কোন মা-বাবাই সন্তানদেরকে উত্তম আদব-কায়দা ও স্বভাব-চরিত্র শিক্ষাদান অপেক্ষা ভাল কোন দান দিতে পারে না। তিরমিযী শরীফ
সন্তানকে বাস্তব অবস্থা দিয়ে শেখাতে পারাটা সবচেয়ে উপকারী এবং তার স্থায়ীত্ব অনেক দূর। ছোট শিশুটি কিন্তু খেয়াল করে তার মা বাবা বা ভাই বোন অথবা পরিবারের অন্য সদস্যরা কে কিভাবে আচরন করে।
সবার আগে নিজকে গড়ো এই নীতিকে সামনে রেখে চলতে হবে। কোন একটা অপছন্দনীয় কাজ হলে আপনার আচরন যদি সুন্দর ভাবে তা ম্যানেজ করা হয় তাহলে সেই সন্তানটিও জীবনের এইরকম অবস্থায় অস্থিরতার পরিচয় দিবে না। অনেক পরিবারে দেখা যায় –কাজের পরিচারিকাটিকে পানি বা একটা কিছু আনতে বললে একটু দেরী হলে সেই সন্তানটি ভয়ানক রাগ প্রকাশ করে, এটা কিন্তু পরিবারে আপনার বা কারো সেই পরিচারিকার প্রতি আচরন থেকে শেখা। তাই সেই অবস্থায় আপনি যদি সুন্দরের আদর্শ -বাস্তবে দেখাতে পারেন তাহলে সেই সন্তানটিকে শেখাতে পারবেন,তা না হলে শেখানো সম্ভব না।
আবার অনেক পিতারা অতীতে নিজেদের বাবাদের সাথে সম্পর্কের ধরনকে উদাহরন হিসেবে নিয়ে, সন্তানের সাথে আচরন করে থাকেন, ফলে এই প্রজন্মের সন্তানেরা আরো দূরে চলে যায়। নির্মল সুন্দর আচরন না পেলে এই সন্তানটিও একসময় সেই রকম আচরন করা শিখে যায়, এমনকি একটু বড় হয়ে পিতা মাতার সাথেই এই আচরন দেখা যায়, যা অত্যন্ত দুখঃজনক। তখন পিতা মাতা সন্তানকে আরো বকা ঝকা করা শুরু করেন, অথচ এই আচরনের শুরু কিন্তু আপনি মা বাবা করে দিয়েছিলেন। আবার অনেক পিতাকে মায়ের সাথে খারাপ বা অভদ্র আচরন করতে দেখে বা কোন ক্ষেত্রে মাকে বাবার সাথে অপ্রত্যাশিত আচরন করতে দেখেও অন্তরে ধারন করে রাখে, সময়মত সেটার প্রতিফলন দেখা যায়। তাই নিজেদেরকে আদর্শ হিসেবে সামনে আনতে হবে। আপনি মা, আপনি সুন্দর শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যান, ইন শা আল্লাহ আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন।
পবিত্র কোর’আনে সন্তানকে কি শিক্ষা দিবেন সুন্দর করে আল্লাহতা’আলা শিখিয়ে দিয়েছেন।
বিশেষ ব্যক্তিত্ব লোকমান(আঃ) যেভাবে শিখিয়ে ছিলেন তার সন্তানকে তার উল্লেখ করেই আল্লাহ বলেছেন।
স্মরণ করো যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল, সে বললো,
১। হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম ৷
২। আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার হক চিনে নেবার জন্য নিজেই তাকিদ করেছি ৷ তার মা দুর্বলতা সহ্য করে তাকে নিজের গর্ভে ধারণ করে এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়তে ৷ (এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং নিজের পিতা-মাতার প্রতিও, আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে ৷
কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যাকে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না৷ দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচার করতে থাকো কিন্তু মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে ৷ তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে ৷ সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তা আমি তোমাদের জানিয়ে দেবো ৷
৩। (আর লুকমান বলেছিল ) “ হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে , আকাশে বা পৃথিবীতে কোথাও, তাহলে আল্লাহ তা বের করে নিয়ে আসবেন ৷ তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন ৷
৪। হে পুত্র! নামায কায়েম করো,
সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং
যা কিছু বিপদই আসুক সে জন্য সবর করো ৷ একথাগুলোর জন্য বড়ই তাকিদ করা হয়েছে ৷
৫। আর মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলো না,
পৃথিবীর বুকে চলো না উদ্ধত ভঙ্গিতে, আল্লাহ পছন্দ করেন না আত্মম্ভরী ও অহংকারীকে ৷
৬। নিজের চলনে ভারসাম্য আনো এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো ৷
সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ ৷ সূরা লোকমান (১৩-১৯)
এই পয়েন্ট গুলোকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বাস্তবতার সাথে সন্তানকে শেখাতে পারলে ইনশাআল্লাহ আমাদের সন্তান গড়ে উঠবে সুন্দর করে।
https://www.youtube.com/watch?v=SleD4AMw1is
রাসূল(সঃ) তার কন্যা ফাতিমা(রাঃ)-র দুই ছেলের একজনকে কোলে করে বাইরে এলেন। তখন তিনি বলেন-(সন্তানের মহব্বতে) তোমরাই কৃপনতা, কাপুরুষতা ও অজ্ঞতার কারণ হও। তোমরা হলে আল্লাহর বাগানের সুগন্ধ ফুল। তিরমিযী: ১৮৬০
রাসূল(সঃ) বলেছেন—যে ব্যক্তি আমাদের ছোটদের স্নেহ করে না, বড়দের সম্মান করে না, সৎ কাজের নির্দেশ দেয় না এবং অসৎ কাজে বাধা দেয় না সে আমাদের নয়। তিরমিযীঃ ১৮৭১
নবী (সঃ) হাসান অথবা হুসাইনকে চুমু খেয়েছেন। আল-আকরা(রা) বলেন, আমার দশটি সন্তান আছে কিন্তু আমি কখনও তাদের কাউকে চুমু খাইনি। রাসূল(সঃ) বলেন—যে লোক দয়া-অনুগ্রহ করে না সে দয়া-অনুগ্রহপ্রাপ্ত হয় না। বুখারী, তিরমিযী: ১৮৬১
আদরের সাথে শেখানো—অনেকে দেখা যায় নিজের পরিবারের বাইরের পরিবেশে খুব ভালো ব্যবহার ও সুন্দর করে অনেক কিছু শেখান কিন্তু পরিবারের মাঝে তা দেখা যায় না। অথচ পরিবারের হক সবচেয়ে বেশী। পরিবারেই ধৈর্যের আসল প্রশিক্ষন হয়। সন্তানদের মাঝে ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা দেখানো প্রয়োজন। তাহলে তারাও শিখবে।
সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি সে যে পরিবারে উত্তম।
জানার আগ্রহ বাড়ে এমনভাবে উদাহরনসহ শেখানো
বড়দের সাথে একসাথে বসার সুযোগ দেয়া মাঝে মাঝে।
পরিবারে তাদের গুরুত্ব আছে এটা বুঝতে দেয়া—মাঝে মাঝে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যপারে তাদের সাথে পরামর্শ করা।
পরিবারের সদস্যরা একসাথে বাইরে বেড়াতে যাওয়া—নিজেদের মধ্যে বন্ধন বাড়ে। অনেকে এই ভুলটা করেন যে, নিজেরা বাইরে বেড়াতে যান, সন্তান হয়তো কম্পিউটারে খেলবে বা মুভি দেখবে বা খেলা করার জন্য মা বাবার সাথে যেতে চায় না, আর তখন পিতামাতারাও সহজেই তাদের সুযোগ করে দেয়, ফলে একসময় আর যেতেই চায় না। সন্তানকে বুঝতে দিতে হবে যে, তাকে ছাড়া মা বাবা বাইরে যেতে ভালো লাগে না, তাকে ছাড়া আপনারা যাবেন না। এমনভাবে পরিস্থিতি করা প্রয়োজন যে সেই সন্তান তার নিজের মূল্যায়ন বুঝতে পারে, এইভাবেই সম্পর্কের ভিত সুন্দর হবে।
প্রশংসা করা-–ভালো কাজের জন্য। কখনোই কটাক্ষ না করে ভালো কাজের জন্য মাঝে মাঝে পুরস্কৃত করা।
অন্যের কাছে বা সামনে তাকে হেয় না করা—এটা মহিলাদের আলোচনায় খুব বেশী দেখা যায়, অন্যদের কাছে নিজের সন্তানের দোষ ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা-তাতে গীবতের গুনাহ এবং সন্তান মানসিকভাবে ছোট হয়ে যায়।
খেলাধূলায় উৎসাহদান করা– কম্পিউটারে বা মুবাইলে বা অন্য কোন ডিবাইসে গেইম না খেলতে দিয়ে শারিরীক ব্যায়াম বা নড়া চড়া হয় এমন খেলা দিয়ে আনন্দ দেয়া।
এটা মনে রাখা দরকার যে এই কাজগুলোকে অনেকে বেহুদা মনে করে কাজের পরিচারিকার কাছে দিয়ে নিজে অন্য কাজে চলে যান, এটা ঠিক নয় সবসময়ের জন্য। মাঝে মাঝে আপনি এইভাবে জরুরী কাজ থাকলে অন্যের কাছে দিতে পারেন, তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যার কাছে দিচ্ছেন,তার চারিত্রিক পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে।
এখানে বুঝার জন্য একটি ঘটনা বলছি। আমার এক কলিগ তার ৮মাসের শিশু ছেলের জন্য একজন ১৪-১৫ বছরের মেয়ে পরিচারিকা রেখেছিল, সেই মেয়েটি শিশুটির সাথে খেলা করতো। খেলা করতো শিশুটির প্রাইভেট অংগটি নিয়ে, যা ভয়ানক।
আরো অনেক ঘটনাই শুনা যায়। তাই ইসলামের শরীয়ার বিষয়গুলো নিয়ে জানা ও গুরুত্ব সহকারে মানা প্রয়োজন।
সন্তানকে গড়তে যেয়ে যে সময়টি আপনি মা হিসেবে দিবেন তা খেলা হলেও ইবাদাত।