সন্তানের বিয়ের বয়স হলে উপযুক্ত পাত্রের কাছে কন্যাকে পাত্রস্থ বা পুত্র সন্তানের জন্য পাত্রী এনে দেয়ায় সহযোগীতা করা পিতা মাতার অন্যতম কাজ।
দুনিয়াবী দৃষ্টিকোন থেকে চিন্তা না করে আখেরাতের সফলতা ও জবাবদিহীতাকে সামনে রেখেই সব ব্যপার সামনে আনা প্রয়োজন।
অনেক পিতা মাতাই ছেলে মেয়ে উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে কিন্তু পছন্দের অনেক দিক শর্ত পূরন না হলে বিয়ে দিতে বা করাতে রাজী হোন না। হাদীসের আলোকে পরহেজগারীতাকে প্রাধান্য দিয়েই সময় থাকতেই বিয়ে দেয়াটা উত্তম।
রাসূল সা. বলেছেন,
“তোমাদের নিকট যদি এমন পাত্র বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসে যার দ্বীনদারী ও চরিত্র তোমাদের নিকট পছন্দসই, তবে তার সাথে তোমাদের কন্যাদের বিবাহ দিয়ে দাও। যদি তোমরা এরূপ না কর (দ্বীনদার ও চরিত্রবান পাত্রকে প্রত্যাখ্যান কর এবং তাদের সাথে কন্যাদের বিবাহ না দাও) তবে এর কারণে পৃথিবীতে অনেক বড় ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হবে। (তিরমিযী)
অনেক পিতা মাতাই দুনিয়াবী লাভ ও স্বার্থকে সামনে রেখেও বিয়ে দিতে বা করাতে বিলম্ব করেন যা মোটেও ইসলাম সম্মত নয়। দেরী হওয়ার কারনে সন্তানের চারিত্রিক যে সমস্যা দেখা যাবে তার জবাবদিহীতা পিতা মাতাকেও করতে হবে।
ছেলে সাবলম্বী হলেই বিয়ের অনুমতি দেয়া পিতা মাতার কর্তব্য। এই ক্ষেত্রে দীনদারীকে প্রাধান্য দিয়েই অনুমতি ও সহযোগীতা করা প্রয়োজন।
সুন্নাহ পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়া এবং বিবাহর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা এবং উপযুক্ত সময়ে বিবাহের ব্যবস্থা করা। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে,
নিশ্চয়ই পিতার উপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে। [জামিউল কাবীর]
বিবাহ দেওয়ার জন্য সাবালক ছেলে-মেয়ের অনুমতি গ্রহণ করা আবশ্যক।
জনৈক সাবালিকা মেয়েকে তার পিতা তার অসম্মতিতে বিবাহ দিলে রাসূল স. মেয়ের আপত্তির কারণে উক্ত বিবাহ বাতিল করে দেন (বুখারী, মিশকাত হা/৩১২৮, ইবনু মাজাহ হা/১৮৭৩)।
একইভাবে কোন সাবালিকা মেয়ে তার পিতা বা বৈধ অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত বিয়ে করলে উক্ত বিবাহ বাতিল হবে’ (আবুদাঊদ হা/২০৮৩; মিশকাত হা/৩১৩১)। অতএব পিতা ও মেয়ে উভয়ের পারস্পরিক সম্মতি ও অনুমতির মাধ্যমে বিয়ে হ’তে হবে।
তবে সাবালক ছেলে স্বাধীনভাবে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তাকে পিতা-মাতাকে সন্তুষ্ট রেখে বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা রাসূল স. বলেন, ‘পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পিতা-মাতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি’ (বায়হাক্বী শু‘আব হা/৭৮২৯, তিরমিযী হা/১৮৯৯, মিশকাত হা/৪৯২৭)।
জোরপূর্বক বিবাহ দিলে ছেলে বা মেয়ের তা ভেঙ্গে দেওয়ার অধিকার রয়েছে এবং এতে তারা গুনাহগার হবে না। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ছেলের অসম্মতিতে তাকে কারো সাথে বিবাহ দেওয়ার অধিকার পিতা-মাতার নেই। আর অসম্মতি জানানোর কারণে সে অবাধ্য (عَاقٌّ) হিসাবেও গণ্য হবে না’ (ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ৩২/৩০)।
