হাদীসের আলোকে সাওম-৮

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘সেহরি হল একটি বরকতময় খাদ্য, তাই তা তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সেহরি করে নাও। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও ফেরেশ্‌তাগণ সেহরিতে অংশ গ্রহণকারীদের জন্য দোয়া করে থাকেন।’ বর্ণনায় : আহমদ

সিয়াম পালনের জন্য সেহরি খাওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘তোমরা সেহরি খাও, কারণ সেহরিতে বরকত রয়েছে।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

সেহরি না খেয়ে সিয়াম পালন করলেও সিয়াম আদায় হবে। তবে সেহরি খাওয়ার ফায়দা জানলে সেহরী খাওয়ার ইচ্ছা জোড়ালো হবে। তাহলে সমাজে কেউ সেহরি খাওয়ার ফায়দা লাভের এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে চাবেন না।

(ক) সেহরি খাওয়া সুন্নত। রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেহরি খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন।

(খ) ক্ষুধা-পিপাসা মোকাবিলা করার জন্য।

(গ) সেহরি খেলে সিয়াম পালনে কষ্ট কম হয় ও সিয়াম পালন সহজ হয়।

(ঘ) ইহুদি ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধাচরণ করা। কারণ তারা সিয়াম পালন করতে সেহরি খায় না। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

আমাদের ও ইহুদি-খ্রিস্টানদের সিয়ামের মাঝে পার্থক্য হল সেহরি খাওয়া।’ বর্ণনায় : মুসলিম

(ঙ) সেহরির মাধ্যমে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইল করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

‘তারা শেষ রাতে (সেহরির সময়) ক্ষমা প্রার্থনা করে।’ সূরা জারিয়াত : ১৮

‘আমাদের মহান প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। তখন মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলেন, যে আমার কাছে দোয়া করবে আমি তাতে সাড়া দেব, যে আমার কাছে চাইবে আমি তাকে দান করব ও যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে আমি তাকে ক্ষমা করব।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

অনেক মানুষ এমন আছেন যারা এ সময় জাগ্রত হয়ে খাওয়া-দাওয়াসহ অনেক কাজ সমাধা করেন কিন্তু দোয়া- প্রার্থনা. ইস্তিগফার, তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করার সুযোগ করে নিতে পারেন না।

শেষ রাতের সালাত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

‘হে মানবসকল ! তোমরা সালামের প্রচলন কর। অন্যকে খাবার দাও। আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখ আর রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন তোমরা সালাত আদায় কর তাহলে শান্তির সাথে জান্নাতে যেতে পারবে।’ বর্ণনায় : তিরমিজি

(চ) ফজরের সালাত জামাতের সাথে আদায় করা নিশ্চিত হয়।

তাই সেহরি খাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।

 

রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘মুমিনের উত্তম সেহরি হল খেজুর।’ বর্ণনায় : আবু দাউদ।

সেহরির অর্থ হল যা কিছু রাতের শেষ ভাগে খাওয়া হয়। সুন্নত হল দেরি করে সেহরি খাওয়া। তবে সেহরির খাবার হালকা হওয়া ভাল। এমন বেশি খাওয়া উচিত নয় যাতে দিনের বেলা কাজ-কর্মে অলসতা দেখা দেয়। যে কোন হালাল খাবার সেহরিতে গ্রহণ করা যায়।

সেহরির সময় হল আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি দান-প্রতিদানের সময়। এ সময় সে ব্যক্তিই তার সামনে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন যিনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্ব ভালভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের নিয়তকে বিশুদ্ধ করেছেন।

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

‘যখন এখান থেকে রাত্রির আগমন ঘটে ও ওখান থেকে দিন চলে যায় এবং সূর্য অস্ত যায় তখন সিয়াম পালনকারী ইফতার করবে।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে রাতের আগমন ঘটে ও ইফতার করার সময় হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:’অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করবে।’ সূরা বাকারা : ১৮৭

তাই ইফতারের আদব হল সূর্যাস্ত মাত্রই তাড়াতাড়ি ইফতার করা। তাড়াতাড়ি ইফতার করার ব্যাপারে অনেক হাদিসে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

‘মানুষ যতদিন পর্যন্ত তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের সাথে থাকবে।’ বর্ণনায় : বোখারি ও মুসলিম

তিনি আরো বলেছেন : ‘যতদিন মানুষ তাড়াতাড়ি ইফতার করবে ততদিন দ্বীন বিজয়ী থাকবে। কেননা ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ইফতারিতে দেরি করে।’ বর্ণনায় : আবু দাউদ

