষণাদির দ্বারাই আনুগত্যকারীর পরিচয় হয়। পরবর্তী আয়াতসমূহে এর বর্ণনা আসছে।

মানব জাতির সাফল্য লাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে কেবল কুরআন-হাদীছকে মেনে নেওয়া।

আনুগত্যঃ

আনুগত্য অর্থ মান্য করা, মেনে চলা, আদেশ ও নিষেধ পালন করা, কোন কর্তৃপক্ষের ফরমান-ফরমায়েশ অনুযায়ী কাজ করা। আল-কোরআনে এর প্রতিশব্দ এতায়াত। এতায়াতের বিপরীত শব্দ মাছিয়াত। যার অর্থ নাফরমানী করা, হুকুম অমান্য করা।

প্রকৃত আনুগত্য হলো আল্লাহর যাবতীয় হুকুম আহকাম মেনে চলা। প্রকৃত এতায়াতের ব্যবহারিক রূপ হলো: ‘‘আল্লাহর এতায়াত কর, রাসূলের এতায়াত কর এবং উলিল আমরের এতায়াত কর। (আন নিসা-৫৯)

ইসলামের সাথে আনুগত্যের সম্পর্ক: ইসলাম ও আনুগত্য অর্থের দিক দিয়ে এক ও অভিন্ন। শাব্দিক অর্থের আলোকে ইসলামের অন্তর্নিহিত দাবি অনুধাবন করলে দেখা যাবে যে, এখানে আনুগত্যই মূল কথা। সুতরাং আমরা বলতে পারি, ইসলামই আনুগত্য অথবা আনুগত্যই ইসলাম। যেখানে, আনুগত্য নেই সেখানে ইসলাম নেই। যেখানে ইসলাম নেই, সেখানে আনুগত্য নেই। আনুগত্যের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা: কুরআনের ঘোষণা: ‘‘আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’’ (আশ-শুআরা-১৫০) এখানে আল্লাহকে ভয় করে চলার এবং তার পছন্দনীয় পথে জীবন-যাপন করার জন্যে রাসূলের আনুগত্যকে অপরিহার্য করা হয়েছে। আর এ দুটো শব্দ বিশিষ্ট নির্দেশ অর্থাৎ আল্লাহকে ভয় কর, আমার আনুগত্য কর- মক্কার সূরাগুলোতে বার বার এসেছে। কোরআনে আনুগত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে আরো বলা হয়েছে

মহান আল্লাহ বলেন,

قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيعُوْهُ تَهْتَدُوْا وَمَا عَلَى الرَّسُوْلِ إِلَّا الْبَلاَغُ الْمُبِيْنُ–

‘বল! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য সে দায়ী এবং তোমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। আর তোমরা তাঁর আনুগত্য করলে সৎপথ পাবে, রাসূলের কর্তব্য হচ্ছে শুধু স্পষ্টভাবে পৌঁছে দেয়া’ (নূর ২৪/৫৪)।

 

রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করা এবং তাঁর অনুসরণে ছালাত প্রতিষ্ঠা করা ও যাকাত দেওয়ার মধ্যেই মানব জীবনে শান্তি ফিরে আসবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَأَقِيْمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ-

‘তোমরা ছালাত ক্বায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হ’তে পার’ (নূর ২৪/৫৬)।

রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে, আল্লাহরই আনুগত্য করা হয়। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

مَنْ يُّطِعِ الرَّسُوْلَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ

‘যে কেউ রাসূলের আনুগত্য করে থাকে, নিশ্চয়ই সে আল্লাহরই আনুগত্য করে থাকে’ (নিসা ৪/৮০)।

মানব জাতির জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলেরই আনুগত্য করা আবশ্যক।

আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُوْلِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيْلاً-

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো ও রাসূলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের অন্তর্গত ‘ঊলুল আমর’ তথা আদেশ দাতাগণের। অতঃপর যদি তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে ম­তবিরোধ দেখা দেয়, তবে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস করে থাক। এটাই কল্যাণকর ও শ্রেষ্ঠতর সমাধান’ (নিসা ৪/৫৯)।

মানব জীবনের সকল প্রকার আমল কুরআন-হাদীছ মোতাবেক হ’তে হবে। এর মাঝেই মানবতার সার্বিক সফলতা নিহিত আছে। আর আমল কুরআন-সুন্নাহ অনুসরণে না হ’লে তা নিঃসন্দেহে বাতিল বলে গণ্য হবে। মহান আল্লাহ বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَلاَ تُبْطِلُوْا أَعْمَالَكُمْ-

‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য কর, আর (তা না করে) তোমাদের আমল সমূহ বিনষ্ট করো না’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)।

রাসূল (ছাঃ) যা করতে আদেশ দিয়েছেন তা গ্রহণ করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا

‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা হ’তে তোমাদের নিষেধ করেন তা হ’তে বিরত থাকো’ (হাশর ৫৯/৭)।

মানুষকে সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের ফায়ছালা গ্রহণ করতে হবে, তাহ’লে তারা সফলকাম হবে। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতা করলে পথভ্রষ্ট হবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلاَ مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُوْنَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاَ مُبِيْنًا

‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা করলে কোন মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর নিজেদের ব্যাপারে অন্য কোন সিদ্ধান্তের ইখতিয়ার থাকবে না। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِيْ مُسْتَقِيْمًا فَاتَّبِعُوْهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيْلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ-

‘আর এটাই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এ পথেরই অনুসরণ। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করো না। অন্যথা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরিয়ে দিবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এই নির্দেশ দিলেন, যেন তোমরা বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।

 

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর অমিয় বাণী গ্রহণ করলে বিশ্বের পথহারা মানুষ সঠিক পথ পাবে। মহান আল্লাহ বলেন,

فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ حَتَّى يُحَكِّمُوْكَ فِيْمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوْا فِيْ أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا

‘অতএব তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা কখনও মুমিন হ’তে পারবে না, যে পর্যন্ত তোমাকে তাদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের বিচারক হিসাবে মেনে না নিবে, তৎপর তুমি যে বিচার করবে তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করবে এবং ওটা শান্তভাবে পরিগ্রহণ না করবে’ (নিসা ৪/৬৫)।

আল্লাহ এবং রাসূল (ছাঃ)-কে অনুসরণের মাধ্যমেই মানব জাতি সর্বোত্তম মর্যাদা পাবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَأُوْلَئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُوْلَئِكَ رَفِيْقًا

‘আর যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হয়, তবে তারা ঐ ব্যক্তিদের সঙ্গী হবে যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন; অর্থাৎ নবীগণ, সত্য সাধকগণ, শহীদগণ ও সৎকর্মশীলগণ। আর এরাই সর্বোত্তম সঙ্গী’ (নিসা ৪/৬৯)।

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধাচরণ করবে সে জাহান্নামে যাবে। মহান আল্লাহ বলেন,

وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيْلِ الْمُؤْمِنِيْنَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيْرًا

‘আর সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং বিশ্বাসীগণের বিপরীত পথের অনুগামী হয়, তবে সে যাতে অভিনিবিষ্ট আমি তাকে তাতেই প্রত্যাবর্তিত করব ও তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব এবং এটা নিকৃষ্টতর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (নিসা ৪/১১৫)।

কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের কথা শুনার সাথে সাথে তা মেনে নেওয়ার মধ্যেই মানব জাতির সফলতা।

মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا دُعُوْا إِلَى اللهِ وَرَسُوْلِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُوْلُوْا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُوْلَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ، وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَخْشَ اللهَ وَيَتَّقْهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الْفَائِزُوْنَ-

‘মুমিনদের উক্তি তো এই, যখন তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেবার জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের দিকে আহবান করা হয় তখন তারা বলবে, আমরা শ্রবণ করলাম ও মান্য করলাম, আর তারাই সফলকাম। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর অবাধ্যতা হ’তে সাবধান থাকে তারাই সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১-৫২)।

 

আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে জান্নাতে যাওয়া যাবে, বিরুদ্ধাচরণ করলে জাহান্নামে যেতে হবে। যেমন হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

كُلُّ أُمَّتِىْ يَدْخُلُوْنَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى. قَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى، قَالَ مَنْ أَطَاعَنِىْ دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِىْ فَقَدْ أَبَى-

‘আমার সকল উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কিন্তু যে অস্বীকার করবে (সে নয়)। তারা বললেন, কে অস্বীকার করে? তিনি বললেন, যারা আমার অনুসরণ করবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার অবাধ্য হবে সেই অস্বীকার করে ’ বুখারী হা/৭২৮০)।

 

কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করলে মানুষ সঠিক পথ পাবে, বিরোধিতা করলে পথভ্রষ্ট হবে। হুযায়ফাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,

يَا مَعْشَرَ الْقُرَّاءِ اسْتَقِيْمُوْا فَقَدْ سُبِقْتُمْ سَبْقًا بَعِيْدًا فَإِنْ أَخَذْتُمْ يَمِيْنًا وَشِمَالاً، لَقَدْ ضَلَلْتُمْ ضَلاَلاً بَعِيْدًا

‘হে কুরআন পাঠকারীগণ! তোমরা (কুরআন ও সুন্নাহর উপর) সুদৃঢ় থাক। নিশ্চয়ই তোমরা অনেক পশ্চাতে পড়ে আছ। আর যদি তোমরা ডান দিকের কিংবা বাম দিকের পথ অনুসরণ কর, তাহ’লে তোমরা সঠিক পথ হ’তে বহু দূরে সরে পড়বে’। বুখারী হা/৭২৮২।

 

কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরলেই মানব জাতি ধ্বংসের পথ থেকে বেঁচে যাবে।

আবূমূসা (রাঃ) নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, ‘আমার ও আমাকে আল্লাহ যা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন তার উদাহরণ হ’ল এমন যে, এক লোক কোন এক কওমের নিকট এসে বলল, হে কওম! আমি নিজের চোখে সেনাবাহিনীকে দেখে এসেছি। আমি সুস্পষ্ট সতর্ককারী। কাজেই তোমরা আত্মরক্ষার চেষ্টা কর। কওমের কিছু লোক তার কথা মেনে নিল, সুতরাং রাতের প্রথম প্রহরে তারা সে জায়গা ছেড়ে রওনা হ’ল এবং একটি নিরাপদ জায়গায় গিয়ে পৌঁছল। ফলে তারা রক্ষা পেল। তাদের মধ্যকার আর এক দল লোক তার কথা মিথ্যা মনে করল, ফলে তারা নিজেদের জায়গাতেই রয়ে গেল। সকাল বেলায় শত্রুবাহিনী তাদের উপর আক্রমণ করল ও তাদের ধ্বংস করে দিল এবং তাদের মূল উৎপাটিত করে দিল। এটা হ’ল তাদের উদাহরণ যারা আমার আনুগত্য করে এবং আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসরণ করে। আর যারা আমার কথা অমান্য করে তাদের দৃষ্টান্ত হ’ল, আমি যে সত্য (বাণী) নিয়ে এসেছি তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা’। বুখারী হা/৭২৮৩।

 

কুরআন-সুন্নাহকে মযবুতভাবে আঁকড়ে না ধরলে এবং নিজের খেয়াল-খুশীমতে চললে মানুষ অবশ্যই পথভ্রষ্ট হবে। যেমন মহান আল্লাহ বলেন,

فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيْبُوْا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُوْنَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ-

‘অতঃপর যদি তারা তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তাহ’লে জানবে যে, তারা তো শুধু নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আল্লাহর পথনির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, সে ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে পথ-নির্দেশ করেন না’ (ক্বাছাছ ২৮/৫০)।

অন্যত্র তিনি বলেন, أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلٰهَهُ هَوَاهُ

‘তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে তারপ্রবৃত্তিকে নিজের মা‘বূদ বানিয়ে নিয়েছে’? (জাছিয়া ৪৫/২৩)।

 

কুরআন-সুন্নাহ জানার পরেও যদি কোন ব্যক্তি নিজের খেয়াল-খুশিমত চলে এবং সত্য বিষয় জানার পরেও যদি অধিকাংশ মানুষ যেদিকে চলছে সেদিকে চলে, তাহ’লে সে পথভ্রষ্ট হবে।

মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُوْنَ-  ‘তুমি যদি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের কথার অনুসরণ কর, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ হ’তে বিভ্রান্ত করে ফেলবে, তারা তো নিছক ধারণা ও অনুমানেরই অনুসরণ করে। আর তারা ধারণা ও অনুমান ছাড়া কিছুই করছে না’ (আন‘আম ৬/১১৬)।

 

নিজের খেয়াল-খুশীমত চললে মানুষ কখনও সঠিক পথ পেতে পারে না। এজন্য মহান আল্লাহ বলেন,

يَا دَاوُوْدُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيْفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلاَ تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ إِنَّ الَّذِيْنَ يَضِلُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيْدٌ بِمَا نَسُوْا يَوْمَ الْحِسَابِ-

‘হে দাঊদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। কেননা এটা তোমাকে আল্লাহর পথ হ’তে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ পরিত্যাগ করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কারণ তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৬)।

ইবলীসের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে, নিজের খেয়াল-খুশিমত চলার ফলে তার পরিণতি কি হয়েছিল? মহান আল্লাহ বলেন,

قَالَ يَا إِبْلِيْسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ أَسْتَكْبَرْتَ أَمْ كُنْتَ مِنَ الْعَالِيْنَ، قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِيْ مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ، قَالَ فَاخْرُجْ مِنْهَا فَإِنَّكَ رَجِيْمٌ، وَإِنَّ عَلَيْكَ لَعْنَتِيْ إِلَى يَوْمِ الدِّيْنِ-

‘তিনি বললেন, হে ইবলীস! আমি যাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি, তার প্রতি সিজদাবনত হ’তে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি কি ঔদ্ধত্য প্রকাশ করলে, না তুমি উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন? সে বলল, আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। তিনি বললেন, তুমি এখান হ’তে বের হয়ে যাও। নিশ্চয়ই তুমি বিতাড়িত এবং তোমার উপর আমার লা‘নত স্থায়ী হবে প্রতিদান দিবস পর্যন্ত’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫-৭৮)।

