সুরা আলে ইমরানঃ১১ম রুকু(আয়াত ১০২-১০৯)

أَعُوذُ بِاللَّهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ.

بِسۡمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ

 

১১তম রুকু(১০২-১০৯)

৩:১০২ یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰہَ حَقَّ تُقٰتِہٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ

১০২. হে মুমিনগণ! তোমরা যথার্থভাবে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করএবং তোমরা মুসলিম (পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী) না হয়ে কোন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো না।

অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি অনুগ্রহ ও বিশ্বস্ত থাকো৷

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহর তাকওয়া অর্জনের হক্ক আদায় করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাকওয়ার ঐ স্তর অর্জন কর, যা তাকওয়ার হক। কিন্তু তাকওয়ার হক বা যথার্থ তাকওয়া কি? আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, রবী, কাতাদাহ ও হাসান রাহিমাহুমুল্লাহ বলেন, তাকওয়ার হক হল, প্রত্যেক কাজে আল্লাহর আনুগত্য করা, আনুগত্যের বিপরীতে কোন কাজ না করা, আল্লাহকে সর্বদা স্মরণে রাখা- কখনো বিস্মৃত না হওয়া এবং সর্বদা তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা- অকৃতজ্ঞ না হওয়া। [ইবন কাসীর]

পূর্ণ ইসলামই প্রকৃতপক্ষে তাকওয়া। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্ণ আনুগত্য করা এবং তার অবাধ্যতা থেকে বেঁচে থাকার নামই হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন। আয়াতের শেষে মুসলিম না হয়ে যেন কারও মৃত্যু না হয় সেটার উপর জোর দেয়া হয়েছে। দুনিয়াতে ঈমানদারের অবস্থান হবে আশা-নিরাশার মধ্যে। সে একদিকে আল্লাহর রহমতের কথা স্মরণ করে নাজাতের আশা করবে, অপরদিকে আল্লাহর শাস্তির কথা স্মরণ করে জাহান্নামে যাওয়ার ভয় করবে। কিন্তু মৃত্যুর সময় তাকে আল্লাহ সম্পর্কে সুধারণা নিয়েই মরতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন আল্লাহ সম্পর্কে সু ধারণা না নিয়ে মারা না যায়।” [মুসলিম: ২৮৭৭] অর্থাৎ মৃত্যুর সময় তার আশা থাকবে যে, নিশ্চয় আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন।

এখানে জানা থাকতে হবে মুসলিম কিভাবে হয় বা কোন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে তাকে মুসলিম বলা হবে।

মুসলিম (বা মুসলমান,আরবী: مسلم – অর্থ:আত্বসমর্পণ,অনুগত) হলো সেই লোক যে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর কাছে আত্বসমর্পণ করে৷…

অতএব যে নিজের ইচ্ছাকে আত্বসমর্পণ করে শান্তি অর্জন করেছে তাকে মুসলিম বলে। যেমন: স্মরণ কর ইব্রাহীমকে যখন তার পালনকর্তা বলেন আত্মসমর্পণ কর। সে বলল আমি বিশ্ব জগতের প্রতিপালকের নিকট আত্মসমর্পণ করলাম (সুরা বাকারা ১৩১)।

কোন ব্যক্তি যদি মুসলিম হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে তাকে সর্বপ্রথম সমস্ত সৃষ্ট  থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সমস্ত কিছুর স্রষ্টা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের দিকে মুখ ফিরাতে হবে। যেমন কুরানে আল্লাহ বলেন “আমি সমস্ত কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে তার দিকে মুখ ফিরালাম যিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই।” (সুরা আন আম ৭৯)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা মুসলমানের সংজ্ঞা এইভাবে দেন,

“বলুন আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও  মরন সব বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।” (সুরা আন আম ৬:১৬৩)

আর আল্লাহ বলেন আল্লাহ ছাড়া  কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই …সুরা ইউসুফ, আয়াত ৪০ এবং ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যাবস্থার নাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্‌ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” (সুরা মায়েদা, আয়াত ৩)

কারন আল্লাহ বলেন… যারা আল্লাহ্‌ ও শেষ দিবসে আসা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসলুলুল্লাহর জীবনে উত্তম আদর্শ রয়েছে (সুরা ৩৩:২১) যে ইসলাম ছাড়া  অন্যকোন জীবন ব্যবস্থা তালাশ করবে তা কখনো গ্রহণ করা হবেনা (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৮৫)।

আর এটাই হল কালেমায়ে ত্যাইয়েবা লা ইলাহা ইলাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সঃ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। তাই মুসলিম মাত্রই তার বেক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্র ও সংবিধান সবকিছুতে ইসলামকে একমাত্র আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবে অথবা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালাবে এবং ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সমস্ত কিছুকে প্রত্যাখ্যান করবে। এটি হল কালেমায়ে তায়িবার দাবী। শুধু বিশ্বাস করাই যথেষ্ট নয় নিষ্কলুষ বিশ্বাস নিয়ে আমরন থাকতে হবে।

আসুন আমরা সবাই বিশুদ্ধ ঈমান নিয়ে জীবন যাপন করি…কারন আল্লাহ বলেন ..” যারা ঈমান আনার পর ইমানকে জুলম অর্থাৎ শিরক দ্বারা কলুষিত করেনি তাদের জন্য শান্তি” (সুরা নিসা, আয়াত ৮৬)

>>>> পারিভাষিক অর্থে <<<<

যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে মহান প্রতিপালক হিসেবে গ্রহন করবে, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবেনা এবং রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে নিজের জীবন চালাবে, হালাল কে হালাল বলে মানবে এবং হারামকে বয়কট করবে, সালাত প্রতিষ্ঠা করবে, রোজা রাখবে, নিসাবের অধিকারী হলে যাকাত আদায় করবে এবং হজ্জে গমন করবে। এইসব গুনাবলীর অধিকারী হলে তাকে মুসলিম বলা হয়।

মহান আল্লাহ জানিয়েছেন—-

সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হল সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, 23:2

الَّذِينَ هُمْ فِي صَلَاتِهِمْ خَاشِعُونَ যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র;

وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ যারা অনর্থক কথা-বার্তায় নির্লিপ্ত, 23:4

وَالَّذِينَ هُمْ لِلزَّكَاةِ فَاعِلُونَ যারা যাকাত দান করে থাকে, 23:5

وَالَّذِينَ هُمْ لِفُرُوجِهِمْ حَافِظُونَ এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। 23:6

