মানসিক প্রশান্তিঃ
মানুষের মন ও শরীর একটি অপরটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ভালো থাকলে অপরটি ভালো থেকে আবার একটি অসুস্থ হলে অন্যটিও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
রোযা মানুষের আত্ম-সংযমের শক্তি সৃষ্টি করে – মানুষের খুদী বা আত্মজ্ঞান যখন দেহ ও অন্যান্য শক্তিসমূহকে পরিপুর্ণভাবে আয়ত্তাধীন করে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজের অধীন করে তখনই আত্মসংযম হয়।এই অবস্থায় কোন অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকার প্রত্যয় লাভ করে যা ব্যক্তির মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়।
কৃচ্ছ্বতাসাধনের মাধমে আত্মশুদ্ধি সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম তাৎপর্য। আর আত্মশুদ্ধি মানবচরিত্র সংশোধনও বিকাশের উৎকৃষ্টতম উপায়। আত্মশুদ্ধির দ্বারা ব্যক্তিতথা সমাজজীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে স্বচ্ছ সুদৃঢ় স্বকীয় সত্তার। রোজা পালনের দ্বারা মানুষের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি ও তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি হয়। রোজার দ্বারা মানুষের স্বভাবে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয় এবং দুরদর্শিতা আরো প্রখর হয়।
আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
কিন্তু তিনি সকলকেই একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। পরে যখন সেই সময় এসে উপস্থিত হয় তখন তার একমুহুর্ত আগে পরে হতে পারে না। সূরা আন নাহল: ৬১
আমাদের জীবনের যে কোন সময় ‘সেই সময়’ অর্থাৎ মৃত্যুর ফেরেশতা চলে আসবেন এবং একটু সময়ও এদিক সেদিক হবে না। তাই তাড়াতাড়ি আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন। অবকাশকে আমরা যেন হেলা করে নষ্ট না করে ফেলি, এই সুযোগ আমাদের আমল সুন্দর করার জন্য। অনেকে আগামী দিন করবো, আস্তে আস্তে আল্লাহর দিকে এগুবো ইত্যাদি অনেক কথা বলি যা নিজের জন্য খুব সংকটপূর্ণ, আগামী দিন বা পরে এই সময়টুকু নাও পেতে পারি!!
তোমার আল্লাহকে ডাকো, কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে, চুপে চুপে। নিশ্চিতই তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না, যখন তার সংশোধন ও সুস্থতা বিধান করা হয়েছে। এবং আল্লাহকে ডাকো ভয় সহকারে এবং আশান্বিত হয়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত নেক চরিত্রের লোকদের অতি নিকটে। সূরা আল আরাফ: ৫৫-৫৬
আর সফলকাম হবে ঐ সব লোক যারা আল্লাহ ও রাসূলের হুকুম পালন করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর নাফরমানী হতে দূরে থাকে। সূরা আন নূর: ৫২
মানুষের মাঝে ৩টি জিনিসের দাবী থাকে —
১। ক্ষুন্নিবৃত্তির দাবী (জীবন রক্ষার জন্য)
২। যৌন আবেগের দাবী
৩। শান্তি ও বিশ্রাম গ্রহণের দাবী
ইসলাম হলো মুসলমানের ৫ স্তম্ভ বিশিষ্ট ঘর। রোযা বা সাওম হলো ৩য় স্তম্ভ।
সিয়াম বা রোযার আভিধানিক অর্থ – বিরত রাখা, আবদ্ধ রাখা।
পারিভাষিক অর্থ – নিয়তের সাথে সুব্হে সাদেক (ফজরের ওয়াক্তের প্রথম) হতে সুর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সব ধরনের রোযা ভংগকারী যেমন পানাহার, জৈবিক ও শারীরিক কোনো কিছু ভোগ করা থেকে বিরত থাকা।
রামাদান অর্থ পুড়িয়ে ফেলা অর্থাৎ রোযা গুনাহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।
রোযা মানুষের আত্ম-সংযমের শক্তি সৃষ্টি করে, মানুষের খুদী বা আত্মজ্ঞান যখন দেহ ও অন্যান্য শক্তিসমূহকে পরিপুর্ণভাবে আয়ত্তাধীন করে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিজের রুহের অধীন করে তখনই আত্মসংযম হয়। রোযার মাস আমাদের ট্রেনিং দেয় কিভাবে এই আত্মসংযম লাভ করা যায়। এই মাসে আমরা প্রত্যেকের অন্তরের অবস্থান যাচাই করতে পারি। কিভাবে! চলুন জানার ও বুঝার চেষ্টা করি।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। রাসুল সা. বলেছেন, রমযান মাস শুরু হলে আসমানের দরজাসমূহ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শিকলে বন্দী করা হয়।সহীহ আল বুখারী: ১৭৬৪
এখানে অনেকে বলেন, তাহলে মানুষ রামাদান মাসে খারাপ কাজ করে কেন? এখানেই অন্তর যাচাই করার উত্তর চলে আসে।
মানুষ খারাপ কাজ করে কারণ:
· জীন শয়তান ওয়াদা করেছে মানুষকে জাহান্নামে নিবেই আর তাই সে নানা ভাবে প্রলুদ্ধ করে।
· অথবা মানুষের ভেতর নফ্সে আম্মারা (সব সময় খারাপ দিকে যেতে চায়) ও নফসে লাওয়ামা (দ্বিধাগ্রস্ত অন্তর) খারাপ কাজের দিকে আহবান করে
· অথবা মানুষের মধ্যেও প্ররোচনাকারী আছে যারা খারাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করে।
আর তাই আল্লাহ তা’লা সুরা নাসের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর সাহায্য চাওয়ার জন্য।
বলো, আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের প্রতিপালক, মানুষের মালিক, মানুষের প্রকৃত উপাস্যের কাছে। এমন প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে যে বারবার ফিরে আসে, যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে, সে জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে ৷সূরা আন নাস
তাহলে দেখা যাচ্ছে রামাদান মাসের চাঁদ দেখার পর শয়তান কাছে আসে না, আসে বাকী দু’টি মাধ্যম যারা খারাপ কাজ করায়। আর আমার আপনার মন যদি রাজী না হয় কেউ জোর করে খারাপ কাজ কতটুক করাতে পারবে?