অনেক ক্ষেত্ত্রে বিয়ের সময় অনেক অন্যায় শর্ত পিতা মাতা দিয়ে থাকেন, সেইক্ষেত্রে এই অন্যায় শর্ত পালন না করা সন্তানের কর্তব্য, তবে পিতা মাতার সাথে অন্যায় আচরন বা খারাপ ব্যবহার করে কষ্ট দেয়া যাবে না।
“হে ঈমানদারগন, তোমরা সর্বদাই ইনসাফের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকো এবং আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষী থেকো যদি তা তোমার নিজের, নিজ পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়দের বিপরীতে যায় …তবুও।” – [সূরা নিসা: ১৩৫]
এই আয়াতের আলোকে পিতা মাতার জানা থাকা প্রয়োজন যে, অন্যায় নির্দেশ সন্তান পালন করতে বাধ্য নয়, এতে সন্তানের কোন গুনাহ নেই।পিতা মাতার সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলে কাজের বরকত এসে থাকে।কারন যেকোন কাজেই পরামর্শভিত্তিক হলে ও আল্লাহর নামে করলে তাতে বরকত লাভ হয়।
তবে পিতা-মাতা যদি অন্যায় কাজের আদেশ করে তাহলে সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করা যাবে না।
মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তোমার পিতা-মাতা যদি তোমাকে পীড়াপীড়ি করে আমার সাথে কাউকে শরীক করতে যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পৃথিবীতে তাদের সাথে সদভাবে বসবাস করবে।’’ (সূরা লুকমানঃ১৫)।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কারো কোন আনুগত্য নেই। আনুগত্য শুধু ভাল কাজে।’’ বুখারী, মুসলিম।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, “স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির আনুগত্য নেই” (বুখারী, মুসলিম)।
এইক্ষেত্রে পিতা মাতা যদি সন্তানকে কোন ফরয লংঘন বা মহান আল্লাহর সাথে শিরক করতে বলে সেই আদেশ সন্তানের জন্য মানা গুনাহ। আবার তেমনি সন্তানও যদি কোন অন্যায় কাজের দাবী জানায় বা গর্হিত কাজে সমর্থন পেতে চায় সেক্ষেত্রে পিতা মাতা শরীয়ার আলোকেই ভূমিকা রাখবেন, কোনভাবেই অন্যায়ের সাথে আপোষ বা অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।সন্তানকে বুঝিয়ে আদর ও শাসন উভয়ের মাধ্যমেই অন্যায় থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা চালাতে হবে এবং মহান রবের কাছে দু’আ করতে হবে খুব বেশী করে, তারপর সন্তানের তাকদীরে যা আছে তাতেই পিতা মাতাকে সবর করতে হবে, অস্থিরতা এনে নিজেদের ক্ষতি বা বিশৃংখলা করে পরিবারের ক্ষতি না করাই শ্রেয়।।
হযরত ইবরাহীম আ. হযরত ইসমাইল আ.এর ঘরের চৌকাঠ পালটিয়ে ফেলার কথা বলাতে ইসমাইল আ. স্ত্রীকে তালাক দিয়ে অন্য আরেকজন পরহেজগার নারীকে বিয়ে করেন” অনেকেই এই ঘটনা উদাহরন হিসেবে নিয়ে আসেন যে, পিতা-মাতা তালাক দিতে বললে পুত্র নিজ স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য।
আসলে এটা আমাদের বুঝার ভুল। হযরত ইবরাহীম আ.ছিলেন একজন নবী, তারপর ইসমাঈল আ. এর সেই স্ত্রী, সংসার জীবনের প্রেক্ষাপট সেই সময়ে তাঁদের জীবনের একটি চিত্র মাত্র। হযরত ইবরাহীম আ. এর সাথে পুত্রের সম্পর্ক কতটা গভীর সেটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন, এই সম্পর্কের ভিত্তিই ছিল মহান রবের সন্তুষ্টিকে কেন্দ্র করে, এই আনুগত্যের মূল স্পিরিট ছিল আখেরাতের জীবনে শান্তি পাওয়ার লক্ষ্যে।
তাই এই ঘটনাকে উদাহরন হিসেবে নিয়ে এসে সব পরিবেশের সাথে প্রয়োগ করা শরীয়ার আলোকে যুক্তিযুক্ত নয়।এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে কিন্তু অবস্থা যাচাই না করেই হুবহু এই ঘটনার পূনরাবৃত্তি করতে হবে তা বলা হয় নি।
কুর’আনের আয়াতের বিরুদ্ধাচরন করা মোটেই যুক্তিসংগত নয়। মহান আল্লাহ জানিয়েছেন-“হে ঈমানদারগন, তোমরা সর্বদাই ইনসাফের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থেকো এবং আল্লাহর জন্য সত্যের সাক্ষী থেকো যদি তা তোমার নিজের, নিজ পিতামাতা ও নিকট আত্মীয়দের বিপরীতে যায় …তবুও।” – [সূরা নিসা: ১৩৫]
অনেক পিতা মাতা সন্তানের দীন পালনের ক্ষেত্রেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় যেমন কন্যাকে পর্দা করতে বারন করা ও ছেলেকে দাঁড়ি ও মসজিদে সালাতে যেতে বাঁধা দেয়া আজ অনেক পরিবারেই শুনা যায়। এইক্ষেত্রে পিতা মাতার মনে রাখা প্রয়োজন যে সন্তান এই ধরনের আদেশের আনুগত্য করতে বাধ্য নন বরং আনুগত্য নিষেধ করা আছে। এইক্ষেত্রে আনুগত্য করা গুনাহের কাজ। তাই পিতা মাতাকে কুর’আনের অনুশাসন মানতে সন্তানকে কখনোই বারন করার অধিকার রাখে না।
বিয়ে পরবর্তী জীবনে কন্যা সন্তানের দায়িত্ব তার নিজ পরিবারকে নিয়েই আবর্তিত হয় প্রধানত, এইক্ষেত্রে পিতা মাতাকেও সহযোগীতা করা প্রয়োজন যেন, কন্যা সন্তানটি তার সংসারকে আপন করে নিয়ে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে। কন্যা সন্তানের পরিবারের অকল্যান আনে এইধরনের যেকোন উপদেশ বা আদেশ দেয়া থেকে বিরত থাকা পিতা মাতার দায়িত্ব। শুধুমাত্র দীন বহির্ভূত কোন অবস্থা দেখলে সেইক্ষেত্রে সংশোধন করার কথা বলবে এবং সব সময়ই দীনের নসীহাত করে যাবেন কন্যা সন্তানসহ তার পরিবারের আত্মীয়দের মাঝেও।পিতা মাতার জন্য কন্যা সন্তানের পরিবারের স্বা্মী স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যপারে জানার আগ্রহ থাকা বা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করাও ইসলাম সম্মত নয়। তাদের কর্তব্য কন্যা সন্তানকে দীনের দিকে আরো বেশী এগুনোর চেষ্টা করার কথা স্মরন করিয়ে দেয়া।মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সবর অর্জন করার উৎসাহ দিবেন।
পিতা মাতা যদি আর্থিকভাবে চলতে অক্ষম থাকেন সেইক্ষেত্রে পুত্র সন্তানের অনুপস্থিতিতে কন্যা সন্তানের দায়িত্ব থাকে পিতা মাতাকে আর্থিকভাবে সহযোগীতা করা যদি কন্যা সন্তানের পরিবারে আর্থিক অবস্থা ভালো থাকে।
এবার আসি ছেলে সন্তান ও তার স্ত্রী সম্পর্কে। মূলত পিতা মাতার মনে রাখা প্রয়োজন যে, ছেলে সন্তানকে প্রতিষ্ঠিত করে বিয়ে করিয়ে দেয়ার পর পিতা মাতার সেই সন্তানের তদারকির দায়িত্বের মহান রবের কাছে জবাবদিহীতা থাকে না।এটা পিতা মাতার জন্য দায়িত্ব সহজ করে দেয়া যা পালন করা বয়সের ভারে কঠিন হয়ে যেতো তাই মহান রবের এই নিয়মটি অনেক বড় নি’আমত।দীর্ঘ সংসার জীবনের দায়িত্ব পালন করে বয়সের এই পর্যায়ে এসে ক্লান্ত হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই সময়েই সাবলম্বী সন্তান পরিবারের দায়িত্ব পালন করে পিতা মাতাকে-অনেক রিলিফ দিবে এবং পিতা মাতাকেও সন্তানের জন্য এই সুযোগ ও পরিবেশ অনুকূল করে দিতে হবে। এইক্ষেত্রেও ছেলেকে তার সংসার সুন্দর শান্তিময় রাখার জন্য যা করবে পিতা মাতাকে সেই ক্ষেত্রে সহযোগীতাই করা প্রয়োজন। ছেলের সংসারের ব্যক্তিগত বিষয়াদি জানার চেষ্টা না করাই উত্তম। তবে এইক্ষেত্রেও দীনের প্রয়োজনীয় নসীহাত করবেন পিতা মাতা, দীন বহির্ভূত ব্যপার দেখলে ছেলেকে সংশোধন করে দিবেন। ছেলের আয় ব্যয়ের হিসাব নিয়ে নজরদারী করা ঠিক নয়। তবে পিতা মাতার ছেলেকে আগের মতই সন্তান ভেবেই নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন থাকবেন। আল্লাহ প্রদত্ত যে দায়িত্ব ছেলে সন্তানকে দেয়া আছে তা পালনে পিতা মাতাকেই সহায়ক হতে হবে।অনেক ক্ষেত্রে পিতা মাতা দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগেন এবং সন্তানের সাথে সহজ আচরন করতে অপারগ থাকেন যা ছেলে সন্তানের জন্য খুবই কষ্টদায়ক। পিতা মাতাকে বুঝতে হবে যে, তাদেরই সন্তান এখন নিজ সংসারের বড় দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছে, তার পরিবার গঠন সুন্দর হলে পিতা মাতার বংশীয় ধারার ইসলামী অনুশাসন অব্যাহত রাখা সহজ হবে ও সাদাকায়ে জারিয়া হিসেব পিতা মাতাও আমলনামায় সেই সওয়াব অর্জন করবেন।তাই পিতা মাতাই ছেলের কাছে পূর্বের মতই সহজ উপস্থাপন করে (ছেলেকে)দায়িত্ব নিয়ে দুশ্চিন্তা করা থেকে মুক্ত রাখতে পারেন। মনে রাখা প্রয়োজন মহান রবের কাছে এই ছেলে সন্তানটির জবাবদিহীতা এখন স্ত্রী-সন্তান ও পিতা মাতাকে নিয়ে। ভালোবাসার তাগিদেই সন্তানের জন্য পিতা মাতার রহমশীল হওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দেয়াটাই সহজ হয়ে যায় পরিবারের পরিবেশ। পিতা মাতা সহজ ও সরল ও রহমশীল না হলে একটি ছেলে সন্তানের জন্য পিতা মাতাকে ও স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করে মহান রবের সন্তুষ্টি পাওয়ার পথটি অনেক জটিল ও কঠিন হয়ে যায়।মানুষের সীমাবদ্ধতাকে সামনে রেখেই পরিবারের লেন দেন করা ও সন্তুষ্ট থাকা প্রয়োজন তাহলে সেই পরিবারে সমস্যা থাকে না বা সমস্যা আসলেও মিটিয়ে ফেলা যায় সহজেই। পিতা মাতাকে সন্তানের প্রতি ভালোবাসা দিয়েই তাকে দায়িত্ব পালন করতে সহজ পথের সুযোগ করে দেয়াটা এহসান।
সন্তানের সম্পদে বাবা-মার অধিকার রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘লোকে কি ব্যয় করবে সে সম্পর্কে তোমাকে প্রশ্ন করে। বল, যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকীন এবং মুসাফিরদের জন্য।’’ (সূরা আল বাকারাঃ ২১৫)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘‘নিজ উপার্জনের আহার সর্বোত্তম আহার। অবশ্য তোমাদের সন্তানও নিজ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত।’’
এক ব্যক্তি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ধন-সম্পদও আছে এবং আছে সন্তান-সন্ততিও। কিন্তু এমতাবস্থায় আমার পিতা আমার সম্পদ নিতে চায়। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তুমি আর তোমার ধন-সম্পদ সবই তোমার পিতার।
