হজ্জের পূর্ব প্রস্তুতি
হজ্জের যাবার জন্য কিছু পূর্ব প্রস্তুতি থাকা দরকার। এত বড় একটি এবাদত যা আমার আপনার শারীরিক অর্থনৈতিক এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়কে কাজে লাগাতে হয়, সেই এবাদতটা অবশ্যই যেন শুধু মক্কা-মদিনা যাওয়া আসার মধ্যে না হয় এবং তা যেন জীবনের রাস্তাকে পরিবর্তন করে একমুখী হয়ে মহান আল্লাহর দেয়া সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে পরিচালিত হয় সেইভাবে নিজেকে তৈরী হতে হবে।
তাই আমাদের থাকা দরকার—
• ব্যক্তিগত প্রস্তুতি—-মানসিক ও শারীরিক
• পারিবারিক দায়িত্ব
• সামাজিক অবস্থান
মানসিক প্রস্তুতি
১। প্রথমেই আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্থির করে নিতে হবে, এটা হজ্জে যারা যেতে চান তাদের জন্য ওয়াজিব।
একমাত্র উদ্দেশ্য হবে মহান আল্লাহর সন্তষ্টি লাভ ও পরকালের সৌভাগ্য অর্জন। নির্দিষ্ট মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহে এমন সব কথা ও আমল দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতে হবে যেন আল্লাহ সন্তুষ্ট হন। মহান আল্লাহ জানিয়েছেন,
. আর তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্জ ও উমরাহ পূর্ণ করো। সূরা আল বাকারা:১৯৬
লোক দেখানো বা হাজী নাম অর্জন করার জন্য বা লোকদের মাঝে গল্প করে গর্ব প্রকাশ করা হতে নিজেকে পূর্ণমাত্রায় বাঁচিয়ে চলতে হবে। কারন এর ফলে মহান আল্লাহর কাছে আমল বাতিল বলে গন্য হবে।
এমনকি অনেকে যদি এইভাবে চিন্তা করেন যে আল্লাহর জন্য এবং সমাজে একজন হাজী বলে সম্মানিত হবো তাহলেও আমল বাতিল বলে গন্য হবে হাদীসের আলোকে।
কারন রাসূল সা. বলেছেন: আল্লাহ বলেন, সমস্ত শরীকদের মধ্যে আমি শিরক হতে সর্বাধিক বেনিয়ায-বেপরোয়া। অর্থাৎ শরীকানা কাজের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং যদি কেউ কোন কাজে আমার সাথে আমি ভিন্ন অন্যকে শরীক করে তখন আল্লাহ তাকে এবং তার শিরককে পরিত্যাগ করে থাকেন। হাদীসে কুদসী,ইমাম মুসলিম
আমাদের মাঝে অনেক ভাই-বোনেরা অনেক ফরয কাজ নিয়মিতভাবে আদায় করতে সচেষ্ট হননি যেমন নামাজ ও পর্দা শুরু করেননি কিন্তু এখন নিয়্যত করেছেন যে হজ্জে যাওয়ার পর সেগুলো নিয়মিত করবো। হজ্জ থেকে ফেরার পর শরীয়ত মেনে চলবো। হজ্জ থেকে ফিরে আর কখনো হারাম রুজির দিকে যাবো না। বাবা-মা,ভাই-বোন ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুসম্পর্ক রাখবো ইত্যাদি। আলহামদুলিল্লাহ। খুবই ভালো চিন্তা, মহান আল্লাহ অবশ্যই ভালো কাজের নিয়্যত করলেই সওয়াব দেন। কিন্তু একটু চিন্তা করুন—আমাদের জীবনের যেখানে কোন নির্দিষ্ট সময় বলে দেয়া নেই-আপনি জানেন না যে হজ্জে যাওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন কিনা! তাহলে কি এই মূহুর্ত থেকেই নিজেকে সংশোধিত করে মহান আল্লাহর কাছে সঁপে দেয়াটা বুদ্ধিমান ইমানদারের কাজ হয় না?
মহান আল্লাহ জানিয়েছেন:
কোন প্রাণীই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরতে পারে না ৷ মৃত্যুর সময় তো লেখা আছে ৷ যে ব্যক্তি দুনিয়াবী পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে আমি তাকে দুনিয়া থেকেই দেবো ৷ আর যে ব্যক্তি পরকালীন পুরস্কার লাভের আশায় কাজ করবে সে পরকালের পুরস্কার পাবে এবং শোকরকারীদেরকে আমি অবশ্যি প্রতিদান দেবো ৷ সূরা আলে ইমরান:১৪৫
তাহলে নামাজ পর্দার মত ফরজ কাজগুলোসহ জীবনের বিভিন্ন দায়িত্ব কেন আমি ফেলে রাখবো? তাহলে মহান আল্লাহতা’আলার কাছে কি জবাবদিহী হবে???
মহান আল্লাহ আরো বলেছেন:
আর তারা (যেন না ভুলে যায়) সেদিনের কথা যেদিন তিনি ডাকবেন এবং জিজ্ঞেস করবেন, “যে রসূল পাঠানো হয়েছিল তাদেরকে তোমরা কি জবাব দিয়েছিলে?” সেদিন তাদের কোন জবাব থাকবে না, তারা নিজেদের মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদও করতে পারবে না ৷তবে যে ব্যক্তি আজ তওবা করেছে, ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করেছে সে-ই সাফল্যলাভের আশা করতে পারে ৷ সূরা কাসাস:৬৫-৬৭
অনেক মা বোনেরা হজ্জের সময়কালীন পর্দার অনুশাসন মেনে চলেন ঠিকই কিন্তু পূর্ব থেকেই নিয়ত করে নেন যে হজ্জ থেকে ফিরে আর পর্দা করবো না, অনেক ভাইরা খুব আবেগ নিয়ে দাঁড়ি রেখে দেন কিন্তু বিদায়ী তাওয়াফ করে ফিরতি ফ্লাইটে উঠার আগেই দাঁড়ি কামিয়ে ফেলেন। আবার অনেকে হজ্জ করে এসে চল্লিশ দিন পর্যন্ত (অনেকে বলে থাকেন হজ্জ থেকে আসার পর ৪০ দিন দু’য়া কবুল হয় এবং এই সময় বাইরে বের হোন না,পর্দাও মেনে চলেন) শরীয়তের নিয়ম নীতি ভালোভাবেই মেনে চলেন অথচ ৪০ দিনের ব্যপারে কোন সহীহ হাদীস জানা যায় নাই এবং এর কোন ভিত্তি নেই।। অবাক ব্যপার যে, যা শরীয়তে বলা নেই তা নিয়ে কিছু মানুষের অতি আগ্রহ অথচ যা শরীয়তে বার বার তাগিদ করা হচ্ছে, সেটার ব্যাপারে একদম উদাসীন। সাময়িক পরিবর্তনের জন্য হজ্জের আহকাম দেয়া হয় নাই। তাই সত্যই যদি নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দিয়ে থাকেন তাহলে মৃত্যুর মূহুর্ত পর্যন্ত আত্মসমর্পনকারী হিসেবে থাকার চেষ্টা করতে হবে,তা না হলে সেটা হবে আল্লাহর সাথে, নিজের সাথে, সমাজের সাথে প্রতারনা, যার শাস্তি আরো ভয়ানক।
২। নিজের সকল প্রকার গুনাহ হতে তাওবাতুন নাসূহার জন্য জলদি করা তার জন্য ওয়াজিব মনে করতে হবে।
সকল অন্যায় ও গুনাহগুলি স্মরন করত এমন খাঁটিভাবে একাগ্রতার সাথে তাওবাহ করবে, যেন সেই অন্যায়গুলি পুনরায় সংঘটিত না করার জন্য দৃঢ়চিত্ত হওয়া যায়।
প্রসঙ্গত জানা থাকা প্রয়োজন যে তাওবাহ শুধুমাত্র আস্তাগফিরুল্লাহ বললেই হয়ে যায় না।
সত্যিকার তাওবাহ করার শর্তসমূহ:
১। ইখলাসের (একনিষ্ঠতা) সাথে তাওবাহ করা।
২। কৃত গুনাহের জন্য অনুতপ্ত হওয়া।
৩। গুনাহের কাজ চিরতরে ত্যাগ করা।
৪। সেই গুনাহের কাজে আবার ফিরে না যাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় সংকল্প করা।
৫। সময় শেষ হওয়ার আগে তাওবাহ করা (মৃত্যুকালে রূহ কবযের আগে, সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদয় হবার আগে)।
৬। কারো হক থাকলে তা ফিরিয়ে দেয়া ও ক্ষমা চাওয়া। এটা খুবই জরুরী।
রাসূল সা. বলেছেন: কোন মুমিন যখন কোন গুনাহের কাজ করে, তখন তার ক্বলবের উপর একটি কালো দাগ বসে যায়। তারপর সে যদি তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তার ক্বলবটি পরিষ্কার হয়ে যায়। আর যদি গুনাহ করা অব্যাহত রাখে তবে ক্রমশঃ দাগটি বাড়তে বাড়তে তার সমস্ত ক্বলব আচ্ছন্ন করে ফেলে। আল জামে আত তিরমিযী
রাসূল সা. আরো বলেছেন: হে মানবসকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা করো। কেননা নিশ্চয়ই আমি দিনে একশ’বার আল্লাহর কাছে তাওবা করি।
সহীহ মুসলিম
মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন:
হে নবী! বলুন, হে আমার বান্দাহগণ, যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমুদয় গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল,পরম দয়ালু। অতএব তোমরা তোমাদের মালিকের দিকে ফিরে এসো এবং তাঁর কাছেই আত্মসমর্পন করো, তোমাদের উপর আল্লাহর আযাব আসার আগেই, অতঃপর তোমাদের আর কোন রকম সাহায্য করা হবে না। সূরা আয যুমার: ৫৩-৫৪
আল্লাহ আমাদের অন্তরের চাওয়া পাওয়া দেখেন, জানেন, বুঝেন। তিনি একমাত্র অন্তর্যামী। যিনি আমাদের সব দিতে পারেন। তাঁর ক্ষমা, দয়া, করুণা, রহমত, বরকত দিয়েই আমরা শান্তি, সুস্থতা, বিপদ থেকে উদ্ধার, রিযিকে বরকতলাভ করে থাকি।
হেদায়ায়েতের আলো এবং মৃত্যু পর্যন্ত সীরাতুল মুস্তাকীমের পথে কায়েম রাখা তিনিই করে দিতে পারেন।
একমাত্র মহান রাহীম ও রাহমানই আমাদের জান্নাতের উত্তরাধীকার বানিয়ে দিতে পারেন।
মহান আল্লাহর কাছে তাই আমরা মন খুলে চোখের পানি ফেলে চলুন না আবার তওবা করে মুমিন হওয়ার অংগীকার করি, যেন সব গুনাহ থেকে নিজেদের পবিত্র করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি।
মাবরুর হজ্জতো সেই হজ্জ যা আমাকে আপনাকে আল্লাহর নিকট আরো অনুগত করে দেয়।
যেই কাজগুলোকে আপনারা মনে করছেন করা প্রয়োজন তাহলে কার জন্য, কোন দিনের আশায় সেগুলো ফেলে রাখছেন????
আমরা মহিলারা বেশী নির্বোধের মত কাজ করি, বিশেষ করে বাংগালী নারী, নিজের আখেরাতের কথা ভাবার সময় নেন না—জীবনকে শুধু রান্না খাওয়া ও ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা করাতে পারলেই আর একটু নামাজটা কোন রকম আদায় করতে পারলেই হলো। কিন্তু না বোনেরা, আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। কবরে আপনি আমি একাই যাব এবং আমার আপনার প্রত্যেকের কাজের উপরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে। এত ভালবাসার স্বামী বা সন্তানেরা কেউই তখন সাফাই করবেন না।
মহান আল্লাহ তায়ালা জানিয়েছেন:
সেদিন মানুষ পালাতে থাকবে নিজের ভাই, বোন,মা, বাপ, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের থেকে ৷ তাদের প্রত্যেকে সেদিন এমন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে যে, নিজের ছাড়া আর কারোর কথা তার মনে থাকবে না৷
সূরা আবাসা: ৩৪-৩৭
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: হে মানুষেরা ! তোমাদের রবের ক্রোধ থেকে সতর্ক হও এবং সেদিনের ভয় করো যেদিন কোন পিতা নিজের পুত্রের পক্ষ থেকে প্রতিদান দেবে না এবং কোন পুত্রই নিজের পিতার পক্ষ থেকে কোন প্রতিদান দেবে না৷ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। কাজেই এ দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে এবং প্রতারক যেন তোমাকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত করতে সক্ষম না হয় ৷
সূরা লোকমান:৩
আমরা যদি একটু খেয়াল করি যখন কেউ মারা যান তার পরমূহুর্ত থেকে তাকে একটি পরিচয়ে সবাই সম্বোধন করে, আর তা হলো মূর্দা বা লাশ। তখন কিন্তু নাম, বউ বা মা বাবা বলে কেউ ডাকে না। আরো বাস্তব সত্য যে ঘরে যে বিছানাতে প্রিয়জনকে নিয়ে থাকা হতো, সেই ঘরেই সেই প্রিয়জনেরা থাকতে মারা যাবার পর ভয় পায়, এত বাস্তব নমুনা আমাদের সামনে দেখা যায়,তারপরও কি আমরা নিজেদের ব্যপারে সচেতন হবো না?
৩। অসিয়ত করে যাওয়া।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
“কোন মুসলিমের যদি কোন কিছু অসিয়ত করার থাকে তার জন্য এটা উচিত হবে না যে, সে অসিয়ত না করে দু’টি রাত যাপন করে”।বুখারি: ২৫৮৭, মুসলিম: ১৬২৭
আলেমগণ বলেন, যদি মানুষের হকের ব্যাপারে কোন অসিয়ত থাকে, যেমন কারো ঋণ, আমানত অথবা কোন ফরজ হক যা অসিয়ত ছাড়া সাব্যস্ত করার উপায় নেই এমতাবস্থায় অসিয়ত করে তা লিখে রাখাও উচিত। আর যদি কারো জন্যে সম্পদ থেকে নফল অসিয়ত করতে চায় তাহলে এক তৃতীয়াংশের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ রাখা প্রয়োজন।
মহান আল্লাহ আমাদের বুঝার ও আমলদার হবার তৌফিক দান করুন। আমাদের ক্ষমা করুন।