রজব থেকে রামাদান ডায়েরী-১৩ (ই’তিকাফ)

 

ই’তিকাফের শাব্দিক অর্থ অবস্থান করা যা দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হতে পারে।

রামাদান মাসের শেষ দশদিনের এই ই’তিকাফ মুমিন মুমিনার জীবনে একটি শিক্ষামূলক নিবিড় আত্মিক প্রশিক্ষণ, যার ইতিবাচক লক্ষণ সেই ব্যক্তির জীবনে ই’তিকাফের দিনগুলিতেই দেখা যায়, সুবহানাল্লাহী ওয়া বিহামদিহি।

এই ইতিবাচক প্রভাব পরবর্তী রামাদান পর্যন্ত এবং অন্যান্য দিনগুলোতেও রাখে। তাই এই সুন্নাহকে উজ্জীবিত রাখা আমাদের মুসলিম সমাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মহান আল্লাহ বলেছেন:

আর যতক্ষণ তোমরা ই’তিকাফরত (দুনিয়াবী কাজ থেকে বিরত থেকে নিজেকে ইবাদাত ও প্রার্থনার জন্য মসজিদের ভিতর সীমাবদ্ধ রাখা) অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিলিত হয়ো না।

সূরা আল বাকারা: ১৮৭

এই হুকুম নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।

আমরা অনেকেই বছরে কোথাও আনন্দ ভ্রমণের জন্য পূর্বেই পরিকল্পনা করে নেই ছুটি ও আনুসাঙ্গিক বিষয়ের। সারা বছরে এই একটি মাত্র মাসে ক্বদরের রাতকে পাওয়ার জন্য, মহান রবের সাথে একান্ত সান্নিধ্যে কিছু দিন বা সময় নিজেকে গভীর মনোনিবেশে যাওয়ার জন্য, আমরা কি এই রকম একটি পরিকল্পনা নিতে পারি না! এই সময় আমার জীবনকে চালিত করে নিয়ে যেতে পারে সুন্দর শান্তির স্থায়ী জান্নাতের পথে ইনশা’আল্লাহ।

ই’তিকাফ হলো আল্লাহ তা’লার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করা, সময় কম হোক বা বেশী হোক।

শাইখ ইবনু বায (মাজমু আল ফাতওয়া)

ই’তিকাফের সর্বনিম্ন সময়সীমা সম্পর্কে অধিকাংশ আলেমগন যে মত তা’কীদের সাথে পোষণ করেন এবং এটিই সঠিক মত যে এর জন্য মসজিদে অবস্থান করা শর্ত অর্থাৎ ই’তিকাফ মসজিদে হতে হবে এবং তা বেশী বা অল্প সময়ের জন্য হতে পারে, কিছু সময় (সা’আহ) বা মুহূর্তের জন্যও সমাপ্ত ও সংক্ষিপ্ত।

ইমাম আন-নাওয়াউয়ী (আল মাজমু)

পুরুষ ও নারীর জন্য মসজিদের বাইরে ই’তিকাফ করা শুদ্ধ নয়।

ইমাম আন-নাওয়াউয়ী (আল মাজমু)

শাইখ ইবনু উসাইমীন (আশ শারহ আল মুমতি: ৬/৫১৩)

ই’তিকাফ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সুন্নাহ, এবং উম্মাহাতুল মু’মিনীন রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় ই’তিকাফ করেছেন এবং তাঁর (নবী সা.) ইন্তেকালের পরও ই’তিকাফ পালন করেছেন।

সহীহ আল বুখারী: ২০২৬, সহীহ মুসলিম: ১১৭২

একজন নারী সব মসজিদেই ই’তিকাফ করতে পারবেন, সে মসজিদে জামা’আতে সালাত আদায় করতে হবে এমন কোন শর্ত নেই, কারণ জামা’আতে সালাত তার জন্য বাধ্যতামূলক নয়।

ইবনু কুদামাহ (আল মুঘনী: ৪/৪৬৪)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

আমি প্রথম দশদিন ই’তিকাফ করেছি, এই রাতের (লাইলাতুল ক্বদরের) খোঁজে, এর মাঝের দশদিন ই’তিকাফ করেছি, এরপর আমার কাছে এসে বলা হল: এটি শেষ দশকে। সুতরাং আপনাদের মাঝে যে ই’তিকাফ করতে পছন্দ করে/চায়, সে যাতে ই’তিকাফ করে। এরপর লোকেরা তাঁর সাথে ই’তিকাফ করলেন।

সহীহ মুসলিম: ১১৬৭

এই হাদীস থেকে ই’তিকাফের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা যায়:

  • লাইলাতুল ক্বদরের খোঁজ করা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে।
  • এই রাতে ক্বিয়াম করা ও তা উজ্জীবিত করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া।
  • সাহাবা রা. নবী সা.কে অনুসরন করে ই’তিকাফে বসেছিলেন।
  • ই’তিকাফের কষ্টের কথা ভেবে সাহাবীগনের প্রতি ভালবাসা ও দয়ার কারণে ই’তিকাফ চালিয়ে যাওয়া বা না যাওয়ার ইখতিয়ার দিয়েছিলেন।

 

ই’তিকাফের অন্যান্য উদ্দেশ্য:

  • মহান আল্লাহ তা’লার একান্ত সান্নিধ্যে যাওয়া।
  • আত্মশুদ্ধির জন্য মহান আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা।
  • কোন বিঘ্ন ছাড়াই সালাত, দু’আ, যিকির, কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে ইবাদাতে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত রাখা।
  • নফসের কুপ্রবৃত্তি ও কামনা বাসনা যা সাওমের উপর প্রভাব ফেলা থেকে রক্ষা করা।
  • দুনিয়ার অনুমতিপ্রাপ্ত বিষয়সমূহ ভোগ কমিয়ে দেয়া যদিও ভোগ করার সামর্থ্য আছে।
  • ঈমানের দুর্বলতা কাটিয়ে রাসূল সা.এর মহব্বত বাড়ানোর তাগিদ লাভ করা।
  • দুনিয়ার জীবনের সুখ, আরাম ও ভোগ বিলাস ও অতিমাত্রার আকর্ষণ থেকে নিজেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও আখেরাতে জীবনের গুরুত্ব উপলব্ধির মাধ্যমে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে যাওয়া।
  • জান্নাত লাভ করাই হলো জীবনের মূল্যবান একটি মিশন যা লাভের জন্য মূল্যবান সম্পদকে কুরবান করতে প্রস্তুত হওয়া।

আমাদের সমাজে নারীরা যখন মসজিদে জুমা বা তারাবীহ পড়তে যান তখন মসজিদে ই’তিকাফের নিয়্যাত করে প্রবেশ করতে পারেন। যতটুকু সময় মসজিদে থাকবেন পুরোটাই মহান রবের যিকির, তাসবীহ, দুয়া ও নামাজে ব্যস্ত থাকবেন। মহান আল্লাহ আমাদের তাঁর অনুগ্রহকারী বান্দাহ হিসেবে কবুল করে নিন।