আল্লাহর আহবানে বায়তুল্লাহর অতিথির সাড়া-“হে আল্লাহ আমি হাযির-১০” হজ্জের পূর্ব প্রস্তুতি

পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ এর প্রস্তুতি:

 আমাদের সমাজে দেখা যায়,পরিবারের মূল ব্যক্তিরা হজ্জে যাচ্ছেন এটা যেন শুধু তাদের(যে হজ্জে যাচ্ছেন) তাদের ব্যপার। পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যপারে কোন নির্দেশনা নাই।
কিন্তু না,একটু চিন্তা করুন। আপনার আমার অনুপস্থিতিতে এই ঘরে (যা নিজের সংসার) কি হচ্ছে বা কি শিক্ষার ধারা দিয়ে গিয়েছেন যা পরিবারের অন্য সদস্যরা কি সেই ভাবে নিজেদের পরিচালিত করছেন!!
হাজ্জ থেকে ফিরে আসতে পারাটাও মহান আল্লাহর হুকুম। সব অবস্থাতেই আমাদের মৃত্যু পরবর্তী সময়ের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখা দরকার। তাই প্রথমেই স্বীয় পরিবার-পরিজনদের এবং সংগী-সাথীগনকে তাকওয়ার জন্য নসীহাত করা যেন মহান আল্লাহর নির্দেশ পালনে অনুগত থাকে।
মহান আল্লাহ বলেছেন:
 হে লোকজন যারা ঈমান এনেছো, তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজেদের পরিবার ও সন্তান-সন্তুতিকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো মানুষ এবং পাথর হবে যার জ্বালানী ৷ সেখানে রুঢ় স্বভাব ও কঠোর হৃদয় ফেরেশতারা নিয়োজিত থাকবে যারা কখনো আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না এবং তাদেরকে যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে ৷  সূরা আত তাহরীম:৬

এ আয়াত থেকে প্রকাশ পায় যে, আল্লাহর আযাব থেকে নিজেকে রক্ষা কারা জন্য প্রচেষ্টা চালানোর মধ্যেই কোন মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সীমাবদ্ধ নয় ৷ বরং প্রকৃতির বিধান যে পরিবারটির নেতৃত্বের বোঝা তার কাঁধে স্থাপন করেছে তার সদস্যরা যাতে আল্লাহর প্রিয় মানুষরূপে গড়ে উঠতে পারে সাধ্যমত সে শিক্ষা দীক্ষা দেয়াও তার কাজ ৷ তারা যদি জাহান্নামের পথে চলতে থাকে তাহলে যতটা সম্ভব তাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করবে ৷ তার সন্তান-সন্তুতি পৃথিবীতে সুখী হোক তার শুধু এই চিন্তা হওয়া উচিত নয় ৷ বরং এর চেয়েও তার বড় চিন্তা হওয়া উচিত এই যে, তারা যেন আখেরাতে জাহান্নামের ইন্ধন না হয় ৷

সহীহ বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন তোমরা প্রত্যেকই রাখাল এবং তাকে তার অধিনস্ত লোকদের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে ৷শাসকও রাখাল ৷ তাকে তার অধীনস্ত লোকদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে ৷ নারী তার স্বামীর বাড়ী এবং তার সন্তান-সন্তুতির তত্ত্ববধায়িকা তাকে তাদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে ৷
মহান আল্লাহ বলেছেন:
যারা ঈমান গ্রহণ করেছ এবং তাদের সন্তানরাও ঈমানসহ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে আমি তাদের সেসব সন্তানকেও তাদের সাথে (জান্নাতে) একত্রিত করে দেব ৷ আর তাদের আমলের কোন ঘাটতি আমি তাদেরকে দেব না ৷ প্রত্যেক ব্যক্তি তার উপার্জিত কর্মের হাতে জিম্মী রয়েছে ৷  সূরা আত তুর:২১

এখানে “জিম্মী” বা “বন্ধক” শব্দটি রূপক ব্যবহার অত্যন্ত অর্থবহ ৷ কোন ব্যক্তি যদি কাউকে কিছু ঋণ দেয় এবং ঋণদাতা তার পাওনা আদায়ের নিশ্চয়তা হিসেবে ঋণ গ্রহীতার কোন জিনিস নিজের কাছে বন্ধক রাখে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ঋণ পরিশোধ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধকী বস্তু মুক্ত হবে না ৷
তাছাড়া নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যদি বন্ধকী বস্তু মুক্ত না করে তাহলে বন্ধকী বস্তুটি বাজেয়াপ্ত বা হাতছাড়া হয়ে যায় ৷
আল্লাহ তা’আলাও মানুষের মধ্যকার লেনদেনের বিষয়টিকে এখানে বন্ধকী লেনদেনের সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে যে সাজ-সরঞ্জাম, যেসব শক্তি, যেসব যোগ্যতা, এবং যেসব ইখতিয়ার দিয়েছেন তা যেন মালিক তার বান্দাকে ঋণ দিয়েছেন ৷ এ ঋণের জামানত হিসেবে বান্দা নিজেই আল্লাহর কাছে বন্ধক বা জিম্মী হয়ে রয়েছে ৷
 বান্দা যদি এসব সাজ-সরঞ্জাম, শক্তি এবং ইখতিয়ার সঠিক ভাবে ব্যবহার করে নেকী অর্জন করে যে নেকী দ্বারা এসব ঋণ পরিশোধ হবে, তাহলে সে বন্ধকী মাল অর্থাৎ নিজেকে মুক্ত করে নেবে ৷ অন্যথায় তা বাজেয়াপ্ত করে নেয়া হবে ৷
পূর্ববর্তী আয়াতের পরপরই একথা বলার কারণ হচ্ছে, সৎকর্মশীল ঈমানদারগণ যত বড় মর্যাদা সম্পন্নই হোক না কেন তাদের সন্তানরা নিজেদের কর্ম দ্বারা নিজেদের সত্তাকে মুক্ত না করলে তাদের বন্ধক মুক্তি হতে পারে না। বাপ-দাদার কর্ম সন্তানদের মুক্ত করতে পারে না ৷ তবে সন্তানরা যদি যে কোন মাত্রার ঈমান ও সৎকর্মশীলদের আনুগত্য দ্বারা নিজেরা নিজেদের মুক্ত করতে পারে তাহলে আল্লাহ তা’আলা জান্নাতে তাদেরকে নিম্ন মর্যাদা থেকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে বাপ-দাদার সাথে একত্রিত করে দেবেন ৷ এটা নিছক আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী ও দয়া ৷
সন্তানরা বাপ-দাদার সৎকাজের এ সুফলটুকু অন্তত লাভ করতে পারে ৷ তবে তারা যদি নিজেদের কর্মদ্বারা নিজেরাই নিজেদেরকে দোযখের উপযোগী বানায় তাহলে এটা কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, বাপ-দাদার কারণে তাদেরকে জান্নাতে পৌছিয়ে দেয়া হবে ৷
সাথে সাথে এ আয়াত থেকে একথাও বুঝা যায় যে, নিম্ন মর্যাদার নেক সন্তানদের নিয়ে উচ্চ মর্যাদার নেক পিতা-মাতার সাথে একত্রিত করে দেয়া প্রকৃতপক্ষে সেসব সন্তানের কর্মের ফল নয়, বরং তা ঐসব পিতা-মাতার কর্মের ফল ৷ তারা নিজেদের আমল দ্বারা এ মর্যাদা লাভের উপযুক্ত হবে ৷ তাই তাদের মন খুশী করার জন্য সন্তানদেরকেও তাদের সাথে একত্রিত করা হবে ৷ এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা মর্যাদা হ্রাস করে তাদেরকে তাদের সন্তানদের কাছে নিয়ে যাবেন না ৷ বরং সন্তানদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে তাদের কাছে নিয়ে যাবেন’ যাতে নিজ সন্তানদের থেকে দূরে অবস্থানদের কারণে মনোকষ্ট না হয় এবং তাদের জন্য আল্লাহর নিয়াতমসমূহ পূর্ণ করে দেয়ার ক্ষেত্রে এ কমতিটুকু না থেকে যায় ৷

 পরিবারের জন্য এখন থেকে কিছু নির্দেশনা দিতে থাকুন। যেমন:

•      প্রথমেই আপনার অনুপস্থিতিতে যিনি অভিভাবক হিসেবে থাকবেন তিনি যেন একজন পরহেজগার হোন সেইভাবে মনোনিত করুন।
•      বাড়ির যে পরিচারিকা আছে বা রেখে যাবেন তাকেও পরহেজগার দেখে নিন বা শিক্ষা দিন।
•      সন্তানদের একটি নেক আমলের পরিকল্পনা তৈরী করে দিন যেন আপনাদের অনুপস্থিতিতে সেই অনুযায়ী আমল করে যেতে থাকে।
•      সন্তানদের বুঝতে দিন, তাদের সহযোগীতায় মানসিকভাবে প্রশান্তির সাথে হজ্জ করতে পারলে তারাও সওয়াব পাবে ইনশা’আল্লাহ।
•      পরিবারের বাড়ির নিরাপত্তার জন্য যা করা প্রয়োজন তা এখন থেকে গুছিয়ে নিন।
•      বাজার রান্না স্কুল/কলেজ ইত্যাদি সব নির্দেশনা সুন্দর করে গুছিয়ে এখন থেকে একটু করে করিয়ে নিন সেই ভাবে।
•      আমাদের সমাজে একটি প্রচলন আছে যে, হজ্জে যাওয়ার পূর্বে সবার সাথে দেখা করে ক্ষমা চাওয়া, দেখা যায় সারা জীবনেও এমন মানুষদের দেখা নাই তাদের সাথে যেয়ে দেখা করে মাফ চাওয়া এবং এটাকে করনীয় একটা অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলক করে নেয়া হয়।
আসলে আমাদের সবার কাছে সব সময়ের জন্য ক্ষমা ও ঋনমুক্ত থাকা দরকার কারন যে কোন সময়েই আমার জীবনের পরিসমাপ্তি হতে পারে,শুধু হজ্জে গেলেই নয়।
•      আত্মীয়ের ব্যপারে আমরা দাওয়াত করে খাবার খাওয়ানো এবং কিছু বৈষয়িক উপহার দেয়াটাকে দায়িত্ব মনে করেই শেষ। অথচ আত্মিয়ের মুল হক হলো ভালো কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের নিষেধ করা। শুভাকাংখী হয়ে এই সংক্রান্ত বই উপহার দেয়া যেন তারা জান্নাতের পথে চলতে পারে-এটাই হলো সত্যিকার ভালোবাসা যা আখেরাতে সহায়ক।
মহান আল্লাহতা’আলার এটা একটা বিশেষ দয়া যে, যখন আপনি হজ্জে থাকবেন তখন পরিবারের ব্যপারে দুশ্চিন্তা আসে না। একটি প্রগার বিশ্বাস নিজের মধ্যে আসে যে, মহান আল্লাহতা’আলা অবশ্যই আমার পরিবারের হেফাজত করবেন। বাস্তবেও মহান আল্লাহ অবশ্যই হেফাজত করেন। আপনি আল্লাহর ঘরের মেহমান হিসেবে মক্কায় সফরে যাচ্ছেন আর মহান আল্লাহ আপনার ঘরের যিম্মাদার হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ-এইভাবেই আল্লাহর কাছে চাইতে থাকুন। মক্কা মদিনা থাকা অবস্থায় যে কোন দুয়া সাথে সাথে কবুল হওয়ার বাস্তব নমুনাও আপনি পাবেন ইনশা’আল্লাহ। আল্লাহু আকবার। সুবহানাল্লাহী ওয়া বিহামদিহী সুবহানাল্লাহীল আযীম।
 
 https://www.youtube.com/watch?v=wUwXOskjMvw