মুযদালিফায় রাত্রিকালীন অবস্থান
মুযদালিফায় রাত্রিযাপনের আবশ্যকতা ও করণীয় সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
আর হজ্জের সাথে সাথে তোমরা যদি তোমাদের রবের অনুগ্রহের সন্ধান করতে থাকো তাহলে তাতে কোন দোষ নেই। তারপর আরাফাত থেকে অগ্রসর হয়ে ‘মাশআরুল হারাম’ (মুয্দালিফা) এর কাছে থেমে আল্লাহকে স্মরণ করো এবং এমনভাবে স্মরণ করো যেভাবে স্মরণ করার জন্য তিনি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নয়তো ইতিপূর্বে তোমরা তো ছিলে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত। তারপর যেখান থেকে আর সবাই ফিরে আসে তোমরাও সেখান থেকে ফিরে এসো এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমাশীল ও করুণাময়। সূরা আল বাকারা:১৯৯
মুযদালিফার সীমানায় পৌঁছলে সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন। যেখানে লেখা আছে-
Muzdalifa Starts Here
(অর্থাৎ মুযদালিফা এখান থেকে শুরু)
আর এ এলাকা শেষ হলে দেখতে পাবেন সীমানা চিহ্নিত
আরেকটি সাইনবোর্ড যেখানে লেখা পাবেন,
Muzdalifa Ends Here
(অর্থাৎ মুযদালিফা এখানে শেষ)
যখনই মুযদালিফায় পৌছে যাবেন তখনই নামাযের তারতীব ঠিক রেখে অর্থাৎ প্রথমে মাগরিবের ৩ রাক’আত এবং এরপর ইশার ২ রাক’আত কসর নামায পড়তে হবে। হাজ্জীরা একত্রে হলে এক আযানে আর দুই ইকামতে আদায় করবে। এখানে সবাই খোলা আকাশের নীচে অবস্থান করে থাকে।
নারীদের মধ্যে যারা দূর্বল তাদের,যারা অক্ষম ও শিশুদের শেষ রাত্রে মীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করা সিদ্ধ হবে। এ ছাড়া অন্যসব হাজীদের ফযরের নামায না পড়া পর্যন্ত মুযদালিফাতে অবস্থান করতে হবে।
ফযরের নামাযের পর মাশআরুল হারাম সামনে রেখে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াবে এবং খুব বেশী আল্লাহর যিকর, তাকবীর এবং দোয়া দরুদ পাঠ করতে থাকবে যে পর্যন্ত প্রভাতের আলোকরেখা অনেকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। দোয়ার সময় হাত উঠানো মুস্তাহাব।
মাশআরুল হারাম” একটি পাহাড়ের নাম। এটি মুযদালিফায় অবস্থিত। এখানে একটি মসজিদও আছে। মাশআরুল হারাম” একটি পাহাড়ের নাম হলেও পুরো মাশআরুল হারামই মুযদালিফা। এখানে হাজীদের যা করণীয় তা হল :
(১) মাশআরুল হারামের নিকট কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো,
(২) তাকবীর বলা,
(৩) তাসবীহ-তাহলীল পড়া অর্থাৎ ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহাম্দু লিল্লাহ’ এবং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ পড়া।
(৪) যিক্র করা
(৫) প্রাণ খুলে আল্লাহ তা’আলার কাছে দোয়া করা,
(৬) খুশু-খুযু ও বিনম্র হয়ে মাবুদের কাছে আপনার যা চাওয়ার আছে তা চেয়ে নেবেন। বিশেষ করে আপনার মাতা-পিতা, স্ত্রী, পুত্র-সন্তানাদি ও আপনজন-আত্মীয়স্বজনের জন্যও দোয়া করবেন।
(৭) দোয়ার সময় দুহাত উঠিয়ে মুনাজাত করা মুস্তাহাব।
এভাবে ফজরের নামাযের পর থেকে আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দোয়া করতে থাকা মুস্তাহাব। ভীড়ের কারণে “মাশআরুল হারাম”-এর কাছে যেতে না পারলে মুযদালিফার যে কোন স্থানে দাঁড়িয়ে এভাবে দোয়া করবেন।
মাশআরুল হারাম বলতে মুজদালিফাকে বুঝানো হয়েছে বলেছেন আল কুরতুবী, কেউ কেউ বলেছেন কাযাহ পর্বতের নাম মাশআরুল হারাম, অনেকে মুযদালিফার দুই পর্বতের মাঝের ভ্যালীকে( মুহাসসীর ভ্যালী) বুঝিয়েছেন।
আরাফার ময়দান থেকে মুযদালিফায় সূর্যাস্তের পর পরই লক্ষ লক্ষ লোক একসময়ে একযোগে এসে থাকেন। অনেকে ট্রেনে, বাসে বা হেঁটে এসে থাকেন। মুযদালিফাতে আসার পর একটি সুবিধামতো জায়গা নিয়ে পাটি বিছিয়ে নির্দিষ্ট করে নিলে ভালো, বিশেষ করে টয়লেটের কাছে বা মসজিদের কাছে হলে সুবিধা হয়। সেখানে মাগরিব ও ঈশা সালাত আদায় করার পর খানিক ঘুমিয়ে নিবেন কারন পরদিন অনেক পরিশ্রমের কাজ আছে। এখানে টয়লেটে বেশ ভিড় থাকে, তাই এই রাতে পানি কম খেলে ভালো। বালু কনা ও পাথর কনার উপর পাটি বিছিয়ে খোলা আকাশের নিচে শুয়ে ঘুমিয়ে নিবেন। ধনী-গরীব সকলেই একসাথে একই অবস্থানে থেকে একটি নিবেদন আর তা হলো, হে আল্লাহ! আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।
১০ই জিলহজ্জ:
ফজরের সুন্নাত পড়ে, আউয়াল ওয়াক্তে অন্ধকার থাকতেই ফরয নামাজ পড়ে, মাশআরুল হারামের নিকটবর্তী গিয়ে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে দোয়া মুনাজাত করতে থাকবেন। অবশ্য যেকোন জায়গাতে এইভাবে দাঁড়িয়ে করলেও হবে। আকাশ ফর্সা হয়ে গেলে সূর্য উঠার আগেই মিনায় রওয়ানা দিবেন। অনেক ক্ষেত্রে ভিড়ের কারনে বাসে অপেক্ষা না করে হেঁটে রওয়ানা দিতে পারেন, অবশ্য এখানেও ট্রেনের ব্যবস্থাপনা রয়েছে।
এখানে চলার সময় বেশী বেশী তালবিয়্যাহ ও আল্লাহু আকবার পড়তে থাকবেন।
সুন্নাত হলো প্রথম দিনের ৭টি কংকর মাশআরুল হারাম থেকে রওয়ানা দেয়ার পর মুযদালিফা থেকেই কুড়াবেন। এখান থেকে এর বেশী নয়। আর বাকী ৩ দিনের প্রত্যেক দিনের ২১টি করে কংকর মিনা থেকেই কুড়ানো যায়। এটাই সর্বোত্তম পদ্ধতি। তবে হারামের মধ্যবর্তী যে কোন স্থান থেকেই কংকর কুড়ানো জায়েয আছে।
নবী স. মাশআরুল হারাম থেকে মীনায় গমনকালে ঐ দিনে জামরা উকবায় মারার জন্য কেবল ৭টি কঙ্কর চয়ন করেন। তবে মুযদালিফা বা মীনা যেখান থেকেই হোক কঙ্কর নেয়া জায়িয হবে।
অবশিষ্ট তিন দিবসের জন্য অর্থাৎ ১১,১২,১৩ তারিখের জন্য মীনা হতে প্রতিদিন ২১টি করে কঙ্কর চয়ন করবে এবং তিন জামরায় পর্যায়ক্রমে নিক্ষেপ করবে।
কঙ্কর ধৌত করার প্রয়োজন নেই এবং ব্যবহারকৃত কঙ্কর পুনরায় ব্যবহার করা ঠিক না।
ওয়াদী মুহাসসির উপত্যকায় যখন পৌছে যাবেন তখন কিঞ্চিৎ দ্রুত চলা মুস্তাহাব। এই জায়গাটি মুযদালিফা ও মীনার মধ্যবর্তী একটি উপত্যকার নাম। এখানেই আবরাহা বাদশাহকে তার হাতী বাহিনীসহ ধ্বংস করা হয়েছিল।
মীনায় তাবুতে পৌছে নাস্তা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আপনি ছোট ব্যাগটির কিছু জিনিষ রেখে(যেমন বিছানা,কাপড়) হালকা করে পরবর্তী কাজের জন্য বের হবেন।
১০ই যিলহজ্জ অর্থাৎ ঈদের দিনের কাজ — নিম্নবর্ণিত ৪টি কাজ :
(১) কংকর নিক্ষেপ (শুধুমাত্র বড় জামারায়),
(২) কুরবানী করা,
(৩) চুল কাটা
(৪) তাওয়াফ করা অর্থাৎ তাওয়াফুল ইফাদা বা ফরয তাওয়াফ। এ দিনে না পারলে পরবর্তী ২ দিনের মধ্যে বা অন্য যে কোন সময় করলেও চলবে।
কংকর নিক্ষেপ————
আজকের ঈদের দিনে যে কাজটি প্রথমে করতে হয়-
বড় জামারায় ৭টি কংকর মারা। মুস্তাহাব হলো এর আগে অন্য কোন কাজ না করা।
হারাম শরীফ থেকে মিনায় আসলে ঐ পথে যেটা কাবার নিকটতম সেটাই বড় জামরা।
কংকর নিক্ষেপের হেকমত হলো আল্লাহ তা’আলার যিক্র কায়েম করা। নবী সা. বলেছেন : আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সাঈ এবং জামারায় পাথর নিক্ষেপ আল্লাহ তা’আলার যিক্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যই করা হয়েছে। (তিরমিযী)
মীনার তাবু থেকে বের হয়ে জামারায় পাথর মারার জন্য নিচতলায় না যেয়ে, আগেই সেই রাস্তা দিয়ে চলুন ( প্রয়োজনে সঠিকভাবে জেনে নিন) যেটা চলে গিয়েছে জামরার উপরের ফ্লোরগুলোতে। চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উপর তলার কোন এক ফ্লোরে যেয়ে ধীর স্থীরভাবে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে পারবেন। এখানে তেমন ধাক্কা ধাক্কি হয় না। ছোট শিশুদের নিয়ে অসুস্থ ও বৃদ্ধ ব্যক্তিরাও এখানে নিশ্চিত ধীরগতিতে পাথর নিক্ষেপ করে থাকেন। নিচতলায় কোনভাবেই যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। নিচতলার রাস্তাটি ও অন্যান্য ফ্লোরে যাওয়ার রাস্তা অনেক আগে থেকেই আলাদা। একবার এক লাইনে ঢুকে গেলে পরে বুঝতে পারলেও লাইন পরিবর্তন করে অন্যটাতে যেতে পারবেন না। তাই শুরু থেকেই রাস্তাটির দিক নির্দেশনা জেনে নিয়ে চলুন।
জামরাতুল উকবার (বড় জামরায়) কাছে গিয়ে তালবিয়া (লাব্বাইক) বন্ধ করে দিয়ে হাত তুলে তাকবীর আল্লাহু আকবার বলে প্রত্যকটি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন লক্ষ্যস্থলে।
প্রথমদিন অর্থাৎ ১০ই যিলহজ্জ তারিখে ‘বড় জামারায়’ পাথর নিক্ষেপের সময় হলো সূর্যোদয়ের পর থেকে কংকর মারা উত্তম। ফজরের আউয়াল ওয়াক্ত থেকে সূর্য উঠার আগেও পাথর নিক্ষেপ জায়েয আছে। দুর্বল, শিশু, নারী ও অক্ষম ব্যক্তিরা মধ্যরাত্রির পর থেকে কংকর মারা শুরু করতে পারেন।
তবে ঐদিনে কংকর নিক্ষেপের উত্তম সময় হল সূর্যোদয় থেকে শুরু করে দুপুরে সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত। সন্ধ্যা পর্যন্ত মারাও জায়েয আছে। কারণবশতঃ সন্ধ্যার পর থেকে ঐ দিবাগত রাতের ফজর উদয় হওয়ার আগেও যদি মারে তবু চলবে। তবে এ সময়ে মাকরূহ হবে।
কংকর নিক্ষেপের শর্তঃ
(১) জামারার খুঁটিকে লক্ষ্য করে কংকর ছুঁড়ে মারতে হবে। অন্যদিকে টার্গেট করে মারলে খুঁটিতে লাগলেও শুদ্ধ হবে না।
(২) ঢিলটি জোরে নিক্ষেপ করতে হবে। সাধারণভাবে কংকরটি সেখানে শুধু ছুয়ায়ে দিলে হবে না।
(৩) কংকরটি পাথর হতে হবে। মাটি বা ইটের টুকরা দিয়ে হবে না।
(৪) কংকরটি হাত দিয়ে নিক্ষেপ করতে হবে। ছেলে-মেয়েদের খেলনা, গুলাল, তীর বা পা দিয়ে লাথি মেরে নিক্ষেপ করলে হবে না।
(৫) সাতটি পাথর হাতের মুঠোয় ভরে একেবারে নয় বরং একটি একটি কংকর হাতে নিয়ে নিক্ষেপ করতে হবে।
(১) মিনায় প্রবেশ করে কংকর নিক্ষেপের আগে অন্য কিছু না করা।
(২) কংকর নিক্ষেপ শুরু করার পূর্বে তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করে দেয়া।
(৩) প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় “আল্লাহু আকবার” বলা। ডান হাতে নিক্ষেপ করা। পুরুষের হাত উঁচু করে নিক্ষেপ করা। মেয়েরা হাত উঁচু করবে না।
(৪) কংকরের সাইজ হবে গুলালের গুলির কাছাকাছি বা চানা বুটের দানার চেয়ে একটু বড়।
(৫) প্রথমদিন সূর্যোদয়ের পরে মারা সুন্নাত।
(৬) দাঁড়ানোর সুন্নত হলো মক্কাকে বামপাশে এবং মিনাকে ডানে রেখে ‘জামারার’ দিকে মুখ করে দাঁড়াবে। এরপর নিক্ষেপ করবে। প্রচণ্ড ভীড় হলে যে কোন দিকে দাঁড়িয়েও মারতে পারেন।
(৭) একটা কংকর মারার পর আরেকটি মারা। অর্থাৎ দুই কংকরের মধ্যে বেশী সময় না নেয়া।
(৮) কংকরগুলো পবিত্র হওয়া মুস্তাহাব। অপবিত্র হলেও তা দিয়ে নিক্ষেপ করা যাবে। তবে মাকরূহ হবে।
কঙ্কর মারার পর হাদীর (হজ্জের জন্য যে পশু জবাই হয় তা হল হাদী এবং ঈদুল আযহায় যে পশু জবাই হয় সেটি হচ্ছে কুরবানী) জানোয়ার যবেহ করা হবে।
(মুয়াল্লিমের কাছে জেনে নিতে হবে কুরবানী করা হয়েছে কি না)। ১০ হতে ১৩ই যিলহজ্জ পর্যন্ত চার দিবসই কুরবানী করা চলে।
এইবার হাজীরা মীনাতেই চুল মুণ্ডন বা ছোট করে কাটবে। তবে মুন্ডন করাই উত্তম কারন রাসূল স. মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্য তিনবার রহমত ও মাগফিরাতের দোয়া করেছেন, চুল ছোটকারীদের জন্য একবার দোয়া করেছেন। নারীদের জন্য তাদের চুলের প্রত্যেক বেনী হতে কমপক্ষে আংগুল পরিমান কাটতে হবে। চুল কাটার পর এই অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস ছাড়া অন্য সব কিছুই হালাল হয়ে যাবে যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল। এটাকে প্রথম হালাল বা তাহাললুলে আওয়াল বলা হয়।