উপরোক্ত আয়াত থেকে মানুষের শিক্ষা নেওয়া উচিত। আর কুরআন-সুন্নাহকে মযবূত করে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমেই তারা সাফল্য ফিরে পাবে। সেই সাথে যারা কুরআন-সুন্নাহর আইন প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনপণ করেছে তাদের সাহায্য করতে হবে।

বেলাল বিন সা‘আদ বলেন, তিনটি বিষয় কোন আমলে পাওয়া গেলে তা গ্রহণ করা হবে না। তাহ’ল শিরকী ও কুফরী (কাজ) এবং নিজের রায় মত চলা (নিজের ইচ্ছা মত আমল করা)। আমি বললাম, হে আবূ ওমর! রায় কি জিনিস? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ ছেড়ে দিয়ে নিজের ইচ্ছামত বলা এবং আমল করা। বুখারী হা/৭২৮২।

অকী‘ (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি হাদীছ যেভাবে এসেছে সেভাবে অন্বেষণ করে, তাহ’লে জানবে সে সুন্নাতের অনুসারী। আর যে ব্যক্তি হাদীছ অন্বেষণ করবে তার রায়কে (মতকে) শক্তিশালী করার জন্য তাহ’লে জানবে সে বিদ‘আতী।বুখারী হা/৭২৮৩।

 

মানুষ অনেক বিদ‘আতী কাজ করে থাকে। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছে, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا، فَهْوَ رَدٌّ

‘যে কেউ এমন কোন আমল করল, যে ব্যাপারে আমাদের অনুমোদন নেই তা প্রত্যাখ্যাত’। বুখারী হা/২০; মুসলিম হা/১৭১৮।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِى أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ

‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে নেই এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, তা প্রত্যাখ্যাত’।মুসলিম হা/১৭১৮।

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, তোমরা কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ কর, বিদ‘আত কর না, (কুরআন-সুন্নাহই) তোমাদের জন্য যথেষ্ট এবং প্রত্যেক নতুন আবিষ্কৃত জিনিসই বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আত ভ্রষ্টতা।

গাযীফ বিন হারেছ বলেন, বিদ‘আতী কাজ করলে তার স্থানে (আমলকৃত) সুন্নাতটি ছেড়ে দেওয়া হয়’।

কুরআন-সুন্নাহর অনুসারীদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে। হাদীছে এসেছে,

আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيْبًا وَسَيَعُوْدُ غَرِيبًا فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءِ  ‘ইসলাম শুরু হয়েছিল গুটিকতক লোকের মাধ্যমে, আবার সেই অবস্থা প্রাপ্ত হবে। অতএব সুসংবাদ সেই অল্প সংখ্যক লোকদের জন্য (যারা কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করে)।মুসলিম, মিশকাত হা/১৫৯।

 

পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সৎ আমলের দিকে মানুষকে আহবান জানালে অশেষ ছওয়াব রয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলাম বিরোধী বা বিদ‘আতের দিকে মানুষকে ডাকলে তার জন্য গোনাহ রয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,

مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلُ أُجُوْرِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا-

‘যে ব্যক্তি কাউকে সঠিক পথের দিকে ডাকে তার জন্য সেই পরিমাণ নেকী রয়েছে, যে পরিমাণ নেকী তার কথার অনুসারী ব্যক্তি পাবে এবং তার নেকীর সামান্য পরিমাণও কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি কাউকে বিভ্রান্তির পথে ডাকে তার জন্য সেই পরিমাণ পাপ রয়েছে, যে পরিমাণ পাপ তার কথার অনুসারী ব্যক্তি পাবে, তার পাপ থেকে সামান্য পরিমাণও কমানো হবে না’।মুসলিম, আবূ দাঊদ হা/৪৬১১; ইবনু মাজাহ হা/২০৮; মিশকাত হা/১৫৮, সনদ ছহীহ।

 

যারা আল্লাহ ও রাসূলের অনুসারী তথা কুরআন-হাদীছ মেনে চলবে না, ক্বিয়ামতের দিন তারা আফসোস করবে এবং তাদেরকে যারা বিভ্রান্ত করেছিল, সেসব অনুসৃত লোকদের দ্বিগুণ শাস্তি কামনা করবে। মহান আল্লাহর বাণী,

يَوْمَ تُقَلَّبُ وُجُوهُهُمْ فِي النَّارِ يَقُوْلُوْنَ يَا لَيْتَنَا أَطَعْنَا اللهَ وَأَطَعْنَا الرَّسُوْلاً، وَقَالُوْا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّوْنَا السَّبِيْلاً، رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا-

‘যে দিন তাদের মুখমন্ডল অগ্নিতে উলটপালট করা হবে, সেদিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহকে মানতাম ও রাসূলকে মানতাম! তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন এবং তাদেরকে দিন মহা অভিশাপ’ (আহযাব ৩৩/৬৬-৬৮)।

 

মহান আল্লাহ আরো বলেন,

وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا رَبَّنَا أَرِنَا اللَّذَيْنِ أَضَلاَّنَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُوْنَا مِنَ الْأَسْفَلِيْنَ-

‘কাফেররা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! যেসব জ্বিন ও মানব আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল তাদের উভয়কে দেখিয়ে দিন, আমরা উভয়কে পদদলিত করবো, যাতে তারা নিম্ন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়’ (হা-মী-ম সাজদাহ ৪১/২৯)।

 

উল্লিখিত আয়াতগুলো থেকে অনুমিত হয় যে, সকল কল্যাণ নিহিত আছে কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মধ্যে এবং সকল শাস্তি নিহিত আছে কুরআন-সুন্নাহ ছেড়ে বাপ-দাদার পদাঙ্ক অনুসরণের মধ্যে।

অথচ আজকে মানুষ কুরআন-সুন্নাহ ছেড়ে বাপ-দাদার কৃষ্টি-কালচার অনুসরণ করছে, ব্যক্তিপূজা করছে, ইমামগণ যা বলেছেন, সেটারই তাক্বলীদ করছে, যদিও তার নিকট কুরআন-সুন্নাহ মওজুদ রয়েছে। কোন মাসআলায় ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হ’লেও যদি তা ইমামের কথার বিপরীত হয় তাহ’লে হাদীছের উপর আমল না করে ইমামের রায় মেনে চলে, বাপ-দাদার কৃষ্টির উপরেই থাকার চেষ্টা করে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

وَإِذَا قِيْلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللهُ وَإِلَى الرَّسُوْلِ قَالُوْا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لاَ يَعْلَمُوْنَ شَيْئًا وَلاَ يَهْتَدُوْنَ-

‘আর যখন তাদেরকে বলা হয়, আল্লাহর অবতীর্ণ বিধান সমূহের দিকে এসো এবং রাসূলের দিকে এসো, তখন তারা বলে, আমাদের জন্য ওটাই যথেষ্ট, যার উপর আমাদের বাপ-দাদাদেরকে পেয়েছি; যদিও তাদের বাপ-দাদারা না কোন জ্ঞান রাখতো, আর না হেদায়াত প্রাপ্ত ছিল’ (মায়েদাহ ৫/১০৪)।

 

অন্যত্র তিনি বলেন,

بَلْ قَالُوْا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُهْتَدُوْنَ، وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِيْ قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيْرٍ إِلاَّ قَالَ مُتْرَفُوْهَا إِنَّا وَجَدْنَا آبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آثَارِهِمْ مُقْتَدُوْنَ-

‘বরং তারা বলে, আমরাতো আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের উপর এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে হেদায়াতপ্রাপ্ত।

অনুরূপ তোমার পূর্বে কোন জনপদে যখনই কোন সতর্ককারী প্রেরণ করেছি তখন ওর সমৃদ্ধশালী ব্যক্তিরা বলতো আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পেয়েছি এক মতাদর্শের উপর এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি’ (যুখরুফ ৪৩/২২-২৩)।

এ আয়াত থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, বাপ-দাদার কৃষ্টি-কালচার কি ছিল সেটার দিকে লক্ষ্য না করে  এবং কোন ব্যক্তি পূজা না করে কুরআন ও সুন্নাহ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। যেমন ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি দেখছি তারা অচিরেই ধ্বংস হবে। কেননা আমি বলছি, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন। কিন্তু ওরা বলছে, আবু বকর ও ওমর (রাঃ) নিষেধ করছেন।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, তোমাদের উপর আকাশ থেকে পাথর বর্ষিত হওয়ার সময় প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। কারণ আমি বলছি, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, অথচ তোমরা বলছ, আবু বকর ও ওমর (রাঃ) বলেছেন।মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়া, ২০/২১৫, ২৫১।

ইমামগণও মানুষকে কুরআন হাদীছ আঁকড়ে ধরার জন্য বলেছেন। যেমন ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) বলেন, ‘আমি যদি আল্লাহর কিতাব (কুরআন) ও রাসূল (ছাঃ)-এর কথার (সুন্নাহ) বিরোধী কোন কথা বলে থাকি, তাহ’লে আমার কথাকে ছুড়ে ফেলে দিও’। মাজমূউর রাসায়েল আল-মুনীরিয়া, ১/২৫-২৬।

তিনি আরো বলেন, إذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনো সেটাই আমার মাযহাব’।ইবনু আবেদীন, রদ্দুল মুহতার ১/১৬৭।

ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, السنة سفينة نوح من ركبها نجا، ومن تخلف عنها غرق،  ‘সুন্নাত হ’ল নূহ (আঃ)-এর নৌকা সদৃশ। যে তাতে আরোহণ করবে সে পরিত্রাণ পাবে। আর যে তা থেকে পিছে অবস্থান করবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে’।মাজমূ‘ ফাতাওয়া ইবনে তায়মিয়া, ৪/১৩৭।

তিনি আরো বলেন, আমি একজন মানুষ মাত্র। আমি ভুল করি, আবার ঠিকও করি। অতএব আমার সিদ্ধান্তগুলো তোমরা যাচাই কর। যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর অনুকূলে হবে সেগুলো গ্রহণ কর। আর যেগুলো কুরআন ও সুন্নাহর প্রতিকূলে হবে তা প্রত্যাখ্যান কর’। শাওকানী, আল-কওলুল মুফীদ ফী আদিল্লাতিল ইজতেহাদি ওয়াত তাকলীদ, পৃঃ ১৬; ইবনু হাযম, আল-আহকাম ফী উছূলিল আহকাম, ৬/৫৯-৬০, সনদ হাসান।

ইমাম শাফঈ (রহঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর কথার উপর অন্য কারো কথা চলবে না, এর উপর সকল মানুষ ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এরপর বলেন, আমার কথা যখন কোন ছহীহ হাদীছের বিরোধী হবে তখন আমার কথাকে দেয়ালে ছুড়ে ফেল এবং ছহীহ হাদীছের উপর আমল কর। ইলামুল মুওয়াক্কিঈন, ৪/২৩৩; মাজমূউর রাসায়েল আল-মুনীরিয়া, ১/২৭।

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, আশ্চর্য লাগে ঐ সকল সম্প্রদায়কে যারা ছহীহ হাদীছ ও (হাদীছের) ছহীহ সনদ জানার পরেও (মানুষকে) ছুফিয়ান ও অন্যান্য (ইমামদের) রায় গ্রহণ করার জন্য ডাকে এবং সে রায়ের দিকেই যেতে বলে। এরূপ করা আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ। একাজের পরিণতি ভয়াবহ। ইবনুন নাজ্জার, শারহুল কাওকাবুল মুনীর ৪/৫৯০।

 

আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ

‘সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় তাদের উপর আপতিত হবে অথবা আপতিত হবে তাদের উপর কঠিন শাস্তি’ (নূর ২৪/৬৩)।

উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কুরআন-সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তারা কখনও লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হবে না। তাছাড়া সকল ইমামই কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ করে গেছেন এবং সকলকে কুরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। তাঁরা তাঁদের কোন কথা কুরআন-সুন্নাহর বিরোধী হ’লে, তাদের কথা ছুড়ে ফেলে কুরআন-সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং ব্যক্তিপূজা ও মাযহাবী গোঁড়ামি করতে নিষেধ করেছেন।

অপরদিকে রাসূল (ছাঃ) মানুষের মুক্তির জন্য দু’টি জিনিস রেখে গেছেন। তিনি বলেন,

تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ

‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি; যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্ত্তকে মযবূতভাবে ধরে থাকবে, ততদিন (তোমরা) পথভ্রষ্ট হবে না। সে দু’টি বস্ত্ত হ’ল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’।মুওয়াত্ত্বা, মিশকাত হা/১৮৬, সনদ হাসান।

সুতরাং যখন কেউ কোন বিষয়ে মতপার্থক্য দেখবে  তখন সরাসরি রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করবে। যেমন নবী করীম (ছাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে থেকে যারা জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। অতএব (মতপার্থক্যের সময়) আমার সুন্নাত এবং আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা হবে তোমাদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য। এ সুন্নাতকে খুব মযবূতভাবে মাড়ির দাঁত দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকবে। আর সমস্ত বিদ‘আত থেকে বিরত থাকবে। কেননা প্রত্যেকটি বিদ‘আতই গুমরাহী (ভ্রষ্টতা)’। আবূ দাঊদ হা/৪৬০৭, সনদ ছহীহ।

 

বিদ‘আতের অশুভ পরিণতি সম্পর্কে ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন,

من ابتدع في الإسلام بدعة يراها حسنة، فقد زعم أن محمداً خان الرسالة، لأن الله يقول : اليوم أكملت لكم دينكم، فما لم يكن يؤمئذ ديناً، فلا يكون اليوم ديناً

‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে বিদ‘আত চালু করে তাকে উত্তম মনে করে, সে যেন ধারণা করল যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) রিসালাতের দায়িত্বে খিয়ানত করেছেন। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নে‘মতকে পরিপূর্ণ করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। তাফসীরুল উশরিল আখির, পৃঃ ৭৪।

(সংগৃহিত– হাফেয আব্দুল মতীন)

 

৩:১৩৩ وَ سَارِعُوۡۤا اِلٰی مَغۡفِرَۃٍ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ وَ جَنَّۃٍ عَرۡضُہَا السَّمٰوٰتُ وَ الۡاَرۡضُ ۙ اُعِدَّتۡ لِلۡمُتَّقِیۡنَ

১৩৩. আর তোমরা তীব্র গতিতে চল নিজেদের রবের ক্ষমার দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।

এ আয়াতে ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতামুলকভাবে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্যের পর এটি দ্বিতীয় নির্দেশ।

এখানে ক্ষমার অর্থ আল্লাহর কাছে সরাসরি ক্ষমা চাওয়া হতে পারে। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে এখানে এমন সব সৎকর্ম এর উদ্দেশ্য, যা আল্লাহ্ তা’আলার ক্ষমা লাভ করার কারণ হয়। এটাই মত।

সাহাবী ও তাবেয়ীগণ বিভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু সারমর্ম সবগুলোরই এক। এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘কর্তব্য পালন’ ইবনে-আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, ‘ইসলাম’। আবুল আলিয়া বলেছেন ‘হিজরত’। আনাস ইবনে-মালেক বলেছেন ‘সালাতের প্রথম তাকবীর’। সায়ীদ ইবনে-জুবায়ের বলেছেন ইবাদাত পালন। দাহহাক বলেন ‘জিহাদ’। আর ইকরিমা বলেছেন ‘তওবা’। এসব উক্তির সারকথা এই যে, ক্ষমা বলে এমন সৎকর্ম বুঝানো হয়েছে, যা আল্লাহর ক্ষমার কারণ হয়ে থাকে।

এখানে দুটি বিষয় জানা আবশ্যক।

১। শ্রেষ্ঠত্ব দু’প্রকারঃ

এক, ঐ শ্রেষ্ঠত্ব, যা অর্জন করা মানুষের ইচ্ছা ও শক্তির বাইরে। এগুলোকে অনিচ্ছাধীন শ্রেষ্ঠত্ব বলা হয়। উদাহরণতঃ শ্বেতাঙ্গ হওয়া, সুশী হওয়া ইত্যাদি।

দুই, ঐ শ্রেষ্ঠত্ব, যা মানুষ অধ্যবসায় ও চেষ্টার দ্বারা অর্জন করতে পারে। এ গুলোকে ইচ্ছাধীন শ্রেষ্ঠত্ব বলা হয়। অনিচ্ছাধীন শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের চেষ্টা এবং বাসনা করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন,

“আর যা কিছু আল্লাহ‌ তোমাদের কাউকে অন্যদের মোকাবিলায় বেশী দিয়েছেন তার আকাংখা করো না। যা কিছু পুরুষেরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী। আর যা কিছু মেয়েরা উপার্জন করেছে তাদের অংশ হবে সেই অনুযায়ী। হ্যাঁ,, আল্লাহর কাছে তাঁর ফযল ও মেহেরবানীর জন্য দোয়া করতে থাকো। নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ‌ সমস্ত জিনিসের জ্ঞান রাখেন”। সূরা আন-নিসা ৩২

কারণ, এ জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব আল্লাহ্ স্বীয় হেকমত অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বন্টন করেছেন। এতে কারও চেষ্টার কোন দখল নাই। সুতরাং যত চেষ্টা ও বাসনাই করা হোক না কেন এ জাতীয় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হবে না। চেষ্টাকারীর মনে হিংসা ও শক্রতার আগুন জ্বলা ছাড়া আর কোন লাভ হবে না।

তবে যে সব শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে মানুষের ইচ্ছা শক্তি কাজ করে থাকে সেগুলোকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে অর্জন করার নির্দেশ বহু আয়াতে দেয়া হয়েছে। ঠিক এ আয়াতেও আল্লাহর ক্ষমার কারণ হয় এমন যাবতীয় কাজ করে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কেননা এটা মানুষের ইচ্ছাধীন বিষয়।

২। আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াতে ক্ষমাকে জান্নাতের পূর্বে উল্লেখ করে সম্ভবতঃ এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন যে, জান্নাত লাভ করা আল্লাহর ক্ষমা ছাড়া সম্ভব নয়। কেননা, মানুষ যদি জীবনভর পুণ্য অর্জন করে এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে, তবুও তার সমগ্র পুণ্যকর্ম জান্নাতের মুল্য হতে পারে না।

জান্নাত লাভের পস্থা মাত্র একটি। তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার ক্ষমা ও অনুগ্রহ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ “সততা ও সত্য অবলম্বন কর, মধ্যবর্তী পথ অনুসরণ কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের সুসংবাদ লাভ কর। কারও কর্ম তাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে না। শ্রোতারা বললোঃ আপনাকেও নয়কি- ইয়া রাসূলাল্লাহ। উত্তর হলোঃ আমার কর্ম আমাকেও জান্নাতে নেবে না। তবে আল্লাহ যদি স্বীয় রহমত দ্বারা আমাকে আবৃত করে নেন।” [বুখারীঃ ৫৩৪৯, মুসলিমঃ ২৮১৬]

মোটকথা এই যে, আমাদের কর্ম জান্নাতের মূল্য নয়। তবে আল্লাহ্ তাআয়ালার রীতি এই যে, তিনি স্বীয় অনুগ্রহ ঐবান্দাকেই দান করেন, যে সৎকর্ম করে। বরং সৎকর্মের সামর্থ্য লাভ হওয়াই আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির লক্ষণ। অতএব সৎকর্ম সম্পাদনে ক্রটি করা উচিৎ নয়।

আয়াতে জান্নাত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এর বিস্তৃতি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সমান। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের চাইতে বিস্তৃত কোন বস্তু মানুষ কল্পনা করতে পারে না। এ কারণে জান্নাতের প্রস্থতাকে এ দু’টির সাথে তুলনা করে বুঝানো হয়েছে যে, জান্নাত খুবই বিস্তৃত। প্রশস্ততায় তা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে নিজের মধ্যে ধরে নিতে পারে। এর প্রশস্ততাই যখন এমন, তখন দৈর্ঘ্য কতটুকু হবে, তা আল্লাহই ভাল জানেন। অবশ্য কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ জান্নাত দৈর্ঘ ও প্রস্থে সমান। কেননা তা আরশের নীচে গম্বুজের মত। গম্বুজের মত গোলাকার বস্তুর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান হয়ে থাকে। এ বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, তিনি বলেছেনঃ “তোমরা যখন আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইবে তখন ফেরদাউস চাইবে; কেননা তা সর্বোচ্চ জান্নাত, সবচেয়ে উত্তম ও মধ্যম স্থানে অবস্থিত জান্নাত, সেখান থেকেই জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত। আর তার ছাদ হলো দয়াময় আল্লাহর আরশ। [বুখারীঃ ২৭৯০, ৭৪২৩]

তবে আয়াতের এ ব্যাখ্যা তখন হবে, যখন عرض শব্দের অর্থ طول তথা দৈর্ঘ্যের বিপরীতে নেয়া হয়। কিন্তু যদি এর অর্থ হয় মূল্য’ তবে আয়াতের অর্থ হবে যে, জান্নাত কোন সাধারণ বস্তু নয়- এর মূল্য সমগ্র নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল। সুতরাং এহেন মূল্যবান বস্তুর প্রতি ধাবিত হও। কোন কোন মুফাসসির বলেনঃ আয়াতে উল্লেখিত عرض শব্দের অর্থ ঐ বস্তু যা বিক্রিত বস্তুর মোকাবেলায় মূল্য হিসেবে পেশ করা হয়। উদ্দেশ্য এই যে, যদি জান্নাতের মূল্য ধরা হয়, তবে সমগ্র নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল এবং এতদুভয়ের সবকিছু হবে এর মূল্য। এতে করে জান্নাত যে অমূল্য বিষয় তা প্রকাশ করাই লক্ষ্য। [তাফসীরে কাবীর]

(৩) জান্নাতের দ্বিতীয় বিশেষণে বলা হয়েছেঃ জান্নাত মুত্তাকীগণের জন্যে নির্মিত হয়েছে। এতে বুঝা গেল যে, জান্নাত সৃষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা বুঝা যায় যে, জান্নাত তৈরী হয়ে আছে। তাছাড়া কুরআন ও হাদীসে জান্নাতের যে সমস্ত বর্ণনা এসেছে সেগুলোতে কোথাও কোথাও স্পষ্ট করে বলা আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন। যেমন জান্নাতের বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “জান্নাতের এক ইট রৌপ্যের ও এক ইট স্বর্ণের, তার নীচের আস্তর সুগন্ধি মিশকের, তার পাথরকুচিগুলো হীরে-মুতি-পান্নার সমষ্টি, মিশ্রণ হচ্ছে, ওয়ারস ও যা’ফরান। যে তাতে প্রবেশ করবে সে তাতে স্থায়ী হবে, মরবে না, নিয়ামত প্রাপ্ত হবে, হতভাগা হবে না, যৌবন কখনও ফুরিয়ে যাবে না, কাপড়ও কখনও ছিড়ে যাবে না।” [মুসনাদে আহমাদ ২/৩০৪, ৩০৫, সহীহ ইবন হিব্বান: ১৬/৩৯৬]

৩:১৩৪ الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰہُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ

১৩৪. যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয়(১) করে, যারা ক্রোধ সংবরণকারী(২) এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল; আর আল্লাহ মুহসিনদেরকে ভালবাসেন;

যে সমাজে সুদের প্রচলন থাকে সেখানে সুদখোরীর কারণে দুই ধরনের নৈতিক রোগ দেখা দেয়। সুদ গ্রহণকারীদের মধ্যে লোভ-লালসা, কৃপণতা ও স্বার্থান্ধতা এবং সুদ প্রদানকারীদের মধ্যে, ঘৃণা, ক্রোধ, হিংসা ও বিদ্ধেষ জন্ম নেয়। ওহোদের পরাজয়ে এ দুই ধরনের রোগের কিছু না কিছু অংশ ছিল। মহান আল্লাহ‌ মুসলমানদের জানিয়ে দিয়েছেন যে, সুদখোরীর কারণে সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে যে নৈতিক গুণাবলীর সৃষ্টি হয় তার বিপরীত পক্ষে আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের কারণে এসব ভিন্নধর্মী নৈতিক গুণাবলী জন্ম হয়। আল্লাহর ক্ষমা, দান ও জান্নাত অর্জিত হতে পারে এই দ্বিতীয় ধরনের গুণাবলীর মাধ্যমে, প্রথম ধরনের গুণাবলীর মাধ্যমে নয়।

আয়াতে মহান রব আহ্বান করেছেন ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটতে। এর পরের দুই আয়াতে বলেছেন চারটি গুণের কথা। শেষে ১৩৬ নং আয়াতে এই সুসংবাদ দিয়েছেন যে, উল্লিখিত চারগুণের অধিকারীরাই রবের তরফ থেকে ক্ষমা এবং চিরস্থায়ী জান্নাতপ্রাপ্ত হবেন। আয়াতে বর্ণিত সেই চারটি গুণ হলো

(১) অর্থাৎ মোত্তাকী তারাই, যারা আল্লাহ্ তা’আলার পথে স্বীয় অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে অভ্যস্ত। স্বচ্ছলতা হোক কিংবা অভাব-অনটন হোক, সর্বাবস্থায় তারা সাধ্যানুযায়ী ব্যয় কার্য অব্যাহত রাখে। বেশী হলে বেশী এবং কম হলে কমই ব্যয় করে। এতে একদিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, দরিদ্র ও নিঃস্ব ব্যক্তিও আল্লাহর পথে ব্যয় করতে নিজেকে মুক্ত মনে করবে না এবং সৌভাগ্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখবে না। অপর দিকে আয়াতে এ নির্দেশও রয়েছে যে, অভাব-অনটনেও সাধ্যানুযায়ী ব্যয়কার্য অব্যাহত রাখলে আল্লাহর পথে ব্যয় করার কল্যাণকর অভ্যাসটি বিনষ্ট হবে না।

সম্ভবতঃ এর বরকতে আল্লাহ্ তা’আলা আর্থিক স্বচ্ছলতা ও স্বাচ্ছন্দ্য দান করতে পারেন। স্বচ্ছলতা ও অভাব-অনটন উল্লেখ করার আরও একটি রহস্য সম্ভবতঃ এই যে, এ দু’অবস্থায়ই মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়। অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য হলে আরামআয়েশে ডুবে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়। অপরদিকে অভাব-অনটন থাকলে প্রায়ই সে চিন্তামগ্ন হয়ে আল্লাহর প্রতি গাফেল হয়ে পড়ে। আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আরাম-আয়েশেও আল্লাহকে ভুলে না কিংবা বিপদাপদেও আল্লাহর প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে না।

আয়াতে মহান রব আহ্বান করেছেন ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটতে। এর পরের দুই আয়াতে বলেছেন চারটি গুণের কথা। শেষে ১৩৬ নং আয়াতে এই সুসংবাদ দিয়েছেন যে, উল্লিখিত চারগুণের অধিকারীরাই রবের তরফ থেকে ক্ষমা এবং চিরস্থায়ী জান্নাতপ্রাপ্ত হবেন। আয়াতে বর্ণিত সেই চারটি গুণ হলো

সচ্ছল-অসচ্ছল উভয় অবস্থায় ব্যয় করা। সচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করা তো সহজসাধ্য। কিন্তু অসচ্ছল অবস্থায়? আল্লাহর নির্দেশনা হচ্ছে অসচ্ছল অবস্থায়ও সম্পদ বৃদ্ধির জন্য দান করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে ‘আর যার জীবিকা সঙ্কীর্ণ করে দেয়া হয়েছে সে যেন আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন তা থেকে খরচ করে…কোনো সঙ্কট দেখা দিলে আল্লাহ তারপর স্বাচ্ছন্দ্যও সৃষ্টি করে দেবেন।’ (সূরা ত্বলাক, আয়াত : ০৭)

টিউব অয়েলে অনেক সময় পানি নাগালের বাইরে চলে যায়। তখন সামান্য পানি দিয়ে হ্যান্ডেল চাপতে থাকলে পানির প্রবাহ ফিরে আসে। অর্থাৎ সামান্য পানি অধিক পানি নিয়ে আসে। অসচ্ছল অবস্থায় দানের বিষয়টি তেমন। অসচ্ছলতার দরুণ হয়তো আমি বেশি কিছু ব্যয় করতে পারবো না। কিন্তু সে সময়ের কিঞ্চিৎ দান আমার সম্পদ বৃদ্ধির কারণ হবে।

যে ব্যক্তি গোপনে সদকা দেয় তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই সাত জনের মধ্যে হিসাব করেছেন যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তার ছায়ায় ছায়া দিবেন যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত অন্যকোনো ছায়া থাকবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘এবং এমন ব্যক্তি যে সদকা করল, অতঃপর তা গোপন করল, এমনকি তার বাম হাত জানল না, তার ডান হাত কি দান করছে।’

(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

দান করার আদবঃ

ক। আল্লাহর জন্য ইখলাস ঐকান্তিকতা। তাই সদকা দেয়া হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশে, যাতে থাকবে না কোনো রিয়া ও সুনাম অর্জনের ইচ্ছা।

খ. সদকাগ্রহীতাকে খোঁটা ও কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা, ইরশাদ হয়েছে:

(أَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُبۡطِلُواْ صَدَقَٰتِكُم بِٱلۡمَنِّ وَٱلۡأَذَىٰ ) [البقرة:262]

{হে মুমিনগণ, তোমরা খোঁটা ও কষ্ট দেয়ার মাধ্যমে তোমাদের সদকা বাতিল করো না।  সূরা আল বাকারাঃ২৬২

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

(يَتِيمٗا ذَا مَقۡرَبَةٍ ١٥ ) [البلد:51]

{ইয়াতীম আত্মীয়স্বজনকে} [ সূরা আলবালাদ:১৫]

হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘নিশ্চয় মিসকীনকে সদকাদান একটি সদকা, আর আত্মীয়কে দানে রয়েছে দুটি: সদকা ও আত্মীয়তা-বন্ধন রক্ষা।

গ। সদকার জন্য সম্পদের হালাল ও ভালো অংশ এবং ব্যক্তির কাছে যা প্রিয় তা বেছে নেয়া। ইরশাদ হয়েছে :

(لَن تَنَالُواْ ٱلۡبِرَّ حَتَّىٰ تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَۚ ) [آل عمران:

{তোমরা কখনো ছাওয়াব অর্জন করতে পারবে না, যতণ না ব্যয় করবে তা থেকে, যা তোমরা ভালবাস।} সূরা আলে ইমরান:৯২

আল্লাহ তাআলা বলেন:

(إِن تُبۡدُواْ ٱلصَّدَقَٰتِ فَنِعِمَّا هِيَۖ وَإِن تُخۡفُوهَا وَتُؤۡتُوهَا ٱلۡفُقَرَآءَ فَهُوَ خَيۡرٞ لَّكُمۡۚ ) [البقرة:171]

{তোমরা যদি সদাকা প্রকাশ কর, তবে তা উত্তম। আর যদি তা গোপন কর এবং ফকীরদেরকে তা দাও, তাহলে তাও তোমাদের জন্য উত্তম} [সূরা আল বাকারা:২৭১]

যদি সদকা প্রকাশ করায় কোনো দীনী স্বার্থ থাকে, যেমন অন্যদেরকে উৎসাহিত করা, তাহলে প্রকাশ্যে সদকা করাই উত্তম। তবে এ ব্যাপারে নিজের নিয়তের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে এবং নিয়ত যাতে কলুষমুক্ত থাকে সে ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে।

ঘ. সামর্থ্যানুযায়ী সদকা করা, হোক তা সামান্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা খেজুরের একাংশ দান করে হলেও আগুন থেকে বাঁচো।’(বর্ণনায় বুখারী)

দানের উপকারিতা—

প্রথমত: ব্যক্তিগত উপকারিতা

১- আত্মার পরিশুদ্ধি। ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন:

(خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم ) [التوبة:301]

{তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও। এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।} [ সূরা তাওবা:১০৩]

২ – নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ ; কেননা তাঁর একটি অবিচ্ছেদ্য গুণ ছিল দান-খয়রাত করা। আর তিনি এমন দান করতেন যারপর আর দারিদ্র্যের ভয় থাকত না। তিনি বিলাল রাযি. কে বলেছেন, ‘হে বিলাল তুমি সদকা করো, আরশের মালিক তোমার সম্পদ কমিয়ে দেবেন এ আশঙ্কা করোনা।’(বর্ণনায় বাযযার)

৩ – ব্যক্তি যা ব্যয় করবে আল্লাহ তাকে এর পরিবর্তে রিযক দেবেন। আর সদকা দ্বারা মানুষের আত্মোন্নতি ঘটে। আল্লাহ তাআলা বলেন :

(وَمَآ أَنفَقۡتُم مِّن شَيۡءٖ فَهُوَ يُخۡلِفُهُۥۖ وَهُوَ خَيۡرُ ٱلرَّٰزِقِينَ ٣٩ )[سبأ:93]

{আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দেবেন এবং তিনিই উত্তম রিয্কদাতা।}[সূরা সাবা:৩৯]

৪ – বেচা- কেনার ভুল থেকে সম্পদকে পবিত্র করা। কায়েস ইবনে আবি গারাযা রযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে আমাদেরকে দালাল বলা হতো। একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের পাশ দিয়ে গেলেন এবং এর থেকেও উত্তম নামে আমাদেরকে সম্বোধন করলেন। তিনি বললেন, ‘হে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, নিশ্চয় ব্যবসায় অহেতুক কথা ও কসম এসে যায়, অতঃপর তোমরা তা সদকা দ্বারা মিশ্রিত করো [অর্থাৎ তার কাফফরা প্রদান করো]’(বর্ণনায় আবু দাউদ)

৫ – ছাওয়াব অর্জন ও গুনাহের কাফফারা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,‘যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুর পরিমাণ সদকা করে – আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত অন্যকিছু গ্রহণ করেন না – আল্লাহ তাআলা তা তাঁর ডান হাতে গ্রহণ করেন এরপর তিনি তা লালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ তার ঘোড়ার বাচ্চাকে লালন করে, এমনকি একসময় সে সদকা পাহাড়তুল্য হয়ে যায়।’(বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম)

৬ – মৃত্যুর পর সদকায়ে জারিয়ার দ্বারা মুসলমানের উপকার লাভ

আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন মানুষ মরে যায় তখন তার আমাল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিন প্রকার ব্যতীত: সদকায়ে জারিয়া অথবা এমন ইলম যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় অথবা সৎ সন্তান যে তার জন্য দুআ করে।’(বর্ণনায় মুসলিম)

দ্বিতীয়ত: সামাজিক উপকার

১- সদকা যাকাতের সামাজিক মিশনকে পূর্ণতা দান করে।

২- সমাজে পারিস্পরিক সহায়তা, সহযোগিতা, স্থিতিশীলতা ও মিল-মহব্বত কায়েম করে।

 

  1. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ঘায়েল বা পরাভূত করতে পারাটাই বীর হওয়ার লক্ষণ নয়, বীর হল ঐ ব্যক্তি যে নিজেকে ক্রোধের সময় সম্বরণ করতে পেরেছে। [বুখারীঃ ৬১১৪, মুসলিমঃ ২৬০৯]

অনুরূপভাবে এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেনঃ আমাকে এমন একটি কথা বলুন যা আমার কাজে আসবে, আর তা সংক্ষেপে বলুন যাতে আমি তা আয়ত্ব করতে পারি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেনঃ রাগ করো না। সাহাবী বার বার একই প্রশ্ন করলেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও একই উত্তর দিলেন। [বুখারী: ৬১১৬; মুসনাদের আহমাদঃ ৫/৩৪]

আল্লাহ তাআলা মুত্তাকি লোকদের প্রশংসা করে বলেন, ‘যখন তারা রাগান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়। (সুরা শুরা : আয়াত ৩৭)

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা কোন বান্দাকে ক্ষমার বিনিময়ে কেবল সম্মানই বৃদ্ধি করে দেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয়ী হয় আল্লাহ তাকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করেন। [তিরমিযীঃ ২৩২৫, মুসনাদে আহমাদঃ ৪/৪৩১]

অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন ক্রোধকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হওয়া সত্বেও দমন করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে সমস্ত সৃষ্টিকুলের সামনে ডেকে যে কোন হুর পছন্দ করে নেয়ার অধিকার দিবেন।” [ইবন মাজাহঃ ৪১৮৬]

অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর কাছে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ক্রোধ সম্বরণ করার চেয়ে বড় কোন সম্বরণ বেশী সওয়াবের নেই।” [ইবন মাজাহ: ৪১৮৯]

কুরআন ও হাদিসের আলোকে রাগ থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে প্রিয়নবির এ হাদিসটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, রাগ বা ক্রোধ শয়তানের তরফ থেকে আসে। শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুনকে পানি ঠাণ্ডা করে দেয়। যদি কারো ক্রোধ বা রাগ আসে তবে তার উচিত ওজু করে নেয়া।’ (বুখারি, মিশকাত)

রাগের যাবতীয় অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য বিশ্বনবির ছোট্ট একটি হাদিসই যথেষ্ট। আর তা হলো-

“রাগ মানুষের ঈমানকে নষ্ট করে দেয় যেমনিভাবে তিক্ত ফল মধুকে নষ্ট করে দেয়।” (বাইহাকি, মিশকাত)

ক্ষমা হলো আল্লাহ তাআলার অন্যতম গুণ। আল্লাহ নিজে ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে আল্লাহ তাআলা ভালোবাসেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকের অনেক জায়গায় প্রিয়নবিকে ক্ষমার ব্যাপারে নসিহত পেশ করেছেন-

আল্লাহ বলেন, ‘আপনি ক্ষমা করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদের এড়িয়ে চলুন। (সুরা আরাফ : আয়াত ১৯৯)

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অতএব আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৫৯)

মানুষের প্রতি ক্ষমা ও দয়ায় রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা। ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা যদি ওদেরকে ক্ষমা (মার্জনা) কর; ওদের দোষ ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং ক্ষমা কর তবে জেনে রেখ, আল্লাহ ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। (সুরা তাগাবুন : আয়াত ১৪)

 

৩:১৩৫ وَ الَّذِیۡنَ اِذَا فَعَلُوۡا فَاحِشَۃً اَوۡ ظَلَمُوۡۤا اَنۡفُسَہُمۡ ذَکَرُوا اللّٰہَ فَاسۡتَغۡفَرُوۡا لِذُنُوۡبِہِمۡ ۪ وَ مَنۡ یَّغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ اِلَّا اللّٰہُ ۪۟ وَ لَمۡ یُصِرُّوۡا عَلٰی مَا فَعَلُوۡا وَ ہُمۡ یَعۡلَمُوۡنَ

১৩৫. আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবে? এবং তারা যা করে ফেলে, জেনে-বুঝে তারা তা পুনরায় করতে থাকে না।

 

(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোন এক ব্যক্তি গোনাহ করার পর বললঃ হে আল্লাহ! আমি গোনাহ করেছি সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বললেনঃ আমার বান্দা গোনাহ করেছে এবং এটা জেনেছে যে, তার একজন রব আছে যিনি তার গোনাহ মাফ করবে ও তাকে পাকড়াও করবে; আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। তারপর সে আবার আরেকটি গোনাহ করে আবারও বললঃ হে রব! আমি গোনাহ করেছি সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তা’আলা বললেনঃ আমার বান্দা গোনাহ করেছে এবং এটা জেনেছে যে, তার একজন রব আছে যিনি তার গোনাহ মাফ করবে ও তাকে পাকড়াও করবে; আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম। তারপর সে আবার আরেকটি গোনাহ করে আবারও বললঃ হে রব! আমি গোনাহ করেছি সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বললেনঃ আমার বান্দা গোনাহ করেছে এবং এটা জেনেছে যে, তার একজন রব আছে যিনি তার গোনাহ মাফ করবে ও তাকে পাকড়াও করবে; আমি আমার বান্দাকে ক্ষমা করে দিলাম, সে যাই করুক না কেন। [বুখারীঃ ৭৫০৭, মুসলিমঃ ২৭৫৮]

 

আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমাকে আবু বকর হাদীস শুনিয়েছে। আর আবু বকর সত্য বলেছে। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছেন, “কোন লোক যদি গুনাহ করে, তারপর পাক-পবিত্র হয় এবং সালাত আদায় করে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। তারপর তিনি উপরোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করলেন।” [তিরমিযী: ৪০৬; ইবন মাজাহঃ ১৩৯৫; আবু দাউদ ১৫২১]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, “তোমরা দয়া কর, তোমাদেরকেও রহমত করা হবে, তোমরা ক্ষমা করে দাও আল্লাহও তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন, যারা কোন কথা না শোনার জন্য নিজেদেরকে বন্ধ করে নিয়েছে তাদের জন্য ধ্বংস, যারা অন্যায় করার পর জেনে-বুঝে বারবার করে তাদের জন্যও ধ্বংস।” [মুসনাদে আহমাদ: ২/১৬৫]

 

৩:১৩৬ اُولٰٓئِکَ جَزَآؤُہُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ مِّنۡ رَّبِّہِمۡ وَ جَنّٰتٌ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِہَا الۡاَنۡہٰرُ خٰلِدِیۡنَ فِیۡہَا ؕ وَ نِعۡمَ اَجۡرُ الۡعٰمِلِیۡنَ

১৩৬. তারাই, যাদের পুরস্কার হলো তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা এবং জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; সেখানে তারা স্থায়ী হবে। আর সৎকর্মশীলদের পুরস্কার কতইনা উত্তম!

৩:১৩৭ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ سُنَنٌ ۙ فَسِیۡرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ فَانۡظُرُوۡا کَیۡفَ کَانَ عَاقِبَۃُ الۡمُکَذِّبِیۡنَ

(১৩৭) অতীতে তোমাদের পূর্বে বহু ঘটনা অতিবাহিত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ কর এবং দেখ মিথ্যাশ্রয়ীদের পরিণাম কি ছিল!

উহুদ যুদ্ধে মুসলিমদের সৈন্য সংখ্যা ছিল সাতশ’। তাদের মধ্য থেকে ৫০ জন তীরন্দাজের একটি দলকে রসূল (সাঃ) আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ)-এর নেতৃত্বে (জাবালে রুমাত) ছোট পাহাড়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিতে নিযুক্ত করে বলেছিলেন, আমরা জিতে যাই বা হেরে যাই, কোন অবস্থাতেই তোমরা এখান থেকে নড়বে না। তোমাদের কাজ হবে, কোন অশবারোহী এদিকে এলে তাকে তীর ছুঁড়ে পশ্চাৎপদ হতে বাধ্য করা। কিন্তু যখন মুসলিমরা বিজয় লাভ করে গনীমতের মাল জমা করছিলেন, তখন এই দলের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল। কেউ কেউ বলতে লাগলেন, নবী করীম (সাঃ)-এর উদ্দেশ্য ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এখান থেকে নড়া হবে না। এখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, কাফেররা পশ্চাদপসরণ করেছে। অতএব আর এখানে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। কাজেই তাঁরা সেখান থেকে চলে এসে মাল-পত্র জমা করার কাজে লেগে গেলেন। সেখানে নবী করীম (সাঃ)-এর নির্দেশের আনুগত্য করে কেবল দশজন সাহাবী রয়ে গেলেন। এদিকে ঘাঁটি শূন্য পেয়ে কাফেরা উপকৃত হল। তাদের অশবারোহী দল মুসলিমদের পিছন থেকে পাল্টা আক্রমণ করে বসল। অতর্কিতে এই আক্রমণের কারণে মুসলিমদের মধ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিল এবং তাঁরা স্বাভাবিকভাবে বহু কষ্টের শিকারও হলেন। এই আয়াতগুলোতে মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন যে, তোমাদের সাথে যা কিছু হয়েছে, তা নতুন কিছু নয়; পূর্বেও এ রকম হয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ও বরবাদী তাদের ভাগ্যেই নেমে আসে, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।

৩:১৩৮ ہٰذَا بَیَانٌ لِّلنَّاسِ وَ ہُدًی وَّ مَوۡعِظَۃٌ لِّلۡمُتَّقِیۡنَ

১৩৮. এগুলো মানুষের জন্য স্পষ্ট বর্ণনা এবং মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত ও উপদেশ

৩:১৩৯ وَ لَا تَہِنُوۡا وَ لَا تَحۡزَنُوۡا وَ اَنۡتُمُ الۡاَعۡلَوۡنَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ

১৩৯. তোমরা হীনবল হয়ো না এবং চিন্তিতও হয়ো না; তোমরাই বিজয়ী যদি তোমরা মুমিন হও।

 

(১) আলোচ্য আয়াতে মুসলিমদের হতাশ না হতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। কতিপয় ক্রটি-বিচ্যুতির কারণে ওহুদের যুদ্ধে প্রথম পর্যায়ে জয়লাভ করার পর কিছুক্ষণের জন্য মুসলিমরা পরাজয় বরণ করে সত্তরজন সাহাবী শহীদ হন। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আহত হন। কিন্তু এ সবের পর আল্লাহ তা’আলা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেন এবং শত্রুরা পিছু হটে যায়। এ সাময়িক বিপর্যয়ের কারণ ছিল তিনটি।

(এক) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তীরন্দাজ বাহিনীর প্রতি যে নির্দেশ জারি করেছিলেন, পারস্পরিক মতভেদের কারণে তা শেষ পর্যন্ত পালিত হয়নি।

(দুই) স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিহত হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুসলিমদের মনে নৈরাশ্যের সৃষ্টি হয়। ফলে সবাই ভীত ও হতোদ্যম হয়ে পড়ে।

(তিন) মদীনা শহরে অবস্থান গ্রহণ করে শক্ৰদের মোকাবেলা করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ পালনে যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল, সেটাই ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুসলিমদের এ তিনটি বিচ্যুতির কারণেই তারা সাময়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন।

এ সাময়িক পরাজয় অবশেষে বিজয়ের রূপ ধারণ করেছিল সত্য; কিন্তু মুসলিম যোদ্ধারা আঘাতে জর্জরিত ছিলেন। মুসলিম বীরদের মৃতদেহছিল চোখের সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও হতভাগারা আহত করে দিয়েছিলো। সর্বত্র ঘোর বিপদ ও নৈরাশ্য ছায়া বিস্তার করেছিল। মুসলিম মুজাহিদগণ স্বীয় ক্রটি-বিচ্যুতির জন্যেও বেদনায় মুষড়ে পড়েছিলেন। সার্বিক পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল।

(এক) অতীত ঘটনার জন্য দুঃখ ও বিষাদ।

(দুই) আশঙ্কা যে, ভবিষ্যতের জন্য মুসলিমগণ যেন দুর্বল ও হতোদ্যম না হয়ে পড়ে এবং বিশ্ব-নেতৃত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এ জাতি অঙ্কুরেই মনোবল হারিয়ে না ফেলে।

এ দুইটি ছিদ্রপথ বন্ধ করার জন্যে কুরআনের এ বাণীতে বলা হয় যে, ভবিষ্যতের জন্যে তোমরা দৌর্বল্য ও শৈথিল্যকে কাছে আসতে দিয়ো না এবং অতীতের জন্যেও বিমর্ষ হয়ো না। যদি তোমরা ঈমান ও বিশ্বাসের পথে সোজা হয়ে থাক এবং আল্লাহ্ তা’আলার ওয়াদার উপর ভরসা রেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য ও আল্লাহর পথে জেহাদে অনড় থাক, তবে পরিশেষে তোমরাই জয়ী হবে। উদ্দেশ্য এই যে, অতীতে যে সব ক্রটি-বিচূতি হয়ে গেছে, তার জন্য দুঃখ ও শোক প্রকাশে সময় ও শক্তি নষ্ট না করে ভবিষ্যতে সংশোধনের চিন্তা করা দরকার। ঈমান, বিশ্বাস ও রাসূলের আনুগত্য উজ্জল ভবিষ্যতের দিশারী। এগুলো হাতছাড়া হতে দিয়ো না। পরিশেষে তোমরাই জয়ী হবে।

৩:১৪০ اِنۡ یَّمۡسَسۡکُمۡ قَرۡحٌ فَقَدۡ مَسَّ الۡقَوۡمَ قَرۡحٌ مِّثۡلُہٗ ؕ وَ تِلۡکَ الۡاَیَّامُ نُدَاوِلُہَا بَیۡنَ النَّاسِ ۚ وَ لِیَعۡلَمَ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ یَتَّخِذَ مِنۡکُمۡ شُہَدَآءَ ؕ وَ اللّٰہُ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیۡنَ

১৪০. যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, অনুরূপ আঘাত তো ওদেরও লেগেছে। মানুষের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আমরা এ দিনগুলোর আবর্তন ঘটাই, যাতে আল্লাহ মুমিনগণকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য থেকে কিছু সংখ্যককে শহীদরূপে গ্রহণ করতে পারেন। আর আল্লাহ যালেমদেরকে পছন্দ করেন না।

এখানেও অন্য এক ভঙ্গিমায় মহান আল্লাহ মুসলিমদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন যে, উহুদ যুদ্ধে তোমাদের কিছু লোক আহত হয়েছে তো কি হয়েছে? তোমাদের বিরোধী দলও তো বদরের যুদ্ধে এবং উহুদ যুদ্ধের প্রথম দিকে এইভাবেই আহত হয়েছিল। আর মহান আল্লাহ তাঁর হিকমতের দাবীতে হার-জিতের পালা পরিবর্তন করতে থাকেন। কখনো বিজয়ীকে পরাজিত করেন, আবার কখনো পরাজিতকে করেন বিজয়ী।

এখানে বদর যুদ্ধের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে ৷ একথা বলার অর্থ হচ্ছে এই যে, বদর যুদ্ধের আঘাতে যখন কাফেররা হিম্মতহারা হয়নি তখন ওহোদ যুদ্ধের এই আঘাতে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলছো কেন?

তোমাদের থেকে কিছু সংখ্যা শহীদ নিতে চাইছিলেন৷ অর্থাৎ কিছু লোককে শাহাদাতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে চাইছিলেন৷

দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, বর্তমানে তোমাদের মধ্যে ঈমানদার ও মুনাফিক যে মিশ্রিত দলটি গড়ে উঠেছে তার মধ্য থেকে এমন সব লোকদের ছেঁটে আলাদা করে নিতে চাইছিলেন যারা আসলে —— (সমগ্র মানব জাতির ওপর সাক্ষী) অর্থাৎ এই মহান পদের যোগ্য হিসেবে বিবেচিত৷ কারণ এই মহান ও মর্যাদাপূর্ণ পদেই মুসলিম উম্মাহকে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে৷

ওহুদ যুদ্ধে হযরত আবদুল¬াহ ইবনে আমর ইবনে হারাম শাহাদাত লাভ করেন। যুদ্ধের পর রাসূল করীম (সা) শহীদের পুত্র হযরত জাবির ইবনে আবদুল্ল-াহকে সান্তনা দিতে গিয়ে বলেন- “হে জাবির, আমি কি তোমাকে তোমার পিতার সঙ্গে আাল্ল¬াহ রাব্বুল আলামীনের সাক্ষাতের সুসংবাদ দেব না? জাবির বললেন অবশ্যই দিন হে আল্ল¬াহর রাসূল। তখন তিনি বলেন ঃ আল্লাহ বলেনঃ হে আমার গোলাম তোমার যা খুশী আমার নিকট চাও। আমি তোমায় দান করবো।” তিনি জবাবে বলেছেন, “হে আমার মনিব। আমাকে জীবিত করে আবার পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিন আবার আপনার পথে শহীদ হয়ে আসি।” তখন আল্ল¬াহ তাকে বলেন, “আমার এ ফয়সালা তো পূর্বেই জানিয়ে দিয়েছি যে, মৃত লোকেরা ফিরে যাবে না।” তখন তোমার পিতা আরজ করেন, “আমার মনিব তবে আমাকে যে সম্মান ও মর্যাদা আপনি দান করেছেন, তার সুসংবাদ পৃথিবীবাসীদের জানিয়ে দিন।” তখন আল্ল¬াহ নিন্মোক্তে আয়াতটি নাযিল করেন। “যারা আল্ল¬াহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, তারা জীবিত। জামে আত্-তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী

শাহাদাতের মর্যাদা

১। শহীদরা অমর: ২। শহীদরা নিহত হবার কষ্ট অনুভব করেনা: ৩। কিয়ামতের দিন শহীদরা তাজা রক্ত নিয়ে উঠবে:

৪। কবর আযাব থেকে রেহাই এবং সুপারিশ করার অধিকার লাভ: রাসূল (সা) বলেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদদের জন্যে ছয়টি পুরস্কার রয়েছে।

সেগুলো হচ্ছেঃ ক) প্রথম রক্ত বিন্দু ঝরতেই তাকে মাফ করে দেয়া হয় এবং তার আবাসস্থল জান্নাত চাক্ষুষ দেখানো হয়। খ) তাকে কবরের আযাব থেকে রেহাই দেয়া হয়। গ) সে ভয়ানক আতঙ্ক থেকে নিরাপদ থাকে। ঘ) তাকে সম্মানের টুপি পরিয়ে দেয়া হবে, যার এক একটি ‘ইয়াকুত’ পৃথিবী এবং পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকেও উত্তম। ঙ) তাকে উপঢৌকন স্বরূপ আয়তনয়না হূর প্রদান করা হবে এবং চ) তাকে সত্তর জন আত্মীয় স্বজনের জন্যে সুপারিশ করার ক্ষমতা প্রদান করা হবে (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, মেকদাদ ইবনে মা’দীকরব)।

৫। শহীদের জন্য রিয্কে হাসানা ও সন্তোষজনক জান্নাত:শহীদের বিভিন্ন নিয়ামত এবং অনুগ্রহ রাজির ব্যাপারে আল কুরআনে বহু প্রমাণ মেলে। তাদের সুসংবাদের কোন শেষ নেই।

 

الَّذِينَ قَالُواْ لإِخْوَانِهِمْ وَقَعَدُواْ لَوْ أَطَاعُونَا مَا قُتِلُوا قُلْ فَادْرَؤُوا عَنْ أَنفُسِكُمُ الْمَوْتَ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ- وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُواْ فِي سَبِيلِ اللّهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاء عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ- فَرِحِينَ بِمَا آتَاهُمُ اللّهُ مِن فَضْلِهِ وَيَسْتَبْشِرُونَ بِالَّذِينَ لَمْ يَلْحَقُواْ بِهِم مِّنْ خَلْفِهِمْ أَلاَّ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ- يَسْتَبْشِرُونَ بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللّهِ وَفَضْلٍ وَأَنَّ اللّهَ لاَ يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ

এরা ঐসব লোক, যারা নিজেরা তো বসেই রইলো, আর তাদের যেসব ভাই-বন্ধু যুদ্ধ করতে গেলো এবং নিহত হলো তাদের সম্বন্ধে এরা বলে দিলো যে, যদি তারা আমাদের কথা মেনে নিতো তাহলে তারা মারা যেতো না। হে নবী! ওদেরকে বলে দিন যে, যদি তোমরা এ কথায় সত্যবাদী হও তাহলে যখন তোমাদের মৃত্যু আসবে তখন তোমাদের নিজেদের থেকে তা ফিরিয়ে দিব। যারা আল¬াহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত মনে করো না। তারা তো আসলে জীবিত। তারা তাদের রবের কাছ থেকে রিযক পাচ্ছে। আল্লাহ তাদেরকে নিজ মেহেরবাণী থেকে যা কিছু দিয়েছেন, তাতে তারা খুশি ও তৃপ্ত। আর তারা এ বিষয়েও নিশ্চিত যে, যেসব ঈমানদার লোক তাদের পেছনে দুনিয়াতে রয়ে গেছে এবং এখনো সেখানে পৌঁছেনি, তাদের জন্য কোন ভয় ও দুঃখের কারণ নেই। তারা আল্লাহর নিয়ামত ও মেহেরবাণী পেয়ে আনন্দিত এবং তারা জানতে পেরেছে যে, আল্লাহ ঈমানদারদের পুরষ্কার নষ্ট করেন না।

আলে-ইমরানঃ ১৩৬

৬। আল্লাহর সান্নিধ্য এবং যা খুশী তাই পাবার অধিকার লাভ ৭। শহীদ পরিবারের গৌরব

 ৮।শাহাদাত উচ্চ মর্যাদার মডেল

৩:১৪১ وَ لِیُمَحِّصَ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ یَمۡحَقَ الۡکٰفِرِیۡنَ

১৪১. আর যাতে আল্লাহ মুমিনদেরকে পরিশোধন করতে পারেন এবং কাফেরদেরকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেন।

উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা তাঁদের অবহেলার কারণে সাময়িকভাবে যে পরাজয়ের শিকার হন, তাতেও ভবিষ্যতের জন্য এমন কয়েকটি যৌক্তিকতা নিহিত রয়েছে, যা মহান আল্লাহ পরের আয়াতে বর্ণনা করেছেন।

প্রথমতঃ মহান আল্লাহ ঈমানদারদেরকে অন্যদের থেকে পৃথক করে দেখিয়ে দেন। (কারণ, ধৈর্য ও সুদৃঢ় থাকা ঈমানের দাবী।) যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে এবং মসীবতের সময় যাঁরা ধৈর্য ও সুদৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, অবশ্যই তাঁরা সকলেই মু’মিন।

দ্বিতীয়তঃ কিছু লোককে শাহাদতের মর্যাদা দানে ধন্য করেন।

তৃতীয়তঃ ঈমানদারদেরকে তাঁদের সমস্ত পাপ থেকে পবিত্র করেন। تَمْحِيْصٌ শব্দ কয়েকটি অর্থে ব্যবহার হয়ঃ যেমন, বেছে নেওয়া এবং পবিত্র, পরিশুদ্ধ বা বিশুদ্ধ করা। আর পবিত্র ও পরিশুদ্ধ বলতে, পাপ থেকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করা। (ফাতহুল ক্বাদীর)

আর চতুর্থতঃ কাফেরদের ধ্বংস সাধন। কারণ, সাময়িকভাবে জয়লাভে তাদের অবাধ্যতা ও দাম্ভিকতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে এই জিনিসই তাদের ধ্বংস ও বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

 

৩:১৪২ اَمۡ حَسِبۡتُمۡ اَنۡ تَدۡخُلُوا الۡجَنَّۃَ وَ لَمَّا یَعۡلَمِ اللّٰہُ الَّذِیۡنَ جٰہَدُوۡا مِنۡکُمۡ وَ یَعۡلَمَ الصّٰبِرِیۡنَ

১৪২. তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে, অথচ আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কে জিহাদ করেছে আর কে ধৈর্যশীল তা এখনো প্রকাশ করেননি?

ঈমানের পরীক্ষা বলতে কি বুঝায়? আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের মাঝে মধ্যে ভাল ও মন্দ অবস্থায় ফেলে পরীক্ষা করা তাঁর চিরাচরিত নিয়ম।

كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَنَبْلُوكُم بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً وَإِلَيْنَا تُرْجَعُونَ

প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাধ আস্বাধন করতে হবে। আর আমি ভালো ও মন্দ অবস্থায় ফেলে তোমাদেরকে পরীক্ষা করছি। অবশেষে তোমরা আমারই কাছে ফিরে আসবে (আম্বিয়া-৩৫)।

আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন,

إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا–

‘আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি (পিতা-মাতার) মিশ্রিত শুক্রবিন্দু হ’তে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। অতঃপর আমরা তাকে করেছি শ্রবণশক্তিসম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন’ (দাহর৭৬/২)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,

تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ-الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ–

‘বরকতময় তিনি, যাঁর হাতে সকল রাজত্ব এবং তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান। যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য, কে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর আমল করে। আর তিনি মহা পরাক্রান্ত ও ক্ষমাশীল’ (মুলক ৬৭ /২)। মহান আল্লাহ আরো বলেন,

إِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَى الْأَرْضِ زِينَةً لَهَا لِنَبْلُوَهُمْ أَيُّهُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا-

‘ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে সবকিছুকে আমরা তার শোভা বর্ধনকারী হিসাবে সৃষ্টি করেছি যাতে আমরা মানুষের পরীক্ষা নিতে পারি, তাদের মধ্যে কে সুন্দরতম কাজ করে’ (কাহফ ১৮/৭)।

ঈমানের পরীক্ষার কারণ

পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় ঈমানের দাবীতে কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী

وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَالصَّابِرِينَ وَنَبْلُوَ أَخْبَارَكُمْ

আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, যাতে তোমাদের অবস্থা যাছাই করে নিতে পারি এবং দেখে নিতে পারি যে, তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ ও ধৈর্যশীল-(মুহাম্মদ- ৩১)।

ঈমানের ঘোষনা দিলে পরীক্ষা আসবেই

الم، أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ، وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللَّهُ الَّذِينَ صَدَقُوا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِينَ

আলিফ- লাম মীম। লোকেরা কি মনে করে রেখেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে আর পরীক্ষা করা হবেনা? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তী সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যাবাদী। (আনকাবুত ১-৩)।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ তা’আলার চিরাচরিত নিয়ম হচ্ছে যে, তিনি কাউকে পরীক্ষা না করে জান্নাতে দিবেন না। তিনি তাদেরকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে তারপর সে পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। পবিত্র কুরআনে এ কথাটি বারবার ঘোষিত হয়েছে। যেমন, আল্লাহ বলেন,

“তোমরা কি মনে কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের কাছে তোমাদের পূর্ববতীদের মত অবস্থা আসেনি? অর্থ-সংকট ও দুঃখ-ক্লেশ তাদেরকে স্পর্শ করেছিল এবং তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সংগী-সাথী ঈমানদারগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? [সূরা আল-বাকারাহ: ২১৪]

আরও বলেন, “তোমরা কি মনে কর যে, তোমাদেরকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে যতক্ষন পর্যন্ত আল্লাহ না প্রকাশ করেন তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ এবং কারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ও মুমিনগণ ছাড়া অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করেনি?” [আত-তাওবাহ; ১৬]

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, “হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা আমরা নবী করীম (সা.) এর নিকট (আমাদের দুঃখ-দুর্দশা ও অত্যাচার-নির্যাতন সম্পর্কে অভিযোগ করলাম। তখন তিনি তার চাদরটিকে বালিশ বানিয়ে কাবা ঘরের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা তাকে বললাম : আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চান না? আপনি কি আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য দোয়া করেন না? তখন তিনি বললেন : তোমাদের ওপর আর কি দুঃখ নির্যাতন এসেছে? তোমাদের পূর্বেকার ঈমানদার লোকদের অবস্থা ছিল এই যে, তাদের কারো জন্য গর্ত খোড়া হতো এবং সে গর্তের মধ্যে তার দেহের অর্ধেক পুতে তাকে দাঁড় করিয়ে  তার মাথার ওপর করাত দিয়ে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হতো। কিন্তু এ অমানুষিক অত্যাচার তাকে তার দ্বীন থেকে বিরত রাখতে পারতো না। আবার কারো শরীর থেকে লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়িয়ে হাড় থেকে গোশত আলাদা করে ফেলা হতো। কিন্তু এতেও তার দ্বীন থেকে ফিরাতে পারতো না। আল্লাহর কসম, এ দ্বীন অবশ্যই পূর্ণতা লাভ করবে। তখন যেকোন উটারোহী লানআ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত দীর্ঘ পথ নিরাপদে সফর করবে। আর এ দীর্ঘ সফরে সে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করবে না। এবং মালিক তার মেষ পালের ব্যাপারে নেকড়ে ছাড়া আর কারো ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা খুবই তাড়াহুড়া করছো।” (বুখারী)

হযরত সুফিয়ান ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : আমি রাসূল (সা.)কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম; হে আল্লাহর রসুল (সা.): ইসলাম সম্পর্কে আমাকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ হেদায়েত দেন যাতে এ সম্পর্কে আর কাউকে প্রশ্ন করার প্রয়োজন না হয়। রাসূল (সা.) বলেন : বলো “আমানতুবিল্লাহ” অর্থাৎ আমি আল্লাহর ওপর ঈমান আনলাম এবং তার ওপর সুদৃঢ় থাকো।” (মুসলিম)

তোমরা বর্তমানে যে অবস্থায় আছো আল্লাহ মুমিনদের কখনো সেই অবস্থায় থাকতে দেবেন না৷ পাক –পবিত্র লোকেদেরকে তিনি নাপাক ও অপবিত্র লোকদের থেকে আলাদা করেই ছাড়বেন৷ কিন্তু তোমাদেরকে গায়েবের খবর জানিয়ে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়৷ গায়েবের খবর জানাবার জন্য তিনি নিজের রসূলদের মধ্য থেকে যাকে চান বাছাই করে নেন৷ কাজেই ( গায়েবের ব্যাপারে) আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান রাখো ৷ যদি তোমরা ঈমান ও আল্লাহকে ভয় করার নীতি অবলম্বন করো তাহলে বিরাট প্রতিদান পাবে৷ আলে ইমরান-১৭৯

পরীক্ষার মাঝে অনেক গোপন উপকারিতা ও শিক্ষা রয়েছে ইউসুফ-১১১

স্মরণ করো যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উত্‌রে গেলো, তখন তিনি বললেনঃ “আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠত করবো ৷ ইবরাহীম বললোঃ “আর আমার সন্তানদের সাথেও কি এই অংগীকার ?” জবাব দিলেনঃ “আমার এ অংগীকার যালেমদের ব্যাপারে নয় ৷বাক্বারা -১২৪

মুছ‘আব ইবনু সা‘দ (রাহঃ) হ’তে তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি (সা‘দ) বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মানুষের মাঝে কার বিপদের পরীক্ষা সবচেয়ে কঠিন হয়? তিনি বললেন, নবীদের বিপদের পরীক্ষা, তারপর যারা নেককার তাদের বিপদের পরীক্ষা। এরপর যারা নেককার তাদের বিপদের পরীক্ষা। মানুষকে তার ধর্মানুরাগের অনুপাত অনুসারে পরীক্ষা করা হয়। তুলনামূলকভাবে যে লোক বেশী ধার্মিক তার পরীক্ষাও সে অনুপাতে কঠিন হয়ে থাকে। আর যদি কেউ তার দ্বীনের ক্ষেত্রে শিথিল হয়ে থাকে তাহ’লে তাকে সে মোতাবেক পরীক্ষা করা হয়। অতএব, বান্দার উপর বিপদাপদ লেগেই থাকে, অবশেষে তা তাকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেয় যে, সে যমীনে চলাফেরা করে অথচ তার কোন গুনাহই থাকে না’। তিরমিযী হা/২৩৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৪০২৩; মিশকাত হা/ ১৫৬২।

জীবনের হুমকি ও শাহাদাত

لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُواْ أَذًى كَثِيرًا وَإِن تَصْبِرُواْ وَتَتَّقُواْ فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الأُمُورِ

হে মুসলমানগণ! তোমাদের উপর মাল ও জানের দিক দিয়ে পরীক্ষা আসবেই এবং তোমরা অবশ্যই আহলে কিতাব ও মুশরিকদের পক্ষ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনতে পাবে। যদি এসব অবস্থায় তোমরা সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে চলতে থাকো তাহলে তা বড়ই হিম্মতের কাজ-(আল ইমরান-১৮৬)।

পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত হয় কারা আল্লাহর অনুগত: ১. তালুতের পিপাসা কাতর সৈনিকদের সামনে পানি ছিল জীবন মরণ ইস্যু। নদী সামনে পেয়ে পানি পান করার জন্য সবাই যখন খুব উদগ্রীব ছিল সেই সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে পানি পান না করার জন্য। বাক্বারা ঃ ২৪৯-২৫১।

২. হযরত দাউদ (আ) এর সময়ে বনী ইসরাঈলকে শনিবারে মাছ ধরতে নিষেধ করার ঘটনাটিও শিক্ষাপ্রদ। হযরত দাউদ (আ) এর সময়ে ইয়াহুদীদেরকে আল্লাহ পাক শনিবার মাছ ধরতে নিষেধ করে পরীক্ষা করেন। কিন্তু তারা ছল-চাতুরী করে উক্ত নির্দেশ পুরোপুরি পালন করেননি। এরফলে আল্লাহ পাক তাদেরকে শাস্তি প্রদান করেন। আরাফ-১৬৩ ।

৩. আল্লাহ তায়ালা একটি উটনি দিয়ে সামুদ জাতিকে পরীক্ষা করেন। আরাফ ঃ ৭৩ । মূলত উক্ত উটনি ছিল তাদের ছিল পরীক্ষার বস্তু। অর্থাৎ একটি উটনি তাদের সামনে এনে হাজির করা হল এবং বলা হলো এ একলা একদিন পানি পান করবে এবং তোমরা ও তোমাদের পশু অন্যদিন পানি পান করবে। তার পালার দিন তোমরা কেউ কুপে পানি নিতে আসবেনা এবং তোমাদের পশুকেও পানি পান করাতে আসবেনা।

ঈমানদারদের পরীক্ষার কতিপয় উদাহরণ

হযরত খুবাইব

হযরত খুবাইব রা এর হস্তদ্বয় পিঠমোড়া করে বেঁধে মক্কার নারী পুরুষেরা তাঁকে ধাক্বা দিতে দিতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যেতে রাগলো। আর জনতা করতালি দিয়ে এ হত্যাকান্ড যেন উতসবে পরিণত করেছে। তাদের নির্মম নির্যাতনে তিনি ব্যাকুল হনননি। ফাঁসির মঞ্চে বসার আগে বললেন

ان شئتم ان تتركوني اركع ركعتين قبل مصرعي فافعلوا

তিনি এরপর খুব স্বল্প সময়ে নামাজ অদায় করলেন। আর বললেন

والله لولا ان تظنوا اني اطلت الصلاة جزعا من الموت لااستكثرت الصلاة

তাঁর জীবিত অবস্থায় তাঁর সমস্ত অংগ প্রত্যংগগুলো একের পর এক বিচ্ছিন্ন করতে থাকে আর বলে, তুমি কি চাও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদকে হত্যা করি? রাসুল প্রেমিক খুবাইব এই করূন অবস্থায় উত্তর দিলেন, আল্লাহর শপথ আমি মুক্তি পেয়ে আমার পরিবার পরিজনের নিকট ফিরে যাব আর মুহাম্মদ (দ) এর গায়ে কাঁটার আচড় লাগবে তা হতে পারেনা। সাথে সাথে তারা চীতকার করে বলে উঠল তাকে হত্যা হত্যা কর। সাথে সাথে ফাঁসির কাষে।ট ঝুলন্ত খুবাইব উপরে হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়লো কাফেররা। তীর বর্ষা আর খঞ্জরের আঘাতে আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন।শাহাদাদাতের মুহুর্তে কালেমা শাহাদাত পড়ছিলেন আর বলছিলেন হে আল্লাহ এদের শক্তি ও প্রতিপত্তি ধ্বংস কর এবং কাউকে ক্ষমা করোনা। হযরত খুবাইব রা এর মৃত্যুর এই দৃশ্য দেখে আাঁর তার বদদোয়া শুনে ভয়ে অস্থির হয়ে হযরত সায়ীদ বিন আমের আল জুমাহী ইসলাম গ্রহন করেন।

হযরত মুসআবের শাহাদাত : হযরত মুসআব ইসলাম গ্রহন করার পর তাঁর উপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখা হয়। একদিন বন্দী জীবনের শৃংখল ভেংগে আবিসিনায় চলে যান। সেখান থেকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন একটি পোশাক পরিধান করে মদীনায় আসেন। হযরত মুসআবের এই দুরবস্থা দেখে আল্লাহর রাসুল (সা) এর চোখ অশ্রু সিক্ত হয়। কেননা মুসআব খুবই আরাম আয়েশের জীবন যাপন করতো। শুধুমাত্র ইসলাম গ্রহন করার কারণে তার এই দুরবস্থা। মুসআব মদীনায় আসার পর ওহুদ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। উক্ত যুদ্ধে মুসআবের হাতে ছিল ইসলামের পতাকা। যুদ্ধের ময়দানে শত্র“র প্রচন্ড আঘাতে মুসআবের ডান হাত কেটে যায়। এরপর তিনি বাম হাত দিয়ে ইসলামের পতাকা উড্ডীন রাখেন। একটু পরে বাম হাতও কাটা যায়। দুহাত কাটা যাওয়ার পর দুই হাতের অবশিষ্টাংশ দিয়ে ইসলামের পতাকা বুকে ধরে রাখলেন। যতক্ষণ প্রাণ ছিলো ইসলামের পতাকা মাটিতে পড়তে দেন নাই। অবশেষে শত্র“ পক্ষের তীরের আঘাতে তিনি শহীদ হন।

হযরত ইউনুছ (আ)

وَذَا النُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَاضِبًا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقْدِرَ عَلَيْهِ فَنَادَى فِي الظُّلُمَاتِ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ، فَاسْتَجَبْنَا لَهُ وَنَجَّيْنَاهُ مِنَ الْغَمِّ وَكَذَلِكَ نُنجِي الْمُؤْمِنِينَ

আমি মাছওয়ালাকেও ঐ নিয়ামত দিয়েছি। যখন তিনি রাগ করে চলে গেলেন এবং মনে করেছিলেন যে, আমি এর কারণে তাকে দোষী সাব্যস্ত করবো না, তখন শেষ পর্যন্ত (মাছের পেটে থাকা অবস্থায়) অন্ধকার থেকে আমাকে ডাকলেন, “তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, তোমার সত্তা পবিত্র, নিশ্চয়ই আমি যালিমদের মধ্যে শামিল ছিলাম। তখন আমি তাঁর দোয়া কবুল করলাম এবং দুশ্চিন্তা থেকে তাঁকে নাজাত দিলাম। আর এ রকমভাবেই আমি মুমিনদেরকে নাজাত দিয়ে থাকি- (আম্বিয়া ঃ৮৭-৮৮)।

অসুস্থতা

হযরত আইউব (আ)কে শারীরিক অসুস্থতা দিয়ে পরীক্ষা করা হয়।

وَأَيُّوبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّي مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ، فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِن ضُرٍّ وَآتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُم مَّعَهُمْ رَحْمَةً مِّنْ عِندِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِينَ

(এই একই হুকুম ও ইলমের নিয়ামত) আমি আইউবকে দিয়েছিলাম। যখন তিনি তাঁর রবকে ডেকে বললেন, “আমাকে তো রোগে আক্রমণ করেছে, আর তুমি তো সবচেয়ে বড় মেহেরবান।আমি তাঁর দোয়া কবুল করলাম। রোগের কারণে যে কষ্ট ছিলো তা দূর করে দিলাম এবং তাঁকে তাঁর পরিবার পরিজন তো দিলামই, আমার খাস রহমত থেকে তার পরিবারের সমান সংখ্যায় আরও দিলাম, যাতে ইবাদতকারীদের জন্য এটা একটা শিক্ষা হয়ে থাকে-(আম্বিয়া ঃ৮৩-৮৪)।

বিদ্রুপ ও উপহাস করা

প্রায় সকল নবী-রাসুলকেই বিদ্রুপ করতো; হেয় প্রতিপন্ন করা হতো

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ فِي شِيَعِ الأَوَّلِينَ- وَمَا يَأْتِيهِم مِّن رَّسُولٍ إِلاَّ كَانُواْ بِهِ يَسْتَهْزِؤُونَ

হে নবী! আপনার আগে গত হওয়া নেক কাওমের নিকট আমি রাসুল পাঠিয়েছি। এমন কখনো হয়নি যে, তাদের কাছে রাসুল আসলেন, আর তারা তাঁকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করেনি-(হিজরঃ১০-১১)।

দুর্বব্যবহার এবং পাথর মেরে হত্যার হুমকি

হযরত নুহ (আ) এর কাওম ছিল পথভ্রষ্ট। অথচ তারা হযরত নুহকে পথভ্রষ্ট মানুষ হিসাবে মনে করত।

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُواْ اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّيَ أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ- قَالَ الْمَلأُ مِن قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ- قَالَ يَا قَوْمِ لَيْسَ بِي ضَلاَلَةٌ وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِّن رَّبِّ الْعَالَمِينَ-

আমি নূহকে তার কাওমের নিকট পাঠালাম। তিনি বলেন ঃ হে আমার দেশবাসী! আল্লাহর দাসত্ব করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। আমি তোমাদের জন্য এক ভীষণ দিনের আযাবের ভয় করি।কাওমের সরদাররা জওয়াব দিলো ঃ আমরা তো দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি স্পষ্ট গোমাহীর মধ্যে পড়ে আছো।নূহ (আ)বললেন ঃ হে আমার কাওম! আমি কোন গোমরাহীতে পড়িনি; বরং আমি রাব্বুল আলামীনের রাসূল। -(সুরা আল আরাফঃ৫৯-৬১)।

 

قَالُوا لَئِن لَّمْ تَنتَهِ يَا نُوحُ لَتَكُونَنَّ مِنَ الْمَرْجُومِينَ- قَالَ رَبِّ إِنَّ قَوْمِي كَذَّبُونِ- فَافْتَحْ بَيْنِي وَبَيْنَهُمْ فَتْحًا وَنَجِّنِي وَمَن مَّعِي مِنَ الْمُؤْمِنِينَ- فَأَنجَيْنَاهُ وَمَن مَّعَهُ فِي الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ- ثُمَّ أَغْرَقْنَا بَعْدُ الْبَاقِينَ- إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُم مُّؤْمِنِينَ- وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ-

তারা বললো, হে নূহ! তুমি যদি বিরত না হও তাহলে তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দেওয়া হবে। নূহ দোয়া করলেন, “হে আমার রব! আমার কাওম আমাকে মিথ্যা মনে করছে। কাজেই এখন আমার ও তাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথে যেসব মুমিন আছে তাদেরকে নাজাত দাও। অবশেষে আমি তাঁকে ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে একটি জাহাজে তুলে বাঁচিয়ে দিলাম। এরপর বাকি লোকদেরকে ডুবিয়ে দিলাম। নিশ্চয়ই এর মধ্যে এক নিদর্শন রয়েছে। আর তাদের বেশির ভাগ লোকই মুমিন ছিলো না। নিশ্চয়ই আপনার রব মহাশক্তিশালী ও দয়াবান-(সুরা শোয়ারা ঃ১১৬-১২২)

ফেরাউক কর্তৃক মুসাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং হত্যার পরিকল্পনা সূরা গাফের ঃ ২৩-৩৩

৩:১৪৩ وَ لَقَدۡ کُنۡتُمۡ تَمَنَّوۡنَ الۡمَوۡتَ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ تَلۡقَوۡہُ ۪ فَقَدۡ رَاَیۡتُمُوۡہُ وَ اَنۡتُمۡ تَنۡظُرُوۡنَ

১৪৩. মৃত্যুর সম্মুখীন হওয়ার আগে তোমরা তো তা কামনা করতে, এখনতো তোমরা তা স্বচক্ষে দেখলে।

এখানে সেই সাহাবীদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, যাঁরা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে না পারার কারণে নিজেদের হৃদয়ে এক প্রকার বঞ্চনা-ব্যথা অনুভব করতেন এবং চাইতেন যে, আবারও যুদ্ধের ময়দান উত্তপ্ত হলে তাঁরাও কাফেরদের শিরচ্ছেদ করে জিহাদের ফযীলত অর্জন করবেন। আর এই সাহাবীরাই উহুদের দিন জিহাদের উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন মুসলিমদের বিজয় কাফেরদের অভাবিত আক্রমণের ফলে পরাজয়ে পরিবর্তন হয়ে গেল (যার বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে হয়েছে), তখন জিহাদের উদ্দীপনায় ভরপুর যাঁদের অন্তর এমন মুজাহিদরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন এবং অনেকে তো পলায়নও করেন। (পরে এর আলোচনা আসবে) অতঃপর অল্প সংখ্যক লোক দৃঢ়তার সাথে ময়দানে টিঁকে থাকেন। (ফাতহুল ক্বাদীর)

এই জন্যই হাদীসে এসেছে যে, ‘‘তোমরা শত্রুর মুখোমুখী হওয়ার আশা করো না এবং আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা কর। তবে যদি শত্রুর সাথে মুখোমুখী হওয়ার পরিস্থিতি আপনা আপনিই এসে যায় এবং তোমাদেরকে তাদের সাথে লড়তে হয়, তাহলে তখন (ময়দানে) সুদৃঢ় ও অনড় থাকো। জেনে রাখো! জান্নাত হল তরবারির ছায়ার তলে।’’ (বুখারী-মুসলিম)

رَأَيْتُمُوهُ  এবং تَنْظُرُوْنَ উভয়ের অর্থ একই। অর্থাৎ, দেখা। সুনিশ্চয়তা ও আধিক্য বুঝানোর জন্য উভয় শব্দ ব্যবহূত হয়েছে। অর্থাৎ, তরবারির চমকে, বর্শা-বল্লমের তীক্ষ্ণতায়, তীরের আঘাতে এবং বীরদের সারিবদ্ধতায় তোমরা মৃত্যুকে খুব ভালোভাবে দর্শন করেছ। (ইবনে কাসীর, ফাতহুল ক্বাদীর)

বিপদ মুসীবতে করণীয়

 

  • আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা: আল্লাহ আমাদের জন্য যেই ফায়সালা করেন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

قُل لَّن يُصِيبَنَا إِلاَّ مَا كَتَبَ اللّهُ لَنَا هُوَ مَوْلاَنَا وَعَلَى اللّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ

হে রাসূল! ওদেরকে বলুনঃ “আআল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া কখনো কোন (ভালো বা মন্দ) কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছে না। তিনিই আমাদের মনিব। মু’মিনদেরকে আল্লাহরই উপর ভরসা করা উচিত. তাওবাহ-৫১ ।

  • আল্লাহর দরবারে ধরনা দেয়া: নাহল ঃ ৫৩

আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল :

َمَا لَنَا أَلاَّ نَتَوَكَّلَ عَلَى اللّهِ وَقَدْ هَدَانَا سُبُلَنَا وَلَنَصْبِرَنَّ عَلَى مَا آذَيْتُمُونَا وَعَلَى اللّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُتَوَكِّلُونَ আমরা কেন আল্লাহর উপর ভরসা করবো না, অথচ তিনিই আমাদের জীবনে চলার পথ দেখিয়েছেন? তোমরা আমাদেরকে যে কষ্ট দিচ্ছো এতে আমরা সবর করবো। আর ভরসাকারীদের শুধু আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত। ইবরাহীমঃ১২ ।

  • পরস্পর বিবাদে লিপ্ত না হওয়া এবং আভ্যন্তরীণ শৃংখলা নষ্ট না করা।

হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কোন বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন সুদৃঢ় থাক এবং আল্লাহকে  অধিক পরিমাণে স্মরন কর যাতে তোমরা উদ্দেশ্যে কৃতকার্য হতে পার।আর আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ মান্য কর এবং তাঁর রসূলের। তাছাড়া তোমরা পর¯পরে বিবাদে লিপ্ত হইও না। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা রয়েছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। আর তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা বেরিয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোকদেরকে দেখাবার উদ্দেশে। আর আল্লাহর পথে তারা বাধা দান করত। বস্তুত: আল্লাহ্র আয়ত্বে রয়েছে সে সমস্ত বিষয় যা তারা করে।