ইমাম শাওকানী বলেছেন, الإجماع على أنه يجب على الولد الموسر مؤنة الأبوين المعسرين. ‘‘দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত পিতা-মাতার জন্য অর্থ ব্যয় করা সচ্ছল সন্তানের উপর ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে আলিমগণের ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’’
ছেলে সন্তানের বউকে নিজ কন্যা সন্তানের মতোই আপন করে নিয়ে পিতা মাতার ভূমিকায় অবতীর্ন হওয়া প্রয়োজন। নিজেদের আদর সোহাগ বউকে ঘিরে রাখলে পরিবারের পরিবেশ সুন্দর হয়ে উঠে। পিতা মাতা দীর্ঘ সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা ও দীনের জ্ঞানের আলোকে সন্তানদের দিকে কল্যানের দৃষ্টি ও সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেয়াটাই সন্তানের ও পরিবারের জন্য উত্তম।
অনেক মায়েরা আবার একসাথে চলতে গিয়ে ছেলের বউ আসার পর নিজ পছন্দ অপছন্দকেই চাপিয়ে দিতে চান ছেলের বউ এর উপর। অনেক ক্ষেত্রে মায়েরা কর্তৃ্ত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছেলে ও ছেলের বউকে স্বাধীন ইচ্ছার প্রতিফলন করতে বাঁধা দেন, এর পরিনতি সম্পর্কের অবনতি ও পরিবারে বিশৃংখলা দেখা যায়। মনে রাখা প্রয়োজন সংক্ষিপ্ত এই দুনিয়ার জীবনে এতোদিনের সাজানো সংসারকে স্থায়ীভাবেই ফেলে রেখে চলে যেতে হবে আখেরাতের জীবনে। আজ মারা গেলে সাথে কি যাবে এবং এই সংসারের সাজানো চিত্র কি ধরে রাখতে পারবেন? সাদা কাপড়ে পেঁচিয়ে কবরে মাটির নিচে শুয়ায়ে দিয়ে আসবে আত্মাটা বের হওয়ার সাথে সাথেই।আবার এই আত্মাটাও যেকোন সময়েই চলে যাওয়ার অবস্থা চলে আসতে পারে।
তাহলে পিতা মাতার জন্য বয়সের এই প্রান্তে যে সুযোগ মহান আল্লাহ দিয়েছেন সেই সুযোগটা ইবাদাত ও কল্যানমূলক কাজে নিজেদের ব্যস্থ রাখাটাই উত্তম ও বুদ্ধিমতির নয় কি? সন্তানদের সংসারের দায়িত্ব তাদের নিজেদের মত করে করতে দিয়ে নিজেরা ইবাদাতে ব্যস্থ হয়ে গেলেই অনেক সমস্যা থেকে যেমন পরিবারকে সুন্দর রাখা যায় তেমনি সবচেয়ে বড় ও উপকার যে, সময়কে নিজের কবরের জীবনের ও আখেরাতের জীবনের জন্য কিছু আমল করার সুযোগ লাভ হবে। তাই ছেলে ও ছেলের বউকে সুন্দর করে পরিবার গঠনের ইসলামিক নির্দেশনা দিয়ে দায়িত্ব তাদের উপর ছেড়ে দিয়ে দায়িত্বশীল হওয়ার সুযোগ করে দিন।
ছেলে বা ছেলের বউ যার যার ভুলটি আলাদাভাবে তাকেই একান্তে কাছে ডেকে সুন্দর ও আদর করে ধরিয়ে দিন।কোন কোন ক্ষেত্রে ছেলেকে বউ সম্পর্কে বা বউকে ছেলে সম্পর্কে দোষ-চর্চা না করে একসাথে দুজনকে ডেকে তুলে ধরাটাই মুমিনের চরিত্র। অন্যদের (পরিবারের বাইরে) কাছে পরিবারের সম্পর্কে দোষ চর্চায় লিপ্ত না হয়ে প্রশংসার ও ভালো কথা বলার অভ্যাস করা প্রয়োজন। অনেক পিতা মাতা অনেক ক্ষেত্রেই ছেলে ও বউ এর আচরন ভালো না লাগলে অন্যদের সাথে আক্ষেপ করে বলে শান্তি পেতে চান যা সম্পূর্ণ শয়তানের একটি ফাঁদ। পিতা মাতার বুঝা প্রয়োজন এর মাধ্যমে নিজেদের গুনাহের বোঝা বাড়ানো ও পরিবারের অশান্তি ডেকে আনা ছাড়া আর কোন লাভ নেই।
একের অধিক সন্তান ও তাদের বউ ও কন্যা ও জামাতাদের সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সকল সময় পিতা মাতা সমান আচরন করেন। অন্তরে ভালোবাসা কারোর জন্য বেশী কম হতে পারে কিন্তু আচরন ও লেন দেনে কখনোই বৈষম্য রাখা যাবে না। তাহলেও পরিবারে অশান্তি ও মহান রবের কাছেও জবাবদিহী করতে হবে পিতা মাতাকে।
অনেক ক্ষেত্রে ছেলে সংসারের সুবিধার জন্য পৃথক আবাসনের ব্যবস্থা করতে চায়, এইক্ষেত্রে পিতা মাতার জানা থাকা প্রয়োজন যে ইসলাম এই পৃ্থক থাকাটাকে গুনাহের কাজ বলে আখ্যায়িত করেনি।একজন স্ত্রী তার স্বা্মীর কাছে পৃথক আবাসনের দাবী জানাতেই পারে, এটা শরীয়তে অনুমোদিত স্ত্রীর অধিকারের একটি অংশ।তবে একসাথে থাকাটা আরো বেশী পূন্যের কাজ ও পিতা মাতাকে সেবা করে জান্নাতের পথ সুগম করা সহজ। স্ত্রী সহযোগীতা করলেই স্বা্মীর পক্ষ্যেও এই দায়িত্ব পালন সহজ হয়। একজন মুমিনা আখেরাতের প্রত্যাশী হলেই শুধুমাত্র এই একসাথে থাকাটা সহজ ও সুন্দর হয়। তাই মুমিনা নারী জান্নাতের সহজ রাস্তা রেখে কঠিন রাস্তায় যেতে চাইবে না কারন মুমিনা স্ত্রী স্বামীর সন্তুষ্টি পাওয়া সহজ হবে যদি শশুর শাশুড়িকে কাছে রেখে সংসারজীবন যাপন করেন, কাছে থাকলে স্বা্মীর পক্ষে পিতা মাতার প্রতি ভূমিকা রাখা সহজ হয় ও তাদের দু’আ পেতে পারেন।
অবশ্য কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা মাতা ও সন্তানের জন্য পৃথক থাকা কল্যান হয়ে থাকে। মানুষ বৈচিত্র মনের এবং সীমাবদ্ধ সামর্থের অধিকারী। তাই এই সকল ক্ষেত্রে সহজভাবে পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া প্রয়োজন সম্পর্ক তিক্ত হওয়ার আগেই। এইক্ষেত্রে পৃথক থেকেও যার যার দায়িত্ব পালন করে যাবে মহান রবের কাছে জবাবদিহীর প্রয়োজনে।
পিতা মাতা যদি নিজেকে মহান রবের দেয়া দায়িত্ব ও জবাবদিহীতার কথা স্মরনে রাখেন তাহলে মহান রবের সন্তুষ্টির জন্যই বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায় যা আপাত কঠিন ও অসম্ভব ব্যপার মনে হয়।
এই প্রবন্ধে পিতা মাতা মূলত মায়ের ভূমিকা নিয়েই আলোচিত হয়েছে, পিতা মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও ভূমিকা আরো গুরুত্বপূর্ণ। সেই ব্যপারেও সন্তানকে ছোট থেকেই একটু একটু করে জানাতে হবে এবং নিজেদের জীবনের বাস্তব নমুনা অর্থাৎ সন্তানের দাদা দাদী বা নানা নানীর প্রতি দায়িত্ব পালন ও ভূমিকা রেখে সন্তানদের শেখাতে হবে। মহান আল্লাহ মানুষের কর্মের কারনে দুনিয়াতেও অনেক কিছুর পরিনতি ভোগ করিয়ে দেখান এবং আখেরাতের জন্যতো আসল বিচারালয় আছেই। তাই সকলকেই যার যার অবস্থানে থেকে আখেরাতের জবাবদিহীতা ও সফলতাকে প্রাধান্য দিয়েই ক্ষনস্থায়ী এই দুনিয়ার জীবনে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। অন্যে পালন করলো কি করলো না তা বিচার না করে নিজে কি করছি তা পর্যালোচনা করেই যেতে হবে কবরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। তাহলেই শুধু মাত্র এই দুনিয়ার জীবনকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যাবে ইন শা আল্লাহ।
আরো অনেক শিক্ষা রয়েছে যা সন্তান গঠনের জন্য প্রয়োজন এবং সহায়ক। ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় কিছু আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি মাত্র। মহান আল্লাহ আমাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন।