তাফসীর- সূরা হুমাযা

সুরা হুমাযা ১০৪তম। রুকু-১। আয়াত-০৯। মক্কায় অবতীর্ণ

Surah 104 . Al-Humazah  । Ruku: 1. Verse: 09

بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْم

وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ ﴿1

দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে ( সামনা সামনি) লোকদের ধিক্কার দেয় এবং (পেছনে ) নিন্দা করতে অভ্যস্ত।

Woe to every fault-finding backbiter;

الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ  (2

২) যে অর্থ জমায় এবং তা বার বার গুণে গুণে রাখে ৷

who amasses wealth and counts it over and again.

يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ ﴿3

৩) সে মনে করে তার অর্থ -সম্পদ চিরকাল থাকবে ।

He thinks that his wealth will immortalise him forever.

كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ 4

৪) কখনো নয়, তাকে তো চূর্ণ – বিচূর্ণকারী জায়গায় ফেলে দেয়া হবে ৷

Nay, he shall be thrown  into the Crusher

وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ ﴿5

৫) আর তুমি কি জানো সেই চূর্ণ – বিচূর্ণকারী জায়গাটি কি ?

And what do you know what the Crusher is?

sura-humaza word by word meaning

نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ ﴿6

৬) আল্লাহর আগুন , প্রচণ্ডভাবে উৎক্ষিপ্ত ,

It is the Fire kindled by Allah,

الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ ﴿7﴾

৭) যা হৃদয় অভ্যন্তরে পৌঁছে যাবে ৷

the Fire that shall rise to the hearts (of criminals).

إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ ﴿8

৮) তা তাদের ওপর ঢেকে দিয়ে বন্ধ করা হবে

Verily it will close in upon them,

فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ ﴿9

৯) (এমন অবস্থায় যে তা ) উঁচু উঁচু থামে (ঘেরাও হয়ে থাকবো )

in outstretched columns.

sura-humaza word by word meaning

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য

এই সূরায় এমন কিছু নৈতিক অসৎবৃত্তির নিন্দা করা হয়েছে যেগুলো জাহেলী সমাজে অর্থলোলুপ ধনীদের মধ্যে পাওয়া যেতো। সবাই এগুলোকে খারাপ মনে করতো। একজনও সৎগুণ মনে করতো না এবং প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখতো না । এই জঘন্য প্রবণতাগুলো পেশ করার পর আখেরাতে এই ধরনের চরিত্রের অধিকারী লোকদের পরিণাম কি হবে তা বলা হয়েছে। আর যেহেতু দুনিয়ায় এই ধরনের চরিত্রের লোকেরা কখনোবা কোন শাস্তি পায় না বরং উলটো তাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে দেখা যায় তাই আখেরাত অনিবার্যভাবে অনুষ্ঠিত হবেই । এখানে জাহেলী যুগের নেতৃত্বের একটি নমুনা পেশ করে লোকদের সামনে যেন এ প্রশ্ন রাখা হয়েছে যে, এই ধরনের চরিত্র ও কর্মকাণ্ডের অধিকারী ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না কেন ?

সংক্ষিপ্ত আলোচনা

وَيْلٌ لِكُلِّ هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ

দুর্ভোগ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে ( সামনা সামনি) লোকদের ধিক্কার দেয় এবং (পেছনে ) নিন্দা করতে অভ্যস্ত।

(104:1) Woe to every fault-finding backbiter;

এখানে মূল শব্দ হচ্ছে (আরবী هُمَزَةٍ لُمَزَةٍ  ) ৷ আরবী ভাষায় এই শব্দ দুটি অর্থের দিক দিয়ে অনেক বেশী কাছাকাছি অবস্থান করছে ৷  এমন কি কখনো শব্দ দুটি সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷

আবার কখনো দু ‘য়ের পার্থক্য হয় ৷  এখানে যেহেতু দু’টি শব্দ এক সাথে এসেছে এবং “হুমাযাহ ” ও “লুমাযাহ” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তাই উভয় মিলে এখানে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হচ্ছে : সে কাউকে লাঞ্ছিত ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ৷ কারোর প্রতি তাচ্ছিল্য ভরে অংগুলি নির্দেশ করে ৷ চোখের ইশারায় কাউকে ব্যঙ্গ করে কারো বংশের নিন্দা করে ৷ কারো ব্যক্তি সত্তার বিরূপ সমালোচনা করে ৷ কারো মুখের ওপর তার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে ৷ কারো পেছনে তার দোষ বলে বেড়ায় ৷ কোথাও চোখলখুরী করে এবং এর কথা ওর কানে লাগিয়ে বন্ধুদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় ৷ কোথাও লোকদের নাম বিকৃত করে খারাপ নামে অভিহিত করে ৷ কোথাও কথার খোঁচায় কাউকে আহত করে এবং কাউকে দোষারোপ করে ৷ এসব তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ৷

রাসূল(সঃ) বলেছেন- এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তার সম্পর্কে মিথ্যা বলবে না, তাকে অপমান করবেনা। প্রত্যেক মুসলমানের মান-সম্মান, ধন-সম্পদ ও রক্তের(জীবনের) উপর হস্তক্ষেপ করা অপর মুসলমানের উপর হারাম। তাকওয়া এখানে(অন্তরে)। কোন ব্যক্তির মন্দ প্রমানিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার অপর মুসলিম ভাইকে হেয় জ্ঞান করে।

আত-তিরমিযী আবওয়াবুল বিরর ওয়াস সিলাহঃ১৮৭৭

হে ঈমানদারগণ, পুরুষরা যেন অন্য পুরুষদের বিদ্রূপ না করে ৷ হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম ৷ আর মহিলারাও যেন অন্য মহিলাদের বিদ্রূপ না করে ৷ হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম ৷ তোমরা একে অপরকে বিদ্রূপ করো না ৷ এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না ৷ ঈমান গ্রহণের পর গোনাহর কাজে প্রসিদ্ধ লাভ করা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার ৷ যারা এ আচরণ পরিত্যাগ করেনি তারাই জালেম।

হে ঈমানদাগণ, বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ ৷ দোষ অন্বেষন করো না ৷ আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে ৷ এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে ? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয় ৷ আল্লাহকে ভয় করো ৷ আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু ৷  সূরা-হুজুরাতঃ১১-১২

মহান আল্লাহর বিধান কত সুন্দর ও শান্তিময়। একটি পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ জীবনএ শান্তি এনে দিতে পারে এইভাবে একজন আরেকজনের সাথে আচরন করলে। বিশেষ করে পরিবারের ভিত্তি সুন্দর শিক্ষায় গড়ে উঠলে সেই পরিবার থেকে আরো কয়েকটি পরিবার গড়ে উঠবে– এইভাবে সমাজ সুন্দর হয়ে যেতে পারে। আল্লাহ আমাদের বাস্তব আমলদার মুমিনা হওয়ার তৌফিক দান করুন। আগামীতে আরো চলবে ইনশাল্লাহ।

الَّذِي جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ

২) যে অর্থ জমায় এবং তা বার বার গুণে গুণে রাখে ৷

(104:2) who amasses wealth and counts it over and again.

প্রথম বাক্যটির পর এই দ্বিতীয় বাক্যটির থেকে স্বতষ্ফূর্তভাবে এ অর্থই প্রকাশিত হয় যে , নিজের অগাধ ধনদৌলতের অহংকারে সে মানুষরক এভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে ৷ অর্থ জমা করার জন্য ( আরবী – جَمَعَ مَالًا -) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ৷ এ থেকে অর্থ প্রাচুর্য বুঝা যায় ৷ তারপর ‘ গুণে গুণে রাখা ‘ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কার্পণ্য ও অর্থ লালসার ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে৷

يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُ أَخْلَدَهُ

৩) সে মনে করে তার অর্থ -সম্পদ চিরকাল থাকবে ।

(104:3) He thinks that his wealth will immortalise him forever.

৩. এর আর একটি অর্থ হতে পারে ৷ তা হচ্ছে এই যে , সে মনে করে তার অর্থ – সম্পদ তাকে চিরন্তন জীবন দান করবে ৷ অর্থাৎ অর্থ জমা করার এবং তা গুণে রেখে দেবার কাজে সে এত বেশী মশগুল যে নিজের মৃত্যুর কথা তার মনে নেই ৷ তার মনে কখনো এ চিন্তার উদয় হয় না যে , এক সময় তাকে এসব কিছু ছেড়ে দিয়ে খালি হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে ৷

মহান আল্লাহতা’আলা বলেছেন-

এ ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের একটি সাময়িক সৌন্দর্য-শোভা মাত্র ৷ আসলে তো স্থায়িত্ব লাভকারী সৎকাজগুলোই তোমার রবের কাছে ফলাফলের দিক দিয়ে উত্তম এবং এগুলোই উত্তম আশা-আকাঙ্ক্ষা সফল হবার মাধ্যম ৷  সূরা কাহফঃ ৪৬

এবং জেনে রেখো, তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্তুতি আসলে পরীক্ষার সামগ্রী ৷  আর আল্লাহর কাছে প্রতিদান দেবার জন্য অনেক কিছুই আছে ৷  সুরা আনফালঃ ২৮

তারা সবসময় একথাই বলেছে, আমরা তোমাদের চাইতে বেশী সম্পদ ও সন্তানের অধিকারী এবং আমরা কক্ষনো শাস্তি পাব না ৷ হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, আমার রব যাকে চান প্রশস্ত রিযিক দান করেন এবং যাকে চান মাপাজোপা দান করেন কিন্তু বেশীর ভাগ লোক এর প্রকৃত তাৎপর্য জানে না ৷ তোমাদের এই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে; হ্যাঁ, তবে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে ৷এরাই এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ ইমারত সমূহে নিশ্চিন্তে নিরাপদে থাকবে ৷ সূরা সাবাঃ ৩৫-৩৭

রাসূল(সঃ) বলেছেন—

আদম সন্তান বার্ধক্যে পৌছে যায়, কিন্তু দুটি ব্যপারে তার আকাঙ্ক্ষা যৌবনে বিরাজ করে—সম্পদের লালসা এবং বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।  সহীহ মুসলিমঃ ২২৮১ ৩য় খণ্ড

আদম সন্তান যদি দুটি মাঠ ভর্তি সম্পদের অধিকারী হয়া যায় তাহলে সে তৃ্তীয় মাঠ ভর্তি সম্পদ খুঁজে বেড়াবে। আদম সন্তানের পেট-মাটি ছাড়া কোন কিছুই পেট ভরতে পারে না। যে ব্যক্তি তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।  সহীহ মুসলিমঃ ২২৮৪ ৩য় খণ্ড

হে আদম সন্তান! তোমার কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে মালামাল রয়েছে তা খরচ করতে থাকো, এটা তোমার জন্য উত্তম। আর যদি তুমি তা দান না করে কুক্ষিগত করে রাখো তাহলে এটা তোমার জন্য অমংগল বয়ে আনবে। তবে প্রয়োজন পরিমান রাখায় কোন দোষ নেই। এজন্য তোমাকে ভৎর্সনাও করা হবে না। যাদের প্রতিপালনের দায়িত্ব তোমার উপর রয়েছে তাদেরকে দিয়েই দান শুরু করো। উপরের হাত নীচের হাতের চেয়ে উত্তম। সহীহ মুসলিমঃ ২২৫৬ ৩য় খণ্ড

খরচ করো আর কত খরচ করলে তার হিসেব রেখোনা। আর যদি তাই করো তাহলে আল্লাহতা’আলাও তোমাদের গুনে গুনে দিবেন। আর জমা করে রেখো না তাহলে আল্লাহও জমা করে রাখবেন(অর্থাৎ আল্লাহও তোমাকে দিবেন না।)   সহীহ মুসলিমঃ ২২৪৬ ৩য় খণ্ড

হে সেই সব লোক যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না দেয় ৷  যারা এরূপ করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে ৷  আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় আসার পূর্বেই তা থেকে খরচ করো ৷ সে সময় সে বলবে : হে আমার রব, তুমি আমাকে আরো কিছুটা অবকাশ দিলে না কেন ? তাহলে আমি দান করতাম এবং নেককার লোকদের মধ্যে শামিল হয়ে যেতাম ৷ অথচ যখন কারো কাজের অবকাশ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার সময় এসে যায় তখন আল্লাহ তাকে আর কোন অবকাশ মোটেই দেন না ৷ তোমরা যা কিছু কর সে বিষয়ে আল্লাহ পুরোপুরি অবহিত ৷   সূরা মুনাফিকুনঃ ৯-১১

আমাদের আরো বেশী দান-খয়রাত করা প্রয়োজন। মাটির নীচে যাওয়ার আর বেশী সময় নেই ধরেই আমাদের আমল করা প্রয়োজন। যে কেউ যে কোন মূহুর্তে সাদা কাপড়ে নিজেকে সাজানোর উপযুক্ততায় চলে যেতে পারি। মহান আল্লাহ আমাদের তাকওয়াপূর্ণ জীবন-যাপন করার তৌফিক দান করুন।

كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ

৪) কখনো নয়, তাকে তো চূর্ণ – বিচূর্ণকারী জায়গায় ফেলে দেয়া হবে ৷

(104:4) Nay, he shall be thrown  into the Crusher

 

মূলে হুতামা (  — الۡحُطَمَۃِ —) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর মূল হাতম ৷ হাতম মানে ভেঙ্গে ফেলা , পিষে ফেলা ও টুকরা টুকরা করে ফেলা ৷ জাহান্নামকে হাতম নামে অভিহিত করার কারণ হচ্ছে এই যে , তার মধ্যে যা কিছু ফেলে দেয়া হবে তাকে সে নিজের গভীরতা ও আগুনের কারণে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে রেখে দেবে৷

আরবী ভাষায় কোন জিনিসকে তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া অর্থে (- یُنۡۢبَذَنَّ -) শব্দটি ব্যবহার করা হয়৷ এ থেকে আপনা আপনি এই ইংগিত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে , নিজের ধনশালী হওয়ার কারণে সে দুনিয়ায় নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করে৷ কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকে ঘৃণাভরে জাহান্নামে ছুঁড়ে দেয়া হবে৷

এই শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাদী ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর প্রচন্ড ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছে।

كَلاَّ হল প্রত্যাখ্যানকারী অব্যয়। অর্থাৎ ধনলিপ্সু কাফেররা যা ধারণা করে, সেটা কখনোই হবার নয়।

ওমর বিন আব্দুল্লাহ (গুফরাহর গোলাম) বলেন, আল্লাহ পাক যেখানেই كَلاَّ বলেন, সেখানে তার অর্থ হবে যেন তিনি বলছেন, كَذَبْتَ ‘তুমি মিথ্যা বলেছ’ (কুরতুবী)। অতএব كَلاَّ অর্থ حَقَّا لَيُنْبَذَنَّ ‘অবশ্যই সে নিক্ষিপ্ত হবে’। অথবা উহ্য শপথের জওয়াব, وَاللهِ لَيُنْبَذَنَّ আল্লাহর কসম! সে নিক্ষিপ্ত হবে’।

এখানে ‘কখনোই না’ বলে একথা বুঝানো হয়েছে যে, ধন-সম্পদ কাউকে চিরজীবী বা দীর্ঘজীবী করে না। বরং মাল ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তার নেক আমল বেঁচে থাকে। এই নেক আমল বা সৎকর্ম তাকে যেমন দুনিয়াতে সুনাম-সুখ্যাতির সাথে বাঁচিয়ে রাখে, আখেরাতেও তেমনি তার সাথী হয় এবং তার জান্নাতের অসীলা হয়।

মহান আল্লাহ এই সম্পদের ব্যপারে কুর’আনে যা বলেছেন——-

ভালভাবে জেনে রাখো দুনিয়ার এ জীবন, একটা খেলা, হাসি তামাসা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব ও অহংকার এবং সন্তান সন্তুতি ও অর্থ-সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এর উপমা হচ্ছে, বৃষ্টি হয়ে গেল এবং তার ফলে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজি দেখে কৃষক আনন্দে উৎফূল্ল হয়ে উঠলো৷ তারপর সে ফসল পেকে যায় এবং তোমরা দেখতে পাও যে, তা হলদে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভূষিতে পরিণত হয়৷ পক্ষান্তরে আখেরাত এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আযাব, আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি৷ পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সূরা হাদীদঃ২০

আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তাদের অর্থ-সম্পদ যেমন কাজে আসবে না, তেমনি সন্তান-সন্তুতিও কোন কাজে আসবে না৷ তারা দোযখের উপযুক্ত, সেখানেই তারা চিরদিন থাকবে৷মুজাদালাঃ১৭

আর তার ধন – সম্পদ তার কোন কাজে লাগবে যখন সে ধবংস হয়ে যাবে ? সূরা লাইলঃ১১

করনীয়ঃ

হে সেই সব লোক যারা ঈমান এসেছো, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফিল করে না দেয়৷ যারা এরূপ করবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে৷মুনাফিকুনঃ৯

মহান আল্লাহ আরো জানিয়েছেন-

তোমাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি একটি পরীক্ষা৷ আর কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে আছে বিরাট প্রতিদান। তাই যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চলো৷ শোন, আনুগত্য করো এবং নিজেদের সম্পদ ব্যয় করো৷ এটা তোমাদের জন্যই ভাল৷ যে মনের সংকীর্ণা থেকে মুক্ত থাকলো সেই সফলতা লাভ করবে। যদি তোমরা আল্লাহকে করযে হাসানা দাও তাহলে তিনি তোমাদেরকে তা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবেন এবং তোমাদের ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন৷ আল্লাহ সঠিক মূল্যায়ণকারী ও অতিব সহনশীল৷

তাগাবুনঃ১৪-১৭

ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের একটি সাময়িক সৌন্দর্য-শোভা মাত্র৷ আসলে তো স্থায়িত্ব লাভকারী সৎকাজগুলোই তোমার রবের কাছে ফলাফলের দিক দিয়ে উত্তম এবং এগুলোই উত্তম আশা-আকাঙ্ক্ষা সফল হবার মাধ্যম৷সূরা কাহফঃ ৪৬

 

وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ

৫) আর তুমি কি জানো সেই চূর্ণ – বিচূর্ণকারী জায়গাটি কি ?

104:5) And what do you know what the Crusher is?

প্রথমদিকের আয়াতসমূহে যে চরিত্র তুলে ধরা হয়েছিল তাদের পরিনতি সম্পর্কে বাকী আয়াতগুলোতে বলা হয়েছে। আল্লাহ আমাদের এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে হেফাজত করুন।

মূলে হুতামা ( আরবী -لْحُطَمَةُ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ৷ এর মূল হাতম  ৷ হাতম মানে ভেঙ্গে ফেলা , পিষে ফেলা ও টুকরা টুকরা করে ফেলা ৷ জাহান্নামকে হাতম নামে অভিহিত করার কারণ হচ্ছে এই যে , তার মধ্যে যা কিছু ফেলে দেয়া হবে তাকে সে নিজের গভীরতা ও আগুনের কারণে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে রেখে দেবে ৷

আসলে বলা হয়েছে ( আরবী –لَيُنْبَذَنّ–) ৷ আরবী ভাষায় কোন জিনিসকে তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া অর্থে এটা ব্যবহার করা হয়। এ থেকে আপনা আপনি এই ইংগিত সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে , নিজের ধনশালী হওয়ার করণে সে দুনিয়ায় নিজেকে অনেক বড় কিছু মনে করে ৷ কিন্তু কিয়ামতের দিন তাকে ঘৃণাভরে জাহান্নামে ছুঁড়ে দেয়া হবে ৷

نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ

৬) আল্লাহর আগুন , প্রচণ্ডভাবে উৎক্ষিপ্ত ,

It is the Fire kindled by Allah,

কুরআন মজীদের একমাত্র এখানে ছাড়া আর কোথাও জাহান্নামের আগুনকে আল্লাহর আগুন বলা হয়নি ৷ এখানে এই আগুনকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে কেবলমাত্র এর প্রচণ্ডতা ও ভয়াবহতারই প্রকাশ হচ্ছে না ৷ বরং এই সংগে এও জানা যাচ্ছে যে , দুনিয়ার ধন – সম্পদ লাভ করে যারা অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় মেতে ওঠে তাদেরকে আল্লাহ কেমন প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন ৷ এ কারণেই তিনি জাহান্নামের এই আগুনকে নিজের বিশেষ আগুন বলেছেন এবং এই আগুনেই তাকে নিক্ষেপ করা হবে৷

কুর‘আনে খুব অল্প কিছু জিনিসকে আল্লাহ তাঁর নিজের বলে সম্বোধন করেছেন। ‘হুতামাহ’ তার একটি। মহান আল্লাহ  যখন কোনো কিছুকে তাঁর নিজের বলেন, তখন সেটা সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো সৃষ্টি, যা কল্পনাতীত কোনো কিছু। সেটা এমন চরম পর্যায়ের সৃষ্টি যে, তিনি উচ্চ পর্যায়ের ফেরেশতাদের সাথেও তার সম্পর্ক করেন না।

জাহান্নামের এই বিশেষ আগুন এমন ভয়ংকর কিছু, যা ফেরেশতাদের জ্বালানোরও ক্ষমতা নেই। আল্লাহ নিজে সেটা জ্বালিয়েছেন। এখানে এই আগুনকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করার মাধ্যমে কেবলমাত্র এর প্রচণ্ডতা ও ভয়াবহতারই প্রকাশ হচ্ছে না৷ বরং এই সংগে এও জানা যাচ্ছে যে , দুনিয়ার ধন – সম্পদ লাভ করে যারা অহংকার ও আত্মম্ভরিতায় মেতে ওঠে তাদেরকে আল্লাহ কেমন প্রচণ্ড ঘৃণা ও ক্রোধের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন৷এরা সেই ব্যক্তি—পেছনে কথা লাগায়, সামনে অপমান করে, কৃপণের মতো সম্পদ গুনেগুনে রাখে,এই মানুষগুলো এত বড় পাপী যে, এদেরকে চরম পর্যায়ের শাস্তি দেওয়ার জন্য তিনি নিজে এক ভীষণ আগুন তৈরি করেছেন।

 

الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ

৭) যা হৃদয় অভ্যন্তরে পৌঁছে যাবে ৷

the Fire that shall rise to the hearts (of criminals).

হৃদয় পর্যন্ত এই আগুন পৌঁছবার একটি অর্থ হচ্ছে এই যে , এই আগুন এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে যেখানে মানুষের অসৎচিন্তা , ভুল আকীদা – বিশ্বাস , অপবিত্র ইচ্ছা , বাসনা , প্রবৃত্তি , আবেগ এবং দুষ্ট সংকল্প ও নিয়তের কেন্দ্র ৷ এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে , আল্লাহর এই আগুন দুনিয়ার আগুনের মতো অন্ধ হবে না ৷ সে দোষী ও নির্দোষ সবাইকে জ্বালিয়ে দেবে না ৷ বরং প্রত্যেক অপরাধীর হৃদয় অভ্যন্তরে পৌঁছে সে তার অপরাধের প্রকৃতি নির্ধারণ করবে এবং প্রত্যেককে তার দোষ ও অপরাধ অনুযায়ী আযাব দেবে ৷

এখানে তাত্তালিউ ‘ ( تَطَّلِعُ  ) শব্দটির মূলে হচ্ছে ‘ ইত্তিলা এর একটি অর্থ হচ্ছে চড়া , আরোহণ করা ও ওপরে পৌঁছে যাওয়া ৷দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে , অবগত হওয়া ও খবর পাওয়া ৷

الْأَفْئِدَةِ একবচনে فؤاد অর্থ হৃদয় বা কলিজা

কিন্তু বুকের মধ্যে যে হৃদপিণ্ডটি সবসময় ধুক ধুক করে তার জন্যও ফুওয়াদ শব্দটি ব্যবহার করা হয় না৷ বরং মানুষের চেতনা , জ্ঞান , আবেগ , আকাংক্ষা , চিন্তা , বিশ্বাস , সংকল্প ও নিয়তের কেন্দ্রস্থলকেই এই শব্দটি দিয়ে প্রকাশ করা হয়৷ হৃদয় পর্যন্ত এই আগুন পৌঁছবার একটি অর্থ হচ্ছে এই যে , এই আগুন এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে যেখানে মানুষের অসৎচিন্তা , ভুল আকীদা – বিশ্বাস , অপবিত্র ইচ্ছা , বাসনা , প্রবৃত্তি , আবেগ এবং দুষ্ট সংকল্প ও নিয়তের কেন্দ্র৷

এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে , আল্লাহর এই আগুন দুনিয়ার আগুনের মতো অন্ধ হবে না৷ সে দোষী ও নির্দোষ সবাইকে জ্বালিয়ে দেবে না৷ বরং প্রত্যেক অপরাধীর হৃদয় অভ্যন্তরে পৌঁছে সে তার অপরাধের প্রকৃতি নির্ধারণ করবে এবং প্রত্যেককে তার দোষ ও অপরাধ অনুযায়ী আযাব দেবে৷

আগুন তার সারা দেহ খেয়ে ফেলবে। এমনকি তার কলিজা পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। কিন্তু সে মরবে না।

কেননা আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, لاَ يَمُوْتُ فِيْهَا وَلاَ يَحْيَى ‘সেখানে তারা মরবেও না এবং বাঁচবেও না’ (ত্বোয়াহাঃ৭৪;

যে বৃহৎ আগুনে প্রবেশ করবে , তারপর সেখানে মরবেও না, বাঁচবেও না ৷আলাঃ১৩)।

এখানে নির্দিষ্টভাবে ‘কলিজা’ বলার কারণ হ’ল এই যে, এটিই হ’ল দেহের সবচেয়ে নরম স্থান এবং আগুন যখন কলিজায় পৌঁছে যায়, তখন মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ ঐ ব্যক্তি শাস্তির কঠোরতায় মৃত্যুর দুয়ারে উপনীত হবে। কিন্তু মরবে না, যাতে সে শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারে। আবার বাঁচবেও না যাতে সে স্বস্তি লাভ করে

 

إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ

৮) তা তাদের ওপর ঢেকে দিয়ে বন্ধ করা হবে

104:8) Verily it will close in upon them,

অর্থাৎ অপরাধীদেরকে জাহান্নামের মধ্যে নিক্ষেপ করে ওপর থেকে তা বন্ধ করে দেয়া হবে ৷ কোন দরজা তো দূরের কথা তার কোন একটি ছিদ্রও খোলা থাকবে না ৷

فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ

৯) (এমন অবস্থায় যে তা ) উঁচু উঁচু থামে (ঘেরাও হয়ে থাকবো )

104:9) in outstretched columns.

. ফি আমাদিম মুমাদ্দাদাহ এর একাধিক মানে হতে পারে ৷

যেমন এর একটি মানে হচ্ছে , জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে তার ওপর উঁচু উঁচু থাম গেঁড়ে দেয়া হবে ৷

এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে,এই অপরাধীরা উঁচু উঁচু থামের গায়ে বাঁধা থাকবে ৷

এর তৃতীয় অর্থ ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণনা করেছেন , এই আগুনের শিখাগুলো লম্বা লম্বা থামের আকারে ওপরের দিকে উঠতে থাকবে ৷

আবু হুরায়রা(রা) থেকে বর্ণিত। নবী(সঃ) বলেছেন—জাহান্নামের আগুন এক হাজার বছর প্রজ্বলিত করার পর তা লাল হয়ে যায়। অতঃপর এক হাজার বছর প্রজ্বলিত করার পর তা সাদা বর্ণ ধারন করে। পুনরায় এক হাজার বছর প্রজ্বলিত করার পর তা কালো রঙ ধারন করে। বর্তমানে তা কালো ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আছে।   তিরমিযীঃ ২৫২৯

মহান আল্লাহ আমাদের আমলকে সুন্দর করার ও তাঁর সন্তষ্টির বান্দাহ হিসাবে কবুল করে নিন।

sura-humaza-teaching

https://www.youtube.com/watch?v=grqR7MJS57o