তাফসির সূরা নসর

দয়াময় মেহেরবান আল্লাহর নামে

তাফসির সূরা নসর

সূরা নংঃ ১১০। আয়াত সংখ্যাঃ ৩

 

এ সূরাকে সূরা তাওদী‘ (التوديع) বা ‘বিদায় দানকারী’ সূরা বলা হয় (কুরতুবী)। কেননা এ সূরার মধ্যে রাসূল (সা)-এর চির বিদায়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।

সূরা নসর নাযিল হয়েছে মক্কা বিজয়ের প্রায় সোয়া দু’বছর পরে ১০ম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের সম্ভবত ১২ তারিখে মিনায় আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী সময়ে।

আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, যখন এ সূরা নাযিল হলো তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরাটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লেন। এবং বললেন, “মক্কা বিজয়ের পর আর কোন হিজরত নেই।” [মুস্তাদরাকে হাকিম: ২/২৫৭]

বিষয়বস্ত্ত :

মক্কা বিজয়ের পর আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গোত্রীয় প্রতিনিধিদল মদীনায় আসতে থাকে এবং দলে দলে মানুষ মুসলমান হতে থাকে, সেকথা বলা হয়েছে প্রথম দু’টি আয়াতে। অতঃপর উক্ত অনুগ্রহ লাভের শুকরিয়া স্বরূপ রাসূলের করনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করা এবং বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার করা, একথাগুলি বলা হয়েছে তৃতীয় অর্থাৎ শেষ আয়াতে।

গুরুত্ব :

(১) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) একবার ওবায়দুল্লাহ বিন ওৎবা (রাঃ)-কে বলেন, কুরআনের কোন সূরাটি সবশেষে নাযিল হয়েছে জানো কি? ওবায়দুল্লাহ বললেন, জানি, সূরা নসর। ইবনু আববাস (রাঃ) বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ’।মুসলিম হা/৩০২৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়।

(২) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, সূরাটি বিদায় হজ্জে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী সময়ে মিনায় নাযিল হয়। অতঃপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রসিদ্ধ ভাষণটি প্রদান করেন’ (বায়হাক্বী ৫/১৫২, হা/৯৪৬৪)।

(৩) ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় মিনাতে অত্র সূরাটি নাযিল হয়।

অতঃপর একই সময়ে নাযিল হয় ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার সেই বিখ্যাত

আয়াতটি اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِيْ وَرَضِيْتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِيْناً، ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য আমি ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। এটা ছিল রাসূল (সা)-এর মৃত্যুর ৮০ দিন পূর্বের ঘটনা। অতঃপর মৃত্যুর ৫০দিন পূর্বে নাযিল হয় কালালাহর বিখ্যাত আয়াতটি (নিসা ৪/১৭৬)। অতঃপর মৃত্যুর ৩৫ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা তওবাহর সর্বশেষ দু’টি আয়াত-

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ، فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ-

‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট যার উপরে কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু’। ‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও যে, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। তিনি মহান আরশের অধিপতি’ (তওবাহ ৯/১২৮-১২৯)। অতঃপর মৃত্যুর ২১ দিন    মতান্তরে ৭ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা বাক্বারাহর ২৮১ আয়াতটি-

وَاتَّقُواْ يَوْماً تُرْجَعُوْنَ فِيْهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُوْنَ-

‘আর তোমরা ভয় কর ঐ দিনকে, যেদিন তোমরা ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মফল পুরোপুরি পাবে। আর তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১; কুরতুবী, সূরা নছর)।

উপরের আলোচনায় একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, সূরা নসর কুরআনের সর্বশেষ পূর্ণাংগ সূরা হিসাবে বিদায় হজ্জের সময় নাযিল হয়েছে। এরপরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন আয়াত নাযিল হলেও কোন পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়নি।

(৪) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, একদিন ওমর (রাঃ) জ্যেষ্ঠ বদরী সাহাবীদের মজলিসে আমাকে ডেকে বসালেন। এতে অনেকে সংকোচ বোধ করেন। প্রবীণতম সাহাবী আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ (রাঃ) বলেন, أتسأله ولنا بنون مثله ‘আপনি ওকে জিজ্ঞেস করবেন? অথচ ওর বয়সের ছেলেরা আমাদের ঘরে রয়েছে’। ওমর (রাঃ) বললেন, সত্বর জানতে পারবেন’। অতঃপর তিনি সবাইকে সূরা নসরের তাৎপর্য জিজ্ঞেস করলেন। তখন সকলে প্রায় একই জওয়াব দিলেন যে, ‘এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, যখন বিজয় লাভ হবে, তখন যেন তিনি তওবা-ইস্তেগফার করেন’। এবার তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, إِنَّمَا هُوَ أَجَلُ رَسُوْل ِاللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَعْلَمَهُ إِيَّاهُ- ‘এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূলের মৃত্যু ঘনিয়ে আসার খবর দিয়েছেন’। অতঃপর বললাম, إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ ‘যখন এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ অর্থ فذلك علامة موتك ‘এটাতে আপনার মৃত্যুর আলামত এসে গেছে’। অতঃপর فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ ‘এক্ষণে তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর ও তওবা-ইস্তেগফার কর’।

এ ব্যাখ্যা শোনার পর ওমর (রাঃ) বললেন, تَلُوْمُوْنِىْ عَلَيْهِ؟ وَاللهِ مَا أَعْلَمُ مِنْهَا إِلاَّ مَا تَعْلَمُ– ‘আপনারা আমাকে এই ছেলের ব্যাপারে তিরষ্কার করছিলেন? আল্লাহর কসম! হে ইবনে আববাস! তুমি যা বলেছ, এর বাইরে আমি এর অর্থ অন্য কিছুই জানিনা।

বুখারী হা/৩৬২৭; তিরমিযী হা/৩৩৬২; কুরতুবী হা/৬৫০৯; ইবনু কাছীর।

তাফসীর :

 

(১) إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ

‘যখন এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও (মক্কা) বিজয়’।

‘আল্লাহর সাহায্য’ বলতে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধসমূহে আল্লাহর সাহায্য। যেমন বদর, ওহোদ, খন্দক, খায়বার প্রভৃতি যুদ্ধে। অতঃপর ‘বিজয়’ অর্থ ‘মক্কা বিজয়’ যা ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার সকালে সংঘটিত হয়েছিল। এখানে عطف الخاص على العام হয়েছে। অর্থাৎ সকল সাহায্য, বিশেষ করে মক্কা বিজয়।

বিজয় মানে কোন একটি সাধারণ যুদ্ধে বিজয় নয় বরং এর মানে হচ্ছে এমন একটি চুড়ান্ত বিজয় যার পরে ইসলামের সাথে সংঘর্ষ করার মতো আর কোন শক্তির অস্তিত্ব দেশের বুকে থাকবে না এবং একথাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, বর্তমানে আরবে এ দ্বীনটিই প্রাধান্য বিস্তার করবে।

ইমাম কুরতুবী বলেন, এখানে إِذَا অর্থ قَدْ অর্থাৎ جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ قَدْ ‘অবশ্যই এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ (কুরতুবী)। কেননা সূরা নসর নাযিল হয়েছে মক্কা বিজয়ের প্রায় সোয়া দু’বছর পরে ১০ম হিজরীর যিলহজ্জ মাসের সম্ভবত ১২ তারিখে মিনায় আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী সময়ে। সেকারণ إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ ‘যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’ এরূপ অর্থ করা ঠিক হবে না। তাছাড়া إِذَا হ’ল تحقيق বা নিশ্চয়তাবোধক অব্যয়, যা إِنْ -এর বিপরীত। কেননা إِنْ হ’ল সন্দেহ বা অনিশ্চয়তাবোধক অব্যয় (তানতাভী)।

 

إِذَا সাধারণত শর্তের অর্থ দেয়, যা ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হয়। যেমন রাসূল (সা) বলেন, وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ ‘যখন তুমি সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও’।আহমাদ, তিরমিযী হা/২৫১৬, মিশকাত হা/৫৩০২।

কিন্তু إِذَا ‘নিশ্চয়তা’ অর্থেও আসে, যা নিশ্চিতভাবে ঘটে গেছে ও ঘটছে। যেমন মসজিদে নববীতে জুম‘আর খুৎবারত অবস্থায় দেহিইয়াহ বিন খলীফা (তখন অমুসলিম ছিলেন) তবলা বাজাতে বাজাতে তার ব্যবসায়িক মালামাল নিয়ে মদীনায় উপস্থিত হন। তাতে আববাস ও ওমর (রাঃ) সহ মাত্র ১২ জন বাদে সব মুছল্লী দ্রুত বেরিয়ে যান। সে উপলক্ষে আয়াত নাযিল হয়, وَإِذَا رَأَوْا تِجَارَةً أَوْ لَهْوًا انْفَضُّوْا إِلَيْهَا وَتَرَكُوْكَ قَائِمًا ‘আর যখন তারা ব্যবসা বা খেল-তামাশা দেখল, তখন তারা তোমাকে দাঁড়ানো অবস্থায় রেখে সেদিকে ছুটে গেল’। জুম‘আ ৬২/১১; বুখারী হা/৪৮৯৯, মুসলিম, তিরমিযী হা/৩৩১১ প্রভৃতি।

এখানে إِذَا ভবিষ্যৎ অর্থে নয় বরং বর্তমান ও নিশ্চিত অর্থে এসেছে।

২) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجاً

‘এবং তুমি মানুষকে দেখছ তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে (ইসলামে) প্রবেশ করছে’।

মক্কা বিজয়ের পরের বছর অর্থাৎ ৯ম ও ১০ম হিজরীকে ইতিহাসে عام الوفود ‘প্রতিনিধি দলসমূহের আগমনের বছর’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐ সময় আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা দলে দলে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করছিল। আব্দুল ক্বায়েস গোত্র, ছাক্বীফ গোত্র, ইয়ামন, হামাদান, নাজরান, তাঈ, আশ‘আরী ও সর্বশেষ নাখ্ঈ গোত্রের প্রতিনিধিদল সহ জীবনীকারগণ ৭০-এর অধিক প্রতিনিধিদলের বর্ণনা দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের পরে দলে দলে ইসলাম কবুলের অন্যতম কারণ ছিল বিশ্বাসগত। কারণ লোকেরা তখন বলতে থাকলো, যে হারাম শরীফকে আল্লাহ্ হস্তীওয়ালাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন, সেই হারামের তত্ত্বাবধায়ক তার কওমের উপর যখন মুহাম্মাদ জয়লাভ করেছেন, তখন তিনি অবশ্যই সত্য নবী (إِنْ ظَهَرَ عَلَي قَوْمِهِ فَهُوَ نَبِىٌّ صَادِقٌ)। বুখারী হা/৪৩০২; ‘মাগাযী’ অধ্যায়; মিশকাত হা/১১২৬ ‘সালাত’ অধ্যায়-৪, ‘ইমামত’ অনুচ্ছেদ-২৬।

ইকরিমা ও মুক্বাতিল বলেন, وَرَأَيْتَ النَّاسَ বলতে ইয়ামনী প্রতিনিধিদলের দিকে (বিশেষভাবে) ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা এদের প্রায় সাতশো লোক মুসলমান হয়ে কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন পাঠ করতে করতে, কেউ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে মদীনায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। যাতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) খুবই খুশী হন। কিন্তু ওমর ও আববাস (রাঃ) কাঁদতে থাকেন।কুরতুবী ‘ইবনু আববাস’ এবং তানতাভী ‘আববাস’ বলেছেন। সম্ভবত আববাসই সঠিক।

ইকরিমা ইবনু আববাস হ’তে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ খুশী হয়ে বলেন, أَتَاكُمْ أَهْلُ الْيَمَنِ، أَضْعَفُ قُلُوْبًا وَأَرَقُّ أَفْئِدَةً، الْفِقْهُ يَمَانٍ، وَالْحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ– ‘ইয়ামনবাসীরা তোমাদের কাছে এসে গেছে। এদের অন্তর বড়ই দুর্বল, হৃদয় খুবই নরম। বুঝশক্তি ইয়ামনীদের এবং দূরদর্শিতা ইয়ামনীদের’। বুখারী হা/৪৩৯০, মুসলিম হা/৫২; মিশকাত হা/৬২৫৮; কুরতুবী হা/৬৫০৩।

 

অধিকাংশ প্রতিনিধিদলই খুশী মনে রাসূল (সা)-এর দরবারে এসে ইসলাম কবুল করতেন, কেউবা আগেই ইসলাম কবুল করে মদীনায় আসতেন, যাদের দেখে আল্লাহর রাসূল (সা) স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত আনন্দিত হ’তেন। কিন্তু দূরদর্শী সাহাবীগণ কেঁদে বুক ভাসাতেন, যেকোন সময়ে রাসূল (সা)-এর মৃত্যুর আশংকায়।

(৩) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً

‘তখন তুমি তোমার পালনকর্তার প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তাঁর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সর্বাধিক তওবা কবুলকারী’।

“সাব্বাহা” অর্থ গুণগান করা, পবিত্রতা বর্ণনা করা, প্রশংসা করা, মহিমা ঘোষণা করা, তসবীহ পাঠ করা। “সুবহান” অর্থ গুণগান, মহিমা, প্রশংসা, পবিত্র, মহান।

মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “আসমান সমূহে যা কিছু আছে, আর জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিপতি, অতি পবিত্র, পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা জুমুআহ্- ১)

অর্থাৎ سَبِّحْهُ تسبيحًا مقرونًا بالحمد ‘তুমি তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর’।

তাঁর পবিত্রতা তো বর্ণনা করছে সাত আকাশ ও পৃথিবী এবং তাদের মধ্যে যা কিছু আছে সব জিনিসই৷এমন কোনো জিনিস নেই যা তাঁর প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে না,কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমা কীর্তন বুঝতে পারো না৷ আসলে তিনি বড়ই সহিষ্ণু ও ক্ষমাশীল৷বনি ইসরাইলঃ ৪৪

পর্বতমালাকে আমি বিজিত করে রেখেছিলাম তার সাথে, ফলে সকাল সাঁঝে তারা তার সাথে আমার গুণগান, পবিত্রতা ও মহিমা প্রচার করতো৷  পাখপাখারী সমবেত হতো এবং সবাই তার তাসবীহ অভিমুখী হয়ে যেতো৷সূরা সাদঃ১৮-১৯

‘আর বজ্র তার সপ্রশংস তাসবিহ পাঠ করে।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ১৩)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, বজ্রধ্বনি শুনতে পেলে আলাপ-আলোচনা বন্ধ করে দিয়ে বলতেন, ‘মহাপবিত্র সেই সত্তা বজ্রধ্বনি যাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং ফেরেশতাকুল যার ভয়ে শঙ্কিত।’ অতঃপর তিনি বলতেন, এটা হলো জগত্বাসীর জন্য চরম ভীতি প্রদর্শন বা হুমকি। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস : ৭২৮)

আবু যর রাঃ বলেন, আমাকে রাসূল (সাঃ) বলেন, তুমি কি জানো, সূর্য কোথায় যায়? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন। তিনি বললেন, এটা যায় আরশের নীচে, তারপর আরশের নীচে সিজদাহ করে। অতপর অনুমতি গ্রহন করে। অচিরেই এমন সময় আসবে তাকে যখন বলা হবে, যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও। (সহীহ বুখারী, হা- ৩১৯৯)

তুমি আরো দেখতে পাবে যে, ফেরেশতারা আরশের চারদিক বৃত্ত বানিয়ে তাদের রবের প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছে৷ মানুষের মধ্যে ইনসাফের সাথে ফায়সালা করে দেয়া হবে এবং ঘোষণা দেয়া হবে, সারা বিশ্ব-জাহানের রবের জন্যই সমস্ত প্রশংসা৷যুমারঃ৭৫

আর ফেরেশতারা তাদের রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করে এবং পৃথিবীতে যারা আছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে; জেনে রেখো, আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা : শুরা: ৫)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত, একটি পিঁপড়া নবীকুলের কোনো নবীকে কামড়ে দিলে তিনি পিঁপড়ার বাসা সম্পর্কে বিশেষ হুকুম দিলেন, ফলে তা জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। তখন আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে এই মর্মে ওহি পাঠালেন যে একটি (মাত্র) পিঁপড়া তোমাকে কামড়ে দিল, তাতে কিনা তুমি উম্মত ও সৃষ্টিকুলের এমন একটি দলকে জ্বালিয়ে দিলে, যারা তাসবিহ পাঠ করছিল? (মুসলিম, হাদিস : ৫৬৫৪)

‘তাসবীহ’ অর্থ تنزيه الله تعالى عما لا يليق بشأنه ‘আল্লাহর মর্যাদার উপযুক্ত নয়, এমন সব কিছু থেকে তাঁকে পবিত্র করা’।

‘হামদ’ অর্থ الثناء على الله بالكمال مع المحبة والتعظيم ‘ভালবাসা ও সম্মান সহকারে পূর্ণভাবে আল্লাহর প্রশংসা করা’। অত্র আয়াতে পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনাকে একত্রিত করা হয়েছে। এটি হ’ল আল্লাহর প্রথম নির্দেশ।

আমরা কোন কারণে আল্লাহর প্রশংসা করব? উত্তরে আলেমরা বলেছেন, দুই কারণে আল্লাহর প্রশংসা করতে হবে।

এক. আল্লাহতায়ালা বিশেষ গুণ ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।

দুই. তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহকারী।

وَقُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ

“বল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই।” (সূরা ইসরা ১১১ আয়াত)

وَآخِرُ دَعْوَاهُمْ أَنِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

“তাদের শেষ বাক্য হবে, আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন (সমস্ত প্রশংসা সারা জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য)।” (সূরা ইউনুস ১০ আয়াত)

তিনিই এক আল্লাহ যিনি ছাড়া ইবাদাতের আর কোন হকদার নেই৷ তাঁরই জন্য প্রশংসা দুনিয়ায়ও, আখেরাতেও৷ শাসন কর্তৃত্ব তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে৷   (সূরা কাসাস :৭০)।

যদি ভূ-পৃষ্ঠের গাছ-গাছালি সব কলম হয়ে যায় এবং সাগরের সাথে আরও সাত সাগর মিলে কালি হয়ে যায়, তবু আল্লাহর মহিমাকীর্তন শেষ হবে না।’ (লুকমান : ২৭),

হজরত সামুরা ইবনে জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘শ্রেষ্ঠ বাক্য হচ্ছে ৪টি-

সুবহানাল্লাহি; ওয়ালহামদুলিল্লাহি; ওয়া লাই ইলাহা ইল্লাল্লাহু; ওয়াল্লাহু আকবার।

অর্থ : ‘আল্লাহ পবিত্র; আল্লাহর জন্য প্রশংসা; আল্লাহ ব্যতিত কোনো মাবুদ নেই এবং আল্লাহ সর্বাপেক্ষা মহান।’

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘উল্লেখিত ৪টি বাক্য আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। এর যে কোনোটি তুমি বলবে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। (মুসলিম)

অতঃপর দ্বিতীয় নির্দেশটি হ’ল, ইস্তিগফার কর।

‘ইস্তিগফার’ অর্থ طلب المغفرة ক্ষমা প্রার্থনা করা।

আর ‘মাগফিরাত’ অর্থ ستر الله تعالى على عبده ذنوبه مع مَحْوِهَا والتجاوز عنها ‘পাপ দূরীকরণ ও ক্ষমার মাধ্যমে বান্দার পাপসমূহের উপর আল্লাহর পর্দা আরোপ করা’। বস্ত্ততঃ বান্দার এটাই সবচেয়ে বড় চাওয়া। কেননা বান্দা সর্বদা ভুলকারী। আল্লাহ যদি তাকে দয়া না করেন, তাহ’লে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।

যেমন রাসূল (সা) বলেন, لَنْ يُنَجِّىَ أَحَدًا مِنْكُمْ عَمَلُهُ. قَالُوا وَلاَ أَنْتَ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ وَلاَ أَنَا، إِلاَّ أَنْ يَتَغَمَّدَنِىَ اللهُ بِرَحْمَتِهِ ‘তোমাদের কেউ তার আমলের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। সাহাবীগণ বললেন, আপনিও নন হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, না। যদি না আল্লাহ আমাকে তাঁর রহমত দ্বারা আবৃত করেন’।বুখারী হা/৬৪৬৩; মুসলিম হা/২৮১৬; মিশকাত হা/২৩৭১ ‘দু‘আ সমূহ’ অধ্যায়, ৫ অনুচ্ছেদ।

ইমাম কুরতুবী বলেন, الاستغفار تعبُّد يجب إتيانه، لا للمغفرة، بل تعبُّدا ‘ক্ষমা প্রার্থনা হ’ল দাসত্ব প্রকাশ করা, যা আল্লাহর নিকটে পেশ করা ওয়াজিব। ক্ষমার জন্য নয় বরং দাসত্ব প্রকাশের জন্য’ (কুরতুবী)। অর্থাৎ রাসূল (সা)-এর ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ আল্লাহর প্রতি অধিকহারে বিনয় ও দাসত্ব পেশ করা।

তিনি বলেন, এর মধ্যে তাঁর উম্মতের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যেন তারা শংকাহীন না হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা ছেড়ে না দেয়। তিনি বলেন, নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও যখন আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশ দিয়েছেন, তখন অন্যদের কেমন করা উচিত? (কুরতুবী)।

কয়েকটি মাসনূন বাক্য উল্লেখ করছি:

১।أَستَغْفِرُ اللهَ

উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হ। অর্থ: আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সুনানু তিরমিযী, ৩০০। হাদীসটি সহীহ।

২।

أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ

উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হা ওয়া আতূবু ইলাইহি।

অর্থ : আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর দিকে ফিরে আসছি।সহীহ মুসলিমঃ১১১৬।

৩। رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ (أنْتَ) التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ (الغَفُوْرُ)

উচ্চারণ : রাব্বিগ্ ফিরলী, ওয়া তুব ‘আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত তাওয়া-বুর রাহীম। দ্বিতীয় বর্ণনয় “রাহীম”-এর বদলে: ‘গাফূর’।

অর্থ: “হে আমার প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী করুণাময়। দ্বিতীয় বর্ণনায়: তাওবা কবুলকারী ও ক্ষমাকারী।”

সুনানু ইবনে মাজাহঃ৩৮১৪; সুনানু তিরমিযীঃ ৩৪৩৪। হাদীসটি সহীহ।

৩। (৩ বার)

أَسْتَغْفِرُ اللهَ (الْعَظِيْمَ) الَّذِيْ لاَ إلهَ إِلاَّ هُوَ الحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ

উচ্চারণ : আসতাগফিরুল্লা-হাল্ (‘আযীমাল্) লাযী লা- ইলা-হা ইল্লা- হুআল ‘হাইউল কাইঊমু ওয়া আতূবু ইলাইহি।

অর্থ: “আমি মহান আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও সর্ব সংরক্ষক, এবং তাঁর কাছে তাওবা করছি।”সুনানে আবু দাউদঃ ১৫১৭। হাদীসটি সহীহ।

৪। (সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার)

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لا إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِيْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِيْ فَاغْفِرْ لِيْ فَإِنَّهُ لاَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ

উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, আনতা রাব্বী, লা- ইলা-হা ইল্লা- আনতা, খালাক্বতানী, ওয়াআনা ‘আবদুকা, ওয়াআনা ‘আলা- ‘আহদিকা ওয়াওয়া‘অ্দিকা মাস তাতা‘অ্তু। আ‘ঊযু বিকা মিন শাররি মা- স্বানা‘তু, আবূউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়্যা, ওয়াআবূউ লাকা বিযামবি। ফাগ্ফিরলী, ফাইন্নাহু লা- ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা- আনতা।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আপনি আমার প্রভু, আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনার বান্দা। আমি আপনার কাছে প্রদত্ত অঙ্গিকার ও প্রতিজ্ঞার উপরে রয়েছি যতটুকু পেরেছি। আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমি যে কর্ম করেছি তার অকল্যাণ থেকে। আমি আপনার কাছে প্রত্যাবর্তন করছি আপনি আমাকে যত নিয়ামত দান করেছেন তা-সহ এবং আমি আপনার কাছে প্রত্যাবর্তন করছি আমার পাপ-সহ। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না।” সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৩০৬।

কুরআন কারীমে মুমিনগণকে বারবার তাওবা ও ইসতিগফার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাওবা ও ইসতিগফারের জন্য ক্ষমা, পুরস্কার ও মর্যাদা ছাড়াও জাগতিক উন্নতি ও বরকতের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়াও ইস্তিগফারের অতিরিক্ত মর্যাদা ও সাওয়াব রয়েছে।

আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ  বলেছেন :

وَاللهِ إِنِّي لأَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ فِي الْيَوْمِ أَكْثَرَ مِنْ سَبْعِينَ مَرَّةً.

“আল্লাহর কসম! আমি দিনের মধ্যে ৭০ বারেরও বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং তাওবা করি।” বুখারী (৮৩-কিতাবুদ দাআওয়াত, ৩-বাব ইসতিগফারিন নাবিয়্যি) ৫/২৩২৪

 

ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এর অর্থ فصل حامدا له على ما آتاك من الظفر والفتح وسل الله الغفران ‘আল্লাহ তোমাকে যে সফলতা ও বিজয় দান করেছেন, সেজন্য আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর (কুরতুবী)। অর্থাৎ দ্বীন পূর্ণতা লাভ করেছে এবং মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। এখন তোমার গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নেই। অতএব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাসবীহ পাঠ কর ও ইস্তিগফার কর।

এখানে মক্কা বিজয়কে অধিক গুরুত্ব দেবার কারণ,

প্রথমতঃ এটা হ’ল আল্লাহর ঘর। যা ছিল তাওহীদের কেন্দ্রবিন্দু এবং যা ছিল ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ)-এর হাতে নির্মিত আল্লাহর ইবাদতগৃহ। অথচ সেটি শিরকের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

দ্বিতীয়তঃ আরবরা ভাবত, বায়তুল্লাহর অধিকারীরাই أهل الله বা আল্লাহওয়ালা। যাদেরকে আল্লাহ আবরাহা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। অতএব কা‘বাকে শিরকমুক্ত করা এবং মানুষের ভুল বিশ্বাস ভেঙ্গে দেবার স্বার্থে মক্কা বিজয় খুবই জরূরী ছিল।

تَوَّابٌ -এর ওযন فَعَّالٌ যা اسم فاعل مبالغة যার দ্বারা কর্তার কর্মে আধিক্য বুঝানো হয়। এটি আল্লাহ ও বান্দা উভয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

বান্দার ক্ষেত্রে হ’লে অর্থ হবে ‘আল্লাহর প্রতি অধিক তওবাকারী (التائب إلى الله) ’ এবং আল্লাহর ক্ষেত্রে হ’লে অর্থ হবে ‘বান্দার তওবা অধিক কবুলকারী (التائب على العبد) ’। এক্ষণে إِنَّهُ كَانَ تَوَّاباً অর্থ لم يزل عز وجل تواباً على عبده، إذا استغفره ‘আল্লাহ সর্বদা বান্দার তওবা কবুলকারী, যখনই সে তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে’।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, সূরা নসর নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (সা) এমন কোন সালাত আদায় করেননি, যেখানে রুকূ ও সিজদায় নিম্নের দো‘আটি পাঠ করেননি

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْلِىْ ‘সকল পবিত্রতা তোমার হে আল্লাহ, তুমি আমাদের পালনকর্তা, তোমার জন্যই সকল প্রশংসা, হে আল্লাহ তুমি আমাকে ক্ষমা কর’।বুখারী হা/৭৯৪, মুসলিম/৪৮৪; মিশকাত হা/৮৭১; কুরতুবী হা/৬৫০৭।

এতদ্ব্যতীত বুখারী, মুসলিম, আহমাদ প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বহু দু‘আ বর্ণিত হয়েছে, যার মাধ্যমে তিনি আল্লাহর নিকটে নিজের দীনতা প্রকাশ করতেন এবং তাঁকে যে পুরস্কার আল্লাহ দান করেছেন, তার কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জ্ঞাপন করতেন।

রাসূল (সা)-এর তো আগে-পিছে সব গোনাহ মাফ, এমতাবস্থায় তাঁকে ক্ষমা প্রার্থনার হুকুম দেওয়ার অর্থ কি? এরূপ প্রশ্ন একবার আয়েশা (রাঃ) করলে তার জওয়াবে রাসূল (সা) বলেছিলেন,

أَفَلاَ أَكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا ؟ ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না’? [বুখারী হা/১১৩০, মুসলিম হা/২৮১৯-২০; মিশকাত হা/১২২০ ‘সালাত’ অধ্যায়, ‘রাত্রি জাগরণে উৎসাহ দান’ অনুচ্ছেদ-৩৩।

অন্য হাদীসে এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সা) দৈনিক একশো বার তওবা- ইস্তেগফার করতেন ও নিম্নের দো‘আটি পাঠ করতেন-

أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ

‘আস্তাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়াল হাইয়ুল ক্বাইয়ূমু ওয়া আতূবু ইলাইহে’ (আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক এবং আমি তাঁর দিকেই ফিরে যাচ্ছি (বা তওবা করছি)।তিরমিযী, আবুদাঊদ হা/১৫১৭, মিশকাত হা/২৩৫৩, ‘দু‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৯, অনুচ্ছেদ –৪; সহীহাহ হা/২৭২৭।

সারকথা :

আল্লাহর রহমত লাভের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতে হবে। অতঃপর আল্লাহর সাহায্য লাভ করলে তাঁর প্রতি অধিকতর অনুগত ও ক্ষমাপ্রার্থী হ’তে হবে।

সফলতা বা বিজয়ের পর মহান রাব্বুল আলামিন তিনটি কর্মসুচি এই সুরায় ঘোষণা করেছেন।

সেগুলো হল: ১.ফাসাব্বিহ, (আল্লাহর তাসবিহ পাঠ তথা পবিত্রতা বর্ণনা করা) পাঠ করা।

২. বিহামদী রাব্বিক, (আল্লাহর হামদ তথা শুকরিয়া) আদায় করা।

৩. ওয়াসতাগফীর, ( ভুলভ্রান্তি তথা সীমালংঘন থেকে রবের কাছে ক্ষমা চাওয়া) প্রার্থনা করা।

মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

( সংগৃহিতঃ তাফসিরে যাকারিয়া , আহসানুল বয়ান ও তাফহিমুল কুর’আন )