পরিকল্পনা (বাড়ীর মুরুব্বীদের জন্য)
- যারা কোরআন পড়তে জানেন তাঁদের অর্থসহ পুরো কোরআন একবার পড়ার জন্য ব্যবস্থা ও সুযোগ করে দিন। যারা কোরআন পড়তে পারেন না উনাদের জন্য অর্থসহ পুরো কোরআন শুনার জন্য মোবাইল/কম্পিউটার/ল্যাপটপ ইত্যাদিতে সেট করে দিন বা আপনার সন্তানকে দিয়ে করিয়ে নিন।
- কিছু ইসলামিক আলোচনা সেট করে রাখুন শুনার জন্য।
- সহীহ দোয়া দরুদ পড়ার পরিকল্পনা দিন।
- নামাজের নিয়ম, সূরাগুলো সহীহ হচ্ছে কি না তা যাচাই করার গুরুত্ব তুলে ধরুন, প্রয়োজনে একজন মুরুব্বী (যিনি সহীহ নিয়ম জানেন) উনাকে কিছুদিন বাসায় আনার ব্যবস্থা করতে পারেন।
- উনাদের দায়িত্ব দিন বাসার ছোট ছেলে-মেয়েদের নবী জীবনী/দুয়া শুনাতে।
- রোযা রাখতে সামর্থ্য না থাকলে এখনি ফিদিয়া আদায়ের ব্যবস্থা করে ফেলুন।
- নির্দিষ্ট রোগী হলে (ডায়াবেটিক) সেই অনুযায়ী ইফতার ও সেহরীর মেন্যু ঠিক করে বাজার করিয়ে ফেলুন।
- সময় নষ্টকারী অনুষ্ঠান দেখা/বেহুদা গল্প করা (গীবত) থেকে বিরত রাখুন।
- দান করার জন্য উনাদের সাথে পরামর্শ করে (কোরআনের আলোকে) দানের খাত বের করুন।
পরিকল্পনা (অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানদের জন্য)
১। কোরআন প্রতিদিন শেখানোর জন্য একজন শিক্ষক নিযুক্ত করুন।
২। কোরআনের গল্প প্রতিদিন একটি করে শুনাতে বলুন/নিজে বলুন।
৩। ছেলে শিশুকে মসজিদে ও মেয়ে সন্তানকে সাথে নিয়ে নামাজ আদায় করুন।
৪। নামাজে পড়া যায় এমন ছোট সূরা অর্থসহ নির্দিষ্ট করে শেখান: ৫-৬টি
৫। আখলাক জাতীয় হাদীস ১টি করে শুনান, প্রয়োজনে মুখস্ত করিয়ে দিন ও বাস্তবে আমল করান।
৬। প্রতিটি কাজের আগে নির্ধারিত যিকির বা দুয়া শেখান ও বাস্তবে পড়ার অভ্যাস করান।
৭। সবাইকে সুন্দর করে সালাম দেয়ার অভ্যাস করান।
৮। টেবিলে ইফতার গুছানোর কাজ দিন।
৯। সেহরীতে জাগিয়ে দিন, সেহরী খেতে উৎসাহিত করুন এবং ফজর নামাজ সাথে নিয়ে পড়ুন।
১০। মাঝে মাঝে রোজা রাখতে উৎসাহিত করুন।
শিশুদের রোযা: আমাদের শিশুদেরও রোযা রাখাতাম। তাদেরকে আমরা তুলা বা পশমের খেলনা তৈরী করে দিতাম। তারা কেউ খাওয়ার জন্য কাঁদলে আমরা তাদেরকে ঐ খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখতাম। আর এইভাবেই ইফতারের সময় হয়ে যেত। সহীহ আল বুখারী: ১৮২১
১১। ওদের হাত দিয়ে দান করান। অন্যদের ইফতার খাওয়াতে কাজ দিন।
১২। টিভিতে কার্টুন বা অন্য কোন বেহুদা অনুষ্ঠান না দেখতে দিয়ে কম্পিউটারে কিছু ইসলামিক প্রামান্য, ইতিহাস, ছোট শিশুদের কোরআন তেলাওয়াত দেখান।
১৩। ইসলামিক ইতিহাস জানার জন্য কিছু কুইজ প্রস্তুত করে শেখাতে পারেন, উপহার দিতে পারেন উৎসাহিত করার জন্য।
এই রোযার মাসটা পরিকল্পিতভাবে পরিবার গঠনের কাজে সময় দিন।
অনেক পিতা এমনকি মায়েরাও বিভিন্ন ব্লগ বা সামাজিক সাইটগুলোতে যেয়ে অনেক সময় দেন, অনেকে হয়তো বলবেন ইসলাম প্রচার ও জানার জন্য যাই।
কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আপনার পরিবারে কি আপনি দিনের এতো সময় ধরে ইসলাম প্রচারের কাজ করছেন? অথবা
নিজের স্বামী বা স্ত্রীর সাথে বসে একটু মতবিনিময় করে ইসলামকে বুঝানোর দায়িত্ব পালন করছেন?
তাই আপনার সময়, চিন্তা, অন্তরকে প্রশ্ন রাখুন: আপনি কি করছেন? সজাগ হোন, শয়তান ভালো কাজের নাম ভাঙ্গিয়ে যেনার কাছে নিয়ে যাচ্ছে কি না?
পরিকল্পনা (প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
১। কোরআন
- অর্থসহ একবার পড়ার জন্য সুযোগ করে নিন।
দিনে ৩০-৩৫ পৃষ্ঠা বা প্রতি ওয়াক্তে ৭ পৃষ্ঠা করে পড়ে নিলে এক মাসে পুরোটা পড়া যাবে। আপনারা অন্যভাবেও নিজেদের সুবিধামতো করে পরিকল্পনা করে নিন।
- হায়েজ/নিফাস অবস্থায়ও তিলাওয়াত শুনা ও অর্থ পড়ার কাজ চালু রাখুন।
- এই সূরা গুলো সহ আপনি যে আয়াতগুলো নামাজে পড়েন অন্তত সেগুলো এই রোযায় শব্দভিত্তিক অর্থ শেখার পরিকল্পনা নিতে পারেন।
সূরা নং- ৯৭, ৯৯, ১০১-১১৪ (সহীহ ভাবে তেলাওয়াত সহ)
- কয়েকটি সূরা অধ্যয়নের (তাফসীর সহ) পরিকল্পনা নিতে পারেন
সূরা নং- ৩৬, ৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৯, ৬৩, ৬৪, ৮৭, ৯০, ৯২
- দোয়া মুখস্থের তালিকা করে নিন। বেশী করে দরুদ পড়ুন।
২। প্রাত্যহিক জীবনে প্রয়োজনীয় হাদিস জানুন ও মানুন – প্রতিদিন ১টি করে সহীহ আল বুখারী ও সহীস মুসলিম থেকে।
৩। তওবা ও ইস্তেগফার বেশী করে করুন। এটা খুবই জরুরী।
অনুশোচনা ও আত্মোপলব্ধি নিয়ে বিগত গুনাহের জন্য ক্ষমা ও আগামী দিনের জন্য হেদায়েতের পথে টিকে থাকার জন্য সাহায্য কামনা মহান আল্লাহর কাছে চাইতে হবে।
সাইয়্যেদুল এস্তেগফার পড়া প্রয়োজন।
৪। নামাজ ওয়াক্ত অনুযায়ী ও খুশু সহকারে সহীহভাবে আদায় করুন।
৫। তারাবীহ ও জুমার নামাজ মসজিদে পড়ায় পরিবারের সবাইকে সহযোগিতা করুন।
৬। তাহাজ্জুদ নামাজে অভ্যস্ত হোন যদিও ২ রাক’আত হয়। মহান আল্লাহর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরী করুন। বেশী করে আল্লাহ তা’লার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, চেয়ে নিন আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস।
চোখের অশ্রু ফেলুন জাহান্নামের ভয়ে, নিজের গুনাহের অনুশোচনায়। পরিবারের সদস্যসহ সকল মু’মিন বান্দাহদের (জীবিত ও মৃত) জন্য দোয়া করুন।
৭। সালাতুত দোহা নামাজে অভ্যস্ত হোন।
৮। নিজের আচার-আচরণ সুন্দর করুন যেন পরিবারে উত্তম মানুষ হিসেবে সাক্ষী পেতে পারেন যা আখেরাতে মুক্তির জন্য সহায়ক।
৯। শিরক-বিদ’আত, হারাম কাজ থেকে পরিচ্ছন্ন হোন।
১০। মিথ্যা কথা (কৌতুক করে হলেও) বলা, গীবত করা, অন্যকে কষ্ট দেয়া ও লোক দেখানো কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
১১। এই রামাদান মাসে নিজের ব্যক্তিগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার তাগিদেই টিভি, কম্পিউটারে সময় কমিয়ে আনুন বা বাদ রাখুন (যদিও ভাল অনুষ্ঠান হয়)
১২। কোন ফরয/ওয়াজিব কাজ আমলে না এনে থাকলে তা এই মাসেই অভ্যাস করে ফেলুন।
১৩। রামাদান মাস জিহাদের মাস, এই মাসেই বেশির ভাগ যুদ্ধ হয়েছিল যা ইসলাম কায়েমের জন্য। এই খাতে দানের উত্তম উদাহরণ আমরা সাহাবা রা. ও মুমিনা নারীদের জীবনে দেখতে পাই। তাই এই মাসে এই খাতে (ইসলাম প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোন কাজে) আপনারাও শরীক হোন।
১৪। যাকাত ও ফিতরার সঠিক হিসেব করে বন্টনের পরিকল্পনা করে ফেলুন।
১৫। প্রতিদিন অল্প কিছু দিয়ে হলেও কাউকে ইফতার করান।
১৬। প্রতিদিন ১টি আয়াত বা হাদীস অন্যকে শুনান।
১৭। ই’তেকাফে বসার পরিকল্পনা রাখুন।
১৮। শেষ দশ রোজা বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে সারা রাত ইবাদাতে মশগুল থেকে পবিত্র মহিমান্বিত রাতের যে সকল ফায়দা রয়েছে তা হাসিল করার চেষ্টার পরিকল্পনা করুন।
১৯। যাদের বিভিন্ন জিনিস (তামাক পাতা, জর্দা, সিগারেট) খেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন এবং একধরনের নেশা হয়ে গিয়েছে, এই রামাদান মাসটিকে আপনারা কাজে লাগাতে পারেন। মহান আল্লাহ তা’লার সাহায্যে ইনশাআল্লাহ এই সমস্ত কুঅভ্যাস থেকে নিজেদের ফিরিয়ে আনতে পারবেন। তবে নিজেদের মনকে সিদ্ধান্ত নেয়াতে হবে প্রথমে। “জীবন” এই দুনিয়াতে একবারই, সময় চলে যাচ্ছে!!!!
আরেকটি দিক, অনেক ভাই/বোনেরা বিভিন্ন সময় হারাম কাজে লিপ্ত থাকেন যেমন – মিউজিক দিয়ে গান শুনা, অশ্লীল সিনেমা নাটক দেখে সময় পার করে, মোবাইল-ফেসবুক দিয়ে অপোজিট সেক্স এর সাথে সময় কাটানো। এই রামাদান মাস হোক পবিত্র একটি মন তৈরীর সময়। যে দিন চলে যাচ্ছে, যা করে যাচ্ছেন তা সবই কালের সাক্ষী হয়ে আমল নামায় লিখে যাচ্ছেন পরিদর্শকরা। তওবা করে এখনি আল্লাহ তা’লার খাস আনুগত্যকারী হওয়ার সময়।
আবার দেখা যায় গৃহ পরিচারিকার মন ভালো রাখার নামে ডাইনিং রুমে টিভি দেখার বা গৃহ পরিচারিকার রুমেই টিভি দিয়ে দেন। ফলে পরিবারের অধঃস্থন বিশেষ এই ব্যক্তিটি ইসলামের সুমহান শিক্ষা থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন, অথচ এই ব্যক্তিটির দীনের জ্ঞান দেয়া ও তা অনুশীলনের সুযোগ করে দেয়াটাও আপনার আমার প্রত্যেকের দায়িত্ব। এই রামাদান মাসের আগেই তাকে কোরআন শেখা ও বুঝার ব্যবস্থা করে দিন। আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা জাগ্রত করে সেই রকম আলোচনা শুনার সুযোগ করে দিন।
মা-বাবার জন্য বলছি, আপনার ছেলে বা মেয়েটি কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে গিয়েছে কি পোশাকে? অপোজিট সেক্স এর সাথে সময় কাটাচ্ছে না তো?? এই রামাদান মাসেই তাদের পর্দার শিক্ষা দিন। হাশরের মাঠে প্রত্যেককেই তার অধীনস্তদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। অনেক বয়স্ক মা বাবা আছেন যারা বুঝতে পারেন না কিভাবে ভালো আমল করে সময় পার করবেন। দয়া করে তাদের একটু যত্নের সহিত কিছু টিপস দেবার ব্যাপারে উদ্যোগী হোন।
মহান আল্লাহ তা’লা আমাদের পরহেজগারী দান করুন, আমীন।
আমাদের জীবনের যে কোন সময়, সেই সময় অর্থাৎ মৃত্যুর ফেরেশতা চলে আসবেন এবং একটুও সময় এদিক সেদিক হবে না। মহান আল্লাহ বলেছেন:
কিন্তু তিনি সকলকেই একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। পরে যখন সেই সময় এসে উপস্থিত হয় তখন তার একমুহুর্ত আগে পরে হতে পারে না। সূরা আন নাহল: ৬১
তাই খুব দ্রুত আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন। অবকাশকে আমরা যেন হেলা করে নষ্ট না করে ফেলি, এই সুযোগ আমাদের আমল সুন্দর করার জন্য। অনেকে আগামী দিন করবো, আস্তে আস্তে আল্লাহর দিকে এগুবো ইত্যাদি অনেক কথা বলি যা নিজের জন্য খুব সংকটপূর্ণ, আগামী দিন বা পরে এই সময়টুকু নাও পেতে পারি!!! মহান আল্লাহ বলেছেন:
তোমার আল্লাহকে ডাকো,কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে, চুপে চুপে। নিশ্চিতই তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না, যখন তার সংশোধন ও সুস্থতা বিধান করা হয়েছে। এবং আল্লাহকে ডাকো ভয় সহকারে এবং আশান্বিত হয়ে। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত নেক চরিত্রের লোকদের অতি নিকটে। সূরা আল আ’রাফ: ৫৫-৫৬
হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা কর অগ্নি হতে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম-হৃদয়, কঠোর-স্বভাব ফিরিশতাগণ, যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা তাঁদের আদেশ করেন এবং তাঁরা যা করতে আদিষ্ট হয় তাই করে।
সূরা আত তাহরীম: ৬