হাদীসের আলোকে চিকিৎসা-৯

হাত ধোঁয়া

  • নবীজি সা. অন্যতম সাহাবী বুসর ইবনে আরতাতের বংশধর আবুল ওয়ালীদ আহমাদ ইবনে বাক্কার আদ্-দিমাশকী (রাযি.) থেকে- আব হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত। রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যদি রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে তবে সে হাতে দুই বা তিনবার পানি ঢেলে তা পাত্রে ঢুকাবে, কারণ সে জানে না তার হাত কোন কোন স্থানে রাত কাটিয়েছে। তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ।
  • আমাদের প্রিয় নবী সা. খাবার আগে এবং পরে হাত ধৌত করতে বলেছেন।
  • খাদ্য খাওয়ার আগে হাত ধোয়া ও কুলি করা (তিরমিযি)
  • উভয় হাত কব্জি পর্যন্ত ধোয়া (আবু দাউদ. তিরমিযি)
  • হাতে চর্বি লেগে থাকলে (হাত ধোয়ার আগে) তা বাহুতে বা পায়ে মুছে নেয়া। (ইবনে মাজাহ)
  • খাদ্য খাওয়া শেষে আঙ্গুলসমূহ যথাক্রমে মধ্যমা, তর্জনী, বৃদ্ধা, অনামিকা ও কনিষ্ঠ আঙ্গুল চেটে খাওয়া। (তিরমিযি, সামায়েলে তিরমিযি)
  • খাদ্য খাওয়ার পর উভয় হাত ধোয়া। (তিরমিযি, আবু দাউদ)
  • সালমান ফারসী (রাযি.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি তাওরাত কিতাবে পড়েছি যে, খাওয়া দাওয়ার পর অজু করলে বরকত হয়। এ বিষয়ে আমি নবিজির সাথে আলাপ করলাম, নবী সা. বললেন, খাওয়ার আগে ও পরে অজু করলে আহারে বরকত হয়। (শামায়িলে তিরমিযি, তিরমিযি, আবু দাউদ, আহমাদ, হাকেম)
  • আনাস ইবনে মালিক (রাযি,) রাসুল সা. হতে নকল করেন, যে ব্যক্তি নিজ ঘরে বরকত বৃদ্ধি আকাঙ্খা করে সে যেন তার সামনে খাবার উপস্থিত হলে হাত ধুয়ে নেয় এবং তা তুলে নেওয়ার পরেও হাত ধুয়ে নেয়। (আখলাকুন নবি সাঃ, ইফাবা, হাদিস নং ৬৫৪, )
  • আহমদ ইবনে মানী (রহ.) আবু হুরায়রা রাঃ, রাসুল সা. হতে বর্ণনা করেন, শয়তান অত্যন্ত অনুভুতি সম্পন্ন এবং খুবই লোলুপ। নিজেদের ব্যাপারে তোমরা একে ভয় করবে। হাতে চর্বির গন্ধ নিয়ে কেউ যদি রাত যাপন করে আর হাতের যদি কোন ক্ষতি হয় তবে সে যেন, নিজেকেই মালামত করে।(মানে সে যেন নিজেকেই এর দায়িত্ব নেয়। (তিরমিযি)
  • খাদ্য খাওয়ার পরে যদি হাত ভালভাবে পরিস্কার না করা হয় তাহলে খাদ্যের গন্ধে পোকামাকড়, পিপড়া, ইদুর এসে দংশন করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। অনেক সময় অনেকে নখকে উইপোকা কামড়ে চামরা তুলে নিয়েছে বলে অনেক ঘটনা আমরা দেখেছি। তাছাড়া সে খাদ্যে অনেক সময় এমন কোন স্থানে লেগে থাকে যেখান থেকে পঁচে আরও রোগজীবাণুর আখড়া তৈরি করে। আবার হাত ধোয়ার পরে কাপড়ে হাত মুছে নেয়াকেও ইসলাম সমর্থন করে।
  • আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দশটি জিনিস ফিতরাতের (মানুষের স্বাভাবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন প্রণালী) অন্তর্ভূক্ত। ১. মোঁচ (গোঁফ) কেটে ফেলা / ছাঁটা, ২. দাড়ি বড় করা, ৩. মিসওয়াক করা, ৪. নাকে পানি দেয়া / পানি দ্বারা নাসা রন্ধ্র পরিষ্কার করা, ৫. হাত পায়ের নখ কাটা, ৬. (ওজু গোসলের সময়)আঙ্গুলের জোড় এবং গিরাসমূহ ধুয়ে ফেলা, ৭. বগলের চুল কাটা / বোগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা, ৮. নাভী মন্ডলের (যৌনকেশ) চুল কাটা, ৯. (পানির দ্বারা) ইস্তেঞ্জা করা (অর্থাৎ পেশাব পায়খানার পর পানি দিয়ে পবিত্রতা হাসিল করা)। বর্ণনাকারী বলেন (রাবী যাকারিয়া (রাঃ) বলেন, হযরত মুসআব (রাঃ) বলেছেন) দশমটি আমি ভুলে গেছি। সম্ভবত সেটি হবে কুলি করা। (মিশকাত শরীফ-হাদিস নং ৩৫০, রিয়াদুস সালেহীন হাদিস নং ১২০৪, মুসলিম শরীফ-হাদিস নং ৩৫০, আবু দাউদ শরীফ-হাদিস নং ৫৩, সুনানু ইবনে মাজাহ- হাদিস নং ২৯৩)।
  • রোগ ঠেকাতে হাত ধোয়ার প্রচলন খুব বেশি দিনের নয়। উনবিংশ শতকে প্রথম সচেতনতা তৈরি হয়। সদ্য প্রসূতি এবং আহত সৈনিকদের ক্ষেত্রে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রথম চোখে পড়ে কিছু মানুষের। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন হাঙ্গেরির চিকিৎসক ইগনাস সেমেলউইজ। ভিয়েনা, অস্ট্রিয়ায় কাজ করতে গিয়ে তাঁর এই অভিজ্ঞতা হয়। ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলেরও এ বিষয়ে অবদান রয়েছে। তার আগে দুর্গন্ধকেই রোগ ছড়ানোর কারণ বলে মনে করতেন উন্নত দেশগুলির মানুষ। ১৯৮০-র দশকে এসে হাত ধোয়ার মতো জরুরি স্বাস্থ্যবিধি যে বহু রোগ প্রতিরোধে সক্ষম, তা নিয়ে সচেতন হয় মানুষ। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু ছড়ানোর পর সচেতনতা বাড়ে বিশ্ব জুড়ে। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া।

কেন জরুরি

  • সর্দি-কাশি, ইনফ্লুয়েঞ্জার হাত থেকে রেহাই মেলে।
  • শ্বাসকষ্টজনিত সংক্রমণ রোখা যায়।
  • ডায়েরিয়া সংক্রমণ কমে।
  • শিশু মৃত্যুর হার কমাতে সাহায্য করে মা ও শিশুর হাত ধোয়ার অভ্যাস।
  • পাঁচ বছরের নীচের শিশুদের উচ্চতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাহায্য করে।

হাত ধোয়ার সঠিক উপায়

  • খাবার আগে ও পরে উষ্ণ গরম পানিতে সাবান দিয়ে হাত ধুলে ভাল।
  • শৌচকর্মের পরে সাবান ব্যবহার অবশ্যই উচিত।
  • সাবানের বদলে মাটি বা ছাই ব্যবহার করা যায়।
  • হাতের কাছে আর কিছু না পেলে স্রেফ ঠান্ডা পানিতে ভাল করে হাত ধুয়ে তবেই খাবার মুখে তোলা উচিত।

নিরাপদ ও সুন্দর থাকতে হাত ধোয়া জরুরীঃ

অনেকে হাত ধোয়াকে এতই নগন্য ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য মনে করে যে এটাকে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করাতো দূরের কথা এটাকে বিরক্তি ও অযথা কাজ মনে করে। অথচ এই সুঅভ্যাস গড়ে তোলা আমাদের সবার জন্য অবশ্যক। এতে জীবন হবে সুন্দর ও স্বাস্থ্য থাকবে নিরাপদ।

শুধু খাবার পূর্বে এবং বাথরুম ব্যবহারের পর হাত ধোয়া জরুরী নয় বরং সবসময়ই হাত ধোয়া প্রয়োজন। সবজি, মাছ গোস্ত কাটাকাটি ও ধরার পূর্বে, খাবার রান্না করার পূর্বে, খাবার পরিবেশন করার পূর্বে যেমন হাত ধোয়া প্রয়োজন তেমনি ভ্রমণ করার পর, অফিসে আসার পর, বাসায় যাওয়ার পর, বাহির থেকে ঘরে ফেরার পর, কোন কাজ করার পর অর্থাৎ প্রতি ক্ষত্রেই এটা অভ্যাসে পরিণত করা দরকার।

অনেকে হাত ধোয়া মানে পানি দিয়ে অল্প করে হাত ভেজানো মনে করেন। হোটেল রেস্তোরাঁয় প্রায়ই দেখা যায় খুব দ্রুত পানি দিয়ে এক হাত একটু ভিজিয়ে খেতে বসে যায়। এতে হাতের ময়লা আরো বেশী নরম হয়ে এবং খাবারে মিশে যেতে সহজ হয়। হাত ধুতে সাবান, লিকুয়িড বা পরিষ্কারক এন্টিসেপটিক জাতীয় তরল পদার্থ ব্যবহার করতে হবে। এক হাত নয় বরং দুই হাতে ভাল করে সাবান মাখিয়ে আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে, নখে, হাতের সামনে-পিছনে ও কবজিতে ভালভাবে ঘষে পরিস্কার করা উচিত। ১০-১৫ সেকেন্ডের কম সময়ে নয় বরং ময়লা ও সাবানের পিচ্ছিল ভাব ভালভাবে দূর না হওয়া পর্যন্ত পানি দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। হাতে বেশী ময়লা থাকলে একাধিকবার সাবান লাগাতে হবে।

আদরের সন্তান, ছোট ভাই বোন, ইত্যাদি পরিবার পরিজনকে একদম ছোট বয়স থেকে এই অভ্যাস গড়ে দেয়া গেলে এটা নিয়মিত কাজের মতোই মনে হবে, কঠিন বা বিরক্তি লাগবে না। তবে আমরা বড়রাই যদি গাফলতি করি তাহলে ছোটরা কি শিখবে? তাই সবাইকে হাত ধোয়ার ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। ইসলামের নির্দেশনায় চললে অনেক রোগ থেকে হেফাজতে থাকা যায়, ভাল একটি অভ্যাস জীবনে গড়তে পারলে দেখবেন জীবন আসলেই খুব সুন্দর।

https://youtu.be/7D0eIsuZC3w