তাহলে এই মন বা অন্তর (নফ্স) আমাদের কোন অবস্থানে আছে তা এই রামাদান মাসে সহজে বুঝা যায়। নফ্সে মুতমায়ীন (আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে অন্তর সর্বক্ষণ প্রস্তুত) নাকি নফ্সে লাওয়ামা (দ্বিধাগ্রস্ত অন্তর) নাকি নফ্সে আম্মারা (সব সময় খারাপ দিকে যেতে চায়) এবং সেই অনুযায়ী নিজেকে ট্রেনিং দেয়ার উপযুক্ত সময় হলো এই রামাদান মাস এবং এই ট্রেনিং নিয়ে বাকী এগারো মাস বাস্তব অনুশীলন করতে হবে।
এই অন্তর ঠিক রাখতে পারলে অর্থাৎ মুতমায়ীন অবস্থায় যাওয়াটা হলো রোযার স্বার্থকতা। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন: হে প্রশান্ত আত্মা! তোমার প্রতিপালকের কাছে ফিরে এসো (তোমার ভালো পরিণতির জন্য) সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে; আমার বান্দাহদের মধ্যে শামিল হও এবং প্রবেশ করো জান্নাতে। সূরা আল ফজর: ২৭-৩০
চিন্তা হতে কাজের উৎপত্তি। যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পেছনে উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায়ই মুখ্য, যা প্রণীত হয় বিবেক-বুদ্ধির আলোকে। আত্মাই মানুষের অন্যতম চালিকাশক্তি। আত্মা স্বচ্ছ পবিত্র ও কলুষমুক্ত না হলে ভালোমন্দ পাপপুণ্য উপলব্ধির ক্ষমতা লোপ পায়। সাওম আত্মাকে পবিত্র রাখার জন্য সহায়ক।
মানসিক দুশ্চিন্তা জনিত বিভিন্ন অসুখ , কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন কু রুচি সম্পন্ন বদ অভ্যাস দূর করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে সাওম।
রমাদানে রোজা রাখার মাধ্যমে দেহ ও মনে নিঃসন্দেহে একধরণের ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেছেন যে, রমাদানে রোজা রাখার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নতুন নতুন কোষের জন্ম হয়। ফলে মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়। অন্যদিকে কোর্টিসল নামক একধরণের হরমোন রয়েছে যা আড্রিনালিন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হয় তার পরিমাণও কমে যায়। এর ফলে পুরো রমজান মাসে এবং রমাদানের পরেও মানসিক চাপ বেশ কম থাকে।
যাদের তাকওয়া অর্জনের ইচ্ছা থাকে তাদের মাঝে রাগ বা অল্পতে রেগে যাওয়া স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে। কেন না রোজা মানুষ কে ধৈর্য ও সহানুভূতির শিক্ষা দেয় ।
রোজা রাখার ফলে প্রথম ৬ ঘন্টার মধ্যেই মস্তিস্ক এবং শরীরের মাংস পেশীতে, গ্লুকোজের অভাবে এড্রিনালিন এবং নরএড্রিনালিন ( adrenaline and noradrenaline ) কিছু টা অনিয়ন্ত্রিত অতিরিক্ত বেড়ে যায় বা কমে যায় , তড়িৎ গতিতে এবং গ্লুকোজের সাময়িক ভারসাম্যতা ঠিক মত মস্তিষ্কে পৌছতে পারেনা এর জন্য মানুষের উপবাস জনিত রাগ বাড়ে । তখন যদি উক্ত ব্যাক্তি ( ৩০/৫০ মিনিট ) , সামান্য কিছু সময় উত্তেজিত বিষয় এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করে ও ইসলামের শিক্ষা(রাগের সময় করনীয়) অনুসরন করে তাহলে অল্প সময়েই নিয়ন্ত্রন করতে পারে নিজেকে।
সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স অনুসারে দেখা যায় আত্মনিয়ন্ত্রণ হারা ব্যাক্তিদের রমজান মাসে রাগ গোস্বা বেশী বাড়ে ।
মানসিক প্রশান্তি আসবে তখনই যখন ব্যক্তি নিজেকে মহান রবের কাছে পূর্ণ সঁপে দিয়ে আখেরাতের সফলতার সিদ্ধান্তে চলতে চাইবে।