আল্লাহর আহবানে বায়তুল্লাহর অতিথির সাড়া-“হে আল্লাহ আমি হাযির-২৮ হজের পর করণীয় কী?

হজের পর করণীয় কী?

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য, যিনি তার বান্দাদের সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছেন এবং দরূদ ও সালাম নবী মুহাম্মদের ওপর, যিনি হাউযে কাউসার ও মহান মর্যাদার অধিপতি এবং তার পরিবার ও সাথীদের ওপর, আর সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর তাদের অনুসরণকারী প্রত্যেকের ওপর।

যখন আপনারা বাড়ি ফিরার ইচ্ছা করেন আপনাদের মনে পড়ে পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন ও বন্ধু-বান্ধবদের কথা। তাদের জন্য বিভিন্ন উপহার সংগ্রহ করেন। যার সামর্থ্য রয়েছে, ব্যবসার জন্য অতিরিক্ত জিনিস পত্র খরিদ করেন। এতে কোন সমস্যা নেই, কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

তোমাদের উপর কোন পাপ নেই যে, তোমরা ‎‎তোমাদের রবের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ‎অনুসন্ধান করবে। সুতরাং যখন তোমরা ‎আরাফা থেকে বের হয়ে আসবে, তখন ‎মাশআরে হারামের নিকট আল্লাহকে স্মরণ ‎কর এবং তাকে স্মরণ কর যেভাবে তিনি ‎‎তোমাদেরকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও ‎‎তোমরা এর পূর্বে অবশ্যই পথভ্রষ্টদের অন্ত‎র্ভুক্ত ছিলে।

সূরা বাকারা:১৯৮

ইমাম কুরতুবি রহ. বলেন: “এ আয়াত প্রমাণ করে যে, হাজি সাহেব হজ পালন করার সাথে ব্যবসাও করতে পারবেন, এ নিয়ত শিরক হিসেবে গণ্য হবে না এবং এ জন্য তার ফরয ইখলাস ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। ইমাম দারাকুতনি তার সুনান গ্রন্থে আবু উমামাহ তাইমি থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন: আমি ইব্‌ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করেছি: “আমি হজের সফরে ভাড়ার কাজ করি (যেমন উট ইত্যাদি ভাড়া দেই), কতক লোক বলে: তোমার হজ নেই। ইব্‌ন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন: এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে তাকে জিজ্ঞাসা করল, যেরূপ তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছ, তিনি চুপ থাকলেন, অতঃপর নাযিল হল:

“তোমাদের উপর কোন পাপ নেই যে, তোমরা ‎‎তোমাদের রবের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ ‎অনুসন্ধান করবে…”। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “নিশ্চয় তোমার হজ রয়েছে”। অর্থাৎ তোমার হজ বিশুদ্ধ।

সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,

প্রয়োজন অনুযায়ী দুনিয়া গ্রহণ করলে ইখলাস ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, তবে হাজি সাহেব, আপনি যখন ঐ পবিত্র নিদর্শনগুলো বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করছিলেন তখন আপনার অনুভূতি কেমন হয়েছিল? হাজি সাহেব, আপনি অবশ্যই জানেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন তওয়াফে বিদা (বিদায়ী তওয়াফ) ব্যতীত মক্কা প্রস্থান না করে। ইব্‌ন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “লোকেরা (হজ শেষে) নিজ নিজ রাস্তা গ্রহণ করত, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন:

কেউ প্রস্থান করবে না, যতক্ষণ না তার শেষ কর্ম হয় তওয়াফে বিদা সহীহ মুসলিম

সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,

এরূপ নির্দেশ প্রদান করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথীদেরকে যখন তারা পবিত্র কাবা প্রস্থান করার ইচ্ছা করেছিল; যাতে তারা মক্কা থেকে চলে আসার সময়ে সর্বশেষ কর্ম হিসেবে তওয়াফ বিদা সম্পন্ন করার মাধ্যমে সে ঘরের বড়ত্ব ও মর্যাদা দ্বারা তাদের দৃষ্টি ও অন্তর পূর্ণ হয়। আল্লাহ তার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করুন।

আর আপনি সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,

যখন বাড়ি ফিরার প্রস্তুতি নিয়ে পবিত্র কাবা ঘর বিদায় জানাচ্ছিলেন তখন আপনার অনুভূতি কেমন হয়েছিল? ভাই, কোন সন্দেহ নেই ঐ পবিত্র ঘর বিদায় জানানো সত্যিই কঠিন, বিশেষ করে যে অন্তর হজের পুরো সময়ে একমাত্র তার রবের ধ্যানে নিবিষ্ট ছিল, তার কাছে বিদায় ঘণ্টা সত্যিই বেদনাদায়ক!

সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,

স্মরণ করুন, এখন আপনি পবিত্র কাবা ঘরকে শেষ বারের মত সম্মান করছেন, অথচ ইতোপূর্বে আপনি অবস্থান করছিলেন ইবাদতের দিনগুলোয় ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের পুণ্য মৌসুমে। সত্যি হজের সারাক্ষণ ও প্রতি মুহূর্ত খুব ভাগ্যবান! কিন্তু প্রিয় ভাই, একটি জিজ্ঞাসা: আপনি যখন বাড়ি ফিরবেন ইবাদতের ধারাবাহিকতা কি বন্ধ হয়ে যাবে? অথচ আপনি স্মরণ করবেন মহান ও পবিত্র ঘর কাবার নিকট আল্লাহর সান্নিধ্যে আপনার উপস্থিতির কথা, আপনি স্মরণ করবেন আরাফার দিন ও তার বড়ত্বের কথা এবং মিনার দিনগুলো ও তার সম্মানের কথা!

সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,

এরপর কীভাবে আপনি আপনার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবেন! বরং ইবাদতে আত্মনিয়োগ করুন; জীবনের জন্য নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করুন; যেন মাবরুর হজকারীদের গুণাগুণ আপনি অর্জন করতে সক্ষম হন। হাসান বসরি রহ. বলেছেন: “হজ্জে-মাবরুর হচ্ছে ব্যক্তির (হাজির) দুনিয়াত্যাগী ও আখিরাতমুখী হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করা”।

কেউ বলেছেন: হজ্জে মাবরুর এর নিদর্শন: “হজ শেষে এর আলামত স্পষ্ট হয়, যদি আগের চেয়ে ভালো অবস্থা নিয়ে বাড়ি ফিরে, বুঝা যাবে তার হজ মাবরুর”।

আরেকটি বিষয় প্রিয় হাজি ভাই ও বোনেরা : আপনি যখন পবিত্র কাবা ঘর বিদায় জানাচ্ছেন, দোয়া করুন এটাই আপনার শেষ সাক্ষাত না হয়। কেননা, ইবাদতের পর ইবাদতে মগ্ন থাকা যেমন দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার আলামত, অনুরূপ পাপের পর পাপে লিপ্ত থাকা গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতার নিদর্শন।

সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,

ইবাদতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করুন, মনে রাখবেন কিয়ামতের দিন আপনার সফলতার চাবিকাঠি এটাই। দেখুন আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:

কোন আমল আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়? তিনি বললেন: ধারাবাহিক আমল, যদিও তা কম হয়

সহীহ মুসলিম

সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,

নেককার হওয়ার আলামত হচ্ছে নিয়মিত ইবাদত করা যদিও তার পরিমাণ হয় সামান্য। তাই , এ গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আপনাকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি: আপনি নেক আমলকে আঁকড়ে ধরুন, তা থেকে কখনো বিচ্যুত হবেন না। যত ছোট হোক কোন আমলকে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না, আল্লাহ আপনাকে খাতেমা বিল খায়ের তথা শুভ সমাপ্তি দান করবেন এবং আপনার হজের বরকত আপনার জন্য অক্ষত রাখবেন, ইনশাআল্লাহ।

সম্মানিত হাজি সাহেব/সাহেবা,,

আপনি কখনো তাদের মতো হবেন না, যারা নির্দিষ্ট মৌসুম ব্যতীত ইবাদতের কথা মনে করে না; এসব মৌসুম শেষ হলে তারা তাদের পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। আলকামা রহ. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করেন: “হে উম্মুল মুমেনিন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল কেমন ছিল? তিনি কি ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন নির্বাচন করতেন? তিনি বললেন: না, তার আমল ছিল নিয়মিত। তোমাদের কার সে রকম সামর্থ্য রয়েছে, যেরূপ সামর্থ্য ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের?!”। [বুখারি]

মুহাম্মদ ইব্‌ন কাসেম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণনা করেন, যখন তিনি কোন আমল করতেন, তাতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেন।

প্রিয় হাজি ভাই/ বোনেরা ,

ধৈর্যসহ ইবাদতে অবিচল থাকা জরুরী। আপনি আপনার হজ পরবর্তী জীবন নতুনভাবে আরম্ভ করুন। পাপ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরুন। আল্লাহর আনুগত্য ও পাপ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা নিঃসন্দেহে মুমিনের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার আলামত।

মায়মুন ইব্‌ন মেহরান রহ. বলেছেন: “সবর দু’প্রকার: মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করা ভাল, কিন্তু তার চেয়ে অধিক ভাল পাপ থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করা”।

সম্মানিত হাজি ভাই/বোনেরা,

আপনি কখনো তাদের মতো হবেন না, যাদের সম্পর্কে ইমাম ইব্‌নুল কাইয়ূম রহ. বলেছেন:

“পাপিষ্ঠ ও হতভাগারা তাদের প্রবৃত্তি ও নফসের অনুসরণে অধিক ধৈর্যশীল, কিন্তু তাদের রবের আনুগত্যে তারা সবচেয়ে অধৈর্য। তারা শয়তানের আনুগত্যের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ধৈর্যের পরীক্ষা দেয়, কিন্তু আল্লাহর আনুগত্যে ন্যূনতম ধৈর্য প্রদর্শন করে না। তারা স্বীয় শত্রুকে খুশি করার জন্য প্রবৃত্তির অনুসরণে কঠোর পরিশ্রম করে, কিন্তু তাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য সামান্য কষ্ট স্বীকার করে না। তারা শয়তানের আনুগত্য ও নফসের হুকুম তামিলে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে, কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ পালন ও রাসূলের অনুসরণে তারা পুরোপুরি অক্ষমতা প্রদর্শন করে। এরাই কপালপোড়া ও হতভাগা। তারা কখনো আল্লাহর নিকট সম্মান পাবে না। কখনো তারা সেসব নেককার লোকদের কাতারে দাঁড়াতে পারবে না, যাদেরকে আল্লাহ কিয়ামতের জনসমুদ্রে আহ্বান করবেন: “কোথায় মুত্তাকীগণ” বলে, যেন উপস্থিত সবাই তাদের মর্যাদা প্রত্যক্ষ করে, তাদের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষী দেয়।

হাজি ভাই/বোনেরা,

সবরকারীদের শেষ ফল জান্নাত। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

“যারা তাদের রবের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সবর ‎করে, সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে ‎রিযক প্রদান করেছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ‎ব্যয় করে এবং ভাল কাজের মাধ্যমে মন্দকে দূর ‎করে, তাদের জন্যই রয়েছে আখিরাতের শুভ ‎পরিণাম।‎ ‎স্থায়ী জান্নাতসমূহ, যাতে তারা এবং তাদের ‎পিতৃপুরুষগণ, তাদের স্ত্রীগণ ও তাদের সন্তানদের ‎মধ্যে যারা সৎ ছিল তারা প্রবেশ করবে। আর ‎‎ফেরেশতারা প্রতিটি দরজা দিয়ে তাদের নিকট ‎প্রবেশ করবে। ‎(আর বলবে) ‘শান্তি তোমাদের উপর, কারণ তোমরা ‎সবর করেছ, আর আখিরাতের এ পরিণাম কতই না ‎উত্তম”।

সূরা রাদ:২২২৪

এখানে আল্লাহর বাণী: “‘শান্তি তোমাদের উপর, কারণ তোমরা ‎সবর করেছ, আর আখিরাতের এ পরিণাম কতই না ‎উত্তম”— এ সম্পর্কে ফুযাইল ইব্‌ন আয়াদ রহ. বলেছেন: “তারা আল্লাহর নির্দেশিত বিধান পালনে ধৈর্য ধারণ করেছেন, তদ্রূপ তারা আল্লাহর নিষিদ্ধ বস্তু পরিহার করার ক্ষেত্রেও ধৈর্যধারণ করেছেন”।

প্রিয় হাজি ভাই/বোন,

নফস স্বাভাবিকভাবে অলস ও আরামপ্রিয়। আপনি কখনো তার আশা পূর্ণ হতে দিবেন না, তবেই শয়তান আপনাকে কখনো কাবু করতে পারবে না। হাসান বসরি রহ. বলেছেন: “শয়তান যখন দেখে যে তুমি আল্লাহর ইবাদতে নিয়মিত মগ্ন, সে তোমাকে সীমালঙ্ঘন করাবে এবং সীমালঙ্ঘন করাবে, তারপরও যদি তোমাকে ইবাদতে মগ্ন দেখে, তখন তোমার ওপর বিরক্ত হয়ে তোমাকে সে পরিত্যাগ করে। আর যদি তুমি কখনো এরূপ, আবার কখনো সেরূপ হও, তাহলে তোমার ব্যাপারে সে আশাবাদী হয়”।

প্রিয় হাজি ভাই/বোন,

আপনি আপনার হজ থেকে আগমন করেছেন, বেশি দিন হয়নি আপনি হজের ন্যায় মহান ইবাদত শেষে বাড়ি ফিরেছেন। আপনি যদি হজের দিনগুলোর ন্যায় ইবাদতে মগ্ন থাকেন আপনার ব্যাপারে কল্যাণের আশা করা যায়। প্রিয় হাজি ভাই, মন্থরতা ও অলসতা সৃষ্টি হওয়ার আগে আপনি আপনার ইবাদতের ধারাবাহিকতা অটুট রাখুন। যদি আপনি অলসতায় গা হেলিয়ে দেন তাহলে ‘নফসে আম্মারা’ আপনাকে কাবু করবে এবং শয়তান আপনার ওপর প্রভাব বিস্তারে সফল হবে, ফলে আপনার হজ ধুলো-বালিতে মিশে যাবে।

হারিস ইব্‌ন কায়েস রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: “যখন তুমি কোন ভাল কাজ করার ইচ্ছা কর, আগামীকাল পর্যন্ত তা বিলম্ব কর না। আর যদি পার্থিব বিষয় হয় তাহলে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন কর। যদি তুমি সালাতে থাক এবং শয়তান তোমাকে বলে যে তুমি লোকদের দেখাচ্ছ, তাহলে তুমি সালাত আরও দীর্ঘ কর।”

হাজি ভাই/বোন!

দ্রুত করুন, দ্রুত করুন। কখনো বলবেন না আগামীকাল করব অথবা অতিসত্বর করব। দেখুন সুমামা ইব্‌ন বাজাদ আস্‌সুলামি তার সম্প্রদায়কে উপদেশ দিয়ে বলেন: “হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে ‘শীঘ্রই করব, শীঘ্রই সালাত আদায় করব, শীঘ্রই সিয়াম পালন করব’ ইত্যাদি কথা থেকে সতর্ক করছি”।

হাজি ভাই/বোন,

পরিশ্রম করুন, যেমন পরিশ্রম করেছেন হজের দিন ও পবিত্র স্থানসমূহে; অলস হবেন না। আল্লাহ তা’আলা বলেন:

আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন

 সূরা রূম:৬৯

অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে:

সুতরাং যে সীমালঙ্ঘন করে, আর দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়, নিশ্চয় জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল আর যে স্বীয় রবের সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজকে বিরত রাখে, নিশ্চয় জান্নাত হবে তার আবাসস্থল

সূরা নাযিআত:৩৭৪১

প্রিয় হাজি ভাই/বোন,

আল্লাহর নিকট অধিক দোয়া করুন যেন আপনাকে তিনি ইবাদতে অবিচল থাকার মদদ দান করেন। আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ বৃদ্ধি করুন, তার দরবারে আকুতি-মিনতি বাড়িয়ে দিন, যেন তিনি আপনার কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেন এবং আপনি তার দ্বীনে অবিচল থাকার তৌফিক প্রাপ্ত হন। লক্ষ্য করুন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার জন্য আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রার্থনা করতেন।

উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অধিক দোয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: তিনি বলেন: তার সর্বাধিক দোয়া ছিল:

“হে অন্তরসমূহ পরিবর্তনকারী, আমার অন্তরকে আপনার দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন”। এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:

“এমন কোন মানুষ নেই যার অন্তর আল্লাহর আঙ্গুলসমূহ থেকে দু’আঙ্গুলের মাঝে নয়। যাকে ইচ্ছা তিনি অবিচল রাখেন, যাকে ইচ্ছা তিনি বক্র করেন”।

 তিরমিযি, আহমদ, ইব্ আবি শায়বাহ, সিলসিলাতুল আহাদিসিস সাহিহা: ২০৯১

অপর বর্ণনায় রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন:

“হে অন্তরসমূহ স্থিরকারী, আমাদের অন্তরগুলো আপনার দ্বীনের ওপর স্থির করে দিন”।

ইব্ মাজাহ, সহিহ ইব্ মাজাহ লিল আলবানি:১৬৬

প্রিয় হাজি ভাই/বোন,

যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্য তার রবের নিকট সর্বাধিক প্রার্থনা করেন, অথচ তিনি আল্লাহর মহান নিদর্শনসমূহ প্রত্যক্ষ করেছেন যা তার দ্বীনের ওপর অবিচল থাকার জন্য যথেষ্ট, তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হওয়া উচিত?! আপনি যে যুগে অবস্থান করছেন সেখানে ফিতনার ছড়াছড়ি এবং গোমরাহির সকল উপকরণের বিস্তার প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমন এক যুগ, যেখানে সত্যের সাথী ও কল্যাণের সাহায্যকারী পাওয়া দুষ্কর, বরং দ্বীনের ওপর আপনার অবিচলতা দেখে আপনাকে নিয়ে উপহাসকারী, আপনার দিকে অশ্রাব্য সকল বাক্য নিক্ষেপকারীর অভাব নেই। কিন্তু মুমিন কখনো এসবের পরোয়া করে না। সে সর্বদা নিজ রবের সাক্ষাত লাভের প্রহর গুনে। তাদের দিকে ফিরে তাকানোর ফুরসত তার নেই। অতএব হাজি ভাই, আপনার কর্তব্য বেশি বেশি আল্লাহর নিকট দোয়া করা, যেন তিনি আপনাকে তার দ্বীনের ওপর অবিচল রাখেন। আপনি একান্তভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, ইবাদতের স্বাদ আস্বাদন করুন, আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করে সান্ত্বনা লাভ করুন। গাফেল ও অমনোযোগীদের মত দোয়া করবেন না, যারা তাদের মুখের কথার অর্থের দিকেও লক্ষ্য করে না। হাজি ভাই, আপনার একান্ত কর্তব্য আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল ও অটল থাকা, তবেই আপনি হজের সুফল লাভ করবেন এবং প্রাণ ভরে তার স্বাদ আস্বাদনে সক্ষম হবেন।

হাজি ভাই/বোন,

আপনার বাড়ি ফিরার মুহূর্তে আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি: আপনি কখনো আত্মগর্বী ও অহংকারীদের ন্যায় নিজেকে দেখবেন না, যারা সামান্য আমল আঞ্জাম দিয়ে নিজেদেরকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ও উত্তম জ্ঞান করে।

আপনি সর্বদা নিজের দিকে ত্রুটির দৃষ্টি দিন, কারণ আপনি যত ইবাদত সম্পন্ন করুন, আল্লাহর সামান্যতম নিয়ামতের বিনিময়েও তা যথেষ্ট নয়। আপনি যদি জানতে চান নেক আমল সম্পন্ন করার পর নেককারদের অবস্থা কেমন হয়, তাহলে নিম্নের বর্ণনাটি দেখুন; কীভাবে আল্লাহর বান্দারা সর্বদা নিজেদের ত্রুটির স্বীকারোক্তি প্রদান করতেন।

দেখুন, আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর তার প্রসিদ্ধ খুৎবায় বলেছেন: “হে লোক সকল, আমাকে তোমাদের ওপর খলিফা নিযুক্ত করা হয়েছে, অথচ আমি আপনাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি নই…”

হাসান বসরি রহ. বলেছেন: “নিশ্চয় তিনি তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু মুমিনগণ নিজেদেরকে ছোট মনে করেন।”

মুহাম্মদ ইব্‌ন আতা রহ. আমাদের নিকট বর্ণনা করেন: “আমি একবার আবু বকরের সাথে বসা ছিলাম। তিনি একটি পাখি দেখে বললেন: পাখি! তোমার সৌভাগ্য, তুমি গাছে গাছে খাও অতঃপর মল ত্যাগ কর, এরপর আর কিছু নেই; তোমার ওপর কোন হিসাব, কোন জবাবদিহিতা নেই; আমার ইচ্ছা হয় আমি যদি তোমার স্থানে হতাম! আমি তাকে বললাম: আপনি এরূপ কথা বলছেন, অথচ আপনি আল্লাহর রাসূলের সিদ্দিক?!”

ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেখুন, তিনি বলেন: “যদি কিয়ামতের দিন কেউ ঘোষণা করে: হে লোক সকল তোমরা সকলে জান্নাত প্রবেশ কর একজন ব্যতীত, আমি মনে করব সে ব্যক্তিই আমি”।

হাজি ভাই/বোন,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখুন, তিনি আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন আল্লাহর ইবাদত কেমন হওয়া উচিত। তিনি রাতে এত দীর্ঘ কিয়াম করতেন যে তার দু’পা ফেটে যেত। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তিনি বললেন:

আমি কি আল্লাহর শোকরগোযার বান্দা হব না (বুখারি) তিনি আরও বলেছেন:

আল্লাহর শপথ! আমি দিনে সত্তরবারের অধিক আল্লাহর ইস্তেগফার করি তার নিকট তওবা করি [বুখারি]

হাজি ভাই/বোন,

আপনি ভেবে দেখেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বাপর সকল পাপ মোচন করে দেয়ার পরও যদি তিনি এভাবে আল্লাহর ইবাদতে দণ্ডায়মান থাকেন, এরপর কারো পক্ষে বলা সম্ভব: আমি আল্লাহর যথাযথ ইবাদত করেছি?!

সম্মানিত হাজি ভাই/বোন,

আপনি আপনার নফস দমন করলে সে আপনার অনুগত থাকবে, আর যদি তার দিকে পূর্ণতা ও সন্তুষ্টির দৃষ্টি দেন, তাহলে সে আপনার আনুগত্যে কসুর করবে, একসময় আপনার ইবাদতে বিঘ্ন ঘটাবে। প্রিয় হাজি ভাই! ইবাদতের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নফসের অলসতার বিপরীতে আমি আপনাকে আশ্চর্য এক প্রতিষেধকের কথা বলতে পারি, যদি আপনি তা গ্রহণ করেন তাহলে সুন্দর ফল লাভ করবেন। আপনি জানেন তা কি?! নিশ্চয় তা হচ্ছে মৃত্যু। মনে করুন, হাজি ভাই, দুনিয়া ত্যাগ করে আপনি আখিরাতে প্রস্থান করছেন, যেখানে নেককার ও বদকারদের প্রতিদান দেয়া হবে। আপনি যদি চান আপনার হজের বরকত বিদ্যমান থাক— তাহলে নফসকে মৃত্যু স্মরণ করিয়ে দিন। কারণ তখন সে আল্লাহর আনুগত্যে দ্রুত অগ্রসর হবে ও ইবাদত আঞ্জাম দেয়ার ক্ষেত্রে উদ্যমতা দেখাবে। এই দেখুন আমাদের নবী সা. ইব্‌ন ওমরকে তার গর্দান ধরে বলেছেন:

তুমি দুনিয়াতে এভাবে থাক যেন তুমি পরদেশী বা পথিক ইব্ ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন: যখন তুমি সন্ধ্যা কর সকালের অপেক্ষা কর না, যখন তুমি ভোর কর সন্ধ্যার অপেক্ষা কর না তুমি তোমার সুস্থতা থেকে অসুস্থতার সম্বল গ্রহণ কর এবং জীবন থেকে মৃত্যুর জন্য সঞ্চয় কর [বুখারি]

ইমাম নববি রহ. বলেছেন: “এ হাদিসের অর্থ হচ্ছে দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে যেয়ো না এবং তাকে স্থায়ী নিবাস হিসাবে গ্রহণ কর না, এখানে চিরদিন থাকার চিন্তা কর না, এর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত কর না যেমন পরদেশী পরদেশের সাথে গভীর সম্পর্ক কায়েম করে না।

হাজি ভাই/বোন,

হাসান বসরি রহ. বলতেন: “দ্রুত কর! দ্রুত কর! কারণ (জীবনের) মূল হচ্ছে কেবল নিঃশ্বাস, যদি তা বন্ধ করে দেয়া হয়, তাহলে তোমাদের আল্লাহ্‌র নৈকট্য অর্জনের আমল শেষ হয়ে যাবে। আল্লাহ তাকে রহম করুন, যে নিজের দিকে তাকিয়ে পাপের জন্য ক্রন্দন করে।” তারপর তিনি এ আয়াতটি পড়েন:

 “আমি তো কেবল তাদের জন্য নির্ধারিত কাল গণনা করছি (সূরা মারইয়াম:৮৪)

এরপর তিনি কেঁদে বলেন: “ভাই! জানেন নির্ধারিত কাল কি? আপনার নফস বের হওয়া। অপর নির্ধারিত কাল হচ্ছে আপনার পরিবার-পরিজন ত্যাগ করা। অপর নির্ধারিত কাল হচ্ছে আপনার কবরে প্রবেশ করা।”

প্রিয় হাজি ভাই/বোন,

এই দেখুন ওমর ইব্‌ন আব্দুল আযিয রহ. বলেন: “দুনিয়ার ভোগ-বিলাস ও চাকচিক্য সত্যেও দুনিয়াবাসীদের জীবন বিষাদময় করে দিয়েছে মৃত্যু। মৃত্যু তাদের দুয়ারে অকস্মাৎ হানা দিয়ে জীবন সাঙ্গ করে দেয়। মৃত্যু যাকে সতর্ক করতে পারেনি তার জন্য ধ্বংস, সর্বনাশ! ধ্বংস তার জন্যও যে সচ্ছলতার সময় মৃত্যুকে স্মরণ করে কোন কল্যাণ করতে সক্ষম হয় নি, যার ফল সে দুনিয়া ও পরিবার ত্যাগ করে ভোগ করবে”। অতঃপর তার ওপর কান্না প্রবল হয়, তিনি চলে যান।

ভাই /বোনেরা আমার!

আর কত দিন আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে টালবাহানা করবেন? আর কত দিন আশায় আশায় কাটাবেন? আর কত সুযোগ হাতছাড়া করে ধোঁকায় নিমজ্জিত থাকবেন? আর কত দিন মৃত্যু ঘনিয়ে আসার কথা ভুলে থাকবেন? নিশ্চয় যা প্রসব করেছেন তা মাটির খোরাক; যা নির্মাণ করেছেন তা ধ্বংসের মুখোমুখি; যা সংগ্রহ করেছেন তা নিঃশেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে; আর যা আমল করেছেন তা হিসাব দিবসের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে কিতাবে।

শ্রদ্ধেয় হাজি ভাই/বোন,

আমার অন্তরে যা ছিল তা আমি আপনার জন্য উজাড় করে দিয়েছি। আমি আপনাকে এ তোহফা হাদিয়া হিসেবে পেশ করছি। আপনি এতে চিন্তা করুন। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি, তিনি আমাকে ও আপনাকে তার সত্য দ্বীনের ওপর অবিচল রাখুন এবং আমাদের সবাইকে দু’জাহানের সফলতা দান করে ধন্য করুন।

 

হজের পর করণীয় কী? গবেষণা বিভাগ, দারু ইব্ন খুযাইমাহ অনুবাদ: সানাউল্লাহ নজির আহমদ সম্পাদনা: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া