স্বামীর পিতা মাতার প্রতি ছেলের বউয়ের দায়িত্ব কতটুকু?

আসসালামু’আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ

একটি প্রশ্ন অনেকেই বারে বার করছিলো, আমি এই বিষয়টি নিয়ে লিখতে চাই নি  কারন নেটে অনেক লেখা লেখি হয় এটা নিয়ে। এতোদিনে বিষয়টি বুঝে এসে যাওয়ার কথা। তারপরেও সংক্ষেপে লিখলাম মূল কথাটি।

আমাদের সমাজে আজ তরুনীদের মাঝে একটি প্রশ্ন খুব শুনা যায়, আর তা হলো স্বামীর পিতা মাতার প্রতি ছেলের বউয়ের দায়িত্ব কতটুকু?

আবার অন্যদিকে স্বামীর পিতা মাতা ভাবেন, ছেলের বউ এর দায়িত্ব থাকবে না কেনো? আমরা করে আসছি না!

মহান আল্লাহ আমাদের সকলকেই সঠিন জ্ঞান ও আমলের উপর সুদৃঢ় করে দিন।

পরিবার মহান আল্লাহর দেয়া এক অন্যতম নি’আমত। আর পরিবারের সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক আরো শান্তিদায়ক যা দুনিয়াতেই সুখ অনুভূত হয়।

প্রতিটি মানুষেরই নারী পুরুষ সকলেরই মহান রবের বান্দা হিসেবে কিছু করনীয় রয়েছে। এই করনীয় রবের প্রতি ও রবের অন্য সৃষ্টির প্রতি। অন্য সৃষ্টির মাঝে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ যাদের সাথে চলতে হয় যেমন পরিবার ও সমাজ(আত্মীয় প্রতিবেশী ও অন্যান্য) তাদের প্রতিও।

মানুষের প্রতি মানুষের করনীয় বলতে দুই ধরনের অবস্থা চলে আসে।

১। যে করনীয় বাধ্যতামূলক-যার জন্য মহান রবের দরবারে জবাবদিহীতা রয়েছে

২। যে করনীয় ঐচ্ছিক- যার জন্য জবাবদিহীতায় দাঁড়াতে হবে না, করলে কল্যান না করলে শাস্তি নাই তবে কল্যান থেকে নিজে বঞ্চিত থাকে।

একজন  বউ ও স্বামীর পিতা মাতার পারস্পরিক ব্যপারটা হলো ২য় প্রকার অর্থাৎ ঐচ্ছিক।

একজন ছেলে ও একজন মেয়ের যার যার পিতা মাতার প্রতি করনীয় হলো ১ম প্রকার অর্থাৎ বাধ্যতামূলক। তবে এইক্ষেত্রে একজন মেয়ের ব্যাপার কিছুটা শিথিল আছে কারন সে নিজের সংসারের প্রতি বাধ্যতামূলক।

স্ত্রী তার স্বামী-গৃহের দায়িত্বশীল এবং তাকে তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (সহীহ বুখারী: ২৫৫৪; সহীহ মুসলিম,: ৪৮২৮) অর্থাৎ স্বামীগৃহের হেফাজত করা, মালামালের প্রতি দৃষ্টি রাখা ও সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ করা তার দায়িত্ব। এটা কুরআন মাজীদের আয়াতেরই ব্যাখ্যা। তাতে ইরশাদ হয়েছে

حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ

 

অর্থাৎ আল্লাহ স্বামীদের উপর তাদের অন্ন-বস্ত্র ও বাসস্থানের দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের যে হেফাজতের ব্যবস্থা করেছেন তজ্জন্য তারাও স্বামীদের অনুপস্থিতিতে ঘর-সংসার, সন্তান-সন্তুতি ও নিজ সতিত্বের হেফাজতকারিনী হবে। (নিসা : ৩৪)

একজন নারী ও পুরুষের যখন বিয়ে হয় তখন এই আয়াতটি মনে রাখা প্রয়োজন, আর তা হলো–

সেই আল্লাহকে ভয় করো যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছ থেকে নিজেদের হক আদায় করে থাকো এবং আত্মীয়তা ও নিকট সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকো৷ নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ তোমাদের ওপর কড়া নজর রেখেছেন৷ সূরা নিসাঃ১

এই আয়াতে একজন নারী ও পুরুষের উভয়ের দুপক্ষের আত্মীয় সম্পর্ক রক্ষার তাগিদ দেয়া হয়েছে। একজন নারী যেমন স্বামীর আত্মীয়দের ব্যপারে সচেতন থাকবে তেমনি একইভাবে একজন পুরুষ তার স্ত্রীর আত্মীয়ের ব্যাপারেও সচেতন থাকবেন যেনো সুসম্পর্ক বজায় থাকে।

 

আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, قَالَ اللهُ : أَنَا اللهُ وَأَنَا الرَّحْمَنُ خَلَقْتُ الرَّحِمَ وَشَقَقْتُ لَهَا مِنَ اسْمِى فَمَنْ وَصَلَهَا وَصَلْتُهُ وَمَنْ قَطَعَهَا بَتَتُّهُ- ‘আল্লাহ বলেছেন, আমি আল্লাহ, আমি রহমান। আমিই রেহেম সৃষ্টি করেছি। আমি ‘রেহেম’ শব্দটিকে আমার ‘রহমান’ নাম থেকে নিঃসৃত করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ় রাখবে, আমি তার সাথে যুক্ত থাকব। আর যে ব্যক্তি সেটা ছিন্ন করবে, আমি তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিব’। তিরমিযী হা/১৯০৭; আবুদাঊদ হা/১৬৯৪

আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ الرَّحِمَ سُجْنَةٌ مِنَ الرَّحْمَنِ ‘রেহেম শব্দটি রহমান থেকে নিঃসৃত। সেকারণ আল্লাহ বলেছেন,…। বুখারী হা/৫৯৮৮; মিশকাত হা/৪৯২০।

আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, الرَّحِمُ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ ‘রেহেম আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত। সে বলে, যে আমাকে নিজের সাথে যুক্ত রাখবে, আল্লাহ তাকে যুক্ত রাখবেন। আর যে আমাকে ছিন্ন করবে, আল্লাহ তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন’। মুসলিম হা/২৫৫৫; মিশকাত হা/৪৯২১।

বু উমামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ثَلاَثَةٌ لاَ يُقْبَلُ مِنْهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَرْفٌ وَلاَ عَدْلٌ: عَاقٌّ وَمَنَّانٌ وَمُكَذِّبٌ بِقَدْرٍ- ‘তিনজন ব্যক্তির কোন দান বা সৎকর্ম আল্লাহ কবুল করেন না : পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, খোটা দানকারী এবং তাক্বদীরে অবিশ্বাসী ব্যক্তি’। ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৫৪৭; ছহীহাহ হা/১৭৮৫

প্রতিটি সন্তানকে নিজ নিজ পিতা মাতার ব্যাপারে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে যেনো পিতা মাতার সন্তুষ্টি পেতে পারে কারন—

তুমি তোমার মায়ের সেবা কর। فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا ‘কেননা জান্নাত তার দু’পায়ের নীচে’ (নাসাঈ হা/৩১০৪)।

আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,رِضَى الرَّبِّ فِى رِضَى الْوَالِدِ وَسَخَطُ الرَّبِّ فِى سَخَطِ الْوَالِدِ ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পিতার ক্রোধে আল্লাহর ক্রোধ’।তিরমিযী হা/১৮৯৯; মিশকাত হা/৪৯২৭; ছহীহাহ হা/৫১৬।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, তার নাক ধূলি ধূসরিত হৌক (৩ বার)। বলা হ’ল, তিনি কে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার পিতা-মাতা উভয়কে কিংবা একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল, অথচ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না’। মুসলিম হা/২৫৫১; মিশকাত হা/৪৯১২

একজন পুরুষ যেমন স্ত্রীকে বাধ্য করতে পারবেন না নিজ পিতা মাতা ভাই বোনদের সেবা করার জন্য আবার একজন স্ত্রীকেও বুঝতে হবে স্বামীর খুশি ও জান্নাত নির্ভর করছে স্বা্মীর পিতা মাতার সেবা করার সাথে,তাহলে স্ত্রী সহযোগীতা করলেই সহজ হতে পারে স্বা্মীর জন্য সেই ভূমিকা রাখা, উপরন্ত স্বা্মীর জন্য স্ত্রী ও নিজ(স্বা্মী) বাবা মার সেবা হক আদায় বাধ্যতামূলক,যা একমাত্র স্ত্রী ও পিতা মাতার(স্বা্মীর) সহযোগীতায় স্বা্মীর জন্য ভারসাম্যপূর্ণভাবে করতে সক্ষম।

পরিবারের শান্তি কখনোই যোগ বিয়োগের হিসেব কষে আনা যায় না। এখানে প্রত্যেককেই নিজ নিজ আচরন ভূমিকা দায়বদ্ধতার কথা স্মরন রেখেই সুসম্পর্ক রেখে চলার ইচ্ছা ও বাস্তব আমল করতে হবে কারন মহান রবের কাছে আমরা সকলেই হাযির হবো নিজ নিজ কৃতকর্ম হিসেব নিকেষের জন্য।অন্যে কি করলো কি করলো না তা দিয়ে কিন্তু নিজকে মুক্ত করতে পারবে না। তাই মহান রবের সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় সামর্থ অনুযায়ী ও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভূমিকা রাখার জন্য সচেষ্ট থাকাই বুদ্ধিমান মুমিন ও মুমিনার জন্য প্রয়োজন।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-

ভালো ও মন্দ সমান নহে। তুমি অন্যায় ও মন্দকে দূর কর সেই ভালো দ্বারা যা অতীব উত্তম। তুমি দেখতে পাবে যে তোমার সাথে শত্রুতা ছিল সে প্রানের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। এই গুন কেবল তাদের ভাগ্যেই জুটে থাকে যারা ধৈর্যধারন করতে পারে। সুরা হামীম আস সেজদা ৩৪-৩৫

মহান আল্লাহ আমাদের পরিবারগুলোর বন্ধন আরো মজবুত ও সুন্দর শান্তিময় করে দিন।সকলকেই জান্নাতের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রচেষ্টায় প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হওয়ার মত মন দিন। তাহলেই দুনিয়ার ভোগ বিলাস চাওয়া পাওয়ার হিসেবের বাইরেই সুসম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।