হাদিসে আরো এসেছে, আবু দারদা রা. বলেন : ‘তিনটি বিষয় নবী চরিত্রের অংশ : তাড়াতাড়ি ইফতার করে ফেলা, দেরি করে সেহরি খাওয়া ও সালাতে দাঁড়িয়ে ডান হাত বাম হাতের উপর রাখা।’ বর্ণনায় : তাবরানী

রাসূলে করিম স.-এর সাহাবিগণ তাঁর অনুসরণের ব্যাপারে কত যত্নবান ছিলেন সেটা লক্ষণীয়। প্রতি পদে পদে রাসূলের অনুসরণ করার জন্য আমাদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ রয়েছে।

সমাজে বিশেষ করে নারীরা ও বাড়ীর গৃহকর্মীরা গরম গরম ভাজা খাবার খাওয়ার জন্য দেখা যায় আজান হয়ে গিয়েছে অথচ তখনও চুলার কাছে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন। এই অবস্থা থেকে নিজে ও গৃহকর্মীকেও সরে এসে ইফতারের আগে দু’আ ও সময়মতো ইফতার করার সুযোগ করে নিতে হবে।

 

আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতের পূর্বে তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি তাজা খেজুর না পাওয়া যেত তবে শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। যদি শুকনো খেজুর না পাওয়া যেত তাহলে কয়েক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করতেন।’ বর্ণনায় : আহমদ

এ হাদিস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ইফতারির আদব হল: মাগরিবের সালাতের পূর্বে ইফতার করা। তাজা খেজুর বা শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করা। খেজুর দিয়ে ইফতার করার উপকারিতা হল, খেজুর সহজপাচ্য। দীর্ঘক্ষণ খালি পেটে থাকার কারণে খাওয়ার পর যে সমস্যা হওয়ার কথা খেজুর খেলে তা হয় না। উপরন্তু খেজুর হালকা খাবারের একটি। পানি, খেজুর এগুলো দ্বারা ইফতার করলে অলসতা সৃষ্টি হয় না।

বিশেষ করে ভাজা, ঝাল ও মসলাযুক্ত খাবার থেকে এই সময় দূরে থাকা উপকারী। দই চিড়া,রুটি, রাইস বা ফল দিয়ে ইফতার করা ভালো। তবে পেট ভরে ঢেকুর তুলা পর্যন্ত না খাওয়া কর্তব্য।

 পেট পুরে পানাহার ইসলাম সমর্থন করে না। রাসূলুল্লাহ স.বলেছেন :

‘মানুষ সে সকল পাত্র পূর্ণ করে তার মাঝে মানুষের পেট অপেক্ষা আর কোন খারাপ পাত্র নেই। মানুষের কোমর সোজা রাখার জন্য কয়েকটি লোকমাই যথেষ্ট। এর থেকেও বেশি যদি প্রয়োজন হয়, তবে পেটের এক তৃতীয়াংশ খাদ্যের জন্য, এক তৃতীয়াংশ পানীয়ের জন্য এবং অবশিষ্ট এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের জন্য রেখে দেয়া উচিত।’ বর্ণনায় : তিরমিজি

 

রাসূল স. বলেছেন,

       যে কোন সাওম পালনকারীকে ইফতার করায়, তার (যে ইফতার করালো) তার (সাওম পালনকারীর) সমান সওয়াব হবে, অথচ সেই সাওম পালনকারীর সওয়াব কোন অংশে কমে যাবে না। আত তিরমিযী: ৬৪৭

আমাদের সকলের তাই এখন থেকেই পরিকল্পনায় রাখা প্রয়োজন যেন আমরা প্রতিদিন কাউকে না কাউকে ইফতার করাতে পারি।

পুরু মাসের ইফতার করানোর সওয়াব পাওয়ার জন্য রামাদানের পূর্বেই শুকনো ইফতার পৌছে দিতে পারি গরীব মিসকীন অসহায়দের দুয়ারে।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন এই সওয়াব আদায় করতে যেয়ে অনেকে পরিবারে ইফতার পার্টি দিয়ে থাকেন- যেখানে নারী পুরুষ অবাধ মেলা মেশা গল্প গুজব হয়ে থাকে এবং দেখা যায় এই আয়োজনে শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে ফরয সালাতটাও ঠিকমত আদায় করেন না। এই ধরনের ইফতার করানোর কথা কিন্তু হাদীসে বলা হয় নি। এমন পার্টি ইসলামী শরীয়াতে নিষেধ সুতরাং ইফতারের সওয়াব কতটুক হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।

রামাদান আত্মশুদ্ধির জন্য, আনন্দ উল্লাস করে মহান রবের শরীয়াকে অপমান করার জন্য নয়। মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন।