অনেকে নির্ধারিত হজ্জের তারিখের অনেক পূর্বে মক্কায় চলে আসার সুযোগ করে থাকেন। এটা মহান আল্লাহর অশেষ রহমত যে, হজ্জের দিনগুলি আসার পূর্বে এখানে অবস্থান করে নিজেকে, পুরু সময় শুধুমাত্র মহান রবের সান্নিধ্যে যেয়ে প্রিয় বান্দা হবার সুযোগ লাভ করে থাকেন। দুনিয়ার সব দায়িত্ব থেকে অন্তত কিছু দিনের জন্য মুক্ত থেকে নিজের অন্তরকে যাচাই করার সুযোগ আসে যে, মহান রবের প্রতি আমার কতটুকু ভালোবাসা আছে, ইচ্ছা করলে আমি নিজেকে আরো কত সুন্দর করে মহান রবের দরবারে নিজেকে সঁপে দিতে পারি! কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে অনেক সময় অনেকে এই সুন্দর দিনগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে পারেন না এবং পরে খুব আফসোস করে থাকেন। তাই পুর্ব থেকেই সুচিন্তিত পরিকল্পনা রাখা প্রয়োজন যে,আমার এই সময়গুলো কিভাবে কাজে লাগাবো! জীবনের এই দিনগুলোর মত আবার সুযোগ নাও আসতে পারে,হতে পারে এই দিনগুলোর ইবাদাতই আমার শেষ ইবাদাত। যতটুকু সম্ভব ইবাদাতে মশগুল থাকাটাই উত্তম।
কতগুলো দিক তুলে ধরবো যা আমাদের দেশের মা-বোনেরা অনেকে হজ্জে যাওয়ার পর করে থাকেন , আর কিছু মুয়াল্লিম আছেন তারাও নারীদের বুঝিয়ে থাকেন এইভাবেই। আর তা হলো-মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ার ব্যপারে। আমাদের দেশেও অনেক পুরুষ আছেন এবং অনেক নারীও আছেন যারা অজ্ঞতার কারনে এমন বলে থাকেন। নারীদের মসজিদে না যাওয়ার জন্য। ওয়াক্তের নামাজ ঘরে পড়া উত্তম বলে মসজিদে যাওয়াটাকে একদম নিষেধের আওতায় নিয়ে এসেছেন। অথচ আমাদের প্রিয় নবী স. নারীদের ব্যপারে বলেছেন–
রাসূল স. বলেছেন–তোমাদের কারো স্ত্রী তার স্বামীর কাছে মসজিদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে সে যেন তাকে নিষেধ না করে।
সহীহ মুসলিম–২য় খণ্ড ৮৮৩
রাসূল স. বলেছেন–তোমাদের কেউ যখন মসজিদে উপস্থিত হয়, সে যেন সুগন্ধি স্পর্শ না করে(আসে)।
সহীহ মুসলিম–২য় খণ্ড ৮৯২
আমাদের দেশের নারীরা যখন বাজারে দোকানে বা পড়াশুনার জন্য বাইরে ঘুরতে যেতে পারে সেখানে এই নারীরা মসজিদে যেতে চাইলে বাধা দেয়ার কোন যুক্তি নেই। মসজিদে গেলে নারীর মন নরম হয়ে আরো বেশী আমলদার হওয়ার আগ্রহ বাড়বে ইন শা আল্লাহ।
তবে অবশ্যই বিশৃংখলা যেন না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। যাই হোক হজ্জের এই অল্প কয়েকটাদিন যেখানে একলাখ নামাজের সওয়াব এক ওয়াক্তে পাওয়া যাচ্ছে, সেটা কেন আমাদের মা বোনেরা বঞ্ছিত হবেন। বরং পুরুষ মহলদের সহযোগীতা করা দরকার যেন এই নারীটি যে এত কষ্ট করে এতদূরে এসেছেন, তিনি কাবার মসজিদে যেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজই পড়তে পারেন।
মসজিদের জামায়াতে নামাজ এবং বাইরে অন্য জায়গায় নামাজ কখনোই এক সমান সওয়াব হতে পারে না।
অনেকে আবার মক্কায় কাবার পাশেই হোটেল আছে সেখানে নামাজ পড়েন-এটাও ইচ্ছে করে করা ঠিক নয়। জীবনে একবার সুযোগ হলো এই কাবার মসজিদে আসার-একটু কষ্ট করে সচেতন থাকলে সব নামাজই ভিতরে পড়া যায়।
অনেকে আবার রান্না খাওয়া ইত্যাদিতে ব্যস্ত হয়ে যান। আমার প্রিয় বোনেরা –সংসার জীবনে আমরা সব সময়ই এই কাজে ব্যস্ত থাকি, এই কয়েকটি দিন না হয় একটু হালকা কেনা খাবারের উপর দিয়ে চালিয়ে দিলাম, মক্কায় অনেক ভালো হোটেলও পাওয়া যায়। হজ্জ থেকে কেনা খাবার খেয়ে সময় বাঁচিয়ে এবাদতে মশগুল থাকাটা বুদ্ধিমানের কাজ। অনেক ফ্রেশ জুস ও দুধ পাওয়া যায়। একটু স্মরন করুন, আল্লাহর রাসূল স.এর পরিবারে কতদিন চুলা জ্বলেছিল? আমরা খুব গল্প করে রাসূলের স. জীবনের অনেকদিকই তুলে ধরি কিন্তু বাস্তবতায় প্রমান দেয়ার সময় হলে আসল অবস্থা বুঝা যায়, কে কতটুকু আমল করছি।
জীবনের এই মূল্যবান সময়টুকু যেন এইভাবে কাজে লাগান যায় যে—
- শুধুমাত্র মহান আল্লাহর যিকর
- স্বীয় গুনাহের কথা মনে করে বারবার ইস্তেগফার পড়া
- বিনয় সহকারে তাঁর করুণা প্রার্থনা করা
- পবিত্র কুর’আন পাঠ করে এর অর্থ অনুধাবন করা
- জামায়াতে সালাত আদায় করার ব্যাপারে বিশেষ যত্নশীল হওয়া
- স্বীয় জিহবাকে বাজে কথার উচ্চারণ ও কথা বার্তা থেকে সংযত রাখা
- অপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম ও অতিরিক্ত তামাশামূলক কথাবার্তা হতে নিজেকে বিরত রাখা
- স্বীয় রসনাকে মিথ্যা কথন,গীবত ও চোগলখোরী হতে বিরত রাখা
- স্বীয় সহচর ও অন্যান্য মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দকে হাস্যাস্পদ করার মত অবস্থা হতে নিজেকে সংযত রাখা
- হজ্জযাত্রীদের সাথে সদ্ব্যবহার করা,তাদের দুঃখ কষ্ট দূর করার চেষ্টা রাখা
- সাধ্যমত সুকৌশলে মিষ্টি ভাষায় ভালো কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও অপ্রিয় কাজ থেকে বিরত থাকার নসীহত করা
- যতটা পারেন পুরু সময়টা মহান আল্লাহতা’আলার ঘরের সামনে থাকার চিন্তা রাখুন, আর মন থেকে মহান আল্লাহর ক্ষমা ও দয়া চাইতে থাকুন। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।
আমাদের অনেক মা বোনেরা মক্কা-মদিনায় যেয়েও মসজিদে বসে দেখা যায় দেশের রান্না-খাওয়া, জমির মালিকানা বা আত্মীয়দের কোন ব্যপার ইত্যাদি নানামুখী গল্পে মশগুল হয়ে যান, আবার অনেক স্বামী-স্ত্রী সেখানেও কোন কারনে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হলে ঝগড়া ঝাটি শুরু করে দেন। আবার একটু ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি দেখলেও অনেকে নানা ভাবে গাল-মন্দ করতে শুরু করে দেন ইত্যাদি। মাহরাম পুরুষ ব্যক্তিটি যদি নিজে ইবাদাতে মশগুল থেকে নারীকে সহযোগীতা করেন তবে এইক্ষেত্রে দুজনের জন্যই সময়ের সুন্দর ব্যবহার করা সম্ভব।
আসলে হজ্জ আমাদের অনেক বড় সাহসিকতার ব্যপার ধৈর্য্যের অনুশীলন করায়—মহান রাব্বুল আলামীন সুমহান,সুক্ষ্মদর্শী, মহাবিজ্ঞানী।সুবহানাল্লাহী ওয়া বিহামদিহী। মানুষের এই দুনিয়ার জীবনেই শান্তিপূর্ণ অবস্থানের জন্য যা প্রয়োজন তা বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষন দেয়ার ব্যবস্থা করেও দিয়েছেন মহান আল্লাহতা’আলা।
ইয়া হাজ্জী-সবর ! হাজ্জী সবর! এই কথাগুলো আপনারা হজ্জের সময় ভলান্টিয়ার বোনদের কাছে বা অন্য কোন দেশের কোন হাজীর কাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সমস্যাজনক অবস্থায় শুনতে পাবেন। কত দেশের কত মানুষ একসাথে যে শৃংখলার সাথে চলেন, এটাও মহান আল্লাহর দেয়া বিরাট সাহায্য। ছোট একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আমরা সুন্দরভাবে সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে যাই কিন্তু এত বড় একটা মহামিলন কেন্দ্রে কত সুন্দর পরিবেশ-আলহামদুলিল্লাহ-এটাই মুসলিম ভাতৃত্বের উৎকৃষ্ট উদাহরন। তাই আমাদের সবর বা ধৈর্য্যধারন করতে শিখতে হবে।
সবরের কয়েকটি ধাপ:
- নিজের আবেগকে সংযত রাখা। মুখ দিয়ে কোন অশালীন কথা না বলা।
- বিপদ আপদে ঘাবড়ে না যাওয়া।
- রাগের বশবর্তী হয়ে কোন কাজ না করা।
- ত্বরা – প্রবনতা (তাড়াতাড়ি হতে হবে) পরিহার করা।
- অশোভন আচরনে উত্তেজিত না হওয়া।
- কাংখিত ফল পেতে দেরী হলে অস্থির না হওয়া।
- প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজের কর্তব্যে অবিচল থাকা।
মহান আল্লাহতা’আআ কুর’আনে বলেছেন—
সবর ও নামায সহকারে সাহায্য চাও। সূরা আল বাকারা:৪৫
সবর শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, বাধা দেয়া, বিরত রাখা ও বেঁধে রাখা ৷ এ ক্ষেত্রে মজবুত ইচ্ছা, অবিচল সংকল্প ও প্রবৃত্তির আশা-আকাংখাকে এমনভাবে শৃংখলাবদ্ধ করা বুঝায়, যার ফলে এক ব্যক্তি প্রবৃত্তির তাড়না ও বাইরের সমস্যাবলীর মোকাবিলায় নিজের হৃদয় ও বিবেকের পছন্দনীয় পথে অনবরত এগিয়ে যেতে থাকে ৷ এই নৈতিক গুণটিকে নিজের মধ্যে লালন করা এবং বাহির থেকে একে শক্তিশালী করার জন্য নিয়মিত নামায পড়া ৷
(হে মুসলমানগণ!) তোমাদের অবশ্যি ধন ও প্রাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা আহলি কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে ৷ যদি এমন অবস্থায় তোমরা সবর ও তাকওয়ার নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকো তাহলে তা হবে বিরাট সাহসিকতার পরিচায়ক ৷ সূরা আলে ইমরান:১৮৬
আসলে কেউ যদি তাকওয়া ও সবর অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহর কাছে এ ধরণের সৎলোকদের কর্মফল নষ্ট হয়ে যায় না ৷ সূরা ইউসুফ:৯০
এবং তাদেরকে বলবে:তোমাদের প্রতি শান্তি ৷ তোমরা দুনিয়ায় যেভাবে সবর করে এসেছো তার বিনিময়ে আজ তোমরা এর অধিকারী হয়েছো ৷ কাজেই কতই চমৎকার এ আখেরাতের গৃহ! সূরা রাদ:২৪
এর আগে এমন অনেক নবী চলে গেছে যাদের সাথে মিলে বহু আল্লাহ ওয়ালা লড়াই করেছে ৷ আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি ৷ এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন ৷ সূরা আলে ইমরান:১৪৬
তাদের দোয়া কেবল এতটুকুই ছিলঃ হে আমাদের রব ! আমাদের ভুল –ক্রুটিগুলো ক্ষমা করে দাও৷ আমাদের কাজের ব্যাপারে যেখানে তোমার সীমালংঘিত হয়েছে, তা তুমি মাফ করে দাও ৷ আমাদের পা মজবুত করে দাও এবং কাফেরদের মোকাবিলায় আমাদের সাহায্য করো ৷ সূরা আলে ইমরান:১৪৭
যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা আঁচ করতে পার তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো তিনি সব কিছু শোনেন এবং জানেন ৷ সূরা হামীম আস সাজদাহ:৩৬
শয়তানের প্রতারণার ব্যাপারে সাবধান থাকা দরকার ৷ সে অত্যন্ত দরদী ও শুভকামী সেজে এই বলে মানুষকে উত্তেজিত করে যে, অমুক অত্যাচার কখনো বরদাশত করা উচিত নয়, অমুক কথার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত এবং এই আক্রমনের জবাবে পাল্টা আক্রমণ করা উচিত ৷ তা না হলে কাপুরুষ মনে করা হবে এবং নিজেদের আদৌ কোন প্রভাব থাকবে না এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন নিজেদের মধ্যে কোন অযথা উত্তেজনা অনুভব হবে তখনই সাবধান হয়ে যেতে হবে ৷ কারণ, তা শয়তানের প্ররোচনা ৷ সে আমাদের উত্তেজিত করে কোন ভুল সংঘটিত করাতে চায় ৷ সাবধান হয়ে যাওয়ার পর এটা মনে না করা যে, আমি আমার মেজাজকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখছি, শয়তান আমাকে দিয়ে কোন ত্রুটি করাতে পারবে না ৷ নিজের এই ইচ্ছা শক্তির বিভ্রম হবে শয়তানের আরেকটি বেশী ভয়ংকর হাতিয়ার ৷ এর চেয়ে বরং আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিত । কারণ তিনি যদি তাওফীক দান করেন ও রক্ষা করেন তবেই মানুষ ভুল-ত্রুটি থেকে রক্ষা পেতে পারে ৷
তাই দেখা যায় হজ্জে যাওয়ার নিয়্যত করার পর থেকেই বিভিন্ন রকমের অবস্থা যা মেজাজের ভারসাম্য রক্ষা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট—এইসব অবস্থায় আমাদের সতর্কভাবে নিজেদের ধৈর্য্যের প্রশিক্ষন দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে মহান আল্লাহতা’আলার অপার সাহায্যে। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন।