সুরা আলে ইমরানঃ১৩দশ রুকু( আয়াত ১২১-১২৯)

১৩দশ রুকু(১২১-১২৯)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

 

৩:১২১ وَ اِذۡ غَدَوۡتَ مِنۡ اَہۡلِکَ تُبَوِّیٴُ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ مَقَاعِدَ لِلۡقِتَالِ ؕ وَ اللّٰہُ سَمِیۡعٌ عَلِیۡمٌ

১২১. আর স্মরণ করুন, যখন আপনি আপনার পরিজনদের নিকট থেকে প্রত্যুষে বের হয়ে যুদ্ধের জন্য মুমিনগণকে ঘাঁটিতে বিন্যস্ত করছিলেন; আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

বেশীরভাগ মুফাসসেরদের মতানুযায়ী এটা হল উহুদ যুদ্ধের ঘটনা, যা ৬ই শাওয়াল হিজরী ৩য় সনে সংঘটিত হয়েছিল।

এখান থেকে চতুর্থ ভাষণ শুরু হচ্ছে। ওহোদ যুদ্ধের পর এটি নাযিল হয়। এখানে ওহোদ যুদ্ধের ওপর মন্তব্য করা হয়েছে। আগের ভাষণটি শেষ করার সময় বলা হয়েছিল, ‍‍“যদি তোমরা সবর করো এবং আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো, তাহলে তোমাদের বিরুদ্ধে তাদের কোন কৌশল কার্যকর হতে পারবেনা।” এখন যেহেতু ওহোদ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণই দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে সবরের অভাব ছিল এবং কোন কোন মুসলমানের এমন কিছু ভুলচুক হয়ে গিয়েছিল যা ছিল আল্লাহভীতি বিরোধী, তাই তাদের এই দুর্বলতা সম্পর্কে সতর্কবাণী সম্বলিত এ ভাষণটি উপরোক্ত ভাষণের শেষ বাক্যটির পরপরই তার সাথে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

এর সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট হল, হিজরী ২য় সনে বদরের যুদ্ধে কাফেররা শিক্ষামূলক পরাজয় বরণ করে, তাদের ৭০জন লোক মারা যায় এবং ৭০জন বন্দী হয়। আর এই পরাজয় ছিল তাদের জন্য বড়ই লাঞ্ছনাকর ও অপমানজনক। তাই তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অতীব শক্তিশালী এক প্রতিশোধমূলক যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে এবং এতে তাদের মহিলারাও শরীক হয়। এদিকে মুসলিমরা যখন জানতে পারলেন যে, তিন হাজার কাফের উহুদ পাহাড়ের নিকটে যুদ্ধের তাঁবু খাটিয়েছে, তখন নবী করীম (সাঃ) সাহাবাদের নিয়ে এ ব্যাপারে পরামর্শ করলেন যে, তাঁরা মদীনার ভিতরে থেকেই যুদ্ধ করবেন, না মদীনার বাইরে গিয়ে তাদের সাথে লড়বেন। কোন কোন সাহাবী ভিতর থেকেই যুদ্ধ করার পরামর্শ দিলেন এবং মুনাফিকদের সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইও এই মত প্রকাশ করেছিল। কিন্তু উদ্দীপনায় উদ্বুদ্ধ কিছু সাহাবী যাঁরা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি, তাঁরা মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করার কথা সমর্থন করলেন।

মহানবী (সাঃ) হুজরার ভিতরে গিয়ে যুদ্ধের পোশাক পরে বাইরে এলেন। তা দেখে দ্বিতীয় মত প্রকাশকারীগণ অনুতপ্ত হলেন। তাঁরা ভাবলেন, হয়তো আমরা নবী করীম (সাঃ)-এর ইচ্ছার বিপরীত তাঁকে মদীনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে সঠিক কাজ করিনি। তাই তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রসূল! যদি আপনি শহরের ভিতরে থেকে মোকাবেলা করা পছন্দ করে থাকেন, তবে তা-ই করুন! তিনি বললেন, যুদ্ধের পোশাক পরে নেওয়ার পর কোন নবীর জন্য শোভনীয় নয় যে, তিনি আল্লাহর ফয়সালা ব্যতিরেকে ফিরে যাবেন অথবা পোশাক খুলে ফেলবেন। সুতরাং এক হাজার মুসলিম যোদ্ধা যুদ্ধের জন্য রওনা হয়ে গেলেন।

অতি সকালে যখন তাঁরা ‘শাউত্ব’ নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এই বলে তার ৩ শ’ জন সাথীকে নিয়ে ফিরে গেল যে, তার মত গ্রহণ করা হয়নি। সুতরাং অকারণে জান দিয়ে লাভ কি? তার এই ফায়সালায় সাময়িকভাবে কোন কোন মুসলিম প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের অন্তর দুর্বল হয়ে পড়েছিল। (ইবনের কাষীর)

কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয়ী সাহাবীগণের প্রচেষ্টায় তাদের মানসিক অস্থিরতা ও হতাশা দূর হয়ে যায়। এই অবশিষ্ট সাত’শো সৈন্য নিয়ে নবী ﷺ সামনের দিকে এগিয়ে যান এবং ওহোদ পর্বতের পাদদেশে (মদীনা থেকে প্রায় চার মাইল দূরে) নিজের সেনাবাহিনীকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যার ফলে পাহাড় থাকে তাদের পেছন দিকে এবং সামনের দিকে থাকে কুরাইশ সেনাদল।

একপাশে এমন একটি গিরিপথ ছিল, যেখান থেকে আকস্মিক হামলা হবার আশঙ্কা ছিল। সেখানে তিনি আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরের নেতৃত্বে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী মোতায়েন করেন। তাদেরকে জোর তাগীদ দিয়ে জানিয়ে দেনঃ “কাউকে আমাদের ধারে কাছে ঘেষঁতে দেবে না। কোন অবস্থায় এখান থেকে সরে যাবে না। যদি তোমরা দেখো, পাখিরা আমাদের গোশত ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে, তাহলেও তোমরা নিজেদের জায়গা থেকে সরে যাবে না।” অতঃপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। প্রথম দিকে মুসলমানদের পাল্লা ভারী থাকে। এমনকি মুশরিকদের সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তারা বিচ্ছিন্ন –বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু এই প্রাথমিক সাফল্যকে পূর্ণ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছিয়ে দেবার পরিবর্তে গনীমতের মাল আহরণ করার লোভ মুসলমানদের বশীভূত করে ফেলে। তারা শত্রু সেনাদের ধন-সম্পদ লুট করতে শুরু করে।

 

ওদিকে যে তীরন্দাজদেরকে পেছন দিকের হেফাজতে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তারা যখন দেখতে পেলো শত্রুরা পালিয়ে যাচ্ছে এবং গনীমতের মাল লুট করা হচ্ছে তখন তারাও নিজেদের জায়গা ছেড়ে গনীমতের মালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কড়া নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বার বার বাঁধা দিতে থাকেন। কিন্তু মাত্র কয়েকজন ছাড়া কাউকে থামানো যায়নি।

কাফের সেনাদলের একটি বাহিনীর কমাণ্ডার খালেদ ইবনে অলীদ যথা সময়ে এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন। তিনি নিজের বাহিনী নিয়ে পাহাড়ের পেছন দিক থেকে এক পাক ঘুরে এসে গিরিপথে প্রবেশ করে আক্রমণ করে বসেন। আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাঁর মাত্র কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে এই আক্রমণ সামাল দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। গিরিপথের ব্যুহ ভেদ করে খালেদ তার সেনাদল দিয়ে অকস্মাৎ মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। খালেদের বাহিনীর এই আক্রমণ পলায়নপর কাফেরবাহিনীর মনে নতুন আশার সঞ্চার করে। তারাও পেছন ফিরে মুসলমানদের ওপর একযোগে আক্রমণ করে বসে। এভাবে মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা বদলে যায়।

হঠাৎ এই অপ্রত্যাশিত অবস্থার মুখোমুখি হয়ে মুসলমানরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তাদের একটি বড় অংশ বিক্ষিপ্ত হয়ে পলায়নমুখী হয়। তবুও কয়েক জন সাহসী সৈন্য তখনো যুদ্ধ ক্ষেত্রে বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। এমন সময় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, নবী ﷺ শহীদ হয়ে গেছেন। এ গুজবটি সাহাবায়ে কেরামের অবশিষ্ট বাহ্যিক জ্ঞানটুকুও বিলুপ্ত করে দেয়। এতক্ষণ যারা ময়দানে লড়ে যাচ্ছিলেন এবার তারাও হিম্মতহারা হয়ে বসে পড়েন। এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চারপাশে ছিলেন মাত্র দশ বারো জন উৎসর্গীত প্রাণ মুজাহিদ। তিনি নিজেও আহত ছিলেন। পরিপূর্ণ পরাজয়ে আর কিছুই বাকি ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে সাহাবীগণ জানতে পারলেন, নবী ﷺ জীবিত আছেন। কাজেই তারা সবদিক থেকে একে একে তাঁর চারদিকে সমবেত হতে থাকে। তারা তাঁকে নিরাপদে পর্বতের ওপরে নিয়ে যান। এ সময়ের এ বিষয়টি আজও দুর্ব্যেধ্য রয়ে গেছে এবং এ প্রশ্নটির জবাব আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি যে, কাফেররা তখন অগ্রবর্তী হয়ে ব্যাপকভাবে আক্রমণ না চালিয়ে কিসের তাড়নায় নিজেরাই মক্কায় ফিরে গিয়েছিল? মুসলমানরা এত বেশী বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাদের পক্ষে পুনর্বার এক জায়গায় একত্র হয়ে যথারীতি যুদ্ধ শুরু করা কঠিন ছিল। কাফেররা তাদের বিজয়কে পূর্ণতার প্রান্তসীমায় পৌঁছাতে উদ্যোগী হলে তাদের সাফল্য লাভ অসম্ভব ব্যাপার ছিল না। কিন্তু তারা নিজেরাই বা কেন ময়দান ছেড়ে চলে গিয়েছিল তা আজও অজানা রয়ে গেছে।

৩:১২২ اِذۡ ہَمَّتۡ طَّآئِفَتٰنِ مِنۡکُمۡ اَنۡ تَفۡشَلَا ۙ وَ اللّٰہُ وَلِیُّہُمَا ؕ وَ عَلَی اللّٰہِ فَلۡیَتَوَکَّلِ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ

১২২. যখন তোমাদের মধ্যে দু’দলের সাহস হারাবার উপক্রম হয়েছিল অথচ আল্লাহ উভয়ের অভিভাবক ছিলেন, আর আল্লাহর উপরই যেন মুমিনগণ নির্ভর করে।

অর্থাৎ তোমাদের দুটি দল ভীরুতা প্রকাশের সংকল্প করেছিল, অথচ আল্লাহ তাদের সহায় ছিলেন। এ দুই দল হলো আউস গোত্রের বনী হারেসা এবং খাযরাজ গোত্রের বনী সালমা। এরা উভয়ই আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দেখাদেখি দুর্বলতা প্রদর্শন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের মধ্যে দুর্বলতা ছিল না, বরং স্বদলের সংখ্যাল্পতা ও সাজ-সরঞ্জামের অভাব দেখেই তারা এ ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েছিল। তবে আয়াতের منكم বাক্যটি তাদের ঈমানের পূর্ণাঙ্গতারই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

এ গোত্রদ্বয়ের মধ্য থেকে জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ বলতেন, “এ আয়াত যদিও আমাদের বনু হারেসা ও বনু সালামাকে উদ্দেশ্য করে নাযিল হয়েছিল এবং আয়াতে আমাদের প্রতি কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু (وَاللَّهُ وَلِيُّهُمَا) ব্যাক্যাংশের সুসংবাদও আমাদের লক্ষ্য করেই উক্ত হয়েছে। এ কারণে এ আয়াত নাযিল না হওয়া আমাদের জন্য সুখকর ছিল না। [বুখারীঃ ৪০৫১, ৪৫৫৮, মুসলিমঃ ২৫০৫]

 