>>>> হাদীস থেকে ব্যখ্যা <<<<

আবদুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ জু’ফী (রাঃ)…আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেন ঈমানের শাখা রয়েছে ষাটের কিছু বেশী। আর লজ্জা ঈমানের একটি শাখা।। [সহীহ বুখারী ১ম খন্ড ঈমান অধ্যায় হাদীস নং ৮]।

প্রকৃত মুসলিম সে-ই যার হাত ও জিহবা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।। [সহীহ বুখারী হাদীস নং ৯]। এখানে হাত থেকে নিরাপদ বলতে কারো উপর আক্রমন করবেনা এবং জিহবা থেকে নিরাপদ বলতে কারো নামে কুৎসা গিবত মিথ্যা অপবাদ এবং অন্যায়ভাবে কারো সম্পদ ফল ফলাদি গ্রাস না করা বুঝানো হয়েছে।

মুহাম্মদ ইবনুন মুসান্না (রাঃ) … আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) থেকে বর্নিত, নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করেনঃ

তিনটি গুণ যার মধ্য থাকে সে ঈমানের স্বাদ পায়।

১. আল্লাহ ও তার রাসূল তার কাছে অন্য সব কিছু হতে প্রিয় হওয়া।

২. কাউকে খালিস আল্লাহর জন্যই মুহব্বত করা।

৩. কূফরীতে ফিরে যাওয়াকে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপসন্দ করা। সহীহ বুখারী হাদীস নং ১৫ ঈমান অধ্যায়।

আম্মার (রাঃ) বলেন, তিনটি গুণ যে আয়ত্ব করে, সে (পুর্ণ) ঈমান লাভ করে।

১. নিজ থেকে ইনসাফ করা। ২. বিশ্বে সালামের প্রচলন করা। ৩. অভাবগ্রস্হ অবস্হায়ও দান করা। সহীহ বুখারী হাদীস নং ২৬।

হাদীসটি পড়ে একটু চিন্তা করুনতো…’ আমরা কি আসলেই প্রকৃত মুসলিম হতে পেরেছি?…

না-কি জুম্মাবারে মসজিদে হাজিরা আর কুরবানীর গরুর মাংস খাওয়ার দাবীদার মুসলিম?..

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের কুরান বুঝার তৌফিক দান করুন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর নির্দেশিত পথে চলার তাওফিক দান করুন। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান পুরোপুরি মেনে চলার তাওফিক দান করুন আমীন।

: প্রকৃত মুসলিম কি ও কেন :: সূরা হাজ্জ্ব, ৭৮ নং আয়াত এবং সূরা হা-মীম-সিজদার ৩৩নং আয়াতের আলোকে মুসলিমের বিস্তারিত ব্যাখ্যা

সূরা হাজ্জের ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

) وَجَاهِدُوا فِي اللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِ هُوَ اجْتَبَاكُمْ وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِي الدِّينِ مِنْ حَرَجٍ مِلَّةَ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ هُوَ سَمَّاكُمُ الْمُسْلِمِينَ مِنْ قَبْلُ وَفِي هَذَا لِيَكُونَ الرَّسُولُ شَهِيدًا عَلَيْكُمْ وَتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَاعْتَصِمُوا بِاللَّهِ هُوَ مَوْلَاكُمْ فَنِعْمَ الْمَوْلَى وَنِعْمَ النَّصِيرُ (78)

“তোমরা আল্লাহর জন্য জিহাদ করো যেভাবে জিহাদ করা উচিত। তিনি তোমাদের মনোনীত করেছেন। তিনি তোমাদের ধর্মে তোমাদের জন্য কঠিন কোনো বিধান দেননি। এই দ্বীন তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের দ্বীনের অনুরূপ। আল্লাহ এর আগে তোমাদের নামকরণ করেছেন- ‘মুসলিম’ এবং এই কিতাবেও তা করেছেন; যাতে রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষী হয় এবং তোমরাও সাক্ষী হও মানব জাতির জন্য। সুতরাং তোমরা নামাজ কায়েম করো, যাকাত দাও এবং আল্লাহকে শক্তভাবে ধারণ করো। তিনিই তোমাদের অভিভাবক, কতো উত্তম অভিভাবক এবং কতো উত্তম সাহায্যকারী তিনি!” (২২:৭৮)

এটি সূরা হাজ্জের সর্বশেষ আয়াত। সূরা হাজ্জ এর ৭৭নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا ارْكَعُوا وَاسْجُدُوا وَاعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَافْعَلُوا الْخَيْرَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (77)

“হে মুমিনগণ! তোমরা রুকু কর,সেজদা কর, তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর এবং সৎকাজ সম্পাদন কর,যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।” (২২:৭৭)।

অতএব, সূরা হাজ্জ এর ৭৭নং আয়াতের সাথে মিল রেখে আল্লাহ এখানে মুমিন তথা আত্নসমর্পনকারী মুসলিমদের জন্য আরো কিছু নির্দেশনা তুলে ধরেছেন। আয়াতের প্রথমে আল্লাহ তার বান্দাদের উদ্দেশ করে বলেন: আল্লাহ তোমাদের সৃষ্টি করে তার রাসূলের মাধ্যমে তোমাদেরকে হেদায়েত করেছেন, তাই তার পথে চল, নিজেদের ঈমানকে শক্তিশালী করে তার দ্বীন প্রচারের চেষ্টা করো। তবে এখানে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আমলের মধ্য নিষ্ঠা থাকতে হবে ও কাজকর্ম হতে হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

এ আয়াতে জিহাদ শব্দটি কাফের ও কুপ্রবৃত্তি উভয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) একবার একটি যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে সাহাবীদের উদ্দেশ করে বলেন: আমরা জিহাদে আসগর বা ছোট জিহাদ থেকে জিহাদে আকবর বা বড় জেহাদে ফিরে এলাম। এ সময় সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করেন: বড় জেহাদ কি? তিনি বলেন: নফ্‌স বা কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জেহাদ।

এ আয়াতে আরো বলেন: আল্লাহ ইসলাম এবং আদিপিতা ইব্রাহিমের দ্বীনকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং এ দ্বীনে তোমাদের জন্য কঠিন কোনো দায়িত্ব নেই। যেসব দায়িত্ব ও কর্তব্য এতে আছে তা মানুষের সাধ্যের বাইরে নয়। যেমন নামাজ বাধ্যতামূলক হলেও একটি সহজ কর্তব্য। নামাজকে এতটাই সহজ করা হয়েছে যে, অসুস্থ ব্যক্তি শোয়া অবস্থায় সরাসরি রুকু-সেজদা না করে ইশারায় নামাজ আদায় করতে পারবে। এ ছাড়া, যারা অসুস্থ ও শারিরীকভাবে অক্ষম তাদেরকে ইসলাম রোজা রাখতে বাধ্য করা হয়নি। আর যাদের অর্থনৈতিক ও শারীরিক সামর্থ্য আছে শুধুমাত্র তাদের উপর হজ ওয়াজিব করা হয়েছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই এ ধর্ম আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম ধর্ম। এ ধর্মে আল্লাহর রাসূল মুমিনদের জন্য আদর্শ এবং প্রকৃত মুমিনরা গোটা মানবজাতির জন্য আদর্শ। এ মর্যাদা রক্ষা করতে হলে নির্দেশ অনুযায়ী নামাজ পড়তে ও জাকাত দিতে হবে এবং নিজেকে আল্লাহর খাঁটি বান্দায় পরিণত করতে হবে।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১. আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সব ধরনের অবহেলা ও অলসতা থেকে দূরে থাকতে হবে।

২. ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে এটিকে সহজ ও পালনযোগ্য করে তুলে ধরতে হবে, অপরকে ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা বা এক্ষেত্রে কঠোর হওয়া যাবে না।

৩. শুধুমাত্র মুখে ঈমান এনে নামমাত্র মুসলমান হলে চলবে না, কারণ, আমল ছাড়া ঈমানের কোন গুরুত্ব নেই।

হা-মীম-সেজদার ৩৩নং আয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা

পবিত্র কুরআনের সূরা হা-মীম-সিজদার ৩৩নং আয়াতটি বিশ্লেষন করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে ইনশাল্লাহ।নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ-

সূরা হা-মীম সাজদাহ – ৩৩নং আয়াতের আলোকে মুসলিম এর সঠিক ব্যাখ্যা

পবিত্র কুরআনে সূরা হা-মীম-সিজদায় মুসলিম সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা বলেছেনঃ-

وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ

‘‘তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার, যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহবান করে, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম (আমি একজন আজ্ঞাবহ)’’ (হা-মীম সাজদাহ – ৩৩)।”

হা-মীম-সিজদার ৩৩নং আয়াত অনুযায়ী মুসলিম এর ব্যাখ্যায় বলা যায় যে, কোনো ব্যাক্তির আল্লাহকে রব হিসাবে স্বীকার করে সোজা পথ তথা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে যে পথের কথা বলেছেন সেটাকেই বুঝানো হয়েছে তথা আত্মসমপর্ণকারী মুসলিমের কথাই বুঝানো হয়েছে এবং তারাই এ কাজ করে যারা একমাত্র কুরআন ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সহীহ সুন্নাহর অনুসারী। মুসলিম জাতির মত বা পথ একটিই, সেটা হলো সহজ, সরল, সোজা পথ। যে সোজা পথ সর্ম্পকে নাবী (ﷺ) বলেছেন–

حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا أَبُو خَالِدٍ الأَحْمَرُ، قَالَ سَمِعْتُ مُجَالِدًا، يَذْكُرُ عَنِ الشَّعْبِيِّ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَخَطَّ خَطًّا وَخَطَّ خَطَّيْنِ عَنْ يَمِينِهِ وَخَطَّ خَطَّيْنِ عَنْ يَسَارِهِ ثُمَّ وَضَعَ يَدَهُ فِي الْخَطِّ الأَوْسَطِ فَقَالَ ” هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ ” . ثُمَّ تَلاَ هَذِهِ الآيَةَ {وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ}

জাবির ইবনু আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিকট উপস্থিত থাকা অবস্থায় তিনি একটি সরল রেখা টানলেন এবং তাঁর ডান দিকে দুটি সরল রেখা টানলেন এবং বাম দিকেও দুটি সরল রেখা টানলেন। অতঃপর তিনি মধ্যবর্তী রেখার উপর তাঁর হাত রেখে বলেন: এটা আল্লাহ্র রাস্তা। অতঃপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেনঃ

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ

(অর্থাৎ- এই হচ্ছে আমার সরল-সঠিক পথ, সুতরাং তোমরা একে অনুসরণ করো এবং তোমরা অন্যান্য পথ অনুসরণ করো না, নতুবা তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে।) (সূরাহ আনআম ৬:১৫৪) তাখরীজ কুতুবুত সিত্তাহ: আহমাদ ১৪৮৫৩ তাহক্বীক্ব আলবানী: সহীহ। তাখরীজ আলবানী: যিলূলুল জান্নাহ ১৬। গ্রন্থঃ সুনানে ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ ১/ রাসুল (সাঃ)’র সুন্নাতের অনুসরণ, হাদীস নম্বরঃ ১১)

সোজা পথ সম্বন্ধে আরও বিস্তারিতভাবে বলা যায় যে, যারা আল্লাহর হাদীস ‘কুরআন’ ও রসূলের সহীহ হাদীসের একনিষ্ট অনুসারী তারাই হল আহলে হাদীস বা আহলুল হাদীস। আবার সুন্নাহর অপর নাম হাদীস তাই যারা আহলুস্সুন্নাহ তারাই আহলুল হাদীস এবং এরাই প্রকৃতপক্ষে আত্মসমপর্ণকারী মুসলিম।

আত্মসমর্পণকারী মুসলিমের সংজ্ঞা – পবিত্র কুরআনের আলোকে

(১) যারা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করে তারাই মুসলিম এবং যারাই কুরআন ও সহীহ হাদীস অনুসরন করে তারাই আহলে হাদীস তথা আত্মসমর্পণকারী মুসলিম যেহেতু তারাই রাসূল (সাঃ) ও তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী। তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা এ প্রসঙ্গে তাদের সম্বন্ধে পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ- (হে নবী) যদি তারা তোমার সাথে বিতর্ক করে, তবে তুমি বলে দাও, ‘আমি নিজেকে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করলাম এবং আমার অনুসারীরাও’ আর যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং নিরক্ষরদেরকে তুমি বলে দাও, ‘তোমরা কি আত্মসমর্পণ করেছ’? অতঃপর যদি তারা আত্মসমর্পণ করে, তাহলে অবশ্যই তারা হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে, আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তোমার দায়িত্ব শুধু (দাওয়াত) পৌঁছিয়ে দেয়া আর আল্লাহ বান্দাদের সম্পর্কে সম্যক দ্রষ্টা। আলে-ইমরান, ৩/২০

(২) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা পবিত্র কুরআনে আত্মসমর্পণকারী মুসলিম সম্বন্ধে আরও বলেছেন: “আর তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে? যে আল্লাহর দিকে আহবান করে আর সৎকর্ম করে এবং বলে, নিশ্চয় আমি আত্মসমর্পণকারীদের/অনুগতদের (মুসলিমদের) অর্ন্তভুক্ত। সূরা ফুসসিলাত, ৪১/৩৩।”

(২) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা পবিত্র কুরআনে আরও বলেছেন:-“তুমি বল, হে আহলে-কিতাব, তোমরা এমন বাণীর দিকে এস, যা আমাদের ও তোমাদের মাঝে সমান, তা এই যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করব না আর কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে রব হিসাবে গ্রহণ করব না অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয় তাহলে বল দাও, তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা (আল্লাহর নিকট) আত্মসমর্পণকারী/অনুগত (মুসলিম)। সূরা আলে-ইমরান, ৩/৬৪ ।”

সুতরাং, আলোচনায় বলা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে যারা রাসূল (সাঃ) ও তাঁর অনুসারী তারাই আল্লাহর নিকট আত্মসমপর্ণকারী মুসলিম তথা আহলে হাদীস বা আহলুল হাদীস।

মুসলিমের প্রকারভেদ

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনায় বলা যায় যে, মুসলিম দু’প্রকার।নিম্নে তা তুলে ধরা হলোঃ-

১. আত্মসমর্পণকারী এবং ২. সীমালংঘনকারী বা বিপদগামী।

অতএব, সূরা হা-মীম-সিজদার ৩৩নং আয়াত অনুযায়ী নিজেদেরকে শুধু নামধারী মুসলিম বললেই হবে না বরং রাসূল (সাঃ) ও তাঁর অনুসারী হতে হলে মুমিন বান্দার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কাজ করতে হবে তবেই আত্মসমর্পণকারী মুসলিম হওয়া যাবে তথা প্রকৃত আহলে হাদীস হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করা যাবে তথা আত্মসমর্পণকারী মুসলিম হিসাবে পরিচয় দেয়া সম্ভব হবে।

আর নিশ্চয় আমাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক আছে আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) আর কিছুসংখ্যক আছে সীমালঙ্ঘনকারী তবে যারা আত্মসমপর্ণ করেছে তারাই সঠিক সত্যপথ বেছে নিয়েছে আর যারা সীমালঙ্ঘনকারী তারা জাহান্নামের ইন্ধন। আল-জিন, ৭২/১৪-১৫

উপরের আলোচনা থেকে বুঝা যায়, মুসলিম দাবী করলেই মুসলিম হওয়া যায় না। যে আল্লাহর নিকট আত্মসমপর্ণ করে সেই মুসলিম। যে আল্লাহর প্রতিটি বাণী মেনে নেয় অর্থাৎ কুরআনের প্রতিটি আয়াতের কাছে আত্মসমপর্ণ করে সেই হল আত্মসমপর্ণকারী বা অনুগত মুসলিম। আমাদেরকে সম্পূর্ণ কুরআনের উপর ঈমান আনতে হবে। আর যে আল্লাহর নিকট নিজেকে আত্মসমপর্ণ করল না, অর্থাৎ কুরআনে কাছে মাথা নত করল না; কুরআনে কিছু আয়াত স্বীকার করল আর কিছু আয়াত অমান্য করল তারা হল সীমালঙ্ঘনকারী মুসলিম।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা’আলা পবিত্র কুরআনে তাই বলেছেন- তবে কি তোমরা কিতাবের কিছু অংশকে বিশ্বাস কর আর কিছু অংশকে অবিশ্বাস করবে? তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তবে কী প্রতিদান হতে পারে? এবং কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে আর তোমরা যা করছ সে সম্পর্কে আল্লাহ গাফেল নন। এরাই আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে ক্রয় করেছে, অতএব তাদের থেকে আযাব হালকা করা হবে না আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না। আল-বাকারা, ২/৮৫-৮৬

 

৩:১০৩ وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰہِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡکُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰہِ عَلَیۡکُمۡ اِذۡ کُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِکُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِہٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ کُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَکُمۡ مِّنۡہَا ؕ کَذٰلِکَ یُبَیِّنُ اللّٰہُ لَکُمۡ اٰیٰتِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَہۡتَدُوۡنَ

আর তোমরা সকলে আল্লাহ্‌র রশি দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমর তো অগ্নিগর্তের দ্বারপ্রান্তে ছিলে, তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন যাতে তোমরা হেদায়াত পেতে পার।

 

আল্লাহ তোমাদের উপর তিনটি ব্যাপারে খুশী হন: (১) তোমরা কেবলমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করো এবং তাঁর সংগে কাউকে শরীক করো না। (২) তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রজ্জুকে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং আর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ো না (৩) আল্লাহ যাদেরকে তোমাদের উপর শাসন ক্ষমতা দান করেন, তাদেরকে সু-পরামর্শ দিবে।ছ্বহীহ মুসলিম হা/১৭১৫।

এ তিনটি বিষয়ের সম্পূর্ণ অথবা আংশিক লঙ্ঘন করার কারণে মানুষের দীন ও দুনিয়াবী বিষয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ব্যাখ্যা: কতিপয় জাহিলী সমস্যা: জাহিলরা শাসকের প্রতি অনুগত নয়। অনুগত থাকাকে তারা অসম্মানের কারণ মনে করে। শাসকের অবাধ্য হওয়াকে মর্যাদাকর ও স্বাধীনতা হিসাবে তারা গ্রহণ করে। একারণে কোন ইমাম (নেতা) ও আমীর (শাসক) তাদেরকে জামা‘আতবদ্ধ করতে পারে না। কেননা তারা অনুগত নয়। তারা দাম্ভিক ও অহংকারী। ইসলাম তাদের এ কাজের বিরোধিতা করে। সেই সাথে ইসলাম মুসলিম শাসকের কথা শ্রবণ করা ও তার প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ দেয়, যা কল্যাণকর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ) [النساء: 59]

হে মুমিনগণ, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের (সূরা আন নিসা ৪:৫৯)।

এ আয়াত থেকে শাসকের প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ প্রমাণিত হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অবাধ্যতায় আনুগত্যের সীমা নির্ধারণ করে বলেন,

لا طاعة لمخلوق في معصية الخالق

অর্থাৎ স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য নেই।ছ্বহীহ: মুসনাদে আহমাদ, ছ্বহীহ জামে হা/৭৫২০।

তিনি আরোও বলেন,

إنما الطاعة في المعروف

আনুগত্য শুধু সৎকাজে। ছ্বহীহ বুখারী হা/৭২৫৭ , ছ্বহীহ মুসলিম হা/১৮৪০

তাই আল্লাহর অবাধ্যতা ব্যতীত শাসকের আনুগত্য করা ওয়াজীব-আবশ্যক। শাসক অবাধ্যতার নির্দেশ দিলে তার আনুগত্য করা যাবে না। অবাধ্য বিষয় ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে তার বিরোধিতা করা যাবে না। বিশেষত যে বিষয়ে অবাধ্যতা রয়েছে সে ব্যাপারে আদৌ শাসকের আনুগত্য করা যাবে না। এ কারণে শাসক ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকলে অন্যান্য বিষয়ে তার বাইয়াত ভঙ্গ করা যাবে না এবং তার বিরোধিতাও করা যাবে না। কেননা একতাবদ্ধ থাকা, রক্তপাত নিবৃত্ত করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অত্যাচারীর হাত থেকে নির্যাতিতদের রক্ষা করা, মানুষের অধিকার রক্ষা করা ও ন্যায়ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা শাসকের আনুগত্যের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। এমনকি শাসক যদি দীনের উপর অটল না থাকে ও ফাসিকও হয়, কিন্তু কুফরীতে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার আনুগত্য করতে হবে। যেমন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

اسمعوا وأطيعوا، إلا أن تروا كفراً بواحاً عندكم عليه من الله برهان

তোমরা শাসকের কথা শ্রবণ করবে ও তার অনুগত থাকবে কিন্তু যদি স্পষ্ট কুফরী দেখ, তোমাদের কাছে আল্লাহর তরফ থেকে যে বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান, তাহলে আলাদা কথা। ছ্বহীহ বুখারী হা/৭০৫৬ , ছ্বহীহ মুসলিম হা/১৭০৯।

শাসক কুফরী ব্যতীত অন্যান্য অবাধ্যতায় লিপ্ত হলেও তার কথা শ্রবণ করতে হবে ও তার অনুগত থাকতে হবে, যদি তার নের্তৃত্ব ও তার প্রতি অনুগত থাকা মুসলিমদের জন্য কল্যাণকর হয়। তবে ফাসিকী শাসকের উপরই বর্তাবে।

 

আল্লাহর রজ্জু বলতে তাঁর দীনকে বুঝানো হয়েছে৷ আল্লাহর দীনকে রজ্জুর সাথে তুলনা করার কারণ হচ্ছে এই যে, এটিই এমন একটি সম্পর্ক, যা একদিকে আল্লাহর সাথে ঈমানদারদের সম্পর্ক জুড়ে দেয় এবং অন্যদিকে সমস্ত ঈমানদারদেরকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে এক জামায়াত বদ্ধ করে৷ এই রজ্জুকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার মানে হচ্ছে, মুসলমানরা ”দীন” কেই আসল গুরুত্বের অধিকারী মনে করবে,তার ব্যাপারেই আগ্রহ পোষণ করবে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে এবং তারই খেদমত করার জন্য পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করবে৷ যেখানেই মুসলমানরা দীনের মৌলিক শিক্ষা ও দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়বে এবং তাদের সমগ্র দৃষ্টি ও আগ্রহ ছোটখাট ও খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হবে সেখানেই অনিবার্যভাবে তাদের মধ্যে সে এই প্রকারের দলাদলি ও মতবিরোধ দেখা দেবে, যা ইতিপূর্বে বিভিন্ন নবীর উম্মাতদেরকে তাদের আসল জীবন লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে দুনিয়া ও আখেরাতের লাঞ্ছনার আবর্তে নিক্ষেপ করেছিল৷

ইসলামের আগমেনর পূর্বে আরববাসীরা যেসব ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল, এখানে সেদিকেই ইংগিত করা হয়েছে৷ বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা, কথায় কথায় ঝগড়া বিবাদ এবং রাতদিন মারামারি, কাটাকাটি,হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণে সমগ্র আবর জাতিই ধ্বংসের কবলে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল৷ এই আগুনে পুড়ে ভস্মীভুত হওয়া থেকে ইসলামই তাদেরকে রক্ষা করেছিল৷ এই আয়াত নাযিল হওয়ার তিন চার বছর আগেই মদীনার লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেছিল৷ ইসলামের এ জীবন্ত অবদান তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিল৷ তারা দেখছিলঃ আওস ও খাযরাজ দু’টি গোত্রে বছরের পর বছর থেকে শত্রুতা চলে আসছিল৷ তারা ছিল পরস্পরের রক্ত পিপাসু৷ ইসলামের বদৌলতে তারা পরস্পরের মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল৷ এই গোত্র দু’টি মক্কা থেকে আগত মুহাজিরদের সাথে এমন নজীর বিহীন ত্যাগ ও প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করছিল, যা সাধারণত একই পরিবারের লোকদের নিজেদের মধ্যে করতে দেখা যায় না৷

অর্থাৎ যদি তোমাদের সত্যিকার চোখ থেকে থাকে, তাহলে এই আলামতগুলো দেখে তোমরা নিজেরাই আন্দাজ করতে পারবে, কিসে তোমাদের কল্যাণ-এই দীনকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার মধ্যে, না একে পরিত্যাগ করে আবার তোমাদের সেই পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার মধ্যে? তোমাদের আসল কল্যাণকামী কে-আল্লাহ ও তাঁর রসূল না সেই ইহুদী, মুশরিক ও মুনাফিক, যারা তোমাদের আগের অবস্থার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে?(তাফহিমুল কুর’আন)

আল্লাহকে ভয় করার কথা বলার পর ‘তোমরা সকলে আল্লাহর রশিকে শক্ত করে ধর’এর আদেশ দিয়ে এ কথা পরিষ্কার করে দিলেন যে, মুক্তিও রয়েছে এই দুই মূল নীতির মধ্যে এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে ও থাকতে পারে এই মূল নীতিরই ভিত্তিতে।

وَلاَ تَفَرَقُّوا ‘‘পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’’ এর মাধ্যমে দলে দলে বিভক্ত হওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, উল্লিখিত দু’টি মূল নীতি থেকে যদি তোমরা বিচ্যুত হয়ে পড়, তাহলে তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং ভিন্ন ভিন্ন দলে তোমরা বিভক্ত হয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য যে, বর্তমানে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার দৃশ্য আমাদের সামনেই রয়েছে। কুরআন ও হাদীস বোঝার এবং তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে পারস্পরিক কিছু মতপার্থক্য থাকলেও তা কিন্তু দলে দলে বিভক্ত হওয়ার কারণ নয়। এ ধরনের বিরোধ তো সাহাবী ও তাবেঈনদের যুগেও ছিল, কিন্তু তাঁরা ফির্কাবন্দী সৃষ্টি করেননি এবং দলে দলে বিভক্ত হয়েও যাননি। কারণ, তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সকলের আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র ছিল একটাই। আর তা হল, কুরআন এবং হাদীসে রসূল (সাঃ)। কিন্তু যখন ব্যক্তিত্বের নামে চিন্তা ও গবেষণা কেন্দ্রের আবির্ভাব ঘটল, তখন আনুগত্য ও আকীদার মূল কেন্দ্র পরিবর্তন হয়ে গেল। আপন আপন ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের উক্তি ও মন্তব্যসমূহ প্রথম স্থান দখল করল এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উক্তিসমূহ দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী হল। আর এখান থেকেই মুসলিম উম্মাহর মাঝে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা শুরু হল; যা দিনে দিনে বাড়তেই লাগল এবং বড় শক্তভাবে বদ্ধমূল হয়ে গেল।

 

৩:১০৪ وَلۡتَکُنۡ مِّنۡکُمۡ اُمَّۃٌ یَّدۡعُوۡنَ اِلَی الۡخَیۡرِ وَ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡہَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ ہُمُ الۡمُفۡلِحُوۡنَ

১০৪. আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল যেন থাকে যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে(১); আর তারাই সফলকাম।

ইসলাম যেসব সৎকর্ম ও পূণ্যের নির্দেশ দিয়েছে এবং প্রত্যেক নবী আপন আপন যুগে যে সব সৎকর্মের প্রচলন করেছেন, তা সবই আয়াতের উল্লেখিত ‘মারুফ’ তথা সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। ‘মারুফ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরিচিত। এসব সৎকর্ম সাধারণ্যে পরিচিত। তাই এগুলোকে ‘মারুফ’ বলা হয়।

এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব অসৎকর্মরূপী কাজকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন বলে খ্যাত, তা সবই আয়াতে উল্লেখিত মুনকার এর অন্তর্ভুক্ত। এ স্থলে ‘ওয়াজিবাত’ অর্থাৎ ‘জরুরী করণীয় কাজ’ ও ‘মা’আসী’ অর্থাৎ ‘গোনাহর কাজ’ এর পরিবর্তে মারুফ ও মুনকার বলার রহস্য সম্ভবত এই যে, নিষেধ ও বাধাদানের নির্দেশটি শুধু সবার কাছে পরিচিত ও সর্বসম্মত মাসআলা-মাসায়েলের ব্যাপারেই প্রযোজ্য হবে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোন খারাপ কাজ দেখবে, সে যেন তা হাত দ্বারা প্রতিহত করে, তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে মুখ দ্বারা প্রতিহত করবে, আর যদি তাও সম্ভব না হয় তাহলে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করবে। এটাই ঈমানের সবচেয়ে দুর্বল স্তর”। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এর পরে সরিষা পরিমাণ ঈমানও বাকী নেই’। [মুসলিমঃ ৪৯, আবু দাউদঃ ১১৪০]

অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যার হাতে আমার জীবন তার শপথ করে বলছি, অবশ্যই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে। নতুবা অচিরেই আল্লাহ তোমাদের উপর তার পক্ষ থেকে শাস্তি নাযিল করবেন। তারপর তোমরা অবশ্যই তার কাছে দোআ করবে, কিন্তু তোমাদের দোআ কবুল করা হবে না। [তিরমিযীঃ ২১৬৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৫/৩৯১] অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক লোক জিজ্ঞেস করলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল, কোন লোক সবচেয়ে বেশী ভাল? তিনি বললেনঃ সবচেয়ে ভাল লোক হল যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সৎকাজে আদেশ দেয় ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ঠিক রাখে। [মুসনাদে আহমাদঃ ৬/৪৩১]

 

৩:১০৫ وَ لَا تَکُوۡنُوۡا کَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَہُمُ الۡبَیِّنٰتُ ؕ وَ اُولٰٓئِکَ لَہُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ

১০৫. তোমরা তাদের মত হয়ে না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ দুই কিতাবী সম্প্রদায় তাদের দ্বীনের মধ্যে বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে। আর এ উম্মত তিহাত্তর দলে বিভক্ত হবে। প্রত্যেক দলই জাহান্নামে যাবে কেবলমাত্র একটি দল ব্যতীত। আর তারা হল আল-জামাআতের অনুসারী। আমার উম্মতের মধ্যে এমন কিছু দল বেরুবে যাদেরকে কুপ্রবৃত্তি এমনভাবে তাড়িয়ে বেড়াবে, যেমন পাগলা কুকুরে কামড়ানো ব্যক্তিকে সর্বদা কুকুর তাড়িয়ে বেড়ায়। [আবু দাউদঃ ৪৫৯৭, মুসনাদে আহমাদঃ ৪/১০২]

এখানে পুর্ববর্তী নবীদের এমন সব উম্মাতের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে, যারা সত্য দীনের সরল ও সুস্পষ্ট শিক্ষা লাভ করেছিল৷ কিন্তু কিছুদিন অতিবাহিত হবার পর দীনের মূল বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে দীনের সাথে সম্পর্কবিহীন গৌণ ও অপ্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি বিষয়াবলীর ভিত্তিতে নিজেদেরকে একটি আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে দিয়েছিল৷ তারপর অবান্তর ও আজেবাজে কথা নিয়ে এমনভাবে কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল যে, আল্লাহ তাদের ওপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন তার কথাই তারা ভুলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাস ও নৈতিকতার যেসব মূলনীতির ওপর আসলে মানুষের সাফল্য ও কল্যাণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে, তার প্রতি কোন আগ্রহই তাদের ছিল না৷

সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে’ এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের পারস্পরিক বিরোধ ও দলাদলির কারণ এই ছিল না যে, তারা সত্য জানতো না এবং দলীলাদির ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল, বরং প্রকৃত ব্যাপার হল এই যে, তারা সব কিছু জানা সত্ত্বেও কেবল দুনিয়ার লোভে এবং ব্যক্তিস্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে বিরোধ ও দলাদলির পথ অবলম্বন করেছিল এবং এ পদ্ধতি শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছিল। কুরআন মাজীদ বারংবার বিভিন্নভাবে (তাদের) প্রকৃত ব্যাপারকে তুলে ধরেছে এবং তা থেকে দূরে থাকার তাকীদও করেছে। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় যে, এই উম্মতের বিভেদ সৃষ্টিকারীরাও ঠিক ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের মতই স্বভাব অবলম্বন করেছে। তারাও সত্য এবং তার প্রকাশ্য দলীলাদি খুব ভালভাবেই জানে, তা সত্ত্বেও তারা দলাদলি ও ভাগাভাগির উপর শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধির সমস্ত মেধাকে বিগত জাতিদের মত (শরীয়তের) অপব্যাখ্যা এবং বিকৃতি করার জঘন্য কাজে নষ্ট করছে।

‘নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বিষয় আল্লাহ তা‘আয়ালার নিকট সমর্পিত’ (আল-আন‘আম ১৫৯)।

‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারণ করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি আপনার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না’ (আশ-শূরা ১৩)

প্রত্যেক দল নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে আনন্দিত’ (আল-মুমিনূন ৫৩)। নিঃসন্দেহে এসব দলাদলি আল্লাহ্‌র নির্দেশের পরিপন্থী। তিনি এরশাদ করেন,

﴿ إِنَّ هَٰذِهِۦٓ أُمَّتُكُمۡ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ وَأَنَا۠ رَبُّكُمۡ فَٱعۡبُدُونِ ٩٢ ﴾ [الانبياء: ٩٢]

‘তারা সকলেই তোমাদের ধর্মের; এবং আমিই তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, আমারই ইবাদত কর’ (আল-আম্বিয়া ৯২)।

এসব দলাদলির ফলাফলও কল্যাণকর নয়। কেননা প্রত্যেকটি দল অপর পক্ষকে নানাভাবে গালাগালি করে থাকে।

৩:১০৬ یَّوۡمَ تَبۡیَضُّ وُجُوۡہٌ وَّ تَسۡوَدُّ وُجُوۡہٌ ۚ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اسۡوَدَّتۡ وُجُوۡہُہُمۡ ۟ اَکَفَرۡتُمۡ بَعۡدَ اِیۡمَانِکُمۡ فَذُوۡقُوا الۡعَذَابَ بِمَا کُنۡتُمۡ تَکۡفُرُوۡنَ

১০৬. সেদিন কিছু মুখ উজ্জল হবে এবং কিছু মুখ কালো হবে যাদের মুখ কালো হবে (তাদেরকে বলা হবে), ‘তোমরা কি ঈমান আনার পর কুফরী করেছিলে? সুতরাং তোমরা শাস্তি ভোগ কর, যেহেতু তোমরা কুফরী করতে।

উজ্জ্বল মুখ ও কালো মুখ কারা, এ সম্পর্কে তাফসীরবিদগণের বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে।

ইবনে-আব্বাস বলেনঃ আহলে সুন্নাত সম্প্রদায়ের মুখমণ্ডল শুভ্র হবে এবং বিদ’আতীদের মুখমণ্ডল কালো হবে।

আতা বলেনঃ মুহাজির ও আনসারগণের মুখমণ্ডল সাদা হবে এবং বণী-নদ্বীরের মুখমণ্ডল কালো হবে।

ইকরিমাহ বলেনঃ আহলে কিতাবগণের এক অংশের মুখমণ্ডল কালো হবে অর্থাৎ যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়ত লাভের পূর্বে তিনি নবী হবেন বলে বিশ্বাস করতো কিন্তু নবুওয়ত প্রাপ্তির পর তাকে সাহায্য ও সমর্থন করার পরিবর্তে তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে শুরু করে।

আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘খারেজী সম্প্রদায়ের মুখমণ্ডল কালো হবে। আর যারা তাদের হত্যা করবে, তাদের মুখমণ্ডল সাদা হবে। তিনি আরও বলেন, ‘এটি যদি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাতবার না শুনতাম, তবে বর্ণনাই করতাম না। [তিরমিযী: ৩০০০]

তাদের চেহারা কেন কালো হবে, তার কারণ বর্ণনায় এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তাদের চেহারা কালো হবার কারণ হচ্ছে, “তারা ঈমান আনার পর কুফরী করেছে”। অন্য আয়াতে আল্লাহর উপর মিথ্যাচার করাকেই চেহারা কালো হওয়ার কারণ বলা হয়েছে,

  • “আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, আপনি কিয়ামতের দিন তাদের চেহারাসমূহ কালো দেখবেন। অহংকারীদের আবাসস্থল কি জাহান্নাম নয়?” [সূরা আয-যুমার: ৬০]
  • অপরাধীগণ সেখানে নিজ নিজ চেহারা দিয়েই পরিচিত হবে এবং তাদেরকে কপালের চুল ও পা ধরে চ্যাংদোলা করে (জাহান্নামের দিকে) নিয়ে যাওয়া হবে। (সূরা আর রাহ্‌মান-৪১)
  • আবার কোন কোন আয়াতে গোনাহ অর্জন করার কারণে তাদের চেহারা কালো হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

“আর যারা মন্দ কাজ করে তাদের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং তাদেরকে হীনতা আচ্ছন্ন করবে; আল্লাহ থেকে তাদের রক্ষা করার কেউ নেই; তাদের মুখমন্ডল যেন রাতের অন্ধকারের আস্তরণে আচ্ছাদিত। তারা আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” [সূরা ইউনুস: ২৭]

  • কোন কোন আয়াতে কুফর ও অপরাধী হওয়াকেই চেহারা কালো হবার কারণ হিসেবে ধরা হয়েছে,

“আর অনেক চেহারা সেদিন হবে ধূলিধূসর, সেগুলোকে আচ্ছন্ন করবে কালিমা। এরাই কাফির ও পাপাচারী।” [সূরা আবাসাঃ ৪০-৪১]।

বস্তুত: এগুলোতে কোন বিরোধ নেই। কারণ, এ সব কারণেই চেহারা কালো হবে। কাফেরদের চেহারা কালো হবে.

  • সেদিন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে, শিকল দ্বারা শক্ত করে হাত-পা বাঁধা রয়েছে এবং গায়ে গন্ধকের পোষাক পরানো হয়েছে। আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ তাদের মুখমন্ডল আচ্ছন্ন করে রেখেছে। (সূরা ইবরাহীম-৪৯-৫০)
  • তারা যখন তা (কিয়ামতের শাস্তি) আসন্ন দেখবে, তখন অবিশ্বাসীদের মুখমণ্ডল ম্লান হয়ে পড়বে এবং বলা হবে এটাই তো তোমরা চাচ্ছিলে।’ (সুরা : মুলক, আয়াত : ২৭)
  • বেনামাজির চেহারা মলিন হবে:

কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কিয়ামতের দিন তার চেহারা উদাস ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে, যে কোরআনকে মেনে নেয়নি এবং নামাজ আদায় করেনি। ’ –সূরা কিয়ামাহ: ৩১

৩:১০৭ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ ابۡیَضَّتۡ وُجُوۡہُہُمۡ فَفِیۡ رَحۡمَۃِ اللّٰہِ ؕ ہُمۡ فِیۡہَا خٰلِدُوۡنَ

১০৭. আর যাদের মুখ উজ্জল হবে তারা আল্লাহর অনুগ্রহে থাকবে, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।

শুভ্র মুখমণ্ডলবিশিষ্টদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা সর্বদা আল্লাহর অনুকম্পার মধ্যে অবস্থান করবে। ইবনে-আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ এখানে আল্লাহর অনুকম্পা বলে জান্নাত বুঝানো হয়েছে। তবে জান্নাতকে অনুকম্পা বলার রহস্য এই যে, মানুষ যত ইবাদাতই করুক না কেন, আল্লাহর অনুকম্পা ব্যতীত জান্নাতে যেতে পারবে না। কারণ, ইবাদাত করা মানুষের নিজস্ব পরাকাষ্ঠা নয়; বরং আল্লাহর প্রদত্ত সামর্থের বলেই মানুষ ইবাদাত করতে পারে। সুতরাং ইবাদাত করলেই জান্নাতে প্রবেশ অপরিহার্য হয়ে যায় না। বরং আল্লাহর অনুকম্পার দ্বারাই জান্নাতে প্রবেশ করা সম্ভব।

  • তবে সেদিন কিছু মানুষের চেহারা হবে খুশীতে উজ্জ্বল। নিজেদের অর্জনে তারা তৃপ্ত। তারা থাকবে আলিশান বাগানে। যেখানে তারা কোনো বাজে কথা শুনবে না। সেখান দিয়ে ঝরনা বয়ে যায়। আছে উঁচু আসন। সামনে সাজানো পানীয় পাত্র। সারি সারি নরম বালিশ। নরম গালিচা বিছানো। আল-গাশিয়াহ ৮-১৬
  • কিয়ামতের দিন মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তির দৈর্ঘ্য হবে আট গজ, চেহারা হবে উজ্জ্বল এবং মাথায় মুক্তার টুপি পরানো হবে। অতঃপর সে বন্ধুদের কাছে যাবে। তারা তাকে দূর থেকেই দেখবে। পক্ষান্তরে কাফিরদের অবস্থা হবে করুণ। তাদের বাঁ হাতে আমলনামা দেওয়া হবে এবং মাথায় আগুনের টুপি পরানো হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩১৩৬)
  • কিয়ামতের দিন ঈমানদারদের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ওই দিন কিছু লোকের চেহারা উজ্জ্বল হবে, আর কিছু লোকের চেহারা হবে কালো।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৬)
  • রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন, আমার উম্মত অজুর প্রভাবে কিয়ামতের দিন দীপ্তিময় মুখমণ্ডল ও হাত-পা নিয়ে উঠবে। কাজেই তোমরা যারা সক্ষম তারা অধিক বিস্মৃত দীপ্তিসহ উঠতে সে যেন চেষ্টা করে। (মুসলিম, হাদিস : ৪৬৮)
  • নবী (সা.) বলেছেন, যারা অন্ধকার রাতে মসজিদে যাতায়াত করে তাদের কিয়ামতের দিন পূর্ণ জ্যোতির সুসংবাদ দাও। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫৬১)

রাসুল (সা.) দোয়া করতেন, (উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মাজআল ফি কলবি নূরা, ওয়া ফি বাসারি নূরা, ওয়া ফি সাম-ই নূরা, ওয়া আ’ইঁইয়ামিনি নূরা, ওয়া আ’ই ইয়াসারি নূরা, ওয়া ফাওকি নূরা, ওয়া তাহতি নূরা, ওয়া আমামি নূরা, ওয়া খলফি নূরা, ওয়াজআল লি নূরা।’) অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি আমার অন্তরে, আমার চোখে, আমার কানে, আমার ডানে-বামে, আমার উপর-নিচে, আমার সামনে-পেছনে, আমার জন্য নূর দান করুন। (বুখারি, হাদিস : ৬৩১৬)

৩:১০৮ تِلۡکَ اٰیٰتُ اللّٰہِ نَتۡلُوۡہَا عَلَیۡکَ بِالۡحَقِّ ؕ وَ مَا اللّٰہُ یُرِیۡدُ ظُلۡمًا لِّلۡعٰلَمِیۡنَ

১০৮. এগুলো আল্লাহ্‌র আয়াত, যা আমরা আপনার কাছে যথাযথভাবে তেলাওয়াত করছি। আর আল্লাহ সৃষ্টিজগতের প্রতি যুলুম করতে চান না।

৩:১০৯ وَ لِلّٰہِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الۡاَرۡضِ ؕ وَ اِلَی اللّٰہِ تُرۡجَعُ الۡاُمُوۡرُ

১০৯. আর আসমানে যা কিছু আছে ও যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই এবং আল্লাহর কাছেই সব কিছু প্রত্যাবর্তিত হবে।