  • আল্লাহ পাকই মাযলুমের সাহায্যকারী : আমাদেরকে হাওয়ারীর ভুমিকা পালন করতে হবে

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ رُسُلًا إِلَى قَوْمِهِمْ فَجَاؤُوهُم بِالْبَيِّنَاتِ فَانتَقَمْنَا مِنَ الَّذِينَ أَجْرَمُوا وَكَانَ حَقًّا عَلَيْنَا نَصْرُ الْمُؤْمِنِينَ

(হে নবী!) আপনার আগে আমি রাসূলগণকে তাদের কাওমের নিকট পাঠিয়েছি এবং তারা তাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছেন। তারপর যারা আপরাধ করেছে তাদের থেকে আমি প্রতিশোধ নিয়েছি। আর আমার উপর মুমিনদের এ অধিকার ছিলো যে, আমি তাদেরকে সাহায্য করি (রুম ঃ ৪৭)।

– يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا كُونوا أَنصَارَ اللَّهِ كَمَا قَالَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ لِلْحَوَارِيِّينَ مَنْ أَنصَارِي إِلَى اللَّهِ قَالَ الْحَوَارِيُّونَ نَحْنُ أَنصَارُ اللَّهِ فَآَمَنَت طَّائِفَةٌ مِّن بَنِي إِسْرَائِيلَ وَكَفَرَت طَّائِفَةٌ فَأَيَّدْنَا الَّذِينَ آَمَنُوا عَلَى عَدُوِّهِمْ فَأَصْبَحُوا ظَاهِرِينَ

হে ঐসব লোক, যারা ঈমান এনেছো! আল্ল¬াহর সাহায্যকারী হও। যেমন ঈসা ইবনে মারইয়াম তার সাথীদেরকে ডেকে বলেছিলেন, “আল্লাহর দিকে (ডাকবার) কাজে আমার সাহায্যকারী কে আছো? হাওয়ারীগণ জওয়াব দিয়েছিলো, “আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী।” তখন বনী ইসরাঈলের একটি দল ঈমান আনলো, আর একটিদল কুফরী করলো। তারপর যারা ঈমান আনলো আমি তাদের দুশমনদের বিরুদ্ধে তাদেরকে শক্তিশালী করলাম এবং তারাই বিজয়ী হয়ে রইলো-(সূরা সফ ১২-১৪)।

  • উগ্রতা প্রদর্শন কিংবা বাড়াবাড়ি না করা: বাক্বারা ঃ ১৯৪
  • মন্দের জবাব উত্তমভাবে দেয়া: ফুসসিলাত ঃ ৩৪-৩৬
  • আত্মপর্যালোচনা ও আত্মসংশোধন করা ঃ আনফাল ১-৬
  • আর্থিক কুরবানী পেশ করা:

যারা সব অবস্থায়ই নিজেদের মাল খরচ করে-খারাপ অবস্থাই থাকুক আর মন্দ অবস্থায় থাকুক; যারা রাগকে দমন করে এবং অপরের দোষ মাফ করে দেয়; এমন নেক লোক আল্ল¬াহ খুব পছন্দ করেন। আর যাদের অবস্থা এমন যে, যদি কখনো কোন অশ্ল¬ীল কাজ তাদের দ্বারা হয়ে যায় অথবা কোন গুনাহ করে নিজেদের উপর যুলুম করে বসে, তাহলে সাথে সাথেই আল্লাহর কথা তাদের মনে হয় এবং তাঁর কাছে তারা নিজেদের গুনাহ মাফ চায়। কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে, যে গুনাহ মাফ করতে পারে? এসব লোক যেটুকু (গুনাহের) কাজ করে ফেলেছে তা জেনেবুঝে আর করতে থাকে না-(আল ইমরান ১৩৪-১৩৫)।

  • আদর্শের বিজয়ের ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয় থাকতে হবে-সূরা মুযাদালাহ ২১-২২
  • সর্বাবস্থায় সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে চলতে হবে আনআম ঃ১৫৩-১৫৪
  • কোন অবস্থাতেই হতাশ কিংবা মনোবল হারানো যাবেনা

وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ আলেইমরান ১৩৯

  • আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। আল হাজ্জ-৭৮
  • কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে-

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন হুযাফা : যুদ্ববন্দী থাকা অবস্থায় রোম সম্রাট বললেন তোমাকে মুক্তি দেব যদি খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহন কর। তোমাকে ক্ষমতার অংশীদার বানাবো যদি আহবানে সাড়াদাও। তার জবাবে তিনি বললেন, ان الموت لاحب الي الف مرة مما تدعوني اليه

সমগ্র রোম সাম্রাজের ক্ষমতা ও সমূদয় সম্পদ দিলেও আমি অমার আদর্শ ত্যাগ করবোনা। এটা দেখে সম্রাট ক্রোাধে তাকে জ্বলন্ত ডেকচিতে নিক্ষেপ করতে বললো। যখন জল্লাদরা নিয়ে যাচ্ছিল তাঁর চোখে অশ্রুফোটা আসলো। তা দেখে জল্লাদরা দৌড়ে সম্রাটকে জানালে এবং বললো মনে হয় ভয়ে কেঁদে ফেলেছে। সম্রাট মনে করলো এবার কাজ হবে। তাঁকে সম্রাটের নিকট ফিরে নিয়ে যাওয়া হলো। সম্রাট অবারও ইসলাম ত্যাগের আহবান জানালো এবং তিনি দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করলেন।

তখন সম্রাট বললো ধিক্কার তোমার প্রতি তুমি মৃত্যুকে ভয় না পেলে কাঁদলে কেন? তিনি জবাব দিলেন আমি ভেবেছিলাম তোমার অনেকগুলো ডেকচি উত্তপ্ত করবে এবং আমাকে আরও নির্মমভাবে হত্যা করবে আর আমি শাহাদাতের সর্বোচ্চ মার্যাদা লাভ করবো। আমি কেঁদেছি এই ভেবে যে, আমি আমার কাংখিত মার্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি কিনা? সম্রাট এতে খুবই অবাক হলেন। এরপর বললেন তুমি যদি আমার মাথায় একটি চুম্বন দাও আমি তোমাকে ছেড়ে দিব। এপ্রস্তাবে তিনি বললেন তুমি যদিসমস্ত যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দাও তাহলে এ প্রস্তাব আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি। তখন অব্দুল্লাহ ইবন হুযাফা ভাবলেন একটি চুম্বন দিয়ে সকল মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করতে পারলে তাহলে চুম্বন দিতে লজ্জা কিসের। সকল বন্দী মুক্তি পেল। হযরত উমর এটা শোনার পর বললো সকল মুসলমানের উচিত অব্দুল্লাহর কাপালে চুম্বন দেয়া আর আমিই প্রথম তার কপালে চুম্বন দিচ্ছি।

যোগ্য ও ত্যাগী অল্প সংখ্য কর্মী বাহিণীই বিশ্বের চেহারা পাল্টে দিতে পরে। বদর যুদ্ধে মাত্র ৩১৩ জন সাহাবা ত্যাগের মহিম্ায় উজ্জীবিত ছিলেন বলেই আল্লাহর সাহায্যে বিজয় লাভ করেন; তাঁরা ত্যাগ ও কুরবানীর নজরানা স্থাপন করেছেন বলেই ফেরেশতা পাঠিয়ে আল্লাহ সাহায্য করেছেন। আল্লাহ শুধু ফেরেশতা পাঠিয়ে বা আবাবিল পাখি দিয়ে কিংবা কুন ফায়াকুন বলে সব কিছু করতে পারেন। কিন্তু তা আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুন্যের ফিতরাত নয়। ভিশন বাস্তবায়ন করার জন্য কর্মী বাহিনীর ত্যাগ ও কুরবানীর নজরানা প্রয়োজন। ভিশন হচ্ছে দূরদৃষ্টি-

আল্লাহর রাসুল (সা) ভিশনারী ও কৌশলী ছিলেন।

হোদাইবিয়ার সন্ধিকালে অপরপক্ষের দাবীর মুখে সাহাবারা যখন অনড় ছিলেন তখন নিজ হাতে ’ রাসুলুল্লাহ’’ শব্দটি মুছে দিয়ে সন্ধিচুক্তি করেন। এরফলে দেখা যায় হোদাইবিয়ার সন্ধির সময় মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০০। আর মক্কা বিজয়ের সময় ছিল প্রায় দশ হাজার। কিন্তু বিদায় হজ্জের সময় ছিল লক্ষাধিক। তাই হুদাইবিয়ার সন্ধিকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে ফাতহুম মুবীন বলা হয়।

এই ক্ষেত্রে হিকমাত প্রয়োজনের আলোকে করতে হয়। চলমান কোন কৌশল ফলপ্রসু না হলে নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় আমরা ট্রেডিশনাল কাজে এত বেশী অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে ডাইনামিক কোন পরিবর্তন সহজে গ্রহন করতে পারিনা। খন্দক যুদ্ধে মদীনায় পরিখা খনন করার সময় পাথর খন্ডে আঘাত করলে আলোর রশ্মি যখন ছড়িয়ে পড়ে তখন সাহাবাদেরকে রোম ও পারস বিজয়ের সুসংবাদ দেন। তা শুনে মুনাফিকরা হাসি-কৌতুক করে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তা বাস্তবায়ন হয়।

  • সংকটকালে ত্যাগের নজরানা স্থাপন করতে হবে সূরা হাদীদ ১০-১১। এই প্রসংগে আল্ল¬াহ বলেন:

আল্লাহর পথে খরচের ব্যাপারে তোমাদের আপত্তির কি কারণ থাকতে পারে? অথচ আসমান ও জমিনের সবকিছুর মালিকানা আল্লাহর। তোমাদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহর পথে লড়াইয়ে অংশ গ্রহন করেছে এবং খরচ করেছে বিজয়ের আগে ; বিজয়ের পর খরচকারী এবং লড়াইয়ে অংশগ্রহনকারিগণ তাদের সমান হতে পারেনা। পরবর্তীদের চেয়ে পূর্ববর্তীগনের মর্যাদা অনেক বড়। অবশ্য আল্ল-াহ সবার জন্য উত্তম পুরুষ্কারের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ অবশ্যই তোমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল আছেন। আল্লাহকে উত্তম করজ দেবার মত কেউ আছে কি? যদি কেউ এভাবে করজ দিতে এগিয়ে আসে তাহলে আল্লাহই তাকে অনেক গুণ বেশী প্রতিদান দেবেন। তার জন্যে রয়েছে আরও সন্মানজনক প্রতিদান- সূরা হাদীদ ১০-১১।

  • যার কাছে যা বেশী প্রিয় তাকে সেই বস্তু ত্যাগ করতে হবে -আলে ইমরান ৯২।
  • আল্লাহ যা দান করেছেন তা থেকেই আল্লাহর পথে ব্যয় করতে হবে

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে যা কিছু রিযিক দিয়েছেন তা তাঁর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যয় করা মুমীনের অন্যতম গুণ। আল্লাহ তায়ালা মুমীনের উক্ত গুনের কথা এইভাবে উল্লেখ করেন, ওয়া মিম্মা রাযাকনাহুম য়ুনফিক’ন। ইমাম কুরতুবীর মতে রিযিক হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত দান, চিন্তা শক্তি ও ইচ্ছা শক্তি।

তোমরা যারা ঈমান এনেছ, জেনে রেখে দাও। তোমাদেরকে আমি যা কিছু ধন-দৌলত দিয়েছি তার থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় কর ঐ দিন (কিয়ামত) আসার পূর্বে যেদিন না কোন বেচা-কেনা চলবে না দোস্তি মহব্বত আর না কোন সুপারিশ কোন কাজে আসবে। (বাকারাহঃ২৫৪)

-(ঈমানদারদের কাজ ত এই যে) তারা আল্লাহর সাথে সম্পাদিত চুক্তি পূরণ করে, তা সুদৃঢ় করার পর ভঙ্গ করেনা। আল্লাহ যে যে সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখার আদেশ করেন তা অক্ষুণ্ণ রাখে নিজেদের প্রভূকে ভয় করে এবং এ ভয়ও তারা করে যে কি জানি হয়তো মন্দভাবে এবং কঠোরতার সাথে তাদের হিসেব নেয়া হবে। তাদের চরিত্রের আর একটি দিক এই যে, একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ধৈর্যশীল হয়ে পড়ে, নামায কায়েম করে, আমি আল্লাহ তাদেরকে যা দিয়েছি তার থেকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে আল্লাহর পথে ব্যয় করে এবং ভালোর দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করে। আখিরাতের সুখের আবাসস্থল তাদেরই জন্য। (রা’দঃ২০-২২)

উপরের আয়াত দুটিতে একত্রে দশটি ঈমানের দাবী পেশ করা হয়েছে

  • আল্লাহর সাথে সম্পাদিত চুক্তি পূরণ করা।
  • চুক্তি ভঙ্গ না করা।
  • আল্লাহর আদিষ্ট ও বাঞ্ছিত সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখা।
  • আল্লাহকে ভয় করা।
  • আখিরাতে হিসেবের কঠোরতার ভয়করা।
  • আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের লক্ষ্য মনে করা।
  • ধৈর্যশীল হওয়া।
  • নামায কায়েম করা।
  • প্রকাশ্যে এবং গোপনে আল্লাহর দেয়া সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করা।
  • ভালোর দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করা।

প্রকৃত মু’মিনের জন্য আখিরাতের বাসস্থান কেমন হবে তাও এ প্রসঙ্গে বলে দেয়া হয়েছে।

তাফসিরে যাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন,আহসানুল বায়ান ও কিছু সংগৃহিত।