নারীর বিশেষ পবিত্রতা-১

নারীর সাময়িক বিরতিতে করনীয়

(ঋতুস্রাব,নিফাস,ইস্তিহাযা)

নারী জাতি সাধারণত: তিন প্রকার রক্তস্রাবে আক্রান্ত হয়ে থাকে।

যথা:

১) হায়েয- মাসিক রক্তস্রাব।

২) ইস্তেহাযাহ- হায়েয ও নেফাসের দিন উত্তীর্ণ হওয়ার পর যে রক্তস্রাব হয়।

৩) নেফাস- সন্তান প্রসবের পরের রক্তস্রাব)।

 

নারীর মাসিক রক্তস্রাব এর সর্ব নিম্ন ও সর্বোচ্চ সময়-সীমা ও মধ্যবর্তী পৃথকীকরন সময়সীমাঃ

কুর’আন ও সুন্নাহ এর আলোকে নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা নির্ধারন করে দেয়া হয়নি।

মূল কথা যখনই নারীর গর্ভাশয় থেকে প্রাকৃ্তিকভাবে রক্তক্ষরন হবে তখনই হায়েয শুরু এবং পুরু বন্ধ হওয়া দিন পর্যন্তই সেই বিধান থাকবে।দুই রক্তক্ষরনের মাঝেও কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা করে দেয়া হয়নি।

“যদি তোমরা পরস্পর কোন বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে পড় তাহলে সেটিকে আেল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি প্রত্যার্পিত কর। যদি তোমরা আল্লাহ ও কিয়ামত দিবসের উপর বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম।” [সূরা আন-নিসা: ৫৯]

“আমি প্রত্যেক বস্তুর সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়ে তোমার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছি।” [সূরা আন-নাহ্‌ল: ৮৯]

“তারা তোমাকে হায়েয সম্পর্কে প্রশ্ন করে, তুমি বলে দাও, এটা কষ্টদায়ক বস্তু, কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাক এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিকট যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পবিত্র না হয়।” [সূরা আল-বাকারাহ: ২২২]

এখানে স্ত্রী সহবাসের নিষিদ্ধতা নির্দিষ্ট দিনের সাথে সম্পর্কিত করা হয়নি। এর সম্পর্ক হচ্ছে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার সাথে।

এ থেকে বুঝা যায়, বিধানটির কারণ হচ্ছে ঋতু থাকা বা না থাকা। যখনই ঋতু পাওয়া যাবে, বিধান প্রযোজ্য হবে। যখনই পবিত্র হয়ে যাবে, তার বিধান সমূহও রহিত হবে।

তাছাড়া নির্দিষ্ট দিন বেঁধে দেয়ার কোন দলীলও নেই। অথচ বিষয়টি বর্ণনা করে দেয়ার দরকার ছিল। বয়স বা দিনের নির্দিষ্টতা যদি শরীয়ত সম্মত হত, তবে তা অবশ্যই আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাতে বর্ণিত হত।

অতএব এই ভিত্তিতে নারীদের কাছে পরিচিত স্রাব যখনই দেখা যাবে, নারী তখনই নিজেকে ঋতুবতী গণ্য করবে। এখানে কোন দিন নির্দিষ্ট করবে না।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া একটি নীতিমালা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: ‘কুরআন ও সুন্নাহতে আল্লাহ তা’আলা রক্তস্রাবের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু হুকুম-আহকাম বর্ণনা করেছেন, কিন্তু রক্তস্রাব কতদিন থাকতে পারে, এর সর্ব নিম্ন ও সর্বোচ্চ সময়-সীমা কি, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেন নি। এমনকি বান্দার জন্য অত্যাধিক প্রয়োজনীয় এবং জটিল বিষয় হওয়া সত্বেও আল্লাহ তা’য়ালা দুই পবিত্রতার মধ্যবর্তী সময়ের সীমা-রেখা নির্দিষ্ট করেননি। আরবী অভিধানও এর কোন সময়-সূচী নির্ধারণ করেনি।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ হায়েয সম্পর্কে বলেন: ‘নারীদের রেহেম গর্ভাশয়) থেকে যা কিছু বের হবে তাই হায়েয বলেই গণ্য হবে যতক্ষণ না ইস্তেহাযার রক্ত হিসেবে অকাট্য কোন প্রমাণ পাওয়া যায়।’ তিনি আরো বলেন: ‘নারীর লজ্জাস্থান থেকে যখন কোন প্রকার রক্ত বের হবে তখন যদি জানা না থাকে যে, এটা কি রগ থেকে বের হয়ে আসা রক্ত না কোন আঘাত জনিত কারণে প্রবাহিত রক্ত, তাহলে সে রক্তকে হায়েয হিসেবেই গণ্য করতে হবে।’

“তিনি দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি।” [সূরা আল-হাজ্জ: ৭৮]

নিশ্চয়ই দ্বীন সহজ। কেউ দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করে জিততে পারে না। কাজেই তোমরা মধ্য পথ অবলম্বন কর, দ্বীনের) নিকটবর্তী থাক এবং অল্প কিন্তু স্থিতিশীল আমলের প্রতিদানের) সুসংবাদ দাও।)) [বুখারী]

নবী করীম সা.-এর বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত গুনাহ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোন বিষয়ের দুটি দিকের মধ্যে সহজ দিকটাই তিনি গ্রহণ করতেন।

ঋতুস্রাবের কিছু মাস’আলাঃ

১ম বিষয়: রক্তস্রাব নির্দিষ্ট নিয়ম ও পরিমাণের চেয়ে কম অথবা বেশী হওয়া। যেমন কোন নারীর প্রতি মাসে ছয় দিন করে ঋতুস্রাবের অভ্যাস। ছিল কিন্তু এক মাসে ৭ দিন পর্যন্ত ঋতুস্রাব অব্যাহত থাকে অথবা কোন মেয়েলোকের ৭ দিন করে ঋতুস্রাব হয়ে থাকে সেখানে ৬ দিন থাকার পর বন্ধ হয়ে গেল।

২য় বিষয়: নিয়মিত অভ্যাসের আগে-পরে হায়েয আরম্ভ হওয়া। যেমন যেখানে মাসের শেষের দিকে হায়েয আসে সেখানে প্রথম দিকে আসলো অথবা মাসের প্রথম দিকে আসার পরিবর্তে শেষের দিকে আসলো।

উপরোক্ত বিষয় দু’টির হুকুম কি? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ রয়েছে। তবে সঠিক সমাধান হচ্ছে এই যে, নারী যখনই ঋতুস্রাব দেখতে পাবে তখনই ঋতুবতী হিসেবে গণ্য হবে এবং যখনই তা বন্ধ হবে তখনই পবিত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রে পূর্ব অভ্যাসের চেয়ে কম-বেশী হওয়া কিংবা আগে-পরে হওয়া সমান কথা।

তৃতীয় বিষয় হলুদ অথবা মাটি বর্ণের রক্ত প্রসঙ্গ:

কোন মহিলা যদি তার লজ্জাস্থানে জখমের পানির মত হলুদ বর্ণের অথবা হলুদ এবং কাল রং এর মধ্যবর্তী বর্ণের রক্ত দেখে তাহলে সে রক্ত ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে অথবা ঋতুস্রাবের পর পরই পবিত্র হওয়ার পূর্বেই প্রবাহিত হলে ঋতুস্রাব বলে গণ্য হবে এবং এর উপর ঋতুস্রাবের বিধি-বিধান কার্যকরী হবে। পক্ষান্তরে যদি সে রক্ত পবিত্রতা অর্জনের পরে প্রবাহিত হয়ে থাকে তাহলে সেটা ঋতুস্রাবের অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা উম্মে আতিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহা এ প্রসঙ্গে বলেছেন:

আমরা পবিত্রতা অর্জন করার পর হলুদ অথবা মাটিবর্ণের রক্তকে কিছুই মনে করতাম না।)) [হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ রাহিমাহুল্লাহ বিশুদ্ধ সনদ দ্বারা উল্লেখ করেছেন।

ইমাম বুখারী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীস لاَ تَعْجَلْنَ حَتَّى تَرَيْنَ الْقَصَّةَ الْبَيْضَاء অর্থাৎ সাদা পানি না দেখা পর্যন্ত তাড়াহুড়া করো না।)

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার যে হাদীসটির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে তার প্রকৃত বিষয়বস্তু এই যে, তখনকার নারীরা আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহার) খিদমতে দারাজাহ্‌ এমন জিনিষ যা দ্বারা নারী তার লজ্জাস্থান আবৃত করে রাখে) পাঠাতেন, যেন তারা বুঝতে পারে যে, সেখানে ঋতুস্রাবের কোন চিহ্ন বাকী আছে কি না? সে দারাজাহতে হায়েযের নেকড়া বা তুলা ছিল এবং উক্ত নেকড়ায় হলুদ রং দেখে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন: তোমরা সাদা পানি না দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা কর।)) প্রকাশ থাকে যে, হাদীসে বর্ণিত ‘আল-কাস্‌সাতুল বাইযা’ বলা হয় সেই সাদা পানিকে যা হায়েয বন্ধ হওয়ার সময় মহিলার গর্ভাশয় থেকে বের হয়।

হায়েযের হুকুম-আহকামঃ

১) নামায:

ঋতুবতী মহিলার জন্য ফরয হোক কিংবা নফল, সকল প্রকার নামায পড়া নিষিদ্ধ। যদি পড়া হয় তাহলে সে নামায শুদ্ধ হবে না। এমনিভাবে ঋতুবতী মহিলার জন্য নামায ওয়াজিবও নয়। তবে পবিত্র হওয়ার পর অথবা ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পূর্বে কোন ওয়াক্তের পূর্ণ এক রাক’আত পড়তে পারে এতটুকু সময় যদি পেয়ে যায় তাহলে উক্ত ওয়াক্তের নামায কাযা করা ওয়াজিব। এক্ষেত্রে সে সময়টুকু ওয়াক্তের প্রথম দিক হোক অথবা শেষ দিক, এতে কোন পার্থক্য নেই।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে উম্মে আতিয়াহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সা.-কে আমি বলতে শুনেছি, স্বাধীন নারী, পর্দানশীন ও ঋতুবতী মহিলারা দুই ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে যেতে পারবে এবং তারা ধর্মীয় আলোচনা ও মু’মিনগণের দু’আয় উপস্থিত হতে পারবে। তবে ঋতুবতী নারীরা নামাযের স্থান থেকে দূরে থাকবে।

২) রোযা:

ঋতুবতী নারীর পক্ষে ফরয-নফল সর্ব প্রকার রোযা রাখা হারাম এবং রোযা রাখাও তার জন্য জায়েয হবে না। কিন্তু ফরয রোযার কাযা তার উপর ওয়াজিব। কেননা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন:

আমাদের যখন রক্তস্রাব হতো তখন আমাদেরকে শুধু রোযার কাযা করার আদেশ দেয়া হতো। কিন্তু নামাযের কাযা করার আদেশ দেয়া হতো না।)) [বুখারী ও মুসলিম]

রোযা অবস্থায় রক্তস্রাব আসলে তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যায়। যদিও রক্তস্রাব সূর্যাস্তের সামান্য পূর্বে এসে থাকে। তবে ঐ রোযাটি ফরয হয়ে থাকলে তার কাযা ওয়াজিব। কিন্তু রোযাদার মহিলা যদি রোযা অবস্থায় সূর্যাস্তের পূর্বে লজ্জাস্থানের বেদনা অনুভব করে এবং প্রকৃত পক্ষে রক্তস্রাব সূর্যাস্তের পরেই আরম্ভ হয়ে থাকে তাহলে উক্ত নারীর রোযা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে এবং বিশুদ্ধ অভিমত অনুসারে রোযা নষ্ট হবে না।

৩) বাইতুল্লাহ শরীফের তওয়াফ:

ঋতুবতী নারীর জন্য বাইতুল্লাহ শরীফের ফরয ও নফল উভয় প্রকার তাওয়াফ করা হারাম। যদি করা হয় তাহলে তা শুদ্ধ হবে না। এর প্রমাণ হচ্ছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার রক্তস্রাব আরম্ভ হওয়ার পর রাসূলে করীম সা. তাঁকে বলেছিলেন:

পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত তুমি কা’বা শরীফের তওয়াফ ছাড়া হজ্জের অন্যান্য কাজগুলো করে যাও।)) এ হাদীসে নবী সা. হায়েয অবস্থায় আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে তাওয়াফ করতে নিষেধ করেছেন। বুঝা গেল, রক্তস্রাব অবস্থায় কা’বা শরীফের তওয়াফ করা হারাম। তবে হজ্জ ও উমরার অন্যান্য কাজ যেমন সাফা-মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে দৌড়ানো, আরাফার ময়দানে অবস্থান করা, মুযদালিফা ও মিনায় রাত্রি যাপন করা এবং জামরায় পাথর নিক্ষেপ করা ইত্যাদি হারাম নয়। এ থেকে আরো পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যদি কোন মহিলা পবিত্রাবস্থায় তাওয়াফ করে এবং তাওয়াফ শেষ হওয়া মাত্রই হায়েয শুরু হল অথবা সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝে দৌড়ানোর সময় হায়েয দেখা দিল তাহলে তাতে কোন অসুবিধা নেই।

৪) ঋতুবতী নারীর জন্য বিদায়ী তওয়াফ জরুরী নয়:

হজ্জ ও উমরার করণীয় কাজগুলো শেষ করে নিজের দেশের দিকে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে যদি কোন মহিলার রক্তস্রাব আরম্ভ হয়ে যায় এবং রওয়ানা হওয়া পর্যন্তঅব্যাহত থাকে তাহলে বিদায়ী তওয়াফ করা থেকে উক্ত মহিলা মুক্তি পেয়ে যাবে অর্থাৎ বিদায়ী তওয়াফ আর করা লাগবে না) কেননা এ প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস :-এর হাদীস রয়েছে। তিনি বলেন:

সকল হজ্জকারী) কে এ ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তাদের শেষ কাজ যেন কা’বা শরীফের তাওয়াফ দিয়েই হয়। কিন্তু ঋতুবতী নারীর জন্য এই আদেশ শিথিল করা হয়েছে।)) অর্থাৎ তাদের সেই বিদায়ী তওয়াফ করতে হবে না। {বুখারী মুসলিম}

৫) মসজিদে ঋতুবতী নারীর অবস্থান:

ঋতুবতী নারীর মসজিদে এমনকি ঈদগাহে নামাযের স্থানে অবস্থান করা হারাম। এ প্রসঙ্গে উম্মে আতিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসটিকে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করা যায়। তিনি রাসূল ৎ-কে বলতে শুনেছেন:

স্বাধীন, পর্দানশীন ও ঋতুবতী নারীরা যেন বের হয়।)) হাদীসে এও উল্লেখ আছে: ঋতুবতী নারীরা নামাযের স্থান থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে।))

৬) স্ত্রী সহবাস:

রক্তস্রাব চলাকালীন স্ত্রী সহবাস করা স্বামীর জন্য যেমন হারাম ঠিক তেমনি ঐ অবস্থায় স্বামীকে মিলনের সুযোগ দেয়াও স্ত্রীর জন্য হারাম। এ হুকুমটি সরাসরি পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ বলেন:

“তারা তোমাকে হায়েয সম্পর্কে প্রশ্ন করে, তুমি বলে দাও যে, এটা কষ্টদায়ক বস্তু, কাজেই তোমরা হায়েয অবস্থায় স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাক এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিকট যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা পবিত্র না হয়।” [সূরা আল-বাকারাহ: ২২২]

উক্ত আয়াতে মাহীয) শব্দ দ্বারা হায়েযের সময় এবং লজ্জাস্থানকে বুঝানো হয়েছে। এভাবে হাদীস দ্বারাও বিষয়টি প্রমাণিত। প্রিয় নবী সা. বলেছেন: স্ত্রী সহবাস ছাড়া বাকী সব কিছু করতে পার।)) [মুসলিম]

আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে যে, রক্তস্রাব অবস্থায় স্ত্রী সহবাস হারাম হওয়ার ব্যাপারে সমস্ত মুসলমান একমত। এখানে কারো কোন রকম দ্বিমত নেই। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা’আলা এবং পরকালের প্রতি ঈমান রাখে তার জন্য এমন একটি অসৎ কাজে লিপ্ত হওয়া কোনভাবেই বৈধ হবে না, যার উপর কুরআন, সুন্নাহ এবং মুসলমানদের সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর পরও যারা এ অবৈধ কাজে লিপ্ত হবে তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ কারীদের অন্তর্ভুক্ত এবং মু’মিনদের মতাদর্শের পরিপন্থী পথের অনুসারী হিসেবে সাব্যস্ত হবে।

আল-মাজমূ’ শারহুল মুহায্‌যাব ২য় খন্ডের ৩৭ নং পৃষ্ঠায় ইমাম শাফেয়ী রাহিমাহুল্লাহর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে যে, ঋতুস্রাব চলাকালে যে ব্যক্তি স্ত্রী সঙ্গমে লিপ্ত হবে তার কবীরা গুনাহ হবে। আমাদের ওলামায়ে কেরাম যেমন ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন: যে ব্যক্তি হায়েয অবস্থায় স্ত্রী মিলনকে হালাল মনে করবে সে কাফের হয়ে যাবে।

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার যিনি পুরুষের জন্য ঋতুস্রাব চলাকালীন সঙ্গম ব্যতীত স্ত্রীর সাথে এমন সব কাজ করাকে জায়েয করে দিয়েছেন যার মাধ্যমে স্বামী আপন কামোত্তেজনা নির্বাপিত করতে পারে। যেমন চুমু দেয়া, আলিঙ্গন করা এবং লজ্জাস্থান ছাড়া অন্যান্য অঙ্গের মাধ্যমে যৈবিক চাহিদা পূর্ণ করা। তবে নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত অংশ ব্যবহার না করাই উত্তম। কাপড় বা পর্দা জড়িয়ে আড়াল করে নিলে অসুবিধা নেই। কেননা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: নবী করীম সা. ঋতুস্রাব চলাকালীন আমাকে আদেশ করলে আমি ইযার পরতাম। তখন তিনি আমাকে আলিঙ্গন করতেন।))

৭) তালাক:

হায়েয অবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেয়া স্বামীর জন্য হারাম। কেননা মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের সূরা তালাকের ১ম আয়াতে ইরশাদ করেন:

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ إِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاء فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ ১) سورة الطلاق

“হে নবী! তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও তখন তাদেরকে ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে তালাক দাও।”

[সূরা আত-তালাক: ১]

অর্থাৎ এমন সময়ে তালাক দিবে যার মাধ্যমে তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী যেন তালাকের পর থেকে নির্দিষ্ট ইদ্দত গণনা করতে পারে। আর এটা গর্ভবতী অবস্থায় অথবা সঙ্গমবিহীন পবিত্রতার সময়ে তালাক দেয়া ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ রক্তস্রাবের অবস্থায় তালাক দেয়া হলে স্ত্রী ইদ্দত গণনা করতে পারবে না বরং অসুবিধার সম্মুখীন হবে। কেননা যে হায়েযের মধ্যে তাকে তালাক দেয়া হয়েছে সেটা তো ইদ্দতের মধ্যে গণ্য হবে না। এমনিভাবে যদি পবিত্রতার অবস্থায় সঙ্গমের পর তালাক দেয়া হয় তখনও ইদ্দতকাল নির্দিষ্ট করা সম্ভব হবে না। কেননা এই সঙ্গমের দ্বারা স্ত্রীর গর্ভবতী হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ অজানা থাকবে। যদি গর্ভবতী না হয়ে থাকে তাহলে হায়েযের মাধ্যমে ইদ্দত গণনা করবে। এমতাবস্থায় যেহেতু ইদ্দতের প্রকার সম্পর্কে কোন কিছু নিশ্চিত জানা নেই সেহেতু বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তালাক দেয়া হারাম।

১০) গোসল ওয়াজিব প্রসঙ্গ:

ঋতুবতী নারীর ঋতুস্রাব বন্ধ হলে গোসলের মাধ্যমে পুরো শরীরের পবিত্রতা অর্জন করা ওয়াজিব। এ প্রসঙ্গে নবী করীম সা. ফাতেমা বিনতে হুবাইশকে বলেছিলেন:

যখন তোমার রক্তস্রাব আরম্ভ হবে তখন নামায ছেড়ে দিবে। আর যখন বন্ধ হবে তখন গোসল করে নামায পড়বে। [বুখারী]

ওয়াজিব গোসল সমাপনের সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে পুরো দেহটাকে চুলের গোড়া সহ গোসলের মধ্যে শামিল করে নেয়া। আর উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে হাদীস শরীফে বর্ণিত পন্থায় গোসল করা। জনৈকা আসমা বিনতে শাকাল নবী করীম সা.-কে ঋতুবতী মহিলার গোসল সম্পর্কে প্রশ্ন করলে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন:

তোমরা বরইপাতা মিশ্রিত পানি দিয়ে উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করবে। অতঃপর মাথায় পানি ঢালবে এবং উত্তমরূপে ঘষে ঘষে চুলের গোড়ায় গোড়ায় পানি পৌঁছাবে এবং সম্পূর্ণ শরীরে পানি ঢেলে দিবে। পরে কস্তুরী মাখানো এক টুকরা কাপড় দ্বারা পবিত্রতা হাসিল করবে। একথা শুনে আসমা বললেন: কস্তুরী মাখানো বস্ত্র দ্বারা কিভাবে পবিত্রতা হাসিল করবো? তখন নবী সা. বললেন: সুবহানাল্লাহ! তুমি তা দিয়েই পবিত্রতা হাসিল করবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা চুপিসারে তাকে বললেন: রক্তের চিহ্ন উক্ত কস্তুরী মিশ্রিত) কাপড় দ্বারা ঘষে মুছে ফেলবে। [বুখারী]

গোসলের সময় নারীদের মাথায় চুল বাঁধা থাকলে তা খোলা আবশ্যক নয়। তবে যদি এমন শক্তভাবে বাঁধা থাকে যে, চুলের গোড়ায় পানি না পৌঁছার আশঙ্কা থাকে তাহলে বন্ধন খোলা ওয়াজিব। সহীহ মুসলিমে উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত এক হাদীস দ্বারা তাই প্রমাণিত হয়। তিনি রাসূল সা.-কে প্রশ্ন করেছিলেন যে, আমি আমার মাথার চুল বেঁধে রাখি। এখন পবিত্রতার জন্য গোসলের সময় অন্য রেওয়ায়েত অনুযায়ী) অপবিত্রতা ও হায়েযের গোসলের সময় আমি কি তা খুলে নিব? উত্তরে রাসূল সা. বললেন:

না, বরং তোমার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, তুমি মাথার ওপর তিন আঁজলা পানি ঢেলে দিবে। অতঃপর সারা শরীরে পানি ঢেলে পবিত্রতা অর্জন করবে।))

নামাযের ওয়াক্ত চলাকালে ঋতুস্রাব বন্ধ হলে ঋতুবতী মহিলার উপর তাড়াতাড়ি গোসল করা ওয়াজিব, যাতে উক্ত নামায নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করতে পারে। তবে ঋতুবতী মহিলা যদি সফরে থাকে এবং সঙ্গে পানি না থাকে অথবা সাথে পানি আছে কিন্তু ব্যবহার করলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে অথবা অসুস্থতার কারণে ব্যবহার করলে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে তাহলে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করে নিবে।

কিছু কিছু মহিলা এমনও আছেন যারা নামাযের ওয়াক্তের মধ্যেই রক্তস্রাব বন্ধ হওয়া সত্বেও গোসল করতে বিলম্ব করেন এবং এই বলে কারণ দেখিয়ে থাকেন যে এই সময়ে পূর্ণাঙ্গরূপে পবিত্র হওয়া সম্ভব নয়। মূলতঃ এটা কোন দলীল বা ওজর হতে পারে না। কেননা ওয়াজিবের সর্ব নিম্ন স্তর অনুসারে কোন রকম গোসল সেরে ওয়াক্তের মধ্যে নামায আদায় করা সম্পূর্ণ সম্ভব, অসম্ভবের কিছুই নেই। অতঃপর দীর্ঘ সময় পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গরূপে পবিত্রতা অর্জন করে নিতে পারে।