রামাদান পূর্ব কিছু অনুশীলন–৩

আপনারা কি তাড়া হুড়ো করে সালাত আদায় করেন?
আমাদের সমাজে এখন অনেকেই ইয়োগা করে থাকেন বা নিজের সুস্থ রাখার জন্য জীমে যান । সেখানে একেকটি অনুশীলন যেভাবে ধীরে যত সংখ্যায় করিয়ে দেন মানুষ ঠিকই সেটাতে আন্তরিকতা সহকারে খুব আনন্দের সাথে অভ্যস্থ হোন। কিন্তু মহান আল্লাহ খুব ভালোবেসে তাঁর সৃষ্টির জন্য সালাতের প্রতিটি রুকনকে ধীর স্থীরতার সাথে করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং মেডিটেশনের জন্য কুর’আনের কিরাত ও দু’আকে সালাতের ভিতর অন্তর্ভূক্ত করে দিয়েছেন। কিন্তু কোথায় যত তাড়াহুড়া শুধুই যেন সালাতের সময় হয়। এইভাবেই শয়তান আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করাতে ভালো লাগাকে সরিয়ে অন্য কাজে নেবার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি মানুষের মাঝে ঢুকিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন।

কিছু টিপস উল্লেখ করা হলো, যা ইন শা আল্লাহ সালাতে মনোযোগ দিতে সহায়ক হবে। আর এই সাওমের আগেই সালাতকে সৌন্দর্য মণ্ডিত করে নেই।

রাসূল স.বলেছেন,
যখন কেউ সালাতে থাকে তখন সে তার প্রভুর সাথে মুনাজাতে(গোপন কথা বার্তায়) রত থাকে। কাজেই তার ভেবে দেখা উচিত কিভাবে এবং কী বলে সে তাঁর সাথে মুনাজাত বা আলাপ করছে। বুখারীঃ ১/১৫৯

লক্ষ্য করুন, আমরা কোন বিশেষ ব্যক্তির সামনে কথা বলার জন্য কত প্রস্তুতি নিয়ে সেটা পোষাক থেকে শুরু করে কি বলবো কতটুকু বলবো এইগুলো পূর্বেই ঠিক করে নেই। আবার সেই ব্যক্তির সামনে কত সাবধানতা সহকারে দাঁড়াই যেন কোন মনতুষ্ট না হয়। এর পিছনে কারন কি—
– সেই বিশেষ ব্যক্তিটির মর্যাদা বা শক্তি সম্পর্কে জ্ঞান আছে।
– সেই বিশেষ ব্যক্তিটির কাছেই দায়বদ্ধতা রয়েছে।
– সেই বিশেষ ব্যক্তিটিই পারেন চাওয়াকে বাস্তবায়ন করে দিতে।
– সেই বিশেষ ব্যক্তিটির খুশিতেই চাওয়াটা পাওয়া সহজ হবে।
– নিজের সেই চাওয়াটা জীবনের জন্য অত্যাবশ্যক যা ছাড়া চলবে না।
– সেই চাওয়াটা দুনিয়ার জীবনে এখনই লাভ হবে তাই এতো জোর প্রচেষ্টা।

উপরের এই বিষয়গুলোকেই আমরা দুনিয়ার একজন ব্যক্তির সামনে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে খুব বেশী গুরুত্ব দেই বলেই আমাদের অবস্থান এতো সুস্থির ও সুন্দর হয়।

তাহলে মহান রব যিনি আমার প্রতিপালক, যাঁর অনুমতিক্রমেই সেই বিশেষ ব্যক্তিটি ভূমিকা রেখে থাকে ইতিবাচক বা নেতিবাচকরুপে, মহান আল্লাহ সেই ব্যক্তিকে সেই শক্তি ও মর্যাদা না দিলে কিছুই করতে পারতো না। মহান রব সম্পর্কে তাহলে আমাদের কতটুকু গুরুত্ব ও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন! মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার তাওফিক দান করুন।

  • সালাতে মহান রবের সামনে দাঁড়াচ্ছি, তাই সেই রকম মন নিয়ে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
  • সালাতে যখন দাঁড়াবো তখন সালাতে যা পড়ি তা একটু শব্দ করে নিজের কানে পৌছায় এমনভাবে পড়লে মনোযোগ আসবে ইন শা আল্লাহ। এটা একাকী নিজ ঘরে সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে ভালো হয়। অন্যের সমস্যা যেন না হয় এবং গায়ের মাহরাম যেন না থাকে।
  • সালাতে যা পড়ছি সেগুলোর অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পড়া এবং অর্থের সাথে অন্তরকে একীভূত করে আলোড়িত করা। তাহলে আমাদের কাজ হবে যা পড়ি, সেগুলোর অর্থ শিখে ফেলা। এই রামাদানে পরিকল্পনা নেই সালাতে যা পড়ি তার অর্থ শিখে ফেলবো ইন শা আল্লাহ।
  • সালাতকে আরো সুন্দর ও ধীর স্থীর করার জন্য রুকু ও সেজদাহতে রাসূল স. অতিরিক্ত যে দু’আ ও যিকির করেছেন সেগুলো কয়েকটি শিখে পড়া
  • সালাতের শুরুতে হাত বাঁধার পর দো‘আ

আমরা যে সানাগুলো পড়ি সেটার সাথে এই সানাটা পড়তে পারি। রাসূল স. এই সানাটি বেশী পড়তেন।

اللَّهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اللَّهُمَّ نَقِّنِي مِنْ خَطَايَايَ كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الْأَبْيَضُ مِنَ الدَّنَسِ، اللَّهُمَّ اغْسِلْني مِنْ خَطَايَايَ، بِالثَّلْجِ وَالْماءِ وَالْبَرَدِ».

(আল্লা-হুম্মা বা-‘ইদ বাইনী ওয়া বাইনা খাত্বা-ইয়া-ইয়া কামা বা-‘আদতা বাইনাল মাশরিক্বি ওয়াল মাগরিব। আল্লা-হুম্মা নাক্বক্বিনী মিন খাত্বা-ইয়া-ইয়া কামা ইয়ুনাক্কাস্ ছাওবুল আবইয়াদু মিনাদ দানাসি। আল্লা-হুম্মাগসিলনী মিন খাত্বা-ইয়া-ইয়া বিস্সালজি ওয়াল মা-’ই ওয়াল বারাদ)।
“হে আল্লাহ! আপনি আমার এবং আমার গুনাহসমূহের মধ্যে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করুন যেরূপ দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আমার গুনাহসমূহ থেকে এমন পরিষ্কার করে দিন, যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার করা হয়। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আমার পাপসমূহ থেকে বরফ, পানি ও মেঘের শিলাখণ্ড দ্বারা ধৌত করে দিন। বুখারী ১/১৮১

সালাতে রুকু করা, রুকু থেকে দাঁড়ানো- সোজা হয়ে থাকা, সেজদায় থাকা ও সেজদা থেকে সোজা হয়ে বসায় সময় দেয়া প্রতিটি ভংগী একটি সালাতের অংগ। সালাতে রুকু সেজদা ধীরে করা ও স্থীর হয়ে দাঁড়ানো ও বসা অন্যতম রুকন ও ওয়াজীব। তাই বেশী সময় থাকার জন্য যিকিরগুলো ধীরে শুদ্ধভাবে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে বেশী করে পড়া।

সালাতকে আরো সুন্দর ও ধীর স্থীর করার জন্য রুকুতে রাসূল স. অতিরিক্ত যে দু’আ ও যিকির করেছেন সেগুলো কয়েকটি শিখে পড়া। আরো বেশী শিখতে চাইলে হিসনুল মুসলিম থেকে পড়ে শিখে নিতে পারেন।

এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো যা সুন্দর করে পড়ার মাধ্যমে সালাতকে ধীর স্থীর করা সম্ভব ইন শা আল্লাহ।

রুকুর তাসবিহ

سُبْحانَ رَبِّيَ الْعَظِيمِ». .
(সুবহা-না রব্বিয়াল ‘আযীম)।

“আমার মহান রব্বের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি” আবু দাউদ-৮৭০

«سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي».

(সুবহা-নাকাল্লা-হুম্মা রব্বানা ওয়াবিহামদিকা, আল্লা-হুম্মাগফির লী)।

“হে আল্লাহ! আমাদের রব্ব! আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি আপনার প্রশংসাসহ। হে আল্লাহ! আপনি আমাকে মাফ করে দিন।”বুখারী-৭৯৪

রুকূ‘র দো‘আ (রুকুর তাসবিহ পড়ার পর)

اللَّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ، وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ، خَشَعَ لَكَ سَمْعِي، وَبَصَرِي، وَمُخِّي، وَعَــــظْمِي، وَعَصَبِي، [وَمَا استَقَلَّتْ بِهِ قَدَمِي]».

(আল্লা-হুম্মা লাকা রাকা‘তু, ওয়াবিকা আ-মানতু ওয়া লাকা আস্লামতু। খাশা‘আ লাকা সাম‘ঈ ওয়া বাসারী ওয়া মুখ্খী ওয়া ‘আযমী ওয়া ‘আসাবী [ওয়ামাস্তাক্বাল্লাত বিহি কাদামী])।

“হে আল্লাহ! আমি আপনার জন্যেই রুকু করেছি, আপনার উপরই ঈমান এনেছি এবং আপনার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছি। আমার কান, আমার চোখ, আমার মস্তিষ্ক, আমার হাড়, আমার পেশী, সবই আপনার জন্য বিনয়াবনত। [আর যা আমার পা বহন করে দাঁড়িয়ে আছে (আমার সমগ্র সত্তা) তাও (আপনার জন্য বিনয়াবনত)]” মুসলিম ১/৫৩৪

সালাতের মধ্যে দু’আর অন্যতম সময় সাজদাহর সময়। সাজদাহর মাধ্যমে বান্দা মহান রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। দু’আ কবুলের উপযুক্ত সময়।

সিজদার তাসবিহ
«سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلَى».
(সুবহা-না রব্বিয়াল আ‘লা)
“আমার রব্বের পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করছি, যিনি সবার উপরে।” তিরমিযী-২৬২
سُبوحٌ، قُدُّوسٌ، رَبُّ الْمَلَائِكَةِ وَالرُّوحِ».
(সুব্বূহুন কুদ্দূসুন রব্বুল মালা-ইকাতি ওয়াররূহ)।

“(তিনি/আপনি) সম্পূর্ণরূপে দোষ-ত্রুটিমুক্ত, অত্যন্ত পবিত্র ও মহিমান্বিত; ফেরেশতাগণ ও রূহ এর রব্ব।”মুসলিম-১/৩৫৩

সিজদাহর দো‘আ (সিজদাহর তাসবিহ পড়ার পর)

যেহেতু সিজদাতে দু’আ কবুল হয়ে থাকে তাই আমরা নিয়মিত তাসবিহ পড়ার পর এই দু’আগুলো শিখে নিলে আমাদের প্রয়োজনীয় চাওয়াগুলো বলা হয়ে যায়।

 

اللَّهُمَّ لَكَ سَجَدْتُ وَبِكَ آمَنْتُ، وَلَكَ أَسْلَمْتُ، سَجَدَ وَجْهِيَ لِلَّذِي خَلَقَهُ، وَصَوَّرَهُ، وَشَقَّ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ، تَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسنُ الْخَالِقينَ».
ক) (আল্লা-হুম্মা লাকা সাজাদতু ওয়াবিকা আ-মানতু ওয়া লাকা আসলামতু। সাজাদা ওয়াজহিয়া লিল্লাযী খালাক্বাহু ওয়া সাওয়্যারাহু ওয়া শাক্কা সাম‘আহু ওয়া বাসারাহু, তাবারাকাল্লাহু আহ্সানুল খালিক্বীন) ।
“হে আল্লাহ! আমি আপনার জন্যই সিজদা করেছি, আপনার উপরই ঈমান এনেছি, আপনার কাছেই নিজেকে সঁপে দিয়েছি। আমার মুখমণ্ডল সিজদায় অবনত সেই মহান সত্তার জন্য; যিনি একে সৃষ্টি করেছেন এবং আকৃতি দিয়েছেন, আর তার কান ও চোখ বিদীর্ণ করেছেন। সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ্ অত্যন্ত বরকতময়।” মুসলিম ১/৫৩৪

اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي كُلَّهُ: دِقَّهُ وَجِلَّهُ، وَأَوَّلَهُ وَآخِرَهُ، وَعَلاَنِيَّتَهُ وَسِرَّهُ».
খ) (আল্লা-হুম্মাগফির লী যাম্বী কুল্লাহু; দিক্কাহু ওয়া জিল্লাহু, ওয়া আউয়ালাহু ওয়া ‘আখিরাহু, ওয়া ‘আলানিয়্যাতাহু ওয়া সিররাহু) ।
“হে আল্লাহ! আমার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিন— তার ক্ষুদ্র অংশ, তার বড় অংশ, আগের গুনাহ, পরের গুনাহ, প্রকাশ্য ও গোপন গুনাহ।”
মুসলিম ১/২৩০

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ، وَبِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقوبَتِكَ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْكَ، لاَ أُحْصِي ثَنَاءً عَلَيْكَ، أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلَى نَفْسِكَ».
গ) (আল্লা-হুম্মা ইন্নী আঊযুবিরিদ্বা-কা মিন সাখাত্বিকা, ওয়া বিমু‘আ-ফা-তিকা মিন ‘উক্বুবাতিকা, ওয়া আঊযু বিকা মিনকা, লা উহ্সী সানা-আন আলাইকা, আনতা কামা আসনাইতা ‘আলা নাফসিকা)।

“হে আল্লাহ! আমি আপনার সন্তুষ্টির মাধ্যমে অসন্তুষ্টি থেকে, আর আপনার নিরাপত্তার মাধ্যমে আপনার শাস্তি থেকে আশ্রয় চাই। আর আমি আপনার নিকটে আপনার (পাকড়াও) থেকে আশ্রয় চাই। আমি আপনার প্রশংসা গুনতে সক্ষম নই; আপনি সেরূপই, যেরূপ প্রশংসা আপনি নিজের জন্য করেছেন”। মুসলিম ১/৩৫২

 https://youtu.be/-qIL-ZrGPZI
https://youtu.be/Bobr_Jdxb0g