আয়াতের শেষে বলা হয়েছেঃ আল্লাহর উপর ভরসা করাই মুসলিমদের কর্তব্য। এতে পরিস্কার বলা হয়েছে যে, সংখ্যাধিক্য ও সাজ-সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার পর ভরসা একমাত্র আল্লাহ পাকের উপরই করা দরকার। সাজ-সরঞ্জামের অভাব দেখেই বনী-হারেসা ও বনী সালমার মনে দুর্বলতা ও ভীরুতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। আল্লাহর প্রতি ভরসা দ্বারা এর প্রতিকার করা হয়েছে। আল্লাহর প্রতি যথার্থ ভরসা ও আস্থাই এ জাতীয় কুমন্ত্রণার অমোঘ প্রতিকার। মূলত: তাওয়াক্কুল (আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসা) মানুষের প্রতি অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ।

ইয়াদ ইবন গানম আল-আশ’আরী বলেন, ইয়ারমূকের যুদ্ধে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু পরপর পাঁচজনকে আমীর বানিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, যুদ্ধ শুরু হলে একমাত্র আমীর হবে আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ।

যুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের ময়দান থেকে আমরা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লিখলাম; মৃত্যু আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। আমাদের জন্য সাহায্য পাঠান। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সেটার উত্তরে লিখলেন, সাহায্য চেয়ে পাঠানো পত্র আমার হস্তগত হয়েছে। আমি তোমাদেরকে এমন একজনের সন্ধান দেব যিনি সবচেয়ে বেশী সাহায্য করতে পারেন, যাঁর সেনাবাহিনী সদা প্রস্তুত, তিনি হচ্ছেন, আল্লাহ তা’আলা। সুতরাং তোমরা তার কাছেই সাহায্য চাও। কেননা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বদরের দিনে তোমাদের চেয়ে কম সংখ্যা ও অস্ত্র-সন্ত্র নিয়েও কাফেরদের উপর জয়লাভ করেছিলেন। অতএব, যখন আমার এ চিঠি আসবে তখন তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করবে, এ ব্যাপারে আর আমার সাথে যোগাযোগ করবে না। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর আমরা যুদ্ধ করলাম এবং যুদ্ধে জয়লাভ করলাম। [মুসনাদে আহমাদ ১/৪৯; সহীহ ইবন হিব্বান: ১১/৮৩-৮৪]

৩:১২৩ وَ لَقَدۡ نَصَرَکُمُ اللّٰہُ بِبَدۡرٍ وَّ اَنۡتُمۡ اَذِلَّۃٌ ۚ فَاتَّقُوا اللّٰہَ لَعَلَّکُمۡ تَشۡکُرُوۡنَ

১২৩. আর বদরের যুদ্ধে আল্লাহ অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন অথচ তোমরা হীনবল ছিলে। কাজেই তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পার।

এখানে ঐ যুদ্ধের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট করা হচ্ছে-যাতে মুসলিমরা পুরোপুরি তাওয়াক্কুলের পরিচয় দিয়েছিল এবং আল্লাহ তা’আলা তাদের সাফল্য দান করেছিলেন। অর্থাৎ স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তা’আলা বদরে তোমাদের সাহায্য করেছিলেন; অথচ তোমরা সংখ্যায় ছিলে অতি নগণ্য। আর সে যুদ্ধটি ছিল বদরের যুদ্ধ।

৩:১২৪ اِذۡ تَقُوۡلُ لِلۡمُؤۡمِنِیۡنَ اَلَنۡ یَّکۡفِیَکُمۡ اَنۡ یُّمِدَّکُمۡ رَبُّکُمۡ بِثَلٰثَۃِ اٰلٰفٍ مِّنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ مُنۡزَلِیۡنَ ﴿

১২৪. স্মরণ করুন, যখন আপনি মুমিনগণকে বলছিলেন, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের রব তিন হাজার ফিরিশতা নাযিল করে তোমাদেরকে সহযোগিতা করবেন?

এখানে স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠে যে, আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদের প্রভূত শক্তি দান করেছেন। একজন ফেরেশতা একাই গোটা জনপদ উল্টে দিতে পারেন। উদাহারণতঃ কওমে-লুতের বস্তি একা জিবরীল ‘আলাইহিস সালামই উল্টে দিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় এখানে ফেরেশতাদের বাহিনী প্রেরণ করার কি প্রয়োজন ছিল? এছাড়া ফেরেশতারা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণই করেছিল, তখন একটি কাফেরেরও প্রাণ নিয়ে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল না। এ সব প্রশ্নের উত্তর স্বয়ং আল্লাহ্ তাআলা দিয়েছেন। অর্থাৎ ফেরেশতা প্রেরণের উদ্দেশ্য তাদের দ্বারা যুদ্ধ জয় করানো ছিল না; বরং উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীকে সান্তনা প্রদান করা, তাদের মনোবল দৃঢ় করা এবং বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া।

এ ঘটনা সম্পর্কেই সূরা আল-আনফালের ১২ নং আয়াতে আরও স্পষ্ট করে ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, “তোমরা মুসলিমদের অন্তর স্থির রাখ- অস্থির হতে দিয়ো না। অন্তর স্থির রাখার বিভিন্ন পন্থা রয়েছে।

তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, কোন না কোন উপায়ে মুসলিমদের সামনে একথা ফুটিয়ে তোলা যে, আল্লাহর ফেরেশতারা তাদের সাহায্যার্থে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যেমন কখনো দৃষ্টির সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করে, কখনো আওয়াজ দিয়ে এবং কখনো অন্য কোন উপায়ে। বদরের রণক্ষেত্রে এসব উপায়ই ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন সাহাবী জিবরাঈলের আওয়াজ শুনেছেন যে, তিনি কাউকে ডাকছেন। কেউ কেউ কতক ফেরেশতাকে দেখেছেনও। কোন কোন সাহাবী কোন কোন কাফেরকে ফেরেশতাদের হাতে মরতেও দেখেছেন [ মুসলিম: ১৭৬৩]

উপরোক্ত ঘটনাবলী এ কথারই সাক্ষ্য বহন করে যে, কিছু কিছু কাজের মাধ্যমে ফেরেশতাগণ মুসলিমদের আশ্বস্ত করছিলেন যে, তারাও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছেন। প্রকৃতপক্ষে তাদের কাজ ছিল মুসলিমদের মনোবল অটুট রাখা এবং সান্ত্বনা দেয়া।

পুরো যুদ্ধটাই ফেরেশতাদের দ্বারা করানো উদ্দেশ্য ছিল না। এর আরও একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এই যে, এ জগতে জিহাদের দায়িত্ব মানুষের স্কন্ধে অর্পণ করা হয়েছে। সে কারণেই তারা সওয়াব, ফযীলত ও উচ্চমর্যাদা লাভ করে।

ফেরেশতা-বাহিনী দ্বারা দেশ জয় করা যদি আল্লাহ্‌র ইচ্ছা হত, তাহলে পৃথিবীতে কাফেরদের রাষ্ট্র দুরের কথা, তাদের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যেত না। এ বিশ্ব চরাচরে আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছা তা নয়। এখানে কুফর, ঈমান, ইবাদাত ও গোনাহ মিশ্রিতভাবেই চলতে থাকবে। এদের পরিস্কার পৃথকীকরনের জন্যে হাশরের দিন নির্ধারিত রয়েছে। [মাআরিফুল কুরআন]

৩:১২৫ بَلٰۤی ۙ اِنۡ تَصۡبِرُوۡا وَ تَتَّقُوۡا وَ یَاۡتُوۡکُمۡ مِّنۡ فَوۡرِہِمۡ ہٰذَا یُمۡدِدۡکُمۡ رَبُّکُمۡ بِخَمۡسَۃِ اٰلٰفٍ مِّنَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ مُسَوِّمِیۡنَ

১২৫. হ্যাঁ, নিশ্চয়, যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তারা দ্রুত গতিতে তোমাদের উপর আক্রমণ করে, তবে আল্লাহ্‌ পাঁচ হাজার চিহ্নিত ফিরিশতা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।

বদরের যুদ্ধে ফেরেশতা প্রেরণের ওয়াদা প্রসঙ্গে ফেরেশতাদের সংখ্যা বিভিন্ন সূরায় বিভিন্নরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

সূরা আল-আনফালের আয়াতে এক হাজার, সূরা আলে-ইমরানের আয়াতে প্রথমে তিন হাজার এবং পরে পাঁচ হাজার ফেরেশতা প্রেরণের ওয়াদা করা হয়েছে। এর রহস্য কি?

উত্তর এই যে, সূরা আল-আনফালে বলা হয়েছে, বদর যুদ্ধে মুসলিমগণ- যাদের সংখ্যা ছিল তিনশত তের জন আর শত্রু সংখ্যা এক হাজার- আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এতে এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করার ওয়াদা করা হয়। অর্থাৎ শক্র সংখ্যা যত, তত সংখ্যক ফেরেশতা প্রেরণ করা হবে। আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তোমরা স্বীয় রব এর সাহায্য প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের জবাব দেন যে, আমি এক হাজার অনুসরণকারী ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবো। এ আয়াতের পরও ফেরেশতা প্রেরণের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়েছে মুসলিমদের মনোবল অটুট রাখা এবং বিজয়ের সুসংবাদ প্রদান করা।

 

পরবর্তীতে সূরা আলে ইমরানের আলোচ্য আয়াতে তিন হাজার ফেরেশতার ওয়াদা করার কারণ সম্ভবতঃ এই যে, বদরের মুসলিমদের কাছে সংবাদ পৌছে যে, কুরয ইবনে জাবের মুহারেবী স্বীয় গোত্রের বাহিনী নিয়ে কুরাইশদের সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসছে। পূর্বেই শক্রদের সংখ্যা মুসলিমদের তিনগুণ বেশী ছিল। এ সংবাদে মুসলিমদের মধ্যে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিলে তিন হাজার ফেরেশতা প্রেরণের ওয়াদা করা হয়- যাতে শক্রদের চাইতে মুসলিমদের সংখ্যা তিনগুন বেশী হয়ে যায়। অতঃপর এ আয়াতের শেষ ভাগে কয়েকটি শর্ত যোগ করে এ সংখ্যাকে বৃদ্ধি করে পাঁচ হাজার করে দেয়া হয়েছে। শর্ত ছিল দুটিঃ

(এক) মুসলিমগণ ধৈর্য ও আল্লাহভীতির উচ্চস্তরে পৌছলে,

(দুই) শক্ররা আকস্মিক আক্রমন চালালে।

দ্বিতীয় শর্তটি অর্থাৎ আকস্মিক আক্রমণ বাস্তবে ঘটেনি, তাই পাঁচ হাজারের ওয়াদা পূরণেরও প্রয়োজন হয়নি। আকস্মিক আক্রমন না হওয়া সত্বেও আল্লাহর ওয়াদা পাঁচ হাজারের আকারে পূর্ণ করা হয়েছে, না তিন হাজারের আকারে সে সম্পর্কে তাফসীর ও ইতিহাসবিদগণের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত হয়েছে। [তাফসীরে ফাতহুল কাদীর]

৩:১২৬ وَ مَا جَعَلَہُ اللّٰہُ اِلَّا بُشۡرٰی لَکُمۡ وَ لِتَطۡمَئِنَّ قُلُوۡبُکُمۡ بِہٖ ؕ وَ مَا النَّصۡرُ اِلَّا مِنۡ عِنۡدِ اللّٰہِ الۡعَزِیۡزِ الۡحَکِیۡمِ

১২৬. আর এটা তো আল্লাহ তোমাদের জন্য শুধু সুসংবাদ ও তোমাদের আত্মিক প্রশান্তির জন্য করেছেন। আর সাহায্য তো শুধু পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময় আল্লাহর কাছ থেকেই হয়।

৩:১২৭ لِیَقۡطَعَ طَرَفًا مِّنَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَوۡ یَکۡبِتَہُمۡ فَیَنۡقَلِبُوۡا خَآئِبِیۡنَ

১২৭. যাতে তিনি কাফেরদের এক অংশকে ধ্বংস করেন বা তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন; ফলে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যায়।

আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতে বলেন যে, তিনি তার বান্দাদেরকে সাহায্য করবেন দু’টি কারণের কোন একটি কারণে।

এক. তিনি হত্যা, বন্দী, গণীমত, শহর বিজয় ইত্যাদির মাধ্যমে কাফেরদের এক শক্তি ও ভিত্তি ভেঙে দেবেন; ফলে মুমিনরা শক্তিশালী হবে ও কাফেররা দুর্বল হবে। কারণ ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের মূল শক্তি হল সৈন্য, ধন-সম্পদ, অস্ত্র ও ভূ-সম্পত্তি। এসব কিছুর মধ্যে কোন কিছু যদি দুর্বল করে দেয়া যায়, তবে তাদের শক্তি কমে যাবে। দুই. কাফেররা মুসলিমদের উপর জয়ী হওয়ার জন্য আশা করবে এবং প্রচেষ্টা চালাবে, কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা মুসলিমদেরকে বিজয়ী করবেন ফলে তারা লাঞ্ছিত ও নিরাশ হয়ে ফিরে যাবে। মূলত আল্লাহ তা’আলার সাহায্য দুটির কোন একটি হয়ে থাকে; হয় তিনি মুসলিমদেরকে কাফেরদের উপর বিজয়ী করবেন, নতুবা কাফেরদেরকে লাঞ্ছিত করবেন। আয়াতে এ দুটি দিকই উল্লেখ করা হয়েছে। [তাফসীর সা’দী]

৩:১২৮ لَیۡسَ لَکَ مِنَ الۡاَمۡرِ شَیۡءٌ اَوۡ یَتُوۡبَ عَلَیۡہِمۡ اَوۡ یُعَذِّبَہُمۡ فَاِنَّہُمۡ ظٰلِمُوۡنَ

১২৮. তিনি তাদের তাওবা কবুল করবেন বা তাদেরকে শাস্তি দেবেন- এ বিষয়ে আপনার করণীয় কিছুই নেই; কারণ তারা তো যালেম।

এখান থেকে আবারো ওহুদের ঘটনায় প্রত্যাবর্তন করা হয়েছে। মাঝখানে সংক্ষেপে বদর যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। এ আয়াত অবতরনের কারণ এই যে, ওহুদ যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখস্থ উপর ও নীচের চারটি দাঁতের মধ্যে থেকে নীচের পাটির ডান দিকের একটি দাত পড়ে গিয়েছিল এবং মুখমণ্ডল আহত হয়ে পড়েছিল। এতে দুঃখিত হয়ে তিনি এ বাক্যটি উচ্চারণ করেছিলেনঃ “যারা নিজেদের নবীর সাথে এমন দুর্ব্যবহার করে, তারা কেমন করে সাফল্য অর্জন করবে? অথচ নবী তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করেন।” এরই প্রেক্ষিতে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। [বুখারী, মুসলিমঃ ১৭৯১]

এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধৈর্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকু থেকে উঠার পর কাফেরদের উপর বদ দোআ করতেন, কিন্তু এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর তিনি তা ত্যাগ করেন৷ [বুখারীঃ ৪৫৬০, ৪০৬৯, ৪০৭০ মুসলিমঃ ৬৭৫]

অনুরূপ অন্যান্য বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি (সাঃ) কাফেরদের উপর বদ্দুআ করার জন্য ক্বুনুতে নাযেলার যত্ন নিলে মহান আল্লাহ এই আয়াত অবতীর্ণ করেন। অতঃপর তিনি (সাঃ) বদ্দুআ করা বাদ দেন। (ইবনে কাসীর, ফাতহুল ক্বাদীর) এই আয়াত থেকে তাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত, যারা নবী করীম (সাঃ)-কে ইচ্ছাময় ক্ষমতার মালিক মনে করে। তাঁর তো এতটুকু এখতিয়ারও ছিল না যে, কাউকে সঠিক পথের পথিক করে দেন। অথচ তিনি (সাঃ) এই পথের দিকে আহবান করার জন্যই প্রেরিত হয়েছিলেন।

 

এই সেই গোত্র যাদের উপর রসূল (সাঃ) বদ্দুআ করেছিলেন তারা সকলেই আল্লাহর তাওফীকে মুসলমান হয়ে যায়। অতএব এ কথা পরিষ্কার যে, সমস্ত ক্ষমতার মালিক এবং অদৃশ্য জগতের (গায়বী) জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।

৩:১২৯ وَ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ یَغۡفِرُ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یُعَذِّبُ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰہُ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ

১২৯. আর আসমানে যা কিছু আছে ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই তিনি যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন এবং যাকে ইচ্ছে শাস্তি দেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

্তাফসীরে জাকারিয়া, তাফহিমুল কুর’আন, আহসানুল বয়ান